উম্মতের ওপর নবী মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকার

উক্ত বইটিতে উম্মতের ওপর নবী মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে সকল অধিকার রয়েছে যেমন, তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন, তাঁর আনুগত্য ও মহব্বত করা, তাঁকে সমর্থন ও সহযোগিতা করা, তাঁর দাওয়াতকে সম্প্রসারণ করা, যখনই তাঁর আলোচনা হবে তখনই দুরূদ পাঠ করা, তাঁর বন্ধুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করা এবং শত্রুদেরকে ঘৃণা করার বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে।

اسم الكتاب: من حقوق المصطفى صلى الله عليه وسلم على أمته


تأليف: أحمد بن عثمان المزيد - عادل بن علي الشدي


الناشر: المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة


نبذة مختصرة: كتاب مترجم إلى اللغة البنغالية، تحدث فيه مؤلفه مفصلاً عن حقوق المصطفى - صلى الله عليه وسلم - على أمته، مثل وجوب الإيمان به، ووجوب طاعته، ومحبته، ونصرته وموازرته، والقيام بدعوته، والصلاة عليه كلما جاء ذكره، وموالاة أوليائه ومعاداة أعدائه.

উম্মতের ওপর নবী মুহাম্মাদ
 মোস্তাফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকার

من حقوق المصطفى صلى الله عليه وسلم على أمته

< بنغالي- Bengal - বাঙালি>


        

ড. আহমাদ আল-মাযইয়াদ
ড. আদেল আশ-শিদ্দী



অনুবাদক: ড. মো. আমিনুল ইসলাম
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

من حقوق المصطفى صلى الله عليه وسلم على أمته

        

د/ أحمد المزيد
د/ عادل الشدي




ترجمة: د/ محمد أمين الإسلام
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

সূচিপত্র


ক্রম    বিষয়    পৃষ্ঠা
1.        ভূমিকা    
2.        প্রথমত: নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনয়ন    
3.        দ্বিতীয়ত: নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করা    
4.        তৃতীয়ত: নবী মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসা    
5.        নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহব্বত করার মানগত স্তর    
6.        দ্বিতীয় স্তরটি নফল বা অতিরিক্ত    
7.        চতুর্থত: মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সমর্থন ও সহযোগিতা করা    
8.        পঞ্চমত: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতকে সম্প্রসারণ করা    
9.        ষষ্ঠত: নবী মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মান করা    
10.        নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর তাঁকে সম্মান করা    
11.        সপ্তমত: যখনই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলোচনা হবে তখনই তাঁর প্রতি সালাত পাঠ করা    
12.        অষ্টমত: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বন্ধুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করা এবং তাঁর শত্রুদেরকে ঘৃণা করা    
        


ভূমিকা

بسم الله الرحمن الرحيم
সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, আর সালাত ও সালাম আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি, যাঁর পর আর কোনো নবী নেই এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সঙ্গী-সাথীদের সকলের প্রতি।
অতঃপর.....
আমাদের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন সৃষ্টিকুলের জন্য উপহারস্বরূপ প্রদত্ত রহমত এবং উপকারী নি‘আমত। তাঁর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন এবং আমাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর পথে নিয়ে এসেছেন, আর আমাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে সৌভাগ্যের দরজাসমূহ খুলে দিয়েছেন। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বে আমরা কারা বা কী পরিচয় ছিল আমাদের? তাঁর দীন ও শরী‘আত ব্যতীত কী মূল্যই বা ছিল আমাদের? আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿لَقَدۡ جَآءَكُمۡ رَسُولٞ مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ عَزِيزٌ عَلَيۡهِ مَا عَنِتُّمۡ حَرِيصٌ عَلَيۡكُم بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ رَءُوفٞ رَّحِيمٞ ١٢٨﴾ [التوبة: ١٢٨]  
“অবশ্যই তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য হতেই একজন রাসূল এসেছেন, তোমাদের যে দুঃখ-কষ্ট হয়ে থাকে তা তার জন্য বড়ই বেদনাদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি তিনি করুণাশীল ও অতি দয়ালু।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১২৮]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿لَقَدۡ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ بَعَثَ فِيهِمۡ رَسُولٗا مِّنۡ أَنفُسِهِمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ١٦٤﴾ [ال عمران: ١٦٤]  
“আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের কাছে রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাঁর আয়াতসমূহ তাদের কাছে তিলাওয়াত করেন, তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন, যদিও তারা  আগে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৪]
সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত বড় মহান অনুগ্রহ! আর তাঁর আগমন ও রিসালাত কত বড় শ্রেষ্ঠ উপহার!
নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক অধিকার রয়েছে তাঁর উম্মতের ওপর। ইসলামের অনুসারী মুসলিমগণের দায়িত্ব হলো সে অধিকারগুলো আদায় ও সংরক্ষণ করা, আর সে অধিকারগুলো নষ্ট করা বা সেগুলোকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করা থেকে সতর্ক ও সাবধান হওয়া। আর সেসব অধিকারের অন্যতম কিছু অধিকার নিম্নরূপ:  
প্রথমত: নবী মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনয়ন
উম্মতের ওপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকারগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম ও প্রধান অধিকার হলো তাঁর ঈমান আনয়ন করা এবং তাঁর রিসালাতকে সত্য বলে মেনে নেওয়া। সুতরাং যে ব্যক্তি সর্বশেষ নবী হিসেবে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনতে পারে নি, সে ব্যক্তি কাফির, যদিও সে তাঁর পূর্বে আগত সকল নবী ও রাসূলের ওপর ঈমান আনয়ন করে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অস্বীকার করা মানে আল্লাহ তা‘আলাকে অস্বীকার ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করা। আর তিনি যে কিতাব নাযিল করেছেন এবং যে রাসূল প্রেরণ করেছেন, তা অস্বীকার করা।
আর আল-কুরআন পরিপূর্ণ হয়ে আছে এমন কতগুলো আয়াত দ্বারা, যেগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনয়ন করা, তাঁর অনুসরণ ও আনুগত্য করার জন্য নির্দেশ করে, আরও নির্দেশ করে তাঁর পথ ও নিয়মনীতিগুলো থেকে বিচ্যুতির ব্যপারে সতর্ক ও সাবধান থাকার জন্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿فَ‍َٔامِنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَٱلنُّورِ ٱلَّذِيٓ أَنزَلۡنَاۚ﴾ [التغابن: ٨]
“অতএব, তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও যে নূর আমরা নাযিল করেছি তাতে ঈমান আন।” [সূরা আত-তাগাবূন, আয়াত: ৮]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمۡ يَرۡتَابُواْ﴾ [الحجرات: ١٥]
“তারাই তো মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান এনেছে, তারপর সন্দেহ পোষণ করে নি।” [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৫]
আর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনয়নের বিষয়টিকে আল্লাহ তা‘আলা শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার কারণ বলে বর্ণনা করেছেন। সুতরাং তিনি বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ هَلۡ أَدُلُّكُمۡ عَلَىٰ تِجَٰرَةٖ تُنجِيكُم مِّنۡ عَذَابٍ أَلِيمٖ ١٠ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ .....﴾ [الصف: ١٠،  ١١]
“হে ঈমানদারগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসার সন্ধান দেব, যা তোমাদেরকে রক্ষা করবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে? তা এই যে, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান আনবে .....।” [সূরা আস-সাফ, আয়াত: ১০–১১]
আর আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অবিশ্বাস এবং তাঁদের বিরোধিতা করার বিষয়টি ধ্বংস ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির কারণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ شَآقُّواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥۚ وَمَن يُشَاقِقِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَإِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ١٣﴾ [الانفال: ١٣]
“এটা এ জন্যে যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করেছে। আর কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করলে আল্লাহ তো শাস্তি দানে কঠোর।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১৩]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ٱسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ أَوۡ لَا تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ إِن تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ سَبۡعِينَ مَرَّةٗ فَلَن يَغۡفِرَ ٱللَّهُ لَهُمۡۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡفَٰسِقِينَ ٨٠﴾ [التوبة: ٨٠]  
“আপনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন অথবা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করুন একই কথা। আপনি সত্তর বার তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেও আল্লাহ তাদেরকে কখনই ক্ষমা করবেন না। এটা এ জন্যে যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফুরী করেছে। আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৮০]
আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়ে দিয়েছেন যে, এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই জাহান্নামের অধিবাসী হবে, যে ব্যক্তি তাঁর আগমনের কথা শুনেছে, অথচ তাঁর রিসালাতের ওপর ঈমান আনে নি। (আ‘উযুবিল্লাহ)। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ ، لاَ يَسْمَعُ بِى أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِىٌّ وَلاَ نَصْرَانِىٌّ، ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِى أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ».
“যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন তাঁর নামে শপথ করে বলছি! এ উম্মতের (জাতির) যে কেউ আমার ব্যাপারে শুনল চায় সে ইয়াহূদী হউক, খ্রিষ্টান হউক। অতঃপর যে রিসালাত দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছে তার ওপর ঈমান না এনেই সে মারা গেল, সে ব্যক্তি জাহান্নামের অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”
আর এটা এ জন্য যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের বিষয়টি সকল মানুষের জন্য আবশ্যকীয়ভাবে প্রযোজ্য। কোনো সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য নয়। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا رَحۡمَةٗ لِّلۡعَٰلَمِينَ ١٠٧﴾ [الانبياء: ١٠٧]
“আর আমরা তো আপনাকে সৃষ্টিকুলের জন্য শুধু রহমতরূপেই পাঠিয়েছি।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا كَآفَّةٗ لِّلنَّاسِ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗا وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَعۡلَمُونَ ٢٨﴾ [سبا: ٢٨]
“আর আমরা তো আপনাকে সমগ্র মানুষের জন্যই সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।” [সূরা সাবা, আয়াত: ২৮]
দ্বিতীয়ত: নবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করা
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য ও অনুসরণ করা তাঁর ওপর ঈমান আনয়নের বাস্তব প্রমাণ। সুতরাং যে ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও তাঁকে মহব্বত করার (ভালোবাসার) দাবি করল, অতঃপর সে তাঁর নির্দেশের অনুসরণ করলা না এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা থেকে নিষেধ করেছেন এমন হারাম থেকে বিরত থাকল না, আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো সুন্নাতের অনুসরণ করল না, সে ব্যক্তি তার ঈমান আনয়ন করার দাবিতে মিথ্যাবাদী। কারণ, ঈমান হলো এমন এক বিষয়, যা অন্তরের মধ্যে স্থিরভাবে অবস্থান করে এবং আমল তাকে সত্য ও বাস্তবে পরিণত করে।
আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণকারী ও অনুগত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ তাঁর (আল্লাহর) রহমত লাভ করতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَرَحۡمَتِي وَسِعَتۡ كُلَّ شَيۡءٖۚ فَسَأَكۡتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱلَّذِينَ هُم بِ‍َٔايَٰتِنَا يُؤۡمِنُونَ ١٥٦ ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِيَّ ٱلۡأُمِّيَّ﴾ [الاعراف: ١٥٦،  ١٥٧]  
“আর আমার দয়া তা তো প্রত্যেক বস্তুকে ঘিরে রয়েছে। কাজেই আমি তা লিখে দেব তাদের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় ও আমাদের আয়াতসমূহে ঈমান আনে, যারা অনুসরণ করে রাসূলের, উম্মী (নিরক্ষর) নবীর।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৬–১৫৭]
আর আল্লাহ তা‘আলা ঈমান আনয়ন ও আনুগত্য করা -এ দু’টি বিষয়কে একত্রিত করে দিয়েছেন এবং তাকে হিদায়াত ও সফলতার অন্যতম উপায় বানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং তিনি বলেন:
﴿ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِيَّ ٱلۡأُمِّيَّ ٱلَّذِي يَجِدُونَهُۥ مَكۡتُوبًا عِندَهُمۡ فِي ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَٱلۡإِنجِيلِ يَأۡمُرُهُم بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَىٰهُمۡ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيۡهِمُ ٱلۡخَبَٰٓئِثَ وَيَضَعُ عَنۡهُمۡ إِصۡرَهُمۡ وَٱلۡأَغۡلَٰلَ ٱلَّتِي كَانَتۡ عَلَيۡهِمۡۚ فَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِهِۦ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَٱتَّبَعُواْ ٱلنُّورَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ مَعَهُۥٓ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٥٧﴾ [الاعراف: ١٥٧]  
“যারা অনুসরণ করে রাসূলের, উম্মী নবীর, যার উল্লেখ তারা তাদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিপিবদ্ধ পায়, যিনি তাদেরকে সৎকাজের আদেশ দেন, অসৎকাজ থেকে নিষেধ করেন, তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করেন এবং অপবিত্র বস্তু হারাম করেন। আর তাদেরকে তাদের গুরুভার ও শৃংখল হতে মুক্ত করেন যা তাদের ওপর ছিল। কাজেই যারা তার ওপর ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তার সাথে নাযিল হয়েছে সেটার অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৭]
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিদায়াত থেকে যারা মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তাঁর নির্দেশের বিরোধিতা করে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির হুমকি দিয়েছেন। সুতরাং তিনি বলেন:
﴿فَلۡيَحۡذَرِ ٱلَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنۡ أَمۡرِهِۦٓ أَن تُصِيبَهُمۡ فِتۡنَةٌ أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٦٣﴾ [النور: ٦٣]
“কাজেই যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের ওপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের ওপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৬৩]
আর আল্লাহ তা‘আলা ঝগড়া-বিবাদ ও মতানৈক্যের সময় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফয়সালা ও সিদ্ধান্তের অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন, যা মূলত আল্লাহরই ফয়সালা। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের খেয়াল খুশি মত কোনো কথা বলতেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ﴾ [النساء: ٥٩]
“অতঃপর কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাক।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৯]
আর তাঁর বিচারের প্রতি মনের ঘৃণা নিয়ে তাঁর নিকট বিচারের আবেদন করলেও যথেষ্ট হবে না; বরং আবশ্যক হলো তাঁর বিচারের প্রতি মনের উদারতা প্রদর্শন করে এবং তাঁর নির্দেশকে এমনভাবে মেনে নেওয়া, যেখানে কোনো প্রকার আপত্তি থাকবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥﴾ [النساء: ٦٥]  
“কিন্তু না, আপনার রবের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার ওপর অর্পণ না করে। অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬৫]
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন: “আল্লাহ তা‘আলা শপথ করার শ্রেষ্ঠ বিষয় দ্বারা এখানে শপথ করেছেন, আর তা হলো তিনি স্বয়ং নিজেই নিজের নামে শপথ করেছেন, আর শপথের প্রাসঙ্গিক বিষয়টি হলো তাদের জন্য ঈমান সাব্যস্ত হবে না এবং তারা ঈমানদার বলেও গণ্য হবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের মধ্যকার সকল দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয়ে/দীনের সার্বিক বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিচারক হিসেবে গ্রহণ করবে। শুধু এটাই নয়, (বরং তারা মুমিন হতে পারবে না) যতক্ষণ না এর সাথে সংযুক্ত হবে তাঁর বিচার-মীমাংসার প্রতি তাদের উদার মন-মানসিকতা, যেখানে তারা তাদের মনে তাঁর বিচার-ফয়সালা ও সিদ্ধান্তের প্রশ্নে কোনো প্রকার সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা অনুভব করবে না; বরং তাঁর বিচার-মীমাংসাকে উদার চিত্তে গ্রহণ করে নিবে এবং তাকে মেনে নেওয়ার মাধ্যমে স্বাগত জানাবে।” অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য ও অনুসরণ করার বিষয়টির সাথে অবশ্যই সংযুক্ত থাকতে হবে তাঁর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের) প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মহব্বত; আর এটা হলো উম্মতের উপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকারসমূহ থেকে তৃতীয় অধিকার।
তৃতীয়ত: নবী মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসা
প্রকৃত মুমিনের জন্য আবশ্যক হলো তার অন্তরের মণিকোঠা থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসা; কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন তার ঈমানের উপলক্ষ, জাহান্নাম থেকে তার মুক্তির উপায় এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তার সৌভাগ্যের মূলসূত্র।
আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে মহব্বত করার মহান মানদণ্ড স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন:  
«لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَلَدِهِ وَوَالِدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ».
“তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার সন্তানের চেয়ে, তার পিতামাতার চেয়ে এবং দুনিয়ার সকল মানুষের চেয়ে সর্বাধিক প্রিয় হতে পারব।”  সুতরাং যে মানুষটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসবে না, সে আদৌ মুমিন নয়, যদিও মুসলিমগণের নামে তার নাম রাখা হয় এবং তাদের মাঝেই সে বসবাস করে; এমনকি যদিও সে নিয়মিতভাবে ইবাদত করে ও ইসলামী অনুষ্ঠানগুলো পালন করে (তবুও সে মুমিন নয়)।
আরও আবশ্যক হলো আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত বাকি সকল প্রিয় ব্যক্তি বা বস্তুর ওপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বতকে (ভালোবাসাকে) স্থান দেওয়া। সুতরাং তাঁকে ভালোবাসার বিষয়টি সন্তানাদি ও পিতামাতাকে ভালোবাসার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে, এমনকি মানুষ কর্তৃক নিজকে ভালোবাসার চেয়েও তাঁকে ভালোবাসার বিষয়টি অনেক বড় হতে হবে; আর এটা এমন একটি মহান পর্যায়, যে পর্যায়ে কামিল (পরিপূর্ণ) মুমিন ব্যতীত অন্য কেউ পৌঁছতে পারে না। কেননা একবার উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেন:  
«يا رسولَ الله، لأَنْتَ أَحَبُّ إِليَّ مِن كل شيء ، إِلا نَفْسي، فقال النبيُّ صلى الله عليه وسلم : «لا، والذي نَفْسي بيده حتى أكون أحبَّ إِليكَ مِن نَفْسِكَ». فقال له عُمَرُ : فَإِنَّهُ الآن، والله  لأنت أحبُّ إِليَّ مِن نَفْسي، فقال له النبيُّ صلى الله عليه وسلم : «الآنَ يا عمرُ».
“হে আল্লাহর রাসূল! আমার জীবন ব্যতীত সব কিছুর চেয়ে আপনি আমার নিকট অধিক প্রিয়। তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘না, যার হাতে আমার জীবন তাঁর নামে শপথ করে বলছি! যতক্ষণ না আমি তোমার নিকট তোমার নিজের জীবনের চেয়ে অধিক প্রিয় না হব (ততক্ষণ তুমি পরিপূর্ণ মুমিন নও)। তারপর উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন: তাহলে এখন বলছি, আল্লাহর কসম! অবশ্যই আপনি আমার কাছে আমার জীবনের চেয়েও অধিক প্রিয়; অতঃপর তাঁকে লক্ষ্য করে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘এতক্ষণে, হে উমার! (তুমি পরিপূর্ণ মুমিন)।”
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহব্বত করার মানগত স্তর:
ইমাম ইবন রাজাব বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসার বিষয়টি মানগতভাবে দু’টি স্তরে বিভক্ত:
প্রথম স্তরটি ফরয: আর তা এমন মহব্বত, যার দাবি হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার নিকট থেকে যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ করা এবং তাঁকে ভালোবাসা, সন্তুষ্টি, সম্মান ও স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে গ্রহণ করে নেওয়া। আর তাঁর সুন্নাত বা রীতিনীতির বাইরে গিয়ে কোনোভাবেই হেদায়েত অন্বেষণ না করা; অতঃপর সেসব বিষয়ে তাঁর যথাযথ অনুসরণ করা, যা তিনি তাঁর ‘রব’-এর পক্ষ থেকে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। যেমন, যতসব বিষয়ে তিনি সংবাদ পরিবেশন করেছেন, সে ক্ষেত্রে তাঁকে সত্যবাদী বলে স্বীকৃতি দেওয়া, তিনি যেসব আবশ্যকীয় বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর আনুগত্য করা এবং যেসব নিষিদ্ধ বিষয় থেকে তিনি নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা; আর তাঁর দীনকে সাহায্য করা এবং যে বা যারা তাঁর বিরোধিতা করে, তার বিরুদ্ধে সামর্থ্য অনুযায়ী জিহাদ করা। সুতরাং এ পরিমাণ মহব্বত অবশ্যই থাকতে হবে, তা ব্যতীত ঈমান পরিপূর্ণ হবে না।
দ্বিতীয় স্তরটি নফল বা অতিরিক্ত:
আর তা এমন মহব্বত, যার দাবি হলো তাঁকে সুন্দরভাবে অনুকরণ করা এবং তাঁর চরিত্র, আদব-কায়দা, নফল ‘ইবাদাত, খাবার ও পানীয় গ্রহণ, পোশাক পরিধান, স্ত্রীগণের সাথে উত্তম ব্যবহার ইত্যাদি ধরনের পরিপূর্ণ শিষ্টাচার ও পবিত্র চরিত্রের ক্ষেত্রে তাঁর সুন্নাতের যথাযথ অনুসরণ করা।  
সুতরাং এ মহান নবীকে মহব্বত করা থেকে আমরা কোথায় আছি?
পরিবার-পরিজন, সন্তানাদি ও ধন-সম্পদের ভালোবাসার ওপর তাঁর ভালোবাসাকে অগ্রাধিকার দেওয়া থেকে আমারা কোথায় অবস্থান করছি?
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿قُلۡ إِن كَانَ ءَابَآؤُكُمۡ وَأَبۡنَآؤُكُمۡ وَإِخۡوَٰنُكُمۡ وَأَزۡوَٰجُكُمۡ وَعَشِيرَتُكُمۡ وَأَمۡوَٰلٌ ٱقۡتَرَفۡتُمُوهَا وَتِجَٰرَةٞ تَخۡشَوۡنَ كَسَادَهَا وَمَسَٰكِنُ تَرۡضَوۡنَهَآ أَحَبَّ إِلَيۡكُم مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَجِهَادٖ فِي سَبِيلِهِۦ فَتَرَبَّصُواْ حَتَّىٰ يَأۡتِيَ ٱللَّهُ بِأَمۡرِهِۦۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡفَٰسِقِينَ ٢٤﴾ [التوبة: ٢٤]  
“বলুন, ‘তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর (আল্লাহর) পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশি প্রিয় হয় তোমাদের পিতৃবর্গ, তোমাদের সন্তানরা, তোমাদের ভ্রাতাগণ, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের আপনগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালোবাস, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না।” [সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ২৪]
চতুর্থত: নবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সমর্থন ও সহযোগিতা করা
আর এটা জীবিত ও মৃত অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকারসমূহের মধ্যে একটি অত্যন্ত জোরালো অধিকার; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় তাঁর সাহাবীগণ এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সর্বত্তোম পন্থায় বাস্তবায়ন করেছেন। এই তো সাহাবী কাতাদা ইবন নু‘মান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটি ধনুক হাদিয়া দেওয়া হলো; ওহুদ যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে ধনুকটি আমার নিকট হস্তান্তর করলেন। তারপর আমি তার দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগে আগে তীর নিক্ষেপ করলাম, এমনকি শেষ পর্যন্ত তার দুই পাশের বাঁকা অংশ গুঁড়া হয়ে গেল, আর আমি সার্বক্ষণিকভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আমার চেহারার দ্বারা তীর প্রতিহত করতে থাকলাম। যখনই কোনো তীর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা মুবারকের দিকে ধেয়ে আসত, তখনই আমি আমার মাথাকে ঝুঁকিয়ে দিতাম, যাতে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা মুবারককে রক্ষা করতে পারি !!
আর এ তো সাহাবী ও সভাকবি হাসসান ইবন সাবিত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কথা বলছি, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার কাজে ব্যস্ত থাকতেন, এমনকি তিনি এ জন্য নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে সুন্দর সুন্দর প্রসংসা অর্জন করেছেন। কেননা, তিনি বলেন:  
«اهْجُهُمْ أَوْ هَاجِهِمْ وَجِبْرِيلُ مَعَكََ ».
“তুমি তাদের (কাফিরদের) নিন্দা কর, আর জিবরীল আলাইহিস সালাম তোমার সাথে আছেন।”
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে মুশরিকদের বিপক্ষে তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য উৎসাহিত করেছেন, তিনি বলেন:  
«مَنْ يَرُدُّهُمْ عَنَّا وَلَهُ الْجَنَّةُ أَوْ هُوَ رَفِيقِى فِى الْجَنَّةِ».
“যে আমাদের থেকে তাদেরকে প্রতিরোধ করবে, তার জন্য জান্নাত রয়েছে, অথবা সে জান্নাতে আমার সাথী হবে।”
আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর প্রতিরক্ষার বিষয়টি হবে তাঁর সুন্নাতের ক্ষেত্রে, যখন তা অপবাদ প্রদানকারীদের অপবাদ, জাহিলদের বিকৃতি ও বাতিলদের জালিয়াতির শিকার হয়। অনুরূপভাবে তাঁর মহান ব্যক্তিত্বকে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা, যখন কেউ তাঁকে মন্দ বলে আক্রমণ করে, অথবা এমন বিশেষণ দ্বারা তাঁকে বিশেষিত করে, যা তাঁর শান ও মর্যাদার সাথে একেবারেই বেমানান। আর এ যুগে দুর্নাম বা কুৎসা রটানোর মত আক্রমণের হার অনেক পরিমাণে বেড়ে গেছে, যার দ্বারা তারা ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অপবাদ আরোপ করে যাচ্ছে; আর এ অবস্থায় গোটা উম্মতের আবশ্যকীয় দায়িত্ব হলো তাদের নবীকে প্রতিরক্ষার জন্য যথাসম্ভব শক্তি ও বল প্রয়োগের সকল উপায় অবলম্বন করা, যাতে ঐসব দুষ্ট লোকগুলো ঐ জাতীয় উদ্দেশ্য প্রণোদিত বর্বর আক্রমণ থেকে বিরত থাকে, যার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো মানুষকে ইসলাম ও মুসলিমগণ থেকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া।        
পঞ্চমত: নবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাও‘য়াতকে সম্প্রসারণ করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকার পূরণের অন্যতম একটি দিক হলো ইসলাম প্রসারের কাজ করা এবং প্রত্যেক জায়গায় তাঁর বাণী প্রচার করা। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:  
«بَلِّغُوا عَنِّي وَلَوْ آيَةً».
“তোমরা আমার পক্ষ থেকে পৌঁছিয়ে দাও, যদিও তা একটি আয়াত হয়।”
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:  
«لأَنْ يَهْدِىَ اللَّهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِدًا خَيْرٌ لَكَ مِنْ أَنْ يَكُونَ لَكَ حُمْرُ النَّعَمِ».
“তোমার দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক একজন মানুষকে হিদায়াত করাটা তোমার জন্য লাল উটের মালিক হওয়া থেকে অনেক বেশি উত্তম।”  আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও সংবাদ দিয়েছেন এ বলে:  
«فَإِنِّى مُكَاثِرٌ بِكُمُ الأممَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ».
“আমি কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে নিয়ে অন্যান্য উম্মতের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাবো।”  আর উম্মতের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দেওয়ার কাজ করা এবং আল্লাহর দীনের মধ্যে দলে দলে লোকজনের প্রবেশ, আর আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, তাঁর দিকে দা‘ওয়াত দেওয়ার কাজটি হলো রাসূলগণ ও তাঁদের অনুসারীদের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। সুতরাং তিনি বলেন:
﴿قُلۡ هَٰذِهِۦ سَبِيلِيٓ أَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا۠ وَمَنِ ٱتَّبَعَنِي﴾ [يوسف: ١٠٨]
“বলুন, ‘এটাই আমার পথ, আল্লাহর প্রতি মানুষকে আমি ডাকি জেনে-বুঝে, আমি এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও।” [সূরা ইউসূফ, আয়াত: ১০৮]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলে দিয়েছেন যে, দাওয়াতের কাজে যেসব কথা বলা হয়, সেগুলো হলো সর্বোত্তম কথা। তিনি বলেন:
﴿وَمَنۡ أَحۡسَنُ قَوۡلٗا مِّمَّن دَعَآ إِلَى ٱللَّهِ وَعَمِلَ صَٰلِحٗا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ٣٣﴾ [فصلت: ٣٣]
“আর তার চেয়ে কার কথা উত্তম, যে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানায় এবং সৎকাজ করে। আর বলে, ‘অবশ্যই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।” [সূরা ফুস্সিলাত, আয়াত: ৩৩]
সুতরাং এ উম্মতের জন্য আবশ্যক হলো- তারা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে আঁকড়ে ধরবে, যা পালন করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, আর তা হলো আল্লাহর দিকে আহ্বান করা, সৎকাজের আদেশ দেওয়া এবং অসৎকাজে নিষেধ করা, আর বিশেষ করে এ যুগে, যে সময়ে ইসলামের শত্রুরা উম্মতের ওপর উৎপীড়ন করে চলেছে তাদেরকে ধ্বংস ও নিঃশেষ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে; আর আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহে কখনও তাদের এ লক্ষ্য অর্জিত হবে না, যতক্ষণ এ উম্মত তাদের আকিদা-বিশ্বাসকে মজবুতভাবে ধারণ করবে এবং তাদের নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিদায়াত ও নির্দেশনার অনুসরণ করে মানুষকে তাদের রবের দিকে ডাকবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ ﴾ [ال عمران: ١١٠]
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানব জাতির জন্য যাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০]
ষষ্ঠত: নবী মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মান করা
আর এটাও নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম একটি অধিকার, যে ব্যাপারে অনেক মানুষ অবহেলা করে। আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿إِنَّآ أَرۡسَلۡنَٰكَ شَٰهِدٗا وَمُبَشِّرٗا وَنَذِيرٗا ٨ لِّتُؤۡمِنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُۚ وَتُسَبِّحُوهُ بُكۡرَةٗ وَأَصِيلًا ٩﴾ [الفتح: ٨،  ٩]  
“নিশ্চয় আমরা আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান আন এবং তাঁর শক্তি যোগাও ও তাঁকে সম্মান কর; আর সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।” [সূরা আল-ফাতহ, আয়াত: ৮–৯]
ইবন সা‘দী রহ. বলেন: অর্থাৎ তোমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মান ও শ্রদ্ধা কর এবং তাঁর অধিকারসমূহ আদায় কর, যেমনিভাবে তোমাদের তত্ত্বাবধান করার জন্য তাঁর মহান অনুগ্রহ ও দয়া ছিল।”
বস্তুত নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ তাঁকে অনেক বেশি ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। কেননা, যখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা বলতেন, তখন তাঁরা তাঁর উদ্দেশ্য নীরবে মাথা নত করে থাকতেন, এমনকি মনে হত যেন তাঁদের মাথার উপর পাখি বসে আছে।
আর যখন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَرۡفَعُوٓاْ أَصۡوَٰتَكُمۡ فَوۡقَ صَوۡتِ ٱلنَّبِيِّ وَلَا تَجۡهَرُواْ لَهُۥ بِٱلۡقَوۡلِ كَجَهۡرِ بَعۡضِكُمۡ لِبَعۡضٍ أَن تَحۡبَطَ أَعۡمَٰلُكُمۡ وَأَنتُمۡ لَا تَشۡعُرُونَ ٢﴾ [الحجرات: ٢]  
(হে ঈমানদারগণ! তোমরা নবীর কন্ঠস্বরের উপর নিজেদের কন্ঠস্বর উঁচু করো না এবং নিজেদের মধ্যে যেভাবে উচ্চস্বরে কথা বল তার সাথে সেরূপ উচ্চস্বরে কথা বলো না; এ আশঙ্কায় যে, তোমাদের সকল কাজ বিনষ্ট হয়ে যাবে অথচ তোমরা উপলব্ধিও করতে পারবে না।) [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ২] নাযিল হয়, তখন আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: “আল্লাহর কসম! তার পরে আমি আপনার সাথে শুধু গোপন বিষয়ের আলাপকারীর মতোই চুপে চুপে কথা বলব। আর উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও অন্যান্য সাহাবীগণও এরূপ করতেন, এমনকি শেষ পর্যন্ত তাঁদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন,
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ يَغُضُّونَ أَصۡوَٰتَهُمۡ عِندَ رَسُولِ ٱللَّهِ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱمۡتَحَنَ ٱللَّهُ قُلُوبَهُمۡ لِلتَّقۡوَىٰۚ لَهُم مَّغۡفِرَةٞ وَأَجۡرٌ عَظِيمٌ ٣﴾ [الحجرات: ٣]  
“নিশ্চয় যারা আল্লাহর রাসূলের সামনে নিজেদের কন্ঠস্বর নীচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য পরীক্ষা করে নিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।” [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ৩]
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর তাঁকে সম্মান করা:
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর তাঁকে সম্মান করার বিষয়টি হবে তাঁকে অনুসরণ করার মাধ্যমে, তাঁর নির্দেশকে শ্রদ্ধার সাথে মেনে নেওয়ার মাধ্যমে, তাঁর বিধানকে গ্রহণ করে নেওয়ার মাধ্যমে, তাঁর বাণীর সাথে আদব রক্ষা করে চলার মাধ্যমে এবং কোনো ব্যক্তির মত অথবা মাযহাবের দোহাই দিয়ে তাঁর হাদিসের বিরোধিতা না করার মাধ্যমে। ইমাম শাফেঈ রহ. বলেন: “মুসলিমগণ এ কথার ওপর ঐক্যবদ্ধ (ইজমা) হয়েছেন যে, যার নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে, তার জন্য কোনো ব্যক্তির কথায় তা (সুন্নাত) বর্জন করা বৈধ নয়।”
সাফওয়ান ইবন সুলাইমের নিকট যখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলোচনা হত, তখন তিনি কাঁদতেন, অতঃপর তিনি কাঁদতেই থাকতেন, শেষ পর্যন্ত লোকজন তার নিকট থেকে উঠে যেতেন এবং তাকে রেখে চলে যেতেন।
সপ্তমত: যখনই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলোচনা হবে তখনই তাঁর প্রতি দুরূদ পাঠ করা
আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণকে তাঁর নবীর প্রতি সালাত পাঠ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿إِنَّ ٱللَّهَ وَمَلَٰٓئِكَتَهُۥ يُصَلُّونَ عَلَى ٱلنَّبِيِّۚ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ صَلُّواْ عَلَيۡهِ وَسَلِّمُواْ تَسۡلِيمًا ٥٦﴾ [الاحزاب: ٥٦]
“নিশ্চয় আল্লাহ নবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফিরিশতাগণ নবীর জন্য দো‘আ-ইস্তেগফার করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও নবীর ওপর সালাত পাঠ কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৬]
আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:  
«مَنْ صَلَّى عَلَىَّ صَلاَةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ بِهَا عَشْرًا».
“যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার সালাত পাঠ করবে, তার বিনিময়ে আল্লাহ তার ওপর দশবার সালাত পেশ করবেন (প্রশংসা করবেন)।”
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:  
«رَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ».
“ঐ ব্যক্তির নাম ধুলামলিন হউক, যার নিকট আমার আলোচনা হয় অথচ সে আমার প্রতি সালাত পাঠ করে না।”  
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:  
«أَوْلَى النَّاسِ بِي يَومَ القِيَامَةِ أكْثَرُهُمْ عَلَيَّ صَلاَةً».
“কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তি আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী হবে, যে আমার ওপর সবচেয়ে বেশি সালাত পাঠ করবে।”
সুতরাং নির্দয় আচরণ বা দুর্ব্যবহারের অন্তর্ভুক্ত হলো, কোনো মানুষ কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলোচনা শুনা, অতঃপর তাঁর ওপর দুরূদ পাঠ করতে কৃপণতা করা। ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রহ. তার ‘জালাউল আফহাম ফিস সালাত ওয়াস সালাম ‘আলা খাইরিল আনাম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ ( جلاء الأفهام في الصلاة و السلام على خير الأنام صلى الله عليه و سلم ) নামক গ্রন্থে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরূদ পাঠ করার অনেক উপকারিতা আলোচনা করেছেন। সুতরাং আরও বেশি জানার জন্য তা অধ্যয়ন করা যেতে পারে।
অষ্টমত: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বন্ধুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করা এবং তাঁর শত্রুদেরকে ঘৃণা করা
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿لَّا تَجِدُ قَوۡمٗا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ يُوَآدُّونَ مَنۡ حَآدَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَوۡ كَانُوٓاْ ءَابَآءَهُمۡ أَوۡ أَبۡنَآءَهُمۡ أَوۡ إِخۡوَٰنَهُمۡ أَوۡ عَشِيرَتَهُمۡۚ أُوْلَٰٓئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ ٱلۡإِيمَٰنَ وَأَيَّدَهُم بِرُوحٖ مِّنۡهُۖ﴾ [المجادلة: ٢٢]
“আপনি পাবেন না আল্লাহ ও আখিরাতের ওপর ঈমানদার এমন কোন সম্প্রদায়, যারা ভালোবাসে তাদেরকে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে, হোক না এ বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা এদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠী। এদের অন্তরে আল্লাহ লিখে দিয়েছেন ঈমান এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা।” [সূরা আল-মুজাদালা, আয়াত: ২২]
আর তাঁকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার অন্যতম বিষয় হলো: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করা, তাঁদেরকে ভালোবাসা, সম্মান করা এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা। আর তাদের অধিকার সম্পর্কে জানা, তাদের প্রশংসা ও গুণগান করা এবং তাদের অনুসরণ করা। আর তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং তাদের মধ্যকার সংঘটিত অনাকাঙ্খিত ঘটনা ও বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা থেকে বিরত থাকা, আর তাদের সাথে যে ব্যক্তি শত্রুতা পোষণ করে অথবা তাদেরকে গালি দেয় অথবা তাদের কোনো একজনের ব্যাপারে দুর্নাম বা নিন্দা করে, তার সাথে শত্রুতা পোষণ করা। আর (তাদের ব্যাপারে) তাদের কেউ মন্দ আলোচনা করলে তা গ্রহণ না করা; বরং তাদের ভালো ও মর্যদাপূর্ণ বিষয়গুলো এবং তাদের প্রশংসনীয় জীবন বৃত্তান্ত আলোচনা করাটাকেই যথেষ্ট মনে করা; আর এগুলোর বাইরে আলোচনা করা থেকে নীরব ও চুপ থাকা।
আর এরই অন্তর্ভুক্ত হলো: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবার-পরিজন (আহলে বাইত)-কে মহব্বত করা এবং তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করা, আর তাদের মান-সম্মান প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা এবং তাদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি বর্জন করা। কারণ, বাড়াবাড়ি করার বিষয়টি এমন, যা থেকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন।
আর এরই অন্তর্ভুক্ত হলো: আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণকে মহব্বত করা এবং তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করা, আর তাদের দুর্নাম করা এবং তাঁদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া অথবা তাদের গীবত করা ও তাদের গোশত ভক্ষণ করার বিষয়টি বর্জন করা। কারণ, আলেমগণের গোশতের (গীবত করার) বিষয়টি বিষাক্ত ও মারাত্মক অন্যায়। আর তাদের দুর্নামকারী ব্যক্তিদের ব্যাপারে আল্লাহর বিধানের বিষয়টি তো সর্বজনবিদিত।  
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার অন্যতম বিষয় হলো: তাঁর শত্রু কাফির, মুনাফিক, বিদ‘আতের অনুসারী প্রমুখ পথভ্রষ্টদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা। কারণ, আসমা ইবন ‘উবাইদ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«دَخَلَ رَجُلَانِ مِنْ أَصْحَابِ الْأَهْوَاءِ عَلَى ابْنِ سِيرِينَ فَقَالَا: يَا أَبَا بَكْرٍ! نُحَدِّثُكَ بِحَدِيثٍ؟ قَالَ : لَا، قَالَا: فَنَقْرَأُ عَلَيْكَ آيَةً مِنْ كِتَابِ اللَّهِ ؟ قَالَ : لَا، لَتَقُومَانِ عَنِّي أَوْ لَأَقُومَنَّ، فَقَامَا وخَرَجَا».
“প্রবৃত্তি পূজারীদের মধ্যে দুই ব্যক্তি ইবন সিরীন রহ.-এর নিকট প্রবেশ করল, তারপর বলল: হে আবু বকর (তার উপনাম)! আমরা কি আপনার নিকট একটি হাদীস বর্ণনা করব? তিনি বললেন: না, তারা আবার বলল: তাহলে আমরা কি আপনার কাছে আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত পাঠ করব? তিনি বললেন: না, বরং হয় তোমরা আমার কাছ থেকে চলে যাবে অথবা আমি চলে যাব! অতঃপর তারা দু’জন দাঁড়িয়ে গেল এবং বের হয়ে চলে গেল।”
অনুরূপ প্রবৃত্তি পূজারীদের এক ব্যক্তি আইয়ুব আস-সাখতিয়ানী রহ.-কে উদ্দেশ্য করে বলল:
«أسألك عن كلمة . فولى عنه وهو يشير بأصبعه : ولا نصف كلمة».
“আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই; কিন্তু তিনি তার নিকট থেকে চলে গেলেন এমতাবস্থায় যে, তিনি তাঁর আঙুল দ্বারা ইশারা করলেন: অর্ধক কথাও না।”  
এ সবগুলোই হলো নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতকে সম্মান করার জন্য এবং তাঁর শত্রুদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করার জন্য।
আমরা আল্লাহ তা‘আলার নিকট আবেদন করছি যে, তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের) অনুসারীগণের অন্তর্ভুক্ত করে নেন এবং আমাদেরকে সমবেত করেন তাঁর দলে; আর তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর হিদায়াত ও সুন্নাতের বিরোধী বানিয়ে না দেন।
সমাপ্ত

 

উম্মতের ওপর নবী মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকার

বই সম্পর্কে

লেখক :

أحمد بن عثمان المزيد Adel ibn Ali Al-Shiddy

প্রকাশক :

www.islamhouse.com

বিভাগ :

Doctrine & Sects