রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য

এ ছোট্ট পুস্তিকায় লিখক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের সুন্দর ঈমান, চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও গুণাবলী তুলে ধরেছেন। তাদের ব্যাপারে সমালোচকদের সমালোচনা যে মোটেই শুদ্ধ নয় তা কুরআন ও সহীহ হাদীসের দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণ করেছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য
[ বাংলা – Bengali – بنغالي ]
শাইখ সালেহ ইবন আবদিল্লাহ আদ-দারওয়ীশ
বিচারক, আল-কাতিফ উচ্চ আদালত, সৌদি আরব।



অনুবাদ : আব্দুল্লাহ আল মামুন আল-আযহারী

সম্পাদনা : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী







2014 - 1435
 
 
﴿ صحبة رسول الله صلى الله عليه وسلم﴾
« باللغة البنغالية »
الشيخ صالح بن عبد الله الدرويش
القاضي بالمحكمة الكبرى بالقطيف


ترجمة: عبد الله المأمون الأزهري
مراجعة: د/ محمد  منظور إلهي


2014 - 1435
 
 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য
ভূমিকা
إن الحمد لله، نحمده، ونستعينه، ونستغفره، ونتوب إليه، ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا، من يهده الله فلا مضل له، ومن يضلل فلا هادي له
সব প্রশংসা আল্লাহর, আমরা তাঁর প্রশংসা করছি, তাঁর নিকট ক্ষমা চাচ্ছি, তাঁর কাছে তাওবা করছি, তাঁর কাছে আমাদের অন্তরের সব কলুষতা ও পাপ থেকে পানাহ চাই। তিনি যাকে হিদায়াত দান করেন কেউ তাকে গোমরাহ করতে পারে না, আর তিনি যাকে পথ-ভ্রষ্ট করেন কেউ তাকে হিদায়াত দিতে পারে না।
অতঃপর, বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ ইসলামী জাগরণের যুগে বসবাস করছে, - আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি তিনি যেন তাদেরকে এ জাগরণের পূর্ণ ফল ভোগ করার তাওফিক দিন-। উম্মতের এ জাগরণকে কুফরীশক্তি কখনও ছেড়ে দিবে না, যদিও সামান্য সুযোগ দেয়, তবে নবজাগরণ থেকে তাদেরকে পদে পদে বাধা দিবে। আর শত্রুর মোকাবিলায় ধৈর্যধারণ করা ছাড়া উম্মতের জাগরণ পরিণতিতে পৌছেঁ না। সর্বপ্রকারের ধৈর্যধারণ, আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করলে উম্মত তখন নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব পাবে এবং আল্লাহর রহমতে তাদের জাগরণ মুবারকময় হবে। ইসলামের শত্রুদের একটি মারাত্মক ষড়যন্ত্র হলো উম্মতকে নানা দল ও মতে বিভক্ত করে এর ফায়েদা লুটে নেয়া।
মুসলমানকে নানা দলে বিভক্ত করার অন্যতম উপয় হলো তাদের ভয়াবহ ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে ঘাটাঘটি করা। কতিপয় কিচ্ছা-কাহিনীকারগণ এসব ঘটনায় নানা রং ঢং ও ঢালাই ও ভাষার বুনন দিয়ে এগুলোকে সাজিয়ে উপস্থাপন করে থাকে। স্বার্থান্বেষীরা এগুলোকে ব্যবহার করে মানুষের অনুভুতিকে জাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। জনসাধারণের অনুভুতিকে কাজে লাগিয়ে ধন-সম্পদ অর্জন করে। তারা এগুলোকে কাজে লাগিয়ে তাদের হীন স্বার্থ হাসিল করে।
মুসলমানদের উচিত, বিশেষ করে তালিবে ইলমদের উচিত এ ব্যাপারে সত্য-মিথ্যা বর্ণনা করা ও ঈমানদারদেরকে কুরআন ও সুন্নহের উপর অটল থাকতে আহ্বান করা। দলাদলি পরিহার করে উম্মতকে বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে মুক্ত থাকা ও শত্রুদের হীন ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করা।
সম্মানিত পাঠকের কাছে একথা অস্পষ্ট নয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পরে কল্প-কাহিনীকারেরা সাহাবীদের মধ্যকার ঘটমান বিষয় নিয়ে মানুষের মাঝে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছে।
প্রকৃত ঘটনা উদঘটনে অংশীদার হতে ও আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতে আক্বীদা ও মাযহাবের ভিন্নতা সত্ত্বেও সাধারণ মুসলমান নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সকলের জন্য এ ছোট পুস্তিকাটি লিখেছি। আক্বলী ও নক্বলী বিশেষ করে কুরআনুল কারীম থেকে দলিল পেশ করতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। সাথে সাথে মানুষের অনুভুতি ও বিবেকের চাহিদাকেও লক্ষ্য রেখেছি। আশা করছি আল্লাহ তা‘আলা এ কিতাবটি দ্বারা সবাইকে উপকৃত করবেন। যা সঠিক, তা তো মহান আল্লাহর তরফ থেকেই। আমার ভুল ত্রুটি ও সব পাপের জন্য ইস্তিগফার করছি।
পাঠককে সুন্দর মতামত, পরামর্শ ও সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে বিশেষ অনুরোধ করছি।

সালেহ ইবন আবদিল্লাহ আদ-দারওয়ীশ
বিচারক, আল-কাতিফ উচ্চ আদালত, সৌদি আরব।

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিশন থেকে
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ رَبَّنَا وَٱبۡعَثۡ فِيهِمۡ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَيُزَكِّيهِمۡۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٢٩ ﴾ [البقرة: ١٢٩] 
“হে আমাদের রব, তাদের মধ্যে তাদের থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যে তাদের প্রতি আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে আর তাদেরকে পবিত্র করবে। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়”। [সূরা : আল-বাকারা: ১২৯]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,
﴿ هُوَ ٱلَّذِي بَعَثَ فِي ٱلۡأُمِّيِّ‍ۧنَ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٖ ٢ ﴾ [الجمعة: ٢] 
“তিনিই উম্মীদের (উম্মী দ্বারা আরবের লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে) মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে, যে তাদের কাছে তেলাওয়াত করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং তাদেরকে শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাত। যদিও ইতঃপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল”। [সূরা : আল্-জুমু‘আ: ২]
এগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সম্মানিত সাহাবীদের   মাঝে সুসম্পর্কের ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলিল।  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে মিশন নিয়ে আল্লাহ তা‘আলা প্রেরণ করেছেন তা এখানে সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণিত হয়েছে। আর এটা হলো তাঁর উপর শরয়ী‘ ওয়াজিব ও তাঁর উপর অর্পিত রিসালাতের প্রজ্ঞা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেয়া দায়িত্ব উত্তমরূপে আদায় করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দ্বারা মানুষকে শিরক ও কুফরের স্পষ্ট ভ্রষ্টতা থেকে ঈমান ও তাওহীদের দিকে মুক্তি দিয়েছেন। 
হ্যাঁ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের মাঝে বসবাস করেছেন। আল্লাহ তাদের মধ্য থেকেই তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। কুরাইশদের এমন কোন গোত্র নাই যার সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আত্মীয়তার সম্পর্ক পাওয়া যাবে না। এমনকি মদীনার আনসারদের সাথেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। তাদের মধ্যে বনু নাজ্জার গোত্র আব্দুল মুত্তালিবের মামার বংশধর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নানার গোত্র।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ ١٢٩ ﴾ [البقرة: ١٢٩] 
“তিনিই (উম্মীদের মাঝে) একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে”। [আল-বাকারাহ: ১২৯]
হ্যাঁ, আল্লাহ তা‘আলা মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বোত্তম বংশধর থেকে নির্বাচিত করেছেন। তিনি তাকে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশধর থেকে পাঠিয়েছেন। তাকে পৃথিবীর সর্বোত্তম ভূমি মক্কা মুকাররমায় প্রেরণ করেছেন। নবী আলাইহিস সালাম তাঁর পিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দু‘আর সফল। তিনি আদম আলাইহিস সালামের শ্রেষ্ঠ সন্তান। মাকামে মাহমুদ, হাউসে কাওসার, কিয়ামতের দিন শাফা‘আতের অধিকারী ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। সব উম্মতের ঐক্যমতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বোত্তম মানব ও সমস্ত নবী রাসূলদের নেতা। তাই সব প্রশংসা মহান আল্লাহর ও তাঁরই অনুগ্রহ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মহান আল্লাহর পূর্ণ নি‘আমত হলো তিনি জ্ঞান গরিমা, সাহসিকতা ও বীরত্বে শ্রেষ্ঠ মানুষদেরকে তাঁর সাহাবী নির্বাচিত করেছেন। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, যেহেতু তাঁরা তাঁরই আত্মীয় স্বজন ও গোত্রীয়। বংশ হিসেবে তাঁরা শ্রেষ্ঠ মানুষ, চরিত্রের বিবেচনায় সর্বোত্তম। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«النَّاسُ مَعَادِنُ، خِيَارُهُمْ فِي الجَاهِلِيَّةِ خِيَارُهُمْ فِي الإِسْلاَمِ، إِذَا فَقُهُوا»
“মানুষ খনি বিশেষ, জাহিলিয়্যাতের যুগে যারা তাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিল, ইসলামেও তাঁরা সর্বোত্তম ব্যক্তি, যদি তারা ইসলামী জ্ঞান লাভ করে”। 
একথা সকলের কাছেই স্পষ্ট যে, আল্লাহ তা‘আলা ইসমাঈল আলাইহিস সালামের সন্তানদের থেকে কিনানকে নির্বাচিত করেছেন। আর কিনান থেকে কুরাইশ, কুরাইশ থেকে বনী হাশিমকে নির্বাচিত করেছেন, যারা তাদের মধ্য থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওতের কারণে সুমহান সম্মান ও উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছেন।  তারা রাসূলের গোত্রীয় লোক যাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বন্দি করে রেখেছিল। তারা এমন মর্যাদাবান যাদের জন্য সদকা গ্রহণ করা জায়েয ছিল না। তাদের মধ্য থেকেই ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবার পরিজন, তাদের থেকেই আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশ্ববাসীর জন্য নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন।
সম্মানিত পাঠক পাঠিকা, একটু চিন্তা গবেষণা করুন!
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, 
﴿ وَيُزَكِّيهِمۡ ٢ ﴾ [الجمعة: ٢] 
“তাদেরকে পবিত্র করে”। [সূরা : আল্-জুমু‘আ: ২] তাঁরা ছিলেন সর্বোত্তম মানুষ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন ও পবিত্র করেছেন। সুতরাং তাদের ব্যাপারে কোন ধরনের অপবাদ কল্পনা করা যায়? তাযকিয়াকে শিক্ষার উপরে অগ্রাধিকার দেয়ার ব্যাপারে একটু চিন্তা করুন! এটা অর্থের দিক থেকে বিশেষ তাত্পর্য বহন করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, 
﴿ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ ٢ ﴾ [الجمعة: ٢] 
“এবং তাদেরকে শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাত।”। [সূরা : আল্-জুমু‘আ: ২] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে আদায় করেছেন। অতঃএব, আল্লাহকে ভয়কারী ন্যায়পরায়ণ বিবেকবান কেউ কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিষ্যদেরকে (সাহাবাদেরকে) অজ্ঞ ভাবতে পারে?! 
হে সম্মানিত পাঠক!
তাড়াহুড়া না করে এ আয়াতের প্রতি বিশেষ নজর দিন, এর অর্থের প্রতি একটু চিন্তা ভাবনা করুন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ هُوَ ٱلَّذِي بَعَثَ فِي ٱلۡأُمِّيِّ‍ۧنَ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٖ ٢ ﴾ [الجمعة: ٢] 
“তিনিই উম্মীদের (উম্মী দ্বারা আরবের লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে) মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে, যে তাদের কাছে তেলাওয়াত করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং তাদেরকে শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাত। যদিও ইতঃপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল”। [সূরা : আল্-জুমু‘আ: ২]
এর পরবর্তী আয়াতে দিকে খেয়াল করুন।
﴿ ذَٰلِكَ فَضۡلُ ٱللَّهِ يُؤۡتِيهِ مَن يَشَآءُۚ ٤ ﴾ [الجمعة: ٤] 
“এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন”। [সূরা : আল্-জুমু‘আ: ৪]
    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য মহান আল্লাহ তা‘আলার বিরাট নি‘আমত ও অনুগ্রহ। হ্যাঁ, এটা  আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে দান করেন। আর সাহাবায়ে কিরামগণ এ অনুগ্রহ লাভ করেছেন এবং অন্যদের থেকে তাঁরা অগ্রগামী হয়েছেন।
    হ্যাঁ, এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাথে বসবাসকারী তাঁর সম্মানিত সাহাবীদের মাঝে এক গভীর বন্ধন।
তাদের অগ্রভাগে রয়েছেন তাঁর পবিত্র পরিবার বর্গ, মু’মিনদের মাতা তাঁর স্ত্রীগণ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুন্না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে উঠা বসায় হাসি খুশি ও আনন্দ করতেন। তাঁরা ছিলেন তাঁর সেনাবাহিনী, সহযোগী ও তাঁর যোগ্য শিষ্য যারা তাঁর থেকে ইলম গ্রহণ করেছেন। তাদের মাঝে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবন অতিবাহিত করেছেন এবং তাদের মাঝেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।
হ্যাঁ, নিশ্চয় যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসেন, তাকে অনুসরণ করেন তাঁরা বিশ্বাস করেন যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আমানত যথাযথ ভাবে আদায় করেছেন এবং রিসালাত সঠিকভাবে পৌঁছেছেন। আল্লাহ তাকে যা আদেশ দিয়েছেন তা তিনি পালন করেছেন। এভাবেই তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে ইলম পৌঁছেছেন এবং তাদেরকে পুতঃপবিত্র করেছেন। তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে সরাসরি কুরআন ও সুন্নহ গ্রহণ করেছেন। আবার তাদের থেকে তাবেয়ী‘গণ গ্রহণ করেছেন। দ্বীনের ব্যাপারে তাদের সততা, ন্যায়পরায়ণতার হুকুম দেয়া এবং এ সাক্ষ্য দেয়া যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ যা নির্দেশ দিয়েছেন তা তিনি সঠিকভাবে পালন করেছেন।
তাদের ব্যাপারে অপবাদ দেয়া মানে তাদের ইমাম, নেতা ও শিক্ষক সাইয়্যেদুল মুরসালিন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অপবাদ দেয়া। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ।
চিন্তা করুন ও ভাবুন
কেননা এখানে ব্যাপারটা অত্যাবশ্যকীয়ভাবে একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।  এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের দোষ অন্বেষণ ও ভুলত্রুটি খোঁজা বা এ সব দোষত্রুটি বর্ণনা করা সব জ্ঞানবানদের ঐক্যমতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই দোষত্রুটি খোঁজার নামান্তর। নিম্নে এ ব্যাপারে সংক্ষিপ্তভাবে ব্যাখ্যা করা হলো।  
 

চিন্তা ভাবনা
সম্মানিত পাঠক ব্যস্ত হবেন না, আমার সাথে ভাবুন:
আপনি যখন একাকী হবেন বা বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভর করা যায় এমন কোনো জ্ঞানীর সাথে থাকবেন তখন একটু চিন্তা ভাবনা করুন। এটা দ্বীনের অংশ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ ۞قُلۡ إِنَّمَآ أَعِظُكُم بِوَٰحِدَةٍۖ أَن تَقُومُواْ لِلَّهِ مَثۡنَىٰ وَفُرَٰدَىٰ ثُمَّ تَتَفَكَّرُواْۚ مَا بِصَاحِبِكُم مِّن جِنَّةٍۚ ٖ ٤٦ ﴾ [سبا: ٤٦] 
“বল, ‘আমি তো তোমাদেরকে একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে দু’জন অথবা এক একজন করে দাঁড়িয়ে যাও, অতঃপর চিন্তা করে দেখ, তোমাদের সাথীর মধ্যে কোন পাগলামী নেই।” [সূরা : সাবা' : ৪৬]
আপনি কি চিন্তা করেছেন যে, কোন দেশ বা জাতির প্রধান বা উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি যদি এমন কিছু অনুসারীদের দ্বারা বেষ্টিত যারা শুধু সুবিধাবাদীই নন বরং বিশ্বাসঘাতক ও খিয়ানতকারী। তারা তাদের শিক্ষক বা নেতার চিন্তা ধারার বিরুদ্ধে কথা বলে। এসব খিয়ানতকারীরা তার প্রিয়ভাজন, বিশেষ লোক, পরামর্শদাতা, বংশীয় ও বৈবাহিক আত্মীয় এবং তারাই তার চিন্তাধারাকে লালন পালন করে প্রচার প্রসার করছেন।
চিন্তা গবেষণা করুন!
উত্তর দিতে তাড়াহুড়া করবেন না। আপনি কি বলবেন যদি সেই ইমাম ও নেতার প্রশংসা তার অনুসারীরা করেন আর তিনিও তাদের প্রশংসা করেন। যারা ঐ অনুসারীদের নিন্দা ও অপবাদ দেয় তিনিও তাদের নিন্দা করেন ও তাদেরকে অবমূল্যায়ন করেন।
এমন কি কোন শাসক পাওয়া যাবে যার উপদেষ্টা, মন্ত্রীপরিষদকে গাল মন্দ করা হয় এবং তাদেরকে খিয়ানতকারী হিসেবে গণ্য করা হয়, আর তিনি তাদের এসব নিন্দা ও অপবাদের উপর রাজি খুশি থাকেন??
ভাবুন ও চিন্তা করুন!!
আপনি একজন আলিমের ব্যাপারে কি বলবেন যিনি তার সব প্রচেষ্টা ও জ্ঞান তার সেসব ছাত্রদের শিক্ষা দেয়ার  কাজে ব্যয় করেছেন যারা শয়নে স্বপনে, প্রকাশ্য গোপন সর্বাবস্থায় তার সাথে ছিল। তারা নিজেদের পরিবার, দেশ ধনসম্পদ ইত্যাদি শুধু তাদের উস্তাদের সাহচর্য,  তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও তার যথাযথ অনুসরণের জন্য কুরবানী করেছেন। অতঃপর তাদের পরের প্রজন্ম এসব ছাত্রদেরকে অপবাদ ও দোষারোপ করল এবং তাদেরকে অজ্ঞ ও ইলম গোপনকারী হিসেবে আখ্যায়িত করল??
আপনি সে আলেমের ব্যাপারে কি বলবেন যার থেকে তারা ইলম গ্রহণ করেছে?
হ্যাঁ, আপনি এ মহান শিক্ষকের ব্যাপারে কি বলবেন, তার ছাত্রদেরকে কি গুণে গুনান্বিত করবেন যারা তার সাথে সব ধরনের কষ্ট ক্লেশ ও প্রচেষ্টা করেছেন? তার মধ্যে কি কোন দোষ ত্রুটি ছিল?
বা  তার সেসব ছাত্রদের মাঝে কি দোষ ত্রুটি ছিল যারা ছেলে সন্তান, ধন সম্পদ, পরিবার পরিজন ও দেশ ত্যাগ করেছেন শুধু মাত্র তাদের এ মহান শিক্ষকের সাহচর্য, তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও তার অনুসরণের জন্য। তার ভালবাসা তাদের ছেলে মেয়ে, পরিবার পরিজন, ধন সম্পদ ও দেশ সব কিছুর উর্ধে ছিল। এ সবের দলিল হলো তার ভালবাসায় তাদের দেশ ছেড়ে হিজরত।
নাকি এটা সমালোচনাকারীদের অপরাধ যারা ঐ সব মহান ছাত্রদের সম্পর্কে সমালোচনা করে অথচ এটা অনুধাবন করতে পারে না যে, তাদের এ সমালোচনা তাদের মহান শিক্ষককেই শামিল করে অথবা সমালোচনা ও দোষারোপকারীর দিকেই ফিরে যায়।
মহান শিক্ষক, তাঁর শিষ্য ও সমালোচনাকারীর দিকে একটু নজর দিন, চিন্তা ভাবনা ও গবেষণা করুন।
সম্মানিত পাঠক ভাই ও বোনেরা:
প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনার মহান নেতার ব্যাপারে একটু চিন্তা গবেষণা করুন। তিনি সৃষ্টিজগতের সবার আদর্শ ও মডেল। তাঁর সাহচর্য লাভ করেছেন অসংখ্য সহচর ও সাহায্যকারী। প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য, যুদ্ধ, শান্তি, অভাব অনটন ও সাচ্ছন্দ্যতা সব অবস্থায় তারা তাঁর সাথে ছিলেন। তাঁর সাথে শত্রুর সব ধরনের কঠিন পরীক্ষার মোকাবেলায় সঙ্গী ছিলেন। বিপদাপদ ও কষ্ট ক্লেশ এতই কঠিন ছিল যে, মনে হতো প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এ সত্ত্বেও তারা তাঁর থেকে পিছপা হননি বা তাঁকে ছেড়ে যাননি, বরং সর্বাবস্থায় তাকেই অনুসরণ করেছেন।
হ্যাঁ, তাঁরা তাঁর পবিত্র জবান থেকে সরাসরি তাঁর বাণী গ্রহণ করেছেন। প্রতিটি মিনিট ও সেকেন্ড তথা সর্বাবস্থায় তাঁর সাথে ছিলেন। কখনও তাঁর মজলিস ছেড়ে যান নি, বরং তারা তাঁর চুল, থুথু মোবারক পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করতেন। তাদের এ মহান মুরব্বী নিজেই তাদের উপদেশ ও শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। কখনও সম্মিলিত ভাষণের মাধ্যমে, আবার কখনও ব্যক্তিগত ভাবে উপদেশ প্রদান করেছেন। ভুল ভ্রান্তিকারীর ভুলের সংশোধন করেছেন, আর সৎকর্মশীলের প্রশংসা করেছেন ও উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি তাঁর সর্বাত্মক শক্তি ব্যয় করেছেন। তাদের সুশিক্ষায় তাঁর সব প্রচেষ্টা ও সময় ব্যয় করেছেন। যেসব জিনিসে তাদের কল্যাণ ও স্বার্থ রয়েছে সেসব জিনিস তিনি নিজে করেছেন ও তাদেরকে করতে উৎসাহিত করেছেন, আর যাতে অকল্যাণ ও ক্ষতি আছে সে সব কিছু সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। কোন কিছুই বর্ণনা করতে বাদ দেন নি।
হ্যাঁ, এ মহান অভিভাবক, তাঁর সঙ্গী-সাথী ও তাদের মহব্বতকারীদের সম্পর্ক এবং তাদের মধ্যকার ভালবাসা সম্পর্কে আলোচনা করতে কলম অক্ষম। তারা তাঁর নির্দেশ পাওয়া মাত্রই পালন করেছেন, তাকে অনুসরণ করেছেন। তাঁর কার্যকলাপ অবলোকন করেছেন, বাণী ও উপদেশ শ্রবণ করেছেন এবং সে অনুযায়ী আমল করেছেন। তারা কোন মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি বিশুদ্ধ উৎস থেকে ইলম গ্রহণ করেছেন। 
    এত গুণাবলির পরেও কেউ কি বলবে যে, অল্প কিছু সংখ্যক ব্যতীত তাদের অনেকেই পশ্চাদপসরণ করেছে। অর্থাৎ তাঁর শিক্ষা ও উপদেশের দ্বারা অধিকাংশই উপকৃত হয় নি!! সেসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, তারা অর্থের বিনিময়ে দ্বীনকে বিক্রয় করেছে!! তাহলে সে অর্থ কে নিয়েছে?? কেই বা প্রদান করেছে??
    আপনি বলবেন, না, এরূপ কখনও হয় নি, বরং তারা সম্মান ও মর্যাদার কারণে কখনও এরূপ করেননি। তাদের মহান ইমামের সাহচর্যের সম্মান ও খিদমত কি কোন কিছুর সমান হতে পারে? তাহলে তারা কেন পশ্চাদপসরণ করেছে? এর উত্তর আমার জানা নাই।
মূলকথা হলো, নিন্দুকেরা তাদের ন্যায়পরায়নতার ব্যাপারে সমালোচনা করে, তারা মনে করেন, তারা মুত্তাকী নয়। সমালোচকদের সবচেয়ে নিকৃষ্ট সমালোচনা হলো, যারা এ মহান নেতার স্বহস্তে শিক্ষালাভ করল তারা নাকি দূর্বল ঈমানের অধিকারী!! হ্যাঁ, এটা সবচেয়ে মারাত্মক নিন্দা। 
আল্লাহর কসম করে আমাকে বলতে পারবে কার মধ্যে দোষ? সে মহান অভিভাবক ও নেতার মধ্যে নাকি যাদের শিক্ষার জন্য তিনি সব কিছু ব্যয় করেছেন, তাদের প্রশংসা করেছেন, তাদেরকে পবিত্র করেছেন ও শিক্ষা দান করেছেন তাদের মধ্যে??
নাকি সে নিন্দুক  সমালোচকের মধ্যে দোষ??
উত্তর দিতে তাড়াহুড়া করবেন না, চিন্তা ভাবনা ও গবেষণা করুন!!
মুজাহিদদের ইমামের সাথে তাদের জিহাদের কথা চিন্তা করুন। তাঁর সাথে তারা কিভাবে ধৈর্যধারণ করেছেন! তারা তাদের ধন সম্পদ সব কিছুই ব্যয় করেছেন। এমনকি আল্লাহর কালিমাকে সুউচ্চ করতে তারা নিজেদের নিকটতম আত্মীয় স্বজনদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেছেন। জিহাদের ময়দান হলো হাতে কলমে শিক্ষার প্রশস্ত ময়দান। তারা তাদের ইমামের সাথে সব ধরনের জিহাদের ময়দানে অংশগ্রহণ করেছেন। নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ, সম্পদের বিরুদ্ধে জিহাদ, দাওয়াতের ক্ষেত্রে জিহাদ ইত্যাদি। সব কল্যাণের কাজে পরস্পর প্রতিযোগিতা করেছেন। পরিশেষে তারা মহান আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন করেছেন। আল্লাহ তাদের সকলের উপর সন্তুষ্ট। এর পরেও কি তারা আবার পিছনে ফিরে গেছে?? সুবহানাল্লাহ!!
প্রিয় ভাইয়েরা!
ব্যতিব্যস্ত হবেন না, আমার সাথে একটু ধৈর্য ধরে থাকুন। চিন্তা ভাবনার পরে আপনিই ফয়সালা দিন। আপনার জানা শুনার পরে আপনার মতামত সম্পর্কে আমাকে অবহিত করুন। আমরা ইনশাআল্লাহ পরবর্তী সংস্করণে আপনার মতামতের ভিত্তিতে আমাদের ভুল হলে ফিরে আসব, কম হলে বাড়াবো আর বেশি হলে মুছে দিব। আমার সাথে আপনার পড়া চালিয়ে যান। চিন্তা ভাবনার পরে ফয়সালা দিন।
আপনি আমার সাথে এ ব্যাপারে একমত যে, এ মহান ইমাম, নেতা, নমুনা, শিক্ষক ও অভিভাবকের ব্যাপারে কোন রূপ অপবাদ বা ত্রুটি দেয়া যায় না, বা তিনি এ সবের ঊর্ধ্বে। এখন যদি ভুল ত্রুটি, গরমিল ও দুর্বলতা তার অনুসারীদের ব্যাপারে বলি, আর যদি বলি যে, তাদের অধিকাংশই খিয়ানতকারী ছিলেন এবং নেতার দ্বারা কোন উপকৃত হয় নি ইত্যাদি অপবাদ যা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি, তাহলে নিঃসন্দেহে তাদের এসব অপবাদ পক্ষান্তরে তাদের মহান নেতার উপরই বর্তাবে। বিশেষ করে যখন তারা বলে যে, নেতার বিশেষ সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ও যারা তাঁর মজলিসে বসত তাদের মাঝে অজ্ঞতা ও খিয়ানত ছিল। তারা তাকে দেয়ালের মতো চারিদিকে ঘিরে রাখত, তারাই ছিল তাঁর পরিবার পরিজন ও উপদেষ্টামন্ডলী। 
আর যখন আমরা সমালোচনা বর্ণনাকারীর সনদ বা সরাসরি সমালোচকদের প্রতি দোষ ত্রুটি নিক্ষেপ করব তখন দেখব এটাই সঠিক। তারাই প্রকৃত দোষী ও অপরাধী। বিষয়টি স্পষ্ট করতে নিন্মে এ ব্যাপারে কিছু উদাহরণ পেশ করলাম।
ঐতিহাসিকদের সর্বসম্মত মতানুসারে, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে তাঁর দলের মধ্য থেকে একদল লোক বের হয়েছিল, যাদেরকে “আল-খাওয়ারিজ” নামে অভিহিত করা হয়। তাদের সাথে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর দীর্ঘ আলোচনা ও পর্যালোচনার পরেও তারা যখন নিরপরাধ মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালো এবং আব্দুল্লাহ ইবন খাব্বাবকে হত্যা করল তখন তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন।
সুতরাং এ দলটির কারণে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে কি দোষারোপ করা যাবে? যারা তার কাছে বাই‘য়াত গ্রহণ করেছেন এবং তাকে মুসলমানদের খলিফা হিসেবে মেনে নিয়েছেন, অতঃপর তার সাথে যুদ্ধে শরিক হয়েছেন তাদেরকে কি ঐ সীমালঙ্ঘনকারী দলের কারণে দোষারোপ করা যাবে?
একথা কি বলা যাবে যে, আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে যারা বাই‘য়াত গ্রহণ করেছে তারা সকলেই কাফির বা ফাসিক বা অজ্ঞ বা আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর মৃত্যুর পরে তার সাথে খিয়ানত করেছেন ইত্যাদি দোষে দোষী তো শুধু এমন একটি দলের জন্য, যাদের বের হওয়া সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগেই সতর্ক করেছেন, তাদের মধ্যে সুস্পষ্ট আলামত ছিল এবং তারা ইসলাম থেকে এমনভাবে বেরিয়ে গেছে যেমনভাবে ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে যায়।  
প্রিয় পাঠক ভাই ও বোনেরা:
আপনি আমার সাথে একমত হবেন যে, আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে সমালোচনার মাধ্যমে উপদেশ দেয়া এখানে সম্ভব নয়, এমনিভাবে যারা তার কাছে বাই‘য়াত গ্রহণ করেছেন তাদেরকে সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে দূরে সরে যাওয়ার অপবাদ দেয়া ও তারা মারাত্মক বিদ‘আতে লিপ্ত হয়েছেন একথা বলাও সম্ভব নয়। বরং আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাতে বাই‘য়াত নেয়া ছিল সর্বসম্মত বিষয়, এ ব্যাপারে কোন বিতর্ক নেই। সুতরাং যারা ইমাম আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বা তার হাতে বাই‘য়াত গ্রহণকারীদের ব্যাপারে সমালোচনা করবে পক্ষান্তরে তাদের সমালোচনা তাদের দিকেই ফিরবে এবং তারাই সঠিক পথ থেকে সরে যাবে। এরপরেও যারা লৌককতা ও নিজেকে বিখ্যাত করার মানসে সমালোচনা করতে চান তাদের উচিত আগে ঘটনার সনদের দিকে খেয়াল করা। কেননা ইসলামের এ মহান ইমাম আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর বিরুদ্ধে যে সব সমালোচনা করা হয় তা সবার মতে মিথ্যা অপবাদ ও কুৎসা রটনা। এটা সকলের কাছেই একেবারেই স্পষ্ট।
আমার সাথে চিন্তা ও গবেষণা করুন:
আমার বিশ্বাস আপনি আমার সাথে পূর্বের আলোচনার সাথে একমত হবেন যে, ইমাম আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, তার  কাছে বাই‘য়াত গ্রহণকারী ও তাকে সাহায্যকারী কারো বিরুদ্ধেই সমালোচনা করা সম্ভব নয়, বরং সমালোচনাকারী বা সমালোচনা বর্ণনাকারীর দিকেই সে অপবাদ প্রত্যাবর্তন করে।
এ ব্যাপারে কি আপনার দ্বিমত আছে? দ্বিমত থাকলে সেটা কি?
হ্যাঁ, অবশ্যই আপনি আমার সাথে এ সঠিক ফলাফলে উপনীত হবেন। তাইনা?
এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমাম আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর  চেয়ে উত্তম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীরা হলেন উত্তম সহচর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবার পরিজন ছিলেন সর্বোত্তম পরিবার। এর বাহিরে যে বা যারাই যা কিছু উত্তম বলবে তা গ্রহণ করা হবে না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন শিক্ষক, সাহাবীরা হলেন তাঁর ছাত্র, যারা তাঁর হাতে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারের লোকজন ছিলেন সর্বাগ্রে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সেনাপতি। তাঁর সম্মানীত সাহাবীগণ ছিলেন তাঁর সৈন্যবাহিনী, যারা নিজেদের জীবন তাঁর সামনে কুরবানী করেছেন। এদের সর্বাগ্রে ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারবর্গ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মুরব্বী বা অভিভাবক ছিলেন। তাঁর সম্মানীত সাহাবীগণ ছিলেন সে প্রজন্মের লোক, যাদের শিক্ষা দেয়ার কাজ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই গ্রহণ করেছেন। এদের সর্বাগ্রে ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারবর্গের লোকজন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন বিচারক ও রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর বিশেষ সহযোগী সাহাবীগণ ছিলেন উপদেষ্টা ও মন্ত্রীবর্গ। বিশেষ করে তাঁর শশুরকুল ও পিতৃকুলের লোকজন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবের পক্ষ থেকে তাঁর রিসালাহ তথা বাণী পৌঁছিয়েছেন। তাঁর সম্মানীত সাহাবীগণ সেসব বাণী গ্রহণ করেছেন এবং প্রচার করেছেন। তাদের সর্বাগ্রে ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারের লোকজন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সম্মানীত সাহাবীগণের মাঝে এটা ছিল এক গভীর ও সুদৃঢ় সম্পর্ক যা একে অন্যের থেকে আলাদা হওয়ার নয়। এদের সর্বাগ্রে রয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারবর্গের সম্পর্ক।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দোষারোপ করা এবং তাকে খাটো করা ও অপবাদ দেয়া উম্মতের ঐক্যমতে কুফুরী।
 

বাস্তবতা
    ফয়সালা দেয়ার আগে চিন্তা-গবেষণা করুন!
আহলে সুন্নত ওয়াল জামা‘আত সাহাবীদের ন্যায়পরায়ণতা ও সততার বিষয়টি কেন এত গুরুত্বের সাথে দেখে?
    এব্যাপারে নিজেকে প্রশ্ন করুন এবং উত্তর তালাশ করুন। এ প্রশ্নের জবাব পেতে আপনার সামনে কতিপয় ধাপ রয়েছে। সেগুলো হলো:
    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের ব্যাপারে অপবাদ দেয়া মানে ইসলামের শত্রুদের ইসলামের বিরুদ্ধে আক্রমনের পথ খুলে দেয়া। সেটা কিভাবে? আমি বলছি:
     প্রথমত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের ব্যাপারে যখন অপবাদ দেয়া হবে তখন সাহাবী ছাড়া অন্যানদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া আরো  অধিক সহজ ও উপযোগী হবে। হ্যাঁ, নিম্নের কারণে অন্যান্যদের ব্যাপারে সমালোচনা অধিক উপযোগী:
ক- সাহাবীগণের সম্মানে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে আয়াত নাযিল করেছেন যা কিয়ামত পর্যন্ত তিলাওয়াত করা হয়।
খ- মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অসংখ্য হাদীসে প্রশংসা করেছেন।
গ- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য ও ভালবাসার সম্পর্ক বিদ্যমান যা কখনও বিচ্ছিন্ন হওয়ার নয়। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের অভিভাবক, শিক্ষক, সেনাপতি......... ইত্যাদি ছিলেন, যা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি।
ঘ- ইসলামী সব দলের ঐক্যমতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদম আলাইহিস সালামের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তিনি নবীদের সর্দার ও মুসলিহীনদের ইমাম। অতঃএব, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার দ্বারা যদি চারিত্রিক, ব্যক্তিগত কর্মকান্ড ও আকাঈদ ইত্যাদি ইসলাহ না হয় তবে যারা তাঁর চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম মর্যাদার তাদের দ্বারা এসব কাজ না হওয়াই অধিক যুক্তিসঙ্গত।
ঙ- ইতিহাস নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের মর্যাদার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়। কেননা তারা অধিকাংশ ইসলামী বিজয়ের সেনাপতি ছিলেন। তারাই ইসলামের পতাকা বহন ও প্রচার প্রসার করেছেন। উত্তম চরিত্র ও ঈমানী শক্তি ইত্যাদি কারণে নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের মর্যাদা অন্যান্য নবীদের সাহাবীদের মর্যাদার উর্ধ্বে ছিল।
দ্বিতীয়ত: সাহাবীদের ব্যাপারে অপবাদ ইসলামের শত্রুদেরকে কুরআনের বিরুদ্ধে অপবাদ দিতে সাহায্য করে। যেমন তারা অপবাদ দেয়: কুরআনের প্রচার কাজে তাওয়াতুর তথা অসংখ্য মানুষের বর্ণনা কোথায়? কুরআন বহনকারীর মাঝে আমানত ও ন্যায়পরায়নতা কোথায়?
তৃতীয়ত: সাহাবীদেরকে অপবাদ দেয়া মানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাদীস ও সিরাতের ব্যাপারে অপবাদ দেয়া। কেননা সাহাবীগণই হাদীস ও সিরাত বর্ণনা করেছেন।
চতুর্থত: এতে ইসলামের শত্রুরা সমালোচনার উর্বর ভূমি পাবে। তারা বলবে যে, ‘‘ইসলামের মৌলিক বিষয় ও উত্তম আখলাকের শিক্ষা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কেননা যারা কুরআন নাযিলের সময় উপস্থিত ছিলেন এবং তাদেরকে সৃষ্টিকুলের সর্দার নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে শিক্ষা দিয়েছেন অথচ তারা অধিকাংশই এর বিপরীত ছিলেন’’।
পঞ্চমত: ইসলামের মর্যাদা ও এর সভ্যতা বিঘ্নিত হবে। এ ছাড়াও অনেক কারণ রয়েছে যা এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। এগুলো আপনাকে জবাব পেতে সাহায্য করবে।
رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ ١٠ ﴾ [الحشر: ١٠] 
হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না।
    হে আল্লাহ, আমাদেরকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন অন্তর ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ ও সকল সাহাবীদের ভালবাসা দান করুন। ইয়া আরহামার রাহিমীন।
 

প্রথম অধ্যয়ের উপসংহার
প্রিয় ভাই ও বোনেরা:
এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মাস’য়ালা। এ মাস’য়ালার ব্যাপারে মতানৈক্য উম্মতের মাঝে দলাদলি ও বিচ্ছিন্নতার অন্যতম কারণ। এটি যদিও একটি সাধারণ ও আক্বলি ও নকলি দলিলের ভিত্তিতে স্পষ্ট বিষয়, তথাপি কতিপয় লোক এ ব্যাপারে মতানৈক্য করে থাকে। একদল ইমাম আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও তার সহযোগীদেরকে কাফির বলে থাকে। আমরা আল্লাহর কাছে এ সব কাজ থেকে পানাহ চাই।
আরেক দল নির্বিচারে সব সাহাবীদেরকে কাফির বলে থাকে। ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। আবার কেউ কেউ এ মাস’য়ালার ব্যাপারে দিশেহারা হয়ে যায়, অথচ মাস’য়ালাটি সকলের কাছে একেবারেই স্পষ্ট। কেননা সাহাবীদেরকে অপবাদ দেয়া মানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অপবাদ দেয়া, যেহেতু তিনি হলেন তাদের অভিভাবক, শিক্ষক, সেনাপতি ইত্যাদি যা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। এজন্যই তাদেরকে ভালবাসা ও তাদের ন্যায়পরায়ণতার সাক্ষ্য দেয়া আমাদের উপর কর্তব্য। কেননা তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী, আর এটাই তাদের সম্মান ও গর্বের জন্য যথেষ্ট।
হে আল্লাহ আপনি আমাদেরকে তাদের (সাহাবীদের) ভালবাসা দান করুন, এবং তাদের গুণকীর্তনের তাওফিক দিন। ইয়া আরহামার রাহিমীন।
সম্মানিত ভাই ও বোনেরা:
মানুষ যে সত্যের দাবী করে সে সত্য থেকে আপনি সাবধান থাকবেন। আপনার আক্বল, ব্যক্তিত্ব ও চিন্তা ভাবনা কোথায়?
আপনি এ কথা কখনও বলবেন না  যে, অমুক একদল, বা অমুক লোক বা আলিম এ কথা বলেছেন আর আমি তাদের মতের অনুসরণ করছি??
কিয়ামতের দিন আপনি আপনার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। অচিরেই কবরে আপনি একাই যাবেন।
চিন্তা ভাবনা করুন আর আপনার রবের কাছে কায়মনোবাক্যে হিদায়েত কামনা করুন। আল্লাহ সরল সঠিক পথের হিদায়াত দানকারী। আল্লাহর নিকট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মান ও মর্যাদার কথা স্মরণ করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সাহাবীদের মর্যাদার কথা ভাবুন। এতেও যদি আপনি সন্তুষ্ট হতে না পারেন তবে আপনি নিন্মোক্ত দলিলসমূহ নিয়ে চিন্তা গবেষণা করুন।
 

দ্বিতীয় অধ্যয়
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের মধ্যকার কতিপয় ঘটনাবলী

দলিল প্রমাণের পরিচ্ছেদ
প্রিয় ভাই ও বোনেরা:
    কুরআনুল কারীম পাঠকারী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন চরিত সম্পর্কে অনেক আয়াত পাবেন। এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের বিভিন্ন অবস্থা, বিধিবিধান ও এ সম্পর্কিত অনেক ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ পাবেন। তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি একাকী জীবন যাপন করেছেন? নিঃসন্দেহে তিনি তাঁর সাহাবী ও পরিবার পরিজন সকলের মাঝেই জীবন যাপন করেছেন।
    এজন্যই তাদের সম্পর্কে অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে। এখানে সংক্ষেপে কিছু ঘটনা তুলে ধরছি, যেন আপনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সম্মানিত সাহাবীদের মধ্যকার গভীর সম্পর্ক, সে সহচর্যের মর্যাদা ও সে সব ঘটনাবলীতে যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বসবাস করেছেন তাদের অপরিসীম মর্যাদা সম্পর্কে বুঝতে পারেন।
বদরের যুদ্ধ
এ যুদ্ধের ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা সূরা আল-আনফাল নাযিল করেছন। আমরা ইতিপূর্বে যেসব সূক্ষ্ম বিষয় আলোচনা করেছি তা এ সূরার তিনটি আয়াতে শামিল করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ إِذۡ يُغَشِّيكُمُ ٱلنُّعَاسَ أَمَنَةٗ مِّنۡهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيۡكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ لِّيُطَهِّرَكُم بِهِۦ وَيُذۡهِبَ عَنكُمۡ رِجۡزَ ٱلشَّيۡطَٰنِ وَلِيَرۡبِطَ عَلَىٰ قُلُوبِكُمۡ وَيُثَبِّتَ بِهِ ٱلۡأَقۡدَامَ ١١ ﴾ [الانفال: ١١] 
“স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন তাঁর পক্ষ থেকে নিরাপত্তাস্বরূপ এবং আকাশ থেকে তোমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন, আর যাতে এর মাধ্যমে তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করেন, আর তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা দূর করেন, তোমাদের অন্তরসমূহ দৃঢ় রাখেন এবং এর মাধ্যমে তোমাদের পা-সমূহ স্থির রাখেন”। [সূরা : আল-আনফাল: ১১]
এ আয়াত সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করুন, এর অর্থ অনুধাবন করুন। আয়াতে পবিত্রকরণ ও শয়তানের কুমন্ত্রণা দূর হওয়া সম্পর্কে ভাবুন। এর পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তাদের ঈমান সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
﴿ فَثَبِّتُواْ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْۚ ١٢ ﴾ [الانفال: ١٢] 
“সুতরাং যারা ঈমান এনেছে তোমরা তাদেরকে অনড় রাখ”।
এজন্যই রাসূল  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لَعَلَّ اللهَ اطَّلَعَ عَلَى أَهْلِ بَدْرٍ فَقَالَ: اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ، فَقَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ "
“সম্ভবত আল্লাহ তা’আলা বদরী সাহাবাদের প্রতি নজর দিবেন এবং বলে দিবেন তোমরা যা ইচ্ছা করতে পার; তোমাদের আমি মাফ করে দিলাম”।  
গুরুত্বপূর্ণ ফায়েদা: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ঈমান আনায়নকারী সব সিরাতসংকলক ও অন্যান্যদের মতে, মানুষের মাঝে বদরের যুদ্ধের পরে নিফাক অনুপ্রবেশ করেছে, এর আগে কোন নিফাক বিদ্যমান ছিল না। এ সম্পর্কে সতর্ক থাকো।
সম্মানিত পাঠক ভাই ও বোনেরা:
এ সূরার শেষ আয়াতের দিকে লক্ষ্য করুন, একটু চিন্তা ভাবনা করুন। আল্লাহ তা‘আলা মুহাজির ও আনসারদেরকে পরস্পর পরস্পরের সহযোগী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আল্লাহর এ আয়াতের নির্দেশনা সম্পর্কে ভাবুন:
﴿ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَهَاجَرُواْ وَجَٰهَدُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱلَّذِينَ ءَاوَواْ وَّنَصَرُوٓاْ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ حَقّٗاۚ لَّهُم مَّغۡفِرَةٞ وَرِزۡقٞ كَرِيمٞ ٧٤ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنۢ بَعۡدُ وَهَاجَرُواْ وَجَٰهَدُواْ مَعَكُمۡ فَأُوْلَٰٓئِكَ مِنكُمۡۚ وَأُوْلُواْ ٱلۡأَرۡحَامِ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلَىٰ بِبَعۡضٖ فِي كِتَٰبِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمُۢ ٧٥ ﴾ [الانفال: ٧٤،  ٧٥] 
“আর যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে এবং যারা আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, তারাই প্রকৃত মুমিন, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক। আর যারা পরে ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং তোমাদের সাথে জিহাদ করেছে, তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত, আর আত্মীয়-স্বজনরা একে অপরের তুলনায় অগ্রগণ্য, আল্লাহর কিতাবে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে মহাজ্ঞানী”। [সূরা : আল-আনফাল: ৭৪-৭৫]
    আল্লাহু আকবর। তাদের জন্য সুখবর। এটা আগে ঈমান আনায়নকারী মুহাজির ও আনসারদের ঈমান সম্পর্কে স্বয়ং মহান আল্লাহ তা‘আলার সাক্ষ্য। আল্লাহর বাণী حَقّٗاۚ “প্রকৃত মুমিন” এ সম্পর্কে একটু ভাবুন। এটা দ্বারা তাগিদ দেয়া হয়েছে। এর পরে আল্লাহ বলেছেন, لَّهُم مَّغۡفِرَةٞ وَرِزۡقٞ كَرِيمٞ তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক। এ সব সাক্ষ্য ও তাগিদের পরেও কোন মু’মিনের পক্ষ্যে তাদেরকে অপবাদ দেয়া সম্ভব?
 

অহুদের যুদ্ধ
এ যুদ্ধের ঘটনাবলী সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা সূরা আলে-ইমরানের ষাটটি আয়াত নাযিল করেছেন। এ সূরাতে সাহাবীদের প্রশংসা ও মর্যাদা সম্পর্কে যা এসেছে তা নিয়ে আলাদাভাবে গবেষণা করা যায়।
    আয়াতের শুরুতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সৈন্যবাহিনী সাহাবীদের মধ্যকার সম্পর্ক ও আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমানের কথা আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ وَإِذۡ غَدَوۡتَ مِنۡ أَهۡلِكَ تُبَوِّئُ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ مَقَٰعِدَ لِلۡقِتَالِۗ ١٢١ ﴾ [ال عمران: ١٢١] 
“আর স্মরণ কর, যখন তুমি তোমার পরিবার পরিজন থেকে সকাল বেলায় বের হয়ে মুমিনদেরকে লড়াইয়ের স্থানসমূহে বিন্যস্ত করেছিলে”। [আলে ইমরান: ১২১]
    এর পরের আয়াতে এ যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, এমনকি যে আয়াতে পরাজয়ের গ্লানির কথা বলা হয়েছে সেখানে আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন”। এখানে তাদের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমার ঘোষণা করা হয়েছে। এ যুদ্ধের পরের ঘটনা নিয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করুন। বরং এ যুদ্ধে স্পষ্ট বিজয় ছিল মুসলমানদের এবং তাদের ভয়ে কুরাইশগণ পালায়ন করেছিল। মু’মিনগণ আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে ফিরে এসেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ ٱلَّذِينَ قَالَ لَهُمُ ٱلنَّاسُ إِنَّ ٱلنَّاسَ قَدۡ جَمَعُواْ لَكُمۡ فَٱخۡشَوۡهُمۡ فَزَادَهُمۡ إِيمَٰنٗا وَقَالُواْ حَسۡبُنَا ٱللَّهُ وَنِعۡمَ ٱلۡوَكِيلُ ١٧٣ فَٱنقَلَبُواْ بِنِعۡمَةٖ مِّنَ ٱللَّهِ وَفَضۡلٖ لَّمۡ يَمۡسَسۡهُمۡ سُوٓءٞ وَٱتَّبَعُواْ رِضۡوَٰنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ ذُو فَضۡلٍ عَظِيمٍ ١٧٤ ﴾ [ال عمران: ١٧٣،  ١٧٤] 
“যাদেরকে মানুষেরা বলেছিল যে, ‘নিশ্চয় লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছে। সুতরাং তাদেরকে ভয় কর’। কিন্তু তা তাদের ঈমান বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা বলেছিল, ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক’! অতঃপর তারা ফিরে এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিআমত ও অনুগ্রহসহ। কোন মন্দ তাদেরকে স্পর্শ করেনি এবং তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করেছিল। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল”। [আলে ইমরান: ১৭৩-১৭৪]
    তাদের ঈমান বৃদ্ধির ব্যাপারে মহান আল্লাহর সাক্ষ্য এবং তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করেছিল। এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, যারা অহুদের যুদ্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অংশগ্রহণ করেছেন তারা সবাই “হামরা আল-আসাদ”  এ রাসূলের সাথে গমন করেছিলেন। তাদের সম্পর্কে অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে।
    আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ তাদের সম্পর্কে যা বলেছেন তা নিয়ে চিন্তা গবেষণা করুন। ইহা তাদের উপর আল্লাহর অপরিসীম রহমতের প্রমাণ করে।
 

খন্দকের যুদ্ধ
সূরা আল-আহযাবে এ যুদ্ধ সম্পর্কে আয়াত নাযিল হয়। সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা হলেও এতে সাহাবীদের মাঝে গভীর সম্পর্কের কথা, তাদের মানসিক অবস্থা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সর্বাবস্থায় থাকার কারণে যে কষ্ট ক্লেশ, ক্ষুধা যন্ত্রনা ও ভয়ভীতির সম্মুখীন হয়েছেন তা আলোকপাত করা হয়েছে। 
সূরা আহযাবের ৯ নং আয়াত সম্পর্কে ভাবুন, এতে আল্লাহ মু’মিনদেরকে সম্বোধন করেছেন এবং সে ঘটনার সময় আল্লাহর নি‘আমতের কথা উল্লেখ করেছেন।
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱذۡكُرُواْ نِعۡمَةَ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡ إِذۡ جَآءَتۡكُمۡ جُنُودٞ فَأَرۡسَلۡنَا عَلَيۡهِمۡ رِيحٗا وَجُنُودٗا لَّمۡ تَرَوۡهَاۚ وَكَانَ ٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرًا ٩ ﴾ [الاحزاب: ٩] 
হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিআমতকে স্মরণ কর, যখন সেনাবাহিনী তোমাদের কাছে এসে গিয়েছিল, তখন আমি তাদের উপর প্রবল বায়ু ও সেনাদল প্রেরণ করলাম যা তোমরা দেখনি। আর তোমরা যা কর আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। [সূরা : আল্-আহযাব: ৯]
এর পর আল্লাহ শত্রুদের আক্রমণ থেকে তাদেরকে রক্ষা করে তাঁর নিয়ামতের কথা স্মরণ করে দেন এবং তাদের ঈমানের সাক্ষ্য দিয়ে বলেন,
﴿ وَكَفَى ٱللَّهُ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٱلۡقِتَالَۚ ٢٥ ﴾ [الاحزاب: ٢٥] 
যুদ্ধে মুমিনদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। [সূরা : আল্-আহযাব: ২৫]
এর পরের দু’আয়াতে প্রসিদ্ধ ইয়াহুদী সম্প্রদায় বনী কুরাইযার ঘটনা উল্লেখ করেন।
পরবর্তী আয়াতগুলো খুব মনোযোগ সহকারে চিন্তা করুন। আল্লাহ বলেছেন,
﴿ وَلَمَّا رَءَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلۡأَحۡزَابَ قَالُواْ هَٰذَا مَا وَعَدَنَا ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَصَدَقَ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥۚ وَمَا زَادَهُمۡ إِلَّآ إِيمَٰنٗا وَتَسۡلِيمٗا ٢٢ ﴾ [الاحزاب: ٢٢] 
আর মুমিনগণ যখন সম্মিলিত বাহিনীকে দেখল তখন তারা বলল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের যে ওয়াদা দিয়েছেন এটি তো তাই। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্যই বলেছেন’। এতে তাদের ঈমান ও আত্মসমর্পণই বৃদ্ধি পেল। [সূরা : আল্-আহযাব: ২২]
    আল্লাহর রহমত তাদের উপর ব্যপ্ত ছিল। তাঁর রহমত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে থাকা কারো জন্য খাস ছিল না, বরং সকলের জন্যই প্রশস্ত ছিল।
কারা বলেছিলেন, ‘‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের যে ওয়াদা দিয়েছেন এটি তো তাই?”
কারা রাসূল  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে খন্দক খনন করেছিলেন?
তাদের ঈমান ও ঈমানের বৃদ্ধি সম্পর্কে আল্লাহর সাক্ষ্য সম্পর্কে চিন্তা করুন। এমনিভাবে দুনিয়াতে তাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহের কথা ভাবুন।
কারা বনী কুরাইযার উত্তরাধিকারী হলেন? কারা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন?
আল্লাহ বলেছেন,
﴿ وَأَوۡرَثَكُمۡ أَرۡضَهُمۡ وَدِيَٰرَهُمۡ وَأَمۡوَٰلَهُمۡ وَأَرۡضٗا لَّمۡ تَطَ‍ُٔوهَاۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٗا ٢٧ ﴾ [الاحزاب: ٢٧] 
“আর তিনি তোমাদেরকে উত্তরাধিকারী করলেন তাদের ভূমি, তাদের ঘর-বাড়ী ও তাদের ধন-সম্পদের এবং এমন ভূমির যাতে তোমরা পদার্পণও করনি। আল্লাহ সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান”। [সূরা : আল্-আহযাব: ২৭]
ইয়াহুদীদের দূর্গ বিজয়ের মাধ্যমে সাহাবীদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ, ইয়াহুদীদের অন্তরে ভয় ভীতির সঞ্চয়, তাদেরকে হত্যা ও বন্দী করা ইত্যাদি নিয়ামতের কথা এ সূরাতে উল্লেখ করা হয়েছ। আপনি কি এ ঘটনার শুরুর আয়াতগুলো মনোযোগ দিয়ে তিলাওয়াত করেছেন?

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱذۡكُرُواْ نِعۡمَةَ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡ إِذۡ جَآءَتۡكُمۡ جُنُودٞ فَأَرۡسَلۡنَا عَلَيۡهِمۡ رِيحٗا وَجُنُودٗا لَّمۡ تَرَوۡهَاۚ وَكَانَ ٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرًا ٩ ﴾ [الاحزاب: ٩] 
“হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিআমতকে স্মরণ কর, যখন সেনাবাহিনী তোমাদের কাছে এসে গিয়েছিল, তখন আমি তাদের উপর প্রবল বায়ু ও সেনাদল প্রেরণ করলাম যা তোমরা দেখনি। আর তোমরা যা কর আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা”। [সূরা : আল্-আহযাব: ৯]
উপরিউক্ত আয়াত থেকে এ পর্যন্ত তিলাওয়াত করুন:
﴿ وَأَوۡرَثَكُمۡ أَرۡضَهُمۡ وَدِيَٰرَهُمۡ وَأَمۡوَٰلَهُمۡ وَأَرۡضٗا لَّمۡ تَطَ‍ُٔوهَاۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٗا ٢٧ ﴾ [الاحزاب: ٢٧] 
“আর তিনি তোমাদেরকে উত্তরাধিকারী করলেন তাদের ভূমি, তাদের ঘর-বাড়ী ও তাদের ধন-সম্পদের এবং এমন ভূমির যাতে তোমরা পদার্পণও করনি। আল্লাহ সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান”। [সূরা : আল্-আহযাব: ২৭]
    সূরা আহযাবের আয়াতগুলো খুব মনোযোগ সহকারে পড়ুন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাহাবীদের সম্পর্ক, ভালবাসা ও তাদের সম্পর্কে আল্লাহর সম্বোধন সম্পর্কে লক্ষ্য করুন।
হুদাইবিয়ার সন্ধি
সম্মানিত পাঠক:
আপনি জানেন যে, রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা আল্লাহ তা‘আলা সূরা আল-ফাতহ এ উল্লেখ করেছেন।
﴿ لَّقَدۡ صَدَقَ ٱللَّهُ رَسُولَهُ ٱلرُّءۡيَا بِٱلۡحَقِّۖ لَتَدۡخُلُنَّ ٱلۡمَسۡجِدَ ٱلۡحَرَامَ ٢٧ ﴾ [الفتح: ٢٧] 
“অবশ্যই আল্লাহ তাঁর রাসূলকে স্বপ্নটি যথাযথভাবে সত্যে পরিণত করে দিয়েছেন। তোমরা আল-মাসজিদুল হারামে অবশ্যই প্রবেশ করবে”। [সূরা : আল-ফাতহ: ২৭] ......আয়াতের শেষ পর্যন্ত।
    আপনি অবগত আছেন যে, নবীদের স্বপ্ন সত্য। খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানগণ কঠিন মুসিবাতের সম্মুখীন হওয়ার পরে এটা ছিল তাদের জন্য সুসংবাদ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে এ সংবাদ দেন এবং উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে রওয়ানার আহ্বান করেন। হ্যাঁ, তিনি উমরাহ পালনকারী হিসেবে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানার ইচ্ছা করলেন এবং রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন ঘোষণাকারী এ ঘোষণা দেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবেকীন মুহাজির ও আনসারদেরকে সাথে নিয়ে রওয়ানা করলেন। তাদের সংখ্যা ছিল চৌদ্দশত।
    বেদুইনরা অংশগ্রহণ করলেন না। আর মুনাফিকদের থেকে একজন ব্যতীত কেউ অংশগ্রহণ করে নি।
এ ঘটনার হিকমত সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করুন।
    সত্যনিষ্ঠ কাফেলা মক্কার পানে চলল। ‘আল-বাইদা’ নামক স্থান তাদের তাকবীর ও তাহলীলে প্রকম্পিত হচ্ছিল। সেখানে তারা কুরাইশ কর্তৃক মক্কায় প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হন। হুদাইবিয়ায় সাহাবীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে বাই‘আত গ্রহণ করেন।  সত্যনিষ্ঠ কাফেলা মুহাজির ও আনসারগণ রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ধৈর্যধারণ ও উমরা না করে মদীনায় ফিরে না যাওয়ার বাই‘আত গ্রহণ করেন। এটাকে ‘বাই‘আতে রিদওয়ান’ বলা হয়।
মক্কার প্রতি তাদের ভালবাসা ও টান বর্ণনাতীত, সেখানে প্রবেশের ব্যাপারে তাদের সুসংবাদ ছিল কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসা, তাঁর অনুসরণ, অনুকরণ, দুনিয়াবিমূখ ও আল্লাহর কাছে প্রতিদান তালাশ ছিল তাদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাদের সম্পর্কে আয়াত নাযিল করে সম্মানিত করেছেন।
সম্মানিত পাঠক:
আপনি সূরা আল-ফাতহ অর্থসহকারে চিন্তা গবেষণার সাথে তিলাওয়াত করুন। আল্লাহ বলেছেন,
﴿ إِنَّا فَتَحۡنَا لَكَ فَتۡحٗا مُّبِينٗا ١ لِّيَغۡفِرَ لَكَ ٱللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِن ذَنۢبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ وَيُتِمَّ نِعۡمَتَهُۥ عَلَيۡكَ وَيَهۡدِيَكَ صِرَٰطٗا مُّسۡتَقِيمٗا ٢ وَيَنصُرَكَ ٱللَّهُ نَصۡرًا عَزِيزًا ٣ ﴾ [الفتح: ١،  ٣] 
“নিশ্চয় আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দিয়েছি; যেন আল্লাহ তোমার পূর্বের ও পরের পাপ ক্ষমা করেন, তোমার উপর তাঁর নিআমত পূর্ণ করেন আর তোমাকে সরল পথের হিদায়াত দেন। এবং তোমাকে প্রবল সাহায্য দান করেন”। [সূরা : আল-ফাতহ: ১-৩]
    এখানে মহান আল্লাহ তাঁর হাবীব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অনুগ্রহ, অতঃপর সাহাবীদের উপর আল্লাহর দয়া ও তাদের উপর আল্লাহর যে প্রশান্তি নাযিল হয়েছে এবং যা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে সেসব কথা উল্লেখ করেছেন।
অতঃপর আল্লাহ বাই‘আতে রিদওয়ানের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেছেন,
﴿ ۞لَّقَدۡ رَضِيَ ٱللَّهُ عَنِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ يُبَايِعُونَكَ تَحۡتَ ٱلشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمۡ فَأَنزَلَ ٱلسَّكِينَةَ عَلَيۡهِمۡ وَأَثَٰبَهُمۡ فَتۡحٗا قَرِيبٗا ١٨ ﴾ [الفتح: ١٨] 
“অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নিচে আপনার হাতে বাই‘আত গ্রহণ করেছিল; অতঃপর তিনি তাদের অন্তরে কি ছিল তা জেনে নিয়েছেন, ফলে তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে পুরস্কৃত করলেন নিকটবর্তী বিজয় দিয়ে”। [সূরা : আল-ফাতহ: ১৮]
মানুষকে যতই বালাগাত ও ফাসাহাত (বাগ্মিতা ও বিশুদ্ধতা) দান করা হোক তারা আল্লাহর বর্ণিত এ রকম প্রশংসা করতে পারবে না।
হ্যাঁ, রাব্বুল আলামীন সে সব মু’মিনদের উপর রহমত করেছেন, মানবজাতির সর্দার মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তাদের মধ্যে যা ঘটেছে সে ব্যাপারে অহী নাযিল করেছেন। তিনি খুবই সূক্ষ্মভাবে তাদের গুণকীর্তন করেছেন এবং রহস্য গোপন  রেখেছেন। তিনি বলেছেন,  مَا فِي قُلُوبِهِمۡ অর্থাৎ তাদের অন্তরে কি ছিল তা জেনে নিয়েছেন।
সাহাবীগণ সততা ও একনিষ্ঠতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে খুবই তৎপর ছিলেন। ফলে তারা বিশাল সাফল্য লাভ করেছেন। প্রত্যেকেই গাছের নিচে বাই‘আত গ্রহণ করেছিলেন। প্রত্যেকেই জানত তারা আল্লাহর এ সম্বোধনের অন্তর্ভুক্ত এবং সবাই আল্লাহ প্রদত্ত সম্মান, সৌভাগ্য, আখেরাতে মহাসফলতা ও দুনিয়াতে গনীমত লাভ করেছেন।
    এ আয়াত নিয়ে চিন্তা করুন। আমাকে এবার বলুন একজন বিবেকবান লোক কিভাবে তাদের (সাহাবীদের) সম্পর্কে সমালোচনা করে? বা তারা কিভাবে বলে যে, আল্লাহ তা ‘আলা তাদের উপর সন্তুষ্টির পর অসন্তুষ্ট হয়েছেন! হায়! সুবহানআল্লাহ!
আমি আলোচনা দীর্ঘ করব না। এ সব অপব্যাখ্যার জবাবে আমি কুরআনের শুধু একটি আয়াত উল্লেখ করব। আপনি এ আয়াতের অর্থ নিয়ে ভাবুন। এটা একেবারেই স্পষ্ট এবং এতে মু’মিনের অন্তরের রোগের মুক্তি রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের অপবাদকারীগণ রূঢ় এবং ভাবনাহীন, এমনকি তারা এ আয়াতের উত্তর দিতেও অক্ষম বা অপব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। তারা হীনতার পরিচয় দেয়, বস্তুত তারা দুর্বল। কিন্তু লৌকিকতা, বিতর্ক, প্রবৃত্তি ইত্যাদি মানুষকে সত্য অনুসরণে বাধা দেয়।
আয়াতটি হলো মহান আল্লাহ বাণী:
﴿ وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلۡأَوَّلُونَ مِنَ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحۡسَٰنٖ رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُ وَأَعَدَّ لَهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي تَحۡتَهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۚ ذَٰلِكَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ ١٠٠ ﴾ [التوبة: ١٠٠] 
“আর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে সুন্দরভাবে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাতসমূহ, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে। এটাই মহাসাফল্য”। [আত্-তাওবা: ১০০]
এ আয়াতে ও আল্লাহর নিন্মোক্ত বাণী নিয়ে চিন্তা ভাবনা করুন:
وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلۡأَوَّلُونَ “যারা প্রথম অগ্রগামী” এসব লোক কাদের থেকে? এর পরেই আল্লাহ তাদের সম্পর্কে বলেছেন,  مِنَ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ “মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে” ।
    হ্যাঁ, যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হিজরত করেছেন এবং যারা তাকে সাহায্য করেছেন তারাই কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী সাবেকীন বা অগ্রগামী। সুতরাং এতে কোন ধরনের তা’বীল বা অপব্যাখ্যা করার সম্ভাবনা নেই, তবে আপনি তৃতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন।  وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحۡسَٰنٖ “এবং যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে সুন্দরভাবে”। সুতরাং সাহাবীরা হলেন ইমাম, যাদেরকে অনুসরণ করা হয় এবং আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। 
আপনি এ আয়াতের গুরুত্ব ও সুসংবাগুলো নিয়ে ভাবনা করুন।
এখানে  رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُ , وَرَضُواْ عَنۡهُ َ  এবং وَأَعَدّ অতীতকালের সিগাহ ব্যবহার করা হয়েছে। অতঃপর বলা হয়েছে لَهُمۡ মালিকানা অর্থে এবং خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۚ দ্বারা চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করা বুঝানো হয়েছে।
    আয়াতে বেদুঈন ও মুনাফিকদের সম্পর্কে যা উল্লেখ আছে তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করুন। হ্যাঁ, যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে, এ বিশ্বাস করে যে এটা আল্লাহর বাণী এবং আরবী ভাষা বুঝে, সে কখনো সাহাবীদের সম্মান ও মর্যাদাকে অস্বীকার করতে পারবে না।
প্রিয় পাঠক:
আমাকে নিন্মোক্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা একটু দীর্ঘ করতে সুযোগ দিন। আল্লাহ বলেছেন,
﴿ مُّحَمَّدٞ رَّسُولُ ٱللَّهِۚ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥٓ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ تَرَىٰهُمۡ رُكَّعٗا سُجَّدٗا يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗاۖ سِيمَاهُمۡ فِي وُجُوهِهِم مِّنۡ أَثَرِ ٱلسُّجُودِۚ ذَٰلِكَ مَثَلُهُمۡ فِي ٱلتَّوۡرَىٰةِۚ وَمَثَلُهُمۡ فِي ٱلۡإِنجِيلِ كَزَرۡعٍ أَخۡرَجَ شَطۡ‍َٔهُۥ فَ‍َٔازَرَهُۥ فَٱسۡتَغۡلَظَ فَٱسۡتَوَىٰ عَلَىٰ سُوقِهِۦ يُعۡجِبُ ٱلزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ ٱلۡكُفَّارَۗ وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ مِنۡهُم مَّغۡفِرَةٗ وَأَجۡرًا عَظِيمَۢا ٢٩ ﴾ [الفتح: ٢٩] 
“মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; পরস্পরের প্রতি সদয়, তুমি তাদেরকে রুকূকারী, সিজদাকারী অবস্থায় দেখতে পাবে। তারা আল্লাহর করুণা ও সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করছে। তাদের আলামত হচ্ছে, তাদের চেহারায় সিজদার চি‎হ্ন থাকে। এটাই তাওরাতে তাদের দৃষ্টান্ত। আর ইনজীলে তাদের দৃষ্টান্ত হলো একটি চারাগাছের মত, যে তার কঁচিপাতা উদগত করেছে ও শক্ত করেছে, অতঃপর তা পুষ্ট হয়েছে ও স্বীয় কান্ডের উপর মজবুতভাবে দাঁড়িয়েছে, যা চাষীকে আনন্দ দেয়। যাতে তিনি তাদের দ্বারা কাফিরদেরকে ক্রোধান্বিত করতে পারেন। তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও মহাপ্রতিদানের ওয়াদা করেছেন”। [সূরা : আল-ফাতহ: ২৯]
    হ্যাঁ, সাহাবীদের বর্ণনা, তাদের প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যাবলী, ও তাদেরকে পার্থক্যকারী গুণাবলির কথা তাওরাত ও ইঞ্জিলে উল্লেখ আছে।
    মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন ইমামুল মুরসালীন। তাঁর সাহাবীরা ছিলেন সর্বোত্তম সাথী, وَٱلَّذِينَ مَعَهُ “আর যারা তাঁর সাথে আছে”। বিপদে আপদে তারা প্রকৃত বন্ধু, ভাই ও ঘনিষ্ঠজন।  ٓ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ কাফিরদের উপর কঠোর। আর পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীদের উপর দয়াবান। رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ “নিজেদের মধ্যে সদয়”। সীরাত সম্পর্কে অধ্যয়নকারী দেখতে পাবে সাহাবীদের মধ্যে ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন কোন পর্যায় ছিল। দয়াশীলতার বাস্তব প্রয়োগ সর্বোচ্চ পর্যায় ছিল। যেমন: নিজের উপর অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়া। যেমন আল্লাহর বাণী:
﴿ وَيُؤۡثِرُونَ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ وَلَوۡ كَانَ بِهِمۡ خَصَاصَةٞۚ ٩ ﴾ [الحشر: ٩] 
এবং নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ওপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। [সূরা : আল্-হাশর: ৯]
তাদের মাঝে ছিল প্রকৃত বন্ধুত্ব। তারা পরস্পরে বন্ধু ছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেছেন,
﴿ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ ٧١ ﴾ [التوبة: ٧١] 
“তারা পরস্পরে বন্ধু”। এটা মহান আল্লাহ কর্তৃক তাদের গুণাবলি। তাই কুরআনে তাদের যে সব গুণ এসেছে সেগুলো আমাদের গ্রহণ করা ফরয। তাদের সম্পর্কে কুরআনে এসেছে,  رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ  “পরস্পরের প্রতি সদয়”। তাদের মাঝে উদারতা ও ভালবাসা হলো মূল, কেননা এগুণের কথা স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলাই বর্ণনা করেছেন। সুতরাং আমাদেরকে এটাকেই গ্রহণ করতে হবে এবং ইতিহাসবিদগণ যেসব কিচ্ছা কাহিনী বর্ণনা করেছেন তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এ মাস’য়ালাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস’য়ালা। আমাদের সামনে আয়াতে মুহকাম রয়েছে, আর এর বিপরীতে এমন কিছু রিওয়ায়েত যার সনদ সম্পর্কে আল্লাহই ভাল জানেন এবং এর মতন কুরআনের সাথে বিরোধপূর্ণ। সুতরাং এ আয়াত  ও আপনার ধারণা সম্পর্কে চিন্তা করুন। আপনার ধারণা কি কুরআনের মোতাবেক? নাকি আপনি ঐতিহাসিক কিচ্ছা কাহিনীর দ্বারা প্রভাবিত?
সাহাবীরা ইবাদতগুজার ছিলেন। আল্লাহ তাদের সম্পর্কে বলেছেন, تَرَىٰهُمۡ رُكَّعٗا سُجَّدٗا “তাদের আলামত হচ্ছে, তাদের চেহারায় সিজদার চি‎হ্ন থাকে”। এ বর্ণনায় তাদের সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো হয়েছে। এতে ইবাদতের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থা তথা রুকু ও সিজদার কথা উল্লেখ করে একথাই বুঝানো হয়েছে যে, এটাই তাদের সার্বক্ষণিক অবস্থা। কেননা তাদের অন্তরে রুকু সিজদার ভালবাসা স্থায়ীভাবে স্থাপিত এবং তাদের অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত।
তাদের অবস্থা এমন যে, সর্বক্ষণ তারা মসজিদে রুকু ও সাজদাহ অবস্থায় কাটায়। এর দলিল হলো আল্লাহ তাদের অন্তরের প্রশংসা ও নিয়্যাতের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে বলেছেন,  ا يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗاۖ “তারা আল্লাহর করুণা ও সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করছে”। এটা তাদের অনুভূতি, প্রবৃত্তি ও চাহিদা। তাদের সর্বক্ষণের কাজই হলো আল্লাহর দয়া ও সন্তুষ্ট অন্বেষণ করা।
    তাই দুনিয়ার কোন লোভ লালসা তাদের অন্তরে ছিল না। এ সব চাহিদা তাদের জীবনযাপনের নানা ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়েছে, তাই তাদের মধ্যে কোন অহংকার, লৌকিকতা ও হিংসা বিদ্বেষ ছিল না; বরং নম্রতা, খুশু’, খুদু’ ও ঈমানের দীপ্তময় আলোই ছিল তাদের আলামত। এখানে আয়াতের উদ্দেশ্য এটা নয় যে, তাদের কপালে সিজদার চিহ্ন বিদ্যমান থাকবে। তবে কারো তবে এরূপ হওয়া নিষেধ নয়।  তাওরাতে ইয়াহুদীদের কাছে তাদের গুণাবলি সম্পর্কে চিন্তা করুন। এগুণাবলির পাশাপাশি ইঞ্জিলে উল্লেখিত নাসারাদের কাছে তাদের গুণাবলি নিয়ে ভাবুন। তাদের দৃষ্টান্ত হলো একটি চারাগাছের মত, যে তার কঁচিপাতা উদগত করেছে ও শক্ত করেছে, অতঃপর তা পুষ্ট হয়েছে ও স্বীয় কান্ডের উপর মজবুতভাবে দাঁড়িয়েছে, যা চাষীকে আনন্দ দেয়। আয়াতে চাষ ও চাষী সম্পর্কে চিন্তা করুন। চাষী কে? তাদের অবস্থা এরকম: “যাতে তিনি তাদের দ্বারা কাফিরদেরকে ক্রোধান্বিত করতে পারেন”। আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও উত্তম পরিণামের কথা জোর দিয়ে বলেছেন,
وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ مِنۡهُم مَّغۡفِرَةٗ وَأَجۡرًا عَظِيمَۢا
“যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও মহাপ্রতিদানের ওয়াদা করেছেন”। [সূরা : আল-ফাতহ: ২৯]
مِنۡهُم বলতে কারা? এটা দ্বারা শ্রেণী বুঝানো হয়েছে, যেমন আল্লাহর বাণী:
﴿فَٱجۡتَنِبُواْ ٱلرِّجۡسَ مِنَ ٱلۡأَوۡثَٰنِ ٣٠ ﴾ [الحج: ٣٠] 
“সুতরাং মূর্তিপূজার অপবিত্রতা থেকে বিরত থাক”। [সূরা : আল-হাজ্জ: ৩০]


এ সব কিছু নিয়ে চিন্তা ভাবনা করুন:
    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করুন। তাওরাত ও ইঞ্জিলে তাদের উদাহরণ হলো: তারা পরস্পরে উদার। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনায় আল্লাহ তা‘আলা জোর দিয়ে অনেক বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর তরফ থেকে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় নি‘আমত হলো:
﴿ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ فِيكُمۡ رَسُولَ ٱللَّهِۚ ٧ ﴾ [الحجرات: ٧] 
“আর তোমরা জেনে রাখ যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন”। [আল-হুজুরাত: ৭]
এ সূরাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের সম্মান সম্পর্কে অনেক আলোচনা রয়েছে।
 

ওয়াফুদ তথা প্রতিনিধি দলসমূহকে অভ্যর্থনা
সূরা হুজুরাতে কিছু আয়াত আছে যাতে স্পষ্টভাবে সাহাবীদের মর্যাদা বুঝানো হয়েছে। এ সূরা আক্বীদা, শরি‘য়াহ ও মানব অস্তিত্বের প্রকৃত অবস্থার মৌলিক বিষয়ের বিবরণ দেয়া হয়েছে। এতে মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য, ঈমানী ভ্রাতৃত্ব এবং যেসব জিনিস এ সবের বিপরীত ও যা এর ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয় সেসব ব্যাপারে বর্ণনা করা হয়েছে।
এখানে আয়াতে বর্ণিত দু’টি অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করব:
প্রথমত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আচরণবিধি ও বেদুইনদের অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।
সূরাটি মু’মিনদেরকে সম্বোধন করে শুরু হয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ মান্য করা, তাদের হুকুমের সামনে কোনো কিছু অগ্রাধিকার না দেয়া বরং তাদের রায়ের উপর সন্তুষ্ট থাকা, আত্মসমর্পণ করা, তাড়াহুড়া করে রাসূলের উপর কোন মত না দেয়া এবং কোন ব্যাপারে আল্লাহর বিধান না আসা পর্যন্ত তাদের কোন কথা বলা উচিত নয়, এমনিভাবে কোন কাজ না করা ইত্যাদি সম্পর্কে সূরাতে আলোচনা করা হয়েছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, স্বর উচুঁ না করা ইত্যাদি সুমহান শিষ্টাচার সম্পর্কে ভাবুন। আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সাহাবী ও বেদুইনদের মাঝে শিষ্টাচারের পার্থক্য সম্পর্কে ভাবুন। এটা দ্বারাই সাহাবীদের মর্যাদা প্রমাণিত হয়।
চিন্তা ও গবেষণা করুন:
উপরিউক্ত আয়াতসমূহে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাস্তব জীবনের সাথে সাহাবীদের জীবন্ত চিত্র লক্ষ্য করুন।
দ্বিতীয়ত: আয়াতে সাহাবীদের সুমহান মর্যাদা সম্পর্কে আলোকপাত হয়েছে। এতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, তাদের মাঝে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপস্থিতিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় নি‘আমত।
﴿ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ فِيكُمۡ رَسُولَ ٱللَّهِۚ ٧ ﴾ [الحجرات: ٧] 
“আর তোমরা জেনে রাখ যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন”। [আল-হুজুরাত: ৭]
এ আয়াতের উদ্দেশ্য কি? সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী নাযিল হত আর তিনি সাহাবীদের মাঝে  অবস্থান করতেন। ফলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে এ মু’মিন সম্প্রদায়ের সাথে মহান আল্লাহর সম্পর্ক সৃষ্টি হত। তাদের খোঁজ খবর ও অবস্থা সম্পর্কে অহী নাযিল হতো। এমনকি তাদের অন্তরের খবর ও বিপদ আপদে তাদের ফয়সালা সরাসরি আল্লাহর তরফ থেকে নাযিল হতো।
এমনকি তাদের ব্যক্তিগত বিষয়েও অহী নাযিল হতো।
﴿ قَدۡ سَمِعَ ٱللَّهُ قَوۡلَ ٱلَّتِي تُجَٰدِلُكَ فِي زَوۡجِهَا ١ ﴾ [المجادلة: ١] 
“আল্লাহ অবশ্যই সে রমণীর কথা শুনেছেন যে তার স্বামীর ব্যাপারে তোমার সাথে বাদানুবাদ করছিল”। [সূরা : আল্-মুজাদালা: ১]
আল্লাহ উম্মুল মু’মিনীন উম্মে হানী রাদিয়াল্লাহু আনহার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি ও তাঁর কাছে যেসব সাহাবীরা ছিলেন তারা সবাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুতে অহী বন্ধ হওয়ায় কান্নাকাটি করছিলেন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য সাহাবীরা তাঁর (উম্মে হানী রাদিয়াল্লাহু আনহু) মৃত্যুর পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুকরণে তাঁর কবর যিয়ারত করছিলেন। উক্ত ঘটনাটি একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা।
অতঃপর এ আয়াত সম্পর্কে ভাবুন:
﴿ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ فِيكُمۡ رَسُولَ ٱللَّهِۚ لَوۡ يُطِيعُكُمۡ فِي كَثِيرٖ مِّنَ ٱلۡأَمۡرِ لَعَنِتُّمۡ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ حَبَّبَ إِلَيۡكُمُ ٱلۡإِيمَٰنَ وَزَيَّنَهُۥ فِي قُلُوبِكُمۡ وَكَرَّهَ إِلَيۡكُمُ ٱلۡكُفۡرَ وَٱلۡفُسُوقَ وَٱلۡعِصۡيَانَۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلرَّٰشِدُونَ ٧ ﴾ [الحجرات: ٧] 
“আর তোমরা জেনে রাখ যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন। সে যদি অধিকাংশ বিষয়ে তোমাদের কথা মেনে নিত, তাহলে তোমরা অবশ্যই কষ্টে পতিত হতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের কাছে ঈমানকে প্রিয় করে দিয়েছেন এবং তা তোমাদের অন্তরে সুশোভিত করেছেন। আর তোমাদের কাছে কুফরী, পাপাচার ও অবাধ্যতাকে অপছন্দনীয় করে দিয়েছেন। তারাই তো সত্য পথপ্রাপ্ত”। [সূরা আল-হুজুরাত: ৭]
হ্যাঁ, সাহাবীদের উপর মহান আল্লাহর অনুগ্রহ হলো তাদের অন্তরে ঈমানকে দৃঢ় ও স্বভাবসুলভ করে দিয়েছেন। তাদের নিকট প্রবৃত্তির ভালবাসার চেয়ে ঈমানের ভালবাসা অধিক প্রিয়। এ আয়াতের তাগীদ সম্পর্কে ভাবুন। ‘এবং তা তোমাদের অন্তরে সুশোভিত করেছেন’। এরপরে ঈমানের ভালবাসার বিপরীত ও ত্রুটিযুক্ত দিকগুলো উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘আর তোমাদের কাছে কুফরী, পাপাচার ও অবাধ্যতাকে অপছন্দনীয় করে দিয়েছেন’। আল্লাহ তা‘আলা যা কিছুই ঈমানের ঘাটতি ঘটায় তা সব কিছুই সাহাবীদের অন্তরে অপছন্দনীয় করে দিয়েছেন। আল্লাহু আকবর। আয়াতের শেষাংশ নিয়ে ভাবুন।
أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلرَّٰشِدُونَ
“তারাই তো সত্য পথপ্রাপ্ত”। [সূরা আল-হুজুরাত: ৭]
    এ দলটির উপর মহান আল্লাহর অনুগ্রহ হলো তিনি তাদেরকে তাঁর নবীর সাহচর্য হিসেবে নির্বাচিত করেছেন এবং তাদেরকে ঈমানের হিদায়াত দান করেছেন। এ ঈমান তাদের অন্তরে সুশোভিত করেছেন। তাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী হওয়ার যোগ্য করে তুলেছেন। ফলে তারা কুফরী, পাপাচার ও অবাধ্যতাকে অপছন্দ করতেন। এতে পরিপূর্ণ হিকমত রয়েছে। কেননা আয়াতে ঈমানের বিপরীত তিনটি খারাপ দোষের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো কুফরী, পাপাচার ও অবাধ্যতা।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ، قَالَ: " إِنَّ اللهَ نَظَرَ فِي قُلُوبِ الْعِبَادِ، فَوَجَدَ قَلْبَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَيْرَ قُلُوبِ الْعِبَادِ، فَاصْطَفَاهُ لِنَفْسِهِ، فَابْتَعَثَهُ بِرِسَالَتِهِ، ثُمَّ نَظَرَ فِي قُلُوبِ الْعِبَادِ بَعْدَ  قَلْبِ مُحَمَّدٍ، فَوَجَدَ قُلُوبَ أَصْحَابِهِ خَيْرَ قُلُوبِ الْعِبَادِ، فَجَعَلَهُمْ وُزَرَاءَ نَبِيِّهِ، يُقَاتِلُونَ عَلَى دِينِهِ
“আব্দুল্লাহ ইবন মাস ‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ বান্দাহদের অন্তরের দিকে তাকালেন। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরকে সবচেয়ে উত্তম পেলেন। ফলে তাকে নবুওতের জন্য নির্বাচিত করেছেন এবং রিসালাত দিয়ে প্রেরণ করেছেন। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরের পরে আবার বান্দাহর অন্তরের দিকে তাকালেন। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরের পরে সাহাবীদের অন্তর উত্তম অন্তর হিসেবে পেলেন। ফলে তিনি তাদেরকে তাঁর নবীর সাহায্যকারী করলেন, তারা তাঁর দ্বীনের জন্য জিহাদ করেছেন”।  
হ্যাঁ, এ আয়াতে সাহাবীদের মর্যাদা, ন্যায়পরায়ণতা, যোগ্যতা ও মহান আল্লাহর কাছে তাদের অপরিসীম সম্মান ও মর্যাদার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। মহান মাওলার নিন্মোক্ত বাণী সম্পর্কে ভাবুন:
أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلرَّٰشِدُونَ
“তারাই তো সত্য পথপ্রাপ্ত”। [সূরা আল-হুজুরাত: ৭]
এর পরে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَنِعۡمَةٗۚ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ٨ ﴾ [الحجرات: ٨] 
“আল্লাহর পক্ষ থেকে করুণা ও নিআমত স্বরূপ। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়”। [সূরা : আল-হুজুরাত: ৮]
হ্যাঁ, রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য মহান আল্লাহর তরফ থেকে এক বিরাট নি‘আমত যা আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদেরকে দান করেছেন। তিনি সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়। আল্লাহর হিকমত হলো তিনি মুহাম্মদ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসূল হিসেবে নির্বাচিত করেছেন, তিনি তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল করেছেন। এমনিভাবে সাহাবীদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহচর্য হিসেবে নির্বাচন করেছেন। সাহাবীদের মর্যাদার কারণ হলো রাসূলের সাহচর্য আর তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন।
 

তাবুকের যুদ্ধ
আল্লাহ তা‘আলা তাবুকের যুদ্ধের আগে ও পরের ঘটনা সম্পর্কে সূরা তাওবা নাযিল করেন। এটি রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিলকৃত শেষ সূরার মধ্যে একটি সূরা। এতে রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্তৃক পরিশোধিত সমাজ ব্যবস্থার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
এ সূরার গবেষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এটি মক্কা বিজয়ের পরে নাযিল হয়েছে এবং এতে মুসলিম সমাজের রূপরেখা রয়েছে। আর এটাই এ সূরা সম্পর্কে গবেষণার প্রধান কারণ। এটাই মূল আলোচ্য বিষয়। এ সূরার আয়াতগুলো তিলাওয়াতের সময় আপনার উচিত এ বিষয়টি খেয়াল রাখা। আপনি দেখবেন এতে মুনাফিকদের অবস্থা বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। এতে তাদের চরিত্রের অবস্থা, দোষত্রুটি, মদিনাবাসীদের মাঝে নিফাকির অনুপ্রবেশ, তাদের রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যুদ্ধ যাওয়া থেকে বিরত থাকা, এমনকি তারা জিহাদের ব্যয়ভার বহনেও অংশগ্রহণ করেনি; বরং দানশীল মু’মিনদেরকে দান করা থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করেছিল, তারা দাবী করত তারাই সংশোধনকারী, কথায় কথায় হলফ করত, সামান্য সন্দেহ সংশয় হলেই জিহাদ থেকে বিরত থাকত এবং পরবর্তীতে ওজর পেশ করত। এ ছিল মুনাফিকদের সাধারণ চরিত্র। এবার দেখুন তাদের মধ্যে কি সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন জান্নাতী রয়েছেন? নাকি অগ্রবর্তী সাহাবীদের মধ্যেই  সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন জান্নাতী রয়েছেন?
প্রিয় পাঠক:
মুনাফিকদের অবস্থা সম্পর্কে ভাবুন, অন্যদিকে আল্লাহ তা‘আলা অগ্রগামী প্রথমদিকের মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের সম্পর্কে যেসব গুণাবলি বর্ণনা করেছেন সে সম্পর্কে ভাবুন। আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের  সম্পর্কে যা উল্লেখ করেছেন সে ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট ও খুশি হওয়া উচিত। উক্ত সূরাতে বেদুইনদের সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। তবে তারা সবাই একই ধরনের নয়। যেমন আল্লাহ তাদের সম্পর্কে বলেছেন,
﴿ وَمِنَ ٱلۡأَعۡرَابِ مَن يَتَّخِذُ مَا يُنفِقُ مَغۡرَمٗا وَيَتَرَبَّصُ بِكُمُ ٱلدَّوَآئِرَۚ عَلَيۡهِمۡ دَآئِرَةُ ٱلسَّوۡءِۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٞ ٩٨ ﴾ [التوبة: ٩٨] 
“আর বেদুঈনদের কেউ কেউ যা (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে, তা জরিমানা গণ্য করে এবং তোমাদের দুর্বিপাকের প্রতীক্ষায় থাকে। দুর্বিপাক তাদের উপরই এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী”। [আত্-তাওবা: ৯৮]
এরা হলেন বেদুইনদের এক প্রকার যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে বসবাস করেছেন। তদের মধ্যে আবার অন্য এক জাতি ছিলেন, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,
﴿ وَمِنَ ٱلۡأَعۡرَابِ مَن يُؤۡمِنُ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَيَتَّخِذُ مَا يُنفِقُ قُرُبَٰتٍ عِندَ ٱللَّهِ وَصَلَوَٰتِ ٱلرَّسُولِۚ أَلَآ إِنَّهَا قُرۡبَةٞ لَّهُمۡۚ سَيُدۡخِلُهُمُ ٱللَّهُ فِي رَحۡمَتِهِۦٓۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٩٩ ﴾ [التوبة: ٩٩] 
“আর বেদুঈনদের কেউ কেউ আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে এবং যা ব্যয় করে তাকে আল্লাহর নিকট নৈকট্য ও রাসূলের দো‘আর উপায় হিসেবে গণ্য করে। জেনে রাখ, নিশ্চয় তা তাদের জন্য নৈকট্যের মাধ্যম। অচিরেই আল্লাহ তাদেরকে তাঁর রহমতে প্রবেশ করাবেন। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। [আত্-তাওবা: ৯৯]
যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যুদ্ধ শরীক না হয়ে বিরত থেকেছেন এবং যারা ভালকাজে নিজেকে ব্যপৃত রেখেছেন তাদের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা হয়েছে। এতে সে সমাজের বাস্তব অবস্থা ফুটে উঠেছে। কুরআনের যেখানেই মুহাজির ও আনসারদের আলোচনা এসেছে সেখানেই তাদের সম্পর্কে ভাল বলা হয়েছে। কুরআনের সবখানেই সাহাবীদেরকে সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। এভাবেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য ও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। নিন্মোক্ত আয়াত পড়ুন ও ভাবুন:
﴿ لَّقَد تَّابَ ٱللَّهُ عَلَى ٱلنَّبِيِّ وَٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ ٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُ فِي سَاعَةِ ٱلۡعُسۡرَةِ مِنۢ بَعۡدِ مَا كَادَ يَزِيغُ قُلُوبُ فَرِيقٖ مِّنۡهُمۡ ثُمَّ تَابَ عَلَيۡهِمۡۚ إِنَّهُۥ بِهِمۡ رَءُوفٞ رَّحِيمٞ ١١٧ ﴾ [التوبة: ١١٧] 
“অবশ্যই আল্লাহ নবী, মুহাজির ও আনসারদের তাওবা কবুল করলেন, যারা তার অনুসরণ করেছে সংকটপূর্ণ মুহূর্তে। তাদের মধ্যে এক দলের হৃদয় সত্যচ্যূত হওয়ার উপক্রম হবার পর। তারপর আল্লাহ তাদের তাওবা কবূল করলেন। নিশ্চয় তিনি তাদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু”। [আত্-তাওবা: ১১৭]
    এটা সব মুহাজির ও আনসারদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। আয়াতের শুরুতে তাদের তাওবা সম্পর্কে ভাবুন। অতঃপর আয়াতের মধ্যবর্তীতে তাওবা সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা নিয়ে ভাবুন। এরপরে আয়াতের শেষে বলা হয়েছে 
إِنَّهُۥ بِهِمۡ رَءُوفٞ رَّحِيمٞ
“নিশ্চয় তিনি তাদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু”।
    মহান আল্লাহ রহমতের দ্বারা যাদের দায় দায়িত্ব নিয়েছেন, মাওলা তাদের প্রতি স্নেহশীল ও পরম দয়ালু তাদের ব্যাপারে আপনার ধারণা কি? হ্যাঁ,  এর পূর্ববর্তী আয়াতে সাবেকীন আওয়ালীন মুহাজির ও আনসারদের বৈশিষ্ট্য, যারা তাদেরকে একনিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করেন তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এতে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কিছু ফায়েদা আছে যা ইতিপূর্বে ইশারা করা হয়েছে। 
    এখন প্রশ্ন হলো: সাবেকীন বা অগ্রগামী সাহাবী কারা? যারাই রাসূল  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দু’কিবলার দিকে ফিরে সালাত আদায় করেছেন তারাই সাবেকীন সাহাবী। কারো মতে, যারা বৃক্ষের নিচে আল্লাহর রাসূলের হাতে বাই‘আত গ্রহণ করেছেন তারাই সাবেকীন সাহাবী।
    যাই হোক সাহাবীরা অনেক স্তরের, সব স্তরের লোকদের আলাদা আলাদা মর্যাদা। সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাবান সাহাবী হলেন সাবেকীন বা অগ্রগামী সাহাবীগণ। তারা হলেন বদর, অহুদ, খন্দক যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও বাই‘আতে রিদওয়ানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে বাই‘আত গ্রহণকারীগণ।
    তাদের কেউ যদি নিফাকী করত –আল্লাহ তাদেরকে এ থেকে রক্ষা করেছেন এবং তাদের সকলের উপর তিনি রাজি খুশি- তবে  তার বর্ণনা আসত। সুবহানআল্লাহ। তাদের মধ্য থেকে তিনজন জিহাদ থেকে বিরত থেকেছে তাদের বর্ণনা ও তাদের শাস্তির বিধান নাযিল হয়েছে। এমনিভাবে দূর্বল সাহাবীরা যারা অর্থাভবে জিহাদে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি তাদের সম্পর্কেও বর্ণনা এসেছে। আর যাদের অন্তরে নিফাক ছিল তাদের সম্পর্কে আল্লাহ নিরব ছিলেন। তাদের অন্তরে ছিল নিফাকির রোগ। সূরা তাওবা তিলাওয়াতকারী নিশ্চিতভাবে দেখতে পাবে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমাজে কেউ দোষত্রুটি বা ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করে গোপন থাকতে পারত না। তাদের বাস্তব অবস্থা এ সূরাতে আলোচনা করা হয়েছে। কেনই বা হবে না, এ সূরার নামই সূরা আল-ফাদিহাহ বা সূরা আল-কাশিফা বা স্পষ্টকারী সূরা।

সূরা তাওবা অনুসারে সমাজের শ্রেণীবিভাগ
১- মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী। আল্লাহ তাদের সম্পর্কে বলেছেন,
﴿ وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلۡأَوَّلُونَ مِنَ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحۡسَٰنٖ رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُ ١٠٠ ﴾ [التوبة: ١٠٠] 
“আর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে সুন্দরভাবে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে”।  [আত্-তাওবা: ১০০]
২- আল্লাহ তা‘আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও যারা তাঁর সাথে আছেন তাদের সকলকে সর্বসাধারণভাবে উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ সাবেকীন ও গাইরে সাবেকীন সব মু’মিনগণ। আল্লাহ তাদের সম্পর্কে বলেছেন,
﴿ لَٰكِنِ ٱلرَّسُولُ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مَعَهُۥ جَٰهَدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ لَهُمُ ٱلۡخَيۡرَٰتُۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٨٨ ﴾ [التوبة: ٨٨] 
“কিন্তু রাসূল ও তার সাথে মুমিনরা তাদের মাল ও জান দিয়ে জিহাদ করে, আর সে সব লোকের জন্যই রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ এবং তারাই সফলকাম”। [আত্-তাওবা: ৮৮]
৩- আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা মুহাজির ও আনসারদেরকে অগ্রগামী বা অনগ্রগামী কোনরূপ পার্থক্য না করে তাদের কথা উল্লেখ করেছেন। অন্য আয়াতে এদের সম্পর্কে স্পষ্ট বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ لَا يَسۡتَوِي مِنكُم مَّنۡ أَنفَقَ مِن قَبۡلِ ٱلۡفَتۡحِ وَقَٰتَلَۚ أُوْلَٰٓئِكَ أَعۡظَمُ دَرَجَةٗ مِّنَ ٱلَّذِينَ أَنفَقُواْ مِنۢ بَعۡدُ وَقَٰتَلُواْۚ وَكُلّٗا وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلۡحُسۡنَىٰۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ خَبِيرٞ ١٠ ﴾ [الحديد: ١٠] 
“তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে এবং যুদ্ধ করেছে তারা সমান নয়। তারা মর্যাদায় তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, যারা পরে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে। তবে আল্লাহ প্রত্যেকের জন্যই কল্যাণের ওয়াদা করেছেন। আর তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবগত”। [সূরা : আল্-হাদীদ: ১০]
এখানে তাদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট। তবে আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রত্যেকের জন্যই কল্যাণের ওয়াদা করেছেন।  তিনি হলেন কল্যাণদাতা। আল্লাহ সে সমাজের তিনজনের ঘটনা উল্লেখ করেছেন যারা জিহাদ থেকে পশ্চাতে ছিলেন, এমনিভাবে যারা সহায় সম্বলের অভাবে জিহাদে শরিক হতে পারেন নি তাদের ঘটনাও উল্লেখ করেছেন।
৪- আল্লাহ তাদের সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন যারা ভালো ও খারাপ কাজ মিশ্রিত করে ফেলেছিলেন। যারা তাকওয়ার উপর ভিত্তি করে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন তাদেরকে প্রশংসা করেছেন। তাই এ এখানে যাদের সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে তাদের নিয়ে চিন্তা গবেষণা করুন। তারা সকলেই মু’মিন ছিল।
৫- এরপরে আল্লাহ মুনাফিকদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাদের দোষত্রুটি ও অবস্থা আলাদা আলাদাভাবে উল্লেখ করেছেন। কিছু দোষ তাদের সকলের মাঝেই ছিল আবার কিছু তাদের ব্যক্তিগত দোষত্রুটি ছিল। এ সম্পর্কে চিন্তা করুন। মু’মিনদের সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে যা আলোচনা হয়েছে তা ভাবভাবে পর্বেক্ষণ করুন ও গবেষণা করুন। এছাড়াও বেদুইনদের সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সত্যিকারের মু’মিন ছিল, আবার কেউ মিথ্যাবাদী মুনাফিক ছিল। তাই মু’মিন, বেদুঈন ও মুনাফিকদের সম্পর্কে ভাবুন। এরপরেও কি কেউ দ্বিধা সন্দেহে পড়তে পারে? কারা সবচেয়ে বিপজ্জনক তা বুঝতে কি কোন অসুবিধে থাকতে পারে? 

উপসংহারের পূর্বে
আল্লাহ তা ‘আলা বলেছেন,
﴿ وَٱصۡبِرۡ نَفۡسَكَ مَعَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ رَبَّهُم ٢٨ ﴾ [الكهف: ٢٨] 
“আর তুমি নিজকে ধৈর্যশীল রাখ তাদের সাথে, যারা তাদের রবকে ডাকে” [সূরা : আল-কাহফ: ২৮]
    আল্লাহ তাঁর নবীকে তাঁর কিছু সংখ্যক সাহাবীদের সাথে ধৈর্যধারণ করতে আদেশ করেছেন। এ আয়াতে চিন্তা করুন। এ সম্মানের দিকে লক্ষ্য করুন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এত সুমহান মর্যাদা সত্ত্বেও আল্লাহ যারা তাকে ডাকে তাদের সাথে ধৈর্য ধরতে আদেশ করেছেন। তাহলে তারা কারা? এটাই হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের মধ্যকার অবিচ্ছেদ্য ও নিবিড় সম্পর্ক।
আল্লাহ বলেছেন,
﴿ فَبِمَا رَحۡمَةٖ مِّنَ ٱللَّهِ لِنتَ لَهُمۡۖ وَلَوۡ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ ٱلۡقَلۡبِ لَٱنفَضُّواْ مِنۡ حَوۡلِكَۖ فَٱعۡفُ عَنۡهُمۡ وَٱسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ وَشَاوِرۡهُمۡ فِي ٱلۡأَمۡرِۖ ١٥٩ ﴾ [ال عمران: ١٥٩] 
“অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের কারণে তুমি তাদের জন্য নম্র হয়েছিলে। আর যদি তুমি কঠোর স্বভাবের, কঠিন হৃদয়সম্পন্ন হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং তাদেরকে ক্ষমা কর এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। আর কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরার্মশ কর”।  [আলে ইমরান: ১৫৯]
    আল্লাহর রহমতের কারণে সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নম্রতা, ক্ষমা, দু‘আ, ও পরামর্শ  লাভ করেছেন।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা:
আয়াতের অর্থ সম্পর্কে ভাবুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসমান ও যমীনের রবের পক্ষ থেকে অহী নাযিল হতো, তিনি তাঁর সব কাজ-কর্মে মিমাংসীত ও সর্বোত্তম মহামানব, অথচ তাকে তাঁর সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে ইসলামে মুশওয়ারার গুরুত্ব স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। আয়াতের শাহেদ হলো যাদের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরামর্শ করেছেন তাদের মর্যাদা বুঝানো। হ্যাঁ, যার অন্তর ও চক্ষু আছে সেই এটা বুঝতে পারবে। মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা সম্পর্কে ভাবুন, তিনি যাদের সাথে সাথে পরামর্শ করেছেন তাদের সম্পর্কে ভাবুন। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের জন্য ইস্তিগফার করেছেন। হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ ইস্তিগফার তাদের জন্য সুসংবাদ ও মহাঅর্জন। আর তারা এ মর্যাদা লাভ করেছেন একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যের বদৌলতে।
সম্মানিত পাঠক ও পাঠিকা:
কুরআনে কারীম তিলাওয়াতকারী অসংখ্য আয়াত পাবেন যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের সম্পর্কে সাধারণভাবে নাযিল হয়েছে। সংক্ষিপ্তাকারে ইতিপূর্বে কিছু আয়াত আলোচনা করেছি। যার অন্তর আছে, মানার যোগ্যতা আছে তার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। 
 

শেষকথা
সম্মানিত পাঠক, আল্লাহর দরবারে দাঁড়ানোকে ভয় করুন। যেসব আয়াত উল্লেখ করেছি সেগুলো নিয়ে ভাবুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের সাথে সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে যেসব সময় পার করেছেন সে সম্পর্কে ভাবুন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত নিয়ে ভাবুন। তিনি কাদের সাথে জীবন কাটিয়েছেন?
কারা তাঁর শিষ্য, যারা তাঁর থেকে ইলম গ্রহণ করেছেন?
কারা তাঁর সৈনিক ছিলেন, যারা শত্রুর মোকাবিলা করেছেন?
কারা তাঁর সঙ্গী সাথী ছিলেন, যাদের সাথে তিনি নানা পরামর্শ করেছেন?
কাদের সাথে তিনি খাওয়া দাওয়া, উঠা বসা, আনন্দ হাসি করেছেন?
কারা তাঁর পিছনে সালাত আদায় করেছেন, তাঁর ওয়াজ নসিহত ও ভাষণ শ্রবণ করেছেন?
তারা কারা যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছেন?
কারা তাদের ধন-সম্পদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে ব্যয় করেছেন?
কারা তাদের জীবনকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে উৎসর্গ  করেছেন?
কারা তাঁর থেকে কুরআন বর্ণনা করেছেন?
কারা তাঁর থেকে নবুওয়ের রিসালা গ্রহণ করেছেন ও তা মানুষের মাঝে পৌঁছিয়েছেন?
তারা কারা যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহচর ছিলেন, তিনিও তাদের সাথী ছিলেন, তিনি তাদের মাঝে বসবাস করেছেন। মৃত্যুর পরে তারা তাঁর জানাযার সালাত আদায় করেছেন, তাঁর মৃত্যুতে তারা ব্যথিত হয়েছেন, তাকে হারানোর মুসিবতে ধৈর্যধারণে প্রতিদান পেয়েছেন যেমনিভাবে তাঁর সাথে জীবন যাপনে তারা প্রতিদান লাভ করেছেন।
অতঃপর, যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদেরকে গালমন্দ ও অপবাদ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে যাদের তাওবার সৌভাগ্য হয়েছে তারা যে প্রশান্তি, জীবনের আনন্দ ও ঈমানের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করেছেন তা আলোচনা করা হয়েছে। তাওবার আগে ও পরে  তাদের অবস্থা কি ছিল তা জানুন।
তারা আল্লাহর নিন্মোক্ত বাণীর প্রকৃত অবস্থায় জীবন যাপন করেছেন,
﴿ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠ ﴾ [الحشر: ١٠] 
“এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু”। [সূরা : আল্-হাশর: ১০]
    তারা তাদের অন্তরে বিদ্বেষ রাখেনি, পবিত্র আলে বাইত ও অন্যান্য সাহাবীদেরকে ভালবেসেছেন। আলে-বাইত ও সব সাহাবীদের ভালবাসাই হলো সঠিক ভালবাসা। এতে বিচ্ছিন্ন অন্তর একত্রিত হয় এবং মু’মিন প্রকৃত সৌভাগ্য ও প্রশান্তি লাভ করে। আল্লাহর রহমতে কিয়ামতের দিন বিশুদ্ধ ও পবিত্র অন্তর নিয়ে আল্লাহর দরবারে দাঁড়াবেন।
    অতঃএব, আপনার অন্তরের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সাবধান হোন। আপনার অন্তরে সাধারণভাবে মু’মিনদের ব্যাপারে, বিশেষ করে সাহাবীগণ ও আলে বাইতের ব্যাপারে কোন বিদ্বেষ থাকলে তা পরিহার করুন, যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যের সৌভাগ্যবান হয়েছেন এবং তাঁর আত্মীয় স্বজন হয়েছেন।
اللهم ربنا لا تجعل في قلوبنا غلا للذين آمنوا ربنا إنك رؤوف رحيم، وصلى الله وسلم على محمد وآله وصحبه أجمعين.
হে আমাদের রব! যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু। আল্লাহ সালাত ও সালাম নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার পরিজন ও সব সাহাবীদের উপর বর্ষণ করুন।


 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য

বই সম্পর্কে

লেখক :

Saleh ibn Abd Allah Ad-Darweesh

প্রকাশক :

www.islamland.com

বিভাগ :

For New Muslim