Паёмбаратро Бишнос

যে কাজে সময় ও সুযোগ ব্যয় করা হয়, তন্মধ্যে সবচেয়ে সুবর্ণ সময় হলো যা পবিত্র সীরাতুন্নবী ও চিরস্থায়ী মুহাম্মাদী ইতিহাস অধ্যয়নে ব্যয় করা হয়। আর এ পুস্তিকাটি হচ্ছে সীরাতুন্নবী সম্পর্কে, যা অধ্যয়নের মধ্যে মুসলিম ব্যক্তি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবে, জানতে পারবে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্ব, তাঁর জীবন ও বসবাসের পদ্ধতি এবং সন্ধি ও যুদ্ধের সময়কার তাঁর দাওয়াতের রীতি-পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে।


চিনে নাও তুমি তোমার নবী
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে

[ بنغالي –  Bengali – বাংলা ]

 


        

ড. আদেল আশ-শিদ্দী
ড. আহমাদ আল-মাযইয়াদ


অনুবাদ: ড. মো: আমিনুল ইসলাম
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

 

أعرف نبيك

    
عادل بن علي الشدي
أحمد بن عثمان المزيد



ترجمة: د/ محمد أمين الإسلام
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
সূচীপত্র

الصفحة    العنوان    م
    ভূমিকা    ১
    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশ    ২
    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামসমূহ    ৩
    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশের পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা    ৪
    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম    ৫
    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতার মৃত্যু    ৬
    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুধ পান    ৭
    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মায়ের মৃত্যু    ৮
    আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জাহেলিয়্যাতের কালিমা থেকে সুরক্ষা    ৯
    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবাহ    ১০
    খাদিজা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার মৃত্যু    ১১
    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তান-সন্ততি    ১২
    তাঁর পুত্র সন্তানগণ    ১৩
    তাঁর কন্যা সন্তানগণ    ১৪
    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবু্ওয়াত    ১৫
    নিদারুন কষ্টে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধৈর্য    ১৬
    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাওমের প্রতি তাঁর দয়া ও অনুকম্পা    ১৭
    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায় হিজরত    ১৮
    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুদ্ধসমূহ    ১৯
    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হজ ও ওমরা    ২০
    নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৈহিক আকৃতি    ২১
    কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা    ২২


ভূমিকা
بسم الله الرحمن الرحيم
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদের জন্য হিদায়াতের পথকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন এবং আমাদের দৃষ্টি থেকে ভ্রষ্টতার অন্ধকারকে দূর করে দিয়েছেন, আর দুরূদ ও সালাম নবী মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি, যাকে গোটা সৃষ্টি জগতের জন্য ‘রহমত’স্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছে এবং যাকে পাঠানো হয়েছে অনুসরণকারীদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে, আর সালাত ও সালাম বর্ষিত হউক তাঁর পরিবার-পরিজন ও সঙ্গী-সাথীদের ওপর এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা তাদেরকে অত্যন্ত চমৎকার ও সুন্দরভাবে অনুসরণ করবে তাদের ওপরও।

অতঃপর.......
হে মুসলিমগণ! যে কাজে সময় ও সুযোগ ব্যয় করা হয়, তন্মধ্যে সবচেয়ে সুবর্ণ সময় হলো যা পবিত্র সীরাতুন্নবী ও চিরস্থায়ী মুহাম্মাদী ইতিহাস অধ্যয়নে ব্যয় করা হয়। কারণ, তা মুসলিম ব্যক্তিকে এমনভাবে প্রস্তুত করে ফেলে, মনে হয় যেন সে ঐসব মহান ঘটনাবহুল দিনগুলোর মধ্যে জীবনযাপন করে, যে দিনগুলো মুসলিমগণ অতিক্রম করে এসেছে। আবার কখনও কখনও সে কল্পনা করে যে, সে ঐসব পুণ্যবান ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত একজন, যাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মর্যাদার সুউচ্চ প্রাসাদ এবং বীরত্বের অহংকার।

* সীরাত অধ্যয়নের মধ্যে মুসলিম ব্যক্তি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবে, জানতে পারবে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে, তাঁর জীবন ও বসবাসের পদ্ধতি সম্পর্কে এবং সন্ধি ও যুদ্ধের সময়কার তাঁর দাওয়াতের রীতি-পদ্ধতি সম্পর্কে।
* সীরাতের মধ্যে মুসলিম ব্যক্তি আরও অনুসন্ধান করবে দুর্বলতা ও শক্তিমত্তার পয়েন্ট বা সূত্রগুলো, আর অনুসন্ধান করবে জয় ও পরাজয়ের কারণগুলো এবং খুঁজে বেড়াবে বড় বড় ঘটনাগুলো মুকাবিলা করার ধরন-পদ্ধতি।
* সীরাতুন্নবী অধ্যয়নের মাধ্যমে মুসলিমগণ তাদের নিজেদের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাসকে ফিরিয়ে আনবে এবং তারা বিশ্বাস করতে শিখবে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের সাথে আছেন এবং তিনি তাদেরকে সাহায্য করবেন, যদি তারা সত্যিকারভাবে আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাঁর শরী‘আতের প্রতি আত্মসমর্পণ করে। আল-কুরআনের ভাষায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِن تَنصُرُواْ ٱللَّهَ يَنصُرۡكُمۡ وَيُثَبِّتۡ أَقۡدَامَكُمۡ ٧﴾ [محمد: ٧]
“যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তবে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা বা কদমসমূহ সুদৃঢ় করবেন।” [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৭]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿إِنَّا لَنَنصُرُ رُسُلَنَا وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَيَوۡمَ يَقُومُ ٱلۡأَشۡهَٰدُ ٥١﴾ [غافر: ٥١]
“নিশ্চয় আমরা আমাদের রাসূলগণকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সাহায্য করব দুনিয়ার জীবনে, আর যেদিন সাক্ষীগণ দাঁড়াবে।” [সূরা গাফির, আয়াত: ৫১]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿وَلَيَنصُرَنَّ ٱللَّهُ مَن يَنصُرُهُۥٓۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ ٤٠﴾ [الحج: ٤٠]
“আর নিশ্চয় আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন, যে আল্লাহকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী।” [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৪০]

* আর এ পৃষ্ঠাগুলো নবী মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত বা জীবন প্রসঙ্গে সহজ বাক্যে কিছু মৌলিক লেখা, যার দ্বারা উদ্দেশ্যে হলো মুসলিম তরুণ ও যুবকদের সামনে এ চিরস্থায়ী ‘সীরাতুন্নবী’ তথা নবী জীবনী সম্পর্কে গভীর অধ্যয়নের পথ খুলে দেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مُّحَمَّدٞ رَّسُولُ ٱللَّهِۚ﴾ [الفتح: ٢٩]
“মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।” [সূরা আল-ফাতহ, আয়াত: ২৯]

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশ:
তিনি হলেন আবুল কাসেম মুহাম্মাদ ইবন আবদিল্লাহ ইবন আবদিল মুত্তলিব ইবন হাশিম ইবন আবদে মান্নাফ ইবন কুসাই ইবন কিলাব ইবন মুররাহ ইবন কা‘ব ইবন লুয়াই ইবন ফিহর ইবন মালেক ইবন নদ্বর ইবন কেনানা ইবন খুযাইমা ইবন মুদরিকা ইবন ইলিয়াস ইবন মুদার ইবন নিযার ইবন মা‘আদ ইবন ‘আদনান। এটা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশধারার ব্যাপারে ঐতিহাসিকগণের ঐক্যবদ্ধ মত। আর তারা এ ব্যাপারেও একমত যে, ‘আদনান ছিলেন ইসমাঈল আলাইহিস সালামের সন্তান।

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামসমূহ:
জুবায়ের ইবন মুত‘য়ীম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ لِي أَسْمَاءً ، أَنَا مُحَمَّدٌ ، وَأَنَا أَحْمَدُ ، وَأَنَا الْمَاحِي الَّذِي يَمْحُو اللَّهُ بِيَ الْكُفْرَ ، وَأَنَا الْحَاشِرُ الَّذِي يُحْشَرُ النَّاسُ عَلَى قَدَمَيَّ ، وَأَنَا الْعَاقِبُ الَّذِي لَيْسَ بَعْدَهُ أَحَدٌ».
“আমার কতগুলো নাম রয়েছে: আমি মুহাম্মাদ, আমি আহমাদ, আমি আল-মাহী (নিশ্চিহ্নকারী), আমাকে দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা কুফরীকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। আমি আল-হাশের (সমবেতকারী কিয়ামতের ভয়াবহ দিনে), আমার পায়ের কাছে হাশরের দিন জনগণকে একত্রিত করা হবে, আর আমি হলাম আল-‘আকেব (সর্বশেষ আগমনকারী নবী), যার পরে আর কোনো নবী-রাসূল নেই।”
আর আবু মূসা আল-আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُسَمِّى لَنَا نَفْسَهُ أَسْمَاءً ، فَقَالَ : « أَنَا مُحَمَّدٌ ، وَأَحْمَدُ ، وَالْمُقَفِّى ، وَالْحَاشِرُ ، وَنَبِىُّ التَّوْبَةِ ، وَنَبِىُّ الرَّحْمَةِ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং আমাদের জন্য তাঁর কতগুলো নামের উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেছেন: আমি ‘মুহাম্মাদ’, ‘আহমাদ’, ‘আল-মুকাফ্ফী’ (অনুসরণকারী), ‘আল-হাশের’ (কিয়ামতের ভয়াবহ দিনে সমবেতকারী), ‘নাবিউত তাওবা’ (তাওবার নবী) এবং ‘নাবিউর রাহমা’ (রহমত তথা দয়ার নবী)।”
 
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশের পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা:
জেনে রাখুন, আল্লাহ আমাকে ও আপনাকে রহম করুন -আমাদের নবী মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন সকল মানুষের সেরা। আল্লাহ তাঁর পিতাকে ব্যভিচারের কলঙ্ক থেকে রক্ষা করেছেন এবং সঠিক বিবাহবন্ধন থেকেই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মেছেন এবং কোনো প্রকার যিনা-ব্যভিচার থেকে তাঁর জন্ম হয় নি। কারণ, ওয়াছেলা ইবনুল আসকা‘ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى كِنَانَةَ مِنْ بَنِي إِسْمَاعِيلَ ، وَاصْطَفَى مِنْ بَنِي كِنَانَةَ قُرَيْشًا ، وَاصْطَفَى مِنْ قُرَيْشٍ بَنِي هَاشِمٍ ، وَاصْطَفَانِي مِنْ بَنِي هَاشِمٍ».
“আল্লাহ তা‘আলা ইসমাঈলের বংশ থেকে কেনানাকে নির্বাচন করেছেন, আর কেনানার বংশ থেকে কুরাইশ বংশকে নির্বাচন করেছেন, আর কুরাইশ বংশ থেকে বনু হাশিমকে নির্বাচন করেছেন, আর বনু হাশিম থেকে আমাকে নির্বাচন করেছেন।”  
আর যখন রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস (হিরাকল) আবু সুফিয়ানকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশ সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন, তখন জবাবে তিনি বললেন,
«هُوَ فِينَا ذُو نَسَبٍ ، فقَال هرقل: كَذَلِكَ الرُّسُلُ تُبْعَثُ فِي نَسَبِ قَوْمِهَا».
“তিনি আমাদের মধ্যে অতি সম্ভ্রান্ত বংশের। তখন হিরাক্লিয়াস বললেন: এভাবে রাসূলগণকে তাদের সম্প্রদায়ের সেরা বংশেই প্রেরণ করা হয়।”  

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম:
রবিউল আওয়াল মাসের সোমবারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি রবিউল আওয়াল মাসের ২ তারিখ জন্মগ্রহণ করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেন, রবিউল আওয়াল মাসের ৮ তারিখ জন্মগ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ বলেন, দশম তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন। কেউ বলেন, ১২ তারিখ জন্মগ্রহণ করেছেন। ইবন কাসীর রহ. বলেন, বিশুদ্ধ কথা হলো তিনি হস্তির বর্ষে জন্মগ্রহণ করেছেন। (অর্থাৎ যে বছর আবরাহা বাদশাহ হাতি নিয়ে মক্কা আক্রমণ করতে এসেছিল সে বছর) ঐক্যবদ্ধভাবে এ তথ্য পেশ করেছেন ইমাম বুখারী রহ.-এর ওস্তাদ ইবরাহীম ইবন মুনযির আল-হাযেমী ও খলিফা ইবন খাইয়াত প্রমুখ।  

* ঐতিহাসিকগণ বলেন: যখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মাতা আমেনার গর্ভে তখন তিনি (আমেনা) বলেন, আমি তাঁর কারণে কোনো কষ্ট অনুভব করি নি। অতঃপর যখন সে জন্ম লাভ করে, তখন তাঁর সাথে এমন এক আলো বের হয়ে আসে, যা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত গোটা দুনিয়া আলোকিত করে দেয়।  

* আর ‘ইরবাদ ইবন সারিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে আছে, তিনি বলেন,
«سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ : «إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ فِي أُمِّ الْكِتَابِ لَخَاتَمُ النَّبِيِّينَ، وَإِنَّ آدَمَ لَمُنْجَدِلٌ فِي طِينَتِهِ، وَسَأُنَبِّئُكُمْ بِتَأْوِيلِ ذَلِكَ : دَعْوَةِ أَبِي إِبْرَاهِيمَ، وَبِشَارَةِ عِيسَى قَوْمَهُ ، وَرُؤْيَا أُمِّي الَّتِي رَأَتْ ، أَنَّهُ خَرَجَ مِنْهَا نُورٌ أَضَاءَتْ لَهُ قُصُورُ الشَّامِ».
“আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: ‘আমি আসমানী কিতাবের মধ্যে আল্লাহর বান্দা সর্বশেষ নবী হিসেবে স্বীকৃত, তখনও আদম আলাইহিস সালাম তাঁর মাটির মধ্যে মিশে আছেন। আমি তোমাদেরকে অবশ্যই এর ব্যাখ্যা দেব: ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দো‘আ, ‘ঈসা আলাইহিস সালাম কর্তৃক তাঁর কাওমের কাছে দেওয়া (আমার) সুসংবাদ এবং আমার মায়ের দেখা স্বপ্ন -তিনি দেখেন যে, তার থেকে এমন এক আলো বের হয়েছে, যার কারণে শাম দেশের প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে গেছে।”

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতার মৃত্যু:
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মায়ের গর্ভে থাকাবস্থায় তাঁর পিতা মারা যান। কেউ বলেন, তাঁর জন্মের একমাস পর তাঁর পিতা মারা যান, তবে প্রথম তথ্যটিই প্রসিদ্ধ।

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুধ পান:
তাঁকে আবু লাহাবের দাসী সুয়াইবা কিছুদিন দুধ পান করান, অতঃপর বনু সা‘দ গোত্রে তাঁকে দুধ পান করানোর জন্য আবেদন করা হয়, তারপর সেখানে হালিমাতুস সা‘দিয়া তাঁকে দুধ পান করান এবং তার নিকট তিনি বনু সা‘দ গোত্রে প্রায় চার বছর অবস্থান করেন, আর সেখানে তাঁর বক্ষ বা হৃদয় বিদীর্ণের ঘটনা ঘটে এবং তাঁর থেকে প্রবৃত্তি ও শয়তানের অংশ বের করে নেওয়া হয়; আর এ ঘটনার পরপরই হালিমা তাঁকে তাঁর মায়ের নিকট ফেরত দিয়ে আসেন।  
 
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মায়ের মৃত্যু:
অতঃপর তাঁর বয়স যখন ছয় বছর তখন তাঁর মাতা মক্কায় ফিরে আসার পথে ‘আবওয়া’ নামক স্থানে মারা যান, আর মক্কা বিজয়ের বছর যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আবওয়া’ স্থানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি তাঁর রবের নিকট তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন, তিনি তাঁকে যিয়ারতের অনুমতি প্রদান করেন, তারপর তিনি কাঁদেন এবং তাঁর আশেপাশে যারা ছিলেন তারাও কাঁদেন, আর তিনি বলেন,
«زُورُوا الْقُبُورَ فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الْمَوْتَ».
“তোমরা কবর যিয়ারত কর। কারণ, তা মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।”  

তারপর যখন তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়, তখন উম্মু আইমান তাঁকে তার কোলো আশ্রয় দেন, আর সে ছিল তাঁর পিতার নিকট থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া দাসী এবং তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স যখন আট বছরে উপনীত হয়, তখন তাঁর দাদা মারা যান এবং তাঁর ব্যাপারে তাঁর চাচা আবু তালিবের নিকট অসীয়ত করেন, তারপর তাঁর চাচা তাঁর অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর পরিপূর্ণভাবে দেখাশুনা করেন। আর যখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে নবুওয়াত দান করেন, তখন তিনি তাঁকে সাহায্য ও সমর্থন করেন এবং তিনি শির্কের ওপর অবিচল থাকা সত্ত্বেও মৃত্যু পর্যন্ত পূর্ণ সমর্থন দিয়ে গেছেন। ফলে এর কারণে আল্লাহ তার শাস্তিকে হালাকা করে দিয়েছেন, এ প্রসঙ্গে যেমনটি সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জাহেলিয়্যাতের কালিমা থেকে সুরক্ষা:
আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছোট বেলা থেকেই তাঁকে রক্ষা করেছেন এবং জাহেলিয়্যাতের কলঙ্ক ও যাবতীয় দোষ-ত্রুটি থেকে তাঁকে পবিত্র করেছেন, আর তাঁকে দান করেছেন সুন্দর চরিত্র, শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর জাতি ও সম্প্রদায়ের মাঝে ‘আল-আমীন’ (বিশ্বস্ত) বলে প্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। যখন তারা তাঁর পবিত্রতা, সততা ও আমানতদারীতার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছিল; এমনকি তাঁর ৩৫ বছর বয়সে যখন কুরাইশগণ কা‘বা ঘরের অবকাঠামো সংস্কারের ইচ্ছা করল এবং এক পর্যায়ে তারা ‘হাজরে আসওয়াদ’ নামক পাথরের অবস্থান স্থল পর্যন্ত পৌঁছল, তখন তাদের মাঝে মতবিরোধ সৃষ্টি হলো এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিষয়ে, যে বা যারা পাথরটিকে তার জায়গায় রাখবে এবং প্রত্যেক গোত্র বলতে লাগল: আমরা তাকে তার জায়গায় রাখব। অতঃপর তারা এক পর্যায়ে এ বিষয়ে ঐক্যমত হলো যে, তাদের মাঝে সর্বপ্রথম যিনি উপস্থিত হবেন, তিনিই পাথরটিকে তার জায়গায় রাখবেন। অতঃপর প্রথম আগমনকারী ব্যক্তি হয়ে গেলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তখন তারা বলে উঠল: এসে গেছে আল-আমীন এবং তারা তাঁকে মেনে নিল। অতঃপর তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একটি কাপড় নিয়ে আসার জন্য বললেন, তারপর তিনি পাথরটিকে তার মাঝখানে রাখলেন এবং প্রত্যেক গোত্রকে নির্দেশ দিলেন কাপড়ের এক পাশ ধরে উপরে উঠানোর জন্য, অতঃপর তিনি কাপড়ের মাঝখান থেকে পাথরটিকে নিয়ে তার জায়গায় রেখে দিলেন। -(আহমাদ ও হাকেম এবং তিনি তাকে সহীহ বলেছেন)।  
    
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবাহ:
তাঁর বয়স যখন পঁচিশ বছর, তখন তাঁকে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বিয়ে করেন; ইতোপূর্বে তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) খাদিজা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার গোলাম মায়সারার সাথে তাঁর (খাদিজার) ব্যবসার ব্যাপারে শাম দেশের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন এবং এক সঙ্গে সফরকালে মায়সারা তাঁর ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্য ও দীপ্তি এবং সততা ও বিশ্বস্ততার উজ্জ্বল আবা অবলোকন করলেন। অতঃপর যখন সে ফিরে আসল, তখন তার মনিব খাদিজাকে সে যা যা দেখেছে তা অবহিত করল, তারপর খাদিজা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা তাঁর নিকট তাঁকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করলেন।
     
খাদিজা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার মৃত্যু:
খাদিজা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হিজরতের তিন বছর পূর্বে মারা যান এবং তাঁর মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য কাউকে বিয়ে করনে নি। তারপর খাদিজা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা যখন মারা যান, তখন তিনি সাওদা বিনতে যাম‘আ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে বিয়ে করেন, তারপর তিনি আয়েশা বিনতে আবি বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে বিয়ে করেন এবং তাঁকে ব্যতীত তিনি কুমারী নারী হিসেবে আর কাউকে বিয়ে করেন নি। অতঃপর তিনি হাফসা বিনতে উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে বিয়ে করেন, তারপর বিয়ে করেন যয়নব বিনতে খুযাইমা ইবনুল হারিছ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে, তারপর বিয়ে করেন উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে, তার নাম হলো হিন্দ বিনতে আবি উমাইয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা। অতঃপর বিয়ে করেন যয়নব বিনতে জাহাশ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে, অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিয়ে করেন জুয়াইরিয়া বিনতে হারেস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে, তারপর বিয়ে করেন উম্মে হাবিবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে এবং তার নাম হলো রামলা। আবার কেউ কেউ বলেন, তার নাম হিন্দ, তাঁর পিতা হলেন, আবু সুফিয়ান। আর খায়বর বিজয়ের পরপরই বিয়ে করেন সফিয়্যা বিনতে হুয়াই ইবন আখতাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে। অতঃপর তিনি মাইমুনা বিনতে হারিছ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে এবং তিনিই হলেন সর্বশেষ নারী, যাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিয়ে করেছিলেন।

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তান-সন্তুতি:
ইবরাহীম ব্যতীত নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছেলে ও মেয়ে সন্তানদের সকলেই খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করেন। কারণ, তিনি (ইবরাহীম) জন্মগ্রহণ করেন মারিয়া কিবতিয়্যার গর্ভে, মুকাওকিস যাকে তাঁর জন্য উপহার হিসেবে প্রেরণ করেছেন।
তাঁর পুত্র সন্তানগণ:
কাসেম, তাকে কেন্দ্র করেই তাঁর (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের) উপনাম হয়েছে ‘আবুল কাসেম’ এবং তিনি খুব অল্প দিনই বেঁচে ছিলেন, আর বাকি দু’জন হলেন ‘তাহের’ ও ‘তাইয়্যেব’।
আর কেউ কেউ বলেন: ইসলামের যুগে ‘আবদুল্লাহ’ নামে তাঁর একজন সন্তান জন্মগ্রহণ করেন, তারপর তাঁকে উপাধি দেওয়া হয় ‘তাহের ও তাইয়্যেব’। আর ইবরাহীম জন্মগ্রহণ করেছেন মদীনাতে এবং তিনি দুই মাস কম দুই বছর বেঁচে ছিলেন, আর তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর তিন মাস পূর্বে মারা যান।
 
তাঁর কন্যা সন্তানগণ:
‘যয়নব’ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা এবং তিনি তাঁর কন্যাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন, যাঁকে আবুল ‘আস ইবন রাবি‘ বিয়ে করেন এবং তিনি ছিলেন তাঁর খালাতো ভাই। ‘রুকাইয়্যা’ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা, যাকে বিয়ে করেছেন ‘উসমান ইবন ‘আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু। ‘ফাতেমা’ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা, যাকে বিয়ে করেছেন আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এবং তাঁর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছেন জান্নাতের অধিবাসী যুবকদের সর্দার (নেতা) হাসান ও হোসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা। ‘উম্মে কুলছুম’ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা, যাকে ‘রুকাইয়্যা’ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার মৃত্যুর পর ‘উসমান ইবন ‘আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বিয়ে করেন।
ইমাম নাওয়াওয়ী রহ. বলেন: সর্বসম্মতিক্রমে তাঁর কন্যাগণ হলেন চারজন। আর বিশুদ্ধ মতে তাঁর ছেলেদের সংখ্যা হলো তিনজন।

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবু্ওয়াত:
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াত প্রদান করা হয়, তারপর রমযান মাসের ১৭ তারিখ সোমবার হেরা গুহায় তাঁর নিকট ফিরিশতার আগমন ঘটে, আর ফিরিশতা যখন তাঁর নিকট অহী নিয়ে আগমন করতেন, তখন এটা তাঁর নিকট অত্যন্ত কষ্টকর মনে হত, তাঁর চেহারা পরিবর্তন হয়ে যেত এবং তাঁর কপাল ঘর্মাক্ত হয়ে যেত।

* অতঃপর যখন তাঁর নিকট ফিরিশতা অবতরণ করলেন, তখন তিনি (ফিরিশতা) তাঁকে (রাসূলকে) বললেন, ‘আপনি পড়ুন’। জবাবে তিনি বললেন: “আমি তো পড়তে জানি না”। অতঃপর ফিরিশতা তাঁকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিলেন যে, তাতে তাঁর কষ্ট হলো। অতঃপর তিনি তাঁকে আবার বললেন: ‘আপনি পড়ুন’, জবাবে তিনি বললেন: “আমি তো পড়তে জানি না”। এভাবে তিনি তিনবার বললেন। অতঃপর তিনি বললেন (আল-কুরআনের বাণী):
﴿ٱقۡرَأۡ بِٱسۡمِ رَبِّكَ ٱلَّذِي خَلَقَ ١ خَلَقَ ٱلۡإِنسَٰنَ مِنۡ عَلَقٍ ٢ ٱقۡرَأۡ وَرَبُّكَ ٱلۡأَكۡرَمُ ٣ ٱلَّذِي عَلَّمَ بِٱلۡقَلَمِ ٤ عَلَّمَ ٱلۡإِنسَٰنَ مَا لَمۡ يَعۡلَمۡ ٥﴾ [العلق: ١،  ٥]     
“পড়ুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ (জমাট বাঁধা রক্ত) হতে। পড়ুন, আর আপনার রব মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।” [সূরা আল-‘আলাক, আয়াত: ১-৫]

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাঁপতে কাঁপতে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার নিকট গেলেন, তারপর তিনি তাঁকে নিয়ে যা ঘটেছে তা তাঁর কাছে খুলে বললেন, অতঃপর খাদিজা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্ত্বনা ও অভয় দিয়ে বললেন: আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন, অসম্ভব! আল্লাহ কখনও আপনাকে অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, সত্য কথা বলেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।

* অতঃপর অহী স্থগিত হয়ে গেল, তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অহীর অপেক্ষায় থাকলেন যতক্ষণ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অপেক্ষা চেয়েছেন, তখন তিনি আর কোনো কিছুই দেখলেন না, যার কারণে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং অহী নাযিলের প্রত্যাশায় উৎসুক হয়ে থাকলেন, অতঃপর একদিন তাঁর উদ্দেশ্যে ফিরিশতা আত্মপ্রকাশ করলেন, যিনি আসামন ও যমীনের ব্যাপী পাতা এক আসন বা চেয়ারে বসা। সেই ফিরিশতা তাঁকে সাহস দিলেন এবং সুসংবাদ দিলেন যে, তিনি সত্যিকার অর্থে আল্লাহর রাসূল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাকে (ফিরিশতাকে) দেখলেন, তখন তিনি ভয় পেয়ে গেলেন এবং সোজা খাদিজা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার নিকট চলে গেলেন এবং বললেন: “আমাকে বস্ত্রাবৃত কর, আমাকে কম্বল দ্বারা ঢেকে দাও”। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ওপর নাযিল করলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلۡمُدَّثِّرُ ١ قُمۡ فَأَنذِرۡ ٢ وَرَبَّكَ فَكَبِّرۡ ٣ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرۡ ٤ ﴾ [المدثر: ١،  ٤]
“হে বস্ত্রাচ্ছাদিত! উঠুন, অতঃপর সতর্ক করুন, আর আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন। আর আপনার পরিচ্ছদ পবিত্র করুন।” [সূরা আল-মুদ্দাসসির, আয়াত: ১–৪]

কাজেই আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতগুলোর মধ্যে তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন- তিনি যাতে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকজনকে সতর্ক করেন এবং তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করেন। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দায়িত্ব পালনের প্রস্তুতি নিলেন এবং আল্লাহর আনুগত্য পালনে পুরোপুরিভাবে আত্মনিয়োগ করলেন- তিনি ছোট ও বড়, স্বাধীন ও গোলাম, পুরুষ ও নারী এবং কালো ও সাদা নির্বিশেষে সকল মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার দিকে ডাকতে লাগলেন। অতঃপর প্রত্যেক গোত্র থেকে ঐসব আল্লাহর বান্দা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিলেন, যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা ও (জাহান্নাম থেকে) মুক্তি দানের জন্য কবুল করেছেন। ফলে তারা জেনে-শুনে ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করেন। অতঃপর মক্কার নির্বোধ লোকগুলো তাদেরকে কষ্ট ও শাস্তি দিতে শুরু করে দিল, আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে তাঁর চাচা আবু তালিবের মাধ্যমে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করলেন। কারণ, তিনি (আবু তালিব) ছিলেন তাদের মধ্যে ভদ্র, অনুসরণীয়, বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তি, যখন তারা চাচা কর্তৃক ভাতিজাকে প্রচণ্ডভাবে ভালোবাসার বিষয়টি জানত, তখন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো কাজের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে সাহস করত না।
* ইবনুল জাওযী রহ বলেন: অবশেষে তিনি তিন বছর নবুওয়াতের বিষয়টি গোপন করে রাখেন, অতঃপর তাঁর প্রতি অহী নাযিল হয়:
﴿فَٱصۡدَعۡ بِمَا تُؤۡمَرُ وَأَعۡرِضۡ عَنِ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ٩٤﴾ [الحجر: ٩٤]
“অতএব, আপনি যে বিষয়ে আদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন, তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন এবং মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন।” [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯৪]
এ আয়াত নাযিলের পর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকাশ্যে দাওয়াতী কাজ শুরু করেন। তারপর যখন নাযিল হয় আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ ٱلۡأَقۡرَبِينَ ٢١٤﴾ [الشعراء: ٢١٤]
“আর আপনার নিকটস্থ জ্ঞাতি-গোষ্ঠীকে সতর্ক করুন” [সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ২১৪], তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘর থেকে বের হয়ে ‘সাফা’ পর্বতে আরোহন করেন, তারপর তিনি (يا صباحاه)! (হায়! সকাল বেলার বিপদ) বলে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন, তারপর তারা বলল: কে চিৎকার করে ডাকছে? তারাই আবার বলল: এ তো মুহাম্মাদ! তখন তারা সকলে তাঁর কাছে সমবেত হলে তিনি বললেন,
«يَا بَنِى فُلاَنٍ! يَا بَنِى فُلاَنٍ! يَا بَنِى فُلاَنٍ ! يَا بَنِى عَبْدِ مَنَافٍ! يَا بَنِى عَبْدِ الْمُطَّلِبِ! فَاجْتَمَعُوا إِلَيْهِ فَقَالَ «أَرَأَيْتَكُمْ لَوْ أَخْبَرْتُكُمْ أَنَّ خَيْلاً تَخْرُجُ بِسَفْحِ هَذَا الْجَبَلِ أَكُنْتُمْ مُصَدِّقِىَّ». قَالُوا مَا جَرَّبْنَا عَلَيْكَ كَذِبًا. قَالَ «فَإِنِّى نَذِيرٌ لَكُمْ بَيْنَ يَدَىْ عَذَابٍ شَدِيدٍ». فَقَالَ أَبُو لَهَبٍ : تَبًّا لَكَ، أَمَا جَمَعْتَنَا إِلاَّ لِهَذَا ؟ ثُمَّ قَامَ، فَنَزَلَتْ : ﴿تَبَّتۡ يَدَآ أَبِي لَهَبٖ وَتَبَّ﴾  إِلَى آخِرِ السُّورَةِ».
“হে অমুক সম্প্রদায়! ...হে অমুক সম্প্রদায়! ...হে অমুক সম্প্রদায়! ...হে বনী আবদে মান্নাফ! ...হে বনী আবদিল মুত্তালিব! তখন তারা সকলে তাঁর কাছে সমবেত হলো। তারপর তিনি বললেন, ‘যদি আমি বলি যে, একটি শত্রুদল পাহাড়ের পাদদেশ থেকে তোমাদেরকে আক্রমণের জন্য ক্রমশই এগিয়ে আসছে, তবে তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে কি? সবাই একবাক্যে বলে উঠল: (হাঁ, অবশ্যই বিশ্বাস করব) আমরা কখনও তোমার ওপর মিথ্যা বলা অভিযোগ দেখি নি। তখন তিনি বললেন: (যদি তাই হয়) আমি (শির্ক ও কুফরের কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত) এক ভীষণ আযাব সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ক করছি। এ কথা শুনে আবু লাহাব বলল: " تباً لك ألهذا جمعتنا؟ (ধ্বংস হও তুমি, এজন্যেই কি আমাদেরকে একত্রিত করেছ’?) অতঃপর সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাথর মারতে উদ্যত হলো। তারপর নাযিল হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী (সূরা লাহাব):
﴿تَبَّتۡ يَدَآ أَبِي لَهَبٖ وَتَبَّ ١ مَآ أَغۡنَىٰ عَنۡهُ مَالُهُۥ وَمَا كَسَبَ ٢ سَيَصۡلَىٰ نَارٗا ذَاتَ لَهَبٖ ٣ وَٱمۡرَأَتُهُۥ حَمَّالَةَ ٱلۡحَطَبِ ٤ فِي جِيدِهَا حَبۡلٞ مِّن مَّسَدِۢ ٥﴾ [المسد: ١،  ٥]  
“ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দু‘হাত এবং ধ্বংস হয়েছে সে নিজেও। তার ধন-সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোন কাজে আসে নি। অচিরে সে দগ্ধ হবে লেলিহান আগুনে এবং তার স্ত্রীও- যে ইন্ধন বহন করে, তার গলায় পাকানো রশি”।”   

নিদারুন কষ্টে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধৈর্য:         
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে অনেক দুঃখ-কষ্ট পেয়েছেন এবং এমতাবস্থায় তিনি চরম ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দিয়েছেন, আর তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে যুলুম ও নিপীড়ন থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য হাবশায় হিজরত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে তাঁরা মক্কা থেকে হাবশার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছেন।
* ইবন ইসহাক বলেন: অতঃপর যখন আবু তালিব মারা যান, তখন কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এত বেশি কষ্ট দিয়েছে, যা তারা তার (আবু তালিবের) জীবদ্দশায় কখনও আশা করে নি। আবু না‘ঈম আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
«لما مات أبو طالب تجهَّموا رسول الله فقال: « يا عم ما أسرع ما وجدت فقدك».
“যখন আবু তালিব মারা যান, তখন তারা (কুরাইশগণ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এমতাবস্থায় তিনি বলেন: ‘হে আমার চাচা! কত দ্রুত আমি আপনাকে হারানোর ক্ষতি অনুভব করতে লাগলাম।”
* সহীহ বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন সালাত আদায় করছিলেন এবং তাঁর নিকটবর্তী স্থানে উটের নাড়িভুঁড়ি পড়া অবস্থায় ছিল, তখন ‘উকবা ইবন আবি মু‘য়ীত তা নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিঠের উপর নিক্ষেপ করল, ফলে তিনি আর সাজদাহ থেকে উঠতে পারছিলেন না, শেষ পর্যন্ত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা এসে তাঁর পিঠ থেকে তা ফেলে দিলেন, তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«اللَّهُمَّ عَلَيْكَ بِالْمَلأِ مِنْ قُرَيْشٍ».
“হে আল্লাহ! কুরাইশ নেতাদের থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার বিষয়টি আমি আপনার দায়িত্বে ছেড়ে দিলাম।”

ইমাম বুখারী রহ. স্বতন্ত্রভাবে আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, যার মূলকথা হলো এ রকম: “উকবা ইবন আবি মু‘য়ীত একদিন নিজের চাদর দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাঁধে চেপে ধরলেন এবং তার নিজের চাদর দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের গলদেশে পেঁচিয়ে ফেলল, তারপর সে তার দ্বারা কঠিনভাবে শ্বাসরোধ করে তাঁকে হত্যা করার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, ঠিক সে সময় আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আসলেন এবং তার হাত থেকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্ধার করলেন এবং বললেন:     
«أَتَقْتُلُونَ رَجُلًا أَنْ يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ ، وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَبِّكُمْ».
“তোমারা কি একজন মানুষ হত্যা করতে চাও এ কারণে যে, সে বলে আমার ‘রব’ হলেন আল্লাহ এবং সে তার দাবীর সত্যতা প্রমাণে তোমাদের রবের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে এসেছেন?”

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাওমের প্রতি তাঁর দয়া ও অনুকম্পা:
অতঃপর আবু তালিব ও খাদিজা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার মৃত্যুর পর যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর কষ্টের মাত্রা প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গেল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলেন এবং ছাকীফ গোত্রের লোকজনকে ইসলামের দা‘ওয়াত দিলেন; কিন্তু তিনি তাদের পক্ষ থেকে বিরোধিতা, তিরস্কার ও কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পেলেন না। তারা তাঁকে পাথর মেরে তাঁর দুই পায়ের গোড়ালিকে রক্তাক্ত করে দিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার মক্কায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«فَانْطَلَقْتُ (يعني من الطائف) وَأنا مَهْمُومٌ عَلَى وَجْهِي ، فَلَمْ أسْتَفِقْ إِلاَّ وأنَا بِقَرْنِ الثَّعَالِبِ (ميقات أهل نجد)، فَرَفَعْتُ رَأْسِي، وَإِذَا أنَا بِسَحَابَةٍ قَدْ أظَلَّتْنِي، فَنَظَرْتُ فَإذَا فِيهَا جِبريلُ عليه السلام، فَنَادَاني ، فَقَالَ : إنَّ الله تَعَالَى قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ، وَمَا رَدُّوا عَلَيْكَ، وَقَد بَعَثَ إلَيْكَ مَلَكَ الجِبَالِ لِتَأْمُرَهُ بمَا شِئْتَ فِيهِمْ . فَنَادَانِي مَلَكُ الجِبَالِ، فَسَلَّمَ عَلَيَّ ، ثُمَّ قَالَ : يَا مُحَمَّدُ ! إنَّ اللهَ قَدْ سَمِع قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ، وَأنا مَلَكُ الجِبال، وَقَدْ بَعَثَنِي رَبِّي إلَيْكَ لِتَأْمُرَنِي بِأَمْرِكَ، فَمَا شِئْتَ، إنْ شئْتَ أطْبَقْتُ عَلَيْهِمُ الأَخْشَبَيْنِ (جبلان بمكةَ). فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم: بَلْ أرْجُو أنْ يُخْرِجَ اللهُ مِنْ أصْلاَبِهِمْ مَنْ يَعْبُدُ اللهَ وَحْدَهُ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئاً».
“তখন আমি এমনভাবে বিষণ্ন চেহারা নিয়ে (তায়েফ থেকে) ফিরে এলাম যে, কারনুস সা‘আলিবে (নজদবাসীর মীকাত) পৌঁছা পর্যন্ত আমার চিন্তা লাগব হয় নি, তখন আমি আমার মাথা উপরে উঠালাম, হঠাৎ দেখতে পেলাম এক টুকরো মেঘ আমাকে ছায়া দিচ্ছে। অতঃপর আমি সে দিকে দৃষ্টি দিলাম, তার মধ্যে ছিলেন জিবরাঈল আলাইহিস সালাম। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, আপনার কাওম আপনাকে যা বলেছে এবং তারা প্রতি উত্তরে যা বলেছে, তা সবই আল্লাহ শুনেছেন। তিনি আপনার কাছে পাহাড়ের (দায়িত্বে নিয়োজিত) ফিরিশতাকে পাঠিয়েছেন, এদের (তায়েফবাসী) সম্পর্কে আপনার যা ইচ্ছা আপনি তাকে হুকুম দিতে পারেন, তখন পাহাড়ের ফিরিশতা আমাকে ডাকলেন এবং আমাকে সালাম দিলেন। অতঃপর বললেন, হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার কাওম আপনাকে যা বলেছে, তা সবই আল্লাহ শুনেছেন; আর আমি হলাম পাহাড়ের (দায়িত্বে নিয়োজিত) ফিরিশতা। আপনার ‘রব’ আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন, আপনার যা ইচ্ছা আপনি আমাকে হুকুম দিতে পারেন। আপনি যদি চান, তাহলে আমি তাদের উপর ‘আখশাবাইন’কে (মক্কায় অবস্থতি দু’টি কঠিন শিলার পাহাড়) চাপিয়ে দিব। জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (না, তা হতে পারে না) বরং আমি আশা করি যে, আল্লাহ তাদের বংশ থেকে এমন সন্তান বের করে আনবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না।”

* আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক (হজের) মৌসমে বের হতেন, আর নিজেকে (রাসূল হিসেবে)  বিভিন্ন কাওম ও গোষ্ঠীর নিকট পেশ করতেন এবং বলতেন:
«مَنْ يُؤويني؟ من يَنصُرني؟  فَإِنَّ قُرَيْشًا قَدْ مَنَعُونِي أَنْ أُبَلِّغَ كَلامَ رَبِّي عَزَّ وَجَلَّ».
“কে আমাকে আশ্রয় দিবে? কে আমাকে সাহায্য করবে? কারণ, কুরাইশরা আমাকে আমার মহান রবের বাণী প্রচার করতে বাধা দিচ্ছে!”  
* অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজের মৌসুমে ‘আকাবা নামক স্থানের কাছে ছয় ব্যক্তিকে পেলেন এবং তাদেরকে দা‘ওয়াত দিলেন, ফলে তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করলেন। অতঃপর তারা মদীনায় ফিরে গেলেন এবং তাদের কাওমের লোকজনকে দাওয়াত দিলেন, শেষ পর্যন্ত তাদের মাঝে ইসলামের আলো ছড়িয়ে গেল। অতঃপর প্রথম ও দ্বিতীয় ‘আকাবার শপথ অনুষ্ঠান হয়ে গেল এবং এগুলো ছিল গোপনে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মুসলিমগণের মধ্য থেকে কারা কারা হিজরত করে মদীনায় চলে যাবে, সে বিষয়টি যখন চূড়ান্ত হয়ে গেল, তখন তাঁরা দলে দলে বের হয়ে গেলেন।
 
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায় হিজরত:
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মদীনার উদ্দেশ্যে বের হলেন এবং এক পর্যায়ে সাওর পর্বতের সামনে গিয়ে হাযির হলেন। অতঃপর তাঁরা উভয়ে সেখানে তিন দিন অবস্থান করলেন; আর তাদের বিষয়টি কুরাইশদের নিকট অজ্ঞাত বা অন্ধকারেই রয়ে গেল। অতঃপর তিনি মদীনায় প্রবেশ করলেন এবং মদীনাবাসী তাঁকে শুভেচ্ছাসহ সাদরে গ্রহণ করে নিলেন, তারপর তিনি সেখানে তাঁর মাসজিদ ও আবাসস্থল নির্মাণ করেন।

০ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুদ্ধসমূহ:
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে বের হলেন, তখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, তারা তাদের নবীকে বের করে দিল! ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজে‘উন’ (আমরা আল্লাহর জন্য, আর আমাদেরকে তাঁর দিকেই ফিরে যেতে হবে)। অবশ্যই তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন:
﴿أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَٰتَلُونَ بِأَنَّهُمۡ ظُلِمُواْۚ ﴾ [الحج: ٣٩]
“যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে। কারণ, তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে।” [সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ৩৯]
আর এ আয়াতটি যুদ্ধের ব্যাপারে সর্বপ্রথম নাযিলকৃত আয়াত। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাতাশটি যুদ্ধে (গাযওয়ায়)  নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তন্মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন নয়টিতে: বদর, ওহুদ, মরীসী‘, খন্দক, কুরায়যা, খায়বর, মক্কা বিজয়, হুনায়েন ও তায়েফ। আর ৫৬টি যুদ্ধে (সারিয়ায়)  বাহিনী প্রেরণ করেছেন।
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হজ ও ওমরা:
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করার পর একটি মাত্র হজ করেছেন, আর তা হলো ‘বিদায় হজ’; আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম চারটি ওমরা করেছেন এবং বিদায় হজের সাথে করা ওমরাটি ছাড়া বাকি সব কয়টি ওমরাই যিলকা‘দ মাসে করেছেন। সুতরাং প্রথম ওমরা হলো ‘হুদায়বিয়ার ওমরা’, যাতে মুশরিকগণ বাধা দিয়েছিল। আর দ্বিতীয় ওমরা হলো (৭ম হিজরীতে করা) ‘কাযা ওমরা’, আর তৃতীয় ওমরা হলো ‘ওমরায়ে জি‘রানা’ এবং তাঁর জীবনের চতুর্থ ওমরা হলো তাঁর হজের সাথে করা ওমরাটি।

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৈহিক আকৃতি:
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মাঝারি গড়নের, বেশি লম্বাও নন এবং খাটোও নন। গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা, অর্থাৎ দুধে আলতা মিশানো রং-এর মত। মাথায় লম্বা চুল বিশিষ্ট, ডাগর কৃষ্ণ চোখ বিশিষ্ট, অর্থাৎ চোখ দু’টি কাজল কালো। ছোট চুল বিশিষ্ট বক্ষ, অর্থাৎ এমন চুল যা তাঁর বক্ষ ও পেটকে ঢেকে দেয় না। বক্ষে সরু রেখার চুল বিশিষ্ট, অর্থাৎ তাঁর বক্ষ ও পেটের মাঝ বরাবর সরল রেখার মতো কিছু চুল বা পশম ছিল।
 
কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
০ ইসরা ও মি‘রাজ: হিজরতের তিন বছর পূর্বে ইসরা ও মি‘রাজ সম্পন্ন হয়েছিল এবং তাতে সালত ফরয হয়।
০ হিজরী প্রথম বর্ষ: মসজিদ নির্মাণ, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কেন্দ্রিক ছুটাছুটি, যাকাত ফরয।
০ হিজরী দ্বিতীয় বর্ষ: ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং তাতে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দেন, আর তাদেরকে তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহায্য ও বিজয় দান করেন।
০ হিজরী তৃতীয় বর্ষ: ওহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং তাতে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ লঙ্ঘন করার কারণে এবং কোনো কোনো সৈনিকের গনীমতের মালের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার কারণে পরাজয়ের শিকার হয়।
০ হিজরী চতুর্থ বর্ষ: বনু নাযিরের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং তাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু নাযির গোত্রের ইয়াহূদীদেরকে মদীনা থেকে উচ্ছেদ ও বিতাড়িত করেন। কারণ, তারা মুসলিমগণ ও তাদের মধ্যকার স্বাক্ষরিত চুক্তি ভঙ্গ করেছে।
০ হিজরী পঞ্চম বর্ষ: এ বছর বনু মুস্তালিকের যুদ্ধ, আহযাবের যুদ্ধ এবং বনু কোরায়যার যুদ্ধ হয়।
০ হিজরী ষষ্ঠ বর্ষ: হুদায়বিয়ার সন্ধি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এ বছরই চূড়ান্তভাবে মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ (হারাম) হয়।
০ হিজরী সপ্তম বর্ষ: খায়বরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়; আর এ বছরেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলিমগণ পবিত্র মক্কায় প্রবেশ করেন এবং ওমরা পালন করেন। আবার এ বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফিয়া বিনতে হুয়াই রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে বিয়ে করেন।
০ হিজরী অষ্টম বর্ষ: রোমবাসী ও মুসলিমগণের মধ্যে মুতার যুদ্ধ সংঘটিত হয়, মক্কা বিজয় হয়, আর হাওয়াযিন ও ছাকীফ গোত্রের বিরুদ্ধে হুনায়েনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
০ হিজরী নবম বর্ষ: তাবুকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়, আর এটাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের গাযওয়াসমূহের মধ্যে সংঘটিত সর্বশেষ গাযওয়া। আর এ বছরেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট অনেক প্রতিনিধি দলের আগমন হয় এবং দলে দলে মানুষ আল্লাহর দীন ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করে; আর এ বছরটিকে ইসলামের ইতিহাসে ‘আমিল ওফূদ’ (عام الوفود) তথা প্রতিনিধি দলের বছর বলা হয়।  
০ হিজরী দশম বর্ষ: বিদায় হজ অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে লক্ষাধিক মুসলিম পবিত্র হজ পালন করেন।
০ হিজরী একাদশ বর্ষ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যু হয় এবং তা হয়েছিল রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার দিনে, তবে মাসের এ দিনটি সুনির্দিষ্ট করার ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে।

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মারা যান, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। তন্মধ্যে নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে ৪০ বছর এবং নবী ও রাসূল হিসেবে ২৩ বছর, আর সে ২৩ বছরের মধ্যে ১৩ বছর মক্কায় এবং ১০ বছর মদীনায়।
صلى الله عليه و على آله و صحبه و سلّم .
“আল্লাহ তা‘আলা সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন তাঁর প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীগণের প্রতি”।
সমাপ্ত

যে কাজে সময় ও সুযোগ ব্যয় করা হয়, তন্মধ্যে সবচেয়ে সুবর্ণ সময় হলো যা পবিত্র সীরাতুন্নবী ও চিরস্থায়ী মুহাম্মাদী ইতিহাস অধ্যয়নে ব্যয় করা হয়। আর এ পুস্তিকাটি হচ্ছে সীরাতুন্নবী সম্পর্কে, যা অধ্যয়নের মধ্যে মুসলিম ব্যক্তি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবে, জানতে পারবে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্ব, তাঁর জীবন ও বসবাসের পদ্ধতি এবং সন্ধি ও যুদ্ধের সময়কার তাঁর দাওয়াতের রীতি-পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে।

 

 

 

 

Паёмбаратро Бишнос

বই সম্পর্কে

লেখক :

Adel ibn Ali Al-Shiddy

প্রকাশক :

www.islamhouse.com

বিভাগ :

Muhammad (PBUH)