আত-তাফসীর আল-মুইয়াসসার (দ্বিতীয় পারা)

তাফসীরে কুরতুবী থেকে পবিত্র কুরআনের মক্কায় অবতীর্ণ গুরুত্বপূর্ণ সূরা আন-নাবা-এর তাফসীর এখানে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ এ সূরাটিতে কিয়ামতের আলোচনা ও জান্নাতের নি‘আমত এবং জাহান্নামের শাস্তি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। মানুষের প্রতি আল্লাহর যে অসীম দয়া রয়েছে তাও তিনি তুলে ধরেছেন। তাফসীরে যদি কোথাও অগ্রহণযোগ্য বর্ণনা দৃষ্টিগোচর হয়েছে তখনি তা বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে কোথাও কোথাও লেখকের নিয়মানুসারে কিছু তাফসীর বর্ণনা করা হয়েছে। বুদ্ধিমান পাঠক সঠিক মতটি নিতে কার্পন্য করবে না বলেই বিশ্বাস।

اسم الكتاب: تفسير سورة النبأ


تأليف: محمد بن أحمد القرطبي


الناشر: المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة


نبذة مختصرة: كتاب مترجمة إلى اللغة البنغالية لتفسير سورة النبأ من الجامع لأحكام القرآن لأبي عبدالله القرطبي رحمه الله.


আত-তাফসীর আল-মুইয়াসসার
(দ্বিতীয় পারা)
التفسير الميسر (الجزء الثاني)

< بنغالي >
        
একদল বিশেষজ্ঞ সৌদী আলেম





অনুবাদক: আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
 


التفسير الميسر
(الجزء الثاني)

        

جماعة من العلماء




ترجمة: على حسن طيب
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

সূচিপত্র

ক্রম    বিষয়    পৃষ্ঠা
1.        সূরা আল-বাকারাহ    
2.        আয়াতসমূহ ১৪২-২৫২     

আল-কুরআনের সংক্ষিপ্ত তাফসীর
(দ্বিতীয় পারা)

﴿سَيَقُولُ ٱلسُّفَهَآءُ مِنَ ٱلنَّاسِ مَا وَلَّىٰهُمۡ عَن قِبۡلَتِهِمُ ٱلَّتِي كَانُواْ عَلَيۡهَاۚ قُل لِّلَّهِ ٱلۡمَشۡرِقُ وَٱلۡمَغۡرِبُۚ يَهۡدِي مَن يَشَآءُ إِلَىٰ صِرَٰطٖ مُّسۡتَقِيمٖ ١٤٢﴾ [البقرة: ١٤٢]  
“অচিরেই নির্বোধ লোকেরা বলবে, ‘কিসে তাদেরকে তাদের কিবলা থেকে ফিরাল, যার ওপর তারা ছিল?’ বল, ‘পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই। তিনি যাকে চান সোজা পথ দেখান।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪২]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর : মূর্খ ও কম বুদ্ধিসম্পন্ন ইহুদী ও তাদের সমমনারা বিদ্রূপ ও সমালোচনা করে অচিরেই বলবে, এই মুসলিমরা ইসলামের সূচনাযুগে যে কিবলার দিকে (বাইতুল মুকাদ্দাস) ফিরে সালাত আদায় করত তা থেকে তাদের কিসে ফেরাল? হে রাসূল আপনি তাদের বলুন, পূর্ব দিগন্ত ও পশ্চিম দিগন্ত এবং উতদুভয়ের মধ্যবর্তী যা আছে তার সবই আল্লাহর মালিকানাধীন। তাই কোনো দিকই তাঁর রাজত্বের বাইরে নয়। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে চান তিনি তাকে সরল সোজা পথের সন্ধান দেন। এতে বুঝানো হচ্ছে যে নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে সর্বময় ক্ষমতা ও কৃতিত্বও তাঁর। অতএব তিনি আমাদের যেদিকেই ফেরান আমরা সেদিকে ফিরতে বাধ্য।
﴿وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَٰكُمۡ أُمَّةٗ وَسَطٗا لِّتَكُونُواْ شُهَدَآءَ عَلَى ٱلنَّاسِ وَيَكُونَ ٱلرَّسُولُ عَلَيۡكُمۡ شَهِيدٗاۗ وَمَا جَعَلۡنَا ٱلۡقِبۡلَةَ ٱلَّتِي كُنتَ عَلَيۡهَآ إِلَّا لِنَعۡلَمَ مَن يَتَّبِعُ ٱلرَّسُولَ مِمَّن يَنقَلِبُ عَلَىٰ عَقِبَيۡهِۚ وَإِن كَانَتۡ لَكَبِيرَةً إِلَّا عَلَى ٱلَّذِينَ هَدَى ٱللَّهُۗ وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَٰنَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِٱلنَّاسِ لَرَءُوفٞ رَّحِيمٞ ١٤٣ ﴾ [البقرة: ١٤٣]  
“আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি, যাতে তোমরা মানুষের ওপর সাক্ষী হও এবং রাসূল সাক্ষী হন তোমাদের ওপর। আর যে কিবলার ওপর তুমি ছিলে, তাকে কেবল এ জন্যই নির্ধারণ করেছিলাম, যাতে আমরা জেনে নেই যে, কে রাসূলকে অনুসরণ করে এবং কে তার পেছনে ফিরে যায়। যদিও তা অতি কঠিন (অন্যদের কাছে) তাদের ছাড়া যাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত করেছেন এবং আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তোমাদের ঈমানকে বিনষ্ট করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৩]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর : হে মুসলিমগণ, তোমাদেরকে আমি যেমন দীনের ব্যাপারে সঠিক পথ দেখিয়েছি, তেমনি তোমাদেরকে সর্বোত্তম ও ন্যায়নিষ্ঠ উম্মত বানিয়েছি। যাতে পরকালে তোমরা এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে পার যে তাদের রাসূলগণ তাদের রবের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। তেমনি আখিরাতে রাসূলও তোমাদের ওপর সাক্ষ্য হবেন যে তিনি তোমাদের কাছে তাঁর রবের দীন পৌঁছে দিয়েছেন। আর হে রাসূল, আপনি যে ‘বাইতুল মুকাদ্দাসে’র কিবলামুখী ছিলেন আর আমি তা থেকে আপনাকে মক্কাস্থ কা‘বার দিকে ফিরালাম, এটা করেছিলাম কেবল ‘আযলে’ আমি যা জেনেছি তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। যে জানার সঙ্গে সম্পৃক্ত পুরস্কার ও তিরস্কারের বিষয়টি। যাতে আমি যে আপনার আনুগত্য ও অনুসরণ করে, আপনি যে দিকেই ফেরেন সে দিকে মুখ ফেরায় আর যে দুর্বল ঈমানবিশিষ্ট, আপন সন্দেহ ও কপটতার দরুণ যে মুরতাদ হয়ে হয়ে যায়। আর এ অবস্থা যাতে মুসলিমরা নিজের সালাতে বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে কা‘বার দিকে ফিরেন, তা আল্লাহর যাদের হিদায়াত দিয়েছেন এবং তাদের প্রতি ঈমান ও তাকওয়া দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন তারা ছাড়া অন্যদের জন্য বড় ভারি ও কঠিন। আল্লাহ তোমাদের তাঁর প্রতি ঈমান এবং তাঁর রাসূলের অনুসরণ বৃথা করবেন না। পূর্বতন কিবলার সালাতগুলোকে বাতিল করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল, পরম দয়ালু।
﴿قَدۡ نَرَىٰ تَقَلُّبَ وَجۡهِكَ فِي ٱلسَّمَآءِۖ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبۡلَةٗ تَرۡضَىٰهَاۚ فَوَلِّ وَجۡهَكَ شَطۡرَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِۚ وَحَيۡثُ مَا كُنتُمۡ فَوَلُّواْ وُجُوهَكُمۡ شَطۡرَهُۥۗ وَإِنَّ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ لَيَعۡلَمُونَ أَنَّهُ ٱلۡحَقُّ مِن رَّبِّهِمۡۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا يَعۡمَلُونَ ١٤٤﴾ [البقرة: ١٤٤]  
“আকাশের দিকে বার বার তোমার মুখ ফিরানো আমি অবশ্যই দেখছি। অতএব আমি অবশ্যই তোমাকে এমন কিবলার দিকে ফিরাব, যা তুমি পছন্দ কর। সুতরাং তোমার চেহারা মাসজিদুল হারামের দিকে ফিরাও এবং তোমরা যেখানেই থাক, তার দিকেই তোমাদের চেহারা ফিরাও। আর নিশ্চয় যারা কিতাবপ্রাপ্ত হয়েছে, তারা অবশ্যই জানে যে, তা তাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য এবং তারা যা করে, সে ব্যাপারে আল্লাহ গাফিল নন।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৪]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে রাসূল, কিবলা পরিবর্তন সংক্রান্ত ওহী নাযিলের প্রতীক্ষায় আমি আপনার আসমান পানে একের পর এক মুখ ফিরানো দেখেছি। তাই বাইতুল মুকাদ্দাসের দিক থেকে আমি আপনাকে এমন এক কিবলার দিকে ফিরাব যা আপনি পছন্দ করেন এবং যাতে আপনি সন্তুষ্ট হবেন। আর তা হলো মক্কার মসজিদে হারামের কিবলা। অতএব আপনি সেদিকে নিজের মুখ ফিরান। আর হে মুসলিমগণ, যেখানেই সালাতের ইচ্ছে কর না কেন তোমরা মসজিদে হারামের দিকে ফের। আর ইহুদী ও খ্রিস্টানদের মতো আল্লাহ যাদেরকে কিতাবের ইলম দান করেছেন, তারা নিশ্চিতভাবে জানে যে কা‘বার দিকে আপনার মুখ ফিরানো প্রসঙ্গটি তাদের কিতাবে প্রমাণিত। এই সংশয়বাদী সমালোচনাকারীদের ব্যাপারে আল্লাহ উদাসীন নন; এর তিনি তাদেরকে প্রতিদান দেবেন।
﴿وَلَئِنۡ أَتَيۡتَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ بِكُلِّ ءَايَةٖ مَّا تَبِعُواْ قِبۡلَتَكَۚ وَمَآ أَنتَ بِتَابِعٖ قِبۡلَتَهُمۡۚ وَمَا بَعۡضُهُم بِتَابِعٖ قِبۡلَةَ بَعۡضٖۚ وَلَئِنِ ٱتَّبَعۡتَ أَهۡوَآءَهُم مِّنۢ بَعۡدِ مَا جَآءَكَ مِنَ ٱلۡعِلۡمِ إِنَّكَ إِذٗا لَّمِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ ١٤٥﴾ [البقرة: ١٤٥]    
“আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তুমি যদি তাদের নিকট সব নিদর্শন নিয়ে আস, তারা তোমার কিবলার অনুসরণ করবে না আর তুমিও তাদের কিবলার অনুসরণকারী নও এবং তারা একে অপরের কিবলার অনুসরণকারী নয়। আর যদি তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ কর তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর, তবে নিশ্চয় তুমি তখন যালিমদের অন্তর্ভুক্ত।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৫]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে রাসূল, যাদেরকে তাওরাত ও ইঞ্জিল কিতাব দেওয়া হয়েছে আপনি যদি তাদের সামনে এ ব্যাপারে সব প্রমাণ ও দলীল নিয়ে আসেন যে সালাতে আপনার কিবলামুখী হবার বিষয়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য, তদুপরি বিদ্বেষ ও অহমিকা হেতু তারা আপনার অনুসরণ করবে না। আর পুনরায় আপনিও তাদের কিবলার অনুসারী হবেন না। আর একে অপরেও কেউ কারো কিবলার অনুসারী হবে না। আর আপনি যদি আপনার কাছে আপনিই সঠিক এবং তারা বেঠিক মর্মে ইলম আসার পরও কিবলা বা অন্য বিষয়ে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করেন, তবে সে ক্ষেত্রে আপনি নিজের ওপর যুলুমকারী বলে গণ্য হবেন। এই সম্বোধনটি সকল উম্মতের জন্য। আর এটি ইসলামী শরী‘আ বিরোধীদের অনুসরণ যারা করতে চায় তাদের জন্য ধমক ও সতর্কবাণী।
﴿ٱلَّذِينَ ءَاتَيۡنَٰهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ يَعۡرِفُونَهُۥ كَمَا يَعۡرِفُونَ أَبۡنَآءَهُمۡۖ وَإِنَّ فَرِيقٗا مِّنۡهُمۡ لَيَكۡتُمُونَ ٱلۡحَقَّ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ١٤٦ ﴾ [البقرة: ١٤٦]  
“যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তারা তাকে চিনে, যেমন চিনে তাদের সন্তানদেরকে। আর নিশ্চয় তাদের মধ্য থেকে একটি দল সত্যকে অবশ্যই গোপন করে, অথচ তারা জানে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৬]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর ইহুদী পাদ্রী ও খ্রিস্টান যাজকদের মধ্যে আমি যাদের তাওরাত ও ইঞ্জিলের জ্ঞান দিয়েছি, তারা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের কিতাবে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহের আলোকে এমনভাবে চেনে, যেভাবে তারা চেনে নিজেদের সন্তানকে। আর তাদের একটি দল সততা ও তার বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ পাবার পরও সত্যকে আড়াল করে।   
﴿ٱلۡحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡمُمۡتَرِينَ ١٤٧﴾ [البقرة: ١٤٧]  
“সত্য তোমার রবের পক্ষ থেকে। সুতরাং তুমি কখনো সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৭]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর : হে নবী, আপনার রবের পক্ষ থেকে যা আপনার প্রতি নাযিল করা হয়েছে তা সত্য। অতএব আপনি কখনো এ নিয়ে সংশয়বাদীদের কাতারে যাবেন না। এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করা হলেও এর দ্বারা উদ্দেশ্য সকল উম্মত।
﴿وَلِكُلّٖ وِجۡهَةٌ هُوَ مُوَلِّيهَاۖ فَٱسۡتَبِقُواْ ٱلۡخَيۡرَٰتِۚ أَيۡنَ مَا تَكُونُواْ يَأۡتِ بِكُمُ ٱللَّهُ جَمِيعًاۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ١٤٨ ﴾ [البقرة: ١٤٨]  
“আর প্রত্যেকের রয়েছে একটি দিক, যেদিকে সে চেহারা ফিরায়। সুতরাং তোমরা কল্যাণকর্মে প্রতিযোগিতা কর। তোমরা যেখানেই থাক না কেন, আল্লাহ তোমাদের সবাইকে নিয়ে আসবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৮]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: প্রত্যেক জাতিরই একটি কিবলা রয়েছে, যেদিকে ফিরে তারা সালাত আদায় করে। অতএব হে মু’মিনগণ, তোমরা সৎ কর্মসমূহে সক্রিয় হও আল্লাহ যা দীনে ইসলামে তোমাদের জন্য প্রবর্তন করেছেন। আর তোমরা যেখানেই থাক আল্লাহ কিয়ামতের দিন তোমাদের একত্র করবেন। সন্দেহ নেই আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।
﴿وَمِنۡ حَيۡثُ خَرَجۡتَ فَوَلِّ وَجۡهَكَ شَطۡرَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِۖ وَإِنَّهُۥ لَلۡحَقُّ مِن رَّبِّكَۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ١٤٩﴾ [البقرة: ١٤٩]  
“আর তুমি যেখান থেকেই বের হও, তোমার চেহারা মাসজিদুল হারামের দিকে ফিরাও। আর নিশ্চয় তা সত্য তোমার রবের পক্ষ থেকে এবং তোমরা যা কর, আল্লাহ তা থেকে গাফিল নন।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৯]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর হে নবী, আপনি যেখানেই সফরে বের হন না কেন, সালাত আদায় করতে চাইলে আপনার চেহারাকে মাসজিদুল হারাম অভিমুখী করুন। আর আপনার সেদিকে ফেরাটা আপনার রবের পক্ষ থেকে প্রমাণিত সত্য। আর তোমরা যা আমল করছ আল্লাহ সে সম্পর্কে উদাসীন নন এবং তিনি সেসবের প্রতিদান দেবেন।
﴿وَمِنۡ حَيۡثُ خَرَجۡتَ فَوَلِّ وَجۡهَكَ شَطۡرَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِۚ وَحَيۡثُ مَا كُنتُمۡ فَوَلُّواْ وُجُوهَكُمۡ شَطۡرَهُۥ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَيۡكُمۡ حُجَّةٌ إِلَّا ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ مِنۡهُمۡ فَلَا تَخۡشَوۡهُمۡ وَٱخۡشَوۡنِي وَلِأُتِمَّ نِعۡمَتِي عَلَيۡكُمۡ وَلَعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُونَ ١٥٠﴾ [البقرة: ١٥٠]  
“আর তুমি যেখান থেকেই বের হও, তোমার চেহারা মাসজিদুল হারামের দিকে ফিরাও এবং তোমরা যেখানেই থাক, তার দিকে তোমাদের চেহারা ফিরাও, যাতে তোমাদের বিপক্ষে মানুষের বিতর্ক করার কিছু না থাকে। তবে তাদের মধ্য থেকে যারা যুলম করেছে, তারা ছাড়া। সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, আমাকে ভয় কর। আর যাতে আমি আমার নিআমত তোমাদের ওপর পূর্ণ করতে পারি এবং যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হও।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫০]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর : হে নবী, আপনি যেখান থেকেই বের হন ন কেন, আপনার চেহারাকে মাসজিদুল হারাম অভিমুখী করুন। আর হে মুসলিমগণ, তোমরা যে ভূখণ্ডেই অবস্থান কর না কেন মাসজিদুল হারামের দিকে তোমাদের চেহারা ফেরাও। যাতে সেদিকে ফেরার পর তোমাদের বিরুদ্ধ লোকদের কোনো তর্ক-বিতর্কের মওকা না থাকে। তবে তাদের মধ্যে যারা অন্যায় ও হিংসা পোষণকারী তাদের কথা ভিন্ন। তারা তো তাদের বিবাদ ও বিরোধিতা চালিয়ে যাবেই। অতএব তাদের কোনো পরোয়া করো না। বরং আমার আদেশ ও নিষেধ পালনের মাধ্যমে আমাকেই ভয় করো। যাতে করে সবচে পূর্ণাঙ্গ দীন বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে আমি তোমাদের ওপর আমার নিয়ামতসম্ভারকে পূর্ণতা দিতে পারি। আর যাতে তোমরা হক ও সত্যের পথ খুঁজে পাও।
﴿كَمَآ أَرۡسَلۡنَا فِيكُمۡ رَسُولٗا مِّنكُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡكُمۡ ءَايَٰتِنَا وَيُزَكِّيكُمۡ وَيُعَلِّمُكُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمۡ تَكُونُواْ تَعۡلَمُونَ ١٥١﴾ [البقرة: ١٥١]  
“যেভাবে আমি তোমাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি তোমাদের মধ্য থেকে, যে তোমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে, তোমাদেরকে পবিত্র করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়। আর তোমাদেরকে শিক্ষা দেয় এমন কিছু যা তোমরা জানতে না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫১]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আমি কা‘বাকে তোমাদের কিবলা বানিয়ে যেমন নি‘আমতধন্য করেছি, তেমনি তোমাদের মাঝে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যিনি তোমাদের সামনে মিথ্যা থেকে সত্যকে সুস্পষ্টকারী আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন। তোমাদেরকে শিরকের নোংরামী এবং অসৎ চরিত্র থেকে পবিত্র করেন। তোমাদেরকে কুরআন, সুন্নাহ ও শরী‘আতের বিধি-বিধান শিক্ষা দেন এবং তোমাদেরকে নবীদের সংবাদ ও পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ঘটনাবলি সম্পর্কে জ্ঞান দান করেন যা তোমরা জানতে না।
﴿فَٱذۡكُرُونِيٓ أَذۡكُرۡكُمۡ وَٱشۡكُرُواْ لِي وَلَا تَكۡفُرُونِ ١٥٢﴾ [البقرة: ١٥٢]  
“অতএব, তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর আমার শোকর আদায় কর, আমার সঙ্গে কুফরী করো না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫২]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আল্লাহ মু’মিনদের নির্দেশ দিয়েছেন তাঁকে স্মরণ করার। এর জন্য তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বিনিময়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর তা হল ‘মালায়ে আলা’য় তাঁর স্মরণ করা হবে। আর হে মু’মিনগণ কথা ও কর্মে একমাত্র আমারই প্রশংসা কর। তোমাদের প্রতি দেওয়া নি‘আমতের অস্বীকৃতি জানিও না।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱسۡتَعِينُواْ بِٱلصَّبۡرِ وَٱلصَّلَوٰةِۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٥٣﴾ [البقرة: ١٥٣]  
“হে মু’মিনগণ, ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৩]  
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে মু’মিনগণ, তোমরা প্রতিটি বিষয়ে কেবল আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা কর। আর তা করবে বিপদ-আপদে ধৈর্য্য ধারণ এবং পাপ ও গুনাহ বর্জনের মাধ্যমে। আর ছাওয়াব ও নেকীর কাজগুলোয় এবং সালাতে ধৈর্য্য অবলম্বনের মাধ্যমে। যার দ্বারা অন্তর প্রশান্ত হয় এবং যা যাবতীয় অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। আর আপন সাহায্য, তাওফীক ও হিদায়াতের মাধ্যমে আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সঙ্গে আছেন। আয়াতে আল্লাহ মু’মিনদের সঙ্গে আছেন বলে জানানো হয়েছে, যে সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা হয়েছে। তবে সাধারণভাবে সাহায্য ও রহমতের মাধ্যমে সবার সঙ্গে থাকার বিষয়টি সকল সৃষ্টির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
﴿وَلَا تَقُولُواْ لِمَن يُقۡتَلُ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ أَمۡوَٰتُۢ ۚ بَلۡ أَحۡيَآءٞ وَلَٰكِن لَّا تَشۡعُرُونَ ١٥٤﴾ [البقرة: ١٥٤]  
“যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা অনুভব করতে পার না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৪]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে মু’মিনগণ, যারা আল্লাহর পথে লড়াই করে জীবন দিয়েছে তাদেরকে মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত। কবরে তারা বিশেষ এক জীবন লাভ করেছেন। যার প্রকৃত অবস্থা কেবল আল্লাহই জানেন; কিন্তু তোমরা তা অনুভব কর না। এ আয়াতে কবরে নি‘আমতের একটি প্রমাণ বিদ্যমান।  
﴿وَلَنَبۡلُوَنَّكُم بِشَيۡءٖ مِّنَ ٱلۡخَوۡفِ وَٱلۡجُوعِ وَنَقۡصٖ مِّنَ ٱلۡأَمۡوَٰلِ وَٱلۡأَنفُسِ وَٱلثَّمَرَٰتِۗ وَبَشِّرِ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٥٥﴾ [البقرة: ١٥٥]  
“আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৫]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: অবশ্যই আমি তোমাদেরকে খানিক ডর-শঙ্কা, ক্ষুৎ-পিপাসা দিয়ে পরীক্ষা করব। পরীক্ষা করব সম্পদ হ্রাস বা তা ক্ষয়ের মাধ্যমে, মৃত্যু বা আল্লাহর পথে শাহাদাতের মাধ্যমে, ফলন কম বা নষ্ট হওয়ার মাধ্যমে এবং খেজুর, আঙ্গুর ও বীজ স্বল্পতার দ্বারা। আর হে নবী, যারা এসব এবং এ ধরনের আপদে ধৈর্য ধরবে তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে খুশি ও সন্তোষজনক সুপরিণামের সুসংবাদ দিন।
﴿ٱلَّذِينَ إِذَآ أَصَٰبَتۡهُم مُّصِيبَةٞ قَالُوٓاْ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّآ إِلَيۡهِ رَٰجِعُونَ ١٥٦﴾ [البقرة: ١٥٦]  
“যারা, তাদেরকে যখন বিপদ আক্রান্ত করে তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৬]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর এই ধৈর্যশীলদের বৈশিষ্ট্য হল তারা অপ্রিয় কিছু হতে দেখলে বলে, আমরা আল্লাহর মালিকানাধীন দাস, যারা মালিকের ইচ্ছা ও চাহিদামাফিক পরিচালিত হয়। ফলে তিনি আমাদের যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারেন। আর মৃত্যু অতপর হিসাব ও প্রতিদানের জন্য পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে তারই কাছে আমরা প্রত্যাবর্তিত হব।
﴿أُوْلَٰٓئِكَ عَلَيۡهِمۡ صَلَوَٰتٞ مِّن رَّبِّهِمۡ وَرَحۡمَةٞۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُهۡتَدُونَ ١٥٧﴾ [البقرة: ١٥٧]  
“তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৭]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর এই ধৈর্যশীলদের জন্যই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে বিশাল রহমত ও প্রশংসা এবং এরাই সঠিক পথের সন্ধান লাভকারী।
﴿إِنَّ ٱلصَّفَا وَٱلۡمَرۡوَةَ مِن شَعَآئِرِ ٱللَّهِۖ فَمَنۡ حَجَّ ٱلۡبَيۡتَ أَوِ ٱعۡتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِ أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَاۚ وَمَن تَطَوَّعَ خَيۡرٗا فَإِنَّ ٱللَّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ ١٥٨﴾ [البقرة: ١٥٨]  
“নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে বাইতুল্লার হজ করবে কিংবা উমরা করবে তার কোনো অপরাধ হবে না যে, সে এগুলোর তাওয়াফ করবে। আর যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কল্যাণ করবে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ভালো কাজের পুরস্কারদাতা, সর্বজ্ঞ।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৮]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর : নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া (পূর্বদিকে কাবার কাছাকাছি দুটি ছোট পাহাড়) হলো আল্লাহর প্রকাশ্য নিদর্শনসমূহের অন্যতম, আল্লাহ যে দুই পাহাড়ের মধ্যখানে দৌড়াবার বিধান চালু করেছেন। অতএব, যে হজ বা উমরা করতে গিয়ে কাবা অভিমুখী হয়, তার জন্য এতদুভয়ের মধ্যে সাঈ করায় কোনো সমস্যা নাই। বরং তার জন্য তা ওয়াজিব। আর যে মনোতুষ্টির সঙ্গে একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার মানসিকতায় ইবাদত করে, আল্লাহ তার পুরস্কারদাতা। তিনি অল্পের জন্য বেশি প্রদান করেন এবং তিনি তাঁর বান্দাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে জানেন। ফলে তিনি তা বিফলে যেতে দেবেন না এবং তিল পরিমাণও কারো লোকসান ঘটাবেন না।
﴿إنَّ ٱلَّذِينَ يَكۡتُمُونَ مَآ أَنزَلۡنَا مِنَ ٱلۡبَيِّنَٰتِ وَٱلۡهُدَىٰ مِنۢ بَعۡدِ مَا بَيَّنَّٰهُ لِلنَّاسِ فِي ٱلۡكِتَٰبِ أُوْلَٰٓئِكَ يَلۡعَنُهُمُ ٱللَّهُ وَيَلۡعَنُهُمُ ٱللَّٰعِنُونَ ١٥٩﴾ [البقرة: ١٥٩]  
“নিশ্চয় যারা গোপন করে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ ও হিদায়াত যা আমি নাযিল করেছি, কিতাবে মানুষের জন্য তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করার পর, তাদেরকে আল্লাহ লা‘নত করেন এবং লা‘নতকারীগণও তাদেরকে লা‘নত করে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৯]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত এবং তাঁর আনীত দীনের প্রমাণবাহী সুস্পষ্ট নির্দশনাবলিকে যারা গোপন করে, যেমন ইহুদী যাজক, খ্রিস্টান পাদ্রী ও অন্য যারা তাওরাত ও ইঞ্জিলে মানুষের জন্য প্রকাশ করা আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয় গোপন করে, আল্লাহ তাদেরকেই তাঁর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন এবং সকল মাখলূক তাদের ওপর লা‘নত করে।
﴿إِلَّا ٱلَّذِينَ تَابُواْ وَأَصۡلَحُواْ وَبَيَّنُواْ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَتُوبُ عَلَيۡهِمۡ وَأَنَا ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ١٦٠﴾ [البقرة: ١٦٠]  
“তারা ছাড়া, যারা তাওবা করেছে, শুধরে নিয়েছে এবং স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। অতএব, আমি তাদের তাওবা কবূল করব। আর আমি তাওবা কবূলকারী, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬০]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: তবে যারা নিজেদের গুনাহসমূহর জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে ফিরে এসেছে, নিজেদের ভুল-ভ্রান্তিসমূহ শুধরে নিয়েছে এবং নিজেদের গোপন করা বিষয় প্রকাশ করে দিয়েছে তারা ছাড়া। কারণ আমি তাদের তাওবা কবূল করি এবং মাগফিরাতের মাধ্যমে আমি তাদের প্রতিদান দেই। আমার বান্দাদের মধ্যে যারা তাওবা করে আমি তাদের তাওবা কবূলকারী। আর আমি তাদের প্রতি দয়াবান। কারণ, আমি তাদেরকে তাওবার সুযোগ দিয়েছি এবং তাদের তাওবা কবূল করেছি।
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ وَمَاتُواْ وَهُمۡ كُفَّارٌ أُوْلَٰٓئِكَ عَلَيۡهِمۡ لَعۡنَةُ ٱللَّهِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ وَٱلنَّاسِ أَجۡمَعِينَ ١٦١﴾ [البقرة: ١٦١]  
“নিশ্চয় যারা কুফুরী করেছে এবং কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের ওপর আল্লাহ, ফেরেশতাগণ ও সকল মানুষের লা‘নত।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬১]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: সন্দেহ নাই যারা ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, সত্যকে গোপন করেছে এবং মৃত্যু অবধি তারা এ অবস্থায় বহাল থেকেছে, রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেবার মাধ্যমে তাদের ওপর আল্লাহ, ফেরেশতাবর্গ এবং সকল মানুষের অভিশাপ।
﴿خَٰلِدِينَ فِيهَا لَا يُخَفَّفُ عَنۡهُمُ ٱلۡعَذَابُ وَلَا هُمۡ يُنظَرُونَ ١٦٢﴾ [البقرة: ١٦٢]  
“তারা সেখানে স্থায়ী হবে। তাদের থেকে আযাব হালকা করা হবে না এবং তাদেরকে অবকাশও দেয়া হবে না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬২]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: লা‘নত ও অগ্নিতে থাকবে তারা অনন্তকাল, তাদের ‘আযাব কমানো বা লঘু করা হবে না। আর তাদেরকে কোনো ওজর-আপত্তি উত্থাপনের অবকাশ দেওয়া হবে না।
﴿وَإِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞۖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلرَّحۡمَٰنُ ٱلرَّحِيمُ ١٦٣﴾ [البقرة: ١٦٣]  
“আর তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি অতি দয়াময়, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৩]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর হে মানুষ, তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। তিনি তাঁর সত্ত্বায়, নামসমূহে, গুণাবলিতে, কর্মসমূহে এবং তাঁর জন্য তাঁর সৃষ্টির দাসত্বে একক। তিনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই। তিনি সকল মাখলূকের জন্য তাঁর সত্তা ও কর্মসমূহে অতিশয় দয়ালু। মু’মিনদের প্রতি তিনি দয়ার্দ্র।  
﴿إِنَّ فِي خَلۡقِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَٱخۡتِلَٰفِ ٱلَّيۡلِ وَٱلنَّهَارِ وَٱلۡفُلۡكِ ٱلَّتِي تَجۡرِي فِي ٱلۡبَحۡرِ بِمَا يَنفَعُ ٱلنَّاسَ وَمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مِن مَّآءٖ فَأَحۡيَا بِهِ ٱلۡأَرۡضَ بَعۡدَ مَوۡتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِن كُلِّ دَآبَّةٖ وَتَصۡرِيفِ ٱلرِّيَٰحِ وَٱلسَّحَابِ ٱلۡمُسَخَّرِ بَيۡنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَعۡقِلُونَ ١٦٤﴾ [البقرة: ١٦٤]  
“নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত-দিনের বিবর্তনে, সে নৌকায় যা সমুদ্রে মানুষের জন্য কল্যাণকর বস্তু নিয়ে চলে এবং আসমান থেকে আল্লাহ যে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন অতঃপর তার মাধ্যমে মরে যাওয়ার পর যমীনকে জীবিত করেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সকল প্রকার বিচরণশীল প্রাণী ও বাতাসের পরিবর্তনে এবং আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী স্থানে নিয়োজিত মেঘমালায় রয়েছে নিদর্শনসমূহ এমন কওমের জন্য, যারা বিবেকবান।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৪]  
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: সন্দেহ নাই সুউচ্চ ও সুবিস্তৃত আসমানসমূহ সৃষ্টিতে, পাহাড়রাশি, সমতল ও সমুদ্ররাজির সৃজনে, রাত ও দিনের দীর্ঘতা-হ্রস্বতায়, আলো-আঁধারিতে ও একের পিঠে অন্যের গমনাগমনে, মানুষের প্রয়োজনীয় রসদবাহী সমুদ্রে চলমান যানসমূহে, আসমান থেকে আল্লাহর বৃষ্টি বর্ষণে, অতপর তা থেকে ভূমিকে জীবন্তকরণে, তরু-লতাহীন শুকনো অবস্থা থেকে তাকে দৃষ্টিদন্দন সবুজকরণে, ভূমিতে বিচরণশীল আল্লাহর ছড়িয়ে দেওয়া প্রতিটি প্রাণীতে এবং বাতাসের পরিবর্তন ও দিক বদলে এবং  আসমান ও জমিনের মধ্যখানে প্রবাহমান মেঘমালার নেয়ামতে- এসবের প্রতিটিতে আল্লাহর একত্ববাদ, তাঁর অসংখ্য নি‘আমতের নিদর্শন বিদ্যমান, এমন কওমের জন্য যারা প্রমাণস্থান সম্পর্কে ধারণা রাখে এবং আল্লাহর একত্বাবাদ ও একমাত্র তাঁরই ইবাদতের উপযুক্ত হবার প্রমাণাদি অনুধাবন করতে পারে।
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ ٱللَّهِ أَندَادٗا يُحِبُّونَهُمۡ كَحُبِّ ٱللَّهِۖ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَشَدُّ حُبّٗا لِّلَّهِۗ وَلَوۡ يَرَى ٱلَّذِينَ ظَلَمُوٓاْ إِذۡ يَرَوۡنَ ٱلۡعَذَابَ أَنَّ ٱلۡقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعٗا وَأَنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعَذَابِ ١٦٥﴾ [البقرة: ١٦٥]  
“আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালবাসার মত ভালবাসে। আর যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহর জন্য ভালোবাসায় দৃঢ়তর। আর যদি যালিমগণ দেখে- যখন তারা আযাব দেখবে যে, নিশ্চয় সকল শক্তি আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আল্লাহ আযাব দানে কঠোর।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৫]  
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: এতসব অকাট্য প্রমাণাদি সত্ত্বেও একদল মানুষ আল্লাহ ছাড়া নানা মূর্তি, প্রতিমা বা সত্তাকে আল্লাহ তা‘আলার সমতুল্য স্থির করে এবং তাদেরকে এমন ভালোবাসা, ভক্তি ও আনুগত্য দেখায় যার যোগ্য কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা। আর এই কাফিররা আল্লাহ ও তাদের অন্য প্রতিমাদের যেমন ভালোবাসে, মু’মিনরা আল্লাহকে তার চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসে। কেননা মু’মিনগণ তাদের যাবতীয় ভালোবাসাকে সমর্পিত করে কেবল আল্লাহরই প্রতি। পক্ষান্তরে ওরা ভালোবাসায় অন্যকে অংশীদার বানায়। আর যদি দুনিয়ার জীবনে শিরকের দ্বারা নিজের ওপর যুলুমকারীরা জানত, যখন তারা আখিরাতের আজাব প্রত্যক্ষ করবে, যে একমাত্র আল্লাহর হাতেই সব শক্তি এবং নিশ্চয় আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা, তবে আল্লাহ ছাড়া কাউকে ইলাহ বানিয়ে তাঁকে বাদ দিয়ে তাদের ইবাদত করত না এবং তাদের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভের প্রয়াস পেত না।
﴿إِذۡ تَبَرَّأَ ٱلَّذِينَ ٱتُّبِعُواْ مِنَ ٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُواْ وَرَأَوُاْ ٱلۡعَذَابَ وَتَقَطَّعَتۡ بِهِمُ ٱلۡأَسۡبَابُ ١٦٦ ﴾ [البقرة: ١٦٦]  
“যখন, যাদেরকে অনুসরণ করা হয়েছে, তারা অনুসারীদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে এবং তারা আযাব দেখতে পাবে। আর তাদের সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৬]     
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: তারা যখন আখিরাতের ‘আযাব প্রত্যক্ষ করবে তখন শিরক করে তারা যাদের আনুগত্য করেছিল তারা তাদের থেকে দায়মুক্ত হয়ে যাবে। তাদের মধ্যে দুনিয়াতে স্থাপিত নৈকট্য, আনুগত্য ও ধর্ম ইত্যাদি কেন্দ্রীক সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।
﴿وَقَالَ ٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُواْ لَوۡ أَنَّ لَنَا كَرَّةٗ فَنَتَبَرَّأَ مِنۡهُمۡ كَمَا تَبَرَّءُواْ مِنَّاۗ كَذَٰلِكَ يُرِيهِمُ ٱللَّهُ أَعۡمَٰلَهُمۡ حَسَرَٰتٍ عَلَيۡهِمۡۖ وَمَا هُم بِخَٰرِجِينَ مِنَ ٱلنَّارِ ١٦٧﴾ [البقرة: ١٦٧]  
“আর যারা অনুসরণ করেছে, তারা বলবে, ‘যদি আমাদের ফিরে যাওয়ার সুযোগ হত, তাহলে আমরা তাদের থেকে আলাদা হয়ে যেতাম, যেভাবে তারা আলাদা হয়ে গিয়েছে’। এভাবে আল্লাহ তাদেরকে তাদের আমলসমূহ দেখাবেন, তাদের জন্য আক্ষেপস্বরূপ। আর তারা আগুন থেকে বের হতে পারবে না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৭]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর ওই অনুসারীরা বলবে, হায় আমরা যদি পুনরায় দুনিয়ায় আবার ফিরে যেতে পারতাম! তাহলে এই নেতাদের থেকে আমরাও সম্পর্ক ছিন্ন ঘোষণা করতাম। যেভাবে তারা আমাদের থেকে নিজেদের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ যেমন তাদের আযাবের তীব্রতা দেখাবেন, তেমনি তিনি আফসোস বাড়াতে তাদের বাতিল আমলগুলোও দেখাবেন। তারা কখনো জাহান্নামের অগ্নি থেকে বের হতে পারবে না।  
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ كُلُواْ مِمَّا فِي ٱلۡأَرۡضِ حَلَٰلٗا طَيِّبٗا وَلَا تَتَّبِعُواْ خُطُوَٰتِ ٱلشَّيۡطَٰنِۚ إِنَّهُۥ لَكُمۡ عَدُوّٞ مُّبِينٌ ١٦٨﴾ [البقرة: ١٦٨]  
“হে মানুষ, জমিনে যা রয়েছে, তা থেকে হালাল পবিত্র বস্তু আহার কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট শত্রু।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৮]  
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে লোক সকল, আল্লাহ জমিনে তোমাদের জন্য রিযিকসমূহের মধ্যে যা বৈধ করেছেন সেগুলো তোমরা ভক্ষণ করো। তা হতে হবে অপবিত্র নয়; পবিত্র, ক্ষতিকর নয়; উপকারী। এবং হালাল-হারাম ও গুনাহ-বিদআতে তোমরা শয়তানের পথ অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।
﴿إِنَّمَا يَأۡمُرُكُم بِٱلسُّوٓءِ وَٱلۡفَحۡشَآءِ وَأَن تَقُولُواْ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ١٦٩﴾ [البقرة: ١٦٩]  
“নিশ্চয় সে তোমাদেরকে আদেশ দেয় মন্দ ও অশ্লীল কাজের এবং আল্লাহর ব্যাপারে এমন কিছু বলতে, যা তোমরা জান না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৯]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: নিশ্চয় শয়তান তোমাদেরকে সব ধরনের গর্হিত ও গুনাহকর্মের এবং সকল অশোভন কাজের আদেশ দেয় যা তোমাদের মানহানী ঘটায়। সে আদেশ দেয় যাতে তোমরা আল্লাহর ওপর হালালকে হারাম করে এবং হারামকে হালাল করে না জেনে মিথ্যাচার করো।
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ ٱتَّبِعُواْ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ قَالُواْ بَلۡ نَتَّبِعُ مَآ أَلۡفَيۡنَا عَلَيۡهِ ءَابَآءَنَآۚ أَوَلَوۡ كَانَ ءَابَآؤُهُمۡ لَا يَعۡقِلُونَ شَيۡ‍ٔٗا وَلَايَهۡتَدُونَ ١٧٠﴾ [البقرة: ١٧٠]  
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা অনুসরণ কর, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন’, তারা বলে, ‘বরং আমরা অনুসরণ করব আমাদের পিতৃ-পুরুষদেরকে যার ওপর পেয়েছি’। যদি তাদের পিতৃ-পুরুষরা কিছু না বুঝে এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত না হয়, তাহলেও কি?” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭০]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর হীতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে মু’মিনরা যখন পথভ্রষ্টদের বলে, আল্লাহ যে কুরআন ও হিদায়াত নাযিল করেছেন তোমরা তার অনুসরণ কর, তখন তাদের পূর্বসুরী মুশরিকদের অন্ধ অনুকরণে অনড় থেকে বলে, আমরা তোমাদের দীনের অনুসারী হব না; আমাদের বাপ-দাদাদের যে বিশ্বাসের ওপর পেয়েছি তারই অনুসরণ করব। তাদের পূর্বপুরুষরা যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে কিছু না বুঝে এবং কোনো হিদায়াত না লাভ করে তবেও কি তারা তাদের অনুসরণ করবে?
﴿وَمَثَلُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ كَمَثَلِ ٱلَّذِي يَنۡعِقُ بِمَا لَا يَسۡمَعُ إِلَّا دُعَآءٗ وَنِدَآءٗۚ صُمُّۢ بُكۡمٌ عُمۡيٞ فَهُمۡ لَا يَعۡقِلُونَ ١٧١﴾ [البقرة: ١٧١]  
“আর যারা কুফরী করেছে তাদের উদাহরণ তার মত, যে এমন কিছুর জন্য চিৎকার করছে, হাঁক-ডাক ছাড়া যে কিছু শোনে না। তারা বধির, বোবা, অন্ধ। তাই তারা বুঝে না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭১]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর যারা কুফরী করেছে এবং যারা তাদেরকে হিদায়াত ও ঈমানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তাদের অবস্থা ওই রাখালের অবস্থার মতো যে চতুষ্পদ প্রাণীদের ডাকে এবং সতর্ক করে, ফলে সে তার কথার অর্থ বুঝে না। তারা শোনে শুধু চিৎকার ও বিকট আওয়াজ। আর এই কাফিররা বধির, যারা নিজেদের কানকে সত্য শ্রবণ থেকে বন্ধ করে দিয়েছে, তারা হলো মুক যারা নিজেদের জিহ্বাকে সত্য উচ্চারণ থেকে বোবা বানিয়ে দিয়েছে এবং তারা হলো অন্ধ, যারা সত্যের জাজ্জ্বল্যমান নিদর্শনগুলোও দেখতে পায় না। এককথায় তারা তাদের বিবেক-বুদ্ধিকে তাদের কল্যাণের পথে কাজে লাগায় না।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُلُواْ مِن طَيِّبَٰتِ مَا رَزَقۡنَٰكُمۡ وَٱشۡكُرُواْ لِلَّهِ إِن كُنتُمۡ إِيَّاهُ تَعۡبُدُونَ ١٧٢﴾ [البقرة: ١٧٢]  
“হে মু’মিনগণ, আহার কর আমি তোমাদেরকে যে হালাল রিযক দিয়েছি তা থেকে এবং আল্লাহর জন্য শোকর কর, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদাত কর।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭২]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে মু’মিনগণ, আমি তোমাদের যে রকমারি খাদ্য দান করেছি তা ভক্ষণ কর। তোমরা কাফিরদের মতো হয়ো না যারা পবিত্র বস্তুসমূহকে হারাম আর অপবিত্র বস্তুনিচয়কে হালাল করে। আর তোমরা তোমাদের মুখ, অন্তর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো তার নানাবিধ নি‘আমতের জন্য। যদি তোমরা প্রকৃতই তাঁর নির্দেশ পালনকারী, তাঁর অনুসারী শ্রোতা হও এবং প্রকৃতই একমাত্র শরীকবিহীন আল্লাহর ইবাদত করো।
﴿إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيۡكُمُ ٱلۡمَيۡتَةَ وَٱلدَّمَ وَلَحۡمَ ٱلۡخِنزِيرِ وَمَآ أُهِلَّ بِهِۦ لِغَيۡرِ ٱللَّهِۖ فَمَنِ ٱضۡطُرَّ غَيۡرَ بَاغٖ وَلَا عَادٖ فَلَآ إِثۡمَ عَلَيۡهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٌ ١٧٣﴾ [البقرة: ١٧٣]  
“নিশ্চয় তিনি তোমাদের ওপর হারাম করেছেন মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোশ্ত এবং যা গায়রুল্লাহর নামে যবেহ করা হয়েছে। সুতরাং যে বাধ্য হবে, অবাধ্য বা সীমালঙ্ঘনকারী না হয়ে, তাহলে তার কোনো পাপ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৩]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর : এটা সন্দেহাতীত যে আল্লাহ তোমাদের জন্য তা-ই হারাম করেছেন যা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। যেমন মৃতপ্রাণী, যা শরী‘আতসম্মত পন্থায় জবাই করা হয় নি এবং শূকরের গোশত ও আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে জবেহকৃত প্রাণীসমূহ। আর তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ ও দয়ার আরেকটি নিদর্শন হলো,  তিনি তোমাদের জন্য অপারগ অবস্থায় এসব নিষিদ্ধ জিনিস ভক্ষণও হালাল করেছেন। অতএব যে কেউ প্রয়োজনের খাতিরে এসবের কিছু আহার করে, প্রয়োজনের সীমা অতিক্রম না করে এবং তিনি যা হালাল করেছেন তাতে বাড়াবাড়ি না করে, তবে তাতে তার কোনো অপরাধ নেই। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য ক্ষমাশীল এবং তাদের প্রতি দয়াবান।
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ يَكۡتُمُونَ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلۡكِتَٰبِ وَيَشۡتَرُونَ بِهِۦ ثَمَنٗا قَلِيلًا أُوْلَٰٓئِكَ مَا يَأۡكُلُونَ فِي بُطُونِهِمۡ إِلَّا ٱلنَّارَ وَلَا يُكَلِّمُهُمُ ٱللَّهُ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمۡ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ١٧٤﴾ [البقرة: ١٧٤]  
“নিশ্চয় যারা গোপন করে যে কিতাব আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং এর বিনিময়ে সামান্য মূল্য গ্রহণ করে, তারা শুধু আগুনই তাদের উদরে পুরে। আর আল্লাহ কিয়ামতের দিনে তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক ‘আযাব।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৪]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: যারা আল্লাহর কিতাবসমূহে নাযিলকৃত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিচয় ও অন্যান্য সত্য বিষয় লুকিয়ে ফেলে এবং এ লুকানোর মাধ্যমে তারা দুনিয়ার ইষৎ সামগ্রী লাভে আগ্রহী হয়, সত্য গোপনের বিনিময়ে তারা কেবল জাহান্নামের অগ্নিই গলধকরণ করে, যা তাদের উদরে প্রজ্জ্বলিত হয়। আর ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি হেতু কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না এবং তাদেরকে নিজেদের কুফর ও পাপের নাপাকি থেকে পবিত্র করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।  
﴿أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱشۡتَرَوُاْ ٱلضَّلَٰلَةَ بِٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡعَذَابَ بِٱلۡمَغۡفِرَةِۚ فَمَآ أَصۡبَرَهُمۡ عَلَى ٱلنَّارِ ١٧٥﴾ [البقرة: ١٧٥]  
“তারাই হিদায়াতের পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা এবং মাগফিরাতের পরিবর্তে ‘আযাব ক্রয় করেছে। আগুনের ওপর তারা কতই না ধৈর্যশীল।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৫]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: এসব গুণে গুণান্বিতরাই সুপথের পরিবর্তে কুপথ এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তিকে অপরিহার্য করেছে। জাহান্নামের অগ্নিকে অপরিহার্যকারী কাজগুলোয় জড়িয়ে তারা কী দুঃসাহসের পরিচায়ই না দিচ্ছে!! এদের কর্মকাণ্ড দেখে স্বয়ং আল্লাহই আশ্চর্য প্রকাশ করছেন। অতএব হে মানবসম্প্রদায়, এদের সাহস, জাহান্নামের আগুনে এদের ধৈর্য্য ও দীর্ঘ অবস্থান দেখে তোমরাও বিস্মিত ও বিচলিত হও। উল্লেখ্য, তাদের আচরণকে হেয় প্রতিপন্ন করা এবং তাদেরকে তাচ্ছিল্য হিসেবে এ কথা বলা হয়েছে।
﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّ ٱللَّهَ نَزَّلَ ٱلۡكِتَٰبَ بِٱلۡحَقِّۗ وَإِنَّ ٱلَّذِينَ ٱخۡتَلَفُواْ فِي ٱلۡكِتَٰبِ لَفِي شِقَاقِۢ بَعِيدٖ ١٧٦﴾ [البقرة: ١٧٦]  
“তা এ কারণে যে, আল্লাহ যথার্থরূপে কিতাব নাযিল করেছেন। আর নিশ্চয় যারা কিতাবে মতবিরোধ করেছে, তারা অবশ্যই সুদূর মতানৈক্যে রয়েছে।
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: তারা এই ‘আযাবের উপযুক্ত হয়েছে এ জন্য যে, রাসূলগণের প্রতি আল্লাহ যে সুস্পষ্ট সত্য সম্বলিত কিতাবগুলো নাযিল করেছেন তারা তা অস্বীকার করেছে। আর যারা কিতাব নিয়ে বিরোধ করেছে এবং এর কিছুতে ঈমান এনেছে আর কিছুকে অস্বীকার করেছে, সন্দেহ নেই তারা সত্য ও বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে সরে বিতর্ক ও বিরোধে লিপ্ত রয়েছে।
﴿لَّيۡسَ ٱلۡبِرَّ أَن تُوَلُّواْ وُجُوهَكُمۡ قِبَلَ ٱلۡمَشۡرِقِ وَٱلۡمَغۡرِبِ وَلَٰكِنَّ ٱلۡبِرَّ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ وَٱلۡكِتَٰبِ وَٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ وَءَاتَى ٱلۡمَالَ عَلَىٰ حُبِّهِۦ ذَوِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينَ وَٱبۡنَ ٱلسَّبِيلِ وَٱلسَّآئِلِينَ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَأَقَامَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَى ٱلزَّكَوٰةَ وَٱلۡمُوفُونَ بِعَهۡدِهِمۡ إِذَا عَٰهَدُواْۖ وَٱلصَّٰبِرِينَ فِي ٱلۡبَأۡسَآءِ وَٱلضَّرَّآءِ وَحِينَ ٱلۡبَأۡسِۗ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ صَدَقُواْۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُتَّقُونَ ١٧٧﴾ [البقرة: ١٧٧]  
“ভালো কাজ এটা নয় যে, তোমরা তোমাদের চেহারা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফিরাবে; বরং ভালো কাজ হল যে ঈমান আনে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি এবং যে সম্পদ প্রদান করে তার প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও নিকটাত্মীয়গণকে, ইয়াতীম, অসহায়, মুসাফির ও প্রার্থনাকারীকে এবং বন্দিমুক্তিতে এবং যে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করে, যারা ধৈর্যধারণ করে কষ্ট ও দুর্দশায় ও যুদ্ধের সময়ে। তারাই সত্যবাদী এবং তারাই মুত্তাকী।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৭]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আল্লাহর কাছে সালাতে পূর্ব বা পশ্চিমমুখী হওয়ায় কোনো কল্যাণ নেই যদি তা আল্লাহর নির্দেশ বা বিধান না হয়; বরং যাবতীয় কল্যাণ নিহিত ওই ব্যক্তির ঈমানে যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে আর একমাত্র তাঁকে শরীকবিহীন মাবুদ সাব্যস্ত করে এবং পুনরুত্থান ও প্রতিদান দিবসের প্রতি, সকল ফিরিশতার প্রতি, নাযিলকৃত সকল কিতাবের প্রতি এবং কোনো পার্থক্য না করে সকল নবীর প্রতি ঈমান রাখে। প্রচণ্ড ভালোবাসা সত্ত্বেও নিজ সম্পদ ব্যয় করে নিকটাত্মীয়, অপ্রাপ্ত বয়সে বাবাহারা অনাথ-এতিম, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জর অসহায় মিসকিন, নিজ পরিবার ও সহায়-সম্পদ থেকে দূরে অবস্থানকারী মুসাফির এবং সীমাহীন প্রয়োজনে হাত পাততে বাধ্য হওয়া অভাবী বা দাস ও বন্দি মুক্তির পেছনে। আর যারা সালাত কায়েম করে, ফরয যাকাত আদায় করে, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং অভাব, অসুস্থতা ও লড়াইয়ের কষ্টে ধৈর্য্য ধারণ করে, এতসব গুণে গুণান্বিতরাই সেই দল যারা নিজেদের ঈমানকে বাস্তবায়ন করেছে। আর এরাই সেই দল যারা আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করে তাঁর অবাধ্যাচরণ থেকে দূরে থেকেছে।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلۡقِصَاصُ فِي ٱلۡقَتۡلَىۖ ٱلۡحُرُّ بِٱلۡحُرِّ وَٱلۡعَبۡدُ بِٱلۡعَبۡدِ وَٱلۡأُنثَىٰ بِٱلۡأُنثَىٰۚ فَمَنۡ عُفِيَ لَهُۥ مِنۡ أَخِيهِ شَيۡءٞ فَٱتِّبَاعُۢ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَأَدَآءٌ إِلَيۡهِ بِإِحۡسَٰنٖۗ ذَٰلِكَ تَخۡفِيفٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَرَحۡمَةٞۗ فَمَنِ ٱعۡتَدَىٰ بَعۡدَ ذَٰلِكَ فَلَهُۥ عَذَابٌ أَلِيمٞ ١٧٨﴾ [البقرة: ١٧٨]  
“হে মু’মিনগণ, নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের ওপর ‘কিসাস’ ফরয করা হয়েছে। স্বাধীনের বদলে স্বাধীন, দাসের বদলে দাস, নারীর বদলে নারী। তবে যাকে কিছুটা ক্ষমা করা হবে তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে, তাহলে সততার অনুসরণ করবে এবং সুন্দরভাবে তাকে আদায় করে দেবে। এটি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে হালকাকরণ ও রহমত। সুতরাং এরপর যে সীমালঙ্ঘন করবে, তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক ‘আযাব।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৮]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে ওই সকল লোক যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করেছ এবং তাঁর শরীয়ত অনুযায়ী জীবনযাপন করেছ, আল্লাহ তোমাদের ওপর স্বেচ্ছাহত্যাকারীর সমান প্রতিদান প্রদান ফরয করেছেন। তবে শর্ত হলো এ ক্ষেত্রে সমতা ও সমগোত্রীয়তা রক্ষা করতে হবে : স্বাধীনের বদলায় স্বাধীন, দাসের বদলায় দাস এবং নারীর বদলায় নারী। তবে যদি নিহত ব্যক্তির পরিজন ও অভিভাবকবৃন্দ হুবহু বদলার বিষয়টি ক্ষমা করে রক্তপণ গ্রহণে সন্তুষ্ট হয়- আর তা হলো ক্ষমার বদলে অপরাধী নির্ধারিত পরিমাণে অর্থ পরিশোধ করবে- তবে উভয়পক্ষ সদাচারের পরিচয় দেবে। অতএব, নিহতের স্বজনরা কোনোরূপ বাড়াবাড়ি ব্যতিরেকে রক্তপণ তলব করবে। তেমনি হত্যাকারীও কোনোরূপ কাটছাট বা টালবাহানা ছাড়া সদুপায়ে তাদের প্রাপ্য পরিশোধ করে দেবে। আর রক্তপণ দিয়ে ক্ষমার সুযোগটি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে দয়া ও ছাড় হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। কারণ, এতে যেমন শাস্তি হ্রাস করা হয়েছে তেমনি নিহতের পরিবারের জন্য আর্থিকভাবে লাভবান হবার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। অতপর যে হত্যাকারীর কাছ থেকে রক্তপণ নিয়ে আবার তাকে হত্যা করে, তবে তার জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে, দুনিয়ায় কিসাসের মাধ্যমে বা আখিরাতে আগুনের মাধ্যমে।
﴿وَلَكُمۡ فِي ٱلۡقِصَاصِ حَيَوٰةٞ يَٰٓأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٧٩﴾ [البقرة: ١٧٩]  
“আর হে বিবেকসম্পন্নগণ, কিসাসে রয়েছে তোমাদের জন্য জীবন, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৯]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর তোমাদের জন্য কিসাসের বিধান প্রচলন এবং তা কার্যকরকরণে নিরাপদ জীবন রয়েছে হে সুস্থ জ্ঞান সম্পন্ন লোকেরা। এটা করবে তোমরা তাকওয়া ও আল্লাহর ভীতি হেতু সর্বদা তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে।  
﴿كُتِبَ عَلَيۡكُمۡ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ ٱلۡمَوۡتُ إِن تَرَكَ خَيۡرًا ٱلۡوَصِيَّةُ لِلۡوَٰلِدَيۡنِ وَٱلۡأَقۡرَبِينَ بِٱلۡمَعۡرُوفِۖ حَقًّا عَلَى ٱلۡمُتَّقِينَ ١٨٠﴾ [البقرة: ١٨٠]  
“তোমাদের ওপর ফরয করা হয়েছে যে, যখন তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হবে, যদি সে কোন সম্পদ রেখে যায়, তবে পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য ন্যায়ভিত্তিক অসিয়ত করবে। এটি মুত্তাকীদের দায়িত্ব।
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: তোমাদের কারো সামনে যখন মৃত্যুর লক্ষণ প্রকাশ পায় তবে সে যদি সম্পদ রেখে যায় তাহলে পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য ইনসাফপূর্ণভাবে একটি অংশের অসিয়ত করে যাবে। যা অনধিক মোট সম্পদের এক তৃতীয়াংশ হতে পারে। এটি একটি প্রমাণিত হক, তাকওয়ার অধিকারী যারা আল্লাহকে ভয় করে তারা এর আমল করে। এটি ছিল মিরাস বা উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হবার আগেকার কথা, যাতে প্রত্যেকের অংশ সুনির্দিষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে।
﴿فَمَنۢ بَدَّلَهُۥ بَعۡدَ مَا سَمِعَهُۥ فَإِنَّمَآ إِثۡمُهُۥ عَلَى ٱلَّذِينَ يُبَدِّلُونَهُۥٓۚ إِنَّ ٱللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٞ ١٨١﴾ [البقرة: ١٨١]  
“অতএব যে তা শ্রবণ করার পর পরিবর্তন করবে, তবে এর পাপ তাদের হবে, যারা তা পরিবর্তন করে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮১]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: অতপর যে ব্যক্তি মৃত্যুর পর ওই ব্যক্তির অসিয়ত জীবদ্দশায় পরিবর্তন করে তবে এর দায় কেবল তা বদল ও পরিবর্তনকারীর। সন্দেহ নেই আল্লাহ তোমাদের অসিয়ত ও যাবতীয় কথা শ্রবণ করেন এবং তোমাদের অন্তরের উচিত ও ইনসাফ বা অনুচিত ও জুলুমের প্রতি গোপন ঝোঁক সম্পর্কে জানেন। আর তিনি এর জন্য তোমাদের প্রতিদানও দেবেন।  
﴿فَمَنۡ خَافَ مِن مُّوصٖ جَنَفًا أَوۡ إِثۡمٗا فَأَصۡلَحَ بَيۡنَهُمۡ فَلَآ إِثۡمَ عَلَيۡهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ١٨٢﴾ [البقرة: ١٨٢]  
“তবে কেউ যদি অসিয়তকারীর পক্ষ থেকে পক্ষপাতিত্ব ও পাপের আশঙ্কা করে, অতঃপর তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়, তাহলে তার কোনো পাপ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮২]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: তবে যদি কেউ অসিয়তকারীর ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অসিয়তে ইনসাফ থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হন তবে তিনি অসিয়তের সময় অধিক ইনসাফ হিস্যাই উল্লেখ করবেন। যদি তা তার পক্ষে সম্ভব না হয় তবে তিনি ওসিয়ত পরিবর্তনে উভয় পক্ষের মধ্যে মিমাংসা করে দেবেন। যাতে করে তা শরীয়তের চাওয়া মত হয়। এ মিমাংসা কাজে তার জন্য কোনো গুনাহ নেই। সন্দেহ নেই আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি ক্ষমাশীল ও অত্যধিক মেহেরবান।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٨٣﴾ [البقرة: ١٨٣]  
“হে মু’মিনগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে ওই সকল লোক, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করেছ এবং তাঁর শরীয়ত অনুযায়ী জীবনযাপন করেছ, আল্লাহ তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করেছেন যেমন ফরয করেছিলেন তিনি তোমাদের আগে অতীত হওয়া লোকদের ওপর। যাতে করে তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর এবং এর ফলে তোমরা গুনাহ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখে একমাত্র তাঁরই ইবাদত ও আনুগত্য কর।
﴿أَيَّامٗا مَّعۡدُودَٰتٖۚ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ وَعَلَى ٱلَّذِينَ يُطِيقُونَهُۥ فِدۡيَةٞ طَعَامُ مِسۡكِينٖۖ فَمَن تَطَوَّعَ خَيۡرٗا فَهُوَ خَيۡرٞ لَّهُۥۚ وَأَن تَصُومُواْ خَيۡرٞ لَّكُمۡ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ١٨٤﴾ [البقرة: ١٨٤]  
“নির্দিষ্ট কয়েক দিন। তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদয়া- একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা। অতএব যে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত সৎকাজ করবে, তা তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর সিয়াম পালন তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জান।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৪]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আল্লাহ তোমাদের ওপর গুটিকয়েক দিনের সাওম ফরয করেছেন। আর তা হলো রমযান মাসের দিনগুলো। অতএব যে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হয়, যার ফলে তার জন্য সাওম রাখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় বা সে মুসাফির হয় তবে তার জন্য সাওম ভাঙ্গার অনুমতি রয়েছে। সে ক্ষেত্রে তার জন্য অন্য সময় না করা রোযাগুলোর কাযা আদায় করতে হবে। আর যাদের জন্য সাওম করা জরুরী; কিন্তু তার কোনো এমন অবস্থা থাকে যা উন্নতির সম্ভবনা রাখে না যেমন অতি বৃদ্ধ, এমন রোগী যার আরোগ্যের সম্ভাবনা নাই, তবে তার জন্য প্রতি দিনের সাওম তরকের বিনিময়ে একটি করে ফিদইয়া আদায় করতে হবে। আর তা হলো একজন করে মিসকীনকে আহার করানো। তবে যে নিজের থেকে এ ফিদইয়ায় পরিমাণ বাড়াবে তবে তার জন্য তা উত্তম বটে। মনে রাখবে, ফিদইয়া দেওয়ার চেয়ে কষ্ট সয়ে রোযা রাখাই তোমাদের জন্য শ্রেয়। যদি তোমরা আল্লাহর কাছে এ সাওমের মহামর্যাদার কথা জানতে।
﴿شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُۖ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۗ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ وَلِتُكۡمِلُواْ ٱلۡعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡ وَلَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ١٨٥﴾ [البقرة: ١٨٥]  
“রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: মাহে রমযান, আল্লাহ যাতে লাইতুল কদরে কুরআন নাযিল শুরু করেছিলেন; মানুষকে সত্যের পথ নির্দেশ করতে। এর মধ্যে আল্লাহর হিদায়াতের এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী সুস্পষ্ট প্রমাণাদি রয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে মাসটি পাবে এবং সে তখন সুস্থ ও মুকীম (মুসাফিরের বিপরীত) থাকবে, তবে সে অবশ্যই এর দিবসগুলোয় রোযা রাখবে। তবে অসুস্থ ও মুসাফিরের জন্য রোযা ভাঙ্গার অবকাশ রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে তারা ওই দিনগুলোর কাযা তুলে নেবে। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য তাঁর শরীয়তে সহজ ও নরম করতে চান। তোমাদের জন্য তিনি কঠোর বা শক্ত করতে চান না। যাতে তোমরা রোযার মেয়াদ এক মাস পুরো কর। যাতে তোমরা ঈদুল ফিতরে আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণার মাধ্যমে সিয়াম সাধনা সমাপ্ত কর। যাতে তোমরা তোমাদের সুপথ দেখানোর নিমিত্তে তাঁর মহত্ত্ব বর্ণনা কর। এবং যাতে তোমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর তোমাদের জন্য তিনি যে হেদায়েত, তাওফীক ও সহজীকরণ করেছেন।
﴿وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعۡوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ فَلۡيَسۡتَجِيبُواْ لِي وَلۡيُؤۡمِنُواْ بِي لَعَلَّهُمۡ يَرۡشُدُونَ ١٨٦﴾ [البقرة: ١٨٦]  
“আর যখন আমার বান্দাগণ তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, আমি তো নিশ্চয় নিকটবর্তী। আমি আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দেই, যখন সে আমাকে ডাকে। সুতরাং তারা যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে। আশা করা যায় তারা সঠিক পথে চলবে।”১৮৬]   
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে নবী, আমার বান্দারা যখন তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে, তখন তাদের বলবে, নিশ্চয় আমি তাদের অতি কাছে। কেউ যখন আমায় ডাকে আমি সেই ডাকে সাড়া দেই। অতএব আমি তোমাদের যা কিছুর আদেশ দেই এবং যা কিছু নিষেধ করি, সে ব্যাপারে আমার আনুগত্য কর এবং আমার প্রতি ঈমান আন। আশা করা যায় তারা তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের পথে ধাবিত হবে। এ আয়াতে আল্লাহ তাঁর বান্দার নিকটবর্তী থাকার বার্তা দিয়েছেন। তাঁর বড়ত্ব ও মহত্ত্বের জন্য উপযুক্ত নৈকট্য।
﴿أُحِلَّ لَكُمۡ لَيۡلَةَ ٱلصِّيَامِ ٱلرَّفَثُ إِلَىٰ نِسَآئِكُمۡۚ هُنَّ لِبَاسٞ لَّكُمۡ وَأَنتُمۡ لِبَاسٞ لَّهُنَّۗ عَلِمَ ٱللَّهُ أَنَّكُمۡ كُنتُمۡ تَخۡتَانُونَ أَنفُسَكُمۡ فَتَابَ عَلَيۡكُمۡ وَعَفَا عَنكُمۡۖ فَٱلۡـَٰٔنَ بَٰشِرُوهُنَّ وَٱبۡتَغُواْ مَا كَتَبَ ٱللَّهُ لَكُمۡۚ وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ثُمَّ أَتِمُّواْ ٱلصِّيَامَ إِلَى ٱلَّيۡلِۚ وَلَا تُبَٰشِرُوهُنَّ وَأَنتُمۡ عَٰكِفُونَ فِي ٱلۡمَسَٰجِدِۗ تِلۡكَ حُدُودُ ٱللَّهِ فَلَا تَقۡرَبُوهَاۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ ءَايَٰتِهِۦ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ يَتَّقُونَ ١٨٧﴾ [البقرة: ١٨٧]  
“সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীদের নিকট গমন হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের জন্য পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের জন্য পরিচ্ছদ। আল্লাহ জেনেছেন যে, তোমরা নিজদের সঙ্গে খিয়ানত করছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের তাওবা কবূল করেছেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন। অতএব, এখন তোমরা তাদের সঙ্গে মিলিত হও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তা অনুসন্ধান কর। আর আহার কর ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্ট হয়। অতঃপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর। আর তোমরা মাসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সঙ্গে মিলিত হয়ো না। এটা আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং তোমরা তার নিকটবর্তী হয়ো না। এভাবেই আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ মানুষের জন্য স্পষ্ট করেন যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে।
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আল্লাহ তোমাদের জন্য রমযান মাসের রাতগুলোয় স্ত্রীদের সঙ্গে মিলন বৈধ করেছেন। তারা তোমাদের জন্য আচ্ছাদন ও নিরাপত্তা স্বরূপ তোমরাও তাদের জন্য আচ্ছাদন ও নিরাপত্তা স্বরূপ।  তোমরা যে সিয়ামের রাতগুলোয় স্ত্রী সহবাস হারাম সংক্রান্ত আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘন করেছ আল্লাহ সে বিষয়ে ওয়াকিফহাল আছেন। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের তাওবা গ্রহণ করেছেন এবং এ বিষয়ে তোমাদের জন্য সহজিকরণ করেছেন। অতএব এখন তোমরা তাদের সঙ্গে সহবাস কর এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যে সন্তানাদি বরাদ্দ রেখেছেন তার তালাশ কর। আর তোমরা সুবহে সাদিকে রাতের আঁধার থেকে ঊষার কিরণ প্রকাশ অবধি খাও ও পান কর। অতপর সূর্য ডুবে রাত আসা অবধি রোযা ভঙ্গকারী বিষয়াদি থেকে বিরত থেকে রোযা পূর্ণ কর। আর তোমরা মসজিদে ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস বা এতে প্রলুব্ধকর কিছু কর না। কারণ, তা ইতিকাফ ভঙ্গ করে দেয়। (আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় নির্দিষ্ট সময় মসজিদে অবস্থানকে ইতিকাফ বলে।) যে বিধানগুলো আল্লাহ তোমাদের জন্য প্রবর্তন করেছেন, সেগুলোই হালাল ও হারামের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী তাঁর সীমারেখা। অতএব তোমরা এসবের কাছেও যেও না। তোমরা যাতে হারামে পতিত না হও। এমন সুস্পষ্ট বর্ণনার মতোই আল্লাহ তাঁর আয়াত ও বিধানসমূহ মানুষের জন্য বলে দেন। যাতে তারা তাঁকে ভয় করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে।
﴿وَلَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ وَتُدۡلُواْ بِهَآ إِلَى ٱلۡحُكَّامِ لِتَأۡكُلُواْ فَرِيقٗا مِّنۡ أَمۡوَٰلِ ٱلنَّاسِ بِٱلۡإِثۡمِ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ١٨٨﴾ [البقرة: ١٨٨]  
“আর তোমরা নিজদের মধ্যে তোমাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না এবং তা বিচারকদেরকে (ঘুষ হিসেবে) প্রদান করো না। যাতে মানুষের সম্পদের কোন অংশ পাপের মাধ্যমে জেনে বুঝে খেয়ে ফেলতে পার।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৮]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর তোমাদের কেউ যেন কারো সম্পদ অবৈধ উপায়ে যেমন মিথ্যা শপথ, ক্রোধ, চুরি, ঘুষ, সুদ ইত্যাদির মাধ্যমে ভক্ষণ না করে। অবৈধভাবে কোনো মানবদলের ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করতে বিচারালয়ে শাসকদের কাছে অসত্য প্রমাণাদি উপস্থাপন কর না। তোমাদের জন্য এটি যে হারাম তা তোমরা সম্যক অবগত আছ।
﴿يَسۡ‍َٔلُونَكَ عَنِ ٱلۡأَهِلَّةِۖ قُلۡ هِيَ مَوَٰقِيتُ لِلنَّاسِ وَٱلۡحَجِّۗ وَلَيۡسَ ٱلۡبِرُّ بِأَن تَأۡتُواْ ٱلۡبُيُوتَ مِن ظُهُورِهَا وَلَٰكِنَّ ٱلۡبِرَّ مَنِ ٱتَّقَىٰۗ وَأۡتُواْ ٱلۡبُيُوتَ مِنۡ أَبۡوَٰبِهَاۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ١٨٩﴾ [البقرة: ١٨٩]  
“তারা তোমাকে নতুন চাঁদসমূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল, ‘তা মানুষের ও হজ্জের জন্য সময় নির্ধারক’। আর ভালো কাজ এটা নয় যে, তোমরা পেছন দিক দিয়ে গৃহে প্রবেশ করবে। কিন্তু ভাল কাজ হল, যে তাকওয়া অবলম্বন করে। আর তোমরা গৃহসমূহে তার দরজা দিয়ে প্রবেশ কর এবং আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৯]  
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে নবী, আপনার সঙ্গীরা আপনাকে নতুন চাঁদ ও তার অবস্থাদি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তাদের উদ্দেশে আপনি বলুন, আল্লাহ চাঁদের উদয়কে নির্দশন বানিয়েছেন, মানুষ যা দ্বারা তাদের সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ইবাদতসমূহ যেমন সাওম ও হজ এবং লেনদেনের সময় জানতে পারে। তোমরা জাহিলী ও ইসলামের প্রাথমিক যুগে হজ বা উমরার ইহরাম নিয়ে পেছন দিক থেকে ঘরে প্রবেশ করার যে অভ্যাস পালন করেছ আর ভেবেছ যে এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল হবে, তাতে কোনো কল্যাণ নেই। বরং কল্যাণ রয়েছে ওই ব্যক্তির কর্মকাণ্ডে যে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করেছে, পাপাচার থেকে বিরত থেকেছে। আর হজ বা উমরার ইহরাম বেঁধে বাসা-বাড়িতে দরজা দিয়ে প্রবেশ কর এবং নিজেদের যাবতীয় বিষয়ে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। যাতে তোমরা দুনিয়া ও আখিরাতে কাঙ্ক্ষিত উভয়বিধ কল্যাণ লাভে কামিয়াব হও।  
﴿وَقَٰتِلُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ ٱلَّذِينَ يُقَٰتِلُونَكُمۡ وَلَا تَعۡتَدُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُعۡتَدِينَ ١٩٠﴾ [البقرة: ١٩٠]  
“আর তোমরা আল্লাহর রাস্তায় তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯০]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে মু’মিনগণ, আল্লাহর দীনের সাহাযার্থে তোমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়ে। তবে লড়াইকালে তোমরা অঙ্গবিকৃতি বা আত্মসাৎ কিংবা অননুমোদিত ব্যক্তি যেমন নারী-শিশু-বৃদ্ধ বা তোমাদের শাসনাধীন ব্যক্তিকে হত্যা করার মতো নিষিদ্ধ কাজে জড়াবে না। যারা সীমা লঙ্ঘন করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হারাম করা বিষয়কে হালাল করে আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না।
﴿وَٱقۡتُلُوهُمۡ حَيۡثُ ثَقِفۡتُمُوهُمۡ وَأَخۡرِجُوهُم مِّنۡ حَيۡثُ أَخۡرَجُوكُمۡۚ وَٱلۡفِتۡنَةُ أَشَدُّ مِنَ ٱلۡقَتۡلِۚ وَلَا تُقَٰتِلُوهُمۡ عِندَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ حَتَّىٰ يُقَٰتِلُوكُمۡ فِيهِۖ فَإِن قَٰتَلُوكُمۡ فَٱقۡتُلُوهُمۡۗ كَذَٰلِكَ جَزَآءُ ٱلۡكَٰفِرِينَ ١٩١﴾ [البقرة: ١٩١]  
“আর তাদেরকে হত্যা কর যেখানে তাদেরকে পাও এবং তাদেরকে বের করে দাও যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে বের করেছিল। আর ফিতনা হত্যার চেয়ে কঠিনতর এবং তোমরা মাসজিদুল হারামের নিকট তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো না, যতক্ষণ না তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সেখানে লড়াই করে। অতঃপর তারা যদি তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তবে তাদেরকে হত্যা কর। এটাই কাফিরদের প্রতিদান।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯১]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: যেসব মুশরিক তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেখানেই পাও তোমরা তাদের হত্যা কর এবং তাদেরকে সেখান থেকে বের করে দাও যেখান থেকে তারা তোমাদের বের করে দিয়েছিল। আর সেটি হলো মক্কা। আর ফিতনা তথা কুফর, শিরক ও ইসলাম থেকে বাধা প্রদানের অপরাধ তোমরা তাদের হত্যা করার চেয়েও গুরুতর। তোমরা মসজিদে হারামের সম্মানার্থে সেখানে হত্যাযজ্ঞের সূচনা কর না যাবৎ না তারা সেখানে তোমাদের হত্যার সূচনা ঘটায়। সুতরাং যদি তারা তোমাদের সঙ্গে মসজিদে হারামে লড়াই করে তবে তোমরাও সেখানে তাদের হত্যা করবে। নিবৃতিমূলক প্রতিদান হিসেবের মতোই কাফিরদের প্রতিদান হয়ে থাকে।
﴿فَإِنِ ٱنتَهَوۡاْ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ١٩٢﴾ [البقرة: ١٩٢]  
“তবে যদি তারা বিরত হয়, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯২]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: যদি তারা কুফুরী, মসজিদে হারামের কাছে হত্যাকাণ্ড ছেড়ে দেয় এবং ঈমানে প্রবেশ করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি ক্ষমাপরায়ণ, তাদের প্রতি করুণাময়।
﴿وَقَٰتِلُوهُمۡ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتۡنَةٞ وَيَكُونَ ٱلدِّينُ لِلَّهِۖ فَإِنِ ٱنتَهَوۡاْ فَلَا عُدۡوَٰنَ إِلَّا عَلَى ٱلظَّٰلِمِينَ ١٩٣﴾ [البقرة: ١٩٣]  
“আর তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর যে পর্যন্ত না ফিতনা খতম হয়ে যায় এবং দীন আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। সুতরাং তারা যদি বিরত হয়, তাহলে যালিমরা ছাড়া (কারো ওপর) কোন কঠোরতা নেই।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৩]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে মু’মিনগণ, অত্যাচারী মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে থাক, যাবৎ না মুসলিমদের জন্য তাদের দীন পালনে কোনো বাধা না থাকে, আল্লাহর সঙ্গে শিরক না থাকে। এবং দীন কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই অবশিষ্ট থাকে। তাঁর সঙ্গে আর কারো ইবাদত না করা হয়। অতএব তারা যদি কুফর ও লড়াই থেকে নিবৃত হয় তবে তোমরাও তাদের থেকে নিবৃত থাক। সুতরাং শাস্তি শুধু তাদের জন্যই যারা তাদের কুফুরী ও সীমালঙ্ঘনে অনড় থাকে।
﴿ٱلشَّهۡرُ ٱلۡحَرَامُ بِٱلشَّهۡرِ ٱلۡحَرَامِ وَٱلۡحُرُمَٰتُ قِصَاصٞۚ فَمَنِ ٱعۡتَدَىٰ عَلَيۡكُمۡ فَٱعۡتَدُواْ عَلَيۡهِ بِمِثۡلِ مَا ٱعۡتَدَىٰ عَلَيۡكُمۡۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلۡمُتَّقِينَ ١٩٤﴾ [البقرة: ١٩٤]  
“হারাম মাস হারাম মাসের বদলে এবং পবিত্র বিষয়সমূহ কিসাসের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে তোমাদের ওপর আক্রমণ করেছে, তোমরা তার ওপর আক্রমণ কর, যেরূপ সে তোমাদের ওপর আক্রমণ করেছে। আর আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৪]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে মু’মিনগণ, যে মাসে আল্লাহ লড়াই নিষিদ্ধ করেছেন সে মাসে তোমাদের মুশরিকবৃন্দকে হত্যা করার অনুমতি মূলত পবিত্র মাসে তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিদান হিসেবে। আল্লাহ যে সময় বা স্থানকে সম্মানিত ঘোষণা করেছেন তাতে যে সীমালংঙ্ঘন করে, তার কাজের প্রতিদান দেয়া হবে অনুরূপ কাজ এবং একই গোত্রের আমল দ্বারা। অতএব লড়াই বা অন্য কোনোভাবে যে তোমাদের প্রতি বাড়াবাড়ি করে, তাকে তার অপরাধের অনুরূপ শাস্তি দ্বারা প্রতিদান দাও। এ কাজে তোমাদের কোনো সমস্যা নাই। কারণ, ওরাই বাড়াবাড়ির সূচনা করেছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। অতএব অনুরূপ শাস্তি দিয়ে কোনোরূপ সীমালঙ্ঘন করবে না। আর জেনে রাখ, আল্লাহ তাদেরই সঙ্গে আছেন যারা তাঁকে ভয় করে এবং তাঁর ফরযসমূহ পালন এবং তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়াবলি বর্জনের মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য দেখায়।
﴿وَأَنفِقُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَلَا تُلۡقُواْ بِأَيۡدِيكُمۡ إِلَى ٱلتَّهۡلُكَةِ وَأَحۡسِنُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ١٩٥﴾ [البقرة: ١٩٥]  
“আর তোমরা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর এবং নিজ হাতে নিজদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। আর সুকর্ম কর। নিশ্চয় আল্লাহ সুকর্মশীলদেরকে ভালবাসেন।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৫]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে মু’মিনগণ, আল্লাহর দীনের সাহায্য এবং তাঁর পথে জিহাদে তোমাদের সম্পদ ব্যয় কর। তোমরা জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ এবং তাঁর পথে ব্যয় না করে নিজেদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না। তোমরা ব্যয় ও ইবাদতে ইহসান তথা একমাত্র আল্লাহকেই সন্তুষ্ট করতে সচেষ্ট হও। এবং তোমাদের সকল আমল সম্পাদন কর একমাত্র আল্লাহকে খুশি করার নিয়তে। নিশ্চয় আল্লাহ ইখলাস ও ইহসানওয়ালাদের ভালোবাসেন।
﴿وَأَتِمُّواْ ٱلۡحَجَّ وَٱلۡعُمۡرَةَ لِلَّهِۚ فَإِنۡ أُحۡصِرۡتُمۡ فَمَا ٱسۡتَيۡسَرَ مِنَ ٱلۡهَدۡيِۖ وَلَا تَحۡلِقُواْ رُءُوسَكُمۡ حَتَّىٰ يَبۡلُغَ ٱلۡهَدۡيُ مَحِلَّهُۥۚ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ بِهِۦٓ أَذٗى مِّن رَّأۡسِهِۦ فَفِدۡيَةٞ مِّن صِيَامٍ أَوۡ صَدَقَةٍ أَوۡ نُسُكٖۚ فَإِذَآ أَمِنتُمۡ فَمَن تَمَتَّعَ بِٱلۡعُمۡرَةِ إِلَى ٱلۡحَجِّ فَمَا ٱسۡتَيۡسَرَ مِنَ ٱلۡهَدۡيِۚ فَمَن لَّمۡ يَجِدۡ فَصِيَامُ ثَلَٰثَةِ أَيَّامٖ فِي ٱلۡحَجِّ وَسَبۡعَةٍ إِذَا رَجَعۡتُمۡۗ تِلۡكَ عَشَرَةٞ كَامِلَةٞۗ ذَٰلِكَ لِمَن لَّمۡ يَكُنۡ أَهۡلُهُۥ حَاضِرِي ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ١٩٦﴾ [البقرة: ١٩٦]  
“আর হজ ও উমরা আল্লাহর জন্য পূর্ণ কর। অতঃপর যদি তোমরা আটকে পড় তবে যে পশু সহজ হবে (তা যবেহ কর)। আর তোমরা তোমাদের মাথা মুণ্ডন করো না, যতক্ষণ না পশু তার যথাস্থানে পৌঁছে। আর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ কিংবা তার মাথায় যদি কোন কষ্ট থাকে তবে সিয়াম কিংবা সদকা অথবা পশু যবেহ-এর মাধ্যমে ফিদিয়া দেবে। আর যখন তোমরা নিরাপদ হবে তখন যে ব্যক্তি উমরার পর হজ সম্পাদনপূর্বক তামাত্তু করবে, তবে যে পশু সহজ হবে, তা যবেহ করবে। কিন্তু যে তা পাবে না তাকে হজে তিন দিন এবং যখন তোমরা ফিরে যাবে, তখন সাত দিন সিয়াম পালন করবে। এই হল পূর্ণ দশ। এই বিধান তার জন্য, যার পরিবার মাসজিদুল হারামের অধিবাসী নয়। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ ‘আযাবদানে কঠোর।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৬]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: তোমরা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে পরিপূর্ণভাবে হজ ও উমরা সম্পন্ন কর। তবে ইহরাম বাঁধার পর হজ ও উমরা সম্পন্ন করায় যদি শত্রু বা অসুস্থতা ইত্যাদি অন্তরায় হয় তাহলে তোমাদের অবশ্য কর্তব্য হবে উট, গরু বা ছাগলের মধ্যে যা সম্ভব হয় আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনে তা জবাই করা। যাতে করে তোমরা মাথা মুড়িয়ে বা চুল ছোট করে তোমাদের ইহরাম থেকে বেরিয়ে যেতে পার। অবরুদ্ধ থাকাকালে তোমরা নিজেদের মাথা মুণ্ডাবে না যাবৎ না অবরুদ্ধ ব্যক্তি তার অবরুদ্ধ থাকার স্থানে নিজ হাদি জবাই করে আপন ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন ‘হুদায়বিয়ায়’ কুরবানী করেছিলেন। আর অবরুদ্ধ না হওয়া ব্যক্তি শুধু হারামেই হাদি জবাই করবে, যেখানে সে ঈদের দিন তথা (জিলহজের) দশ তারিখ এবং পরবর্তী তাশরীকের দিনগুলোয় অবস্থায় করে। অতএব তোমাদের কেউ যদি অসুস্থ হয় অথবা তার মাথায় কোনো সমস্যা হয় যার ফলে তা মুণ্ডানোর প্রয়োজন দেখা দেয়- যখন সে মুহরিম- তবে মুণ্ডিয়ে ফেলবে। আর তাকে এ জন্য ফিদইয়া দিতে হবে। আর তা হলো তিনদিন সাওম পালন কিংবা ছয় জন মিসকীনকে সদকা করবে -প্রত্যেককে আর্ধ সা‘ খাদ্য দেবে কিংবা হেরেম শরীফের দরিদ্রদের জন্য একটি ছাগল জবাই করবে। পক্ষান্তরে তোমরা যখন নিরাপদ ও সুস্থ থাকবে, এমতাবস্থায় তোমাদের মধ্যে যে হজের সঙ্গে উমরাকে মিলিয়ে তামাত্তু করবে আর তা হলো উমরা সমাপ্ত করার পর ইহরাম থেকে হালাল হবার প্রয়াসের মাধ্যমে, তবে তাকে সাধ্যমত হাদি কুরবানী করতে হবে। যার পক্ষে জবাই করার মত কোনো হাদি সংগ্রহ করা সম্ভব না হয় তাকে হজের মাসগুলোয় তিনদিনের রোযা রাখতে হবে আর সাতটি রোযা রাখতে হবে হজের কার্যাদি শেষ করে পরিবারে ফিরে আসার পর। এই হলো পুরো দশ রোযা যা পালন না করলেই নয়। এই হাদি এবং তার বিকল্প হিসেবে যে সিয়ামগুলোর কথা বলা হল সেটা তার জন্য যার পরিবার হারামের অধিবাসী নয়। আর আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর, তাঁর নির্দেশাবলি পালন কর এবং নিষেধাবলি থেকে বিরত থাক। আর জেনে রাখ নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর নির্দেশ অমান্যকারী এবং তাঁর সতর্ককৃত বিষয় সম্পাদনকারীদের কঠোর ‘আযাবদাতা।
﴿ٱلۡحَجُّ أَشۡهُرٞ مَّعۡلُومَٰتٞۚ فَمَن فَرَضَ فِيهِنَّ ٱلۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي ٱلۡحَجِّۗ وَمَا تَفۡعَلُواْ مِنۡ خَيۡرٖ يَعۡلَمۡهُ ٱللَّهُۗ وَتَزَوَّدُواْ فَإِنَّ خَيۡرَ ٱلزَّادِ ٱلتَّقۡوَىٰۖ وَٱتَّقُونِ يَٰٓأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِ ١٩٧﴾ [البقرة: ١٩٧]  
“হজের সময় নির্দিষ্ট মাসসমূহ। অতএব এই মাসসমূহে যে নিজের ওপর হজ আরোপ করে নিল, তার জন্য হজে অশ্লীল ও পাপ কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়। আর তোমরা ভাল কাজের যা কর, আল্লাহ তা জানেন এবং পাথেয় গ্রহণ কর। নিশ্চয় উত্তম পাথেয় তাকওয়া। আর হে বিবেক সম্পন্নগণ, তোমরা আমাকে ভয় কর।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৭]   
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হজের মেয়াদ নির্দিষ্ট কয়েক মাস। আর সেগুলো হলো: শাওয়াল, যিলকদ ও যিলহজের দশ দিন। অতএব, এই মাসগুলোয় যে কেউ ইহরামের মাধ্যমে নিজের ওপর হজ ওয়াজিব করে নেবে, তার জন্য দৈহিক মিলন এবং এতে উদ্বুদ্ধকারী উক্তি ও আচরণ নিষিদ্ধ। তার জন্য কোনো গুনাহ কিংবা অশ্লীল কাজ যা ক্রোধ ও নিষিদ্ধ বিষয়ে ধাবিত করে সম্পূর্ণরূপে হারাম। আর তোমরা যে শুভ কাজই কর না কেন আল্লাহ তা জানেন। অতএব তিনি সবাইকে নিজ নিজ আমলের প্রতিদান দেবেন। আর তোমরা নিজেদের জন্য হজের সফরের জন্য খাদ্য-পানীয় প্রভৃতি পাথেয় সংগ্রহ কর। একইভাবে পরকালীন জীবনের জন্যও নেক ‘আমালের পাথেয় সংগ্রহ কর। কেননা তাকওয়াই হলো উত্তম পাথেয়। আর হে সুস্থ বোধসম্পন্ন লোকেরা তোমরা আমাকে ভয় কর।
﴿لَيۡسَ عَلَيۡكُمۡ جُنَاحٌ أَن تَبۡتَغُواْ فَضۡلٗا مِّن رَّبِّكُمۡۚ فَإِذَآ أَفَضۡتُم مِّنۡ عَرَفَٰتٖ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ عِندَ ٱلۡمَشۡعَرِ ٱلۡحَرَامِۖ وَٱذۡكُرُوهُ كَمَا هَدَىٰكُمۡ وَإِن كُنتُم مِّن قَبۡلِهِۦ لَمِنَ ٱلضَّآلِّينَ ١٩٨﴾ [البقرة: ١٩٨]  
“তোমাদের ওপর কোনো পাপ নেই যে, তোমরা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে অনুগ্রহ অনুসন্ধান করবে। সুতরাং যখন তোমরা আরাফা থেকে বের হয়ে আসবে, তখন মাশআরে হারামের নিকট আল্লাহকে স্মরণ কর এবং তাকে স্মরণ কর যেভাবে তিনি তোমাদেরকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। যদিও তোমরা এর পূর্বে অবশ্যই পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৮]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হজের দিনগুলোয় ব্যবসা থেকে মুনাফা হাসিল করে রিযিক তালাশ করায় তোমাদের কোনো পাপ নেই। অতপর তোমরা যখন সূর্যোদয়ের পর ‘আরাফাত’ থেকে প্রত্যাবর্তন করবে -আর সেটি হলো ওই স্থান যেখানে যিলহজের নয় তারিখে হাজীগণ অবস্থান করেন -তখন ‘মুযদালিফায়’ মাশ‘আরে হারামের কাছে তাসবীহ, তালবিয়া ও দো‘আ ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর যিকির করবে। তোমরা আল্লাহকে সঠিক পন্থায় স্মরণ করবে যিনি তোমাদেরকে নিজের পথ দেখিয়েছেন। অন্যথায় এ হেদায়েতের আগে তোমরা পথ ভ্রষ্টতায় ছিলে যেখানে তোমরা তাঁকে সঠিকভাবে চিনতে না।
﴿ثُمَّ أَفِيضُواْ مِنۡ حَيۡثُ أَفَاضَ ٱلنَّاسُ وَٱسۡتَغۡفِرُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ١٩٩﴾ [البقرة: ١٩٩]  
“অতঃপর তোমরা প্রত্যাবর্তন কর, যেখান থেকে মানুষেরা প্রত্যাবর্তন করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৯]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর জাহিলীযুগের যে সকল লোক জানে না তাদের বিরোধিতায় তোমাদের ‘আরাফাত’ থেকে প্রত্যবর্তন হয় যেন সেখান থেকে যেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর তিনি যেন তোমাদের পাপাচারগুলো মার্জনা করেন। নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারী, ক্ষমাপ্রার্থনাকারী বান্দাদের ক্ষমাকারী এবং তাদের প্রতি দয়াপ্রবণ।
﴿فَإِذَا قَضَيۡتُم مَّنَٰسِكَكُمۡ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ كَذِكۡرِكُمۡ ءَابَآءَكُمۡ أَوۡ أَشَدَّ ذِكۡرٗاۗ فَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ رَبَّنَآ ءَاتِنَا فِي ٱلدُّنۡيَا وَمَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنۡ خَلَٰقٖ ٢٠٠﴾ [البقرة: ٢٠٠]  
“তারপর যখন তোমরা তোমাদের হজের কাজসমূহ শেষ করবে, তখন আল্লাহকে স্মরণ কর, যেভাবে তোমরা স্মরণ করতে তোমাদের বাপ-দাদাদেরকে, এমনকি তার চেয়ে অধিক স্মরণ। আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে যে বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতেই দিয়ে দিন। বস্তুত আখিরাতে তার জন্য কোনো অংশ নেই।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০০]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: অতপর যখন তোমরা নিজেদের ইবাদতসমূহ সমাপ্ত করবে এবং হজের কার্যাদি সম্পন্ন করবে তখন তোমরা অধিকহারে আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর গুণকির্তন করবে। যেমন তোমরা তোমাদের বাপ-দাদার কৃতিত্বগুলো কিংবা এর চেয়ে বড় কিছু বেশি বেশি স্মরণ কর। মানুষের মধ্যে একদল আছে যারা কেবল দুনিয়া নিয়েই ব্যস্ত। এমনকি তারা দো‘আ করে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়ার সুস্থতা, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দান করুন। আখিরাতের এদের জন্য কিছুই নাই। কারণ এরা তা প্রত্যাশা করে না এবং স্রেফ দুনিয়াতেই তাদের চিন্তা ও পরিকল্পনা সীমিত রাখে।  
﴿وَمِنۡهُم مَّن يَقُولُ رَبَّنَآ ءَاتِنَا فِي ٱلدُّنۡيَا حَسَنَةٗ وَفِي ٱلۡأٓخِرَةِ حَسَنَةٗ وَقِنَا عَذَابَ ٱلنَّارِ ٢٠١﴾ [البقرة: ٢٠١]  
“আর তাদের মধ্যে এমনও আছে, যারা বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন। আর আখিরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে আগুনের আযাব থেকে রক্ষা করুন।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০১]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর লোকদের মধ্যে একদল মু’মিন আছে যারা দো‘আয় বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়ায় শান্তি, রিযিক ও উপকারী ইলম এবং দীন ও দুনিয়া সংক্রান্ত নানা উপকারী বিষয় দান করুন। আখিরাতে জান্নাতে দান করুন এবং আমাদের থেকে জাহান্নামের আগুন দূরে রাখুন। আর এটি সবচে অর্থবহুল দো‘আ। এ জন্যই এটি ছিল অধিকাংশ নবীর দো‘আ। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে বুখারী ও মুসলিমে।
﴿أُوْلَٰٓئِكَ لَهُمۡ نَصِيبٞ مِّمَّا كَسَبُواْۚ وَٱللَّهُ سَرِيعُ ٱلۡحِسَابِ ٢٠٢﴾ [البقرة: ٢٠٢]  
“তারা যা অর্জন করেছে তার হিস্যা তাদের রয়েছে। আর আল্লাহ হিসাব গ্রহণে দ্রুত।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০২]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: যারা এই দো‘আ করে তাদের জন্য বিশাল নেকী রয়েছে তারা যে নেক ‘আমলগুলো করেছে তার বিনিময়ে। আর আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। তিনি তাঁর বান্দার আমলের হিসাব রাখেন এবং তিনি তাদেরকে তার বিনিময় দেবেন।
﴿وَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡدُودَٰتٖۚ فَمَن تَعَجَّلَ فِي يَوۡمَيۡنِ فَلَآ إِثۡمَ عَلَيۡهِ وَمَن تَأَخَّرَ فَلَآ إِثۡمَ عَلَيۡهِۖ لِمَنِ ٱتَّقَىٰۗ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّكُمۡ إِلَيۡهِ تُحۡشَرُونَ ٢٠٣﴾ [البقرة: ٢٠٣]  
“আর আল্লাহকে স্মরণ কর নির্দিষ্ট দিনসমূহে। অতঃপর যে তাড়াহুড়া করে দু’দিনে চলে আসবে। তার কোন পাপ নেই। আর যে বিলম্ব করবে, তারও কোন অপরাধ নেই। (এ বিধান) তার জন্য, যে তাকওয়া অবলম্বন করেছে। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয় তোমাদেরকে তাঁরই কাছে সমবেত করা হবে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০৩]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: তোমরা অল্প কয়েকদিনে আল্লাহকে স্মরণ কর তাঁর তাসবীহ ও তাকবীরের মাধ্যমে। আর সে দিনগুলো হলো তাশরীকের দিনসমূহ: যিলহজের একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ। তবে যার তাড়া আছে তিনি দ্বাদশ তারিখে কংকর নিক্ষেপের পর সূর্যাস্তের আগে ‘মিনা’ থেকে বেরিয়ে গেলে তাতে কোনো সমস্যা নাই। আর যার তাড়া নেই, তিনি যদি ত্রয়োদশ তারিখে ‘মিনা’য় রাত্রি যাপন করেন তাতেও কোনো গুনাহ নাই। যে কি-না তার হজে আল্লাহকে ভয় করে। তবে বিলম্ব করাই উত্তম। কারণ, এতে করে ইবাদত বেশি হয় এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলের অনুকরণ করা হয়। আর হে মুসলিমগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তোমাদের প্রতিটি কাজে তাঁকে পর্যবেক্ষক জান এবং মনে রেখ তোমাদের মৃত্যুর পর একমাত্র তাঁর কাছেই তোমরা হিসাব ও প্রতিদানের জন্য সমবেত হবে।
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يُعۡجِبُكَ قَوۡلُهُۥ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَيُشۡهِدُ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا فِي قَلۡبِهِۦ وَهُوَ أَلَدُّ ٱلۡخِصَامِ ٢٠٤﴾ [البقرة: ٢٠٤]  
“আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যার কথা দুনিয়ার জীবনে তোমাকে অবাক করে এবং সে তার অন্তরে যা রয়েছে, তার ওপর আল্লাহকে সাক্ষী রাখে। আর সে কঠিন ঝগড়াকারী।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০৪]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে রাসূল, মুনাফিকদের কারো কারো কথা আপনাকে মুগ্ধ করবে। যে তার মন ভুলানো বচন দিয়ে আখিরাত বাদ দিয়ে কেবল দুনিয়ার কিছু অংশ পেতে চায় এবং সে আল্লাহর শপথ দিয়ে তার মনে ইসলামের ভালোবাসা লালনের দাবি করে। এটি আসলে আল্লাহর সঙ্গে এক ধরনের ঘৃষ্টতা দেখানোর নামান্তর। আর সে কিন্তু ইসলাম ও মুসলিমের বিরুদ্ধে তীব্র শত্রুতা পোষণ করে।
﴿وَإِذَا تَوَلَّىٰ سَعَىٰ فِي ٱلۡأَرۡضِ لِيُفۡسِدَ فِيهَا وَيُهۡلِكَ ٱلۡحَرۡثَ وَٱلنَّسۡلَۚ وَٱللَّهُ لَا يُحِبُّ ٱلۡفَسَادَ ٢٠٥﴾ [البقرة: ٢٠٥]  
“আর যখন সে ফিরে যায়, তখন জমিনে প্রচেষ্টা চালায় তাতে ফাসাদ করতে এবং ধ্বংস করতে শস্য ও প্রাণী। আর আল্লাহ ফাসাদ ভালোবাসেন না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০৫]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে রাসূল, যখন সে আপনার কাছ থেকে চলে যায়, সে তখন যমীনে বিশৃঙ্খলা বা সন্ত্রাস সৃষ্টি, মানুষের শষ্য ধ্বংস এবং তাদের গবাদি পশু হত্যার চেষ্টা চালায়। আল্লাহ বিশৃঙ্খলা বা সন্ত্রাস পছন্দ করেন না।
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُ ٱتَّقِ ٱللَّهَ أَخَذَتۡهُ ٱلۡعِزَّةُ بِٱلۡإِثۡمِۚ فَحَسۡبُهُۥ جَهَنَّمُۖ وَلَبِئۡسَ ٱلۡمِهَادُ ٢٠٦﴾ [البقرة: ٢٠٦]  
“তাকে পাপ করতে উৎসাহ দেয়। সুতরাং জাহান্নাম তার জন্য যথেষ্ট এবং তা কতই না মন্দ ঠিকানা।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০৬]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর ওই মুনাফিককে যখন উপদেশ প্রদান করা করে বলা হয়, আল্লাহকে ভয় কর,  তাঁর শাস্তি থেকে সতর্ক থাক এবং জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি থেকে বিরত থাক, সে উপদেশ গ্রহণ করে না; বরং আত্মম্ভরিতা ও জাহিলী অহংকার তাকে অধিক গুনাহে প্ররোচিত করে। অতএব শাস্তি হিসেবে জাহান্নামই যথেষ্ট তার। আর তা কতই খারাপ বিছানা।
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَشۡرِي نَفۡسَهُ ٱبۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِ ٱللَّهِۚ وَٱللَّهُ رَءُوفُۢ بِٱلۡعِبَادِ ٢٠٧﴾ [البقرة: ٢٠٧]  
“আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজকে বিকিয়ে দেয়। আর আল্লাহ (তার) বান্দাদের প্রতি দয়াশীল।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০৭]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: পক্ষান্তরে কিছু লোক আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে তাঁর পথে জিহাদে এবং তাঁর আনুগত্যে নিজের জীবন বাজি রাখে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি মমতাশীল। মু’মিন বান্দাদের প্রতি তিনি তাদের ইহ ও পরকালে ব্যাপক রহমত বর্ষণ করেন। তিনি তাঁদের উত্তম প্রতিদান দেন।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱدۡخُلُواْ فِي ٱلسِّلۡمِ كَآفَّةٗ وَلَا تَتَّبِعُواْ خُطُوَٰتِ ٱلشَّيۡطَٰنِۚ إِنَّهُۥ لَكُمۡ عَدُوّٞ مُّبِينٞ ٢٠٨﴾ [البقرة: ٢٠٨]  
“হে মু’মিনগণ, তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের জন্য স্পষ্ট শত্রু।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০৮]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর হে ওই সকল লোক যারা রব হিসেবে আল্লাহ, নবী ও রাসূল হিসেবে মুহাম্মদ এবং দীন হিসেবে ইসলামে ঈমান এনেছ, তোমরা পূর্ণাঙ্গরূপে ইসলামে দাখিল হও। এর সকল বিধি-বিধান অনুযায়ী আমল কর। এর কিছুই বাদ রেখ না। আর তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না যে তোমাদেরকে গুনাহের প্রতি আহ্বান জানায়। সন্দেহাতীতভাবে শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। অতএব তার ব্যাপারে সতর্ক থেক।
﴿فَإِن زَلَلۡتُم مِّنۢ بَعۡدِ مَا جَآءَتۡكُمُ ٱلۡبَيِّنَٰتُ فَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ٢٠٩﴾ [البقرة: ٢٠٩]  
“অতএব তোমরা যদি পদস্খলিত হও, তোমাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ আসার পর, তবে জেনে রাখ যে, আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০৯]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: অতএব তোমাদের কাছে কুরআন ও সুন্নাহের মত সুস্পষ্ট প্রমাণাদি আসার পরও যদি তোমরা সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হও, তবে জেনে রাখ আল্লাহ তাঁর রাজত্বে পরাক্রমশালী; কোনো কিছুই তাঁর আওতার বাইরে নয়। আপন আদেশ ও নিষেধ প্রদানে তিনি প্রজ্ঞাবান; প্রতিটি জিনিসকে তিনি তার উপযুক্ত ও যথার্থ স্থানেই রাখেন।
﴿هَلۡ يَنظُرُونَ إِلَّآ أَن يَأۡتِيَهُمُ ٱللَّهُ فِي ظُلَلٖ مِّنَ ٱلۡغَمَامِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَقُضِيَ ٱلۡأَمۡرُۚ وَإِلَى ٱللَّهِ تُرۡجَعُ ٱلۡأُمُورُ ٢١٠﴾ [البقرة: ٢١٠]  
“তারা কি এরই অপেক্ষা করছে যে, মেঘের ছায়ায় আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ তাদের নিকট আগমন করবেন এবং সব বিষয়ের ফয়সালা করে দেয়া হবে। আর আল্লাহর নিকটই সব বিষয় প্রত্যাবর্তিত হবে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১০]  
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: সুস্পষ্ট প্রমাণাদিত উপস্থাপনের পর এসব অবাধ্য কাফিররা কি অপেক্ষা করছে মেঘমালার ছায়ারূপে আল্লাহ তাদের সামনে এসে তাদের ন্যায়ানুগ ফয়সালা করবেন? ফিরিশতারা তাদের সামনে আবির্ভুত হবে আর আল্লাহ তখন বিচার করবেন? আর একমাত্র তাঁর কাছেই সকল সৃষ্টির যাবতীয় বিষয় প্রত্যাবর্তিত হবে।
﴿سَلۡ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ كَمۡ ءَاتَيۡنَٰهُم مِّنۡ ءَايَةِۢ بَيِّنَةٖۗ وَمَن يُبَدِّلۡ نِعۡمَةَ ٱللَّهِ مِنۢ بَعۡدِ مَا جَآءَتۡهُ فَإِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ٢١١﴾ [البقرة: ٢١١]  
“বনী ইসরাঈলকে জিজ্ঞাসা কর, আমি তাদেরকে কত সুস্পষ্ট নিদর্শন দিয়েছি। আর যে আল্লাহর নি‘আমত তার কাছে আসার পর তা বদলে দেবে তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ আযাব দানে কঠোর।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১১]  
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে রাসূল, অবাধ্য বনী ইসরাঈলকে জিজ্ঞেস করুন, আমি তাদের কিতাবগুলোয় কত কত সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি দিয়েছি যা তাদেরকে সত্যের পথ দেখায়। অতপর তারা তার প্রত্যেকটিকে অস্বীকার করেছে, তাকে উপেক্ষা করেছে এবং তাকে তার স্থান থেকে বিচ্যুত করেছে। আর যে আল্লাহর নি‘আমত তথা তাঁর দীনকে বদলে দেবে এবং তার পরিচয় লাভ আর সে সম্পর্কে প্রমাণাদি উপস্থাপনের পরও তাকে অস্বীকার করবে, তাকে মনে রাখতে হবে যে আল্লাহ তাকে কঠোর শাস্তিদাতা।
﴿ زُيِّنَ لِلَّذِينَ كَفَرُواْ ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَا وَيَسۡخَرُونَ مِنَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْۘ وَٱلَّذِينَ ٱتَّقَوۡاْ فَوۡقَهُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِۗ وَٱللَّهُ يَرۡزُقُ مَن يَشَآءُ بِغَيۡرِ حِسَابٖ ٢١٢ ﴾ [البقرة: ٢١٢]  
“যারা কুফুরী করেছে, দুনিয়ার জীবনকে তাদের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে। আর তারা মু’মিনদের নিয়ে উপহাস করে। আর যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে, তারা কিয়ামত দিবসে তাদের উপরে থাকবে। আর আল্লাহ যাকে চান, হিসাববিহীন রিযিক দান করেন।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১২]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: যারা আল্লাহর একত্ববাদকে অস্বীকার করে তাদের জন্য দুনিয়া এবং এর ভোগসামগ্রীকে সুলভ করে দেওয়া হয়েছে। আর তারা মু’মিনদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। যারা আপন রবকে ভয় করে কিয়ামতের দিন তারা সব কাফিরের ওপরে থাকবে। কেননা আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করবেন আর কাফিরদের নিক্ষেপ করবেন জাহান্নামের সবনিম্ন স্তরে। আপন সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ যাকে চান হিসাব ছাড়া রিযক দান করেন।
﴿كَانَ ٱلنَّاسُ أُمَّةٗ وَٰحِدَةٗ فَبَعَثَ ٱللَّهُ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ مُبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ وَأَنزَلَ مَعَهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ بِٱلۡحَقِّ لِيَحۡكُمَ بَيۡنَ ٱلنَّاسِ فِيمَا ٱخۡتَلَفُواْ فِيهِۚ وَمَا ٱخۡتَلَفَ فِيهِ إِلَّا ٱلَّذِينَ أُوتُوهُ مِنۢ بَعۡدِ مَا جَآءَتۡهُمُ ٱلۡبَيِّنَٰتُ بَغۡيَۢا بَيۡنَهُمۡۖ فَهَدَى ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لِمَا ٱخۡتَلَفُواْ فِيهِ مِنَ ٱلۡحَقِّ بِإِذۡنِهِۦۗ وَٱللَّهُ يَهۡدِي مَن يَشَآءُ إِلَىٰ صِرَٰطٖ مُّسۡتَقِيمٍ ٢١٣﴾ [البقرة: ٢١٣]  
“মানুষ ছিল এক উম্মত। অতঃপর আল্লাহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে নবীদেরকে প্রেরণ করলেন এবং সত্যসহ তাদের সঙ্গে কিতাব নাযিল করলেন, যাতে মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করত। আর তারাই তাতে মতবিরোধ করেছিল, যাদেরকে তা দেয়া হয়েছিল, তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষবশত। অতঃপর আল্লাহ নিজ অনুমতিতে মু’মিনদেরকে হিদায়াত দিলেন যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছিল। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১৩]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: সব মানুষ ছিল এক দলভুক্ত। তারা সবাই এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নে এক ছিল। পরবর্তীতে তারা তাদের দীন নিয়ে বিরোধে লিপ্ত হয়। তখন আল্লাহ তাঁর দীনের প্রতি আহ্বান জানাতে নবীদের প্রেরণ করেন। তাঁরা আল্লাহর আনুগত্যকারীদের জান্নাতের সুসংবাদ দেন এবং তাঁর কুফরী ও অবাধ্যাচারণকারীদের তাঁরা সতর্ক করেন। আল্লাহ সত্য জ্ঞানসহ তাঁদের ওপর আসমানী কিতাবসমূহও নাযিল করেন। তাঁরা যাতে তা থেকে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান বিবাদে ফয়সালা করেন এবং ফয়সালা করেন মুহাম্মদ ও কুরআন সংক্রান্ত অনাচার ও বিদ্বেষপ্রসূত বিবাদে। তবে আল্লাহ যাদের তাওরাত দান করেছিলেন, আর তারা তাতে যেসব বিধি-বিধান ও প্রমাণ-নিদর্শনাবলি ছিল তা জেনেছে, ফলে নিজ অনুগ্রহে আল্লাহ মু’মিনদের সত্য-মিথ্যার প্রভেদ এবং তাদের মধ্যে চলমান বিবাদ সম্পর্কে জানার তাওফীক দিয়েছিলেন। আপন বান্দাদের মধ্যে আল্লাহ যাদের চান সীরাতুল মুস্তাকীম বা সরল পথ অবলম্বনের তাওফীক দান করেন।
﴿أَمۡ حَسِبۡتُمۡ أَن تَدۡخُلُواْ ٱلۡجَنَّةَ وَلَمَّا يَأۡتِكُم مَّثَلُ ٱلَّذِينَ خَلَوۡاْ مِن قَبۡلِكُمۖ مَّسَّتۡهُمُ ٱلۡبَأۡسَآءُ وَٱلضَّرَّآءُ وَزُلۡزِلُواْ حَتَّىٰ يَقُولَ ٱلرَّسُولُ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مَعَهُۥ مَتَىٰ نَصۡرُ ٱللَّهِۗ أَلَآ إِنَّ نَصۡرَ ٱللَّهِ قَرِيبٞ ٢١٤﴾ [البقرة: ٢١٤]  
“নাকি তোমরা ভেবেছ যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ এখনো তোমাদের নিকট তাদের মত কিছু আসেনি, যারা তোমাদের পূর্বে বিগত হয়েছে। তাদেরকে স্পর্শ করেছিল কষ্ট ও দুর্দশা এবং তারা কম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তার সাথি মু’মিনগণ বলছিল, ‘কখন আল্লাহর সাহায্য (আসবে)’? জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১৪]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে মু’মিনগণ, বরং তোমরা কি ভেবেছ তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে আর তোমাদের পূর্ববর্তী মু’মিন সম্প্রদায়ের ওপর দারিদ্র, রোগ-শোক ও ভয়-ভীতি ইত্যাদি দিয়ে পরীক্ষা করা হবে না? তার নানা ভয়ে প্রকম্পিত হয়েছে। এমন তারা তাদের রাসূলগণ এবং সঙ্গী মু’মিনগণ জলদি আল্লাহর সাহায্য চেয়ে আল্লাহর উদ্দেশে বলে উঠেছে, কোথায় আল্লাহর সাহায্য? মনে রেখ সন্দেহ নেই আল্লাহর সাহায্য নিকটেই অপেক্ষমান।
﴿يَسۡ‍َٔلُونَكَ مَاذَا يُنفِقُونَۖ قُلۡ مَآ أَنفَقۡتُم مِّنۡ خَيۡرٖ فَلِلۡوَٰلِدَيۡنِ وَٱلۡأَقۡرَبِينَ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۗ وَمَا تَفۡعَلُواْ مِنۡ خَيۡرٖ فَإِنَّ ٱللَّهَ بِهِۦ عَلِيمٞ ٢١٥﴾ [البقرة: ٢١٥]  
“তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে? বল, ‘তোমরা যে সম্পদ ব্যয় করবে, তা পিতা-মাতা, আত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য। আর যে কোনো ভালো কাজ তোমরা কর, নিশ্চয় সে ব্যাপারে আল্লাহ সুপরিজ্ঞাত।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১৫]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে নবী, আপনার সাহাবীরা আপনাকে জিজ্ঞেস করবে তাদের কোন প্রকারের সম্পদ তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যয় করবে এবং কাদের ওপর খরচ করবে? আপনি তাদের উদ্দেশে বলুন, সাধ্যমত হালাল পবিত্র সম্পদের যে প্রকারই পার তোমরা ব্যয় কর। আর তোমাদের সম্পদ ব্যয় করবে বাবা-মা, পরিবারের নিকটজন, আত্মীয়-স্বজন, অনাথ, দরিদ্র এবং নিজ সম্পদ ও পরিবার থেকে দূরে অবস্থানকারী মুসাফিরদের জন্য। আর তোমরা যে কোনো মহৎ কাজ কর না কেন আল্লাহ সে ব্যাপারে অবগত।
﴿كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلۡقِتَالُ وَهُوَ كُرۡهٞ لَّكُمۡۖ وَعَسَىٰٓ أَن تَكۡرَهُواْ شَيۡ‍ٔٗا وَهُوَ خَيۡرٞ لَّكُمۡۖ وَعَسَىٰٓ أَن تُحِبُّواْ شَيۡ‍ٔٗا وَهُوَ شَرّٞ لَّكُمۡۚ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ وَأَنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ ٢١٦﴾ [البقرة: ٢١٦]  
“তোমাদের ওপর লড়াইয়ের বিধান দেওয়া হয়েছে অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয় এবং হতে পারে কোনো বিষয় তোমরা অপছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হতে পারে কোনো বিষয় তোমরা পছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১৬]  
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে মু’মিনগণ, আল্লাহ তোমাদের ওপর কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই ফরয করেছেন। আর কষ্ট ও জীবনের  ঝুঁকি থাকায় লড়াইকে তোমরা পছন্দ কর না। প্রকৃতপক্ষে তোমরা অনেক বিষয় অপছন্দ কর অথচ বাস্তবে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তেমনি তোমরা কোনো জিনিস পছন্দ কর যাতে তোমাদের আরাম বা সাময়িক সুখ রয়েছে অথচ আখেরে তা তোমাদের জন্য শুভকর নয়। আল্লাহ তা‘আলাই ভালো জানেন কীসে তোমাদের মঙ্গল রয়েছে। এটা তোমরা জান না। অতএব তোমরা তাঁর রাস্তায় জিহাদে অগ্রণী হও।  
﴿يَسۡ‍َٔلُونَكَ عَنِ ٱلشَّهۡرِ ٱلۡحَرَامِ قِتَالٖ فِيهِۖ قُلۡ قِتَالٞ فِيهِ كَبِيرٞۚ وَصَدٌّ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ وَكُفۡرُۢ بِهِۦ وَٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ وَإِخۡرَاجُ أَهۡلِهِۦ مِنۡهُ أَكۡبَرُ عِندَ ٱللَّهِۚ وَٱلۡفِتۡنَةُ أَكۡبَرُ مِنَ ٱلۡقَتۡلِۗ وَلَا يَزَالُونَ يُقَٰتِلُونَكُمۡ حَتَّىٰ يَرُدُّوكُمۡ عَن دِينِكُمۡ إِنِ ٱسۡتَطَٰعُواْۚ وَمَن يَرۡتَدِدۡ مِنكُمۡ عَن دِينِهِۦ فَيَمُتۡ وَهُوَ كَافِرٞ فَأُوْلَٰٓئِكَ حَبِطَتۡ أَعۡمَٰلُهُمۡ فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٢١٧﴾ [البقرة: ٢١٧]  
“তারা তোমাকে হারাম মাস সম্পর্কে, তাতে লড়াই করা বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। বল, ‘তাতে লড়াই করা বড় পাপ; কিন্তু আল্লাহর পথে বাধা প্রদান, তাঁর সঙ্গে কুফুরী করা, মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দেওয়া এবং তার অধিবাসীদেরকে তা থেকে বের করে দেওয়া আল্লাহর নিকট অধিক বড় পাপ। আর ফিতনা হত্যার চেয়েও বড়’। আর তারা তোমাদের সঙ্গে লড়াই করতে থাকবে, যতক্ষণ না তোমাদেরকে তোমাদের দীন থেকে ফিরিয়ে দেয়, তারা যদি পারে। আর যে তোমাদের মধ্য থেকে তাঁর দীন থেকে ফিরে যাবে, অতঃপর কাফির অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে, বস্তুত এদের আমলসমূহ দুনিয়া ও আখিরাতে বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং তারাই আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১৭]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে রাসূল, মুশরিকরা আপনাকে সম্মানিত মাস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। আপনি তাদের বলুন, সম্মানিত মাসে লড়াই করা, হারাম মাসকে হালাল বানানো এবং তাতে রক্তপাত ঘটানো আল্লাহর কাছে একটি বড় অপরাধ বটে। তবে তোমরা মানুষকে শাস্তি দিয়ে এবং ভয়-ভীতি দেখিয়ে ইসলামে প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছ, আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও দীনকে অস্বীকার করছ, মসজিদে হারামে প্রবেশে মুসলিমদের বাধা প্রদান করছ এবং নবী ও তাঁর পরিজন-প্রিয়জন মুহাজিরদের বের করে দিয়েছ- এসব তো আরও বড় অপরাধ। এই কাফিরদল কিন্তু তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরে আসছে না। বরং তারা এসবে অটল থাকছে। উপরন্তু তারা তোমাদের সঙ্গে লড়াই নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তারা যেন পারলে তোমাদেরকে ইসলাম থেকে কুফুরিতে ফিরিয়ে আনে। আর হে মুসলিমগণ, তোমাদের মধ্যে যারা তাদের অনুগামী হয় এবং আপন ধর্ম (ইসলাম) ত্যাগ করে শেষাবধি কুফরি অবস্থায় মারা যায়, তবে দুনিয়া ও আখিরাতে তার সব আমল বরবাদ হয়ে যায়। সে হয়ে যায় জাহান্নামের আগুনের অবধারিত খোরাক। কখনো তাকে সে অগ্নি থেকে উদ্ধার করা হবে না।
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَٱلَّذِينَ هَاجَرُواْ وَجَٰهَدُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ أُوْلَٰٓئِكَ يَرۡجُونَ رَحۡمَتَ ٱللَّهِۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٢١٨﴾ [البقرة: ٢١٨]  
“নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে ও হিজরত করেছে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে, তারা আল্লাহর রহমতের আশা করে। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১৮]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সত্য বলে গ্রহণ করে এবং তাঁর শরী‘আত মোতাবেক আমল করে। আর যারা নিজেদের আবাস ত্যাগ করেছেন এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারাই আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর ছাওয়াবের প্রত্যাশা করে। আল্লাহ তাঁর মু’মিন বান্দাদের গুনাহ ক্ষমাকারী এবং তাদের প্রতি ব্যাপকভাবে দয়াবান।
﴿يَسۡ‍َٔلُونَكَ عَنِ ٱلۡخَمۡرِ وَٱلۡمَيۡسِرِۖ قُلۡ فِيهِمَآ إِثۡمٞ كَبِيرٞ وَمَنَٰفِعُ لِلنَّاسِ وَإِثۡمُهُمَآ أَكۡبَرُ مِن نَّفۡعِهِمَاۗ وَيَسۡ‍َٔلُونَكَ مَاذَا يُنفِقُونَۖ قُلِ ٱلۡعَفۡوَۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمُ ٱلۡأٓيَٰتِ لَعَلَّكُمۡ تَتَفَكَّرُونَ ٢١٩﴾ [البقرة: ٢١٩]  
“তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, এ দু’টোয় রয়েছে বড় পাপ ও মানুষের জন্য উপকার। আর তার পাপ তার উপকারিতার চেয়ে অধিক বড়। আর তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা কী ব্যয় করবে। বল, ‘যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত’। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা কর- দুনিয়া ও আখিরাতের ব্যাপারে। আর তারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে ইয়াতীমদের সম্পর্কে। বল, সংশোধন করা তাদের জন্য উত্তম। আর যদি তাদেরকে নিজদের সঙ্গে মিশিয়ে নাও, তবে তারা তোমাদেরই ভাই। আর আল্লাহ জানেন কে ফাসাদকারী, কে সংশোধনকারী এবং আল্লাহ যদি চাইতেন, অবশ্যই তোমাদের জন্য (বিষয়টি) কঠিন করে দিতেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১৯]  
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে নবী, মুসলমানরা আপনাকে মদের কেনাবেচা বা পান করা ইত্যাদি ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। আর মাদক হলো প্রত্যেক ওই নেশাদার বস্তু যা মানুষের বিবেককে অকার্যকর করে দেয়। চাই তা পানীয় হোক বা খাদ্য জাতীয়। আর আপনাকে তারা বাজি বা জুয়ার হুকুম সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করবে আর তা হলো বিজয়ী হবার উদ্দেশে সম্পদ গ্রহণ বা প্রদান করা যেখানে দুই পক্ষের মধ্যে একজন বিজয়ী হয়। আপনি তাদের বলে দিন, এতে দুনিয়া ও আখিরাতের এবং মেধা ও সম্পদের বহুবিধ ক্ষতি ও অকল্যাণ রয়েছে। আবার এ দুটিতে মানুষের কিছু উপকার আছে হিসেবে যে তাতে কিছু অর্থ উপার্জন হয়। তবে এ দুয়ের উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি বহুগুণে। কারণ, এরা আল্লাহর যিকর ও সালাত থেকে বাধা প্রদান করে, মানুষের মধ্যে বিবাদ ও শত্রুতা সৃষ্টি করে এবং সম্পদ ধ্বংস করে। এ দুই কাজ হারাম হবার পেছনে এসবই বেশি ভূমিকা রেখেছে। তারা আপনার কাছে কতটুকু সম্পদ দান-সদকা করবে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি তাদের বলুন, তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদই খরচ কর। এই বর্ণনার মতোই আল্লাহ তোমাদের জন্য নিদর্শন ও শরী‘আতের বিধানাবলি সুস্পষ্ট বলে দেন। যাতে করে তোমরা চিন্তা করে দেখ কোনটা তোমাদের দুনিয়া ও আখিরাতে উপকার দেবে।
﴿فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِۗ وَيَسۡ‍َٔلُونَكَ عَنِ ٱلۡيَتَٰمَىٰۖ قُلۡ إِصۡلَاحٞ لَّهُمۡ خَيۡرٞۖ وَإِن تُخَالِطُوهُمۡ فَإِخۡوَٰنُكُمۡۚ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ ٱلۡمُفۡسِدَ مِنَ ٱلۡمُصۡلِحِۚ وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ لَأَعۡنَتَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٞ ٢٢٠﴾ [البقرة: ٢٢٠]    
“আর হে নবী, তারা আপনার কাছে ইয়াতীমদের সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করবে। তাদের সম্পদ ও জীবনধারণে তারা কেমন ভূমিকা রাখবে? আপনি তাদের বলুন, তোমাদেরকে তাদের মঙ্গল কামনা করতে হবে। অতএব সর্বদা তাদের জন্য কল্যাণকর কাজটিই করতে হবে। জীবনযাপনের সকল পর্যায়ে যদি তোমরা তাদের অংশীদার হও তবে তারা তোমাদের দীনী ভাই। আর ভাইয়ের উচিত তার ভাইয়ের উপকারের দিকটির প্রতি খেয়াল রাখা। আল্লাহ কিন্তু ভালো করার নামে ইয়াতীমদের সম্পদ ভক্ষণকারীদের সম্পর্কে জানেন। আল্লাহ যদি চাইতেন তবে তিনি এই মিলমিশকে হারাম করে তোমাদের জন্য বিষয়টি কঠিন ও কঠোরতর করতে পারতেন। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর রাজত্বে একক ক্ষমতাবান এবং আপন সৃজন, পরিচালন ও বিধান প্রবর্তনে তিনি প্রজ্ঞাবান।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২০]  
﴿وَلَا تَنكِحُواْ ٱلۡمُشۡرِكَٰتِ حَتَّىٰ يُؤۡمِنَّۚ وَلَأَمَةٞ مُّؤۡمِنَةٌ خَيۡرٞ مِّن مُّشۡرِكَةٖ وَلَوۡ أَعۡجَبَتۡكُمۡۗ وَلَا تُنكِحُواْ ٱلۡمُشۡرِكِينَ حَتَّىٰ يُؤۡمِنُواْۚ وَلَعَبۡدٞ مُّؤۡمِنٌ خَيۡرٞ مِّن مُّشۡرِكٖ وَلَوۡ أَعۡجَبَكُمۡۗ أُوْلَٰٓئِكَ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلنَّارِۖ وَٱللَّهُ يَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱلۡجَنَّةِ وَٱلۡمَغۡفِرَةِ بِإِذۡنِهِۦۖ وَيُبَيِّنُ ءَايَٰتِهِۦ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ يَتَذَكَّرُونَ ٢٢١﴾ [البقرة: ٢٢١]  
“আর তোমরা মুশরিক নারীদের বিয়ে করো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে এবং মু’মিন দাসী মুশরিক নারীর চেয়ে নিশ্চয় উত্তম, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে। আর মুশরিক পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে। আর একজন মু’মিন দাস একজন মুশরিক পুরুষের চেয়ে উত্তম, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে। তারা তোমাদেরকে আগুনের দিকে আহ্বান করে, আর আল্লাহ তাঁর অনুমতিতে তোমাদেরকে জান্নাত ও ক্ষমার দিকে আহ্বান করেন এবং মানুষের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ স্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২১]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর : হে মুসলিমগণ, তোমরা মূর্তিপূজারি মুশরিক নারীদের বিয়ে কর না, যাবৎ তারা ইসলামে প্রবেশ করে। আর তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহর প্রতি ঈমানদার একজন দাসী, যার কোনো সম্পদ বা বংশ পরিচয় নেই, একজন মুশরিক নারী থেকে উত্তম। যদিও তোমাদের স্বাধীন মুশরিক নারী মুগ্ধ করে। আর তোমরা তোমাদের মু’মিন নারীদের -চাই সে বাদী হোক বা স্বাধীন- মুশরিকদের সঙ্গে বিয়ে দিও না। যাবৎ তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে। আরও জেনে রাখ, একজন মু’মিন দাস তার দারিদ্র সত্ত্বেও সে যে কোনো মুশরিকের চেয়ে উত্তম, যদিও সে মুশরিক তোমাদের মুগ্ধ করে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এরা সবাই শিরকের দোষে দুষ্ট। এরা তাদের সঙ্গে উঠাবসাকারী প্রত্যেককেই নিতে চায় জাহান্নামে। পক্ষান্তরে মহান আল্লাহ তার বান্দাদের সত্য দীনের প্রতি ডাকেন। যা তাদেরকে জান্নাত এবং তাদের গুনাহসমূহ মার্জনার দিকে নিয়ে যায়। আর তিনি মানুষের জন্য তাঁর নিদর্শনাবলি এবং বিধি-বিধান সুস্পষ্ট বলে দেন, যাতে তারা তা স্মরণ করে এবং শিক্ষা গ্রহণ করে।
﴿وَيَسۡ‍َٔلُونَكَ عَنِ ٱلۡمَحِيضِۖ قُلۡ هُوَ أَذٗى فَٱعۡتَزِلُواْ ٱلنِّسَآءَ فِي ٱلۡمَحِيضِ وَلَا تَقۡرَبُوهُنَّ حَتَّىٰ يَطۡهُرۡنَۖ فَإِذَا تَطَهَّرۡنَ فَأۡتُوهُنَّ مِنۡ حَيۡثُ أَمَرَكُمُ ٱللَّهُۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلتَّوَّٰبِينَ وَيُحِبُّ ٱلۡمُتَطَهِّرِينَ ٢٢٢﴾ [البقرة: ٢٢٢]  
“আর তারা তোমাকে ঋতুস্রাব সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল, তা কষ্ট। সুতরাং তোমরা ঋতুস্রাবকালে স্ত্রীদের থেকে দূরে থাক এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হয়ো না। অতঃপর যখন তারা পবিত্র হবে তখন তাদের নিকট আস, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদেরকে ভালবাসেন এবং ভালবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২২]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর তারা আপনাকে হায়েয সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। আর সেটি হলো ওই রক্ত যা নারীদের জরায়ু থেকে নির্দিষ্ট সময়ে প্রবাহিত হয়। আপনি তাদের বলুন হে নবী, তা একটি নোংরা বর্জ্য, যা এর নিকটবর্তী হওয়া ব্যক্তির ক্ষতি করে। অতএব ঋতুকালে স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকুন, যাবৎ না তার রক্তের প্রবাহ বন্ধ হয়। যখন রক্তের ধারা বন্ধ হয় এবং সে গোসল করে তখন তোমরা তাদের সঙ্গে সে স্থানে মিলন কর যেখানে আল্লাহ তোমাদের জন্য হালাল করেছেন। আর তা পেছনেরটা নয়,  সামনের রাস্তা। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর অধিক তওবা ও ইসতেসফারকারী বান্দাকে পছন্দ করেন। আর তিনি পছন্দ করেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদের, যারা অশ্লীলতা ও অপরিচ্ছন্নতা থেকে দূরে থাকে।
﴿نِسَآؤُكُمۡ حَرۡثٞ لَّكُمۡ فَأۡتُواْ حَرۡثَكُمۡ أَنَّىٰ شِئۡتُمۡۖ وَقَدِّمُواْ لِأَنفُسِكُمۡۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّكُم مُّلَٰقُوهُۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٢٢٣﴾ [البقرة: ٢٢٣]  
“তোমাদের স্ত্রী তোমাদের ফসলক্ষেত্র। সুতরাং তোমরা তোমাদের ফসলক্ষেত্রে গমন কর, যেভাবে চাও। আর তোমরা নিজদের কল্যাণে উত্তম কাজ সামনে পাঠাও। আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয় তোমরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। আর মু’মিনদেরকে সুসংবাদ দাও।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৩]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের ক্ষেত্রস্থান। তোমরা তোমাদের বীর্য তাদের জরায়ুতে স্থাপন কর। আর সেখান থেকে আল্লাহর ইচ্ছায় সন্তান বেরিয়ে আসে। অতএব তোমরা কেবল তাদের সঙ্গমস্থানেই সঙ্গম কর। আর তা হলো সামনের রাস্তা। চাই তা যেভাবেই কর না কেন। আর তোমরা আল্লাহর নির্দেশাবলির প্রতি যত্নবান হয়ে নিজেদের জন্য নেক আমল পেশ কর, আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, অবশ্যই কিয়ামতের দিন তাঁর সামনে দণ্ডায়মান হবে। হে নবী, আপনি মু’মিনদের আখিরাতের যা তাদের তৃপ্ত ও আনন্দিত করবে তার সুসংবাদ দিন।
﴿وَلَا تَجۡعَلُواْ ٱللَّهَ عُرۡضَةٗ لِّأَيۡمَٰنِكُمۡ أَن تَبَرُّواْ وَتَتَّقُواْ وَتُصۡلِحُواْ بَيۡنَ ٱلنَّاسِۚ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٞ ٢٢٤﴾ [البقرة: ٢٢٤]  
“আর আল্লাহকে তোমরা তোমাদের শপথ পূরণে প্রতিবন্ধক বানিয়ো না যে, তোমরা (আল্লাহর নামে এই বলে শপথ করবে যে) ভালো কাজ করবে না, তাকওয়া অবলম্বন করবে না এবং মানুষের মধ্যে সংশোধন করবে না। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৪]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে মুসলিমগণ, তোমরা আল্লাহর নামে নিজেদের শপথকে সৎকাজ, আত্মীয়তা রক্ষা, তাকওয়া ও মানুষের সংশোধন কাজে অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধক বানাবে না। আর তা এভাবে যে, এসব কাজের কোনোটার প্রতি তোমাদের ডাকা হলো আর তোমরা বললে যে আমরা ওই কাজ না করার শপথ করেছি। বরং শপথকারীর কর্তব্য হবে নিজের শপথ থেকে সরে আসা, সৎ কাজ করে যাওয়া, নিজের শপথের জন্য কাফফারা দেওয়া এবং এতে অভ্যস্ত না হওয়া। আল্লাহ তোমাদের কথাগুলো শ্রবণকারী। তোমাদের সকল অবস্থা সম্পর্কে অবগত।
﴿لَّا يُؤَاخِذُكُمُ ٱللَّهُ بِٱللَّغۡوِ فِيٓ أَيۡمَٰنِكُمۡ وَلَٰكِن يُؤَاخِذُكُم بِمَا كَسَبَتۡ قُلُوبُكُمۡۗ وَٱللَّهُ غَفُورٌ حَلِيمٞ ٢٢٥﴾ [البقرة: ٢٢٥]  
“আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের অর্থহীন শপথের জন্য পাকড়াও করবেন না। কিন্তু পাকড়াও করবেন যা তোমাদের অন্তরসমূহ অর্জন করেছে। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, সহনশীল।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৫]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সেসব শপথের জন্য শাস্তি দেবেন না যা তোমরা অনেকটা অনিচ্ছায় উচ্চারণ করেছ, তবে তিনি তোমাদের সেসব শপথের জন্য শাস্তি দেবেন যেগুলো তোমরা ইচ্ছাকৃতভাবে উচ্চারণ করেছ। যে আল্লাহর কাছে ফিরে যায় আল্লাহ তার প্রতি ক্ষমাশীল আর তিনি যে তার অবাধ্য হয় তার প্রতি ধৈর্যশীল, ফলে তাকে তিনি তৎক্ষণাৎ শাস্তি দেন না।
﴿لِّلَّذِينَ يُؤۡلُونَ مِن نِّسَآئِهِمۡ تَرَبُّصُ أَرۡبَعَةِ أَشۡهُرٖۖ فَإِن فَآءُو فَإِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٢٢٦﴾ [البقرة: ٢٢٦]  
“যারা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে মিলিত না হওয়ার শপথ করবে তারা চার মাস অপেক্ষা করবে। অতঃপর তারা যদি ফিরিয়ে নেয়, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৬]  
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: যারা শপথ করে যে তারা নিজেদের স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হবে না, তারা চার মাস অপেক্ষা করবে: যদি তারা চার মাস অতিক্রমের আগে তাদের ফিরিয়ে নেয় তবে তো আল্লাহ তাদের শপথ ও পরে তা প্রত্যাহারের ব্যাপারে ক্ষমাকারী এবং তিনি তাদের প্রতি দয়াবান।
﴿وَإِنۡ عَزَمُواْ ٱلطَّلَٰقَ فَإِنَّ ٱللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٞ ٢٢٧﴾ [البقرة: ٢٢٧]  
“আর যদি তারা তালাকের দৃঢ় ইচ্ছা করে নেয় তবে নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৭]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর তারা যদি শপথে বহাল থাকা এবং সহবাস বর্জনের দ্বারা তালাক দেবে বলে স্থির করে তবে আল্লাহ তাদের কথা শ্রবণকারী, তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত এবং তিনি এর জন্য তাদের প্রতিদান দেবেন।
﴿وَٱلۡمُطَلَّقَٰتُ يَتَرَبَّصۡنَ بِأَنفُسِهِنَّ ثَلَٰثَةَ قُرُوٓءٖۚ وَلَا يَحِلُّ لَهُنَّ أَن يَكۡتُمۡنَ مَا خَلَقَ ٱللَّهُ فِيٓ أَرۡحَامِهِنَّ إِن كُنَّ يُؤۡمِنَّ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ وَبُعُولَتُهُنَّ أَحَقُّ بِرَدِّهِنَّ فِي ذَٰلِكَ إِنۡ أَرَادُوٓاْ إِصۡلَٰحٗاۚ وَلَهُنَّ مِثۡلُ ٱلَّذِي عَلَيۡهِنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ وَلِلرِّجَالِ عَلَيۡهِنَّ دَرَجَةٞۗ وَٱللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ٢٢٨﴾ [البقرة: ٢٢٨]  
“আর তালাকপ্রাপ্তা নারীরা তিন ঋতু পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকবে এবং তাদের জন্য হালাল হবে না যে, আল্লাহ তাদের গর্ভে যা সৃষ্টি করেছেন, তা তারা গোপন করবে, যদি তারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে। আর এর মধ্যে তাদের স্বামীরা তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে অধিক হকদার, যদি তারা সংশোধন চায়। আর নারীদের রয়েছে বিধি মোতাবেক অধিকার। যেমন আছে তাদের ওপর (পুরুষদের) অধিকার। আর পুরুষদের রয়েছে তাদের ওপর মর্যাদা এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৮]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর ঋতুবতী তালাকপ্রাপ্ত নারীরা ইদ্দত হিসেবে তালাকপ্রাপ্তির পর তিন ‘তুহূর’ তথা তিন ঋতুকাল বিয়ে না করে অপেক্ষা করবে। যাতে করে তার গর্ভাশয় সন্তানমুক্ত হিসেবে নিশ্চিত হতে পারে। উপরোক্ত সময়কালে তাদের জন্য কোনো পুরুষকে বিয়ে করার অনুমতি নেই। তাদের জন্য এও অনুমতি নেই যে, তারা আল্লাহ তাদের গর্ভে যা সৃষ্টি করেছেন তা গোপন রাখবে। যদি এই তালাকপ্রাপ্তারা প্রকৃতই আল্লাহ এবং আখিরাতের প্রতি ঈমানদার হয়। আর তালাকপ্রাপ্তাদের স্বামীরা এই সময়ে তাদের ফেরত নেবার ক্ষেত্রে অধিক হকদার। তবে এটি করা উচিত সংশোধন ও মঙ্গলার্থে, ইদ্দতকাল দীর্ঘ করে তাদের শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে নয়। আর স্ত্রীদের প্রতি স্বামীদের মতো স্ত্রীদেরও রয়েছে স্বামীদের প্রতি কিছু অধিকার। এসব প্রদান করা হবে সহৃদয়তার সঙ্গে। তবে স্ত্রীদের প্রতি স্বামীদের অতিরিক্ত কিছু মর্যাদা রয়েছে। যেমন: সদুপায়ে তার সঙ্গে বসবাস ও সহাবস্থান, গৃহের কর্তৃত্ব ও পরিচালনাভার এবং তালাক প্রদানের অধিকার। আর আল্লাহ হলেন পরাক্রমশালী, তার রয়েছে সুউচ্চ মর্যাদা এবং তিনি মহাপ্রজ্ঞাবান, তাই প্রতিটি বিষয়কে তার উপযুক্ত স্থানে রাখেন।
﴿ٱلطَّلَٰقُ مَرَّتَانِۖ فَإِمۡسَاكُۢ بِمَعۡرُوفٍ أَوۡ تَسۡرِيحُۢ بِإِحۡسَٰنٖۗ وَلَا يَحِلُّ لَكُمۡ أَن تَأۡخُذُواْ مِمَّآ ءَاتَيۡتُمُوهُنَّ شَيۡ‍ًٔا إِلَّآ أَن يَخَافَآ أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ ٱللَّهِۖ فَإِنۡ خِفۡتُمۡ أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ ٱللَّهِ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِمَا فِيمَا ٱفۡتَدَتۡ بِهِۦۗ تِلۡكَ حُدُودُ ٱللَّهِ فَلَا تَعۡتَدُوهَاۚ وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ ٱللَّهِ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ٢٢٩﴾ [البقرة: ٢٢٩]  
“তালাক দু’বার। অতঃপর বিধি মোতাবেক রেখে দেবে কিংবা সুন্দরভাবে ছেড়ে দেবে। আর তোমাদের জন্য হালাল নয় যে, তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছ, তা থেকে কিছু নিয়ে নেবে। তবে উভয়ে যদি আশঙ্কা করে যে, আল্লাহর সীমারেখায় তারা অবস্থান করতে পারবে না। সুতরাং তোমরা যদি আশঙ্কা কর যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা কায়েম রাখতে পারবে না তাহলে স্ত্রী যা দিয়ে নিজকে মুক্ত করে নেবে তাতে কোন সমস্যা নেই। এটা আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং তোমরা তা লঙ্ঘন করো না। আর যে আল্লাহর সীমারেখাসমূহ লঙ্ঘন করে, বস্তুত তারাই যালিম।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৯]  
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: যে তালাক থেকে ফিরে নেবার সুযোগ রয়েছে তা হলো দুই তালাক, একটির পর একটি। প্রত্যেক তালাক প্রদানের পর আল্লাহর বিধান হলো : হয়তো স্ত্রীকে সন্তুষ্ট চিত্তে সদুপায়ে ফেরত নেবে এবং ফেরত নেবার পর সুন্দরভাবে বসবাস করবে অথবা তাকে সুন্দর ব্যবহার করে তার পথ ছেড়ে দেবে। আর তা হলো তার হকসমূহগুলো দিয়ে তাকে বিদায় দেওয়া এবং পরবর্তীতে তাকে মন্দভাবে স্মরণ না করা। আর হে স্বামীবৃন্দ, তোমরা তাদের মোহর ইত্যাদি যা দিয়েছ তা ফেরত নেওয়া তোমাদের জন্য বৈধ নয়। তবে স্বামী-স্ত্রী যদি বৈবাহিক অধিকারাবলি কায়েম করবে বলে আশঙ্কা করে তবে তাদের বিষয় উত্থাপন করা হবে অভিভাবকবৃন্দের কাছে। অভিভাবকগণ যদি স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে শঙ্কা বোধ করেন যে তারা আল্লাহর বিধান কায়েম করবে না, তবে স্বামী-স্ত্রীর জন্য তাতে কোনো অপরাধ হবে না স্ত্রী তার তালাকের বিনিময়ে স্বামীকে যা প্রদান করবে। এই বিধানগুলো হলো হালাল ও হারামের মধ্যে আল্লাহর সীমারেখা। অতএব তোমরা তা অতিক্রম কর না। আর যারা আল্লাহর সীমারেখা অতিক্রম করবে তারাই নিজেদেরকে আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন করার মাধ্যমে নিজেদের ওপর যুলুম করবে।
﴿فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُۥ مِنۢ بَعۡدُ حَتَّىٰ تَنكِحَ زَوۡجًا غَيۡرَهُۥۗ فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِمَآ أَن يَتَرَاجَعَآ إِن ظَنَّآ أَن يُقِيمَا حُدُودَ ٱللَّهِۗ وَتِلۡكَ حُدُودُ ٱللَّهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوۡمٖ يَعۡلَمُونَ ٢٣٠﴾ [البقرة: ٢٣٠]  
“অতএব যদি সে তাকে তালাক দেয় তাহলে সে পুরুষের জন্য হালাল হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ভিন্ন একজন স্বামী সে গ্রহণ না করে। অতঃপর সে (স্বামী) যদি তাকে তালাক দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের অপরাধ হবে না যে, তারা একে অপরের নিকট ফিরে আসবে, যদি দৃঢ় ধারণা রাখে যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা কায়েম রাখতে পারবে। আর এটা আল্লাহর সীমারেখা, তিনি তা এমন সম্প্রদায়ের জন্য স্পষ্ট করে দেন, যারা বুঝে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩০]    
সংক্ষিপ্ত তাফসীর : যদি স্বামী আপন স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে দেন তবে সে আর তার জন্য হালাল হবার নয়। তবে যদি অন্য কোনো পুরুষকে যথাযথভাবে বিয়ে করে এবং তার সঙ্গে সহবাস করে। আর এ বিয়ে হয় আগ্রহের ভিত্তিতে; প্রথম স্বামীর জন্য হালাল বানানোর হিলা হিসেবে হয়। অতপর পরের স্বামী যদি তাকে তালাক প্রদান করে কিংবা তিনি মারা যান এবং তার ইদ্দত পূর্ণ হয়, তবে তখনই কেবল প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে আসার সুযোগ রয়েছে। আর তা নতুন বিয়ে এবং নতুন মোহর নির্ধারণের মাধ্যমে। যদি তারা আত্মপ্রত্যয়ী হয় যে স্বামী-স্ত্রীর জন্য আল্লাহর নির্ধারিত বিধি-বিধান পালন করতে পারবে। আর এসব হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধি-বিধান যা তিনি এমন কওমের জন্য বর্ণনা করেছেন যারা তাঁর বিধানাবলি ও সীমারেখা সম্পর্কে জানে। কারণ, এরাই মূলত এ থেকে উপকৃত হয়।
﴿وَإِذَا طَلَّقۡتُمُ ٱلنِّسَآءَ فَبَلَغۡنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمۡسِكُوهُنَّ بِمَعۡرُوفٍ أَوۡ سَرِّحُوهُنَّ بِمَعۡرُوفٖۚ وَلَا تُمۡسِكُوهُنَّ ضِرَارٗا لِّتَعۡتَدُواْۚ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ فَقَدۡ ظَلَمَ نَفۡسَهُۥۚ وَلَا تَتَّخِذُوٓاْ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ هُزُوٗاۚ وَٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتَ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡ وَمَآ أَنزَلَ عَلَيۡكُم مِّنَ ٱلۡكِتَٰبِ وَٱلۡحِكۡمَةِ يَعِظُكُم بِهِۦۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٞ ٢٣١﴾ [البقرة: ٢٣١]  
“আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দেবে অতঃপর তারা তাদের ইদ্দতে পৌঁছে যাবে তখন হয়তো বিধি মোতাবেক তাদেরকে রেখে দেবে অথবা বিধি মোতাবেক তাদেরকে ছেড়ে দেবে। তবে তাদেরকে কষ্ট দিয়ে সীমালঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে তাদেরকে আটকে রেখো না। আর যে তা করবে সে তো নিজের প্রতি যুলম করবে। আর তোমরা আল্লাহর আয়াতসমূহকে উপহাসরূপে গ্রহণ করো না। আর তোমরা স্মরণ কর তোমাদের ওপর আল্লাহর নি‘আমত এবং তোমাদের ওপর কিতাব ও হিকমত যা নাযিল করেছেন, যার মাধ্যমে তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন। আর আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ যে, নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয় সম্পর্কে সুপরিজ্ঞাত।”  [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩১]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর যখন তোমরা স্ত্রীদের তালাক দেবে অতপর তাদের ইদ্দতের সমাপ্তিকাল ঘনিয়ে আসে, তখন এ নিয়তে উত্তম উপায়ে হয়তো তাদের ফেরত নেবে যে ইসলামী ও সামাজিকরীতি অনুযায়ী তাদের প্রাপ্য হকগুলো সুচারুরূপে সম্পন্ন করবে অথবা তাদের একেবারে ছেড়েই দেবে যাতে তাদের ইদ্দতকাল পূর্ণ হয়ে যায়। আর সতর্ক থেকো, তাদেরকে তোমাদের ফিরিয়ে নেয়াটা যেন তাদের হকসমূহ আদায় না করে তাদের কষ্ট দেবার উদ্দেশে না হয়। আর যে তা করবে সে নিজেকে শাস্তির উপযুক্ত বানিয়ে নিজের ওপর যুলুম করবে। আর তোমরা আল্লাহর আয়াতসমূহ এবং তাঁর বিধানাবলিকে উপহাস বা বিদ্রূপের বিষয় বানিয়ো না। আর তোমরা স্মরণ কর আল্লাহর তোমাদের যে ইসলাম ও বিস্তারিত বিধি-নিধানের নি‘আমত দিয়েছেন সেগুলোকে এবং তোমরা আরও স্মরণ কর আল্লাহ যে কুরআন ও সুন্নাহ নাযিল করেছেন তাকে। আর এই বিশাল নি‘আমতগুলোর জন্য তোমরা তাঁর প্রশংসা কর। এর মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন এবং ভয়ঙ্কর বিষয়াবলির ভয় দেখাচ্ছেন। অতএব, আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁকে পর্যবেক্ষণ জেনো। তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহ সবকিছুই জানেন; তাঁর কাছে কিছুই গোপন নয়। সুতরাং তিনি প্রত্যেককে উপযুক্ত প্রতিদান দেবেন।
﴿وَإِذَا طَلَّقۡتُمُ ٱلنِّسَآءَ فَبَلَغۡنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا تَعۡضُلُوهُنَّ أَن يَنكِحۡنَ أَزۡوَٰجَهُنَّ إِذَا تَرَٰضَوۡاْ بَيۡنَهُم بِٱلۡمَعۡرُوفِۗ ذَٰلِكَ يُوعَظُ بِهِۦ مَن كَانَ مِنكُمۡ يُؤۡمِنُ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۗ ذَٰلِكُمۡ أَزۡكَىٰ لَكُمۡ وَأَطۡهَرُۚ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ وَأَنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ ٢٣٢﴾ [البقرة: ٢٣٢]  
“আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দেবে অতঃপর তারা তাদের ইদ্দতে পৌঁছবে তখন তোমরা তাদেরকে বাধা দিয়ো না যে, তারা তাদের স্বামীদেরকে বিয়ে করবে যদি তারা পরস্পরে তাদের মধ্যে বিধি মোতাবেক সম্মত হয়। এটা উপদেশ তাকে দেয়া হচ্ছে, যে তোমাদের মধ্যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে। এটি তোমাদের জন্য অধিক শুদ্ধ ও অধিক পবিত্র। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩২]   
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর তোমরা যখন স্ত্রীদের তিন তালাকের নিচে (এক বা দুই) তালাক দাও আর তাদেরকে ফেরত নেওয়া ছাড়াই তাদের ইদ্দতকাল পুরো হয়ে যায়, তবে হে অভিভাবকবৃন্দ, নতুন আকদের মাধ্যমে নিজেদের স্বামীর কাছে প্রত্যাবর্তন করতে চাইলে তালাকপ্রাপ্ত নারীদের বাধা দিয়ে তোমরা তাদের প্রতি কঠোরতা দেখাবে না। এর মাধ্যমে তাদের উপদেশ প্রদান করা হচ্ছে, তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি খাঁটি ঈমানদার। নিশ্চয় কঠোরতা বর্জন এবং আপন স্ত্রীদের বিয়েতে স্বামীদের সুযোগ প্রদান তোমাদের অধিক সম্মান ও পবিত্রতা বর্ধক, তোমাদের জন্য বেশি লাভজনক ও নেকীজনক। আল্লাহ জানেন কোনটিতে তোমাদের কল্যাণ রয়েছে; কিন্তু তোমরা তা জান না।
﴿وَٱلۡوَٰلِدَٰتُ يُرۡضِعۡنَ أَوۡلَٰدَهُنَّ حَوۡلَيۡنِ كَامِلَيۡنِۖ لِمَنۡ أَرَادَ أَن يُتِمَّ ٱلرَّضَاعَةَۚ وَعَلَى ٱلۡمَوۡلُودِ لَهُۥ رِزۡقُهُنَّ وَكِسۡوَتُهُنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ لَا تُكَلَّفُ نَفۡسٌ إِلَّا وُسۡعَهَاۚ لَا تُضَآرَّ وَٰلِدَةُۢ بِوَلَدِهَا وَلَا مَوۡلُودٞ لَّهُۥ بِوَلَدِهِۦۚ وَعَلَى ٱلۡوَارِثِ مِثۡلُ ذَٰلِكَۗ فَإِنۡ أَرَادَا فِصَالًا عَن تَرَاضٖ مِّنۡهُمَا وَتَشَاوُرٖ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِمَاۗ وَإِنۡ أَرَدتُّمۡ أَن تَسۡتَرۡضِعُوٓاْ أَوۡلَٰدَكُمۡ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡكُمۡ إِذَا سَلَّمۡتُم مَّآ ءَاتَيۡتُم بِٱلۡمَعۡرُوفِۗ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ٢٣٣﴾ [البقرة: ٢٣٣]  
“আর মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর দুধ পান করাবে, (এটা) তার জন্য যে দুধ পান করাবার সময় পূর্ণ করতে চায়। আর পিতার ওপর কর্তব্য, বিধি মোতাবেক মায়েদেরকে খাবার ও পোশাক প্রদান করা। সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো ব্যক্তিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয় না। কষ্ট দেওয়া যাবে না কোনো মাকে তার সন্তানের জন্য, কিংবা কোনো বাবাকে তার সন্তানের জন্য। আর ওয়ারিশের ওপর রয়েছে অনুরূপ দায়িত্ব। অতঃপর তারা যদি পরস্পর সম্মতি ও পরামর্শের মাধ্যমে দুধ ছাড়াতে চায়, তাহলে তাদের কোনো পাপ হবে না। আর যদি তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে অন্য কারো থেকে দুধ পান করাতে চাও, তাহলেও তোমাদের ওপর কোনো পাপ নেই, যদি তোমরা বিধি মোতাবেক তাদেরকে যা দেবার তা দিয়ে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৩]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর মায়েদের দায়িত্ব পূর্ণ দুই বছর নিজের সন্তানকে দুধ পান করানো, যদি সে চায় দুধ পান করানোর মেয়াদ শেষ করতে। আর বাবাদের কর্তব্য, তালাকপ্রাপ্ত স্তন্যদানকারী মায়েদের শরীয়ত ও সমাজের দৃষ্টিতে সুন্দর আহার ও পরিধেয়র ব্যবস্থা করা। কারণ, আল্লাহ কোনো প্রাণের প্রতি তার সাধ্যাতীত কিছু চাপিয়ে দেন না। আর পিতামাতার জন্য হালাল নয় সন্তানকে পরস্পরের ক্ষতির উপায় বানানো। পিতার মৃত্যুকালে ওয়ারিশের ওপর তেমনি খরচাদি ওয়াজিব যা পিতার ওপর ওয়াজিব ছিল তার মৃত্যুর আগে। যদি পিতামাতা দুই বছর পূর্ণ হবার আগেই সন্তানের দুধ ছাড়াতে চায় তবে তাতে কোনো সমস্যা নাই, যদি তারা এ বিষয়ে সন্তানের কল্যাণে উপনীত হবে উভয়ে পরামর্শ ও সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যদি পিতামাতা সন্তানকে মা ছাড়া অন্য কারো দুধ পান করানোর ব্যাপারে একমত হয় তবে তাতেও কোনো সমস্যা নেই তাদের জন্য, বাবা যদি মায়ের হক মেনে নেন এবং স্তন্যদানকারীকে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী বিনিময় দান করে। আর তোমরা তোমাদের সকল অবস্থায় আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, আল্লাহ তোমাদের সব কিছু প্রত্যক্ষ করেন। অতএব তিনি এ জন্য তোমাদের প্রতিদান দেবেন।
﴿وَٱلَّذِينَ يُتَوَفَّوۡنَ مِنكُمۡ وَيَذَرُونَ أَزۡوَٰجٗا يَتَرَبَّصۡنَ بِأَنفُسِهِنَّ أَرۡبَعَةَ أَشۡهُرٖ وَعَشۡرٗاۖ فَإِذَا بَلَغۡنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡكُمۡ فِيمَا فَعَلۡنَ فِيٓ أَنفُسِهِنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۗ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ خَبِيرٞ ٢٣٤﴾ [البقرة: ٢٣٤]  
“আর তোমাদের মধ্য থেকে যারা মারা যাবে এবং স্ত্রীদেরকে রেখে যাবে, তাদের স্ত্রীগণ চার মাস দশ দিন অপেক্ষায় থাকবে। অতঃপর যখন তারা ইদ্দতকাল পূর্ণ করবে, তখন তারা নিজদের ব্যাপারে বিধি মোতাবেক যা করবে, সে ব্যাপারে তোমাদের কোনো পাপ নেই। আর তোমরা যা কর, সে ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক অবগত।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৪]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর তোমাদের মধ্যে যারা মারা যাবে এবং পরবর্তীতে স্ত্রীদের রেখে যাবে, তাদের স্ত্রীদের জন্য জরুরী হবে চার মাস দশদিন নিজেদের অপেক্ষায় রাখা। এ সময়ে তারা স্বামীর গৃহ থেকে বের হবে না, সাজসজ্জা করবে না এবং বিয়েও বসবে না। যখন উল্লিখিত মেয়াদ শেষ হবে তখন হে স্ত্রীদের অভিভাবকবৃন্দ, তোমাদের জন্য কোনো অসুবিধে নেই যদি তারা বের হয়, সাজসজ্জা করে কিংবা শরী‘আতসম্মত পন্থায় বিয়ে করে। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সব কাজ সম্পর্কেই অবগত এবং তিনি এসবের জন্য প্রতিদান দেবেন।  
﴿وَلَا جُنَاحَ عَلَيۡكُمۡ فِيمَا عَرَّضۡتُم بِهِۦ مِنۡ خِطۡبَةِ ٱلنِّسَآءِ أَوۡ أَكۡنَنتُمۡ فِيٓ أَنفُسِكُمۡۚ عَلِمَ ٱللَّهُ أَنَّكُمۡ سَتَذۡكُرُونَهُنَّ وَلَٰكِن لَّا تُوَاعِدُوهُنَّ سِرًّا إِلَّآ أَن تَقُولُواْ قَوۡلٗا مَّعۡرُوفٗاۚ وَلَا تَعۡزِمُواْ عُقۡدَةَ ٱلنِّكَاحِ حَتَّىٰ يَبۡلُغَ ٱلۡكِتَٰبُ أَجَلَهُۥۚ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ مَا فِيٓ أَنفُسِكُمۡ فَٱحۡذَرُوهُۚ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌ حَلِيمٞ ٢٣٥﴾ [البقرة: ٢٣٥]  
“আর এতে তোমাদের কোনো পাপ নেই যে, তোমরা নারীদেরকে ইশারায় যে প্রস্তাব করবে কিংবা মনে গোপন করে রাখবে। আল্লাহ জেনেছেন যে, তোমরা অবশ্যই তাদেরকে স্মরণ করবে। কিন্তু বিধি মোতাবেক কোন কথা বলা ছাড়া গোপনে তাদেরকে (কোন) প্রতিশ্রুতি দিও না। আর আল্লাহর নির্দেশ (ইদ্দত) তার সময় পূর্ণ করার পূর্বে বিবাহ বন্ধনের সংকল্প করো না। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের অন্তরে যা রয়েছে তা জানেন। সুতরাং তোমরা তাকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, সহনশীল।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৫]  
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর হে পুরুষগণ, তোমাদের জন্য এতে কোনো সমস্যা নেই যে তোমরা স্বামী মারা যাওয়া কিংবা ‘বায়ান’ তালাকপ্রাপ্তা নারীদের ইঙ্গিতে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। তেমনি সমস্যা নেই যদি তোমরা ইদ্দতপূর্ণ হবার পর তাদের বিয়ে করবে বলে মনে গোপন বাসনা রাখ। আল্লাহ জানেন যে তোমরা ইদ্দতপালনকারী নারীদের কথা স্মরণ করবে আর মনের দুর্বলতা হেতু তাদের ব্যাপারে চুপ থাকা তোমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। এ কারণে তিনি তোমাদের জন্য তাদেরকে ইঙ্গিতে প্রস্তাব দেয়া বা মনে গোপন বাসনা রাখা বৈধ করেছেন। আর তোমরা সতর্ক থেকো, তাদেরকে যেন ব্যভিচারের মাধ্যমে গোপন বিয়ে বা ইদ্দতকালে বিয়ের চুক্তির মাধ্যমে প্রতিশ্রুতি দিও না। তবে যদি এমন কথা বল, যা থেকে অনুমান করা যে তার মত নারীদের বিয়েতে তুমি আগ্রহী তাহলে ভিন্ন কথা। সর্বোপরি ইদ্দতকাল সমাপ্ত না হওয়া অবধি বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হবে বলে মনস্থ কর না। জেনে রেখ, আল্লাহ তোমাদের মনের কথা জানেন। অতএব তাঁকে ভয় কর। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন যে নিজ গুনাহ থেকে ক্ষমা চায়, তিনি তার বান্দাদের প্রতি সহনশীল, তিনি তোমাদের ওপর প্রতিশোধ নেন না।
﴿لَّا جُنَاحَ عَلَيۡكُمۡ إِن طَلَّقۡتُمُ ٱلنِّسَآءَ مَا لَمۡ تَمَسُّوهُنَّ أَوۡ تَفۡرِضُواْ لَهُنَّ فَرِيضَةٗۚ وَمَتِّعُوهُنَّ عَلَى ٱلۡمُوسِعِ قَدَرُهُۥ وَعَلَى ٱلۡمُقۡتِرِ قَدَرُهُۥ مَتَٰعَۢا بِٱلۡمَعۡرُوفِۖ حَقًّا عَلَى ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٢٣٦﴾ [البقرة: ٢٣٦]  
“তোমাদের কোনো অপরাধ নেই যদি তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দাও এমন অবস্থায় যে, তোমরা তাদেরকে স্পর্শ কর নি কিংবা তাদের জন্য কোনো মোহর নির্ধারণ কর নি। আর উত্তমভাবে তাদেরকে ভোগ-উপকরণ দিয়ে দাও, ধনীর ওপর তার সাধ্যানুসারে এবং সংকটাপন্নের ওপর তার সাধ্যানুসারে। সুকর্মশীলদের ওপর এটি আবশ্যক।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৬]   
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর হে স্বামীগণ, তোমাদের জন্য কোনো অসুবিধা নেই যখন তোমরা আকদের পরে এবং মিলনের আগে কিংবা মোহর নির্ধারণের পূর্বে স্ত্রীদের তালাক দাও। আর তাদেরকে বাধ্যতামূলক কিছু ভরণ-পোষণ দেবে যা থেকে তারা উপকৃত হবে, যাতে করে তালাকের ভীতি হয় এবং হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়। আর এই ভরণ-পোষণ ওয়াজিব হয় তালাক প্রদানকারী স্বামীর অবস্থা অনুপাতে, বিত্তবানের জন্য তার সাধ্য মত, তেমনি বিত্তহীনের জন্যও তার সামর্থ্য মত সদুপায়ে শরীয়তসম্মত পন্থায় ভরণ-পোষণ দিতে হবে। আর যারা শরীয়তের আনুগত্য প্রদর্শনপূর্বক নিজের এবং তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীদের প্রতি সদাচার দেখাতে চায় এটি তাদের জন্য প্রমাণিত হক।  
﴿وَإِن طَلَّقۡتُمُوهُنَّ مِن قَبۡلِ أَن تَمَسُّوهُنَّ وَقَدۡ فَرَضۡتُمۡ لَهُنَّ فَرِيضَةٗ فَنِصۡفُ مَا فَرَضۡتُمۡ إِلَّآ أَن يَعۡفُونَ أَوۡ يَعۡفُوَاْ ٱلَّذِي بِيَدِهِۦ عُقۡدَةُ ٱلنِّكَاحِۚ وَأَن تَعۡفُوٓاْ أَقۡرَبُ لِلتَّقۡوَىٰۚ وَلَا تَنسَوُاْ ٱلۡفَضۡلَ بَيۡنَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٌ ٢٣٧﴾ [البقرة: ٢٣٧]   
“আর যদি তোমরা তাদেরকে তালাক দাও, তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে এবং তাদের জন্য কিছু মোহর নির্ধারণ করে থাক, তাহলে যা নির্ধারণ করেছ, তার অর্ধেক (দিয়ে দাও)। তবে স্ত্রীরা যদি মাফ করে দেয়, কিংবা যার হাতে বিবাহের বন্ধন সে যদি মাফ করে দেয়। আর তোমাদের মাফ করে দেয়া তাকওয়ার অধিক নিকটতর। আর তোমরা পরস্পরের মধ্যে অনুগ্রহ ভুলে যেয়ো না। তোমরা যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৭]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর : আর বিয়ের আক্দ সম্পন্ন হবার পর যদি তোমরা স্ত্রীদের তালাক দাও এমন অবস্থায় যে তোমরা তাদের সঙ্গে মিলন কর নি, তবে তোমরা নিজেদের প্রতি তাদের জন্য মোহর নির্ধারণ করে নিয়েছো, তাহলে তোমাদের কর্তব্য হবে তাদেরকে নির্ধারিত মোহরের অর্ধেক প্রদান করা। তবে তালাকপ্রাপ্তা যদি উদারতা দেখিয়ে নিজের প্রাপ্য অর্ধেক মোহর ক্ষমা করে কিংবা স্বামী উদারতাবশত তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে পুরো মোহরই দিয়ে দেয় তাহলে ভিন্ন কথা। আর হে নারী ও পুরুষ সম্প্রদায়, তোমাদের পরস্পরকে উদারতা দেখানোই আল্লাহর ভয় ও তাঁর আনুগত্যের নিকটবর্তী। হে মানুষ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে উদারতা দেখানো ভুলে যেও না। আর তা হলো প্রাপ্য অংশ ছেড়ে দেওয়া এবং যা আবশ্যক ছিল না তা প্রদান করা। নিশ্চয় তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখেন। তিনি তোমাদেরকে ভালো কাজে আগ্রহী করেন এবং উদারতা ও বেশি প্রদানে উদ্বুদ্ধ করেন।
﴿حَٰفِظُواْ عَلَى ٱلصَّلَوَٰتِ وَٱلصَّلَوٰةِ ٱلۡوُسۡطَىٰ وَقُومُواْ لِلَّهِ قَٰنِتِينَ ٢٣٨﴾ [البقرة: ٢٣٨]  
“তোমরা সালাতসমূহ ও মধ্যবর্তী সালাতের হিফাযত কর এবং আল্লাহর জন্য দাঁড়াও বিনীত হয়ে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৮]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে মুসলিমগণ, তোমরা ফরয পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের প্রতি যত্ন নাও। সেগুলোকে তাদের সঠিক সময়ে তাদের সকল শর্ত, রুকন ও ওয়াজিবসহ আদায় কর। আর এসবের মধ্যবর্তী তথা আসরের সালাতের প্রতি যত্ন নাও। তোমরা তোমাদের আল্লাহর প্রতি বিনয়ী, আনত ও অনুগত হয়ে সালাত কায়েম কর।
﴿فَإِنۡ خِفۡتُمۡ فَرِجَالًا أَوۡ رُكۡبَانٗاۖ فَإِذَآ أَمِنتُمۡ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ كَمَا عَلَّمَكُم مَّا لَمۡ تَكُونُواْ تَعۡلَمُونَ ٢٣٩﴾ [البقرة: ٢٣٩]  
“কিন্তু যদি তোমরা ভয় কর, তবে হেঁটে কিংবা আরোহণ করে (আদায় করে নাও)। এরপর যখন নিরাপদ হবে তখন আল্লাহকে স্মরণ কর, যেভাবে তিনি তোমাদেরকে শিখিয়েছেন, যা তোমরা জানতে না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৯]  
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: যদি তোমরা শত্রুদের ভয় কর তবে তোমরা হেঁটে বা বাহনে চড়ে ‘খাওফ’ বা ভয়ের সালাত আদায় কর, যেভাবেই তা পার না কেন। ইশারায় কিংবা পশ্চিমমুখী না হয়ে। অতপর যখন ভয় কেটে যাবে তখন নিরাপত্তার সালাত আদায় কর। আর (নিরাপদ অবস্থায়) এতে আল্লাহকে স্মরণ কর এবং তার মূল অবস্থা থেকে তা কমিও না। আর তোমরা তাঁর শুকরিয়া আদায় কর যে তিনি তোমাদের অজানা বিধি-বিধান ও ইবাদতের বিষয়াবলি শিখিয়েছেন।
﴿وَٱلَّذِينَ يُتَوَفَّوۡنَ مِنكُمۡ وَيَذَرُونَ أَزۡوَٰجٗا وَصِيَّةٗ لِّأَزۡوَٰجِهِم مَّتَٰعًا إِلَى ٱلۡحَوۡلِ غَيۡرَ إِخۡرَاجٖۚ فَإِنۡ خَرَجۡنَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡكُمۡ فِي مَا فَعَلۡنَ فِيٓ أَنفُسِهِنَّ مِن مَّعۡرُوفٖۗ وَٱللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٞ ٢٤٠﴾ [البقرة: ٢٤٠]  
“আর তোমাদের মধ্য থেকে যারা মারা যাবে এবং স্ত্রীদেরকে রেখে যাবে, তারা তাদের স্ত্রীদের জন্য ওসিয়ত করবে এক বছরের ভরণ-পোষণের বের না করে দিয়ে; কিন্তু যদি তারা (স্বেচ্ছায়) বের হয়ে যায়, তাহলে তারা নিজদের ব্যাপারে বিধি মোতাবেক যা করেছে, সে ব্যাপারে তোমাদের কোনো পাপ নেই। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৪০]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর যেসব স্বামী মারা যায় আর তার পরবর্তীতে স্ত্রীদের রেখে যায়, তাদের কর্তব্য হলো স্ত্রীদের জন্য এ মর্মে অসিয়ত করা যে মৃত্যুর দিন থেকে এক বছর পর্যন্ত সে ভরণ-পোষণ পাবে।  উত্তরাধিকারীরা তাকে স্বামীর গৃহ থেকে বের করে দেবে না। যাতে করে স্ত্রীর মন রক্ষা হয় এবং মৃত ব্যক্তির প্রতি সদ্ব্যবহার দেখানো হয়। তবে যদি স্ত্রীগণ এক বছর অতিক্রান্ত না হতেই স্বেচ্ছায় বেরিয়ে যান, তবে এতে তোমাদের কোনো অপরাধ নেই হে উত্তরাধিকারীগণ। তেমনি স্ত্রীদের জন্যও এতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ তিনি তো বৈধ কাজই করেছেন। আল্লাহ তাঁর মালিকানায় কর্তৃত্ববান, নিজের আদেশ ও নিষেধ প্রদান প্রজ্ঞাবান। এ আয়াতটি পরবর্তীতে অন্য আয়াত দ্বারা মানসূখ বা রহিত করা হয়।
﴿وَلِلۡمُطَلَّقَٰتِ مَتَٰعُۢ بِٱلۡمَعۡرُوفِۖ حَقًّا عَلَى ٱلۡمُتَّقِينَ ٢٤١﴾ [البقرة: ٢٤١]  
“আর তালাকপ্রাপ্তা নারীদের জন্য থাকবে বিধি মোতাবেক ভরণ-পোষণ। (এটি) মুত্তাকীদের ওপর আবশ্যক।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৪১]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: আর তালাকপ্রাপ্তা নারীর জন্য শরী‘আতসম্মত পন্থায় উত্তমরূপে ভরণ-পোষণ প্রাপ্য। এটি তাদের জন্য প্রাপ্য যারা আল্লাহকে তাঁর আদেশ ও নিষেধ পালনের ব্যাপারে ভয় করে।
﴿ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمۡ ءَايَٰتِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ٢٤٢ ﴾ [البقرة: ٢٤٢]  
“এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দেন, যাতে তোমরা উপলব্ধি কর।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৪২]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: সন্তান ও স্ত্রীদের অধিকার সম্পর্কে এমন সুস্পষ্ট বর্ণনার মতো করে আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য তাঁর সকল বিধি-বিধান সুস্পষ্ট বলে দেন। যাতে তোমরা সেগুলো অনুধাবন করতে পার এবং আমলে আনতে পার।
﴿أَلَمۡ تَرَ إِلَى ٱلَّذِينَ خَرَجُواْ مِن دِيَٰرِهِمۡ وَهُمۡ أُلُوفٌ حَذَرَ ٱلۡمَوۡتِ فَقَالَ لَهُمُ ٱللَّهُ مُوتُواْ ثُمَّ أَحۡيَٰهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَذُو فَضۡلٍ عَلَى ٱلنَّاسِ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَشۡكُرُونَ ٢٤٣﴾ [البقرة: ٢٤٣]  
“তুমি কি তাদেরকে দেখ নি, যারা তাদের গৃহসমূহ থেকে বের হয়েছে মৃত্যুর ভয়ে এবং তারা ছিল হাজার-হাজার? অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে বললেন, ‘তোমরা মরে যাও’! তারপর তিনি তাদেরকে জীবিত করলেন। নিশ্চয় আল্লাহ তো মানুষের ওপর অনুগ্রহশীল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ শুকরিয়া আদায় করে না।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৪৩]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে রাসূল, আপনি কি তাদের ঘটনা দেখেন নি, যারা তাদের ভূমি ও আবাস ছেড়ে মহামারী ও যুদ্ধজনিত মৃত্যু ভয়ে পালিয়েছিল, তখন আল্লাহ তাদের উদ্দেশে বললেন, তোমরা মরে যাও। ফলে তারা আল্লাহর তাকদীর থেকে পলায়নের অপরাধে একসঙ্গে সবাই মারা যায় অতপর আল্লাহ তাদেরকে কিছু সময়ের আবার তাদের জীবিত করেন, যাতে তারা নিজেদের আয়ু পূর্ণ করতে পারে এবং উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ করে। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি মহা করুণাবান। তিনি তাদের প্রতি প্রভুত নিয়ামত বর্ষণ করেন। তবে অধিকাংশ মানুষই নিজের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে না।
﴿وَقَٰتِلُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٞ ٢٤٤﴾ [البقرة: ٢٤٤]  
“আর তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই কর এবং জেনে রাখ নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৪৪]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে মুসলিমগণ, তোমরা আল্লাহর দীনকে সাহায্য করতে কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উক্তিসমূহ শ্রবণ করেন। তিনি তোমাদের নিয়ত ও আমল সম্পর্কেও জানেন।
﴿مَّن ذَا ٱلَّذِي يُقۡرِضُ ٱللَّهَ قَرۡضًا حَسَنٗا فَيُضَٰعِفَهُۥ لَهُۥٓ أَضۡعَافٗا كَثِيرَةٗۚ وَٱللَّهُ يَقۡبِضُ وَيَبۡصُۜطُ وَإِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ٢٤٥﴾ [البقرة: ٢٤٥]  
“কে আছে, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেবে, ফলে তিনি তার জন্য বহু গুণে বাড়িয়ে দেবেন? আর আল্লাহ সংকীর্ণ করেন ও প্রসারিত করেন এবং তাঁরই নিকট তোমাদেরকে ফিরানো হবে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৪৫]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: কে আছে যে আল্লাহর পথে প্রতিদানের আশায় সদুপায়ে খরচ করবে, অতপর তাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়া হবে, ছাওয়াব ও উত্তম বিনিময়ের কোনো সংখ্যা থাকবে না। আল্লাহ গুটিয়ে নেন এবং ছড়িয়ে দেন। অতএব তোমরা খরচ কর; পরোয়া কর না। কেননা তিনি রিযিকদাতা। তিনি যার চান রিযিক সংকোচিত করেন এবং অন্যদের প্রতি প্রশস্ত করেন। এতে তাঁর বিশাল হিকমত রয়েছে। আর কেবল তাঁর দিকেই তোমরা মৃত্যুর পর প্রত্যাবর্তিত হবে। তখন তিনি তোমাদের আমলসমূহের প্রতিদান দেবেন।
﴿أَلَمۡ تَرَ إِلَى ٱلۡمَلَإِ مِنۢ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ مِنۢ بَعۡدِ مُوسَىٰٓ إِذۡ قَالُواْ لِنَبِيّٖ لَّهُمُ ٱبۡعَثۡ لَنَا مَلِكٗا نُّقَٰتِلۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِۖ قَالَ هَلۡ عَسَيۡتُمۡ إِن كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلۡقِتَالُ أَلَّا تُقَٰتِلُواْۖ قَالُواْ وَمَا لَنَآ أَلَّا نُقَٰتِلَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَقَدۡ أُخۡرِجۡنَا مِن دِيَٰرِنَا وَأَبۡنَآئِنَاۖ فَلَمَّا كُتِبَ عَلَيۡهِمُ ٱلۡقِتَالُ تَوَلَّوۡاْ إِلَّا قَلِيلٗا مِّنۡهُمۡۚ وَٱللَّهُ عَلِيمُۢ بِٱلظَّٰلِمِينَ ٢٤٦﴾ [البقرة: ٢٤٦]  
“তুমি কি মূসার পর বনী ইসরাঈলের প্রধানদেরকে দেখ নি? যখন তারা তাদের নবীকে বলেছিল, ‘আমাদের জন্য একজন রাজা পাঠান, তাহলে আমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করব’। সে বলল, ‘এমন কী হবে যে, যদি তোমাদের ওপর লড়াই আবশ্যক করা হয়, তোমরা লড়াই করবে না’? তারা বলল, আমাদের কী হয়েছে যে, আমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করব না, অথচ আমাদেরকে আমাদের গৃহসমূহ থেকে বের করা হয়েছে এবং আমাদের সন্তানদের থেকে (বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে)’? অতঃপর যখন তাদের ওপর লড়াই আবশ্যক করা হল, তখন তাদের মধ্য থেকে স্বল্প সংখ্যক ছাড়া তারা বিমুখ হল। আর আল্লাহ যালিমদের সম্পর্কে সম্যক অবগত।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৪৬]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: হে নবী, আপনি কি মূসা আলাইহিস সালাম পরবর্তী যুগে বনী ইসরাঈলের নেতা ও সম্মানিত ব্যক্তিদের ঘটনা জানেন, যখন তারা তাদের নবীর কাছে আবেদন করেছিল যাতে তাদের ওপর একজন রাজা নিযুক্ত করা হয়, যার নেতৃত্ব তারা সমবেত হবে এবং আল্লাহর রাস্তায় শত্রুদের মোকাবেলায় লড়াই করবে। তাদের নবী তাদের উদ্দেশে বলেন, বিষয়টা কি এমন হবে না যেমন আমি আশঙ্কা করি যে তোমাদের ওপর যদি আল্লাহর রাস্তায় লড়াই ফরয করা হয়, তবে তোমরা লড়াই করবে না। কেননা আমি তোমাদের কাপুরুষিকতা ও লড়াই থেকে পলায়নের আশঙ্কা করি। তারা তাদের নবীর আশঙ্কা অস্বীকার করে বলল, আল্লাহর রাস্তায় লড়াইয়ে আমাদের কে বাধা দেবে যখন আমাদের শত্রুতা আমাদেরকে নিজ ভূমি থেকে বের করে দিয়েছে এবং থেকে হত্যা বা বন্দীকরণের মাধ্যমে আমাদেরকে আমাদের সন্তানদের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে? অতপর আল্লাহ যখন তাদের ওপর নিযুক্ত করা রাজার সঙ্গে লড়াই আবশ্যক করে দিলেন, তারা ভীরুতা দেখাল এবং পালিয়ে গেল। কেবল অল্পসংখ্যক ব্যক্তি আল্লাহর করুণায় লড়াইয়ে টিকে রইল। নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী জালেমদের সম্পর্কে আল্লাহ জানেন।
﴿وَقَالَ لَهُمۡ نَبِيُّهُمۡ إِنَّ ٱللَّهَ قَدۡ بَعَثَ لَكُمۡ طَالُوتَ مَلِكٗاۚ قَالُوٓاْ أَنَّىٰ يَكُونُ لَهُ ٱلۡمُلۡكُ عَلَيۡنَا وَنَحۡنُ أَحَقُّ بِٱلۡمُلۡكِ مِنۡهُ وَلَمۡ يُؤۡتَ سَعَةٗ مِّنَ ٱلۡمَالِۚ قَالَ إِنَّ ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰهُ عَلَيۡكُمۡ وَزَادَهُۥ بَسۡطَةٗ فِي ٱلۡعِلۡمِ وَٱلۡجِسۡمِۖ وَٱللَّهُ يُؤۡتِي مُلۡكَهُۥ مَن يَشَآءُۚ وَٱللَّهُ وَٰسِعٌ عَلِيمٞ ٢٤٧﴾ [البقرة: ٢٤٧] “আর তাদেরকে তাদের নবী বলল, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য তালূতকে রাজারূপে পাঠিয়েছেন। তারা বলল, ‘আমাদের ওপর কীভাবে তার রাজত্ব হবে, অথচ আমরা তার চেয়ে রাজত্বের অধিক হকদার? আর তাকে সম্পদের প্রাচুর্যও দেয়া হয়নি’। সে বলল, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাকে তোমাদের ওপর মনোনীত করেছেন এবং তাকে জ্ঞানে ও দেহে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহ যাকে চান, তাকে তাঁর রাজত্ব দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ’।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৪৭]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: তাদের উদ্দেশে তাদের নবী বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে তোমাদের প্রতি তালূতকে রাজারূপে প্রেরণ করেছেন। তোমাদের আবেদন মাফিক শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি তোমাদের নেতৃত্ব দেবেন। বনী ইসরাঈলের শীর্ষস্থানীয়রা বলল, তালূত কিভাবে আমাদের রাজা নিযুক্ত হবে সে তো এর উপযুক্ত নয়? কারণ, সে রাজ বংশীয় নয়; আবার নবুওয়তের ঘর থেকেও নয়। কিংবা তাকে প্রচুর সম্পদও দেয়া হয় নি, নিজের মালিকানায় যার সাহায্য নেবে। অথচ রাজত্ব লাভে আমরা তার চেয়ে বেশি উপযুক্ত ছিলাম। কারণ, আমরা হলাম রাজ বংশধর এবং নবীগৃহে আমাদের জন্ম। তাদের উদ্দেশে তাদের নবী বললেন, আল্লাহ তোমাদের ওপর তাকে নিযুক্ত করেছেন। আর তিনি তাঁর বান্দাদের বিষয়াদি সবচে ভালো জানেন। তিনি তাকে ইলমের প্রাচুর্য দান করেছেন এবং শত্রুর মোকাবিলার জন্য শারীরিক শক্তিও দিয়েছেন। আল্লাহ হলেন রাজাধিরাজ, তিনি তার বান্দার মধ্যে যাকে চান রাজত্ব দান করেন। আল্লাহ ব্যাপক দাতা ও দয়ালু। তিনি সকল বিষয়ের গূঢ় তথ্য জানেন; তাঁর কাছে কিছুই গোপন নয়।
﴿وَقَالَ لَهُمۡ نَبِيُّهُمۡ إِنَّ ءَايَةَ مُلۡكِهِۦٓ أَن يَأۡتِيَكُمُ ٱلتَّابُوتُ فِيهِ سَكِينَةٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَبَقِيَّةٞ مِّمَّا تَرَكَ ءَالُ مُوسَىٰ وَءَالُ هَٰرُونَ تَحۡمِلُهُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَةٗ لَّكُمۡ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٢٤٨﴾ [البقرة: ٢٤٨]  
“আর তাদেরকে তাদের নবী বলল, নিশ্চয় তার রাজত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের নিকট তাবূত আসবে, যাতে থাকবে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে প্রশান্তি এবং মূসার পরিবার ও হারূনের পরিবার যা রেখে গিয়েছে তার অবশিষ্ট, যা বহন করে আনবে ফিরিশতাগণ। নিশ্চয় তাতে রয়েছে তোমাদের জন্য নিদর্শন, যদি তোমরা মু’মিন হও।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৪৮]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: তাদের উদ্দেশে তাদের নবী বললেন, তাঁর রাজত্বের নিদর্শন হলো তোমাদের কাছে সিন্দুক আসবে, যাতে থাকবে তাওরাত; যা তাদের থেকে তাদের শত্রুরা ছিনিয়ে নিয়েছিল। তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তার মধ্যে থাকবে প্রশান্তি, যাতে নিষ্ঠাবানদের অন্তরকে দৃঢ় করবে। আর তাতে মূসা ও হারূন আলাইহিমাস সালামের পরিবারের কিছু অবশিষ্ট সামগ্রী থাকবে, যেমন: লাঠি ও ফলকসমূহের টুকরো। ফেরেশতারা এসব বহণ করবেন। এতে তোমাদের জন্য আল্লাহর নির্দেশে তালূতকে নিজেদের রাজা হিসেবে গ্রহণ করার সবচে বড় নিদর্শন রয়েছে যদি তোমরা আল্লাহ ও রাসূলগণের সত্যায়নকারী হও।
﴿فَلَمَّا فَصَلَ طَالُوتُ بِٱلۡجُنُودِ قَالَ إِنَّ ٱللَّهَ مُبۡتَلِيكُم بِنَهَرٖ فَمَن شَرِبَ مِنۡهُ فَلَيۡسَ مِنِّي وَمَن لَّمۡ يَطۡعَمۡهُ فَإِنَّهُۥ مِنِّيٓ إِلَّا مَنِ ٱغۡتَرَفَ غُرۡفَةَۢ بِيَدِهِۦۚ فَشَرِبُواْ مِنۡهُ إِلَّا قَلِيلٗا مِّنۡهُمۡۚ فَلَمَّا جَاوَزَهُۥ هُوَ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مَعَهُۥ قَالُواْ لَا طَاقَةَ لَنَا ٱلۡيَوۡمَ بِجَالُوتَ وَجُنُودِهِۦۚ قَالَ ٱلَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُم مُّلَٰقُواْ ٱللَّهِ كَم مِّن فِئَةٖ قَلِيلَةٍ غَلَبَتۡ فِئَةٗ كَثِيرَةَۢ بِإِذۡنِ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ ٢٤٩﴾ [البقرة: ٢٤٩]  
“অতঃপর যখন তালূত সৈন্যবাহিনী নিয়ে বের হল, তখন সে বলল, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে একটি নদী দ্বারা পরীক্ষা করবেন। অতএব, যে তা হতে পান করবে, সে আমার দলভুক্ত নয়। আর যে তা খাবে না, তাহলে নিশ্চয় সে আমার দলভুক্ত। তবে যে তার হাত দিয়ে এক আজলা পরিমাণ খাবে, সে ছাড়া; কিন্তু তাদের মধ্য থেকে স্বল্পসংখ্যক ছাড়া তা থেকে তারা পান করল। অতঃপর যখন সে ও তার সাথি মু’মিনগণ তা অতিক্রম করল, তারা বলল, ‘আজ আমাদের জালূত ও তার সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা নেই’। যারা দৃঢ় ধারণা রাখত যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হবে, তারা বলল, ‘কত ছোট দল আল্লাহর হুকুমে বড় দলকে পরাজিত করেছে’! আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৪৯]   
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: তালূত যখন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে আমালেকা গোত্রের সঙ্গে লড়াইয়ে বের হল তিনি তাদের উদ্দেশে বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের সবরের পরীক্ষা নিবেন সামনে পড়বে এমন একটি নদী দিয়ে। যাতে করে মু‘মিনরা মুনাফিকদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। অতএব তোমাদের মধ্যে যে নদীর পানি পান করবে সে আমার দলভুক্ত নয়। সে আমার সঙ্গে জিহাদের যোগ্যতা রাখে না। আর যে পানির স্বাদ নেবে না, সে আমার দলভুক্ত। সে আমার নির্দেশের অনুগত এবং জিহাদের যোগ্য। তবে যে অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে নিজ হাতে এক ঢোক গিলবে, তাতে কোনো সমস্যা নাই। অতপর যখন তারা নদীর কাছে উপনীত হল, সাগ্রহে তারা পানির ওপর ঝুঁকে পড়ল এবং অতিমাত্রায় তা থেকে পান করল। তাদের কেবল গুটিকয়েক ব্যক্তি গরম ও তৃষ্ণায় ধৈর্য ধরল। তারা কেবল এক ঢোকেই ক্ষান্ত হল। এ পর্যায়ে অবাধ্যরা পিছিয়ে গেল। যখন তালূত ও তার স্বল্পসংখ্যক মু’মিন সঙ্গী (তাদের সংখ্যা ছিল তিনশ’র কিছু বেশি) তার সঙ্গে নদী অতিক্রম করল এবং শত্রুর মুখোমুখী তাদের সংখ্যা অনেক বেশি দেখল, তখন তারা বলল, আজ আমাদের জালূত ও তার বিশাল বাহিনীর মোকাবিলার শক্তি নেই। যারা আল্লাহর সাক্ষাতে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী তারা তাদের ভাইদের আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলল, কত ধৈর্যশীল মু’মিনদের ছোট দল আল্লাহর নির্দেশ ও ইশারায় অবাধ্যাচারী বেশি সংখ্যক কাফের দলের ওপর বিজয়ী হয়েছে। আর আল্লাহ তাঁর তাওফীক ও সাহায্যের মাধ্যমে ধৈর্যশীলদের সঙ্গেই আছেন।
﴿وَلَمَّا بَرَزُواْ لِجَالُوتَ وَجُنُودِهِۦ قَالُواْ رَبَّنَآ أَفۡرِغۡ عَلَيۡنَا صَبۡرٗا وَثَبِّتۡ أَقۡدَامَنَا وَٱنصُرۡنَا عَلَى ٱلۡقَوۡمِ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٢٥٠﴾ [البقرة: ٢٥٠]  
“আর যখন তারা জালূত ও তার সৈন্যবাহিনীর মুখোমুখি হল, তখন তারা বলল, ‘হে আমাদের রব, আমাদের ওপর ধৈর্য ঢেলে দিন, আমাদের পা স্থির রাখুন এবং আমাদেরকে কাফের জাতির বিরুদ্ধে সাহায্য করুন।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫০]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: তারা যখন জালূত ও তার সৈন্যবাহিনীর সম্মুখীন হল এবং ভয়ঙ্কর অবস্থা প্রত্যক্ষ করল, তখন তারা আল্লাহর কাছে বিনয় ও কাকুতি-মিনতিসহ বলল, হে আমাদের রব, আমাদের অন্তরে ব্যাপক সবর দান করুন, আমাদের কদম অবিচল রাখুন এবং শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ে তা অটুট রাখুন। যাতে যুদ্ধের ভয়াবহতায় তা পলায়ন না করে। এবং আপনার সাহায্য ও সহযোগিতার মাধ্যমে আপনি আমাদেরকে কাফির সম্প্রদায়ের ওপর বিজয় দান করুন।
﴿فَهَزَمُوهُم بِإِذۡنِ ٱللَّهِ وَقَتَلَ دَاوُۥدُ جَالُوتَ وَءَاتَىٰهُ ٱللَّهُ ٱلۡمُلۡكَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَعَلَّمَهُۥ مِمَّا يَشَآءُۗ وَلَوۡلَا دَفۡعُ ٱللَّهِ ٱلنَّاسَ بَعۡضَهُم بِبَعۡضٖ لَّفَسَدَتِ ٱلۡأَرۡضُ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ ذُو فَضۡلٍ عَلَى ٱلۡعَٰلَمِينَ ٢٥١﴾ [البقرة: ٢٥١]  
“অতঃপর তারা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে পরাজিত করল এবং দাঊদ জালূতকে হত্যা করল। আর আল্লাহ দাঊদকে রাজত্ব ও প্রজ্ঞা দান করলেন এবং তাকে যা ইচ্ছা শিক্ষা দিলেন। আর আল্লাহ যদি মানুষের কতককে কতকের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তবে অবশ্যই জমিন ফাসাদপূর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর ওপর অনুগ্রহশীল।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫১]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: অতপর আল্লাহর নির্দেশে তারা তাদেরকে পরাজিত করল। দাঊদ আলাইহিস সালাম অত্যাচারী এই বাহিনীর নেতা তালূতকে হত্যা করলেন। এ ঘটনার পর আল্লাহ দাঊদ আলাইহিস সালামকে রাজত্ব ও বনী ইসরাঈলের জন্য নবুওয়াত দান করলেন এবং তাঁকে তিনি যেসব চাইলেন জ্ঞান দান করলেন। আল্লাহ যদি কিছু মানুষ- তারা হল আল্লাহর অনুগত ও তাঁর প্রতি ঈমানদার- দ্বারা কিছু মানুষ- তারা হল আল্লাহর অবাধ্য এবং তাঁর সঙ্গে শিরককারী- কে প্রতিরোধ না করতেন তাহলে কুফুরী শক্তির আধিপত্য, অবাধ্য ও পাপাচারীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে পৃথিবী বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ত। কিন্তু সকল মাখলূকের প্রতি দয়াবান।
﴿تِلۡكَ ءَايَٰتُ ٱللَّهِ نَتۡلُوهَا عَلَيۡكَ بِٱلۡحَقِّۚ وَإِنَّكَ لَمِنَ ٱلۡمُرۡسَلِينَ ٢٥٢﴾ [البقرة: ٢٥٢]  
“এগুলো আল্লাহর আয়াত, যা আমি তোমার ওপর যথাযথভাবে তিলাওয়াত করি। আর নিশ্চয় তুমি রাসূলগণের অন্তর্ভুক্ত।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫২]
সংক্ষিপ্ত তাফসীর: এসব হল আল্লাহর নিদর্শন ও প্রমাণাদি, যা আমি তোমাকে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠভাবে বলে দেই (হে নবী)। আর নিশ্চয় তুমি সত্য রাসূল।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আত-তাফসীর আল-মুইয়াসসার (দ্বিতীয় পারা)

বই সম্পর্কে

লেখক :

جماعة من العلماء

প্রকাশক :

www.islamhouse.com

বিভাগ :

About Quran & Hadith