সূরা আত-তাওবার তাফসীর

সূরা আত-তাওবাহ সর্বশেষ নাযিল হওয়া সূরাসমূহের অন্যতম। এ সূরার অপর নাম আল-ফাদ্বিহাহ। অর্থাৎ অপমানকারী। কারণ এতে কাফের-মুশরিকদের বর্ণনার পাশাপাশি মুনাফিকদের সার্বিক অবস্থা ও কাজকর্মের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমানে মানুষের মধ্যে মুনাফেকী বিভিন্ন চরিত্র দেখা যাচ্ছে, সুতরাং এ সূরার তাফসীর যদি তাফসীরে ইবন কাসীরের মতো প্রামান্য গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তবে তা তাদের হেদায়াতের জন্য মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

اسم الكتاب: تفسير سورة التوبة


تأليف: إسماعيل بن عمر بن كثير



نبذة مختصرة:ترجمة تفسير سورة التوبة لابن كثير باللغة البنغالية..


সূরা আত-তাওবার তাফসীর
تفسير سورة التوبة

< بنغالي >
            
আবুল ফিদা ইসমা‘ঈল ইবন ওমর ইবন কাসীর





অনুবাদক: জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
 

تفسير سورة التوبة

        

أبو الفداء إسماعيل بن عمر بن كثير




ترجمة: ذاكرالله أبوالخير
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

 

 

সূচিপত্র

ক্রম    বিষয়    পৃষ্ঠা
1.        মুশরিকদের প্রতি সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা    
2.        কাফির নেতৃবৃন্দের নিকট শপথ বলে কিছু নেই    
3.        মুশরিকরা আল্লাহ তা‘আলার মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণকারী সেবক হবে না    
4.        মুমিনগণ মসজিদসমূহের রক্ষণাবেক্ষণকারী সেবক হবে    
5.        মুশরিকদের বন্ধুত্ব পরিত্যাগের নির্দেশ যদিও তারা নিকটাত্মীয় হয়    
6.        গায়েবী সাহায্যের উপরে বিজয়ের সীমাবদ্ধতা    
7.        হুনাইনের যুদ্ধের ঘটনা    
8.        মসজিদুল হারামে প্রবেশে মুশরিকদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ    
9.        জিযিয়া না দেওয়া পর্যন্ত আহলে কিতাবিদেরকে হত্যা করার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান    
10.        ইয়াহূদী-নাসারাদের শির্ক ও কুফরী, যা তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার কারণ    
11.        আহলে কিতাবগণ কর্তৃক ইসলামের আলোকে নিভিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা    
12.        দীন ইসলাম সকল ধর্মের উপরে বিজয়ী    
13.        নিকৃষ্ট ‘আলেম এবং পথভ্রষ্ট ইবাদত-কারীদের থেকে সতর্কীকরণ    
14.        মতামত প্রদানের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার শরী‘আতে নাক-গলানোর নিন্দা    
15.        জিহাদের ব্যাপারে অলসতা করার উপরে তিরস্কার ও হুঁশিয়ারী    
16.        মুনাফিক কর্তৃক রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যার পরিকল্পনা    
17.        মুহাজির ও আনসার এবং পরম নিষ্ঠার সাথে যারা তাদের অনুসরণ করে তাদের মর্যাদা    
18.        মসজিদে দ্বিরার (ক্ষতিসাধণের উদ্দেশ্যে বানান মসজিদ) আর যে মসজিদ তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত    
19.        মুশরিকদের জন্য দো‘আ করা নিষিদ্ধ    
20.        তাবুক যুদ্ধের বর্ণনা    
21.        মু’মিনের ঈমান বাড়ে ও কমে আর মুনাফিকদের সংশয় সন্দেহ বৃদ্ধি পায়    

ভূমিকা

﴿بَرَآءَةٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦٓ إِلَى ٱلَّذِينَ عَٰهَدتُّم مِّنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ١ فَسِيحُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ أَرۡبَعَةَ أَشۡهُرٖ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّكُمۡ غَيۡرُ مُعۡجِزِي ٱللَّهِ وَأَنَّ ٱللَّهَ مُخۡزِي ٱلۡكَٰفِرِينَ ٢﴾ ]التوبة: ١،  ٢[
“১. মুশরিকদের মধ্যে যাদের সঙ্গে তোমরা সন্ধিচুক্তি করেছিলে, তাদের সাথে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ হতে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেওয়া হল। ২. অতঃপর (হে কাফিরগণ!) চার মাস তোমরা জমিনে (ইচ্ছেমত) চলাফেরা করে নাও; আর জেনে রেখ যে, তোমরা আল্লাহকে অপারগ করতে পারবে না। আর নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদের লাঞ্ছিতকারী।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১-২]
এই সম্মানিত সূরাটি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর শেষ দিকে অবতীর্ণ হওয়া সূরাগুলোর অন্যতম একটি সূরা। ইমাম বুখারী বর্ণনা করেন, বারা‘ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: সর্বশেষ যে আয়াত অবতীর্ণ হয় তা হচ্ছে:
﴿يَسۡتَفۡتُونَكَ قُلِ ٱللَّهُ يُفۡتِيكُمۡ فِي ٱلۡكَلَٰلَةِۚ ١٧٦﴾] النساء : ١٧٦[
“লোকেরা তোমার কাছে ফতওয়া জিজ্ঞেস করছে; বল, আল্লাহ তোমাদেরকে পিতা-মাতাহীন নিঃসন্তান ব্যক্তি সম্পর্কে ফতওয়া দিচ্ছেন।” [সূরা আন-নিসা: ১৭৬]
আর সর্বশেষ যে সূরা অবতীর্ণ হয় তা হচ্ছে সূরা ‌আল-বারা’আহ (অর্থাৎ সূরা তাওবাহ)। এ সূরার প্রথমে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম’ বলা হয় নি। কেননা, সাহাবীগণ সংগৃহীত কুরআনের পূর্ণাঙ্গ কপিতে তাঁরা এটা লিপিবদ্ধ করেন নি। এক্ষেত্রে তাঁরা উসমান ইবনু আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর অনুসরণ করেন। এই সম্মানিত সূরার প্রথম দিকের অংশ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপরে এমন সময় অবতীর্ণ হয় যখন তিনি তাবুকের অভিযান থেকে ফিরছিলেন। আর তাঁরা হজের মওসুমে ছিলেন, যে হজ পালন করতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনস্থ হন। কিন্তু তাঁকে জানানো হয় যে, মুশরিকরা তাদের অভ্যাসবশত এই বছরও হজে হাজির হবে আর উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে। ফলে তিনি তাদের সাথে মিশে যাওয়াকে অপছন্দ করেন। তাই এ বৎসর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে হজের নেতা নিযুক্ত করে মক্কায় প্রেরণ করেন। যাতে তিনি হজের আচারানুষ্ঠানগুলো লোকদেরকে দেখিয়ে দেন আর মুশরিদেরকে জানিয়ে দেন যে, তারা এ বৎসরের পরে আর হজ করবে না এবং লোকদের মাঝে এ কথার ঘোষণা দেন- بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ “আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ হতে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেওয়া হল।”
এরপর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন মক্কায় চলে আসেন তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেন; যাতে করে তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে (আরেকবার এ ঘোষণা) প্রচার করে দেন। কেননা তিনি ছিলেন তাঁর চাচাত ভাই। এর বর্ণনা শীঘ্রই আসছে।
মুশরিকদের প্রতি সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ “আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ হতে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেওয়া হল” অর্থাৎ এই ঘোষণা হচ্ছে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সকল প্রকার দায়িত্ব আদায়ের বাধ্য-বাধকতার ক্ষেত্রে স্বাধীনতার ঘোষণা।
إِلَى ٱلَّذِينَ عَٰهَدتُّم مِّنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ “মুশরিকদের মধ্যেকার যাদের সঙ্গে তোমরা সন্ধি চুক্তি করেছিলে তাদের সাথে।”
২. অতঃপর [(হে কাফিরগণ!] চার মাস তোমরা জমিনে (ইচ্ছেমত) চলাফেরা করে নাও] এই আয়াতে ঐ সমস্ত কাফেরদের কথা বলা হয়েছে, যাদের সাথে অনির্দিষ্ট মেয়াদের চুক্তি রয়েছে অথবা যাদের সাথে চার বছরের কম মেয়াদের চুক্তি রয়েছে। এরপর তাদের চার বৎসর পূর্ণ হয়ে গেছে, কাজেই যাদের সাথে নির্দিষ্ট মেয়াদের চুক্তি রয়েছে তাদের সময় হচ্ছে এর নির্ধারিত সময় পর্যন্ত যে অবস্থায় তা থাকুক না কেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿فَأَتِمُّوٓاْ إِلَيۡهِمۡ عَهۡدَهُمۡ إِلَىٰ مُدَّتِهِمۡۚ﴾ [التوبة: ٤]  “তাদের সাথে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ কর” [সূরা আত-তাওবাহ: ৪] কেননা অচিরেই হাদিসে আসছে: “আর যার মাঝে এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাঝে চুক্তি রয়েছে তার চুক্তি কার্যকরী থাকবে এর নির্ধারিত সময় পর্যন্ত।” আল-কালবী, মুহাম্মদ ইবনু কা‘আব আল কুরাযী এবং অন্যান্যদের থেকেও এ হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
আবু মা‘শার আল-মাদানি বলেন: হাদিসটি আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদ ইবনু কা‘আব আল কুরাযী এবং অন্যান্যরা। তাঁরা বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবম হিজরি সনে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে হজের আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য প্রেরণ করেন। আর সূরা ‌আল-বারা’আতের ত্রিশটি অথবা চল্লিশটি আয়াত সহকারে আলী ইবনু আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রেরণ করেন। তিনি এগুলো লোকদের সম্মুখে পাঠ করে শোনান। আর তিনি মুশরিকদেরকে চার মাস সময় দেন, যে সময় তারা স্বাধীনভাবে জমিনে বিচরণ করতে পারবে। তিনি তাদের সম্মুখে আরাফার দিন এ আয়াতগুলো পাঠ করেন। যিলহজ মাসের বিশ দিন, মুহাররাম, সফর, রবিউল আউওয়াল এবং রবিউল আখিরের দশ দিন অবকাশ দান করেন। তিনি তাদের আবাসস্থলগুলো গিয়ে ঘোষণা দেন যে, এই বৎসরের পরে কোনো মুশরিক হজ করবে না আর উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَأَذَٰنٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦٓ إِلَى ٱلنَّاسِ يَوۡمَ ٱلۡحَجِّ ٱلۡأَكۡبَرِ أَنَّ ٱللَّهَ بَرِيٓءٞ مِّنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ وَرَسُولُهُۥۚ فَإِن تُبۡتُمۡ فَهُوَ خَيۡرٞ لَّكُمۡۖ وَإِن تَوَلَّيۡتُمۡ فَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّكُمۡ غَيۡرُ مُعۡجِزِي ٱللَّهِۗ وَبَشِّرِ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ ٣ ﴾ [التوبة: ٣]
“৩. আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ হতে মহান হজের দিনে মানুষদের কাছে ঘোষণা দেওয়া হল যে, আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের সাথে সম্পর্কহীন এবং তাঁর রাসূলও। কাজেই এখন যদি তোমরা তাওবাহ কর, তাতে তোমাদেরই ভালো হবে, আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে জেনে রেখ যে, তোমরা আল্লাহকে অপারগ করতে পারবে না। আর যারা কুফুরি করে চলেছে তাদেরকে ভয়াবহ শাস্তির সু-সংবাদ শুনিয়ে দাও।” ]সূরা আত-তাওবাহ্: ৩[
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: وَأَذَٰنٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦٓ “আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ হতে ঘোষণা, প্রাথমিক সতর্কীকরণ”
يَوۡمَ ٱلۡحَجِّ ٱلۡأَكۡبَرِ (মহান হজের দিনে) সেটা হচ্ছে কুরবানির দিন, যা হজের আচার-অনুষ্ঠানের সর্বোত্তম ও স্পষ্ট দিন। যাতে সবচেয়ে বড় জমায়েত হয়ে থাকে। أَنَّ ٱللَّهَ بَرِيٓءٞ مِّنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ وَرَسُولُهُۥ (আল্লাহ মুশরিকদের সাথে সম্পর্কহীন এবং তাঁর রাসূলও) অর্থাৎ তাদের থেকেও দায়মুক্ত। এরপর তিনি তাদেরকে তাঁর নিকট অনুশোচনার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন: فَإِن تُبۡتُمۡ (কাজেই এখন যদি তোমরা তাওবাহ কর) অর্থাৎ তোমরা যে শির্ক ও গোমরাহির মধ্যে রয়েছ তা হতে যদি তোমরা তাওবা কর فَهُوَ خَيۡرٞ لَّكُمۡۖ وَإِن تَوَلَّيۡتُمۡ (তাতে তোমাদেরই ভালো হবে। আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও) অর্থাৎ তোমরা যাতে রয়েছ তাতে নিরবচ্ছিন্ন থাক فَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّكُمۡ غَيۡرُ مُعۡجِزِي ٱللَّهِۗ  (তাহলে জেনে রেখ যে, তোমরা আল্লাহকে অপারগ করতে পারবে না); বরং তিনি তোমাদের উপরে ক্ষমতাবান, তোমরা তাঁর কব্জায়, তাঁর দমন ও ইচ্ছার অধীনে রয়েছ। وَبَشِّرِ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ (আর যারা কুফরি করে চলেছে তাদেরকে ভয়াবহ শাস্তির সু-সংবাদ শুনিয়ে দাও) অর্থাৎ দুনিয়াতে লাঞ্ছনা ও শাস্তির মাধ্যমে আর পরকালে শিকল ও বেড়ির শাস্তির দ্বারা।
ইমাম বুখারী বর্ণনা করেন, আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু আমাকে সে হজে সে সমস্ত ঘোষকদের অন্যতম করে প্রেরণ করেন, যাদেরকে তিনি কুরবানির দিন প্রেরণ করেন। তারা মিনায় এ ঘোষণা দেয়: এই বৎসরের পরে কোনো মুশরিক হজ করবে না এবং উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না। হুমাইদ বলেন: তারপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী ইবনু আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে বারা’আতের ঘোষণা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে প্রেরণ করেন। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আলী আমাদের সাথে কুরবানির দিন মিনায় অবস্থানকারীদের মাঝে মুশরিকদের থেকে দায়মুক্তির ঘোষণা দেন। আর এ ঘোষণাও দেন যে, এ বৎসরের পরে কোনো মুশরিক হজ করবে না আর উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করবে না।
ইমাম বুখারী আরও বর্ণনা করেন, আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু আমাকে কুরবানির দিন মিনায় প্রেরিত ঘোষকদের অন্যতম করে প্রেরণ করেন: এই বৎসরের পরে কোনো মুশরিক হজ করবে না, আর উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহর তাওয়াফও করবে না। কুরবানির দিনকে ‘হাজ্জিল আকবার’ বলা হয়। الأكبر এ জন্য বলা হয়েছে যে, লোকেরা একে আল-হাজ্জুল আসগার বলত। অতঃপর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু সে বৎসর লোকদেরকে বিমুক্তির ঘোষণা প্রদান করেন। ফলে বিদায় হজ, যাতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ করেন তাতে কোনো মুশরিক হজ করে নি। হাদিসের এ শব্দগুলো ইমাম বুখারীর যা তিনি কিতাবুল জিহাদে উল্লেখ করেছেন।
মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক রহ. আবু জা‘ফার মুহাম্মদ ইবনু আলী ইবনুল হুসাইন ইবনু আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন: তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপরে যখন সূরা আত- তাওবাহ অবতীর্ণ হয়, ইতোপূর্বে তিনি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু হজের অনুষ্ঠানাদির তত্ত্বাবধান করার জন্য প্রেরণ করেন। তখন বলা হয়: ইয়া রাসূলাল্লাহ, এ সংবাদ যদি আবু বকরের নিকট প্রেরণ করতেন! তখন তিনি বলেন: ‘এটা আমার পক্ষ থেকে কেবল আমার গৃহের কোনো লোক আদায় করবে।’ এরপর তিনি আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে ডেকে বলেন: সূরা আল-বারা’আতের এই প্রথম ভাগটি নিয়ে বের হয়ে পড় আর কুরবানির দিন লোকদের নিকট তা প্রচার করে দাও, যখন তারা মিনায় একত্রিত হয়। ‘কোনো কাফির জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এই বৎসরের পরে কোনো মুশরিক হজ করবে না, উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না, যার সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চুক্তি রয়েছে তার মেয়াদ হচ্ছে এর নির্ধারিত সময় পর্যন্ত।’ আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদ্ববা নামক উটের পিঠে চড়ে বের হয়ে পড়েন, এমনকি পথে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে পেয়ে যান। যখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে দেখেন তখন তিনি বলেন: আপনাকে কি নেতা করে পাঠানো হয়েছে নাকি অধীনস্থ করে? তিনি বলেন: বরং অধীনস্থ করে। এরপর তাঁরা চলতে থাকেন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু হজে লোকদের নেতৃত্ব দান করেন, সে বছর আরবরা তাদের সাধারণ স্থানগুলোতে অবস্থান করেছিল যাতে তারা জাহেলী যুগে অবস্থান করত। অবশেষে কুরবানির দিন আসলে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু উঠে দাঁড়ান আর লোকদের মাঝে সেই ঘোষণা প্রদান করেন যা তাকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন: হে লোক সকল, জান্নাতে কোনো কাফির প্রবেশ করবে না, এ বৎসরের পরে কোনো মুশরিক হজ করবে না, উলঙ্গ হয়ে কেউ বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না। আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে যার কোনো চুক্তি রয়েছে এর মেয়াদ হচ্ছে তার নির্ধারিত সময় পর্যন্ত। ফলে সে বৎসরের পরে কোনো মুশরিক হজ করে নি, উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে নি। এরপর তাঁরা (দু’জন) রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ফিরে আসে। এই হচ্ছে দায়মুক্তির ঘোষণা তাদের থেকে যারা অনির্ধারিত সময়ের চুক্তির অধিকারী মুশরিক এবং যে সমস্ত মুশরিক নির্ধারিত সময় পর্যন্ত চুক্তি করেছিল।
﴿ إِلَّا ٱلَّذِينَ عَٰهَدتُّم مِّنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ثُمَّ لَمۡ يَنقُصُوكُمۡ شَيۡ‍ٔٗا وَلَمۡ يُظَٰهِرُواْ عَلَيۡكُمۡ أَحَدٗا فَأَتِمُّوٓاْ إِلَيۡهِمۡ عَهۡدَهُمۡ إِلَىٰ مُدَّتِهِمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُتَّقِينَ ٤ ﴾ [التوبة:  ٤]
“৪. কিন্তু মুশরিকদের মধ্যে যারা তোমাদের সঙ্গে চুক্তি রক্ষার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে নি, আর তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্যও করে নি, তাদের সাথে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ কর। নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালোবাসেন।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ৪]
যার অঙ্গিকার রয়েছে কিন্তু সে তা ভঙ্গ করেনি তার মেয়াদ হচ্ছে এর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। এখানে ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে তাদেরকে যারা অনির্দিষ্ট মেয়াদে সাধারণভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে যা বর্ণিত চার মাস মেয়াদের বাইরে। তাদের মেয়াদ হচ্ছে চার মাস। তারা জমিনে বিচরণ করবে, তারা যেখানে খুশি নিজেদের বাঁচার উপায় খুঁজে নিবে। আর যারা নির্ধারিত মেয়াদে চুক্তি হয়েছে তাদের মেয়াদ সে পর্যন্ত যে মেয়াদের উপরে তারা চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ইতোপূর্বে বেশ কিছু হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে যার চুক্তি রয়েছে তার চুক্তির মেয়াদ এর নির্ধারিত সময় পর্যন্ত। তবে তা এ শর্তসাপেক্ষে যে, চুক্তিকারী তার চুক্তি ভঙ্গ করতে পারবে না। আর তারা মুসলিমবৃন্দের বিরুদ্ধে কাউকে সহযোগিতা করতে পারবে না, অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে অন্যদেরকে সাহায্য করতে পারবে না, যে তা করবে তার সাথে কৃত মুসলিমদের এ ধরণের শান্তি চুক্তি শেষ পর্যন্ত রক্ষিত হবে। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা এ ধরণের চুক্তি পূরণ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন: إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُتَّقِينَ “অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালোবাসেন।”
﴿فَإِذَا ٱنسَلَخَ ٱلۡأَشۡهُرُ ٱلۡحُرُمُ فَٱقۡتُلُواْ ٱلۡمُشۡرِكِينَ حَيۡثُ وَجَدتُّمُوهُمۡ وَخُذُوهُمۡ وَٱحۡصُرُوهُمۡ وَٱقۡعُدُواْ لَهُمۡ كُلَّ مَرۡصَدٖۚ فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُاْ ٱلزَّكَوٰةَ فَخَلُّواْ سَبِيلَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٥ ﴾ [التوبة: ٥]
“৫. তারপর (এই) নিষিদ্ধ মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলে মুশরিকদেরকে যেখানে পাবে হত্যা করবে, তাদেরকে পাকড়াও করবে, তাদেরকে ঘেরাও করবে, তাদের অপেক্ষায় প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওৎ পেতে বসে থাকবে। কিন্তু তারা যদি তাওবাহ করে, সলাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে, তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু্।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৫]
মুজাহিদ, আমর ইবনু শুআইব, মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক, কাতাদা, সুদ্দী, আব্দুর রহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম বলেন: আয়াতে উল্লিখিত চার মাস হচ্ছে পূর্বের আয়াতে বর্ণিত নির্দিষ্ট চার মাস,
 ﴿فَسِيحُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ أَرۡبَعَةَ أَشۡهُرٖ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّكُمۡ غَيۡرُ مُعۡجِزِي ٱللَّهِ وَأَنَّ ٱللَّهَ مُخۡزِي ٱلۡكَٰفِرِينَ ٢﴾ [التوبة: ٢]
“অতঃপর (হে কাফিরগণ!) চার মাস তোমরা জমিনে (ইচ্ছে মত) চলাফেরা করে নাও” [সূরা আত-তাওবাহ: ২] এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: فَإِذَا ٱنسَلَخَ ٱلۡأَشۡهُرُ ٱلۡحُرُمُ  “তারপর (এই) নিষিদ্ধ মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলে” অর্থাৎ চার মাস, যাতে আমরা তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে নিষিদ্ধ করেছি। আর যে নির্দিষ্ট সময় আমরা তাদেরকে প্রদান করেছি সেটা যখন শেষ হয়ে যায় তখন তাদেরকে যেখানে পাও সেখানেই হত্যা কর।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:فَٱقۡتُلُواْ ٱلۡمُشۡرِكِينَ حَيۡثُ وَجَدتُّمُوهُمۡ  “মুশরিকদেরকে যেখানে পাও হত্যা কর” অর্থাৎ জমিনে সার্বিকভাবে, তবে হারাম (মক্কার আশে-পাশের সুনির্দিষ্ট এলাকা) এলাকায় হত্যা নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে ব্যতিক্রম করা হয়েছে। আর তা এ আয়াতের মাধ্যমে
﴿وَلَا تُقَٰتِلُوهُمۡ عِندَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ حَتَّىٰ يُقَٰتِلُوكُمۡ فِيهِۖ فَإِن قَٰتَلُوكُمۡ فَٱقۡتُلُوهُمۡۗ ١٩١﴾ [البقرة: ١٩١]
“আর তোমরা মসজিদে হারামের নিকট তাদের সাথে যুদ্ধ করো না, যে পর্যন্ত তারা তোমাদের সাথে সেখানে যুদ্ধ করে। কিন্তু যদি তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তবে তোমরাও তাদের হত্যা কর।” [সূরা আল-বাকারা: ১৯১]
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَخُذُوهُمۡ “তাদেরকে পাকড়াও কর” অর্থাৎ তাদেরকে বন্দী কর, যদি তোমার ইচ্ছা হয়। তবে হত্যাও করতে পার। আর যদি তোমার ইচ্ছা হয় তবে বন্দী করতে পার।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَٱحۡصُرُوهُمۡ وَٱقۡعُدُواْ لَهُمۡ كُلَّ مَرۡصَدٖۚ  “তাদেরকে ঘেরাও কর, তাদের অপেক্ষায় প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওৎ পেতে বসে থাক” অর্থাৎ তোমরা তাদেরকে পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থেকো না। তাদেরকে তাদের এলাকায় এবং দুর্গসমূহে খোঁজ কর এবং অবরোধ কর, তাদেরকে তাদের পথে-ঘাটে এবং চলার স্থানসমূহে তোমাদের পর্যবেক্ষণে রাখ, তাদের জন্য সংকীর্ণতা আনয়ন কর, তাদেরকে হত্যা অথবা ইসলামের প্রতি বাধ্য কর। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُاْ ٱلزَّكَوٰةَ فَخَلُّواْ سَبِيلَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ “কিন্তু তারা যদি তাওবা করে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে, তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু।” এ কারণেই আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এই সম্মানিত আয়াত এবং এ ধরণের অন্যান্য আয়াতের উপরে নির্ভর করে যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কারণ এ আয়াতে কিছু কাজের শর্তে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে নিষিদ্ধ করা হয় তা হচ্ছে, ইসলামে প্রবেশ এবং এর আবশ্যকীয় বিষয়গুলো পালনে সচেষ্ট হওয়া। অবশ্য এ আয়াতে মহান আল্লাহ এ আবশ্যকীয় বিষয়গুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে এর নিচের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর পূর্বে উল্লেখ করেন, কারণ শাহাদাতাঈন অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসূল -এ দু’টি বিষয়ের সাক্ষ্যের পরে ইসলামের সবচেয়ে সম্মানিত রুকন (ভিত্তি) হচ্ছে সালাত, যা আল্লাহ তা‘আলার হক্ব। এরপরে হচ্ছে যাকাত আদায়, যা দরিদ্র ও অভাবী লোকদের জন্য চলমান উপকার। আর তা আল্লাহর সৃষ্টি (বান্দা)-এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবচেয়ে সম্মানিত কাজ। এ কারণে বহু স্থানে আল্লাহ তা‘আলা সালাতের সাথে সাথে যাকাতের আলোচনা করেছেন। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে: আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আমি লোকদের বিরুদ্ধে ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই করতে আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ না তারা এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল এবং তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত প্রদান করে।– আল-হাদীস।  
এই সম্মানিত আয়াতটি হচ্ছে তরবারির (জিহাদের) আয়াত যে সম্পর্কে দহ্হাক ইবনু মুযাহিম বলেন: এই আয়াতটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুশরিকদের মাঝে সংঘটিত যাবতীয় চুক্তিকে রহিত করে দিয়েছে। সকল চুক্তি এবং সকল মেয়াদকে রহিত করে দিয়েছেন।
আউফী বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: সূরা আল-বারা’আহ (সূরা আত-তাওবাহ) অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে কোনো মুশরিকের কোনো চুক্তি এবং কোনো অঙ্গিকার আর অবশিষ্ট নেই। হারাম মাসসমূহ অতিক্রান্ত হওয়া, সূরা আত-তাওবাহ অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে মুশরিকদের থেকে দায়মুক্তির নির্দেশের দিন থেকে রবিউল আখির মাসের প্রথম দশ দিন এই চার মাস।
﴿وَإِنۡ أَحَدٞ مِّنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ٱسۡتَجَارَكَ فَأَجِرۡهُ حَتَّىٰ يَسۡمَعَ كَلَٰمَ ٱللَّهِ ثُمَّ أَبۡلِغۡهُ مَأۡمَنَهُۥۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ قَوۡمٞ لَّا يَعۡلَمُونَ ٦ ﴾ [التوبة: ٦]
“৬. মুশরিকদের কেউ যদি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে তবে তাকে আশ্রয় দাও যাতে সে আল্লাহর বাণী শোনার সুযোগ পায়; তারপর তাকে তার নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দাও। এটা এজন্য করতে হবে যে, এরা এমন এক সম্প্রদায় যারা (ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা সম্পর্কে) অজ্ঞ।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৬]
মুশরিক যখন নিরাপত্তা কামনা করে তখন তাকে নিরাপত্তা দিতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলেন:وَإِنۡ أَحَدٞ مِّنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ  “ মুশরিকদের কেউ যদি” অর্থাৎ যাদেরকে হত্যা করার ব্যাপারে তোমার প্রতি নির্দেশ দিয়েছি আর যাদের জান-মাল তোমার জন্য বৈধ করেছি, তাদের কেউ যদি ٱسۡتَجَارَكَ “তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে” অর্থাৎ তোমার নিকট নিরাপত্তা চায়, তবে তাদের আবেদনে সাড়া দাও। যাতে সে আল্লাহর বাণী শোনার সুযোগ পায় অর্থাৎ তার সম্মুখে কুরআন পাঠ কর এবং দ্বীনের কিছু অংশ বর্ণনা কর, যাতে করে তার বিরুদ্ধে তুমি আল্লাহর দলীল প্রতিষ্ঠা করতে পার। ثُمَّ أَبۡلِغۡهُ مَأۡمَنَهُۥ “তারপর তাকে তার নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দাও” অর্থাৎ তার দেশে, তার ঘরে ও তার নিরাপ্দ স্থানে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত সে নিরাপদ থাকবে ও নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তা পাবে।
ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ قَوۡمٞ لَّا يَعۡلَمُونَ “এটা এ জন্য করতে হবে যে, এরা এমন এক সম্প্রদায় যারা (ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা সম্পর্কে) অজ্ঞ।” এ ধরণের লোকদের জন্য আমরা নিরাপত্তার বিধান দিয়েছি যাতে করে তারা আল্লাহ তা‘আলার দ্বীনকে জানতে পারে আর আল্লাহ তা‘আলার দা‘ওয়াত তাঁর বান্দাদের মাঝে বিস্তার লাভ করে।
ইবনু আবু নাজীহ বর্ণনা করেন, মুজাহিদ এই আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন: যে লোক তুমি কী বল এবং তোমার ওপরে কী অবতীর্ণ হয়েছে তা শোনার জন্য তোমার নিকট আসে, সে নিরাপদ, যখন সে তোমার নিকট তখন সে নিরাপদ, আল্লাহ তা‘আলার বাণী শ্রবণ করে, এরপর সে সেই এলাকার দিকে অগ্রসর হয়ে পৌঁছে যাবে যেখান থেকে সে এসেছিল।
এ আয়াতের দাবী অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ ব্যক্তিকে নিরাপত্তা দিতেন যে হিদায়াতের আশায় অথবা পত্র পৌঁছে দিতে তাঁর নিকট আসত। যেমন হুদাইবিয়ার সন্ধির দিন কুরাইশদের একদল দূত তাঁর নিকট আসে, তাদের মধ্যে ছিল উরওয়াহ ইবনু মাসঊদ, মিকরায ইবনু হাফ্স, সুহাইল ইবনু আমর এবং অন্যান্যরা। তারা তাঁর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং কুরাইশ কাফিরদের মাঝে মধ্যস্ততা করার জন্য একের পর এক আগমন করে। তারা প্রত্যক্ষ করে যে, সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অত্যন্ত ইজ্জত-সম্মান করছেন, যা তাদেরকে তাক লাগিয়ে দেয়। এ ধরনের ইজ্জত-সম্মান ইতোপূর্বে তারা আর কারও জন্য প্রত্যক্ষ করে নি। না কোনো রাজা-বাদশাহর জন্য দেখেছে আর না রোম সম্রাটের জন্য। এরপর তারা নিজেদের কাওমের নিকট ফিরে যায় আর এ ব্যাপারটি তাদেরকে অবহিত করে। এই ঘটনা এবং এ জাতীয় অন্যান্য ঘটনা ছিল তাদের অধিকাংশের হিদায়েত লাভের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় কারণ।
আর এ কারণেই মুসাইলামাতুল কায্যাবের দূত যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসে, তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে বলেন: তোমরা কি সাক্ষ্য দাও যে, মুসাইলামাহ আল্লাহর রাসূল? তারা বলে: হাঁ, তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: দূতকে হত্যার বিধান যদি থাকত, তবে আমি অবশ্যই তোমার গর্দান উড়িয়ে দিতাম। তবে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু কুফার গভর্নর থাকার সময়ে তার গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার জন্য লোক নিযুক্ত করেন। তাকে ইবনুন নাওয়াহাহ্ বলে ডাকা হত, যখন জানা যায় যে, সে মুসাইলামার রাসূলের দাবিতে তখনও অটল ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছিল, তখন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তার বিরুদ্ধে সমন জারি করে তাকে বলেন: তুমি এখন আর দূত নও। ফলে তাঁর নির্দেশে তার গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হয়। (তার উপরে আল্লাহ তা‘আলা দয়া না করুন, আর তার উপরে তাঁর অভিশাপ বর্ষিত হোক)।
এখানে যা উদ্দেশ্য তা হচ্ছে: যে ব্যক্তি বিধর্মী রাষ্ট্র থেকে ইসলামী রাষ্ট্রে আগমন করে বার্তাবাহক হিসেবে অথবা ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে অথবা সন্ধির আশায় অথবা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে অথবা যিযিয়া কর প্রদানের জন্য অথবা এ জাতীয় অন্যান্য কারণে, আর সে রাষ্ট্রের নেতা অথবা তার সহকারীর নিকট নিরাপত্তা কামনা করে তখন কর্তব্য হচ্ছে যতক্ষণ সে ইসলামী রাষ্ট্রে অবস্থান করে এবং যতক্ষণ না সে তার নিরাপদ ভূমি ও স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে ততক্ষণ তাকে নিরাপত্তা দেওয়া।
﴿كَيۡفَ يَكُونُ لِلۡمُشۡرِكِينَ عَهۡدٌ عِندَ ٱللَّهِ وَعِندَ رَسُولِهِۦٓ إِلَّا ٱلَّذِينَ عَٰهَدتُّمۡ عِندَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِۖ فَمَا ٱسۡتَقَٰمُواْ لَكُمۡ فَٱسۡتَقِيمُواْ لَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُتَّقِينَ ٧ ﴾ [التوبة: ٧]
“৭. আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সঙ্গে মুশরিকদের চুক্তি কি করে কার্যকর থাকতে পারে? অবশ্য ঐসব লোক ছাড়া যাদের সঙ্গে তোমরা মসজিদুল হারামের নিকট চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলে; তারা যদ্দিন তোমাদের সঙ্গে চুক্তি ঠিক রাখে, তোমরাও তাদের সঙ্গে কৃত চুক্তিতে দৃঢ় থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালোবাসেন।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ৭]
মুশরিকদের থেকে দায়মুক্তির বিষয়টির প্রতি জোর প্রদান:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রজ্ঞার বর্ণনা দিচ্ছেন মুশরিকদের থেকে দায়মুক্তির এবং তাদেরকে চার মাস অবকাশ প্রদানের ব্যাপারে, এরপর তাদেরকে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানে ধারালো তরবারি (দ্বারা তাদেরকে হত্যা করা হবে)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: كَيۡفَ يَكُونُ لِلۡمُشۡرِكِينَ عَهۡدٌ“আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সঙ্গে মুশরিকদের চুক্তি কী করে কার্যকর থাকতে পারে?” অর্থাৎ নিরাপদ স্থান- তারা যে অবস্থায় রয়েছে সে অবস্থায় তাদেরকে কীভাবে ছেড়ে দেওয়া হবে? যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে অংশীদার স্থাপন করছে, তাঁকে এবং তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করছে।
إِلَّا ٱلَّذِينَ عَٰهَدتُّمۡ عِندَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِۖ “ঐসব লোক ছাড়া যাদের সঙ্গে তোমরা মসজিদুল হারামের নিকট চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলে।” অর্থাৎ হুদাইবিয়ার দিন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿هُمُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ وَصَدُّوكُمۡ عَنِ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ وَٱلۡهَدۡيَ مَعۡكُوفًا أَن يَبۡلُغَ مَحِلَّهُۥۚ ٢٥﴾ [الفتح: ٢٥] “এরা তো তারাই যারা কুফুরী করেছিল আর তোমাদেরকে মসজিদুল হারাম থেকে বাধা দিয়েছিল। বাধা দিয়েছিল হাদঈর পশুগুলোকে তার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে।” [সূরা আল-ফাতাহ্: ২৫] فَمَا ٱسۡتَقَٰمُواْ لَكُمۡ فَٱسۡتَقِيمُواْ لَهُمۡۚ “সুতরাং তারা যদ্দিন তোমাদের সঙ্গে চুক্তি ঠিক রাখে, তোমরাও তাদের সঙ্গে কৃত চুক্তিতে দৃঢ় থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালোবাসেন।” যে পর্যন্ত তারা তোমাদের সঙ্গে কৃত অঙ্গিকার রক্ষা করে এবং এ মর্মে অঙ্গিকার পূর্ণ করে যে, তারা দশ বৎসর যুদ্ধ করবে না فَٱسۡتَقِيمُواْ لَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُتَّقِينَ “তোমরাও তাদের সঙ্গে কৃত চুক্তিতে দৃঢ় থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালোবাসেন” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুসলিমবৃন্দ তা-ই সম্পাদন করেন। ষষ্ঠ হিজরি সনের যিলকদ মাস থেকে শুরু হওয়া মক্কাবাসীদের সাথে কৃত চুক্তি সে পর্যন্ত বহাল থাকে যে পর্যন্ত কুরাইশরা অঙ্গিকার ভঙ্গ করে। আর তাদের মিত্র বানু বাকরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মিত্র খুঁজা’আহর বিরুদ্ধে চক্রান্তে সাহায্য করে। এমনকি তারা হারামে (পবিত্র এলাকায়) তাদের সাথে যুদ্ধ করে। ফলে সে সময় অষ্টম হিজরি সনে রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে পবিত্র নগরীর বিজয় দান এবং তাদের উপরে কর্তৃত্ব প্রদান করেন। (আল্লাহ তা‘আলার জন্য সকল প্রশংসা এবং তাঁরই অনুগ্রহ)। তাদের মধ্যে যারা পরাজিত হওয়ার পরে ঈমান আনে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে ছেড়ে দেন আর তাদের তুলাকা’ (মুক্ত) বলে আখ্যায়িত করেন। তারা ছিল দুই হাজারের কাছাকাছি। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা কুফরির উপরে নিরবচ্ছিন্ন থাকে এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পলায়ন করে। তিনি তাদেরকে চার মাস জমিনে নিরাপত্তা ও সহজ সাবলীলভাবে বিচরণের অঙ্গিকার প্রদান করেন। যেখানে খুশি তারা যেতে পারে। তাদের মধ্যে ছিল সাফওয়ান ইবনু উমাইইয়া, ইকরিমা ইবনু আবু জাহাল এবং অন্যান্যরা। এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পরিপূর্ণ ইসলাম পালনের প্রতি পথ প্রদর্শন করেন। (আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সকল ফায়সালা এবং কর্মকাণ্ডের জন্য প্রশংসিত)।
﴿كَيۡفَ وَإِن يَظۡهَرُواْ عَلَيۡكُمۡ لَا يَرۡقُبُواْ فِيكُمۡ إِلّٗا وَلَا ذِمَّةٗۚ يُرۡضُونَكُم بِأَفۡوَٰهِهِمۡ وَتَأۡبَىٰ قُلُوبُهُمۡ وَأَكۡثَرُهُمۡ فَٰسِقُونَ ٨﴾ [التوبة: ٨]
“৮. কিভাবে (চুক্তি থাকতে পারে) যদি তারা তোমাদেরকে পরাজিত করতে পারে তাহলে তারা তোমাদের সঙ্গে না আত্মীয়তার মর্যাদা দেয়, আর না ওয়াদা-অঙ্গীকারের; তারা তাদের মুখের কথায় তোমাদেরকে সন্তুষ্ট রাখতে চায় কিন্তু তাদের অন্তর তা অস্বীকার করে, তাদের অধিকাংশই ফাসিক।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ৮]
আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণকে মুশরিকদের প্রতি দুশমনি এবং তাদের থেকে দায়মুক্তির ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করছেন। আর বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তাদের সাথে কোনো প্রকার চুক্তি হতে পারে তারা এর যোগ্য নয়। কেননা তারা তো আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করে এবং তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করে। এ সমস্ত কাফিররা যদি মুসলিমবৃন্দকে পরাজিত করার সুযোগ পায়, তবে তারা তাদের বিরাট ক্ষতিসাধন করে। তারা তাদের অনিষ্ট না করে ছাড়ে না। তারা আত্মীয়তার বন্ধনের তোয়াক্কা করে না আর তাদের শপথের পবিত্রতাও রক্ষা করে না।
আলী ইবনু আবু তালহা, ইকরিমা এবং আউফী বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: ۡ إِلّٗاশব্দের অর্থ হচ্ছে রক্তের সম্পর্ক, আর الذمة শব্দের অর্থ হচ্ছে অঙ্গিকার। দাহ্হাক এবং সুদ্দীও অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন।
﴿ٱشۡتَرَوۡاْ بِ‍َٔايَٰتِ ٱللَّهِ ثَمَنٗا قَلِيلٗا فَصَدُّواْ عَن سَبِيلِهِۦٓۚ إِنَّهُمۡ سَآءَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٩ لَا يَرۡقُبُونَ فِي مُؤۡمِنٍ إِلّٗا وَلَا ذِمَّةٗۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُعۡتَدُونَ ١٠ فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُاْ ٱلزَّكَوٰةَ فَإِخۡوَٰنُكُمۡ فِي ٱلدِّينِۗ وَنُفَصِّلُ ٱلۡأٓيَٰتِ لِقَوۡمٖ يَعۡلَمُونَ ١١ ﴾ [التوبة: ٩،  ١١]  
“৯. আল্লাহর আয়াতকে তারা (দুনিয়াবি স্বার্থে) অতি তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করে দিয়েছে, ফলে তারা আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তারা যা করে কতই না জঘন্য সে কাজ। ১০. কোনো ঈমানদার ব্যক্তির ব্যাপারে তারা না কোনো আত্মীয়তার মর্যাদা দেয়, আর না কোনো ওয়াদা-অঙ্গীকারের। এরা সেই লোক যারা সীমালঙ্ঘনকারী। ১১. এখন যদি তারা তাওবাহ করে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই। জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের জন্য আমি স্পষ্ট করে নিদর্শন বলে দিলাম।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ৯-১১]
আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের নিন্দা জানিয়ে এবং মুমিনগণকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে অনুপ্রেরণা প্রদান করে বলেন: ٱشۡتَرَوۡاْ بِ‍َٔايَٰتِ ٱللَّهِ ثَمَنٗا قَلِيلٗ “আল্লাহর আয়াতকে তারা (দুনিয়াবি স্বার্থে) অতি তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করে দিয়েছে। অর্থাৎ মুশরিকরা দুনিয়ার নিকৃষ্ট বিষয়াদিতে ডুবে থাকার সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহের অনুসরণ না করে এর বিরোধিতায় লিপ্ত রয়েছে। فَصَدُّواْ عَن سَبِيلِهِۦ (আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে) অর্থাৎ তারা মুমিনগণকে সত্যের অনুসরণ করার ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করেছে  إِنَّهُمۡ سَآءَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٩ لَا يَرۡقُبُونَ فِي مُؤۡمِنٍ إِلّٗا وَلَا ذِمَّةٗۚ “তারা যা করে কতই না জঘন্য সে কাজ। ১০. কোনো ঈমানদার ব্যক্তির ব্যাপারে তারা না কোনো আত্মীয়তার মর্যাদা দেয়, আর না কোনো ওয়াদা-অঙ্গীকারের।” এ আয়াত এবং পরবর্তী আয়াতের তাফসীর ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।  فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ “এখন যদি তারা তাওবাহ করে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে” এই আয়াতের শেষ পর্যন্ত আগে বর্ণিত হয়েছে।
﴿وَإِن نَّكَثُوٓاْ أَيۡمَٰنَهُم مِّنۢ بَعۡدِ عَهۡدِهِمۡ وَطَعَنُواْ فِي دِينِكُمۡ فَقَٰتِلُوٓاْ أَئِمَّةَ ٱلۡكُفۡرِ إِنَّهُمۡ لَآ أَيۡمَٰنَ لَهُمۡ لَعَلَّهُمۡ يَنتَهُونَ ١٢﴾ [التوبة: ١٢]
“১২. তারা যদি চুক্তি করার পর তাদের শপথ ভঙ্গ করে আর তোমাদের দীনের বিরুদ্ধে কটূক্তি করে, তাহলে কাফিরদের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে লড়াই কর, শপথ বলে কোনো জিনিস তাদের কাছে নেই, (কাজেই শক্তি প্রয়োগ কর) যাতে তারা (শয়তানী কার্যকলাপ থেকে) নিবৃত্ত হয়।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ১২]
কাফির নেতৃবৃন্দের নিকট শপথ বলে কিছু নেই:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: নির্দিষ্ট মেয়াদের উপরে যে সমস্ত মুশরিকদের সাথে তোমরা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছ, তারা যদি তা أَيْمَانَهُمْ “তাদের শপথ” ভঙ্গ করে। অর্থাৎ তাদের অঙ্গিকার ও চুক্তিসমূহ وَطَعَنُوا فِي دِينِكُمْ “আর তোমাদের দীনের বিরুদ্ধে কটূক্তি করে” অর্থাৎ বৈরী ভাব প্রকাশ করে এবং খুঁত সন্ধান করে। এ আয়াত থেকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালি প্রদানকারী ব্যক্তিকে হত্যা করার দলীল গৃহীত হয়েছে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি দ্বীন ইসলামে আঘাত করে অথবা এর দোষত্রুটি রয়েছে বলে আলোচনা করে। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: فَقَٰتِلُوٓاْ أَئِمَّةَ ٱلۡكُفۡرِ إِنَّهُمۡ لَآ أَيۡمَٰنَ لَهُمۡ لَعَلَّهُمۡ يَنتَهُونَ “তাহলে কাফিরদের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে লড়াই কর। শপথ বলে কোনো জিনিস তাদের কাছে নেই, (কাজেই শক্তি প্রয়োগ কর) যাতে তারা (শয়তানী কার্যকলাপ থেকে) নিবৃত্ত হয়। অর্থাৎ যাতে তারা যে কুফরি, একগুঁয়েমি এবং গোমরাহির মধ্যে লিপ্ত রয়েছে তা থেকে ফিরে আসে।
কাতাদা এবং অন্যান্যরা বলেন: কাফির নেতৃবৃন্দ হচ্ছে: আবু জাহাল, উৎবা, শায়বা, উমাইইয়া ইবনু খালফ। তিনি আরও কিছু লোকের নাম উল্লেখ করেন। আ‘মাশ বর্ণনা করেন, যাইদ ইবনু ওয়াহাব বলেন, হুযাইফা বলেছেন: এ আয়াতে উল্লেখিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আর কখনই যুদ্ধ করা হয় নি। আলী ইবনু আবু তালিব থেকে অনুরূপ বর্ণনা বর্ণিত হয়েছে। তবে সঠিক কথা হচ্ছে: এই আয়াতটি সাধারণভাবে সকলকে শামিল করে; যদিও এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট কুরাইশ কাফেররা। তবে সেটা তাদেরকে এবং অন্যান্যদেরকে শামিল করে। (আল্লাহ ভালো জানেন)। ওয়ালিদ ইবনু মুসলিম বলেন: হাদিস বর্ণনা করেছেন আমাদের নিকট সাফওয়ান ইবনু আমর, (তিনি) আব্দুর রহমান ইবনু জুবাইর ইবনু নুফাইর থেকে: আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন সিরিয়ার দিকে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন, তখন তিনি তাদেরকে উপদেশ দেন: অচিরেই তোমরা একদল নেড়া মাথার লোক পাবে, তাদের মধ্য হতে শয়তানের দ্বারা আক্রান্ত অংশটি তরবারি দ্বারা আঘাত কর। আল্লাহ তা‘আলার শপথ, তাদের একজনকে হত্যা করা আমার নিকট অন্যদের সত্তর জনকে হত্যা করার চেয়ে অধিক প্রিয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন: فَقَٰتِلُوٓاْ أَئِمَّةَ ٱلۡكُفۡرِ “কাফিরদের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে লড়াই কর” ইবনু আবু হাতিম এ হাদিস বর্ণনা করেছেন।
﴿أَلَا تُقَٰتِلُونَ قَوۡمٗا نَّكَثُوٓاْ أَيۡمَٰنَهُمۡ وَهَمُّواْ بِإِخۡرَاجِ ٱلرَّسُولِ وَهُم بَدَءُوكُمۡ أَوَّلَ مَرَّةٍۚ أَتَخۡشَوۡنَهُمۡۚ فَٱللَّهُ أَحَقُّ أَن تَخۡشَوۡهُ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ١٣ قَٰتِلُوهُمۡ يُعَذِّبۡهُمُ ٱللَّهُ بِأَيۡدِيكُمۡ وَيُخۡزِهِمۡ وَيَنصُرۡكُمۡ عَلَيۡهِمۡ وَيَشۡفِ صُدُورَ قَوۡمٖ مُّؤۡمِنِينَ ١٤ وَيُذۡهِبۡ غَيۡظَ قُلُوبِهِمۡۗ وَيَتُوبُ ٱللَّهُ عَلَىٰ مَن يَشَآءُۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ ١٥ ﴾ [التوبة: ١٣،  ١٥]  
“১৩. তোমরা সেই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লড়াই কেন করবে না যারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে, যারা রাসূলকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল?। প্রথমে তারাই তোমাদেরকে আক্রমণ করেছিল। তোমরা কি তাদেরকে ভয় কর? তোমরা যাকে ভয় করবে তার সবচেয়ে বেশি হকদার হলেন আল্লাহ, যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাক। ১৪. তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর, তোমাদের হাত দিয়েই আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন, তাদেরকে অপমানিত করবেন, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে সাহায্য করবেন আর মু’মিনদের দিল ঠাণ্ডা করবেন। ১৫. তিনি তাদের মনের জ্বালা নিভিয়ে দিবেন, আল্লাহ যাকে চাইবেন তাওবাহ করার তাওফিক দিবেন, আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ১৩-১৫]
তাদেরকে হত্যা করার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান এবং এর কতিপয় উপকারিতা:
এখানেও ঐ সমস্ত মুশরিকরদেরকে হত্যা করার ব্যাপারে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেওয়া হয়েছে যারা অঙ্গিকার ভঙ্গকারী যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মক্কা থেকে বের করে দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করেছিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿وَإِذۡ يَمۡكُرُ بِكَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ لِيُثۡبِتُوكَ أَوۡ يَقۡتُلُوكَ أَوۡ يُخۡرِجُوكَۚ وَيَمۡكُرُونَ وَيَمۡكُرُ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَيۡرُ ٱلۡمَٰكِرِينَ ٣٠﴾ [الانفال: ٣٠] “স্মরণ কর, সেই সময়ের কথা যখন কাফিরগণ তোমাকে বন্দী করার কিংবা হত্যা করার কিংবা দেশ থেকে বের করে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করে। তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহও কৌশল করেন। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী।” [সূরা আল-আনফাল:৩০] আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿يُخۡرِجُونَ ٱلرَّسُولَ وَإِيَّاكُمۡ أَن تُؤۡمِنُواْ بِٱللَّهِ رَبِّكُمۡ ١﴾ [الممتحنة : ١] “তারা রাসূলকে আর তোমাদেরকে শুধু এ কারণে বের করে দিয়েছে যে, তোমরা তোমাদের রব আল্লাহকে বিশ্বাস কর।”(সূরা আল-মুতাহিনাহ: ১) আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿وَإِن كَادُواْ لَيَسۡتَفِزُّونَكَ مِنَ ٱلۡأَرۡضِ لِيُخۡرِجُوكَ مِنۡهَاۖ ٧٦ ﴾ [الاسراء: ٧٦] “তারা তোমাকে জমিন থেকে উৎখাত করতে চেয়েছিল যাতে তারা তোমাকে তাত্থেকে বের করে দিতে পারে।” [সূরা আল-ইসরা: ৭৬] আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَهُمْ بَدَءُوكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ “প্রথমে তারাই তোমাদেরকে আক্রমণ করেছিল” বলা হয়েছে এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে বদর যুদ্ধ। কুরাইশ কাফিররা তাদের বাণিজ্য কাফিলাকে সাহায্য করার জন্য বের হয়; কিন্তু যখন তারা জানতে পারে যে, বাণিজ্য কাফিলা (মুসলিমবৃন্দের হাত থেকে) বেঁচে গেছে, তার পরও তারা একগুঁয়েমিবশত মুসলিমবৃন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে সম্মুখে অগ্রসর হয়। এ সম্পর্কে ইতোপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন: এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে কুরাইশদের অঙ্গিকার ভঙ্গ এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মিত্র খুঁজা‘আর বিরুদ্ধে তাদের মিত্র বানূ বাকরকে যুদ্ধে সহযোগিতা প্রদান। অবশেষে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের বৎসর তাদের প্রতি অগ্রসর হন। আর যা হবার তাই হয়। (আল্লাহ তা‘আলার জন্য সকল প্রশংসা এবং তাঁরই অনুগ্রহ)। আল্লাহ তা‘আলার বাণী: أَتَخْشَوْنَهُمْ فَاللَّهُ أَحَقُّ أَنْ تَخْشَوْهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ “তোমরা কি তাদেরকে ভয় কর? তোমরা যাকে ভয় করবে তার সবচেয়ে বেশি হকদার হলেন, ‘আল্লাহ’ যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাক” আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তাদেরকে ভয় করো না, কেবল আমাকে ভয় কর, আমার ক্ষমতা এবং আমার শাস্তির কারণে আমিই এর যোগ্য যে, বান্দারা আমাকে ভয় পাবে। সকল কিছু আমার হাতে। আমি যা ইচ্ছা করি তাই হয় আর যা ইচ্ছ করি না তা হয় না। এরপর আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণকে নির্দেশ প্রদান করেন এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদের নির্দেশের হিকমত ব্যাখ্যা করেন। অথচ তিনি নিজের পক্ষ হতে নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে আপন শক্তিতে শত্রুদেরকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। قَٰتِلُوهُمۡ يُعَذِّبۡهُمُ ٱللَّهُ بِأَيۡدِيكُمۡ وَيُخۡزِهِمۡ وَيَنصُرۡكُمۡ عَلَيۡهِمۡ وَيَشۡفِ صُدُورَ قَوۡمٖ مُّؤۡمِنِينَ ١٤ “তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর, তোমাদের হাত দিয়েই আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন, তাদেরকে অপমানিত করবেন, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে সাহায্য করবেন আর মু’মিনদের দিল ঠাণ্ডা করবেন” এ আয়াতটি সকল মুমিনগণের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে বলা হয়েছে। মুজাহিদ, ইকরিমা, সুদ্দী وَيَشۡفِ صُدُورَ قَوۡمٖ مُّؤۡمِنِينَ “আর মু’মিনদের দিল ঠাণ্ডা করবেন” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: অর্থাৎ খুঁজা‘আহর وَيُذْهِبْ غَيْظَ قُلُوبِهِمْ “তিনি তাদের মনের জ্বালা নিভিয়ে দিবেন” এখানেও খুঁজা‘আহর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে وَيَتُوبُ اللَّهُ عَلَى مَنْ يَشَاءُ “আল্লাহ যাকে চাইবেন তাওবাহ করার তাওফিক দিবেন” অর্থাৎ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে। وَاللَّهُ عَلِيمٌ “আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ” অর্থাৎ সে সম্পর্কে কিসে তাঁর বান্দাদের কল্যান রয়েছে حَكِيمٌ “সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞাময়” তাঁর কর্মসমূহে এবং তার কথায়, চাই তা সৃষ্টিতত্বগত হোক অথবা আইন প্রণয়ন সম্বন্ধীয়, তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই হয়। তিনি যেমন খুশী ফায়সালা প্রদান করেন। তিনি হচ্ছেন ন্যায়বিচারক যিনি কখনও যুলুম করেন না। তিনি কণা পরিমাণও ভালো এবং মন্দ বিষয় নষ্ট করেন না; বরং তিনি দুনিয়া ও আখিরাতে এরই ভিত্তিতে প্রতিদান দিবেন।
﴿أَمۡ حَسِبۡتُمۡ أَن تُتۡرَكُواْ وَلَمَّا يَعۡلَمِ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ مِنكُمۡ وَلَمۡ يَتَّخِذُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ وَلَا رَسُولِهِۦ وَلَا ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَلِيجَةٗۚ وَٱللَّهُ خَبِيرُۢ بِمَا تَعۡمَلُونَ ١٦ ﴾ [التوبة: ١٦]
“১৬. তোমরা কি মনে কর যে, তোমাদেরকে এমনিই ছেড়ে দেওয়া হবে যে পর্যন্ত আল্লাহ জেনে না নেবেন তোমাদের মধ্যে কারা তাঁর পথে জিহাদ করেছে, আর আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করেন নি? তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ বিশেষভাবে অবহিত।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ১৬]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: أَمۡ حَسِبۡتُمۡ “তোমরা কি মনে কর” হে ঈমানদারগণ, যে, আমরা তোমাদেরকে অবহেলা করে ছেড়ে দিব আর এমন বিষয় দ্বারা তোমাদেরকে পরীক্ষা করব না যাতে প্রকাশিত হয় কে সত্যবাদী, দৃঢ় সঙ্কল্পের অধিকারী আর কে মিথ্যাবাদী? এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
وَلَمَّا يَعۡلَمِ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ مِنكُمۡ وَلَمۡ يَتَّخِذُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ وَلَا رَسُولِهِۦ وَلَا ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَلِيجَةٗۚ “যে পর্যন্ত আল্লাহ জেনে না নেবেন তোমাদের মধ্যে কারা তাঁর পথে জিহাদ করেছে, আর আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করেনি?” অর্থাৎ সমর্থক, বিশ্বস্ত বন্ধু (যার কাছে গোপন কথা বলা যায়); বরং তারা প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের জন্য আন্তরিক, আল্লাহ তা‘আলা উভয়দলের মধ্য হতে একদলের আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন (ফলে অন্য দলের আলোচনা করেননি)।
আল্লাহ তা‘আলা অপর এক আয়াতে বলেন:﴿الٓمٓ ١ أَحَسِبَ ٱلنَّاسُ أَن يُتۡرَكُوٓاْ أَن يَقُولُوٓاْ ءَامَنَّا وَهُمۡ لَا يُفۡتَنُونَ ٢ وَلَقَدۡ فَتَنَّا ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡۖ فَلَيَعۡلَمَنَّ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ صَدَقُواْ وَلَيَعۡلَمَنَّ ٱلۡكَٰذِبِينَ ٣ ﴾ [العنكبوت: ١، ٣] “আলিফ-লাম-মীম। লোকেরা কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে দেওয়া হবে, আর তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? তাদের পূর্বে যারা ছিল আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছিলাম। অতঃপর আল্লাহ অবশ্য অবশ্যই জেনে নেবেন কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যেবাদী।” (সূরা আল-‘আনকাবুত: ১-৩) আল্লাহ তা‘আলা বলেন:﴿ أَمۡ حَسِبۡتُمۡ أَن تَدۡخُلُواْ ٱلۡجَنَّةَ وَلَمَّا يَعۡلَمِ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ مِنكُمۡ وَيَعۡلَمَ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٤٢﴾ [ال عمران: ١٤٢] “তোমরা কি ভেবেছ যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ আল্লাহ এখনও পর্যন্ত পরখ করেন নি তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করেছে আর কারা ধৈর্যশীল।” [সূরা আলে ইমরান: ১৪২] আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿مَّا كَانَ ٱللَّهُ لِيَذَرَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ عَلَىٰ مَآ أَنتُمۡ عَلَيۡهِ حَتَّىٰ يَمِيزَ ٱلۡخَبِيثَ مِنَ ٱلطَّيِّبِۗ ١٧٩﴾ [ال عمران: ١٧٩] “অসৎকে সৎ থেকে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় আছ, আল্লাহ মু’মিনদেরকে সে অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না।” [সূরা আলে ইমরান: ১৭৯] সারকথা হচ্ছে: আল্লাহ তা‘আলা যখন তাঁর বান্দাদের জন্য জিহাদকে ফরয করেন তখন তিনি এ কথা অবহিত করেন যে, এতে তাঁর প্রজ্ঞা রয়েছে আর তিনি এর দ্বারা তাঁর বান্দাদেরকে পরীক্ষা করেন যে, কে তাঁর আনুগত্য করে আর কে তাঁর নাফরমান হয়। আর যা কিছু ঘটেছে আর যা কিছু ঘটবে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অবহিত রয়েছেন, (তিনি আরও জানেন) যা এখনও হয় নি আর যদি তা হয় তবে তা কিরূপে হবে (সে জ্ঞানও তাঁর রয়েছে)। তিনি যে কোন বিষয় সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই সে সম্পর্কে অবহিত রয়েছেন। আর কিরূপে তা ঘটবে তাও তিনি জানেন। তিনি ছাড়া প্রকৃত কোন উপাস্য নেই, তিনি ছাড়া কোনো রব নেই। এমন কেউ নেই যে আল্লাহ তা‘আলার ফায়সালা এবং তাঁর সিদ্ধান্তকে রোধ করতে পারে।
﴿مَا كَانَ لِلۡمُشۡرِكِينَ أَن يَعۡمُرُواْ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ شَٰهِدِينَ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِم بِٱلۡكُفۡرِۚ أُوْلَٰٓئِكَ حَبِطَتۡ أَعۡمَٰلُهُمۡ وَفِي ٱلنَّارِ هُمۡ خَٰلِدُونَ ١٧ إِنَّمَا يَعۡمُرُ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَأَقَامَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَى ٱلزَّكَوٰةَ وَلَمۡ يَخۡشَ إِلَّا ٱللَّهَۖ فَعَسَىٰٓ أُوْلَٰٓئِكَ أَن يَكُونُواْ مِنَ ٱلۡمُهۡتَدِينَ ١٨﴾ [التوبة: ١٧،  ١٨]
“১৭. মুশরিকদের এটা কাজ নয় যে, তারা আল্লাহর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণকারী সেবক হবে, যখন তারা নিজেরাই নিজেদের কুফরির সাক্ষ্য দেয়। তাদের সমস্ত কাজ বরবাদ হয়ে গেছে, জাহান্নামেই তারা হবে চিরস্থায়ী। ১৮. আল্লাহর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ তো তারাই করবে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান আনে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায়, তারাই হবে সঠিক পথ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ১৭-১৮]
মুশরিকরা আল্লাহ তা‘আলার মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণকারী সেবক হবে না:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: মুশরিকদের জন্য এটা শোভনীয় নয় যে, তারা কেবল আল্লাহ তা‘আলা যার কোনো শরীক নেই তার নামে প্রতিষ্ঠিত মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণকারী সেবক হবে। যারা مسجد الله পাঠ করেছেন তাঁরা এর দ্বারা উদ্দেশ্য নিয়েছেন মসজিদুল হারাম যা দুনিয়ার সবচেয়ে সম্মানিত মসজিদ, যা প্রথম দিন থেকে কেবল মহান আল্লাহ তা‘আলা, যার কোনো শরীক নেই, তার ইবাদতের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছে। এর ভিত্তি স্থাপন করেছেন আল্লাহর বন্ধু ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, এই (যখন এর প্রকৃত অবস্থা) অথচ মুশরিকরা নিজেদের অবস্থা ও কথাবার্তার মাধ্যমে নিজেদের কুফরির ঘোষণা প্রদান করে। সুদ্দী এ মত ব্যক্ত করেছেন। খৃষ্টানকে যদি তুমি জিজ্ঞেস কর যে, তোমার দীন কী? সে বলবে: (সে হচ্ছে) খৃষ্টান। ইয়াহূদীকে যদি জিজ্ঞেস কর যে, তোমার দীন কী: সে বলবে (সে হচ্ছে) ইয়াহূদী। সাবিয়ীকে যদি জিজ্ঞেস কর যে, তোমার দীন কী, সে বলবে যে, (সে হচ্ছে) সাবিয়ী। আর মুশরিককে জিজ্ঞেস করলে সে বলবে যে, (সে হচ্ছে) মুশরিক। أُوْلَٰٓئِكَ حَبِطَتۡ أَعۡمَٰلُهُمۡ “তাদের সমস্ত কাজ বরবাদ হয়ে গেছে” অর্থাৎ তাদের শির্কের কারণে وَفِي ٱلنَّارِ هُمۡ خَٰلِدُونَ (জাহান্নামেই তারা হবে চিরস্থায়ী) আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿وَمَا لَهُمۡ أَلَّا يُعَذِّبَهُمُ ٱللَّهُ وَهُمۡ يَصُدُّونَ عَنِ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ وَمَا كَانُوٓاْ أَوۡلِيَآءَهُۥٓۚ إِنۡ أَوۡلِيَآؤُهُۥٓ إِلَّا ٱلۡمُتَّقُونَ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ ٣٤﴾ [الانفال: ٣٤] “আল্লাহ যে তাদেরকে শাস্তি দিবেন না এ ব্যাপারে ওযর পেশ করার জন্য তাদের কাছে কী আছে যখন তারা (মানুষদেরকে) মসজিদুল হারাম-এর পথে বাধা দিচ্ছে? তারা তো ওর (প্রকৃত) মুতাওয়াল্লী নয়, মুত্তাকীরা ছাড়া কেউ তার মুতাওয়াল্লী হতে পারে না। কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোক এ সম্পর্কে অবগত নয়।” [সূরা আল-আনফাল: ৩৪]
মুমিনগণ মসজিদসমূহের রক্ষণাবেক্ষণকারী সেবক হবে:
এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: إِنَّمَا يَعۡمُرُ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ “আল্লাহর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ তো তারাই করবে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান আনে” আল্লাহ তা‘আলা মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণকারীর ঈমানের সাক্ষ্য দিচ্ছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: إِنَّمَا يَعۡمُرُ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ “আল্লাহর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ তো তারাই করবে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান আনে” তিরমিযী, ইবনু মারদুওয়াইহ এবং হাকিম তাঁর মুস্তাদরিকে এ হাদিস বর্ণনা করেছেন।
আব্দুর রাযযাক বর্ণনা করেন, আমর ইবনু মাইমূন আল-আউদী বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এমন কতিপয় সাহাবীর সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছে, যারা বলতেন: মসজিদসমূহ হচ্ছে জমিনে আল্লাহ তা‘আলার গৃহ আর আল্লাহ তা‘আলার অধিকার হচ্ছে যারা এই ঘরসমূহে আসে তাদেরকে তিনি সম্মান করবেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَأَقَامَ ٱلصَّلَوٰةَ “সালাত প্রতিষ্ঠা করে” অর্থাৎ যেটা দেহের সবচেয়ে বড় ইবাদত وَءَاتَى ٱلزَّكَوٰةَ “যাকাত আদায় করে” অর্থাৎ যেটা সবচেয়ে ভালো কাজ যা অন্যান্য লোকদেরকে উপকার করে। وَلَمۡ يَخۡشَ إِلَّا ٱللَّهَۖ “আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না” অর্থাৎ তারা কেবলমাত্র আল্লাহকে ভয় করে, তাঁকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। فَعَسَىٰٓ أُوْلَٰٓئِكَ أَن يَكُونُواْ مِنَ ٱلۡمُهۡتَدِينَ “আশা করা যায়, তারাই হবে সঠিক পথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত।” আলী ইবনু আবু তালহা বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ আয়াত-إِنَّمَا يَعۡمُرُ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ “আল্লাহর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ তো তারাই করবে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান আনে” সম্পর্কে বলেন: যে ব্যক্তি (ইবাদতে) আল্লাহ তা‘আলাকে এক জানে, সে আখেরাতের ওপর ঈমান আনয়ন করে। তিনি বলেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার অবতীর্ণ হওয়া وَأَقَامَ ٱلصَّلَوٰةَ “সালাত প্রতিষ্ঠা করে” এ আয়াতের প্রতি ঈমান আনে অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের প্রতি যত্নবান হয়, وَلَمۡ يَخۡشَ إِلَّا ٱللَّهَۖ “আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না” তিনি বলেন: সে কেবল আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে।
فَعَسَىٰٓ أُوْلَٰٓئِكَ أَن يَكُونُواْ مِنَ ٱلۡمُهۡتَدِينَ “নিশ্চিত যে, তারাই হবে সঠিক পথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত” আল্লাহ তা‘আলা বলেন: এ ধরণের লোকেরাই সফলকাম। (এখানে عَسَىٰٓ নিশ্চিত অর্থে, সন্দেহের অর্থে নয়) যেমন তাঁর নবীর জন্য তাঁর বাণী: ﴿عَسَىٰٓ أَن يَبۡعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامٗا مَّحۡمُودٗا ٧٩ ﴾ [الاسراء: ٧٩] “শীঘ্রই তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত স্থানে উন্নীত করবেন।” (সূরা আল-ইসরা: ৭৯) তিনি বলেন: তোমার রব তোমাকে জান্নাতের শ্রেষ্ঠতম প্রশংসিত স্থানে অধিষ্ঠিত করবেন অর্থাৎ শাফা‘আত করার স্থান প্রদান করবেন, কুরআনে যে স্থানেই عَسَىٰٓ কথাটি এসেছে সেটা হবেই-নিশ্চিত অর্থে।
﴿أَجَعَلۡتُمۡ سِقَايَةَ ٱلۡحَآجِّ وَعِمَارَةَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ كَمَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَجَٰهَدَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِۚ لَا يَسۡتَوُۥنَ عِندَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ١٩ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَهَاجَرُواْ وَجَٰهَدُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡ أَعۡظَمُ دَرَجَةً عِندَ ٱللَّهِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡفَآئِزُونَ ٢٠ يُبَشِّرُهُمۡ رَبُّهُم بِرَحۡمَةٖ مِّنۡهُ وَرِضۡوَٰنٖ وَجَنَّٰتٖ لَّهُمۡ فِيهَا نَعِيمٞ مُّقِيمٌ ٢١ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدًاۚ إِنَّ ٱللَّهَ عِندَهُۥٓ أَجۡرٌ عَظِيمٞ ٢٢ ﴾ [التوبة: ١٩،  ٢٢]
“১৯. হাজীদেরকে পানি পান করানো আর মসজিদে হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করাকে কি তোমরা তাদের কাজের সমান মনে কর যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের উপর বিশ্বাস করে আর আল্লাহর পথে জিহাদ করে? আল্লাহর দৃষ্টিতে এরা সমান নয়। (যারা ভ্রান্ত পথে আল্লাহর সন্তুষ্টি খুঁজে এমন) যালিম সম্প্রদায়কে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন না। ২০. যারা ঈমান আনে, হিজরত করে, আর নিজেদের জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে, আল্লাহর নিকট তাদের বিরাট মর্যাদা রয়েছে, এরাই হলো সফলকাম। ২১. তাদের রব তাদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছেন তাঁর দয়া ও সন্তুষ্টির, আর জান্নাতের যেখানে তাদের জন্য আছে স্থায়ী সুখ-সামগ্রী। ২২. যেখানে তারা চিরদিন থাকবে। আল্লাহর কাছেই তো রয়েছে মহা পুরস্কার।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ১৯-২২]
হাজীদেরকে পানি পান করানো আর মসজিদে হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করা ঈমান এবং জিহাদের সমান নয়,
আউফী তাঁর তাফসীরে বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এই আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন: মুশরিকরা বলে: আল্লাহর ঘরের রক্ষণাবেক্ষণকারী এবং হাজীদের পানি পান করায়, এমন ব্যক্তি মু’মিন ও জিহাদ কারীর চেয়ে উত্তম। তারা মসজিদুল হারাম নিয়ে গর্ব করত আর তারা এ নিয়ে এ জন্য অহংকার করত যে, তারা এই এলাকার বাসিন্দা এবং এর রক্ষণাবেক্ষণকারী। আল্লাহ তা‘আলা তাদের অহংকার এবং সত্যকে প্রত্যাখ্যানের কথা উল্লেখ করেন। তিনি মসজিদুল হারামের মুশরিক রক্ষণাবেক্ষণকারীদের উদ্দেশ্য করে বলেন: ﴿قَدۡ كَانَتۡ ءَايَٰتِي تُتۡلَىٰ عَلَيۡكُمۡ فَكُنتُمۡ عَلَىٰٓ أَعۡقَٰبِكُمۡ تَنكِصُونَ ٦٦ مُسۡتَكۡبِرِينَ بِهِۦ سَٰمِرٗا تَهۡجُرُونَ ٦٧﴾ [المؤمنون : ٦٦، ٦٧] “আমার আয়াত তোমাদের কাছে পড়ে শোনানো হত, কিন্তু তোমরা গোড়ালির ভরে পিছনে ঘুরে দাঁড়াতে। অহংকার বশতঃ (কুরআন) সম্পর্কে অর্থহীন কথা বলতে যেমন কেউ রাতে গল্প বলে।” [সুরা আল-মু’মিনুন: ৬৬-৬৭] অর্থাৎ তারা মসজিদুল হারাম নিয়ে গর্ববোধ করত। তিনি বলেন: بِهِ سَامِرًا “কেউ রাতে গল্প বলে” অর্থাৎ তারা রাতে গল্পগুজব করত আর কুরআন ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে অর্থহীন কথা বলত, ফলে আল্লাহ তা‘আলা ঈমানকে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে জিহাদ করাকে মুশরিকদের কর্তৃক বায়তুল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং হাজীদেরকে পানি পান করানোর চেয়ে উত্তম বলে ঘোষণা দেন। তাঁর সাথে শরীক স্থাপন করা অবস্থায় তাঁর ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং এর খেদমত করা তাদের কোনো উপকারে আসবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: لَا يَسۡتَوُۥنَ عِندَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ “আল্লাহর দৃষ্টিতে এরা সমান নয়। যালিম সম্প্রদায়কে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন না” অর্থাৎ যারা ধারণা করে যে, তারা রক্ষণাবেক্ষণকারী আল্লাহ তা‘আলা তাদের শির্কের কারণে তাদেরকে যালিম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, তাদের রক্ষণাবেক্ষণ তাদের কোনো উপকারে আসে নি।
আলী ইবনু আবু তালহা বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এবং আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে বলেন: এই আয়াত অবতীর্ণ হয় আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিব সম্পর্কে বদর যুদ্ধে যখন তিনি বন্দি হন তখন বলেন: যদি তোমরা আমাদের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করে থাক আর হিজরত ও জিহাদ কর তবে শুনে রাখ! আমরা মসজিদুল হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করতাম হাজীদেরকে পানি পান করাতাম, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের ঋণ মাফ করে দিতাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: أَجَعَلۡتُمۡ سِقَايَةَ ٱلۡحَآجِّ  “হাজীদেরকে পানি পান করানোকে কি করেছ” এখান থেকে لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ “যালিম সম্প্রদায়কে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন না” আয়াত পর্যন্ত। অর্থাৎ এ সবকিছু তাদের মুশরিক অবস্থায়, আর শির্ক লিপ্ত থাকা অবস্থায় আমি (আল্লাহ) কোনো আমল গ্রহণ করব না। দাহ্হাক ইবনু মুযাহিম বলেন: মুসলিমবৃন্দ আব্বাস এবং তাঁর সঙ্গি-সাথীদের নিকট আগমন করেন, যারা বদর যুদ্ধে বন্দী হয়েছিল আর তাদেরকে তাদের শির্কের জন্য তিরস্কার করেন। তখন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন: জেনে রাখ, আল্লাহর শপথ, আমরা মসজিদুল হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করতাম, ঋণগ্রস্তদের ঋণকে মাফ করতাম, বায়তুল্লাহয় গিলাফ চড়াতাম, হাজীদেরকে পানি পান করাতাম। তখন আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করেন:أَجَعَلۡتُمۡ سِقَايَةَ ٱلۡحَآجِّ  “হাজীদেরকে পানি পান করানোকে কি তোমরা সমান জ্ঞান করেছ।”
এ আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে মারফূ সূত্রে হাদিস বর্ণিত হয়েছে যা অবশ্যই এখানে উল্লেখযোগ্য। আব্দুর রাযযাক বর্ণনা করেন, নু‘মান ইবনু বাশীর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, জনৈক ব্যক্তি বলেন: ইসলাম গ্রহণের পরে হাজীদের পানি পান করানো ছাড়া আর যদি কোন কাজ না করি তবে তাতে আমার পরওয়া নেই। আরেকজন বলে: ইসলাম গ্রহণের পরে মসজিদুল হারামের রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া আর যদি কোনো কাজ না করি তবে তাতে আমার পরওয়া নেই। আরেকজন বলে: তোমরা যা বলছ তার চেয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা অধিক উত্তম। তখন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের ধমক দিয়ে বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মিম্বারের নিকট তোমরা উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলো না। আর সেদিন ছিল জুমু‘আর দিন। কিন্তু আমরা জুমু‘আর সালাত আদায় শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গিয়ে তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে (এ আয়াত) অবতীর্ণ হয়: أَجَعَلۡتُمۡ سِقَايَةَ ٱلۡحَآجِّ وَعِمَارَةَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ  “হাজীদেরকে পানি পান করানো আর মসজিদে হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করাকে কি তোমরা তাদের কাজের সমান মনে কর لَا يَسۡتَوُۥنَ عِندَ ٱللَّهِۗ “আল্লাহর দৃষ্টিতে এরা সমান নয়” এই পর্যন্ত।
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَتَّخِذُوٓاْ ءَابَآءَكُمۡ وَإِخۡوَٰنَكُمۡ أَوۡلِيَآءَ إِنِ ٱسۡتَحَبُّواْ ٱلۡكُفۡرَ عَلَى ٱلۡإِيمَٰنِۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمۡ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ٢٣ قُلۡ إِن كَانَ ءَابَآؤُكُمۡ وَأَبۡنَآؤُكُمۡ وَإِخۡوَٰنُكُمۡ وَأَزۡوَٰجُكُمۡ وَعَشِيرَتُكُمۡ وَأَمۡوَٰلٌ ٱقۡتَرَفۡتُمُوهَا وَتِجَٰرَةٞ تَخۡشَوۡنَ كَسَادَهَا وَمَسَٰكِنُ تَرۡضَوۡنَهَآ أَحَبَّ إِلَيۡكُم مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَجِهَادٖ فِي سَبِيلِهِۦ فَتَرَبَّصُواْ حَتَّىٰ يَأۡتِيَ ٱللَّهُ بِأَمۡرِهِۦۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡفَٰسِقِينَ ٢٤ ﴾ [التوبة: ٢٣،  ٢٤]
“২৩. হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের পিতা আর ভাইদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না যদি তারা ঈমানের চেয়ে কুফরিকেই বেশি ভালোবাসে। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই যালিম। ২৪. বল, ‘যদি তোমাদের পিতারা, আর তোমাদের সন্তানেরা, আর তোমাদের ভাইয়েরা, আর তোমাদের স্ত্রীরা, আর তোমাদের গোষ্ঠীর লোকেরা আর ধন-সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর ব্যবসা তোমরা যার মন্দার ভয় কর, আর বাসস্থান যা তোমরা ভালো বাস (এসব) যদি তোমাদের নিকট প্রিয়তর হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করা হতে, তাহলে অপেক্ষা কর যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর চূড়ান্ত ফায়সালা তোমাদের কাছে নিয়ে আসেন।’ আর আল্লাহ অবাধ্য আচরণকারীদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ২৩-২৪]
মুশরিকদের বন্ধুত্ব পরিত্যাগের নির্দেশ যদিও তারা নিকটাত্মীয় হয়:
যারা আল্লাহ তা‘আলাকে অস্বীকার করে তাদের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দেন, যদিও তারা পিতৃপুরুষ, অথবা সন্তানসন্ততি হয়ে থাকে, আর তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন। যখন তারা ঈমানের ওপরে কুফরিকে পছন্দ করে নেয়। আর এ বলে তাদের প্রতি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন:
﴿لَّا تَجِدُ قَوۡمٗا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ يُوَآدُّونَ مَنۡ حَآدَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَوۡ كَانُوٓاْ ءَابَآءَهُمۡ أَوۡ أَبۡنَآءَهُمۡ أَوۡ إِخۡوَٰنَهُمۡ أَوۡ عَشِيرَتَهُمۡۚ أُوْلَٰٓئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ ٱلۡإِيمَٰنَ وَأَيَّدَهُم بِرُوحٖ مِّنۡهُۖ وَيُدۡخِلُهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ﴾ [المجادلة: ٢٢]   
“আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান আনয়নকারী এমন কোনো দল তুমি পাবে না যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরোধিতাকারীদেরকে ভালোবাসে- হোক না এই বিরোধীরা তাদের পিতা, পুত্র, তাদের ভাই অথবা তাদের জ্ঞাতি গোষ্ঠী। আল্লাহ এদের অন্তরে ঈমান বদ্ধমূল করে দিয়েছেন আর নিজের পক্ষ থেকে রূহ দিয়ে তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন। তাদেরকে তিনি দাখিল করবেন জান্নাতে, যার তলদেশ দিয়ে বয়ে চলেছে নির্ঝরিণী।” [সূরা আল-মুজাদালাহ: ২২]
হাফিয আবু বকর আল বাইহাক্বী আব্দুল্লাহ ইবনু শাওযাবের হাদিস বর্ণনা করেন। তিনি বলেন: বদরের দিন আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহর পিতা তার পুত্রের (আবু উবাইদাহ ইবনুল র্জারাহর) সম্মুখে দেব-দেবীর প্রশংসা করতে থাকে আর আবু উবাইদাহ তার থেকে সরে যেতে থাকেন। এরপর জাররাহ যখন নাছোড় বান্দার মত দেব-দেবীদের প্রশংসা করতেই থাকে আবু উবাইদাহ তখন তার মুখোমুখি হয়ে তাকে হত্যা করে ফেলেন। তখন এ ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করেন: لا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ “আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী এমন কোনো দল তুমি পাবে না যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা-কারীদেরকে ভালোবাসে” এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দেন যেন তিনি ঐ সকল লোকদের প্রতি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন, যারা আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর পথে জিহাদ করার ওপরে তাদের পরিবার-পরিজন, নিকটাত্মীয় এবং নিজ গোত্রকে প্রাধান্য দেয়। তিনি বলেন:
قُلۡ إِن كَانَ ءَابَآؤُكُمۡ وَأَبۡنَآؤُكُمۡ وَإِخۡوَٰنُكُمۡ وَأَزۡوَٰجُكُمۡ وَعَشِيرَتُكُمۡ وَأَمۡوَٰلٌ ٱقۡتَرَفۡتُمُوهَا “বল, ‘যদি তোমাদের বাপ-দাদাগণ, তোমাদের সন্তান-সন্তুতি, তোমাদের ভাই-বেরাদর, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের গোষ্ঠীর লোকেরা এবং ধন-সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ” অর্থাৎ যা তোমরা কামাই করেছ, অর্জন করেছ, وَتِجَٰرَةٞ تَخۡشَوۡنَ كَسَادَهَا وَمَسَٰكِنُ تَرۡضَوۡنَهَآ “আর ব্যবসা তোমরা যার মন্দার ভয় কর আর বাসস্থান যা তোমরা ভালোবাস” অর্থাৎ তোমরা একে পছন্দ কর, কেননা তা আরামদায়ক ও ভালো। অর্থাৎ এ সব বিষয়গুলো যদি أَحَبَّ إِلَيۡكُم مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَجِهَادٖ فِي سَبِيلِهِۦ فَتَرَبَّصُواْ  “আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করা হতে যদি (এসব) তোমাদের নিকট প্রিয়তর হয়, তাহলে অপেক্ষা কর” অর্থাৎ প্রতীক্ষায় থাক তোমাদের উপরে তাঁর কী ধরণের শাস্তি ও গযব আপতিত হয়। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: حَتَّىٰ يَأۡتِيَ ٱللَّهُ بِأَمۡرِهِۦۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡفَٰسِقِينَ “যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর চূড়ান্ত ফায়সালা তোমাদের কাছে নিয়ে আসেন আর আল্লাহ অবাধ্য আচরণকারীদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না।”
ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন, যাহরাহ ইবনু মা‘বাদ তাঁর দাদা থেকে বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলাম এমন সময় যখন তিনি ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর হাত ধরে ছিলেন। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে বললেন: “হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমার নিকট সকল কিছু থেকে অধিক প্রিয় তবে আমার নিজেকে ছাড়া। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান লাভ করতে পারবে না; যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার নিজের থেকে অধিক প্রিয় না হই। এরপর ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আল্লাহর শপথ, আপনি এখন আমার নিকট আমার জানের চেয়েও অধিক প্রিয়। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: এখন হে ওমর! ইমাম বুখারী এককভাবে এ হাদিস বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ, বর্ণনা করেন, শব্দগুলো আবু দাউদের, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি: তোমরা যদি ‘ঈনাহ’ (বাকীতে বিক্রয় করে আবার ক্রেতা থেকে কমদামে কিনে রাখা)-এর লেনদেন কর, গরুর লেজ ধর, চাষাবাদে লিপ্ত থাকাকে পছন্দ কর আর জিহাদ পরিত্যাগ কর, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ওপরে অপমানকে চাপিয়ে দিবেন আর তোমরা তোমাদের দীনে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত সেটা তোমাদের থেকে পৃথক হবে না।”
﴿لَقَدۡ نَصَرَكُمُ ٱللَّهُ فِي مَوَاطِنَ كَثِيرَةٖ وَيَوۡمَ حُنَيۡنٍ إِذۡ أَعۡجَبَتۡكُمۡ كَثۡرَتُكُمۡ فَلَمۡ تُغۡنِ عَنكُمۡ شَيۡ‍ٔٗا وَضَاقَتۡ عَلَيۡكُمُ ٱلۡأَرۡضُ بِمَا رَحُبَتۡ ثُمَّ وَلَّيۡتُم مُّدۡبِرِينَ ٢٥ ثُمَّ أَنزَلَ ٱللَّهُ سَكِينَتَهُۥ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ وَعَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَأَنزَلَ جُنُودٗا لَّمۡ تَرَوۡهَا وَعَذَّبَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْۚ وَذَٰلِكَ جَزَآءُ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٢٦ ﴾ [التوبة: ٢٥،  ٢٦]  
“২৫. বস্তুত: আল্লাহ তোমাদেরকে বহু যুদ্ধ ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন আর হুনায়নের যুদ্ধের দিন, তোমাদের সংখ্যার আধিক্য তোমাদেরকে গর্বে মাতোয়ারা করে দিয়েছিল; কিন্তু তা তোমাদের কোনো কাজে আসে নি, জমিন তার বিশালতা নিয়ে তোমাদের কাছে সংকীর্ণই হয়ে গিয়েছিল, আর তোমরা পিছন ফিরে পালিয়ে গিয়েছিলে। ২৬. তারপর আল্লাহ তাঁর রাসূলের উপর, আর মুমিনদের উপর তাঁর প্রশান্তির অমিয়ধারা বর্ষণ করলেন আর পাঠালেন এমন এক সেনাবাহিনী যা তোমরা দেখতে পাও নি। অতঃপর তিনি কাফিরদেরকে শাস্তি প্রদান করলেন। এভাবেই আল্লাহ কাফিরদেরকে প্রতিফল দিয়ে থাকেন।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ২৫-২]
গায়েবী সাহায্যের উপরে বিজয়ের সীমাবদ্ধতা:
ইবনু জুরাইজ বর্ণনা করেন, মুজাহিদ বলেন: এই হচ্ছে বারা’আতের অবতীর্ণ হওয়া প্রথম আয়াত, যাতে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণের উপরে তাঁর দয়া ও অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে থাকাবস্থায় বহু স্থানে যুদ্ধে সাহায্য করেছেন। আর তা তাঁর পক্ষ থেকে হয়েছে। তিনি তাঁদেরকে শক্তিশালী করেছেন আর তাদের ব্যাপারে ফায়সালা দিয়েছেন বিধায় তা সংঘটিত হয়েছে। তাদের সংখ্যা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ সৈন্য সরবরাহ থাকার কারণে নয়। তিনি তাদেরকে অবহিত করেন যে, বিজয় তাঁর পক্ষ থেকে এসে থাকে, চাই দল অল্প হোক কিংবা বেশি হোক। হুনাইনের যুদ্ধে মুসলিমবৃন্দ নিজেদের সংখ্যা দেখে খুশি হয়েছিল; কিন্তু তা সত্ত্বেও সেটা তাদের উপকারে আসে নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে তাদের অল্প কয়েকজন থেকে যাওয়া ছাড়া বাকিরা পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করে পলায়ন করেছে। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সঙ্গে যে সব মুমিন থেকে গিয়েছিলেন তাদের উপরে তাঁর সাহায্য নেমে আসে। ইনশা’আল্লাহ এ ব্যাপারে শীঘ্রই আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব, যাতে লোকেরা অবহিত হয় যে, বিজয় কেবল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আসে আর তাঁর সাহায্যে, যদিও দল অল্প হয়, ‘আল্লাহর হুকুমে বহু ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র দল বৃহৎ দলের উপর জয়যুক্ত হয়েছে।’ আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।
হুনাইনের যুদ্ধের ঘটনা:
মক্কা বিজয়ের পরে অষ্টম হিজরি সনের শাওয়াল মাসে হুনাইনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ঘটনা ছিল এরূপ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয় সমাপ্ত করার পরে সবকিছু যখন স্থির হয়, এর অধিকাংশ লোক ইসলাম গ্রহণ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে ছেড়ে দেন (সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন) এরপর তিনি জানতে পারেন যে, হাওয়াযিন গোত্র তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একত্রিত হয়েছে। তাদের নেতা হচ্ছে মালিক ইবনু আউফ আন-নাদরী। তার সাথে রয়েছে পুরো সাক্বীফ গোত্র, বানু জুশাম, বানু সা‘আদ ইবনু বকর, বানূ হিলালের কতিপয় ব্যক্তি, তারা সংখ্যায় অল্প, আমর ইবনু আমির এবং আউফ ইবনু আমিরের কিছু সংখ্যক লোক, তারা অগ্রসর হয়, তাদের সঙ্গি হয় নারী, শিশু, ভেড়া এবং উট, এগুলো ছিল তাদের সামরিক শক্তি এবং তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য যোগান হিসেবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের মোকাবিলা করার জন্য বের হন, যারা মক্কা বিজয়ের জন্য তাঁর সাথে এসেছিল। তাঁদের সংখ্যা হচ্ছে দশ হাজার, যাদের মধ্যে মুহাজির-আনসার এবং আরবের কিছু গোত্র রয়েছে। তাঁর সাথে ওরাও ছিল যারা মক্কা বিজয়ের পরে ইসলাম গ্রহণ করে, যাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা ছিল সংখ্যায় দু’হাজার।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে সাথে করে শত্রুদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন, উভয় বাহিনীর মাঝে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী একটি উপত্যকায় দেখা হয়, যার নাম হুনাইন। প্রভাতের প্রথম ভাগে যুদ্ধ আরম্ভ হয়। হাওয়াযিন গোত্র অতর্কিতে আক্রমণ করার জন্য ওত পেতে থাকে। মুসলিমরা উপত্যকায় প্রবেশ করা মাত্রই তারা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মুসলিমরা অতর্কিত আক্রমণের সম্মুখীন হয়। তাদের প্রতি তীর নিক্ষিপ্ত হয় এবং তরবারির আঘাত আসতে থাকে। তারা যৌথভাবে একব্যক্তির হামলার মত করে হামলা চালায় যেভাবে তাদের বাদশাহ তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিল। সে সময় মুসলিমরা পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করে পলায়ন করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন দৃঢ় ছিলেন, তিনি তাঁর আশ-শাহবা নামক খচ্চরের পিঠে আরোহণ করে শত্রুদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর চাচা আব্বাস খচ্চরটির ডান দিকের রশি ধরেছিলেন আর আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিস ইবনু আব্দুল মুত্তালিব এর বাম পাশের রশি ধরেছিলেন। তাঁরা খচ্চরটির গতি মন্থর করতে চাইছিলেন যাতে করে সেটা দ্রুত শত্রুদের দিকে ধাবিত না হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চস্বরে নিজের নাম উচ্চারণ করে মুসলিমদেরকে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছিলেন। আর বলছিলেন: আমার নিকট ফিরে এসো আল্লাহর বান্দারা, আমার দিকে এসো, আমি আল্লাহর রাসূল। আর সে অবস্থায় তিনি বলছিলেন: আমি নবী, আমি মিথ্যা বলি না, আমি আব্দুল মুত্তালিবের সন্তান। তাঁর সঙ্গে প্রায় একশত জন সাহাবী দৃঢ় থাকেন। কেউ কেউ বলেন: তারা ছিলেন আশি জন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আবু বকর, ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা, আব্বাস, আলী, ফাদ্ল ইবনু আব্বাস, আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিস, আইমান ইবনু উম্মু আইমান, উসামা ইবনু যাইদ এবং অন্যান্যরা রিদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আজমা‘ঈন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাচাকে নির্দেশ দেন -তিনি ছিলেন উঁচু আওয়াজের অধিকারী। তিনি লোকদের মাঝে উচ্চস্বরে এ ঘোষণা দেন যে, হে বাবলা গাছের তলদেশের বায়’আতকারীগণ,-এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে মুহাজির ও আনসারবৃন্দ, যারা বৃক্ষের তলদেশে রিযওয়ানের অঙ্গিকার প্রদান করেছিল যে, তাঁরা তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে পলায়ন করবে না। তখন তিনি তাদেরকে উচ্চস্বরে ডাকতে থাকেন: হে সামুরাহ বৃক্ষের লোকেরা, তিনি আরেকবার বলেন: হে সূরা বাকারার লোকেরা, তাঁরা বলতে থাকেন: আমরা এখানে, আমরা এখানে। লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ফিরে আসতে শুরু করে। তাদের কারও উট যদি তার আনুগত্য করতে অসম্মত হয় (ক্লান্ত হয়ে পড়ার কারণে) তখন সে তার বর্ম পরিধান করে তার উট থেকে নেমে পায়ে হেঁটে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ছুটে আসে। যখন বিশাল সংখ্যক জনতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চারিপাশে জড়ো হয় তখন তিনি তাদেরকে আন্তরিক হয়ে লড়াই করার নির্দেশ দেন। এরপর তিনি এক মুষ্টি বালু গ্রহণ করে তাঁর রবের নিকট দো‘আ করেন আর তাঁর সাহায্য কামনা করে বলেন: اللهم أنجز لي ما وعدتني “হে আল্লাহ আপনি আমাকে যে ওয়াদা দিয়েছিলেন তা পূর্ণ করুন” এরপর তা কাফেরদের মুখে ছুঁড়ে মারেন, ফলে তাদের প্রত্যেকের চোখে-মুখে তা লাগে আর তাদেরকে লড়াইয়ে বাধা প্রদান করে, এরপর তারা পরাজিত হয়। মুসলিমরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে তাদের কতককে হত্যা করেন আর কতককে বন্দী করেন। আর বাকি মুসলিমরা ফিরে এসে দেখেন বন্দীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মুখে বাঁধা অবস্থায় উপস্থিত রয়েছে।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে: শু‘বা বর্ণনা করেন, আবু ইসহাক রহ. বারা ইবনু আযিব রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণনা করে বলেন: জনৈক ব্যক্তি তাঁকে বলেন: হে আবু আমারাহ, আপনি কি হুনাইনের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন? তিনি বলেন: (তা বটে) কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পলায়ন করেন নি, হাওয়াযিন গোত্র ছিল তীরন্দাজীতে পারদর্শী, তাদের সাথে আমাদের সাক্ষাত হলে আমরা তাদের উপরে হামলা করি। ফলে তারা পরাজিত হয়। এরপর লোকেরা গনিমতের মাল সংগ্রহ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে; কিন্তু ক্রমাগতভাবে আমাদের প্রতি তীর নিক্ষিপ্ত হতে শুরু করে। লোকেরা (মুসলিমবৃন্দ) পরাজিত হয়। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রত্যক্ষ করি এ সময় আবু সুফিয়ান তাঁর সাদা খচ্চরের লাগাম টেনে ধরেছিলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সময় বলছিলেন: আমি হচ্ছি নবী, আমি মিথ্যা বলি না, আমি আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র। আমি বলি: এতে তিনি দুর্দান্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তিনি প্রচণ্ড যুদ্ধের মধ্যে অবস্থান করেন। তাঁর সৈন্যরা তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে যায় অথচ তিনি তাঁর খচ্চরের উপরে ছিলেন আর এটা এত দ্রুতগতির কোনো বাহন ছিল না, যা দ্রুত চলতে পারে অথবা পালিয়ে যেতে পারে। তা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটাকে শত্রুদের দিকে ধাবিত হতে উৎসাহিত করছিলেন। আর তিনি নিজের পরিচয় দিচ্ছিলেন, ফলে তাদের মধ্যে যারা তাঁকে চিনত না তারও তাঁকে চিনতে পারে। (কিয়ামত দিবস পর্যন্ত তাঁর উপরে দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক।) আর এ সব কিছু কেবলমাত্র আল্লাহ তা‘আলার প্রতি তাঁর আস্থা ও ভরসার কারণে হয়েছিল আর তিনি জানতেনও যে, অচিরেই আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে সাহায্য করবেন। আর যা সহকারে তিনি তাঁকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তা পূর্ণ করবেন। আর সকল দ্বীনের উপরে তিনি তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
ثُمَّ أَنزَلَ ٱللَّهُ سَكِينَتَهُۥ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ “তারপর আল্লাহ প্রশান্তির অমিয়ধারা বর্ষণ করলেন তাঁর রসূলের উপর” অর্থাৎ, তাঁর রাসূলের উপরে তাঁর প্রশান্তি ও স্থিরতা। وَعَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ “আর মু’মিনদের উপর” অর্থাৎ যারা তাঁর সাথে রয়েছেন। وَأَنزَلَ جُنُودٗا لَّمۡ تَرَوۡهَا  “আর পাঠালেন এমন এক সেনাবাহিনী যা তোমরা দেখতে পাও নি” তারা হচ্ছে ফেরেশতামণ্ডলী, ইমাম আবু জাফর ইবনু জারীর এ মত ব্যক্ত করেন: হাদিস বর্ণনা করেছেন আমাদের নিকট কাসিম (তিনি) বলেন: হাদিস বর্ণনা করেছেন আমার নিকট আল-হাসান ইবনু আরফাহ, (তিনি) বলেন: হাদিস বর্ণনা করেছেন আমার নিকট আল-মু‘তামির ইবনু সুলাইমান, (তিনি)) আউফ থেকে, তিনি হচ্ছেন ইবনু আবু জামীলাহ আল-আরাবী, (তিনি) বলেন: আমি ইবনু বারসানের আযাদকৃত গোলাম আব্দুর রহমানকে বলতে শুনেছি: আমার নিকট এমন এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, যে হুনাইনের যুদ্ধে মুশরিকদের সাথে ছিল। সে বলল: হুনাইনের যুদ্ধে আমরা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগন যখন পরস্পরের মুখোমুখি হই, তখন তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে ততক্ষণও টিকে ছিল না, যতক্ষণ সময়ে বকরীর দুধ দোহন করা হয়। সে আরও বলে: আমরা তাদেরকে পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকি এমনকি আমরা সাদা খচ্চরের আরোহীর নিকট এসে থামি। তখন দেখি তিনি হচ্ছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি বলেন: (এ সময়) তাঁর নিকটে আমরা সুন্দর শুভ্র চেহারার কিছু লোকের দেখা পাই। তারা আমাদেরকে বলে: তোমাদের চেহারাগুলো ধ্বংস হোক, তোমরা ফিরে যাও। সে বলে: এরপর আমাদের পরাজয় ঘটে। এরপর তারা আমাদের কাঁধে চেপে বসে, এই ছিল আমাদের সমাপ্তি।
﴿ثُمَّ يَتُوبُ ٱللَّهُ مِنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَ عَلَىٰ مَن يَشَآءُۗ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٢٧﴾ [التوبة: ٢٧]  
“২৭. এরপরও আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছে করবেন তাকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু।” [সূরা আত-তাওবাহ: ২৭]
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ثُمَّ يَتُوبُ ٱللَّهُ مِنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَ عَلَىٰ مَن يَشَآءُۗ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ “এরপরও আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছে করবেন তাকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু” আল্লাহ তা‘আলা হাওয়াযিনে গোত্রের বাকি লোকদের তাওবাহ কবুল করেন, তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করে এবং তাঁরা মুসলিম হয়ে তাঁর নিকট আগমন করে, তাঁর সাথে যোগ দেয়। এই ঘটনা ঘটে তাঁর মক্কায় পৌঁছানোর পূর্বে হুনাইন যুদ্ধের প্রায় বিশ দিন পরে জি‘রানা নামক স্থানে। সে সময় তাদেরকে দু’টি বিষয়ের একটি বেছে নেওয়ার ইখতিয়ার দেওয়া হয়, তাদেরকে বন্দীদের গ্রহণ করার অথবা তাদের সম্পদ। তারা তাদের বন্দীদের গ্রহণে সম্মত হয়, তারা ছিল ছয় হাজার বন্দী যাদের মধ্যে নারী ও শিশু ছিল। তিনি তাদেরকে তাদের নিকট ফিরিয়ে দেন, তবে তাদের সম্পত্তি বিজয়ীদের মাঝে বণ্টন করেন। তিনি সাধারণ ক্ষমা প্রাপ্ত লোকদেরকে অতিরিক্ত কিছু প্রদান করেন, যাতে করে ইসলামের প্রতি তাদের অন্তর আকৃষ্ট হয়। তাদেরকে প্রত্যেককে একশতটি করে উট দেন, তাদের মধ্যে মালিক ইবনু আউফ আন-নাদ্বরীও ছিল। তিনি তাঁকে তার কাওমের শাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। যেমন সে ইতোপূর্বে ছিল।
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡمُشۡرِكُونَ نَجَسٞ فَلَا يَقۡرَبُواْ ٱلۡمَسۡجِدَ ٱلۡحَرَامَ بَعۡدَ عَامِهِمۡ هَٰذَاۚ وَإِنۡ خِفۡتُمۡ عَيۡلَةٗ فَسَوۡفَ يُغۡنِيكُمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦٓ إِن شَآءَۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ٢٨ قَٰتِلُواْ ٱلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَلَا بِٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ ٱلۡحَقِّ مِنَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ حَتَّىٰ يُعۡطُواْ ٱلۡجِزۡيَةَ عَن يَدٖ وَهُمۡ صَٰغِرُونَ ٢٩﴾ [التوبة: ٢٨،  ٢٩]
“২৮. হে ঈমানদারগণ! মুশরিকরা অপবিত্র। কাজেই এ বছরের পর তারা যেন মসজিদে হারামের নিকট না আসে। তোমরা যদি দরিদ্রতার ভয় কর তবে আল্লাহ ইচ্ছে করলে অচিরেই তাঁর অনুগ্রহের মাধ্যমে তোমাদেরকে অভাব-মুক্ত করে দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, মহা বিজ্ঞানী। ২৯. যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না এবং শেষ দিনের প্রতিও না আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তাকে হারাম গণ্য করে না আর সত্য দ্বীনকে নিজেদের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে না তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যে পর্যন্ত না তারা বশ্যতা সহকারে স্বেচ্ছায় ট্যাক্স দেয়।” [সূরা আত-তাওবাহ: ২৮-২৯]
মসজিদুল হারামে প্রবেশে মুশরিকদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ:
আল্লাহ তা‘আলা দ্বীনী ও আত্মিক দিক থেকে পবিত্র তাঁর মুমিন বান্দাগণকে নির্দেশ প্রদান করেন তারা যেন দ্বীনী ভাবে অপবিত্র মুশরিকদেরকে মসজিদুল হারামে প্রবেশে বাধা দান করে। আর তারা যেন এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পরে এর নিকটবর্তী না হয়। এই আয়াতটি নবম হিজরি সনে অবতীর্ণ হয়। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে বৎসর আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর সঙ্গী হিসেবে প্রেরণ করেন। আর তাঁকে নির্দেশ দেন যে, তিনি যেন মুশরিকদের মাঝে ঘোষণা করেন, এ বৎসরের পর কোনো মুশরিক যেন হজ না করে আর উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ না করে। আল্লাহ তা‘আলা এ ফায়সালা পূর্ণ করেন আর এটাকে শরীয়ত হিসেবে জারি করেন। আব্দুর রাযযাক বর্ণনা করেন, জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ এই আয়াত:
إِنَّمَا ٱلۡمُشۡرِكُونَ نَجَسٞ فَلَا يَقۡرَبُواْ ٱلۡمَسۡجِدَ ٱلۡحَرَامَ بَعۡدَ عَامِهِمۡ هَٰذَا “মুশরিকরা অপবিত্র, কাজেই এ বছরের পর তারা যেন মসজিদে হারামের নিকট না আসে” সম্পর্কে বলেন: তবে সে যদি দাস অথবা যিম্মী হয় তবে ভিন্ন কথা। ইমাম আবু আমর আল-আউযায়ী বলেন: ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (তাঁর গভর্নরকে) লিখে পাঠান যে, ইয়াহূদী ও নাসারাদেরকে মুসলিমবৃন্দের মসজিদসমূহে প্রবেশে বাধা প্রদান কর, আর তিনি তার এই নির্দেশের সাথে আল্লাহ তা‘আলার এই বাণীও লিখে পাঠান: إِنَّمَا ٱلۡمُشۡرِكُونَ نَجَسٞ “মুশরিকরা অপবিত্র”।
‘আতা বলেন: হারামের (পবিত্র এলাকার) সম্পূর্ণ অংশই মসজিদ। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন: فَلَا يَقۡرَبُواْ ٱلۡمَسۡجِدَ ٱلۡحَرَامَ بَعۡدَ عَامِهِمۡ هَٰذَا “কাজেই এ বছরের পর তারা যেন মসজিদে হারামের নিকট না আসে”।
এই সম্মানিত আয়াতটি প্রমাণ করে যে, মুশরিকরা অপবিত্র, যেভাবে তা মুমিনগণের পবিত্রতার প্রমাণ বহন করে। এ ব্যাপারে সহীহ হাদিসে এসেছে: ‘মু’মিন অপবিত্র হয় না।’
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَإِنۡ خِفۡتُمۡ عَيۡلَةٗ فَسَوۡفَ يُغۡنِيكُمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦٓ إِن شَآءَۚ “তোমরা যদি দারিদ্রতার ভয় কর, তবে অচিরেই তাঁর অনুগ্রহের মাধ্যমে তোমাদেরকে অভাব-মুক্ত করে দেবেন”। মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক বলেন: কেননা লোকেরা বলতে লাগলো: আমাদের হাট-বাজার বন্ধ হয়ে যাবে, আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে আর আমরা যা উপার্জন করেছি তা বিফলে যাবে। ফলে আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াত: وَإِنۡ خِفۡتُمۡ عَيۡلَةٗ فَسَوۡفَ يُغۡنِيكُمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦٓ إِن شَآءَۚ “তোমরা যদি দারিদ্রতার ভয় কর, তবে অচিরেই তাঁর অনুগ্রহের মাধ্যমে তোমাদেরকে অভাব-মুক্ত করে দেবেন”। এছাড়া অন্যান্য উপায়ে, إِنْ شَاءَ “আল্লাহ ইচ্ছে করলে” وَهُمۡ صَٰغِرُونَ “তারা বশ্যতা সহকারে” এই পর্যন্ত নাযিল করেন। অর্থাৎ তোমরা যে সে সমস্ত বাজার বন্ধের আশঙ্কা করছ এটা তার পরিবর্তে, ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে শির্কের বিষয় থেকে তাদের যা বন্ধ হয়ে গেছে তার বিনিময় প্রদান করেন। তিনি তাদেরকে আহলে কিতাবীদের নিকট থেকে জিযিয়া (ট্যাক্স) গ্রহণের ব্যবস্থা করেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা, মুজাহিদ, ইকরিমা, সাঈদ ইবনু জুবাইর, কাতাদা, দাহ্হাক এবং অন্যান্যদের থেকে এরূপ বর্ণিত হয়েছে।
إِنَّ اللَّهَ عَلِيم “নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ” অর্থাৎ কিসে তোমাদের মঙ্গল রয়েছে, حَكِيم “মহা বিজ্ঞানী” অর্থাৎ যে বিষয়ে তিনি নির্দেশ দেন আর যা থেকে নিষেধ করেন। কেননা তিনি তাঁর কথা ও কর্মসমূহে নিখুঁত, তাঁর বান্দাদের এবং তাঁর সিদ্ধান্তে ইনসাফের অধিকারী। এ কারণে তিনি সে সমস্ত আয়-উপার্জনের পরিবর্তে তাদেরকে জিযিয়ার সম্পদ প্রদান করেন, যা তারা জিম্মিদের নিকট থেকে গ্রহণ করে।

জিযিয়া না দেওয়া পর্যন্ত আহলে কিতাবিদেরকে হত্যা করার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান:
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ قَٰتِلُواْ ٱلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَلَا بِٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ ٱلۡحَقِّ مِنَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ حَتَّىٰ يُعۡطُواْ ٱلۡجِزۡيَةَ عَن يَدٖ وَهُمۡ صَٰغِرُونَ ٢٩﴾ [التوبة: ٢٩]  
“২৯. যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না, আর শেষ দিনের প্রতিও না, আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তাকে হারাম গণ্য করে না, আর সত্য দ্বীনকে নিজেদের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে না তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর যে পর্যন্ত না তারা বশ্যতা সহকারে স্বেচ্ছায় ট্যাক্স দেয়।” [সূরা আত-তাওবাহ: ২৯]
তারা যখন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঈমান আনে না তখন রাসূলগণের কারও প্রতি আর তারা যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি তাদের বিশুদ্ধ ঈমান টিকে না; বরং তারা তো নিছক তাদের খেয়ালখুশি, তাদের প্রবৃত্তির এবং তাদের বাপ-দাদারা যাতে লিপ্ত ছিল তার অনুসরণ করে; তারা সেগুলোর অনুসরণ এজন্য করে না যে, এগুলো আল্লাহ তা‘আলার আইন এবং তাঁর দীন। কেননা তাদের হাতে যে কিতাব রয়েছে তার প্রতি যদি তারা বিশুদ্ধ রূপে ঈমান আনত তবে তো সেটা তাদেরকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঈমান আনার প্রতি দিক নির্দেশনা দিত। কেননা সমস্ত নবীই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন আর তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আগমন করেন তখন তারা তাঁকে অস্বীকার করে অথচ তিনি হচ্ছেন সবচেয়ে সম্মানিত রাসূল। কাজেই বুঝা যাচ্ছে যে, তারা পূর্ববর্তী নবীগণের শরীয়তকে এ হিসেবে আঁকড়ে ধরেনি যে, সেটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এসেছে; বরং তারা তাদের খেয়ালখুশি এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছিল। ফলে অবশিষ্ট নবীদের প্রতি তাদের ঈমান আনয়ন তাদের কোনো উপকারে আসে নি, তারা তো নবীদের সর্দার, তাদের মধ্যে সর্বোত্তম, সর্বশেষ ও সবচেয়ে কামেল নবীকে অস্বীকার করেছে। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: قَاتِلُوا الَّذِينَ لا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلا بِالْيَوْمِ الآخِرِ وَلا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ “যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না, আর শেষ দিনের প্রতিও না, আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তাকে হারাম গণ্য করে না, আর সত্য দ্বীনকে নিজেদের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে না”। মুশরিকরা পরাজিত হওয়ার পরে আহলে কিতাবীদের সাথে যুদ্ধের সূচনা করার নির্দেশ প্রদান করে এই সম্মানিত আয়াত অবতীর্ণ হয়, যখন লোকেরা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করে। আরব উপদ্বীপে যখন স্থিরতা আসে তখন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ইয়াহূদী ও নাসারাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ প্রদান করেন। এটা ছিল নবম হিজরির ঘটনা। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন আর লোকদেরকেও এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেন। আর তিনি তাদেরকে তাঁর লক্ষ্য ও গন্তব্য সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি মদিনার আশে পাশে বিভিন্ন আরব এলাকাসমূহে সৈন্য সংগ্রহের জন্য তাঁর লোক প্রেরণ করেন, তিনি ত্রিশ হাজার সৈন্য সংগ্রহ করেন, মদীনাবাসী এবং তার আশে পাশের মুনাফিক এবং অন্যান্যরা জিহাদ থেকে পেছনে পড়ে যায়। এটা ছিল দুর্ভিক্ষ এবং প্রচণ্ড গরমের সময়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য শামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। এমনকি তিনি তাবুক পৌঁছেন, তিনি সেখানে অবতরণ করে পানির উৎসে তাঁবু খাটিয়ে প্রায় বিশ দিন অবস্থান করেন। এরপর তিনি মদিনায় ফিরে আসার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট ইস্তিখারা (সিদ্ধান্ত পাওয়ার উদ্দেশ্যে সালাত আদায়) করেন। এরপর তিনি ফিরে আসেন। কেননা অবস্থা খুব সংগিন ছিল এবং লোকেরা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এ সংক্রান্ত বর্ণনা আল্লাহ চাহে তো অচিরেই আসছে।
জিযিয়া হচ্ছে অপমান-অপদস্থ এবং কুফরির নিদর্শন:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:حَتَّى يُعْطُوا الْجِزْيَةَ  “যে পর্যন্ত না তারা স্বেচ্ছায় ট্যাক্স দেয়” অর্থাৎ যদি তারা ইসলাম গ্রহণ না করে عَنْ يَدٍ “স্বেচ্ছায়” অর্থাৎ পরাজিত করে এবং বাধ্য করে وَهُمْ صَاغِرُونَ (বশ্যতা সহকারে) অর্থাৎ তারা অপমানিত-অপদস্থ। এ কারণে জিম্মিদেরকে সম্মান প্রদর্শন করা এবং মুসলিমদের উপরে তুলে ধরার বৈধতা নেই; বরং তারা হীন, সম্মানহীন ও হতভাগা। যেমন, সহীহ মুসলিম শরীফে এসেছে: আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা ইয়াহূদী-খৃষ্টানদেরকে (তাদের পূর্বেই) আগে বেড়ে সালাম দিও না। তাদের কারও সাথে পথে যখন তোমাদের সাক্ষাত হয় তখন তাদেরকে সংকীর্ণ সরু পথে (চলতে) বাধ্য কর।” এ কারণে আমীরুল মু’মিনীন ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের উপরে তাদের অপমান-অপদস্থের এই প্রসিদ্ধ শর্ত আরোপ করেন। এ বিষয়টি হাদিসের ইমামগণ আব্দুর রহমান ইবনু গানাম আল-আশআরী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমি ওমর ইবনুল খাত্তাবের পক্ষ থেকে শামের খৃষ্টানদের সাথে কৃত শান্তিচুক্তির শর্তগুলো লিপিবদ্ধ করেছি,
“পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহ তা‘আলার নামে শুরু করছি, এটা হচ্ছে অমুক অমুক শহরের খৃষ্টানদের পক্ষ থেকে আল্লাহর বান্দা ওমর ইবনুল খাত্তাবের প্রতি (লিখিত) দলীল: আপনারা (হে মুসলিম) যখন আমাদের নিকট আগমন করেন তখন আমরা আমাদের নিজেদের, আমাদের সন্তানাদির, আমাদের ধনসম্পদের এবং আমাদের ধর্মের অনুসারীদের জন্য নিরাপত্তার আবেদন জানিয়েছিলাম আর তোমাদের জন্য আমরা আমাদের উপরে এ শর্ত করে নিয়েছিলাম যে, আমরা আমাদের এলাকায় এবং আশে পাশের এলাকায় সন্ন্যাসীদের জন্য না কোনো মাঠ, গির্জা ও পুণ্যস্থান নির্মাণ করব আর না ধ্বংস হয়ে যাওয়া এগুলোর কোনোটি সংস্কার করব, আর না এগুলোর কোনোটি মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করব। আর না দিনে-রাতে কোনো মুসলিমকে আমাদের গীর্জাসমূহে অবতরণ করতে বাধা দিব। আর আমাদের ইবাদতখানার দরজাগুলোকে পথিক ও মুসাফিরদের জন্য উন্মুক্ত করে দিব, মুসলিমবৃন্দের যারা আমাদের নিকট অতিথি হিসেবে আসবে তাদেরকে আমরা তিনদিন থাকার এবং খাবারের ব্যবস্থা করব। আর না আমরা আমাদের গির্জা এবং ঘরবাড়ীগুলোতে মুসলিমবৃন্দের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাদের আশ্রয় দিব, অনুরূপভাবে মুসলিমদের সাথে প্রতারণার কোনো কাজ হতে দেখলে তা গোপনও করব না। আমরা আমাদের সন্তানদেরকে কুরআন শিক্ষা দিব না, জনগণের নিকট শির্ক প্রচার করবো না, আর না সেদিকে কাউকে আহ্বান করব, আমাদের কোনো আত্মীয়স্বজনকে ইসলামে প্রবেশে বাধা দিব না যদি সে তা চায়, আমরা মুসলিমবৃন্দকে সম্মান করব, আমরা আমাদের সে সব আসন ছেড়ে দিব যেসব আসনে তারা বসতে চায়, আমরা তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করব না তাদের পোষাকের, টুপি, পাগড়ী, চপ্পল, চুলের স্টাইলের, আমরা তাদের মত কথাবার্তা বলব না, তাদের মত উপনাম রাখব না, অশ্ব-পৃষ্ঠে চড়ব না, আমাদের কাঁধে তরবারি ঝুলিয়ে রাখব না, আমরা কোনো অস্ত্র ধারণ করব না, আর তা আমাদের সাথে বহনও করবো না, আমরা আরবি ভাষায় আমাদের সীলহোমার খোদাই করব না, মদ বিক্রয় করব না, আমাদের মাথার সামনের দিকে চুল কাটা থাকবে। আমরা যেখানে যাব সেখানে আমাদের রেওয়াজ মাফিক পোষাক পরিধান করব। আমরা কোমরে বেল্ট পরিধান করব। আমাদের গীর্জসমূহে ক্রুশ টাঙ্গাব না, মুসলিমবৃন্দের পথে-ঘাটে এবং হাট-বাজারে ক্রুশ প্রকাশ করব না এবং কোনো কিছু লিখব না, আমাদের গীর্জাগুলোতে মৃদুভাবে ঘন্টা বাজাব, মুসলিমবৃন্দের উপস্থিতিতে আমাদের গীর্জাগুলোতে উচ্চস্বরে আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করব না, আমাদের মৃতদের দাফন-কাফনের প্রার্থনায় আমাদের আওয়াজকে উঁচু করব না, মুসলিমবৃন্দের রাস্তাঘাটে এবং হাট-বাজারে শব-শোভাযাত্রায় বাতি জ্বালাব না, মুসলিমবৃন্দের কবরের পার্শ্বে আমাদের মৃতদেরকে কবরস্থ করব না, মুসলিমবৃন্দের পাকড়াও করা বন্দীকে গোলাম হিসেবে ক্রয় করব না, আমরা মুসলিমবৃন্দকে পথের সন্ধান দিব, তাদের বাড়ি-ঘরে উঁকি মারব না।”
তিনি বলেন: যখন আমি এই দলীলটি নিয়ে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট আসি তখন তিনি তাতে সংযোজন করেন: কোনো মুসলিমকে প্রহার করব না। আমরা আপনাদের জন্য আমাদের, আমাদের ধর্মের অনুসারিদের বিরুদ্ধে এ সমস্ত শর্তারোপ করলাম, আর এ শর্তে আমরা নিরাপত্তা গ্রহণ করলাম, আর আপনাদেরকে দেওয়া এ সমস্ত শর্তের কোনো একটি যদি আমরা ভঙ্গ করি তবে আমাদের কোনো যিম্মাহ (নিরাপত্তার অঙ্গিকার) নেই। আর আপনারা আমাদের সাথে তাই করতে পারবেন যা আপনারা আপনাদের বিরুদ্ধাচরণকারী ও বিদ্রোহীদের সাথে করে থাকেন।”
﴿وَقَالَتِ ٱلۡيَهُودُ عُزَيۡرٌ ٱبۡنُ ٱللَّهِ وَقَالَتِ ٱلنَّصَٰرَى ٱلۡمَسِيحُ ٱبۡنُ ٱللَّهِۖ ذَٰلِكَ قَوۡلُهُم بِأَفۡوَٰهِهِمۡۖ يُضَٰهِ‍ُٔونَ قَوۡلَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِن قَبۡلُۚ قَٰتَلَهُمُ ٱللَّهُۖ أَنَّىٰ يُؤۡفَكُونَ ٣٠ ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِ وَٱلۡمَسِيحَ ٱبۡنَ مَرۡيَمَ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُوٓاْ إِلَٰهٗا وَٰحِدٗاۖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۚ سُبۡحَٰنَهُۥ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٣١ ﴾ [التوبة: ٣٠،  ٣١]  
“৩০. ইয়াহূদীরা বলে, ‘উযায়র আল্লাহর পুত্র। আর নাসারারা বলে, মাসীহ আল্লাহর পুত্র। এসব তাদের মুখের কথা। এতে তারা তাদের পূর্বেকার কাফিরদের কথারই অনুকরণ করে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন! কেমনভাবে তারা সত্য পথ থেকে দূরে ছিটকে পড়েছে। ৩১. আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা তাদের ‘আলিম আর দরবেশদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছে; আর মারইয়াম-পুত্র মাসীহকেও। অথচ তাদেরকে এক ইলাহ ব্যতীত (অন্যের) ‘ইবাদাত করার আদেশ দেওয়া হয় নি। তিনি ব্যতীত সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই, প্রশংসা আর মহিমা তাঁরই, (বহু ঊর্ধ্বে তিনি) তারা যাদেরকে (তাঁর)) অংশীদার গণ্য করে তা থেকে।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ৩০-৩১]
ইয়াহূদী-নাসারাদের শির্ক ও কুফরী, যা তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার কারণ:
আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণকে উদ্বুদ্ধ করছেন ইয়াহূদী-খৃষ্টান মুশকির-কাফির সম্প্রদায়কে হত্যার করার ব্যাপারে। কেননা তারা আল্লাহ তা‘আলার বিরুদ্ধে জঘন্য মিথ্যাচার করে, ইয়াহূদীরা উযাইর আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলে: তিনি হচ্ছেন আল্লাহর পুত্র, আল্লাহ তা‘আলা এ ধরণের কথা-বার্তা থেকে অনেক অনেক উর্ধ্বে। ...
অনুরূপভাবে ঈসা মাসীহ আলাইহিস সালামের ব্যাপারে খৃষ্টানদের গোমরাহি সুস্পষ্ট। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা উভয় দলকে মিথ্যাবাদী ঘোষণা করে বলেন: ذَٰلِكَ قَوۡلُهُم بِأَفۡوَٰهِهِمۡۖ “এসব তাদের মুখের কথা) অর্থাৎ মিথ্যা ও ভ্রান্ত কথাবার্তা ছাড়া তারা যে দাবি করেছে সে ব্যাপারে তাদের কোনো ভিত্তি নেই। يُضَٰهِ‍ُٔونَ “অনুকরণ করে” অর্থাৎ সাদৃশ্য সৃষ্টি করে قَوۡلَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِن قَبۡلُۚ  “এতে তারা তাদের পূর্বেকার কাফিরদের কথারই” অর্থাৎ তাদের পূর্বে যে সমস্ত জাতি ছিল এরা তাদের অনুকরণ করছে, ফলে তারা তাদের মত গোমরাহ হয়ে গেছে قَٰتَلَهُمُ ٱللَّهُۖ “আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন” আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: তাদের উপরে আল্লাহ তা‘আলার অভিশাপ أَنَّىٰ يُؤۡفَكُونَ “কেমনভাবে তারা সত্য পথ থেকে দূরে ছিটকে পড়েছে” অর্থাৎ কীভাবে তারা সত্য থেকে বিভ্রান্ত হচ্ছে অথচ তা সুস্পষ্ট, তারা মিথ্যার প্রতি ফিরে আসছে?
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِ وَٱلۡمَسِيحَ ٱبۡنَ مَرۡيَمَ  “আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা তাদের ‘আলিম আর দরবেশদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছে; আর মারইয়াম-পুত্র মাসীহকেও” ইমাম আহমাদ, তিরমিযী এবং ইবনু জারীর ‘আদী ইবনু হাতিম রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণনা করেন, তাঁর নিকট যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাওয়াত পৌঁছে তখন তিনি পালিয়ে শামে চলে যান। তিনি জাহেলী যুগে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বোন এবং তাঁর জাতির একদল লোক বন্দী হয়। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বোনের প্রতি দয়া করে মুক্ত করে দেন এবং কিছু উপঢৌকনও প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর ভাইয়ের কাছে ফিরে এসে তাকে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট যেতে বলেন। আদী মদীনায় আগমন করেন। তিনি ছিলেন তাঁর তা’ঈ সম্প্রদায়ের সর্দার। তাঁর পিতা হাতিম তা’ঈ বদান্যতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। লোকেরা তাঁর আগমনের কথা বলাবলি করতে থাকেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট প্রবেশ করেন। এ সময় আদীর কাঁধে রৌপ্যের ক্রুশ ছিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াত পাঠ করেন: ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِ “আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা তাদের ‘আলিম আর দরবেশদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছে” তিনি বলেন: আমি বলি: তারা তো ওদের ইবাদত করে নি, ফলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: তা বটে; কিন্তু তারা তাদের উপরে হালাল বিষয়কে হারামে পরিণত করেছে আর তাদের জন্য হারাম বিষয়কে হালালে পরিণত করেছে, এরপর তারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে, আর এভাবেই তারা তাদের ইবাদত করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: হে ‘আদী তুমি কি ‘আল্লাহু আকবার’ (আল্লাহ সবচেয়ে বড়) এ কথা বলার ভয়ে শামে পালিয়ে গিয়েছিলে? তোমার কি জানা আছে যে, আল্লাহ তা‘আলার চেয়ে বড় কিছু রয়েছে? কীসে তোমাকে পালাতে উদ্বুদ্ধ করেছিল? তোমাকে لا إله إلا الله “আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই” এ কথা বলতে হবে বলে কি তুমি পালিয়েছিলে? আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য রয়েছে বলে কি তোমার জানা আছে? এরপর তিনি তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সত্যের ঘোষণা প্রদান করেন। তিনি বলেন: আমি তাঁর চেহারায় খুশির ঝিলিক দেখতে পাই এরপর তিনি বলেন: ইয়াহূদীরা হচ্ছে অভিশপ্ত, আর খৃষ্টানরা হচ্ছে পথভ্রষ্ট।
হুযাইফাহ ইবনুল ইয়ামান, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এবং অন্যান্যরা ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِ “আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা তাদের ‘আলিম আর দরবেশদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছে” এই আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে এ মত ব্যক্ত করেন: তারা যা কিছু হালাল ও হারাম করে দিয়েছিল তাই তারা মেনে নিয়েছিল। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُوٓاْ إِلَٰهٗا وَٰحِدٗاۖ “অথচ তাদেরকে এক ইলাহ ব্যতীত (অন্যের) ‘ইবাদাত করার আদেশ দেওয়া হয় নি” অর্থাৎ যিনি কোনো জিনিসকে যখন হারাম করেন তখন তা হারাম আর যা তিনি হালাল করেন সেটা হালাল বলে গন্য। তিনি যে আইন দিয়েছেন তা পালনীয় আর তিনি যে নির্দেশ দিয়েছেন অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۚ سُبۡحَٰنَهُۥ عَمَّا يُشۡرِكُونَ “তিনি ব্যতীত সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই, প্রশংসা আর মহিমা তাঁরই, (বহু ঊর্ধ্বে তিনি) তারা যাদেরকে (তাঁর) অংশীদার গণ্য করে তাত্থেকে।” তিনি সুউচ্চ, পবিত্র, শরীক, সমকক্ষ, সাহায্যকারী, প্রতিপক্ষ এবং সন্তানসন্তুতি থেকে মুক্ত। তিনি ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই, তিনি ছাড়া কোনো রব নেই।
﴿يُرِيدُونَ أَن يُطۡفِ‍ُٔواْ نُورَ ٱللَّهِ بِأَفۡوَٰهِهِمۡ وَيَأۡبَى ٱللَّهُ إِلَّآ أَن يُتِمَّ نُورَهُۥ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡكَٰفِرُونَ ٣٢ هُوَ ٱلَّذِيٓ أَرۡسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلۡهُدَىٰ وَدِينِ ٱلۡحَقِّ لِيُظۡهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡمُشۡرِكُونَ ٣٣ ﴾ [التوبة: ٣٢،  ٣٣]
“৩২. তারা তাদের মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর আলোকে নিভিয়ে দিতে চায়; কিন্তু আল্লাহ তা হতে দিবেন না, তিনি তাঁর আলোকে পূর্ণ না করে ছাড়বেন না, যদিও কাফিরগণ তা অপছন্দ করে। ৩৩. তিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত আর সঠিক দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন যাবতীয় দ্বীনের উপর একে বিজয়ী করার জন্য যদিও মুশরিকগণ না পছন্দ করে। [সূরা আত-তাওবাহ: ৩২-৩৩]
আহলে কিতাবগণ কর্তৃক ইসলামের আলোকে নিভিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: মুশরিক ও আহলে কিতাবী অবিশ্বাসীরা চায় أَن يُطۡفِ‍ُٔواْ نُورَ ٱللَّهِ “আল্লাহর আলোকে নিভিয়ে দিতে” অর্থাৎ শুধুমাত্র ঝগড়া-বিবাদ এবং মিথ্যার মাধ্যমে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে হিদায়াত ও সঠিক দ্বীন নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন, তা তারা নিভিয়ে দিতে চায়। এ ব্যাপারে তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঐ ব্যক্তির মত যে তার ফুৎকারে সূর্যকিরণ অথবা চাঁদের আলোকে নিভিয়ে দিতে চায়। বস্তুত এ ধরণের ব্যক্তি কখনই তার আকাঙ্খা সুসম্পন্ন করতে পারবে না। অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সত্য নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন, আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই তা পূর্ণ করবেন আর তাকে বিজয়ী করবেন। এ কারণে তারা যে আশা-আকাঙ্খা করেছিল আল্লাহ তা‘আলা তার বিপরীতে বলেন: وَيَأۡبَى ٱللَّهُ إِلَّآ أَن يُتِمَّ نُورَهُۥ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡكَٰفِرُونَ “কিন্তু আল্লাহ তা হতে দিবেন না, তিনি তাঁর আলোকে পূর্ণ না করে ছাড়বেন না, যদিও কাফিরগণ তা অপছন্দ করে”।
 كافر বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে যে কোনো কিছু গোপন করে এবং লুকায়। এ কারণে রাত্রিকে كافر বলা হয়। কেননা তা বস্তুসমূহকে গোপন করে। চাষীকেও كافر বলা হয় কেননা তা জমিনে দানা গোপন করে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿أَعۡجَبَ ٱلۡكُفَّارَ نَبَاتُهُۥ﴾ [الحديد: ٢٠] “উৎপন্ন শষ্যাদি কৃষকের মনকে আনন্দে ভরে দেয়।” [সূরা আল-হাদিদ: ২০]  

দীন ইসলাম সকল ধর্মের উপরে বিজয়ী:
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: هُوَ ٱلَّذِيٓ أَرۡسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلۡهُدَىٰ وَدِينِ ٱلۡحَقِّ “তিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত আর সঠিক দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন”هدى-এর অর্থ হচ্ছে সত্য বিবরণ, বিশুদ্ধ ঈমান এবং উপকারী জ্ঞান আর دين حق হচ্ছে দুনিয়া ও অখিরাতের উপকারী বিশুদ্ধ [সৎ] আমল।
لِيُظۡهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ “যাবতীয় দ্বীনের উপর একে বিজয়ী করার জন্য” অর্থাৎ সকল দীনের উপরে। যেমন বিশুদ্ধ হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম পার্শ্ব টেনে আমার নিকটে করে দেন (আমার দেখার জন্য) আমার উম্মাতের শাসনক্ষমতা আমাদের দেখা অঞ্চলগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেন।
তামীমদারী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি: এই বিষয় (ইসলাম) সে পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছবে যে পর্যন্ত দিবা-রজনী পৌঁছে। তিনি আরও বলেন, কাদামাটি এবং চুল-পশমের তৈরী প্রতিটি বাড়িতে এই দীন প্রবেশ করাবেন (একটিও বাড়িও বাদ রাখবেন না)। তিনি সম্মানিতকে সম্মানিত করবেন আর হীন ব্যক্তিকে অপদস্থ করবেন। তিনি সম্মানের মাধ্যমে ইসলামকে (এর অনুসারীদেরকে) উন্নীত করবেন আর অপমান দ্বারা কুফুরীকে (এবং এর অনুসারীদের) নিচে নামিয়ে দিবেন। তামীম দারী বলতেন: আমার পরিবারের লোকদের দ্বারাই এর প্রমাণ পেয়েছি। তাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছিল তারা কল্যাণ ও সম্মান-মর্যাদা লাভ করেছে, আর যারা কাফের ছিল তারা অপমান-অপদস্থ হয় এবং জিযিয়া প্রদান করেছে।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّ كَثِيرٗا مِّنَ ٱلۡأَحۡبَارِ وَٱلرُّهۡبَانِ لَيَأۡكُلُونَ أَمۡوَٰلَ ٱلنَّاسِ بِٱلۡبَٰطِلِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِۗ وَٱلَّذِينَ يَكۡنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلۡفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَبَشِّرۡهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٖ ٣٤ يَوۡمَ يُحۡمَىٰ عَلَيۡهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكۡوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمۡ وَجُنُوبُهُمۡ وَظُهُورُهُمۡۖ هَٰذَا مَا كَنَزۡتُمۡ لِأَنفُسِكُمۡ فَذُوقُواْ مَا كُنتُمۡ تَكۡنِزُونَ ٣٥﴾ [التوبة: ٣٤،  ٣٥]
“৩৪. হে ঈমানদারগণ! অবশ্যই ‘আলিম ও দরবেশদের অধিকাংশই ভুয়া কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষদের সম্পদ গ্রাস করে থাকে আর আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে। যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে আর আল্লাহর পথে তা ব্যয় করে না তাদেরকে ভয়াবহ শাস্তির সুসংবাদ দাও। ৩৫. যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে আর তা দিয়ে তাদের কপালে, পার্শ্বদেশে ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে, (আর তাদেরকে বলা হবে) ‘এটা হল, যা তোমরা নিজেদের জন্য স্তূপীকৃত করেছিলে, কাজেই যা জমা করছিলে তার স্বাদ গ্রহণ কর।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৩৪-৩৫]
নিকৃষ্ট আলেম এবং পথভ্রষ্ট ইবাদত-কারীদের থেকে সতর্কীকরণ:
সুদ্দী বলেন: الأحبار হচ্ছে ইয়াহূদী ধর্মযাজক আর الرهبان হচ্ছে খৃষ্টান সন্ন্যাসী। এই মত সঠিক। কেননা الأحبار হচ্ছে ইয়াহূদী পণ্ডিতরা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿لَوۡلَا يَنۡهَىٰهُمُ ٱلرَّبَّٰنِيُّونَ وَٱلۡأَحۡبَارُ عَن قَوۡلِهِمُ ٱلۡإِثۡمَ وَأَكۡلِهِمُ ٱلسُّحۡتَۚ ٦٣﴾ [المائ‍دة: ٦٣] “রব্বানী ও পুরোহিতগণ তাদেরকে পাপ কথা বলা হতে এবং হারাম ভক্ষণ থেকে নিষেধ করে না কেন?” [সূরা আল-মায়েদা: ৬৩] আর الرهبان হচ্ছে খৃষ্টান উপাসক, قسيس হচ্ছে তাদের পণ্ডিতরা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:  ذَٰلِكَ بِأَنَّ مِنۡهُمۡ قِسِّيسِينَ وَرُهۡبَانٗا ٨٢﴾ [المائ‍دة: ٨٢] “কেননা তাদের মধ্যে ‘ইবাদতকারী ‘আলিম ও সংসার বিরাগী আছে।” [সূরা আল-মায়েদা: ৮২] উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিকৃষ্ট আলেম এবং পথভ্রষ্ট ইবাদতকারীদের থেকে সতর্কীকরণ, যেমন সুফিয়ান ইবনু উইয়াইনা বলেন: আমাদের আলেমগণের মধ্যে যারা নষ্ট হয়ে গেছে তাদের মাঝে ইয়াহূদীদের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। আর আমাদের মাঝে যে সমস্ত ইবাদতকারী নষ্ট হয়ে গেছে তাদের মধ্যে খৃষ্টানদের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। অনুরূপ সহীহ হাদিসে এসেছে: তোমরা ধাপে ধাপে তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতির অনুসরণ করবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন: ইয়াহূদী-নাসারাদের কী? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: তবে আর কাদের? অপর এক বর্ণনায় রয়েছে: পারস্য ও রোমের? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: ওরা ছাড়া লোকদের মাঝে আর কাদের?
মোদ্দাকথা হচ্ছে: এখানে ইয়াহূদী-নাসাদের কথাবার্তা ও কার্যকলাপের সাদৃশ্য গ্রহণ করা থেকে সতর্ক করা হচ্ছে। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: لَيَأۡكُلُونَ أَمۡوَٰلَ ٱلنَّاسِ بِٱلۡبَٰطِلِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ “ভুয়া কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষদের সম্পদ গ্রাস করে থাকে আর আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে” কেননা তারা দীনের পরিবর্তে দুনিয়া, লোকদের মাঝে তাদের পদমর্যাদা ও নেতৃত্বের সুফল ভোগ করে আর এর মাধ্যমে তারা তাদের ধনসম্পদ ভোগ করে। যেভাবে জাহেলী যুগে লোকদের মাঝে ইয়াহূদী পণ্ডিতদের মর্যাদা ছিল, তারা তাদেরকে উপঢৌকন, খাজনা ও উপহার সামগ্রী প্রদান করত। এরপর আল্লাহ তা‘আলা যখন তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেন তখন তারা তাদের গোমরাহি, কুফরী ও একগুঁয়েমির উপরে অটল থাকে এ লোভে পড়ে যে, তাদের সে নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব টিকে থাকবে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা নবুওয়তের আলোর মাধ্যমে তাকে নিভিয়ে দেন। তাদের থেকে সেই নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব কেড়ে নেন। তার পরিবর্তে তাদের উপর অপমান অপদস্থতা চাপিয়ে দেন, তারা নিজেদের উপরে আল্লাহ তা‘আলার অসন্তুষ্টি ডেকে আনে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِۗ “আর আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে” তারা তাদের হারাম ভক্ষণের পাশাপাশি লোকদেরকে সত্যের অনুসরণ করা থেকে বাধা প্রদান করে। সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করে আর যারা অজ্ঞতাবশত তাদের অনুসরণ করে তাদের নিকট তারা প্রকাশ করে যে, তারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা সেরূপ নয় যেমন তারা ধারণা করে; বরং তারা হচ্ছে জাহান্নামের প্রতি আহ্বানকারী। আর কিয়ামত দিবসে তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না।
যারা স্বর্ণ ও রৌপ্যকে জমা করে রাখে তাদের শাস্তি:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَٱلَّذِينَ يَكۡنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلۡفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَبَشِّرۡهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٖ “যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে আর আল্লাহর পথে তা ব্যয় করে না তাদেরকে ভয়াবহ শাস্তির সুসংবাদ দাও” এরা হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণীর নেতৃবৃন্দ। কেননা লোকেরা সাধারণত তাদের মধ্যেকার পণ্ডিত (আলেম), ইবাদাতকারী ও সম্পদশালী লোকদের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। যখন এই শ্রেণীর লোকেরা নষ্ট হয়ে যায় তখন লোকদের অবস্থাও খারাপ হয়ে যায়। যেমন পূর্ববর্তী মনিষীদের কেউ কেউ (আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক) বলতেন:
রাজা-বাদশাহ এবং নিকৃষ্ট ‘আলিম ও দরবেশদের ছাড়া আর কারও দ্বারা কি দীন নষ্ট হয়েছে?
الكنز সম্পর্কে মালিক রহ. আব্দুল্লাহ ইবনু দীনার থেকে বর্ণনা করেন, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে, তিনি বলেন: সেটা হচ্ছে যে সম্পদের যাকাত আদায় করা হয় না।
ইমাম বুখারী যুহরী থেকে হাদিস বর্ণনা করেন, খালিদ ইবনু আসলাম বলেন: আমরা আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমার সঙ্গে বের হলে তিনি বলেন: এটা হচ্ছে যাকাতের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বের বিধান, এরপর যখন যাকাতের আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন তিনি সেটাকে মালের পবিত্রকারী হিসেবে গণ্য করেন। ওমর ইবনু আব্দুল আযীয এবং এরাক ইবনু মালিকও অনুরূপ মত ব্যক্ত করেন: তারা বলেন, এ আয়াতটিকে ﴿خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ﴾ [التوبة: ١٠٣]  “তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করবে” [সূরা আত-তাওবাহ: ১০৩] এ আয়াত রহিত করে দিয়েছে।
স্বল্প পরিমাণ স্বর্ণ-চাঁদি থাকার প্রশংসা করে এবং তা বেশি থাকার নিন্দা জানিয়ে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এখানে তার কয়েকটি বর্ণনা করব যা অন্যান্যগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে। আব্দুর রাযযাক বর্ণনা করেন, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু وَٱلَّذِينَ يَكۡنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلۡفِضَّةَ “যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: স্বর্ণের জন্য দুঃখ, চাঁদির জন্য দুঃখ। তিনবার তিনি একথা বলেন: তিনি (আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: তখন বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণের নিকট অত্যন্ত জটিল মনে হয়। তাঁরা বলেন: তাহলে আমরা কোন সম্পদ গ্রহণ করব? তখন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আচ্ছা আমি তোমাদের জন্য বিষয়টি তাঁর নিকট জেনে নিচ্ছি। ফলে তিনি বলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনার সাহাবীগণের নিকট তো বিষয়টি ভারি হয়ে গেছে। তারা বলেছে: আমরা কোন সম্পদ গ্রহণ করব? তিনি বলেন: যিকিরকারী জবান, শুকরিয়া আদায়কারী অন্তর এবং এমন স্ত্রী যে তোমাদের কাউকে তার দীনের ব্যাপারে সাহায্য করে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿يَوۡمَ يُحۡمَىٰ عَلَيۡهَا فِي نَارِجَهَنَّمَ فَتُكۡوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمۡ وَجُنُوبُهُمۡ وَظُهُورُهُمۡۖ هَٰذَا مَاكَنَزۡتُمۡ لِأَنفُسِكُمۡ فَذُوقُواْ مَا كُنتُمۡ تَكۡنِزُونَ ٣٥﴾ [التوبة: ٣٥]
“যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে আর তা দিয়ে তাদের কপালে, পার্শ্বদেশে ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে, (আর তাদেরকে বলা হবে) এটা হল, যা তোমরা নিজেদের জন্য স্তূপীকৃত করেছিলে। কাজেই যা জমা করছিলে তার স্বাদ গ্রহণ কর।” [সুরা আত-তাওবাহ: ৩৫]
এ কথা তাদেরকে তিরস্কার, সমালোচনা এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে বলা হবে। যেমন তিনি এ আয়াতে বলেন,
﴿ثُمَّ صُبُّواْ فَوۡقَ رَأۡسِهِۦ مِنۡ عَذَابِ ٱلۡحَمِيمِ ٤٨ ذُقۡ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡكَرِيمُ ٤٩﴾ [الدخان: ٤٨، ٤٩]
“অতঃপর তার মাথার উপর ফুটন্ত পানি ঢেলে ‘আযাব দাও। (বলা হবে) গ্রহণ কর স্বাদ-তুমি তো ছিলে ক্ষমতাশালী, সম্মানী।” [সূরা আদ-দুখান:৪৮-৪৯] অর্থাৎ এ শাস্তি, এ কারণে যে, এটা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করতে। এ কারণে বলা হয়: যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যের উপরে কোনো কিছুকে ভালোবাসবে এবং সেটা প্রাধান্য দিবে -এর দ্বারা তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। তাদের নিকট এ সমস্ত ধন-সম্পদ জমা করা যখন আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির চেয়ে অধিক প্রিয়, তখন এর মাধ্যমে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে। যেভাবে আবু লাহাব-তার উপরে আল্লাহ তা‘আলার অভিশাপ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে শত্রুতায় চেষ্টিত ছিল আর তার স্ত্রী এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছিল। সে কিয়ামত দিবসেও আবু লাহাবের শাস্তির ক্ষেত্রে সাহায্যকারিণী হবে। তার ঘাড়ে রয়েছে পাকানো আগুনের রশি। অর্থাৎ সে জাহান্নাম থেকে জ্বালানি একত্রিত করে তার উপরে নিক্ষেপ করবে, যাতে করে তার শাস্তি চরমে পৌঁছে- যেটা তার নিকট দুনিয়াতে অধিক ভয়ের কারণ ছিল। যেভাবে এ সমস্ত সম্পদ তাদের নিকট তাদের রবের চেয়ে অধিক সম্মানের ছিল অনুরূপভাবে সেটা তাদের জন্য পরকালে সবচেয়ে ক্ষতির কারণ হবে। এগুলোকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে, এটা হবে চরম পর্যায়ের গরম। এরপর এর দ্বারা তাদের কপালে, পার্শ্বদেশে এবং পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে।
ইমাম আবু জা‘ফার ইবনু জারীর বর্ণনা করেন, সাউবান বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন: যে ব্যক্তি ধন-সম্পদ ছেড়ে মারা যায় (যেগুলোর সে যাকাত আদায় করে নি) কিয়ামত দিবসে সেগুলোকে টেকো বিষধর স্বর্পে পরিণত করা হবে। যার চোখের উপরে দু’টো কালো দাগ হবে। এই সাপটি তাকে অনুসরণ করবে। তখন সে বলবে: তুমি ধ্বংস হও, কে তুমি? সে বলবে: আমি তোমার গচ্ছিত সম্পদ যা তুমি তোমার পরে ছেড়ে গিয়েছিলে। সে তাকে অনবরত অনুসরণ করেই চলবে এমনকি লোকটি তাকে তার হাত দিবে ফলে সে তা গিলে ফেলবে। অবশেষে তার পুরো দেহকে সে গিলে নিবে। ইবনু হিব্বান তাঁর সহীহতে বর্ণনা করেছেন, ইয়াযীদ সাঈদ থেকে বর্ণনা করেন, এ হাদীসের মুল সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত। সহীহ মুসলিমে এসেছে, আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি তার সম্পদের যাকাত আদায় করে না কিয়ামত দিবসে সেটাকে আগুনের থালায় রুপান্তরিত করা হবে। এর দ্বারা তার পার্শ্বদেশে, কপালে এবং পৃষ্ঠদেশে এমন একদিন দাগ দেওয়া হবে যার দৈর্ঘ্য হবে পঞ্চাশ হাজার বৎসরের সমান। এমনকি বান্দাদের মাঝে বিচার-ফায়সালা সম্পন্ন হয়ে যাবে। এরপর তাকে তার গন্তব্য দেখানো হবে- হয় জান্নাত নয়ত জাহান্নাম। তিনি সম্পূর্ণ হাদিস বর্ণনা করেন।
ইমাম বুখারী এই আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন, যাইদ ইবনু ওয়াহ্হাব বলেন: আমি রাবাযাহ নাকম স্থানে আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে অতিক্রমকালে তাঁকে জিজ্ঞেস করি: কীসে আপনাকে অত্র এলাকায় বসবাস করতে উদ্বুদ্ধ করেছে? তিনি বলেন: আমি শামে ছিলাম, এরপর আমি وَٱلَّذِينَ يَكۡنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلۡفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَبَشِّرۡهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٖ “যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে আর আল্লাহর পথে তা ব্যয় করে না তাদেরকে ভয়াবহ শাস্তির সুসংবাদ দাও” এ আয়াত পাঠ করি। তখন মু‘আবিয়া বলেন: এই আয়াত আমাদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয় নি, এ তো শুধুমাত্র আহলে কিতাবীদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি বলেন: আমি বলি এটা আমাদের এবং তাদের (উভয়ের) ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে।
﴿إِنَّ عِدَّةَ ٱلشُّهُورِ عِندَ ٱللَّهِ ٱثۡنَا عَشَرَ شَهۡرٗا فِي كِتَٰبِ ٱللَّهِ يَوۡمَ خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ مِنۡهَآ أَرۡبَعَةٌ حُرُمٞۚ ذَٰلِكَ ٱلدِّينُ ٱلۡقَيِّمُۚ فَلَا تَظۡلِمُواْ فِيهِنَّ أَنفُسَكُمۡۚ وَقَٰتِلُواْ ٱلۡمُشۡرِكِينَ كَآفَّةٗ كَمَا يُقَٰتِلُونَكُمۡ كَآفَّةٗۚ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلۡمُتَّقِينَ ٣٦﴾ [التوبة: ٣٦]
“৩৬. আসমান-যমীন সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে মাসগুলোর সংখ্যা হল বারো। তার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস। এটা হল সু-প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা। কাজেই ঐ সময়ের মধ্যে নিজেদের উপর জুলুম করো না। মুশরিকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে। জেনে রেখ, আল্লাহ অবশ্যই মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৩৬]
বারো মাসে এক বৎসর:
ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন, আবু বাকরাহ বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হজের ভাষণে বলেন: আল্লাহ তা‘আলা যখন থেকে আসমান-জমিন সৃষ্টি করেছেন তখন থেকে সময় তার আপন অবস্থায় (বারবার) ঘুরে আসে। বৎসর হচ্ছে বার মাসে, তার মধ্যে চারটি পবিত্র- তিনটি পরস্পর ধারাবাহিকভাবে আসে (সেগুলো হল) যিলক্বদ, যিলহজ এবং মুহাররম। আর মুদার গোত্রের রজব মাস যা জুমাদা ও শাবান মাসের মাঝে রয়েছে। এরপর তিনি বলেন: আজ কোন দিন? আমরা বলি: আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল বেশি ভালো জানেন। এরপর তিনি (কিছুক্ষণ) চুপ থাকেন এমনকি আমরা ধারণা করি তিনি হয়ত এর অন্য নাম দিবেন। তারপর তিনি বলেন: এটা কি যিলহাজ্জ মাস নয়? আমরা বলি: অবশ্যই। এরপর তিনি বলেন: এটা কোন শহর? আমরা বলি: আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল বেশি ভালো জানেন, এরপর তিনি (কিছুক্ষণ) চুপ থাকেন এমনকি আমরা ভাবি, তিনি অচিরেই এর অন্য কোনো নাম রাখবেন। তারপর তিনি বলেন: এটা কি (পবিত্র) নগরী নয়? আমরা বলি: অবশ্যই। তিনি বলেন: নিশ্চয় তোমাদের পরস্পরের জান, তোমাদের মাল, আমার ধারণা- তিনি এও বলেন:- তোমাদের মান-মর্যাদা তোমাদের নিকট তেমনি পবিত্র যেমন তোমাদের এই মাসে তোমাদের এই নগরে তোমাদের আজকের এই দিনটি তোমাদের নিকট পবিত্র। অচিরেই তোমরা তোমাদের রবের সাথে সাক্ষাত করবে। এরপর তিনি বলেন, তোমাদেরকে তোমাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। জেনে রাখ, তোমরা একে অপরের গর্দানে আঘাত করে গোমরাহিতে ফিরে যেও না। হে উপস্থিতি, আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? হে তোমাদের যারা উপস্থিত রয়েছ তারা অনুপস্থিতদের নিকট (আমার বাণী) পৌঁছে দিবে। সম্ভবত যাকে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে সে কতক অংশে যে পৌঁছাচ্ছে তার চেয়ে অধিক বোধশক্তি সম্পন্ন।” ইমাম বুখারী তাফসীর এবং অন্য প্রসঙ্গে এ হাদিস বর্ণনা করেছেন, ইমাম মুসলিমও তা বর্ণনা করেছেন।
[অধ্যায়]
শাইখ আলামুদ্দীন আস-সাখাবী তাঁর ছোট্ট পুস্তিকায় উল্লেখ করেছেন আর তার নাম দিয়েছেন: المشهور في أسماء الأيام والشهور অর্থাৎ ‘প্রসিদ্ধ’ দিবস ও মাসসমূহের নামের ব্যাপারে (লিখিত গ্রন্থ) তাতে তিনি বলেন,
[মাসসমূহের নাম]
মুহাররম মাসের নাম (মুহাররম) রাখা হয়েছে কেননা সেটা সম্মানিত মাস। আমার মতে এ মাসে অন্যায় কাজ করা হারাম হওয়ার অধিক গুরুত্ব বুঝাতে এই নামে নামকরণ করা হয়েছে। কেননা আরবরা একে অদল-বদল করত। এক বৎসর তারা বলত এটা পবিত্র মাস, আবার অন্য বৎসর বলত এটা নিষিদ্ধ মাস। এর বহুবচন কয়েক ভাবে হয়। যেমন, محرمات, محارم, محاريم
সফর মাসকে এ জন্য صفر বলা হয়; কেননা এ মাসে যুদ্ধবিগ্রহ ও ভ্রমণের উদ্দেশ্যে লোকেরা তাদের বাড়ি-ঘর পরিত্যাগ করত। বলা হয় صفر المكان সে স্থান খালি করেছে। এর বহুবচন হচ্ছে أصفار যেমন, جمل ও أجمل
রবিউল আউওয়াল এ জন্য নামকরণ করা হয়েছে যে, এ মাসে লোকেরা তাদের ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করত। এর বহুবচন হচ্ছে أربعاء যেমন نصيب থেকে أنصباء তবে এর বহুবচন أربعة ও হয়। যেমন- رغيف থেকে أرغفة রবিউল আখির আউওয়ালের মতই।
جمادى এ জন্য নামকরণ করা হয়েছে এ সময় পানি জমে যায়।
তিনি বলেন: তাদের হিসেবে মাসসমূহ (প্রতি বৎসর) আগপাছ হয় না। (অর্থাৎ মওসুমগুলোতে) কিন্তু এ কথায় আপত্তি রয়েছে। কেননা মাসসমূহ চন্দ্রের সাথে সম্পৃক্ত ফলে অবশ্যই তা (মওসুমসমূহে) আগপাছ হয়। সম্ভবত সর্বপ্রথম তারা যখন এর নামকরণ করে তখন ঠাণ্ডায় পানি জমে গিয়েছিল (কিন্তু প্রত্যেক বৎসরে শীতের সময় জমাদিউল মাসদ্বয় আসে না।) এর বহুবচন হচ্ছে جماديات যেমন حبارى থেকে حباريات একে কখনও পুরুষবাচক আবার কখনও স্ত্রীবাচকরূপে ব্যবহার করা হয়। যেমন جمادى الأولى আবার جمادى الأول অনুরূপভাবে جمادى الآخر আবার جمادى الآخرة
রাজাব হচ্ছে ترجيب শব্দ থেকে। অর্থ, সম্মান করা। এর বহুবচন আসে أرجاب, رجاب, رجبات
শাবানকে এ জন্য নামকরণ করা হয়েছে- বিভিন্ন গোত্র (নিজেদের মাঝে) বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের বাড়ীঘরে ফিরে আসত। এর বহুবচন شعابين এবং شعبانات আসে।
রমযান শব্দটি رمضاء শব্দ থেকে উৎকলিত হয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে উষ্ণতা, উটের বাচ্চা যখন তৃষ্ণার্ত হয়, তখন رمضت الفصال বলা হয়। এর বহুবচন رمضانات, رماضين এবং أرمضة আসে। আর যে বলে এটা আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি নাম তা ভুল। এর কোনো দলীল বা এর কোনো সমর্থন নেই। আমি (ইবনু কাসীর) বলি: এ ব্যাপারে হাদিস এসেছে তবে তা দুর্বল। এটি আমি ‘সিয়াম অধ্যায়ের’ শুরুতে বর্ণনা করেছি।
শাউওয়াল শব্দটি شالت শব্দ থেকে এসেছে। উট যখন দৌড়ানোর জন্য তার লেজকে উত্তোলন করে তখন এ কথা বলা হয়। এর বহুবচন شواول, شواويل এবং شوَّالات আসে।
القعدة শব্দটি قاف এর উপরে যাবার দিয়ে- আমি (ইবনু কাসীর) বলি: যের দিয়েও পড়া যায়, যুদ্ধবিগ্রহ ও সফরে না গিয়ে তাদের বসে থাকার কারণে এ নাম রাখা হয়েছে। এর বহুবচন ذوات القعدة আসে। الحجة শব্দটি যের দিয়ে (আমি বলি) যাবার দিয়েও পড়া যায়, হজে অবস্থান করার কারণে এ নাম রাখা হয়েছে। এর বহুবচন ذوات الحجة আসে।
দিবসসমূহের নামসমূহ:
প্রথমত: الأحد, এর বহুবচন آحاد, أوحاد এবং وحاد আসে।
এরপর الاثنين এর বহুবচন أثانين আসে।
الثلاثاء লম্বা করে এটা পুরুষবাচক এবং স্ত্রীবাচক উভয়টি হয়। এর বহুবচন ثلاثاوات এবং أثالث উভয়টি আসে।
এরপর الأربعاء মাদ (লম্বা) সহকারে, এর বহুবচন أربعات এবং أرابيع উভয়টি আসে।
الخميس শব্দটির বহুবচন أخمسة এবং أخامس উভয় আসে।
এরপর الجمعة শব্দটির ميم এ পেশ, সাকীন এবং যাবার (তিন অবস্থায়)পড়া যায়। এর বহুবচন جُمَع এবং جماعات উভয়টি আসে।
السبت শব্দটি سَبْت শব্দ থেকে উৎকলিত হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে القطع শেষ হওয়া; কেননা সংখ্যার গণনা এখানে শেষ হয়।
আরবরা বারের নামসমূহ এভাবে রেখেছিল: আউওয়াল, আহওয়ান, জুবার, দুবার, মু’নিস, ‘আরূবাহ এবং শিয়ার। জনৈক প্রচীন আরব কবি তার কবিতায় এ নামগুলো উল্লেখ করেছেন।
হারাম (পবিত্র) মাস:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: مِنۡهَآ أَرۡبَعَةٌ حُرُمٞۚ  “তার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস” এ মাসটিকে আরবরা জাহেলী যুগেও পবিত্র বলে ঘোষণা করেছিল। তবে বাসল নামক তাদের একটি দল অতিরঞ্জিত করে ও বাড়াবাড়ি বশত বৎসরে আটটি মাসকে পবিত্র (যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ) বলে ঘোষণা দিয়েছিল।
‘তিনটি মাস পরস্পর’- যিলক্বদ, যিলহজ এবং মুহাররম এবং মুদার এর রাজাব যা জুমাদা এবং শাবানের মাঝে অবস্থিত। রজব শব্দের পূর্বে মুদার শব্দটি সংযোজন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে: রজবের ব্যাপারে মুদার গোত্রের দাবির বিশুদ্ধতা বর্ণনার জন্য যে, সেটা হচ্ছে ঐ মাস যা জুমাদা এবং শাবানের মাঝে অবস্থিত। রাবী‘আহ গোত্র যে ধারণা করে যে সম্মানিত রজব মাস হচ্ছে যা শাবান ও শাউওয়ালের মাঝে অবস্থিত তা নাকচ করে দেওয়ার জন্য। যা বর্তমানে রমযান হিসেবে গণ্য। ফলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেন যে, সেটা হচ্ছে মুদার গোত্রের রজব, রাবী‘আহ গোত্রের রজব নয়।
পবিত্র মাস হচ্ছে চারটি: তিনটি পরস্পর সংযুক্ত আর একটি পৃথক। হজ ও উমরার আচার অনুষ্ঠান পালনের উদ্দেশ্যে হজের মাসের পূর্বের একটি মাসকে পবিত্র করা হয় তা হচ্ছে যিলক্বদ। কেননা লোকেরা এ মাসে যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বসে থাকে। যিল হাজ্জ মাসকে পবিত্র করা হয়। কেননা এটা হচ্ছে হজের মাস আর এ মাসে লোকেরা হজের আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য ব্যস্ত থাকে। আর এর পরেও আরেকটি মাসকে পবিত্র করা হয় সেটা হচ্ছে মুহাররম। লোকেরা যাতে করে নিরাপদে দূর-দূরান্তে তাদের বাড়ি-ঘরে ফিরে যেতে পারে। আর বৎসরের মাঝখানে রজব মাসকে পবিত্র মাস করা হয়েছে, যাতে আরব উপদ্বীপের দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা বায়তুল্লাহর যিয়ারত ও উমরা করার উদ্দেশ্যে এসে আবার নিরাপদে তাদের দেশে ফিরে যেতে পারে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ذَٰلِكَ ٱلدِّينُ ٱلۡقَيِّمُ “এটা হল সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা” এটা হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত শরী‘আত যা পবিত্র হিসেবে গণ্য করা মাস, যা গোড়া থেকে আল্লাহ তা‘আলার নিকট লিপিবদ্ধ ছিল -এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ পালন কর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: فَلَا تَظۡلِمُواْ فِيهِنَّ أَنفُسَكُمۡۚ “কাজেই ঐ সময়ের মধ্যে নিজেদের উপর যুলুম করো না” অর্থাৎ এই পবিত্র মাসসমূহে। কেননা অন্যান্য মাসের চেয়ে এ মাসে সংঘটিত গোনাহ্ অধিক গুরুতর এবং তা কয়েকগুণ বেশি বাড়িয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়। যেভাবে হারাম শরীফে (পবিত্র এলাকায়) সংঘটিত গোনাহ দ্বিগুণ হয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿وَمَن يُرِدۡ فِيهِ بِإِلۡحَادِۢ بِظُلۡمٖ نُّذِقۡهُ مِنۡ عَذَابٍ أَلِيمٖ ٢٥﴾ [الحج : ٢٥] “যে তাতে অন্যায়ভাবে কোনো দীনদ্রোহী কাজ করার ইচ্ছে করে তাকে আমি আস্বাদন করাব ভয়াবহ শাস্তি।” [সূরা আল-হজ: ২৫] অনুরূপভাবে পবিত্র মাস, এতে গোনাহ্ গুরুতর হয়ে থাকে। আলী ইবনু আবু তালহা বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা إِنَّ عِدَّةَ ٱلشُّهُورِ عِندَ ٱللَّهِ ٱثۡنَا عَشَرَ شَهۡرٗا فِي كِتَٰبِ ٱللَّهِ “আসমান-জমিন সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে মাসগুলোর সংখ্যা হল বারো” فَلَا تَظۡلِمُواْ فِيهِنَّ أَنفُسَكُمۡۚ “কাজেই ঐ সময়ের মধ্যে নিজেদের উপর যুলুম করো না” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: এর সবগুলোতেই (অপরাধ করো না) তবে তার মধ্যে চারটি মাসকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ মাসগুলোকে তিনি পবিত্র মাস হিসেবে ঘোষণা করেন আর এগুলোর পবিত্রতা অত্যন্ত বড় করে তুলে ধরেন। এ মাসগুলোতে সংঘটিত গোনাহকে গুরুতর বলে উল্লেখ করেন আর এ মাসে কৃত সৎ আমলের প্রতিদান অত্যন্ত বড় বলেও অবহিত করেন।
কাতাদা فَلَا تَظۡلِمُواْ فِيهِنَّ أَنفُسَكُمۡۚ “কাজেই ঐ সময়ের মধ্যে নিজেদের উপর জুলুম করো না” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: পবিত্র মাসসমূহে কৃত অন্যায় অন্যান্য মাসে কৃত অন্যায়ের চেয়ে বেশি নিকৃষ্ট এবং গুরুতর। যদিও অন্যায় সর্বাবস্থায় গুরুতর। তবে আল্লাহ তা‘আলা কোনো জিনিসকে তাঁর যেমন খুশি অন্য জিনিসের চেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন। তিনি আরও বলেন: আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কোনো কোনো সৃষ্টিকে অন্যান্য সৃষ্টির উপরে বেশি পছন্দ করেছেন, তিনি ফেরেশতাদের মধ্য থেকে বার্তাবাহক মনোনীত করেছেন, মানুষের মধ্য থেকে তিনি রাসূল বেছে নিয়েছেন, কথাবার্তার মধ্য থেকে তাঁর যিকিরকে চয়ন করেছেন, জমিনের মধ্য থেকে মসজিদকে প্রাধান্য দিয়েছেন, মাসসমুহের মধ্য হতে রমযানকে বেশি ভালোবেসেছেন, দিবসসমূহের মধ্য হতে জুমু‘আর দিনকে অধিক পছন্দ করেছেন, রাত্রিসমূহের মধ্য হতে লাইলাতুল ক্বদরকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। কাজেই তোমরাও তাকে সম্মান কর আল্লাহ তা‘আলা যাকে সম্মানিত করেছেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা যে সব বিষয়কে সম্মানিত করেছেন তাকে সম্মানিত করা বোধশক্তিসম্পন্ন ও জ্ঞানী লোকের পরিচয়।
পবিত্র মাসে যুদ্ধবিগ্রহ:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَقَٰتِلُواْ ٱلۡمُشۡرِكِينَ كَآفَّةٗ “মুশরিকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ কর” অর্থাৎ তোমাদের সকলেই كَمَا يُقَٰتِلُونَكُمۡ كَآفَّةٗۚ “যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে” অর্থাৎ তোমাদের সকলের সাথে, وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلۡمُتَّقِينَ “জেনে রেখ, আল্লাহ অবশ্যই মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন” অর্থাৎ জেনে রাখ, পবিত্র মাসে নিজে থেকে প্রথমে গিয়ে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُحِلُّواْ شَعَٰٓئِرَ ٱللَّهِ وَلَا ٱلشَّهۡرَ ٱلۡحَرَامَ ٢﴾ [المائ‍دة: ٢] “হে মু’মিনগণ! আল্লাহর নিদর্শনাবলী এবং হারাম মাসের অসম্মান করো না।” [সূরা আল-মায়েদা: ২] তিনি আরও বলেন: ﴿ٱلشَّهۡرُ ٱلۡحَرَامُ بِٱلشَّهۡرِ ٱلۡحَرَامِ وَٱلۡحُرُمَٰتُ قِصَاصٞۚ فَمَنِ ٱعۡتَدَىٰ عَلَيۡكُمۡ فَٱعۡتَدُواْ عَلَيۡهِ بِمِثۡلِ مَا ٱعۡتَدَىٰ عَلَيۡكُمۡۚ ١٩٤﴾ [البقرة: ١٩٤] “সম্মানিত মাস হচ্ছে সম্মানিত মাসের বিনিময়ে এবং পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব সবার জন্য সমান, কাজেই যে কেউ তোমাদের প্রতি কঠোর আচরণ করে, তবে তোমরাও তাদের প্রতি কঠোর আচরণ কর যেমনি কঠোরতা সে তোমাদের প্রতি করেছে।” (সূরা আল-বাকারা: ১৯৪) তিনি আরও বলেন: فَإِذَا انْسَلَخَ الأشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِين “তারপর (এই) নিষিদ্ধ মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলে মুশরিকদেরকে হত্যা কর।”
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَقَٰتِلُواْ ٱلۡمُشۡرِكِينَ كَآفَّةٗ كَمَا يُقَٰتِلُونَكُمۡ كَآفَّةٗۚ “যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে। মুশরিকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ কর।” তবে যদি মুশরিকরাই প্রথম যুদ্ধের সূচনা করে, সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে। এখানে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণকে যুদ্ধের অনুমতি দিচ্ছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿ٱلشَّهۡرُ ٱلۡحَرَامُ بِٱلشَّهۡرِ ٱلۡحَرَامِ وَٱلۡحُرُمَٰتُ قِصَاصٞۚ ﴾ [البقرة: ١٩٤] “সম্মানিত মাস হচ্ছে সম্মানিত মাসের বিনিময়ে এবং পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব সবার জন্য সমান।” [সূরা আল-বাকারা: ১৯৪] তিনি আরও বলেন: ﴿وَلَا تُقَٰتِلُوهُمۡ عِندَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ حَتَّىٰ يُقَٰتِلُوكُمۡ فِيهِۖ فَإِن قَٰتَلُوكُمۡ فَٱقۡتُلُوهُمۡۗ ١٩١﴾ [البقرة: ١٩١] “তোমরা মাসজিদে হারামের নিকট তাদের সাথে যুদ্ধ করো না, যে পর্যন্ত তারা তোমাদের সাথে সেখানে যুদ্ধ না করে; কিন্তু যদি তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তবে তোমরাও তাদের হত্যা কর।” [সূরা আল-বাকারা: ১৯১] রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফবাসীকে যে অবরোধ করেছিলেন -এমনকি পবিত্র মাসে তা প্রবেশ করে সে ব্যাপারটি ছিল হাওয়াযিন এবং তাদের মিত্র সাক্বীফ গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সম্পূরক হিসেবে। ওরাই যুদ্ধের সূচনা করেছিল, পুরুষদেরকে একত্রিত করেছিল। যুদ্ধ ও সংঘাতের দিকে তাদেরকে আহ্বান জানিয়েছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য বের হন। এরপর যখন তারা তায়েফে দূর্গে আশ্রয় নেয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাদেরকে দুর্গ থেকে নামিয়ে আনার জন্য তাদের প্রতি রওয়ানা করেন; কিন্তু তারা সম্মিলিতভাবে মুসলিমদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমনকি মুসলিমদের কয়েকজনকে হত্যাও করে ফেলে, তাই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চল্লিশ দিন পর্যন্ত তাদেরকে অবরোধ করে রাখেন। এই অবরোধ শুরু হয়েছিল হালাল মাসে (যাতে যুদ্ধবিগ্রহ করা বৈধ); কিন্তু তা পবিত্র মাসে প্রবেশ করে এর কয়েকটি দিন অতিবাহিত হয়। এরপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবরোধ তুলে নিয়ে মক্কায় ফিরে আসেন। কেননা “কোনো কিছু শুরু করতে যে ধরণের নিষিদ্ধতা থাকে তা সে বিষয়ের অবশিষ্টতায় থাকে না”। এটা শরী‘আতস্বীকৃত নীতি, এর বহু দৃষ্টান্তও রয়েছে। আল্লাহ্ই ভালো জানেন। এ বিষয়টি আমরা সীরাতের কিতাবে লিখেছি। আল্লাহ ভালো জানেন।
﴿إِنَّمَا ٱلنَّسِيٓءُ زِيَادَةٞ فِي ٱلۡكُفۡرِۖ يُضَلُّ بِهِ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ يُحِلُّونَهُۥ عَامٗا وَيُحَرِّمُونَهُۥ عَامٗا لِّيُوَاطِ‍ُٔواْ عِدَّةَ مَا حَرَّمَ ٱللَّهُ فَيُحِلُّواْ مَا حَرَّمَ ٱللَّهُۚ زُيِّنَ لَهُمۡ سُوٓءُ أَعۡمَٰلِهِمۡۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٣٧﴾ [التوبة: ٣٧]
“৩৭. নিষিদ্ধ মাসকে পিছিয়ে দেওয়া কুফরির উপর আরেক কুফরী কাজ যা দ্বারা কাফিরদেরকে পথভ্রষ্ট করা হয়। এক বছর তারা একটি মাসকে হালাল করে, আরেক বছর ঐ মাসটিকে হারাম করে যাতে আল্লাহর হারাম করা মাসগুলোর সংখ্যা পূর্ণ করা যায়। এভাবে তারা আল্লাহর হারাম করা মাসগুলোকে হারাম করে নেয়। তাদের খারাপ কাজগুলো তাদের কাছে আনন্দদায়ক। আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে সঠিক পথ দেখান না।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ৩৭]
মতামত প্রদানের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার শরী‘আতে নাক-গলানোর নিন্দা:
এখানে আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের নিন্দা জানিয়েছেন; কেননা তারা তাদের বাতিল মতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার শরীয়তে নাক গলায়। আর তাদের অসার খেয়াল-খুশি দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার বিধানাবলীকে পরিবর্তন করে। আল্লাহ তা‘আলা যা কিছু হারাম করেছেন সেগুলো তারা হালাল সাব্যস্ত করে। আর তিনি যা হালাল করেছেন সেগুলোকে তারা হারাম বানায়। তারা মনে করত শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহ বাদ দিয়ে ধারাবাহিক এই তিনটি মাস বসে থাকা বড়ই দীর্ঘ সময়। কেননা, তারা ক্রোধ ও উন্মত্ততায় ফুঁসে থাকত। এ কারণে তারা ইসলামের পূর্বে মুহাররম মাসের পবিত্রতায় পরিবর্তন এনেছিল। একে তারা সফর মাসে বিলম্ব করেছিল। ফলে মুহাররম মাসে তারা যুদ্ধবিগ্রহ বৈধ করে নিয়েছিল। আর হালাল মাসে (যে মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ বৈধ) সে মাসে যুদ্ধবিগ্রহকে হারাম করে নিয়েছিল। যাতে আল্লাহর হারাম করা মাসগুলোর সংখ্যা পূর্ণ করা যায়। তা হচ্ছে চারটি মাস।
আলী ইবনু আবু তালহা বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা إِنَّمَا النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْرِ “নিষিদ্ধ মাসকে পিছিয়ে দেওয়া কুফরির উপর আরেক কুফরী কাজ” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: নিষিদ্ধ মাসকে পিছিয়ে দেওয়া। জু-নাদা ইবনু আউফ ইবনু উমাইয়া আল-কিনানী যিনি আবু সুমামা নামে পরিচিত ছিল, সে প্রতি বৎসরের হজ মওসুমে আগমন করত আর ঘোষণা দিত আবু সুমামা পরিত্যক্তও হয় নি আর সে ভ্রান্ত হিসেবে গণ্য হয় নি। সে এক বৎসর লোকদের জন্য সফর মাসকে পবিত্র মাস হিসেবে আরোপ করত আর মুহাররম মাসকে যুদ্ধবিগ্রহ বৈধ বলে ঘোষণা দিত। আবার অন্য মাসে সে মুহাররম মাসকে পবিত্র মাস বলে ঘোষণা দিত আর সফরকে যুদ্ধবিগ্রহ বৈধ গণ্য করত। এ কথাই আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে বলেছেন: إِنَّمَا النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْرِ “নিষিদ্ধ মাসকে পিছিয়ে দেওয়া কুফুরির উপর আরেক কুফুরি কাজ” অর্থাৎ তারা এক বৎসর মুহাররম মাসে যুদ্ধবিগ্রহ বৈধ ঘোষণা দিত। আর আরেক মাসে তাকে পবিত্র ঘোষণা দিত।
আউফী বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমাও অনুরূপ বলেছেন। লাইস ইবনু আবু সুলাইম মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন, কিনানা গোত্রের জনৈক ব্যক্তি প্রতি বৎসর হজের মওসুমে তার গাধার পিঠে চড়ে আগমন করত। আর বলত: হে লোক সকল, আমি ভ্রান্ত বলে গণ্য নই, পরিত্যক্তও নই আর আমার কথা প্রত্যাখ্যাত নয়। আমরা আসন্ন মুহাররম মাসকে পবিত্র বলে ঘোষণা করেছি, সফরকে নয়। এরপর পরবর্তী বৎসর এসে সে তার প্রাথমিক কথাগুলো বলে বলত: আমরা (এ বৎসর) সফরকে পবিত্র মাস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি, মুহাররমকে নয়। এ কথা আল্লাহ তা‘আলা এখানে বলেন: لِيُوَاطِئُوا عِدَّةَ مَا حَرَّمَ اللَّه “যাতে আল্লাহর হারাম করা মাসগুলোর সংখ্যা পূর্ণ করা যায়” অর্থাৎ তা চারটি মাস, ফলে তারা এই পবিত্র মাসটিকে (মুহাররমকে) পিছিয়ে দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা যাকে পবিত্র বলে ঘোষণা দিয়েছেন তাতে যুদ্ধবিগ্রহ হালাল করে নিত। তারা এক বৎসর পবিত্র মাসে যুদ্ধবিগ্রহ হালাল করত আর তার পরিবর্তে সফরকে পবিত্র বলে ঘোষণা দিত। এরপর রবীউল আউয়াল এভাবে তারা তাদের সাধারণ গণনা ও নাম অনুসারে বৎসরের বাকি মাসগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখত। পরবর্তী বৎসর তারা মুহাররামকে পবিত্র মাস বলে ঘোষণা করত এরপর পরের মাসগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখত। যেমন, মুহাররমের পরে সফর তারপর রবীউল আউয়াল এভাবে বৎসরের শেষ পর্যন্ত। يُحِلُّونَهُ عَامًا وَيُحَرِّمُونَهُ عَامًا لِيُوَاطِئُوا عِدَّةَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ  “এক বছর তারা একটি মাসকে হালাল করে, আরেক বছর ঐ মাসটিকে হারাম করে যাতে আল্লাহর হারাম করা মাসগুলোর সংখ্যা পূর্ণ করা যায়” অর্থাৎ বৎসরের চারটি মাসকে পবিত্রকরণে তবে ধারাবাহিক তিনটি পবিত্র মাসের তৃতীয় মাসটিকে এক বৎসর আগেই পবিত্র হিসেবে রাখত। আবার আরেক বৎসর সফর মাসে বিলম্বিত করত অর্থাৎ তৃতীয় পবিত্র মাসকে পিছিয়ে সফরে করত।
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক এ ব্যাপারে তাঁর ‘সীরাহ’ নামক গ্রন্থে খুবই উপকারী ও সুন্দর কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন: আরবের যে ব্যক্তি মাসের পবিত্রতা পেছানোর রীতি শুরু করে: অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা যে মাস হারাম করেছেন তাকে হালাল ঘোষণা করে আর যাকে আল্লাহ তা‘আলা হালাল করেছেন তাকে হারাম বানিয়ে নেয়, সে হচ্ছে আল-কালাম্মাস’ সে হচ্ছে হুযাইফা ইবনু আব্দ্ ফুকাইম ইবনু ‘আদী ইবনু ‘আমির ইবনু সা‘লাবা ইবনুল হারিস ইবনু মালিক ইবনু কিনানা ইবনু খুযাইমা ইবনু মুদরিকাহ ইবনু ইলইয়াস ইবনু মুদার ইবনু নিযার ইবনু মা‘আদ ইবনু আদনান। তারপরে এ কাজে নিয়োজিত হয় তার ছেলে ‘আব্বাদ’। আব্বাদের পরে তার পুত্র কালা‘ ইবনু আব্বাদ, এরপর তার পুত্র উমাইইয়া ইবনু কালা‘, এরপর তার পুত্র আউফ ইবনু উমাইইয়া, এরপর তার পুত্র আবু সুমামাহ জুনাদাহ ইবনু আউফ। এই ব্যক্তি হচ্ছে এ কাজের সর্বশেষ ব্যক্তি আর তার সময় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। আরবরা যখন হজ সম্পন্ন করত তখন তারা তার নিকট একত্রিত হত। সে তাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়ে রজব, যিলক্বদ এবং যিল হজ মাসকে পবিত্র বলে ঘোষণা করত। এরপর এক বৎসর সে মুহাররম মাসকে হালাল (যুদ্ধবিগ্রহ বৈধ) ঘোষণা দিত আর তার স্থলে সফরকে পবিত্র মাস গণ্য করত। আবার আরেক বৎসর মুহাররামকে পবিত্র মাস আখ্যায়িত করত যাতে করে আল্লাহ তা‘আলার হারাম করা মাসগুলোর সংখ্যা পূরণ করা যায়। ফলে তারা আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করেছেন তাকে হালাল সাব্যস্ত করত অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা যা বৈধ করেছেন তারা হারাম আখ্যায়িত করত। আল্লাহ ভালো জানেন।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مَا لَكُمۡ إِذَا قِيلَ لَكُمُ ٱنفِرُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ ٱثَّاقَلۡتُمۡ إِلَى ٱلۡأَرۡضِۚ أَرَضِيتُم بِٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا مِنَ ٱلۡأٓخِرَةِۚ فَمَا مَتَٰعُ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا فِي ٱلۡأٓخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ ٣٨ إِلَّا تَنفِرُواْ يُعَذِّبۡكُمۡ عَذَابًا أَلِيمٗا وَيَسۡتَبۡدِلۡ قَوۡمًا غَيۡرَكُمۡ وَلَا تَضُرُّوهُ شَيۡ‍ٔٗاۗ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٌ ٣٩﴾ [التوبة: ٣٨،  ٣٩]
“৩৮. হে ঈমানদারগণ! তোমাদের হয়েছে কী যে, যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে বের হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় তখন তোমরা আরও জোরে মাটি কামড়ে ধর। তোমরা কি আখিরাতের স্থলে দুনিয়ার জীবনকেই বেশি পছন্দ কর? আখিরাতের তুলনায় পার্থিব জীবনের ভোগ সামগ্রী তো অতি সামান্য। ৩৯. তোমরা যদি যুদ্ধাভিযানে বের না হও, তাহলে তোমাদেরকে ভয়াবহ শাস্তি দেওয়া হবে, আর তোমাদের স্থলে অন্য সম্প্রদায়কে আনা হবে (অথচ) তোমরা তাঁর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান।” [সূরা আত-তাওবাহ্:৩৮-৩৯]
জিহাদের ব্যাপারে অলসতা করার উপরে তিরস্কার ও হুঁশিয়ারী:
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তাবুক যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে যে সকল ব্যক্তি পেছনে রয়ে গিয়েছিল এখানে তাদের প্রতি তিরস্কার শুরু হয়েছে। এ সময় ফল পেকেছিল আর প্রচণ্ড ও ভয়ানক গরম হয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مَا لَكُمۡ إِذَا قِيلَ لَكُمُ ٱنفِرُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ  “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের হয়েছে কী যে, যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে বের হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়” অর্থাৎ যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে জিহাদ করার জন্য আহ্বান জানানো হয় ٱثَّاقَلۡتُمۡ إِلَى ٱلۡأَرۡضِۚ “তখন তোমরা আরও জোরে মাটি কামড়ে ধর।” ছায়া ও পাকা ফলের স্থানে থেকে যাওয়ার জন্য অলসতা কর হেলান দিয়ে পড়ে যাও।  أَرَضِيتُم بِٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا مِنَ ٱلۡأٓخِرَةِۚ “তোমরা কি আখিরাতের স্থলে দুনিয়ার জীবনকেই বেশি পছন্দ কর?” তোমাদের কী হল, কেন তোমরা এ কাজ কর, এটা কি তোমাদের আখিরাতের পরিবর্তে পার্থিব জীবনকে পছন্দ করে নেওয়ার কারণে? এরপর আল্লাহ তা‘আলা পার্থিব জীবনের প্রতি আগ্রহ হ্রাস করে এবং আখিরাতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে বলেন: فَمَا مَتَٰعُ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا فِي ٱلۡأٓخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ “আখিরাতের তুলনায় পার্থিব জীবনের ভোগ সামগ্রী তো অতি সামান্য”।
ইমাম আহমদ বানু ফিহরের অন্যতম এক ব্যক্তি মুসতাওরিদ থেকে বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আখিরাতের তুলনায় পার্থিব জীবন তো তদ্রুপ যেমন তোমাদের কোনো ব্যক্তি সাগরে তার আঙ্গুল ডুবায় এরপর যেন সে দেখে তাতে কতটুকু পানি ফিরে আসে? এরপর তিনি তার তর্জনী দ্বারা ইঙ্গিত করেন। ইমাম মুসলিম এককভাবে এ হাদিস বর্ণনা করেছেন।
সাউরী আ‘মাশ থেকে فَمَا مَتَٰعُ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا فِي ٱلۡأٓخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ “আখিরাতের তুলনায় পার্থিব জীবনের ভোগ সামগ্রী তো অতি সামান্য” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: মুসাফিরের পাথেয়ের মত।
আব্দুল আযীয ইবনু আবু হাযিম তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, আব্দুল আযীয ইবনু মারওয়ান যখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত হন তখন তিনি বলেন: আমাকে যে কাফন পরানো হবে সেটি নিয়ে এস যেন আমি তা প্রত্যক্ষ করতে পারি। এরপর যখন সেটা তাঁর সম্মুখে রাখা হয় তিনি সেটা দেখতে থাকেন আর বলেন: এটা কি সেই জিনিস যার সাথে আমার দুনিয়াবী জীবন সমাপ্ত হচ্ছে? এরপর তিনি পিঠ ফিরান আর কেঁদে কেঁদে বলেন: তোমার জন্য আফসোস, হে দুনিয়া, তোমার প্রাচুর্য প্রকৃতই স্বল্প। আর তোমার স্বল্প তো আরও ছোট। আমরা তো তোমার ধোঁকায় পড়ে রয়ে ছিলাম।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা জিহাদ পরিত্যাগ করা থেকে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন: إِلَّا تَنْفِرُوا يُعَذِّبْكُمْ عَذَابًا أَلِيمًا “তোমরা যদি যুদ্ধাভিযানে বের না হও, তাহলে তোমাদেরকে ভয়াবহ শাস্তি দেওয়া হবে।” আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতিপয় আরবকে যুদ্ধে শামিল হওয়ার জন্য আহ্বান জানান; কিন্তু তারা অলসতা বশতঃ থেকে যায়। ফলে আল্লাহ তা‘আলাও তাদের থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেন আর এটা ছিল তাদের শাস্তি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: وَيَسۡتَبۡدِلۡ قَوۡمًا غَيۡرَكُمٌۡ “আর তোমাদের স্থলে অন্য সম্প্রদায়কে আনা হবে” অর্থাৎ তাঁর নবীকে সাহায্য করতে এবং তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿وَإِن تَتَوَلَّوۡاْ يَسۡتَبۡدِلۡ قَوۡمًا غَيۡرَكُمۡ ثُمَّ لَا يَكُونُوٓاْ أَمۡثَٰلَكُم ٣٨﴾ [محمد : ٣٨] “তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে নিয়ে আসবেন, তখন তারা তোমাদের মত হবে না।” [সূরা মুহাম্মদ: ৩৮]
وَلَا تَضُرُّوهُ شَيۡ‍ٔٗاۗ “(অথচ) তোমরা তাঁর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না” অর্থাৎ তোমরা যদি জিহাদ থেকে পেছনে থেকে যাও, গৃহে অবস্থান কর আর অলসতা কর, তবে তোমরা আল্লাহ তা‘আলার কোনোই ক্ষতি করতে পারবে না।
وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٌ “আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান” অর্থাৎ তিনি তোমাদের সাহায্য ছাড়াই শত্রুদেরকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম।
إِلَّا تَنصُرُوهُ فَقَدۡ نَصَرَهُ ٱللَّهُ إِذۡ أَخۡرَجَهُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ ثَانِيَ ٱثۡنَيۡنِ إِذۡ هُمَا فِي ٱلۡغَارِ إِذۡ يَقُولُ لِصَٰحِبِهِۦ لَا تَحۡزَنۡ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَنَاۖ فَأَنزَلَ ٱللَّهُ سَكِينَتَهُۥ عَلَيۡهِ وَأَيَّدَهُۥ بِجُنُودٖلَّمۡ تَرَوۡهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ ٱلسُّفۡلَىٰۗ وَكَلِمَةُ ٱللَّهِ هِيَ ٱلۡعُلۡيَاۗ وَٱللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ٤٠
“৪০. যদি তোমরা তাকে (অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে) সাহায্য না কর (তাতে কোনই পরোয়া নেই) কারণ আল্লাহ তো তাকে সেই সময় সাহায্য করেছেন যখন কাফিররা তাকে বের করে দিয়েছিল, সে ছিল দু’জনের দ্বিতীয়জন যখন তারা দু’জন গুহার মধ্যে ছিল, যখন সে তার সঙ্গীকে বলছিল, ‘চিন্তা করো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ তখন আল্লাহ তার প্রতি তাঁর প্রশান্তি বর্ষণ করলেন আর তাকে এমন সেনাবাহিনী দিয়ে শক্তিশালী করলেন তোমরা যা দেখতে পাওনি, আর তিনি কাফিরদের মুখের বুলিকে গভীর নীচে ফেলে দিলেন। আর আল্লাহর বাণীই রয়েছে সর্বোচ্চে। আল্লাহ প্রবল পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞানী।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ৪০]
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীর সাহায্যকারী:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: إِلَّا تَنصُرُوهُ “যদি তোমরা তাকে (অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে) সাহায্য না কর, (তাতে কোনই পরোয়া নেই)।” অর্থাৎ তাঁর রাসূলকে সাহায্য না কর, তবে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাহায্যকারী, তিনি তাঁকে শক্তিশালী করবেন। তিনিই তাঁর জন্য যথেষ্ট, তাঁর হিফাযতকারী, যেভাবে তিনি তাঁকে সাহায্য করেছেন إِذۡ أَخۡرَجَهُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ ثَانِيَ ٱثۡنَيۡنِ “যখন কাফিররা তাকে বের করে দিয়েছিল, সে ছিল দু’জনের দ্বিতীয়জন।” অর্থাৎ হিজরতের বৎসর যখন মুশরিকরা তাকে হত্যা অথবা বন্দী অথবা বয়কট করার চিন্তা করেছিল, তখন তিনি তাঁর বন্ধু ও সঙ্গী আবু বকর ইবনু আবু কুহাফাকে সাথে নিয়ে মক্কা থেকে বের হয়ে যান। এরপর তিনি সাউর পর্বতে তিনদিন আশ্রয় গ্রহণ করেন, যাতে করে যে সমস্ত অনুসন্ধানকারীরা তাদের পদচি‎হ্ন ধরে তাঁদেরকে খুঁজতে এসেছিল তারা ফিরে যায়। এরপর তিনি মদিনার দিকে রওয়ানা হন, (তাঁরা যখন সাউর গুহায় অবস্থান করেন) তখন আবু বকর ভয় পান যে তাদের কেউ তাঁদেরকে দেখে ফেলবে আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কষ্ট দিবে; কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মনে প্রশান্তি আনয়ন করেন আর তাকে শান্ত করে বলেন: হে আবু বকর, তোমার দু’জনের সম্পর্কে কী ধারণা যাদের তৃতীয় জন হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা। যেমন- ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে বর্ণনা করেন: আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করি -এমতাবস্থায় যে আমি গুহায় অবস্থান করছি- তাদের কেউ যদি তার দু’পায়ের প্রতি লক্ষ্য করে তবে তার দু’পায়ের তলে আমাদেরকে দেখতে পাবে। তিনি বলেন: তখন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: হে আবু বকর, তোমার দু’জনের সম্পর্কে কী ধারণা যাদের তৃতীয় জন হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা? ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম তাঁদের ‘সহীহ’ গ্রন্থদ্বয়ে এ হাদিস বর্ণনা করেছেন। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: فَأَنزَلَ ٱللَّهُ سَكِينَتَهُۥ عَلَيۡهِ “তখন আল্লাহ তার প্রতি তাঁর প্রশান্তি বর্ষণ করলেন” তাঁর নবীর প্রতি তাঁর সাহায্য বিজয় প্রেরণ করেন। কেউ কেউ বলেন: আবু বকরের উপরে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: وَأَيَّدَهُۥ بِجُنُودٖلَّمۡ تَرَوۡهَا “আর তাকে এমন সেনাবাহিনী দিয়ে শক্তিশালী করলেন তোমরা যা দেখতে পাও নি” অর্থাৎ ফেরেশতা পাঠিয়ে। وَجَعَلَ كَلِمَةَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ ٱلسُّفۡلَىٰۗ وَكَلِمَةُ ٱللَّهِ هِيَ ٱلۡعُلۡيَاۗ  “আর তিনি কাফিরদের মুখের বুলিকে গভীর নীচে ফেলে দিলেন। আর আল্লাহর বাণীই রয়েছে সর্বোচ্চে।”
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: কাফেরদের মুখের বুলির অর্থ হচ্ছে: শির্ক আর আল্লাহর বাণীর অর্থ হচ্ছে لا إله إلا الله অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে: আবু মূসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ সমস্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় যারা বীরত্ব দেখানোর জন্য লড়াই করে অথবা নিজের সম্মানের উন্মত্ততা প্রদর্শনের জন্য লড়াই করে অথবা লোক দেখানোর জন্য লড়াই করে, এদের মধ্যে কে আল্লাহর পথে লড়াই করে? তিনি বলেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার বাণীকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য লড়াই করে সে আল্লাহর পথে লড়াই করে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَٱللَّهُ عَزِيزٌ  “আল্লাহ প্রবল পরাক্রান্ত” অর্থাৎ তাঁর প্রতিশোধ গ্রহণে এবং শাস্তি প্রদানে। তিনি হচ্ছেন শক্তিশালী সম্মানিত, যে ব্যক্তি তাঁর আশ্রয় গ্রহণ করে আর তিনি যা শিক্ষা দিয়েছেন তা আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে তাঁর শরণাপন্ন হয় সে অন্যায়ভাবে অত্যাচারিত হয় না। حَكِيمٌ“মহা-বিজ্ঞানী” তাঁর কথা ও কাজে।
﴿ٱنفِرُواْ خِفَافٗا وَثِقَالٗا وَجَٰهِدُواْ بِأَمۡوَٰلِكُمۡ وَأَنفُسِكُمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِۚ ذَٰلِكُمۡ خَيۡرٞ لَّكُمۡ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٤١﴾ [التوبة: ٤١]
“৪১. যুদ্ধাভিযানে বেরিয়ে পড়, অবস্থা হালকাই হোক আর ভারীই হোক (অস্ত্র কম থাকুক আর বেশি থাকুক) আর আল্লাহর রাস্তায় তোমাদের মাল দিয়ে আর তোমাদের জান দিয়ে জিহাদ কর, এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, তোমরা যদি জানতে!” [সূরা আত-তাওবাহ: ৪১]

সর্বাবস্থায় জিহাদ অপরিহার্যকরণ:
সুফিয়ান আস-সারী তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি আবুয্ যুহা মুসলিম ইবনু সুবাইহ থেকে বর্ণনা করেন। সূরা বারা’আতের এই আয়াত সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়। মু‘তামির ইবনু সুলাইমান তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, হাদরামী দাবি করেন যে, তাকে বলা হয়েছে: কতিপয় ব্যক্তি ঘোষণা করত যে (যদি তারা জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হওয়া মুসলিম সৈন্যদল থেকে পেছনে রয়ে যায়) তবে তাদের কোনো গোনাহ হবে না। কেননা তারা অসুস্থ ও বয়োবৃদ্ধ তখন আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করেন: ٱنفِرُواْ خِفَافٗا وَثِقَالٗا “ যুদ্ধাভিযানে বেরিয়ে পড়, অবস্থা হালকাই হোক আর ভারীই হোক।” আল্লাহ তা‘আলা তাবুক যুদ্ধের বছর তাঁর শত্রু আহলে কিতাবি রোমিও কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সকলকে সার্বিকভাবে বেরিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। আর সুখ-দুঃখ, উদ্দীপনা-অনীহা সর্বাবস্থায় মুমিনগণকে রাসূলুল্লাহ‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বের হওয়াকে আবশ্যক করে দেন। তিনি বলেন: ٱنفِرُواْ خِفَافٗا وَثِقَالٗا “যুদ্ধাভিযানে বেরিয়ে পড়, অবস্থা হালকাই হোক আর ভারীই হোক।”
আলী ইবনু যাইদ আনাস থেকে বর্ণনা করেন, আবু তলহা বলেন: পৌঢ় হোক বা যুবক হোক, আল্লাহ তা‘আলা কারো জন্যও কৈফিয়ত প্রদানের সুযোগ রাখেন নি। এরপর আবু তালহা শামের দিকে রওয়ানা করেন এবং লড়াই করতে করতে শহীদ হন।
অপর এক বর্ণনায় রয়েছে: আবু তালহা সূরা আল-বারা’আহ পাঠ করতে থাকেন অবশেষে যখন তিনি  ٱنفِرُواْ خِفَافٗا وَثِقَالٗا وَجَٰهِدُواْ بِأَمۡوَٰلِكُمۡ وَأَنفُسِكُمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ“যুদ্ধাভিযানে বেরিয়ে পড়, অবস্থা হালকাই হোক আর ভারীই হোক আর আল্লাহর রাস্তায় তোমাদের মাল দিয়ে আর তোমাদের জান দিয়ে জিহাদ কর” এ আয়াতে পৌঁছেন তখন তিনি বলেন: আমি দেখছি আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে জিহাদে বের হতে বলেছেন, চাই আমরা বৃদ্ধ হই অথবা যুবক হই। ওহে আমার পুত্ররা, আমাকে সাজিয়ে দাও, তাঁর পুত্ররা বলেন: আল্লাহ আপনার উপরে রহম করুন, আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সাথে থেকে যুদ্ধ করেছেন। আপনি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এরও মৃত্যু র্যন্ত তাঁর সাথে থেকে জিহাদ করেছেন, আপনি ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এরও মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সাথে থেকে যুদ্ধ করেছেন। এখন আমরা আপনার পক্ষ থেকে যুদ্ধ করব; কিন্তু তিনি অস্বীকার করেন। তিনি সমুদ্রে ভ্রমণ করেন, এরপরে মারা যান। তাঁকে দাফন করার জন্য এক টুকরোও দ্বীপও পাওয়া যায় নি। তবে নয় দিন পরে যখন তাঁকে দাফন করা হয় তখন দেখা যায় তাঁর দেহে কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। এরপর তাঁরা তাঁকে একটি দ্বীপে দাফন করেন।
সুদ্দী ٱنفِرُواْ خِفَافٗا وَثِقَالٗا “অবস্থা হালকাই হোক আর ভারীই হোক যুদ্ধাভিযানে বেরিয়ে পড়” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: ধনী হোক, দরিদ্র হোক, শক্তিশালী হোক বা দুর্বল হোক, জনৈক ব্যক্তি সম্মুখে আসে, লোকেরা মনে করে তিনি হচ্ছেন মিকদাদ। তিনি ছিলেন বিশাল ও মোটা দেহের অধিকারী। তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এ ব্যাপারে আপত্তি জানান আর যুদ্ধে না যাওয়ার ব্যাপারে অনুমতি প্রার্থনা করেন; কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অস্বীকার করেন তখন সেদিন অবতীর্ণ হয়: ٱنفِرُواْ خِفَافٗا وَثِقَالٗا “অবস্থা হালকাই হোক আর ভারীই হোক যুদ্ধাভিযানে বেরিয়ে পড়।” যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন এই নির্দেশ লোকদের উপরে অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত রহিত করে দিয়ে বলেন: لَيْسَ عَلَى الضُّعَفَاءِ وَلَا عَلَى الْمَرْضَى وَلَا عَلَى الَّذِينَ لَا يَجِدُونَ مَا يُنْفِقُونَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوا لِلَّهِ وَرَسُولِهِ “দুর্বলের উপর, পীড়িতের উপর আর ব্যয় করার মত কোনো সম্বল যাদের নেই তাদের উপর কোনো অভিযোগ নেই, যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি কল্যাণকামী হয়ে থাকে।”
ইবনু জারীর বলেন: হাদিস বর্ণনা করেন আমার নিকট হিব্বান ইবনু যাইদ আশ-শারআবী, তিনি বলেন: আমরা আল-আফসূস নগরীর নিকট অবস্থিত হিমসের গভর্নর সাফওয়ান ইবনু আমেরের সাথে জিরাজিমাহর দিকে জিহাদের জন্য বের হই, (এ সময়) আমি সেনাবাহিনীর মধ্যে একজন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিকে লক্ষ্য করি যিনি তখনও সক্রিয় ছিলেন। তাঁর ভ্রূদ্বয় তাঁর দুই চোখের উপরে ঝুলে পড়েছে, তিনি ছিলেন লড়াই করতে আসা দামেস্ক-বাসীদের অন্যতম; যিনি তাঁর বাহনে সাওয়াররত ছিলেন। আমি তাঁর নিকট এগিয়ে গিয়ে বলি: হে চাচা, আল্লাহ তা‘আলা তো আপনার জন্য কৈফিয়ত রেখেছেন। বর্ণনাকারী বলেন: এরপর তিনি তাঁর ভ্রূদ্বয় উঠিয়ে বলেন: হে আমার ভাতিজা, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে অবস্থা হালকাই হোক আর ভারীই হোক সর্ববাস্থায় যুদ্ধে বের হতে বলেছেন। জেনে রাখ, আল্লাহ তা‘আলা যাকে ভালোবাসেন তাকে পরীক্ষায় ফেলেন। এরপর আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাদেরকে চিরস্থায়ী ঠিকানায় ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের মাঝে তাকে ভালোবাসেন যে তাঁর শুকরিয়া আদায় করে, ধৈর্যধারণ করে এবং তাঁকে স্মরণ করে। আর সে আল্লাহ ছাড়া আর কারও ইবাদত করে না।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাস্তায় দান করার ব্যাপারে এবং তাঁর ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে রক্ত দিতে উৎসাহিত করে বলেন: وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ “আর আল্লাহর রাস্তায় তোমাদের মাল দিয়ে আর তোমাদের জান দিয়ে জিহাদ কর, এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, তোমরা যদি জানতে।” অর্থাৎ দুনিয়া ও আখিরাতে এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। কেননা তোমরা সামান্য পরিমাণ ব্যয় কর, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে তোমাদের শত্রুদের সম্পদের মাধ্যমে ধনী করে দিবেন। আবার তার সাথে তো তিনি তোমাদের জন্য পরকালে সম্মান সঞ্চিত করে রেখেছেন। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পথে লড়াইকারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন যে, সে যদি মারা যায় তবে তিনি তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন অথবা সাওয়াব ও গনিমত সহকারে তাঁকে তাঁর বাসস্থানে ফিরিয়ে দিবেন। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلۡقِتَالُ وَهُوَ كُرۡهٞ لَّكُمۡۖ وَعَسَىٰٓ أَن تَكۡرَهُواْ شَيۡ‍ٔٗا وَهُوَ خَيۡرٞ لَّكُمۡۖ وَعَسَىٰٓ أَن تُحِبُّواْ شَيۡ‍ٔٗا وَهُوَ شَرّٞ لَّكُمۡۚ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ وَأَنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ ٢١٦﴾ [البقرة: ٢١٦] “তোমাদের প্রতি যুদ্ধের বিধান দেওয়া হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপ্রিয় কিন্তু তোমরা কোন কিছু অপছন্দ কর সম্ভবত: তোমাদের জন্য তা কল্যাণকর এবং সম্ভবত: কোনো কিছু তোমাদের কাছে প্রিয় অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। বস্তুত: আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না।” [সুরা আল-বাকারা: ২১৬]  
এ সম্পর্কে ইমাম আহমাদ আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক ব্যক্তিকে বলেন: তুমি ইসলাম গ্রহণ কর; কিন্তু সেই লোকটি বলে: এমনটি করতে আমার অপছন্দ হচ্ছে, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: তুমি ইসলাম গ্রহণ কর যদিও তোমার নিকট তা অপছন্দনীয় মনে হয়।
﴿لَوۡ كَانَ عَرَضٗا قَرِيبٗا وَسَفَرٗا قَاصِدٗا لَّٱتَّبَعُوكَ وَلَٰكِنۢ بَعُدَتۡ عَلَيۡهِمُ ٱلشُّقَّةُۚ وَسَيَحۡلِفُونَ بِٱللَّهِ لَوِ ٱسۡتَطَعۡنَا لَخَرَجۡنَا مَعَكُمۡ يُهۡلِكُونَ أَنفُسَهُمۡ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ إِنَّهُمۡ لَكَٰذِبُونَ ٤٢﴾ [التوبة: ٤٢]
“৪২. স্বার্থ উদ্ধার হলে আর যাত্রা সহজ হলে তারা অবশ্যই তোমার সাথে যেত; কিন্তু পথ তাদের কাছে দীর্ঘ ও ভারী মনে হয়েছে। অচিরেই তারা আল্লাহর নামে হলফ করে বলবে, ‘আমরা যদি পারতাম তাহলে অবশ্যই তোমাদের সঙ্গে বের হতাম।’ আসলে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংস করছে, আর আল্লাহ জানেন যে, তারা অবশ্যই মিথ্যেবাদী।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৪২]
মুনাফিকদের পেছনে পড়ার কারণ আর তাদের ছলচাতুরী:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে তাবুক যুদ্ধে যাওয়া থেকে যারা পেছনে রয়ে গিয়েছিল আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি ভৎসনা করেন। তাদের ওযর রয়েছে এ ধরণের ভাব প্রকাশ করে তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অনুমতি নিয়ে যুদ্ধে যাওয়া বাদ দিয়ে বসেছিল অথচ প্রকৃতপক্ষে তাদের এ ধরণের ওযর ছিল না। তিনি বলেন: لَوۡ كَانَ عَرَضٗا قَرِيبٗا “স্বার্থ উদ্ধার হলে” অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: তাদের সম্মুখে গনিমত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, وَسَفَرٗا قَاصِدٗا “আর যাত্রা সহজ হলে” সম্মুখে সফর থাকলে لَّٱتَّبَعُوكَ “তারা অবশ্যই তোমার সাথে যেত।” অর্থাৎ তারা সেজন্য তোমার সাথে যেত। وَلَٰكِنۢ بَعُدَتۡ عَلَيۡهِمُ ٱلشُّقَّةُۚ “কিন্তু পথ তাদের কাছে দীর্ঘ ও ভারী মনে হয়েছে” শামে যাওয়ার দূরত্ব وَسَيَحۡلِفُونَ بِٱللَّهِ يُهۡلِكُونَ أَنفُسَهُمۡ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ إِنَّهُمۡ لَكَٰذِبُونَ “অচিরেই তারা আল্লাহর নামে হলফ করে বলবে” অর্থাৎ তোমাদের নিকট তোমরা যখন তাদের নিকট ফিরে আস لَوِ ٱسۡتَطَعۡنَا لَخَرَجۡنَا مَعَكُمۡ “আমরা যদি পারতাম তাহলে অবশ্যই তোমাদের সঙ্গে বের হতাম।” অর্থাৎ আমাদের যদি ওযর না থাকত তবে অবশ্যই আমরা তোমাদের সাথে বের হতাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: يُهۡلِكُونَ أَنفُسَهُمۡ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ إِنَّهُمۡ لَكَٰذِبُونَ “আসলে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংস করছে, আর আল্লাহ জানেন যে, তারা অবশ্যই মিথ্যেবাদী।”
﴿عَفَا ٱللَّهُ عَنكَ لِمَ أَذِنتَ لَهُمۡ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكَ ٱلَّذِينَ صَدَقُواْ وَتَعۡلَمَ ٱلۡكَٰذِبِينَ ٤٣ لَا يَسۡتَ‍ٔۡذِنُكَ ٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ أَن يُجَٰهِدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡۗ وَٱللَّهُ عَلِيمُۢ بِٱلۡمُتَّقِينَ ٤٤ إِنَّمَا يَسۡتَ‍ٔۡذِنُكَ ٱلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَٱرۡتَابَتۡ قُلُوبُهُمۡ فَهُمۡ فِي رَيۡبِهِمۡ يَتَرَدَّدُونَ ٤٥ ﴾ [التوبة: ٤٣،  ٤٥]
“৪৩. আল্লাহ তোমাকে মাফ করুন! কারা সত্য বলেছে তা স্পষ্ট না হতেই আর মিথ্যাবাদীদেরকে তুমি চিনে না নিয়েই কেন তুমি তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে দিলে? ৪৪. যারা আল্লাহয় ও শেষ দিনে বিশ্বাস করে তারা তাদের মাল দিয়ে আর জান দিয়ে জিহাদ করা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য তোমার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে না। মুত্তাকীদের সম্পর্কে আল্লাহ খুবই অবগত আছেন। ৪৫. তোমার কাছে অব্যাহতি প্রার্থনা তারাই করে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস করে না, যাদের অন্তর সন্দেহ-পূর্ণ, কাজেই তাঁরা তাদের সন্দেহের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।” (সূরা আত-তাওবাহ্: ৪৩)
তাদেরকে অনুমতি দেওয়ার কারণে আল্লাহ তা‘আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তিরস্কার করেন
ইবনু আবু হাতিম বর্ণনা করেন, আউন বলেন: আপনারা কি এর চেয়ে উত্তম কোন তিরস্কারে কথা কি শুনেছেন? তিরস্কারের পূর্বেই ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: عَفَا ٱللَّهُ عَنكَ لِمَ أَذِنتَ لَهُمۡ “আল্লাহ তোমাকে মাফ করুন! কেন তুমি তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে দিলে?” মুওর্য়ারক আল-আজালী এবং অন্যান্যরা এ মত ব্যক্ত করেন।
কাতাদা বলেন: তিনি তাঁকে তিরস্কার করেছেন যেমন তোমরা শুনছ এরপর তাদের মধ্যে তাঁর যাকে খুশি অনুমতি দানের অনুমতি প্রদান করে সূরা আন-নূরে আল্লাহ তা‘আলা আয়াত অবতীর্ণ করেন ﴿ فَإِذَا ٱسۡتَ‍ٔۡذَنُوكَ لِبَعۡضِ شَأۡنِهِمۡ فَأۡذَن لِّمَن شِئۡتَ مِنۡهُمۡ ٦٢﴾ (النور : ٦٢) “কাজেই তাদের কেউ তাদের কোনো কাজে যাওয়ার জন্য তোমার কাছে অনুমতি চাইলে তুমি তাদের যাকে ইচ্ছে অনুমতি দিবে।” [সূরা আন-নূর: ৬২] অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে ‘আতা’ আল খোরাসানী থেকে।
মুজাহিদ বলেন: এই আয়াত একদল লোক সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে তারা বলে: তোমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি চেয়ে দেখ, যদি তিনি অনুমতি দেন তবে যুদ্ধে না গিয়ে বসে থাক। আর যদি তিনি অনুমতি নাও দেন তবুও বসে থাকবে। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكَ ٱلَّذِينَ صَدَقُواْ “কারা সত্য বলেছে তা স্পষ্ট না হতেই” প্রকৃতই ওযর রয়েছে কিনা তা না জেনে وَتَعۡلَمَ ٱلۡكَٰذِبِينَ “আর মিথ্যাবাদীদেরকে তুমি চিনে না নিয়েই” আল্লাহ তা‘আলা বলেন: কেন তুমি তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করলে না যখন তারা তোমার নিকট যুদ্ধে না গিয়ে বসে থাকার অনুমতি চায়তে আসে, যাতে করে তুমি বুঝতে পার তোমার আনুগত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে কে তাদের মধ্যে সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী। তারা তো যুদ্ধে না গিয়ে বসে থাকার দিকেই ঝুঁকে ছিল যদিও তুমি তাদেরকে অনুমতি না দিতে।
এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা অবহিত করেন যে, যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে তারা যুদ্ধে না গিয়ে বসে থাকার অনুমতি চায় না। তিনি বলেন: لَا يَسۡتَ‍ٔۡذِنُكَ “তোমার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে না” অর্থাৎ যুদ্ধ থেকে বসে থাকার জন্য। ٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ أَن يُجَٰهِدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡۗ “যারা আল্লাহয় ও শেষ দিনে বিশ্বাস করে তারা তাদের মাল দিয়ে আর জান দিয়ে জিহাদ করা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য।” তারা জিহাদকে আল্লাহ তা‘আলা নৈকট্য পাওয়ার কারণ মনে করে। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা যখন তাদেরকে জিহাদের আহ্বান জানান তখন তারা দ্রুত সেদিকে অগ্রসর হয়। আর তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে, وَٱللَّهُ عَلِيمُۢ بِٱلۡمُتَّقِينَ “মুত্তাকীদের সম্পর্কে আল্লাহ খুবই অবগত আছেন। তোমার কাছে অব্যাহতি প্রার্থনা তারাই করে” অর্থাৎ যাদের কোনো ওজর-আপত্তি নেই তারাই বসে থাকার জন্য, ٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ “যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস করে না” অর্থাৎ পরকালে তারা তাদের আমলের জন্য আল্লাহ তা‘আলার সাওয়াবের আশা করে না। وَٱرۡتَابَتۡ قُلُوبُهُمۡ “যাদের অন্তর সন্দেহপূর্ণ” অর্থাৎ তুমি যা নিয়ে তাদের নিকট আগমন করেছ তার বিশুদ্ধতার ব্যাপারে তারা সন্দিহান فَهُمۡ فِي رَيۡبِهِمۡ يَتَرَدَّدُونَ “কাজেই তাঁরা তাদের সন্দেহের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে” তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পতিত, তারা একবার একধাপ সামনে অগ্রসর হয় আরেকবার একধাপ পিছিয়ে যায়, কোনো বিষয়ে তাদের পা স্থির নেই। তারা আত্মবিশ্বাস-হীন এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত। তারা এ দলেও নেই ও দলেও নেই। আল্লাহ তা‘আলা যাকে গোমরাহ করেন তার জন্য কোন পথ পাবে না।
﴿وَلَوۡ أَرَادُواْ ٱلۡخُرُوجَ لَأَعَدُّواْ لَهُۥ عُدَّةٗ وَلَٰكِن كَرِهَ ٱللَّهُ ٱنۢبِعَاثَهُمۡ فَثَبَّطَهُمۡ وَقِيلَ ٱقۡعُدُواْ مَعَ ٱلۡقَٰعِدِينَ ٤٦ لَوۡ خَرَجُواْ فِيكُم مَّا زَادُوكُمۡ إِلَّا خَبَالٗا وَلَأَوۡضَعُواْ خِلَٰلَكُمۡ يَبۡغُونَكُمُ ٱلۡفِتۡنَةَ وَفِيكُمۡ سَمَّٰعُونَ لَهُمۡۗ وَٱللَّهُ عَلِيمُۢ بِٱلظَّٰلِمِينَ ٤٧ ﴾ [التوبة: ٤٦،  ٤٧]  
“৪৬. (যুদ্ধাভিযানে) তাদের যদি বের হওয়ার ইচ্ছেই থাকত তবে তারা সেজন্য অবশ্যই প্রস্তুতি নিত; কিন্তু তাদের অভিযানে গমনই আল্লাহর পছন্দ নয়। কাজেই তিনি তাদেরকে পশ্চাতে ফেলে রাখেন আর তাদেরকে বলা হয়, ‘যারা (নিষ্ক্রিয় হয়ে) বসে থাকে তাদের সাথে বসে থাক’। ৪৭. তারা যদি তোমাদের সঙ্গে বের হত তাহলে বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কিছুই বাড়াত না আর তোমাদের মাঝে ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশে তোমাদের মাঝে ছুটাছুটি করত আর তোমাদের মাঝে তাদের কথা শুনার লোক আছে। আল্লাহ যালিমদের সম্পর্কে খুব ভালভাবেই অবহিত আছেন।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ৪৬-৪৭]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: وَلَوۡ أَرَادُواْ ٱلۡخُرُوجَ “(যুদ্ধাভিযানে) বের হওয়ার তাদের যদি ইচ্ছেই থাকত” অর্থাৎ তোমার সাথে যুদ্ধে لَأَعَدُّواْ لَهُۥ  “তবে তারা সেজন্য অবশ্যই প্রস্তুতি নিত” এ ধরণের কাজে তারা প্রস্তুতি নিত।
وَلَٰكِن كَرِهَ ٱللَّهُ ٱنۢبِعَاثَهُمۡ “কিন্তু তাদের অভিযানে গমনই আল্লাহর পছন্দ নয়।” তারা তোমার সাথে যাক আল্লাহ এটা অপছন্দ করেছেন তাঁর ফায়সালা-গত ভাবে فَثَبَّطَهُمۡ “কাজেই তিনি তাদেরকে পশ্চাতে ফেলে রাখেন।” অর্থাৎ তিনি তাদেরকে পেছনে করে দিয়েছেন وَقِيلَ ٱقۡعُدُواْ مَعَ ٱلۡقَٰعِدِينَ “আর তাদেরকে বলা হয়, ‘যারা (নিষ্ক্রিয় হয়ে) বসে থাকে তাদের সাথে বসে থাক।” এটা তাদের বিরুদ্ধে ফায়সালার একটি অংশ, এরপর আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণের সাথে তাদের বের হওয়া অপছন্দ করার কারণ বর্ণনা করে বলেন:لَوۡ خَرَجُواْ فِيكُم مَّا زَادُوكُمۡ إِلَّا خَبَالٗا “তারা যদি তোমাদের সঙ্গে বের হত তাহলে বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কিছুই বাড়াত না।” অর্থাৎ কেননা তারা ভীরু, ব্যর্থ। وَلَأَوۡضَعُواْ خِلَٰلَكُمۡ يَبۡغُونَكُمُ ٱلۡفِتۡنَةَ “আর তোমাদের মাঝে ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশে তোমাদের মাঝে ছুটাছুটি করত।” তোমাদের মাঝে ফিতনা, ঘৃণা এবং কুৎসা রটনার উদ্দেশ্যে ছুটে বেড়াত وَفِيكُمۡ سَمَّٰعُونَ لَهُمۡۗ “আর তোমাদের মাঝে তাদের কথা শুনার লোক আছে।” অর্থাৎ তাদের অনুসারী, তাদের আলোচনা ও কথা-বার্তা তাদের কাছে ভালো লাগে। তারা তাদের নিকট উপদেশ চায়, যদিও তারা তাদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত নয়। ফলে সেটা মুমিনগণের মাঝে অনিষ্ট ও বিরাট বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক বর্ণনা করেন, আমার জানা মতে যারা অনুমতি চেয়েছিল তার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ, তাদের মধ্যে রয়েছে আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনু সালূল, জাদ্দ ইবনু কাইস, তারা ছিল তাদের গোত্রের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত লোক। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পেছনে করে দেন কারণ তিনি জানেন যে, তারা যদি তাঁর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে বের হত তবে তাঁর সৈন্যগণের মাঝে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত। তাঁর সৈন্যগণের মধ্যে এমন কতগুলো লোক ছিল যারা তাদেরকে পছন্দ করত এবং তারা তাদেরকে যার প্রতি আহ্বান জানাত সেক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করত, কেননা তাদের মাঝে তাদের সম্মান ছিল। তিনি বলেন: وَفِيكُمۡ سَمَّٰعُونَ لَهُمۡۗ “আর তোমাদের মাঝে তাদের কথা শুনার লোক আছে” এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পূর্ণ জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত করে বলেন: وَٱللَّهُ عَلِيمُۢ بِٱلظَّٰلِمِينَ “আল্লাহ যালিমদের সম্পর্কে খুব ভালভাবেই অবহিত আছেন।” এরপর তিনি অবহিত করেন যে, আল্লাহ তা‘আলা সে সব বিষয় জানেন যা ঘটেছে এবং ঘটবে। আর যা হয় নি যদি তা হত তবে কীভাবে সেটা হত। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: لَوۡ خَرَجُواْ فِيكُم مَّا زَادُوكُمۡ إِلَّا خَبَالٗا “তারা যদি তোমাদের সঙ্গে বের হত তাহলে বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কিছুই বাড়াত না।” আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করে বলেন যে, যদি তারা বের হত তবে কী ঘটত তা সত্ত্বেও তার বের হয় নি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿ وَلَوۡ رُدُّواْ لَعَادُواْ لِمَا نُهُواْ عَنۡهُ وَإِنَّهُمۡ لَكَٰذِبُونَ ٢٨﴾ [الانعام: ٢٨] “আর তাদেরকে (পৃথিবীতে) ফিরিয়ে দেওয়া হলে তারা আবার তা-ই করবে যা করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, নিশ্চয় তারা হল মিথ্যুক।” [সূরা আল-আন‘আম: ২৮] আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿وَلَوۡ عَلِمَ ٱللَّهُ فِيهِمۡ خَيۡرٗا لَّأَسۡمَعَهُمۡۖ وَلَوۡ أَسۡمَعَهُمۡ لَتَوَلَّواْ وَّهُم مُّعۡرِضُونَ ٢٣﴾ [الانفال: ٢٣]  “আল্লাহ যদি জানতেন যে, তাদের মধ্যে কোনো ভালো গুণ নিহিত আছে, তবে তিনি তাদেরকে শুনবার তাওফিক দিতেন। আর (গুণ না থাকা অবস্থায়) তিনি যদি তাদেরকে শুনতে দিতেন তাহলে তারা উপেক্ষা করে মুখ ফিরিয়ে নিত।” [সূরা আল-আনফাল: ২৩]  
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَلَوۡ أَنَّا كَتَبۡنَا عَلَيۡهِمۡ أَنِ ٱقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ أَوِ ٱخۡرُجُواْ مِن دِيَٰرِكُم مَّا فَعَلُوهُ إِلَّا قَلِيلٞ مِّنۡهُمۡۖ وَلَوۡ أَنَّهُمۡ فَعَلُواْ مَا يُوعَظُونَ بِهِۦ لَكَانَ خَيۡرٗا لَّهُمۡ وَأَشَدَّ تَثۡبِيتٗا ٦٦ وَإِذٗا لَّأٓتَيۡنَٰهُم مِّن لَّدُنَّآ أَجۡرًا عَظِيمٗا ٦٧﴾ [النساء : ٦٦، ٦٧]
“৬৬. যদি আমি তাদের প্রতি ফরয করে দিতাম যে তোমরা নিজেদেরকে হত্যা কর কিংবা নিজেদের দেশ থেকে বেরিয়ে যাও, তবে স্বল্পসংখ্যক লোক ছাড়া কেউ তা পালন করত না। যা করতে তাদেরকে উপদেশ দেওয়া হয় তা যদি তারা পালন করত, তবে তা তাদের পক্ষে কল্যাণকর হত এবং দৃঢ় চিত্তটার কারণ হত। সে অবস্থায় অবশ্যই আমি তাদেরকে আমার নিকট হতে মহা-পুরস্কার দান করতাম এবং তাদেরকে অবশ্যই সঠিক পথ প্রদর্শন করতাম।” [সূরা আন-নিসা: ৬৬-৬৮] এ ব্যাপারে অনেক আয়াত রয়েছে।
﴿لَقَدِ ٱبۡتَغَوُاْ ٱلۡفِتۡنَةَ مِن قَبۡلُ وَقَلَّبُواْ لَكَ ٱلۡأُمُورَ حَتَّىٰ جَآءَ ٱلۡحَقُّ وَظَهَرَ أَمۡرُ ٱللَّهِ وَهُمۡ كَٰرِهُونَ ٤٨﴾ [التوبة: ٤٨]  
“৪৮. আগেও তারা ফিতনা সৃষ্টি করতে চেয়েছে আর তোমার অনেক কাজ নষ্ট করেছে যতক্ষণ না প্রকৃত সত্য এসে হাজির হল আর আল্লাহর বিধান প্রকাশিত হয়ে গেল যদিও এতে তারা ছিল নাখোশ।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ৪৮]
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের বিরুদ্ধে তাঁর নবীকে উৎসাহিত করে বলেন: لَقَدِ ٱبۡتَغَوُاْ ٱلۡفِتۡنَةَ مِن قَبۡلُ وَقَلَّبُواْ لَكَ ٱلۡأُمُورَ “আগেও তারা ফিতনা সৃষ্টি করতে চেয়েছে আর তোমার অনেক কাজ নষ্ট করেছে” আল্লাহ তা‘আলা বলেন: মুনাফিকরা তোমার এবং তোমার সাথিদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছে। যেমন- তারা তোমাদের দীনকে ব্যর্থ করার ও নিভিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছে। সেটা ঐ সময় যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম মদিনায় আগমন করেন, যখন সকল আরব পৌত্তলিকরা একত্রিত হয়েছিল, মদিনার ইয়াহূদী এবং এর মুনাফিকরা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। এরপর যখন বদর যুদ্ধে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে সাহায্য করেন আর তাঁর বাণীকে উঁচুতে তুলে ধরেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই এবং তার সাথিরা বলে: এটা (ইসলাম) এমন এক বিষয় যা বিজয় লাভ করেছে। ফলে তারা বাহ্যিকভাবে ইসলামে প্রবেশ করে। এরপর যখনই আল্লাহ তা‘আলা ইসলাম এবং এর অনুসারীদের শক্তিশালী করেন তখন মুনাফিকদের ক্রোধ এবং হতাশা বৃদ্ধি পায়। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: حَتَّىٰ جَآءَ ٱلۡحَقُّ وَظَهَرَ أَمۡرُ ٱللَّهِ وَهُمۡ كَٰرِهُونَ “যতক্ষণ না প্রকৃত সত্য এসে হাজির হল আর আল্লাহর বিধান প্রকাশিত হয়ে গেল যদিও এতে তারা ছিল নাখোশ।”
﴿وَمِنۡهُم مَّن يَقُولُ ٱئۡذَن لِّي وَلَا تَفۡتِنِّيٓۚ أَلَا فِي ٱلۡفِتۡنَةِ سَقَطُواْۗ وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمُحِيطَةُۢ بِٱلۡكَٰفِرِينَ ٤٩﴾ [التوبة: ٤٩]
“৪৯. তাদের মাঝে এমন লোক আছে যারা বলে, ‘আমাকে অব্যাহতি দিন, আমাকে পরীক্ষায় ফেলবেন না।’ জেনে রেখ, তারা তো ফিতনাতে পড়েই আছে। বস্তুত: জাহান্নাম কাফিরদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ৪৯]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: মুনাফিকদের মধ্যে কেউ বলে: হে মুহাম্মাদ, ٱئۡذَن لِّي “আমাকে অব্যাহতি দিন” অর্থাৎ বসে থাকার وَلَا تَفۡتِنِّيٓۚ “আমাকে পরীক্ষায় ফেলবেন না” আপনার সাথে বের হয়ে আর রোমিও নারীদের দেখে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: أَلَا فِي ٱلۡفِتۡنَةِ سَقَطُواْ “জেনে রেখ, তারা তো ফিতনাতে পড়েই আছে।” তারা তো তাদের এ কথার দ্বারাই ফিতনাতে পড়ে গেছে। যেমন, মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক বর্ণনা করেন, যুহরী, ইয়াযীদ ইবনু রূমান, আব্দুল্লাহ ইবনু আবু বকর, ‘আসিম ইবনু কাতাদাহ এবং অন্যান্যরা বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনূ সালামার জাদ্দ ইবনু কায়েসকে বলেন: হে জাদ্দ, এ বৎসর কি তুমি বানূ আসফারকে বিতাড়নে আমাদের সাথি হবে? তখন সে বলে: হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাকে অনুমতি দিন। আর আমাকে ফিতনায় (পরীক্ষায়) ফেলবেন না, আল্লাহর শপথ, আমার কাওম জানে যে, আমার চেয়ে নারীদের প্রতি অধিক আকৃষ্ট ব্যক্তি আর নেই। আর আমার ভয় হচ্ছে আমি যদি বনূ আসফারের নারীদেরকে দেখি তবে তাদের ব্যাপারে ধৈর্য ধরে থাকতে পারব না। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন আর বলেন: ‘আমি তোমাকে অনুমতি দিলাম’ তখন জাদ্দ ইবনু কায়েসের ব্যাপারে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়:وَمِنۡهُم مَّن يَقُولُ ٱئۡذَن لِّي وَلَا تَفۡتِنِّيٓۚ “তাদের মাঝে এমন লোক আছে যারা বলে, ‘আমাকে অব্যাহতি দিন, আমাকে পরীক্ষায় ফেলবেন না” অর্থাৎ যদি এমন হয় যে, সে বনূ আসফারের নারীদের ব্যাপারে আশঙ্কা করছে, -প্রকৃত ব্যাপার অবশ্যই তা নয়। তবে সেটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে না যেয়ে পেছনে থেকে যাওয়ার চেয়ে বড় ফিতনা নয়। আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জানের নিরাপত্তার চেয়ে নিজের জানের নিরাপত্তাকে পছন্দ করে নেওয়া তার চেয়ে আরও বড় ফিতনা (যার সে মিথ্যা দাবিদার)। এরূপ ভাবে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা, মুজাহিদ এবং অন্যান্যদের থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এই আয়াতটি জাদ্দ ইবনু কায়েসের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। জাদ্দ ইবনু কায়েস ছিল বনু সালামার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। বিশুদ্ধ বর্ণনায় এসেছে: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বলেন: হে বনু সালামাহ, তোমাদের নেতা কে? তারা বলে: আল জাদ্দ ইবনু কায়েস, যদিও আমরা তাকে কঞ্জুস হিসেবে জানি, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: কৃপণতার ব্যাধির চেয়ে অধিক ব্যাধি আর কী হতে পারে?। বরং তোমাদের নেতা হচ্ছে কোঁকড়ানো চুল বিশিষ্ট ফর্সা যুবক বিশর ইবনুল বারা’ ইবনু মা‘রূর। আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمُحِيطَةُۢ بِٱلۡكَٰفِرِينَ “বস্তুত: জাহান্নাম কাফিরদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে।” অর্থাৎ এ থেকে তাদের পলায়নের কোনো স্থান নেই, নেই তাদের কোনো পালাবার পথ।
﴿إِن تُصِبۡكَ حَسَنَةٞ تَسُؤۡهُمۡۖ وَإِن تُصِبۡكَ مُصِيبَةٞ يَقُولُواْ قَدۡ أَخَذۡنَآ أَمۡرَنَا مِن قَبۡلُ وَيَتَوَلَّواْ وَّهُمۡ فَرِحُونَ ٥٠ قُل لَّن يُصِيبَنَآ إِلَّا مَا كَتَبَ ٱللَّهُ لَنَا هُوَ مَوۡلَىٰنَاۚ وَعَلَى ٱللَّهِ فَلۡيَتَوَكَّلِ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٥١ ﴾ [التوبة: ٥٠،  ٥١]
“৫০. তোমার মঙ্গল হলে তা তাদেরকে মনঃকষ্ট দেয়, আর তোমার উপর বিপদ আসলে তারা খুশির সঙ্গে এ কথা বলতে বলতে সরে পড়ে যে, ‘আমরা আগেই সাবধানতা অবলম্বন করেছিলাম।’ ৫১. বলে দাও, ‘আল্লাহ আমাদের জন্য যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তাছাড়া অন্য কিছুই আমাদের ঘটবে না। তিনিই আমাদের রক্ষক আর আল্লাহর উপরই মু’মিনদের ভরসা করা দরকার।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ৫০-৫১]
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে তাঁর প্রতি ওদের শত্রুতার কথা জানিয়ে দিচ্ছেন, কেননা তিনি যে কল্যাণই অর্জন করেন অর্থাৎ শত্রুদের উপরে বিজয়, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আর তাঁর সাহাবীগণের জন্য সহজ করে দিয়েছেন এতে তারা (মুনাফিকরা) কষ্ট পায়। وَإِن تُصِبۡكَ مُصِيبَةٞ يَقُولُواْ قَدۡ أَخَذۡنَآ أَمۡرَنَا مِن قَبۡلُ “আর তোমার উপর বিপদ আসলে তারা বলে: আমরা আগেই সাবধানতা অবলম্বন করেছিলাম।” অর্থাৎ আমরা ইতোপূর্বেই তার আনুগত্য করা থেকে সতর্ক ছিলাম।
وَيَتَوَلَّواْ وَّهُمۡ فَرِحُونَ “আর তারা খুশির সঙ্গে এ কথা বলতে বলতে সরে পড়ে” ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে তাঁর প্রতি তাদের পুর্ণাঙ্গ শত্রুতার এ ভাবে জবাব দিতে বলছেন قُلْ “বলে দাও” অর্থাৎ তাদেরকে বলে দাও لَّن يُصِيبَنَآ إِلَّا مَا كَتَبَ ٱللَّهُ لَنَا “আল্লাহ আমাদের জন্য যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তাছাড়া অন্য কিছুই আমাদের ঘটবে না” অর্থাৎ আমরা তাঁর ইচ্ছা ও তাঁর ফায়সালার অধীনে আছি। هُوَ مَوۡلَىٰنَاۚ “তিনিই আমাদের রক্ষক” আমাদের অভিভাবক, আমাদের আশ্রয়স্থল। وَعَلَى ٱللَّهِ فَلۡيَتَوَكَّلِ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ “আর আল্লাহর উপরই মু’মিনদের ভরসা করা দরকার” অর্থাৎ আমরা তাঁর উপরে ভরসা রাখি। তিনি আমাদের জন্য যথেষ্ট আর তিনি উত্তম কর্মবিধায়ক।
﴿قُلۡ هَلۡ تَرَبَّصُونَ بِنَآ إِلَّآ إِحۡدَى ٱلۡحُسۡنَيَيۡنِۖ وَنَحۡنُ نَتَرَبَّصُ بِكُمۡ أَن يُصِيبَكُمُ ٱللَّهُ بِعَذَابٖ مِّنۡ عِندِهِۦٓ أَوۡ بِأَيۡدِينَاۖ فَتَرَبَّصُوٓاْ إِنَّا مَعَكُم مُّتَرَبِّصُونَ ٥٢ قُلۡ أَنفِقُواْ طَوۡعًا أَوۡ كَرۡهٗا لَّن يُتَقَبَّلَ مِنكُمۡ إِنَّكُمۡ كُنتُمۡ قَوۡمٗا فَٰسِقِينَ ٥٣ وَمَا مَنَعَهُمۡ أَن تُقۡبَلَ مِنۡهُمۡ نَفَقَٰتُهُمۡ إِلَّآ أَنَّهُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَبِرَسُولِهِۦ وَلَا يَأۡتُونَ ٱلصَّلَوٰةَ إِلَّا وَهُمۡ كُسَالَىٰ وَلَا يُنفِقُونَ إِلَّا وَهُمۡ كَٰرِهُونَ ٥٤ ﴾ [التوبة: ٥٢،  ٥٤]
“৫২. বল, ‘তোমরা আমাদের জন্য যে জিনিসের অপেক্ষা করছ তা দুটো ভালোর একটি ছাড়া আর কিছুই না (শাহাদাত কিংবা বিজয়)আর আমরা অপেক্ষা করছি এজন্য যে, আল্লাহ নিজেই তোমাদেরকে শাস্তি দেন অথবা আমাদের হাত দিয়ে দেয়ান। কাজেই অপেক্ষায় থাক, আমরা তোমাদের সাথে অপেক্ষায় থাকলাম।’ ৫৩. বল, ‘স্বেচ্ছায় দান কর আর অনিচ্ছায়, তোমাদের থেকে কক্ষনো তা গ্রহণ করা হবে না; তোমরা হলে এক ফাসিক সম্প্রদায়।’ ৫৪. তাদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য গ্রহণ নিষিদ্ধ করার কারণ এ ছাড়া আর কিছু নয় যে তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করে, সলাতে আসলে আসে শৈথিল্যভরে আর দান করলেও করে অনিচ্ছা নিয়ে।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ৫২-৫৪]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: قُلْ (বল) তাদেরকে, হে মু‏হাম্মাদ هَلۡ تَرَبَّصُونَ “তোমরা আমাদের জন্য যে জিনিসের অপেক্ষা করছ” অর্থাৎ তোমরা আমাদের যে জিনিসের প্রতীক্ষায় রয়েছ, إِلَّآ إِحۡدَى ٱلۡحُسۡنَيَيۡنِۖ “তা দু’টো ভালোর একটি ছাড়া আর কিছুই না।” তা হল, শাহাদত অথবা তোমাদের উপরে বিজয়। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা, মুজাহিদ, কাতাদা এবং অন্যান্যরা এ মত ব্যক্ত করেছেন وَنَحۡنُ نَتَرَبَّصُ بِكُمۡ “আর আমরা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছি এজন্য যে” অর্থাৎ আমরাও তোমাদের প্রতীক্ষায় রয়েছি  أَن يُصِيبَكُمُ ٱللَّهُ بِعَذَابٖ مِّنۡ عِندِهِۦٓ أَوۡ بِأَيۡدِينَاۖ “আল্লাহ নিজেই তোমাদেরকে শাস্তি দেন অথবা আমাদের হাত দিয়ে দেয়ান।” অর্থাৎ আমরা তোমাদের জন্য এর অথবা ওর প্রতীক্ষায় আছি- হয়
أَن يُصِيبَكُمُ ٱللَّهُ بِعَذَابٖ مِّنۡ عِندِهِۦٓ أَوۡ بِأَيۡدِينَا “আল্লাহ নিজেই তোমাদেরকে শাস্তি দেন অথবা আমাদের হাত দিয়ে দেয়ান।” অর্থাৎ বন্দি করে অথবা হত্যা করে فَتَرَبَّصُوٓاْ إِنَّا مَعَكُم مُّتَرَبِّصُونَ “কাজেই অপেক্ষায় থাক, আমরা তোমাদের সাথে অপেক্ষায় থাকলাম।” আল্লাহ তা‘আলার বাণী: قُلۡ أَنفِقُواْ طَوۡعًا أَوۡ كَرۡهٗا  “বল, স্বেচ্ছায় দান কর আর অনিচ্ছায়” অর্থাৎ তোমরা যা কিছু দান কর স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় لَّن يُتَقَبَّلَ مِنكُمۡ إِنَّكُمۡ كُنتُمۡ قَوۡمٗا فَٰسِقِينَ “তোমাদের থেকে কক্ষনো তা গ্রহণ করা হবে না; তোমরা হলে এক ফাসিক সম্প্রদায়।” এরপর আল্লাহ তা‘আলা এর কারণ উল্লেখ করেন অর্থাৎ তিনি যে তাদের থেকে গ্রহণ করবেন না তার কারণ  أَنَّهُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَبِرَسُولِهِۦ “তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করে” অর্থাৎ আমল কেবলমাত্র ঈমান সহকারে বিশুদ্ধ হয় وَلَا يَأۡتُونَ ٱلصَّلَوٰةَ إِلَّا وَهُمۡ كُسَالَىٰ “সলাতে আসলে আসে শৈথিল্যভরে” অর্থাৎ তাদের না আছে বিশুদ্ধ অভিপ্রায় আর না আছে আমল করার আগ্রহ। وَلَا يُنفِقُونَ “আর দান করলেও” কোন দান, إِلَّا وَهُمۡ كَٰرِهُونَ “অনিচ্ছা নিয়ে” সত্যবাদী এবং সত্য যার প্রতি সম্পৃক্ত করা হয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ তা‘আলা কোএা বান্দাকে পুরস্কার দেওয়া বন্ধ করে দেন না, যতক্ষণ না তোমরা (হে বিশ্বাসীগণ) আমল করা বন্ধ করে দাও। আল্লাহ তা‘আলা হচ্ছেন পবিত্র আর তিনি কেবল পবিত্র বিষয়ই গ্রহণ করেন। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদের থেকে কোনো ধরণের দান-সদাক্বাহ, কোনো ধরণের আমল গ্রহণ করবেন না। কেননা তিনি শুধুমাত্র মুত্তাক্বী ব্যক্তিদের থেকেই গ্রহণ করেন।
﴿فَلَا تُعۡجِبۡكَ أَمۡوَٰلُهُمۡ وَلَآ أَوۡلَٰدُهُمۡۚ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُعَذِّبَهُم بِهَا فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَتَزۡهَقَ أَنفُسُهُمۡ وَهُمۡ كَٰفِرُونَ ٥٥ ﴾ [التوبة: ٥٥]
“৫৫. কাজেই তাদের ধন-সম্পত্তি আর সন্তান-সন্ততি যেন তোমার চোখ ধাঁদিয়ে না দেয়, ওসব দিয়েই আল্লাহ দুনিয়াতে ওদেরকে শাস্তি দিতে চান আর কাফির অবস্থাতেই যেন তাদের জান বাহির হয়।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ৫৫]
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে বলেন: فَلَا تُعۡجِبۡكَ أَمۡوَٰلُهُمۡ وَلَآ أَوۡلَٰدُهُمۡۚ “কাজেই তাদের ধন-সম্পত্তি আর সন্তান-সন্ততি যেন তোমার চোখ ধাঁদিয়ে না দেয়” যেমন তিনি বলেন: ﴿وَلَا تَمُدَّنَّ عَيۡنَيۡكَ إِلَىٰ مَا مَتَّعۡنَا بِهِۦٓ أَزۡوَٰجٗا مِّنۡهُمۡ زَهۡرَةَ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا لِنَفۡتِنَهُمۡ فِيهِۚ وَرِزۡقُ رَبِّكَ خَيۡرٞ وَأَبۡقَىٰ ١٣١﴾ [طه: ١٣١]  “তুমি কখনো চোখ খুলে তাকিও না ঐ সব বস্তুর প্রতি, যা আমি তাদের বিভিন্ন দলকে পার্থিব জীবনে উপভোগের জন্য সৌন্দর্যস্বরূপ দিয়েছি, এসব দিয়ে তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। তোমার রবের দেওয়া রিযকই হল সবচেয়ে উত্তম ও সবচেয়ে বেশি স্থায়ী।” (সূরা ত্বহা: ১৩১) তিনি আরও বলেন: ﴿أَيَحۡسَبُونَ أَنَّمَا نُمِدُّهُم بِهِۦ مِن مَّالٖ وَبَنِينَ ٥٥ نُسَارِعُ لَهُمۡ فِي ٱلۡخَيۡرَٰتِۚ بَل لَّا يَشۡعُرُونَ ٥٦﴾ [المؤمنون : ٥٥، ٥٦] “তারা কি ভেবে নিয়েছে, আমি যে তাদেরকে ধনঐশ্বর্য ও সন্তানাদির প্রাচুর্য দিয়ে সাহায্য করেছি ৫৬. এর দ্বারা কি তাদের কল্যাণ ত্বরান্বিত করছি? না, তারা বুঝে না।” [সূরা আল-মু’মিনুন: ৫৫-৫৬]
তাঁর বাণী: إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُعَذِّبَهُم بِهَا فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا “ওসব দিয়েই আল্লাহ দুনিয়াতে ওদেরকে শাস্তি দিতে চান।” হাসান আল-বাসরী রহ. বলেন: তাদের থেকে তাদের অর্থ-সম্পদের যাকাত গ্রহণ করে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার মাধ্যমে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَتَزۡهَقَ أَنفُسُهُمۡ وَهُمۡ كَٰفِرُونَ “আর কাফির অবস্থাতেই যেন তাদের জান বাহির হয়” অর্থাৎ তিনি তাদেরকে মৃত্যু দিতে চান। যখন তাদেরকে মৃত্যু দিতে চান-কুফরির উপরে যাতে করে সেটা তাদের জন্য অত্যন্ত নিকৃষ্ট হয় আর শাস্তি হিসেবে চরম যন্ত্রণাদায়ক হয়। আল্লাহ তা‘আলার নিকট আমরা আশ্রয় কামনা করি। আর তারা যাতে পড়ে আছে তাতে ঢিল বা সাময়িক ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে।
﴿وَيَحۡلِفُونَ بِٱللَّهِ إِنَّهُمۡ لَمِنكُمۡ وَمَا هُم مِّنكُمۡ وَلَٰكِنَّهُمۡ قَوۡمٞ يَفۡرَقُونَ ٥٦ لَوۡ يَجِدُونَ مَلۡجَ‍ًٔا أَوۡ مَغَٰرَٰتٍ أَوۡ مُدَّخَلٗا لَّوَلَّوۡاْ إِلَيۡهِ وَهُمۡ يَجۡمَحُونَ ٥٧﴾ [التوبة: ٥٦،  ٥٧]
“৫৬. তারা আল্লাহর নামে কসম করে বলে যে, তারা তোমাদেরই মধ্যের লোক, তারা কক্ষনো তোমাদের মধ্যের লোক নয়, প্রকৃতপক্ষে তারা তোমাদের ব্যাপারে ভীত-সন্ত্রস্ত লোক। ৫৭. তারা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়ার জায়গা পেলে কিংবা গিরিগুহা বা ঢুকে থাকার মত জায়গা পেলে সেখানেই তারা ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে  যেত।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ৫৬-৬৭]
মুনাফিকদের আতঙ্কের ব্যাখ্যা:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাদের আতঙ্ক, বিভীষিকা ও ভয়-ডর সম্পর্কে অবহিত করেন। আল্লাহ বলেন, وَيَحۡلِفُونَ بِٱللَّهِ إِنَّهُمۡ لَمِنكُمۡ “তারা আল্লাহর নামে কসম করে বলে যে, তারা তোমাদেরই মধ্যের লোক” দৃঢ় শপথ
وَمَا هُم مِّنكُمۡ “তারা কক্ষনো তোমাদের মধ্যের লোক নয়” অর্থাৎ বাস্তবে
  وَلَٰكِنَّهُمۡ قَوۡمٞ يَفۡرَقُونَ “প্রকৃতপক্ষে তারা তোমাদের ব্যাপারে ভীত-সন্ত্রস্ত লোক।” এ বিষয়টি তাদেরকে শপথ করার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করেছে
لَوۡ يَجِدُونَ مَلۡجَ‍ًٔا “তারা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়ার জায়গা পেলে” কোনো দূর্গ অথবা সুরক্ষিত যাতে তারা আশ্রয় নিবে, أَوۡ مَغَٰرَٰتٍ “কিংবা গিরিগুহা” অর্থাৎ যা পাহাড়ে হয়ে থাকে أَوۡ مُدَّخَلٗا  “বা ঢুকে থাকার মত জায়গা পেলে” অর্থাৎ জমিনের মধ্যে কোনো সুড়ঙ্গ এবং গর্ত -এ তিনটি বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়েছেন আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা, মুজাহিদ এবং কাতাদা।
لَّوَلَّوۡاْ إِلَيۡهِ وَهُمۡ يَجۡمَحُونَ “সেখানেই তারা ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে যেত।” তবে তারা তোমাদের থেকে ছুটে পালিয়ে যেত। কেননা তারা তোমাদের সাথে মিশে নিছক অসন্তুষ্টি সহকারে, ভালোবেসে নয়। তারা পারতপক্ষে তোমাদের সাথে মিশতে চায় না; অবশ্য অত্যাবশ্যক প্রয়োজনীয় কিছু বিধি-বিধান এর ব্যতিক্রম রয়েছে, এ কারণে তারা সর্বদা উদ্বিগ্ন এবং দুশ্চিন্তায় পড়ে থাকে। কেননা ইসলাম এবং তার অনুসারীদের উত্তরোত্তর উন্নতই ঘটেই চলেছে। এ কারণে যখনই মুসলিমগণ আনন্দিত হয় তখনই তারা এতে কষ্ট পায় এবং তারা মুমিনগণের সাথে মিশতে চায় না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: لَوۡ يَجِدُونَ مَلۡجَ‍ًٔا أَوۡ مَغَٰرَٰتٍ أَوۡ مُدَّخَلٗا لَّوَلَّوۡاْ إِلَيۡهِ وَهُمۡ يَجۡمَحُونَ “তারা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়ার জায়গা পেলে কিংবা গিরিগুহা বা ঢুকে থাকার মত জায়গা পেলে সেখানেই তারা ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে যেত।
﴿وَمِنۡهُم مَّن يَلۡمِزُكَ فِي ٱلصَّدَقَٰتِ فَإِنۡ أُعۡطُواْ مِنۡهَا رَضُواْ وَإِن لَّمۡ يُعۡطَوۡاْ مِنۡهَآ إِذَا هُمۡ يَسۡخَطُونَ ٥٨ وَلَوۡ أَنَّهُمۡ رَضُواْ مَآ ءَاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَقَالُواْ حَسۡبُنَا ٱللَّهُ سَيُؤۡتِينَا ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦ وَرَسُولُهُۥٓ إِنَّآ إِلَى ٱللَّهِ رَٰغِبُونَ ٥٩ ﴾ [التوبة: ٥٨،  ٥٩]
“৫৮. তাদের মধ্যে এমন লোক আছে যারা সদাক্বাহ (বণ্টনের) ব্যাপারে তোমার প্রতি দোষারোপ করে, তাত্থেকে দেওয়া হলে খুশি হয়, আর তাত্থেকে না দেওয়া হলে সাথে সাথে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। ৫৯. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাদেরকে যা দিয়েছেন তারা যদি তাতে সন্তুষ্ট থাকত আর বলত, ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, অচিরেই আল্লাহ অনুগ্রহ করে আমাদেরকে দিবেন আর তাঁর রাসূলও, আমরা আশা ভরসা নিয়ে আল্লাহর দিকেই চেয়ে থাকি।” [সূরা আত-তাওবাহ্:  ৫৮-৫৯[
সদাক্বাহর ব্যাপারে মুনাফিকদের দোষারোপ করা এবং এর প্রতি তাদের লোভ:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: وَمِنۡهُم “তাদের মধ্যে এমন লোক আছে” অর্থাৎ মুনাফিকদের মধ্যে مَّن يَلۡمِزُكَ  “তোমার প্রতি দোষারোপ করে” অর্থাৎ তোমার দোষ বের করে  فِي “ব্যাপারে” বন্টনের ব্যাপারে ٱلصَّدَقَٰتِ “সদকা” যখন তুমি তা বন্টন কর তখন সে ব্যাপারে তোমার স্বচ্ছতা নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলে। অথচ তারাই এর উপযুক্ত যে, তাদের চরিত্র প্রশ্নের সম্মুখীন। তারা দ্বীনের দরদে যে এরকম আচরণ করে তা নয়; বরং তারা আরও বেশি পাওয়ার জন্য এমনটি করে। এ কারণে যদি فَإِنۡ أُعۡطُواْ مِنۡهَا رَضُواْ وَإِن لَّمۡ يُعۡطَوۡاْ مِنۡهَآ إِذَا هُمۡ يَسۡخَطُون “তাত্থেকে তাদেরকে দেওয়া হয়, তখন খুশি হয় আর তাত্থেকে না দেওয়া হলে সাথে সাথে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে।” অর্থাৎ- ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়ে। কাতাদা وَمِنۡهُم مَّن يَلۡمِزُكَ فِي ٱلصَّدَقَٰتِ “তাদের মধ্যে এমন লোক আছে যারা সদকা (বণ্টনের) ব্যাপারে তোমার প্রতি দোষারোপ করে” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: তাদের মধ্যে কেউ কেউ সদকা বণ্টনের ব্যাপারে তোমার সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলে। আমাদেরকে বলা হয়েছে যে, সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী জনৈক গ্রাম্য লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আগমন করে। এ সময় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বর্ণ-রৌপ্য বণ্টন করছিলেন। তখন সে বলে: হে মুহাম্মাদ, যদিও আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে বণ্টনের ক্ষেত্রে ইনসাফ করতে বলেছেন তথাপি তুমি ইনসাফ কর নি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: তুমি ধ্বংস হও, আমার পরে আর কে তোমার উপরে ইনসাফ করবে? এরপর আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: তোমরা এর এবং এর মত যারা আছে তাদের থেকে সতর্ক হও। আমার উম্মতের মাঝে এর মত কিছু লোক হবে, (যারা) কুরআন পাঠ করবে; কিন্তু সেটা তাদের গণ্ডদেশও অতিক্রম করবে না। কাজেই যখন তারা বের হবে তখন তাদেরকে তোমরা হত্যা কর। এরপর (আবারও) যখন তারা বের হবে তখন তোমরা তাদেরকে হত্যা কর। এরপর (আবারও) যখন তারা বের হবে তখনও তোমরা তাকে হত্যা কর। আমাদেরকে বলা হয়: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন: যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, আমি তোমাদেরকে কোনো কিছু দিবও না আবার বাধাও দিব না। আমি তো কেবল একজন তত্ত্বাবধায়ক।
কাতাদা এ সংক্রান্ত যা কিছু বলেন সেটা তার মত যা বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। আবু সাঈদ ‘যুল খুওয়াইসারাহ’-এর ঘটনা সম্পর্কে বলেন, যার নাম হচ্ছে ‘হুরকুস’। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনাইনের গনিমত বণ্টন করার সময় সে তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উপরে আপত্তি জানায়। সে তাঁকে বলে: ইনসাফ করুন, কেননা আপনি ইনসাফ করেন নি। ফলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: ‘যদি আমি ইনসাফ না করি তবে তো ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাব।’ লোকটি চলে যাওয়ার পরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: এর বংশধরের মধ্যে এমন কতগুলো লোক হবে যাদের সালাতের তুলনায় তোমাদের সালাতকে নিতান্ত নগণ্য মনে করবে। তাদের সিয়ামের তুলনায় তোমাদের সিয়ামকে তুচ্ছ মনে করবে। তারা দীন থেকে সেভাবে বের হয়ে যাবে যেভাবে ধনুক থেকে তীর বের হয়ে যায়। তাদের সাথে তোমাদের যেখানেই দেখা হবে সেখানেই তাদেরকে হত্যা করবে। আসমানের নিচে এরা হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট লাশ। এরপর হাদিসের বাকি অংশ বর্ণনা করেন। এরপর আল্লাহ তা‘আলা এ ধরণের লোকদেরকে জানিয়ে দেন যে, এ ধরণের আচরণের চেয়ে কিসে তাদের আরও বেশি উপকার রয়েছে? তিনি বলেন: وَلَوۡ أَنَّهُمۡ رَضُواْ مَآ ءَاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَقَالُواْ حَسۡبُنَا ٱللَّهُ سَيُؤۡتِينَا ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦ وَرَسُولُهُۥٓ إِنَّآ إِلَى ٱللَّهِ رَٰغِبُونَ “আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাদেরকে যা দিয়েছেন তারা যদি তাতে সন্তুষ্ট থাকত আর বলত, ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, অচিরেই আল্লাহ অনুগ্রহ করে আমাদেরকে দিবেন আর তাঁর রাসূলও, আমরা আশা ভরসা নিয়ে আল্লাহর দিকেই চেয়ে থাকি।” এই সম্মানিত আয়াতটি মহান শিষ্টাচার এবং সম্মানিত রহস্যের সাথে সংশ্লিষ্ট, আল্লাহ তা‘আলা ধার্য করে দিয়েছেন যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট হতে হয় আর কেবল তাঁর উপর ভরসা রাখতে হয়। এ কথাই তিনি বলেছেন: وَقَالُواْ حَسۡبُنَا ٱللَّهُ “আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট” অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করার সামর্থ্য চাওয়া, তাঁর নির্দেশসমূহ পালন করা এবং তাঁর নিষেধসমূহকে বর্জন করা, তিনি যে সব বিষয়ে অবহিত করেছেন সেগুলো সত্য বলে মেনে নেওয়া এবং তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করা। এ সকল ক্ষেত্রে কেবল আল্লাহ তা‘আলার প্রতি আশা করতে হয়।
﴿إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ٦٠ ﴾ [التوبة: ٦٠]
“৬০. সদাক্বাহ হল ফকীর, মিসকীন ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারী ও যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তি ও ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে (ব্যয়ের জন্য) আর মুসাফিরের জন্য। এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ফরয। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, মহা-বিজ্ঞানী।” (সূরা আত-তাওবাহ্: ৬০)
যাকাতের খাতগুলোর বর্ণনা:
ইতোপূর্বে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেন যে, নির্বাধ মুনাফিকরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-উপরে আপত্তি জানায় আর সাদাক্বাহ বণ্টনের ক্ষেত্রে তাঁকে দোষারোপ করে। এরপর তিনি বর্ণনা করেন যে, তিনিই স্বয়ং এগুলো বণ্টন করেছেন, এর বিধান বর্ণনা করেছেন, তিনি স্বয়ং এর তত্ত্বাবধান করেছেন। বণ্টনের দায়িত্ব তিনি ছাড়া আর কারও উপরে ন্যস্ত করেন নি। তিনি একে উল্লিখিত লোকদের মাঝে বণ্টন করেছেন। অন্যদের উপরে এখানে ফকীরদেরকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কেননা এ কথা প্রসিদ্ধ যে, অন্যদের চেয়ে ফকীররাই সবচেয়ে অভাবগ্রস্ত আর তাদের চাহিদা এবং অভাব বেশি। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা, মুজাহিদ, হাসান আল-বাসরই এবং ইবনু যাইদ থেকে বর্ণিত হয়েছে, ইবনু জারীর সহ একাধিক আলেম এ মতকে পছন্দ করেছেন যে, ফকীর হচ্ছে ঐ মার্জিত ব্যক্তি যে কারও কাছে কোনো কিছুই চায় না। আর মিসকীন হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে যাচনা করে এবং মানুষের দ্বারে দ্বারে এবং পেছনে পেছনে ঘুরে। কাতাদা বলেন: ফকীর হচ্ছে দরিদ্র ব্যক্তি আর মিসকীন হচ্ছে সে, যে সুস্থ দেহ-সম্পন্ন। আমরা এখানে কতগুলো হাদিস উল্লেখ করব যা এই আট প্রকারের সকলের সাথে সংশ্লিষ্ট।
ফকীর:
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ধনী ব্যক্তির জন্য সদকা গ্রহণ হালাল নয় এবং তারও জন্য নয়, যে সুস্থ দেহের অধিকারী। আহমাদ, আবু দাউদ এবং তিরমিযী এ হাদিস বর্ণনা করেছেন।

মিসকীন:
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মিসকীন তো সে নয়, যে লোকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় আর তাদের নিকট এক বা দুই লোকমা খাদ্যে অথবা একটি বা দু’টি খেজুর যাচনা করে। তখন সাহাবীগন জিজ্ঞেস করেন তবে মিসকীন কে ইয়া রাসূলাল্লাহ? তিনি বলেন: সে ঐ ব্যক্তি যে এমন কিছু পায় না, যার দ্বারা সে তার অভাব পূরণ করতে পারে অথবা যার অবস্থা সম্পর্কে লোকেরা জানে ফলে তাকে সদকা করে; কিন্তু লোকদের নিকট কিছু চায় না। বুখারী ও মুসলিম।
যাকাত সংগ্রাহক:
যাকাত সংগ্রাহকগন যাকাতের একটি অংশ পাওয়ার হকদার। আর এই যাকাত সংগ্রাহক রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটাত্মীয়দের হওয়া শোভনীয় নয়, যাদের উপরে যাকাত হারাম। যেমন সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। আব্দুল মুত্তালিব ইবনু রাবী‘আহ ইবনুল হারিস বর্ণনা করেন, তিনি এবং ফযল ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গিয়ে তাদেরকে যাকাত সংগ্রাহকের দায়িত্বে নিযুক্ত করার জন্য আরয করেন। তখন তিনি বলেন: যাকাত মুহাম্মাদ এবং মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা) বংশধরের জন্য বৈধ নয়। সেটা তো জনগণের সম্পদের ময়লা।
মন সন্তুষ্ট করা হয়েছে এমন লোকজন:
মন সন্তুষ্ট করা হয়েছে এমন লোকজন কয়েক-ভাগে বিভক্ত: তাদের মাঝে কাউকে দেওয়া হবে তাকে ইসলাম গ্রহণ করাতে, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফওয়ান ইবনু উমাইয়াকে হুনাইনের গনিমত থেকে প্রদান করেন, সে মুশরিক অবস্থায় হুনাইনের যুদ্ধে অংশ নেয়। তিনি (সাফওয়ান) বলেন: তিনি আমাকে দিতেই থাকেন এমনকি তিনি আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হন অথচ ইতোপূর্বে তিনি আমার নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি ছিলেন। যেমন ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেন, সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ্ আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনাইনের দিন আমাকে দান করেন। তিনি ছিলেন আমার নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। তিনি আমাকে দিতেই থাকেন অবশেষে তিনি আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হন। মুসলিম, তিরমিযী এ হাদিস বর্ণনা করেছেন।
তাদের মধ্যে কাউকে এজন্য দেওয়া হবে, সে যেন তার ইসলামকে (রীতিনীতি পালনকে) সুন্দর করে, আর তার অন্তর স্থির হয়, যেভাবে তিনি হুনাইনের দিনই তুলাকা (যাদের তিনি মক্কা বিজয়ের পর ছেড়ে দেন) এরূপ লোকদের বিশিষ্ট জনকে একশতটি করে উট দেন আর তিনি বলেন: আমি এমন এক ব্যক্তিকে (যাকাত) থেকে প্রদান করছি ঠিক যে সময়ে অন্য লোক তার চেয়ে আমার নিকট বেশি প্রিয়। আর তা এ ভয়ে যে, আল্লাহ তা‘আলা হয়ত তার মুখের ভরে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (যদি সে ইসলাম গ্রহণ না করে)। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু ইয়েমেন থেকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট মাটি মিশ্রিত স্বর্ণ প্রেরণ করেন। ফলে তিনি সেটা চারজন ব্যক্তির মাঝে বণ্টন করে দেন। (তাঁরা হলেন) আল-আকরা‘ ইবনু হাবিস, উইয়াইনা ইবনু বাদর, ‘আলক্বামাহ ইবনু উলাসাহ, এবং যাইদ আল-খাইর। আর তিনি বলেন: তাদের অন্তরগুলো কাছে আনার জন্য (এগুলো প্রদান করলাম)।
তাদের কাউকে এজন্য দেওয়া হবে হতে পারে তার কোনো সহচর ইসলাম গ্রহণ করবে। আবার কাউকে দেওয়া হবে আশে পাশের এলাকা থেকে যাকাত সংগ্রহ করার জন্য অথবা মুসলিমদের চৌকি রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য। আল্লাহ তা‘আলা ভালো জানেন।
দাসমুক্তি
রিক্বাব (দাসমুক্তি) সম্পর্কে হাসান আল-বসরী, মুকাতিল ইবনু হাইয়ান, ওমর ইবনু আব্দুল ‘আযীয, সা‘ঈদ ইবনু জুবাইর, নাখ‘ঈ, যুহরী এবং ইবনু যাইদ থেকে বর্ণিত হয়েছে: যে গোলাম অর্থ প্রদান করার শর্তে তার মনিবের সাথে নিজেকে মুক্ত করার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। আবু মূসা আশ‘আরী থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা, হাসান বলেছেন: যাকাতের অর্থ দিয়ে গোলাম আযাদ করায় দোষের কিছু নেই। অর্থাৎ রিক্বাব শব্দটি এ থেকে ব্যাপক যে, শুধুমাত্র মুকাতাব -কে তার মুক্তির জন্য অর্থ প্রদান করা হবে। অথবা দাস ক্রয় করে তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণরূপে আযাদ করা হবে। মারফূ সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে: আল্লাহ তা‘আলা আযাদকৃত গোলামের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিনিময়ে আযাদকারীর প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করবেন। এমনকি লজ্জা স্থানের বদলে লজ্জা স্থান। আর তা এ জন্য যে, পুরস্কার আমলের অনুরূপ হয়ে থাকে। ﴿ وَمَا تُجۡزَوۡنَ إِلَّا مَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ ٣٩ ﴾ [الصافات : ٣٩] “তোমাদেরকে কেবল তারই প্রতিফল দেওয়া হবে যা তোমরা করতে।” [সূরা আস-সাফফাত: ৩৯]
দাসমুক্তির ফযিলত:
মুসনাদে এসেছে: বারা’ ইবনু ‘আযিব বলেন: জনৈক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞেস করেন: হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলে দিন যা আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করে দিবে আর জাহান্নাম থেকে দুরে রাখবে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: নাসামা (গোলাম) আযাদ কর আর গর্দান মুক্ত কর। তখন লোকটি বলল: হে আল্লাহর রাসূল, এ দু’টি বিষয় কি এক নয়? তিনি বললেন: না, নাসামা আযাদ করার অর্থ হচ্ছে তাকে তুমি এককভাবে আযাদ করে দাও আর গর্দান মুক্ত করার অর্থ হচ্ছে তার (মুক্ত হওয়ার চুক্তিকৃত) অর্থে সাহায্য কর।
ঋণগ্রস্তদের জন্য:
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য কয়েকভাবে হতে পারে: তন্মধ্যে কেউ নিজের কাঁধে কারও ঋণের বোঝা বয়ে নেয়। (ফলে লোকদের মাঝে সংঘটিত বিবাদ মিটিয়ে দেয়।) আবার কেউ ঋণের জামিন হয় যে, সে ঋণ পরিশোধ করে দিবে; কিন্তু (দেখা যায়) তার সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে অথবা সে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে অথবা পাপে (ঋণী হয়ে পড়েছে) পরে সে তাওবাহ করেছে। এ ধরণের লোকের ঋণ পরিশোধে তাদেরকে যাকাত দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে কাবীসাহ ইবনু মুখারিক্ব আল-হিলালীর হাদিস এসেছে, তিনি বলেন: আমি এক ব্যক্তির ঋণের বোঝা নিজের ঘাড়ে তুলে নেই। এরপর আমি এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আগমন করি। তিনি বলেন: তুমি ধৈর্য ধর, অবশেষে যখন আমাদের নিকট যাকাত আসে আমরা তোমার জন্য সেখান থেকে বরাদ্দ করার নির্দেশ দিব। তিনি বলেন: এরপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: হে কাবীসাহ, এই তিন ব্যক্তি ছাড়া আর কারও জন্য যাচনা করা বৈধ নয়: যে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব কাঁধে নেয়, তার জন্য যাচনা করা বৈধ যে পর্যন্ত না সে তা পায়, এরপর সে বিরত থাকবে। অথবা যে ব্যক্তির আকস্মিক কোন দুর্ঘটনায় তার সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়, ফলে তার জীবন ধারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন যাচনা করা বৈধ রয়েছে। যে ব্যক্তি দারিদ্রতার কারণে দুর্বল হয়ে গিয়েছে, তার নিকটাত্মীয়দের তিনজন বিচক্ষণ ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিবে যে, সে দারিদ্রতার কারণে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে, ফলে তার জন্য যাচনা করা বৈধ রয়েছে- যে পর্যন্ত না সে তার জীবনধারণের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। এ ছাড়া অন্যান্য কারণে যাচনা করা অবৈধ সম্পত্তি। এর ভক্ষক অবৈধ সম্পদ ভক্ষণ করে। (মুসলিম)
আবু সাঈদ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে জনৈক ব্যক্তির ক্রয়কৃত ফলফলাদি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে সে অত্যন্ত ঋণী হয়ে পড়ে। ফলে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: একে তোমরা সদকা কর। ফলে লোকেরা তাকে সদকা করে, তবে সেটা তার ঋণ শোধ করার পরিমাণ পর্যন্ত পৌঁছে না। তখন তিনি ঋণ পাওনাদারদের বলেন: যা পেয়েছ তাই গ্রহণ কর। এ ছাড়া তোমাদের জন্য আর কিছু নেই। [মুসলিম]
আল্লাহর পথে (ব্যয়ের জন্য):
আল্লাহর পথে, তাদের মধ্যে রয়েছে মুজাহিদ (আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী) যে মুসলিমদের সম্পদ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করে না।
আর মুসাফিরের জন্য:
ইবনুস সাবীল হচ্ছে, সে অভাবি মুসাফির যে এমন কোনো জমিনে ভ্রমণ করে সেখানে এমন কোনো সাহায্য পায় না যার মাধ্যমে সে তার সফরের ব্যয়ভার বহন করতে পারে। ফলে তাকে যাকাত থেকে সেই পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হবে যাতে সে তার গন্তব্যে পৌঁছতে পারে। যদিও তার দেশে বা গন্তব্যে তার সম্পদ থাকে। এই বিধান তার জন্যও প্রযোজ্য যে তার নিজ এলাকা থেকে সফরের ইচ্ছা পোষণ করে; কিন্তু তার সাথে কিছু নেই। ফলে তার যাওয়া-আসার জন্য যে পরিমাণ অর্থ যথেষ্ট সেটা তাকে যাকাত থেকে দেওয়া যাবে। এর দলীল হচ্ছে বক্ষ্যমাণ আয়াতটি আর সেই হাদিস যা ইমাম আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ মা‘মার থেকে বর্ণনা করেছেন। যায়েদ ইবনু আসলাম ‘আতা’ ইবনু ইয়াসার থেকে বর্ণনা করেন, আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ধনীর জন্য যাকাত বৈধ নয় তবে পাঁচটি কারণ ছাড়া: সে তহশিলদার (যাকাত সংগ্রাহক), যে ব্যক্তি তার অর্থ দ্বারা যাকাতের বস্তু বা সম্পদ কিছু ক্রয় করে। ঋণী, আল্লাহ পথে লড়াইকারী অথবা কোনো মিসকিনকে সদকা করা হলে যে ধনীকে হাদিয়া হিসেবে তা প্রদান করে।”
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: فَرِيضَةً مِنَ اللَّهِ “এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ফরয।” অর্থাৎ একটি বিধান, ফায়সালা এবং বণ্টন যা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে ধার্যকৃত। وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ “আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, মহাবিজ্ঞানী” অর্থাৎ তিনি সকল বিষয়ের বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে অবহিত আরও জানেন কিসে তাঁর বান্দাদের উপকার রয়েছে। তিনি প্রজ্ঞাবান সে সব বিষয়ে যা তিনি বলেন, যা তিনি করেন, যে আইন প্রণয়ন করেন এবং যে ফায়সালা প্রদান করেন। তিনি ছাড়া প্রকৃত কোন উপাস্য নেই, তিনি ছাড়া নেই কোনো রব।
﴿وَمِنۡهُمُ ٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ ٱلنَّبِيَّ وَيَقُولُونَ هُوَ أُذُنٞۚ قُلۡ أُذُنُ خَيۡرٖ لَّكُمۡ يُؤۡمِنُ بِٱللَّهِ وَيُؤۡمِنُ لِلۡمُؤۡمِنِينَ وَرَحۡمَةٞ لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنكُمۡۚ وَٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ رَسُولَ ٱللَّهِ لَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٞ ٦١﴾ [التوبة: ٦١]
“৬১. তাদের মাঝে এমন লোকও আছে যারা নবীকে কষ্ট দেয় আর বলে তিনি কান কথা শুনেন। বল, ‘তোমাদের যাতে ভালো আছে সে তাই শোনে’। সে আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে, আর মু’মিনদেরকে বিশ্বাস করে, আর তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য রহমত। অপরপক্ষে আল্লাহর রাসূলকে যারা কষ্ট দেয় তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ ‘আযাব।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৬১]
মুনাফিকদের অন্যমত নিদর্শন হচ্ছে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট দেওয়া:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: মুনাফিকদের একদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্রের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে তাকে কষ্ট দেয়। তারা বলে: هُوَ أُذُنٌ “তিনি কান কথা শুনেন” অর্থাৎ আমাদের সম্পর্কে যে যাই বলে তাই তিনি বিশ্বাস করেন। তার সাথে যেই কথা বলে তাকেই তিনি বিশ্বাস করেন। কাজেই আমরা যদি তাঁর নিকট যাই আর শপথ করি তিনি আমাদেরকে বিশ্বাস করে নিবেন। এ ধরণের বর্ণনা আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা, মুজাহিদ এবং কাতাদা থেকে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: قُلۡ أُذُنُ خَيۡرٖ لَّكُمۡ  “বল, ‘যাতে তোমাদের ভালো আছে, তিনি তাই শোনেন।” তাঁর শোনা ভালো। তিনি জানেন কার কথা সত্য আর কার কথা মিথ্যা। يُؤۡمِنُ بِٱللَّهِ وَيُؤۡمِنُ لِلۡمُؤۡمِنِينَ وَرَحۡمَةٞ “সে আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে, আর মু’মিনদেরকে বিশ্বাস করে” অর্থাৎ তিনি মুমিনগণকে বিশ্বাস করেন। وَرَحۡمَةٞ لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنكُمۡۚ “আর তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য রহমত” অর্থাৎ তিনি কাফিরদের বিরুদ্ধে একটি প্রমাণ। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: وَٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ رَسُولَ ٱللَّهِ لَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٞ “অপরপক্ষে আল্লাহর রাসূলকে যারা কষ্ট দেয় তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ ‘আযাব।”
﴿يَحۡلِفُونَ بِٱللَّهِ لَكُمۡ لِيُرۡضُوكُمۡ وَٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَحَقُّ أَن يُرۡضُوهُ إِن كَانُواْ مُؤۡمِنِينَ ٦٢ أَلَمۡ يَعۡلَمُوٓاْ أَنَّهُۥ مَن يُحَادِدِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَأَنَّ لَهُۥ نَارَ جَهَنَّمَ خَٰلِدٗا فِيهَاۚ ذَٰلِكَ ٱلۡخِزۡيُ ٱلۡعَظِيمُ ٦٣ ﴾ [التوبة: ٦٢،  ٦٣]
“৬২. তোমাদেরকে খুশি করার জন্য তারা তোমাদের সামনে আল্লাহর নামে কসম করে। তারা যদি মু’মিন হয়ে থাকে তবে কাউকে খুশি করতে চাইলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই এর সবচেয়ে বেশি হকদার। ৬৩. তারা কি জানে না যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরোধিতা করে তার জন্য আছে জাহান্নামের আগুন যেখানে সে হবে চিরস্থায়ী? আর এটা খুবই লাঞ্ছনার ব্যাপার।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৬২-৬৩]
(মুনাফিকদের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে) মিথ্যা শপথ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সন্তুষ্টি করার প্রচেষ্টা। কাতাদাيَحۡلِفُونَ بِٱللَّهِ لَكُمۡ لِيُرۡضُوكُمۡ “তোমাদেরকে খুশি করার জন্য তারা তোমাদের সামনে আল্লাহর নামে কসম করে।” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: আমাদেরকে বলা হয়েছে: জনৈক মুনাফিক বলে: আল্লাহর শপথ, এরা (মুনাফিকরা) হচ্ছে আমাদের নেতা এবং আমাদের মধ্যেকার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেন তা যদি সত্য হয় যে, তারা গাধার চেয়ে নিকৃষ্ট। জনৈক মুসলিম এ কথা শুনে ফেলেন এরপর বলেন: আল্লাহর শপথ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেন তা অবশ্যই সত্য আর তুমি হচ্ছ গাধার চেয়ে নিকৃষ্ট। মুসলিম ব্যক্তিটি যা ঘটেছে সে বিষয়টি বহন করে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গিয়ে অবহিত করেন। রাসূল লোকটিকে ডেকে পাঠান। এরপর বলেন: ‘কিসে তোমাকে এ কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করেছে? সে নিজেকে ভর্ৎসনা করা শুরু করে আর আল্লাহর শপথ করে বলে যে, সে এ কথা বলে নি। তখন মুসলিম ব্যক্তিটি বলে ওঠে: হে আল্লাহ আপনি সত্যবাদীকে সত্যবাদী ঘোষণা করুন আর মিথ্যাবাদীকে মিথ্যাবাদী ঘোষণা করুন। তখন আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করেন: أَلَمۡ يَعۡلَمُوٓاْ أَنَّهُۥ مَن يُحَادِدِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ “তারা কি জানে না যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে” অর্থাৎ তারা কি নিশ্চিত হয় না আর জানে না যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার বিরোধিতা করে, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় আর তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে আর এভাবে সে একদিকে অবস্থান নেয়, যে সময়ে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল অন্যদিকে থাকেন। فَأَنَّ لَهُۥ نَارَ جَهَنَّمَ خَٰلِدٗا فِيهَاۚ  “তার জন্য আছে জাহান্নামের আগুন যেখানে সে হবে চিরস্থায়ী।” অর্থাৎ লাঞ্ছনা ও বেদনাদায়ক শাস্তি। ذَٰلِكَ ٱلۡخِزۡيُ ٱلۡعَظِيمُ “আর এটা খুবই লাঞ্ছনার ব্যাপার” অর্থাৎ এটা হচ্ছে মহা অপমান এবং বড় ধরণের দুর্ভাগ্য।
﴿ يَحۡذَرُ ٱلۡمُنَٰفِقُونَ أَن تُنَزَّلَ عَلَيۡهِمۡ سُورَةٞ تُنَبِّئُهُم بِمَا فِي قُلُوبِهِمۡۚ قُلِ ٱسۡتَهۡزِءُوٓاْ إِنَّ ٱللَّهَ مُخۡرِجٞ مَّا تَحۡذَرُونَ ٦٤ ﴾ [التوبة: ٦٤]
“৬৪. মুনাফিকরা ভয় পায় তাদের মনের কথা প্রকাশ করে তাদের ব্যাপারে কোন সূরা নাযিল হয়ে যায় নাকি। বল, ‘ঠাট্টা করতে থাক, তোমরা যে ব্যাপারে ভয় পাও, আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিবেন।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৬৪]
(আরও নিদর্শন হচ্ছে) তাদের গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়:
মুজাহিদ বলেন: তারা তাদের মধ্যে কথাবার্তা বলে এরপর বলে: আল্লাহর নিকট আমাদের আশা, তিনি যেন আমাদের এই গোপনীয় প্রকাশ করে না দেন। এই আয়াতটি এই আয়াতের মত ﴿ وَإِذَا جَآءُوكَ حَيَّوۡكَ بِمَا لَمۡ يُحَيِّكَ بِهِ ٱللَّهُ وَيَقُولُونَ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ لَوۡلَا يُعَذِّبُنَا ٱللَّهُ بِمَا نَقُولُۚ حَسۡبُهُمۡ جَهَنَّمُ يَصۡلَوۡنَهَاۖ فَبِئۡسَ ٱلۡمَصِيرُ ٨﴾ [المجادلة: ٨] “তারা যখন তোমার কাছে আসে তখন তারা তোমাকে এমনভাবে সম্ভাষণ করে, যেমনভাবে আল্লাহ তোমাকে সম্ভাষণ করেন নি। তারা মনে মনে বলে, ‘আমরা যা বলি তার জন্য আল্লাহ আমাদেরকে ‘আযাব দেন না কেন?। জাহান্নামই তাদের জন্য যথেষ্ট, তাতে তারা জ্বলবে, কতই না নিকৃষ্ট সেই গন্তব্য স্থল!” [সূরা আল-মুজাদিলাহ: ৮]  তিনি অত্র আয়াতে বলেন: قُلِ ٱسۡتَهۡزِءُوٓاْ إِنَّ ٱللَّهَ مُخۡرِجٞ مَّا تَحۡذَرُونَ “বল, ‘ঠাট্টা করতে থাক, তোমরা যে ব্যাপারে ভয় পাও, আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিবেন” অর্থাৎ শীঘ্রই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলের উপরে আয়াত অবতীর্ণ করে তোমাদেরকে গোপনীয়তা ফাঁস করবেন আর তাঁকে তোমাদের ব্যাপারাদি জানিয়ে দিবেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿أَمۡ حَسِبَ ٱلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ أَن لَّن يُخۡرِجَ ٱللَّهُ أَضۡغَٰنَهُمۡ ٢٩ وَلَوۡ نَشَآءُ لَأَرَيۡنَٰكَهُمۡ فَلَعَرَفۡتَهُم بِسِيمَٰهُمۡۚ وَلَتَعۡرِفَنَّهُمۡ فِي لَحۡنِ ٱلۡقَوۡلِۚ ٣٠﴾ [محمد : ٢٩، ٣٠] “যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা কি মনে করে যে, আল্লাহ কক্ষনো তাদের লুকানো বিদ্বেষভাব প্রকাশ করে দিবেন না? আমি যদি ইচ্ছে করতাম তাহলে আমি তোমায় ওদেরকে দেখিয়ে দিতাম। আর তাদের কথাবার্তার ধরন দেখে তুমি তাদেরকে অবশ্যই অবশ্যই চিনতে পারবে।” [সূরা মুহাম্মাদ: ২৯-৩০] এ কারণে কাতাদা বলেন: এই সূরাটিকে সূরা ‘ফাদিহাহ’ মুনাফিকদের ‘গোমর ফাঁস’ সূরা বলা হয়।
﴿وَلَئِن سَأَلۡتَهُمۡ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلۡعَبُۚ قُلۡ أَبِٱللَّهِ وَءَايَٰتِهِۦ وَرَسُولِهِۦ كُنتُمۡ تَسۡتَهۡزِءُونَ ٦٥ لَا تَعۡتَذِرُواْ قَدۡ كَفَرۡتُم بَعۡدَ إِيمَٰنِكُمۡۚ إِن نَّعۡفُ عَن طَآئِفَةٖ مِّنكُمۡ نُعَذِّبۡ طَآئِفَةَۢ بِأَنَّهُمۡ كَانُواْ مُجۡرِمِينَ ٦٦ ﴾ [التوبة: ٦٥،  ٦٦]
“৬৫. তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা জোর দিয়েই বলবে, ‘আমরা হাস্য রস আর খেল-তামাশা করছিলাম।’ বল, ‘আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে তোমরা বিদ্রুপ করছিলে?’ ৬৬. ওযর পেশের চেষ্টা করো না, ঈমান আনার পর তোমরা কুফরী করেছ। তোমাদের মধ্যেকার কোন দলকে ক্ষমা করলেও অন্যদেরকে শাস্তি দেব, কারণ তারা অপরাধী।” [সূরা আত-তাওবাহ:  ৫৬-৬৬]
মুনাফিকরা মিথ্যার উপরে নির্ভর করে আর মিথ্যা বাহানা দেখায়:
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: জনৈক ব্যক্তি তাবুক যুদ্ধে এক মজলিসের মধ্যে বলে: আমরা আমাদের ক্বারীদের মত (ক্বারী) আর দেখি নি আর ওদের পেট হচ্ছে সবচেয়ে ক্ষুধার্ত, তাদের জিহ্বা হচ্ছে সবচেয়ে মিথ্যাবাদী আর তারা যুদ্ধের ময়দানে সবচেয়ে ভীরু। ((এ সময়) মসজিদে অবস্থানরত এক ব্যক্তি বলে: তুমি মিথ্যা বলেছ, আসলে তুমি হচ্ছ একটা মুনাফিক। আমি এখনই গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ কথা জানিয়ে দিচ্ছি। রাসূলুল্লাহ‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এ সংবাদ পৌঁছে, তখন কুরআন অবতীর্ণ হয়। এরপর আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: আমি পরে ঐ লোকটিকে দেখি সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উটের কাঁধের সাথে লেগে অবস্থান করছিল, প্রস্তরের আঘাত পাচ্ছিল। আর সে বলছিল: হে আল্লাহর রাসূল, আমি তো হাঁসি-তামাশা করে এ কথা বলেছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:أَبِٱللَّهِ وَءَايَٰتِهِۦ وَرَسُولِهِۦ كُنتُمۡ تَسۡتَهۡزِءُونَ  “আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে তোমরা বিদ্রূপ করছিলে?” ইবনু ইসহাক বলেন: একদল মুনাফিক যাদের মধ্যে ওয়াদী‘আহ ইবনু সাবিতও ছিল (সে হচ্ছে) বানু উমাইয়া ইবনু যাইদ ইবনু আমর ইবনু আউফের লোক, আরও ছিল বানু সালামার মিত্র আশাজা‘ গোত্রের জনৈক ব্যক্তি তার নাম হচ্ছে মুখাশ্শান ইবনু হুমাইর। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে চলছিল যখন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুকের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন তাদের একজন অপরজনকে বলে: তোমরা কি মনে কর বনু আসফারের বিতাড়ন আরবদের পারস্পরিক যুদ্ধের মতই? আল্লাহর শপথ, যেন আমরা তোমাদের সাথে আগামীকাল একই রশিতে বন্দি হতে যাচ্ছি মুমিনগণকে ভয়ভীতি দেখানোর জন্য। (একথা বলে) তখন মুখাশশান ইবনু হুমাইইয়ার বলে: আল্লাহর শপথ, আমি তো এ ফায়সালা দেওয়ার ইচ্ছা করেছি আমাদের প্রত্যেককে একশটি করে কোড়া মারা হবে, আমরা তো পরাজিত হব। তোমাদের এই যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের নিকট কুরআন অবতীর্ণ হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- যতদূর আমরা জানি -আম্মার ইবনু ইয়াসারকে বলেন: এই লোকগুলোকে ধর, তারা তো আগুন জ্বালিয়েছে, তারা যা বলেছে সে সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তারা অস্বীকার করে তবে বল: অবশ্যই তোমরা এরূপ এরূপ বলেছ। আম্মার রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের নিকট গিয়ে তাদেরকে এ কথা জিজ্ঞেস করেন। তখন তারা কৈফিয়ত প্রদানের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসে। তখন ওয়াদী‘আহ ইবনু সাবিত বলে, আর এ সময় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বাহনে ছিলেন, ওয়াদী‘আহ উটের কাঁধ ধরে বলতে থাকে: ইয়া রাসূলাল্লাহ‌্, আমরা তো কেবল খেল-তামাশার ছলে এ কথা বলেছিলাম। তখন মুখশা ইবনু হুমাইয়ার বলে: ইয়া রাসূলাল্লাহ‌্, আমার আর আমার পিতার নাম ডুবে গেছে। এই আয়াতে যাকে ক্ষমা করা হয় সে হচ্ছে মুখাশ্শান ইবনু হুমাইয়ার। তাঁর নাম আব্দুর রহমান রাখা হয়। তিনি আল্লাহর নিকট দো‘আ করেন তিনি যেন এমন স্থানে শহীদ হন যে সম্পর্কে কেউ জানতে না পারে। তিনি ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হন; কিন্তু তাঁর চি‎হ্ন কেউ খুঁজে পায় নি।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: لَا تَعۡتَذِرُواْ قَدۡ كَفَرۡتُم بَعۡدَ إِيمَٰنِكُمۡۚ  “ওজর পেশের চেষ্টা করো না, ঈমান আনার পর তোমরা কুফরী করেছ।” অর্থাৎ যে কথার দ্বারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছ, إِن نَّعۡفُ عَن طَآئِفَةٖ مِّنكُمۡ نُعَذِّبۡ طَآئِفَةَۢ  “তোমাদের মধ্যেকার কোনো দলকে ক্ষমা করলেও অন্যদেরকে শাস্তি দেব” অর্থাৎ তোমাদের সকলকেই ক্ষমা করা হবে তা নয়; বরং তোমাদের কাউকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে। بِأَنَّهُمۡ كَانُواْ مُجۡرِمِينَ “কারণ তারা অপরাধী” অর্থাৎ এই ভুল ও পাপের উক্তির কারণে।
﴿ٱلۡمُنَٰفِقُونَ وَٱلۡمُنَٰفِقَٰتُ بَعۡضُهُم مِّنۢ بَعۡضٖۚ يَأۡمُرُونَ بِٱلۡمُنكَرِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَقۡبِضُونَ أَيۡدِيَهُمۡۚ نَسُواْ ٱللَّهَ فَنَسِيَهُمۡۚ إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ هُمُ ٱلۡفَٰسِقُونَ ٦٧ وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ وَٱلۡمُنَٰفِقَٰتِ وَٱلۡكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ خَٰلِدِينَ فِيهَاۚ هِيَ حَسۡبُهُمۡۚ وَلَعَنَهُمُ ٱللَّهُۖ وَلَهُمۡ عَذَابٞ مُّقِيمٞ ٦٨﴾ [التوبة: ٦٧،  ٦٨]
“৬৭. মুনাফিক পুরুষ আর মুনাফিক নারী সব এক রকম, তারা অন্যায় কাজের নির্দেশ দেয় আর সৎ কাজ করতে নিষেধ করে, (আল্লাহর পথে ব্যয় করার ব্যাপারে) হাত গুটিয়ে রাখে, তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, তাই তিনিও তাদেরকে ভুলে গেছেন। মুনাফিকরাই তো ফাসিক। ৬৮. আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ, মুনাফিক নারী ও কাফিরদের জন্য জাহান্নামের আগুনের ওয়া‘দা দিয়েছেন, তাতে তারা চিরদিন থাকবে, তা-ই তাদের জন্য যথেষ্ট। তাদের উপর আছে আল্লাহর অভিশাপ, আর আছে তাদের জন্য স্থায়ী ‘আযাব।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৬৭-৬৮]
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের তিরস্কার করেন, কেননা তারা মুমিনগণের বৈশিষ্ট্যের চেয়ে বিপরীত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কেননা মুমিনগণ সৎকাজের আদেশ দেয় আর অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে; কিন্তু মুনাফিকরা يَأۡمُرُونَ بِٱلۡمُنكَرِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَقۡبِضُونَ أَيۡدِيَهُمۡۚ “তারা অন্যায় কাজের নির্দেশ দেয় আর সৎ কাজ করতে নিষেধ করে হাত গুটিয়ে রাখে” অর্থাৎ আল্লাহর পথে ব্যয় করা থেকে (হাত গুটিয়ে রাখে), نَسُواْ ٱللَّهَ “তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে” অর্থাৎ তারা আল্লাহর স্মরণ ভুলে গেছে, فَنَسِيَهُمۡۚ “তাই তিনিও তাদেরকে ভুলে গেছেন” অর্থাৎ তিনিও তাদের সাথে তাদেরকে ভুলে যাওয়ার মত আচরণ করেছেন, যেমন অন্য আয়াতে বলেছেন, ﴿وَقِيلَ ٱلۡيَوۡمَ نَنسَىٰكُمۡ كَمَا نَسِيتُمۡ لِقَآءَ يَوۡمِكُمۡ هَٰذَا وَمَأۡوَىٰكُمُ ٱلنَّارُ وَمَا لَكُم مِّن نَّٰصِرِينَ ٣٤﴾ [الجاثية : ٣٤] “আর বলা হবে ‘আজ আমি তোমাদেরকে ভুলে যাব, যেমন করে তোমরা এ দিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিলে।” [সূরা আল- জাছিয়াহ: ৩৪]
إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ هُمُ ٱلۡفَٰسِقُونَ “মুনাফিকরাই তো ফাসিক” অর্থাৎ সত্য পথ থেকে বের হয়ে গেছে, গোমরাহির পথে প্রবেশ করেছে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ وَٱلۡمُنَٰفِقَٰتِ وَٱلۡكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ “আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ, মুনাফিক নারী ও কাফিরদের জন্য জাহান্নামের আগুনের ওয়া‘দা দিয়েছেন।” এ সমস্ত কর্মকাণ্ডের কারণে যা আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। خَٰلِدِينَ فِيهَاۚ “তাতে তারা চিরদিন থাকবে” তারা এবং কাফেররা চিরকাল সেখানে অবস্থান করবে। هِيَ حَسۡبُهُمۡۚ “তা-ই তাদের জন্য যথেষ্ট” শাস্তির জন্য وَلَعَنَهُمُ ٱللَّهُۖ “তাদের উপর আছে আল্লাহর অভিশাপ” তিনি তাদেরকে বিতাড়িত করেছেন, (তাঁর রহমত থেকে) দুরে সরিয়ে দিয়েছেন, وَلَهُمۡ عَذَابٞ مُّقِيمٞ “আর আছে তাদের জন্য স্থায়ী ‘আযাব।”
﴿ كَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ كَانُوٓاْ أَشَدَّ مِنكُمۡ قُوَّةٗ وَأَكۡثَرَ أَمۡوَٰلٗا وَأَوۡلَٰدٗا فَٱسۡتَمۡتَعُواْ بِخَلَٰقِهِمۡ فَٱسۡتَمۡتَعۡتُم بِخَلَٰقِكُمۡ كَمَا ٱسۡتَمۡتَعَ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُم بِخَلَٰقِهِمۡ وَخُضۡتُمۡ كَٱلَّذِي خَاضُوٓاْۚ أُوْلَٰٓئِكَ حَبِطَتۡ أَعۡمَٰلُهُمۡ فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ٦٩ ﴾ [التوبة: ٦٩]  
“৬৯. (তোমাদের কাজ-কারবার) তোমাদের আগের লোকদের মতই, যারা ছিল তোমাদের চেয়ে অধিক শক্তির অধিকারী, আর ধন-মাল আর সন্তান-সন্ততিতেও তোমাদের চেয়ে অধিক সমৃদ্ধিশালী, তাদের প্রাপ্য অংশ তারা ভোগ করে গেছে। এখন তোমরাও তোমাদের প্রাপ্য অংশ ভোগ কর যেমন তোমাদের আগের লোকেরা তাদের প্রাপ্য অংশ ভোগ করেছে। আর তোমরা অনর্থক কথাবার্তায় লিপ্ত আছ যেমন তারা অনর্থক কথাবার্তায় লিপ্ত ছিল। এরাই হল তারা দুনিয়া ও আখিরাতে যাদের কাজ-কর্ম নিষ্ফল হয়ে গেছে, আর তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।” [সুরা আত-তাওবাহ: ৬৯]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: দুনিয়া ও আখিরাতে তারা সেভাবেই আযাবের সম্মুখীন হয়েছে যেভাবে তাদের পূর্ববর্তীগণ সম্মুখীন হয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলার বাণী: بِخَلَٰقِكُمۡ “তাদের প্রাপ্য অংশ” হাসান আল-বাসরী বলেন: তাদের দ্বীনের সাথে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَخُضۡتُمۡ كَٱلَّذِي خَاضُوٓاْۚ  “এখন তোমরাও তোমাদের প্রাপ্য অংশ ভোগ কর যেমন তোমাদের আগের লোকেরা তাদের প্রাপ্য অংশ ভোগ করেছে।” অর্থাৎ মিথ্যা ও ভ্রান্ত বিষয়ে, أُوْلَٰٓئِكَ حَبِطَتۡ أَعۡمَٰلُهُمۡ  “এরাই হল তারা যাদের কাজ-কর্ম নিষ্ফল হয়ে গেছে।” তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে, এ জন্য তাদের কোনো সাওয়াব নেই। কেননা সেগুলো নষ্ট।
فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ “দুনিয়া ও আখিরাতে, আর তারাই ক্ষতিগ্রস্ত”। এ জন্য তাদের কোনো সাওয়াবই হয় নি। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: এই রাত্রিটি গত রাত্রির সাথে কতই না সাদৃশ্যপূর্ণ। كَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ “তোমাদের আগের লোকদের মতই” এরা হচ্ছে বনী ইসরাইল, যাদের সাথে আমাদের তুলনা দেওয়া হয়েছে। আমি এটাই কেবল জানি যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, তোমরা তাদের অনুসরণ করবে, এমনকি তাদের কেউ যদি ষাণ্ডার গর্তে গিয়ে প্রবেশ করে, তবে তোমরাও তাতে প্রবেশ করবে।” আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, অবশ্যই তোমরা এক বিঘত এক বিঘত, এক হাত এক হাত, এক বাহু এক বহু করে তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করবে। এমনকি তাদের কেউ যদি ষাণ্ডার গর্তে গিয়ে প্রবেশ করে তবে তোমরাও তাতে প্রবেশ করবে।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন: তারা কারা হে আল্লাহর রাসূল, আহলে কিতাবরা কী? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: “তবে আর কারা?” বিশুদ্ধ বর্ণনায় এ হাদিসের সমার্থক হাদিস রয়েছে।
﴿أَلَمۡ يَأۡتِهِمۡ نَبَأُ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡ قَوۡمِ نُوحٖ وَعَادٖ وَثَمُودَ وَقَوۡمِ إِبۡرَٰهِيمَ وَأَصۡحَٰبِ مَدۡيَنَ وَٱلۡمُؤۡتَفِكَٰتِۚ أَتَتۡهُمۡ رُسُلُهُم بِٱلۡبَيِّنَٰتِۖ فَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيَظۡلِمَهُمۡ وَلَٰكِن كَانُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ يَظۡلِمُونَ ٧٠ ﴾ [التوبة: ٧٠]
“৭০. তাদের কাছে কি তাদের আগের লোকদের সংবাদ আসে নি, নূহের জাতি, ‘আদ, সামূদ, ইবরাহীমের সম্প্রদায় এবং মাদায়েনের অধিবাসীবৃন্দ আর উল্টে দেওয়া নগরসমূহের? তাদের কাছে তাদের রাসূলগণ স্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে এসেছিল, অতঃপর আল্লাহ তাদের উপর জুলুম করেননি, আসলে (তারাই তাদের অন্যায় কার্যকলাপের মাধ্যমে) নিজেদের আত্মার উপর জুলুম করেছিল।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৭০]
মুনাফিকরা যেন তাদের পূর্ববর্তীদের থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে এ মর্মে উপদেশ:
আল্লাহ তা‘আলা এ সমস্ত মুনাফিকদের উপদেশ দিচ্ছেন, যারা রাসূলগণকে অস্বীকার করে। أَلَمۡ يَأۡتِهِمۡ نَبَأُ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡ “তাদের কাছে কি তাদের আগের লোকদের সংবাদ আসে নি” অর্থাৎ তোমাদের কাছে কি ঐ সমস্ত জাতির খবর পৌঁছে নি যারা রাসূলগণকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল। قَوۡمِ نُوحٖ “নূহের জাতির” জমিনবাসীর সকলেই নিমজ্জিত হয়েছিল, তবে তারা ব্যতীত যারা তাঁর বান্দা এবং তাঁর রাসূল নূহ আলাইহিস সালামের প্রতি ঈমান এনেছিল। وَعَادَٖ “আদ” কীভাবে তিনি তাদেরকে অনুর্বর বাতাস দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। কেননা তারা হূদ আলাইহিস সালামকে অস্বীকার করেছিল। وَثَمُودَ “সামূদ” কীভাবে তাদেরকে বিকট আওয়াজ পাকড়াও করেছিল। কেননা তারা সালিহ আলাইহিস সালামকে অস্বীকার করেছিল এবং উটনিকে হত্যা করেছিল। وَقَوۡمِ إِبۡرَٰهِيمَ “ইব্রাহীমের সম্প্রদায়” কীভাবে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে তাদের উপরে সাহায্য করেন আর সুস্পষ্ট মু‘জিযা দ্বারা তাদের উপরে তাঁকে শক্তিশালী করেন। আর কীভাবে তাদের বাদশাহ নামরূদ ইবনু কিন‘আন ইবনু কূশ আল-কিন‘আনীকে ধ্বংস করেন। (তার উপরে আল্লাহ তা‘আলার লা‘নাত) وَأَصۡحَٰبِ مَدۡيَنَ “এবং মাদায়েনের অধিবাসীবৃন্দ” তারা হচ্ছে শু‘আইব আলাইহিস সালামের কাওম। কীভাবে তাদেরকে ভূমিকম্প এবং ছায়ার দিবসের শাস্তি গ্রাস করে। وَٱلۡمُؤۡتَفِكَٰتِۚ “আর উল্টে দেওয়া নগরসমূহের?” অর্থাৎ লুত আলাইহি সালামের সম্প্রদায়, যারা ইতোপূর্বে মাদায়েনে বসবাস করত। অন্য আয়াতে এসেছে,﴿وَٱلۡمُؤۡتَفِكَةَ أَهۡوَىٰ ٥٣﴾ [النجم : ٥٣] “তিনি (লুত জাতির) উল্টানো আবাস ভূমিকে উঠিয়ে নিক্ষেপ করেছিলেন।” [সূরা আন-নাজম: ৫৩] অর্থাৎ উল্টে দেওয়া জাতি। কেউ কেউ বলেন: তাদের জনপদকে (উল্টে দেওয়া হয়), আর সেটা হচ্ছে সাদূম (জনপদ), উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা তাদের সকলকে ধ্বংস করে দেন। কেননা তারা তাদের নবী লুত আলাইহি সালামকে অস্বীকার করেছিল আর তারা এমন জঘন্য অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়েছিল যাতে ইতোপূর্বে পৃথিবীর আর কেউ লিপ্ত হয় নি।
أَتَتۡهُمۡ رُسُلُهُم بِٱلۡبَيِّنَٰتِۖ “তাদের কাছে তাদের রাসূলগণ স্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে এসেছিল” অর্থাৎ অকাট্য দলীল-প্রমাণ সহকারে,
 فَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيَظۡلِمَهُمۡ “অতঃপর আল্লাহ তাদের উপর যুলুম করেন নি” অর্থাৎ তাদেরকে ধ্বংস করে, কেননা আল্লাহ তা‘আলা রাসূলগণকে প্রেরণ করেন এবং সন্দেহ দুর করে তাদের বিরুদ্ধে দলীল প্রতিষ্ঠা করেন।
وَلَٰكِن كَانُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ يَظۡلِمُونَ “আসলে (তারাই তাদের অন্যায় কার্যকলাপের মাধ্যমে) নিজেদের আত্মার উপর জুলুম করেছিল” অর্থাৎ রাসূলগণকে অস্বীকার করে সত্যের বিরুদ্ধাচরণ করে। ফলে যেমন ধ্বংস ও শাস্তির মধ্যে পতিত হওয়ার পতিত হয়।
﴿وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتُ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ يَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَيُطِيعُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ أُوْلَٰٓئِكَ سَيَرۡحَمُهُمُ ٱللَّهُۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٞ ٧١ ﴾ [التوبة: ٧١]
“৭১. মু’মিন পুরুষ আর মু’মিন নারী পরস্পর পরস্পরের বন্ধু, তারা সৎকাজের নির্দেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, সালাত ক্বায়িম করে, যাকাত দেয়, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে। তাদের প্রতিই আল্লাহ করুণা প্রদর্শন করবেন। আল্লাহ তো প্রবল পরাক্রান্ত, মহা প্রজ্ঞাবান।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৭১]
মুমিনগণের প্রশংসনীয় গুণাবলী:
ইতোপূর্বে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করেন, এর সাথে তিনি সংযুক্ত করে আলোচনা করেন মুমিনগণের প্রশংসনীয় গুণাবলী সম্পর্কে। তিনি বলেন: وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتُ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ  “মু’মিন পুরুষ আর মু’মিন নারী পরস্পর পরস্পরের বন্ধু” তারা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করে, যেমন সহীহ হাদিসে এসেছে: এক মু’মিন অপর মু’মিনের জন্য ভবনস্বরূপ, এর একটি অংশ অপর অংশকে শক্তি যোগায়, এ বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আঙ্গুলসমূহকে পরস্পর পরস্পরের মাঝে প্রবেশ করান। বিশুদ্ধ বর্ণনায় আরও রয়েছে: “মু’মিনগণের পারস্পরিক দয়ামায়ার দৃষ্টান্ত হচ্ছে একটি দেহের ন্যায়। এর একটি অঙ্গ যখন পীড়িত হয় তখন সমস্ত শরীর জ্বর ও নিদ্রাহীনতায় ভোগে।”
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: يَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ  “তারা সৎকাজের নির্দেশ দেয়, অন্যায় কাজে বাঁধা দেয়।” যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ ١٠٤﴾ [ال عمران: ١٠٤] “তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল হোক, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করে, সৎ কাজের আদেশ করে এবং অসৎ কাজ হতে নিষেধ করে।” [সূরা আলে ইমরান: ১০৪]
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ “সালাত কায়িম করে, যাকাত দেয়” অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করে এবং তাঁর বান্দাদের প্রতি সদয় আচরণ করে।
وَيُطِيعُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓ “আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে।” অর্থাৎ যে বিষয়ে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন আর যা থেকে বারণ করেছেন তার বর্জন করে।
أُوْلَٰٓئِكَ سَيَرۡحَمُهُمُ ٱللَّهُۗ “তাদের প্রতিই আল্লাহ করুণা প্রদর্শন করবেন” অর্থাৎ যে ব্যক্তি এ সমস্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে অচিরেই আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতি অনুগ্রহ করবেন।
إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ “আল্লাহ তো প্রবল পরাক্রান্ত” যে ব্যক্তি তাঁর আনুগত্য করে তিনি তাকে শক্তিশালী করেন। কেননা শক্তি ও মর্যাদা তো আল্লাহর জন্য আর তাঁর রাসূলের জন্য এবং মুমিনগণের জন্য।
حَكِيمٞ “মহা প্রজ্ঞাবান” তাঁদের জন্য এ সমস্ত গুণাবলীর তাঁর বণ্টনের ক্ষেত্রে এবং পূর্ববর্তী বৈশিষ্ট্যগুলো মুনাফিকদের সাথে নির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে। কেননা বরকতময় ও মহান আল্লাহ যা কিছুই করেন তাতেই তাঁর প্রজ্ঞা নিহীত রয়েছে।
﴿وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَا وَمَسَٰكِنَ طَيِّبَةٗ فِي جَنَّٰتِ عَدۡنٖۚ وَرِضۡوَٰنٞ مِّنَ ٱللَّهِ أَكۡبَرُۚ ذَٰلِكَ هُوَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ ٧٢ ﴾ [التوبة: ٧٢]
“৭২. মু’মিন পুরুষ আর মু’মিন নারীর জন্য আল্লাহ অঙ্গিকার করেছেন জান্নাতের- যার নীচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, তাতে তারা চিরদিন থাকবে। আর জান্নাতে চিরস্থায়ী উত্তম বাসগৃহের (সেদিনের) সবচাইতে বড় (নি‘আমত) হবে (বান্দার প্রতি) আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি; এটাই হল বিরাট সাফল্য।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৭২]
মুমিনগণকে চিরস্থায়ী নি‘আমতের সুসংবাদ:
আল্লাহ তা‘আলা মুমিন এবং মুমিনগণকে অবহিত করছেন যে, তিনি তাদের জন্য আনন্দ এবং চিরস্থায়ী সুখ তৈরি করে রেখেছেন جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَا “জান্নাতে যার নীচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, তাতে তারা চিরদিন থাকবে” সেখানে তারা চিরকাল বসবাস করবে।
وَمَسَٰكِنَ طَيِّبَةٗ “আর জান্নাতে চিরস্থায়ী উত্তম বাসগৃহের” সুন্দর নির্মাণ, যা চারদিক থেকে সুন্দর নিবাস। যেমন সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, আবু মুসা আব্দুল্লাহ ইবনু কাইস আল-‘আশ‘আরী বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “দু’টো জান্নাত হবে যার পেয়ালা এবং এতে যা কিছু হবে সবকিছু হবে স্বর্ণের এবং দু’টো জান্নাত হবে যার পেয়ালা এবং এতে যা কিছু হবে সবকিছু হবে রৌপ্যের। জান্নাতে আদনে লোকদের এবং তাদের রবকে দর্শনের মাঝে রয়েছে তাঁর চেহারার উপরে থাকা গৌরবের পর্দা।” তিনি আরও বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “জান্নাতে মুমিনের জন্য ফাঁপা মুক্তার একটি তাঁবু হবে, যার দৈর্ঘ্য আসমানের দিকে ষাট মাইল আর তাঁবুতে মুমিনের বিরাট পরিবার বাস করবে যাদের সকলের নিকট মু’মিন গমন করবে; কিন্তু তাদের একে অপরকে দেখতে পাবে না।” বুখারী ও মুসলিম তাঁদের সহীহ গ্রন্থদ্বয়ে এ হাদিস বর্ণনা করেছেন। বুখারী-মুসলিমে আরও বর্ণিত হয়েছে: আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে, রমযানের সিয়াম পালন করে, আল্লাহ তা‘আলার কর্তব্য হচ্ছে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (কোনো ব্যাপার নয়) চাই সে আল্লাহর পথে হিজরত করুক অথবা সে তার স্থানে যেখানে জন্মেছে সেখানে বসে থাকুক। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি এ কথা লোকদেরকে জানিয়ে দিব না? তিনি বলেন: জান্নাতে একশতটি স্তর রয়েছে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পথে লড়াইকারী (মুজাহিদদের) জন্য যা তৈরি করে রেখেছেন। প্রতি দুই স্তরের মাঝের দুরত্ব আসমান-জমিনের দূরত্বের মত। কাজেই যখন তোমরা আল্লাহ তা‘আলার নিকট চাইবে তখন তোমরা জান্নাতুল ফিরদাউস চাও। কেননা এটা হচ্ছে জান্নাতের সবচেয়ে উঁচু স্তর আর জান্নাতের মধ্যস্থান, এখান থেকে জান্নাতের নহর সমূহ প্রবাহিত হয় আর এর উপরে রয়েছে দয়াময়ের আরশ।”
ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেন, আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যখন তোমরা আমার ওপরে দুরূদ পাঠ কর তখন তোমরা আমার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট ‘ওয়াসীলা’ চাও। বলা হয়: হে আল্লাহর রাসূল, ‘ওয়াসীলা’ কী? তিনি বলেন: জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তর। এক ব্যক্তি ছাড়া কেউ সেটা পাবে না আর আমি আশা করি সেই ব্যক্তি আমিই”।
মুসনাদ ইমাম আহমদে বর্ণিত হয়েছে, সা‘দ ইবনু মুজাহিদ আত-ত’ঈ বলেন, আবুল মুদিল্লাহ আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন তিনি (আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: আমরা জিজ্ঞেস করি: হে আল্লাহর রাসূল, জান্নাত সম্পর্কে আমাদেরকে অবহিত করুন যে, সেটা কিসের তৈরি? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: এর একটি ইট হচ্ছে স্বর্ণের, একটি ইট হচ্ছে রৌপ্যের, এর মশলা গোলা (ইট গাঁথার) হচ্ছে কস্তূরীর, এর নুড়ি পাথর হচ্ছে মণিমুক্তা ও চুনির -এর মাটি হচ্ছে জাফরানের, যে তাতে প্রবেশ করবে, সে আনন্দিত হবে, সে নিরাশ হবে না, সে চিরকাল বসবাস করবে মৃত্যুবরণ করবে না, তার কাপড় মলিন হবে না তার যৌবন কখনও শেষ হবে না।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَرِضۡوَٰنٞ مِّنَ ٱللَّهِ أَكۡبَرُۚ “(সেদিনের) সবচাইতে বড়ো (নি‘আমত) হবে (বান্দার প্রতি) আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি।” অর্থাৎ তারা যে নি‘আমতের মাঝে ডুবে থাকবে তার চেয়ে বড় ও মহান হচ্ছে তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। যেমন ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন, যাইদ ইবনু আসলাম ‘আতা’ ইবনু ইয়াসার থেকে বর্ণনা করেছেন, আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন: আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতবাসীদের বলবেন: হে জান্নাতবাসীরা, তারা বলবে: আমরা আপনার খেদমতে হাযির। আর সৌভাগ্য আর সকল কল্যাণ আপনার হাতে। তিনি বলবেন: তোমরা কি খুশি হয়েছ? তারা বলবে: আমাদের কী হল যে, আমরা খুশি হবো না, হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে যা দিয়েছেন তা আপনার অন্য কোন সৃষ্টিকে দেননি। এরপর তিনি বলবেন: আমি কি এর চেয়ে উত্তম কোন কিছু তোমাদেরকে দিব না? তারা বলবে: হে আমাদের রব, এগুলোর চেয়ে উত্তম আর কী হতে পারে? তিনি বলবেন: আমি তোমাদের প্রতি আমার সন্তুষ্টিকে মঞ্জুর করে নিব, আর কখনও তোমাদের প্রতি আমি অসন্তুষ্ট হব না”।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ جَٰهِدِ ٱلۡكُفَّارَ وَٱلۡمُنَٰفِقِينَ وَٱغۡلُظۡ عَلَيۡهِمۡۚ وَمَأۡوَىٰهُمۡ جَهَنَّمُۖ وَبِئۡسَ ٱلۡمَصِيرُ ٧٣ يَحۡلِفُونَ بِٱللَّهِ مَا قَالُواْ وَلَقَدۡ قَالُواْ كَلِمَةَ ٱلۡكُفۡرِ وَكَفَرُواْ بَعۡدَ إِسۡلَٰمِهِمۡ وَهَمُّواْ بِمَا لَمۡ يَنَالُواْۚ وَمَا نَقَمُوٓاْ إِلَّآ أَنۡ أَغۡنَىٰهُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ مِن فَضۡلِهِۦۚ فَإِن يَتُوبُواْ يَكُ خَيۡرٗا لَّهُمۡۖ وَإِن يَتَوَلَّوۡاْ يُعَذِّبۡهُمُ ٱللَّهُ عَذَابًا أَلِيمٗا فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِۚ وَمَا لَهُمۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ مِن وَلِيّٖ وَلَا نَصِيرٖ ٧٤﴾ [التوبة: ٧٣،  ٧٤]
“৭৩. হে নবী! কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, তাদের প্রতি কঠোরতা অবলম্বন কর, তাদের বাসস্থান হল জাহান্নাম আর তা কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়স্থল! ৭৪. তারা আল্লাহর নামে শপথ করে বলে যে তারা (অন্যায়) কিছু বলেনি; কিন্তু তারা তো কুফরী কথা বলেছে আর ইসলাম গ্রহণ করার পরও কুফরী করেছে। তারা ষড়যন্ত্র করেছিল; কিন্তু তাতে সফল হয় নি, তাদের এ প্রতিশোধ স্পৃহার কারণ এছাড়া আর কিছু ছিল না যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল করুণাবশতঃ তাদেরকে সম্পদশালী করে দিয়েছেন। এখন যদি তারা অনুশোচনাভরে এ পথ থেকে ফিরে আসে তবে তা তাদের জন্যই কল্যাণকর। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তি দিবেন। পৃথিবীতে রক্ষক আর সাহায্যকারী হিসেবে কাউকে তারা পাবে না।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৭৩-৭৪]
কাফের, মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ এবং তাদের প্রতি কঠোরতা আরোপের নির্দেশ:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে কাফের এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ এবং তাদের উপরে কঠোরতা আরোপের নির্দেশ প্রদান করেন, যেভাবে তিনি তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন মুমিনগণের যারা তাঁর অনুসরণ করে তাদের প্রতি দয়াপরবশ হতে। তিনি তাঁকে অবহিত করেন যে, পরকালে কাফের এবং মুনাফিকদের ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ جَٰهِدِ ٱلۡكُفَّارَ وَٱلۡمُنَٰفِقِينَ﴾ [التحريم: ٩] “কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর” [সূরা আত-তাহরীম: ৯] এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: জিহাদ করুন তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হাত দ্বারা আর যদি তিনি তা না পারেন তবে অন্ততপক্ষে তাদের প্রতি তাঁর চেহারায় কঠোর ভাব আনয়ন করবেন।
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে তরবারির সাহায্যে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জবানের মাধ্যমে জিহাদের নির্দেশ দেন। আর তাদের থেকে নমনীয়তা দুর করতে বলেন।
দাহ্হাক বলেন: কাফেরদের বিরুদ্ধে তরবারির মাধ্যমে জিহাদ করতে এবং মুনাফিকদের উপরে কথার দ্বারা কঠোরতা আরোপ করুন, আর সেটাই তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ। মুকাতিল এবং রবী‘ থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে।
হাসান ও কাতাদা বলেন: তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের অর্থ হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে হদ (দণ্ড) কায়েম করুন। বলা যেতে পারে: এ সমস্ত মতামত সাংঘর্ষিক নয়। কখনও তাদেরকে এভাবে ধরা হবে কখনও ওভাবে ধরা হবে। (অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে কাফির ও মুনাফিকদেরকে এ সমস্ত শাস্তি দেওয়া হবে।) আল্লাহ ভালো জানেন।
শানে নুযূল (ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট):
আল-উমাবী তাঁর মাগাযী গ্রন্থে বলেন: হাদিস বর্ণনা করেছেন আমাদের নিকট মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক, (তিনি) যুহরী থেকে (তিনি) আব্দুর রহমান ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু কা‘আব ইবনু মালিক থেকে, (তিনি) তাঁর পিতা থেকে, তাঁর দাদা থেকে তিনি বলেন: তিনি (কা‘আব ইবনু মালিক) যে সমস্ত মুনাফিক যুদ্ধ থেকে পেছনে রয়ে গিয়েছিল, তিনিও তাদের সাথে ছিলেন, তাদের মধ্য থেকে তাঁর ব্যাপারে কুর’আনের আয়াত অবতীর্ণ হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে যারা ছিলেন তাদের অন্যতম হচ্ছে আল-জুলাস ইবনু সুওয়াইদ ইবনুস সামিত। সে উমাইর ইবনু সা‘আদের মাকে বিবাহ করেছিল। উমাইর তার গৃহে লালিত পালিত হয়েছিল। এরপর যখন কুর’আন অবতীর্ণ হয় আর মুনাফিকদের আচার-আচরণ সম্পর্কে অবহিত করে আল্লাহ তা‘আলা যা উল্লেখ করার উল্লেখ করেন। তখন জুলাস বলে: আল্লাহর শপথ, এ ব্যক্তি (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার কথায় যদি সত্য হয়, তবে আমরা গাধার চেয়েও নিকৃষ্ট। এ কথা উমাইর ইবনু সা‘আদ শুনে ফেলে, এরপর বলে: আল্লাহর শপথ হে জুলাস, তুমি আমার নিকট লোকদের মাঝে সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি। আমার প্রতি তোমার অনেক অবদান রয়েছে। আমি অন্য যে কারও ব্যাপারের চেয়ে বেশি অপছন্দ করি তোমাকে কোনো কষ্ট স্পর্শ করলে। তুমি এমন এক মারাত্মক কথা বলেছ, যদি আমি তা প্রকাশ করি তবে তোমাকে প্রকাশ করা হবে। আর যদি আমি তা গোপন করি তবে তুমি আমাকে ধ্বংস করে দিবে, তবে এ দু’টোর একটি আমার নিকট অপরটির চেয়ে বেশি সহজ। এ বলে উমাইর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গিয়ে জুলাসের বলা কথা ব্যক্ত করেন। এ খবর যখন জুলাসের নিকট পৌঁছে তখন সে বের হয়ে রাসূলুল্লাহ‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট হাযির হয় আর আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে বলে যে, উমাইর ইবনু সা‘আদ যা বলেছে সে তা বলে নি। সে আমার ব্যাপারে মিথ্যা বলেছে তখন আল্লাহ তা‘আলা তার ব্যাপারে আয়াত অবতীর্ণ করেন: يَحۡلِفُونَ بِٱللَّهِ مَا قَالُواْ وَلَقَدۡ قَالُواْ كَلِمَةَ ٱلۡكُفۡرِ وَكَفَرُواْ بَعۡدَ إِسۡلَٰمِهِمۡ “তারা আল্লাহর নামে শপথ করে বলে যে তারা (অন্যায়) কিছু বলে নি; কিন্তু তারা তো কুফরী কথা বলেছে। আর তারা ইসলাম গ্রহণ করার পরও কুফরী করেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াতটি জুলাসকে পৌঁছে দেন, সে তাঁদের ধারণা মতে তাওবা করে। আর তার তাওবা ছিল অকৃত্রিম, সে সুন্দরভাবে কপটতা পরিহার করে।
ইমাম আবু জা‘ফার ইবনু জারীর বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহ আনহুমা বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃক্ষের ছায়ায় বসে ছিলেন এ সময় তিনি বলেন: তোমাদের নিকট অচিরেই এক ব্যক্তি আগমন করবে যে শয়তানের দু’চোখ দ্বারা তোমাদেরকে প্রত্যক্ষ করবে। কাজেই সে যখন আসবে তার সাথে তোমরা কথা বলবে না। কিছু সময় যাওয়ার পর নীলবর্ণের এক ব্যক্তির আগমন ঘটে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন: তুমি এবং তোমার সাথিরা আমাকে গাল-মন্দ কর কেন? লোকটি গিয়ে তার সাথিদেরকে ডেকে এনে আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে বলে, তারা এরূপ কিছু বলে নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করেন: يَحۡلِفُونَ بِٱللَّهِ مَا قَالُواْ “তারা আল্লাহর নামে শপথ করে বলে যে তারা (অন্যায়) কিছু বলে নি”
মুনাফিক কর্তৃক রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যার পরিকল্পনা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَهَمُّواْ بِمَا لَمۡ يَنَالُواْ “তারা ষড়যন্ত্র করেছিল কিন্তু তাতে সফল হয় নি” বলা হয়: এই আয়াতটি জুলাস ইবনু সুওয়াইদ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়। কেননা সে তার স্ত্রীর পুত্র (তার পালকপুত্র)-কে হত্যার পরিকল্পনা করে যখন সে বলে: আমি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে (এ কথা) জানিয়ে দিব। কেউ বলেন: আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনু সালুলের ব্যাপারে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যার পরিকল্পনা করে। সুদ্দী বলেন: এমন কতিপয় লোক সম্পর্কে এ আয়াত অবতীর্ণ হয় যারা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইকে সিংহাসনে বসানোর পরিকল্পনা করে। যদিও তাতে রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মত নেই। বর্ণিত হয়েছে, কতিপয় মুনাফিক রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যার পরিকল্পনা করে আর সেটা তাবুকের যুদ্ধে তাঁর যাত্রাকালিন সময়ের কোনো এক রাত্রিতে। তারা ছিল সংখ্যায় দশের কিছু বেশি। দাহ্হাক বলেন: তাদের ব্যাপারে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়: বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে দালাইলুন নুবুওয়াহ গ্রন্থে। যাতে হাফিয আবু বকর আল-বায়হাক্বী বর্ণনা করেছেন, হুযাইফাহ ইবনুল ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উটনীর লাগাম টেনে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলাম আর আম্মার ইবনু ইয়াসার সেটাকে হাঁকাচ্ছিলেন অথবা আমি উটনীকে হাঁকাচ্ছিলাম আর আম্মার তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশেষে আমরা যখন আক্বাবায় আগমন করি তখন দেখি বারোজন সওয়ারী রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথ রোধ করেছে। যখন আমি রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সতর্ক করি তখন তিনি তাদের প্রতি চিৎকার করলে তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালিয়ে যায়। এরপর রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বলেন: তোমরা কি ওদেরকে চিনতে পেরেছ? আমরা বলি: না (চিনতে পারি নি) ইয়া রাসূলাল্লাহ, তারা মুখ ঢেকে ছিল, তবে আমরা তাদের ঘোড়াগুলো চিনতে পেরেছি। তিনি বলেন: তারা কিয়ামত পর্যন্ত একদল মুনাফিক, তোমরা কি জান তারা কী চেয়েছিল? আমরা বলি: না (জানি না), তিনি বলেন: তারা আক্বাবাতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মিশে গিয়ে সেখান থেকে তাকে (উপত্যকার দিকে) নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল। আমরা বলি: আপনি কি তাদের গোত্রগুলোকে এ মর্মে সংবাদ পাঠাবেন না তারা যেন প্রত্যেক গোত্র প্রধানকে আপনার নিকট প্রেরণ করে? তিনি বলেন: না, (পাঠাব না) আমি এটা অপছন্দ করি যে, আরবরা বলাবলি করুক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতিপয় লোককে যুদ্ধে ব্যবহার করেন এরপর আল্লাহ তা‘আলা যখন তাদের সাহায্যের মাধ্যমে তাঁকে বিজয় দান করেন এরপর তিনি তাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। এরপর তিনি বলেন: হে আল্লাহ, তাদের প্রতি আপনি দুবাইলাহ প্রেরণ করুন, আমরা বলি: হে আল্লাহর রাসূল, দুবাইলাহ কী? তিনি বলেন: আগুনের উল্কা যা তাদের কারও অন্তরে নিক্ষিপ্ত হয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়।
হাদিস বর্ণনা করেছেন আমাদেরকে আবুত তুফাইল (তিনি বলেন), আক্বাবার জনৈক ব্যক্তি এবং হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর মাঝে তর্ক-বিতর্ক হয়। যেমন লোকদের মধ্যে হয়ে থাকে, তিনি বলেন: আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আক্বাবার অধিবাসীদের সংখ্যা কত ছিল? বর্ণনাকারী বলেন: লোকেরা তাকে বলে: তাকে বল যখন সে তোমাকে জিজ্ঞেস করে, হুযাইফা বলেন: আমাদেরকে বলা হয়েছিল তারা ছিল চৌদ্দ জন। আর যদি তুমি তাদের মধ্যে থেকে থাক তবে তাদের সংখ্যা পনের জন। আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি তাদের মধ্যে বার ব্যক্তি দুনিয়ায় এবং যেদিন সাক্ষীদেরকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সম্মুখে আনা হবে সেদিন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। তাদের মধ্যেকার তিন ব্যক্তি ওযর গ্রহণ করা হয়। কেননা তারা বলে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ব্যক্তিকে কিছু ঘোষণা দেওয়ার জন্য প্রেরণ করেন আমরা তাঁর কথা শুনি নি আর আমরা ওদের চক্রান্ত সম্পর্কেও অবগত ছিলাম না। কেননা তিনি কঙ্করময় স্থান দিয়ে চলছিলেন আর বলছিলেন: পানির পরিমাণ কম, কাজেই কেও যেন আমার পূর্বে সেখানে না পৌঁছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও কতিপয় ব্যক্তিকে দেখেন সেখানে আগেই গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ফলে তিনি সেদিন তাদেরকে অভিশাপ দেন।
ইমাম মুসলিম আরও বর্ণনা করেন, আম্মার ইবনু ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আমাকে অবহিত করে বলেন: তিনি বলেছেন: আমার সাহাবীগণের মাঝে বারোজন মুনাফিক হবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তারা এর সুবাসও পাবে না যতক্ষণ না সুচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে আট ব্যক্তি দুবাইলাহর দ্বারা মারা যাবে, (সেটা হচ্ছে) আগুনের উল্কা যা তাদের কাঁধের মাঝে প্রকাশ পাবে আর তাদের বক্ষদেশকে ছিদ্র করে ফেলবে। এ কারণে হুযাইফাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রহস্যের ধারক বলা হয়ে থাকে যা তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। অর্থাৎ তিনি জানেন যে, সে সমস্ত মুনাফিক কারা ছিল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের পরিচয় সম্পর্কে শুধুমাত্র তাঁকেই বলেছিলেন অন্য কাউকে নয়। আল্লাহ ভালো জানেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَمَا نَقَمُوٓاْ إِلَّآ أَنۡ أَغۡنَىٰهُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ مِن فَضۡلِهِۦ “তাদের এ প্রতিশোধ স্পৃহার কারণ এছাড়া আর কিছু ছিল না যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল করুণাবশতঃ তাদেরকে সম্পদশালী করে দিয়েছেন।” রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় করেন নি। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বরকত এবং সৌভাগ্যের দ্বারা তাদেরকে সম্পদশালী করেছেন। তাদের উপরে যদি সৌভাগ্য পূর্ণতা লাভ করত তবে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাঁর রাসূল যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি হিদায়েত করতেন। যেমন তিনি আনসারবৃন্দকে বলেন: আমি কি তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট পাই নি? এরপর আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে আমার দ্বারা হিদায়েত করেছেন। তোমরা দলে দলে বিভক্ত ছিলে এরপর আল্লাহ তা‘আলা আমার দ্বারা তোমাদেরকে একত্রিত করেছেন, তোমরা ছিলে দরিদ্র। আল্লাহ তা‘আলা আমার দ্বারা তোমাদেরকে ধনী করেছেন। যখনই তিনি কিছু বলেন তাঁরা বলে: আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল অনুগ্রহ করেছেন। এভাবে বলা হয়েছে যখন সেখানে কোনো অন্যায় হয় নি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿وَمَا نَقَمُواْ مِنۡهُمۡ إِلَّآ أَن يُؤۡمِنُواْ بِٱللَّهِ ٱلۡعَزِيزِ ٱلۡحَمِيدِ ٨﴾ (البروج: ٨) “তারা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল একমাত্র এই কারণে যে, তারা মহা-পরাক্রান্ত প্রশংসিত আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল।” [সূরা আল-বুরূজ: ৮]
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাওবাহ করার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন: فَإِن يَتُوبُواْ يَكُ خَيۡرٗا لَّهُمۡۖ وَإِن يَتَوَلَّوۡاْ يُعَذِّبۡهُمُ ٱللَّهُ عَذَابًا أَلِيمٗا فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِ “এখন যদি তারা অনুশোচনাভরে এ পথ থেকে ফিরে আসে তবে তা তাদের জন্যই কল্যাণকর। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তি দিবেন” অর্থাৎ যদি তারা তাদের পন্থার উপরে নিরবচ্ছিন্ন থাকে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে দুনিয়াতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিবেন অর্থাৎ হয় তারা নিহত হবে নয়ত দুশ্চিন্তায় পড়বে আর পরকালে: তাদের জন্য রয়েছে শাস্তি, আযাব, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা।
 ۚ وَمَا لَهُمۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ مِن وَلِيّٖ وَلَا نَصِير“পৃথিবীতে রক্ষক আর সাহায্যকারী হিসেবে কাউকে তারা পাবে না” অর্থাৎ যে তাদেরকে খুশি করবে, তাদেরকে সাহায্য করবে, তাদের কোনো উপকার করতে পারবে না আর তাদের থেকে কোনো ক্ষতি দুর করতে পারবে না।
﴿وَمِنۡهُم مَّنۡ عَٰهَدَ ٱللَّهَ لَئِنۡ ءَاتَىٰنَا مِن فَضۡلِهِۦ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلصَّٰلِحِينَ ٧٥ فَلَمَّآ ءَاتَىٰهُم مِّن فَضۡلِهِۦ بَخِلُواْ بِهِۦ وَتَوَلَّواْ وَّهُم مُّعۡرِضُونَ ٧٦ فَأَعۡقَبَهُمۡ نِفَاقٗا فِي قُلُوبِهِمۡ إِلَىٰ يَوۡمِ يَلۡقَوۡنَهُۥ بِمَآ أَخۡلَفُواْ ٱللَّهَ مَا وَعَدُوهُ وَبِمَا كَانُواْ يَكۡذِبُونَ ٧٧ أَلَمۡ يَعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ سِرَّهُمۡ وَنَجۡوَىٰهُمۡ وَأَنَّ ٱللَّهَ عَلَّٰمُ ٱلۡغُيُوبِ ٧٨﴾ [التوبة: ٧٥،  ٧٨]
“৭৫. তাদের মধ্যেকার কিছু লোক আল্লাহর সঙ্গে ওয়াদা করেছিল, ‘যদি তিনি আমাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ হতে দান করেন তবে আমরা অবশ্যই দান করব আর অবশ্যই সৎ লোকদের মধ্যে শামিল থাকব।’ ৭৬. অতঃপর আল্লাহ যখন তাদেরকে স্বীয় করুণার দানে ধন্য করলেন, তখন তারা দান করার ব্যাপারে কার্পণ্য করল আর বে-পরোয়া ভাবে মুখ ফিরিয়ে নিল। ৭৭. পরিণামে তিনি আল্লাহর সঙ্গে তাদের কৃত ওয়া‘দা ভঙ্গের কারণে এবং মিথ্যাচারে লিপ্ত থাকার কারণে তাদের অন্তরে মুনাফিকী বদ্ধমূল করে দিলেন; ঐ দিন পর্যন্ত যেদিন তারা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করবে। ৭৮. তারা কি জানে না যে, আল্লাহ তাদের গোপন কথাবার্তা আর গোপন পরামর্শ সম্পর্কে অবহিত আছেন আর আল্লাহ তো যাবতীয় গায়েব সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অবগত আছেন।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৭৫-৭৮]
মুনাফিকদের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে তারা সম্পদ চায় কিন্তু দান করার সময় কৃপণতা করে:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: মুনাফিকদের মধ্যে এমন কেউ রয়েছে, যে আল্লাহ তা‘আলাকে অঙ্গিকার দিয়েছে যে, যদি তিনি অনুগ্রহ করে তাকে ধনী করে দেন তবে সে তার সম্পদ থেকে দান করবে, আর সে সৎকর্মশীল হয়ে যাবে; কিন্তু সে তার অঙ্গিকার পূর্ণ করে নি আর সে যে দাবি করেছিল তাতে সত্যবাদীর পরিচয় দেয় নি। ফলে তাদের এমন কর্মের পরিণামে তাদের অন্তরে মুনাফিকিই বদ্ধমূল করে দিলেন আর তা সে দিন পর্যন্ত যেদিন তারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে কিয়ামত দিবসে, (আল্লাহ তা‘আলার নিকট আমার এ থেকে আশ্রয় চাই)।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: بِمَا أَخْلَفُوا اللَّهَ مَا وَعَدُوهُ  “তিনি আল্লাহর সঙ্গে তাদের কৃত ওয়া‘আদা ভঙ্গের কারণে” অর্থাৎ তাদের অঙ্গিকার ভঙ্গ এবং মিথ্যাচারের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরে কপটতাকে বদ্ধমূল করে দেন। যেমন সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মুনাফিকের নিদর্শন হচ্ছে তিনটি: যদি সে কথা বলে তবে মিথ্যা বলে, যদি সে অঙ্গিকার করে, তবে তা ভঙ্গ করে, আর যদি তার কাছে আমানত রাখা হয় সে তা আত্মসাৎ করে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: أَلَمۡ يَعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ سِرَّهُمۡ وَنَجۡوَىٰهُمۡ “তারা কি জানে না যে, আল্লাহ তাদের গোপন কথাবার্তা আর গোপন পরামর্শ সম্পর্কে অবহিত আছেন।”
আল্লাহ তা‘আলা অবহিত করেন যে, তিনি গোপন এবং তারও চেয়ে বেশি লুকানো বিষয় সম্পর্কে অবগত আছেন। তিনি তাও জানেন যা তারা তাদের অন্তরসমূহে লুকিয়ে রাখে, যদিও তারা প্রকাশ করে যে, তারা যদি সম্পদ অর্জন করে তবে তারা সেখান থেকে সদকা করবে আর এ জন্য কৃতজ্ঞতা আদায় করবে; কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদের নিজেদের থেকে তাদের সম্পর্কে অবগত আছেন, কেননা আল্লাহ তা‘আলা গায়েবের সব কিছু সম্পর্কে জানেন অর্থাৎ তিনি প্রতিটি গোপন এবং দৃশ্যমান সম্পর্কে জানেন আরও অবগত আছেন গোপন কথাবার্তা ও গোপন পরামর্শ সম্পর্কে এবং প্রতিটি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বিষয় সম্পর্কে।
﴿ٱلَّذِينَ يَلۡمِزُونَ ٱلۡمُطَّوِّعِينَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ فِي ٱلصَّدَقَٰتِ وَٱلَّذِينَ لَا يَجِدُونَ إِلَّا جُهۡدَهُمۡ فَيَسۡخَرُونَ مِنۡهُمۡ سَخِرَ ٱللَّهُ مِنۡهُمۡ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٧٩﴾ [التوبة: ٧٩]
“৭৯. মু’মিনদের মধ্যে যারা মুক্ত হস্তে দান করে, তাদেরকে যারা দোষারোপ করে আর সীমাহীন কষ্টে দানকারীদেরকে যারা বিদ্রূপ করে আল্লাহ তাদেরকে বিদ্রূপ করেন আর তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৭৯]
মুনাফিকদের অন্যমত নিদর্শন হচ্ছে, তারা মুক্ত হস্তে দানকারীদের দোষারোপ করে এবং সামান্য সম্পদের অধিকারীদের সাথে ঠাট্টাবিদ্রূপ করে:
মুনাফিকদের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে, তারা সর্বাবস্থায় কারও দোষত্রুটি ধরতে ছাড়ে না, এমন দানকারীরাও তাদের সমালোচনা থেকে মুক্ত নয়। তাদের কেউ যদি অঢেল সম্পদও নিয়ে আগমন করে তবু তার সম্পর্কে মুনাফিকরা বলে: সে তো লোক দেখানোর জন্য দান করছে আর যদি সামান্য সম্পদ নিয়ে (দানকারী) উপস্থিত হয় তবে তারা তাকে বলে: আল্লাহ তা‘আলা তোমার এই সামান্য সম্পদের মুখাপেক্ষী নন। যেমন ইমাম বুখারী বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু সাঈদ আমাদেরকে হাদিস বর্ণনা করেছেন, (তিনি বলেন) হাদিস বর্ণনা করেছেন আমাদের নিকট আবুন নু‘মান আল বাসারী, (তিনি বলেন) হাদিস বর্ণনা করেছেন, আমাদের নিকট শু‘বা (তিনি) সুলাইমান থেকে (তিনি) আবু ওয়াইল থেকে, (তিনি) আবু মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে। তিনি বলেন: দান-সদকা করার আয়াত যখন অবতীর্ণ হয় এ সময় আমরা কুলির কাজ করতাম। এক ব্যক্তি এসে অনেক দান-সদকা করে। ফলে তারা (মুনাফিকরা) বলেন: লোক দেখানো আরেক ব্যক্তি এসে এক সা পরিমাণ দান করলে তারা বলতে থাকে: আল্লাহ তা‘আলা তোমার এই সামান্য সম্পদের মুখাপেক্ষী নন। তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়: يَلۡمِزُونَ ٱلۡمُطَّوِّعِينَ “যারা মুক্ত হস্তে দানকারীদের দোষারোপ করে” ইমাম মুসলিমও তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থে এ হাদিস বর্ণনা করেছেন।
আউফী বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন লোকদের মাঝে বের হয়ে এসে তাদেরকে দান-সদকা জমা করার নির্দেশ দেন। ফলে লোকেরা যার যার সদকা এনে জমা করে। সর্বশেষে এক ব্যক্তি এক সা পরিমাণ খেজুর নিয়ে হাযির হয়ে বলে: হে আল্লাহর রাসূল, এই হচ্ছে এক সা খেজুর, আমি গতরাতে পানি আনার কাজ করে দুই সা খেজুর উপার্জন করেছি, আমি এক সা রেখে দিয়েছি আর আরেক সা আপনার নিকট নিয়ে এসেছি। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটাকেও যাকাতের সাথে যুক্ত করার নির্দেশ দেন। কতিপয় ব্যক্তি সেই লোকটিকে ঠাট্টা করতে শুরু করে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোমার এ দানের মুখাপেক্ষী নন, তোমার এই সা লোকদের কী উপকারে আসবে? এরপর আব্দুর রহমান ইবনু আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলেন: সদকা করতে আর কেউ বাকি আছে কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: তুমি ছাড়া আর কেউ বাকি নেই। তখন আব্দুর রহমান ইবনু আউফ তাঁকে বলেন: আমি দান বাবদ একশত উকিয়া স্বর্ণ প্রদান করছি। তখন ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: তুমি কি বাতিকগ্রস্ত (অত্যুৎসাহী)? তিনি বলেন: আমি বাতিকগ্রস্ত নই। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: তুমি যা দিতে চেয়েছে তাই কি প্রদান করবে? তিনি বলেন: হাঁ, আমার নিকট আশি হাজার দিরহাম রয়েছে, তন্মধ্যে চল্লিশ হাজার দিরহাম আমি আমার রবকে ঋণ বাবদ দিচ্ছি, আর চল্লিশ হাজার আমার নিজের জন্য রেখে দিয়েছি। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: তুমি যা রেখে দিয়েছ তাতে আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে বরকত দিন আর যা তুমি প্রদান করেছ তাতেও তোমাকে বরকত দান করুন। তখন মুনাফিকরা কুৎসা রটিয়ে বলতে শুরু করে: আব্দুর রহমান লোক দেখানো ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে দান করে নি; কিন্তু এ সব মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী। আব্দুর রহমান স্বেচ্ছায় দান করেন, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর এবং তাঁর সঙ্গি দরিদ্র ব্যক্তির নির্দোষ-নির্মলতা সাব্যস্ত করে আয়াত অবতীর্ণ করেন ٱلَّذِينَ يَلۡمِزُونَ ٱلۡمُطَّوِّعِينَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ فِي ٱلصَّدَقَٰتِ “মু’মিনদের মধ্যে যারা মুক্ত হস্তে দান করে, তাদেরকে যারা দোষারোপ করে” এভাবে মুজাহিদ এবং একাধিক ব্যক্তি থেকে এরূপ বর্ণিত হয়েছে।
ইবনু ইসহাক বলেন: মু’মিনদের মধ্যে যারা মুক্ত হস্তে দান করে তাদের মধ্যে রয়েছে আব্দুর রহমান ইবনু আউফ, তিনি চার হাজার দিরহাম দান করেন, আর বানূ ‘আজলানের ‘আসিম ইবনু আদী। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দান করতে উদ্বুদ্ধ করেন আর তা দিতে বলেন ফলে আব্দুর রহমান ইবনু আউফ উঠে দাঁড়িয়ে চার হাজার দিরহাম দান করেন, ‘আসিম ইবনু ‘আদী দাঁড়িয়ে একশত ওয়াসাক খেজুর দান করেন, ফলে (মুনাফিকরা) তাঁদের দু’জনের কুৎসা রটাতে থাকে আর বলে: এটা রিয়া ছাড়া আর কোনো কিছুই নয়, আর যে ব্যক্তি তাঁর সামর্থ্যানুযায়ী সামান্য পরিমাণ দান করে তার নাম আবু আক্বীল। সে আমর ইবনু আউফ গোত্রের মিত্র আনীফ আল-আরাশ গোত্রের লোক। সে এক সা পরিমাণ খেজুর নিয়ে আসে আর তা সদকা মধ্যে যুক্ত করে, তারা (মুনাফিকরা) তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করে আর বলে: আল্লাহ তা‘আলা আবু আক্বীলের সদকা থেকে অমুখাপেক্ষী।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: فَيَسۡخَرُونَ مِنۡهُمۡ سَخِرَ ٱللَّهُ “যারা বিদ্রূপ করে আল্লাহ তাদেরকে বিদ্রূপ করেন” তাদের এই মন্দ কর্ম এবং মুমিনগণের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপের পরিবর্তে তাদেরকে তিরস্কার করেন। কেননা যেমন কর্ম তেমন ফল, ফলে দুনিয়াতে মুমিনগণকে সাহায্য করার জন্য মুমিনগণ নিয়ে যারা ঠাট্টা করে তাদের প্রতি তিনিও অনুরূপ করেন। আল্লাহ তা‘আলা পরকালে মুনাফিকদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন। কেননা যেমন কর্ম ফল ঠিক সেই অনুযায়ী।
﴿ٱسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ أَوۡ لَا تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ إِن تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ سَبۡعِينَ مَرَّةٗ فَلَن يَغۡفِرَ ٱللَّهُ لَهُمۡۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡفَٰسِقِينَ ٨٠ ﴾ [التوبة: ٨٠]
“৮০. তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর বা না কর (উভয়ই সমান), তুমি তাদের জন্য সত্তর বার ক্ষমা প্রার্থনা করলেও আল্লাহ কখনো তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। এটা এজন্য যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে কুফুরী করেছে। আর আল্লাহ ফাসিক লোকদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৮০]
মুনাফিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে অবহিত করেন যে, এ সমস্ত মুনাফিক এর যোগ্য নয় যে, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হবে, যদিও তুমি সত্তরবার তাদের জন্য ক্ষমা চাও তিনি তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। বলা হয়েছে: তাদের জন্য ক্ষমার দরজা বন্ধ করে দিতে সত্তর বারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা আরবরা তাদের কথার পদ্ধতিতে কোনো কিছু বাড়িয়ে বলার ক্ষেত্রে সত্তর (সংখ্যাটি) ব্যবহার করত। তারা নির্দিষ্ট করে সত্তরেই সীমাবদ্ধ রাখত না আবার সত্তরের বেশিও বুঝাত না।
কেউ কেউ বলেন: এর নির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে, যেমন শা‘বী তা বলেছেন: আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই যখন মারা যায় তখন তার পুত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গিয়ে বলে: আমার পিতা মারা গেছে, আমি পছন্দ করি যে, আপনি তার নিকট উপস্থিত হোন আর তার জানাযার সালাত আদায় করুন। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন: ‘তোমার নাম কী’ সে বলে: আল-হুবাব ইবনু আব্দুল্লাহ, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: বরং তুমি হচ্ছ আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহ, কেননা আল-হুবাব হচ্ছে শয়তানের নাম। তিনি তার সাথে গিয়ে আব্দুল্লাহর জানাযায় উপস্থিত হন আর কাফন হিসেবে তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একটি জামা পরিধান করান আর তার জানাযার সালাত পড়ান। তখন তাঁকে বলা হয়: আপনি কি এর জানাযা পড়বেন (অথচ এ হচ্ছে মুনাফিক) ফলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: إِن تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ سَبۡعِينَ مَرَّةٗ “তুমি তাদের জন্য সত্তরবার ক্ষমা প্রার্থনা করলেও” আমি তার জন্য সত্তরবার ক্ষমা প্রার্থনা করব। আরও সত্তরবার আরও সত্তর বার। এভাবে উরওয়া ইবনু জুবাইর, মুজাহিদ, কাতাদা ইবনু দি‘আমাহ থেকে এটা বর্ণিত হয়েছে, ইবনু জারীর এর সনদ সহ এই হাদিস বর্ণনা করেন।
﴿فَرِحَ ٱلۡمُخَلَّفُونَ بِمَقۡعَدِهِمۡ خِلَٰفَ رَسُولِ ٱللَّهِ وَكَرِهُوٓاْ أَن يُجَٰهِدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَقَالُواْ لَا تَنفِرُواْ فِي ٱلۡحَرِّۗ قُلۡ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرّٗاۚ لَّوۡ كَانُواْ يَفۡقَهُونَ ٨١ فَلۡيَضۡحَكُواْ قَلِيلٗا وَلۡيَبۡكُواْ كَثِيرٗا جَزَآءَۢ بِمَا كَانُواْ يَكۡسِبُونَ ٨٢ ﴾ [التوبة: ٨١،  ٨٢]
“৮১. (তাবুক অভিযানে) যারা পিছনে থেকে গিয়েছিল তারা রাসূলের বিরোধিতায় বসে থাকাতেই আনন্দ প্রকাশ করেছিল আর তাদের ধন-সম্পদ ও জান দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করতে তারা অপছন্দ করেছিল। তারা বলেছিল, ‘গরমের মধ্যে অভিযানে বেরিও না।’ বল, ‘জাহান্নামের আগুনই তাপে প্রচণ্ডতম।’ যদি তারা বুঝত! ৮২. তারা যেন কম হাসে এবং বেশি কাঁদে, তারা যে (পাপ) কামাই করছে তার ফলস্বরূপ।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৮১-৮২]

যুদ্ধ থেকে পেছনে থেকে যাওয়ায় মুনাফিকদের আনন্দ:
তাবুক যুদ্ধে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণ থেকে যে সমস্ত মুনাফিকরা পেছনে পড়ে রয়েছিল আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (যুদ্ধের জন্য) বেরিয়ে যাবার পরও যারা বসে থাকতেই পছন্দ করেছিল, আল্লাহ তা‘আলা তাদের তিরস্কার করে বলেন, وَكَرِهُوٓاْ أَن يُجَٰهِدُواْ “আর জিহাদ করতে তারা অপছন্দ করেছিল” তাঁর সাথে, بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَقَالُواْ “তাদের ধন-সম্পদ ও জান দিয়ে আল্লাহর পথে আর তারা বলেছিল” অর্থাৎ, পরস্পর পরস্পরকে لَا تَنفِرُواْ فِي ٱلۡحَرِّۗ  “গরমের মধ্যে অভিযানে বেরিও না।” কেননা তাবুক যুদ্ধে বের হওয়াটা ছিল প্রচণ্ড গরমের মধ্যে যখন মদীনায় ছায়া (অন্য সময়ের তুলনায়) ছিল ভালো এবং ফলফলাদি পেকেছিল। এ কারণে তারা বলে: لَا تَنفِرُواْ فِي ٱلۡحَرِّۗ “গরমের মধ্যে অভিযানে বেরিও না।”
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে বলেন: قُلۡ “বল” তাদেরকে  نَارُ جَهَنَّمَ“জাহান্নামের আগুনই” তোমাদের বিরোধিতার কারণে যেটা হবে তোমাদের ঠিকানা, أَشَدُّ حَرّٗاۚ “তাপে প্রচণ্ডতম” যে গরম থেকে তোমরা পালিয়েছ; বরং সেটা দুনিয়ার আগুনের চেয়েও বেশি উত্তপ্ত হবে। যেমন ইমাম আহমাদ আবুয যিনাদ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি ‘আরাজ থেকে (তিনি) আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: মানুষের (ব্যবহৃত) আগুন যা তোমরা জ্বালিয়ে থাক সেটা জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগের একভাগ। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন: এই আগুনই তো যথেষ্ট। তিনি বলেন: জাহান্নামের আগুনকে ঊনসত্তর গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বুখারী ও মুসলিম তাঁদের ‘সহীহ’ গ্রন্থদ্বয়ে এ হাদিস বর্ণনা করেছেন। ‘আমাশ বর্ণনা করেন, আবু ইসহাক নু‘মান ইবনু বাশীর থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “কিয়ামত দিবসে সবচেয়ে হালকা শাস্তি দেওয়া হবে ঐ ব্যক্তিকে যাকে জাহান্নামের আগুনের দু‘টি জুতা পরিয়ে দেওয়া হবে। এতে তার মগজ টগবগ করে ফুটবে যেভাবে হাড়ি টগবগ করে। সে ভাববে তার চাইতে আর কাউকে এর চেয়ে বেশি শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। অথচ সেই সবচেয়ে হালকা শাস্তির অধিকারী।” বুখারী ও মুসলিম তাঁদের ‘সহীহ’ গ্রন্থদ্বয়ে এ হাদিস বর্ণনা করেছেন। এ ব্যাপারে বহু আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সম্মানিত গ্রন্থে বর্ণনা করেন: ﴿كَلَّآۖ إِنَّهَا لَظَىٰ ١٥ نَزَّاعَةٗ لِّلشَّوَىٰ ١٦﴾ [المعارج: ١٥، ١٦] “না, কখনো নয়, ওটা জ্বলন্ত অগ্নিশিখা, যা চামড়া তুলে দিবে।” (সুরা আল-মা‘আরিজ: ১৫-১৬) অন্যত্র তিনি বলেন:
﴿هَٰذَانِ خَصۡمَانِ ٱخۡتَصَمُواْ فِي رَبِّهِمۡۖ فَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ قُطِّعَتۡ لَهُمۡ ثِيَابٞ مِّن نَّارٖ يُصَبُّ مِن فَوۡقِ رُءُوسِهِمُ ٱلۡحَمِيمُ ١٩ يُصۡهَرُ بِهِۦ مَا فِي بُطُونِهِمۡ وَٱلۡجُلُودُ ٢٠ وَلَهُم مَّقَٰمِعُ مِنۡ حَدِيدٖ ٢١ كُلَّمَآ أَرَادُوٓاْ أَن يَخۡرُجُواْ مِنۡهَا مِنۡ غَمٍّ أُعِيدُواْ فِيهَا وَذُوقُواْ عَذَابَ ٱلۡحَرِيقِ ٢٢﴾ [الحج : ١٩، ٢٢]
“এরা বিবাদের দু’টি পক্ষ, (মু’মিনরা একটি পক্ষ আর সমস্ত কাফিররা আরেকটি পক্ষ) এরা এদের রব সম্বন্ধে বাদানুবাদ করে। অতঃপর যারা (তাদের রবকে) অস্বীকার করে তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে আগুনের পোশাক, তাদের মাথার উপর ঢেলে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি, যা দিয়ে তাদের পেটে যা আছে তা ও তাদের চামড়া গলিয়ে দেওয়া হবে। উপরন্তু তাদের (শাস্তির) জন্য থাকবে লোহার মুগুর। যখনই তারা যন্ত্রণার চোটে তাত্থেকে বেরিয়ে আসতে চাইবে (তখনই) তাদেরকে তার ভিতরে ফিরিয়ে দেওয়া হবে (আর বলা হবে, আগুনে) পোড়ার শাস্তি আস্বাদন কর।” [সূরা আল-হজ: ১৯-২২]
অনুরূপ অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بِ‍َٔايَٰتِنَا سَوۡفَ نُصۡلِيهِمۡ نَارٗا كُلَّمَا نَضِجَتۡ جُلُودُهُم بَدَّلۡنَٰهُمۡ جُلُودًا غَيۡرَهَا لِيَذُوقُواْ ٱلۡعَذَابَۗ ٥٦﴾ [النساء : ٥٦] “যারা আমার আয়াতসমূহকে প্রত্যাখ্যান করে, নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে আগুনে দগ্ধ করব। যখন তাদের গায়ের চামড়া দগ্ধ হবে, আমি সেই চামড়াকে নতুন চামড়া দ্বারা বদলে দেব যেন তারা (শাস্তির পর) শাস্তি ভোগ করে।” [সূরা আন-নিসা: ৫৬]
সেরূপ আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে বলেন: قُلۡ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرّٗاۚ لَّوۡ كَانُواْ يَفۡقَهُونَ “বল, ‘জাহান্নামের আগুনই তাপে প্রচণ্ডতম’। যদি তারা বুঝত।” অর্থাৎ যদি তাদের জ্ঞান থাকত এবং তারা অনুধাবন করত, তবে অবশ্যই তারা গরমের মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বের হত এবং জাহান্নামের উত্তাপ থেকে বাঁচত, যার উত্তাপ বহুগুণ বেশি।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা এ সকল মুনাফিকদের কর্মকাণ্ডের উপরে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন: فَلۡيَضۡحَكُواْ قَلِيلٗا “তারা যেন কম হাসে।” ইবনু আবু তালহা বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহ আনহুমা বলেন: দুনিয়া সামান্য, কাজেই তারা যেমন খুশি এখানে হেসে নেয়, এরপর যখন দুনিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং তারা আল্লাহ তা‘আলার নিকট ফিরে যাবে তখন তারা কাঁদতে শুরু করবে যা কোনো দিন শেষ হবে না।

﴿فَإِن رَّجَعَكَ ٱللَّهُ إِلَىٰ طَآئِفَةٖ مِّنۡهُمۡ فَٱسۡتَ‍ٔۡذَنُوكَ لِلۡخُرُوجِ فَقُل لَّن تَخۡرُجُواْ مَعِيَ أَبَدٗا وَلَن تُقَٰتِلُواْ مَعِيَ عَدُوًّاۖ إِنَّكُمۡ رَضِيتُم بِٱلۡقُعُودِ أَوَّلَ مَرَّةٖ فَٱقۡعُدُواْ مَعَ ٱلۡخَٰلِفِينَ ٨٣﴾ (التوبة: ٨٣)
“আল্লাহ যদি তোমাকে তাদের কোনো দলের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন আর যদি তারা (তোমার সঙ্গে) অভিযানে বের হবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে তখন বলবে, ‘আমার সাথে কখনো বের হতে পারবে না আর কখনো আমার সঙ্গে গিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে পারবে না, তোমরা প্রথমবারেই নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকাকেই বেশি পছন্দ করে নিয়েছ, কাজেই (এখন) পিছে-পড়াদের সাথেই বসে থাক’।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৮৩]
মুনাফিকদেরকে যুদ্ধে বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে না:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিয়ে বলেন: فَإِن رَّجَعَكَ ٱللَّهُ “আল্লাহ যদি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন” অর্থাৎ তোমার এই যুদ্ধ থেকে আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে ফিরিয়ে আনেন إِلَىٰ طَآئِفَةٖ “তাদের কোনো দলের কাছে।” কাতাদা বলেন: আমরা অবহিত হই তারা ছিল ১২জন ব্যক্তি।  فَٱسۡتَ‍ٔۡذَنُوكَ لِلۡخُرُوجِ “আর যদি তারা (তোমার সঙ্গে) অভিযানে বের হবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে” অর্থাৎ তোমার সঙ্গে অন্য যুদ্ধে فَقُل لَّن تَخۡرُجُواْ مَعِيَ أَبَدٗا وَلَن تُقَٰتِلُواْ مَعِيَ عَدُوًّاۖ “তখন বলবে, ‘আমার সাথে কখনো বের হতে পারবে না আর কখনো আমার সঙ্গে গিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে পারবে না” অর্থাৎ তাদেরকে তিরস্কার ও শাস্তিস্বরূপ। এরপর এর কারণ বর্ণনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: إِنَّكُمۡ رَضِيتُم بِٱلۡقُعُودِ أَوَّلَ مَرَّةٖ “তোমরা প্রথমবারেই নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকাকেই বেশি পছন্দ করে নিয়েছ” এ আয়াতটি এ আয়াতের মত ﴿وَنُقَلِّبُ أَفۡ‍ِٔدَتَهُمۡ وَأَبۡصَٰرَهُمۡ كَمَا لَمۡ يُؤۡمِنُواْ بِهِۦٓ أَوَّلَ مَرَّةٖ ١١٠﴾ [الانعام: ١١٠] “যেহেতু তারা প্রথম চোটেই ঈমান আনে নি, কাজেই আমি তাদের বিবেক আর অন্তর্দৃষ্টিকে অন্যদিকে ফিরিয়ে দেব।” [সূরা আল-আন‘আম: ১১০] কেননা মন্দের পরিণতি তার পরে মন্দই হয়, যেভাবে ভালো কাজের সাওয়াব তার পরে ভালোই হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা হুদাইবিয়ার উমরাহ প্রসঙ্গে বলেন: ﴿سَيَقُولُ ٱلۡمُخَلَّفُونَ إِذَا ٱنطَلَقۡتُمۡ إِلَىٰ مَغَانِمَ لِتَأۡخُذُوهَا ١٥﴾ [الفتح: ١٥] “তোমরা যখন গনিমতের মাল সংগ্রহ করার জন্য যেতে থাকবে তখন পিছনে থেকে যাওয়া লোকগুলো বলবে।” [সূরা আল-ফাতহ্: ১৫] আল্লাহ তা‘আলার বাণী: فَٱقۡعُدُواْ مَعَ ٱلۡخَٰلِفِينَ “কাজেই (এখন) পিছে-পড়াদের সাথেই বসে থাক।” আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: অর্থাৎ এ সমস্ত লোকদের সাথে যারা অভিযান থেকে পেছনে পড়ে রয়েছিল।
﴿وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰٓ أَحَدٖ مِّنۡهُم مَّاتَ أَبَدٗا وَلَا تَقُمۡ عَلَىٰ قَبۡرِهِۦٓۖ إِنَّهُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَمَاتُواْ وَهُمۡ فَٰسِقُونَ ٨٤﴾ [التوبة: ٨٤]  
“৮৪. তাদের কেউ মারা গেলে তুমি কক্ষনো তাদের জন্য (জানাযার) সালাত পড়বে না আর তাদের কবরের পাশে দণ্ডায়মান হবে না। তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সঙ্গে কুফুরী করেছে আর বিদ্রোহী পাপাচারী অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৮৪]
মুনাফিকদের জানাযার সালাত আদায় করা নিষেধ:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি যেন মুনাফিকদের বর্জন করেন আর তাদের যদি কেউ মারা যায় তবে তার জানাযার সালাত যেন আদায় না করেন। আর তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও দো‘আ করার উদ্দেশ্যে তার কবরে না দাঁড়ান। কেননা সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছে আর এ অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে। এ বিধান প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির জন্য যার নিফাক সম্পর্কে জানা গেছে। যদিও এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনু সালূল। যেমন ইমাম বুখারী বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই যখন মারা যায় তখন তার পুত্র আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে সে তার পিতাকে কাফন পরানোর জন্য তাঁর জামাটি দিতে বলে, ফলে তিনি তা দিয়ে দেন। এরপর সে তার পিতার জানাযার সালাত আদায় করতে বললে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা আদায় করার জন্য দণ্ডায়মান হতে উদ্যত হন তখন উমার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসারাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জামা ধরে বলেন: হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি তার জানাযার সালাত আদায় করবেন অথচ আপনাকে আপনার রব তার জানাযা পড়াতে নিষেধ করেছেন? তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এ বলে ইখতিয়ার দিয়েছেন: ٱسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ أَوۡ لَا تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ إِن تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ سَبۡعِينَ مَرَّةٗفَلَن يَغۡفِرَ ٱللَّهُ لَهُمۡۚ “তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর বা না কর (উভয়ই সমান), তুমি তাদের জন্য সত্তর বার ক্ষমা প্রার্থনা করলেও আল্লাহ কক্ষনো তাদেরকে ক্ষমা করবেন না।” আমি তার জন্য সত্তর বারেরও বেশি ক্ষমা চাইব। তিনি (উমার) বলেন: সে তো মুনাফিক। তিনি (আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জানাযার সালাত আদায় করেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন:
وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰٓ أَحَدٖ مِّنۡهُم مَّاتَ أَبَدٗا وَلَا تَقُمۡ عَلَىٰ قَبۡرِهِۦٓ “তাদের কেউ মারা গেলে তুমি কখনো তাদের জন্য (জানাযার) সালাত পড়বে না। আর তাদের কবরের পাশে দণ্ডায়মান হবে না।”
এই হাদিস প্রায় এভাবে স্বয়ং উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতেও বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে: তিনি বলেন: এরপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জানাযা পড়িয়ে দেন। তার (খাটলার) পেছনে পেছনে যান। আর তাকে দাফন করা পর্যন্ত তার কবরের উপরে দাঁড়িয়ে থাকেন। (উমর বলেন) আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে এভাবে কথা বলার সাহসিকতায় সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল অধিক অবগত। আল্লাহর শপথ, বিষয়টি সহজ ছিল। অবশেষে এ দু’টো আয়াত অবতীর্ণ হয়:
وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰٓ أَحَدٖ مِّنۡهُم مَّاتَ أَبَدٗا “তাদের কেউ মারা গেলে তুমি কখনো তাদের জন্য (জানাযার) সালাত পড়বে না।” এরপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর কোএা মুনাফিকের জানাযা পড়েন নি এবং তার কবরের উপরে দাঁড়ান নি আর এ অবস্থাতেই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রূহ কবজ করে নেন। তিরমিযী এভাবে এই হাদিস তাফসীর প্রসঙ্গে বর্ণনা করেছেন আর তিনি বলেন: (হাদিসটি) হাসান-সহীহ। ইমাম বুখারীও এ হাদিস বর্ণনা করছেন।
﴿وَلَا تُعۡجِبۡكَ أَمۡوَٰلُهُمۡ وَأَوۡلَٰدُهُمۡۚ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ أَن يُعَذِّبَهُم بِهَا فِي ٱلدُّنۡيَا وَتَزۡهَقَ أَنفُسُهُمۡ وَهُمۡ كَٰفِرُونَ ٨٥ ﴾ [التوبة: ٨٥]
“তাদের মূলধন আর সন্তান-সন্ততি তোমার যেন চোখ ধাঁদিয়ে না দেয়, দুনিয়াতে আল্লাহ সে সব দিয়েই তাদেরকে শাস্তি দেয়ার ইচ্ছে করেন আর কাফির অবস্থায় যেন তাদের প্রাণবায়ু নির্গত হয়।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৮৫]
এই ধরণের আয়াতের তাফসীর ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার জন্য সকল প্রশংসা এবং তাঁরই অনুগ্রহ।
﴿وَإِذَآ أُنزِلَتۡ سُورَةٌ أَنۡ ءَامِنُواْ بِٱللَّهِ وَجَٰهِدُواْ مَعَ رَسُولِهِ ٱسۡتَ‍ٔۡذَنَكَ أُوْلُواْ ٱلطَّوۡلِ مِنۡهُمۡ وَقَالُواْ ذَرۡنَا نَكُن مَّعَ ٱلۡقَٰعِدِينَ ٨٦ رَضُواْ بِأَن يَكُونُواْ مَعَ ٱلۡخَوَالِفِ وَطُبِعَ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ فَهُمۡ لَا يَفۡقَهُونَ ٨٧ ﴾ [التوبة: ٨٦،  ٨٧]
“৮৬. যখন সূরা অবতীর্ণ করা হয় যে, ‘আল্লাহর ওপর ঈমান স্থাপন কর আর তাঁর রসূলের সঙ্গে থেকে জিহাদ কর’- তখন শক্তি-সামর্থ্য সম্পন্ন লোকেরা তোমার নিকট অব্যাহতি প্রার্থনা করে আর বলে, ‘আমাদেরকে রেহাই দিন, যারা (ঘরে) বসে থাকে আমরা তাদের সঙ্গেই থাকব। ৮৭. তারা পিছনে (ঘরে বসে) থাকা স্ত্রীলোকদের সাথে থাকাকেই পছন্দ করে। তাদের হৃদয়কে সিল করে দেওয়া হয়েছে। কাজেই তারা কিছুই বুঝতে পারে না।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৮৬-৮৭]
আল্লাহ তা‘আলা ঐ সব লোকদের তিরস্কার করেন, যারা ক্ষমতা, সামর্থ্য এবং অর্থ বিত্ত থাকা সত্ত্বেও জিহাদ থেকে পেছনে পড়ে থাকে এবং তা থেকে বিরত থাকে। তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট (অভিযানে না গিয়ে) বসে থাকার অনুমতি চায় আর বলে:  ذَرۡنَا نَكُن مَّعَ ٱلۡقَٰعِدِينَ “আমাদেরকে রেহাই দিন। যারা (ঘরে) বসে থাকে আমরা তাদের সঙ্গেই থাকব” তারা নিজেদের জন্য লজ্জিত হওয়া এবং নারীদের সাথে এলাকায় বসে থাকাকেই পছন্দ করে নিয়েছে। সেনাবাহিনী বের হয়ে যাওয়ার পরে নারীরাই তো পেছনে পড়ে থাকে। যুদ্ধের সময় এলে ওরাই হচ্ছে সবচেয়ে কাপুরুষ; কিন্তু নিরাপদ সময়ে তাদের মত বাচাল আর দেখা যায় না। যেমন, আল্লাহ তাদের সম্পর্কে অপর এক আয়াতে বলেন:
 ﴿أَشِحَّةً عَلَيۡكُمۡۖ فَإِذَا جَآءَ ٱلۡخَوۡفُ رَأَيۡتَهُمۡ يَنظُرُونَ إِلَيۡكَ تَدُورُ أَعۡيُنُهُمۡ كَٱلَّذِي يُغۡشَىٰ عَلَيۡهِ مِنَ ٱلۡمَوۡتِۖ فَإِذَا ذَهَبَ ٱلۡخَوۡفُ سَلَقُوكُم بِأَلۡسِنَةٍ حِدَادٍ أَشِحَّةً عَلَى ٱلۡخَيۡرِۚ أُوْلَٰٓئِكَ لَمۡ يُؤۡمِنُواْ فَأَحۡبَطَ ٱللَّهُ أَعۡمَٰلَهُمۡۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٗا ١٩﴾ [الاحزاب : ١٩]
“তোমাদের প্রতি কৃপণতার বশবর্তী হয়ে। যখন বিপদ আসে তখন তুমি দেখবে মৃত্যু ভয়ে অচেতন ব্যক্তির ন্যায় চোখ উল্টিয়ে তারা তোমার দিকে তাকাচ্ছে। অতঃপর বিপদ যখন কেটে যায় তখন ধনের লালসায় তারা তোমাদেরকে তীক্ষ্ণ বাক্য-বাণে বিদ্ধ করে। নিরাপদ (যখন যুদ্ধবিগ্রহ থাকে না এমন) সময় শক্তিশালী ধারালো কথার মাধ্যমে তাদের জবান চড়া হয়; কিন্তু যুদ্ধের সময় (একেবারে) কাপুরুষ। ওরাই এই সকল লোক যারা ঈমান আনে নি। অতঃপর আল্লাহ তাদের ‘আমলসমুহ পণ্ড করে দিয়েছেন আর এটা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ।” [সূরা আল-আহযাব: ১৯]
আল্লাহ তা‘আলা অপর এক আয়াতে বলেন:
﴿وَيَقُولُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَوۡلَا نُزِّلَتۡ سُورَةٞۖ فَإِذَآ أُنزِلَتۡ سُورَةٞ مُّحۡكَمَةٞ وَذُكِرَ فِيهَا ٱلۡقِتَالُ رَأَيۡتَ ٱلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ يَنظُرُونَ إِلَيۡكَ نَظَرَ ٱلۡمَغۡشِيِّ عَلَيۡهِ مِنَ ٱلۡمَوۡتِۖ فَأَوۡلَىٰ لَهُمۡ ٢٠ طَاعَةٞ وَقَوۡلٞ مَّعۡرُوفٞۚ فَإِذَا عَزَمَ ٱلۡأَمۡرُ فَلَوۡ صَدَقُواْ ٱللَّهَ لَكَانَ خَيۡرٗا لَّهُمۡ ٢١﴾ [محمد: ٢٠،  ٢١]  
“মু’মিনরা বলে, একটি সূরা নাযিল হয় না কেন? অতঃপর যখন কোনো সুস্পষ্ট অর্থবোধক সূরা অবতীর্ণ হয় আর তাতে যুদ্ধের কথা উল্লেখ থাকে তখন তুমি তাদেরকে দেখবে যাদের অন্তরে রোগ আছে মৃত্যুর ভয়ে জ্ঞানহারা লোকের মত তোমার দিকে তাকাচ্ছে। কাজেই ধ্বংস তাদের জন্য। তাদের জন্য উত্তম ছিল (আল্লাহর) আনুগত্য করা ও ন্যায়সঙ্গত কথা বলা। অতঃপর যুদ্ধের সিদ্ধান্ত হলে তারা যদি আল্লাহর নিকট দেওয়া অঙ্গিকার পূর্ণ করত। তবে তা তাদের জন্য কল্যাণকর হত।” [সূরা মুহাম্মদ: ২০]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:وَطُبِعَ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ  “তাদের হৃদয়কে সীল করে দেওয়া হয়েছে)” জিহাদ থেকে বিরত থাকা এবং আল্লাহর পথে রাসূলের সাথে বের হওয়ার কারণে। فَهُمۡ لَا يَفۡقَهُونَ “কাজেই তারা কিছুই বুঝতে পারে না” অর্থাৎ কিসে তাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে সেটা তারা বুঝে না? যার ফলে সেটা তারা করবে। (আরও বুঝে না) কিসে তাদের অকল্যাণ রয়েছে? ফলে সেটা থেকে তারা বিরত থাকবে।
﴿لَٰكِنِ ٱلرَّسُولُ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مَعَهُۥ جَٰهَدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ لَهُمُ ٱلۡخَيۡرَٰتُۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٨٨ أَعَدَّ ٱللَّهُ لَهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَاۚ ذَٰلِكَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ ٨٩﴾ [التوبة: ٨٨،  ٨٩]
“৮৮. কিন্তু রাসূল আর তার সাথে যারা ঈমান এনেছে তারা তাদের মাল দিয়ে এবং জান দিয়ে জিহাদ করে। যাবতীয় কল্যাণ তো তাদেরই জন্য। সফলকাম তো তারাই। ৮৯. আল্লাহ তাদের জন্য জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন যার নিম্নদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, যাতে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই হল বিরাট সফলতা।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৮৮-৮৯]
ইতোপূর্বে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের গোনাহ সম্পর্কে আলোচনা করেন। এরপর তিনি মুমিনগণের প্রশংসা করেন এবং পরকালে তাদের সাওয়াব সম্পর্কে বর্ণনা দেন। তিনি বলেন: لَٰكِنِ ٱلرَّسُولُ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مَعَهُۥ جَٰهَدُواْ “কিন্তু রাসূল আর তার সাথে যারা ঈমান এনেছে তারা জিহাদ করে” এই দু’টি আয়াতের শেষ পর্যন্ত তাদের অবস্থা এবং ঠিকানা সম্পর্কে আলোচনা করেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَأُوْلَٰٓئِكَ لَهُمُ ٱلۡخَيۡرَٰتُۖ “যাবতীয় কল্যাণ তো তাদেরই জন্য” অর্থাৎ পরকালে। জান্নাতুল ফিরদাউসে এবং উঁচু স্তরে।
﴿وَجَآءَ ٱلۡمُعَذِّرُونَ مِنَ ٱلۡأَعۡرَابِ لِيُؤۡذَنَ لَهُمۡ وَقَعَدَ ٱلَّذِينَ كَذَبُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥۚ سَيُصِيبُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنۡهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٞ ٩٠﴾ [التوبة: ٩٠]  
“৯০. মরুচারীদের মধ্যেও ওজর-আপত্তি পেশকারীরা এসে অব্যাহতির আবেদন জানালো। যারা (নিজেদের ঈমান থাকার ব্যাপারে) আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নিকট মিথ্যা বলেছিল তারাও পিছনে রয়ে গেল। তাদের (অর্থাৎ বেদুইনদের) মধ্যে যারা কুফুরী করেছে শীঘ্রই এক ভয়ঙ্কর ‘আযাব তাদেরকে পাকড়াও করবে।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৯০]
এরপর আল্লাহ তা‘আলা জিহাদ পরিত্যাগের ব্যাপারে ওযর পেশকারীদের অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা করেন, যারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে ওযর পেশ করতে থাকে আর তাদের জিহাদে বের হতে যে দুর্বলতা ও অক্ষমতা রয়েছে তার বর্ণনা দেয়। এরা হচ্ছে মদিনার আশে-পাশে বসবাসকারী আরব বেদুঈন। দাহ্হাক বর্ণনা করেন।
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা وَجَآءَ ٱلۡمُعَذِّرُونَ “ওজর-আপত্তি পেশকারীরা এসে” (তাশদীদ বিহীন) পড়েন আর বলেন: এ হচ্ছে ওযরওয়ালা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এর পরে বলেন: وَقَعَدَ ٱلَّذِينَ كَذَبُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ “যারা (নিজেদের ঈমান থাকার ব্যাপারে) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট মিথ্যা বলেছিল তারাও পিছনে রয়ে গেল” অর্থাৎ তারা এসে ওযর পেশ করে নি।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন: سَيُصِيبُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنۡهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٞ “তাদের (অর্থাৎ বেদুইনদের) মধ্যে যারা কুফুরী করেছে, শীঘ্রই এক ভয়ঙ্কর ‘আযাব তাদেরকে পাকড়াও করবে।”
﴿لَّيۡسَ عَلَى ٱلضُّعَفَآءِ وَلَا عَلَى ٱلۡمَرۡضَىٰ وَلَا عَلَى ٱلَّذِينَ لَا يَجِدُونَ مَا يُنفِقُونَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُواْ لِلَّهِ وَرَسُولِهِۦۚ مَا عَلَى ٱلۡمُحۡسِنِينَ مِن سَبِيلٖۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٩١ وَلَا عَلَى ٱلَّذِينَ إِذَا مَآ أَتَوۡكَ لِتَحۡمِلَهُمۡ قُلۡتَ لَآ أَجِدُ مَآ أَحۡمِلُكُمۡ عَلَيۡهِ تَوَلَّواْ وَّأَعۡيُنُهُمۡ تَفِيضُ مِنَ ٱلدَّمۡعِ حَزَنًا أَلَّا يَجِدُواْ مَا يُنفِقُونَ ٩٢ ۞إِنَّمَا ٱلسَّبِيلُ عَلَى ٱلَّذِينَ يَسۡتَ‍ٔۡذِنُونَكَ وَهُمۡ أَغۡنِيَآءُۚ رَضُواْ بِأَن يَكُونُواْ مَعَ ٱلۡخَوَالِفِ وَطَبَعَ ٱللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ فَهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ ٩٣﴾ [التوبة: ٩١،  ٩٣]  
“৯১. দুর্বলের উপর, পীড়িতের উপর আর ব্যয় করার মত কোনো সম্বল যাদের নেই তাদের উপর কোনো অভিযোগ নেই। যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি কল্যাণকামী হয়ে থাকে। সৎ কর্ম পরায়ণদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করার কোনো সুযোগ নেই। আর আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ৯২. তাদের বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ নেই যারা তোমার কাছে যখন বাহন চাওয়ার জন্য এসেছিল তখন তুমি বলেছিলে, ‘আমি তো তোমাদের জন্য কোনো বাহন পাচ্ছি না’। তখন তারা ফিরে গেল আর সে সময় তাদের চোখ থেকে অশ্র ঝরে পড়ছিল এ দুঃখে যে, ব্যয় বহন করার মত কোনো কিছু তাদের ছিল না। ৯৩. অভিযোগ তো তাদের বিরুদ্ধে যারা সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও (যুদ্ধে যাওয়া হতে) তোমার কাছে অব্যাহতি প্রার্থনা করেছিল, যারা ঘরে বসা থাকা (স্ত্রী লোকদের) সঙ্গে থাকতেই পছন্দ করেছিল। আল্লাহ তাদের হৃদয়কে সীল করে দিয়েছেন আর এ জন্য যে, (কিসে নিজেদের কল্যাণ আছে আর কিসে অকল্যাণ) তা তারা জানে না।” [সুরা আত-তাওবাহ: ৯১-৯৩]
এরপর আল্লাহ তা‘আলা (বৈধ) ওযরগুলোর কথা বর্ণনা করেন, যেগুলোর কারণে যুদ্ধে না গিয়ে বসে থাকলেও ক্ষতি নেই। তন্মধ্যে (প্রথমত তিনি) সেই ওযরের কথা উল্লেখ করেন, যা কোনো ব্যক্তির সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে থাকে, শারীরিক দুর্বলতা যা কাউকে জিহাদে না যেতে অনুমতি দেয়। যেমন অন্ধ, খোঁড়া এবং তার অনুরূপ। এ কারণে তিনি এর দ্বারা শুরু করেছেন। এরপর তিনি এমন সব ওজরের কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলো স্থায়ী নয়। যেমন অসুস্থতা, যা আল্লাহ তা‘আলার পথে যুদ্ধ করতে বাধা দেয় অথবা দারিদ্রতা, যার কারণে সে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে পারে না -এ সমস্ত লোকের জন্য অসুবিধা নেই যদি তারা যুদ্ধে না গিয়ে বসে থাকে আর তাদের বসে থাকা অবস্থায় তারা কল্যাণকামী হয়। তারা বিদ্বেষ ছড়ানো অথবা কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে মুসলিমবৃন্দকে নিরুৎসাহিত করে না; বরং তাদের এ সকল অবস্থায় তারা সৎ স্বভাবের অধিকারী। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: مَا عَلَى ٱلۡمُحۡسِنِينَ مِن سَبِيلٖۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ “কর্ম পরায়ণদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করার কোনো সুযোগ নেই। আর আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
আউযায়ী বর্ণনা করেন, লোকেরা যখন ইস্তিস্কা (বৃষ্টি প্রার্থনার সালাত)-এর জন্য বের হয় তখন তাদের মাঝে বিলাল ইবনু সা‘আদ দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করে বলেন: উপস্থিত জনমণ্ডলি, তোমারা কি গোনাহের স্বীকৃতি দিচ্ছ না? তারা বলে: হাঁ, আল্লাহর শপথ, এরপর তিনি বলেন: হে আল্লাহ আমরা তোমাকে বলতে শুনি: مَا عَلَى ٱلۡمُحۡسِنِينَ مِن سَبِيلٖۚ “কর্ম পরায়ণদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করার কোনো সুযোগ নেই” আমরা গোনাহের স্বীকৃতি দিয়েছি। কাজেই আমাদেরকে ক্ষমা করুন, আমাদের প্রতি রহম করুন, আমাদের প্রতি বৃষ্টি বর্ষণ করুন। তিনি তাঁর দু’হাত উত্তোলন করেন। (তার সঙ্গে) লোকেরাও তাদের দু’হাত উত্তোলন করে। এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি বৃষ্টি বর্ষণ করেন। আউফী বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদেরকে যুদ্ধে তাঁর সাথে বের হয়ে আসতে নির্দেশ দেন। তখন একদল সাহাবী বের হয়ে আসেন যাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনু মুগাফ্ফাল ইবনু মুকাররিন আল-মুযানীও ছিলেন। তাঁরা বলেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমাদেরকে বাহন দিন। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁদেরকে বলেন: আল্লাহর শপথ, আমার কাছে কোনো বাহন নেই। তারা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যায়। তাদের জন্য জিহাদে না গিয়ে বসে থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তাদের (পথের) খরচও নেই আবার বাহনও নেই। আল্লাহ তা‘আলা যখন তাঁর প্রতি এবং তাঁর রাসূলের প্রতি তাদের ভালোবাসার আগ্রহ লক্ষ্য করেন তখন তাদের ওযর গ্রহণ করে আয়াত অবতীর্ণ করেন: لَّيۡسَ عَلَى ٱلضُّعَفَآءِ وَلَا عَلَى ٱلۡمَرۡضَىٰ “দুর্বলের উপর, পীড়িতের উপর কোনো অভিযোগ নেই” لَّيۡسَ عَلَى ٱلضُّعَفَآء “দুর্বলের উপর”فَهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ “তা তারা জানে না” এই পর্যন্ত।
মুজাহিদ রহ. وَلَا عَلَى ٱلَّذِينَ إِذَا مَآ أَتَوۡكَ لِتَحۡمِلَهُمۡ “তাদের বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ নেই, যারা তোমার কাছে যখন বাহন চাওয়ার জন্য এসেছিল” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: মুকাররিন ইবনু মুযায়নাহ গোত্রের ব্যাপারে (এ আয়াত) অবতীর্ণ হয়।
ইবনু আবু হাতিম বর্ণনা করেন, হাসান বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমরা মদিনায় একদল লোক ছেড়ে এসেছ, তোমরা যা কিছুই খরচ করেছ, যে কোনো উপত্যকা অতিক্রম করেছ আর শত্রুদের থেকে যে কোনো কষ্ট পেয়েছ তাতেই তারা তোমাদের সাথে সাওয়াবে শরীক হয়েছে। এরপর তিনি পাঠ করেন: وَلَا عَلَى ٱلَّذِينَ إِذَا مَآ أَتَوۡكَ لِتَحۡمِلَهُمۡ قُلۡتَ لَآ أَجِدُ مَآ أَحۡمِلُكُمۡ عَلَيۡهِ “তাদের বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ নেই যারা তোমার কাছে যখন বাহন চাওয়ার জন্য এসেছিল তখন তুমি বলেছিলে, ‘আমি তো তোমাদের জন্য কোন বাহন পাচ্ছি না’।”
মুল হাদিসটি সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মদিনায় একদল লোক রয়েছে, তোমরা যে উপত্যকাই অতিক্রম করেছ, সম্মুখে অগ্রসর হয়েছ তাতেই তারা তোমাদের সাথে রয়েছে। সাহাবীগণ বলেন: তারা মদিনাতে থেকেই? তিনি বলেন: হাঁ, তাদের ওযর তাদেরকে আটকে দিয়েছে। আর ধনী হওয়া সত্ত্বেও যারা জিহাদে না গিয়ে বসে থাকার অনুমতি চেয়েছে আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি তিরস্কার করেছেন। আর তাদের ভর্ৎসনা করেছেন পেছনে থেকে যাওয়াতে খুশি হওয়ায় নারীদের সাথে যারা তাদের বাড়িঘরে বসে থাকে।
وَطَبَعَ ٱللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ فَهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ “আল্লাহ তাদের হৃদয়কে সীল করে দিয়েছেন আর এ জন্য যে, (কিসে নিজেদের কল্যাণ আছে আর কিসে অকল্যাণ) তা তারা জানে না।”
﴿يَعۡتَذِرُونَ إِلَيۡكُمۡ إِذَا رَجَعۡتُمۡ إِلَيۡهِمۡۚ قُل لَّا تَعۡتَذِرُواْ لَن نُّؤۡمِنَ لَكُمۡ قَدۡ نَبَّأَنَا ٱللَّهُ مِنۡ أَخۡبَارِكُمۡۚ وَسَيَرَى ٱللَّهُ عَمَلَكُمۡ وَرَسُولُهُۥ ثُمَّ تُرَدُّونَ إِلَىٰ عَٰلِمِ ٱلۡغَيۡبِ وَٱلشَّهَٰدَةِ فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ ٩٤ سَيَحۡلِفُونَ بِٱللَّهِ لَكُمۡ إِذَا ٱنقَلَبۡتُمۡ إِلَيۡهِمۡ لِتُعۡرِضُواْ عَنۡهُمۡۖ فَأَعۡرِضُواْ عَنۡهُمۡۖ إِنَّهُمۡ رِجۡسٞۖ وَمَأۡوَىٰهُمۡ جَهَنَّمُ جَزَآءَۢ بِمَا كَانُواْ يَكۡسِبُونَ ٩٥ يَحۡلِفُونَ لَكُمۡ لِتَرۡضَوۡاْ عَنۡهُمۡۖ فَإِن تَرۡضَوۡاْ عَنۡهُمۡ فَإِنَّ ٱللَّهَ لَا يَرۡضَىٰ عَنِ ٱلۡقَوۡمِ ٱلۡفَٰسِقِينَ ٩٦﴾ [التوبة: ٩٤،  ٩٦]
“৯৪. তারা তোমাদের নিকট ওযর পেশ করবে যখন তোমরা তাদের কাছে ফিরে যাবে। বল, ‘তোমরা ওযর পেশ করো না, আমরা তোমাদেরকে কখনো বিশ্বাস করব না। অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের খবর আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহ তোমাদের আমল দেখবেন এবং তাঁর রাসূলও। তারপর তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে গায়েব ও প্রকাশ্যের জ্ঞানীর নিকট। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে যা তোমরা আমল করতে সে সম্পর্কে জানিয়ে দেবেন’। ৯৫. যখন তোমরা তাদের কাছে ফিরে যাবে, তখন অচিরেই তোমাদের কাছে আল্লাহর নামে শপথ করবে, যাতে তোমরা তাদেরকে উপেক্ষা কর। সুতরাং তোমরা তাদেরকে উপক্ষো কর। নিশ্চয় তারা অপবিত্র এবং জাহান্নাম হল তাদের আশ্রয়স্থল। তারা যা অর্জন করত, তার প্রতিফলস্বরূপ। ৯৬. তারা শপথ করবে তোমাদের নিকট, যাতে তোমরা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হও। অতএব তোমরা যদিও তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হও, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ফাসিক কওমের প্রতি সন্তুষ্ট হন না।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৯৪-৯৬]
মুনাফিকদের চক্রান্তের বর্ণনা :
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে মুমিনগণ যখন মদিনায় ফিরে আসে তখন মুনাফিকরা মুমিনদের নিকট ওযর পেশ করতে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে বলেন ‘বলূন তোমরা ওযর পেশ করো না আমরা কখনই তোমাদেরকে বিশ্বাস করি না।’ অর্থাৎ তোমাদেরকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করি না। (আল্লাহ তোমাদের খবর আমাদের কাছে জানিয়ে দিয়েছেন) অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের অবস্থাদি আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন (অচিরেই আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূল তোমাদের কর্মসমূহ প্রত্যক্ষ করবেন)। অর্থাৎ পৃথিবীতে লোকদের কাছে তোমাদের কর্মসমূহ প্রকাশ করে দিবেন।
 فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ“তোমাদেরকে তোমাদের সৎকর্ম ও মন্দ কর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন ও এর ভিত্তিতে তোমাদের প্রতিফল দিবেন।” অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের (মুনাফিকদের) সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে, অচিরেই তারা ওযর পেশের জন্য তোমাদের সাথে শপথ করবে যাতে তোমরা তাদের পরিহার কর কাজেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্যস্বরূপ তাদেরকে উপেক্ষা কর। নিঃসন্দেহে তারা অপবিত্র। অপবিত্র তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয় ও আক্বীদা-বিশ্বাস। তারা যা উপার্জন করেছিল প্রতিফল হিসাবে, পরকালে তাদের ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম। অর্থাৎ গুনাহ ও দোষত্রুটির কারণে।
ٱلۡفَٰسِقِينَ  অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য থেকে বের হয়ে গেছে। কেননা فسق বলা হয়, বের হয়ে যাওয়াকে। যেমন ইঁদুরকে فويسقة বলা হয় ফাসাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তার গর্ত থেকে বের হওয়ার জন্য।
 
﴿ٱلۡأَعۡرَابُ أَشَدُّ كُفۡرٗا وَنِفَاقٗا وَأَجۡدَرُ أَلَّا يَعۡلَمُواْ حُدُودَ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِۦۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ٩٧ وَمِنَ ٱلۡأَعۡرَابِ مَن يَتَّخِذُ مَا يُنفِقُ مَغۡرَمٗا وَيَتَرَبَّصُ بِكُمُ ٱلدَّوَآئِرَۚ عَلَيۡهِمۡ دَآئِرَةُ ٱلسَّوۡءِۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٞ ٩٨ وَمِنَ ٱلۡأَعۡرَابِ مَن يُؤۡمِنُ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَيَتَّخِذُ مَا يُنفِقُ قُرُبَٰتٍ عِندَ ٱللَّهِ وَصَلَوَٰتِ ٱلرَّسُولِۚ أَلَآ إِنَّهَا قُرۡبَةٞ لَّهُمۡۚ سَيُدۡخِلُهُمُ ٱللَّهُ فِي رَحۡمَتِهِۦٓۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٩٩﴾ [التوبة: ٩٧،  ٩٩]
“৯৭. বেদুঈনরা কুফর ও কপটতায় কঠিনতর এবং আল্লাহ তাঁর রাসূলের উপর যা নাযিল করেছেন তার সীমারেখা না জানার অধিক উপযোগী। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। ৯৮. আর বেদুঈনদের কেউ কেউ যা (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে, তা জরিমানা গণ্য করে এবং তোমাদের দুর্বিপাকের প্রতীক্ষায় থাকে। দুর্বিপাক তাদের উপরই এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী। ৯৯. আর বেদুঈনদের কেউ কেউ আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে এবং যা ব্যয় করে তাকে আল্লাহর নিকট নৈকট্য ও রাসূলের দো’আর উপায় হিসেবে গণ্য করে। জেনে রাখ, নিশ্চয় তা তাদের জন্য নৈকট্যের মাধ্যম। অচিরেই আল্লাহ তাদেরকে তাঁর রহমতে প্রবেশ করাবেন। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৯৭-৯৯]
বেদুঈন লোকেরা কুফুরী ও কপটতার দিক থেকে অধিক কঠোর:
আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেন যে, মরুবাসীদের মধ্যে রয়েছে কাফের, মুনাফিক ও মু’মিন। তবে তাদের (মরুবাসী লোকদের) কুফুরী ও কপটতা অন্যদের চেয়ে ব্যাপক, কঠিন ও অধিক উপযোগী। অর্থাৎ তারা আল্লাহ তাঁর রাসূলের উপর যা অবতীর্ণ করেছেন তার সীমা না জানার ব্যাপারে অধিকতর যোগ্য। যেমন আ‘মাশ ইব্রাহীম থেকে বর্ণনা করেন যে, জনৈক বেদুঈন যায়েদ বিন সওহান-এর নিকট উপবিষ্ট ছিল। তিনি (যায়েদ) তাঁর সাথীদের সাথে কথা বলছিলেন আর তিনি ‘নাহাওয়ান্দ’-এর যুদ্ধে তাঁর হাত হারান (কেটে বিচ্ছিন্ন হয়)। গ্রাম্য লোকটি বলল: আল্লাহর শপথ তোমার কথা আমাকে চমৎকৃত করেছে। আর তোমার হাত আমাকে সন্দেহে ফেলেছে। যায়েদ বললেন: তুমি আমার হাতের ব্যাপারে সন্দিহান কেন? মরুবাসী লোকটি বলল: আল্লাহর শপথ আমি জানি না কোনো হাতটি তারা কেটেছিল (চুরি অপরাধের জন্য) ডান হাত নাকি বা হাত? যায়েদ ইবন সওহান বললেন: আল্লাহ সত্যই বলেছেন: ٱلۡأَعۡرَابُ أَشَدُّ كُفۡرٗا وَنِفَاقٗا وَأَجۡدَرُ أَلَّا يَعۡلَمُواْ حُدُودَ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ “বেদুঈনরা কুফর ও কপটতায় কঠিনতর এবং আল্লাহ তাঁর রাসূলের উপর যা নাযিল করেছেন তার সীমারেখা না জানার অধিক উপযোগী।”
ইমাম আহমাদ ইবনে আব্বাস থেকে তিনি (ইবনু আব্বাস) রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন: “যে মরু অঞ্চলে বাস করে সে হয় কঠোর, যে শিকারের পিছনে ছুটে সে হয় গাফেল আর যে বাদশাহর কাছে আসে সে ফিতনায় পড়ে”। আবু দাউদ, তিরমিযী এবং নাসাঈ বর্ণনা করেছেন। আর তিরমিযী হাদিসটিকে হাসান বলেছেন, (তা হচ্ছে) “জনৈক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কিছু উপঢৌকন দিলে তিনি বেদুঈনকে এর কয়েকগুণ প্রতিদান দিলেন, ফলে সে খুশি হল। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমার মনে হয় যেন আমি কোনো কুরাইশ, সাকাফী, আনসারী এবং দাওসি ছাড়া অন্য কারও থেকে উপঢৌকন গ্রহণ না করি।” কেননা তারা মক্কা, তায়েফ, মদিনা এবং ইয়ামেনে বাস করত। তারা মরুবাসীদের চেয়ে কোমল চরিত্রের অধিকারী। কেননা মরুবাসীদের স্বভাব প্রকৃতিতে রয়েছে রুক্ষতা।
وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ “আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়” ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে যে ঈমান ও জ্ঞান শিক্ষা লাভের অধিকার রাখে আর বান্দাদের মাঝে জ্ঞান, অজ্ঞতা, ঈমান, কুফরী এবং কপটতা বণ্টনের ক্ষেত্রে তিনি প্রজ্ঞার অধিকারী। তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা হেতু তিনি যা করেন সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন না।
আল্লাহ তা‘আলা আরও বর্ণনা করেন যে, তারা আল্লাহর রাস্তায় দানকে مَغۡرَمٗا জরিমানা, ক্ষতি মনে করে  وَيَتَرَبَّصُ بِكُمُ ٱلدَّوَآئِرَ “আর তোমাদের দুর্ঘটনা বা বিপদাপদের তারা প্রতিক্ষা করে।” বস্তুত: عَلَيۡهِمۡ دَآئِرَةُ ٱلسَّوۡءِۗ “উল্টো তাদের উপরই দুঃখ মসিবত আপতিত হয়।” আল্লাহ তার বান্দাদের অতিশয় দো’আ শ্রবণকারী আর কে সাহায্য পাওয়ার অধিকারী ও কে অপদস্থ হওয়ার যোগ্য সে সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা জ্ঞাত।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: এটা মরুবাসী লোকদের প্রশংসিত একটি অংশ। আর তারা ওরাই যারা আল্লাহর রাস্তায় যা খরচ করে তাকে তারা আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম মনে করে, যার দ্বারা তারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে থাকে। আর এর দ্বারা তারা তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের দো’আ কামনা করে থাকে। সত্যিই তা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম, জেনে রাখ নিশ্চয় তা তারা অর্জন করবে।
﴿وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلۡأَوَّلُونَ مِنَ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحۡسَٰنٖ رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُ وَأَعَدَّ لَهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي تَحۡتَهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۚ ذَٰلِكَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ ١٠٠﴾ [التوبة: ١٠٠]
“১০০. আর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে সুন্দরভাবে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাতসমূহ, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে। এটাই মহাসাফল্য।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১০০]
মুহাজির ও আনসার এবং পরম নিষ্ঠার সাথে যারা তাদের অনুসরণ করে তাদের মর্যাদা:
আল্লাহ তা‘আলা এ মর্মে সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি অগ্রবর্তী মুহাজির ও আনসারদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং পরম নিষ্ঠার সাথে তাঁদের যারা অনুসরণ করে তাদের প্রতিও। আর তারাও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি সন্তুষ্ট। তিনি তাদের জন্য নি‘আমত পূর্ণ চিরস্থায়ী জান্নাত তৈরি করেছেন।
শা’বি বলেন: অগ্রবর্তী ও প্রথম সারির মুহাজির ও আনসার তারাই যারা হুদাইবিয়ার বৎসরে বাই‘আতুর রিদওয়ানে অংশগ্রহণ করেছেন।
তবে আবু মুসা আশ‘আরী, সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব, মুহাম্মাদ ইবনু সীরিন, হাসান ও কাতাদা প্রমুখ বলেন: তাঁরা হচ্ছেন যারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে উভয় কিবলার দিকে মুখ করে সালাত আদায় করেছেন।
মহান আল্লাহ সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি অগ্রবর্তী ও প্রথম সারির মুহাজির ও আনসার এবং পরম নিষ্ঠার সাথে যারা তাদের অনুসরণ করেছে তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন। দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা তাদের সাথে শত্রুতা রাখে অথবা তাদেরকে গালি দেয়। বিশেষত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর সাহাবাগণের নেতা ও তাঁদের মাঝে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে মর্যাদাবান আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে। কারণ নিকৃষ্ট লাঞ্ছিত শিয়া রাফেযীরা এ সর্বোত্তম সাহাবীদের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে। তাদেরকে ঘৃণা করে এবং গালি দেয়। (আল্লাহর নিকট আমরা এমন কাজ থেকে আশ্রয় চাই)। এতে প্রমাণিত হয় তাদের জ্ঞান বুদ্ধি বাঁকা ও অন্তরসমূহ উল্টা। কোথায় তাদের কুরআনের প্রতি ঈমান, যখন তারা তাদেরকে গালমন্দ করে যাদের ব্যাপারে আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন? আর (আহলে সুন্নাহ) সুন্নাতের অনুসারীগণ তাদের উপর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন যাদের উপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সন্তুষ্ট হয়েছেন। তাদেরকে তিরস্কার করে যাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তিরস্কার করেছেন, তার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে আল্লাহ যার বন্ধু হন। আর তার সাথে শত্রুতা পোষণ করে যার সাথে রয়েছে আল্লাহর শত্রুতা। এরাই প্রকৃত অনুসারী, বিদ‘আতি নয়। এরাই সুন্নাহর আনুগত্য করে আর নিজেরা তা বানিয়ে নেয় না আর এরাই সফলতা অর্জনকারী আল্লাহর দল আর তার বিশ্বাসী বান্দা।
﴿وَمِمَّنۡ حَوۡلَكُم مِّنَ ٱلۡأَعۡرَابِ مُنَٰفِقُونَۖ وَمِنۡ أَهۡلِ ٱلۡمَدِينَةِ مَرَدُواْ عَلَى ٱلنِّفَاقِ لَا تَعۡلَمُهُمۡۖ نَحۡنُ نَعۡلَمُهُمۡۚ سَنُعَذِّبُهُم مَّرَّتَيۡنِ ثُمَّ يُرَدُّونَ إِلَىٰ عَذَابٍ عَظِيمٖ ١٠١﴾ [التوبة: ١٠١]  
“১০১. আর তোমাদের আশপাশের মরুবাসীদের মধ্যে কিছু লোক মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও কিছু লোক অতিমাত্রায় মুনাফিকীতে লিপ্ত আছে। তুমি তাদেরকে জান না। আমি তাদেরকে জানি। অচিরেই আমি তাদেরকে দু’বার আযাব দেব। তারপর তাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে মহা ‘আযাবের দিকে।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১০১]
মদিনার আশে পাশে রয়েছে মুনাফিক, যার উপর তারা নিরবচ্ছিন্ন রয়েছে। বলা হয়ে থাকে شيطان مريد “অবাধ্য শয়তান।” বলা হয় تمرد فلان “জনৈক ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্য হয়েছে” অর্থাৎ উদ্ধত হয়েছে। আল্লাহর বাণীلَا تَعۡلَمُهُمۡۖ نَحۡنُ نَعۡلَمُهُمۡۚ “তুমি তাদেরকে জান না। আমি তাদেরকে জানি” এই আয়াতটি ﴿وَلَوۡ نَشَآءُ لَأَرَيۡنَٰكَهُمۡ فَلَعَرَفۡتَهُم بِسِيمَٰهُمۡۚ ٣٠﴾ (محمد: ٣٠) এ আয়াতকে রহিত করে না। কেননা, এটা তাদের স্বরূপ পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে যে, তাদের মাঝে এমন কিছু গুণাগুণ রয়েছে যার দ্বারা তাদেরকে চেনা যায়। এটা নয় যে, রাসূলের নিকট যত কপট ও সংশয়কারী রয়েছে তাদের সকলকেই নির্দিষ্টভাবে তিনি চিনবেন। অবশ্য কিছুসংখ্যক মদীনাবাসীদের তিনি চিনতেন, যারা তাঁর সাথে কপটতা নিয়ে মিশত এবং তিনি তাদেরকে সকাল সন্ধ্যায় দেখতেন। আর এ বিষয়টি ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ১৪ অথবা ১৫ জন মুনাফিক নেতৃবৃন্দের সম্পর্কে অবহিত করেন। আর এই নির্দিষ্টকরণ দাবি রাখে না যে, তিনি তাদের সকলের নাম ও তাদের নেতৃবৃন্দের সম্পর্কে অবগত ছিলেন।
আব্দুর রাযযাক বলেন: মা‘মার কাতাদা থেকে এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: ঐ সম্প্রদায়ের কী হল যারা লোকদের সম্পর্কে জ্ঞানের দাবি করে যে, অমুক জান্নাতে আর অমুক জাহান্নামে; যখন তাদেরকে কাউকে তার নিজের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তখন সে বলে: আমি জানি না (আমার শেষ পরিণতি কী?) তুমি তোমার নিজের সম্পর্কে অন্যদের চেয়ে বেশি অবগত। তোমরা নিজেদের উপর এমন কিছু বিষয়ের দায়িত্ব চাপিয়ে নিয়েছ যা ইতোপূর্বে নবীগণও করেন নি।
মুজাহিদ রহ. سَنُعَذِّبُهُم مَّرَّتَيۡنِ “অচিরেই আমি তাদেরকে দু’বার আযাব দেব” আয়াত সম্পর্কে বলেন: অর্থাৎ হত্যা ও বন্দী। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে-ক্ষুধা ও কবরের আযাব। হাসান বসরী রহ. বলেন, দুনিয়ার শাস্তি ও কবরের শাস্তি। ثُمَّ يُرَدُّونَ إِلَىٰ عَذَابٍ عَظِيمٖ “তারপর তাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে মহা ‘আযাবের দিকে।” আব্দুর রহমান ইবনু যায়িদ বলেন: দুনিয়াবি শাস্তি হচ্ছে সন্তান-সন্ততি ও ধনসম্পদ। আর তিনি তিলাওয়াত করলেন: . فَلَا تُعۡجِبۡكَ أَمۡوَٰلُهُمۡ وَلَآ أَوۡلَٰدُهُمۡۚ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُعَذِّبَهُم بِهَا فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا “কাজেই তাদের ধন-সম্পত্তি আর সন্তান-সন্ততি যেন তোমার চোখ ধাঁদিয়ে না দেয়, ওসব দিয়েই আল্লাহ দুনিয়াতে ওদেরকে শাস্তি দিতে চান।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৫৫]
এই বিপদাপদগুলো তাদের (মুনাফিক)-দের জন্য দুনিয়াতে আযাবস্বরূপ আর সেটা মুমিনদের জন্য পুরষ্কার। আর পরকালের শাস্তি (মুনাফিকদের জন্য) হচ্ছে জাহান্নাম। (আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই)। ثُمَّ يُرَدُّونَ إِلَىٰ عَذَابٍ عَظِيمٖ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন: এ হল জাহান্নাম।
﴿وَءَاخَرُونَ ٱعۡتَرَفُواْ بِذُنُوبِهِمۡ خَلَطُواْ عَمَلٗا صَٰلِحٗا وَءَاخَرَ سَيِّئًا عَسَى ٱللَّهُ أَن يَتُوبَ عَلَيۡهِمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٌ ١٠٢﴾ [التوبة: ١٠٢]
“১০২. আর আরেকদল তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে, সৎকর্মের সঙ্গে তারা অসৎকর্মের মিশ্রণ ঘটিয়েছে। আশা করা যায়, আল্লাহ তাদের তাওবা কবূল করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা তাওবাহ: ১০২]
অলসতাবশত: যে সকল মু’মিন জিহাদ থেকে পেছনে পড়ে রয়েছে:
ইতোপূর্বে আল্লাহ তা‘আলা ঐ সমস্ত মুনাফিকদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, যারা অনাগ্রহ, মিথ্যা সাব্যস্তকরণ ও সন্দেহে জিহাদ থেকে পেছনে পড়ে রয়েছিল। এখন ঐ সমস্ত গোনাহগার মুমিনদের সম্পর্কে আলোচনা শুরু করছেন, যারা মু’মিন এবং সত্যকে সত্য বলে স্বীকৃতি দান সত্ত্বেও নিছক অলসতা ও আরামপ্রিয়তার কারণে জিহাদ থেকে পেছনে পড়ে রয়েছিল।
তারা তাদের গোনাহসমূহ স্বীকার করেছে। আর যা তাদের ও তাদের রবের মাঝে রয়েছে তা মেনে নিয়েছে। অবশ্য তাদের অন্যান্য সৎ আমল রয়েছে এগুলোকে তাদের ঐ সমস্ত গোনাহসমূহে মিশ্রিত করেছে অতএব এরা আল্লাহর ক্ষমা ও মার্জনার অধীনে। যদিও এ আয়াতটি কতিপয় নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়েছে; কিন্তু তা প্রত্যেক গোনাহগার, অপরাধী, যারা তাদের ভালো আমলকে মন্দ আমলের সাথে মিশ্রিত করে ফেলেছে তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
ইবনু আব্বাস বলেন: وَءَاخَرُونَ আয়াতটি আবু লুবাবা ও একদল সাহাবীর ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়, যারা তাবুক যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অংশগ্রহণ করে নি। কেউ কেউ বলেন: আবু লুবাবা এবং তার সাথে পাঁচজন। কেউ বলেন: তার সাথে সাতজন। কেউ বলেন: তার সাথে নয় জন। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অভিযান থেকে ফিরে আসলেন। তারা নিজেদেরকে মসজিদের খুঁটির সাথে বাঁধলেন এবং শপথ করলেন যে, একমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া তাদেরকে কেউ এখান থেকে মুক্ত করবে না। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা যখন এ আয়াত অবতীর্ণ করেন وَءَاخَرُونَ ٱعۡتَرَفُواْ بِذُنُوبِهِمۡ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে ছেড়ে দিলেন আর তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। ইমাম বুখারী সামুরাহ ইবন জুনদুব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: গত রাত্রিতে দু’জন আগন্তুক আমার নিকট আগমন করে আর আমাকে এমন একটি নগরীতে নিয়ে যায়, যা এমনভাবে নির্মিত যে, যার একটি ইট স্বর্ণের এবং আরেকটি ইট রৌপ্যের। অতঃপর আমাদের সাথে এমন একদল লোকের দেখা হল যাদের (দেহের) এক অংশ এত সুন্দর যে, এমন সুন্দর তুমি কখনই অবলোকন কর নি আর অপর অংশ এত কুৎসিত যে, এমন কুৎসিত তুমি কখনই দেখ নি। তারা দু’জন বললেন: তোমরা যাও এবং ঐ দরিয়ায় ডুব দাও। তারা তাতে ডুব দিল, অতঃপর আমাদের নিকট ফিরে এলো আর তাদের থেকে সেই কুৎসিত রূপ দূর হয়ে গেল। এরপর তারা সুন্দর আকৃতিবিশিষ্ট হয়ে গেল। তারা দু’জন বলল: এটা হচ্ছে জান্নাতে ‘আদন আর এটা আপনার বাসস্থান। তারা বলল: আর এরা যাদের অর্ধাঙ্গ সুন্দর আর অর্ধাঙ্গ কুৎসিত এরা ওরাই যারা তাদের সৎকর্মকে মন্দ কর্মের সাথে মিশ্রিত করেছিল। আল্লাহ তাদের দোষসমূহ উপেক্ষা করেছেন। এভাবে বুখারী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় এভাবে বর্ণনা করেছেন।
﴿خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ تُطَهِّرُهُمۡ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيۡهِمۡۖ إِنَّ صَلَوٰتَكَ سَكَنٞ لَّهُمۡۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ١٠٣ أَلَمۡ يَعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ هُوَ يَقۡبَلُ ٱلتَّوۡبَةَ عَنۡ عِبَادِهِۦ وَيَأۡخُذُ ٱلصَّدَقَٰتِ وَأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ١٠٤ ﴾ [التوبة: ١٠٣،  ١٠٤]
“১০৩.তাদের সম্পদ থেকে সদাকা নাও। এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে। আর তাদের জন্য দো’আ কর, নিশ্চয় তোমার দো’আ তাদের জন্য প্রশান্তিকর। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। ১০৪. তারা কি জানে না যে, নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের তাওবা কবূল করেন এবং সদকা গ্রহণ করেন। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাওবা কবূলকারী, পরম দয়ালু।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১০৩-১০৪]
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তিনি মুসলিমগণের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করবেন, যার দ্বারা তাদেরকে পবিত্র করবেন। এ আয়াতটি সাধারণভাবে অবতীর্ণ হয়েছে যদিও কেউ কেউ أموالهم এর هم কে তাদের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করেছে, যারা তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে, যারা তাদের সৎ আমলের সাথে মন্দ কর্মসমূহকে মিশ্রিত করেছে। এ কারণে আরবের কতিপয় গোত্র যারা যাকাত প্রদানে বিরত ছিল তাদের বিশ্বাস যে, ইমামের নিকট যাকাত প্রদানের বিধান এখন আর নেই; বরং তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সম্পৃক্ত ছিল। এ কারণে তারা خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ  এ আয়াত দ্বারা দলিল দিয়ে থাকে। আবু বাকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ও সকল সাহাবিগণ তাদের এই ভুল ব্যাখ্যা ও অনুধাবন প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর তাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন অবশেষে তারা খলীফার নিকট যাকাত প্রদান করে, যা তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দিত। এমনকি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আল্লাহর শপথ, তারা যদি আমাকে একটি রশিও দিতে অস্বীকার করে যা তারা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দিত, তাহলে তাদের এই যাকাত প্রদান না করার কারণে অবশ্যই আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করব।
وصل عليه “তাদের জন্য দু’আ করুন আর তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।” যেমন ইমাম মুসলিম তার ‘সহীহ মুসলিমে’ আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আউফা থেকে বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যখন কোনো গোত্রের সদকা নিয়ে আসা হত তখন তিনি তাদের জন্য দো’আ করতেন। আমার পিতা তার নিকট তার সদকা নিয়ে আসলেন ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘হে আল্লাহ! আপনি আবু আউফার উপর রহমত বর্ষণ করুন।’ আল্লাহর বাণী إن صلاتك অপর এক কিরাআতে রয়েছে صلواتك বহুবচনরূপে। অন্যান্যরা পড়েছেন إن صلوتك একবচনরূপে। إِنَّ صَلَوٰتَكَ سَكَنٞ لَّهُمۡۗ ইবনে আব্বাস বলেন: “তাদের জন্য রহমতস্বরূপ।” আল্লাহ তা‘আলার বাণী وَٱللَّهُ سَمِيعٌ অর্থাৎ আপনার দো’আর জন্য অত্যাধিক শ্রবণকারী عَلِيمٌ অর্থাৎ যে আপনার দো’আ পাওয়ার অধিকারী তার সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: أَلَمۡ يَعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ هُوَ يَقۡبَلُ ٱلتَّوۡبَةَ عَنۡ عِبَادِهِۦ وَيَأۡخُذُ ٱلصَّدَقَٰتِ “তারা কি জানে না যে, নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের তাওবা কবূল করেন এবং সদকা গ্রহণ করেন।” এটা তাদেরকে তাওবা ও সদকার প্রতি প্রেরণা দানস্বরূপ বলা হয়েছে যে, এ দুটো (তাওবা ও সদকা) গোনাহকে মিটিয়ে দেয় আর তা নিশ্চিহ্ন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: যে ব্যক্তি তাঁর নিকট তাওবা করে তিনি তার তাওবা কবুল করেন। আর যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে দান-সদকা করে, আল্লাহ তা‘আলা তার ডান হাত দ্বারা তা কবুল করে থাকেন অতঃপর সেটা সেই সদকাকারীর জন্য বৃদ্ধি করতে থাকেন। অবশেষে তা থেকে একটি খেজুর সদৃশ জিনিস উহুদ পাহাড় পরিমাণ বৃদ্ধি হয়ে থাকে। যেমন এ সম্পর্কে আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদিস এসেছে তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সদকা কবুল করেন আর তা তিনি তাঁর ডান হাতে গ্রহণ করেন অতঃপর সেটা তোমাদের কারও জন্য বৃদ্ধি করতে থাকেন যেমন ভাবে তোমাদের কেউ তার অশ্বসাবককে লালন পালন করে। অবশেষে সামান্য একটি লোকমা ওহুদ পাহাড় পরিমাণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এ বিষয়টির প্রমাণস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা বলেন: أَلَمۡ يَعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ هُوَ يَقۡبَلُ ٱلتَّوۡبَةَ عَنۡ عِبَادِهِۦ وَيَأۡخُذُ ٱلصَّدَقَٰتِ “তারা কি জানে না যে, নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের তাওবা কবূল করেন এবং সদাকা গ্রহণ করেন।” আর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নিশ্চয় সদকা তার যাচ্ঞাকারীর নিকট পৌঁছার পূর্বে আল্লাহর নিকট পৌঁছে থাকে। এরপর তিনি নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেন।
﴿وَقُلِ ٱعۡمَلُواْ فَسَيَرَى ٱللَّهُ عَمَلَكُمۡ وَرَسُولُهُۥ وَٱلۡمُؤۡمِنُونَۖ وَسَتُرَدُّونَ إِلَىٰ عَٰلِمِ ٱلۡغَيۡبِ وَٱلشَّهَٰدَةِ فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ ١٠٥ ﴾ [التوبة: ١٠٥]
“১০৫. আর বল, তোমরা আমল কর। অতএব, অচিরেই আল্লাহ তোমাদের আমল দেখবেন, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণও। আর অচিরেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে গায়েব ও প্রকাশ্যের জ্ঞানীর নিকট। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জানাবেন যা তোমরা আমল করতে সে সম্পর্কে।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১০৫]
পাপিষ্ঠদের প্রতি হুমকি:
মুজাহিদ বলেন: এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তার নির্দেশের বিরুদ্ধাচারীদের প্রতি ভীতিপ্রদর্শনস্বরূপ বলা হচ্ছে যে, অবশ্যই তাদের কর্মসমূহ আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণের নিকট উত্থাপিত হবে। কিয়ামতের দিন এটা অবশ্যই হবে। যেমন তিনি বলেন: ﴿يَوۡمَئِذٖ تُعۡرَضُونَ لَا تَخۡفَىٰ مِنكُمۡ خَافِيَةٞ ١٨﴾ [الحاقة: ١٨] তিনি আরও বলেন: ﴿يَوۡمَ تُبۡلَى ٱلسَّرَآئِرُ ٩﴾ [الطارق: ٩] তিনি আরও বলেন: ﴿وَحُصِّلَ مَا فِي ٱلصُّدُورِ ١٠﴾ [العاديات: ١٠]  আর সেটা আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে লোকদের জন্য তা প্রকাশ করে দিবেন।
ইমাম বুখারি রহ. বলেন: মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: কোনো ব্যক্তির সৎ আমল যদি তোমাকে চমৎকৃত করে তবে তুমি বল: وَقُلِ ٱعۡمَلُواْ فَسَيَرَى ٱللَّهُ عَمَلَكُمۡ وَرَسُولُهُۥ وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ হাদিস শরীফে এরূপ একটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম আহমাদ আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমাদের উপর এমনটি নয় যে, তোমরা কারো (আমলের) দ্বারা আশ্চর্যান্বিত হবে না, তবে সে যেন দেখে নেয় কিসের দ্বারা ঐ ব্যক্তির (আমল) শেষ হচ্ছে। কেননা ঐ ব্যক্তি তার জীবনের কোনো এক সময়ে সৎ ‘আমল করতে থাকে। যদি সে এরই উপর মৃত্যুবরণ করে তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে; কিন্তু কখনও তার পরিবর্তন ঘটে যায় ফলে মন্দ-কর্ম করতে থাকে।
অনুরূপভাবে কোনো ব্যক্তি তার জীবনের কোনো এক সময় অসৎ আমল করতে থাকে যদি সে এরই উপর মৃত্যুবরণ করে তবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আবার দেখা যায় তার পরিবর্তন ঘটে ফলে সৎকর্ম করতে থাকে। যখন আল্লাহ তা‘আলা তার কোনো বান্দার কল্যাণ চান তার মৃত্যুর পূর্বে সে অনুযায়ী তার দ্বারা আমল করিয়ে নেন। সাহাবীরা প্রশ্ন করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! কীভাবে তার দ্বারা আমল করিয়ে নেন। তিনি বললেন: তাকে সৎকর্ম করার সামর্থ্য দান করেন। অতঃপর এরই উপর তার মৃত্যু ঘটান। এ হাদিসটি শুধুমাত্র ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেছেন।
﴿وَءَاخَرُونَ مُرۡجَوۡنَ لِأَمۡرِ ٱللَّهِ إِمَّا يُعَذِّبُهُمۡ وَإِمَّا يَتُوبُ عَلَيۡهِمۡۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ١٠٦﴾ [التوبة: ١٠٦]  
“১০৬. আর আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় অপর কিছু লোকের সিদ্ধান্ত পিছিয়ে দেওয়া হলো। তিনি তাদেরকে ‘আযাব দেবেন নয়তো তাদের তাওবা কবূল করবেন। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১০৬]
তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা তিন সাহাবীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বিলম্বিত করা:
ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, ইকরিমা, যাহ্হাক প্রমুখ থেকে বর্ণিত: ওরা তিন ব্যক্তি যারা বিলম্বে তাওবাহ করেছে। তারা হচ্ছে মুরারা ইবনু রবী‘, কা‘ব ইবনু মালেক এবং হিলাল ইবনু উমাইয়া। তারা তাবুক যুদ্ধে গমন করা থেকে ঐ সমস্ত লোকদের সাথে বসে ছিল যারা নিছক অলসতা, জানের হিফাযাত, উৎকৃষ্ট ফলফুল লাভ, গোমরাহি ও আরাম আয়েশের টানে তাবুক যুদ্ধে গমন করা থেকে বসে রয়েছিল। দীনের প্রতি সন্দেহ ও কপটতার কারণে নয়। তাদের মাঝে একটি দল ছিল যারা নিজেদেরকে খুঁটির সাথে বেঁধেছিল। যেমন আবু লুবাবা ও তাঁর সাথিরা। অপর একটি দল যারা তা করে নি। আর তারা হচ্ছে উল্লিখিত তিন ব্যক্তি। এদের পূর্বে আবু লুবাবা ও তাঁর সাথিদের তাওবার ব্যাপারে আয়াত অবতীর্ণ হয়। ﴿لَّقَد تَّابَ ٱللَّهُ عَلَى ٱلنَّبِيِّ وَٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ﴾ (التوبة: ١١٧)   অবশেষে অবতীর্ণ হয় ﴿وَعَلَى ٱلثَّلَٰثَةِ ٱلَّذِينَ خُلِّفُواْ﴾ [التوبة: ١١٨] -যার বর্ণনা অচিরেই কা‘ব ইবনে মালেকের হাদিসে আলোচনা করা হবে। আর আল্লাহর বাণী إِمَّا يُعَذِّبُهُمْ وَإِمَّا يَتُوبَ عَلَيْهِمْ তারা আল্লাহর ক্ষমার অধীন, চাইলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের সাথে এরূপ এরূপ আচরণ করবেন আর চাইলে এরূপ এরূপ আচরণ করবেন। তবে আল্লাহ তা‘আলার রহমত তার ক্রোধের উপর বিজয়ী। وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ “কে শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত আর কে ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা সম্যক অবগত। প্রজ্ঞাময় তিনি তার কথা ও কর্মসমূহে।” তিনি ছাড়া প্রকৃত কোন উপাস্য নেই, তিনি ছাড়া কোনো রব নেই।
﴿وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مَسۡجِدٗا ضِرَارٗا وَكُفۡرٗا وَتَفۡرِيقَۢا بَيۡنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَإِرۡصَادٗا لِّمَنۡ حَارَبَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ مِن قَبۡلُۚ وَلَيَحۡلِفُنَّ إِنۡ أَرَدۡنَآ إِلَّا ٱلۡحُسۡنَىٰۖ وَٱللَّهُ يَشۡهَدُ إِنَّهُمۡ لَكَٰذِبُونَ ١٠٧ لَا تَقُمۡ فِيهِ أَبَدٗاۚ لَّمَسۡجِدٌ أُسِّسَ عَلَى ٱلتَّقۡوَىٰ مِنۡ أَوَّلِ يَوۡمٍ أَحَقُّ أَن تَقُومَ فِيهِۚ فِيهِ رِجَالٞ يُحِبُّونَ أَن يَتَطَهَّرُواْۚ وَٱللَّهُ يُحِبُّ ٱلۡمُطَّهِّرِينَ ١٠٨﴾ [التوبة: ١٠٧،  ١٠٨]
“১০৭. আর যারা মসজিদ বানিয়েছে ক্ষতিসাধন, কুফরী ও মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ইতোপূর্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যে লড়াই করেছে তার ঘাঁটি হিসেবে। আর তারা অবশ্যই শপথ করবে যে, ‘আমরা কেবল ভালো চেয়েছি’। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তারা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। ১০৮. তুমি সেখানে কখনো (সালাত কায়েম করতে) দাঁড়িও না। অবশ্যই যে মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকওয়ার উপর প্রথম দিন থেকে তা বেশি হকদার যে, তুমি সেখানে সালাত কায়েম করতে দাঁড়াবে। সেখানে এমন লোক আছে, যারা উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করতে ভালোবাসে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১০৭-১০৮]
মসজিদে দ্বিরার (ক্ষতিসাধণের উদ্দেশ্যে বানান মসজিদ) আর যে মসজিদ তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত:
অত্র আয়াতটির প্রেক্ষাপট:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমনের পূর্বে খাযরাজ গোত্রের ‘আবু আমের রাহেব’ নামক এক ব্যক্তি যে জাহেলী যুগে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করে আর তাদের ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে ধর্মযাজক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। খাযরাজ গোত্রে তার বড় মর্যাদা ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হিজরত করে মদিনায় আগমন করেন তখন মুসলিমগণ তার নিকট একত্রিত হন আর ইসলামের কালিমা সমুন্নত হয়। বদরের যুদ্ধে আল্লাহ তাদের বিজয় দান করেন। ফলে অভিশপ্ত আবু ‘আমেরের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে এবং সে ইসলামের বিরুদ্ধে তার শত্রুতা ঘোষণা করে। সে আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযোগিতার জন্য মক্কার কুরাইশ পৌত্তলিক কাফিরদের নিকট যায়। কুরাইশদের সম্মিলিত বাহিনী আর বেদুইনরা একত্রিত হয়ে ওহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এদিকে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমগণকে পরীক্ষা করেন। অবশ্য শেষ পরিণাম ফল আল্লাহ-ভীরুদের জন্য। এই পাপিষ্ঠ (আবু ‘আমের রাহেব) দুই শিবিরের মাঝে অনেকগুলো গর্ত খনন করে। তার কোনো একটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়ে যান। তাঁর মুখমণ্ডল জখম হয়, তাঁর নিচের পাটির ডান দিকের তৃতীয় দাঁতটি (রুবায়া) ভেঙ্গে যায় আর তিনি মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন। আবু ‘আমের লড়াইয়ের শুরুতে তার গোত্রের আনসারদের নিকট এসে তাদের সম্বোধন করে এবং তাকে সাহায্য ও তার সাথে একমত হওয়ার জন্য তাদেরকে বুঝাতে থাকে। যখন তারা তাকে চিনতে পারে তখন তারা বলে: ওহে আল্লাহর দুশমন, হে পাপিষ্ঠ তোর দর্শনের মাধ্যমে যেন আল্লাহ আমাদের চক্ষু শীতল না করেন। তারা তাকে ভর্ৎসনা করে। অবশেষে সে এ বলে চলে যায় যে, আল্লাহর শপথ আমার পরে আমার সম্প্রদায়কে অনিষ্ট পেয়ে বসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম তার চলে যাওয়ার পূর্বে তাকে ইসলামের দাওয়াত দেন আর কুরআন থেকে তিলাওয়াত করে শুনান। সে ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি আর ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উপর এ বলে বদ-দো’আ করেন যেন আল্লাহ তা‘আলা তাকে বিতাড়িত করে দূরবর্তী স্থানে তার মৃত্যু ঘটান। ফলে আবু ‘আমেরের উপর এ বদ-দো’আ পতিত হয়। আর তা এভাবে যে,
ওহুদ যুদ্ধ সমাপ্ত হল। আবু ‘আমের অনুধাবন করল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বদ-দো’আ ক্রমশ উচ্চ থেকে উচ্চতর হচ্ছে। সে রোমের বাদশাহ হিরাক্লিয়াসের নিকট গমন করে আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে সাহায্য প্রার্থনা করে। ফলে তার উপর হিরাক্লিয়াসের করুণা হয় আর তাকে ওয়াদা দেয় এবং তাকে তার নিকট আশ্রয় দেয়। আবু ‘আমের তার গোত্রের অর্থাৎ খাযরাজ গোত্রের কতিপয় কপট ও ইসলামের উপর সংশয়ী লোকদেরকে লিখে পাঠাল, তাদের সাথে অঙ্গিকার করল যে, শীঘ্রই সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করবে যারা তাঁর এবং তাঁর দো‘আর উপর বিজয় লাভ করবে। সে তাদেরকে নির্দেশ দিল যেন তারা একটি মজবুত স্থান তৈরি করে যেখানে সে তার গুপ্তচর পাঠাতে পারে এবং যেটি তার একটি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে সে পরবর্তীতে তাদের সাথে মিলিত হতে পারে। তারা কুবা মসজিদের পাশে একটি মসজিদ নির্মাণ করে। অবশেষে ঐ সকল মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাবুক যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই তার নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করে। অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসে এবং আবেদন জানায় যে, তিনি যেন তাদের নিকট আসেন আর তাদের মসজিদে সালাত আদায় করেন। যাতে তা তাদের এই মসজিদে তাদের সালাত আদায় করার সঠিকতার উপর প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। আর তারা জানায় যে, তারা এই মসজিদ তাদের মধ্যেকার দুর্বল লোক এবং রাতে বৃষ্টির কারণে আসতে না পারা লোকদের জন্য নির্মাণ করেছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ মসজিদে সালাত আদায় করা থেকে বাঁচান। তিনি বললেন: ‘আমরা তো এখন সফরে বের হয়েছি। আল্লাহ যদি চান তো ফিরে এসে’। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাবুক থেকে ফিরলেন আর তাঁর মদিনায় পৌঁছতে তখনও একদিন কি দিনের কিছু অংশ বাকি ছিল এমতাবস্থায় জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এ মর্মে তাঁর নিকট সংবাদ নিয়ে এলেন যে, এ মসজিদটি কুফুরির ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত আর তা ইসলামের ক্ষতি সাধন ও মুসলিমগণ “যারা কুবা মসজিদে সালাত আদায় করতেন যা প্রথম দিন থেকেই তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত, তাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যা নির্মিত হয়েছে।” ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় পৌঁছার পূর্বেই কতক সাহাবীকে পাঠালেন এ ‘মসজিদে দ্বিরার ভেঙ্গে ফেলার জন্য। যেমন আলী ইবনে আবু তালহা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: কতিপয় আনসার মসজিদ নির্মাণ করে। আবু ‘আমের তাদেরকে বলে: তোমরা মসজিদ নির্মাণ কর আর তোমরা তোমাদের সামর্থ্যানুযায়ী সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ কর। আমি রোমের বাদশাহ কায়সারের নিকট যাচ্ছি। অতঃপর তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে আমি আগমন করব এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও তার সাথীদের বের করে দিব। অতঃপর যখন তারা মসজিদ নির্মাণ সমাপ্ত করে তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলে: আমরা আমাদের মসজিদ নির্মাণ সমাপ্ত করেছি। আমরা এটা পছন্দ করি যে, আপনি তাতে সালাত আদায় করেন আর আমাদের জন্য বরকতের দো’আ করেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করেন: لَا تَقُمۡ فِيهِ أَبَدٗاۚ পর্যন্ত। আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَلَيَحۡلِفُنَّ  অর্থাৎ যারা মসজিদ নির্মাণ করেছে إِنۡ أَرَدۡنَآ إِلَّا ٱلۡحُسۡنَىٰۖ “আমরা এর নির্মাণ দ্বারা শুধু লোকদের কল্যাণ ও আরামই চেয়েছি।” আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন: (আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।) অর্থাৎ তারা যে ইচ্ছা ও সংকল্পের কথা ব্যক্ত করেছে তাতে; বরং তারা তো কেবল কুবা মসজিদের ক্ষতি সাধন, আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস, মু’মিনদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি আর ইতোপূর্বে যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তার ঘাঁটি বানানোর উদ্দেশ্যে তা নির্মাণ করেছে। আর ঐ ব্যক্তি হচ্ছে পাপিষ্ঠ আবু ‘আমের। তাকে বলা হয় ‘রাহিব’ তার উপর আল্লাহর অভিশাপ।
আর তাঁর বাণী  لَا تَقُمۡ فِيهِ أَبَدٗاۚ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার উম্মতকে সব সময়ের জন্য এ মাসজিদে সালাতে দণ্ডায়মান হতে নিষেধ করেছেন।
কুবা মসজিদ এবং এতে সালাত আদায়ের ফযিলত:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে কুবা মাসজিদে সালাত আদায়ের ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করছেন যা প্রথম দিন থেকেই তাকওয়ার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অনুগত হওয়া। মুমিনগণের বাণীকে সমুন্নত করার জন্য আর ইসলাম ও তার অনুসারীদের দুর্গ ও আশ্রয় শিবির হিসেবে। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَّمَسۡجِدٌ أُسِّسَ عَلَى ٱلتَّقۡوَىٰ مِنۡ أَوَّلِ يَوۡمٍ أَحَقُّ أَن تَقُومَ فِيهِۚ “এ প্রাচীন মসজিদ যা তার প্রথম নির্মাণ থেকেই এক আল্লাহ যার কোনো শরীক নেই তার ইবাদতের উপর প্রতিষ্ঠিত”-এর বর্ণনা প্রসঙ্গ কুবা মসজিদ সম্পর্কে। এ কারণে সহীহ হাদিসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: কুবা মাসজিদে সালাত আদায় একটি উমরার সমান (সাওয়াব)।
অপর একটি সহীহ রেওয়ায়াতে রয়েছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সওয়ার হয়ে ও পায়ে হেটে কুবা মাসজিদে যেতেন। সহীহ হাদিস এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তা নির্মাণ করেন আর তার আগমন ও বনী আমর ইবনে আউফ গোত্রে অবতরণের প্রাক্কালে তার ভিত্তি স্থাপন করেন তখন জিবরাঈল স্বয়ং তার কিবলা নির্ধারণ করে দেন।
ইমাম আহমাদ উওয়াইম ইবনে সা‘ইদাহ আল আনসারী থেকে, তিনি তাকে (এ) হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিকট মাসজিদে কুবায় আসলেন অতঃপর বললেন: আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের মসজিদের ঘটনা প্রসঙ্গে পবিত্রতার ক্ষেত্রে তোমাদের অত্যন্ত সুন্দর প্রশংসা করেছেন। কী সেই পবিত্রতা, যা তোমরা অর্জন কর? তারা বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর শপথ এ ব্যাপারে আমাদের তো কিছু জানা নেই তবে আমাদের পড়শি কিছু ইয়াহূদী ছিল তারা মলত্যাগের পর তাদের পশ্চাৎ দেশ ধৌত করত অতঃপর আমরাও ধৌত করি যেমন তারা ধৌত করত।
ইবনে খুযাইমা তার ‘সহীহ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন: আল্লাহ তা‘আলার বাণী: لَّمَسۡجِدٌ أُسِّسَ عَلَى ٱلتَّقۡوَىٰ مِنۡ أَوَّلِ يَوۡمٍ أَحَقُّ أَن تَقُومَ فِيهِۚ “এ প্রাচীন মসজিদ যা তার প্রথম নির্মাণ থেকেই এক আল্লাহ যার কোনো শরীক নেই তার ইবাদতের উপর প্রতিষ্ঠিত”- তাতে সালাত আদায় মুস্তাহাব হওয়ার উপর দলীল। এতে আরও দলীল রয়েছে সৎকর্মশীল, ইবাদাতকারী সুচারুরূপে ওযুকারী এবং ময়লা পোশাক থেকে সতর্কতা অর্জনকারীদের সাথে সালাত আদায় করা মুস্তাহাব হওয়ার ওপর।
ইমাম আহমাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জনৈক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে ফজরের সালাত আদায় করলেন অতঃপর সূরা রুম তিলাওয়াত করে তাতে (তিলাওয়াতে) ভুল করলেন। অতঃপর সালাত সমাপ্ত করে বললেন: আমরা কখনও তিলাওয়াতে ভুল করে থাকি, তোমাদের কতক লোক আমাদের সাথে সালাত আদায় করে; কিন্তু তারা সুচারুরূপে ওজু করে না। অতএব যারা আমাদের সাথে সালাত আদায় করে তারা যেন ভালভাবে ওজু করে। এ হাদিস প্রমাণ করে যে, পূর্ণাঙ্গরূপে পবিত্রতা অর্জন ইবাদতে দণ্ডায়মান হতে, তা সম্পন্ন করতে আর শরী‘আত সম্মতভাবে ইবাদত করতে সাহায্য করে।
আল্লাহর বাণী وَٱللَّهُ يُحِبُّ ٱلۡمُطَّهِّرِينَ “আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।” সম্পর্কে আবুল আলীয়া বলেন, পানি দিয়ে পবিত্রতা উত্তম, যাদের আল্লাহ ভালোবাসেন। তবে তারা হল যারা গুণাহ হতে পবিত্র। আর আ’মাশ বলেন, তারা হলেন যারা গুনাহ হতে তাওবা করেন এবং শির্ক হতে পবিত্র।
﴿أَفَمَنۡ أَسَّسَ بُنۡيَٰنَهُۥ عَلَىٰ تَقۡوَىٰ مِنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٍ خَيۡرٌ أَم مَّنۡ أَسَّسَ بُنۡيَٰنَهُۥ عَلَىٰ شَفَا جُرُفٍ هَارٖ فَٱنۡهَارَ بِهِۦ فِي نَارِ جَهَنَّمَۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ١٠٩ لَا يَزَالُ بُنۡيَٰنُهُمُ ٱلَّذِي بَنَوۡاْ رِيبَةٗ فِي قُلُوبِهِمۡ إِلَّآ أَن تَقَطَّعَ قُلُوبُهُمۡۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ ١١٠﴾ [التوبة: ١٠٩،  ١١٠]
“১০৯. যে তার গৃহের ভিত্তি আল্লাহর তাকওয়া ও সন্তুষ্টির উপর প্রতিষ্ঠা করল, সে কি উত্তম না ঐ ব্যক্তি, যে তার গৃহের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছে এক গর্তের পতনোন্মুখ কিনারায়? অতঃপর তাকে নিয়ে তা ধসে পড়ল জাহান্নামের আগুনে। আর আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না। ১১০. তাদের নির্মিত গৃহ, তাদের অন্তরে সন্দেহের কারণ হয়ে থাকবে, যে পর্যন্ত না তাদের হৃদয় টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১০৯-১১০]
দুই মসজিদের মাঝে পার্থক্য (মসজিদে দ্বিরার ও কুবা মসজিদ)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তারা সমান নয়, যে তার ইমারতের ভিত্তি স্থাপন করেছে আল্লাহভীতি ও তার সন্তুষ্টির উপর, আর যে তা নির্মাণ করেছে ক্ষতিসাধন, কুফরী, মুমিনগণের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি, আর যে ইতোপূর্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করেছে তার সীমান্ত ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে। তারা তো কেবল তাদের ইমারতের ভিত্তি স্থাপন করেছে কোনো গর্তের কিনারায়। উদাহরণস্বরূপ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ  “আল্লাহ তা‘আলা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের কর্মকে সংশোধন করেন না।” জাবের ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে যে মসজিদটি ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল তা থেকে আমি ধোঁয়া নির্গত হতে দেখেছি।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: رِيبَةٗفِي قُلُوبِهِم “সন্দেহ ও কপটতা বশতঃ তাদের অন্তরে।” তাদের এ জঘন্য কর্ম সম্পাদনের কারণে তারা উত্তরাধিকারসূত্রে কপটতা অর্জন করেছে যেভাবে গোবৎসের পূজারীরা গোবৎসপ্রীতির সুধা পান করেছিল। আল্লাহ তা‘আলার বাণী: إِلَّآ أَن تَقَطَّعَ قُلُوبُهُمۡۗ অর্থাৎ তাদের মৃত্যুর মাধ্যমে। যেমন ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, কাতাদা, যায়েদ ইবন আসলাম, সুদ্দী, হাবীব ইবনে আবী সাবেত, দাহ্হাক, আব্দুর রহমান ইবনু যায়েদ ইবনু আসলাম প্রমুখ সালাফ থেকে বর্ণিত হয়েছে। عَلِيمٌ “সর্বজ্ঞ” তার সৃষ্টিকুল সম্পর্কে। حَكِيمٌ “প্রজ্ঞাময়” ভালো-মন্দ বিনিময় প্রদানের ক্ষেত্রে।
﴿إِنَّ ٱللَّهَ ٱشۡتَرَىٰ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ أَنفُسَهُمۡ وَأَمۡوَٰلَهُم بِأَنَّ لَهُمُ ٱلۡجَنَّةَۚ يُقَٰتِلُونَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَيَقۡتُلُونَ وَيُقۡتَلُونَۖ وَعۡدًا عَلَيۡهِ حَقّٗا فِي ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَٱلۡإِنجِيلِ وَٱلۡقُرۡءَانِۚ وَمَنۡ أَوۡفَىٰ بِعَهۡدِهِۦ مِنَ ٱللَّهِۚ فَٱسۡتَبۡشِرُواْ بِبَيۡعِكُمُ ٱلَّذِي بَايَعۡتُم بِهِۦۚ وَذَٰلِكَ هُوَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ ١١١﴾ [التوبة: ١١١]  
“১১১. নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন (এর বিনিময়ে) যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। অতএব তারা মারে ও মরে। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে এ সম্পর্কে সত্য ওয়াদা রয়েছে। আর নিজ ওয়াদা পূরণে আল্লাহর চেয়ে অধিক কে হতে পারে? সুতরাং তোমরা (আল্লাহর সংঙ্গে) যে সওদা করেছ, সে সওদার জন্য আনন্দিত হও এবং সেটাই মহাসাফল্য।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১১১]
আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতের বিনিময়ে মুজাহিদগণের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন:
আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি তাঁর মুমিন বান্দাদের জান ও মালের বিনিময় প্রদান করেন আর তা হচ্ছে জান্নাত। যখন তারা তা (জান-মাল) আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে। আর এটা তাঁর অনুগ্রহ, দয়া ও অনুকম্পাস্বরূপ। কারণ তিনি সৎকর্ম গ্রহণ করেন, অথচ সেটার তিনিই মালিক তারপরও তার বিনিময়ে তাঁর ঈমানদার বান্দাদের প্রতি তিনি অনুগ্রহ করেন।
এ কারণে হাসান আল বাসরী, কাতাদা প্রমুখ বলেন: আল্লাহ তাদের সাথে বেচা-কেনা করেছেন তারপরও মূল্যও বেশি করে দিয়েছেন। শামির ইবনু আতিয়্যাহ বলেন: এমন কোনো মুসলিম নেই যার ঘাড়ে ক্রয়বিক্রয়ের কোনো দায়িত্ব নাই, যা সে আল্লাহর নিকট করে। হয় সে তা সম্পাদন করে অথবা সম্পাদন না করেই মৃত্যুবরণ করে। অতঃপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করেন। এ কারণে বলা হয়: যে আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করে সে আল্লাহর সাথে ক্রয়বিক্রয় সম্পাদন করেছে অর্থাৎ এই চুক্তি গ্রহণ করেছে আর তা পূর্ণ করেছে।
আল্লাহ ত‘আলার বাণী: فَيَقۡتُلُونَ وَيُقۡتَلُونَۖ চাই সে হত্যা করে অথবা নিহত হয় অথবা হত্যা করে ও নিহত হয়। এ সর্বাবস্থায় তাদের জন্য জান্নাত ওয়াজিব।
এ কারণে সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে: আল্লাহ তা‘আলা তার সঙ্গে ওয়াদাবদ্ধ হন, যে তার রাস্তায় বের হয়। (আল্লাহ বলেন) কেবল আমার রাস্তায় জিহাদ ও আমার রাসূলের প্রতি বিশ্বাসই তাকে বের করেছে। যদি সে মৃত্যুবরণ করে তবে তো আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। অথবা সে যা সাওয়াব লাভ করার তা লাভ করে ও গনিমত সহকারে তার গৃহে ফিরে আসে যেখান থেকে সে বের হয়েছিল।”
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَعۡدًا عَلَيۡهِ حَقّٗا فِي ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَٱلۡإِنجِيلِ وَٱلۡقُرۡءَانِۚ এ আয়াতাংশ (পূর্বোক্ত জান্নাতের) ওয়াদার তাকীদস্বরূপ আর সংবাদস্বরূপ যে, তিনি তার উপর দয়া অবধারিত করে নিয়েছেন। আর তা তার রাসূলগণের উপর তার বড় বড় কিতাবসমূহে অবতীর্ণ করেছেন। তা হচ্ছে: তাওরাতে যা মুসা আলাইহিস সালাম-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। আর ইঞ্জিলে যা ঈসা আলাইহিস সালাম-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। আর আল-কুরআনে যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ হয়েছে।
আর তাঁর বাণী: وَمَنۡ أَوۡفَىٰ بِعَهۡدِهِۦ مِنَ ٱللَّهِۚ  তিনি তাঁর অঙ্গিকার ভঙ্গ করেন না। এটা ঐ বাণীর মত যাতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ الله حديثا এবং وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ الله قيلا আর এ কারণে তিনি বলেন: فَٱسۡتَبۡشِرُواْ بِبَيۡعِكُمُ ٱلَّذِي بَايَعۡتُم بِهِۦۚ وَذَٰلِكَ هُوَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ অতএব এই চুক্তির দাবি সম্পাদনে যে সচেষ্ট হয় আর তা পূর্ণ করে সে যেন মহা সাফল্য ও চিরস্থায়ী নি‘আমত প্রাপ্তিতে খুশি হয়।
﴿ٱلتَّٰٓئِبُونَ ٱلۡعَٰبِدُونَ ٱلۡحَٰمِدُونَ ٱلسَّٰٓئِحُونَ ٱلرَّٰكِعُونَ ٱلسَّٰجِدُونَ ٱلۡأٓمِرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَٱلنَّاهُونَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَٱلۡحَٰفِظُونَ لِحُدُودِ ٱللَّهِۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ١١٢﴾ [التوبة: ١١٢]  
“১১২. তারা তাওবাকারী, ইবাদাতকারী, আল্লাহর প্রশংসাকারী, সিয়াম পালনকারী, রুকূকারী, সিজদাকারী, সৎকাজের আদেশদাতা, অসৎকাজের নিষেধকারী এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা হেফাযতকারী। আর মু’মিনদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১১২]
এটা ঐ সমস্ত মু’মিনদের গুণ, আল্লাহ তা‘আলা যাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন। যাদের রয়েছে এ সমস্ত সুন্দর ও সম্মানজনক বৈশিষ্ট্য। যারা التائبون সমস্ত পাপাচার থেকে, সমস্ত অশ্লীল কাজ পরিত্যাগকারী। العابدون যারা তাদের পালনকর্তার ইবাদতকারী, তার সংরক্ষণকারী, আর যাতে রয়েছে কথা ও কাজসমূহ। কথাগুলোর মধ্যে বিশেষ কথা হচ্ছে ‘আল্লাহর প্রশংসা করা’। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন: الحامدون অনুরূপ কর্মসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে ‘সিয়াম’, আর তা হচ্ছে খাদ্যপানীয়ও ও স্ত্রীসম্ভোগের বিনোদন থেকে বিরত থাকা। এখানে এরই অর্থ হচ্ছে السائحون যেমন আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন السائحات “সিয়াম পালনকারিনী।” অনুরূপভাবে রুকু ও সিজদা আর এ দুটো দ্বারা সালাতকে বোঝানো হয়ে থাকে। الراكعون الساجدون এছাড়াও তারা আল্লাহর সৃষ্টির (মানবের) উপকার সাধন করে। তাদেরকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি দিক-নির্দেশনা দান করে। তাদের কী করা উচিৎ আর কী বর্জন করা উচিৎ- এ জ্ঞানও তাদের রয়েছে। আর সেটা হচ্ছে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে হালাল ও হারামের আল্লাহ প্রদত্ত সীমারেখার সংরক্ষণ। তারা আল্লাহর ইবাদত এবং লোকদের নসিহত করতে সচেষ্ট হয়। আর এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: وَبَشِّرِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ কেননা ঈমান এসবগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর আল্লাহর প্রতি যাদের ঈমান রয়েছে তাদের জন্য মহা-সাফল্য।
﴿مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَن يَسۡتَغۡفِرُواْ لِلۡمُشۡرِكِينَ وَلَوۡ كَانُوٓاْ أُوْلِي قُرۡبَىٰ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمۡ أَنَّهُمۡ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَحِيمِ ١١٣ وَمَا كَانَ ٱسۡتِغۡفَارُ إِبۡرَٰهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَن مَّوۡعِدَةٖ وَعَدَهَآ إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُۥٓ أَنَّهُۥ عَدُوّٞ لِّلَّهِ تَبَرَّأَ مِنۡهُۚ إِنَّ إِبۡرَٰهِيمَ لَأَوَّٰهٌ حَلِيمٞ ١١٤﴾ [التوبة: ١١٣،  ١١٤]  
“১১৩. কোনো নবী ও মু’মিনদের জন্য উচিত নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। যদিও তারা আত্মীয় হয়। তাদের নিকট এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যে, নিশ্চয় তারা প্রজ্বলিত আগুনের অধিবাসী। ১১৪. নিজ পিতার জন্য ইবরাহীমের ক্ষমা প্রার্থনা তো ছিল একটি ওয়াদার কারণে, যে ওয়াদা সে তাকে দিয়েছিল। অতঃপর যখন তার নিকট স্পষ্ট হয়ে গেল যে, নিশ্চয় সে আল্লাহর শত্রু, সে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল। নিশ্চয় ইবরাহীম ছিল অধিক প্রার্থনাকারী ও সহনশীল।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১১৩-১১৪]
মুশরিকদের জন্য দো’আ করা নিষিদ্ধ:
ইমাম আহমাদ রহ. সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব থেকে তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন: আবু তালেবের মৃত্যুর সময় যখন ঘনিয়ে আসল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নিকট আগমন করেন। এ সময় তার (আবু তালেবের) নিকট আবু জাহাল ও আব্দুল্লাহ ইবনে আবু উমাইয়া ছিল। তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আবু তালেবকে বললেন: হে চাচা! বলুন: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো নেই প্রকৃত উপাস্য)। এর দ্বারা আমি আল্লাহর নিকট আপনার সম্পর্কে ওজুহাত পেশ করব। আবু জাহাল ও আব্দুল্লাহ ইবনে আবু উমাইয়া তখন বলল: হে আবু তালেব! তুমি কি আব্দুল মুত্তালিবের ধর্মের ব্যাপারে বিরাগ হচ্ছ? (অর্থাৎ তুমি তার ধর্ম ত্যাগ করতে চাচ্ছ।) সে (আবু তালেব) বলল: ‘আমি আব্দুল মুত্তালিবের ধর্মের উপর রইলাম’। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন: ‘যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাকে নিষেধ করা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আপনার জন্য (আমার রবের নিকট) ক্ষমা প্রার্থনা করেই যাব’। ফলে আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করেন: مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَن يَسۡتَغۡفِرُواْ لِلۡمُشۡرِكِينَ وَلَوۡ كَانُوٓاْ أُوْلِي قُرۡبَىٰ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمۡ أَنَّهُمۡ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَحِيمِ “কোনো নবী ও মু’মিনদের জন্য উচিত নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। যদিও তারা আত্মীয় হয়। তাদের নিকট এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যে, নিশ্চয় তারা প্রজ্বলিত আগুনের অধিবাসী।” তিনি (রাবী) বলেন: এ আয়াতও অবতীর্ণ হয়: ﴿إِنَّكَ لَا تَهۡدِي مَنۡ أَحۡبَبۡتَ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يَهۡدِي مَن يَشَآءُۚ ٥٦﴾ [القصص: ٥٦]  “আপনি যাকে পছন্দ করেন তাকে সঠিক পথ দেখাতে পারবেন না। তবে আল্লাহ তা’আলা যাকে চান তাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন।” [সূরা আল-ক্বাসাস: ৫৬]
ইবনু জারীর সুলাইমান ইবনু বুরাইদা থেকে, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কায় আগমন করেন (পথিমধ্যে) তিনি একটি কবরের নিকট যান এবং এর পাশে বসে কিছু বলতে থাকেন। অতঃপর অশ্রুসজল নয়নে দাঁড়ান। আমরা বললাম হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যা করলেন আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি। ফলে তিনি বলেন: আমি আমার রবের নিকট আমার মায়ের কবর যিয়ারতের ব্যাপারে অনুমতি চেয়েছিলাম ফলে তিনি আমাকে অনুমতি দিয়েছেন। আর আমি তাঁর নিকট আমার মায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার অনুমতি চেয়েছিলাম; কিন্তু তিনি আমাকে অনুমতি দেন নি। রাবী বলেন: সেদিনের চেয়ে বেশি ক্রন্দন করতে তাকে আর কখনই দেখি নি।
আওফী ইবনে আব্বাস থেকে এ আয়াত সম্পর্কে বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার অনুমতি চেয়েছেন; কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে সে ব্যাপারে নিষেধ করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন: ইব্রাহীম খলীল (আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর পিতার জন্য (আল্লাহর নিকট) ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। ফলে আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করেন: وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لأَبِيهِ -আলী ইবনে আবু তলহা ইবনে আব্বাস থেকে এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: তারা তাদের পৌত্তলিক (আত্মীয়-স্বজনদের) জন্য এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়া পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা করত। অবশেষে যখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন তারা তাদের মৃত আত্মীয়-স্বজনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা থেকে বিরত থাকে; কিন্তু তখনও জীবিতদের জন্য তাদের মৃত্যুবরণ না করা পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আসে নি। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন।
আল্লাহর বাণী: وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لأَبِيهِ  ইবনে আব্বাস বলেন: ইব্রাহীম (আলাইহি সালাম) তার পিতার জন্য তার মৃত্যু পর্যন্ত দো’আ করতে থাকেন। অতঃপর যখন তার নিকট এটা প্রকাশ পায় যে সে (তাঁর পিতা) আল্লাহর দুশমন তখন তিনি তা থেকে বিরত হন। অপর একটি বর্ণনায় রয়েছে: যখন সে (ইব্রাহীমের পিতা) মারা যায়, তখন ইব্রাহীম (আলাইহি সালাম)-এর নিকট প্রকাশিত হয় যে, সে (ইব্রাহীমের পিতা) আল্লাহর দুশমন। এরূপই বর্ণনা করেছেন মুজাহিদ, দাহ্হাক, কাতাদাহ প্রমুখ (রাহিমাহুমুল্লাহ)। উবাইদ ইবনে ‘উমাইর এবং সা‘ঈদ ইবনে জুবাইর বলেন: তিনি (ইব্রাহীম আলাইহি সালাম) কিয়ামত দিবসে তার পিতা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। কিন্তু তাঁর পিতার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হবে আর তিনি তাঁর পিতার চেহারায় কালিমা দেখতে পাবেন। অতঃপর সে (তাঁর পিতা) বলবে: হে ইব্রাহীম আমি তোমার বিরুদ্ধাচরণ করেছি আজ আমি তোমার কোনো বিরুদ্ধাচরণ করব না। ফলে তিনি (ইব্রাহীম) বলবেন: হে আমার রব! আপনি কি আমার সাথে অঙ্গিকার করেন নি যে, আপনি পুনরুত্থান দিবসে আমাকে বেইজ্জত করবেন না। আমার পিতার বেইজ্জতির চেয়ে বড় বেইজ্জতি আর কী হতে পারে? বলা হবে: তোমার পেছনে দেখ, তিনি দেখতে পাবেন সেখানে রক্তাক্ত একটি হায়েনা পড়ে আছে। তার পিতাকে তাতে রূপান্তরিত করা হবে। অতঃপর তার পা টান দিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: لَأَوَّٰهٌ حَلِيمٞ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: الأواه “অতিশয় প্রার্থনাকারী”। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাসের বিভিন্ন বর্ণনার মধ্যে কোনোটিতে বলা হয়েছে: অনুনয়কারী অথবা বলা হয়েছে: দয়াবান অথবা বলা হয়েছে: দৃঢ়-বিশ্বাসী অথবা বলা হয়েছে। পবিত্রতা ঘোষণাকারী। আর কেউ বলেন অন্য কিছু।
﴿وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُضِلَّ قَوۡمَۢا بَعۡدَ إِذۡ هَدَىٰهُمۡ حَتَّىٰ يُبَيِّنَ لَهُم مَّا يَتَّقُونَۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٌ ١١٥ إِنَّ ٱللَّهَ لَهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ يُحۡيِۦ وَيُمِيتُۚ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ مِن وَلِيّٖ وَلَا نَصِيرٖ ١١٦ ﴾ [التوبة: ١١٥،  ١١٦]
“১১৫. আর আল্লাহ এমন নন যে, তিনি কোন সম্প্রদায়কে হিদায়াত দানের পর তাদেরকে পথভ্রষ্ট করবেন। যতক্ষণ না তাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করবেন, যা থেকে তারা সাবধান থাকবে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে সর্বজ্ঞ। ১১৬. নিশ্চয় আল্লাহ, তাঁর জন্যই আসমানসমূহ ও জমিনের রাজত্ব। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের জন্য না আছে কোনো অভিভাবক, না আছে কোনো সাহায্যকারী।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১১৫-১১৬]
দলীল প্রতিষ্ঠিত হবার পর পাকড়াও:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সম্মানিত সত্ত্বা ও ন্যায়বিচার সম্পর্কে বলেন যে, তিনি কোনো সম্প্রদায়ের নিকট তার বার্তা পৌঁছানোর পরই তাদেরকে (তা না মানার কারণে) গোমরাহ করেন। যাতে করে তাদের বিরুদ্ধে দলীল প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: وَأَمَّا ثَمُودُ فَهَدَيْنَاهُمْ
মুজাহিদ এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণকে মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করার ব্যাপারে বিশেষভাবে অবহিত করেন। আর সাধারণভাবে তাঁর অবাধ্যতা থেকে ভীতি প্রদর্শন ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে উৎসাহ দিচ্ছেন। কাজেই এটা পালন কর অথবা কষ্ট ভোগ কর। ইবনে জারীর বলেন: আল্লাহ তা‘আলা বলেন: আল্লাহ তা‘আলা এমন নন যে, যখন তিনি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন আর যখন তিনি তোমাদেরকে তাঁর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার তাওফিক দিয়েছেন, তখন তোমাদের মুশরিক মৃতদের জন্য তোমাদের প্রার্থনার কারণে তোমরা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছো বলে তিনি ফায়সালা দিয়ে দিবেন। প্রথমত তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবেন যা তোমাদেরকে পরিত্যাগ করতে হবে, যাতে তোমরা তা পরিত্যাগ কর। নিষেধ করে কোনো বিষয়ে ঘৃণিত হওয়া সম্পর্কে তোমাদের জানিয়ে দেওয়ার পূর্বে নিষিদ্ধ বস্তুর ব্যাপারে তোমাদের সীমালঙ্ঘন করার কারণে তিনি তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট বলে গণ্য করবেন না। কেননা আনুগত্য ও অবাধ্যতা তো কেবল আদিষ্ট ও নিষেধকৃত বিষয়েই হয়ে থাকে। আর যাকে নির্দেশ প্রদান অথবা নিষেধ করা হয় নি তাকে সে বিষয়গুলোতে অনুগত অথবা অবাধ্য বলা যায় না।  
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: إِنَّ ٱللَّهَ لَهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ يُحۡيِۦ وَيُمِيتُۚ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ مِن وَلِيّٖ وَلَا نَصِيرٖ  “নিশ্চয় আল্লাহ, তাঁর জন্যই আসমানসমূহ ও জমিনের রাজত্ব। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের জন্য না আছে কোনো অভিভাবক, না আছে কোনো সাহায্যকারী।” ইবনু জারীর বলেন: এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তার মুমিন বান্দাদের প্রতি মুশরিক ও কাফির সর্দারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রেরণাস্বরূপ। আর যেন তারা আল্লাহর সাহায্যের ব্যাপারে আস্থাবান হয় যিনি আসমানসমূহ ও জমিনের মালিক। আর তার শত্রুদের যেন ভয় না পায়। কেননা আল্লাহ ছাড়া তাদের কোনো অভিভাবক নেই, নেই কোন সাহায্যকারী।
﴿لَّقَد تَّابَ ٱللَّهُ عَلَى ٱلنَّبِيِّ وَٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ ٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُ فِي سَاعَةِ ٱلۡعُسۡرَةِ مِنۢ بَعۡدِ مَا كَادَ يَزِيغُ قُلُوبُ فَرِيقٖ مِّنۡهُمۡ ثُمَّ تَابَ عَلَيۡهِمۡۚ إِنَّهُۥ بِهِمۡ رَءُوفٞ رَّحِيمٞ ١١٧﴾ [التوبة: ١١٧]
“১১৭. অবশ্যই আল্লাহ নবী, মুহাজির ও আনসারদের তাওবা কবুল করলেন, যারা তার অনুসরণ করেছে সংকটপূর্ণ মুহূর্তে। তাদের মধ্যে এক দলের হৃদয় সত্যচ্যূত হওয়ার উপক্রম হবার পর। তারপর আল্লাহ তাদের তাওবাহ কবূল করলেন। নিশ্চয় তিনি তাদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১১৭]
তাবুক যুদ্ধের বর্ণনা:
মুজাহিদ প্রমুখ বলেন: এ আয়াতটি তাবুক যুদ্ধ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়। মুসলিমগণ কঠিন অবস্থার মধ্যে তাবুক যুদ্ধে বের হয়। তা ছিল এমন একটি বৎসর যখন ভূমি শুকিয়ে হয়েছিল অনুর্বর, আবহাওয়া ছিল প্রচণ্ড গরম। সফরের সম্বল ও পানীয় সংগ্রহ ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। কাতাদা বলেন: তাবুক যুদ্ধের বৎসরে প্রচণ্ড অগ্নিঝরা গরমে তারা সিরিয়ার উদ্দেশ্যে বের হয় আর যে কষ্ট তারা ভোগ করেন আল্লাহ তা‘আলা তা অবগত আছেন। সেখানে তারা প্রচণ্ড কষ্টে পড়েন। এমনকি আমাদের বলা হয়, দুই ব্যক্তি একটি খেজুরকে তাদের মাঝে দুই ভাগে ভাগ করেন। দুই ব্যক্তি একটি খেজুরকে নিজেদের মাঝে বিনিময় করে। তাদের একজন তা চোষণ করে আর তার উপর গলা ভিজায়। অতঃপর আরেকজন তা চোষণ করে আর তার উপর গলা ভিজায়। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা তাদের তাওবা কবুল করেন আর যুদ্ধ বিরতির নির্দেশ দান করেন।
ইবনে জারীর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন: ওমর ইবনুল খাত্তাবকে এই কষ্টময় সফর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বলেন: আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে তাবুকের উদ্দেশ্যে বের হই। অতঃপর এক স্থানে আমরা যাত্রা বিরতি করলাম। এ সময় আমাদের এমন পিপাসা পেয়ে বসে যে, আমাদের মনে হল আমাদের গর্দানসমুহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এমনকি আমাদের মধ্যে কেউ তার উট জবাই করে তার গোবর বের করে তার রস পান করে। আর তার কিডনিতে যা অবশিষ্ট ছিল তা রাখল।
অবশেষে আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আপনার দো’আ মঞ্জুর করেন। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য দো’আ করুন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘এটা কি পছন্দ কর যে, আমি তা করি’ তিনি (আবু বকর) বললেন: হাঁ। ফলে তিনি তার দু‘হাত উত্তোলন করলেন আর ততক্ষণ পর্যন্ত তা নামালেন না যতক্ষণ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ হল। অতঃপর কিছুক্ষণের জন্য তা বন্ধ হল। এরপর আবার বর্ষণ শুরু হল। ফলে তাদের কাছে যা ছিল তা ভর্তি করে নিলো। আমরা দেখার জন্য বের হলাম কোথায় বৃষ্টি পৌঁছেছে? ফলে পেলাম যে তা আমাদের শিবির অতিক্রম করে চলে গিয়েছে।
আল্লাহ তা“আলার বাণী لَّقَد تَّابَ ٱللَّهُ عَلَى ٱلنَّبِيِّ وَٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ ٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُ فِي سَاعَةِ ٱلۡعُسۡرَةِ সম্পর্কে ইবনে জারীর বলেন: অর্থাৎ খরচাদি, বিজয়, পথের সম্বল, পানীয়ের সঙ্কট। مِنۢ بَعۡدِ مَا كَادَ يَزِيغُ قُلُوبُ فَرِيقٖ مِّنۡهُمۡ অর্থাৎ সত্য থেকে অন্তর বিচ্যুত হওয়ার উপক্রম ঘটেছিল। আর তারা রাসূলের দ্বীনের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে আর তার ব্যাপারে সন্দেহ করে যিনি তাদেরকে (পরীক্ষাস্বরূপ) তাদের সফর ও যুদ্ধে এই ক্লেশ-কষ্ট প্রদান করেন।
﴿وَعَلَى ٱلثَّلَٰثَةِ ٱلَّذِينَ خُلِّفُواْ حَتَّىٰٓ إِذَا ضَاقَتۡ عَلَيۡهِمُ ٱلۡأَرۡضُ بِمَا رَحُبَتۡ وَضَاقَتۡ عَلَيۡهِمۡ أَنفُسُهُمۡ وَظَنُّوٓاْ أَن لَّا مَلۡجَأَ مِنَ ٱللَّهِ إِلَّآ إِلَيۡهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيۡهِمۡ لِيَتُوبُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ١١٨ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَكُونُواْ مَعَ ٱلصَّٰدِقِينَ ١١٩﴾ [التوبة: ١١٨،  ١١٩] “১১৮. আর সে তিন জনের (তাওবা কবূল করলেন), যাদের বিষয়টি স্থগিত রাখা হয়েছিল। এমনকি পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের নিকট তাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। আর তারা নিশ্চিত বুঝেছিল যে, আল্লাহর আযাব থেকে তিনি ছাড়া কোনো আশ্রয়স্থল নেই। তারপর তিনি তাদের তাওবাহ কবুল করলেন, যাতে তারা তাওবায় স্থির থাকে। নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাহ কবূলকারী, পরম দয়ালু। ১১৯. হে মু’মিনগণ, তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১১৮-১১৯]
ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনে কা‘ব ইবনে মালেক, যিনি কা‘ব অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তার চলাফিরায় তাকে সহযোগিতা করতেন। তিনি বলেন: আমি কা‘বকে তার তাবুক যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করতে শুনেছি, যাতে তিনি রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু‌ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অংশগ্রহণ করেন নি। কা‘ব ইবনে মালেক বলেন: কোনো যুদ্ধাভিযানেই আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পিছনে পড়ি নি তাবুক অভিযান ছাড়া। অবশ্য আমি বদর অভিযানে অংশগ্রহণে ব্যর্থ হয়েছিলাম; কিন্তু বদর অভিযানে যারা অংশ নেয়নি তারা কেউ তিরষ্কৃত হয়নি। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল কুরাইশ কাফেলাকে ধরার জন্য বের হয়েছিলেন। অবশেষে দিন ধার্য ছাড়াই আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম আর তাদের শত্রুদের একত্রিত করেন। আমি আক্বাবার রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অংশ গ্রহণ করেছি যখন ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার ব্যাপারে তিনি আমাদের অঙ্গিকার নিয়েছিলেন। আমি এটাকে বদর যুদ্ধের স্থলাভিষিক্ত করতে পছন্দ করি না। যদিও বদর যুদ্ধ লোকদের নিকট বাই‘আতে আক্বাবার চেয়ে অধিক পরিচিত। তাবুক যুদ্ধে আমার ঘটনা হচ্ছে এই: এ যুদ্ধে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পিছেনে পড়েছিলাম। আমি কখনই এত শক্তিশালী আর আমার জন্য কখনই এত সহজ ছিল না যখন আমি এই যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অংশগ্রহণ করি নি। আল্লাহর শপথ ইতোপূর্বে কখনই আমার দুটো উষ্ট্রী ছিল না অথচ এ যুদ্ধের সময় তা ছিল। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোনো অভিযানে বের হতেন (রণকৌশল হিসেবে) রাস্তা পরিবর্তন করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অভিযান প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পরিচালনা করেন। তিনি দীর্ঘ মরু সফরে বের হন। বহুসংখ্যক শত্রুর মুখোমুখি হন। মুসলিমবৃন্দের নিকট শত্রুদের বিরুদ্ধে (যুদ্ধ) প্রস্তুতি গ্রহণ করার বিষয়টি তুলে ধরেন, যাতে তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দিকে যাওয়ার মন স্থির করেন সেটা তাদেরকে অবগত করেন। আর তাঁর সাথে মুসলিমবৃন্দ ছিল অনেক যার তালিকা করা যাবে না। কতক লোক যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত চায় নি তারা ভেবেছিল যে, তাদের ব্যাপারটি গোপনীয়ই থেকে যাবে যদি না আল্লাহ তা‘আলা তা জানিয়ে দেন। আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন সময় এই অভিযান পরিচালনা করেন যখন ফলফলাদি পেকেছিল আর ছায়া ছিল আনন্দদায়ক। আর আমার ঝোঁক সেদিকেই ছিল। (এদিকে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর তাঁর সাথে মুসলিমগণও তাবুক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আমি তাদের সাথে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বের হলাম; কিন্তু তার কিছুই না করে ফিরে আসলাম। আমি মনে মনে বললাম: আমি চাইলে তা করতে পারি। আর এভাবেই আমার (অবস্থা) চলতে থাকে আর লোকেরা এদিকে তাদের প্রস্তুতি চালিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার সাথে মুসলিমবৃন্দও সকাল সকাল বেরিয়ে গেলেন। আর আমি কোনো প্রস্তুতিই গ্রহণ করলাম না। আমি বললাম: আমি একদিন অথবা দুইদিন পর প্রস্তুতি নিব। অতঃপর তার সাথে গিয়ে মিলিত হব। তাদের যাত্রার পরদিন সকালে প্রস্তুতি নিতে গেলাম কিন্তু কিছু না করেই ফিরে এলাম। পরের দিন আবার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লাম; কিন্তু কিছু না করেই ফিরে এলাম। আর এভাবেই আমার চলতে থাকল। অবশেষে লোকেরা প্রতিযোগিতা করে জিহাদে ছুটে গেল। আমি তখন তাদেরকে ধারার জন্য যাত্রা করতে মনস্থ করলাম। হায় যদি আমি তা করতাম। আর এটা আমার পক্ষে সম্ভব হল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চলে যাওয়ার পর যখন আমি লোকদের মাঝে বের হতাম (যারা যুদ্ধে যায় নি) তখন আমাকে এটা পিড়া দিল যে, নেফাকে অভিযুক্ত এবং আল্লাহ কর্তৃক মুক্ত ঘোষিত দুর্বল লোক ছাড়া অন্য কোনো লোক দেখলাম না। তাবুক পৌঁছার পূর্বে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে স্মরণ করেন নি। তাবুক গিয়ে তিনি লোকদের মধ্যে বসে ছিলেন এ সময় বললেন: “কা‘ব ইবন মালেকের কি সমাচার?” বাণী সালামা গোত্রের জনৈক লোক বলল: তাকে তার দুই বুরদা (পোষাকবিশেষ) আর গর্বভরে নিজের দিকে দর্শন তাকে আটকে দিয়েছে। মু‘আয ইবনে জাবাল বলেন: কত মন্দ কথাই না তুমি বলেছ! আল্লাহর শপথ হে আল্লাহ রাসূল! আমরা তার ব্যাপারে ভালো ছাড়া কিছুই জানি না। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ থাকলেন।
কা‘ব ইবন মালেক আরও বলেন: যখন আমি জানতে পারলাম যে, রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাফেলা তাবুক থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে তখন অস্থিরতা আমার উপর ভর করল এবং মনের মধ্যে মিথ্যা অজুহাত দাড় করানোর কথা চিন্তা করতে লাগলাম। আর বললাম কীভাবে আগামীকাল আমি তার ক্রোধ থেকে বের হতে পারি। আর আমার পরিবারের সমস্ত অভিজ্ঞ লোকদের নিকট এ ব্যাপারে সহযোগিতা নিলাম। যখন বলা হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করেছেন তখন সমস্ত দুষ্ট ও মিথ্যা ওজুহাতগুলো আমার মন থেকে দুর হয়ে গেল। আর আমি ভালোভাবেই জানি এ সমস্ত মিথ্যা অজুহাতে আমি পার পাব না। তখন সত্য বলার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলাম। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকালে আগমন করলেন। (তাঁর নিয়ম ছিল) যখন তিনি সফর থেকে আগমন করতেন তখন প্রথমে মসজিদে প্রবেশ করে দু’রা‘আত সালাত আদায় করতেন অতঃপর লোকদেরকে সময় দেওয়ার জন্য বসতেন। ফলে যখন তিনি এভাবে মসজিদে বসলেন। যুদ্ধ থেকে পেছনে পড়ে থাকা লোকেরা এ সময় আসল আর তার কাছে শপথ করে (নানা) ওযর আপত্তি পেশ করতে লাগল। তারা ছিল আশির কিছু ঊর্ধ্বে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বাহ্যিক অবস্থা থেকে তাদের ওযর গ্রহণ করলেন আর তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো আল্লাহর নিকট সোপর্দ করে দিলেন। অতঃপর আমি (তাঁর নিকট) আসলাম। যখন সালাম দিলাম তিনি রাগসুচক মুচকি হাসি দিলেন। অতঃপর আমাকে বললেন: (এ দিকে) এস, ফলে পদব্রজে তার নিকট গেলাম আর তার সামনে বসলাম। তিনি আমাকে বললেন: কিসে তোমাকে আমাদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে পিছে ফেলেছে? তুমি কি যুদ্ধের বাহন ক্রয় কর নি? আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি আপনি ছাড়া পৃথিবীর আর কারও নিকট (এ সময়) বসতাম তবে কোনো ওযর আপত্তি পেশ করে তার ক্রোধ হতে বের হওয়ার উপায় অবলম্বন করতাম। আল্লাহ আমাকে বাগ্মিতা পূর্ণ কথা বলার ক্ষমতা দিয়েছেন; কিন্তু আল্লাহর শপথ আমি অবগত আছি আজ যদি আমি মিথ্যা বলি তবে আপনি হয়ত আমার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন; কিন্তু অচিরেই আল্লাহ তা‘আলা আমার উপর আপনাকে অসন্তুষ্ট করে দিবেন। আমি যদি সত্যি বলি আর আমার সত্য বলার কারণে আপনি রাগান্বিত হন কিন্তু আমি অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে ভালো পরিণতির আশা করি। আল্লাহর শপথ ! আমার কোনোই ওযর ছিল না। আমি কখনই এতটা অবসরে ছিলাম না আর আমার পক্ষে কখনই এতটা সহজ ছিল না, যতটা সহজ ছিল যখন আপনি তাবুক অভিযানে বের হন। তিনি বলেন: অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “এ সত্য বলেছে, উঠ, দেখ আল্লাহ তোমার ব্যাপারে কি ফায়সালা দেন।” ফলে আমি উঠে দাঁড়ালাম। আর আমার নিকট বনু সালামার কতিপয় ব্যক্তি উঠে দাঁড়াল আর অনুসরণ করল। অতঃপর বলল: এর পূর্বে তুমি কোনো অপরাধ করেছ বলে আমরা জানি না। জিহাদ থেকে পেছনে রয়ে যাওয়া অন্যান্যদের মত তুমি ওযর পেশ করতে অপারগ হয়েছ। তোমার অপরাধের জন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনাই তো যথেষ্ট ছিল। আল্লাহর শপথ! তারা আমাকে তিরস্কার করতেই থাকল ফলে আমার মনে হল যেন ফিরে যাই আর আমি (আসলে) মিথ্যা বলেছি বলে তাঁকে অবহিত করি। তিনি (কা‘ব ইবন মালিক) বলেন: অতঃপর আমি তাদেরকে বললাম: এতে (এ অভিযোগে) আমার সাথে আর কেউ আছে কি? তারা বলল: হাঁ এতে তোমার সাথে দু’ব্যক্তি রয়েছে আর তারাও তোমার মতই বলেছে (আল্লাহর রাসূলকে)। আর তাদেরকেও তাই বলা হয়েছে যা তোমাকে বলা হয়েছে (শাস্তির ব্যাপারে)। ফলে বললাম: তারা কারা? তারা বলল: মুরারাহ ইবনে রবী‘ আল আমেরী এবং হিলাল ইবনে উমাইয়া আল ওয়াকিফী। অতঃপর আমাকে দু’জন সৎ ব্যক্তির কথা বলা হল যারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে যাদের মাঝে রয়েছে আমার জন্য আদর্শ। সুতরাং আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম না। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমগণকে আমাদের (পূর্বে উল্লিখিত তিন ব্যক্তির) সাথে কথা বলতে নিষেধ করলেন। লোকেরা আমাদেরকে বয়কট করল। তারা আমাদের সাথে তাদের অবস্থাদি পরিবর্তন করল ফলে ধরা আমার জন্য যেন অপরিচিত হয়ে উঠল। এভাবে আমাদের পঞ্চাশ দিন চলে যায়। এদিকে আমার দুই সাথি তাদের বাড়িতে লুকিয়ে বসে থাকল। আমি ছিলাম আমার গোত্রের কঠিন ও সহিষ্ণু ব্যক্তি। আমি মুসলিমগণের সাথে সলাতে অংশগ্রহণ করতাম আর বাজারে যেতাম তবে কেউ আমার সাথে কথা বলত না। আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সালাতের পর তার মাজলিসে আগমন করি আর মনে মনে বলি আমার সালামের উত্তর প্রদানে তার ঠোঁট নড়ে কিনা? তার নিকটে সালাত আদায় করি আর আড় চোখে তাকে দেখে নিই। যখন আমি আমার সলাতে আত্মনিয়োগ করি তিনি আমার দিকে তাকান। অতঃপর যখন আমি তার দিকে তাকাই তখন আমার থেকে তাঁর মুখ ফিরিয়ে নেন। মুসলিমগণের এই বয়কটে বিষয়টি আমার নিকট অত্যন্ত দীর্ঘ হয়ে উঠল। চলতে লাগলাম অবশেষে আবু কাতাদার (বাড়ীর) প্রাচীরে আরোহণ করলাম। তিনি আমার চাচাত ভাই আর আমার প্রিয় ব্যক্তি। আমি তাকে সালাম দিলাম। আল্লাহর শপথ! তিনি আমার সালামের জবাব দিলেন না। আমি তাকে বললাম: হে আবু কাতাদা! আল্লাহর শপথ! তুমি জান যে, আমি আল্লাহ এবং তার রাসূলকে ভালোবাসি। তিনি (কা‘ব ইবন মালিক) বলেন: তিনি (আবু কাতাদা) চুপ থাকলেন। তিনি (কা‘ব ইবন মালিক) বলেন: আমি তার জন্য বসলাম আর আল্লাহর দোহাই দিলাম। (কিন্তু) তিনি চুপ করে রইলেন। অতঃপর আমি তার জন্য বসলাম আর দোহাই দিলাম। তারপরও তিনি চুপ করে রইলেন। এরপর তিনি বললেন: আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (এ ব্যাপারে) অধিক অবগত।
তিনি (কা‘ব ইবন মালিক) বলেন: আমার চোখ হতে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আর ফিরে আসলাম অবশেষে প্রাচীরে আরোহণ করলাম। একসময় আমি মদিনার বাজারে ঘুরছি হঠাৎ আমার চোখে সিরিয়ার এক নাবাতী বিক্রয়ের জন্য মদীনাতে খাদ্য নিয়ে এসেছে। তারা বলল: কে কা‘ব ইবন মালেকের খোঁজ দিতে পারবে? তিনি বলেন: লোকেরা তাকে আমার দিকে ইঙ্গিত করে দেখিয়ে দিতে লাগল। অবশেষে সে আসল আর আমাকে গাস্সানের বাদশার চিঠি প্রদান করল। আমি লিখক ছিলাম। ফলে দেখি তাতে লিখা রয়েছে: অতঃপর, আমরা জানতে পেরেছি যে, তোমার সাথী তোমার প্রতি নির্দয় ব্যবহার করেছে। আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে লাঞ্ছনাময় ভূমিতে না রাখুন। আমাদের সাথে মিলিত হও আমরা তোমাকে সান্তনা দিব। ফলে যখন আমি তা পাঠ করলাম তখন বললাম: এটাও আরেক পরীক্ষা। অতঃপর আমি পত্রখানা চুলার আগুনে পুড়িয়ে ফেললাম। অতঃপর পঞ্চাশ দিন থেকে যখন চল্লিশ দিন চলে গেল তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দূত আমার নিকট এসে বলল: রাসূলুল্লাহ‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে তোমার স্ত্রী পরিত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন: আমি বললাম: আমি কি তাকে তালাক দিয়ে দেব না কি করব? অতঃপর তিনি বললেন: না; বরং তার থেকে বিচ্ছিন্ন হও আর তার নিকটবর্তী হয়ো না। তিনি বলেন: আমার দুই সাথীর নিকটও অনুরূপ প্রেরণ করেন। তিনি বলেন: আমি আমার স্ত্রীকে বললাম: তুমি তোমার পরিবারের সাথে মিলিত হও আর তাদের নিকট থাক যে পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা এ ব্যাপারে ফায়সালা প্রদান করেন। তিনি (কা‘ব ইবন মালিক) বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হিলাল ইবনে উমাইয়ার স্ত্রী আগমন করল অতঃপর বলল: হে আল্লাহর রাসূল! হিলাল হচ্ছে একজন দুর্বল বৃদ্ধ তার কোনো সেবক নাই। আমি যদি তার সেবা করি তবে কি আপনি তা অপছন্দ করবেন? তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন: না তবে সে যেন তোমার নিকটবর্তী না হয়। সে (হিলালের স্ত্রী) বলল: তার কোনো কিছুর প্রতি আগ্রহ নেই। আর আল্লাহর শপথ! সেই দিন থেকে আজও পর্যন্ত সে কেঁদেই চলেছে। তিনি (কা‘ব ইবন মালিক) আমার পরিবারের কেউ বলল: তুমি যদি তোমার স্ত্রীর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট অনুমতি নিতে। হিলালের স্ত্রীকে তার (হিলালের) সেবা করার জন্য তিনি অনুমতি দিয়েছেন। তিনি বলেন: আমি বললাম: আল্লাহর শপথ আমি আমার স্ত্রীর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট অনুমতি চাইব না আর আমি জানি না যখন আমি তাঁর নিকট অনুমতি চাইব তখন তিনি আমার স্ত্রীর ব্যাপারে কী বলবেন অথচ আমি একজন যুবক পুরুষ?
তিনি বলেন: অতঃপর (আরও দশদিন) অবস্থান করলাম। অবশেষে লোকদের আমার সাথে কথা না বলার পঞ্চাশ দিন পূর্ণ হল। তিনি (কা‘ব ইবন মালিক) বলেন: অতঃপর আমাদের গৃহসমূহের কোনো এক গৃহের ছাদে পঞ্চাশতম দিবসের প্রভাতে ফজরের সালাত আদায় শেষ করেছি। আর আমি এমন অবস্থায় বসে আছি যার বিবরণ আল্লাহ তা‘আলা (কুরআনে) প্রদান করেছেন অর্থাৎ যখন আমি আমার নিজের উপর বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছিলাম এবং ভূ-পৃষ্ঠ নিজ প্রশস্ততা সত্ত্বেও আমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে উঠেছিল। এক চিৎকারকারীকে শুনলাম সে সাল‘আ পাহাড়ে আরোহণ করে তার উচ্চস্বরে বলছে: সুসংবাদ গ্রহণ করো হে কা‘ব ইবনে মালিক! তিনি (কা‘ব ইবন মালিক) বলেন: আমি সিজদায় পড়ে গেলাম আর বুঝতে পারলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওবার মাধ্যমে আমরা নিষ্কৃতি লাভ করলাম। রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাত আদায়ের পর আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের তাওবাহ কবুল হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে দিলেন। লোকেরা আমাদের সুসংবাদ দিতে গেল। আর কতক সু-সংবাদদাতাও গেল আমার দুই সাথীর নিকট। এক ঘোড়ার মালিক আমার নিকট ছুটে এলো আর বানু আসলামের ঐ ব্যক্তিও ছুটে এলো, যে সাল‘আ পাহাড়ে আরোহণ করেছিল। তার আওয়াজ ছিল ঘোড়ার চেয়েও দ্রুত। অতঃপর যখন সে এলো যে আমাকে সুসংবাদ দিয়েছিল আমি তাকে আমার পোশাক দু’টি খুলে দিলাম আর আমাকে সুসংবাদ প্রদানস্বরূপ তাকে সেগুলো পরিধান করালাম। আল্লাহর শপথ সেদিন এ দুটো পোষাক ছাড়া আমার আর কোনো পোশাকই ছিল না। অতঃপর আমি দুটো পোষাক ধার করলাম আর তা পরিধান করে আল্লাহর রাসূলের নিকট গেলাম। লোকেরা দলে দলে আমাকে গ্রহণ করল আর আল্লাহর নিকট তাওবাহ করার সুযোগ লাভের অভ্যর্থনা জানাতে লাগল। তারা বলল: আমরা তোমাকে আল্লাহর নিকট তোমার তাওবার সুযোগ লাভের অভ্যর্থনা জানাচ্ছি। অবশেষে আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম। দেখি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসে আছেন আর লোকেরা তার চারপাশে রয়েছে। আমার নিকট তালহা ইবনে ওবাইদুল্লাহ দাড়িয়ে গেল এবং দ্রুত এসে আমার সাথে মুসাফাহা করল আর অভ্যর্থনা জানাল। আল্লাহর শপথ! তিনি ছাড়া মুহাজিরদের আর কেউ আমার নিকট দাঁড়ায় নি। (অধস্তন রাবী) বলেন: এ কারণে কা‘ব তালহাকে কখনই ভুলেন নি। কা‘ব বলেন: যখন আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম দিলাম খুশিতে তখন তার চেহারা চমকাচ্ছিল। তিনি বললেন: তোমার মা যেদিন তোমাকে প্রসব করেছে সে দিন থেকে অতিবাহিত হওয়া সবচেয়ে উত্তম দিনের সুসংবাদ গ্রহণ কর। তিনি (কা‘ব) বলেন: আমি বললাম: এটা কি আপনার পক্ষ থেকে নাকি আল্লাহর পক্ষ থেকে? তিনি বললেন: না বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে। তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খুশি হতেন তখন তাঁর চেহারা আলোকিত হয়ে উঠত যেন সেটি চাঁদের একটি টুকরা যা তাঁর মাঝে বুঝা যেত। অতঃপর যখন আমি তার সামনে বসলাম তাঁকে বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! আমার তাওবাহ হচ্ছে আমি আমার (যাবতীয়) সম্পদ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নিকট সদকা হিসেবে দিয়ে দিতে চাই। তিনি বললেন: ‘তোমার কিছু সম্পদ তোমার নিকট রেখে দাও সেটা তোমার জন্য কল্যাণকর হবে।’ তিনি (কা‘ব ইবন মালিক) বলেন: আমি বললাম: খায়বার হতে প্রাপ্ত আমার অংশটি আমার জন্য রেখে দিলাম। আর বললাম: হে আল্লাহর রাসূল: নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাকে সত্য বলার কারণে মুক্তি দিয়েছেন। আর আমার তাওবার একটি অংশ হচ্ছে: আমি যতদিন বেঁচে থাকি সত্য ছাড়া কিছু বলব না। আল্লাহর শপথ আমি এমন কোন মুসলিম সম্পর্কে জানি না যাকে আল্লাহ আমার চেয়ে সত্য বলতে সাহায্য করেছেন।
আমি যেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করেছিলাম সেদিন থেকে আজও পর্যন্ত মিথ্যা (বলার) চিন্তাও করি নি আর আমি আল্লাহর নিকট আকাঙ্ক্ষা করি আমি যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন তিনি যেন আমাকে মিথ্যা বলা থেকে হিফাযত করেন।
তিনি (কা‘ব ইবন মালিক) বলেন: আর আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করলেন:
﴿لَّقَد تَّابَ ٱللَّهُ عَلَى ٱلنَّبِيِّ وَٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ ٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُ فِي سَاعَةِ ٱلۡعُسۡرَةِ مِنۢ بَعۡدِ مَا كَادَ يَزِيغُ قُلُوبُ فَرِيقٖ مِّنۡهُمۡ ثُمَّ تَابَ عَلَيۡهِمۡۚ إِنَّهُۥ بِهِمۡ رَءُوفٞ رَّحِيمٞ ١١٧ وَعَلَى ٱلثَّلَٰثَةِ ٱلَّذِينَ خُلِّفُواْ حَتَّىٰٓ إِذَا ضَاقَتۡ عَلَيۡهِمُ ٱلۡأَرۡضُ بِمَا رَحُبَتۡ وَضَاقَتۡ عَلَيۡهِمۡ أَنفُسُهُمۡ وَظَنُّوٓاْ أَن لَّا مَلۡجَأَ مِنَ ٱللَّهِ إِلَّآ إِلَيۡهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيۡهِمۡ لِيَتُوبُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ١١٨ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَكُونُواْ مَعَ ٱلصَّٰدِقِينَ ١١٩ ﴾ [التوبة: ١١٧،  ١١٩]  
“অবশ্যই আল্লাহ নবী, মুহাজির ও আনসারদের তাওবা কবুল করলেন, যারা তার অনুসরণ করেছে সংকটপূর্ণ মুহূর্তে। তাদের মধ্যে এক দলের হৃদয় সত্যচ্যূত হওয়ার উপক্রম হবার পর। তারপর আল্লাহ তাদের তাওবা কবূল করলেন। নিশ্চয় তিনি তাদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু। আর সে তিন জনের (তাওবা কবূল করলেন), যাদের বিষয়টি স্থগিত রাখা হয়েছিল। এমনকি পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের নিকট তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। আর তারা নিশ্চিত বুঝেছিল যে, আল্লাহর আযাব থেকে তিনি ছাড়া কোন আশ্রয়স্থল নেই। তারপর তিনি তাদের তাওবা কবুল করলেন, যাতে তারা তাওবায় স্থির থাকে। নিশ্চয় আল্লাহ তাওবা কবূলকারী, পরম দয়ালু। হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১১৭-১১৯] এভাবে আয়াতসমূহের শেষ পর্যন্ত।
কা‘ব বলেন: আল্লাহর শপথ আল্লাহ তা‘আলা আমাকে ইসলামের সঠিক পথ দেখানোর পর আমার উপর সে দিনের (রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট) আমার সত্য বলার চেয়ে বড় কোনো অনুগ্রহ আর করেন নি আর তা হচ্ছে যে, আমি মিথ্যা বলব না (আর বললে) ফলে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে ধ্বংস করবেন যেমন তিনি তাদেরকে ধ্বংস করেছেন যারা তাঁকে (রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে মিথ্যা বলেছিল। যারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিথ্যা বলেছিল আল্লাহ তা‘আলা যখন ওয়াহী অবতীর্ণ করেন তখন তাদের প্রত্যেকের জন্য মন্দ বলেছেন।
তিনি বলেন: আমরা সেই তিনজন যারা তাবুক যুদ্ধ অংশগ্রহণ করি নি। তারা ওরাই যাদের থেকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযর গ্রহণ করেছেন যখন তারা শপথ করেছিল। অতঃপর তিনি তাদের সাথে বাই‘আত করেন আর তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আর আল্লাহ তা‘আলা ফায়সালা না দেওয়া পর্যন্ত তিনি আমাদের ব্যাপারটি মুলতবী রাখেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: سَيَحۡلِفُونَ بِٱللَّهِ لَكُمۡ إِذَا ٱنقَلَبۡتُمۡ إِلَيۡهِمۡ لِتُعۡرِضُواْ عَنۡهُمۡۖ فَأَعۡرِضُواْ عَنۡهُمۡۖ إِنَّهُمۡ رِجۡسٞۖ ْ -এ আয়াত আমরা যারা যুদ্ধ থেকে পেছনে বসেছিলাম সকলের ক্ষেত্রে নয়; বরং যারা তার নিকট শপথ করেছিল আর তার নিকট ওযর পেশ করেছিল এবং তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন (তাদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়)।
এ হাদিসটি বিশুদ্ধ এবং প্রমাণিত, যার সঠিক হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে, আর বুখারী ও মুসলিম তার অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এ হাদিসটি এ আয়াতের সাথে সুন্দরভাবে সংশ্লিষ্ট একাধিক তাফসিরকার থেকে এ আয়াতের তাফসীরে তা বর্ণিত রয়েছে। যেমন আ‘মাশ আবু সুফইয়ান থেকে, তিনি জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণনা করে وَعَلَى ٱلثَّلَٰثَةِ ٱلَّذِينَ خُلِّفُواْ -এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন: তাঁরা হচ্ছে কা‘ব ইবন মালিক, হিলাল ইবনে উমাইয়া ও মুরারা ইবনে রবী‘। আর তারা প্রত্যেকে আনসার।
সত্য বলার নির্দেশ:
পঞ্চাশ দিবা ও রজনী মুসলিমগণের বয়কটের ফলে দুঃখ কষ্টে নিপতিত অবস্থা থেকে ঐ তিনজনকে আল্লাহ তা‘আলা যখন স্বস্তি দেন তখন এ সম্পর্কে তিনি আয়াত অবতীর্ণ করেন। আর তারা নিজেরা নিজেদের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েছিল আর যখন ভূ-পৃষ্ঠ নিজ প্রশস্ততা সত্ত্বেও তাদের প্রতি সংকীর্ণ হয়ে উঠেছিল অর্থাৎ প্রশস্ততা সত্ত্বেও চলার পথ ও গন্তব্য সংকীর্ণ হয়ে উঠেছিল। আর তারা দিশা পাচ্ছিল না যে, তারা কী করবে? আল্লাহর নির্দেশের জন্য ধৈর্যধারণ করেছিল, তার আদেশের জন্য বিনয়ী হয়েছিল আর অটল ছিল। অবশেষে যুদ্ধে মুসলিমগণের সাথে শরীক না হওয়ার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সত্য বলার কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে স্বস্তি দান করেন। বিনা ওযরে যুদ্ধে গমন থেকে বিরত থাকার কারণে এ পরিমাণ সময় তারা শাস্তি ভোগ করে অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের তাওবা কবুল করেন। অতঃপর তাদের সত্য বলার পরিণাম তাদের জন্য কল্যাণকর ছিল আর সেটা তাদের তাওবাহ হিসেবে গণ্য হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَكُونُواْ مَعَ ٱلصَّٰدِقِينَ  “হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।” অর্থাৎ সত্য বল, সত্যকে আঁকড়ে ধর সত্যবাদী হও ধ্বংস থেকে বাঁচ। তোমাদের কর্মসমুহের ব্যাপারে তোমাদের জন্য স্বস্তি ও সমাধানের পথ বের করে দিবেন।
ইমাম আহমাদ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমরা সত্যকে আঁকড়ে ধর। কেননা সত্য কল্যাণের পথ দেখায় আর কল্যাণ জান্নাতের পথ দেখায়। কোন ব্যক্তি সত্য বলে আর সত্যের প্রয়াস চালায় অবশেষে আল্লাহর নিকট তাকে সত্যবাদী হিসেবে লিখিত হয়। তোমরা মিথ্যা থেকে বেঁচে থাক। কেননা মিথ্যা পাপাচারীতার পথ দেখায়। আর পাপচারীতা জাহান্নামের পথ দেখায়। কোন ব্যক্তি মিথ্যা বলে আর মিথ্যার প্রয়াস চালায় অবশেষে আল্লাহর নিকট তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে লিখিত হয়, যদি তোমরা উল্লিখিত আয়াত তিলাওয়াত কর। ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
مَا كَانَ لِأَهۡلِ ٱلۡمَدِينَةِ وَمَنۡ حَوۡلَهُم مِّنَ ٱلۡأَعۡرَابِ أَن يَتَخَلَّفُواْ عَن رَّسُولِ ٱللَّهِ وَلَا يَرۡغَبُواْ بِأَنفُسِهِمۡ عَن نَّفۡسِهِۦۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ لَا يُصِيبُهُمۡ ظَمَأٞ وَلَا نَصَبٞ وَلَا مَخۡمَصَةٞ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَلَا يَطَ‍ُٔونَ مَوۡطِئٗا يَغِيظُ ٱلۡكُفَّارَ وَلَا يَنَالُونَ مِنۡ عَدُوّٖ نَّيۡلًا إِلَّا كُتِبَ لَهُم بِهِۦ عَمَلٞ صَٰلِحٌۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجۡرَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ١٢٠
“১২০. মদীনার অধিবাসী ও তার আশপাশের মরুবাসীদের জন্য সংগত নয় যে, রাসূলুল্লাহ থেকে পেছনে থেকে যাবে এবং রাসূলের জীবন অপেক্ষা নিজদের জীবনকে অধিক প্রিয় মনে করবে। এটা এ কারণে যে, তাদেরকে আল্লাহর পথে তৃষ্ণা, ক্লান্তি ও ক্ষুধায় আক্রান্ত করে এবং তাদের এমন পদক্ষেপ যা কাফিরদের ক্রোধ জন্মায় এবং শত্রুদেরকে তারা ক্ষতিসাধন করে, তার বিনিময়ে তাদের জন্য সৎকর্ম লিপিবদ্ধ করা হয়। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করেন না।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১২০]
যুদ্ধের জন্য বের হবার পুরষ্কার:
আল্লাহ তা‘আলা তাবুক যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অবগতগুলোর মদীনাবাসী এবং তার আশে পাশের পেছনে পড়ে থাকা লোকদের তিরস্কার করেন। যে কষ্ট-ক্লেশ তিনি এই যুদ্ধে ভোগ করেছেন সে ব্যাপারে তাকে সান্ত্বনা দান থেকে তাদের অনিচ্ছা। তারা নিজেরা নিজেদের সাওয়াবকে হ্রাস করে। কেননা তাদেরকে যে ظَمَأٞ  “তৃষ্ণা”, نَصَبٞ “ক্লান্তি”  مَخۡمَصَةٞ “ক্ষুধা” স্পর্শ করে। وَلَا يَطَ‍ُٔونَ مَوۡطِئٗا يَغِيظُ ٱلۡكُفَّارَ “তারা এমন কোথাও অবতীর্ণ হয় যেখানে তারা তাদের শত্রুদের ভীতি প্রদর্শন করে।” আর وَلَا يَنَالُونَ مِنۡ عَدُوّٖ نَّيۡلًا  এর উপর তাদের কোনো সফলতা ও বিজয় অর্জিত হয়,  إِلَّا كُتِبَ لَهُم بِهِۦ عَمَلٞ صَٰلِحٌۚ এ সমস্ত কর্মসমূহের বিনিময়ে যা তাদের ক্ষমতার অধীনে নয়, তাদের কর্মে ফলাফল মাত্র বড় সাওয়াব ও নেক আমল। إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجۡرَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ “নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করেন না।” যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্যত্র বলেন,﴿ إِنَّا لَا نُضِيعُ أَجۡرَ مَنۡ أَحۡسَنَ عَمَلًا ٣٠﴾ (الكهف: ٣٠)   “অবশ্যই যে ভালো কাজ করে তার কর্মের বিনিময় আমি নষ্ট করি না।” [সূরা আল-কাহাফ: ৩০]
وَلَا يُنفِقُونَ نَفَقَةٗ صَغِيرَةٗ وَلَا كَبِيرَةٗ وَلَا يَقۡطَعُونَ وَادِيًا إِلَّا كُتِبَ لَهُمۡ لِيَجۡزِيَهُمُ ٱللَّهُ أَحۡسَنَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٢١
“১২১. আর তারা স্বল্প কিংবা অধিক যা-ই ব্যয় করে এবং অতিক্রম করে যে প্রান্তরই, তা তাদের জন্য লিখে দেওয়া হয়, যাতে তারা যা আমল করত, আল্লাহ তাদেরকে তার চেয়ে উত্তম প্রতিদান দেন।”  [সূরা আত-তাওবাহ: ১২১]
আল্লাহর পথে ঐ সমস্ত লড়াইকারী। نَفَقَةٗ صَغِيرَةٗ وَلَا كَبِيرَة “অল্প হোক অথবা বেশি।” وَلَا يَقۡطَعُونَ وَادِيًا শত্রুদের উদ্দেশ্যে চলাতে إِلَّا كُتِبَ لَهُمۡ এখানে ভালো কর্মের ফলাফল হিসেবে তার জন্য রয়েছে বিরাট পুরষ্কার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: لِيَجۡزِيَهُمُ ٱللَّهُ أَحۡسَنَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ এ কারণে তিনি বলেন: আমীরুল মু’মিনীন উসমান ইবন আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু আনহু এই আয়াতের প্রতিফলন হিসেবে বিশাল অংশ প্রতিদান হিসেবে লাভ করেন। আর তা এভাবে যে, তিনি এই অভিযানে বিরাট খরচাদি ও অনেক সম্পদ ব্যয় করেন। আব্দুল্লাহ ইবন ইমাম আহমাদ বর্ণনাকারী আব্দুর রহমান ইবনে সামরাহ থেকে আরও বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: উসমান ইবনে আফ্ফান রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তার কাপড়ে এক হাজার দিনার নিয়ে আসেন। ফলে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কষ্টদায়ক এই অভিযানের সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করেন। তিনি (বর্ণনাকারী) বলেন: অতঃপর তিনি তাঁর (রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কোলে ঢেলে দেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেগুলোকে তার হাতে উল্টাতে থাকেন আর বলেন: আফ্ফান পুত্র আজকের পর তার কোনো আমলের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তিনি একথা বারবার বলতে থাকলেন।
কাতাদা আল্লাহর বাণী وَلَا يَقۡطَعُونَ وَادِيًا إِلَّا كُتِبَ لَهُمۡ -এর সম্পর্কে বলেন: যে জাতি আল্লাহর রাস্তায় তার পরিবার থেকে যত দুরে থাকে এতে সে আল্লাহর ততই নিকটবর্তী হয়।
﴿وَمَا كَانَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لِيَنفِرُواْ كَآفَّةٗۚ فَلَوۡلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرۡقَةٖ مِّنۡهُمۡ طَآئِفَةٞ لِّيَتَفَقَّهُواْ فِي ٱلدِّينِ وَلِيُنذِرُواْ قَوۡمَهُمۡ إِذَا رَجَعُوٓاْ إِلَيۡهِمۡ لَعَلَّهُمۡ يَحۡذَرُونَ ١٢٢ ﴾ [التوبة: ١٢٢]
“১২২. আর মুমিনদের জন্য সংগত নয় যে, তারা সকলে একসঙ্গে অভিযানে বের হবে। অতঃপর তাদের প্রতিটি দল থেকে কিছু লোক কেন বের হয় না, যাতে তারা দীনের গভীর জ্ঞান আহরণ করতে পারে এবং আপন সম্প্রদায় যখন তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে, তখন তাদেরকে সতর্ক করতে পারে, যাতে তারা (গুনাহ থেকে) বেঁচে থাকে।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১২২]
এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে বিবরণ যে, আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করেন গোত্রগুলো যেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তাবুক যুদ্ধে বের হয়। কতক পূর্বসূরি আলেম মত ব্যক্ত করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন যুদ্ধে বের হন তখন প্রতিটি মুসলিমের উপর আবশ্যক হল তাঁর সাথে বের হওয়া।
আর আমরা বলতে পারি: এটা সকল গোত্রের বের হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ। অন্ততপক্ষে প্রতিটি গোত্রের ক্ষুদ্র একটি দলের জিহাদে যাওয়ার আবশ্যক হওয়ার বর্ণনা। যারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে জিহাদে বের হয়েছে (তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি দল) রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অধ্যয়ন করবে। আর যখন তারা তাদের (বাকি) লোকদের নিকট ফিরে আসবে তখন তাদেরকে এই যুদ্ধ সম্পর্কে সতর্ক করবে। অতএব এই দলটি যারা লোকদের সাথে জিহাদে বের হয়েছে তাদের মাঝে দু’টি বিষয় একত্রিত হয়েছে আর তা হচ্ছে: জিহাদ এবং ওহীর জ্ঞান অধ্যয়ন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর প্রতিটি গোত্রের ক্ষুদ্র একটি দল তারা দু’টির যে কোনো একটি অর্জনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ব। তা হল- ১. জিহাদ ২. দ্বীনের জ্ঞান অর্জন। এ কারণে প্রতিটি মুসলিম সমাজের উপর জিহাদ ফরযে কিফায়া।
আলী ইবনে আবু তালহা ইবনে আব্বাস থেকে এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: وَمَا كَانَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لِيَنفِرُواْ كَآفَّةٗۚ “মু’মিনদের জন্য আবশ্যক নয় যে তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একাকী ফেলে সকলেই (জিহাদে) বেরিয়ে পড়বে।” فَلَوۡلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرۡقَةٖ مِّنۡهُمۡ طَآئِفَةٞ অর্থাৎ ক্ষুদ্র একটি দল। তারা কেবল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতি সাপেক্ষেই জিহাদে বের হবে। অতঃপর যখন এই দলটি রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে আসবে, আর তাদের বের হয়ে যাবার পর কুরআনের যে অংশ অবতীর্ণ হয়েছে রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে বসে থাকা লোকেরা তা শিক্ষা অর্জন করবে। আর তারা বলবে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের নবীর উপর কুরআন (এর কিছু অংশ) অবতীর্ণ করেছেন আর তা আমরা শিখে নিয়েছি। ফলে (ফিরে আসা) দলটি অবস্থান করবে আর তাদের পরে (অনুপস্থিত থাকাকালিন সময়ে) রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা তারা শিক্ষা অর্জন করবে। আর অপর একটি দলকে রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের জন্য প্রেরণ করবেন। আর তাই হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার বাণী: لِّيَتَفَقَّهُواْ فِي ٱلدِّينِ তারা শিক্ষা অর্জন করবে যা তাদের নবীর উপর প্রেরিত হয়েছে। আর যুদ্ধে প্রেরিত দলকে শিক্ষা দিবে যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে। لَعَلَّهُمۡ يَحۡذَرُونَ “যাতে তারা (গুনাহ থেকে) বেঁচে থাকে।”
মুজাহিদ বলেন: এই আয়াতটি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কতক সাহাবীর ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়, যারা মরু অঞ্চলে গিয়েছিল আর তার অধিবাসীদের থেকে ভালো ব্যবহার পেয়েছিল। আর ভূমি ছিল উর্বর যার দ্বারা তারা তার উপকার অর্জন করেছিল। তারা লোকদের মাঝে যাদেরকে পেয়েছিল (ইসলামের) দাওয়াত দিয়েছিল। লোকেরা তাদেরকে বলল: আমরাতো দেখছি তোমরা তোমাদের সাথীকে ফেলে আমাদের নিকট এসেছ। এতে তারা নিজেদের মাঝে মন্দ দেখতে পেল। ফলে তারা সকলে (ঐ) মরু অঞ্চল থেকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে আসল। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করলেন: فَلَوۡلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرۡقَةٖ مِّنۡهُمۡ طَآئِفَةٞ কল্যাণ কামনা করে। لِّيَتَفَقَّهُواْ فِي ٱلدِّينِ লোকদের নিকট যা রয়েছে তা শ্রবণ করে وَلِيُنذِرُواْ قَوۡمَهُمۡ সকল লোকদেরকে যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসে إِذَا رَجَعُوٓاْ إِلَيۡهِمۡ لَعَلَّهُمۡ يَحۡذَرُونَ
কাতাদাহ এ আয়াত প্রসঙ্গে বলেন: এটা যখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাদের নবীর সাথে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিলেন। এ সময় একদল সাহাবী রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অবস্থান করে দীনের জ্ঞান অর্জন করবে। আরেক দল তাদের লোকদের নিকট যাবে আর তাদেরকে (আল্লাহর দিকে) আহ্বান করবে আর তাদেরকে তাদের সামনে আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করবে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: فَلَوۡلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرۡقَةٖ مِّنۡهُمۡ طَآئِفَةٞ -এ আয়াতটি জিহাদ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয় নি; কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আল্লাহর নিকট মুদার গোত্রের বিরুদ্ধে দুর্ভিক্ষের বদদো‘আ করলো, তাদের দেশে খরা দেখা দিল, তাদের মধ্য থেকে বিভিন্ন গোত্র যারা চরম দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছিল তারা গোটা জাতি একসাথে মদিনায় আসতে শুরু করল। তারা মিছেমিছি দাবি করল যে, তারা মুসলিম। এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীর উপর অত্যন্ত বোঝা হয়ে দাঁড়াল। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তার রাসূলকে আয়াত অবতীর্ণ করে জানিয়ে দিলেন যে, তারা মু’মিন নয়। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে তাদের সম্প্রদায়ের নিকট তাদেরকে ফেরত পাঠালেন আর তাদের (অন্যান্য) লোকদের সতর্ক করলেন যেন তারা যা করেছে তার পুনরাবৃত্তি না।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قَٰتِلُواْ ٱلَّذِينَ يَلُونَكُم مِّنَ ٱلۡكُفَّارِ وَلۡيَجِدُواْ فِيكُمۡ غِلۡظَةٗۚ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلۡمُتَّقِينَ ١٢٣﴾ [التوبة: ١٢٣]  
“১২৩. হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের নিকটবর্তী কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর এবং তারা যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়। আর জেনে রাখ, আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১২৩]
কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদের নির্দেশ পর্যায়ক্রমে অর্থাৎ প্রথমে কাছের তারপর দুরের:
আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণকে প্রথমে ইসলামী রাষ্ট্রের নিকটবর্তী অতঃপর তার দূরবর্তী স্থানের কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দিচ্ছেন। এ কারণে রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরব ভূ-খণ্ডের মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। যখন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ হয় আর আল্লাহ তাকে মক্কা, মদিনা, তায়েফ ইয়েমেন, ইয়ামামাহ, হিজর খাইবার, হাদরামাউত ছাড়াও আরব ভূ-খণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চল সমূহের উপর বিজয় দান করেন আর সকল আরব গোত্রগুলো থেকে লোকেরা দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে তখন ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন, যারা আরব ভূ-খণ্ডের নিকটতম অধিবাসী আর ইসলামের দিকে দাওয়াত প্রদানের ক্ষেত্রে (অন্যদের চেয়ে) অধিক উপযোগী। কেননা তারা ঐশী গ্রন্থের অধিকারী। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক পৌঁছেন অতঃপর লোকদের কষ্ট-ক্লেশ, ভূমির অনুর্বরতা আর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ায় সেখান থেকে তিনি ফিরে আসেন। আর এটা নবম হিজরিতে সংঘটিত হয়। দশম হিজরিতে তিনি বিদায় হজের জন্য ব্যস্ত থাকেন। তারপর তিনি বিদায় হজের একাশি দিন পর ঊর্ধ্বজগতের পরমবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে নশ্বর জগত ত্যাগ করেন। তাঁর উপর আল্লাহর সালাত ও সালামের ধারা অব্যাহত থাকুক। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহচর, বন্ধু ও প্রতিনিধি আবু বকরকে নেতৃত্বের জন্য চয়ন করেন। সে সময় ইসলামের সামনে বহু আক্রমণ এবং তার পরাজয়ের উপক্রম হয়। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তার দীনকে তাঁর (আবু বকরের) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি তার ভিত্তি সুদৃঢ় করেন। অবাধ্য ধর্মত্যাগীদেরকে দ্বীনের প্রতি ফিরিয়ে আনেন। আর ঐ সকল নির্বোধদের নিকট থেকে যাকাত আদায় করেন যারা তা দিতে অস্বীকার করেছিল। তিনি সত্যকে তাদের সামনে উপস্থাপন করেন যারা সে ব্যাপারে অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। রাসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে যে দায়িত্ব তাঁর কাঁধে আসে তা পালন করেন। অতঃপর তিনি ইসলামী সৈন্যদেরকে ক্রুশের পূজারি রোম আর অগ্নিপুজারী পারস্যদের বিরুদ্ধে সুসজ্জিত করেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর এই অভিযানের বরকতে (এই ভূ-খণ্ডের) উপর বিজয় দান করেন। আর রোম ও পারস্য সম্রাট এবং এদের অনুগতদের অনেককে পরাজিত করেন আর এ থেকে অর্জিত ধনসম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে দেন। যেমন এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন। এই অভিযান অব্যাহত থাকে তার নির্বাচিত প্রতিনিধি যিনি পরবর্তীতে (মসজিদের) মিহরাবে শাহাদাত বরণ করেন আবু হাফ্স ওমর ইবনুল খাত্তাবের নেতৃত্বে। আল্লাহ তা‘আলা তার দ্বারা নাস্তিকদের শায়েস্তা করেন ও অবাধ্য মুনাফিকদের দমন করেন। বিশ্বের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভূ-খণ্ডের উপর কর্তৃত্ব দান করেন। দূরের এবং নিকটের সমস্ত অঞ্চল থেকে ধনভাণ্ডার তার নিকট বহন করে আনা হয়। অতঃপর শরী‘আতসম্মতভাবে ও সন্তোষজনক উপায়ে সেগুলোকে বণ্টন করে দেন। অতঃপর মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের পর যখন তিনি শাহাদাত বরণ করেন তখন মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণ উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর খিলাফতের উপর ঐক্যমত্য পোষণ করেন। তিনি গৃহবন্দী অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর খিলাফতকালে ইসলাম নেতৃত্বের প্রশস্ত পরিচ্ছদ পরিধান করে আর পৃথিবীর আনাচে কানাচে পূজারীদের কাঁধে আল্লাহর পরিপূর্ণ দলিল-প্রমাণাদি পৌঁছে যায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ইসলাম প্রচার লাভ করে। আল্লাহর বাণী সমুন্নত হয় আর তার দীন প্রকাশিত হয়। শত্রুদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তা‘আলার খাঁটি দীন এর গভীর লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। যখনই তারা কোনো পাপিষ্ঠ জাতির উপর বিজয় লাভ করে তখন তাঁরা তাদের পরে এরপর যারা রয়েছে তাদের দিকে ছুটে যায়। আল্লাহ তা‘আলার এই আদেশ পালনার্থে। يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قَٰتِلُواْ ٱلَّذِينَ يَلُونَكُم مِّنَ ٱلۡكُفَّارِ “হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের নিকটবর্তী কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর।”
আল্লাহ তা’আলার বাণী- وَلۡيَجِدُواْ فِيكُمۡ غِلۡظَةٗۚ “কাফেররা যেন তোমাদের থেকে তাদের উপর তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের লড়াইয়ে কঠোরতা পায়।” কেননা পূর্ণাঙ্গ মু’মিন তো সেই, যে তার মু’মিন ভাইয়ের প্রতি হয় নম্র এবং কাফের শত্রুর উপর হয় কঠোর। এটা আল্লাহ তা‘আলার সে বাণীর মত, যাতে তিনি বলেন, ﴿أَذِلَّةٍ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى ٱلۡكَٰفِرِينَ ٥٤﴾ (المائ‍دة: ٥٤  অনুরূপ আল্লাহ বলেন, ﴿أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ ٢٩﴾ (الفتح: ٢٩ তাছাড়া আল্লাহ বলেন, ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ جَٰهِدِ ٱلۡكُفَّارَ وَٱلۡمُنَٰفِقِينَ وَٱغۡلُظۡ عَلَيۡهِمۡۚ﴾ (التحريم: ٩ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি হাস্য-রসকারী স্বীয় বন্ধুদের সাথে এবং হত্যাকারী দুশমনদের। অর্থাৎ বন্ধুদের মুখে হাসি কিন্তু শত্রুদের মাথার খুলি উড়াই।
আর আল্লাহর বাণী, “আর জেনে রাখ নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের সাথে রয়েছেন” অর্থাৎ তোমরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধ কর এবং আল্লাহর উপর ভরসা কর, আর জেনে রাখ যে, আল্লাহ তোমাদের সাথে রয়েছেন [জ্ঞানে ও সাহায্য-সহযোগিতায়] যদি তোমরা তাঁর তাকওয়া অবলম্বন কর, ও তাঁর অনুসরণ কর। আর এমনই অবস্থা ছিল প্রথম তিন শতাব্দীতে। তারা (এ শতাব্দীর মুসলিমগণ) দীনের উপর অবিচল ছিল আর আল্লাহর আনুগত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ছিল এ জাতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তারা তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেই চলেছিল। এ সময় বহু সাম্রাজ্য ইসলামী শাসনের আওতায় আসতে থাকে। আর ইসলামের শত্রুদের ক্ষতি সাধিত হতেই থাকে।
অতঃপর যখন ইসলামী সাম্রাজ্যগুলোর শাসকদের মাঝে দ্বন্দ্ব-কলহ, প্রবৃত্তির অনুসরণ আর ফিৎনা-ফাসাদ ছড়িয়ে পড়ে, শত্রুরা তখন সাম্রাজ্যের সীমান্ত ফাঁড়িগুলোর প্রতি লোভী হয়ে উঠে এবং এ সময় মুসলিম শাসকদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব নিয়ে ব্যস্ততার কারণে এক রকম বিনাবাধায় ভূ-খণ্ডের দিকে অগ্রসর হয়। এভাবে চলতে থাকে। অবশেষ তারা অনেক মুসলিম রাষ্ট্র দখল করে নেয়। সমস্ত ব্যাপার আল্লাহর জন্য, শুরুতে এবং শেষেও। যখনই মুসলিম শাসকবৃন্দ উঠে দাঁড়াবে, আল্লাহর নির্দেশে মেনে নেবে আর তাঁর উপর ভরসা করবে তিনি তাদেরকে নিজ ক্ষমতাবলে তাদের দেশসমূহ (হাতছাড়া হয়ে যাওয়া) কাফের হাত থেকে ফিরিয়ে দিবেন। আর আল্লাহ তা‘আলা তো এ দায়িত্ব নিয়েছেন যে, তিনি তাঁর কাফের শত্রুদের থেকে মুসলিমগণকে সুদৃঢ় করবেন আর সমস্ত অঞ্চলগুলোতে তার বাণীকে সমুন্নত করবেন। নিশ্চয় তিনি অতিশয় দানশীল মর্যাদাবান।
﴿وَإِذَا مَآ أُنزِلَتۡ سُورَةٞ فَمِنۡهُم مَّن يَقُولُ أَيُّكُمۡ زَادَتۡهُ هَٰذِهِۦٓ إِيمَٰنٗاۚ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ فَزَادَتۡهُمۡ إِيمَٰنٗا وَهُمۡ يَسۡتَبۡشِرُونَ ١٢٤ وَأَمَّا ٱلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ فَزَادَتۡهُمۡ رِجۡسًا إِلَىٰ رِجۡسِهِمۡ وَمَاتُواْ وَهُمۡ كَٰفِرُونَ ١٢٥﴾ [التوبة: ١٢٤،  ١٢٥]  
“১২৪. আর যখনই কোনো সূরা নাযিল করা হয়, তখন তাদের কেউ কেউ বলে, ‘এটি তোমাদের কার ঈমান বৃদ্ধি করল’? অতএব যারা মু’মিন, নিশ্চয় তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়। ১২৫. আর যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, এটি তাদের অপবিত্রতার সাথে অপবিত্রতা বৃদ্ধি করে এবং তারা মারা যায় কাফির অবস্থায়।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১২৪]
মুমিনের ঈমান বাড়ে ও কমে আর মুনাফিকদের সংশয় সন্দেহ বৃদ্ধি পায়:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: وَإِذَا مَآ أُنزِلَتۡ سُورَةٞ “আর যখনই কোনো সূরা নাযিল করা হয়” মুনাফিকদের মধ্য থেকে فَمِنۡهُم مَّن يَقُولُ أَيُّكُمۡ زَادَتۡهُ هَٰذِهِۦٓ إِيمَٰنٗاۚ “তাদের কিছুসংখ্যক লোক অন্যদের বলে এ সূরা তোমাদের ঈমানের কী বৃদ্ধি করেছে?” এই আয়াত সবচেয়ে বড় প্রমাণ তাদের জন্য যারা বলে ঈমান কমে ও বাড়ে। পূর্ব ও পরবর্তী আলেমগণেরও এই মত। এ ছাড়াও একাধিক ব্যক্তি এর উপর ঐকমত্য হওয়ার বিষয়টি বর্ণনা করেছেন।
 وَأَمَّا ٱلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ فَزَادَتۡهُمۡ رِجۡسًا إِلَىٰ رِجۡسِهِمۡ “আর যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, এটি তাদের অপবিত্রতার সাথে অপবিত্রতা বৃদ্ধি করে” অর্থাৎ তাদের সংশয় সন্দেহের সাথে আরও সংশয়-সন্দেহ বেড়ে যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿ وَٱلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ فِيٓ ءَاذَانِهِمۡ وَقۡرٞ وَهُوَ عَلَيۡهِمۡ عَمًىۚ﴾ [فصلت: ٤٤]   “আর যারা ঈমান আনে না তাদের কানে রয়েছে বধিরতা আর কুরআন তাদের জন্য হবে অন্ধত্ব।” [সূরা ফুস্সিলাত: ৩৩] এটা তাদের দুর্ভাগ্যের সার্বিক আলোচনা যে, যখন তাদের অন্তর সঠিক পথের সন্ধান পায় না তখন সেটা তাদের গোমরাহি ও ধ্বংসের কারণ হিসেবে গণ্য হয়। যেমন কেউ অল্প সময়ের কোনো প্রকার খাদ্যে বিগড়ে যায়, তাহলে তো সে আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে, যখন তা সে আবারও আহার করবে।
﴿أَوَلَا يَرَوۡنَ أَنَّهُمۡ يُفۡتَنُونَ فِي كُلِّ عَامٖ مَّرَّةً أَوۡ مَرَّتَيۡنِ ثُمَّ لَا يَتُوبُونَ وَلَا هُمۡ يَذَّكَّرُونَ ١٢٦ وَإِذَا مَآ أُنزِلَتۡ سُورَةٞ نَّظَرَ بَعۡضُهُمۡ إِلَىٰ بَعۡضٍ هَلۡ يَرَىٰكُم مِّنۡ أَحَدٖ ثُمَّ ٱنصَرَفُواْۚ صَرَفَ ٱللَّهُ قُلُوبَهُم بِأَنَّهُمۡ قَوۡمٞ لَّا يَفۡقَهُونَ ١٢٧﴾ [التوبة: ١٢٦،  ١٢٧]  
“১২৬. তারা কি দেখে না যে, তারা প্রতি বছর এক বার কিংবা দু’বার বিপদগ্রস্ত হয়? এর পরও তারা তাওবাহ করে না এবং উপদেশ গ্রহণ করে না। ১২৭. আর যখনই কোনো সূরা নাযিল করা হয়, তারা একে অপরের দিকে তাকায়। (এবং বলে) ‘তোমাদেরকে কি কেউ দেখছে’? অতঃপর তারা (চুপিসারে) প্রস্থান করে। আল্লাহ তাদের হৃদয়কে সত্যবিমুখ করে দেন। এ কারণে যে, তারা বোধশক্তিহীন কওম।” [সুরা আত-তাওবাহ: ১২৬-১২৭]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ঐ সমস্ত মুনাফিকরা কি দেখে না أَنَّهُمۡ يُفۡتَنُونَ “পরীক্ষিত হয়” فِي كُلِّ عَامٖ مَّرَّةً أَوۡ مَرَّتَيۡنِ ثُمَّ لَا يَتُوبُونَ وَلَا هُمۡ يَذَّكَّرُونَ “তারা তাদের কৃত পূর্বের গোনাসমূহ থেকে তাওবাহ করে না আর ভবিষ্যতেও উপদেশ গ্রহণ তাদের অবস্থা সমূহ থেকে করে না।” মুজাহিদ বলেন: তারা (মুনাফিকরা) পরীক্ষিত হয় দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধার মাধ্যমে। কাতাদা বলেন, বৎসরে একবার বা দুইবার যুদ্ধ দ্বারা পরীক্ষিত হয়।
এখানেوَإِذَا مَآ أُنزِلَتۡ سُورَةٞ نَّظَرَ بَعۡضُهُمۡ إِلَىٰ بَعۡضٍ মুনাফিকদের সম্পর্কে সংবাদ দেওয়া হচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যখন কোনো সূরা অবতীর্ণ হয় তখন نَّظَرَ بَعۡضُهُمۡ إِلَىٰ بَعۡضٍ “একে অপরের দিকে তাকায়।” সত্য থেকে ফিরে যায়। আর এটা দুনিয়াতে তাদের অবস্থা। সত্যের সময় তারা দৃঢ় থাকে না, তারা তা গ্রহণ করে না এবং তারা তা অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী: هَلۡ يَرَىٰكُم مِّنۡ أَحَدٖ ثُمَّ ٱنصَرَفُواْ “ঐ সম্প্রদায়ের কী হল যারা তোমার নিকট থেকে সত্য থেকে পলায়ন করে এবং মিথ্যার উদ্দেশ্যে ডানে ও বামে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়।”﴿فَمَا لَهُمۡ عَنِ ٱلتَّذۡكِرَةِ مُعۡرِضِينَ ٤٩ كَأَنَّهُمۡ حُمُرٞ مُّسۡتَنفِرَةٞ ٥٠﴾ [المدثر: ٤٩،  ٥٠]   তারা যেন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পলায়নরত বন্য গাধা আর তাদের কী হয়েছে যে, তারা উপদেশ বাণী হতে বিমুখ?” [সূরা আল-মুদ্দাছির: ৪৯-৫০]  আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ثُمَّ ٱنصَرَفُواْۚ صَرَفَ ٱللَّهُ قُلُوبَهُم “অতঃপর তারা (চুপিসারে) প্রস্থান করে।” অপর আয়াত ﴿فَلَمَّا زَاغُوٓاْ أَزَاغَ ٱللَّهُ قُلُوبَهُمۡۚ﴾ [الصف: ٥]   এর মত। আল্লাহর বাণী  بِأَنَّهُمۡ قَوۡمٞ لَّا يَفۡقَهُون “তারা আল্লাহর বাণী বুঝে না” আর তারা তা বুঝতে উদ্যোগীও হয় না, তারা তা কামনাও করে না; বরং তা থেকে ব্যস্ততা দেখায় এবং চলে যায়। ফলে এই অবস্থায় তাদের পরিসমাপ্তি ঘটে।
﴿لَقَدۡ جَآءَكُمۡ رَسُولٞ مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ عَزِيزٌ عَلَيۡهِ مَا عَنِتُّمۡ حَرِيصٌ عَلَيۡكُم بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ رَءُوفٞ رَّحِيمٞ ١٢٨ فَإِن تَوَلَّوۡاْ فَقُلۡ حَسۡبِيَ ٱللَّهُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۖ عَلَيۡهِ تَوَكَّلۡتُۖ وَهُوَ رَبُّ ٱلۡعَرۡشِ ٱلۡعَظِيمِ ١٢٩﴾ [التوبة: ١٢٨،  ١٢٩]  
“১২৮. নিশ্চয় তোমাদের নিজদের মধ্য থেকে তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন, তা তার জন্য কষ্টদায়ক যা তোমাদেরকে পীড়া দেয়। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মু’মিনদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু। ১২৯. অতঃপর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে বল, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। আমি তাঁরই উপর তাওয়াক্কুল করেছি। আর তিনিই মহাআরশের রব’।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১২৮-১২৯]
আল্লাহ তা’আলা মু’মিনদের প্রতি তাদের নিজেদের থেকে স্বীয় ভাষায় রাসূল প্রেরণ করার কথা বলেন। যেমনটি ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বলেছিলেন। বলেন, ﴿رَبَّنَا وَٱبۡعَثۡ فِيهِمۡ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ﴾ [البقرة: ١٢٩]   “হে আমার রব! তুমি তাদের থেকে তাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ কর।” [সূরা আল-বাকারা: ১২৯]
﴿لَقَدۡ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ بَعَثَ فِيهِمۡ رَسُولٗا مِّنۡ أَنفُسِهِمۡ﴾ [ال عمران: ١٦٤]  “আল্লাহ তা’আলা মু’মিনদের প্রতি দয়া করেছেন -তিনি তাদের থেকে তাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন।” [সূরা আলে ইমরান: ১৬৪]
আল্লাহ বলেন, لَقَدۡ جَآءَكُمۡ رَسُولٞ مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ “নিশ্চয় তোমাদের নিজদের মধ্য থেকে তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন” তোমাদের শ্রেণি থেকে তোমাদের ভাষায়। আল্লাহ তা‘আলার বাণী: عَزِيزٌ عَلَيۡهِ مَا عَنِتُّمۡ ِ “তার উপর এমন বিষয় কষ্টদায়ক মনে হয় যা তার উম্মতকে ক্ষতি করে এবং তাদের উপর কঠিন হয়।” সহীহ বর্ণনায় আছে নিশ্চয় এই দ্বীন সহজ আর এর শরীয়ত সবটুকুই সম্পূর্ণ সরল ও উদার। আল্লাহ তা‘আলা যার উপর তা সহজ করেন তার উপর তা সহজ। حَرِيصٌ عَلَيۡكُم অর্থাৎ তোমাদের হেদায়াতের এবং তোমাদের প্রতি দুনিয়া ও আখিরাতের উপকার পৌঁছানোর উপর তিনি যত্নবান।
ইমাম আহমাদ রহ. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ হতে বর্ণনা করেন তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা‘আলা কোনো বিষয় তখন হারাম করেন যখন তিনি জানেন যে, তা অচিরেই কোনো অবগতকারী তোমাদেরকে অবগত করাবে। মনে রাখবে, আমি তোমাদের কোমর টেনে ধরব, যাতে তোমরা আগুনে ছিটকে না পড় যেভাবে মশা মাছি আগুনে ছিটকে পড়ে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ رَءُوفٞ رَّحِيمٞ আল্লাহর অপর বাণী ﴿وَٱخۡفِضۡ جَنَاحَكَ لِمَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٢١٥﴾ [الشعراء: ٢١٥]   -এর মতই। আর এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা এ কথারই নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী: فَإِن تَوَلَّوۡاْ অর্থাৎ যে পূর্ণাঙ্গ পবিত্র ও মহান শরী‘আতসহ তুমি আগমন করেছ তা থেকে তারা ফিরে যায়। فَقُلۡ حَسۡبِيَ ٱللَّهُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۖ عَلَيۡهِ تَوَكَّلۡتُۖ  “তুমি তাদের বল, আল্লাহ যথেষ্ট তিনি ব্যতীত প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই, তার উপর আমরা ভরসা করি।” যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿رَّبُّ ٱلۡمَشۡرِقِ وَٱلۡمَغۡرِبِ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ فَٱتَّخِذۡهُ وَكِيلٗا ٩﴾ (المزمل:٩ “তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের রব, তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। সুতরাং তাঁকেই তুমি কার্য সম্পাদনকারীরূপে গ্রহণ কর।” [সূরা আল-মুযযাম্মিল: ৯]
আল্লাহ বলেন, وَهُوَ رَبُّ ٱلۡعَرۡشِ ٱلۡعَظِيمِ অর্থাৎ তিনি সকল কিছুর মালিক ও সৃষ্টিকর্তা। কেননা তিনি মহান আরশের রব। যে আরশ সকল সৃষ্টির ছাদ। আসমান ও জমিনসমূহ আর এতদুভয়ের মাঝখানের সকল সৃষ্টজীব আরশের তলদেশে রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতাবলে (এ সবকিছু) পরাস্ত। তাঁর জ্ঞান সকল কিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে। তার ক্ষমতা সকল বিষয়ে সফল। আর তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান।
ইমাম আহমাদ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে, তিনি উবাই ইবনে কা‘ব থেকে, তিনি (উবাই ইবনে কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: কুরআনের সর্বশেষ এই আয়াতটি সূরার শেষ পর্যন্ত অবতীর্ণ হয়। ইমাম আবু দাউদ আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে হাদিস বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি সকালে ও বিকালে حَسْبِيَ اللَّهُ، لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ، عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ، وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ -এ দো’আটি সাতবার পাঠ করবে, আল্লাহ তা’আলা যাবতীয় দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী দূর করে দেবেন।
সহীহ বর্ণনায় রয়েছে: যায়েদ বলেন: সূরা তাওবার শেষ (অংশ) খুযায়মা ইবনে সাবেত অথবা আবু খুযাইমার নিকট পাই। পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একদল সাহাবী তা রাসূলুল্লাহ‌্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে উল্লেখ করেছেন যেমন খুযাইমাহ ইবন সাবেত বলেন যখন তিনি তাদের নিকট তা আরম্ভ করেন।  আর আল্লাহ তা‘আলা ভালো জানেন।

 

সূরা আত-তাওবার তাফসীর

বই সম্পর্কে

লেখক :

Imam Ibn Kathir

প্রকাশক :

www.islamland.com

বিভাগ :

About Quran & Hadith