আল্লাহর রাসূলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা, এখানে লেখক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ তুলে ধরেছেন। একটি আদর্শ ও সুন্দর সমাজ গঠন করতে হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের কোনো বিকল্প নেই। কেননা তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক, নানা, মুরব্বী, মুনীব ও আদর্শ স্বামী। অত্র গ্রন্থে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ তুলে ধরা হয়েছে।

اسم الكتاب: لكم في رسول الله أسوة حسنة


تأليف: ذاكر الله أبو الخير


الناشر: المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة


نبذة مختصرة: كتاب باللغة البنغالية، يبين فيه المؤلف الأسوة الحسنة لرسول الله - صلى الله عليه وسلم -، وأنه خير الناس في أهله، ومن خير الناس معلمًا، وأحسن الناس سلوكًا.


আল্লাহর রাসূলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ
[ بنغالي – Bengali – বাংলা ]
        

জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের


সম্পাদনা: ড. মুহাম্মাদ মানজুরে ইলাহী
لكم في رسول الله أسوة حسنة

    
ذاكر الله أبو الخير





مراجعة: د/ محمد منظور إلهي

 

সূচীপত্র

ক্র    শিরোনাম    পৃষ্ঠা
১    ভূমিকা    ৩
২    আদর্শ সংস্কারক হিসেবে আল্লাহর রাসূল    ৭
৩    আদর্শ শিক্ষক হিসেবে আল্লাহর রাসূল    ১২
৪    সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করা    ১৬
৫    শিক্ষককে অবশ্যই নম্র হতে হবে    ১৯
৬    প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়গুলো কী হওয়া উচিৎ    ২৭
৭    আদর্শ পরীক্ষক হিসেবে আল্লাহর রাসূল    ৩৪
৮    আদর্শ মুনিব হিসেবে আল্লাহর রাসূল    ৩৬
৯    একজন খাদেমের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ    ৩৮
১০    আদর্শ নানা হিসেবে আল্লাহর রাসূল    ৪৬
১১    আদর্শ স্বামী হিসেবে আল্লাহর রাসূল    ৫১

 
ভূমিকা

إِنَّ الْحَمْدُ للهِ، نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُـوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا، وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلاَ مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُّضْلِلِ اللهُ فَلاَ هَادِيَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ
নিশ্চয় যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। আমরা তারই প্রশংসা করি, তার কাছে সাহায্য চাই, তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। আল্লাহর নিকট আমরা আমাদের প্রবৃত্তির অনিষ্টতা ও আমাদের মন্দ কর্মসমূহ থেকে আশ্রয় কামনা করি। আল্লাহ যাকে হিদায়াত দেন, তাকে গোমরাহ করার কেউ  নেই। আর যাকে গোমরাহ করেন তাকে হিদায়াত দেওয়ারও কেউ  নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্যিকার ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোনো শরীক  নেই। আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। সালাত ও সালাম নাযিল হোক তার ওপর, তার পরিবার-পরিজন ও তার সাহাবীদের ওপর এবং যারা কিয়ামত অবধি সঠিকভাবে তাদের অনুসরণ করেন তাদের ওপর।
একটি আদর্শ ও সুন্দর সমাজ গঠন করতে হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের কোনো বিকল্প  নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শই হলো সমাজের শান্তি, শৃঙ্খলা ও সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখার একমাত্র উপকরণ। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ বাস্তবায়িত হলে সমাজে কোনো প্রকার অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা থাকতে পারে না। আল্লাহ রাসূল ছিলেন মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একজন আদর্শ মহাপুরুষ। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক, একজন আদর্শ সেনাপতি, আদর্শ শিক্ষক ও আদর্শ অভিভাবক। মানব জীবনের সব ক্ষেত্রে তিনি মানুষের জন্য আদর্শ কায়েম করে গিয়েছেন। মানব জীবনের এমন কোনো অধ্যায় পাওয়া যাবে না, যেখান আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ ٢١﴾ [الاحزاب : ٢١]
“অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১] আল্লাহর রাসূলের আদর্শের বিবরণ লিখে শেষ করা যাবে না। আমরা এ প্রবন্ধে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শের কথা তুলে ধরব। মনে রাখতে হবে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক, আদর্শ সংস্কারক, আদর্শ মুরব্বী, আদর্শ নানা, আদর্শ স্বামী ও আদর্শ অভিভাবক। সুতরাং আমরা যারা আদর্শ শিক্ষক, সংস্কারক, মুরব্বী, অভিভাবক ও আদর্শ স্বামী তাদের অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহর রাসূলকে আদর্শের প্রাণপুরুষ হিসেবে আমরা যদি অনুকরণ করি, তবে আমরা দুনিয়ার জীবনে যেভাবে সফল হতে পারব, আখিরাতের জীবনেও আমাদের জন্য থাকবে জান্নাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট আমাদের কামনা তিনি যেন আমাদেরকে তার রাসূলের অনুসরণ করার তাওফীক দেন। আমীন।
সংকলক
জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের
 
আদর্শ সংস্কারক হিসেবে আল্লাহর রাসূল:
আল্লাহর রাসূল ছিলেন একজন মহান মুরব্বী ও সংস্কারক। তিনি মানুষকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করা এবং খারাপ কর্ম থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে ছিলেন খুবই জ্ঞানী ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। তিনি একজন মানুষকে সংশোধন করা ও তাকে কু-কর্ম থেকে ফিরিয়ে রাখতে অত্যন্ত হিকমত ও বুদ্ধিমত্তার সাক্ষ্য স্থাপন করেন। আমরা মনে করি, শুধু শাস্তি দিয়ে মানুষকে কু-কর্ম, অন্যায়-অনাচার ও পাপাচার থেকে বিরত রাখতে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হল, শুধু শাস্তি দিয়ে অন্যায়, অনাচার ও পাপাচার থেকে মানুষকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। এর জন্য মানুষের অন্তরের পাপাচারের অনুভূতি জাগ্রত করা, অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করা এবং অন্যায়ের স্বরূপ উদঘাটন করা খুবই জরুরি।
হাদীসে এসেছে, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যিনা করার অনুমতি চেয়েছিল। তিনি জবাবে এ গর্হিত কাজটি তার মা, বোন, ফুফু কিংবা খালার সাথে করা হলে সে রাজি হবে কি-না পর্যায়ক্রমে এ প্রশ্ন করলে জবাবে লোকটি রাজি হবে না বলে জানাল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটির অনুভূতিতে যেন দাগ কাটে এ জন্য বললেন: দেখ তুমি যার সাথে যিনার অনুমতি চাচ্ছ সে কারো না কারো মা, কিংবা বোন, কিংবা ফুফু অথবা খালা। এ কথা বলার পর তার অনুভূতিতে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। তার অন্তরে গুনাহের প্রতি ঘৃণা জন্মিল। এভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপযুক্ত ও সময় উপযোগী শিক্ষাদানের মাধ্যমে লোকটির অনুভূতি পরিবর্তন করে দিলেন এবং তার জন্য দো‘আ করে দিলেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল তার মুসনাদ গ্রন্থে হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করেছেন। আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
إِنَّ فَتًى شَابًّا أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، ائْذَنْ لِي بِالزِّنَا، فَأَقْبَلَ الْقَوْمُ عَلَيْهِ فَزَجَرُوهُ وَقَالُوا: مَه مَهْ فَقَالَ: ادْنُهْ، فَدَنَا مِنْهُ قَرِيبًا. قَالَ: فَجَلَسَ قَالَ: أَتُحِبُّهُ لِأُمِّكَ؟ قَالَ: لَا وَاللهِ «جَعَلَنِي اللهُ فِدَاءَكَ. قَالَ: وَلَا النَّاسُ يُحِبُّونَهُ لِأُمَّهَاتِهِمْ. قَالَ: أَفَتُحِبُّهُ لِابْنَتِكَ؟ قَالَ: لَا. وَاللهِ يَا رَسُولَ اللهِ جَعَلَنِي اللهُ فِدَاءَكَ قَالَ: وَلَا النَّاسُ يُحِبُّونَهُ لِبَنَاتِهِمْ. قَالَ: أَفَتُحِبُّهُ لِأُخْتِكَ؟ قَالَ: لَا وَاللهِ جَعَلَنِي اللهُ فِدَاءَكَ. قَالَ: وَلَا النَّاسُ يُحِبُّونَهُ لِأَخَوَاتِهِمْ. قَالَ: أَفَتُحِبُّهُ لِعَمَّتِكَ؟ قَالَ: لَا وَاللهِ جَعَلَنِي اللهُ فِدَاءَكَ. قَالَ: وَلَا النَّاسُ يُحِبُّونَهُ لِعَمَّاتِهِمْ. قَالَ: أَفَتُحِبُّهُ لِخَالَتِكَ؟ قَالَ: لَا وَاللهِ جَعَلَنِي اللهُ فِدَاءَكَ. قَالَ: وَلَا النَّاسُ يُحِبُّونَهُ لِخَالَاتِهِمْ. قَالَ: فَوَضَعَ يَدَهُ عَلَيْهِ وَقَالَ: اللهُمَّ اغْفِرْ ذَنْبَهُ وَطَهِّرْ قَلْبَهُ، وَحَصِّنْ فَرْجَهُ قَالَ : فَلَمْ يَكُنْ بَعْدُ ذَلِكَ الْفَتَى يَلْتَفِتُ إِلَى شَيْءٍ».
“একদা এক যুবক আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হয়ে আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে যিনা করার অনুমতি দিন। একথা শুনে উপস্থিত লোকজন অগ্রসর হয়ে তাকে ধমক দিল। তারা বলল: তুমি কি বলছ, থাম, থাম। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমরা তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। এরপর লোকটি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে গিয়ে বসল। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি এ গর্হিত কাজটি তোমার মার জন্য পছন্দ কর। জবাবে লোকটি বলল: না- হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর কসম! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন। জবাবে তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: অন্যান্য লোকজনও এ কাজ তাদের মায়েদের জন্য পছন্দ করে না। এরপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন। তুমি কি এ কাজ তোমার মেয়ের জন্য পছন্দ কর? জবাবে বলল- না-হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কসম, আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন। তখন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: লোকজনও এ কাজ তাদের মেয়েদের জন্য পছন্দ করে না। এরপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি এ কাজ তোমার ফুফুর জন্য পছন্দ কর? জবাবে লোকটি বলল: না, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কসম! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, লোকজনও তাদের ফুফুদের জন্য এ কাজ পছন্দ করে না। এরপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি এ কাজ তোমার খালার জন্য পছন্দ কর? জবাবে লোকটি বলল: না, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কসম! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: লোকজনও এ কাজ তাদের খালাদের জন্য পছন্দ করে না। বর্ণনাকারী বলেন: এরপর রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন হাতকে তার হাতের ওপর রাখলেন এবং দো‘আ করলেন:
«اللهُمَّ اغْفِرْ ذَنْبَهُ وَطَهِّرْ قَلْبَهُ، وَحَصِّنْ فَرْجَهُ».
“হে আল্লাহ! তুমি তার গোনাহ মাফ করে দাও। তার অন্তরকে পবিত্র করে দাও এবং তার লজ্জা স্থানকে হিফাযত কর।” বর্ণনাকারী বলেন: এরপর থেকে সেই যুবকটি কোনো দিন কোনো কিছুর দিকে তাকাত না।  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে যেভাবে কথাগুলো বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাতে তাকে শুধু গুনাহ থেকে বারণ করা হয় নি, বরং তার অন্তরে গুনাহের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করা হয়েছে। যার ফলে লোকটি আর কখনোই গুনাহের প্রতি মনোনিবেশ করে নি। লোকটিকে যদি সরাসরি নিষেধ করা হত, তাহলে হয়ত সে এ গর্হিত কর্ম থেকে ফিরে আসতে কষ্ট অনুভব করত। কিন্তু আল্লাহর রাসূল তাকে যেভাবে বুঝিয়ে দিলেন তাতে সে শুধু গুনাহ তে ফিরেই আসেনি বরং তার অন্তরে গুনাহের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়।
আদর্শ শিক্ষক হিসেবে আল্লাহর রাসূল:
শিক্ষার ক্ষেত্রে একজন শিক্ষকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অহীর জ্ঞানের ভিত্তিতে (ইসলামী শরী‘আহ মোতাবেক) শিক্ষকগণ উম্মাহর জন্য যা কল্যাণকর তা গ্রহণ করে জাতিকে তা শিক্ষা দিতে পারেন। মনগড়া শিক্ষা দ্বারা জাতি কখনোই উন্নতি লাভ করতে পারে না। মানুষের মন-মানসিকতা, আচার-স্বভাব, প্রয়োজন, চাহিদা ও পরিবেশ-পরিস্থিতি এসব কিছুতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা খুবই জরুরি। আর এ প্রয়োজন মেটানোর জন্য ইসলামী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার বিষয় বস্তু হিসেবে ইসলামী জ্ঞান ও পূর্ণাঙ্গ ইসলামী পদ্ধতি সম্পৃক্ত থাকা জরুরি। অন্যথায় জাতি আদর্শ শিক্ষা হতে বঞ্চিত হবে।
আর শিক্ষা যতই ভালো ও গুরুত্বপূর্ণ হোক তার জন্য প্রয়োজন আদর্শ শিক্ষক। শুধু অক্ষর জ্ঞান পাঠদান করা এবং ক্লাসে আলোচ্য বিষয়টিকে খুব ভালোভাবে উপস্থাপন করার নাম শিক্ষা নয়। একজন শিক্ষককে অবশ্যই আদর্শবান হতে হবে। তার মধ্যে নীতি নৈতিকতা থাকতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, তারবীয়ত ও সু-শিক্ষা লাভ করা। আদর্শ শিক্ষা কীভাবে লাভ করা যায় তার জন্য দরকার পর্যালোচনা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা। এতে উম্মাহ জীবন ও সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে পরামর্শ ভিত্তিক আলোচনা করে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারে। ইসলাম বিষয়ক আলোচনা পর্যালোচনাসহ প্রত্যেক ধরনের আলোচনায় ভীতি বর্তমানে আমাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। বিশেষতঃ শিশু সংক্রান্ত আলোচনা ও শিশু শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে এ ভীতি কাজ করে। তবে শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীর পরম বিনয়-ভাব থাকা উত্তম। ইয়েট -এর একটা প্রবাদ বাক্য উল্লেখ করা যেতে পারে- من علمني حرفا صرت عبدا له অর্থাৎ আমাকে যে একটা হরফ বা বর্ণ শিক্ষা দিলেন, আমি তার গোলামে পরিণত হলাম।
বাস্তব জীবন ও সমাজের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সঠিক চিন্তাধারা প্রয়োগ ও সুপরিচিত শিক্ষাদান পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষা দেওয়া খুবই প্রয়োজন। বর্তমানে শিক্ষা দেওয়ার গুণগত মান না থাকা এবং আদর্শ শিক্ষকের অভাবে জাতি আদর্শ শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে আছে। যখন আকীদা-বিশ্বাস, দীন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষাদান মুসলিম মনোবৃত্তি ও মানসিকতা গঠনের বিশেষ দিক বলে বিবেচিত, তখন দীনি শিক্ষা দানের সময় একে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা জরুরি। তাই শিশুকে শিক্ষা দান, শিশুর মনে সুস্থ আবেগ ও অনুভূতি সৃষ্টির চেষ্টা করে এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হবে। আমরা আমাদের ছেলেদের শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করতে ভুল করে থাকি। অনেক জটিল বিষয়গুলোকে তাদের সামনে তুলে ধরা হয়ে থাকে। যার ফলে জরুরি বিষয়গুলো না শিখে তারা সঠিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। একজন বাচ্চা যখনই শিক্ষা উপযোগী বয়সে উপনীত হয় তাকে অবশ্যই তার আক্বিদা-বিশ্বাস বিষয়ক বিষয়গুলো সব কিছুর আগে শিক্ষা দিতে হবে। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, আল্লাহর পরিচয়, ইসলামের পরিচয় এবং মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে তাদের সঠিক ধারণা দিতে হবে।
সন্তান হচ্ছে পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য ও শোভা সহজাত মায়া মমতার বশবর্তী হয়ে পিতা-মাতা সন্তানদের লালন পালন করে থাকে। শত দুঃখ সহ্য করেও তাদেরকে প্রয়োজনীয় পোশাক পরিচ্ছদ ও সুষম খাদ্য প্রদান করে থাকে এবং সুশিক্ষায় গড়ে তোলার নিমিত্তে জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়ে থাকে।
সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করা:
মাতা-পিতার বড় দায়িত্ব হল সন্তানকে সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। সন্তানকে সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে না পারলে, তা যে কত যন্ত্রণা দায়ক তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হল, ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করা। ইসলাম সম্মত উপায়ে জীবন যাপন করা সন্তানের সু-শিক্ষার প্রকৃষ্ট পন্থা। রুযী রোজগারের জন্য সন্তান-সন্ততিদেরকে পার্থিব শিক্ষার সাথে সাথে শরীয়তের ইলম শিক্ষা দান করতে হবে যেন, তারা তাদের স্বভাব চরিত্র শরিয়তের বিধি বিধান মোতাবেক গড়ে তুলতে পারে। এটা মাতা-পিতার অবশ্য কর্তব্য।
এ সম্পর্কে লুকমান হাকীম রহ. এর স্বীয় সন্তানের প্রতি উপদেশ আমাদের জন্য আদর্শ। কুরআনে এর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তিনি প্রথমে তার ছেলেকে তাওহীদ সম্পর্কে শিক্ষা দেন। তারপর তিনি তার ছেলেকে আল্লাহর সাথে কাউকে শিরক করতে না করেন। তার আলোচনা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে এভাবে বর্ণনা করেন:
প্রথমে তিনি তাওহীদ সম্পর্কে বলেছেন,
﴿وَإِذۡ قَالَ لُقۡمَٰنُ لِٱبۡنِهِۦ وَهُوَ يَعِظُهُۥ يَٰبُنَيَّ لَا تُشۡرِكۡ بِٱللَّهِۖ إِنَّ ٱلشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِيمٞ ١٣﴾ [لقمان: ١٣]  
“আর স্মরণ কর, যখন লুকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল, ‘প্রিয় বৎস, আল্লাহর সাথে শির্ক করো না। নিশ্চয় শির্ক হলো বড় যুলুম”। [সূরা লুকমান, আয়াত: ১৩]
দ্বিতীয়ত: তিনি পাপ কাজ হতে বিরত থাকা সম্বন্ধে বলেছেন,
﴿يَٰبُنَيَّ إِنَّهَآ إِن تَكُ مِثۡقَالَ حَبَّةٖ مِّنۡ خَرۡدَلٖ فَتَكُن فِي صَخۡرَةٍ أَوۡ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ أَوۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ يَأۡتِ بِهَا ٱللَّهُۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٞ ١٦﴾ [لقمان: ١٦]
“হে আমার প্রিয় বৎস, নিশ্চয় তা (পাপ-পুণ্য) যদি সরিষা দানার পরিমাণ হয়, অতঃপর তা থাকে পাথরের মধ্যে কিংবা আসমানসমূহে বা জমিনের মধ্যে, আল্লাহ তাও নিয়ে আসবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সুক্ষ্মদর্শী, সর্বজ্ঞ’। [সূরা লুকমান, আয়াত: ১৩]
তৃতীয়ত: সত্য ধর্মের মূলনীতি ও সার শিক্ষা সম্বন্ধে তিনি বলেছেন,
﴿يَٰبُنَيَّ أَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ وَأۡمُرۡ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَٱنۡهَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَٱصۡبِرۡ عَلَىٰ مَآ أَصَابَكَۖ إِنَّ ذَٰلِكَ مِنۡ عَزۡمِ ٱلۡأُمُورِ ١٧ وَلَا تُصَعِّرۡ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمۡشِ فِي ٱلۡأَرۡضِ مَرَحًاۖ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخۡتَالٖ فَخُورٖ ١٨﴾ [لقمان: ١٧، ١٨]
“হে আমার প্রিয় বৎস, সালাত কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, অন্যায় থেকে নিষেধ কর এবং তোমার ওপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধর। নিশ্চয় এগুলো অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ’। ‘আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর যমিনে দম্ভভরে চলাফেরা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো দাম্ভিক, অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না”। [সূরা লুকমান, আয়াত: ১৭-১৮]
শিক্ষককে অবশ্যই নম্র হতে হবে:
যিনি শিক্ষা দেবেন তাকে অবশ্যই কোমল ব্যবহারের অধিকারী হতে হবে, তাকে অবশ্যই আদর্শবান হতে হবে। তার আচার ব্যবহার অবশ্যই মনোমুগ্ধকর হতে হবে। অন্যথায় শিক্ষকের প্রতি ছাত্রদের আস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে। তখন শিক্ষকের কাছ থেকে সে কোনো কিছুই শিখতে চাইবে না। নম্র ও ভদ্র ব্যবহার দিয়ে যতটুক মন জয় করা যায় কটু ব্যবহার ও শাস্তি দিয়ে তত টুকু পারা যায় না। নম্র ব্যবহারে মানুষের মনের ওপর কর্তৃত্ব করা সহজ হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَبِمَا رَحۡمَةٖ مِّنَ ٱللَّهِ لِنتَ لَهُمۡۖ وَلَوۡ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ ٱلۡقَلۡبِ لَٱنفَضُّواْ مِنۡ حَوۡلِكَۖ فَٱعۡفُ عَنۡهُمۡ وَٱسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ وَشَاوِرۡهُمۡ فِي ٱلۡأَمۡرِۖ فَإِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُتَوَكِّلِينَ ١٥٩﴾ [ال عمران: ١٥٩]
“অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের কারণে তুমি তাদের জন্য নম্র হয়েছিলে। আর যদি তুমি কঠোর স্বভাবের, কঠিন হৃদয়সম্পন্ন হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং তাদেরকে ক্ষমা কর এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। আর কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর যখন সংকল্প করবে তখন আল্লাহর ওপর তাওয়াককুল করবে। নিশ্চয় আল্লাহ তাওয়াক্কুল কারীদেরকে ভালবাসেন”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯]
ফিরআউনের মতো এত বড় যালিমকে দাওয়াত দেওয়ার উদ্দেশ্যে মুসা ও হারুন আলাইহিস সালাম প্রেরণ করার পেক্ষাপটে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তার সাথে তোমরা নরম কথা বল।
﴿فَقُولَا لَهُۥ قَوۡلٗا لَّيِّنٗا لَّعَلَّهُۥ يَتَذَكَّرُ أَوۡ يَخۡشَىٰ ٤٤﴾ [طه: ٤٤]
“তোমরা তার সাথে নরম কথা বলবে। হয়তোবা সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে”। [সূরা ত্ব-হা, আয়াত: ৪৪]
আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সর্বোত্তম শিক্ষক হিসেবে যথেষ্ট। তিনি এমনভাবে শিক্ষা দিতেন, যাতে মানুষের অন্তরে তার প্রতি ক্ষোভ বা আতঙ্ক থাকতো না। শিক্ষকের প্রতি ভালোবাসা ও মহব্বত বৃদ্ধি পেত। তিনি শুধু মাত্র প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোই শিক্ষা দিতেন। অত্যন্ত নম্রতা ও ভদ্রতার সাথে শিক্ষা দিতেন। ছাত্রের সাথে কোনো প্রকার দুর্ব্যবহার করতেন না। তাদেরকে প্রহার করতেন না, গালি দিতেন না এবং ধমক দিতেন না। যেমন, হাদীসে এসেছে: মুয়াবিয়া ইবন হাকাম আস সুলামি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«بَيْنَا نَحْنُ نُصَلِّي مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذْ عَطَسَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ، فَقُلْتُ: يَرْحَمُكَ اللهُ، فَرَمَانِي الْقَوْمُ بِأَبْصَارِهِمْ، فَقُلْتُ: وَاثُكْلَ أُمِّيَاهْ مَا شَأْنُكُمْ تَنْظُرُونَ إِلَيَّ قَالَ: فَجَعَلُوا يَضْرِبُونَ بِأَيْدِيهِمْ عَلَى أَفْخَاذِهِمْ، فَلَمَّا رَأَيْتُهُمْ يُصْمِتُونِي، لَكِنِّي سَكَتُّ، فَلَمَّا صَلَّى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَبِأَبِي هُوَ وَأُمِّي مَا رَأَيْتُ مُعَلِّمًا قَبْلَهُ وَلَا بَعْدَهُ أَحْسَنَ تَعْلِيمًا مِنْهُ، وَاللهِ مَا كَهَرَنِي وَلَا شَتَمَنِي وَلَا ضَرَبَنِي قَالَ: إِنَّ هَذِهِ الصَّلَاةَ لَا يَصْلُحُ فِيهَا شَيْءٌ مِنْ كَلَامِ النَّاسِ هَذَا، إِنَّمَا هِيَ التَّسْبِيحُ وَالتَّكْبِيرُ وَقِرَاءَةُ الْقُرْآنِ أَوْ كَمَا قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّا قَوْمٌ حَدِيثُ عَهْدٍ بِالْجَاهِلِيَّةِ، وَقَدْ جَاءَ اللهُ بِالْإِسْلَامِ، وَإِنَّ مِنَّا قَوْمًا يَأْتُونَ الْكُهَّانَ قَالَ: فَلَا تَأْتُوهُمْ قُلْتُ: إِنَّ مِنَّا قَوْمًا يَتَطَيَّرُونَ قَالَ: ذَاكَ شَيْءٌ يَجِدُونَهُ فِي صُدُورِهِمْ، فَلَا يَصُدَّنَّهُمْ قُلْتُ: إِنَّ مَنَّا قَوْمًا يَخُطُّونَ قَالَ: كَانَ نَبِيٌّ يَخُطُّ، فَمَنْ وَافَقَ خَطَّهُ فَذَلِكَ».
“একদা আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সালাত আদায় করতে ছিলাম, এক ব্যক্তি সালাতে হাঁচি দিয়ে আল হামদু লিল্লাহ বললে, আমি বললাম, আল্লাহ তোমার প্রতি দয়া করুন। আমার কথা শোনে লোকেরা আমার দিক বাঁকা চোখে তাকাচ্ছিল, তাদের অবস্থা দেখে আমি তাদের বললাম, তোমাদের কি হল, তোমরা আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছ? আমার কথা শোনে তারা তাদের হাত দিয়ে রানের ওপর থাপড়াচ্ছিল যাতে আমি চুপ থাকি। আমি যখন বুঝতে পারলাম, তারা আমাকে চুপ করাচ্ছে, তখন আমি চুপ হয়ে গেলাম। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাত শেষ করলেন, তার ওপর আমার মাতা-পিতা কুরবান হোক, ইতোপূর্বে ও পরবর্তীতে আমি তার থেকে উত্তম শিক্ষক যিনি তার চেয়ে উত্তম শিক্ষা দিতে পারে আর কখনো দেখিনি। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তিনি আমাকে ধমক দেননি, গালি দেননি এবং কোনো ধরনের প্রহার করেন নি। তিনি আমাকে বললেন, সালাতে কথা বলা গ্রহণ যোগ্য নয়। সালাত হল, তাসবীহ, তাকবীর ও কুরআনের তিলাওয়াত। তারপর আমি বললাম, আমরা কিছু আগেও জাহেলিয়্যাতের অন্ধকারে নিমজ্জিত, নতুন ইসলাম গ্রহণ করেছি, আমাদের মধ্যে কিছু লোক এমন আছে যারা যাদুকরের কাছে যাতায়াত করে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তাদের কাছে যাতায়াত করো না। আমাদের মধ্যে কিছু লোক এমন আছে, যারা পাখি উড়িয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করে, তিনি বললেন, এটি মানুষের মনের কু-সংস্কার, এ ধরনের কোনো বিষয় যেন তোমাদেরকে তোমাদের কর্ম হতে বিরত না রাখে। তারপর সে বলল, আমাদের মধ্যে কতক লোক এমন আছে যারা রেখা টানে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, পূর্বের একজন নবী ছিল যিনি রেখা টানত, যা তার জন্য বৈধ ছিল, তোমাদের জন্য তা বৈধ নয়।  
হাদীসটিতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে যেভাবে শিক্ষা দিলেন, তা জাতির জন্য কিয়ামত অবধি আদর্শ হয়ে থাকবে। একজন আদর্শ শিক্ষকের কাজ হল, তিনি তার ছাত্রদের এমনভাবে শিক্ষা দেবেন, যাতে ছাত্রের অন্তরে শিক্ষকের মহব্বত, ভালোবাসা ও আস্থা বৃদ্ধি পায়। শিক্ষককে অবশ্যই তার ছাত্রের কল্যাণকামী ও হিতাকাংখী হতে হবে, ছাত্রের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে, যাতে ছাত্র তার অজানা বিষয়গুলো শিক্ষকের কাছ থেকে জেনে নিতে পারে। হাদীসে বর্ণিত, ঘটনাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বাভাবিক আচরণে উদ্বুদ্ধ হয়ে, লোকটির মনে জানার আগ্রহ বেড়ে যায় এবং তিনি তার সম্প্রদায়ের লোকদের বিভিন্ন কু-সংস্কার সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে সমাধান জানতে চান।
অপর একটি হাদীস: আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«دَخَلَ أَعْرَابِيٌّ الْمَسْجِدَ، فَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ، ثُمَّ قَالَ: اللَّهُمَّ ارْحَمْنِي وَمُحَمَّدًا، وَلَا تَرْحَمْ مَعَنَا أَحَدًا. فَالْتَفَتَ إِلَيْهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: «لَقَدْ تَحَجَّرْتَ وَاسِعًا، ثُمَّ لَمْ يَلْبَثْ أَنْ بَالَ فِي الْمَسْجِدِ، فَأَسْرَعَ النَّاسُ إِلَيْهِ، فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّمَا [ص:198] بُعِثْتُمْ مُيَسِّرِينَ، وَلَمْ تُبْعَثُوا مُعَسِّرِينَ، أَهْرِيقُوا عَلَيْهِ دَلْوًا مِنْ مَاءٍ، أَوْ سَجْلًا مِنْ مَاءٍ»
“একজন গ্রাম্য লোক মসজিদে এসে দু’ রাকাত সালাত আদায় করার পর বলে, হে আল্লাহ তুমি আমাকে এবং মুহাম্মদকে রহম কর এবং আমাদের সাথে আর কাউকে তুমি দয়া করো না। তার কথা শোনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি আল্লাহর ব্যাপক রহমতকে সংকীর্ণ করে দিলে। তারপর লোকটি একটু পরেই মসজিদে পেশাব করে দিল। পেশাব করতে দেখে লোকেরা তার দিকে ছুটে আসতে আরম্ভ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের সহজকারী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, তিনি তোমাদের কঠোরতাকারী হিসেবে প্রেরণ করেননি। লোকটির পেশাবের উপর এক বালতি বা এক মশক পানি ঢেলে দাও”।
উল্লিখিত হাদীসে দেখা যাচ্ছে যে এক লোক মসজিদে পেশাব করে দিল, অথচ আল্লাহর রাসূল তাকে সুন্দরভাবে তালিম দিলেন। তাকে তিনি কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না। যারা তাকে বাধা দিতে চাইলেন, তাদের তিনি থামিয়ে দিলেন। আর লোকটি বাধাহীন পেশাব করে গেলেন। তারপর অন্যদের নির্দেশ দিলেন, যাতে তারা পেশাবকে ধুয়ে ফেলে। এভাবেই আল্লাহর রাসূল মানব জাতির জন্য আদর্শ ছিলেন। অথচ বর্তমানে আমরা ছোট বাচ্চারা যদি মসজিদে এসে দুষ্টামী করে তাদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দেই। মসজিদে কারও মোবাইল বেজে উঠলে তার প্রতি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠি এবং তার উপর চড়াও হই। মনে রাখবে এগুলো কোনোটিই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ হল তিনি যা বলেছেন,
«إِنَّمَا بُعِثْتُمْ مُيَسِّرِينَ، وَلَمْ تُبْعَثُوا مُعَسِّرِينَ»
“আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের সহজকারী হিসেবে প্রেরণ করেন, কঠোরতাকারী হিসেবে প্রেরণ করেননি”।  
প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়গুলো কী হওয়া উচিৎ:
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবীদের প্রথমে ঈমান শিক্ষা দিতেন তারপর অন্যান্য বিষয় গুলো শিক্ষা দিতেন। ঈমানের পর দ্বীনের জরুরি বিষয়গুলো শিক্ষা দেওয়া খুবই জরুরি। একজন মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে যে সব কর্মগুলো থাকা জরুরি সেগুলো সমাধান করতে চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। তাই আল্লারহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেগুলোই তার সাহাবীদের বাতলিয়ে দিতেন। যেমন, হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট একজন ব্যক্তি এসে আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি তাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো শিখিয়ে দেন।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,  
«أَنَّ أَعْرَابِيًّا جَاءَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، دُلَّنِي عَلَى عَمَلٍ إِذَا عَمِلْتُهُ دَخَلْتُ الْجَنَّةَ، قَالَ: تَعْبُدُ اللهَ لَا تُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا، وَتُقِيمُ الصَّلَاةَ الْمَكْتُوبَةَ، وَتُؤَدِّي الزَّكَاةَ الْمَفْرُوضَةَ، وَتَصُومُ رَمَضَانَ، قَالَ: وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَا أَزِيدُ عَلَى هَذَا شَيْئًا أَبَدًا، وَلَا أَنْقُصُ مِنْهُ، فَلَمَّا وَلَّى، قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى رَجُلٍ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ، فَلْيَنْظُرْ إِلَى هَذَا».
“একজন গ্রাম্য লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে এমন আমল শিক্ষা দেন, যার ওপর আমল করলে আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না। সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, রমজান মাসের সাওম রাখবে। লোকটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা শুনে বলল, আল্লাহর কসম করে বলছি, আমি কখনোই এর ওপর কোনো কিছুকে বাড়াবো না এবং কোনো কিছু কমাবো না। এ কথা বলে লোকটি যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেছনে রেখে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে বললেন, যার ইচ্ছা হয় জান্নাতী কোনো লোককে দেখতে, সে যেন এ লোকটির দিকে তাকায়”।  
অপর একটি বর্ণনায় এসেছে-
সাহাবীদের মধ্যে জানার খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা অধিক প্রশ্ন করতে নিষেধ করলে, সাহাবীগণ ভয়ে জরুরি বিষয়গুলো জিজ্ঞাসা করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তবে তারা চাচ্ছিলেন বাহির থেকে একজন লোক এমন আসবেন, যিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দীনের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করবেন। ঠিক এমন এক মুহুর্তে একজন লোক এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে।
আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كُنَّا قَدْ نُهِينَا أَنْ نَسْأَلَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ شَيْءٍ، فَكَانَ يُعْجِبُنَا أَنْ يَجِيءَ الرَّجُلُ مِنْ أَهْلِ الْبَادِيَةِ الْعَاقِلُ، فَيَسْأَلُهُ وَنَحْنُ نَسْمَعُ، فَجَاءَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْبَادِيَةِ، فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ، أَتَانَا رَسُولُكَ فَزَعَمَ لَنَا أَنَّكَ تَزْعُمُ أَنَّ اللهَ أَرْسَلَكَ. قَالَ: صَدَقَ "، قَالَ: فَمَنْ خَلَقَ السَّمَاءَ؟ قَالَ: اللهُ "، قَالَ: فَمَنْ خَلَقَ الْأَرْضَ؟ قَالَ: اللهُ "، قَالَ: فَمَنْ نَصَبَ هَذِهِ الْجِبَالَ، وَجَعَلَ فِيهَا مَا جَعَلَ؟ قَالَ: اللهُ. قَالَ: فَبِالَّذِي خَلَقَ السَّمَاءَ وَخَلَقَ الْأَرْضَ، وَنَصَبَ هَذِهِ الْجِبَالَ آللَّهُ أَرْسَلَكَ؟ قَالَ: نَعَمْ. قَالَ: فَزَعَمَ رَسُولُكَ أَنَّ عَلَيْنَا خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِي يَوْمِنَا وَلَيْلَتِنَا، قَالَ: صَدَقَ. قَالَ: فَبِالَّذِي أَرْسَلَكَ، آللَّهُ أَمَرَكَ بِهَذَا؟ قَالَ: نَعَمْ قَالَ: وَزَعَمَ رَسُولُكَ أَنَّ عَلَيْنَا زَكَاةً فِي أَمْوَالِنَا، قَالَ: صَدَقَ. قَالَ: فَبِالَّذِي أَرْسَلَكَ، آللَّهُ أَمَرَكَ بِهَذَا؟ قَالَ: نَعَمْ. قَالَ: وَزَعَمَ رَسُولُكَ أَنَّ عَلَيْنَا صَوْمَ شَهْرِ فِي سَنَتِنَا، قَالَ: صَدَقَ . قَالَ: فَبِالَّذِي أَرْسَلَكَ، آللَّهُ أَمَرَكَ بِهَذَا؟ قَالَ: نَعَمْ. قَالَ: وَزَعَمَ رَسُولُكَ أَنَّ عَلَيْنَا حَجَّ الْبَيْتِ مَنْ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا، قَالَ: صَدَقَ. قَالَ: ثُمَّ وَلَّى، فَقَالَ: وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَا أَزِيدُ عَلَيْهِنَّ شَيْئًا، وَلَا أَنْقُصُ مِنْهُنَّ شَيْئًا، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَئِنْ صَدَقَ لَيَدْخُلَنَّ الْجَنَّةَ».
“এক সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করতে আমাদের নিষেধ করা হয়। ফলে আমরা কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করতামনা। আমরা চাইতাম গ্রাম থেকে কোনো বুদ্ধিমান লোক এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করত আর আমরা শুনতাম। এ সময় গ্রাম থেকে এক লোক এসে বলল, হে মুহাম্মাদ! আমাদের নিকট আপনার দূত এসে বলল, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল, আপনাকে আল্লাহ প্রেরণ করেছেন? তিনি বললেন, সত্য বলেছে’ লোকটি বলল, কে আসমান সৃষ্টি করেছে? তিনি বললেন, “আল্লাহ”, সে বলল, কে যমিন সৃষ্টি করেছে? তিনি বললেন, “আল্লাহ”। সে বলল, কে পাহাড়সমূহ স্থাপন করেছেন, তিনি বললেন, “আল্লাহ”। সে বলল, যিনি আসমান সৃষ্টি করেছেন, যমিন সৃষ্টি করেছেন এবং পাহাড় স্থাপন করেছেন তার শপথ করে বলছি, আল্লাহ কি আপনাকে প্রেরণ করেছেন? তিনি বললেন, “হ্যাঁ”। লোকটি বলল, আপনার দূত এ কথার দাওয়াত দেন যে, আমাদের ওপর রাত ও দিনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা ফরয। তিনি বললেন, ঠিক বলেছেন। লোকটি বলল, যিনি আপনাকে প্রেরণ করেছেন, তার শপথ, আল্লাহ কি এ বিষয়ে আদেশ দিয়েছেন? তিনি বললেন, “হ্যাঁ”। লোকটি বলল, আপনার দূত বলল, আমাদের ওপর আমাদের সম্পদের যাকাত ফরয করা হয়েছে। তিনি বললেন, সত্য বলছে। লোকটি বলল, যিনি আপনাকে প্রেরণ করেছেন, তার শপথ, আল্লাহ কি এ বিষয়ে আদেশ দিয়েছেন? তিনি বললেন, “হ্যাঁ”। সে বলল, আপনার দূত এ কথার দাওয়াত দেন যে, আমাদের ওপর বছরে এক মাস রোজা রাখা ফরয। তিনি বললেন, ঠিক বলেছেন। লোকটি বলল, যিনি আপনাকে প্রেরণ করেছেন, তার শপথ, আল্লাহ কি এ বিষয়ে আদেশ দিয়েছেন? তিনি বললেন, “হ্যাঁ”। সে বলল, আপনার দূত এ কথার দাওয়াত দেন যে, আমাদের মধ্যে যার সামর্থ্য আছে তার ওপর বাইতুল্লাহর হজ করা ফরয, তিনি বললেন, ঠিক বলেছেন। তারপর লোকটি চলে যাওয়ার সময় বলল, যিনি আপনাকে সত্য বাণী দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তার শপথ করে বলছি, আমি এর ওপর কোনো কিছু বাড়াবো না এবং কমাবোও না। তার কথা শুনে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি লোকটি সত্য বলে, অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে”।  
হাদীসে দ্বারা প্রমাণিত হয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে মানুষের মধ্যে জরুরি বিষয়গুলো শেখা এবং শেখানোর গুরুত্বই বেশি ছিল। আল্লাহর রাসূল তার দূতদের বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করতেন, তারা যাতে মানুষকে ঈমানের বিষয়গুলোর প্রতি আহ্বান করেন এবং ঈমান ও দীনের জরুরি বিষয়গুলো শিক্ষা দেন। আল্লাহ রাসূল কখনো জটিল বিষয়গুলোর পিছনে সময় নষ্ট করতেন না। বর্তমানে আমরা জরুরি বিষয়গুলো শেখার পরিবর্তে মানতিক, ইলমে কালাম ইত্যাদিতে সময় নষ্ট করে থাকি। ফলে দীনের জরুরি বিষয়গুলো আমাদের অজানা থেকে যায়। এ জন্য আমাদের শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং সিলেবাসকে সাজিয়ে বাচ্চাদের সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় আমরা মুসলিম জাতি হিসেবে ইসলামী জ্ঞান থেকে অনেক পিছিয়ে যাব।
আদর্শ পরীক্ষক হিসেবে আল্লাহর রাসূল:
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় সাহাবীদের পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের ঈমানের পরীক্ষা সবার আগে নিতেন। তারা যদি ঈমানদার হত, তাদের ঈমানের কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে কিনা তা দেখতেন। যদি তাদের ঈমানে কোনো প্রকার ত্রুটি বিচ্যুতি থাকতো প্রথমেই তিনি তা দূর করতেন।
মুয়াবিয়া ইবন হাকাম আস-সুলামী বলেন,
«وَكَانَتْ لِي جَارِيَةٌ تَرْعَى غَنَمًا لِي فِي قِبَلِ أُحُدٍ وَالْجَوَّانِيَّةِ، فَاطَّلَعْتُهَا ذَاتَ يَوْمٍ، فَإِذَا الذِّئْبُ قَدْ ذَهَبَ بِشَاةٍ مِنْغَنَمِهَا، وَأَنَا رَجُلٌ مِنْ بَنِي آدَمَ آسَفُ كَمَا يَأْسَفُونَ، لَكِنِّي صَكَكْتُهَا صَكَّةً، فَأَتَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَعَظَّمَ ذَلِكَ عَلَيَّ، قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَفَلَا أُعْتِقُهَا؟ قَالَ: ائْتِنِي بِهَا فَأَتَيْتُهُ بِهَا فَقَالَ لَهَا: أَيْنَ اللهُ؟ فَقَالَتْ: فِي السَّمَاءِ، قَالَ: مَنْ أَنَا؟ قَالَتْ: أَنْتَ رَسُولُ اللهِ، قَالَ: أَعْتِقْهَا، فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ وَقَالَ مَرَّةً: هِيَ مُؤْمِنَةٌ، فَأَعْتِقْهَا».
“আমার একটি বাদী ছিল সে ওহুদ ও জাওয়ানিয়ার দিকে ছাগল চরাতও। একদিন তার খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি যে, তার ছাগল থেকে একটি ছাগল নেকড়ে বাঘ নিয়ে গেছে। আমি যেহেতু আদম সন্তান তারা যেভাবে কষ্ট পায় আমিও সেভাবে কষ্ট পেলাম। ফলে আমি তাকে খুব জোরে প্রহার করলাম, বিষয়টি আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হলে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি তাকে আযাদ করে দেব? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তাকে আমার কাছে নিয়ে আস। লোকটি বলল, আমি তাকে তার কাছে নিয়ে আসলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহ কোথায়? তিনি বললেন, আল্লাহ আকাশে, তারপর বললেন, আমি কে? তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর রাসূল, তখন তিনি বললেন, তুমি তাকে আযাদ করে দাও কারণ সে মুমিন”।  
আদর্শ মুনিব হিসেবে আল্লাহর রাসূল:
মনে রাখবেন, ঘরের খাদেম, গোলাম, চাকর বাকরের সাথে ভালো ব্যবহার করা খুবই জরুরি। তারাও আমাদের মতই রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। তাদের সাথে দূব্যর্বহার করা কোনো যোগ্যতা বা বাহাদূরী নয়। বরং তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করাই হল যোগ্যতা ও বাহাদুরি। ইসলাম এ ব্যাপারে খুবই সতর্ক অবস্থান তুলে ধরেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে উম্মতকে বিশেষ দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।
আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,
«مَنْ ضَرَبَ عَبْدًا لَهُ حَدًّا لَمْ يَأْتِهِ أَوْ ظَلَمَهُ أَوْ لَطَمَهُ شَكَّ عَبْدُ الرَّحْمَنِ - فَإِنَّ كَفَّارَتَهُ أَنْ يُعْتِقَهُ».
“যে ব্যক্তি কোনো গোলামকে বিনা অপরাধে প্রহার করে অথবা তারা ওপর যুলুম করে, তার কাফ্ফারা হলো, তাকে আযাদ করে দেওয়া”।  
সুতরাং কোনো মানুষের ওপর অন্যায় করা ও যুলুম অত্যাচার করা হতে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের আদর্শ অবশ্যই অনুকরনীয়। তিনি যে আদর্শ মানবজাতির জন্য স্থাপন করেছেন, দুনিয়ার কোনো জাতি বা সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে এমন আদর্শ পাওয়া যাবে না।
একজন খাদেমের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আচরণ:
একজন লোক দশ বছর পর্যন্ত একটি লোকের খেদমত করার পর, তার স্বীকারোক্তি সম্পর্কে আমরা একটি চিন্তা করলে বুঝতে পারি। তিনি কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ মহা মানব। যার আচার আচরণের প্রতি তার সাথী-সঙ্গীরা এতই মুগ্ধ ছিল যে, ইতিহাসে এর দ্বিতীয় কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদেম আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
«خَدَمْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَشْرَ سِنِينَ فَمَا قَالَ لِي أُفٍّ قَطُّ، وَمَا قَالَ لِشَيْءٍ صَنَعْتُهُ لِمَ صَنَعْتَهُ، وَلَا لِشَيْءٍ تَرَكْتُهُ لِمَ تَرَكْتَهُ»
“আমি দশ বছর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমত করি, তিনি কখনো আমাকে বিন্দু পরিমাণও কষ্ট দেন নি। আমি যখনই কোনো কাজ করেছি, তাতে তিনি কখনো এ কথা বলেননি তুমি এ কাজটি কেন করছ? আর যদি এমনটি হত যে, আমি কোনো কাজ করিনি, তাতে তিনি বলেননি তুমি এ কাজটি কেন করনি?”।  
আল্লাহর রাসূল কোনো মানুষকে কষ্ট দেওয়া থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতেন। এমনকি নিজের কোনো খাদেম, নিজের কোনো গোলামকেও এমন কথা বলেন নি, যাতে সে কষ্ট পায়। যেমন, হাদীসে এসেছে: আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ، وَالْمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ مَا نَهَى الله عَنْهُ».
“প্রকৃত মুসলিম সেই যার হাত ও মুখের আক্রমণ থেকে অপর মুসলিম ভাই নিরাপদে থাকে। আর সত্যিকার মুহাজির হলো, যে আল্লাহর নিষিদ্ধ কর্ম থেকে বিরত থাকে”।  
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে কোনো দিন প্রহার করেন নি এবং কাউকে কোনো দিন গালি দেন নি। একমাত্র তিনি যখন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতেন তখন কাফের মুশরিকদের ওপর আক্রমণ করতেন। যেমন, হাদীসে এসেছে: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«مَا ضَرَبَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَادِمًا لَهُ قَطُّ، وَلَا امْرَأَةً لَهُ قَطُّ، وَلَا ضَرَبَ بِيَدِهِ، إِلَّا أَنْ يُجَاهِدَ فِي سَبِيلِ اللهِ، وَمَا نِيلَ مِنْهُ شَيْءٌ فَانْتَقَمَهُ مِنْ صَاحِبِهِ، إِلَّا أَنْ تُنْتَهَكَ مَحَارِمُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، فَيَنْتَقِمُ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَمَا عُرِضَ عَلَيْهِ أَمْرَانِ أَحَدُهُمَا أَيْسَرُ مِنَ الْآخَرِ، إِلَّا أَخَذَ بِأَيْسَرِهِمَا، إِلَّا أَنْ يَكُونَ مَأْثَمًا، فَإِنْ كَانَ مَأْثَمًا كَانَ أَبْعَدَ النَّاسِ مِنْهُ».
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো তার খাদেম ও স্ত্রীকে নিজ হাতে প্রহার করেন নি। আল্লাহর রাস্তার জিহাদের ময়দান ছাড়া তিনি কাউকে আক্রমণ করেন নি। তিনি কখনো তার কোনো সাথী থেকে কখনো প্রতিশোধ নেনটি। তবে যদি কেউ আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়ে লিপ্ত হয়, তার থেকে আল্লাহর জন্য শাস্তি প্রয়োগ করতেন। যখন তার নিকট দু’টি বিষয়কে প্রস্তাব করা হত, তখন যেটি সহজ তাতে যদি কোনো গুনাহ না থাকে সেটি গ্রহণ করতেন। যদি গুনাহ হয় তা হতে তিনি অনেক দূরে থাকতেন”।
অপর একটি হাদীসে এসেছে: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«وَاللَّهِ مَا خُيِّرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَيْنَ أَمْرَيْنِ قَطُّ، إِلَّا أَخَذَ أَيْسَرَهُمَا، مَا لَمْ يَأْثَمْ، فَإِذَا كَانَ الْإِثْمُ كَانَ أَبْعَدَهُمْ مِنْهُ، وَاللَّهِ مَا انْتَقَمَ لِنَفْسِهِ فِي شَيْءٍ يُؤْتَى إِلَيْهِ قَطُّ، حَتَّى تُنْتَهَكَ حُرُمَاتُ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، فَيَنْتَقِمَ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ»
“আল্লাহর শপথ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দু’টি বিষয়ের যে কোনো একটি গ্রহণ করার জন্য ক্ষমতা দেওয়া হলে, তিনি সহজটিই গ্রহণ করতেন, যদি তাতে কোনো গুনাহ না হয়। আর যদি তাতে গুনাহ হতো, তিনি তা থেকে দূরে থাকতেন। আল্লাহর শপথ তিনি কখনো কোনো বিষয়ে নিজের জন্য কারও থেকে প্রতিশোধ নেন নি, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের বিরোধিতা না করা হত। যদি আল্লাহর নিষিদ্ধসমূহের অবাধ্য হত, তাহলে আল্লাহর জন্য তার থেকে প্রতিশোধ নেওয়া হত”।  
তিনি কারও হতে কোনো দিন প্রতিশোধ নেন নি, এমনকি কেউ প্রতিশোধ নিতে চাইলে তাকেও অনুমতি দেন নি। যেমন, হাদীসে এসেছে: মিকদাদ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ أَرَأَيْتَ رَجُلًا ضَرَبَنِي بِالسَّيْفِ، فَقَطَعَ يَدِي، ثُمَّ لَاذَ مِنِّي بِشَجَرَةٍ، ثُمَّ قَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، أَقْتُلُهُ؟ قَالَ: لَا فَعُدْتُ مَرَّتَيْنِ أَوْ ثَلَاثًا فَقَالَ: لَا إِلَّا أَنْ تَكُونَ مِثْلَهُ قَبْلَ أَنْ يَقُولَ مَا قَالَ، وَيَكُونَ مِثْلَكَ قَبْلَ أَنْ تَفْعَلَ مَا فَعَلْتَ».
“আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমি কারো সাথে লড়ি তারপর সে তরবারি দিয়ে আমার হাত কেটে দেয় এবং আমার পাল্টা আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সে একটি গাছের নিকট আশ্রয় নিয়ে বলে, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে ইসলাম গ্রহণ করলাম। তার এ কথা বলার পর আমি কি তাকে হত্যা করতে পারব? তিনি বললেন, না, তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না। আমি কথাটি একাধিক বার জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তরে তিনি বার বার না বললেন। আমি বললাম, সে তো আমার একটি হাত কেটে ফেলছে। কাটার পর সে এ কথা বলছে, তারপরও আমি তাকে হত্যা করতে পারব না? তিনি বললেন, না, তুমি তাকে হত্যা করো না। যদি তুমি তাকে হত্যা কর, তাহলে মনে রাখবে, সে তোমার সেই মর্যাদা পেয়ে যাবে, যাতে তুমি তাকে হত্যা করার পূর্বে ছিলে। আর তুমি তার ঐ কথা বলার পূর্বের অবস্থায় উপনীত হবে”।  
কাউকে যদি বাধ্য হয়ে শাস্তি দিতে হয় বা প্রহার করতে হয়, এ ক্ষেত্রেও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ কতই না উত্তম। কাউকে চেহারায় আঘাত করা যাবে না। যেমন, হাদীসে এসেছে: আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ، وَشَقَّ الْجُيُوبَ، وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ»
“যে চেহারা উপর আঘাত করে, জামা ছিড়ে এবং জাহেলিয়্যাতের যুগের মত চিল্লা-পাল্লা করে সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়”।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,  
إِذَا ضَرَبَ أَحَدُكُمْ، فَلْيَجْتَنِبِ الْوَجْهَ، فَإِنَّ اللهَ خَلَقَ آدَمَ عَلَى صُورَتِهِ».
“যখন কোনো ব্যক্তি কাউকে প্রহার করে, সে যেন চেহারার ওপর আঘাত না করে। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা আদম আলাইহিস সালামকে স্বীয় আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন”।  
আদর্শ নানা হিসেবে আল্লাহর রাসূল:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন আদর্শ নানা। তিনি তার ছোট নাতি ও নাতনিদের খুব আদর করতেন। বিশেষ করে হাসান ও হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু উভয়কে তিনি খুব আদর করতেন। তিনি তাদের চুমো দিতেন। পিঠে বহন করে তাদের সাথে খেলাধুলা করতেন এবং তাদের ঘুরাতেন।
আবু বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
«كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْطُبُنَا، فَجَاءَ الْحَسَنُ، وَالْحُسَيْنُ عَلَيْهِمَا قَمِيصَانِ أَحْمَرَانِ يَمْشِيَانِ وَيَعْثُرَانِ، فَنَزَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنَ الْمِنْبَرِ، فَحَمَلَهُمَا فَوَضَعَهُمَا بَيْنَ يَدَيْهِ، ثُمَّ قَالَ: صَدَقَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ: {إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ} [التغابن: 15] نَظَرْتُ إِلَى هَذَيْنِ الصَّبِيَّيْنِ يَمْشِيَانِ وَيَعْثُرَانِ، فَلَمْ أَصْبِرْ حَتَّى قَطَعْتُ حَدِيثِي وَرَفَعْتُهُمَا».
“একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের খুতবা দিতেছিলেন, এ সময় হাসান ও হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু দু’টি লাল জামা পরিহিত অবস্থায় পায়ে হেটে খুড়ে খুড়ে সামনের দিকে আসছিল, তাদের দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার থেকে নেমে পড়লেন এবং তাদের উভয়কে দুই হাতে তুলে নিয়ে বললেন, “আল্লাহ তা‘আলা সত্যিই বলেছেন, إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ নিশ্চয় তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সন্তান ফিতনা। আমি বাচ্চা দুটিকে দেখলাম তারা খুড়ে খুড়ে হাঁটছিল। তাদের দেখে আমি স্থির থাকতে পারলাম না, কথার মাঝখান দিয়ে কথা বন্ধ করে তাদের উঠিয়ে নিলাম”।  
অপর একটি হাদীসে বর্ণিত, আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«بَيْنَا نَحْنُ فِي الْمَسْجِدِ جُلُوسٌ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَحْمِلُ أُمَامَةَ بِنْتَ أَبِي الْعَاصِ بْنِ الرَّبِيعِ، وَأُمُّهَا زَيْنَبُ بِنْتُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَهِيَ صَبِيَّةٌ فَحَمَلَهَا عَلَى عَاتِقِهِ، فَصَلَّى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهِيَ عَلَى عَاتِقِهِ يَضَعُهَا إِذَا رَكَعَ، وَيُعِيدُهَا عَلَى عَاتِقِهِ إِذَا قَامَ فَصَلَّى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهِيَ عَلَى عَاتِقِهِ ثُمَّ قَامَ حَتَّى قَضَى صَلَاتَهُ يَفْعَلُ ذَلِكَ بِهَا»
“একবার আমরা মসজিদে বসা ছিলাম। এমতাবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমামাহ বিনতে আবিল আস ইবনুর রবি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে কোলে নিয়ে আমাদের নিকট উপস্থিত হন। তার মা হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেয়ে যয়নব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় নাতনী ছোট মেয়েটিকে নিজের কাঁধে নিয়ে সালাতে দাঁড়ালেন, তিনি যখন রুকু করতেন তাকে যমিনে রাখতেন, তারপর যখন দাঁড়াতেন, তখন তাকে আবার কাঁধে তুলে নিতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কাঁদে নিয়েই সালাত আদায় করলেন এবং সালাত শেষ করলেন”।
আব্দুল্লাহ ইব্ন সাদ্দাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
«خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي إِحْدَى صَلَاتَيِ الْعَشِيِّ، الظُّهْرِ - أَوِ الْعَصْرِ - وَهُوَ حَامِلٌ الْحَسَنَ - أَوِ الْحُسَيْنَ - فَتَقَدَّمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَوَضَعَهُ، ثُمَّ كَبَّرَ لِلصَّلَاةِ، فَصَلَّى، فَسَجَدَ بَيْنَ ظَهْرَانَيْ صَلَاتِهِ، سَجْدَةً أَطَالَهَا فَقَالَ: إِنِّي رَفَعْتُ رَأْسِي، فَإِذَا الصَّبِيُّ عَلَى ظَهْرِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَهُوَ سَاجِدٌ، فَرَجَعْتُ فِي سُجُودِي، فَلَمَّا قَضَى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصَّلَاةَ، قَالَ النَّاسُ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّكَ سَجَدْتَ بَيْنَ ظَهْرَانَيْ صَلَاتِكَ، هَذِهِ سَجْدَةً قَدْ أَطَلْتَهَا، فَظَنَنَّا أَنَّهُ قَدْ حَدَثَ أَمْرٌ، أَوْ أَنَّهُ يُوحَى إِلَيْكَ، قَالَ: فَكُلُّ ذَلِكَ لَمْ يَكُنْ وَلَكِنَّ ابْنِي ارْتَحَلَنِي، فَكَرِهْتُ أَنْ أُعَجِّلَهُ حَتَّى يَقْضِيَ حَاجَتَهُ».
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো এক সালাতে আমাদের মধ্যে হাসান হুসাইনকে বহন করে উপস্থিত হলেন। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে সামনে অগ্রসর হলেন এবং সালাতের তাকবীর বলে সালাত আরম্ভ করেন। তিনি তার সালাতে দীর্ঘ লম্বা সাজদাহ করেন। তিনি বলেন, আমি মাথা উঁচু করে দেখি বাচ্চাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিঠে উঠে বসে আছে আর তিনি সাজদারত অবস্থায় পড়ে আছেন। তারপর আমি আবার সাজদায় ফিরে গেলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাত আদায় করা শেষ করলেন, লোকেরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাদের সামনে স্বীয় সালাতের সাজদাহ আদায় করলেন এবং দীর্ঘ লম্বা সাজদাহ করলেন। আমরা ধারণা করছিলাম সালাতে কোনো অঘটন ঘটেছিল অথবা আপনার নিকট অহী আসছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এর কোনোটিই ঘটে নি। কিন্তু আমার নাতি আমাকে বাহন বানিয়েছিল আমি তার চাহিদা না মেটানো পর্যন্ত সাজদাহ থেকে উঠে তাড়াহুড়া করাকে অপছন্দ করি।  
আদর্শ স্বামী হিসেবে আল্লাহর রাসূল:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন আদর্শ স্বামী। তার একাধিক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন তার স্ত্রীদের নিকট খুব প্রিয়। তিনি তার স্ত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার করতেন, খেলা-ধুলা করতেন, তাদের চাহিদাগুলো পূরণ করতেন, তারা কোনো কিছু চাইলে তাতে কোনো কার্পণ্য করতেন না। তাদের অধিকার সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাদের সাথে কাজ কর্মে সহযোগিতা করতেন। প্রতিদিন তাদের খোঁজ খবর নিতেন। হাদীসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِي، وَإِذَا مَاتَ صَاحِبُكُمْ فَدَعُوهُ».
“তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম ব্যক্তি যে তোমাদের পরিবারের নিকট উত্তম। আমি আমার পরিবারের নিকট তোমাদের মধ্যে সর্ব উত্তম। যখন তোমাদের সাথী মারা যায় তাকে তোমরা রেখে দাও”।  
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বয়সে কম থাকার কারণে অনেক সময় তিনি খেলা-ধুলায় মগ্ন হয়ে যেতেন। তাই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে খেল-তামাশার মধ্যেই অনেক সময় ছেড়ে দিতেন। তাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য যা যা করা দরকার আল্লাহর রাসূল তাই করতেন। যেমন, হাদীসে এসেছে: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«وَاللهِ لَقَدْ رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُومُ عَلَى بَابِ حُجْرَتِي، وَالْحَبَشَةُ يَلْعَبُونَ بِالْحِرَابِ، وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْتُرُنِي بِرِدَائِهِ لِأَنْظُرَ إِلَى لَعِبِهِمْ مِنْ بَيْنِ أُذُنِهِ وَعَاتِقِهِ، ثُمَّ يَقُومُ مِنْ أَجْلِي، حَتَّى أَكُونَ أَنَا الَّتِي أَنْصَرِفُ، فَاقْدُرُوا قَدْرَ الْجَارِيَةِ الْحَدِيثَةِ السِّنِّ، الْحَرِيصَةِ عَلَى اللهْوِ»
“হাবশী লোকেরা যখন ডাল সুরকী দিয়ে খেলা করতেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন এবং তিনি তার স্বীয় চাদর দ্বারা আমাকে ডেকে রাখতেন, যাতে আমি তার মাথা ও গর্দানের মাঝে মাথা রেখে তাদের খেলা দেখতে পারি। তিনি আমার জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত নিজ ইচ্ছায় মাথা সরিয়ে নিতাম। অতএব তোমরা কম বয়সী একজন খেলা-ধুলার প্রতি আকৃষ্ট নারীর মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য কর”।  
অপর একটি হাদীসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كُنْتُ أَلْعَبُ بِاللُّعَبِ، فَيَأْتِينِي صَوَاحِبِي، فَإِذَا دَخَلَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَرَرْنَ مِنْهُ، فَيَأْخُذُهُنَّ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَيَرُدُّهُنَّ إِلَيَّ
“আমি খেলার সামগ্রী নিয়ে খেলতে থাকতাম, তখন আমার সঙ্গিনীরা আমার সাথে খেলার জন্য আমার কাছে আসত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ঘরে প্রবেশ করত, তারা পলায়ন করত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ধরে নিয়ে আসত এবং আমার সাথে খেলার জন্য তাদেরকে আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দিত”।

একটি আদর্শ ও সুন্দর সমাজ গঠন করতে হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের কোনো বিকল্প  নেই। কেননা তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক, নানা, মুরব্বী, মুনীব ও আদর্শ স্বামী। অত্র গ্রন্থে লেখক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ তুলে ধরেছেন।

 

 

 

 

 

আল্লাহর রাসূলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ

বই সম্পর্কে

লেখক :

ذاكر الله أبو الخير

প্রকাশক :

www.islamhouse.com

বিভাগ :

Muhammad (PBUH)