ঈমানের মৌলিক নীতিমালা সংক্রান্ত মণিমুক্তা

‘দুররাতুল বায়ান ফী উসূলিল ঈমান’ বা “ঈমানের মৌলিক নীতিমালা সংক্রান্ত মণিমুক্তা” গ্রন্থটি আকীদার গ্রন্থসমূহের মধ্য থেকে একটি সুন্দর মৌলিক গ্রন্থ। লেখক এখানে অধিকাংশ আক্বীদার মাসআলার অবতারণা করেছেন এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা তুলে ধরেছেন। কিতাবটি মসজিদে এবং বিভিন্ন দারসের হালকাসমূহে ব্যাখ্যা করে আক্বীদা শিক্ষা দেওয়ার মতো উপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়েছে।

 

ঈমানের মৌলিক নীতিমালা সংক্রান্ত মণিমুক্তা
[ بنغالي  - Bengali - বাংলা ]


    
        
ড. মুহাম্মাদ ইয়োসরী




অনুবাদ: ড. মো: আমিনুল ইসলাম
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
متن درّة البيان في أصول الإيمان
    
    
د/ محمد يسري




ترجمة: د/ محمد أمين الإسلام
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
 
সূচীপত্র

ক্র    শিরোনাম    পৃষ্ঠা
১    প্রারম্ভিক কথা    
২    প্রথম অধ্যায়: মৌলিক নীতিমালা ও ভূমিকাসমূহ    
৩    প্রথম পরিচ্ছেদ: ঈমান শস্ত্রের মূলনীতি ও তার মৌলিক বিষয়সমূহ    
৪    দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: ইসলাম ও মুসলিমগণের ফযীলত বা মর্যাদা    
৫    তৃতীয় পরিচ্ছেদ: আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও তাদের বৈশিষ্ট্য    
৬    চতুর্থ পরিচ্ছেদ: শিক্ষাগ্রহণ এবং কুরআন ও সুন্নাহকে আকঁড়ে ধরার পদ্ধতি    
৭    দ্বিতীয় অধ্যায়: ঈমানের প্রকৃত রূপ ও তার মূল উপাদানসমূহ    
৮    প্রথম পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমানের স্বরূপ    
৯    দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: ইসলাম ও ঈমানের মধ্যে সম্পর্ক    
১০    তৃতীয় পরিচ্ছেদ: ঈমানের স্তরসমূহ    
১১    চতুর্থ পরিচ্ছেদ: ঈমানের মধ্যে ইস্তিসনা করা    
১২    পঞ্চম পরিচ্ছেদ: কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির বিধান    
১৩    ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ: কিবলার অনুসারীর ব্যাপারে বিধান    
১৪    সপ্তম পরিচ্ছেদ: ঈমানের শ্রেণিবিভাগ ও তাওহীদের প্রকারভেদ    
১৫    অষ্টম পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বের প্রতি ঈমানের দলীলসমূহ    
১৬    নবম পরিচ্ছেদ: প্রভুত্বের গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রতি ঈমান    
১৭    দশম পরিচ্ছেদ: আল্লাহর নামসমূহ ও গুণাবলীর প্রতি ঈমান    
১৮    একাদশ পরিচ্ছেদ: আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের প্রতি ঈমানের মূলনীতি    
১৯    দ্বাদশ পরিচ্ছেদ: আল্লাহর মহান গুণাবলীর প্রতি ঈমানের মূলনীতি    
২০    তৃয়োদশ পরিচ্ছেদ: আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর প্রতি ঈমানের  ফলাফল    
২১    চতুর্দশ পরিচ্ছেদ: এককভাবে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ‘উলূহিয়্যাতের’ গুণাবলী সাব্যস্ত করা    
২২    পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ: ‘উলূহিয়্যাত’ এর প্রতি ঈমানের ফলাফল    
২৩    ষোড়শ পরিচ্ছেদ: ফিরিশতাগণের প্রতি ঈমান    
২৪    সপ্তদশ পরিচ্ছেদ: জিন্ন জাতির অস্তিত্বের প্রতি ঈমান    
২৫    অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত কিতাবসমূহের ওপর ঈমান    
২৬    ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ: রাসূলগণের প্রতি ঈমান    
২৭    বিংশ পরিচ্ছেদ: রাসূলগণের অধিকার প্রশ্নে যা আবশ্যক, বৈধ ও নিষিদ্ধ    
২৮    একবিংশ পরিচ্ছেদ: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্য ও অধিকারসমূহ    
২৯    দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ: আখেরাতের প্রতি ঈমান    
৩০    ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ: ভাগ্য ও নিয়তির ওপর ঈমান    
৩১    তৃতীয় অধ্যায়: ঈমান বিনষ্টকারী ও হ্রাসকারী বিষয়সমূহ    
৩২    প্রথম পরিচ্ছেদ: কুফরের অর্থ ও প্রকারভেদ    
৩৩    দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: শরী‘আতের বিধান প্রয়োগ করার নীতিমালা    
৩৪    তৃতীয় পরিচ্ছেদ: ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়সমূহের প্রকার ও শ্রেণিবিভাগ    
৩৫    চতুর্থ পরিচ্ছেদ: ঈমান হ্রাসকারী বা ঘাটতিকারক বিষয়সমূহ    
৩৬    চতুর্থ অধ্যায়: বিবিধ মাসআলা    
৩৭    প্রথম পরিচ্ছেদ: আলে বাইতের ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের ‘আকিদা    
৩৮    দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের ‘আকিদা    
৩৯    তৃতীয় পরিচ্ছেদ: আলেমগণের প্রতি করণীয় আবশ্যকীয় কর্তব্য    
৪০    চতুর্থ পরিচ্ছেদ: ইমামত বা নেতৃত্ব    
৪১    পঞ্চম পরিচ্ছেদ: বিদ‘আত ও তার অনুসারীদের ব্যাপারে অভিমত    
৪২    ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ: বিদ‘আতের অনুসারীদের সাথে ব্যবহার    
৪৩    সপ্তম পরিচ্ছেদ: আল্লাহর দিকে আহ্বান, সৎ কাজের নির্দেশ ও জিহাদ    
৪৪    অষ্টম পরিচ্ছেদ: ঐক্য ও সংহতি কামনা করা এবং বিভেদ ও অনৈক্যকে প্রত্যাখ্যান করা    
৪৫    উপসংহার    

 
ভূমিকা

সকল প্রসংসা আল্লাহর জন্য, যার নি‘আমতেই ভালো কাজসমূহ সম্পন্ন হয়ে থাকে। আর সালাত ও সালাম ও বরকত জগদ্বাসীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরিত সত্তার ওপর। তার পরিবার-পরিজন ও সাথীবৃন্দের উপর, যারা অন্ধকারে আলোকবর্তিকা, হিদায়াতের তারকা ও প্রভূত কল্যাণের ক্ষেত্র।
তারপর,
আমার পক্ষ থেকে আমার রবের প্রশংসার জিহবা কখনও বন্ধ হওয়ার নয়, তাঁর দয়া, অনুগ্রহের প্রতি আমার অন্তরের মুখাপেক্ষিতা কখনও শেষ হবে না। তাঁর দয়া ও অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় করার জন্য অন্তর ও মুখের সাথে হাতের কাজ একীভূত হতে বাধ্য, কোনোভাবেই বিরোধিতা করবে না।
তিনি আমাদের ওপর মুক্তার মত করে তাঁর দানের ব্যাপকতা বিস্তৃত করেছেন। আর তাঁরই অনুগ্রহে সে মুক্তাকে তাওহীদপন্থীদের জন্য চক্ষুসিক্তকারী বানিয়েছেন। আর সেদিকে সম্পর্কযুক্ত হওয়াকে এমন সম্মানের বিষয় বানিয়েছেন যা সকল মূল্যবান সম্পদকে ছাড়িয়ে গেছে।
মহান আল্লাহর দয়ায় এ কিতাবটি বেশ কয়েকবার ছাপা হয়েছে। সদাজাগ্রত বিবেক ও স্বচ্ছ অন্তর সেটা গ্রহণ করেছে। অনেকেই তাতে বিশেষ অংশ যোগ করেছে, ছুটে যাওয়া জিনিস ভালোবেসে ধরিয়ে দিয়েছেন। এ চতুর্থ সংস্করণের মাধ্যমে কিছু বাদ দেওয়া, কিছু সংযোজন করা, কিছু আগে নেওয়া, কিছু পিছনে স্থানান্তর করার কাজটি সম্পন্ন হয়েছে; যাতে করে ব্যাখ্যা, দলীল দেওয়া, বর্ণনা করা বা কারণ উল্লেখ করা সহজ হয়।
আর আল্লাহ তা‘আলার কাছে চাইব তিনি যেন এর দ্বারা নেকীর পাল্লা ভারী করে দেন এবং এর মাধ্যমে আমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেন।
আর সালাম, সালাম ও বরকত বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তার পরিবার-পরিজন, সাথী সবার ওপর। আর সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি সকল সৃষ্টিকুলের রব।
আবু আবদুল্লাহ।

 

 

 

প্রথম অধ্যায়
( مبادئ و مقدّماته)
মৌলিক নীতিমালা ও তার ভূমিকাসমূহ

 

 

 

 

 

 

 

 

 

প্রথম অধ্যায়
প্রথম পরিচ্ছেদ: ঈমানের মৌলিক নীতিমালা ও তার ভূমিকাসমূহ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: ইসলাম ও মুসলিমগণের ফযীলত বা মর্যাদা
তৃতীয় পরিচ্ছেদ: আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও তাদের বৈশিষ্ট্য
চতুর্থ পরিচ্ছেদ: শিক্ষাগ্রহণ এবং কুরআন ও সুন্নাহকে আকঁড়ে ধরার পদ্ধতি

 

 

 

 

 

 


প্রথম পরিচ্ছেদ
(مبادئ علم الإيمان ومقدماته)
ঈমানের মৌলিক নীতিমালা ও তার ভূমিকাসমূহ
•    বান্দার ওপর প্রথম আবশ্যকীয় ও বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: যমীন ও আকাশসমূহের রব তথা আল্লাহর তাওহীদ প্রতিষ্ঠা।
-    আর তাওহীদ হলো, যাবতীয় ইবাদত শুদ্ধ হওয়ার অন্যতম শর্ত এবং সাওয়াবের কাজগুলো গ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণ।
-    আর তাওহীদ হলো, নবী ও রাসূলগণের দাওয়াতের মূলকথা এবং সকল মানুষ ও জিন্নকে সৃষ্টি করার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
-    ঈমান শাস্ত্রের নামসমূহ (أسماء علم الإيمان): মর্যাদা ও মহত্বের কারণে এ (ঈমান) শাস্ত্রের নামের সংখ্যা অনেক এবং তার গুরুত্ব ও মহিমার কারণে তার ‘লকব’ বা উপাধিসমূহ খুবই প্রসিদ্ধ। সুতরাং ‘ঈমান’ (الإيمان), ‘আস-সুন্নাহ’ (السنة), ‘আত-তাওহীদ’ (التوحيد), ‘আল-‘আকিদা’ (العقيدة), ‘উসূলুদ দীন’ (أصول الدين) ও ‘আশ-শরী‘আহ’ (الشريعة), তবে এ শাস্ত্রের ওপর প্রথম যে নামটি ব্যবহৃত হয়েছিল এবং গ্রন্থ রচনা করা হয়েছিল তা হচ্ছে, ‘আল-ফিকহুল আকবার’ (الفقه الأكبر), যদিও সবগুলো নামই শরী‘আতসম্মত, প্রশংসিত।
-    আর এ শাস্ত্রের নাম ‘ইলমুল কালাম’ (علم الكلام) ও ‘ফালসাফা/দর্শন’ (الفلسفة)- ইত্যাদি দেওয়া বিদ‘আত পদ্ধতিতে দেওয়া হয়েছে ও নিন্দিত হিসেবে পরিগণিত।
•    ঈমান শাস্ত্রের সংজ্ঞা (حَدُّ علمِ الإيمانِ): هو العلمُ بالأحكام الشرعية الإيمانية المستمدُّ من الأدلةِ المرضيَّةِ، ورد الشبهات وقوادح الأدلة الخلافيَّةِ.
“এটি এমন এক শাস্ত্রের নাম, যার অর্থ হচ্ছে, ঈমান সংক্রান্ত শরী‘আতের বিধিবিধান সম্পর্কে জানা, যা অনুমোদিত দলীলসমূহ থেকে গৃহীত এবং যাবতীয় সন্দেহ-সংশয় দূর করা ও বিতর্কিত দলীলসমূহের অপবাদগুলো খণ্ডন করা।”
•    ঈমান শাস্ত্রের সম্পর্ক (نسبة علمِ الإيمانِ): তাওহীদ শাস্ত্র (علم التوحيد) হলো মূল এবং তা ব্যতীত অন্য সব হলো শাখা-প্রশাখা, এ বিদ্যা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অন্যকিছুর মুখাপেক্ষী নয়।
•    ঈমান শাস্ত্রের বিধান (حكمُ علمِ الإيمانِ): তার কিছু বিষয় ফরযে ‘আইন এবং তার কিছু ফরযে কিফায়া।
-    ফরযে ‘আইন হলো: মোটামুটি দলীলসহ এমন কিছু বিষয় জানা, যার দ্বারা আকিদা-বিশ্বাস শুদ্ধ হয় এবং যার ব্যাপারে সকল মানুষকে জিজ্ঞাসা করা হবে।
-    আর ফরযে কিফায়া হলো: এর চেয়ে আরও অধিক বিস্তারিত জানা। যেমন, বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা, দলীল পেশ করা এবং কারণ ব্যাখ্যা করতে জানা, আর একগুঁয়ে অবাধ্য বিরোধীদেরকে মেনে নিতে বাধ্য করতে এবং ভিন্ন মত পোষণকারীদের কণ্ঠরোধ করতে সক্ষম হওয়া।
•    ঈমান শাস্ত্রের ফযীলত (فضلُ علمِ الإيمانِ): ঈমান আনয়ন করা যেমনিভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ আমল, তেমনিভাবে ঈমানের ইলমও সর্বশ্রেষ্ঠ ‘ইলম’ (জ্ঞান); সম্পর্ক, বিষয়বস্তু, জ্ঞাতবিষয় এবং উৎসের দিক থেকে।
-    ঈমান শাস্ত্রের সম্পর্ক (متعلق علمِ الإيمانِ): ঈমান শাস্ত্রের সম্পর্ক হলো: আল্লাহর সাথে, যিনি চিরঞ্জীব, চিরন্তন, মহান, এককভাবে মহত্বপূর্ণ গুণাবলীর অধিকারী এবং সুন্দর ও পরিপূর্ণতার সকল গুণের একচেটিয়া মালিক।
-    ঈমান শাস্ত্রের বিষয়বস্তু (موضوعُ علمِ الإيمانِ): ঈমান শাস্ত্রের বিষয়বস্তু হলো সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠাংশ নবী ও রাসূলগণ। তাদের জন্য যা সাব্যস্ত করা বাধ্যতামূলক, যা বৈধ ও যা নিষিদ্ধ। আর তাদের রিসালতসমূহ; মুকাল্লাফ বা শরী‘আত পালনে আদিষ্টদের ওপর যা বিশ্বাস করা ওয়াজিব।
-    ঈমান শাস্ত্রের সুবিদিত বিষয় (معلوم علمِ الإيمانِ): ঈমান শাস্ত্রের সুবিদিত ও সুনির্দিষ্ট বিষয় হলো আকিদা-বিশ্বাস বিষয়ক মাসআলাসমূহের সাথে সম্পর্কিত আহকাম ও বিধিবিধানসমূহ।
-    ঈমান শাস্ত্রের উৎসমূল ( استمدادُ علمِ الإيمانِ ): ঈমান শাস্ত্রের উৎস হলো; সঠিক প্রকৃতি বা স্বভাব, বিশুদ্ধ দলীল, পূর্ববর্তীদের সাথে আসা গ্রহণযোগ্য ইজমা‘ এবং সুস্পষ্ট যুক্তি।
•    ঈমান শাস্ত্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য (غاية علمِ الإيمانِ ):
-    মুকাল্লাফ বা শরী‘আত পালনে আদিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দিক থেকে:
আকীদা-বিশ্বাসকে শুদ্ধ করা, ইবাদতকে এক আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা, ঈমানে মুজমালের (সংক্ষিপ্ত ঈমানের) স্তর থেকে ঈমানে মুফাস্সালের (বিস্তারিত ঈমানের) স্তরে এবং অন্ধ অনুকরণ করার অবস্থা থেকে দৃঢ় বিশ্বাস ও অনুগত্যের অবস্থায় উন্নতি লাভ করা, দলীল ও যুক্তি-প্রমাণকে বিশ্বাস ও সমর্থন করা, বক্ষ খুলে যাওয়া এবং চিন্তা-ভাবনা স্থিতিশীল হওয়া, অন্তরের কাজগুলো নিশ্চিত করা, রবের পছন্দ মতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো চালিত হওয়া, দুনিয়াতে বিদ‘আত ও সন্দেহ-সংশয় থেকে মুক্তি লাভ করা, পরকালে জাহান্নামে স্থায়ীভাবে অবস্থান করা থেকে নাজাত পাওয়া এবং জান্নাতে প্রবেশ করা।
-    আর মুসলিমগণের সমাজের দিক বিবেচনায়:
পবিত্র জীবন, বিরামহীন বরকত, সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নতি, সমাজের নিরাপত্তা, মুমিনগণের খিলাফত এবং এ দীনের ক্ষমতায়ন।  
-    আর ঈমান শাস্ত্র ও ইসলামের বিদ্যাসমূহের বিবেচনায়:
সাধারণত কোনো বিদ্যা যথার্থভাবে সংরক্ষণ করতে হলে প্রয়োজন হয় সে বিদ্যার মূলনীতিগুলো সংরক্ষণ এবং তার মূলনীতি ও বিষয়গুলো অনুধাবন।
আরও উদ্দেশ্য হচ্ছে, পথনির্দেশপ্রার্থীগণকে সুপথে পরিচালিত করার ব্যাপারে সক্ষমতা অর্জন করা, আগ্রহীজনদেরকে শিক্ষা দান করা, সীমালঙ্ঘনকারীদের বিকৃতি ও অপব্যাখ্যাকে নিষেধ করা, বাতিলদের মতাদর্শ ও অজ্ঞদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে প্রত্যাখ্যান করা এবং বিরোধীগণের বিপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করা। আর এর মধ্যেই রয়েছে দীন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি।
•    ঈমান শাস্ত্রের প্রবর্তক ( واضعُ علمِ الإيمانِ ):
ঈমান শাস্ত্রের প্রবর্তক ও রূপকার হলেন ন্যায়পরায়ণ নির্ভরযোগ্য বিশ্বস্ত বিশিষ্ট ইমামগণ। যেমন, অনুসরণীয় বিশিষ্ট চার ইমাম এবং পূর্ববর্তী সৎব্যক্তিগণের মধ্যে যারা তাদের অনুসরণ-অনুকরণ করেছেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
(فضل الإسلام و أهله)
ইসলাম ও মুসলিমগণের ফযীলত বা মর্যাদা
•    সত্য দীন হলো ইসলাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ﴾ [ال عمران: ١٩]
“নিশ্চয় ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯]
আর ইসলাম হলো আল্লাহ তা‘আলার নির্ভেজাল একত্ববাদের প্রতি আত্মসমর্পন করা, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিপূর্ণ অনুসরণ করা এবং শির্ক ও মুশরিকদের থেকে মুক্ত থাকা।
•    আর সার্বজনীন ইসলাম হলো নবী ও রাসূলগণের দীন। আল্লাহ তা‘আলা নূহ ‘আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে বলেন,
﴿وَأُمِرۡتُ أَنۡ أَكُونَ مِنَ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ٧٢﴾ [يونس: ٧٢]
“আর আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত হতে আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি।” [সূরা ইউনূস, আয়াত: ৭২]
আর আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
﴿أَسۡلِمۡۖ قَالَ أَسۡلَمۡتُ لِرَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٣١﴾ [البقرة: ١٣١]
“‘আত্মসমর্পণ করুন’, তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সৃষ্টিকুলের রবের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৩১]
আর ইবরাহীম ও ইসমা‘ঈল ‘আলাইহিমাস সালাম বলেন,
﴿رَبَّنَا وَٱجۡعَلۡنَا مُسۡلِمَيۡنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَآ أُمَّةٗ مُّسۡلِمَةٗ لَّكَ﴾ [البقرة: ١٢٨]
“‘হে আমাদের রব! আর আমাদের উভয়কে আপনার একান্ত অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধর হতে আপনার এক অনুগত জাতি উত্থিত করুন।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১২৮]
আর ইবরাহীম ও ইয়াকূব ‘আলাইহিমাস সালাম ইসলামের অনুসরণ করার জন্য নির্দেশ দিয়ে বলেন,
﴿فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسۡلِمُونَ ١٣٢﴾ [البقرة: ١٣٢]
“কাজেই তোমরা আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) না হয়ে মারা যেও না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৩২]
আর মূসা ‘আলাইহিস সালাম বলেন,
﴿يَٰقَوۡمِ إِن كُنتُمۡ ءَامَنتُم بِٱللَّهِ فَعَلَيۡهِ تَوَكَّلُوٓاْ إِن كُنتُم مُّسۡلِمِينَ ٨٤﴾ [يونس: ٨٤]
“হে আমার সম্প্রদায়! যদি তোমরা আল্লাহর ওপর ঈমান এনে থাক, তবে তোমরা তাঁরই ওপর নির্ভর কর, যদি তোমরা মুসলিম হয়ে থাক।” [সূরা ইউনূস, আয়াত: ৮৪]
আর হাওয়ারীগণ ‘ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
﴿ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَٱشۡهَدۡ بِأَنَّا مُسۡلِمُونَ ٥٢﴾ [ال عمران: ٥٢]
“আমরা আল্লাহতে ঈমান এনেছি, আর আপনি সাক্ষী থাকুন যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৫২]
•    আর সর্বশেষ মনোনীত ও পছন্দসই রিসালাত হলো ইসলাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ﴾ [المائ‍دة: ٣]
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নি‘আমত সম্পূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [সূরা আল-মায়িদা, আয়াত:৩]
•    আর সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আল্লাহ তা‘আলা যে ইসলাম নাযিল করেছেন, তা ব্যতীত অন্য কেনো ধর্মকে দীন হিসেবে গ্রহণ করা কারো জন্য বৈধ নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٨٥﴾ [ال عمران: ٨٥]
“আর কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো তার পক্ষ থেকে কবুল করা হবে না এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮৫]
•    আর সহীহ হাদীসের মধ্যে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«وَاَلَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الْأُمَّةِ ، وَلاَ يَهُودِيٌّ وَلاَ نَصْرَانِيٌّ ، وَمَاتَ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِاَلَّذِي أُرْسِلْت بِهِ إلاَ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ».
“যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন তাঁর শপথ! এ উম্মতের যে কেউ আমার সম্পর্কে শুনল জানল -ইহুদী হউক, আর খ্রিষ্টানই হউক এবং আমি যে রিসালাত নিয়ে এসেছি তার প্রতি ঈমান না এনেই মারা গেল, সে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত।”  
•    কারণ, ইসলাম হলো স্বভাবধর্ম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَأَقِمۡ وَجۡهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفٗاۚ فِطۡرَتَ ٱللَّهِ ٱلَّتِي فَطَرَ ٱلنَّاسَ عَلَيۡهَاۚ لَا تَبۡدِيلَ لِخَلۡقِ ٱللَّهِۚ﴾ [الروم: ٣٠]
“কাজেই আপনি একনিষ্ঠ হয়ে নিজ চেহারাকে দীনে প্রতিষ্ঠিত রাখুন। আল্লাহর ফিতরাত (স্বাভাবিক রীতি বা দীন ইসলাম), যার ওপর (চলার যোগ্য করে) তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ৩০]
•    আর ইসলাম হলো হিদায়াত ও রহমতের দীন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَنَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ تِبۡيَٰنٗا لِّكُلِّ شَيۡءٖ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٗ وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُسۡلِمِينَ ٨٩﴾ [النحل: ٨٩]
“আর আমরা আত্মসমর্পণকারীদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ, পথনির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদস্বরূপ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৮৯]
•    আর তা সহজ দীন, জটিল নয়, সমস্যামুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا جَعَلَ عَلَيۡكُمۡ فِي ٱلدِّينِ مِنۡ حَرَجٖ﴾ [الحج: ٧٨]
“তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো সংকীর্ণতা রাখেন নি।” [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৭৮]
•    আর ইসলাম হলো আল্লাহ ব্যতীত অন্য সকল কিছুর দাসত্ব করা থেকে মুক্ত থাকার দীন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلۡ يَٰٓأَهۡلَ ٱلۡكِتَٰبِ تَعَالَوۡاْ إِلَىٰ كَلِمَةٖ سَوَآءِۢ بَيۡنَنَا وَبَيۡنَكُمۡ أَلَّا نَعۡبُدَ إِلَّا ٱللَّهَ وَلَا نُشۡرِكَ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يَتَّخِذَ بَعۡضُنَا بَعۡضًا أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِۚ فَإِن تَوَلَّوۡاْ فَقُولُواْ ٱشۡهَدُواْ بِأَنَّا مُسۡلِمُونَ ٦٤﴾ [ال عمران: ٦٤]  
“আপনি বলুন, হে আহলে কিতাবগণ! এসো সে কথায়, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই; যেন আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত না করি, তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক না করি এবং আমাদের কেউ আল্লাহ ছাড়া একে অন্যকে রব হিসেবে গ্রহণ না করি।’ তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তোমরা বল: তোমরা সাক্ষী থাক যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬৪]
•    আর তা হলো ‘ইলম ও ‘আকলের (জ্ঞান, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার) দীন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَرۡفَعِ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنكُمۡ وَٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ دَرَجَٰتٖۚ﴾ [المجادلة: ١١]
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন।” [সূরা আল-মুজাদালা, আয়াত: ১১]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ مُبَٰرَكٞ لِّيَدَّبَّرُوٓاْ ءَايَٰتِهِۦ وَلِيَتَذَكَّرَ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٢٩﴾ [ص: ٢٩]
“এক মুবারক কিতাব, এটা আমরা আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা উপদেশ গ্রহণ করে।” [সূরা সোয়াদ, আয়াত:২৯]
•    আর মুসলিমগণ হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাত বা জাতি, মানবজাতির কল্যাণে যাদের আত্মপ্রকাশ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ وَلَوۡ ءَامَنَ أَهۡلُ ٱلۡكِتَٰبِ لَكَانَ خَيۡرٗا لَّهُمۚ مِّنۡهُمُ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَأَكۡثَرُهُمُ ٱلۡفَٰسِقُونَ ١١٠﴾ [ال عمران: ١١٠]  
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানব জাতির কল্যাণের জন্য যাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে। আর আহলে কিতাবগণ যদি ঈমান আনতো, তবে তা ছিল তাদের জন্য ভাল হতো। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মুমিন আছে; কিন্তু তাদের অধিকাংশই ফাসেক।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০]
•    আর মুসলিমগণ হলেন মধ্যপন্থি জাতি এবং সকল জাতির ওপর ন্যায়পরায়ণ সাক্ষী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَٰكُمۡ أُمَّةٗ وَسَطٗا لِّتَكُونُواْ شُهَدَآءَ عَلَى ٱلنَّاسِ وَيَكُونَ ٱلرَّسُولُ عَلَيۡكُمۡ شَهِيدٗاۗ ﴾ [البقرة: ١٤٣]
“আর এভাবে আমরা তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির ওপর স্বাক্ষী হও এবং রাসূল তোমাদের ওপর সাক্ষী হতে পারেন।”

তৃতীয় পরিচ্ছেদ
(أهل السنة والجماعة وخصائصهم)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও তাদের বৈশিষ্ট্য
•    আর শ্রেষ্ঠ মুসলিম হলেন ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’, আর তারা হলেন সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম এবং সকল যুগে ও স্থানে যে বা যারা তাদেরকে যথাযথভাবে অনুসরণ করে।
•    আর তারা হলেন সৎকর্মশীল পূর্বপুরুষ, অনুসরণকারী ও পদাঙ্ক মান্যকারী এবং হাদীস ও সুন্নাহ’র অনুসারী, আর (জাহান্নাম থেকে) মুক্তিপ্রাপ্ত সম্প্রদায় এবং (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সাহায্যপ্রাপ্ত গোষ্ঠী; তাদের নামসমূহ সম্মানজনক এবং তাদের সম্পর্কও অভিজাত।
•    আর এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত, যিনি আল্লাহকে ‘রব’ বলে মেনে নিয়েছেন, ইসলামকে দীন (জীবনবিধান) হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী ও রাসূল হিসেবে মেনে নিয়েছেন, আর সাথে সাথে তিনি সামগ্রিকভাবে ইসলাম পালন করেন, তার বিধিবিধানকে অনুগত হয়ে ও বিনিতভাবে মেনে চলেন এবং তিনি সকল বিদ‘আতপন্থী মাযহাব ও দল থেকে মুক্ত থাকেন।
•    আর এটা শামিল করে মুসলিম জাতির অধিকাংশ ব্যক্তিবর্গকে, যারা সামগ্রিক বিষয়ে সুন্নাহ’র পরিপন্থী কোনো কাজ করে না, বিদ‘আতী পতাকার তলে অবস্থান করে না এবং কোনো অগ্রহণযোগ্য গোষ্ঠীর পাল্লা ভারী করে না।
•    আর তারা হলেন উম্মাতের সকল গোষ্ঠী ও দলের মধ্যে মধ্যপন্থী সম্প্রদায়।
•    আর তারা কোনো স্থানের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, তবে কোনো সময়ই তাদের থেকে মুক্ত নয়।
•    আর আকিদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম যার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তারা সে গণ্ডী থেকে বের হন না।
•    তারা আল-কুরআনের প্রতি যত্নবান এবং শ্রেষ্ঠ মানুষ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের সংরক্ষণকারী।
•    আর তারা আনুগত্যের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ এবং বিভেদ ও বিদ‘আত বর্জনকারী।
•    আর তারা ‘হক’ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে পরস্পর বন্ধু হন এবং ‘হক’ ও ন্যায়ের ভিত্তিতেই তাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হয়, আর ন্যায়ের ভিত্তিতেই তারা বিচার ফয়সালা করেন।
•    তাদের জীবন-চরিত সবসময় সুন্দর; যেমনিভাবে তাদের আকিদা-বিশ্বাস দৃঢ় মজবুত এবং তাদের শরী‘আত হলো সরল সঠিক শরী‘আত।
•    তাদের চরিত্র হলো কাণ্ডারী জাতীয়, কর্মপন্থা হলো শ্রেষ্ঠ এবং তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ হলো ঈমানী।
•    শিক্ষাদান ও চালচলনের ক্ষেত্রে তারা মা‘সূম (নিষ্পাপ) নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের বিপরীত কাজ করেন না। কারণ, তারা তাঁর শিক্ষায় সুশিক্ষিত হন, তাঁর সুন্নাতের ওপর আমল করেন এবং তাঁর সুন্নাত থেকে তারা বিচ্যুত হন না।
•    তারা শিক্ষাদান করেন, প্রশিক্ষণ প্রদান করেন, সৎকাজের নির্দেশ দেন, অসৎ কাজে নিষেধ করেন, আল্লাহ তা‘আলার দিকে ডাকেন, তাঁর পথ প্রদর্শন করেন এবং তাঁর পথেই জিহাদ (সংগ্রাম) করেন।
•    তাদের একটা গোষ্ঠী সবসময় যুক্তি-প্রমাণ ও বক্তৃতা-বিবৃতি দ্বারা, হাত ও মুখ দ্বারা প্রকাশ্যভাবে বিজয়ী বেশে সংগ্রামে ব্যস্ত থাকেন, যে ব্যক্তি সে গোষ্ঠীকে অপদস্থ করতে বা তার বিরোধিতা করতে চায়, সে কিয়ামত পর্যন্ত তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
•    তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ সকলের জন্য আদর্শ নমুনা, তাদের ইমাম বা নেতাগণ দিশাহারাদের জন্য মিনার, আলোকস্তম্ভ বা বাতিঘর এবং গোটা মানবজাতির জন্য আল্লাহর দলীল প্রমাণস্বরূপ।
•    আর মর্যাদার ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন মানের, আর অধিক মর্যাদার ওপর ভিত্তি করে বলা যাবে না যে, তাদের মাঝে নিষ্পাপ কেউ আছেন, একমাত্র নিষ্পাপ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া।
•    তারা শরী‘আতের মানদণ্ডে বিচার-ফয়সালা করেন এবং একে অপরকে দীন প্রতিষ্ঠার উপদেশ দেন। ফলে তারা নিষেধ করেন বেশি নমনীয় ও চরম একগুঁয়ে হওয়া থেকে এবং নিষেধ করেন দায়িত্বহীনতা, হঠকারিতা, অপারগতা ও ভেঙ্গে পড়া থেকে।
•    তারা আল্লাহ তা‘আলার নিকট নিরাপত্তা চান এবং বিপদ মুসিবতের ইচ্ছাকৃত সম্মুখীন হন না। কিন্তু যখন তাদের প্রতি আল্লাহর ফায়সালা আপতিত হয়, তখন তারা সত্যিকার পুরুষে পরিণত হোন, দৃঢ়পদ থাকেন, অন্যদেরকে দৃঢ় পদ রাখেন।
•    তারা অন্যায় অপরাধ থেকে বিরত থাকেন এবং কোনো ভালো ও কল্যাণকর প্রসঙ্গ ছাড়া জনগণের সাথে মেলামেশা করেন না।
•    তাদের অন্তর পরিষ্কার, আর তারা তাকিয়্যা (মনের কথা গোপন করে বাইরে ভিন্ন কিছু প্রকাশ করার) নীতি হিসেবে কথা বলে জনগণকে ঠকানোর চেষ্টা করে না, মানুষের সাথে নম্র ব্যবহার করেন, তবে তাদেরকে তোষামোদ করে ঠকায় না।
•    যে ব্যক্তি তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তারা তার সাথে স্থাপন করেন, আর যারা তাদেরকে কিছু দিতে নিষেধ করে তারা তাকে দান করেন, আর তারা তাকে ক্ষমা করে দেন, যে তাদের প্রতি যুলুম করে।
•    তারা মানুষের (চরিত্র ও কর্মের) উৎকৃষ্ট অংশ গ্রহণ করেন, (অথবা ক্ষমা করেন) সৎকাজের নির্দেশ দেন (অথবা প্রচলিত নিয়মানুযায়ী নির্দেশনা প্রদান করেন) এবং অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চলেন।
•    তারা ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন করেন এবং তাদের প্রতিপালকের ওপরই ভরসা করেন।
•    তারা আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসায় প্রসিদ্ধি লাভ করেন. আর আল্লাহর ভয়ে শঙ্কিত হন, আর হাসি-তামাসা ও দুনিয়া নিয়ে আনন্দ উল্লাস কম করার মাধ্যমে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হন।
•    তারা জামা‘আতে সালাত আদায় করার ব্যাপারে আগ্রহী থাকেন এবং সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও আনুগত্যের ব্যাপারে নিরবিচ্ছন্ন ও নিয়মিত।
•    তারা রাত্রি জাগরণ তথা রাতের বেলায় নফল সালাত আদায়ের মাধ্যমে সম্মান লাভ করেন, আর অন্তরের ভীতি, চোখের অশ্রু বিসর্জন এবং বেশি বেশি সাওম পালন ও যিকির করার কারণে তারা প্রসিদ্ধি লাভ করেন ও সুপরিচিত হন, আর যখন তাদের প্রতি তাকানো হয়, তখন আল্লাহর কথা স্মরণ হয়।
•    তারা তাদের জিহ্বাকে সংযত রাখেন। তারা লম্বা সময় ধরে নীরব থাকেন, কম কথা বলেন এবং কথা বলার ক্ষেত্রে বিজ্ঞতার পরিচয় দেন।
•    তারা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ করেন, তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো হিফাযত করেন এবং তাদের আমলের ক্ষেত্রে তাদেরকে সঠিক বিষয়টি ইলহাম করা হয়।
•    তারা উদারতার সাথে দান-সাদকা করেন এবং তারা মুক্তহস্তে দান করেন।
•    তারা সুসময়ে (আল্লাহর) শুকরিয়া আদায় করেন এবং দুঃসময়ে ধৈর্যধারণ করেন, আর বালা-মুসিবত নাযিলের সময় প্রার্থনা ও মিনতি প্রকাশ করেন।
•    তারা বিপদ ও প্রতিকূলতার সময় আশার আলো দেখেন এবং সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্যের সময় তাদের ওপর ভয় ও আতঙ্ক প্রাধান্য বিস্তার করে।
•    তারা বেশি বেশি তাওবা ও ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করেন, আর পরাক্রমশালী ক্ষমাশীল আল্লাহর নিকট নিজেদের পেশ করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকেন।
•    তারা ইখলাস তথা নিষ্ঠার সাথে আমল করেন, লোক দেখানো আমল করা থেকে দূরে থাকেন এবং সে ব্যাপারে সতর্ক করেন, আর প্রতি মুহূর্তে তারা তাদের অন্তরকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তদারক করেন।
•    মোটকথা, তাদের মধ্যে ভালো ও উত্তম বিষয়টি প্রাধান্য পায়, যেমনিভাবে খারাপ ও মন্দ বিষয়টি তাদের বিরোধীদের মাঝে প্রাধান্য পায়।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
(منهج التلقي والاعتصام بالكتاب والسنة)
শিক্ষাগ্রহণ এবং কুরআন ও সুন্নাহকে আকঁড়ে ধরার পদ্ধতি
•    আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত তাদের আকিদার শিক্ষা নেন বিশুদ্ধ দলীল, গ্রহণযোগ্য ইজমা, সুস্পষ্ট যুক্তি ও নির্ভরযোগ্য ফিতরাত বা স্বভাব-চরিত্র থেকে।
•    আর তারা বিশ্বাস করেন যে, অকাট্য দলীল ও সেরা তথ্যসূত্র হলো আল্লাহ তা‘আলার কিতাব এবং বিশুদ্ধ হাদীসে নববী, যদি তা ‘আহাদ’ পর্যায়ের হাদীসও হয়।
•    আর তারা আল্লাহ তা‘আলার কালাম (কথা) ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীর ওপর অন্য কারও কথাকে অগ্রাধিকার দেন না, সে যে কেউ হউক না কেন।
•    আর তারা বিশ্বাস করেন যে, আকিদা-বিশ্বাস ও শরী‘আতের বিধিবিধানের ক্ষেত্রে সুন্নাহ স্বয়ং দলীল হিসেবে গণ্য।
•    আর তারা কুরআন ও সুন্নাহ’র বক্তব্যসমূহকে সম্মান ও মর্যাদা সহকারে গ্রহণ করেন।
•    আর তাঁর বিশ্বাস করেন যে, কুরআন ও সুন্নাহ’র বক্তব্যসমূহ দীনের সকল বিষয়কে, বিশেষ করে ঈমানকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
•    আর তারা (কুরআন ও সুন্নাহ’র) সকল বক্তব্যকে আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতার উৎস হিসেবে গ্রহণ করেন।
•    আর তারা প্রত্যেক বিষয়ে বর্ণিত সকল ‘নস’ তথা শরী‘আতের বক্তব্যের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিয়ে থাকেন।
•    আর তারা এসব ‘নস’-কে অনুধাবন করেন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপলব্ধি এবং নির্ভরযোগ্য সাহাবী ও ইমামগণের বুঝ ও অনুধাবনের ভিত্তিতে।
•    তারা কুরআন ও সুন্নাহ’র ব্যাখ্যা করেন কুরআন ও সুন্নাহর দ্বারাই, অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমের কথা এবং যারা তাদের পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন তাদের কথার দ্বারা। তারপর যদি বিষয়টি সুস্পষ্ট না হয়, তাহলে আরবদের বিশুদ্ধ ভাষা ও উপভাষা দ্বারা ব্যাখ্যা করেন।
•    আর তারা তা অনুধাবন করেন তার গ্রহণযোগ্য বাহ্যিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে, আর বাতিল ব্যাখ্যাকে প্রতিহত করেন।
•    আর যা বাহ্যিকভাবে সহীহ দলীল ও স্পষ্ট যুক্তির মাঝে বিরোধপূর্ণ করে তুলে, তারা তা বর্জন করেন।
•    আর তারা বিশ্বাস করেন যে, কুরআন ও সুন্নাহ’র বক্তব্যসমূহ গ্রহণ করার অসম্ভবতা ও অসাধ্যতাকে নিয়ে আসে না; বরং কখনও কখনও তা এমন কিছু নিয়ে আসে, যার ব্যাপারে বিবেক-বুদ্ধি হতভম্ব হয়ে পড়ে।
•    সুতরাং যদি তার বাহ্যিকতায় বিরোধ দেখা দেয়, তাহলে বুঝতে হবে যে, তার যুক্তির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সমস্যা রয়েছে অথবা দলীলটি প্রমাণিত কিনা অথবা তা কি আমি যা প্রকাশ্যে বুঝেছি তার ওপর প্রমাণবহ কিনা তা দেখতে হবে।
•    আর যে ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল চুপ থেকেছেন, কোনো মন্তব্য করেন নি এবং সাহাবীগণ ও তাদের যথাযথ অনুসরণকারীগণ যে প্রসঙ্গে কোনো কথা বলেন নি, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত তা থেকে বিরত থাকেন।
•    সুতরাং তারা আকদী-বিশ্বাস গ্রহণ করার উৎস ও তথ্যসূত্রকে একক করার ব্যাপারে এবং তাকে যাবতীয় বাজে কথার মিশ্রণ অথবা নিন্দিত মন্দ দর্শন অথবা বিদ‘আতী পন্থা থেকে নির্ভেজাল রাখার ব্যাপারে একমত।
•    আর তারা আকিদার বিষয়সমূহ ও দীনের মূলনীতিগুলো বর্ণনা করার সময় কুরআন ও সুন্নাহ’র শব্দ ও পরিভাষাগুলো ব্যবহার করেন এবং আল-কুরআনের ভাষা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বর্ণনার আলোকে সেগুলোর দ্বারা শর‘ঈ অর্থ প্রকাশ করেন।
•    আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে নিষ্পাপ কথাটি কারও জন্য প্রযোজ্য নয়, তবে উম্মাতের ইজমা সংঘটিত হলে ভিন্ন কথা, আর উম্মাতের কারও জন্য নিষ্পাপ কথাটি প্রযোজ্য নয়।
•    আর তারা বিশ্বাস করেন যে, বিধিবিধানের ব্যাপারে ‘ইজমা’ একটি অকাট্য দলীল এবং অনুমোদিত মতবিরোধ হলো অনুমতি বা অবকাশের জায়গা।
•    আর যে বিষয়ে মতবিরোধ হবে, তাকে কুরআন ও সুন্নাহ’র দিকে প্রেরণ করা আবশ্যক, সাথে ইমামগণের মধ্যে থেকে যিনি ভুল করেছেন তাঁর জন্য ওযর পেশ করা। সুতরাং তাদেরকে (ইমামগণকে) নিষ্পাপ বলা যাবে না এবং গুনাহ’র অভিযোগে অভিযুক্তও করা যাবে না।
•    আর এমন প্রত্যেকটি বিষয় ‘ইজতিহাদী’ তথা গবেষণামূলক বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে, যে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো সহীহ দলীল বর্ণিত হয় নি অথবা কোনো ইজমা সংঘটিত হয় নি। সুতরাং এসব বিষয়ে মুজতাহিদকে (গবেষককে) নিন্দা করা যাবে না, যদিও তিনি ভুল করেন, যখন সত্য ও সঠিক বিষয়টি তার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে এবং তা অনুসন্ধানের ব্যাপারে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করে থাকেন।
•    আর তারা সে বিষয়কে গবেষণামূলক মাসআলার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করেন না, যে বিষয়ে কোনো ‘শায’ বা বিরল মতভেদ দেখা দেয় অথবা যা আলেমগণের পদস্খলণজনিত বা সুস্পষ্ট ভুলজনিত মতামতে চালু হয়েছে, সুতরাং এগুলোতে তাদের অনুসরণ করা যাবে না, কিন্তু এ কারণে তাদেরকে অসম্মানজনক কথা বলা যাবে না।
•    আর তারা যেসব গবেষণামূলক মাসআলায় মতবিরোধের উপযুক্ত এবং যেসব গবেষণামূলক মাসআলায় মতবিরোধের উপযুক্ত নয়, সেসবের মাঝে পার্থক্যকরণের দিকে মনোযোগ দেন, আর সে ক্ষেত্র্রে মতবিরোধকারী ব্যক্তির ওপর সংকীর্ণতা আরোপ করেন না। কিন্তু যে সব মাসআলায় মতভেদ করা যাবে না সেটা বর্ণনা করে দেন।
•    আর তাদের মতে, গবেষণামূলক মাসআলার ব্যাপারে মতবিরোধকারী ব্যক্তিকে নিন্দা ও আক্রমণ করার বিষয়টি বর্জন করার মাঝে এবং সেসব মাসআলায় ইলমী (জ্ঞানগত) পর্যালোচনা, বিপক্ষের দলীলের দুর্বলতা বর্ণনা ও তার মাযহাব (মত) অনুসরণ করা থেকে সতর্ক করার মাঝে কোনো বিরোধ বা দ্বন্দ্ব নেই।
•    আর সত্য ফারাসাত বা অন্তর্দৃষ্টির (বাস্তব অভিজ্ঞতার) বিষয়টি সত্য।
•    আর ভালো স্বপ্নের বিষয়টিও সত্য।
•    তবে এ সবকিছু গ্রহণের উৎস বা শরী‘আতের তথ্যের অন্তর্ভুক্ত নয়।
•    আর আল্লাহর ওলীগণের ‘কারামত’-এর (অলৌকিক ঘটনার) বিষয়টি সত্য।
•    আর সর্বোত্তম ‘কারামত’ হলো আনুগত্য ও দৃঢ়তা ব্যাপারে নিরবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা।
•    আর অলৌকিক কিছু ঘটলেই আল্লাহর ‘বেলায়েত’ প্রাপ্তিকে বুঝায় না।
•    আর প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তিই, তার মধ্যে যে তাকওয়া (আল্লাহর ভয়) ও ঈমান রয়েছে সে পরিমাণে দয়াময় আল্লাহর ওলী।
•    আর সুফীদের মুকাশাফা (খুলে যাওয়া), মুখাতাবাহ (সরাসরি জিজ্ঞেস করা) ইত্যাদি, যদি কেউ দাবী করে, তবে সেটা ঠিক মনে করার কোনো সুযোগ নেই।
•    আর শরী‘আতের উৎসকে ওহী থেকে প্রবৃত্তি বা খেয়াল-খুশির দিকে স্থানান্তর করাটা বিদ‘আত ও নাস্তিকতার ভয়াবহ পথগুলোর অন্যতম একটি পথ।
•    আর দীনের ব্যাপারে জ্ঞান ও বুদ্ধির পরিপূর্ণতা আসে ইলম ও আমলের যৌথ সমন্বয়ে। আর ইলম, আমল, ধৈর্য ও দৃঢ়বিশ্বাসের দ্বারা অর্জিত হয় দীন বিষয়ক নেতৃত্ব।
•    আর সামগ্রিকভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পদ্ধতি পালন করা, বিশেষ করে ঈমান বিষয়ক মাসআলাসমূহ সাব্যস্ত ও নিশ্চিত করার ফলে পূর্ববর্তী সৎ বান্দাগণের সাথে সম্পর্কের দাবি করাটা যথাযথ বলে প্রমাণিত হবে, সকলকে একই সারিতে সারিবদ্ধ করবে, সকলকে এক কথার ওপর ঐক্যবদ্ধ করবে, সঠিক বিষয় ও সিদ্ধান্তের পরিমাণ বেড়ে যাবে, ভুলের পরিমাণ কমে যাবে, ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে নিশ্চিত করবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তি ও সফলতা অর্জিত হবে।

 

 

 

 

 

দ্বিতীয় অধ্যায়
(حقيقة الإيمان و أركانه)
ঈমানের প্রকৃত রূপ ও তার মূল উপাদানসমূহ

 

 

 

 

দ্বিতীয় অধ্যায়
প্রথম পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমানের স্বরূপ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: ইসলাম ও ঈমানের মধ্যে সম্পর্ক
তৃতীয় পরিচ্ছেদ: ঈমানের স্তরসমূহ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ: ঈমানের মধ্যে ইস্তিসনা করা
পঞ্চম পরিচ্ছেদ: কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির বিধান
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ: কিবলার অনুসারীর ব্যাপারে বিধান
সপ্তম পরিচ্ছেদ: ঈমানের শ্রেণিবিভাগ ও তাওহীদের প্রকারভেদ
অষ্টম পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বের ওপর ঈমানের দলীলসমূহ
নবম পরিচ্ছেদ: প্রভুত্বের গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যসমূহের ওপর ঈমান
দশম পরিচ্ছেদ: আল্লাহর নামসমূহ ও গুণাবলী’র ওপর ঈমান
একাদশ পরিচ্ছেদ: আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মূলনীতি
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ: আল্লাহর মহান গুণাবলীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মূলনীতি
তৃয়োদশ পরিচ্ছেদ: আল্লাহর নামসমূহ ও গুণাবলীর ওপর ঈমানের ফলাফল
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ: এককভাবে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ‘উলূহিয়্যাত’ তথা ইবাদত সাব্যস্ত করা
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ: ‘উলূহিয়্যাত’ একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের ওপর ঈমানের ফলাফল
ষোড়শ পরিচ্ছেদ: ফিরিশতাগণের ওপর ঈমান
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ: জিন্ন জাতির অস্তিত্বের ওপর ঈমান
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নাযিলকৃত কিতাবসমূহের ওপর ঈমান
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ: রাসূলগণের ওপর ঈমান
বিংশ পরিচ্ছেদ: রাসূলগণের অধিকার প্রশ্নে যা আবশ্যক, বৈধ ও নিষিদ্ধ
একবিংশ পরিচ্ছেদ: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্য ও অধিকারসমূহ
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ: আখেরাতের ওপর ঈমান
ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ: তাকদীর ও ফয়সালার ওপর ঈমান

 

দ্বিতীয় অধ্যায়
(حقيقة الإيمان و أركانه)
ঈমানের প্রকৃত রূপ ও তার মূল উপাদানসমূহ
•    আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর ফিরিশতাগণ, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ, আখেরাত এবং তাকদীরের ভালো ও মন্দের প্রতি ঈমান স্থাপন করা মুসলিমগণের আকিদা-বিশ্বাস। যারা সর্বশেষ নবী ও রাসূলগণের নেতা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের অনুসারী, এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য একই রকম এবং তাদের ইমামগণ এ ব্যাপারে একমত। আর তাদের পরবর্তীগণ তাদের পূর্ববর্তীগণের মধ্য থেকে তা অর্জন করেছেন।
•    শরী‘আতের বিধান পালন করার মতো উপযুক্ত ব্যক্তিগণের জন্য প্রথম ওয়াজিব (আবশ্যকীয়) কাজ হলো আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং ‘শাহাদাতাঈন’  এর মাধ্যমে তার ঘোষণা প্রদান করা।
•    আর মুমিনগণ হলেন আল্লাহর বন্ধু, তিনি তাদেরকে ভালোবাসেন এবং তারাও তাঁকে ভালোবাসে, আর তিনি তাদেরকে রক্ষা করেন। ফলে তিনি তাদেরকে সাহায্য করেন এবং তারাও তাঁকে সাহায্য করে, আর তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে এবং তারাই সুপথপ্রাপ্ত।
•    আর ঈমান ও তা বিনষ্টকারী বিষয় সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে দলীল হলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বর্ণনা।
•    আর শরী‘আতসম্মত ঈমান: তার মানে- ঈমান এমন এক বিষয়ের নাম, যার শাখা ও প্রশাখা রয়েছে; যার রয়েছে সর্বনিম্ন শাখা ও সর্বোচ্চ শাখা। সুতরাং তার সর্বোচ্চ শাখা হলো: لا إله إلا الله (অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই), আর সর্বনিম্ন শাখা হলো ‘রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা’। আর ‘ঈমান’ নামটি যেমনিভাবে তার সকল শাখা-প্রশাখার সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়, ঠিক তেমনিভাবে তার কিছু কিছু শাখা-প্রশাখার সাথেও সম্পর্কযুক্ত হয়।
•    আর ঈমান হলো বিশ্বাস, কথা ও কাজ, আর ঈমানের কিছু অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিষয় রয়েছে।
•    সুতরাং অভ্যন্তরীণ বিষয় হলো: যা অন্তরের মধ্যে অবস্থান করে এবং এটাই হলো ঈমানের আসল।
•    আর বাহ্যিক বিষয় হলো: যা মানুষের মুখ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা প্রকাশ পায়।
•    আর অভ্যন্তরীণ ঈমান (الإيمان الباطن) দুই ধরনের: কথা ও কাজ:
•    প্রথমত: মনের কথা (قول القلب): আর তা হলো জানা, সমর্থন করা, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করা।
•    দ্বিতীয়ত: মনের কাজ (عمل القلب): আর তা হলো আল্লাহর প্রতি আন্তরিকতা, একনিষ্ঠতা ও সম্মান প্রদর্শন; তাঁকে গ্রহণ করা, মেনে নেওয়া, স্বীকৃতি দেওয়া ও তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণ করা; তাঁর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা, তাঁকে ভয় করা, তাঁর নিকট আশা করা, তাঁকে ভালোবাসা ও লজ্জা করা। তাঁকে বড় মনে করা ও ভয় করা, তাঁর নিকট নত হওয়া ও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, ধ্যান করা, ধৈর্য ও সততার নীতি অবলম্বন করা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তাঁর প্রতি আনুগত্য, ভয়-ভীতি, বিশ্বাস ও তাওবা বা প্রত্যাবর্তন। তাঁর ওপর ভরসা করা এবং তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা ইত্যাদি।
•    আর অন্তরের কাজগুলো হলো প্রতিটি ভালো কাজের মূল এবং তার থেকেই প্রত্যেকটি সৎকাজের প্রকাশ ঘটে, আর তা বান্দার ওপর আবশ্যক ও অপরিহার্য এবং আখেরাতে তা সবচেয়ে উপকারী ও প্রতিদানযোগ্য।
•    আর যখন মনের কথা অথবা কাজ সামগ্রিকভাবে চলে যাবে, তখন সামগ্রিকভাবে ঈমানও চলে যাওয়ার ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত একমত।
•    আর অন্তরের মধ্যে যে ঈমান থাকবে, মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের জন্য সেটাই হল আসল বা মূল (চালিকা শক্তি)।
•    আর বাহ্যিক ঈমান (الإيمان الباطن) দুই প্রকারের: কথা ও কাজ:
•    প্রথমত: মুখের কথা (قول اللِّسان): আর তা হলো-   أشهد أن لا إله إلا الله ، وأشهد أن محمدا عبده ورسوله (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল)- এ বলে সাক্ষ্য দেওয়ার মাধ্যমে এবং তা যা দাবি করে তার দ্বারা সেগুলোর স্বীকৃতি প্রদান করা।
•    আর তার অর্থ হলো: ইবাদতকে শুধু আল্লাহর জন্য ঠিক করে নেওয়া, তিনি ভিন্ন অন্য কারও জন্য নয়। আর আনুগত্য ও অনুসরণকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সুন্নাহর জন্য নির্দিষ্ট করা, যাতে তাঁর বক্তব্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা হয় এবং তাঁর শরী‘আতের প্রতি আত্মসমর্পণ করা হয়।   
•    সুতরাং যে ব্যক্তি তার মুখের দ্বারা স্বীকার করল এবং তার অন্তর দ্বারা তা অস্বীকার করল, সে ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে মুসলিম হবে এবং অভ্যন্তরীণভাবে মুনাফিক বলে গণ্য হবে।
•    মুখের কথার আরও কতগুলো (ومن قول اللِّسان) দিক হলো: দো‘আ (الدعاء), যিকির (الذكر), হামদ বা প্রশংসা (الحمد), শুকর বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ (الشكر), ইস্তি‘আযা বা আশ্রয় প্রার্থনা করা (الاستعاذة), ইস্তিগাছা বা ফরিয়াদ (الاستغاثة), সৎ কাজের আদেশ দেওয়া, অসৎ কাজে নিষেধ করা, কুরআন তিলাওয়াত করা, শিক্ষা প্রদান করা ইত্যাদি।
•    দ্বিতীয়ত: অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের কাজ (عمل الجوارح): তা হলো সালাত, যাকাত, সাওম, হজ, জিহাদ, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা, পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা, দাওয়াত দান, বিচার ফয়সালার কাজ করা, আদব রক্ষা করে চলা, ইত্যাদি।
•    আর যেমনিভাবে যে ব্যক্তির ভিতরগত ঈমান নেই তার বাহ্যিক ঈমান কোনো উপকারে বা কাজে লাগবে না, যদিও তার দ্বারা জীবনের নিরাপত্তা হবে এবং সম্পদ সুরক্ষার ব্যবস্থা হবে; ঠিক অনুরূপভাবে যে ব্যক্তির বাহ্যিক ঈমান নেই তার ভিতরগত ঈমান তার জন্য যথেষ্ট হবে না; কিন্তু যখন কোনো অক্ষমতার কারণে বা বল প্রয়োগ করার কারণে অথবা ধ্বংসের আশঙ্কার কারণে (বাহ্যিকভাবে ঈমান প্রকাশ করা) তার পক্ষে অসম্ভব হয়, তখনকার বিষয়টি ভিন্ন। সুতরাং কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকা সত্ত্বেও আমল করা থেকে বিরত বা পিছিয়ে থাকাটা প্রমাণ করে যে, তার ভিতরটা নষ্ট এবং ঈমানশূণ্য।
•    আর যখন প্রয়োজনীয় বিষয় তথা ঈমান বিদ্যমান থাকবে এবং কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকবে, তখন অবশ্যই তার কিছু প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
(العلاقة بين الإسلام و الإيمان)
ইসলাম ও ঈমানের মধ্যে সম্পর্ক
•    ইসলাম (الإسلام) ও ঈমান (الإيمان) শব্দদ্বয় যখন সাধারণভাবে ও পৃথকভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন উভয়টি সমার্থবোধক, আর যখন একত্রে অথবা নির্দিষ্ট বা শর্তযুক্তভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন উভয়টি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রদান করে। সুতরাং ইসলাম হলো বাহ্যিক কথা ও কাজ সমষ্টির নাম। আর ঈমান হলো অভ্যন্তরীণ আকিদা-বিশ্বাস ও কর্মসমূহের নাম, আর আবশ্যক হলো বান্দার মধ্যে উভয়টির সমাবেশ ঘটানো। অতএব, ঈমান ব্যতীত ইসলাম যথেষ্ট নয়, আর ইসলাম ছাড়াও ঈমান যথেষ্ট নয়।
•    আর দীনের তিনটি পর্যায় বা স্তর। তার প্রথমটি হলো: ‘ইসলাম’ আর দ্বিতীয় স্তর হলো: ‘ঈমান’ এবং তৃতীয় স্তর হলো অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসসমূহ ও বাহ্যিক আমলসমূহের মধ্যে ‘ইহসান’ তথা কাজের সুসম্পাদন।  

তৃতীয় পরিচ্ছেদ
(مراتب الإيمان)
ঈমানের স্তরসমূহ
•    আর ঈমানের মূলবিষয় যখন পুরাপুরিভাবে বিশ্বাস ও আত্মসমর্পন এবং বিশেষভাবে ‘গায়েব’ তথা অদেখা বিষয়াবলীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, তখন তার পরিপূর্ণতার জন্য আবশ্যক হলো: ঈমানের রুকনসমূহ ও যাবতীয় ফরয বিষয়গুলো পালন করা এবং কবীরা গুনাহসমূহ ও যাবতীয় হারাম বিষয়গুলো বর্জন করা। আর তার পরিপূর্ণতার জন্য মুস্তাহাব হলো: মুস্তাহাব বা পছন্দনীয় কাজগুলো সম্পাদন করা, ‘মাকরূহ’ বা অপছন্দনীয় বিষয়গুলো পরিহার করা এবং যাবতীয় সন্দেহযুক্ত বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকা।
•    আর অন্তর, মুখ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আনুগত্যের দ্বারা ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবাধ্য আচরণের কারণে ঈমানের ঘাটতি হয়। সুতরাং ঈমানের কতগুলো স্তর ও পর্যায় রয়েছে।
তার প্রথম স্তর হলো: এমন ঈমান, যা জাহান্নামের মধ্যে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করা থেকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে, আর ঈমানের এ স্তরটিকে বলা হয়  أصل الإيمان(মূল ঈমান) অথবা مطلق الإيمان  (নামমাত্র ঈমান) অথবা الإيمان المجمل (মোটামুটি ঈমান), আর তার হকীকত হলো: একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য ইবাদত করা। সুতরাং ইবাদতের সকল আনুষ্ঠানিকতা শুধু তাঁর উদ্দেশ্যেই হবে, আর আনুগত্য ও আত্মসমর্পনের দ্বারা এককভাবে তাঁকেই পাওয়ার উদ্দেশ্য হবে। অতএব, হালাল ও হরামের প্রশ্নে শুধু তাঁরই শরণাপন্ন হতে হবে, যদিও এ স্তরের ঈমানদার ব্যক্তি স্বীয় নাফসের প্রতি যুলুম করে তারা আবশ্যকীয় দায়িত্ব পালনে ত্রুটি করে এবং অন্যায় কাজে প্রলুব্ধ হয়; যতক্ষণ সে ঈমান বিনষ্টকারী বিষয় থেকে বিরত থাকবে, (ততক্ষণ সে এ স্তরের মুমিন বলে গণ্য হবে)।       
আর ঈমানের মধ্যম স্তর হলো: এমন ঈমান, যা জাহান্নামে প্রবশে করতে দেবে না, আর ঈমানের এ স্তরটিকে বলা হয় الإيمان الواجب (আবশ্যকীয় বা বাধ্যতামূলক ঈমান) অথবা الإيمان المطلق (পূর্ণ ঈমান) অথবাالإيمان المفصل  (বিস্তারিত বা ব্যাপক ঈমান)।
•    আর এ প্রকারের ঈমান مطلق الإيمان (নামমাত্র ঈমান)-কে অন্তর্ভুক্ত করে এবং সাথে অতিরিক্ত আবশ্যকীয় কাজ সম্পাদন করা ও নিষিদ্ধ কাজসমূহ বর্জন করার বিষয়টিকেও অন্তর্ভুক্ত করে, আর এটা হলো তার আবশ্যকীয় পরিপূর্ণতা বা পরিপূরক আর মর্যাদার ক্ষেত্রে এ পর্যায়ের ঈমানদার ব্যক্তি কয়েক স্তরে বিন্যস্ত।
•    আর মধ্যম স্তরের ঈমানদার ব্যক্তির প্রথম মানযিল বা আবাসস্থল হলো জান্নাত। সুতরাং সে কখনও জাহান্নামে প্রবেশ করবে না।
•    আর الإيمان المطلق (পূর্ণাঙ্গ ঈমান)-এর অনুপস্থিতি مطلق الإيمان (নামমাত্র ঈমান) না থাকার বিষয়টিকে আবশ্যক করে না।    
আর ইমানের সর্বোচ্চ স্তর হলো: এমন ঈমান, যা তার অধিকারীকে ব্যক্তিকে জান্নাতের মধ্যে মর্যাদা উন্নত করার ব্যবস্থা করবে, আর ঈমানের এ স্তরটিকে বলা হয় الإيمان المستحب (মুস্তাহাব ঈমান) অথবা  الإيمان الكامل بالمستحبات  (মুস্তাহাবসমূহ দ্বারা পূর্ণাঙ্গ ঈমান)।
•    আর এ স্তরের মুমিনের মধ্যে দাবি করা হয় الإيمان المطلق (পূর্ণাঙ্গ ঈমান)-এর বাস্তব উপস্থিতি এবং সাথে আরও অতিরিক্ত থাকবে মুস্তাহাব কাজসমূহ যথাযথভাবে পালন করা এবং মাকরূহ বা অপছন্দনীয় বিষয়গুলো থেকে আত্মরক্ষা করা, আর এটা হলো তার মুস্তাহাব পরিপূর্ণতা।
•    আর সর্বোচ্চ স্তরের ঈমানদার ব্যক্তি কল্যাণের কাজে অগ্রগামী হয়ে পৌঁছে যাবেন জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে।
•    আর ঈমানের এসব স্তরের স্বপক্ষে দলীল হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী, তিনি বলেন,
﴿ثُمَّ أَوۡرَثۡنَا ٱلۡكِتَٰبَ ٱلَّذِينَ ٱصۡطَفَيۡنَا مِنۡ عِبَادِنَاۖ فَمِنۡهُمۡ ظَالِمٞ لِّنَفۡسِهِۦ وَمِنۡهُم مُّقۡتَصِدٞ وَمِنۡهُمۡ سَابِقُۢ بِٱلۡخَيۡرَٰتِ﴾ [فاطر: ٣٢]
“তারপর আমরা কিতাবের অধিকারী করলাম তাদেরকে, যাদেরকে আমাদের বান্দাদের মধ্য থেকে আমরা মনোনীত করেছি, তবে তাদের কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যমপন্থী এবং কেউ কল্যাণের কাজে অগ্রগামী।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ৩২]
সুতরাং প্রথমত ‘মুসলিম’ সাধারণ ঈমানের অধিকারী ব্যক্তি। আর দ্বিতীয়ত ‘মুমিন’ পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অধিকারী ব্যক্তি। আর তৃতীয়ত ‘মুহসিন’ সকল মুস্তাহাব কাজ সম্পাদন করার সাথে সাথে পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী ব্যক্তি।
 
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
(الاستثناء في الإيمان)
ঈমানের মধ্যে ইস্তিসনা বা শর্তারোপ করা
•    ঈমানের মধ্যে ইস্তিসনা করার মানে হলো:  أنا مؤمن إن شاء الله (আল্লাহ চাহেত আমি মুমিন) একথা বলা।
•    আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অধিকাংশ আলেম আত্মিক পবিত্রতা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এবং আল্লাহর ভয়ের কারণে الإيمان المطلق (পূর্ণাঙ্গ ঈমান)-এর ক্ষেত্রে ইস্তিসনা বা শর্তারোপ করাকে বৈধ করেছেন। তবে তারা مطلق الإيمان (নাম মাত্র ঈমান)-এর ক্ষেত্রে তা (ইস্তিসনা করাকে) নিষেধ করেছেন; যদি তা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সন্দেহের কারণে হয়।
•    তাছাড়া মিল্লাতের অনুসারীদের মধ্যে যারা ‘ঈমানের সুদৃঢ় দাবিদার’, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিকট তারা মুসলিম বলে গণ্য।   

পঞ্চম পরিচ্ছেদ
(حكم مرتكب الكبيرة )
কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির বিধান
•    কবীরা গুনাহ জাহেলী কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত, আর তা ঈমানের ক্ষত সৃষ্টিকারী ও তার ঘাটতির কারণ। আর কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি ফাসিক (পাপাচারী)।
•    আহলে কিবলা’র ফাসিক ব্যক্তি পূর্ণ ঈমানের অধিকারী (পূর্ণ মুমিন) বলার উপযুক্ত নয়; বরং তার সাথে শুধু নামমাত্র ঈমানের অস্তিত্ব রয়েছে।
•    আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ইমামগণ নাম ও বিধানের ক্ষেত্রে অংশবিশেষ সাব্যস্তকরণের পক্ষে। সুতরাং (ফাসিক) ব্যক্তির সাথে ঈমানের আংশিক প্রযোজ্য হবে, সম্পূর্ণটা প্রযোজ্য হবে না, আর তার জন্য ঈমানদারগণের বিধান ও সাওয়াবের ততটুকু সাব্যস্ত হবে, যতটুকু তার সাথে বিদ্যমান আছে; যেমনিভাবে তার জন্য ততটুকু শাস্তি বরাদ্দ হবে, যতটুকু সে অমান্য করেছে।
•    আর আহলে কিবলা তথা কিবলার অনুসারী কেনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো গুনাহের কারণে কাফির বলে গণ্য হবে না, যতক্ষণ না সে এমন কোনো অপরাধের সাথে জড়িত হবে, যা ঈমানকে বিনষ্ট করে দেয়ে।
•    আর কবীরা গনাহ’র সাথে জড়িত ব্যক্তিগণ (কিয়ামতের দিন) ‘শাফা‘আত’ লাভ করবে, আর তারা (আল্লাহর) ইচ্ছার অধীনে থাকবে, আর কখনও কখনও তাদের একত্ববাদের প্রতি বিশ্বাসের কারণে অথবা পাপ মোচনকারী সৎকাজের কারণে অথবা গুনাহ মাফকারী বিপদ-মুসীবতের কারণে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন, আর এ সবকিছুই শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ ও দয়া।
•    আর কবীরা গুনাহের অপরাধে অপরাধীগণের মধ্য থেকে যাকে তার গুনাহ’র কারণে শাস্তি দেওয়া হবে, তা তো হবে একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত; সে জাহান্নামে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে না।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
(الحكم على أهل القبلة)
কিবলার অনুসারীর ব্যাপারে বিধান
•    আর যে ব্যক্তি কিবলামুখী হয়ে সালাত আদায় করে, সে মুসলিম মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত, তার পেছনে সালাত আদায় করা যাবে এবং (মারা গেলে) তার জন্য জানাযা’র সালাত আদায় করা হবে, আর বাহ্যিকভাবে তার জন্য ইসলামের সকল প্রশাসানিক ব্যবস্থা প্রযোজ্য হবে এবং তার অভ্যন্তরীণ অবস্থার দায়-দায়িত্ব একান্তভাবে আল্লাহ তা‘আলা সংরক্ষণ করবেন।
•    আর যে ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে ইসলাম পালন করে, তার অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা অথবা তার ইসলামের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা বিদ‘আত।
•    আর শরী‘আতের নির্ভরযোগ্য কোনো দলীল ছাড়া আমরা কিবলার অনুসারীগণের কাউকে জান্নাতে বা জাহান্নামে ফেলে দেই না, আর আমরা সৎকর্মশীল ব্যক্তির জন্য আশাবাদী, তাকে আমরা সুসংবাদ শুনাই কিন্তু তাকে নিশ্চয়তা দেই না, আর পাপী ও অপরাধীর ব্যাপারে আমরা অশঙ্কা করি; কিন্তু আমরা তাকে নিরাশ করি না।
•    আর আমলের ভালো-মন্দ নির্ভর করে তার শেষ অবস্থার ওপর।
•    এমন প্রত্যেক ব্যক্তি, যার নিকট দা‘ওয়াত পৌঁছেনি, তার ওপর (শরী‘আতের) দলীল-প্রমাণ প্রযোজ্য হয় নি, আর সে হবে ‘আহলে ফাতরাত’ তথা ওহীর শিক্ষাবঞ্চিত লোকদের অন্তর্ভুক্ত, তাদেরকে আখেরাতে পরীক্ষা করা হবে; যার মাধ্যমে আল্লাহর পুর্ব নির্ধারিত সৌভাগ্যবান বা হতভাগ্য হওয়া প্রকাশ পাবে।
•    মুমিনগণের শিশুদের মধ্যে যে মারা যাবে, সর্বসম্মতিক্রমে সে জান্নাতে যাবে, আর মুশরিকগণের শিশুদের মধ্য থেকে যে মারা যাবে, তার ব্যাপারে আলেমগণের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে।

সপ্তম পরিচ্ছেদ
(أبواب الإيمان و أقسام التوحيد)
ঈমানের শ্রেণিবিভাগ ও তাওহীদের প্রকারভেদ
•    আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনার অন্তর্ভুক্ত হবে, আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্ব, তাঁর ‘ওয়াহদানিয়্যাত’ (একত্ববাদ), ‘রুবূবিয়্যাত’ (প্রভুত্ব), সুন্দর সুন্দর নাম, মহান গুণাবলী এবং তাঁর ‘উলুহিয়্যাত’ এর প্রতি ঈমান আনার বিষয়সমূহ।
•    আর তাওহীদ বা একত্ববাদ হলো এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তা‘আলাকে এক ও একক, তাঁর সত্ত্বা, নামসমূহে; সুতরাং তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। তিনি তাঁর গুণাবলীতেও একক; সুতরাং তাঁর মতো কেউ নেই, তিনি স্বীয় কার্যাবলীতেও একক; সুতরাং তাঁর কোনো তুলনা নেই, তিনি ইবাদতের হকদার হিসেবেও একক। কেবল তিনিই সকল ইবাদাতের হকদার, সুতরাং তাঁর কোনো শরীক নেই। তাই যে নির্দেশ তিনি দিয়েছেন কেবল তাঁর আনুগত্য ও ইবাদত করা, এবং যে ব্যাপারে তিনি নিষেধ করেছেন এবং হুমকি প্রদান করেছেন তা থেকে বিরত থাকা,।
•    আর ঈমান ও তাওহীদের সমন্বয় সাধনকারী বিষয় হচ্ছে, বান্দা শুধু তার রবের উদ্দেশ্যে তার অন্তর দ্বারা বিশ্বাসসমূহ লালন করবে, তার মুখে বিশ্বাসের কথাগুলো উচ্চারণ করবে এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা বিশ্বাস নিঃসৃত কাজগুলো সম্পাদন করবে।
•    আর যখন ঈমান ও তাওহীদের প্রকৃতরূপ সুপ্ত থাকে (আল্লাহ ও রাসূল থেকে প্রাপ্ত) সংবাদকে বিশ্বাস করা, মেনে নেওয়া ও নির্দেশ বাস্তবায়ন করার মধ্যে, তখন যথাযথ ও যুক্তিযুক্ত হবে তাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দু’টি রুকন বা ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা: এক প্রকারের সম্পর্ক থাকবে (আল্লাহ ও রাসূল থেকে প্রাপ্ত) খবরসমূহ বিশ্বাস করা, জানা ও সাব্যস্তকরণের সাথে, আর অপর প্রকারের সম্পর্ক থাকবে আনুগত্য করার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করার সাথে।
•    আর যখন রুবূবিয়্যাতের গুণাবলীর সাথে আল্লাহ তা‘আলাকে এককভাবে সুনির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে ত্রুটি হয়, তাঁর মহান নামসমষ্টি ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে অবিশ্বাসের জন্ম হয় এবং আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের ব্যাপারে শির্ক ও বিদ‘আতের প্রকাশ ঘটে, তখন পূর্ববর্তী বিজ্ঞ আলেমগণ প্রতিটি দিক ও বিভাগের ব্যাপারে জবাব দানে মনোযোগ দেন এবং প্রতিটি বিষয়ে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করার ব্যাপারে যত্নবান হন।
•    আর শরী‘আতের বক্তব্যসমূহ যথাযথ অনুসন্ধান, সুন্দরভাবে সাজানো ও যথার্থ বিন্যাসের দাবী হচ্ছে, ঈমান ও তাওহীদ প্রসঙ্গে মোটামুটিভাবে দু’টি বাব বা অধ্যায়ের ব্যবস্থা থাকবে:
‘জ্ঞানগত তথ্যভিত্তিক আল্লাহর একত্ববাদ’ (التوحيدُ العلميُّ الخبريُّ) ও
‘উদ্দেশ্যমূলক কাঙ্ক্ষিত একত্ববাদ’ (التوحيدُ القصديُّ الطلبيُّ) বিস্তারিতভাবে যাতে থাকবে তিনটি বাব বা অধ্যায়:
‘রুবূবিয়্যাতের ব্যাপারে আল্লাহর একত্ববাদ’ (التوحيد في الربوبية),
‘উলূহিয়্যাত তথা ইবাদতের ব্যাপারে আল্লাহর একত্ববাদ (التوحيد في الألوهية) ও
‘নামসমষ্টি ও গুণাবলীর ব্যাপারে আল্লাহর একত্ববাদ (التوحيد في الأسماء و الصفات),
প্রকৃতপক্ষে এগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, ওৎপ্রোতভাবে জড়িত এবং আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী বান্দার হৃদয়ে এগুলো একত্রিত ও অবিচ্ছিন্নভাবেই অবস্থান করে।
•    আর যেমনিভাবে গ্রন্থনাটি তাওকীফী বা কুরআন ও হাদীসের ভাষ্য দ্বারা সরাসরি নির্ধারিত নয়, তেমনিভাবে ঈমান ও তাওহীদের মধ্যেও সংখ্যা নিরূপণ করার মত কিছু নেই; বরং এখানে বিবেচ্য বিষয় হলো উদ্দেশ্য ও অর্থগত তাৎপর্য, শব্দ ও শব্দকাঠামো বা বর্ণমালা উদ্দেশ্য নয়।    

অষ্টম পরিচ্ছেদ
(أدلة الإيمان بوجوده تعالى)
আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বের প্রতি ঈমানের দলীলসমূহ
•    আল্লাহ তা‘আলা হলেন চিরন্তন, শাশ্বত ও অনাদি; সুতরাং অস্তিত্বহীনতা তাঁকে পায়নি। তিনি চিরস্থায়ী; সুতরাং ধ্বংস বা বিনাশ তাঁকে স্পর্শ করতে পারবে না। কারণ, আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বের বিষয়টি সত্তাগত এবং এ ব্যাপারে অনেক দলীল-প্রমাণ রয়েছে, যা সংখ্যায় অগণিত এবং সীমার বেষ্টনের বাইরে; যার সূচনা অণু পরমাণু থেকে এবং যার শেষ হয় না সবচেয়ে বড় ছায়াপথ (Galaxy) এর কাছে গিয়েও, আর এসব দলীল-প্রমাণ বিভিন্ন শ্রেণি ও প্রকারের। যেমন,
দলীল (১) : সরল সঠিক স্বভাব-প্রকৃতি:
•    কেননা, আল্লাহ সম্পর্কে জানার বিষয়টি হলো সর্বপ্রথম কাজ, স্পষ্টতর স্বীকৃত বিষয় এবং সুপ্রতিষ্ঠিত জরুরি বিষয়।
•    আর মৌলিকভাবে ঈমান হলো স্বভাবজাত বিষয়, আল্লাহ প্রদত্ত উপহার এবং অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ».
“প্রত্যেক সন্তান জন্মগ্রহণ করে স্বভাবধর্মের ওপর।”  আর তার (ঈমানের) বিস্তারিত বিষয়গুলো নির্ভর করে ওহী ভিত্তিক জ্ঞানের ওপর।
•    আর আমল ও চিন্তা-গবেষণার দ্বারা ঈমান বৃদ্ধি পায়।
•    আর রাসূলগণ বান্দাদেরকে শুধু ঐসব বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করেন, যা তাদের স্বভাব-প্রকৃতির মাঝে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে এবং তাদেরকে সে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেন, যে বিষয়ের ওপর তাদের অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছে। আর তারা তাদেরকে আহ্বান করেন তার পরিণাম ও তাৎপর্যের দিকে বিস্তারিত ও পরিপূর্ণভাবে।  
দলীল (২) : বিবেকের সুস্পষ্ট নির্দেশনা:
•    কারণ, বিবেকের স্বতঃস্ফূর্ততা দাবি করে যে, কোনো বস্তুর পক্ষে নিজেকে সৃষ্টি করা অসম্ভব, যেমনিভাবে স্রষ্টা ছাড়া কোনো বস্তুর অস্তিত্ব অসম্ভব। যেমনিভাবে যে কেউ স্বীকার করবে যে, অস্তিত্বহীন বস্তু কোনো কিছু সৃষ্টি করতে পারে না এবং বস্তুহারা ব্যক্তি তা দিতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَمۡ خُلِقُواْ مِنۡ غَيۡرِ شَيۡءٍ أَمۡ هُمُ ٱلۡخَٰلِقُونَ ٣٥﴾ [الطور: ٣٥]  
“তারা কি স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি হয়েছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা?” [সূরা আত-তূর, আয়াত: ৩৫]
•    আর বিবেক-বুদ্ধি দাবি করে যে, প্রত্যেক সৃষ্টিরই একজন স্রষ্টা আছে। আর যেমনিভাবে শিল্প বা কাজ তার শিল্পী বা কারিগরের বৈশিষ্ট্যর প্রতি নির্দেশনা প্রদান করে। তেমনিভাবে নিখুঁত বিশ্বজগতের সৃষ্টি তার স্রষ্টা ও উদ্ভাবকের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর প্রতি নির্দেশনা প্রদান করে।
দলীল (৩) : বিভিন্ন জাতির ঐকমত্য বা ঐক্যবদ্ধ রায়:
•    আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে চরম মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও, কারও কাছ থেকেই আল্লাহর অস্তিত্বকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা তো দূরের কথা, সকল সৃষ্টিকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সৃষ্টি করার ব্যাপারে তাঁর শরীক বা অংশীদার এবং গুণাবলীর ব্যাপারে তাঁর মত কোনো কিছু সাব্যস্তকরণের মতো কোনো একটি বর্ণনাও বর্ণিত হয় নি। আর প্রত্যেক ভাষায় ও প্রতিটি সৃষ্টির মুখেই উচ্চারিত হয় ‘আল্লাহ’ নামটি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَفِي ٱللَّهِ شَكّٞ﴾ [ابراهيم: ١٠]  
“আল্লাহ সম্বন্ধে কি কোনো সন্দেহ আছে?” [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ১০]
দলীল (৪) : আল্লাহর দৃশ্যমান নিদর্শনসমূহ:
•    কারণ, এ সৃষ্টির অস্তিত্ব ও তার অপূর্ব সামঞ্জস্যতা (আল্লাহ অস্তিত্বের) সুস্পষ্ট দলীল, আর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে যথাযথ পরিমাপ ও পরিমাণে নিরূপন করাটা তাঁর অস্তিত্বের উজ্জ্বল প্রমাণ এবং প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে তার গন্তব্যের দিকে পরিচালিত করাটা তাঁর অস্তিত্বের সুস্পষ্ট বিবরণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿سَبِّحِ ٱسۡمَ رَبِّكَ ٱلۡأَعۡلَى ١ ٱلَّذِي خَلَقَ فَسَوَّىٰ ٢ وَٱلَّذِي قَدَّرَ فَهَدَىٰ ٣﴾ [الاعلا: ١،  ٣]  
“আপনি আপনার সুমহান রবের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন, যিনি সৃষ্টি করেন, অতঃপর সুঠাম করেন। আর যিনি নির্ধারণ করেন, অতঃপর পথনির্দেশ করেন”। [সূরা আল-আ‘লা, আয়াত: ১-৩]
দলীল (৫) : দুঃখিত ও বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিগণের দো‘আ কবুল করা:
•    কারণ, মুমিন, কাফির, পুণ্যবান ও পাপিষ্ঠ সকলেই অসহায়দের প্রার্থনা কবুল করার বাস্তব সাক্ষী, যখন অসহায়গণ তাদের আকুতি নিয়ে জগতসমূহের রব আল্লাহ তা‘আলার মুখোমুখি হয়। আর প্রত্যেক ফরিয়াদের ক্ষেত্রেই বহুলভাবে তা কবুল হওয়াটা এ দলীলের জন্য শর্ত নয়। কারণ, অনেক সময় কোনো বিধিবদ্ধ প্রতিবন্ধকতার কারণে অথবা তাৎপর্যপূর্ণ অন্তর্নিহিত কার্যকারণে দো‘আ কবুল করা হয় না।
দলীল (৬) : রাসূলগণের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নিদর্শনসমূহ:
•    বিশেষ করে দয়াময় রাহমানের অস্তিত্বের প্রমাণস্বরূপ চিরন্তন মু‘জিযা, আর তা হলো আল-কুরআন, যা মুখে তিলাওয়াত (আবৃত্তি) করা হয়, কর্ণ দ্বারা শ্রবণ করা হয় এবং হৃদয়ে হিফয বা সংরক্ষণ করা হয়।
দলীল (৭) : বর্ণনাভিত্তিক বিশুদ্ধ দলীল:
•    আল্লাহর মতো কিছু আল্লাহকে পরিচয় করিয়ে দেবে না, বরং তিনি তাঁর বান্দাদের নিকট পরিচিত হয়েছেন তাঁর ওহী ও শরী‘আত দ্বারা। আর সকল শরী‘আত এবং সব নবী-রাসূল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে কল্যাণ নিয়ে এসেছেন। (যা আল্লাহর অস্তিত্বের পরিচায়ক)
আর আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বের ব্যাপারে অবিশ্বাস করাটা সৃষ্টিগত স্বভাব ও মেজাযের পরিপন্থী এবং বিবেকের স্বতঃস্ফূর্ততা, বর্ণনাভিত্তিক দলীলের সুস্পষ্টতা ও জাতীয় ঐকমত্য তথা ইজমা‘ বিরোধী।

নবম পরিচ্ছেদ
(الإيمان بصفات الربوبية)
রবের গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রতি ঈমান
•    রবের গুণের সাথে আল্লাহ তা‘আলাকে এককভাবে নির্দিষ্ট করার ব্যাপারে প্রমাণ পেশ করেছে আল-কুরআন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٢﴾ [الفاتحة: ٢]  
“সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সৃষ্টিকুলের রব।” [সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ২]
•    আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়্যতের প্রতি ঈমান আনয়ন করা মানে রবের কার্যাবলীতে ও রুবুবিয়্যতের চাহিদা অনুসারে তাঁর সৃষ্টি, তাকদীর (নিয়তি নির্ধারণ), রাজত্ব এবং ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার বিষয়টি এককভাবে তার জন্য নির্ধারণ করা।
-    আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱللَّهُ خَٰلِقُ كُلِّ شَيۡءٖ وَهُوَ ٱلۡوَٰحِدُ ٱلۡقَهَّٰرُ ١٦﴾ [الرعد: ١٦]    
“আল্লাহ সকল বস্তুর স্রষ্টা, আর তিনি এক, মহা প্রতাপশালী।” [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ১৬]
-    আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿وَقُلِ ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ ٱلَّذِي لَمۡ يَتَّخِذۡ وَلَدٗا وَلَمۡ يَكُن لَّهُۥ شَرِيكٞ فِي ٱلۡمُلۡكِ وَلَمۡ يَكُن لَّهُۥ وَلِيّٞ مِّنَ ٱلذُّلِّۖ وَكَبِّرۡهُ تَكۡبِيرَۢا ١١١﴾ [الاسراء: ١١١]    
“বলুন, সকল প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেন নি, তাঁর সার্বভৌমত্বে কোনো অংশীদার নেই এবং যিনি দুর্দশাগ্রস্ত হন না, যে কারণে তাঁর কোনো অভিভাবকের প্রয়োজন হতে পারে। সুতরাং সসম্ভ্রমে তাঁর মাহাত্ম্য ঘোষণা কর।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ১১১]
-    আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَۚ ﴾ [يونس: ٣١]  
“...তিনি সব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন।” [সূরা ইউনূস, আয়াত: ৩১]
•    আর আল্লাহ তা‘আলার রবুবিয়াতে শির্ক করার বিষয়টি বর্ণনাভিত্তিক ও যুক্তিনির্ভর দলীল দ্বারা বাতিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلۡ أَغَيۡرَ ٱللَّهِ أَبۡغِي رَبّٗا وَهُوَ رَبُّ كُلِّ شَيۡءٖۚ ﴾ [الانعام: ١٦٤]  
“বলুন, ‘আমি কি আল্লাহকে ছেড়ে অন্যকে রব খুঁজব? অথচ তিনিই সবকিছুর রব’।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৬৪]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿مَا ٱتَّخَذَ ٱللَّهُ مِن وَلَدٖ وَمَا كَانَ مَعَهُۥ مِنۡ إِلَٰهٍۚ إِذٗا لَّذَهَبَ كُلُّ إِلَٰهِۢ بِمَا خَلَقَ وَلَعَلَا بَعۡضُهُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٖۚ سُبۡحَٰنَ ٱللَّهِ عَمَّا يَصِفُونَ ٩١﴾ [المؤمنون: ٩١]  
“আল্লাহ কোনো সন্তান গ্রহণ করেন নি এবং তাঁর সাথে অন্য কোনো ইলাহও নেই। যদি থাকত তবে প্রত্যেক ইলাহ স্বীয় সৃষ্টি নিয়ে পৃথক হয়ে যেত এবং একে অন্যের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করত। তারা যে গুণে তাকে গুণান্বিত করে, তা থেকে আল্লাহ কত পবিত্র, মহান!” [সূরা আর-মুমিনূন, আয়াত: ৯১]
•    আর যে ব্যক্তি রুবুবিয়্যাতে তার ঈমানকে খাঁটি ও নির্ভেজাল করতে পারবে, তা তাকে অবশ্যই আল্লাহর ‘উলুহিয়্যাত’ তথা একমাত্র তাঁরই ইবাদতের প্রতি ঈমান গ্রহণের দিকে যেতে বাধ্য করবে। ফলে সে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই আনুগত্য ও ইবাদত করবে।
•    কারণ, শুধু রুবুবিয়্যাতের তথা প্রভুত্বের স্বীকৃতি প্রদান করাটাই শির্ক থেকে মুক্ত থাকা এবং ঈমানের ভিতর প্রবেশ করার জন্য যথেষ্ট নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ ءَالِهَةٗ لَّا يَخۡلُقُونَ شَيۡ‍ٔٗا وَهُمۡ يُخۡلَقُونَ وَلَا يَمۡلِكُونَ لِأَنفُسِهِمۡ ضَرّٗا وَلَا نَفۡعٗا وَلَا يَمۡلِكُونَ مَوۡتٗا وَلَا حَيَوٰةٗ وَلَا نُشُورٗا ٣﴾ [الفرقان: ٣]  
“আর তারা তাঁর পরিবর্তে ইলাহরূপে গ্রহণ করেছে অন্যদেরকে, যারা কিছুই সৃষ্টি করে না; বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট এবং তারা নিজেদের অপকার কিংবা উপকার করার ক্ষমতা রাখে না। আর মৃত্যু, জীবন ও উত্থানের ওপরও কোনো ক্ষমতা রাখে না।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৩]
•    আর যে ব্যক্তি এ ঈমানকে নিশ্চিত করবে এবং আল্লাহকে এককভাবে তাঁর রুবুবিয়্যত তথা প্রভুত্বের ব্যাপারে মেনে নিবে, তা তার জন্য ইবাদতের পথটি মসৃণ করবে, তার বিবেক আলোকিত হবে, হৃদয়-মন প্রশান্ত হবে এবং তাকদীর ও ফয়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। ফলে তার বক্ষ সম্প্রসারিত হবে এবং সে আল্লাহর ওপর ভরসা করবে যথাযথভাবে।

দশম পরিচ্ছেদ
(الإيمان بأسماء الله و صفاته)
আল্লাহর নামসমূহ ও গুণাবলী’র ওপর ঈমান
•    আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জানা হচ্ছে, শ্রেষ্ঠ ‘ইলম’ (জ্ঞান) এবং উৎকৃষ্ট আমল।
•    আর তা-ই হচ্ছে আল্লাহকে জানা, সম্মান করা, মর্যাদা দেওয়া এবং তাঁকে ডাকার পথ বা মাধ্যম।
•    আর তা-ই হচ্ছে ঈমান বৃদ্ধি ও জান্নাতে মর্যাদা বৃদ্ধির অন্যতম উপায়।
•    আর তা-ই হচ্ছে দীন প্রতিষ্ঠা এবং উচ্চপদ মর্যাদা ও ক্ষমতা লাভের প্রধান উপায়।
•    আর তা-ই হচ্ছে আধ্যাত্মিক পথের অনুসারীগণের জন্য সৎকর্মশীলগণের নৈতিক চরিত্রের মানে উন্নিত হওয়ার সিঁড়ি।
•    আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আল্লাহর নামসমূহ ও তাঁর সুমহান গুণাবলীর ওপর ঈমান রাখে।
•    আর সৃষ্টিকুলের কারো সাথে তাঁদের রবকে সামঞ্জস্যশীল সাব্যস্ত করা থেকে মুক্ত থাকেন।
•    আর তারা তাঁর ধরন বা আকৃতি অনুধাবন করার লোভ বা আশা করা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখেন।
•    আর তাঁর মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের সাথে যেসব বাস্তব বিষয় ও অর্থ মানানসই হয়, তারা তা প্রতিষ্ঠা ও নিশ্চিত করেন।
আর এ ব্যাপারে তারা আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١﴾ [الشورا: ١١]
“কোনো কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ১১]-এর দ্বারা দলীল পেশ করেন এবং তার ওপর নির্ভর করেন।
•    আর কতগুলো সুন্দর সুন্দর নাম এবং মহান বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী এককভাবে আল্লাহ তা‘আলার জন্য সাব্যস্ত করে প্রমাণ পেশ করেছে আল-কুরআনুল কারীম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَا﴾ [الاعراف: ١٨٠]
 “আর আল্লাহর জন্যই রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব, তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাক।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৮০]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿وَلَهُ ٱلۡمَثَلُ ٱلۡأَعۡلَىٰ﴾ [الروم: ٢٧]
“আর সর্বোচ্চ গুণাগুণ তো তাঁরই।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ২৭]

একাদশ পরিচ্ছেদ
(قواعد الإيمان بالأسماء الحسنى)
আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মূলনীতি
•    আল্লাহর সকল নামই অতি সুন্দর, চাই সে নামটি এক শব্দে হউক অথবা সংযুক্ত শব্দে হউক অথবা হউক পাশাপাশি কয়েক শব্দের সংমিশ্রণে।
•    আর আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহের প্রতি ঈমান স্থাপন করার বিষয়টি তিনটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে: নামের প্রতি ঈমান, নামের নির্দেশিত অর্থের প্রতি ঈমান এবং নামের চাহিদা ও দাবিকৃত প্রভাবের প্রতি ঈমান। যেমন, সে বিশ্বাস করবে যে, তিনি عليمٌ  (মহাজ্ঞানী), ذو علمٍ محيطٍ (অসীম জ্ঞানের অধিকারী) এবং أنه يُدبّرُ الأمر وفقَ علمه  (তিনি তাঁর জ্ঞান অনুযায়ী সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন)।
•    আমাদের রব আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহ তাওকীফী বা কুরআন-হাদীস নির্ভর। যা পর্যাপ্ত পরিমাণ দলীল-প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত।
•    আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহ দ্বারা নাম সাব্যস্ত করে ও গুণ সাব্যস্ত করে। তবে যখন নাম বুঝায় তখন তা একই সত্তার নাম হিসেবে সমার্থে কিন্তু যখন তা দ্বারা গুণ বুঝায় তখন তাঁর নামসমূহে নিহিত গুণসমূহ ভিন্ন ভিন্ন অর্থবোধক।
•    অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহ তাঁর গুণাবলীর প্রতিও নির্দেশ করে। কারণ, নামগুলো তাঁর কিছু গুণাবালী থেকে নির্গত।
•    আর তাঁর নামের সংখ্যা ৯৯ (নিরানব্বই)-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় এবং তা গণনাকারীগণের গণনায় সীমাবদ্ধ করা যাবে না।
•    আর আল্লাহ তা‘আলার প্রত্যেকটি নামই শ্রেষ্ঠ-মর্যাদাপূর্ণ; কিন্তু সত্যিকার অর্থে সেগুলো শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর।  
•    আর যখন তাঁর কোনো নাম গঠন কাঠামোতে ভিন্ন হয় এবং অর্থের দিক থেকে কাছাকাছি হয়, তখন তা আল্লাহর নামসমূহ থেকে বের হয়ে যায় না।
•    আর এ (নামগুলোর) ক্ষেত্রে অবিশ্বাস বা বিকৃতিকরণ বলে গণ্য হবে-
-    তা সাব্যস্ত ও প্রমাণিত হওয়ার পর অস্বীকার করা
-    অথবা তা যা নির্দেশ করে, তা অস্বীকার করার দ্বারা।
-    অনুরূপভাবে তা গঠন ও তৈরি করার ক্ষেত্রে নতুন মত প্রবর্তন করা দ্বারা
-    অথবা সে নামগুলোকে সৃষ্ট ব্যক্তি বা বস্তুর নাম ও গুণাবলীর সাথে উপমা দেওয়ার দ্বারা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَذَرُواْ ٱلَّذِينَ يُلۡحِدُونَ فِيٓ أَسۡمَٰٓئِهِۦۚ سَيُجۡزَوۡنَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٨٠﴾ [الاعراف: ١٨٠]
“আর যারা তাঁর নাম বিকৃত করে, তাদেরকে বর্জন কর। তাদের কৃতকর্মের ফল অচিরেই তাদেরকে দেওয়া হবে।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৮০]

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
(قواعد الإيمان بالصفات العُلا)
আল্লাহর মহান গুণাবলীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মূলনীতি
•    আল্লাহ তা‘আলার সকল গুণাবলী মহান, প্রশংসনীয়, পরিপূর্ণ এবং তাওকীফী বা কুরআন-হাদীস নির্ভর।
•    আর নামসমূহ থেকে গুণাবলীর বিষয়টি অনেক বেশি প্রশস্ত, আর তার চেয়ে আরও বেশি প্রশস্ত ও ব্যাপক হলো আল্লাহ তা‘আলার নাম ও গুণাবলীর ব্যাপারে কোনো সংবাদ প্রদান। আর আল্লাহ তা‘আলার কর্মসমূহ তার নাম ও গুণ থেকে উত্থিত।
•    আর আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী সম্পর্কে কেউ পুরাপুরিভাবে অবহিত নয় এবং তার ব্যাপারে পরিপূর্ণ কোনো হিসাব বা ধারণাও করে শেষ করা যায় না, আর এগুলো শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর, যা কোনো রকম কমতি বা ঘাটতি দাবি করে না, আর এগুলোর অংশবিশেষের তাফসীর বা ব্যাখ্যা হয় অংশ বিশেষের দ্বারা, যা একরকম হওয়া দাবি করে না।
•    আর গুণাবলীর মধ্যে কিছুগুণ হ্যাঁ-বাচক বা সাব্যস্তকরণের, আবার কিছুগুণ না-বাচক বা অসাব্যস্তকরণের বা নিষেধসুচক, আর সাব্যস্তকৃত গুণাবলীর মধ্যে কিছু হলো নিজস্ব সত্তাগত এবং কিছু কর্মবাচক, আর এগুলো সবই প্রশংসনীয় ও পরিপূর্ণ।
•    আর নিজস্ব সত্তাগত গুণাবলী: চিরন্তন ও স্থায়ীভাবে তা সাব্যস্ত। আপন সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কল্পনাই করা যায় না এবং তা না থাকাটা এক প্রকার ত্রুটি ও কমতিকে আবশ্যক করে (যা তাঁর জন্য শোভনীয় নয়), আর তা ইচ্ছা অনিচ্ছার সাথেও সম্পর্কিত নয়। কর্মবাচক গুণাবলী এর বিপরীত।
•    আর সত্তাগত গুণাবলী:
-    কিছু নীতিগতভাবে সাব্যস্ত (সাধারণভাবে সাব্যস্ত করা যায়) : যেমন, শ্রবণ করা, দেখা, শক্তি, জ্ঞান ইত্যাদি।
-    আর কিছু হলো তথ্যগত: যেমন, মুখমণ্ডল বা চেহারা, দু’হাত, পা, চক্ষু ইত্যাদি।
•    আর কর্মবাচক গুণাবলী: যেমন, হাসা, আগমন করা, অবতরণ করা, উপবেশন বা আরোহণ করা ইত্যাদি।
•    আর নেতিবাচক বা না-সূচক গুণাবলী: যেমন, মৃত্যু, ঘুম, ভুলে যাওয়া, দুর্বলতা বা অক্ষমতা ইত্যাদি।
•    আর নেতিবাচক গুণাবলীর মধ্যে কোনো প্রকার পরিপূর্ণতা ও প্রশংসার বিষয় নেই, তার বিপরীত গুণাবলী পরিপূর্ণভাবে সাব্যস্ত করা ছাড়া।
•    আর গুণাবলীর ব্যাপারে ওহীর ধরন বা পদ্ধতি হলো: নেতিবাচকের ক্ষেত্রে সংক্ষেপে এবং ইতিবাচকের ক্ষেত্রে বিস্তারিতভাবে।
•    আর গুণাবলীর ব্যাপারে কথা বলাটা নামসমূহের ব্যাপারে কথা বলার মতোই, আর গুণাবলীর ব্যাপারে কথা বলাটা আপন সত্তার ব্যাপারে কথা বলার মতোই।
•    আর কিছু সংখ্যক গুণাবলীর ব্যাপারে যে মতামত ব্যক্ত করা যায়, বাকি গুণাবলীর ব্যাপারেও একই ধরণের মতামত ব্যক্ত করা যায়।
•    আর (আল্লাহর) নামসমষ্টি ও গুণাবলীর মধ্যে পারস্পরিক যৌথতা নামকরণকৃত ও বিশেষিত বিষয়সমূহের একরকম হওয়াকে জরুরি মনে করে না।
•    আর যুক্তি সম্বন্ধীয় বিষয়ের মধ্যে এমন কিছু নেই, যা প্রত্যয়ন ও প্রমাণ করার পদ্ধতির বিরোধিতা করে।
•    আর গুণাবলী সংক্রান্ত ভাষ্যগুলোর ব্যাপারে আবশ্যকীয় কাজ হলো সেগুলোকে তার বাহ্যিক অর্থের ওপর প্রয়োগ করা, যা আল্লাহ তা‘আলার মহত্ব ও মর্যাদার সাথে মানানসই এবং যা সম্বোধন ও বর্ণনার চাহিদার সাথে সুনির্দিষ্ট, আর যা বুঝা যাবে বর্ণনাপ্রসঙ্গ থেকে।
•    সুতরাং নাম ও গুণাবলী যখন রব-এর প্রতি সম্বন্ধযুক্ত করা হবে, তখন তা তাঁর সাথে সুনির্দিষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং যেমনিভাবে তাঁর জন্য একক সত্তার বিষয়টি সাব্যস্ত হবে, একাধিক সত্তার মতো করে নয়, ঠিক তেমনিভাবে তাঁর সকল নাম ও গুণাবলীও সাব্যস্ত হবে, যার সাথে সৃষ্টির কোনো নাম অথবা গুণের মিল বা তুলনা হবে না।
•    আর আল্লাহ তা‘আলার জন্য যেমনিভাবে বাস্তবতার নিরিখে একক সত্তা ও কার্যাবলী রয়েছে, ঠিক অনুরূপভাবে বাস্তবিক অর্থেই তাঁর কতগুলো গুণাবলীও রয়েছে।
•    আর পরবর্তী লোকদের কাছে পরিচিত ‘তাফওয়ীয’ বা ‘নাম ও গুণের অর্থ না করে যেভাবে তা এসেছে সেভাবে ছেড়ে যাওয়া’ এর মাধ্যমে প্রকৃত অর্থ থেকে বিমুখ হওয়া আবশ্যক হয়, আর তাই সেটি নিকৃষ্ট বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত; তবে তার দ্বারা ‘ধরণ’ সম্পর্কিত প্রকৃত জ্ঞান উদ্দেশ্য নেওয়া হয়, তবে তা ভিন্ন কথা।
•    আর কিবলার অনুসারী দল ও গোষ্ঠীগুলোর মাঝে আল্লাহর গুণাবলীর ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মত মধ্যম পন্থা অবলম্বনকারী। আর তা হলো: তা তুলনাহীনভাবে সাব্যস্তকরণ এবং অর্থশূণ্যতাহীন পবিত্রকরণ। কারণ, প্রত্যেক (আল্লাহর গুণাগুণের সাথে) তুলনাকারী ব্যক্তিই অর্থশূণ্যকারী এবং সে ঐ ব্যক্তির মতো, যে মূর্তিপূজা করে। আর প্রত্যেক অর্থশূণ্যকারী ব্যক্তিই তুলনাকারী এবং সে ঐ ব্যক্তির মত, যে অস্তিত্বহীনের পূজা করে।
•    আর আল্লাহর গুণাবলীকে অস্বীকার করা কুফুরী এবং সৃষ্টিরাজির সাথে সেগুলোর তুলনা ও উপমা সাব্যস্ত করাটাও কুফুরী।
•    আর পরবর্তী লোকদের অপব্যাখ্যা ধ্বংসের আলামত; ব্যাখ্যা তো শুধু তখনই গ্রহণ করা হবে যখন প্রকাশ্য অর্থ কুরআন-হাদীসের সকল সকল বর্ণনার পরিপন্থী হবে। সুতরাং তখন সে প্রকাশ্য অর্থের ব্যাখ্যা করা হবে এমন কিছু দ্বারা, যা কুরআন-হাদীসের সে ভাষ্যসমূহের সাথে সামঞ্জস্যবিধান করবে।
•    আর আল্লাহর গুণাবলীর ব্যাখ্যা করার ওপর নির্ভর করাই মৌলিক পরিপূর্ণ বিদ‘আত, আর তার কোনো কোনোটির ব্যাখ্যা করা জ্ঞানগত ত্রুটি, যা তার প্রবক্তার ওপর নিক্ষিপ্ত হবে এবং যার কারণে তাঁর মর্যাদাকে নষ্ট করা হবে না।  

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
(ثمرات الإيمان بالأسماء و الصفات)
আল্লাহর নামসমূহ ও গুণাবলীর প্রতি ঈমানের ফলাফল
•    আর সৃষ্টি ও নির্মানের ক্ষেত্রে আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর প্রভাব যেমন অনস্বীকার্য, তেমনিভাবে ব্যক্তির দীন ও ইবাদতের মধ্যে এ নাম ও গুণসমূহের প্রভাব অনস্বীকার্য।  
•    আর সঠিকভাবে সেসবের প্রতি ঈমান আনয়ন করলে তা বিভিন্নভাবে আল্লাহর আনুগত্যে সহায়ক প্রমাণিত হবে।
•    কারণ, বান্দা কর্তৃক আল্লাহর মহত্ব, বড়ত্ব ও শক্তি সম্পর্কে জানাটা ইবাদতের মধ্যে তার বিনয়, অনুতাপ, একাগ্রতা ও দৃঢ়তা সৃষ্টির জন্য ফলদায়ক।
•    আর বান্দা কর্তৃক আল্লাহ তা‘আলার শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও ব্যাপক অবগতি সম্পর্কে জানাটা মুখ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হিফাযত এবং মনের চিন্তা ও লজ্জা বিষয়ক ইবাদতের জন্য ফলদায়ক।
•    আর বান্দা কর্তৃক আল্লাহ তা‘আলার প্রাচূর্যতা, বদান্যতা, দানশীলতা ও দয়া সম্পর্কে জানাটা প্রত্যাশার ইবাদত এবং বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বহু রকমের ইবাদতের জন্য ফলদায়ক হবে।
•    আর বান্দা কর্তৃক আল্লাহ তা‘আলার প্রভুত্বের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এবং তাঁর আদেশ ও নিষেধ সম্পর্কে জানাটা তাঁর প্রতি নির্ভেজাল ভালোবাসা, তাঁর সাথে সাক্ষাতের প্রবল ইচ্ছা ও বন্ধুত্ব, তাঁর নৈকট্য হাসিলের ব্যাপারে প্রতিযোগিতা, তাঁর আনুগত্য করার দ্বারা তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন, তাঁকে সর্বদা স্মরণ করা এবং তাঁর দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার ইবাদতের জন্য ফলদায়ক হবে। অতঃপর সে তার রব-এর সাথে তাঁর ইলাহী গুণাগুণ নিয়ে টানাটানি করবে না। ফলে সে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তা ব্যতীত অন্য কিছুর সাহায্যে বিচার-ফয়সালার কাজ করবে না, আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তা ব্যতীত অন্য কিছুর নিকট আপিল করবে না, আর আল্লাহ যা হালাল করেছেন, তা হারাম মনে করবে না, আর আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তা হালাল মনে করবে না।
•    আর আল্লাহ যা কিছুই পছন্দ করেন, তা তাঁর নামসমষ্টি ও গুণাবলীর প্রভাব ও ইতিবাচক তাৎপর্যের কারণেই পছন্দ করেন, আর যা কিছুই অপছন্দ করেন, তা তাঁর নামসমষ্টি ও বৈশিষ্ট্যাবলীর বিপরীত ও নেতিবাচক হওয়ার কারণেই অপছন্দ করেন।
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
(إفراد الله تعالى بصفات الألوهية)
এককভাবে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ‘উলূহিয়্যাত’ তথা মা‘বুদের গুণাবলী সাব্যস্ত করা
•    ‘আল-উলূহিয়্যাত’ (الألوهية) শব্দটি প্রিয় প্রত্যাশিত কাঙ্ক্ষিত মা‘বুদ ‘ইলাহ’ (الإله) এর সাথে সম্পর্কযুক্ত, যাঁর জন্য অন্তরগুলো বিনয়ের সাথে অবনত হয় এবং যাঁর স্মরণে হৃদয়গুলো শান্তি অনুভব করে, আর মনগুলো যাঁর ফয়সালা ও তাকদীরের প্রতি আস্থাবান হয়, যাঁর ইবাদত করে, যাঁর ওপর ভরসা করে এবং যাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করে।
•    আর ‘উলূহিয়্যাত’ তথা মা‘বুদের ওপর ঈমান মানে: এক আল্লাহর ইবাদত করা, যিনি একক এবং যাঁর কোনো শরীক নেই।
•    আর ‘উলূহিয়্যাত’ তথা মা‘বুদ তার গুণে একক ও অদ্বিতীয় হওয়ার ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞۖ﴾ [البقرة: ١٦٣]
“আর তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৩]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿فَٱعۡلَمۡ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ﴾ [محمد: ١٩]
“কাজেই জেনে রাখুন যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই।” [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ১৯]
•    আর ইবাদত এমন একটি বিষয়ের নাম, যা এমন সব বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ কথাসমষ্টি ও কার্যাবলীকে অন্তর্ভুক্ত করে; যা আল্লাহ ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন, যা পালন করা হয় চূড়ান্ত ভালোবাসা ও পরিপূর্ণ আন্তরিকতা দিয়ে, অসীম অনুগত ও পরিপূর্ণ বিনয়ী হয়ে, তাঁর সত্তাকে সম্মান করার নিমিত্তে, তাঁর শাস্তির ভয়ে এবং রহমতের আশায়।
•    আর ইবাদতের জন্য আল্লাহ তা‘আলাকে এককভাবে নির্দিষ্ট করাটা দীন ইসলামের মৌলিক বিষয়, মহাজ্ঞানী মালিকের অধিকার, মানব সৃষ্টির চূড়ান্ত উদ্দেশ্য এবং কাফির ও মুসলিমগণের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করার অন্যতম সূচক। নবীগণের দা‘ওয়াতের সারাংশ এবং সকল মানুষের উদ্দেশ্যে প্রথম বার্তা, আর তা হলো দুনিয়াতে বাঁচার পথ এবং আখেরাতে মহামুক্তি। কারণ, তা হলো দীনের প্রথম ও শেষ কথা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ﴾ [النحل: ٣٦]
“আল্লাহর ইবাদত করার এবং তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্য আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬]  
•    আর আল্লাহর উলূহিয়্যাত’ (ألوهية)-এর প্রতি ঈমান আনয়নের বিষয়টি আল্লাহর ‘রুবূবিয়্যাত, নামসমষ্টি ও মহান গুণাবলীর প্রতি ঈমান আনয়ন করার বিষয়টিকেও অন্তর্ভুক্ত করে।
•    আর কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই’ (لاإلهَ إلا اللهُ ) এমন সাক্ষ্য প্রদান করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে: একক আল্লাহর জন্য তার সকল কর্মকাণ্ডকে, তাঁর নাম ও গুণাবলী অবহিত হওয়ার মাধ্যমে তাঁর পরিচয় জানাকে এবং এক আল্লাহর ইবাদত করার ব্যাপার একনিষ্ঠতাকে- আন্তরিকতা ও আগ্রহ সহকারে এবং অবনত মস্তকে ও ভয়ভীতিসহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ ﴾ [البينة: ٥]
 “আর তাদেরকে কেবল এ নির্দেশই প্রদান করা হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে।” [সূরা আল-বায়্যিনাহ, আয়াত: ৫]  
•    আর কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল’ (محمّدُ رسول اللهِ) এমন সাক্ষ্য প্রদান করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে: তাঁর রিসালাতের প্রতি দৃঢ়বিশ্বাসকে, তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনকে, তাঁর পরিবেশিত তথ্য বা হাদীসসমূহকে সত্য বলে বিশ্বাস করাকে, তাঁর নির্দেশের অনুসরণ করাকে এবং তাঁর নিষেধ করা বিষয় থেকে দূরে থাকাকে। আরও অন্তর্ভুক্ত করে যাবতীয় বিদ‘আত, তিরস্কৃত অন্ধ অনুসরণ অথবা শরী‘আতসম্মত নয় এমন নিন্দিত অনুসরণ থেকে মুক্ত থেকে শুধু তাঁর প্রবর্তিত বিধান অনুযায়ী আল্লাহর ইবাদত করার বিষয়টিকে।
•    আর স্বীকারোক্তিমূলক শাহাদাতাঈনের  উচ্চারণ করার মানে হলো- দুনিয়ার বিধিবিধানের ক্ষেত্রে ইসলামের চুক্তিনামা বা দলীল সাব্যস্ত হওয়া।
•    আর আল্লাহর উলূহিয়্যাত’ (ألوهية)-এর প্রতি ঈমান আনয়নের আরেকটি দিক হলো: এককভাবে আল্লাহ তা‘আলাকে দো‘আ ও আবেদন নিবেদনের ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা। কারণ, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ এ ব্যাপারে ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার নিকট ছাড়া অন্য কারও কাছে তা চাওয়া হবে না।
•    আর যবেহ, মান্নত, তাওয়াফ, সা‘ঈ, ভয়, তাওয়াক্কুল (ভরসা) ইত্যাদি ধরনের ইবাদত শুধু আল্লাহর উদ্দেশ্যেই সম্পাদন করা হবে।
•    আর মসজিদ ও মাশ‘আর তথা মক্কার পবিত্র স্থানসমূহ ব্যতীত পৃথিবীর কোনো ভূ-খণ্ডে সালাত, যিকির, দো‘আ ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করার ইচ্ছা পোষণ করা যাবে না।
•    আর অসীলা করার কিছু শরী‘আতসম্মত এবং কিছু শরী‘আত কর্তৃক নিষিদ্ধ পদ্ধতি রয়েছে। সুতরাং শরী‘আতসম্মত অসীলা হলো- যা আল্লাহ তা‘আলার নাম ও গুণাবলী এবং তাঁর কার্যাবলীর দ্বারা অথবা সৎ আমলসমূহ দ্বারা করা হয়ে থাকে, অথবা নেক দো‘আর মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। তা ছাড়া বাকি সব শরী‘আত কর্তৃক নিষিদ্ধ অসীলার অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ বিধিসম্মত বা শরী‘আতসম্মত করেন নি।
•    আর বরকতের বিষয়টি শুধু এক আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে, আর বরকত লাভ করার বিষয়টি তাওকীফী বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কর্তৃক জানিয়ে দেওয়ার ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং তা শুধু পাকা দলীল দ্বারাই সাব্যস্ত হবে।
•    আর আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে শির্ক হওয়ার প্রত্যেকটি মাধ্যম বা উপায়কে অথবা আল্লাহর দীনের মধ্যে নতুন কিছু উদ্ভাবন করার পথকে বন্ধ করে দেওয়া ওয়াজিব বা আবশ্যক। কারণ মাধ্যমও উদ্দেশ্যের হুকুম রাখে।
•    আর তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের ইবাদতের অন্যতম একটি দিক হলো আল্লাহ তা‘আলাকে এককভাবে আনুগত্য, আত্মসমর্পণ, আইনকানুন ও বিধিবিধানের জন্য নির্দিষ্ট করা। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যা হালাল করেছেন শুধু তাই হালাল বলে গণ্য হবে।  আর আল্লাহ যা হারাম করেছেন শুধু তাই হারাম বলে গণ্য হবে, আর আল্লাহ যা শরী‘আত বলে ঘোষণা করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু দীন বলে গণ্য হবে না।
•    আর ঈমানদারগণকে বন্ধু মনে করা এবং কাফিরগণকে শত্রু মনে করাটা দীনের মূলনীতি ও ঈমানের শাখা-প্রশাখার অন্তর্ভুক্ত।
•    আর যে ব্যক্তি মুসলিম জাতি ভিন্ন অন্য কোনো জাতিকে ভালোবাসে ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে, সে ব্যক্তি দীনকে ধ্বংস করল এবং জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।
•    আর বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার জন্য সর্বোত্তম মানুষ হলেন ঐ ব্যক্তি, যিনি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহর অনুগত, আর তারা হলেন রাসূলগণের পর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহাবীগণ, অতঃপর তাদের মত যারা একের পর এক।
•    আর ইবাদত ও দাসত্বের কতগুলো প্রকার ও বিধিবিধান রয়েছে।
•    সুতরাং ইবাদতের প্রকারসমূহ তিন ভাগে বিভক্ত: আন্তরিকভাবে ও মৌখিকভাবে এবং মানুষের যাবতীয় অঙ্গ-প্রত্যেঙ্গের মাধ্যমে, আর প্রত্যেকটির জন্যই বিশেষ ইবাদত রয়েছে।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
(ثمرات الإيمان بالألوهية)
‘উলূহিয়্যাত’ তথা আল্লাহকে একমাত্র মা‘বুদ হিসেবে ঈমান আনয়নের ফলাফল
•    আর এককভাবে আল্লাহ তা‘আলার জন্য উলূহিয়্যাত’ (ألوهية) তথা ইবাদতের বিষয়টিকে নির্দিষ্ট করার মাঝে কতগুলো ইহকালীন ও পরকালীন ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে:
•    সুতরাং দুনিয়াতে তা পবিত্র জীবনের অধিকারী করে ইবাদতের বিষয়টি পূর্ণকরণের মাধ্যমে, ঈমানের স্বাদ ও মজা উপভোগ করার মাধ্যমে, আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠতা ও তাঁর আনুগত্য করার দ্বারা আনন্দ উপভোগ করার মাধ্যমে, তাঁর ওপর উত্তমভাবে তাওয়াক্কুল ও ভরাসা করার দ্বারা মনের প্রশান্তি অর্জন করার মাধ্যমে, কোনো প্রকার মাধ্যম ব্যতীত সরাসরি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার মাধ্যমে, মনের ইবাদতসমূহ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের ইবাদতকে বিশুদ্ধকরণ ও যথাযথভাবে তা সম্পাদন করার মাধ্যমে, যমীনের মধ্যে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ লাভের মাধ্যমে এবং দীনের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে। অপরদিকে তার প্রভাবে উত্তমভাবে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে।
•    আর আখেরাতে: ফিরিশতাদ্বয় কর্তৃক প্রশ্ন করার সময় অটল থাকা, কবরের শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়া, কিয়ামতের দিনে নিরাপত্তা লাভ করা, গুনাহ মাফের ব্যবস্থা, সিরাত (পুলসিরাত) অতিক্রম করা, জান্নাতে প্রবেশ করা, জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া এবং এ সকল কিছুর উপরে শ্রেষ্ঠ অর্জন হলো আমাদের ‘রব’ আল্লাহ তা‘আলার প্রতিশ্রুত সন্তুষ্টি অর্জন। তিনি বলেন,
﴿وَرِضۡوَٰنٞ مِّنَ ٱللَّهِ أَكۡبَرُ﴾ [التوبة: ٧٢]
“আর আল্লাহর সন্তুষ্টিই সর্বশ্রেষ্ঠ।” [সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৭২]

ষোড়শ পরিচ্ছেদ
(الإيمان بالملائكة)
ফিরিশতাগণের প্রতি ঈমান
•    ঈমান বিল-গাইব (الإيمان بالغيب) তথা না দেখা বিষয়সমূহের ওপর ঈমানের বিষয়টি হলো একত্ববাদীগণের আকিদা-বিশ্বাস এবং মুমিনগণের মহামূল্যবান মর্যাদাপূর্ণ স্থান।
•    আর এটা হলো স্বভাবজাত জরুরি বিষয় এবং শরী‘আতী ‘আকিদা-বিশ্বাস।
•    আর রাহমান যা নাযিল করেছেন, তার সবকিছুর ওপর ঈমান স্থাপন করা ব্যতীত মুমিন জীবনের পূর্ণতা হবে না।
•    আর ঈমান বিল-গাইব (الإيمان بالغيب) এর অন্তর্ভুক্ত হলো: ফিরিশতাগণের প্রতি ঈমান স্থাপন করা এবং এ বিশ্বাস করা যে, তারা হলেন আল্লাহর জ্যোতির্ময় সম্মানিত বান্দা।
•    তারা খাবার ও পানীয় গ্রহণ করেন না এবং বিয়ে-শাদী ও বংশ বিস্তার করেন না।
•    আনুগত্য করার জন্যই তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তারা আল্লাহ ইবাদতের ব্যাপারে ক্লান্তিবোধ করেন না।
•    আর তাদের প্রতি সাধরাণভাবে বিশ্বাস স্থাপন করাটা ঈমানের রুকন (মৌলিক বিষয়) এবং কুরআন ও সুন্নাহ’র মধ্যে যাদের আলোচনা এসেছে, তাদের ব্যাপারে সবিস্তারে ঈমান আনয়ন করাটা ওয়াজিব।
•    তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন জিবরীল আলাইহিস সালাম, যিনি ওহীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিরিশতা, যার (ওহীর) দ্বারা মানুষের অন্তরসমূহ জীবন পেয়ে থাকে, আর তাদের মধ্য থেকে আরেকজন হলেন মিকাঈল আলাইহিস সালাম, যিনি বৃষ্টি বর্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন, আর তাদের আরেকজন হলেন ইসরাফীল আলাইহিস সালাম, যিনি সিঙার দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন, আর তাদের অপর আরেকজন হলেন ‘মালাকুল মাউত’, যিনি মানুষের প্রাণ সংহারের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন, আর তাদের আরও একজন হলেন ‘মালিক’ ফিরিশতা, যিনি জাহান্নামের দায়িত্বে নিয়োজিত, আর তাদের মধ্যে আরও আছেন ধ্বংসের ঘর জাহান্নামের প্রহরী কঠোর ফিরেশতাগণ, আর তাদের মধ্যে আছেন উত্তম ঘর জান্নাতের রক্ষীদের তত্ত্বাবধায়ক, আর তাদের মধ্যে একদল ‘বাইতুল মা‘মুর’ যিয়ারতের দায়িত্বে নিয়োজিত, আর তাদের মধ্য থেকে আরেক দল হলেন দেশে দেশে ভ্রমণকারী ফিরিশতা, যারা যিকিরের মাজলিসগুলো পর্যবেক্ষণ করেন, আর তাদের মধ্যে আরও আছেন বান্দাদের অন্তরে ভালো ভালো কর্মের জাগরণ সৃষ্টিকারী ফিরিশতাগণ, আর তাদের মধ্যে আরও আছেন আল্লাহর আরশ বহনকারী ফিরিশতাগণ, আরও আছেন হিফাযতকারী ফিরিশতাগণ, আর তাদের মধ্যে রয়েছেন সম্মানিত লেখকবৃন্দ।
•    তাদের সংখ্যা হলো অনেক বড় অংকের, যা হিসাব করা যায় না, আর তাদের মহৎ কর্মকাণ্ডগুলোর গভীরতায় প্রবেশ করা যায় না, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে মুমিনগণের বন্ধু; তারা ভালো কাজের নির্দেশনা প্রদান করেন, প্রতিশ্রুতি দেন এবং আহ্বান করেন, আর মন্দ কাজে নিষেধ করেন এবং সতর্ক করেন, আর মুমিনগণের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন এবং তাদের জন্য রহমত কামনা করেন, আর মুমিনগণ কর্তৃক দো‘আ করার সময় তারা আমীন আমীন বলেন, আর তারা জান্নাতের সুসংবাদ দেন।
•    আর মুমিনগণের দায়িত্ব হলো, ফিরিশতাগণের নজর থেকে লজ্জা পাবে, তাদেরকে মহব্বত করার নির্দেশ দিবে এবং তাদেরকে কষ্ট দেওয়া থেকে তারা পরস্পরকে নিষেধ করার উপদেশ দিবে।
•    আর ফিরিশতাগণের প্রতি ঈমান আনয়নের বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছায় সংশয় ও কুসংস্কার থেকে পবিত্রতা লাভের কারণ হবে এবং আল্লাহর মহত্ব ও ক্ষমতা সম্পর্কিত জ্ঞানকে বৃদ্ধি করবে, আর তা দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতার জন্ম দেবে, ধৈর্যকে শক্তিশালী করবে, আল্লাহর যিকিরকে (স্মরণকে) বাধ্যতামূলক করে দেবে, চিন্তা-গবেষণার দিকে আহ্বান করবে এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশে সাহায্য করবে।

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
(الإيمان بوجود الجن)
জিন্ন জাতির অস্তিত্বের প্রতি ঈমান
•    ঈমান বিল-গাইব (الإيمان بالغيب) এর অন্যতম একটি দিক হলো জিন্ন ও শয়তানের অস্তিত্বের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা।
•    আর তাদের সৃষ্টি হয়েছিল মানব সৃষ্টির পূর্বে এবং তাদের সৃষ্টির মূল উপাদান হলো নির্ধূম আগুনের শিখা।
•    আর তারা নির্দিষ্ট সময়কাল ধরে বেঁচে থাকে এবং মারাও যায়, আর তারা বিয়ে-শাদী করে এবং বংশ বিস্তার করে, আর তাদের মধ্যে মুমিন রয়েছে এবং তাদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক রয়েছে পাপিষ্ঠ। সুতরাং যে ঈমান গ্রহণ করেছে, সে হিদায়াতের পথকে বাছাই করল, আর যে কুফুরী করল, সে জহান্নামের ইন্ধন হয়ে গেল।  

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
(الإيمان بالكتب المنزلة)
আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নাযিলকৃত কিতাবসমূহের ওপর ঈমান
•    আর ঈমানের রুকনসমূহের অন্তর্ভুক্ত একটি রুকন হলো: আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীগণের ওপর যা নাযিল করেছেন, তার প্রতি ঈমান স্থাপন করা- চাই তা ফলকের মধ্যে লিখিত হউক অথবা কোনো ফিরিশতার পক্ষ থেকে শ্রুত হউক অথবা পর্দার আড়াল থেকে অবতীর্ণ হউক; চাই তা ‘সহীফা’ বা ‘কিতাব’ নামের কোনো কিছুতে সংকলিত হউক, আর সবগুলোই আল্লাহর বাণী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
•    আল্লাহ তা‘আলা তা নাযিল করেছেন জগৎবাসীর জন্য দলীল-প্রমাণ হিসেবে এবং দীনের পথের অনুসারীদের জন্য পথ চলার নিয়মনীতি হিসেবে।
•    আর আল্লাহর কিতাবে আলোচিত প্রথম সহীফা হলো ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর সহীফা, তারপর ‘তাওরাত’ এবং তা হলো মূসা আলাইহিস সালাম-এর সহীফা অথবা তা ভিন্ন অন্য সহীফা, আর আল্লাহ তা‘আলা দাঊদ আলাইহিস সালামকে ‘যাবূর’ দান করেছেন, অতঃপর তাঁর বান্দা ও রাসূল ‘ঈসা আলাইহিস সালাম-এর ওপর নাযিলকৃত  কিতাব ‘ইঞ্জিল’। আর নাযিলের দিক থেকে সর্বশেষ সহীফা বা কিতাব হলো ‘আদনান’ বংশের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিলকৃত ‘আল-কুরআন’, যাতে তা হতে পারে জগৎবাসীর জন্য আলো, পাপীদের জন্য ভয় প্রদর্শনকারী এবং মুসলিমগণের জন্য হিদায়াত ও রহমত।
•    আর এসব সহীফা ও কিতাবের মধ্য থেকে কোনো একটিকে অস্বীকার করা মানে সবগুলোকেই অস্বীকার করা।
•    আর ঈমানের মৌলিক বিষয়, নৈতিক চরিত্র, দীনের সকল বিষয় এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের সংবাদ পরিবেশন করার ক্ষেত্রে সকল সহীফা ও কিতাবের বক্তব্য এক ও অভিন্ন, যদিও শরী‘আত পালনকারী ব্যক্তিগণের কর্মকাণ্ডের বিধিবিধান ও নিয়ম-কানূনগুলোর ক্ষেত্রে সেগুলোর বক্তব্যের মধ্যে কিছু ভিন্নতা রয়েছে।
•    পরবর্তী কিতাবটি তার পূর্বের কিতাবটিকে সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবে মানসূখ বা রহিত করে দেয়।
•    আর আল্লাহ তা‘আলার কিতাবসমূহ -হয় কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে, কোনো অস্তিত্ব নেই অথবা অরক্ষিত অবস্থায় বিকৃত ও পরবর্তন করা হয়েছে, তবে আল্লাহর হেফাযতে থাকা সংরক্ষিত কিতাবটি ব্যতীত, আর তা সর্বশেষ ‘নাসিখ’ বা রহিতকারী কিতাব, বিজ্ঞ তত্ত্বাবধায়ক, সুস্পষ্ট আলো এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ, আর তা হলো মহাগ্রন্থ আল-কুরআন।
•    আর সামগ্রিকভাবে সেগুলোর মূলনীতিকে সম্মান করা এবং তা নাযিলকরণ ও শরী‘আত হিসেবে নির্ধারণের ক্ষেত্রে আল্লাহর হিকমত সম্পর্কে অবহিত হওয়ার মাধ্যমে সবগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক, তবে সাথে সাথে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তা পাঠ করা থেকে। কেননা, পূর্বে ইঙ্গিত করা হয়েছে তার বিকৃতি ও মানসূখ বা রহিত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে।
•    আর আল-কুরআনের শব্দ ও অর্থসহ সবকিছু মিলেই আল্লাহর বাণী, তাঁর কাছ থেকেই কুরআনের সূচনা এবং তাঁর কাছেই তা ফিরে যাবে। তা নাযিলকৃত, ‘মাখলুক’ বা সৃষ্ট নয়, আর আমরা মুসলিম জামা‘আতের বিরোধিতা করি না।
•    আর আল-কুরআনুল ‘আযীমের ‘হক’ বা অধিকার হলো: তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং তাঁর ফয়সালা মেনে নেওয়া, আর তাঁর দ্বারা রাত্রিকালে ‘ইবাদত করা এবং তাঁকে ধীরস্থিরভাবে পাঠ করা, আর তাঁকে মুখস্থ করা এবং তাঁর গবেষণা করা, আর তাঁর শিক্ষা লাভ করা, আমল করা ও তাঁর শিক্ষা দান করা।
•    আর ঐ ব্যক্তি আল-কুরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেনি, যে তাঁর দেওয়া সংবাদসমূহের কোনো কিছুকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে অথবা তাঁর ঘোষিত হারামসমূহের কোনো কিছুকে হালাল মনে করেছে অথবা তাঁর পরিবর্তন, বিকৃতি বা কাটছাট হয়েছে বলে বিশ্বাস করেছে।

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
(الإيمان بالرسل)
রাসূলগণের ওপর ঈমান
•    ঈমানের রুকনসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি রুকন হলো, নবী ও রাসূলগণের ওপর ঈমান আনয়ন করা, আর এ আস্থা পোষণ করা যে, তারা হলেন আল্লাহর সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠাংশ, আর গোটা দীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নবীগণের নবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের ওপর ভিত্তি করে।
•    সমষ্টিগতভাবে তাদের প্রতি এবং আল-কুরআনে বিস্তারিতভাবে যাদের আলোচনা হয়েছে, তাদের প্রতি ঈমান আনয়ন করা বাধ্যতামূলক।
•    আর তাদের মধ্য থেকে কোনো একজনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা এবং বিশ্বাস না করাটা তাদের সকলকে অস্বীকার করার মতো অপরাধ।
•    আর নবুওয়াতের বিষয়টি রিসালাতের ওপর অগ্রগণ্য, আর নবুওয়াত ও রিসালাত উভয়টি অনুদান হিসেবে প্রাপ্ত, অর্জিত নয়। সুতরাং প্রত্যেক রাসূলই নবী, কিন্তু প্রত্যেক নবী রাসূল নন।
•    আর তারা হলেন সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী, আর বিশ্বাস ও জীবন-পদ্ধতির দিক থেকে তারা সকলের চেয়ে বেশি সঠিক ও ন্যায়পরায়ণ এবং চারিত্রিক দিক থেকে সবচেয়ে পরিপূর্ণ মানুষ, আর তারা হলেন সকলের চেয়ে বেশি সত্যভাষী। কোনো বিপদ-মুসীবত ও দুঃখ-কষ্ট তাদের পিঠ বাঁকা করতে পারেনি, আর কোনো ষড়যন্ত্রই তাদের দৃঢ় সিদ্ধান্তকে দুর্বল করতে পারে নি। তাদের আত্মা ছিল দুনিয়াবিমুখ, আর তাদের রব-এর ব্যাপারে তাদের ভয়ের আগুন সবসময় প্রজ্জ্বলিত ছিল, আর তাদের চোখের অশ্রু সবসময় প্রবাহমান ছিল। তারপর তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল সাহায্য ও শুভ পরিণাম।
•    তাদের কেউ কেউ দুনিয়ার কর্তৃত্ব লাভ করেছেন, তারপর তাদের কোনো নিয়ম-নীতির পরিবর্তন হয়নি এবং তাদের স্বভাব-চরিত্রের ন্যূনতম কোনো পরিবর্তন বা বিকৃতি ঘটে নি। তাদের রবের প্রতি তাদের বিশ্বাস ছিল চমৎকার এবং তাঁর প্রতি তাদের আত্মসমর্পণ ছিল সুস্পষ্টভাবে।
•    আল্লাহ তা‘আলা তাদের হাতে অনেক উজ্জ্বল নিদর্শন প্রকাশ করেছেন, যার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে উপস্থিত ও অনুপস্থিত ব্যক্তি।
•    আর তাদের জীবনকালের পরিসমাপ্তির দ্বারা তাদের মু‘জিযাগুলোর কার্যকারিতাও শেষ হয়ে গেছে, তবে কালজয়ী মু‘জিযা ও অহঙ্কারের প্রতীক আল-কুরআনুল কারীম ব্যতীত, তার ওপর অতিক্রান্ত হয়েছে যামানার চৌদ্দ শতাব্দী, অথচ তাঁর অনবদ্যতা ও চমৎকারিত্ব অভিনব নিত্যনতুন, আর যামানার যৌবন কেটে গেছে, অথচ তাঁর উজ্জ্বলতা ও সৌন্দর্য বেড়েই চলছে, বছরকে বছর শেষ হয়ে গেল এবং দিনগুলো আর রাতগুলো একে একে কেটে গেল, অথচ কেউ তাঁর মতো করে একটি সূরাও নিয়ে আসতে পারেনি এবং কেউ কোনো দিন পারবেও না, যদিও জিন্ন জাতি ও মানুষ জাতি পরস্পর পরস্পকে এ ব্যাপারে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে থাকে।

বিংশ পরিচ্ছেদ
(ما يجب و يجوز و يمتنع في حق الرسل)
রাসূলগণের অধিকার প্রশ্নে যা আবশ্যক, বৈধ ও নিষিদ্ধ
•    আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীগণকে তাঁর নিজ হিফাযতে হিফাযত করেছেন এবং তাদের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তাদেরকে নিষ্পাপ রখেছেন। সুতরাং তাদের পক্ষে কবীরা গুনাহ ও হীন কাজ করাটা একেবারেই নিষিদ্ধ ও অসম্ভব, আর সগীরা গুনাহ- যদি তা হয়েও থাকে, তবে তা বিরল ও ক্ষমাপ্রাপ্ত।
•    আর সাধারণভাবে তাদের সকলের পক্ষে অসম্ভব হলো মিথ্যা বলা, খিয়ানত করা এবং নবুওয়াত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে ভুল করা এবং ভুলে যাওয়া।
•    আর তাদের পক্ষে জীবন ও মরণ, সুস্থ ও অসুস্থ হওয়া, ধনী ও দরিদ্র হওয়া, খাওয়া ও পান করা, যৌন সঙ্গম ও নিদ্রাযাপন এবং বংশ বিস্তার করা বৈধ, আরও বৈধ সকল জাগতিক ভাগ্য এবং মানবিক সামগ্রীর সমাবেশ, আর এমন কিছুও তাদের পক্ষে হওয়া বৈধ, যা তাদের মহান মর্যাদাকে খাটো করে না।
•    আর তাদের মধ্যে প্রথম নবী হলেন আদম আলাইহিস সালাম এবং প্রথম রাসূল হলেন নূহ আলাইহিস সালাম। আর তাদের মধ্যে সর্বশেষ নবী ও রাসূল হলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
•    আর তাদের মাঝে একটি বিশেষ দল আছেন, যারা বিশেষ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ গুণ দ্বারা বিশেষিত, তাদের নামসমূহ একত্রিতভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আল-কুরআনের ‘আহযাব’ ও ‘শূরা’ নামক দু’টি সূরার মধ্যে।
•    আর সাধারণভাবে সর্বসম্মতিক্রমে তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন শেষ রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আর (রাসূলগণের মধ্যে থেকে) এমন প্রতিটি শ্রেষ্ঠত্ব দানের চেষ্টা করাই নিষিদ্ধ, যা স্বজনপ্রীতি, জাতীয়তাবাদ ও গোঁড়ামীকে উস্কে দেয় অথবা আল্লাহর রাসূলগণের দুর্নাম করা হয়।
•    আর তারা পরস্পর বৈমাত্রেয় ভাই, তাদের দীন এক কিন্তু শরী‘আত বিভিন্ন রকম।
•    আর নবীগণ মানবগোষ্ঠী থেকে বিশেষভাবে ব্যতিক্রম হলেন ওহী ও পাপমুক্ত হওয়ার কারণে এবং তাদের অন্তর ঘুমায় না, আর মৃত্যুর সময় তাদেরকে বিশেষ স্বাধীনতা দেওয়া হয় এবং তাদেরকে দাফন করা হয় যেখানে তারা মারা যান, আর তারা ‘বরযাখ’-এর জীবনে তাদের কবরের মধ্যে সালাত আদায়ে ব্যস্ত থাকেন, আর মাটি তাদের শরীর মুবারক খায় না এবং তারা সম্মানিত।
•    আর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে প্রেরণ করার মাধ্যমে দলীল প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং তাদের জীবন-চরিত ও চরিত্র দ্বারা পথের গন্তব্যস্থলকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, আর তাদের দ্বারা তাওহীদ বা একত্ববাদের মিনারকে সুউচ্চ করেছেন এবং তাদের রিসালাতের মাধ্যমে বান্দাদের সার্বিক অবস্থাকে সংস্কার ও পরিশুদ্ধ করেছেন।
•    আর প্রত্যেক নবীই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুসংবাদ প্রচার করেছেন এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন।
•    আর তাওরাত ও ইঞ্জিলে বর্ণিত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি তাদের বাড়াবাড়ি ক্ষমা করে দিবেন এবং তাদের জন্য প্রতিটি চুক্তি ও অঙ্গীকারনামা শিথিল করে দিবেন।  

একবিংশ পরিচ্ছেদ
(خصائص النبيّ صلّى الله عليه و سلم وحقوقه)
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্য ও অধিকারসমূহ
•    আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দ্বারা নবুওয়াত ও রিসালাতের পরিসমাপ্তি করার মাধ্যমে তাঁকে বিশেষিত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٖ مِّن رِّجَالِكُمۡ وَلَٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ﴾ [الاحزاب: ٤٠]  
“মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪০]
•    আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাত সার্বিকভাবে সকল মানুষের জন্য এবং ব্যাপাকভাবে মানুষ ও জিন্ন জাতির জন্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا كَآفَّةٗ لِّلنَّاسِ﴾ [سبا: ٢٨]
“আর আমরা তো আপনাকে সমগ্র মানুষের জন্যই প্রেরণ করেছি।” [সূরা সাবা, আয়াত: ২৮]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا رَحۡمَةٗ لِّلۡعَٰلَمِينَ ١٠٧﴾ [الانبياء: ١٠٧]
“আর আমরা তো আপনাকে সৃষ্টিকুলের জন্য শুধু রহমতরূপেই পাঠিয়েছি।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭]
•    আর আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য দীনকে পরিপূর্ণ করা এবং তাঁর প্রতি বিজয় ও ক্ষমতার মতো নি‘আমত পূর্ণ করার পরেই তিনি মারা যান, আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি আয়াত নাযিল করে বলেন,
﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗا﴾ [المائ‍دة: ٣]
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নি‘আমত সম্পূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত:৩]  
•    অনুরূপভাবে তাঁর ‘রব’ তাঁকে বিশেষিত করেছেন ‘ইসরা’ (রাত্রিকালীন ভ্রমণ) ও ‘মি‘রাজ’ (ঊর্ধ্বগমণ) করানোর মাধ্যমে, আর তাঁর জন্য তিনি চাঁদকে খণ্ডিত করেছেন এবং তাঁর থুতু ও ঘামকে বরকতময় ও চিকিৎসার উপকরণ বানিয়ে দিয়েছেন। তাঁর দো‘আর কারণে বৃষ্টি বর্ষণ হত এবং তাঁর প্রতি গাছপালা অবনমিত হয়েছে, আর উট ও পাথর তাঁকে সালাম প্রদান করেছে, আর তাঁকে সাহায্য করা হয়েছে (শত্রুদেরকে তাঁর) ভয় ও আতঙ্কের দ্বারা এক মাসের দূরত্বের পরিমাণ পর্যন্ত। আর তিনি হলেন আদমসন্তানের নিরহঙ্কারী নেতা, মহান শাফা‘আতের অধিকারী এবং কিয়ামতের দিন ‘প্রশংসার পতাকা’ বহনকারী।
•    তাঁর নবুওয়াতের দলীল-প্রমাণ সীমার অতিরিক্ত এবং তাঁর মহৎ গুণের সংখ্যা অগণিত।
•    সুতরাং তাঁর প্রথম ‘হক’ বা অধিকার হলো তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করা, সাথে সাথে তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ করা, তাঁকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করা এবং তাঁকে মহব্বত করা ও তাঁর প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শন করা, আর তাঁর নিকট বিচারের ভার দেওয়া, তাঁর শরী‘আতকে মেনে সন্তুষ্ট থাকা এবং কোনো রকম বাড়াবাড়ি ও কঠোরতা ছাড়া তাঁকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া, আর তাঁর প্রতি সালাত ও সালাম পেশ করা।                  
صلى الله عليه و على آله و أصحابه، وسلّم تسليماً كثيراً .
“আল্লাহ তাঁর প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীগণের প্রতি বেশি বেশি সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন”।    

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
(الإيمان باليوم الآخر)
শেষ দিবসের ওপর ঈমান
•    আর ঈমানের অন্যতম আরেকটি রুকন হলো: শেষ দিবসের ওপর এবং তার ভূমিকা ও আলামতসমূহের প্রতি ঈমান আনয়ন করা।
•    আর প্রত্যেক যে ব্যক্তিই মারা যাবে তার ছোট কিয়ামত শুরু হয়ে গেছে।
•    আর মৃত্যুক্ষণে ফিরিশতা অবতরণ করে মুমিন ব্যক্তিকে দয়াময় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ এবং জান্নাতে তার জন্য বরাদ্দকৃত আসনের সুসংবাদ প্রদান করেন, আর মৃত্যুর সময় মানুষ কখনও কখনও ফিতনার সম্মুখীন হয়, আর আমলের ভালো-মন্দ নির্ভর করে তার শেষ অবস্থার ওপর।
•    আর কবর হলো আখিরাতের প্রথম মানযিল (স্টেশন), আর আল্লাহর কাছেই কেবল আশ্রয় প্রার্থনা করা হবে তার আলিঙ্গন ও ফিতনা থেকে, আর কবরের শাস্তি ও শান্তি সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের, আর তা অস্বীকার করে থাকে নাস্তিক, ভণ্ড দার্শনিক ও বিদ‘আতপন্থীদের একটি দল, বস্তুত তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এমন বিষয়কে, যা তাদের জ্ঞানের আওতায় নেই, আর ঈমানদারগণের কাউকে কাউকে আল্লাহ তা‘আলা কবরের ফিতনা ও শাস্তি থেকে নিরাপত্তা দান করেন।
•    আর ‘বারযাখ’ নামক জগতের বিধিবিধান পরিচালিত হয় রূহের উপর এবং শরীর তার অনুগামী।
•    আর কিয়মাত সংঘটিত হওয়ার আগে আগে কিছু বিশেষ আলামত ও নমুনা দেখা যাবে।
•    আর তার কিছু নিদর্শন ছোট এবং তা সংঘটিত হয়ে গেছে। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ ও তাঁর মৃত্যু এবং তাঁর জীবদ্দশায় চন্দ্র খণ্ড-বিখণ্ড হওয়া।
•    আর তার কিছু আলামত সংঘটিত হচ্ছে এবং তা বারবার সংঘটিত হবে। যেমন, ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী দাজ্জালগণের আবির্ভাব; ভূমিধ্বস, ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির আত্মপ্রকাশ এবং মুসলিমগণের বিরুদ্ধে সকল জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
•    তার আরও কিছু আলামত আছে, যা এখনও সংঘটিত হয় নি এবং তার অপেক্ষা করা হচ্ছে। যেমন, স্বর্ণের পাহাড় দ্বারা ফুরাত নদী ঢেকে ফেলা, আরব উপ-দ্বীপে সবুজ-শ্যামল বাগান সৃষ্টি ও নদ-নদীর প্রবাহ, রোম বিজয় এবং মাহদী আলাইহিস সালাম-এর আত্মপ্রকাশ।
•    আর কিয়ামতের কিছু বড় বড় আলামত রয়েছে, সেগুলো হলো: দাজ্জালের আবির্ভাব, ‘ঈসা ইবন মারইয়াম ‘আলাইহিস সালামের অবতরণ, তারপর ইয়াজুজ ও মা’জুজের আগমন এবং ধোঁয়া, অতঃপর পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদয় হবে এবং সে সময়ে আর কোনো তাওবা কবুল করা হবে না, আর বিশেষ এক জাতীয় প্রাণীর আবির্ভাব, অতঃপর এমন আগুন, যা মানুষকে সমবেত করবে এবং এটা কিয়ামতের সর্বশেষ বড় আলামত এবং কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বাভাস হিসেবে প্রথম আয়াত বা আলামত।
•    আর কিয়ামতের নিদর্শনগুলো প্রকাশের পর ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, আল-কুরআন উঠে যাবে, মানুষ মূর্তিপূজার দিকে ফিরে যাবে, বাইতুল্লাহ তথা মাসজিদে হারাম ধ্বংস হয়ে যাবে এবং ঈমানদারগণের রূহ কবজ (হরণ) করা হবে।
•    আর কিয়ামতের দিনে সবকিছু কব্জাভুক্ত করা হবে, যমীনকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হবে, আকাশ ফেটে যাবে এবং তাকে গুটিয়ে নেওয়া হবে, সূর্যকে গুটিয়ে নিয়ে তার আলোক বিচ্ছুরণ বন্ধ করা হবে, চন্দ্র গ্রহণের শিকার হয়ে তার আলো নিষ্প্রভ হবে এবং সাগর ও নদীগুলো বিস্ফোরিত হবে।
•    অতঃপর শিঙায় দু’টি বা তিনটি ফুঁ দেওয়া হবে এবং তাতে জনগণ আতঙ্কিত হবে, আর অপর ফুঁ দ্বারা তারা মারা যাবে, তবে আল্লাহ যাকে চান সে ব্যতীত। অতঃপর তৃতীয় বারের ফুঁতে তারা দাঁড়িয়ে গিয়ে পরস্পর তাকাতাকি করবে, যেমনভাবে তিনি তাদেরকে প্রথম সৃষ্টি করেছেন, ঠিক সেভাবে তারা প্রত্যাবর্তন করবে।
•    আর পুনরুত্থান ও হাশর-নশরের বিষয়টি সঠিক ও সত্য বলে প্রমাণিত শরী‘আতের দলীল দ্বারা, বুদ্ধিভিত্তিক যুক্তির মাধ্যমে এবং মুসলিম ও কিতাবধারীগণের ইজমা‘ বা ঐক্যবদ্ধ রায় দ্বারা।
•    আর কিয়ামতের দিনে সর্বপ্রথম যার যমীন (কবর) উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে তিনি হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অতঃপর জনগণকে অবস্থান করার জায়গায় সমবেত করা হবে খালি পা, বিবস্ত্র ও খাতনাবিহীন অবস্থায়, আর সেদিন সর্বপ্রথম যাকে কাপড় পরানো হবে, তিনি হলেন ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম। অতঃপর মুমিনগণকে দয়াময়ের নিকট বাহনে করে সম্মানিত মেহমানরূপে সমবেত করা হবে, আর কাফিরগণকে অন্ধ, বোবা ও বধির করে তৃষ্ণাতুর অবস্থায় উপুড় করে জাহান্নামের দিকে নিক্ষেপ করা হবে।
•    অতঃপর মহাসমাবেশের দিনের উদ্দেশ্য তাদেরকে একত্রিত করা হবে। অতঃপর (আল্লাহর) সাক্ষাৎ হাসিল হবে, আর আপনার রব এবং ফিরিশতাগণ সারিবদ্ধভাবে আগমন করবে।
•    অতঃপর আল্লাহ তা‘আলার দরবারে বান্দাগণের সমাবেশ হবে, তাদের মধ্য থেকে কোনো কিছুই গোপন থাকবে না, আর মুমিনগণের অপরাধ নির্দিষ্ট করার জন্য একটা সমাবেশ হবে, যাতে তাদেরকে তার প্রতিবেদন দেওয়া যায়, তাদের কাছে তা গোপন রাখা যায় এবং ক্ষমা করা যায়, আর এটাই হলো সহজ হিসাব।
•    আর কঠিন হিসাব হলো জেরা বা চুলচেরা হিসাব-নিকাশ, আর যার সূক্ষ্ম হিসাব নেওয়া হবে তাকে তো শাস্তি দেওয়া হবে, আর জান্নাতবাসীদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছেন, যিনি বিনা হিসাবে কোনো পূর্বশাস্তি ছাড়াই তাতে প্রবেশ করবেন।
•    আর আমলনামা নিয়ে আসা হবে এবং তাতে থাকবে ছোট-বড় সকল কথা ও কাজের রেকর্ড।
•    আর সাক্ষী হিসেবে হাযির করা হবে সংরক্ষণকারী ফিরিশতাগণ, সম্মানিত লেখকবৃন্দ, কান, চোখ এবং সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও ত্বকসমষ্টিকে, আর তাদের নিকট মাযলুমের (নির্যাতিতের) জন্য যালিমের থেকে কিসাস (প্রতিশোধ) নেওয়া হবে।
•    অতঃপর আমলনামাগুলো উড়ানো হবে এবং পৃষ্ঠাগুলো খুলে দেওয়া হবে, তারপর কেউ কেউ তা ডান হাতে গ্রহণ করবে, আমরা আল্লাহর নিকট তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। আবার কেউ কেউ তা তার পিঠের পেছন থেকে বাম হাতে গ্রহণ করবে, আল্লাহর কাছে আমরা আমাদের জন্য ক্ষমাসুন্দর আচরণ প্রত্যাশা করছি।
•    অতঃপর কিয়ামতের দিনে ওজনের পাল্লা স্থাপন করা হবে। তারপর যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই হবেন সফলকাম এবং যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত।
•    আর মানুষ প্রস্থান করবে পুলসিরাতের দিকে অন্ধকারের মাঝে, তারপর মুমিন ও মুনাফিকদের মাঝে পার্থক্য সূচিত হবে, অতঃপর তাদের সকলকে তার হিসাব অনুযায়ী নূর বা আলো প্রদান করা হবে।  
•    আর কিয়ামতের দিনে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য ‘কাউছার’ নামক বিশেষ নি‘য়ামতের ব্যবস্থা থাকবে এবং তার থেকে তার হাউয সম্প্রসারণ করা হবে, যে ব্যক্তি তা থেকে একবার পানি পান করবে, সে পরবর্তীতে কখনও তৃষ্ণার্ত হবে না।
•    তার পানি দুধের চেয়েও অনেক বেশি সাদা হবে, বরফের চেয়ে অনেক বেশি শীতল, মধুর চেয়ে অনেক বেশি মিষ্টি, তার ঘ্রাণ মিশকের চেয়ে অনেক বেশি সুগন্ধযুক্ত এবং তার পানপাত্রের সংখ্যা আকাশের তারকারাজির সংখ্যার মত।
•    আর ‘সিরাত’ হলো জাহান্নামের মধ্যভাগের উপরে সম্প্রসারিত সেতু, মানুষ তার কাছে উপস্থিত হবে তাদের আমল নিয়ে, তারপর কেউ পার হয়ে যাবে নিরাপদে অক্ষতভাবে, আবার কেউ পার হবে আঁচড় খেয়ে আহতবস্থায়, আর অন্যজন জাহান্নামের আগুনে স্তূপ হয়ে পড়বে, আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উপর দাঁড়িয়ে ফিরিশতাগণসহ বলতে থাকবেন:
«رَبِّ سَلِّمْ سَلِّمْ».
“হে আমার রব! শান্তি বর্ষণ করুন, শান্তি বর্ষণ করুন।”
•    তার পরে জান্নাতবাসীগণের মাঝে যুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণের অনুষ্ঠান হবে।
•    আর শেষ দিবসের ওপর ঈমান আনয়নের অন্তর্ভুক্ত অন্যতম আরেকটি দিক হলো, শাফা‘আতের প্রতি ঈমান আনয়ন করা, আর তা সাব্যস্ত হবে দু’টি শর্ত পূরণের মাধ্যমে: সুপারিশকারীর জন্য আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি, আর সুপারিশকারী ও যার জন্য সুপারিশ করা হবে- উভয়ের প্রতি তাঁর (আল্লাহর) সন্তুষ্টি।
•    তন্মধ্যে মহান শাফা‘আতের বিষয়টি আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য নির্দিষ্ট, আর তা হবে বিচার-ফয়সালার কাজটি শেষ করার জন্য, আর তাই হলো ‘মাকামে মাহমূদ’ বা প্রশংসিত স্থান।
•    তন্মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরেকটি শাফা‘আত (সুপারিশ) হবে জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়ার ব্যাপারে এবং তাছাড়া তিনি আরও অনেক সুপারিশ করবেন।
•    তন্মধ্যে আরেকটি শাফা‘আত (সুপারিশ) হবে মুমিনগণ এবং আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী পাপীগণের ব্যাপারে, আর এ প্রকারের শাফা‘আতটি সাব্যস্ত হবে তাঁর জন্য এবং সকল ফিরিশতা, নবী ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গের জন্য।
•    আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফা‘আত (সুপারিশ) দ্বারা সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ হবে: যে ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে তার আন্তরিকতা সহকারে বলেছে:  لا إله إلا الله (আল্লাহ ছাড়া উপাসনার যোগ্য কোনো সত্য ইলাহ নেই)।
•    আর সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ তা‘আলার সুপারিশে বহু লোকজন জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে আসবে।
•    আর আখেরাতের প্রতি ঈমান আনয়নের অন্তর্ভুক্ত অন্যতম আরেকটি দিক হলো, কিয়ামতের দিনে মুমিনগণ কর্তৃক তাদের রবকে দেখার বিষয়টির প্রতি ঈমান আনয়ন করা।
•    আরও ঈমান আনা, আফসোস ও অপমানের দিনে কাফিরগণকে দীদারে ইলাহী থেকে পর্দার আড়াল করে বঞ্চিত করার বিষয়টির ওপর।
•    আর আখেরাতের প্রতি ঈমান আনয়ন করার অন্তর্ভুক্ত অন্যতম আরেকটি দিক হলো: জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতি ঈমান আনয়ন করা।
•    কারণ, জান্নাত হলো সৎব্যক্তিগণের আবাসস্থল, আর জাহান্নাম হলো পাপীদের শেষ ঠিকানা।
•    আর উভয়টি আল্লাহর সৃষ্টি, এখনও স্থায়ীভাবে বিদ্যমান এবং এগুলো ধ্বংস হবে না।
•    আর জান্নাত ও তার নি‘য়ামতরাজির কতগুলো মানগত স্তর ও শ্রেণি রয়েছে, আর জাহান্নাম ও তার শাস্তিরও কতগুলো মান ও ধাপ রয়েছে।
•    আর প্রত্যেকটির জন্য রক্ষক ও দরজার ব্যবস্থা আছে; জান্নাতের আছে আটটি দরজা, আর জাহান্নামের রয়েছে সাতটি দরজা এবং তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
•    সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশকারী সৃষ্টি হলো: এ উম্মাত এবং তারা হবেন তার অধিবাসীদের অর্ধেক বা তার চেয়ে বেশি।
•    আর জান্নাতে সর্বপ্রথম প্রবেশকারী ব্যক্তি হবেন এ উম্মাতের নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাতে সর্বশেষ প্রবশেকারী হবেন এ জাতির পাপী লোকেরা।
•    আর তার অধিকাংশ অধিবাসী হলো: দরিদ্র ও দুর্বলগণ।
•    আর জান্নাতের সকল অধিবাসী কেবল আল্লাহর রহমতে তাতে প্রবেশ করবেন।
•    আর আমাদের উম্মাত ব্যতীত অন্যান্য জাতির অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
•    আর জাহান্নামে অধিকাংশ অধিবাসী হবে নারী।
•    আর যে ব্যক্তি তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদ ও ঈমানের ওপর মারা যেতে পারে নি, সে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামের মধ্যে থাকবে।
•    আর আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী পাপীগণের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে, সে তাতে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে না।
•    অতঃপর প্রত্যেকেই যখন তার আবাসস্থল জান্নাত বা জাহান্নামে পৌঁছে যাবে, তখন মৃত্যুকে যবেহ করা হবে; ফলে আর কখনও কারও মৃত্যু হবে না।
•    আর আখেরাতের প্রতি ঈমান আনয়ন করা, ব্যক্তিকে আনুগত্য করার ব্যাপারে প্রেরণা যোগায়, অবাধ্য হওয়া থেকে দূরে রাখে এবং সার্বক্ষণিক দীনের ওপর অটল রাখে, আর দুনিয়ার ভোগবিলাস ও চাকচিক্যের ব্যাপর সংযমী হতে এবং আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করতে উৎসাহিত করে, আর দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদের সময় ধৈর্য ধারণ করতে অনুপ্রেরণা দেয়।

ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
(الإيمان بالقضاء والقدر)
তাকদীর ও ফয়সালার ওপর ঈমান
•    ঈমানের অন্যতম আরেকটি রুকন হলো: তাকদীর ও ফয়সালার ভালো ও মন্দ এবং মিষ্টতা ও তিক্ততার প্রতি ঈমান আনয়ন করা, আরও মনে প্রাণে বিশ্বাস করা যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তা নির্ধারণ করেছেন যথাযথ অনুপাতে, আর তাঁর ফয়সালা সুনির্ধারিত, অবশ্যম্ভাবী।
•    তাকদীরের মূলকথা হলো, আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির মধ্যে এটা তাঁর একটি গোপন বিষয়, তিনি তাঁর বান্দাগণের নিকট থেকে তার (তাকদীরের) ‘ইলম’ বা জ্ঞানকে লুকিয়ে রেখেছেন এবং তাদেরকে তা জানার চেষ্টা করতে নিষেধ করেছেন।
•    আর তাকদীরের প্রতি ঈমানের চারটি স্তর:
•    প্রথমত: আল্লাহর জ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, যিনি অবগত আছেন যা হয়েছে, যা হবে এবং যা হয়নি, যদি হয় তা কিভাবে হবে; যিনি (আগাম) জানেন তাঁর সৃষ্ট মানুষের হৃদয় যা লুকিয়ে রাখে এবং যা প্রকাশ করে, আরও জানেন তাদের অবস্থাদি ও তাদের কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে এবং তাদের ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে, যেখানে তারা পৌঁছাবে; অতঃপর তিনি তাদেরকে বের করে আনেন এ জগতের দিকে, তারপর তাদেরকে আদেশ করেন, নিষেধ করেন এবং দুঃখ-কষ্টে ফেলে তাদেরকে পরীক্ষা করেন, এমনকি শেষ পর্যন্ত তাদের মাঝে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় তাঁর আগে থেকে জানা বিষয়টি এবং সাথে ফুটে উঠে তার পরিপূর্ণ তাৎপর্যটি- আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٗا ٤٠﴾ [الاحزاب: ٤٠]  
“আর আল্লাহ সর্বকিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪০] যিনি পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী বলে বিশেষিত। সুতরাং তাঁর সাথে সংযুক্ত হয় না কোনো ভুল-ত্রুটি এবং সন্দেহ, সংশয় ও বিভ্রান্তি।
•    দ্বিতীয়ত: আগাম জ্ঞানের ভিত্তিতে নির্ধারিত, সৃষ্টির তাকদীরের লিখের রাখার প্রতি ঈমান আনয়ন করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ مَا فِي ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِۚ إِنَّ ذَٰلِكَ فِي كِتَٰبٍ﴾ [الحج: ٧٠]
“আপনি কি জানেন না যে, আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে আল্লাহ তা জানেন। এসবই তো আছে এক কিতাবে।” [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৭০] আর তা হলো ‘লাওহে মাহফূয’ বা সংরক্ষিত ফলক, আর তা হচ্ছে মূল কিতাব। সুতরাং এমন কোনো সৃষ্টি নেই যার নাম আল্লাহ আসমান ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে নির্দিষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রাখেন নি, অতঃপর তারা তাদের মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় তিনি তাদের সৌভাগ্যবান ও হতভাগ্যদের নাম লিপিবদ্ধ করেছেন এবং লিপিবদ্ধ করেছেন তাদের রিযিক, কর্ম ও জীবনকাল, আর এটা হল পর্থিব জীবনকাল সম্পর্কিত তাকদীর বা পূর্বনির্ধারণ, আর ‘লাইলাতুল ক্বদর’ তথা ভাগ্যরজনীতে লিপিবদ্ধ করেন বার্ষিক তাকদীর, আর বান্দার ওপর সুনির্ধারিত নিয়তির বাস্তব প্রয়োগ হয় তার নির্ধারিত সময়ে- তার নাম হলো দৈনন্দিন তাকদীর, আর প্রত্যেকটি ঘটনার জন্য একটি নির্ধারিত অবস্থান রয়েছে এবং অবশ্যই তোমরা জানতে পারবে।
•    তৃতীয়ত: আল্লাহ তা‘আলার বাস্তবায়নযোগ্য ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের প্রতি ঈমান আনয়ন করা। কারণ, তিনি যা চান হয়ে যায় এবং তিনি যা চান না তা হয় না; তিনি যাকে চান অনুগ্রহ করে হিদায়েত দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা ন্যায়-নীতির ভিত্তিতেই পথভ্রষ্ট করেন। তাঁর সিদ্ধান্ত রদ (বাতিল) করার মতো কেউ নেই, কেউ নেউ তাঁর হুকুমকে পরিবর্তন করার মত এবং তাঁর নির্দেশকে পরাস্ত করার মতোও কেউ নেই, আর বান্দাদেরও ইচ্ছা বা অভিপ্রায় রয়েছে। সুতরাং তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সঠিক ও সতাতার পথ চাইবে, সে তার রবের পথকে গ্রহণ করবে, আর যে ব্যক্তি বিপথে যাওয়ার ইচ্ছা করবে, সে শয়তানকে পরিচালক বা কাণ্ডারী হিসেবে গ্রহণ করবে।
•    আর যে ব্যক্তি কোনো কিছুর ইচ্ছা করবে, বিশ্বাস করতে হবে- তার ইচ্ছার পূর্বেই আল্লাহর ইচ্ছা এবং তার অভিপ্রায়ের পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলার অভিপ্রায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا تَشَآءُونَ إِلَّآ أَن يَشَآءَ ٱللَّهُ رَبُّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٢٩﴾ [التكوير: ٢٩]
“আর তোমরা ইচ্ছে করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ ইচ্ছে করেন।” [সূরা আত-তাকওয়ীর, আয়াত: ২৯] আর আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ও অভিপ্রায়টি তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
•    চতুর্থত: আল্লাহ তা‘আলা সকল কিছুর স্রষ্টা- এ কথার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱللَّهُ خَٰلِقُ كُلِّ شَيۡءٖ﴾ [الرعد: ١٦]
“আল্লাহ সকল বস্তুর স্রষ্টা।” [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ১৬] আর মহান আল্লাহ সকল বান্দা ও তাদের কর্মেরও স্রষ্টা। তিনি বলেন,
﴿وَٱللَّهُ خَلَقَكُمۡ وَمَا تَعۡمَلُونَ ٩٦﴾ [الصافات: ٩٦]
“আর আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমরা যা কর তাও।” [সূরা আস-সাফ্ফাত, আয়াত: ৯৬]
•    আর রবের ওপর হৃদয় মনের ভরসা করাটা উপার্জন ও উপায়-উপকরণ গ্রহণ করাকে নিষেধ করে না, বরং তা (ভরসা করাটা) সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় ও অবলম্বন।
•    আর উপায়-উপকরণের ওপর ভরসা করা মানে ‘তাওহীদ’ তথা একত্ববাদের মধ্যে শির্ক করা, আর তাকে (উপায়-উপকরণকে) নিষ্ফল মনে করাটা হবে বিবেক-বুদ্ধির কমতি বা ঘাটতির কারণ এবং তাকে বিলকুল উপেক্ষা করা মানে শরী‘আতের দলীলের দুর্নাম করা।
•    আর বান্দাকে যা পাবে তাতে কখনও ভুল করবে না, আর বান্দা যা হারাবে তা সে কখনও পাবে না। আর আল্লাহ তা‘আলা যা ফয়সালা করবেন, তা অবশ্যই হবে, আর নির্বোধ হতভাগা সে ব্যক্তি, যে তার নিজের অবস্থাকে তিরস্কার করে, আর শুধু বিপদ-মুসীবত ও দুঃখ-কষ্টের সময়ই তাকদীরকে যুক্তি হিসেবে পেশ করা হবে, দোষ-ত্রুটি ও পাপের বেলায় নয়।
•    আল্লাহ তা‘আলার রহমত ও বিচক্ষণতার পরিপূর্ণতার কারণে মন্দকে তাঁর প্রতি সম্পর্কিত করা যাবে না। সুতরাং যদি মন্দকে কোনোভাবে তাঁর ফয়সালাকৃত বস্তুর প্রতি সম্পর্কিত করা হয়, তাহলে তাঁর পক্ষ থেকে তা ন্যায় ও উত্তম বলে গণ্য হবে।
•    আর তাকদীর ও ফয়সালার ওপর ঈমান স্থাপন করার ফলে সরাসরি উপায়-উপকরণের উপস্থিতির সময়েও হৃদয় মন রবের ওপর নির্ভর করবে, তাকদীরের তিক্ততার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে এবং ধৈর্য বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে সাওয়াবের আশা করবে।

 

 

 

 

তৃতীয় অধ্যায়
(نواقض الإيمان و نواقصه)
ঈমান বিনষ্টকারী ও হ্রাসকারী বিষয়সমূহ

 

 

 


তৃতীয় অধ্যায়
প্রথম পরিচ্ছেদ: কুফরের অর্থ ও প্রকারভেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: শরী‘আতের বিধান প্রয়োগ করার নীতিমালা
তৃতীয় পরিচ্ছেদ: ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়সমূহের প্রকার ও শ্রেণিবিভাগ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ: ঈমান হ্রাসকারী বা ঘাটতিকারক বিষয়সমূহ

 

 

 

 

 

প্রথম পরিচ্ছেদ
(معنى الكفر و أقسامه)
কুফরের অর্থ ও প্রকারভেদ
•    কুফর সাব্যস্ত হবে ঈমান বিনষ্টকারী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার কারণে এবং এমন সব কর্মকাণ্ড জড়িত হওয়ার কারণে, যার ওপর সাধারণত কুফুরীর গুনাহ প্রযোজ্য হয়, আর সেগুলো হলো: কথামালা বা কার্যাবলী বা বিশ্বাসসমূহ, শরী‘আত প্রবর্তক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, এগুলো ঈমানকে নষ্ট করে দেয় এবং জাহান্নামে স্থায়ীভাবে অবস্থান করার বিষয়টিকে অপরিহার্য করে দেয়।
•    আর যাবতীয় গুনাহ ও পাপরাশি ঈমানকে কমিয়ে দেয়, কিন্তু তাকে নষ্ট করে দেয় না।
•    আর ‘কুফর’ মানে ঈমান না থাকা, আর তা যেমনিভাবে বিশ্বাস ও কথার দ্বারা হয়ে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে কাজের দ্বারাও হয়ে থাকে, চাই সে কাজটি আন্তরিকভাবে হউক অথবা শারীরিকভাবে হউক।
•    আর যেমনিভাবে কাজের মাধ্যমে কুফুরী হয়, ঠিক তেমনিভাবে কাজ বর্জন করা ও কাজ থেকে বিরত থাকার দ্বারা এবং সন্দেহ ও সংশয় দ্বারাও কুফুরী হতে পারে।
•    আর ‘কুফর’, ‘শির্ক’, ‘ফিসক’ ও ‘যুলুম’ -এ শব্দগুলো শরী‘আতের পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করা হবে এবং এগুলোর দ্বারা উদ্দেশ্য হবে বড় (الأكبر) অথবা ছোট (الأصغر)।
•    সুতরাং বড়টি (الأكبر): তার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে দেয় এবং তার জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি প্রত্যাহার করে নেয়, আর দলীল-প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করার পর দুনিয়াতে তার ওপর কাফিরদের বিধিবিধানগুলো জারি হবে এবং আখেরাতে সে জাহান্নামে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে, আর সুপারিশকারীগণের কোনো সুপারিশ তার উপকারে আসবে না।
•    আর ছোটটি (الأصغر): তার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দুনিয়া ও আখিরাতে মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে এবং আখেরাতে তার বিষয়টি আল্লাহর তা‘আলার বিবেচনায় থাকবে, তিনি যদি চান তাকে শাস্তি দিবেন এবং যদি চান তাকে ক্ষমা করে দিবেন, আর কিয়ামতের দিনে যারা শাফা‘আত লাভের উপযুক্ত হবে, সে তাদের একজন বলে গণ্য হবে।
•    আর ছোট কুফুরী (الكفر الأصغر) কখনও কখনও নি‘য়ামতের অকৃতজ্ঞতার অর্থে অথবা সর্বনিম্নমানের কুফুরীর অর্থে ব্যবহৃত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿هَٰذَا مِن فَضۡلِ رَبِّي لِيَبۡلُوَنِيٓ ءَأَشۡكُرُ أَمۡ أَكۡفُرُ﴾ [النمل: ٤٠]
“এ আমার রব-এর অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন যে, আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, না অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।” [সূরা আন-নামল, আয়াত: ৪০]
•    আর তার ওপর ভিত্তি করে মুসলিম মিল্লাতে বিদ্যমান থাকাবস্থায় একই ব্যক্তির মধ্যে ঈমান ও কুফরের সমাবেশ ঘটা নিষেধ নয়, আর কুফরের শাখাসমুহের কোনো একটি শাখা বান্দার মাঝে বিদ্যমান থাকাটা সাধারণভাবে তার কাফির হয়ে যাওয়াকে অপরিহার্য করে না, যতক্ষণ না সে প্রকৃত কুফুরীকে সমর্থন ও গ্রহণ করবে।
•    আর যেমনিভাবে ‘আসল ঈমানের’ উপস্থিতি ব্যতীত বান্দাকে উপকৃত করার মতো ‘প্রকৃত ঈমানের’ অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না, ঠিক তেমনিভাবে বান্দা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে না, যতক্ষণ না তার মধ্যে প্রকৃত ‘বড় কুফর’ (الكفر الأكبر)-এর উপস্থিতি বিদ্যমান থাকবে।    

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
(ضوابط إجراء الأحكام)
শরী‘আতের বিধান প্রয়োগ করার নীতিমালা
•    কুফর ও কাফির বলে আখ্যায়িত করার বিষয়টি একটি শরী‘আতী বিধান এবং এ উভয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়ার একমাত্র মালিক হলেন আল্লাহ তা‘আলা।
•    আর যে ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে সাব্যস্ত হবে, তা কোনো প্রকার সন্দেহের দ্বারা বিলীন বা বিলুপ্ত হবে না, আর সুস্পষ্টভাবে গ্রহণ করা ইসলামকে সুস্পষ্ট কুফুরী ব্যতীত বিনষ্ট করা যায় না।
•    আর কাফির, ফাসিক অথবা বিদ‘আতপন্থী বলে সাব্যস্ত করার ব্যাপারে ভুল করার চেয়ে এসব (কাফির, ফাসিক অথবা বিদ‘আতপন্থী) বলে আখ্যায়িত না করার ব্যাপারে ভুল করাটা অনেক বেশি সুবিধাজনক।
•    আর দুনিয়াতে শরী‘আতের বিধিবিধানগুলো প্রযোজ্য হবে বাহ্যিক অবস্থা ও শেষ বিষয় বা কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে। সুতরাং যে ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে ঈমানের বিষয়টি প্রকাশ করবে, তাকে ঈমানদার বলে সিদ্ধন্ত দেওয়া হবে, আর যে ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে ঈমানের বিপরীত কিছু প্রকাশ করবে, তাকে অবিশ্বাসী বলে সিদ্ধন্ত দেওয়া হবে, আর অন্তরের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণের  দায়িত্বটি ন্যস্ত থাকবে গায়েবী জগতের বিষয়ে সুবিজ্ঞ আল্লাহর ওপর।
•    আর সুনির্দিষ্ট করে নয়, বরং সাধারণ অবস্থার ওপর ভিত্তি করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মৃত ব্যক্তিগণের ব্যাপারে জাহান্নামে স্থায়ীভাবে অবস্থান করা থেকে নাজাতের বিষয়টি দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করা হবে এবং কাফির ও নাস্তিক সম্প্রদায়ের মৃত ব্যক্তিদের ব্যাপারে জাহান্নামে স্থায়ীভাবে অবস্থান করার বিষয়টি নিশ্চিতরূপে বলা হবে।
•    আর নিষিদ্ধ কর্মে জড়িত হওয়ার ব্যাপারে সাধারণভাবে যে সব হুমকি বর্ণিত হয়েছে, তা সেই নিষিদ্ধ কাজে জড়িত হওয়া ব্যক্তির ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে নির্দিষ্টভাবে পতিত হওয়া দাবি করে না; চাই সে নিষিদ্ধ করা বিষয়টি কথা হউক অথবা কাজ হউক অথবা বিশ্বাসের বিষয় হউক।
•    কারণ, সাধারণ হুকুমের বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়াকে আবশ্যক করে না। সুতরাং শর্তসমূহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে দলীল-প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করার পরেই শুধু ব্যক্তি বিশেষের ওপর হুকুম জারি হবে। সে কাজটি জেনে শুনে করেছে কি না, তার উদ্দেশ্য কী ছিল, সে কি তা ইচ্ছাকৃত করেছে, এসব জানতে হবে। সাথে সাথে তাকে নির্দিষ্ট হুকুমের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে কোনো বাধা আছে কী না তাও জানতে হবে।
•    আর যে ব্যক্তি দাওয়াতের বিষয়টি বুঝতে পারেনি, সে ব্যক্তির ওপর দলীল-প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয় নি।
•    আর ওযরের (যৌক্তিক কারণে অক্ষমতার) বিষয়টি দীনের মূলনীতি ও শাখা-প্রশাখায় এবং ইজমা ও ইখতিলাফের (মেতনৈক্যের) জায়গায় সমান তালে প্রযোজ্য হবে।
•    আর অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এবং সামগ্রিকভাবে যখন অজ্ঞতার সম্ভবনা দেখা দেবে, তখন যুক্তি-প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত ও সঠিক বিষয় স্পষ্ট হওয়া পর্যন্ত তা ‘ওযর’ বলে গণ্য হবে।
•    আর দার্শনিক ও বাতেনীয়াগণ কর্তৃক অপব্যাখ্যা কৃত এমন প্রতিটি অপব্যাখ্যা, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার শামিল অথবা দীনের অপরিহার্য কোনো মূলনীতিকে অস্বীকার করার শামিল এবং এ ধরনের অপব্যাখ্যা করতে তাকে বাধ্য করা হয়নি, তাহলে এমন অপব্যাখ্যাকারী কাফির হয়ে যাবে।
আর যে ব্যক্তি এরূপ নয়, সে হবে দুই জনের একজন, যাদের একজন গুনাহগার হবে, তবে কাফির হয়ে যাবে না। যেমন, ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মুরজিয়া, মু‘তাযিলা ও তাদের অনুরূপ সম্প্রদায়ের সকল লোকজন যেভাবে ব্যাখ্যা করে থাকে। আর অপরজন গুনাহগার হবে না, তাকে বিদ‘আতপন্থী ও কাফিরও বলা যাবে না, যেমন, ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মুজতাহিদগণ যেভাবে আকিদা-বিশ্বাস ও শরী‘আতের শাখা-প্রশাখাসমূহ নিয়ে ব্যাখ্যা করে থাকেন।
•    আর জবরদস্তি ও বলপ্রয়োগের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য ওযর বলে বিবেচিত হবে, যা শরী‘আতের বিধিবিধান প্রয়োগ করতে বাধা প্রদান করে। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِلَّا مَنۡ أُكۡرِهَ وَقَلۡبُهُۥ مُطۡمَئِنُّۢ بِٱلۡإِيمَٰنِ﴾ [النحل: ١٠٦]  
“তবে তার জন্য (মহাশাস্তি) নয়, যাকে কুফুরীর জন্য বাধ্য করা হয়, কিন্তু তা হৃদয় ঈমানে অবিচলিত।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১০৬]
•    আর যদি কোনো কথা কুফরির দিকে নিয়ে যায় এমন কথায় কাফির বলা হলে, তা তৎক্ষণাৎ কুফুরী বলে গণ্য হয় না। আর কোনো কথা বা মাযহাব (মতবাদের) সরাসরি মেনে না নিলে সেটার দাবী অনুযায়ী কাউকে কাফির বা বিদ‘আতপন্থী বলে আখ্যায়িত করা শুদ্ধ হবে না।
•    আর সামগ্রিকভাবে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ব্যাপারে রায় বা সিদ্ধান্ত দেওয়ার বিষয়টি ন্যস্ত হবে গ্রহণযোগ্য বিচারকগণের ওপর এবং দীনের ব্যাপারে অভিজ্ঞ ফকীহ ইমামগণের মধ্য থেকে সুদক্ষ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গের ওপর।  

তৃতীয় পরিচ্ছেদ
( أنواع النواقض و أقسامها )
ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়সমূহের প্রকার ও শ্রেণিবিভাগ
•    আর ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়গুলো হবে আন্তরিক বিশ্বাসে অথবা হবে কথায় বা কাজে।
•    সে বিষয়গুলো আবার চার ভাগে বিভক্ত। প্রথমত: তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদ এবং উলুহিয়্যাত তথা আল্লাহর ইবাদতের ব্যাপার ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়। দ্বিতীয়ত: নবুওয়াতের ক্ষেত্রে ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়। তৃতীয়ত: গায়েব তথা অদেখা বিষয়গুলোর ব্যাপারে ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়। চতুর্থত: বিভিন্ন বিষয়ে ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়।
•    সুতরাং তাওহীদের ক্ষেত্রে আন্তরিক বিশ্বাস বিনষ্টকারী বিষয়সমূহের মধ্য থেকে কিছু বিষয় আছে এমন, যা তার অন্তরের বিশ্বাস ও কথার বিপরীত ও বিরোধী হয়; আবার কিছু বিষয় আছে এমন, যা তার কাজের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হয়।
তাওহীদের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্তরের বিশ্বাস বিনষ্টকারী বিষয়গুলো হলো:
•    ‘রুবূবিয়্যাত’ এর গুণাবলীর ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্য থেকে কারও মাঝে শির্কের সম্পর্ক স্থাপন করা; যেমন, সৃষ্টি, রাজত্ব, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ এবং ইলমুল গাইবের ক্ষেত্রে শির্ক করা অথবা ওয়াহদাতুল ওজুদ (সর্বেশ্বরবাদ “প্রকৃত বিরাজমান সত্তা একমাত্র আল্লাহ”) -এ মতবাদে বিশ্বাস করা অথবা “আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টিরাজির মধ্যে অবস্থান করেন” -এ মতবাদে বিশ্বাস করা।
•    আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উলুহিয়্যাত ইবাদাতে বিশ্বাস করা অথবা আল্লাহ ব্যতীত তাকে বা আল্লাহর সাথে তাকেও ইবাদতের উপযুক্ত মনে করা।
•    আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে অথবা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে অথবা তাঁর কিতাবের ব্যাপারে অথবা তাঁর শরী‘আত ও বিধিবিধানের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা।
•    আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহ ও গুণাবলীর ব্যাপারে অবিশ্বাস করা -তা অস্বীকার করার দ্বারা অথবা আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহের দ্বারা দেব-মূর্তির নামকরণ করার মাধ্যমে অথবা আল্লাহ তা‘আলাকে অসম্পূর্ণতা বা মন্দের দ্বারা গুণান্বিত করার দ্বারা অথবা গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলাকে তাঁর সৃষ্টির সাথে তুলনা করা। (তারা যা বলে, আল্লাহ তা থেকে অনেক বড় ও মহান।)
তাওহীদের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্তরের আমল বিনষ্টকারী বিষয়গুলো হলো:
•    অহঙ্কার ও ঔদ্ধত্য প্রকাশের মাধ্যমে কুফুরী করা, আর তা হলো ইবলিস ও রাসূলগণের শত্রুদের কুফুরী, আর তার আসল তাৎপর্য হলো আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের প্রতি আত্মসমর্পণ করা থেকে বিরত থাকা।
•    আর অন্তরের আমল বিনষ্টকারী আরেকটি বিষয় হলো: নিয়ত, ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের শির্ক। তন্মধ্যে কিছু বড় শির্ক, আবার কিছু ছোট শির্ক।
•    তন্মধ্য থেকে আরেকটি হলো: মহব্বতের (ভালোবাসার) শির্ক। যেমন, আল্লাহকে ভালোবাসার মতো করে কোনো সৃষ্টিকে ভালোবাসা।
আর তাওহীদের সাথে সংশ্লিষ্ট ঈমান বিনষ্টকারী কথা:
•    যেমন, আল্লাহ তা‘আলাকে গালি দেওয়া, তাঁর সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা অথবা তাঁর কিতাবকে গালি দেওয়া, আর এ উভয়টি বিষয় ইজমার দ্বারাও প্রমাণিত।
আর তাওহীদের সাথে সংশ্লিষ্ট ঈমান বিনষ্টকারী আমলগুলো হলো:
•    ইবাদত ও কুরবানীর মধ্যে শির্ক করা। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদত করবে, সে কুফুরী বা শির্ক করল; যেমন, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারও উদ্দেশ্যে যবেহ করা অথবা মানত করা অথবা তাওয়াফ করা অথবা সালাত আদায় করা অথবা তিনি ছাড়া অন্য কারও নিকট প্রার্থনা করা।
•    তন্মধ্যে আরেকটি হলো: আল্লাহ তা‘আলা যা নাযিল করেছেন, তা ব্যতীত অন্যভাবে বিচার-ফয়সালা করা; এর মধ্য থেকে কিছু বড় কুফরী এবং কিছু ছোট কুফরী।
সুতরাং যে ব্যক্তি কোনো একটি বা একাধিক ঘটনায় স্বীয় প্রবৃত্তির কারণে অথবা ঘুষ গ্রহণ করার কারণে অথবা ভয়ে অথবা দুনিয়াবী কোনো স্বার্থের কারণে অথবা এ ধরনের যে কোনো কারণে স্বীয় অপরাধের স্বীকৃতি প্রদান এবং অবাধ্যতার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসসহ আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করার বিষয়টি বর্জন করল, সে ব্যক্তি স্বল্প মাত্রার কুফুরী করল, আর কুফুরীর উপরে কুফুরী আছে।
আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করার বিষয়টি বর্জন করবে তার পরিবর্তন করাটাকে বৈধ মনে করে অথবা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও কাছ থেকে বিধান গ্রহণ করার মাধ্যমে, অথবা তার আবশ্যকতাকে অস্বীকার করে অথবা মনে করে যে তাতে তার স্বাধীনতা আছে অথবা মনে করে যে আল্লাহর বিধান যথাযথ নয় অথবা তিনি ছাড়া অন্যের বিধান খুব লাগসই অথবা মনে করে যে তা আল্লাহর বিধানের সমান, সে ব্যক্তি কাফির বলে গণ্য হবে এবং মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ (বহিষ্কার) হয়ে যাবে, তবে এ সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত হবে দলীল-প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করা এবং সন্দেহ-সংশয় দূর করার পর।
আর দেশের মধ্যে এবং জনগণের হৃদয়ে আল্লাহ শাসনব্যবস্থার ভিত্তিতে শরী‘আতের কর্তৃত্ব ও প্রভাব প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করা শরী‘আতসম্মতভাবে ফরয এবং সন্তোষজনক কাজ, আর তা করতে হবে উম্মাতের পূর্ববর্তীগণের অনুধাবন ও ব্যাখ্যার দ্বারা কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে, যাতে অর্জিত আকিদা-বিশ্বাসকে দোষত্রুটি থেকে নিষ্কণ্টক রাখা যায় এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসরণীয় জীবন-পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষালাভ করা যায়।
•    আর হালাল বা বৈধকারী, (সে ব্যক্তি যে আল্লাহর বিধান ব্যতীত অন্য বিধানে ফয়সালা করা হালাল মনে করেছে) যার কাফির হওয়ার ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ঐকমত্য পোষণ করেছে, সেটা (দু’ভাবে হতে পারে) :
কখনও হয়ে থাকে শরী‘আতের বিধানকে বিশ্বাস না করার কারণে, বস্তুত এটা মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কুফুরী পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, যা ঈমানের ক্ষেত্রে বিশ্বাসের রুকনটি বিনষ্টকারী।
আবার কখনও কখনও (সে হালাল মনে করার বিষয়টি) সংঘটিত হয়ে থাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধানকে প্রত্যাখ্যান করার কারণে এবং তা পালন বা গ্রহণ না করার কারণে, বস্তুত এটা অহঙ্কার ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ কুফুরী পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, যা (ঈমানের অন্যতম শর্ত) আত্মসমর্পণের রুকনটি বিনষ্টকারী।
•    আর সন্তুষ্ট চিত্তে ও ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত বিধানের বাইরে গিয়ে বিচার চাওয়া বা আপিল করা নিফাকী, যা ঈমানের সাথে একত্রিত হতে পারে না।
•    আর কথা, কাজ ও শাসন-পদ্ধতির এমন প্রতিটি সংঘটিত ও উদ্ভাবিত বিষয়ই বাতিল বলে গণ্য হবে, যা শরী‘আতের বিপরীত, তার কোনো মর্যাদা নেই এবং নেই কোনো প্রভাব, যার ওপর তা বিন্যাস হতে পারে; কিন্তু জরুরি অবস্থা যদি কোনো দিকে আহ্বান করবে সেটা ভিন্ন ব্যাপার।
আর নবুওয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট ঈমান বিনষ্টকারী আন্তরিক বিশ্বাসগত বিষয়গুলো:
•    কোনো ব্যক্তির জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা ব্যতীত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কোনো পথ আছে বলে বিশ্বাস করা অথবা তাঁর অনুসরণ করা তার ওপর ওয়াজিব নয় বলে বিশ্বাস করা অথবা অন্যের জন্য তাঁর অনুসরণ করা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে বলে বিশ্বাস করা।
•    আর তন্মধ্য থেকে আরেকটি বিষয় হলো: স্বয়ং নিজেই নবুওয়াত দাবি করা অথবা অন্য নবুওয়াত দাবিকারীর প্রতি বিশ্বাস করা অথবা নবুওয়াতের ধারা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও নবীর আগমনের বিষয়কে বৈধ মনে করা অথবা ‘খতমে নবুওয়াত’ তথা নবুওয়াতের পরিসমাপ্তির বিষয়টিকে অস্বীকার করা।
•    আরেকটি বিষয় হলো: নাযিলকৃত সকল কিতাবকে অস্বীকার করা অথবা বিস্তারিতভাবে যেসব কিতাবের প্রতি ঈমান স্থাপন করা ওয়াজিব, সেসব কিতাবের কিছু কিছু কিতাবকে অস্বীকার করা, বস্তুত এসবের প্রত্যেকটিই ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট মনের কথার বিপরীত বিষয়।
•    আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, তাকে ঘৃণা ও অপছন্দ করা; যা ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট ভালোবাসা, সন্তুষ্টি ও কবুল বা গ্রহণ করার বিরোধী বিষয়।  
আর নবুওয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট ঈমান বিনষ্টকারী মৌখিক বিষয়গুলো:
•    সাধারণভাবে নবীগণকে গালি দেওয়া অথবা নির্দিষ্টভাবে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দেওয়া। সুতরাং যে ব্যক্তি আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অথবা নবীগণের কোনো একজনকে অবজ্ঞা করবে অথবা তাদেরকে বিদ্রূপ ও তুচ্ছ জ্ঞান করবে অথবা তাদেরকে কষ্ট দিবে, সে ব্যক্তি সর্বসম্মতিক্রমে কাফির।
আর নবুওয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট ঈমান বিনষ্টকারী ব্যবহারিক বা কার্যগত বিষয়গুলো:
•    মাসহাফ বা কিতাবের সাথে অশ্রদ্ধা ও অপমানজনক ব্যবহার করা, যেমন, তাকে পায়ের নীচে রাখা অথবা তাকে ময়লা ও আবর্জনার মধ্যে নিক্ষেপ করা অথবা কম বা বেশি করার মাধ্যমে তাকে পরিবর্তন ও বিকৃত করার চেষ্টা করা।  
আর গাইব বা অদৃশ্য বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ঈমান বিনষ্টকারী ‌আন্তরিক ও মৌখিক বিষয়গুলো:
•    ফিরিশতাগণ অথবা জিন্নকে অস্বীকার করা অথবা এদের কাউকে গালি দেওয়া বা এদের কোনো কিছুর সাথে বিদ্রূপ করা, আর তা হলো ওহীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা এবং ইজমাকে লঙ্ঘন করা।
•    তন্মধ্যে আরও কিছু বিষয় হলো: পুনরুত্থান এবং আল্লাহ দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও হুমকিকে অস্বীকার করা অথবা এগুলোর কোনো কিছুর সাথে উপহাস করা এবং গালি দেওয়া।

ঈমান বিনষ্টকারী আরও কতগুলো বিষয়
•    তন্মধ্যে কিছু বিষয় এমন, যেগুলোর ব্যাপারে সকলে একমত। আবার তন্মধ্যে একন কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলোর ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে।
•    সুতরাং যেসব বিষয়ে সকলে একমত, তন্মধ্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা মনের ঈমানের কথার বিপরীত: দীনের আবশ্যকীয় জানা বিষয় অস্বীকার করা। যেমন, নারীর পর্দার বিষয়টিকে মৌলিকভাবে অস্বীকার করা এবং ঢালাওভাবে নগ্নতা ও বিবস্ত্র হওয়াকে বৈধ মনে করা।
•    তন্মধ্যে যা অন্তরের বিশ্বাস ও কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট ঈমানের বিপরীত: তা হচ্ছে নিফাক (কপটতা), আর তা হলো অন্তরে যা আছে, তার বিপরীত কথা বলা ও কাজ করা।
তন্মধ্যে কিছু আছে যা ব্যক্তিকে কাফির বানিয়ে দেয়, আর তা হলো বড় ধরনের নিফাক বা কপটতা, আর কিছু আছে যা ব্যক্তিকে কাফির বানিয়ে দেয় না, আর তা হলো ছোট ধরনের নিফাক, যা পাপ ও অপরাধ জাতীয়।  
•    তন্মধ্যে যা কিছু অন্তরের কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট ঈমানের বিপরীত: কাফিরদের সাথে বন্ধুত্বের কিছু কিছু ব্যাপার। সুতরাং যে ব্যক্তি কোনো কাফিরকে বন্ধু বলে গ্রহণ করল তার কুফুরীর কারণে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি তার আসল ঈমানই নষ্ট হয়ে গেল, আর এ একই শ্রেণিভুক্ত হলো হালাল, হারাম ও শরী‘আতের ক্ষেত্রে তাদের অনুসারী ব্যক্তি, আর তাদের ধর্মীয় বিষয়ে তাদের অনুসরণ ও অনুকরণকারী ব্যক্তিবর্গ।
•    আর মুসলিমগণের বিরুদ্ধে কাফিরগণকে সমর্থন ও সহায়তা করার কয়েকটি মান ও স্তর রয়েছে। তন্মধ্যে কোনো কোনোটি ঈমান নষ্ট করে দেয়, আবার কোনোটি এর চেয়ে নিম্নস্তর ও স্বল্পমানের।
•    তন্মধ্যে আরেকটি হলো: সকল ধর্মকে এক করার দাওয়াত দেওয়া অথবা সকল ধর্মকে বা যে কোনো একটিকে দীন হিসেবে গ্রহণ করার বিষয়টিকে বিশুদ্ধ বলে দাবি করা অথবা ইসলাম ছেড়ে অন্য যে কোনো ধর্মে বিবর্তিত হওয়াকে বৈধ মনে করা।
•    আর তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, যার মানে জীবন থেকে দীনকে পুরাপুরিভাবে বা আংশিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, (এটিও ঈমান বিনষ্টকারী কুফরী) বস্তুত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও ঈমান -এ দু’টি পরস্পর বিরোধি ও বিপরীত, যারা একত্রিত হতে পারে না। কারণ, ওহীর দলীলের কারণে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বাস্তবেই একটি বাতিল মতবাদ এবং তাওহীদ ও নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের বিরোধী ও বিপরীত মতবাদ।
আর মতবিরোধপূর্ণ ঈমান বিনষ্টকারী  কিছু বিষয়:
•    সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমকে গালি দেওয়া। আর বিশুদ্ধ কথা হলো: যে ব্যক্তি তাদের সকলকে অথবা তাদের অধিকাংশকে গালি দিবে এবং তাদেরকে কুফুরী করার অভিযোগে অভিযুক্ত করবে, সে ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে, আর যে ব্যক্তি তাদের দীনের ব্যাপারে কোনো রকম অপবাদ না দিয়ে তাদের কাউকে কাউকে গালি দেয়, তাহলে সে কাফির হবে না (বরং ফাসিক বলে গণ্য হবে)।
•    জাদু করা: আর এ ব্যাপারে সহীহ কথা হলো, যে জাদু কাজে, কথায় বা বিশ্বাসে এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত করে, যা কুফুরীকে অপরিহার্য করে, সে জাদু কুফুরী বলে গণ্য হবে, আর যদি তা না হয়, তাহলে কুফুরী হবে না। আর যদি তা শিক্ষা করা এবং শিক্ষা দেওয়া এমন কিছুকে শামিল করে, যা কুফুরীকে অপরিহার্য করে, তখন তা কুফুরী বলে গণ্য হবে, আর যদি তা না হয়, তাহলে কুফুরী হবে না।
•    জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করা বা গ্রহ-নক্ষত্র দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করা: আর এ ব্যাপারেও সহীহ কথা হলো, যে জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা গ্রহ-নক্ষত্র পূজা করাকে অন্তর্ভুক্ত করে অথবা সৃষ্টির মধ্যে সেগুলোর ক্ষমতা বা হস্তক্ষেপের বিশ্বাসকে শামিল করে অথবা ‘গায়েব’ তথা অদৃশ্যের জ্ঞানের দাবিকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, তা কুফুরী বলে গণ্য হবে, আর যদি তা না হয়, তাহলে কুফুরী হবে না।
•    আর অস্বীকার করে নয়, বরং অলসতা করে যে সালাত বর্জন করা হয়, তার বিধানের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। যিনি সালাত বর্জনকারীকে সাধারণভাবে কাফির বলেন, তিনি তার সাথে দ্বিমত বা ভিন্নমত পোষণকারীকে মুরজিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী বলে অপবাদ দেন নি, আর যিনি সালাত বর্জনকারীকে কাফির বলেননি, তিনি তার সাথে ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তিকে খারেজী সম্প্রদায়ের অনুসারী বলে অভিযুক্ত করেন নি।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ
(نواقص الإيمان)
ঈমান হ্রাসকারী বা ঘাটতিকারক বিষয়সমূহ
•    আর ঈমান হ্রাসকারী বিষয়সমূহ: (আর তা হচ্ছে এমন) কথামালা, কার্যাবলী ও বিশ্বাসসমষ্টি— শরী‘আত প্রবর্তক সিদ্ধান্ত পেশ করেছেন যে, এগুলোর দ্বারা ঈমান কমে, কিন্তু একেবারে বিনষ্ট হয়ে যায় না।
•    আর ঈমান হ্রাসকারী বিষয়সমূহ যেমন: ছোট শির্ক এবং কবীরা ও সগীরা গুনাহসমূহ।
•    আর ছোট শির্ক (الشرك الأصغر): তা এমন পর্যায়ের শির্ক, কুরআন ও সুন্নাহ’র বক্তব্যের মধ্যে যা শির্ক নামে বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু তা বড় শির্ক (الشرك الأكبر)-এর সীমানায় উন্নীত হয়নি। কারণ, তা বড় শির্কের মাধ্যম বা উপলক্ষের মত।
•    আর যেমনিভাবে বড় শির্ক (الشرك الأكبر) সকল আমলকে বিনষ্ট করে দেয়। ঠিক তেমনিভাবে ছোট শির্ক (الشرك الأصغر) সকল আমল নষ্ট করে না; বরং তার সাথে সংশ্লিষ্ট আমলটিকে নষ্ট করে দেয়।
•    আর ছোট শির্ক (الشرك الأصغر) ও বড় শির্ক (الشرك الأكبر)-এর  মাঝে কতগুলো বিষয় দ্বারা পার্থক্য নির্ণয় করা যায়। যেমন,
তার ব্যাপারে শরী‘আতের সুস্পষ্ট বক্তব্য। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ».
“আমি তোমাদের ব্যাপারে যেসব বিষয়ে ভয় করি, তন্মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো ছোট শির্ক।”  
আর ওহীর বক্তব্যসমূহ থেকে সাহাবীগণের বুঝ ও উপলব্ধি। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ ، فَقَدْ كَفَرَ أَوْ أَشْرَكَ».
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে শপথ করল, সে কুফুরী করল অথবা শির্ক করল।”  
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
«الطِّيَرَةُ شِرْكٌ».
“কুলক্ষণ নেওয়া শির্ক।”
আর তার নির্দেশক হিসেবে যা এসেছে, তার আসাটা অনির্দিষ্টভাবে, নির্দিষ্টভাবে নয়। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إن الرُّقَى والتَّمَائِمَ والتِّوَلَةَ شِرْك»
“নিশ্চয় জাদু-মন্ত্র, তাবিজ-কবচ ও বশীকরণবিদ্যা শির্ক।”
আর ছোট শির্ক (الشرك الأصغر) কবীরা গুনাহ’র চেয়ে মারাত্মক ও ভয়াবহ, আর ঈমানের সাথে তার (নেতিবাচক) সম্পর্কের বিষয়টি সুস্পষ্ট এবং অনেক বেশি।
•    আর ‘কবীরা’ গুনাহ (الكبائر) হলো: যা দুনিয়াতে লা‘নত (অভিশাপ) অথবা ‘হদ’ (শরী‘আত নির্ধারতি শাস্তি)-এর উপযুক্ত করে অথবা আখেরাতে শাস্তির অনুগামী করে, আর কবীরা গুনাহ’র মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: জীবন হত্যা, সুদ, ব্যভিচার, অপবাদ এবং যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা।
•    আর ‘সগীরা’ গুনাহ (الصغائر) হলো: যা কবীরা গুনাহসমূহের মানে বা সীমানায় উন্নীত হয় নি, আর যে ব্যক্তি কবীরা গুনাহসমূহ থেকে বিরত থাকে, তার সগীরা গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।
উদাহরণস্বরূপ ঈমান হ্রাসকারী কিছু বিষয় :
•     ইবাদতের ক্ষেত্রে সামান্য ‘রিয়া’ বা লৌকিকতা প্রদর্শন, প্রাণবিশিষ্ট সৃষ্টিজীবের ছবি অঙ্কন। আর বরকত অর্জনের জন্য কবরের মাঝে ও তার দিকে ফিরে সালাত আদায় করা, আর কবরকে মাসজিদ হিসেবে গ্রহণ করা এবং তার ওপর ঘর বা প্রাসাদ নির্মাণ করা, আর আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের নামে শপথ করা। আল্লাহ তা‘আলার নিকট সৃষ্টির সাহায্যে সুপারিশ প্রার্থনা করা, আর যেসব নাম ও গুণাবলী আল্লাহ তা‘আলার জন্য খাস (নির্দিষ্ট), সেসব নামে নাম রাখা, আর তাঁর নামসমূহ ছাড়া অন্যের সাথে বান্দা বা দাসের সম্পর্কযুক্ত করে নাম রাখা বা ডাকা (যেমন, ‘আবদুশ শামছ’ তথা সূর্যের বান্দা বা দাস, কালীদাস ইত্যাদি); বিদ‘আত পন্থায় ঝাঁড়-ফুক করা, তাবিজ-কবচ ব্যবহার করা, বিদ‘আতপন্থী জ্যোতিষীর নিকট আসা-যাওয়া করা, অশুভ লক্ষণ বলে বিবেচনা করা। আর জাহেলী দল এবং জাতিগত ও বর্ণবাদী জাতীয়তাবাদের সমর্থন করা, আর সে ক্ষেত্রে বাতিল ধর্মের অনুসারীদের অনুসরণ ও অনুকরণ করা, যা তাদের ধর্মীয় বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত নয়, আর এ বিষয়গুলোর কিছু বিষয় শির্কের মাধ্যম বা উপায়-উপকরণ। আর কিছু বিষয় হলো এর চেয়ে নিম্নমানের অপরাধ।

 

 

 

 


চতুর্থ অধ্যায়
(مسائل متفرقات)
বিবিধ মাসআলা

 

 

 

 

 

 

চতুর্থ অধ্যায়
প্রথম পরিচ্ছেদ: আলে বাইত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমের ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের আকিদা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: সাহাবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমের ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের ‘আকিদা  
তৃতীয় পরিচ্ছেদ: আলেমগণের প্রতি আবশ্যকীয় কর্তব্য
চতুর্থ পরিচ্ছেদ: ইমামত বা নেতৃত্ব
পঞ্চম পরিচ্ছেদ: বিদ‘আত ও তার অনুসারীদের ব্যাপারে অভিমত
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ: বিদ‘আতের অনুসারীদের সাথে ব্যবহার
সপ্তম পরিচ্ছেদ: আল্লাহর দিকে আহ্বান, সৎ কাজের নির্দেশ ও জিহাদ
অষ্টম পরিচ্ছেদ: ঐক্য ও সংহতি কামনা করা এবং বিভেদ ও অনৈক্যকে প্রত্যাখ্যান করা   


প্রথম পরিচ্ছেদ
(عقيدة أهل السنة في آل البيت رضي الله عنهم)
আলে বাইত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমের ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের আকিদা
•    আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবার-পরিজন হলেন তারা, যাদের জন্য সাদকা গ্রহণ করা হারাম, আর তারা হলেন- আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র পরিবার-পরিজন, জা‘ফর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র পরিবার-পরিজন, ‘আকীল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র পরিবার-পরিজন, ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র পরিবার-পরিজন এবং হারেছ ইবন আবদিল মুত্তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র সন্তানগণ।
•    আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবার-পরিজনের অন্তর্ভুক্ত হলেন- তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণ, তারা দুনিয়াতে ও সর্বোচ্চ জান্নাতে তাঁর একান্ত প্রিয় সঙ্গীনী। তারা হলেন- মুমিনগণের জননী, যাদের থেকে আল্লাহ সকল প্রকার পঙ্কিলতা দূর করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে পবিত্র করেছেন সকল প্রকার কলুষতা ও অপবিত্রতা থেকে; বিশেষ করে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা, যিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে আমৃত্যু এককভাবে সংসার করেছেন। কারণ, তিনি তাঁর বর্তমানে আর কোনো বিয়ে করেন নি। আর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটু ভিন্ন মেজাজের সংসার করেছেন। কেননা তাঁকে তিনি ভিন্ন অন্য কেউ বিয়ে করেন নি।
•    আর তাঁর পরিবার-পরিজনের অন্তর্ভুক্ত হলেন: যাদেরকে তিনি পোশাক বা আচ্ছাদন দ্বারা আবৃত করেছেন। তারা হলেন- আলী ও ফাতেমা, হাসান ও হোসোইন এবং তাদের বংশধর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈন।
•    আর তারা হলেন শ্রেষ্ঠতম পূণ্যবান ব্যক্তিবর্গ এবং পবিত্রতম বংশধর, মর্যাদাবান গৌরবময় পরিবার এবং বংশগতভাবে সবচেয়ে সম্মানিত।
•    আর তাদেরকে মহব্বত করার মাধ্যমে আহলে সুন্নাতের জনগোষ্ঠী আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন করেন, আর তাদের প্রতিরক্ষা ও মর্যাদা সুরক্ষার মাধ্যেমে তারা দীনদারি হাসিল করেন, আর তাদেরকে যারা ঘৃণা করে অথবা দুর্ণাম করে তারা প্রকাশ্যে তাদেরকে ঘৃণা করার কথা ঘোষণা করে, আর তাদেরকে ভালোবাসার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক দেওয়া নির্দেশের প্রতি আমল করেন।
•    আর তারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন এবং তাদেরকে সম্মান করেন, আর (এ ক্ষেত্রে) তারা ভণ্ড ও ফাঁকিবাজদের তরীকা থেকে মুক্ত।
•    আর তারা তাদের ব্যাপারে কোনোরূপ বাড়াবাড়ি করনে না এবং তাদেরকে নিষ্পাপ মনে করনে না, আর (এ ক্ষেত্রে) তারা রাফেযী (শিয়া)দের তরীকা থেকে মুক্ত।
•    আর তারা তাদের মধ্যকার ‘মুহসিন’ বান্দাকে উচ্চমর্যাদায় তুলে ধরেন এবং তাদের মধ্যকার সমালোচিতজনের উদ্দেশ্যে এমন কথা বলেন, যা তাদের নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ بَطَّأَ بِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ»
“যে ব্যক্তিকে তার আমল পিছিয়ে দেবে, তার বংশমর্যাদা তাকে এগিয়ে দিতে পারবে না।”
•    আর যে ব্যক্তি উত্তম বংশ ও সৎ আমলের মধ্যে সমন্বয় করতে পারবে, সে ব্যক্তি দ্বিগুণ ভালো অর্জন করতে পারল এবং দ্বিগুণ মর্যাদা লাভ করল।          

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
(عقيدة أهل السنة في الصحابة رضي الله عنهم)
সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমের ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের আকিদা
•    আর তারা (সাহাবীগণ) হলেন আল্লাহর সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সাথী, আল্লাহর নিকট আল্লাহর নবীগণের পরে সবচেয়ে পছন্দনীয় সৃষ্টি।
•    ঈমানের দিক থেকে তারা হলেন অগ্রগামী পূর্বপুরুষ এবং তারা হলেন রহমানের সন্তুষ্টি অর্জনকারী ব্যক্তিবর্গ।
•    তাদেরকে মহব্বত করাটা আনুগত্য ও ঈমান এবং তাদেরকে ঘৃণা করাটা নিফাকী ও সীমালংঘন।
•    তারা হলেন এ উম্মতের মধ্যে মনের দিক থেকে সবচেয়ে সুহৃদ ও সৎ মানসিকতাসম্পন্ন, ঈমানের দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী, জ্ঞানের দিক থেকে সবচেয়ে গভীর জ্ঞানসম্পন্ন, সবচেয়ে কম আনুষ্ঠানিকতা প্রিয়, (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের) সাহচর্য ও সহযোগিতার দিক থেকে তারা অনেক দূর এগিয়ে এবং তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রত্যয়ন ও প্রশংসার দ্বারা তাঁর মহান মর্যাদায় উপনীত হয়েছেন।
•    তাদের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে সর্বোচ্চ অবস্থানে, পুরস্কারের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি এবং পরিমাপকের পাল্লায় সবচেয়ে ভারী হলেন: সিদ্দীকে আকবর আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, তারপর হলেন ‘ফারুক’ নামে প্রসিদ্ধ উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, আর এ ব্যাপারে সহাবী ও তাবে‘ঈন মুমিনগণের পক্ষ থেকে ‘ইজমা’ সংঘটিত হয়েছে।
•    অতঃপর যুন-নূরাইন ওসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু; তারপর আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, যিনি বালকদের মধ্য থেকে সর্বপ্রথম ঈমান গ্রহণ করেছেন।
•    আর তারা হলেন খোলাফায়ে রাশেদুনের চারজন এবং সুপথপ্রাপ্ত ইমাম, আর তাদের পরবর্তী পর্যায়ের হলেন ‘আশারায়ে মুবাশ্শিরীনের (জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ জনের) অবশিষ্ট ছয়জন।
•    আর তাদের পেছনে রয়েছেন পুণ্যবান মুহাজিরগণের একেবারে প্রথম ধাপের অগ্রগামী দল, তারপর আছেন প্রথম শ্রেণির আনসারগণ।
•    তার পরবর্তী স্তরে রয়েছেন বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ, যারা পুরস্কারের অধিকারী এবং যাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে; অতঃপর ওহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ, যারা আঘাতপ্রাপ্ত ও কঠিন পরিস্থিতির শিকার হওয়ার পরেও আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ডাকে সাড়া দিয়েছেন।
•    অতঃপর ‘বায়‘আতে রিদওয়ান’-এ অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ, যাদের জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেওয়া হয়েছে।
•    অতঃপর যিনি মক্কা বিজয়ের পূর্বে ঈমান এনেছেন, আল্লাহর পথে ব্যয় করেছেন, হিজরত করেছেন এবং জিহাদ করেছেন।
•    অতঃপর যিনি মক্কা বিজয়ের পরে ঈমান এনেছেন, আল্লাহর পথে ব্যয় করেছেন, হিজরত করেছেন এবং জিহাদ করেছেন, আর তাদের সকলের জন্যই রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিশ্রুতি।
•    সুতরাং প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির ওপর ফরয হলো তাদেরকে মহব্বত করা এবং তাদের সকলের ব্যাপারে (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলে) সন্তুষ্টি কামনা করা, আর যে ব্যক্তি তাদেরকে ঘৃণা করে অথবা তাদের দুর্নাম করে এবং তাদের মন্দ সমালোচনা করে, তাকে ঘৃণা করা।
•    আর যেমনিভাবে মর্যাদার ক্ষেত্রে তাদের মাঝে তারতম্য রয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে তাদেরকে ভালোবাসার ক্ষেত্রেও পরিমাণগত তারতম্য হবে।
•    আর তাদেরকে অনুসরণ করা এবং তাদের হিদায়াত বা নির্দেশনা দ্বারা হিদায়াত লাভ করার বিষয়টি নির্ধারিত হবে তাদের মর্যাদার ব্যাপারে কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি ছাড়া অথবা তাদের মর্যাদাকে কোনো রকম খাটো করা ছাড়া। সুতরাং (মনে রাখতে হবে) তারা নিষ্পাপ নন এবং তারা অপরাপর মুমিনগণের কারো মতোও নন।
•    আর তাদের মাঝে ঘটে যাওয়া ঘটনার ব্যাপারে সমালোচনা করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকা এবং তাদের জন্য দো‘আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করা।
•    সুতরাং শুধু তাদের ভালো ও সুন্দর বিষয়গুলোই আলোচনা করা যাবে, আর যে ব্যক্তি তাদের মন্দ সমালোচনা করবে, সে পথভ্রষ্ট বলে গণ্য হবে এবং কঠিন শাস্তির মুখোমুখী হবে।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ
(الواجب نحو العلماء)
আলেমগণের প্রতি করণীয় আবশ্যকীয় কর্তব্য
•    আল্লাহওয়ালা আলেমগণ হলেন সৎ দায়িত্বশীল এবং সত্যবাদী দা‘ঈ তথা আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী।
•    তারা হলেন জনগণের মধ্যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয়কারী ব্যক্তি এবং তাঁর শরী‘আত ও হেদায়েতের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ, আর তারা হলেন আল্লাহর বন্ধু এবং নবীগণের উত্তরাধিকারী, আর তারা হলেন আহলে হাদীস তথা হাদীস ও সুন্নাহ’র ধারক ও বাহক এবং সাথে সাথে বুদ্ধিমান ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ। আবার তারা হলেন আনুগত্যপরায়ণ ও আল্লাহর স্মরণে ব্যস্ত ব্যক্তিবর্গ, আর বাস্তবিক পক্ষে তারা হলেন নেতৃবৃন্দ ও যথাযথ কর্তৃপক্ষ।
•    তারা হলেন উম্মতের মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের খলিফা বা প্রতিনিধি এবং যখন তাঁর কোনো সুন্নাতের মৃত্যু ঘটে, তখন তারা তাকে পুনর্জীবিত করেন, আর পথভ্রষ্টকে সঠিক পথের দিকে ডাকেন এবং তাদের (উম্মতের) পক্ষ থেকে দেওয়া কষ্টের সময় ধৈর্যধারণ করেন।
•    কিতাব তথা আল-কুরআন তাদেরকে সমর্থন করে এবং তারা তা প্রতিষ্ঠা করেন, আর আল-কুরআন তাদের কথা বলে এবং তারাও তাঁর কথা বলেন।
•    সৎ কাজে তাদের আনুগত্য করাটাকে আল্লাহ তা‘আলা ফরয করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে ভালোবাসতে নির্দেশ দিয়েছেন, আর তিনি তাদেরকে জগৎসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে দস্তখতকারী হিসেবে অভিষিক্ত করেছেন।
•    বিপর্যয়ের সময় তাদেরই কাছে যেতে হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রসমূহে তাদের মতামত প্রকাশ করা হয়।
•    তাদের ভালো দিকগুলো প্রচার করা হবে, মন্দ দিকগুলো ঢেকে রাখা হবে এবং তাদের অধিকারসমূহ সংরক্ষণ করা হবে। কারণ, তাদের মাংস বিষাক্ত, আর তাদের দুর্নামকারীদের লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করার ব্যাপারে আল্লাহর নিয়ম তো সর্বজনবিদিত।
•    আর সর্বশ্রেষ্ঠ আলেম হলেন পূর্ববর্তী আলেমগণ। যেমন, সাহাবী, তাবে‘ঈন, তাবে-তাবে‘ঈন এবং ঘোষিত শ্রেষ্ঠ তিন যুগের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ইমামগণ, বিশেষ করে অনুসরণীয় ফিকহী মাযহাবসমূহের স্থপতি চার ইমাম।
•    ঈমান ও আকিদার মাসআলাসমূহের ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য এক ও অভিন্ন, যদিও শরী‘আতের শাখা-প্রশাখাসমূহের কিছু কিছু ব্যাপারে মতপার্থক্য হয়েছে।
•    সাবধান! সাবধান!! তাদের ভুল-ত্রুটির পিছনে লেগে থাকা থেকে এবং তাদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করা থেকে সাবধান থাকবে। আরও সতর্ক থাকবে তারা নিষ্পাপ বলে দাবি করা থেকে।
•    সাবধান! সাবধান!! সতর্ক থাকবে ঐসব ব্যক্তিবর্গ থেকে, যারা দীনকে ব্যবসা ও পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে, ইবাদত ও নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনি, তারা ভালো কাজের আদেশ করে, অথচ তারা তা করে না। আর তারা মন্দ কাজে নিষেধ করে, অথচ তারাই সে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে, আর তারা বাতিল কথা বলে এবং তাকে রংচং দিয়ে সুন্দর করে উপস্থাপন করে, আর তারা সত্যকে গোপন করে এবং তাকে বাতিলের সাথে মিশিয়ে একাকার করে ফেলে।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ
(الإمامة)
ইমামত বা নেতৃত্ব
•    প্রধান ইমাম তথা শাসক নির্ধারণ করা ন্যূনতম পক্ষে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি কর্তৃক অগ্রাধিকারমূলক ওয়াজিব কাজ, যা কুরআন, সুন্নাহ ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।
•    আর ‘ইমামত’ তথা নেতৃত্ব হচ্ছে জনতা ও ইমামগণের মধ্যকার এমন এক চুক্তির নাম, যা দীন দেখাশুনা ও দুনিয়া পরিচালনা করার ব্যাপারে নবুওয়াতের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সম্পাদিত হয়।
•    নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে জনগণের ঐক্যবদ্ধ সমর্থনের দ্বারা অথবা (আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ তথা) সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীগণ কর্তৃক আনুগত্যের শপথবাক্য পাঠ করার দ্বারা অথবা পূর্ববর্তী শাসকের নির্দেশনা দ্বারা, আর যে জোর করে ক্ষমতা দখল করে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে তার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সৎকাজে তার আনুগত্য করাটা বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে।
•    জাতির কল্যাণে তার ইমামগণের দায়িত্ব হলো তাদেরকে শরী‘আতের আলোকে শাসন করা, তাদের আকিদা-বিশ্বাসের হিফাযত করা এবং তাদের ঐক্য রক্ষা করা, যাতে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের মত আবশ্যকীয় বিধানটি প্রতিষ্ঠিত করা যায়, জিহাদের নিদর্শন ও বৈশিষ্ট্যসমূহ ছড়িয়ে দেওয়া যায়, যাকাত ও সাদকা একত্রিত করা যায় এবং উপযুক্ত দায়িত্বশীল লোক নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আমানতদারিতার আশ্রয় নেওয়া যায়।
•    আর জনগণের নিকট ইমামগণের অধিকার হলো- তারা সুখে দুঃখে তাদের কথা শুনবে এবং আনুগত্য করবে তাদের সুখে ও দুঃখে, অনুরূপভাবে শরী‘আত নির্ধারিত সকল আনুগত্যের ক্ষেত্রে ও শরী‘আতসম্মত সকল বৈধ কাজেও তাদের আনুগত্য করবে। তবে (শরী‘আতের) সকল প্রকার অবাধ্যতার ক্ষেত্রে অথবা যুলুমের ক্ষেত্রে আনুগত্য করা চলবে না।
•    আর শাসকের জন্য জনগণের দায়িত্ব হলো—শাসকগণ যখন ভুল করবে, তখন তারা জনগণের পক্ষ থেকে উপদেশ পাওয়ার অধিকার রাখবে, যখন তারা সঠিক কাজ করবে, তখন সহযোগিতা পাওয়ার অধিকার থাকবে, তাদের স্খলন বা অতঃপতনের বিষয়গুলোতে ছাড় দেওয়া হবে, তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো গোপন রাখা হবে, তাদের দুনিয়ার ব্যাপারে লোভ করা হবে না এবং তাদের জন্য কল্যাণের জন্য দো‘আ করা হবে।
•    আর শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা হারাম- যতক্ষণ তারা মুসলিম হিসেবে জীবন চালাবেন এবং আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ অনুযায়ী শাসনকাজ পরিচালনা করবেন। তারা অন্যায় করলেও তাদের ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করতে হবে, আর তাদের সাথে হজ ও জিহাদ করতে হবে, যদিও তারা যুলুম ও পাপ করে, আর তাদের জামা‘আতে লেগে থাকতে হবে, যদিও তারা তাদের আঘাত করে এবঙ তাদের সম্পদ গ্রাস করে।
•    আর শাসক তার ইমামত বা নেতৃত্বের বাই‘আত হারাবে, তার রুকনসমূহের কোনো একটি ভঙ্গ হওয়ার কারণে, যেমন, ইমাম হারিয়ৈ যাওয়া অথবা নেতৃত্বের শর্তসমূহের কোনো একটি নষ্ট হওয়ার কারণে। যেমন, শাসকের পাগলামী ধরা পড়া বা মুরতাদ হয়ে যাওয়া।
•    আর শাসকের নেতৃত্বের চুক্তি নষ্ট হওয়ার কারণে তার কাফির হওয়া আবশ্যক হয় না; বরং তাতে তার বৈধ ক্ষমতার বিলুপ্তি ঘটে মাত্র। ক্ষমতা বিলুপ্তি অর্থ তাকে কর্মকাণ্ডে হেনস্থা করা বা তার সাথে আমল ত্যাগ করাও বুঝায় না। কারণ, এর জন্য কতগুলো শর্ত রয়েছে, যা পূরণ করা জরুরি। আর যদি তা পূরণ করা না হয়, তাহলে তা হবে জীবন ও সম্পদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং নেতৃত্বের বৈধতার শর্তসমূহ পূরণ করা জরুরী এবং জাতির ক্ষতি না করা আবশ্যক। আরও জরুরী হচ্ছে কেবল জাতির শত্রুদের সাথে মোকাবিলা করার নীতি অবলম্বন করা। সাথে থাকবে প্রাধান্যপ্রাপ্ত বিষয়গুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা, ঝাণ্ডাসমূহের সুস্পষ্টতা, পদ-পদবীর বিশুদ্ধতা, দীনকে মর্যাদা দেওয়ার মাধ্যমে স্বার্থ ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ এবং দুর্বলগণের প্রতিরক্ষার ব্যাবস্থা গ্রহণ।
•    আর এর সব কিছুই নির্ধারণ হবে সুদক্ষ আলেমগণের মাধ্যমে এবং ক্ষমতাবান প্রভাবশালী ব্যক্তিগণের মধ্য থেকে যিনি তাদের আনুগত্যের অধীন হয়েছেন তার দ্বারা।
•    আর যখন শরী‘আতসম্মত কারণে অথবা বাস্তব দিক থেকে কোনো স্থান বা কাল সত্যিকারের ইমাম বা শাসক শূন্য হয়ে পড়বে, তখন এ বিষয়টির দায়িত্ব অর্পিত হবে জাতির প্রভাবশালী যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ (আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ) তথা সুশীল সমাজের ওপর, আর তাদের ওপর সুনির্দিষ্ট কর্তব্য হয়ে পড়বে, সত্যের ওপর একতাবদ্ধ থাকা, সুন্নাহ অনুযায়ী চলা, জাতির মধ্যে বিভক্তির বিষয়টি বর্জন করা, আর বাধ্যতমূলক হবে জাতির মধ্যে ফরয বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠা করার কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা।
•    সুতরাং জুমু‘আর সালাত যাদের ওপর ওয়াজিব, তাদের থেকে তা বাদ পড়বে না, আর যাদের ওপর জামা‘আতে সালাত আদায় করা বাধ্যতামূলক, তাদের কেউ জামা‘আতে সালাত আদায় থেকে পিছিয়ে থাকবে না, আর সমাজে সৎকাজের নির্দেশ প্রদান এবং অসৎ কাজে নিষেধ করার মত আবশ্যকীয় কাজটি পরিত্যাগ করা যাবে না, আর মুসলিম অথবা যিম্মী অথবা শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অথবা আশ্রিতদের সম্পদ, জীবন ও মানসম্মান যথযথ কারণ ছাড়া বৈধ বলে গণ্য হবে।
•    আর এটা সমাজের মধ্যে পুনরায় ফিরিয়ে আনবে পবিত্রতা, নিরাপত্তা, সংশোধন ও নিয়ন্ত্রণ, শান্তি ও স্থিরতা এবং শক্তি, আরও ফিরিয়ে আনবে সমাজে ঐক্য ও সংহতি।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ
(الموقف من الابتداع و أهله)
বিদ‘আত ও তার অনুসারীদের ব্যাপারে অভিমত
•    দীনের মধ্যে প্রত্যকটি অভিনব জিনিসই বিদ‘আত, আর প্রত্যেকটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা, আর প্রত্যেক পথভ্রষ্টতাই জাহান্নামের মধ্যে যাবে।
•    আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ‘ইবাদতকে তাওকীফী বা কুরআন-সুন্নাহর দলীল নির্ভর করা এবং বিদ‘য়াতের সকল উপায় বন্ধ করার তাকিদ দেয়, আরও জোর দেয় এমন প্রত্যেক বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করার জন্য, যা সুন্নাহ পরিপন্থী।
•    কারণ, শরী‘আতের অধিভুক্ত বিষয়ের দলীলটি নির্দোষ সাহাবী ও অভিজ্ঞ হাদীস বিশারদগণের উপলব্ধি এবং ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ দ্বারা পবিত্র শরী‘আত-মাফিক হতে হবে।
•    আর এ উম্মাতের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ হলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সুতরাং যখন তাঁর কোনো সুন্নাত বিনা বিরোধে বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হবে, তখন কোনো মানুষের কথায় কারও জন্য তা প্রত্যাখ্যান করা বৈধ নয়।
•    আর বিদ‘আতপন্থীরা হলো তারা, যারা শরী‘আতের অনুসরণ থেকে পিছিয়ে থাকে; তারা অজ্ঞতা, গোঁড়ামি, বাড়াবাড়ি ও প্রবৃত্তির অনুসারী; তারা অন্যায়ভাবে বিতর্ক করে এবং সত্য সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরেও তার ব্যাপারে তারা ঝগড়া-বিবাদ করে।
•    তারা পূর্ববর্তী সৎব্যক্তিগণের রীতিনীতির দুর্নাম করার ব্যাপারে সংঘবদ্ধ এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সাথে শত্রুতা করার ব্যাপারেও ঐক্যবদ্ধ অবস্থান।
•    তারা কিতাবের ব্যাপারে মতবিরোধকারী, কিতাব অমান্যকারী এবং কিতাবের বিরোধিতার ব্যাপরে তারা সকলে ঐক্যবদ্ধ।
•    তারা মনে করে যে, ঈমানের বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহ’র বক্তব্যসমূহ যথেষ্ট নয়। আর তারা কাশ্ফ (আধ্যাত্মিকভাবে গোপন জগতের উন্মুক্তিতা), ‘যাওক’ (রুচি ও বিচক্ষণতা) এবং স্বপ্নসমষ্টি দ্বারা দলীল পেশ করে।
•    আর তারা বানোয়াট বর্ণনাসমূহের ওপর নির্ভর করে।
•    আর তারা বিশুদ্ধ ‘আহাদ’ (মাশহুর, আযীয ও গরীব) হাদীস দ্বারা দলীল দেওয়ার বিষয়টিকে বর্জন করে।
•    তারা দুর্বল যুক্তিকে সহীহ বর্ণনার ওপর প্রাধান্য দেয় এবং বিভিন্ন বক্তব্যকে তার যথাস্থান থেকে পরিবর্তন ও বিকৃত করে।
•    আর তারা অমুসলিমদের ধর্ম থেকে নিয়মনীতি গ্রহণ করে এবং অবিশ্বাসীদের কারিকুলাম ও সংস্কৃতি দ্বারা তারা প্রভাবিত হয়।
•    আর সুন্নাহ বহির্ভূত ফিরকা বা দলগুলো- যেমন, শিয়া, মু‘তাযিলা, মুরজিয়া এবং এদের মত আরও অন্যান্য সম্প্রদায় এক কথায় শাস্তির হুমকিতে নিপতিত। কারণ, তাদের বিধান হলো শাস্তির হুমকির শিকার ব্যক্তিবর্গের বিধান, তারা তাদের শাস্তির মুখোমুখি হবে; আবার তাদের কাউকে কাউকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন তাদের অজ্ঞতার কারণে অথবা তাদের ভালো কাজের বদলে অথবা পাপ মোচনকারী তাওবার বিনিময়ে অথবা গোনহ মোচনকারী বিপদ-মুসিবতের কারণে অথবা গ্রহণযোগ্য ‘মাকবুল শাফা‘আত’-এর কারণে...... ইত্যাদি ইত্যাদি।
•    আর ইসলাম বহির্ভূত দলগুলো- যেমন, বাতেনী, রাফেযী, কাদিয়ানী ও বাহাই সম্প্রদায় এক কথায় কাফির এবং তাদের হুকুম হলো মুরতাদ তথা ইসালাম ত্যাগকারীদের হুকুমের মতো।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
(معاملة أهل البدع)
বিদ‘আতের অনুসারীদের সাথে আচার ব্যবহার
•    আর বিদ‘আতপন্থী ভিন্ন মত পোষণকারীর সাথে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আচার-আচরণ ও লেনদেন বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে:
•    সুতরাং কখনও কখনও তারা (তাদেরকে) সঠিক বিষয়টি বর্ণনা করে দেন এবং নিরপেক্ষভাবে উপদেশ প্রদান করেন। আবার কখনও কখনও তারা তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ ও কোমল ব্যবহার করেন, আবার কখনও কখনও ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা তাদেরকে বর্জন ও এড়িয়ে চলার নীতি অবলম্বন করেন, আর এ তিন ধরনের ব্যবহার হয়ে থাকে স্বয়ং বিদ‘আতের স্তর বা মানের তারতম্য ও বিদ‘আতপন্থীদের অবস্থার বিভিন্নতার ওপর ভিত্তি করে এবং স্থান কাল পাত্র ভেদে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভালো ও মন্দ অনুযায়ী। কারণ, এর প্রতিটি বিষয় শরী‘আতসম্মত রাজনীতি বিষয়ক এমন সব মাসআলার অন্তর্ভুক্ত, যেসব মাসআলা ভালো ও কল্যাণ অর্জন, তার পরিপূর্ণতা বিধান এবং মন্দ ও অকল্যাণসমূহ প্রতিরোধ ও তা কমিয়ে আনার নীতির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।
•    আর তাঁরা প্রথম অবস্থাতে মনে করেন যে, বিদ‘আতপন্থী ভিন্ন মত পোষণকারী ব্যক্তি দা‘ওয়াত পাওয়ার উপযুক্ত— সুকৌশল অবলম্বনে ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে তাদেরকে দা‘ওয়াত দিতে হবে এবং তারা সঠিক পথে ও সুন্নাহ’র আলোর দিকে তাদেরকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তাদের সাথে সহৃদয়তা ও সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার করেন।
•    আর যে ব্যক্তি সত্য কিছু নিয়ে আসে তারা তার থেকে তা গ্রহণ করেন এবং সত্য দ্বারাই তারা মানুষদের পরিচিতি গ্রহণ করেন। আর তারা বিদ‘আতপন্থী ভিন্ন মত পোষণকারী ব্যক্তির সাথেও ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করেন, ফলে তার কথার মধ্যে যেটা সত্য তারা তা গ্রহণ করেন এবং যা বাতিল ও অসত্য তা প্রত্যাখ্যান করেন।
•    আর বিদ‘আতপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের জবাব ও যুক্তিখণ্ডনকে তারা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেন ভালো উদ্দেশ্যে, সত্যের পৃষ্ঠপোষকতায়, মানবজাতির কল্যাণ কামনায় ও হিদায়েতের উদ্দেশ্যে এবং দয়া ও সহানুভূতিসহ।
•    আর তারা এমন ব্যক্তির সাথে বিতর্ক করতে নিষেধ করেন, যে ব্যক্তি জ্ঞানের ক্ষেত্রে শক্তিশালী নয়, যার বুঝশক্তি গভীর ও সুবিস্তৃত নয় এবং যুক্তি-প্রমাণ বিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ নয়, আর তারা বিদ‘আতকে সততার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন এবং তার বাজে রূপকে মূল থেকে ছিন্ন করেন।
•    আর তারা বিতর্ক করার পূর্বে বিপক্ষের মাযহাব, কথা বা মন্তব্য, দলীল ও গ্রন্থগত অবস্থা সম্পর্কে জেনে নেওয়ার নির্দেশ দেন।
•    আর তারা কূটতার্কিক ও কুতার্কিকদের সাথে বিতর্ক করতে বারণ করেন।
•    আর তারা বিরোধের জায়গাগুলো সুনির্ধারণ করেন এবং বিদ‘আতপন্থীদের একের ওপর অন্যের যুক্তি খণ্ডনের বিষয়গুলো সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত করেন।
•    আর প্রথমত তারা বাতিলের স্ববিরোধিতা এবং তার দলীলসমূহের পারস্পরিক অসঙ্গতি ও বাতিলের কথার মাধ্যমে যে ফ্যাসাদ আবশ্যক হয়ে পড়ে তা স্পষ্ট করেন।
•    আর তারা তাদের দলীল-প্রমাণগুলোর শব্দগুচ্ছ ও তার যথার্থ সম্পাদনার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেন এবং আরও নজর দেন তার বর্ণনাপ্রসঙ্গ, পূর্বসূত্র ও যোগসূত্রের প্রতি।
•    আর তারা সাদৃশ্যপূর্ণ বা একই রকম বিষয়গুলো একত্রিত করেন এবং বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোকে পৃথক করেন, আর তারা যুক্তি প্রমাণ পেশ করার ক্ষেত্রে সর্বসম্মত দলীলগুলো দ্বারা দলীল-প্রমাণ পেশ করেন।
•    আর তারা বিভ্রান্তিমূলক অবস্থায় সিদ্ধান্ত দানে বিরত থাকেন।
•    আর সংক্ষিপ্ত কথার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দাবি করেন।
•    আর তারা জানেন যে, নতুন পরিভাষাগুলো শরী‘আতী বাস্তবতার কোনো কিছুই পরিবর্তন করতে পারবে না।
•    আর তারা প্রয়োজনের সময় পরিভাষার অনুসারীগণের সাথে তাদের বিশেষ পরিভাষায় দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী বক্তব্য প্রদান করেন। আর বাতিলপন্থীগণ তাদের মতের সপক্ষে যেসব দলীলসমূহ দ্বারা প্রমাণ পেশ করেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত সেগুলো দিয়ে অনুরূপ একই রকম বিষয়ে তাদের উপর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করে তাদেরকে যুক্তিশূণ্য করেন।
•    আর তারা সেসব ব্যাপারে নীরবতা পালন করেন, যেসব ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল নীরবতা পালন করেছেন।
•    আর বিতর্ক ও আলাপ-আলোচনার ফলাফল শূন্য হওয়ার ব্যাপারে প্রবল ধারণা হলে তারা তা (বিতর্ক করা) থেকে নিষেধ করেন, আর নির্দেশ প্রদান করেন তাদেরকে এড়িয়ে চলার জন্য এবং তাদের সঙ্গ উঠা-বসা করার বিষয়টি বর্জন করার জন্য, যাতে (তাদের) কোনো স্বার্থ বাস্তবায়িত হতে না পারে অথবা কোনো ক্ষতির শিকার না হয়। আর স্বেচ্ছাচারী সমাজ ও বিদ‘আতপন্থীগণের সঙ্গে বসার ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত থেকে আসা সতর্কীকরণের কাজটি উপরিউক্ত নীতির অনুসরণে করা হয়ে থাকে।
•    আর তারা তাদের প্রশাসনের নিকট দাবি করেন স্বেচ্ছাচারী লোকদেরকে এমনভাবে হাত চেপে ধরার জন্য, যার ফলে তাদের অনিষ্টতা বন্ধ হয়ে যাবে এবং যার কারণে তাদের কর্তৃক মুসলিমগণের ক্ষতি করার বিষয়টি রুদ্ধ হয়ে যাবে।
•    মোটকথা, বিদ‘আতপন্থীরা আহলে কিবলা তথা কিবলার অনুসারীগণের অন্তর্ভুক্ত, যতক্ষণ না তারা পরিষ্কার দলীল ও স্পষ্ট প্রমাণ দ্বারা তাদের বিদ‘আতকে নিয়ে ইসলাম থেকে ভিন্ন কোনো আদর্শে স্থানান্তরিত হয়। কারণ, তাদের (বিদ‘আতপন্থীদের) মধ্যে কেউ আছে এমন, যার বিদ‘আত তাকে কাফির বানিয়ে দেয়, আবার তাদের মধ্যে কেউ আছে এমন, যার বিদ‘আত তাকে ফাসিক বানিয়ে দেয়। আর এ জাতীয় প্রত্যেকের জন্য কতগুলো বিধিবিধান রয়েছে।
•    আর তাদের সকলের জন্য হিদায়েতের দো‘আ করা- যেমন বৈধ, ঠিক অপর দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের সকলের জন্য বদদো‘য়া করাও বৈধ। তবে তাদের নির্দিষ্ট জনের ওপর বদদো‘আর ব্যাপারে মতবিরোধ ও বিস্তারিত কথা রয়েছে।  
•    আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত জুমু‘আ ও ঈদের সালাত আদায় করেন আহলে কিবলা তথা কিবলার অনুসরণকারী ব্যক্তির পিছনে এবং ঐ ব্যক্তির পিছনে, যে ব্যক্তি তার বিদ‘আতের দিকে ডাকে না এবং প্রকাশ্যে তা ঘোষণা করে না।
•    আর তারা কিবলার অনুসরণকারী ব্যক্তির জানাযার সালাতে অংশগ্রহণ করেন। আবার কখনও কখনও তাদের মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ কোনো কোনো বিদ‘আতপন্থীর জানাযার সালাত বর্জন করেন তার বিদ‘আতকে তিরস্কার করার জন্য।
•    আর যে ব্যক্তির কুফুরী করার বিষয়টি প্রমাণিত হবে, তার পিছনে সালাত আদায় করা বৈধ হবে না এবং তার জানাযার সালাতে অংশগ্রহণ করাও বৈধ হবে না।
•    আর তারা বিশ্বাস করেন যে, মুসলিমগণের মধ্যে মূল বিষয় হলো (খারাপ আকীদা-বিশ্বাস থেকে) বিশুদ্ধ থাকা।
•    আর ইমামের অনুসরণকারী ব্যক্তির জন্য ইমামের অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করার কোনো শরী‘আতসম্মত সুযোগ রাখা হয় নি, যদি তার অবস্থা অপ্রকাশিত ও গোপন থাকে।
•    আর বিদ‘আতপন্থীদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি বিদ‘আতের দিকে আহ্বান করে, তাকে প্রত্যাখ্যানস্বরূপ তার সাক্ষ্যকে প্রত্যাখ্যান করা হবে এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মধ্যে যিনি তার সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন, তাকেও নিন্দা করা হবে, আর যে ব্যক্তি বিদ‘আতের দিকে আহ্বান করবে না, অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতে তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে।
•    আর বিদ‘আতপন্থীদের কাছ থেকে শিক্ষা অর্জনের ব্যাপারে মূলনীতি হলো- অনিষ্টতাকে প্রতিরোধ বা প্রতিহত করার জন্য এবং ক্ষতির পথ বন্ধ করার নিমিত্তে তাদের নিকট থেকে শিক্ষা অর্জন করা নিষিদ্ধ; কিন্তু তাদের নিকট থেকে শিক্ষা অর্জন করতে বাধ্য হলে, সে ক্ষেত্রে সতর্কতার সাথে শিক্ষা লাভ করা বৈধ।
•    আর যখন প্রযোজন দাবি করে, তখন জিহাদের ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা গ্রহণ করা বৈধ হবে, এ শর্তে যে, তারা এমন ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত হবেন, যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ব্যাপারে ভালো ধারণা করেন এবং তারা হবে নিরাপদ ও বিশ্বস্ত-আমানতদার, আর এ শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে জিহাদের ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা গ্রহণ করা বৈধ হবে না, আর এ ব্যাপারে ইতিহাসে ও বাস্তব ঘটনায় বহু সাক্ষী ও শিক্ষা রয়েছে।

সপ্তম পরিচ্ছেদ
(الدعوة إلى الله و الأمر بالمعروف و الجهاد)
আল্লাহর দিকে আহ্বান, সৎ কাজের নির্দেশ ও জিহাদ
•    আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর দিকে আহ্বান, সৎকাজের আদেশ করা এবং জিহাদ করা নৈকট্য অর্জন করার অন্যতম মহান উপায় এবং অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ, আর তা হলো নবীগণের মিশন এবং পছন্দনীয় লোকগণের পথ, আর এসব কারণেই তারা ব্যয় করেছেন জীবন ও মূল্যবান সম্পদ এবং মুক্তহস্তে দান করেছেন বেশি দামী ও কম দামী সকল কিছু।
•    আর তারা বিশ্বাস করেন যে, তাদের দাওয়াত দেওয়া, আদেশ করা, নিষেধ করা ও জিহাদ করার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো: জনগণকে ঈমান গ্রহণ করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা, তাদেরকে এক আল্লাহর গোলাম বানানো এবং মানুষের গোলামি থেকে বের করে মানুষের রব-এর গোলামে পরিণত করা, আর বিশ্বকে বিশৃঙ্খলামুক্ত করা এবং রাষ্ট্র ও জনগণের নিকট শরী‘আতের দলীলসমূহ উপস্থাপন করা।
•    আর তারা তাদের দাওয়াতের ভিত্তি স্থাপন করেন কতগুলো শক্তিশালী মূলনীতির ওপর ও স্থায়ী ভিত্তির ওপর আর তারা দাওয়াতের ক্ষেত্রে সাধারণত নবীগণের হিদায়াতের অনুসরণ করেন, আর বিশেষ করে নবী মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহাবীগণের নীতি অবলম্বন করেন।
•    তারা তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদ ও ইখলাসে (একনিষ্ঠতায়) বিশ্বাস করেন।
•    তারা পূর্ববর্তী সৎ ব্যক্তিবর্গ ও সুন্নাহ’র অনুসরণ করেন।
•    আর তারা ইলম (জ্ঞান) ও ফিকহ প্রচার করেন।
•    আর তারা নতুন প্রজন্মকে যথাযথ প্রতিপালনের মাধ্যমে বিকশিত করেন-
•    আকিদা-বিশ্বাস ও শরী‘আতের দিক থেকে ইসলামের ব্যাপারে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন করে।
•    জনগণের শ্রেণি ও অবস্থাদি সম্পর্কে সচেতন করে।
•    দাওয়াত দানের মূলনীতি ও উপায়-উপকরণ সম্পর্কে অভিজ্ঞ করে।
•    তারা বুদ্ধি-বিবেচনা ও সঠিক চিন্তাভাবনার মাধ্যমে সৎকাজের আদেশ করেন এবং অসৎকাজে নিষেধ করেন।
•    আর এমন প্রত্যেকটি খারাপ ও অশ্লীলতার প্রতিবাদ করা ওয়াজিব, যা বর্তমানে বিদ্যমান, অনুসন্ধান ছাড়াই দৃশ্যমান এবং কোনো গবেষণা ছাড়াই সুবিদিত, আর কিসের দ্বারা তা মূলোৎপাটন করা যায় সে পরিকল্পনা করা আবশ্যক, যাতে তা বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে না পারে অথবা বড় ধরনের কল্যাণজনক কিছু নষ্ট করতে না পারে।
•    আর এ ক্ষেত্রে কল্যাণ ও ক্ষতির দিকগুলো নির্ণয় করা এবং বিরোধের সময় সে ব্যাপারে প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার দানের দায়িত্বটি অভিজ্ঞ আলেমগণের ওপর ন্যস্ত করা, যারা বুদ্ধিমত্তা, সতর্কতা, দীনদারী ও তাকওয়ার দিক থেকে অধিক নির্ভরযোগ্য।
•    আর মন্দ দূর করা বা কমিয়ে আনা শরী‘আতের দাবি, তবে মন্দ দূর করার সাথে সমপরিমাণ ভালো দূর হয়ে যাওয়া অথবা সমপরিমাণ মন্দ অর্জিত হওয়ার অবস্থা তৈরী হলে সে মন্দ দুর করা যাবে কিনা এ বিষয়টি চিন্তাভাবনা ও গবেষণার ক্ষেত্র।
•    আর মন্দ দূর করা এবং সাথে তার চেয়ে আরও বড় ধরনের মন্দের আমদানি করা অথবা এর চেয়ে বড় ধরনের ভালো কিছু হারিয়ে ফেলা শরী‘আতের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ।
•    আর তারা বিশ্বাস করেন যে, জিহাদ হচ্ছে ইসলামের শীর্ষ চূড়া এবং জীবন ও সম্পদ দিয়ে তা কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে।
•    আর জিহাদের আবশ্যকতা অস্বীকার করা মানে দীনের একটি সুনির্দিষ্ট জরুরি বিষয়কে অস্বীকার করা, আর তা ‘মানসূখ’ (রহিত) হয়ে গেছে বলে দাবি করা অথবা তাকে কথার জিহাদের সাথে নির্দিষ্ট করে দেওয়াটা দীনের মধ্যে বিদ‘আত ও গোমরাহী বলে গণ্য।
•    আর জিহাদ দু ধরনের, প্রতিরোধ করা এবং আহ্বান করা, আর শরী‘আতে জিহাদকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে সীমালঙ্ঘনকারীদের বাড়াবাড়িকে প্রতিরোধ করার জন্য এবং (দীনের) দা‘ওয়াতপ্রাপ্তদের ওপর থেকে ফিতনা দূর করার জন্য, আর দীনের শত্রুদেরকে ভীতি প্রদর্শন করার জন্য এবং মুসলিমগণের রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত ও শক্তিশালী করার জন্য।
•    সুতরাং যদি তাতে যোগদান না করে পিছনে থেকে যাওয়ার ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে ব্যাপারটি মূল্যায়িত হবে সে ক্ষেত্রে অক্ষমতার পরিমাণ অনুযায়ী এবং সাথে তার থেকে গ্রহণ করা হবে জিহাদের জন্য প্রস্তুতির আনুসাঙ্গিক উপায়-উপকরণ।

অষ্টম পরিচ্ছেদ
(الحرص على الوحدة و الائتلاف و نبذ الفرقة و الاختلاف)
ঐক্য ও সংহতি কামনা করা এবং বিভেদ ও অনৈক্যকে প্রত্যাখ্যান করা
•    নিশ্চয় সুন্নাত ঐক্য ও সংহতির সাথে সম্পর্কযুক্ত, যেমনিভাবে বিদ‘আত বিভেদ ও অনৈক্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
•    আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত হলেন তারা, যারা আল-কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরেছেন, সকলে মিলে বাণীতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন এবং ভ্রাতৃত্বের প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্যসমূহ যথাযথভাবে অনুধাবন ও কার্যকর করেছেন।
•    সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত জাতীয়তাবাদী পতাকার জন্য অথবা আঞ্চলিকতার দাবি নিয়ে সংঘবদ্ধ বা দল গঠন করেনি।
•    এবং তারা গোটা মুসলিম জাতির স্বার্থের উপরে কোনো খণ্ডিত দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থকে অগ্রাধিকার বা প্রাধান্য দেন নি।
•    আর তারা বিশ্বাস করেন যে, জাতির কল্যাণ কামনায় উপদেশের অন্যতম আমানত হলো ঐক্যবদ্ধ থাকার ব্যাপারে উৎসাহিত করা, ঐক্য ও সংহতি কামনা করা এবং বিভেদ ও অনৈক্যের ব্যাপারে নিষেধ করা।
•    আর বিরোধ সংঘটিত হওয়া একটি প্রাকৃতিক বাস্তবতা, আর তার কারণগুলো পরিহার করার মাধ্যমে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং দীনের স্বার্থে সতর্কতাস্বরূপ তার থেকে বেরিয়ে আসা শরী‘আতের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
•    সুতরাং ঐকমত্য হতে হলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত যে বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন, তার ওপর হতে হবে।
•    আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত যে ব্যাপারে মতবিরোধ করেছেন, সে ব্যাপারে তারা পরস্পরকে ওজর আছে বলে ধরে নিবে এবং একে অপরকে ক্ষমা করবে; এ ক্ষেত্রে ফিকহী ও আকীদাগত বিষয় সমান বলে বিবেচিত হবে।
•    আর যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে বেরিয়ে যাবে, সে ব্যক্তিকে দাওয়াত দিয়ে, উপদেশ দিয়ে, তার সাথে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করার মধ্য দিয়ে, দলীল-প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে এবং সন্দেহ-সংশয় দূর করে তাকে ফিরিয়ে আনা ওয়াজিব। তারপর সে যদি তাওবা করে ভালো কথা; অন্যথায় তার সাথে ব্যবহার করা হবে তার উপযুক্ত প্রাপ্যতার ভিত্তিতে।
•    আর ঐক্যবদ্ধ থাকার উপায়সমূহ থেকে কিছু:
-    দীনের মধ্যে ইলম (জ্ঞান) ও আমলের সমন্বয় করা।
-    আর আকীদা-বিশ্বাস ও শরী‘আতের দিক থেকে সার্বিকভাবে দীনের দিকে আহ্বান করা।
-    আর (দীনের) দাওয়াত গ্রহণকারী উম্মাত ও দাওয়াত পাওয়ার উপযুক্ত উম্মাত থেকে শুরু করে সকল মানুষকে দীনের দিকে আহ্বান করা।
-    আর দীনের ব্যাপারে ঝগড়া-বিবাদ করা থেকে এবং সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ ছাড়া ঝগড়া ও বিতর্ক করা থেকে সতর্ক করা।
-    আর ভাই ভাই হিসেবে মেলামেশা করার ক্ষেত্রে সততা ও ক্ষমার পরিচয় দেওয়া এবং গোয়েন্দাগিরি না করা, আর বিশৃঙ্খলা বন্ধ করা এবং ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা।
উপসংহার
•    আর উপসংহারে এসে চূড়ান্ত উপদেশ হলো: আকিদা-বিশ্বাসকে শুদ্ধ করতে হবে এবং ইবাদতকে সুন্দর করতে হবে। কারণ, এটাই মানুষ ও জিন্ন সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
•    আর তার ফল সংগ্রহ করার অর্থ: ‘তাকওয়া’ বা আল্লাহ সচেতনতা অর্জন এবং উভয় জগতে আল্লাহর তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন।
•    আর তার পদ্ধতির প্রতি মনোযোগ দেওয়ার মানে হল: জ্ঞান অর্জন এবং সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা।
•    অতঃপর দীনকে শক্তিশালী করা এবং তার সুরক্ষার ব্যাপারে চেষ্টা-সাধনা করা, আর তার দলীল ও প্রমাণসমূহ প্রশ্নকারীদের নিকট পৌঁছে দেওয়া এবং তার শত্রুগণের মধ্য থেকে যারা বিদ্রোহী তাদের গলায় বর্শার ফলা বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা, আর তার বন্ধুদের সাথে নরম ও কোমল ব্যবহার করা।
والحمدُ للهِ على الختامِ، والشُّكرُ للهِ على التَّمامِ، والصلاةُ والسلامُ على خَيرِ الأنامِ، محمدٍ و على آله و أصحابه الأعلامِ .
“উপসংহারে এসে সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য নিবেদন করছি, আর শেষ করতে পেরে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি, আর সালাত ও সালাম সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীগণের প্রতি”।    
লেখক:    
আবূ আবদিল্লাহ মুহাম্মাদ ইয়োসরী
আল্লাহ তাকে, তার পিতামাতাকে এবং সকল মুসলিমকে ক্ষমা করে দিন।

 

‘দুররাতুল বায়ান ফী উসূলিল ঈমান’ বা “ঈমানের মৌলিক নীতিমালা সংক্রান্ত মণিমুক্তা” গ্রন্থটি আকীদার গ্রন্থসমূহের মধ্য থেকে একটি সুন্দর মৌলিক গ্রন্থ। লেখক এখানে অধিকাংশ আক্বীদার মাসআলার অবতারণা করেছেন এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা তুলে ধরেছেন। কিতাবটি মসজিদে এবং বিভিন্ন দারসের হালকাসমূহে ব্যাখ্যা করে আক্বীদা শিক্ষা দেওয়ার মতো উপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়েছে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

ঈমানের মৌলিক নীতিমালা সংক্রান্ত মণিমুক্তা

বই সম্পর্কে

লেখক :

محمد يسري

প্রকাশক :

www.islamhouse.com

বিভাগ :

Doctrine & Sects