ইখলাস

এ বইতে ইসলামে ইখলাস ও এর গুরুত্ব, মর্যাদা, স্তর ও ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও আল্লাহর সৎ বান্দাহদের ইখলাস ও ইসলাস সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাসয়ালা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। পরিশেষে ইখলাস অর্জনের উপায়সমূহ উল্লেখ করা হয়েছে।

اسم الكتاب: الإخلاص


تأليف: عبد الله المأمون
نبذة مختصرة: كتاب باللغة البنغالية اشتمل على الكلام عن الإخلاص وأهميته ومنزلته ودرجته وثمرته في الإسلام. كما جاء فيه بعض القصص والأقوال عن إخلاص الصالحين والأمور التي يجب التنبيه عنها في مسألة الإخلاص، وأخيرا جاء فيه كيفية تحقيق الإخلاص.

ইখলাস


[ বাংলা – Bengali – بنغالي ]
আব্দুল্লাহ আল মামুন আল-আযহারী


সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

2014 - 1436
 
 
﴿ الإخلاص﴾
« باللغة البنغالية »


عبد الله المأمون الأزهري
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا


2014 - 1436
 
 
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على سيدنا محمد، وعلى آل وصحبه وسلم. وبعد:
দীন ইসলামের অন্যতম মৌলিক নীতি হলো, সব কাজে ইখলাস বাস্তবায়ন করা এবং ইখলাসের বিপরীত যা কিছু আছে যেমন: লৌকিকতা, সুনাম সুখ্যাতির প্রত্যাশা, অহমিকা ইত্যাদি বর্জন করা।
আল্লাহ জনৈক আলেমের উপর রহমত নাযিল করুন যিনি বলেছেন: “আমি  মনে করি, যেসব ফকিহ মানুষকে মাকাসিদুশ শরি‘আহ তথা শরি‘আতের বিধিবিধানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য শিক্ষা দিয়ে থাকেন, তারা যদি ইখলাস ব্যতীত মানুষকে এগুলো শিক্ষা দিয়ে থাকেন তবে তাদের সেসব কাজ বিফলে যাবে, কোনো সাওয়াব হবে না”।
অন্তরের কাজের গুরুত্ব:
আহলে সুন্নত ওয়াল জামা‘আতের মতে ঈমান হলো: মৌখিক স্বীকৃতি, আন্তরিক বিশ্বাস ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আমল করা। বান্দাহর আমলের কারণে ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং গুনাহের কারণে ঈমানের ঘাটতি দেখা দেয়।
ঈমানের পরিচিতির মধ্যে বান্দাহর অন্তরের কাজসমূহের অন্যতম মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ইখলাস। বরং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজের চেয়ে অন্তরের কাজ নিশ্চিত ও গুরুত্বপূর্ণ। অন্তরের কাজের দ্বারাই বান্দাহর ঈমান ও কুফুরীর মাঝে পার্থক্য করা হয়। আল্লাহকে সিজদাকারী আর মূর্তিকে সিজদাকারী উভয়েই একই কাজ সম্পাদন করেছে, কিন্তু অন্তরের নিয়্যাতের ভিন্নতার কারণে একজন ঈমানদান আরেকজন কাফির।
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. অন্তরের আমলের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, “এটা ঈমানের মৌলিক উসুল ও দীনের অন্যতম মূলনীতি। যেমন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসা, আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল, একমাত্র আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠা, তাঁর শুকরিয়া আদায়, তাঁর ফয়সালায় ধৈর্য ধারণ করা, তাঁকে ভয় করা, তাঁর কাছে আশাবাদী হওয়া ও এরূপ অন্যান্য বিষয়সমূহ।
সম্মানিত আলেমগণের ঐক্যমতে উপরোক্ত কাজসমূহ সব সৃষ্টির উপর ফরয। মানুষ এতে তিন শ্রেণির। তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি যুলুমকারী এবং কেউ কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী। আবার তাদের কেউ কেউ কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী।
নিজের প্রতি যুলুমকারী হলো আল্লাহর আদেশ অমান্যকারী বা নিষিদ্ধকাজে লিপ্তকারী।
আর মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী হলো আল্লাহর ফরয আদেশমান্যকারী ও হারাম বর্জনকারী।
অন্যদিকে কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী দল হলো বান্দাহর উপর ফরযকৃত কাজসমূহ পালনের সাথে সাথে মুস্তাহাব কাজসমূহও পালন করা এবং হারাম কাজ বর্জনের সাথে সাথে মাকরূহ কাজসমূহও বর্জন করা। যদিও মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী ও কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী ব্যক্তি কখনও কখনও গুনাহের কাজে লিপ্ত হয় তবে তা তাওবা দ্বারা মাফ হয়ে যায়, কেননা আল্লাহ তাওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীকে পছন্দ করেন, আবার কখনও ভালো কাজের দ্বারা মাফ হয়ে যায়। আবার কখনও বিপদাপদ বা অন্য কারণে ক্ষমা করে দেওয়া হয়।
ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, অন্তরের কাজ হলো মূল আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজ হলো অনুসারী ও পূর্ণতাদানকারী। নিয়্যাত হলো মানুষের রূহস্বরূপ আর আমল হলো শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ন্যায়। তাই যে ব্যক্তির রূহ চলে যাবে সে মারা যাবে। অতএব, অন্তরের কাজসমূহের আহকাম জানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের আহকাম জানার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। 
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, অন্তরের নিয়্যাত ব্যতীত প্রকাশ্যকাজ গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা অন্তর হলো রাজা, আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হলো সেনাদল। রাজা খারাপ হলে সৈন্যদলও খারাপ হয়ে যায়। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
عَنْ عَامِرٍ، قَالَ: سَمِعْتُ النُّعْمَانَ بْنَ بَشِيرٍ، يَقُولُ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: " أَلاَ وَإِنَّ فِي الجَسَدِ مُضْغَةً: إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الجَسَدُ كُلُّهُ، أَلاَ وَهِيَ القَلْبُ "
নু‘মান ইবন বশীর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে “জেনে রাখ, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরা আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখ, সে গোশতের টুকরোটি হল কলব”।
ইখলাসের পরিচিতি:
ইখলাসের শাব্দিক অর্থ হল অন্য জিনিসের সংমিশ্রণের থেকে মুক্ত হয়ে নির্মল, পরিচ্ছন্ন ও আলাদা হওয়া, খালি করা, পরিস্কার করা। যেমন বলা হয়,
هذا الشيء خالص لك: أي لا يشاركك فيه غيرك والخالص من الألوان عندهم ما صفا ونصع. ويقولون خالصة في العشرة: صافاه
“এ জিনিসটি খালেসভাবে তোমার। অর্থাৎ এতে কারো অংশীদার নেই। খালেস রং বলতে বুঝায়, যা নির্মল ও পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। যেমন আরো বলা হয়, এটি খালেসভাবে দশজনের, অর্থাৎ শুধু দশজনের জন্যই বিশেষিত।  
যেমন কুরআনে এসেছে,
﴿وَلَا يُشۡرِكۡ بِعِبَادَةِ رَبِّهِۦٓ أَحَدَۢا ١١٠ ﴾ [الكهف: ١١٠] 
“এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে”। [সূরা: আল-কাহফ: ১১০]
‘ইয্‌য ইবন আব্দুস সালাম রহ. বলেন, ইখলাস হচ্ছে, বান্দাহ কর্তৃক একমাত্র আল্লাহর জন্যই আনুগত্য করা, এতে মানুষের থেকে কোনো সম্মান ও মর্যাদা প্রত্যাশা না করা, দীনি কোনো ফায়েদা কামনা বা দুনিয়াবী কোন ক্ষতি থেকে রক্ষার কোনো আশা না করা।  
সাহল ইবন আব্দুল্লাহ রহ. বলেন, বান্দাহর স্থিরতা, নড়াচড়া সব কিছুই একমাত্র মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে করার নাম হলো ইখলাস।
কেউ কেউ বলেন, অন্তরকে একমাত্র আল্লাহর জন্য খালি করাকে ইখলাস বলে। অর্থাৎ তিনি ব্যতীত অন্য কারো জন্য কোনো ব্যস্ততা না রাখা। আর এটা সর্বোচ্চ দরজার ইখলাস। 
আবার কেউ কেউ বলেন, ইখলাস হলো সৃষ্টজগতের কারো পর্যবেক্ষণ ও সমালোচনার ভয় না করে একমাত্র আল্লাহর জন্য আমল করা।
হারওয়ী রহ. বলেন, ইখলাস হচ্ছে, (শির্ক, বিদ‘আত ইত্যাদির) সংমিশ্রণ থেকে মুক্ত থেকে পরিচ্ছন্ন আমল করা।
কেউ কেউ বলেন, মুখলিস হলো যিনি তার অন্তরের সঠিকতা ও সততার জন্য আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনে মানুষের সম্মান বা অসম্মানের কোনো পরোয়া করেন না। তার আমলের সামান্য পরিমাণও মানুষের কাছে প্রকাশ করেন না।
আবু আব্দুল্লাহ তুসতারী রহ. কে জিজ্ঞেস করা হলো, “কোন জিনিসটি নফসের সবচেয়ে বেশি কঠিন? তিনি বললেন, ইখলাস; কেননা এতে নফসের কোনো অংশ নেই”।
সুফইয়ান সাওরী রহ. বলেন, “আমার নিয়্যাতের চেয়ে কোন কিছুতে বেশি প্রচেষ্টা চালাই নি। এটা খুব দ্রুত পরিবর্তনশীল”।  
মোটকথা হলো, ইবাদত বন্দেগী, যাবতীয় সৎকর্ম সম্পাদন ও অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি সব কিছুই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করার নাম ইখলাস।
ইসলামে ইখলাসের স্থান:
ইখলাস হলো দীনের মূলভিত্তি। এটা সব রাসূলের দাওয়াতের বিষয়বস্তু ছিল। আল্লাহ বলেন,
﴿ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلۡقَيِّمَةِ ٥ ﴾ [البينة: ٥] 
“আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয়; আর এটিই হল সঠিক দীন”। [সূরা  আল্-বায়্যিনা: ৫]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿ قُلۡ إِنِّيٓ أُمِرۡتُ أَنۡ أَعۡبُدَ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ ٱلدِّينَ ١١ وَأُمِرۡتُ لِأَنۡ أَكُونَ أَوَّلَ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ١٢ ﴾ [الزمر: ١١،  ١٢] 
“বল, ‘নিশ্চয় আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমি যেন আল্লাহর ইবাদাত করি তাঁর-ই জন্য আনুগত্যকে একনিষ্ঠ করে’। আমাকে আরো নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন আমি প্রথম মুসলিম হই”। [সূরা: আয্-যুমার: ১১-১২]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿أَلَا لِلَّهِ ٱلدِّينُ ٱلۡخَالِصُۚ وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَ مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ إِنَّ ٱللَّهَ يَحۡكُمُ بَيۡنَهُمۡ فِي مَا هُمۡ فِيهِ يَخۡتَلِفُونَۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي مَنۡ هُوَ كَٰذِبٞ كَفَّارٞ ٣ ﴾ [الزمر: ٣] 
“জেনে রেখ, আল্লাহর জন্যই বিশুদ্ধ ইবাদাত-আনুগত্য। আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা কেবল এজন্যই তাদের ‘ইবাদাত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে।’ যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছে আল্লাহ নিশ্চয় সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী কাফির, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না”। [সূরা  আয্-যুমার: ৩]
আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
﴿ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلۡمَوۡتَ وَٱلۡحَيَوٰةَ لِيَبۡلُوَكُمۡ أَيُّكُمۡ أَحۡسَنُ عَمَلٗاۚ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡغَفُورُ ٢ ﴾ [الملك: ٢] 
“যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম। আর তিনি মহাপরাক্রমশালী, অতিশয় ক্ষমাশীল”। [সূরা  আল্-মুলক: ২]
মুখলিসদের প্রশংসায় আল্লাহ বলেছেন,
﴿ وَٱذۡكُرۡ فِي ٱلۡكِتَٰبِ مُوسَىٰٓۚ إِنَّهُۥ كَانَ مُخۡلَصٗا وَكَانَ رَسُولٗا نَّبِيّٗا ٥١ ﴾ [مريم: ٥١] 
“আর স্মরণ কর এই কিতাবে মূসাকে। অবশ্যই সে ছিল মনোনীত এবং সে ছিল রাসূল, নবী”। [সূরা  মারইয়াম: ৫১]
ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,
﴿ وَلَقَدۡ هَمَّتۡ بِهِۦۖ وَهَمَّ بِهَا لَوۡلَآ أَن رَّءَا بُرۡهَٰنَ رَبِّهِۦۚ كَذَٰلِكَ لِنَصۡرِفَ عَنۡهُ ٱلسُّوٓءَ وَٱلۡفَحۡشَآءَۚ إِنَّهُۥ مِنۡ عِبَادِنَا ٱلۡمُخۡلَصِينَ ٢٤ ﴾ [يوسف: ٢٤] 
“আর সে মহিলা তার প্রতি আসক্ত হল, আর সেও তার প্রতি আসক্ত হত, যদি না তার রবের স্পষ্ট প্রমাণ প্রত্যক্ষ করত। এভাবেই, যাতে আমি তার থেকে অনিষ্ট ও অশ্লীলতা দূর করে দেই। নিশ্চয় সে আমার খালেস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত”। [সূরা: ইউসুফ: ২৪]
এমনিভাবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,
﴿ قُلۡ أَتُحَآجُّونَنَا فِي ٱللَّهِ وَهُوَ رَبُّنَا وَرَبُّكُمۡ وَلَنَآ أَعۡمَٰلُنَا وَلَكُمۡ أَعۡمَٰلُكُمۡ وَنَحۡنُ لَهُۥ مُخۡلِصُونَ ١٣٩ ﴾ [البقرة: ١٣٩] 
“বল, ‘তোমরা কি আমাদের সাথে আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক করছ অথচ তিনি আমাদের রব ও তোমাদের রব? আর আমাদের জন্য রয়েছে আমাদের আমলসমূহ এবং তোমাদের জন্য রয়েছে তোমাদের আমলসমূহ এবং আমরা তাঁর জন্যই একনিষ্ঠ”। [সূরা  আল-বাকারা: ১৩৯]
তাছাড়া ইখলাস ছাড়া কোনো আমলই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। হাদীসে এসেছে,
حَدَّثَنِي ابْنُ كَعْبِ بْنِ مَالِكٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «مَنْ طَلَبَ العِلْمَ لِيُجَارِيَ بِهِ العُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللَّهُ النَّارَ»
কা‘ব ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “যে ব্যক্তি এই উদ্দেশ্যে ইলম তালাশ করে যে, সে তা দিয়ে আলিমদের সঙ্গে বিতর্ক করবে বা অজ্ঞ-মুর্খদের সামনে বিদ্যা ফলাবে এবং নিজের দিকে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে দাখিল করবেন”।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَتَعَلَّمُهُ إِلَّا لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا، لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ» يَعْنِي رِيحَهَا
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ইলমকে দুনিয়া লাভের আশায় অর্জন করলো, সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না”।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " قَالَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ، مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيهِ مَعِي غَيْرِي، تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ "
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “বরকতময় মহান আল্লাহ বলেন, আমি শরীকদের শির্ক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যে ব্যক্তি এমন কোনো কাজ করে যাতে আমার সাথে অন্যকে শরীক করে আমি তাকে ও তার শির্ককে প্রত্যাখ্যান করি”।
ফুদাইল ইবন ‘ইয়াদ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, তোমার আমল একমাত্র আল্লাহর জন্য এবং সহীহভাবে করো। তাঁকে বলা হলো, হে আবু আলী, "أخلصه وأصوبه". এর অর্থ কি? তিনি বলেন, কোনো আমল যদি একমাত্র আল্লাহর জন্য করা হয় কিন্তু তা যদি সহীহভাবে না করা হয় তবে তা কবুল করা হবে না। আবার কাজটি যদি সঠিকভাবে করা হয় তবে তাতে যদি ইখলাস না থাকে তবে তাও কবুল করা হবে না। আমলটি একমাত্র আল্লাহর জন্য ও সহীহভাবে করতে হবে। খালিস হলো আল্লাহর জন্য হওয়া আর সাওয়াব মানে সুন্নত অনুযায়ী সম্পাদন করা।
আল্লাহ বলেছেন,   
﴿إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ ٱللَّهُ مِنَ ٱلۡمُتَّقِينَ ٢٧ ﴾ [المائ‍دة: ٢٧]
“আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের থেকে গ্রহণ করেন”। [আল-মায়েদা: ২৭] 
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, এ আয়াতে মানুষ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। দু’দল বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়িতে আছে আর অন্য দল মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী। খারেজীরা মনে করেন, কবিরা গুনাহ থেকে বিরত না থাকলে তাদের থেকে আল্লাহ কোনো আমল কবুল করবেন না। তাদের মতে কবিরা গুনাহকারীর কাছ থেকে কোনো ভালো আমল কখনও কবুল করা হয় না।
অন্যদিকে মুরজিয়া সম্প্রদায় মনে করেন, যারা শির্ক থেকে বেঁচে থাকে তাদের থেকে সৎ আমল কবুল করা হয়।
আর সালাফে সালেহীন ও আলেমগণ মনে করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে এবং আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় একমাত্র তাঁর জন্যই কাজটি করে তার থেকেই উক্ত কাজটি কবুল করা হয়।
স্বল্প আমল সত্ত্বেও ইখলাসের কারণে তার সাওয়াব অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়:
এ ব্যাপারে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে:
عَنْ أَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ المَعَافِرِيِّ ثُمَّ الحُبُلِيِّ، قَالَ: سَمِعْتُ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرِو بْنِ العَاصِ، يَقُولُ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " إِنَّ اللَّهَ سَيُخَلِّصُ رَجُلًا مِنْ أُمَّتِي عَلَى رُءُوسِ الخَلَائِقِ يَوْمَ القِيَامَةِ فَيَنْشُرُ عَلَيْهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ سِجِلًّا كُلُّ سِجِلٍّ مِثْلُ مَدِّ البَصَرِ، ثُمَّ يَقُولُ: أَتُنْكِرُ مِنْ هَذَا شَيْئًا؟ أَظَلَمَكَ كَتَبَتِي الحَافِظُونَ؟ فَيَقُولُ: لَا يَا رَبِّ، فَيَقُولُ: أَفَلَكَ عُذْرٌ؟ فَيَقُولُ: لَا يَا رَبِّ، فَيَقُولُ: بَلَى إِنَّ لَكَ عِنْدَنَا حَسَنَةً، فَإِنَّهُ لَا ظُلْمَ عَلَيْكَ اليَوْمَ، فَتَخْرُجُ بِطَاقَةٌ فِيهَا: أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، فَيَقُولُ: احْضُرْ وَزْنَكَ، فَيَقُولُ: يَا رَبِّ مَا هَذِهِ البِطَاقَةُ مَعَ هَذِهِ السِّجِلَّاتِ، فَقَالَ: إِنَّكَ لَا تُظْلَمُ "، قَالَ: «فَتُوضَعُ السِّجِلَّاتُ فِي كَفَّةٍ وَالبِطَاقَةُ فِي كَفَّةٍ، فَطَاشَتِ السِّجِلَّاتُ وَثَقُلَتِ البِطَاقَةُ، فَلَا يَثْقُلُ مَعَ اسْمِ اللَّهِ شَيْءٌ»
আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন: “আমি রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের এক ব্যক্তিকে সমস্ত সৃষ্টির সন্মুখে আলাদা করে এনে হাযির করবেন। তার সামনে নিরানব্বইটি (আমলের) নিবন্ধন খাতা খুলে দিবেন। এক একটি নিবন্ধন খাতা হবে যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এরপর তিনি তাকে বললেন, এর একটি কিছুও কি অস্বীকার করতে পার? আমার সংরক্ষণকারী লিপিকারগণ (কিরামান কাতিবীন) কি তোমার উপর কোন জুলুম করেছে? লোকটি বলবে: না, হে আমার পরওয়ারদিগার। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তোমার কিছু বলার আছে কি? লোকটি বলবে: না, হে পরওয়ারদিগার। তিনি বলবেন: হ্যাঁ, আমার কাছে তোমার একটি নেকী আছে। আজ তো তোমার উপর কোন জুলুম হবে না। তখন একটি ছোট্ট কাগজের টুকরা বের করা হবে। এতে আছে আশহাদু আনলা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়ারাসূলুহু- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, কোনো ইলাহ নেই। আল্লাহ ছাড়া আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: চল, এর ওযনের সম্মুখে হাযির হও। লোকটি বলবে: ওহে আমার রব, এই একটি ছোট্ট টুকরা আর এতগুলো নিবন্ধন খাতা। কোথায় কি? তিনি বলবেন: তোমার উপর অবশ্যই কোনো জুলুম করা হবে না। অনন্তর সবগুলো নিবন্ধন খাতা এক পাল্লায় রাখা হবে আর ছোট্ট সেই টুকরাটিকে আরেক পাল্লায় রাখা হবে। (আল্লাহর  কি মহিমা) সবগুলো দপ্তর (ওযনে) হালকা হয়ে যাবে আর ছোট্ট টুকরাটিই হয়ে পড়বে ভারী। আল্লাহর নামের মুকাবেলায় কোন জিনিসই ভারী হবে না”।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «بَيْنَمَا كَلْبٌ يُطِيفُ بِرَكِيَّةٍ، كَادَ يَقْتُلُهُ العَطَشُ، إِذْ رَأَتْهُ بَغِيٌّ مِنْ بَغَايَا بَنِي إِسْرَائِيلَ، فَنَزَعَتْ مُوقَهَا فَسَقَتْهُ فَغُفِرَ لَهَا بِهِ»
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন যে, “একদা একটি কুকুর এক কূপের চারদিকে ঘুরছিল এবং প্রবল পিপাসার কারণে সে মৃত্যুর নিকটে পৌছেছিল। তখন বনী ইসরাঈলের ব্যাভিচারিণীদের একজন কুকুরটির অবস্থা লক্ষ্য করল এবং তার পায়ের মোজার সাহায্যে পানি সংগ্রহ করে কুকুরটিকে পান করাল। এ কাজের প্রতিদানে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দিলেন”।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «بَيْنَمَا رَجُلٌ يَمْشِي بِطَرِيقٍ وَجَدَ غُصْنَ شَوْكٍ عَلَى الطَّرِيقِ فَأَخَّرَهُ، فَشَكَرَ اللَّهُ لَهُ فَغَفَرَ لَهُ»
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে চলার সময় কাঁটাদার গাছের একটি ডাল রাস্তায় পেল, তখন সেটাকে রাস্তা থেকে অপসারণ করল, আল্লাহ তার এ কাজকে কবূল করলেন এবং তাকে মাফ করে দিলেন”।
عَنْ عَمَّارِ بْنِ يَاسِرٍ، سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: " إِنَّ الْعَبْدَ لَيَنْصَرِفُ مِنْ صَلَاتِهِ , وَمَا كُتِبَ لَهُ مِنْهَا إِلَّا عُشْرُهَا أَوْ تُسْعُهَا أَوْ ثُمْنُهَا أَوْ سُبْعُهَا أَوْ سُدْسُهَا أَوْ خُمْسُهَا أَوْ رُبْعُهَا أَوْ ثُلُثُهَا أَوْ نِصْفُهَا "
আম্মার ইবন ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “বান্দাহ তার সালাত শেষ করে তখন তার আমলনামায় এক দশমাংশ বা এক নবমাংশ বা এক অষ্টাংশ বা এক সপ্তাংশ বা এক ষষ্ঠাংশ বা এক পঞ্চমাংশ বা এক চতুর্থাংশ বা এক তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক সাওয়াব লেখা হয়”।
আবার ইখলাসের অভাবে অনেক বড় কাজও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: " إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَيْهِ رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: قَاتَلْتُ فِيكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لِأَنْ يُقَالَ: جَرِيءٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ، وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ، وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ: عَالِمٌ، وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ: هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ، وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ كُلِّهِ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلَّا أَنْفَقْتُ فِيهَا لَكَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ: هُوَ جَوَادٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ، ثُمَّ أُلْقِيَ فِي النَّارِ "
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম এমন এক ব্যক্তির ব্যাপারে ফয়সালা হবে যে শহীদ হয়েছিল। তাকে আনা হবে এবং তাকে যে সব নিয়ামত দেওয়া হয়েছিল তাও তার সামনে পেশ করা হবে। সে তা চিনতে পারবে। আল্লাহ তা‘আলা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, আমি যে সব নিয়ামত তোমাকে দিয়েছিলাম তার বিনিময়ে তুমি কি কাজ করেছ? সে বলবে, আমি তোমার পথে জিহাদ করে শহীদ হয়েছি। তিনি বলবেন: তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি তো এ জন্য জিহাদ করেছ যে, লোকেরা তোমাকে বীর-বাহাদুর বলবে। আর দুনিয়াতে তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। অতঃপর আরেক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, সে ইলম অর্জন করেছে, তা লোকদেরকে শিক্ষা দিয়েছে এবং কুরআন পাঠ করেছে। তাকে উপস্থিত করা হবে এবং তাকে দেওয়া নিয়ামতের কথা তার সামনে তুলে ধরা হবে, সে তা দেখে চিনতে পারবে। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি তোমার নিয়ামতের কি সদ্ব্যবহার করেছো? সে বলবে, আমি ইলম অর্জন করেছি, লোকদেরকে তা শিক্ষা দিয়েছি এবং তোমার সন্তুষ্টির জন্য কুরআন পাঠ করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। বরং তুমি এ উদ্দেশ্যে ইলম অর্জন করেছিলে যে, লোকেরা তোমাকে আলেম বা বিদ্বান বলবে, এবং কুরআন এ জন্যে পাঠ করেছিলে যে, তোমাকে ক্বারী বলা হবে। আর তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার সম্বন্ধে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে মুখের উপর উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। অতঃপর আরেক ব্যক্তিকে আনা হবে, তাকে অজস্র ধন- সম্পদ দান করা হয়েছে এবং নানা প্রকারের সম্পদ দেওয়া হয়েছে। তাকে দেওয়া সুযোগ-সুবিধাগুলো তার সামনে তুলে ধরা হবে। সে তা চিনতে পারবে। আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তোমার এ সম্পদ দ্বারা তুমি কি কাজ করেছ? সে বলবে, যেখানে ব্যয় করলে তুমি সন্তুষ্ট হবে এমন কোনো খাত আমি বাদ আমি বাদ দেইনি বরং সেখানেই খরচ করেছি তোমার সন্তুষ্ট লাভের উদ্দেশ্যে। মহান আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। বরং তুমি এ জন্যেই দান করেছ যে, লোকেরা তোমাকে দাতা বলবে। আর তা বলাও হয়েছে। অতঃপর নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তদনুযায়ী তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।”

ইখলাসের স্তরসমূহ:
প্রথম স্তর: আমলের মধ্যে লৌকিকতা বর্জন করা ও তা আল্লাহর দয়ায় ও তাওফিকে হয়েছে বলে মনে করা, প্রতিদান না চাওয়া এবং আমলের কারণে আত্মসন্তুষ্ট না হওয়া; বরং নিজের অক্ষমতা ও স্বল্পতার জন্য সর্বদা লজ্জিত থাকা।
প্রথমত আমলটি আল্লাহর রহমত ও তাওফিকে হয়েছে তার দলিল হলো আল্লাহর বাণী,
﴿ وَلَوۡلَا فَضۡلُ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡ وَرَحۡمَتُهُۥ مَا زَكَىٰ مِنكُم مِّنۡ أَحَدٍ أَبَدٗا وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يُزَكِّي مَن يَشَآءُۗ ١ ﴾ [النور : ٢١] 
“আর যদি তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া না থাকত, তাহলে তোমাদের কেউই কখনো পবিত্র হতে পারত না; কিন্তু আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন”। [সূরা  আন্-নূর: ২১]
দ্বিতীয়ত: আমলকারীর মনে রাখা উচিত যে সে আল্লাহর একজন দাস। আর দাস যা করে তার বিনিময়ে মনিবের কাছে কিছু প্রত্যাশা করতে পারে না।
তৃতীয়ত: নিজের আমলের মধ্যে দোষত্রুটি ও কমতি সর্বদা তালাশ করা।
দ্বিতীয় স্তর: নিজের সাধ্যমত চেষ্টা করার পরেও আমলের ক্ষেত্রে লজ্জাবোধ করা, নিজেকে মনে করা যে আল্লাহর জন্য যথাযথভাবে কাজটি করা হয় নি। আল্লাহ বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ يُؤۡتُونَ مَآ ءَاتَواْ وَّقُلُوبُهُمۡ وَجِلَةٌ أَنَّهُمۡ إِلَىٰ رَبِّهِمۡ رَٰجِعُونَ ٦٠ ﴾ [المؤمنون : ٦٠] 
“আর যারা যা দান করে তা ভীত-কম্পিত হৃদয়ে করে থাকে এজন্য যে, তারা তাদের রবের দিকে প্রত্যাবর্তনশীল”। [সূরা  আল-মুমিনূন: ৬০]
সুতরাং মু’মিন সর্বদা আল্লাহর দয়া কামনা করবে এবং নিজের কমতির জন্য নিজেকে দোষারোপ করবে।
তৃতীয় স্তর: আমলটি ইলম অনুযায়ী বিশুদ্ধ হওয়া, যাতে তা বিদ‘আত হতে মুক্ত হয়। 
 
ইখলাসের ফায়েদা:
প্রতিটি আমল কবুল হওয়ার জন্য দু’টি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূর্ণ হতে হবে।
১- ব্যক্তি কাজটি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করবে।
২- কাজটি কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হওয়া।
উপরিউক্ত দু’টি শর্তের কোনো একটি পাওয়া না গেলে কাজটি বিশুদ্ধ ও কবুল হবে না। এ ব্যাপারে কুরআনের দলিল হলো,
﴿فَمَن كَانَ يَرۡجُواْ لِقَآءَ رَبِّهِۦ فَلۡيَعۡمَلۡ عَمَلٗا صَٰلِحٗا وَلَا يُشۡرِكۡ بِعِبَادَةِ رَبِّهِۦٓ أَحَدَۢا ١١٠ ﴾ [الكهف: ١١٠] 
“সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদাতে কাউকে শরীক না করে”। [সূরা  আল-কাহফ: ১১০]
হাফিয ইবন কাসির রহ. বলেন, “এ দু’টি আমল কবুল হওয়ার শর্ত। তাই আমলটি একমাত্র মহান আল্লাহর জন্যই হতে হবে এবং তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরি‘আত অনুযায়ী হতে হবে”। 
তাই ইখলাসের ফায়েদা হচ্ছে:
১- অহংকার মুক্ত হওয়া। (কুরআনে বর্ণিত তিন ব্যক্তির ঘটনা, ‘ইকরামার ঘটনা ও আসহাবে কাহাফের ঘটনা)।
২- আল্লাহর সাহায্য লাভ। আল্লাহ বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا لَقِيتُمۡ فِئَةٗ فَٱثۡبُتُواْ وَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ كَثِيرٗا لَّعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٤٥ وَأَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَا تَنَٰزَعُواْ فَتَفۡشَلُواْ وَتَذۡهَبَ رِيحُكُمۡۖ وَٱصۡبِرُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ ٤٦ وَلَا تَكُونُواْ كَٱلَّذِينَ خَرَجُواْ مِن دِيَٰرِهِم بَطَرٗا وَرِئَآءَ ٱلنَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِۚ وَٱللَّهُ بِمَا يَعۡمَلُونَ مُحِيطٞ ٤٧ ﴾ [الانفال: ٤٥،  ٤٧] 
“হে মুমিনগণ, যখন তোমরা কোন দলের মুখোমুখি হও, তখন অবিচল থাক, আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হও। আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং পরস্পর ঝগড়া করো না, তাহলে তোমরা সাহসহারা হয়ে যাবে এবং তোমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর তোমরা ধৈর্য ধর, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা তাদের ঘর থেকে অহঙ্কার ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বের হয়েছে এবং আল্লাহর রাস্তায় বাধা প্রদান করে, আর তারা যা করে, আল্লাহ তা পরিবেষ্টন করে আছেন”। [সূরা  আল- আনফাল: ৪৫-৪৭]
৩- শয়তানের ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহ বলেন,
﴿ وَلَقَدۡ هَمَّتۡ بِهِۦۖ وَهَمَّ بِهَا لَوۡلَآ أَن رَّءَا بُرۡهَٰنَ رَبِّهِۦۚ كَذَٰلِكَ لِنَصۡرِفَ عَنۡهُ ٱلسُّوٓءَ وَٱلۡفَحۡشَآءَۚ إِنَّهُۥ مِنۡ عِبَادِنَا ٱلۡمُخۡلَصِينَ ٢٤ ﴾ [يوسف: ٢٤] 
“আর সে মহিলা তার প্রতি আসক্ত হল, আর সেও তার প্রতি আসক্ত হত, যদি না তার রবের স্পষ্ট প্রমাণ প্রত্যক্ষ করত। এভাবেই, যাতে আমি তার থেকে অনিষ্ট ও অশ্লীলতা দূর করে দেই। নিশ্চয় সে আমার খালেস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত”। [সূরা: ইউসুফ: ২৪]
আল্লাহ আরো বলেন, 
﴿قَالَ رَبِّ بِمَآ أَغۡوَيۡتَنِي لَأُزَيِّنَنَّ لَهُمۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَأُغۡوِيَنَّهُمۡ أَجۡمَعِينَ ٣٩ إِلَّا عِبَادَكَ مِنۡهُمُ ٱلۡمُخۡلَصِينَ ٤٠ ﴾ [الحجر: ٣٩،  ٤٠]
“সে বলল, ‘হে আমার রব, যেহেতু আপনি আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তাই যমীনে আমি তাদের জন্য (পাপকে) শোভিত করব এবং নিশ্চয় তাদের সকলকে পথভ্রষ্ট করব’। তাদের মধ্য থেকে আপনার একান্ত বান্দাগণ ছাড়া”। [সূরা: আল-হিজর:  ৩৯-৪০]
৪- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফা‘য়াত লাভ করা।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَنَّهُ قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَنْ أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِكَ يَوْمَ القِيَامَةِ؟ فَقَالَ: " لَقَدْ ظَنَنْتُ، يَا أَبَا هُرَيْرَةَ، أَنْ لاَ يَسْأَلَنِي عَنْ هَذَا الحَدِيثِ أَحَدٌ أَوَّلُ مِنْكَ، لِمَا رَأَيْتُ مِنْ حِرْصِكَ عَلَى الحَدِيثِ، أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ القِيَامَةِ مَنْ قَالَ: لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، خَالِصًا مِنْ قِبَلِ نَفْسِهِ "
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ্! কিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষ থেকে বেশি সৌভাগ্যবান হবে আপনার শাফায়াত দ্বারা কোন লোকটি? তখন তিনি বললেন, হে আবূ হুরায়রা! আমি ধারণা করেছিলাম যে তোমার আগে কেউ এ সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না। কারণ হাদীসের ব্যাপারে তোমার চেয়ে অধিক আগ্রহী আর কাউকে আমি দেখিনি। কিয়ামতের দিন আমার শাফায়াত দ্বারা সর্বাধিক সৌভাগ্যবান ঐ ব্যক্তি হবে যে খালেস অন্তর থেকে বলে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”।
৫- গুনাহ মাফ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। যেমন উল্লিখিত হাদীসে বেতাকা, ব্যাভিচারিণী মহিলার কুকুরকে পানি পান করানো ও রাস্তা থেকে এক ব্যক্তির কাঁটা সরিয়ে ফেলার ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

সালাফে সালেহীন ও তাদের ইখলাস:
ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনা: কুরআনে এসেছে,
﴿ وَلَقَدۡ هَمَّتۡ بِهِۦۖ وَهَمَّ بِهَا لَوۡلَآ أَن رَّءَا بُرۡهَٰنَ رَبِّهِۦۚ كَذَٰلِكَ لِنَصۡرِفَ عَنۡهُ ٱلسُّوٓءَ وَٱلۡفَحۡشَآءَۚ إِنَّهُۥ مِنۡ عِبَادِنَا ٱلۡمُخۡلَصِينَ ٢٤ ﴾ [يوسف: ٢٤] 
“আর সে মহিলা তার প্রতি আসক্ত হল, আর সেও তার প্রতি আসক্ত হত, যদি না তার রবের স্পষ্ট প্রমাণ প্রত্যক্ষ করত। এভাবেই, যাতে আমি তার থেকে অনিষ্ট ও অশ্লীলতা দূর করে দেই। নিশ্চয় সে আমার খালেস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত”। [সূরা: ইউসুফ: ২৪]
মূসা আলাইহিস সালামের ঘটনা:
﴿ وَٱذۡكُرۡ فِي ٱلۡكِتَٰبِ مُوسَىٰٓۚ إِنَّهُۥ كَانَ مُخۡلَصٗا وَكَانَ رَسُولٗا نَّبِيّٗا ٥١ ﴾ [مريم: ٥١] 
“আর স্মরণ কর এই কিতাবে মূসাকে। অবশ্যই সে ছিল মনোনীত এবং সে ছিল রাসূল, নবী”। [সূরা মারইয়াম: ৫১]
আবূ সুলাইমান আদদারানী রহ. বলেন, “যার একটিমাত্র কদম (আমল) সহীহ হয়েছে এবং তা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করেছে তার জন্য সুসংবাদ”।
একজন সৎপূর্বসূরী বলেছেন, “যার জীবনে একটিমাত্র মুহূর্ত (আমল) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কেটেছে সে ব্যক্তি নাজাত পাবে”।
আলী ইবন হাসান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন মারা গেলেন তখন মদীনার শতশত ঘরের লোকজন তার জন্য কেঁদেছেন।
হামদুল ইবন আহমদ রহ. কে বলা হলো সালাফদের কথা আমাদের কথার চেয়ে কল্যাণকর ছিল কেন? তিনি বলেন, “তারা ইসলামের মর্যাদা বৃদ্ধি, নিজের নাজাত লাভ ও রহমানের সন্তুষ্টি লাভের জন্য কথা বলতেন, আর আমরা নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি, দুনিয়া লাভ ও সৃষ্ট মানুষের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কথা বলি”।
এক ব্যক্তি তামীম আদ-দারী রহ. কে তার রাতের সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন। তিনি বললেন, “গভীর রাতে গোপনে এক রাক‘আত সালাত আদায় করা সারারাত সালাতের চেয়েও আমার কাছে উত্তম। অতঃপর তিনি একথা মানুষকে বলতেন”।
আইয়ূব আস-সাখতিয়ানী রহ. বলেন, “যে ব্যক্তি নিজে বিখ্যাত হতে চায় সে কখনও প্রকৃত বান্দাহ হতে পারবে না”।
কোনো এক সালাফ বলেন, “আমি সব কাজে নিয়্যাত করতে পছন্দ করি। এমনকি আমার খাওয়া দাওয়া, পান করা, ঘুমানো ও বাথরুমে যাওয়া ইত্যাদি কাজে”।
হাসান রহ. বলেন, “লোকদের কাছে মেহমান থাকত, সে ব্যক্তি রাতে সালাত আদায় করলে তার মেহমান তা জানত না। তারা বেশি বেশি দু‘আ করতেন কিন্তু তাদের আওয়াজ কেউ শুনতনা। এক ব্যক্তি একই বিছানায় তার স্ত্রীর সাথে রাতে ঘুমাতো, সারারাত সে আল্লাহর কাছে কাঁদত কিন্তু তার স্ত্রী তা বুঝতে পারত না”।
ফুদাইল ইবন ‘ইয়াদ রহ. বলেন, “মানুষের কারণে আমল বাদ দেওয়া রিয়া (লৌকিকতা), আর মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করা শির্ক, এ দুটি থেকে আল্লাহ মুক্ত করলে তা হলো ইখলাস”।
ইমাম শাফে‘য়ী রহ. বলেন, “আমার আশা যে, লোকেরা আমার কিতাবসমূহ পড়ে ইলম অর্জন করুন তবে তা আমার দিকে নিসবত না করুক”।
সুফইয়ান রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাকে মারিয়া রবি‘ ইবন খুসাইম বলেছেন, “রবি‘ এর সব আমল গোপনীয় ছিল। কুরআন তিলাওয়াতের সময় কেউ আসলে তিনি কাপড় দিয়ে তা ঢেকে রাখতেন”।
জুবাইর ইবন নুফাইর রহ. বলেন, “আমি আবূ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে তার শেষ সালাত আদায়ের সময় শুনেছি যে, তিনি তাশাহহুদ শেষে নিফাক থেকে আল্লাহর কাছে বারবার পানাহ চাচ্ছেন। আমি বললাম হে আবূ দারদা আপনি ও নিফাক থেকে পানাহ চাচ্ছেন? তিনি বললেন, তোমার কথা বাদ দাও। আল্লাহর কসম মানুষ শেষ মুহুর্তেও দীন থেকে ঘুরে যেতে পারে ফলে সে দীন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে”।
বিশর আল-হাফী রহ. বলেন, “দীনের বিনিময়ে দুনিয়ার কিছু চাওয়ার চেয়ে বাঁশি বাজিয়ে দুনিয়ার কিছু চাওয়া আমার কাছে উত্তম”।
ইয়াহইয়া ইবন আবু কাসীর রহ. বলেন, “তোমরা নিয়্যাত শিক্ষা কর। কেননা তা আমলের চেয়েও অধিক জরুরী”।
ইবন কাইয়্যেম রহ. বলেছেন, সৎকাজে ধৈর্য ধারণ তিন ধরণের:
১- সৎকাজের পূর্বে ধৈর্য ধারণ।
২- সৎকাজে ধৈর্য ধারণ।
৩- সৎকাজের পরে ধৈর্য ধারণ। অর্থাৎ আল্লাহর অনুগ্রহ চাওয়া, অহমিকা ত্যাগ করা ও লৌকিকতা ছেড়ে দেওয়া।
ইবন ‘আকীল রহ. বলেন, “আবূ ইসহাক ফাইরুযবাদী গরিবকে কিছু দান করার আগে নিয়্যাত করতেন। কোন মাসয়ালা সম্পর্কে কিছু বলার আগে আল্লাহর সাহায্য চাইতেন ও মানুষের কাছে সাজিয়ে ও রঙ্গিয়ে কিছু বলা ছাড়াই সঠিক রায়ের জন্য ইখলাস কামনা করতেন। দু’রাক‘আত সালাত আদায় করা ব্যতীত তিনি কোন মাসয়ালা লেখেন নি। ফলে তার ইখলাসের বদৌলতে সারা দুনিয়ায় তার গ্রন্থাদি প্রসিদ্ধ লাভ করেছে”।
আল্লামা মুহাম্মদ আমীন আশ-শানকীতি রহ. এর নিয়্যাতের বিশুদ্ধতার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। আরবদের বংশতালিকা তন্মধ্যে অন্যতম। এ বইটি তিনি অপ্রাপ্ত বয়সে লিখেছিলেন। বইয়ের শুরুতে তিনি লিখেছেন: বনী ‘আদনানের বংশ, একে আমি “খালিসুজ জুমান” নামকরণ করেছি। কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তিনি এ কবিতাকে মাটিতে পুঁতে ফেলেন। কারণ তিনি এটিকে আত্মীয়দের উপরে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য রচনা করেছিলেন। তার কতিপয় উস্তাদ তাঁকে এ কাজের জন্য ভৎর্সনা করেন, তারা বলেছিলেন, তোমার নিয়্যাত পরিবর্তন ও বিশুদ্ধ করলেই হত”।
আবূ বকর যায়েদ তার (মুহাম্মদ আমীন আশ-শানকীতি রহ.) সম্পর্কে বলেছিলেন, “এ যুগে যদি কাউকে শাইখ বলা হয় তবে তিনিই হবেন তা”।
নিয়্যাতের বিশুদ্ধতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইয়ুব আসসাখতিয়ানী রহ. বলেছেন, “সব কাজের মধ্যে নিয়্যাতের বিশুদ্ধতা সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার”।
‘উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি আবূ মূসা আশ‘য়ারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে লিখেছেন, “যে ব্যক্তি নিয়্যাতকে বিশুদ্ধ করবে তার ও মানুষের মাঝে আল্লাহই যথেষ্ট হবেন”।
কবির ভাষায়:
“যে মু’মিনের প্রকাশ্য ও গোপনীয় উভয়টাই সমান হবে, সে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানেই সফলকাম হবে, আর তখন তার প্রশংসা করা হবে। আর যার প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড গোপনীয়তার বিপরীত হবে, সে সৌভাগ্যবান হবে না; যদিও সে কঠোর পরিশ্রম করে”।
ইমাম শাফে‘য়ী রহ. বলেছেন, “আমার ইচ্ছা হয় যে, মানুষ আমার লিখিত কিতাবসমূহ পড়ে ইলম অর্জন করুক তবে তারা যেন এগুলো আমার দিকে নিসতব না করে অর্থাৎ আমার নাম উল্লেখ না করে”।
তিনি আরো বলেন, “আমি কখনও কারো উপর জয়লাভ করতে বিতর্ক করিনি, একমাত্র সত্যকে প্রকাশ করার জন্যই তর্ক বিতর্ক করেছি”।
তিনি আরো বলেন, “আমি যখন কারো সাথে কথা বলেছি তখন তাকে সংশোধন ও সত্যের ব্যাপারে সাহায্য করতে চেয়েছি, আর আশা করেছি যে, তার উপর আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ ও হেফাযত থাকুক”।
ইমাম শাফে‘য়ী রহ. এর এসব কথা মুখলিসীনদের ইখলাসের কথাই প্রমাণ করে। আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাহদের আলামত হলো তারা নিজেদের জন্য কোনো আমল করতেন না, বরং তাদের একমাত্র লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আর তারা সর্বদা সত্য শিক্ষা দেওয়া ও প্রকাশ করতে ব্রত ছিলেন। কারো সাথে সংলাপ করলে তাতে বিজয়ের মানসিকতা ছিল না, বরং সত্য প্রকাশই ছিল তাদের লক্ষ্য। তারা সর্বদা আশা করতেন যে, আল্লাহ যেন আলোচনার মাধ্যমে হককে প্রকাশ করে দেন।
আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক স্থাপন করতে মানুষের অন্তর থেকে সব সম্মান ও মর্যাদাও যদি শেষ হয়ে যায় তাতে মুখলিস ব্যক্তি কোনো পরোয়া করেন না। আর তারা তাদের সামান্য আমলও মানুষের কাছে প্রকাশ করতে পছন্দ করেন না।

ইখলাস সম্পর্কে কিছু সতর্কতা:
১- আখেরাতের প্রতিদানের আশা করা: কিছু লোক ইবাদত বন্দেগীতে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের ব্যাপারে এতই বাড়াবাড়ি করেন যে, তারা মনে করেন আল্লাহ সালেহীন বান্দাহদেরকে পরোকালের যে সব প্রতিদানের ওয়াদা করেছেন সে জন্য ইবাদত করা ইখলাসের পরিপন্থী ও ঘাটতি। যদিও তারা সাওয়াবের নিয়্যাতে ইবাদত করাকে ইবাদত বাতিল হয়ে যায় একথা বলেন না, তবে এভাবে আমল করাকে মাকরূহ বলেছেন। তারা আখেরাতের প্রতিদানের আশায় ইবাদত করাকে ‘মন্দ কর্মচারী’ (আমলকারী) মনে করেন।
একজন বিখ্যাত সূফী বলেছেন, “ইখলাস হলো, আমলের দ্বারা দুনিয়া ও আখেরাতে প্রতিদানের আশা না করা ও কারো কাছে কিছু না চাওয়া”। 
রাবি‘আহ  আল-‘আদাবীয়াহ (রাবেয়া বসরী) বলেছেন –যদি বর্ণনা সঠিক হয়- “আমি জাহান্নামের ভয়ে বা জান্নাতের আশায় কখনও ইবাদত করিনি। এতে আমি মন্দ আমলকারী হয়ে যেতাম। বরং আমি আল্লাহর ভালোবাসা তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ইবাদত করেছি”। 
সুফীদের এসব মত কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধী। কেননা আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনের গুণ বর্ণনা করতে বলেছেন যে, তারা আল্লাহর ভয়ে ও আশায় ইবাদত করেন।
﴿ إِنَّهُمۡ كَانُواْ يُسَٰرِعُونَ فِي ٱلۡخَيۡرَٰتِ وَيَدۡعُونَنَا رَغَبٗا وَرَهَبٗاۖ وَكَانُواْ لَنَا خَٰشِعِينَ ٩٠ ﴾ [الانبياء: ٩٠] 
“তারা সৎকাজে প্রতিযোগিতা করত। আর আমাকে আশা ও ভীতি সহকারে ডাকত। আর তারা ছিল আমার নিকট বিনয়ী”। [সূরা  আল-আম্বিয়া: ৯০]
আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের গুণ বর্ণনায় বলেন,
﴿ وَٱلَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱصۡرِفۡ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَۖ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَامًا ٦٥ ﴾ [الفرقان: ٦٥] 
“আর যারা বলে, ‘হে আমাদের রব, তুমি আমাদের থেকে জাহান্নামের আযাব ফিরিয়ে নাও। নিশ্চয় এর আযাব হল অবিচ্ছিন্ন”। [সূরা  আল-ফুরকান: ৬৫]
আল্লাহর খলিল ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সম্পর্কে বলেন,
﴿ وَٱجۡعَلۡنِي مِن وَرَثَةِ جَنَّةِ ٱلنَّعِيمِ ٨٥ وَٱغۡفِرۡ لِأَبِيٓ إِنَّهُۥ كَانَ مِنَ ٱلضَّآلِّينَ ٨٦ وَلَا تُخۡزِنِي يَوۡمَ يُبۡعَثُونَ ٨٧ يَوۡمَ لَا يَنفَعُ مَالٞ وَلَا بَنُونَ ٨٨ إِلَّا مَنۡ أَتَى ٱللَّهَ بِقَلۡبٖ سَلِيمٖ ٨٩ ﴾ [الشعراء : ٨٥،  ٨٩] 
“আর আপনি আমাকে সুখময় জান্নাতের ওয়ারিসদের অন্তর্ভুক্ত করুন’। আর আমার পিতাকে ক্ষমা করুন; নিশ্চয় সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত ছিল’। আর যেদিন পুনরুত্থিত করা হবে সেদিন আমাকে লাঞ্ছিত করবেন না’। যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনো উপকারে আসবে না’। তবে যে আল্লাহর কাছে আসবে সুস্থ অন্তরে”। [সূরা আশ-শু‘আরা: ৮৫-৮৯]
আল্লাহ সূরা আল-মুতাফফিফীনে জান্নাতের নাজ নিয়ামতের বর্ণনা দেয়ার পরে মানুষকে তা অর্জনে প্রতিযোগিতা করতে উৎসাহিত করেছেন,
﴿ وَفِي ذَٰلِكَ فَلۡيَتَنَافَسِ ٱلۡمُتَنَٰفِسُونَ ٢٦ ﴾ [المطففين: ٢٦] 
“আর প্রতিযোগিতাকারীদের উচিৎ এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা করা”। [সূরা আল্-মুতাফফিফীন: ২৬]
তাহলে সাওয়াবের আশা করা যাবে না একথা কিভাবে বলা যায়, অথচ আল্লাহর সমস্ত দীন বান্দাহকে জান্নাত কামনা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির দাওয়াত দিয়েছে। সব নবী রাসূল, সিদ্দীক, শহীদ, সকলেই জান্নাত কামনা করেছেন এবং জাহান্নাম থেকে পানাহ চেয়েছেন। অতএব, যারা জান্নাতের আশায় ও জাহান্নামের ভয়ে ইবাদত করে তাকে মন্দ কর্মচারীর সাথে তুলনা করা বা দুর্বল মুরিদ বলা সঠিক নয়।
কিছু কাজ লোক দেখানো বা শির্ক বলে মনে হয়, মূলত তা নয়:
১- ভালো কাজে কাউকে প্রশংসা করা। যেমন:
عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ: قِيلَ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَرَأَيْتَ الرَّجُلَ يَعْمَلُ الْعَمَلَ مِنَ الْخَيْرِ، وَيَحْمَدُهُ النَّاسُ عَلَيْهِ؟ قَالَ: «تِلْكَ عَاجِلُ بُشْرَى الْمُؤْمِنِ»
আবু যার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরয করা হল, সেই ব্যক্তি সম্পর্কে কি অভিমত, যে নেক আমল করে এবং লোকেরা তার প্রশংসা করে? তিনি বললেন, এতো মুমিন ব্যক্তির জন্য তা আগাম সুসংবাদ (এতে কাজটি কবুল হওয়ার লক্ষণ বুঝা যায়)।
২- গুনাহ সম্পর্কে আলোচনা করা, অথচ আল্লাহ গুনাহ প্রকাশ করাকে অপছন্দ করেন এবং গোপন রাখা পছন্দ করেন। হাদীসে এসেছে,
فَمَنْ أَصَابَ مِنْ هَذِهِ الْقَاذُورَاتِ شَيْئًا، فَلْيَسْتَتِرْ بِسِتْرِ اللَّهِ
“যে ব্যক্তি আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়েছে সে যেন আল্লাহর গোপনীয়তায় নিজেকে গোপন রাখে”। 
৩- রিয়া তথা লোকদেখানো ভয়ে ভালো কাজ ছেড়ে দেওয়া। কেননা এটা শয়তানের ষড়যন্ত্র। ইবরাহীম নাখ‘য়ী রহ. বলেছেন, “যখন তুমি সালাতে থাকো তখন শয়তান এসে বলে তুমি তো মানুষকে দেখানোর জন্য সালাত পড়ছ, তখন তুমি সালাত আরো দীর্ঘ করো”।
৪- আবেদ বান্দাহকে দেখে ইবাদতের প্রতি আগ্রহ জন্মানো। ইমাম মাকদিসী রহ. বলেন, “কেউ অধিক ইবাদতকারীর সাথে রাত্রি যাপন করলে তার অল্প ইবাদত করার অভ্যাস থাকলে সে যদি উক্ত ব্যক্তির দ্বারা উৎসাহিত হয়ে বেশি সালাত ও সাওম পালন করে তবে কেউ হয়ত ভাবতে পারে এটা রিয়া তথা লৌকিকতা। আসলে ব্যাপারটা মোটেও এরূপ নয়। বরং এতে ফায়েদা আছে। মূলত সব মু’মিনই আল্লাহর ইবাদত করতে চায়, কিন্তু অনেক সময় বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি ও অলসতার কারণে সম্ভব হয়ে উঠে না, তখন অন্যের কারণে সে অলসতা দূর হয়ে যায়”।  
নিজেকে ইখলাস থেকে নিরাশ মনে করা উচিত নয়, যেমন বলা যে, এটা শক্তিশালী মুখলিস বান্দাই করতে সক্ষম, আমি তাদের তুলনায় কোথায়? এতে ইখলাস অর্জনে সে চেষ্টা ছেড়ে দেয়। অথচ যার মধ্যে ইখলাসের ঘটতি আছে তার ইখলাস সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। 
৫- গুনাহের কথা আলোচনা না করা ও গোপন রাখা:
عَنْ سَالِمِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ: سَمِعْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ، يَقُولُ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: " كُلُّ أُمَّتِي مُعَافًى إِلَّا المُجَاهِرِينَ، وَإِنَّ مِنَ المُجَاهَرَةِ أَنْ يَعْمَلَ الرَّجُلُ بِاللَّيْلِ عَمَلًا، ثُمَّ يُصْبِحَ وَقَدْ سَتَرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ، فَيَقُولَ: يَا فُلاَنُ، عَمِلْتُ البَارِحَةَ كَذَا وَكَذَا، وَقَدْ بَاتَ يَسْتُرُهُ رَبُّهُ، وَيُصْبِحُ يَكْشِفُ سِتْرَ اللَّهِ عَنْهُ "
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, “আমার সকল উম্মত মাফ পাবে, তবে প্রকাশকারী ব্যতীত। আর নিশ্চয়ই এ বড় ধৃষ্টতা যে, কোনো ব্যক্তি রাতে অপরাধ করলো যা আল্লাহ গোপন রাখলেন। কিন্তু সে ভোর হলে বলে বেড়াতে লাগলো, হে অমুক! আমি আজ রাতে এমন এমন কর্ম করেছি। অথচ সে এমন অবস্থায় রাত অতিবাহিত করলো যে, আল্লাহ তার কর্ম গোপন রেখেছিলেন, আর সে ভোরে উঠে তার উপর আল্লাহর পর্দা খুলে ফেললেন”।
৬- প্রত্যাশা ছাড়াই সুনাম সুখ্যাতি অর্জিত হলে, শির্কের ভয়ে আমল ছেড়ে দেওয়া। ফুদাইল ইবন ‘ইয়াদ রহ. বলেন, “লোক দেখানোর ভয়ে আমল ছেড়ে দেওয়া রিয়া, আর লোক দেখানোর জন্য আমল করা শির্ক, আল্লাহ তোমাকে এ থেকে মুক্ত রাখা হলো ইখলাস”।  ইমাম নাওয়াবী রহ. এ কথার ব্যাখ্যায় বলেন, তার কথার উদ্দেশ্য হলো কেউ কোনো ইবাদত করার ইচ্ছা পোষণ করলে লৌকিকতার ভয়ে তা ছেড়ে দিলে রিয়া হিসেবে গণ্য হবে, কেননা মানুষের কারণে আমল ছেড়ে দিলে নফল আমল হলে হয়ত সে নির্জনে সালাত আদায় করবে, আর তা মুস্তাহাবও বটে, কিন্তু ফরয সালাত হলে অথবা ফরয যাকাত হলে বা উক্ত ব্যক্তি এমন বিজ্ঞ আলেম হলে যাকে মানুষ অনুসরণ করে, এরূপ অবস্থায় প্রকাশ্যে ইবাদত করাই উত্তম।
৭- ব্যক্তির ইচ্ছা ছিল ইবাদত গোপনভাবে করা এবং একমাত্র আল্লাহর জন্যই করা, কিন্তু মানুষ যদি জেনে যায় তবে বুঝতে হবে আল্লাহ তা‘আলা তার ইবাদতের সৌন্দর্য মানুষের মাঝে প্রকাশ করেছেন, তখন মানুষের প্রশংসা ও সম্মানের আশা না করে আল্লাহর এ সুন্দর কাজে খুশি হওয়া এবং আল্লাহ তার গুনাহ গোপন করায় আনন্দিত হওয়া প্রয়োজন।
عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ: قِيلَ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَرَأَيْتَ الرَّجُلَ يَعْمَلُ الْعَمَلَ مِنَ الْخَيْرِ، وَيَحْمَدُهُ النَّاسُ عَلَيْهِ؟ قَالَ: «تِلْكَ عَاجِلُ بُشْرَى الْمُؤْمِنِ»
আবু যার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরয করা হল, সেই ব্যক্তি সম্পর্কে কি অভিমত, যে নেক আমল করে এবং লোকেরা তার প্রশংসা করে? তিনি বললেন, এতো মুমিন ব্যক্তির জন্য তা আগাম সুসংবাদ (এতে কাজটি কবুল হওয়ার লক্ষণ বুঝা যায়)।
ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, যে ব্যক্তির নিয়মিত দুহা (চাশত) এর সালাত বা তাহাজ্জুদ বা অন্য সালাতের অভ্যাস আছে সে যেখানেই থাকুক সে সালাত পড়ে নিবে। লোক দেখানো ও ইখলাসের পরিপন্থী না হলে শুধুমাত্র মানুষের মাঝে থাকার তারা তার এ গোপন ইবাদতের কথা জেনে যাবে এ কথা ভেবে উক্ত ইবাদত বাদ দেওয়া উচিত নয়।
তিনি আরো বলেন, কেউ শুধুমাত্র রিয়ার ধারণা করে জায়েয কাজ থেকে বিরত থাকতে নিষেধ করলে তা নিন্মোক্ত কারণে গ্রহণযোগ্য হবে না:
১- কোনো জায়েয কাজ শুধুমাত্র রিয়ার ভয়ে বাদ দেওয়া যাবে না, বরং তা ইখলাসের সাথে করতে আদেশ দেওয়া হবে।
২- শরি‘আত যা নিষেধ করেছে শুধু তাই নিষেধ করা যাবে।
«إِنِّي لَمْ أُومَرْ أَنْ أَنْقُبَ عَنْ قُلُوبِ النَّاسِ وَلاَ أَشُقَّ بُطُونَهُمْ»
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমাকে মানুষের দিল ছিদ্র করে, পেট ফেঁড়ে (ঈমানের উপস্থিতি) দেখার জন্য বলা হয় নি”।
৩- এভাবে করতে অনুমতি দিলে শির্ক ও বাতিলপন্থীরা দীনদার ও সৎ লোকের শরি‘আতসিদ্ধ ভালো কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। যখনই তারা কোনো জায়েয কাজ দেখবে তখন তারা বলে বেড়াবে ‘এটা লোক দেখানোর জন্য করা হচ্ছে’। ফলে হকপন্থীরা জায়েয কাজটি প্রকাশ পেয়ে যাবে এ ভয়ে ছেড়ে দিবে। এভাবে ভালো কাজ বাদ পড়ে যাবে। 
৪- তাছাড়া এটা মুনাফিকের চরিত্র। তাদের অভ্যাস হলো, যারা ভালো কাজ প্রকাশ্যভাবে করে তাদেরকে দোষারোপ করা।
﴿ ٱلَّذِينَ يَلۡمِزُونَ ٱلۡمُطَّوِّعِينَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ فِي ٱلصَّدَقَٰتِ وَٱلَّذِينَ لَا يَجِدُونَ إِلَّا جُهۡدَهُمۡ فَيَسۡخَرُونَ مِنۡهُمۡ سَخِرَ ٱللَّهُ مِنۡهُمۡ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٧٩ ﴾ [التوبة: ٧٩] 
“যারা দোষারোপ করে সদাকার ব্যাপারে মুমিনদের মধ্য থেকে স্বেচ্ছাদানকারীদেরকে এবং তাদেরকে যারা তাদের পরিশ্রম ছাড়া কিছুই পায় না। অতঃপর তারা তাদেরকে নিয়ে উপহাস করে, আল্লাহও তাদেরকে নিয়ে উপহাস করেন এবং তাদের জন্যই রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব”। [আত্-তাওবা: ৭৯]
শাইখ ইবন ‘উসাইমীন রহ. বলেন, ইবাদত নষ্টকারী  হিসেবে রিয়া দু’প্রকার:
প্রথমত: যেটা মূল ইবাদতের মধ্যে হবে। এ ধরণের হলে তার আমল বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য হবে।
দ্বিতীয়ত: যা কোনো কারণবশত ইবাদতের মধ্যে পাওয়া গেছে। এ ধরণের রিয়া আবার দু’প্রকার:
প্রথম: রিয়াটি দূর করা হবে। এতে কোনো ক্ষতি হবে না।
দ্বিতীয়: রিয়াটি ইবাদতের সঙ্গে থাকবে। রিয়াটি যদি ইবাদতের সঙ্গে যুক্ত থাকে তা আবার দু’প্রকার:
প্রথমটি: যে সব ইবাদতের শেষ অবস্থা শুরু অবস্থার উপর নির্ভরশীল, যেমন সালাত। তাহলে উক্ত ইবাদতটি বাতিল বলে গণ্য হবে।
দ্বিতীয়ত: ইবাদতের শেষ অবস্থা যদি শুরুর উপর নির্ভরশীল না হয়, বরং স্বতন্ত্র, যেমন সাদাকা। এক্ষেত্রে যেটি ইখলাসের সাথে করা হবে তা গ্রহণযোগ্য হবে আর যেটি ইখলাস ছাড়া শির্কের সাথে করা হবে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।

ইখলাস সম্পর্কিত কিছু সূক্ষ্ম বিষয়:
রিয়া দু’প্রকার। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য।
প্রকাশ্য রিয়া হলো যা সরাসরি আমলটির প্রেরণা যোগায় ও যে কারণে কাজটি করা হয়।
আর অপ্রকাশ্য রিয়া হলো যে কারণে আমলটি করা হয় না, বরং সে আমলটি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয় কিন্তু তাতে রিয়ার অনুপ্রবেশ ঘটে, তা আমলটিকে হালকা করে দেয়। যেমন, কোনো ব্যক্তির তাহাজ্জুদ সালাতের অভ্যাস আছে, তবে তা মাঝে মাঝে তার জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় যদি তার কাছে কোনো মেহমান আসে এবং এতে তার উৎসাহ বাড়ে এবং কাজটি করা সহজ হয়ে দেখা দেয় তবে বুঝতে হবে সেটি রিয়া খফি বা অপ্রকাশ্য রিয়া।
এর চেয়েও খফি রিয়া আছে যা আমল ও সহজ হওয়ার মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলে না। এর উৎকৃষ্ট আলামত হলো মানুষ কাজটি জানলে সে আনন্দিত হয়। কিছু মুখলিস আবেদ আছেন যারা আমলের ক্ষেত্রে রিয়া করেন না, বরং রিয়া অপছন্দ করেন, কিন্তু মানুষ তাদের আমলটি জানলে তারা খুশি হন। এতে করে অন্তর থেকে ইবাদতের তীব্রতা কমে যায়। এ ধরণের খুশি রিয়া খফির অন্তর্ভুক্ত। আর রিয়া হলো মানুষকে দেখানোর জন্য ইবাদত করা।
 
রিয়ার কিছু সূক্ষ্ম ও অপ্রকাশ্য দিক:
ইখলাসের অভাবে মানুষের অনেক ইবাদত নষ্ট হয়ে যায়। এটা হয়ত রিয়া, সুনাম সুখ্যাতি, অহমিকা ইত্যাদির কারণে হতে পারে। রিয়া হলো লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করা, যাতে লোক তার প্রশংসা করে এবং সে এর দ্বারা নিজের বড়ত্ব, প্রশংসা, আকাঙ্ক্ষা ও ভীতি প্রকাশ করেন।
সুম‘আ বলতে বুঝায় মানুষের সুনাম সুখ্যাতি শোনার জন্য ইবাদত করা। অতএব রিয়া মানুষের চোখের সাথে সম্পৃক্ত আর সুম‘আ শ্রবণের সাথে সম্পৃক্ত।
আর ‘উজব তথা অহমিকা বিষয়টি রিয়ার কাছাকাছি। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ এ দুয়ের মাঝে পার্থক্যে বলেছেন, রিয়া হলো সৃষ্টি জগতের সাথে শির্ক করা আর ‘উজব হলো নিজের নফসের সাথে শির্ক করা।
রিয়ার তিনটি সূক্ষ্ম দিক:
প্রথমত: আবু হামেদ গাযালী রহ. খফি রিয়া সম্পর্কে আলোচনায় বলেছেন,  এর চেয়েও খফি কিছু রিয়া আছে যা ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত প্রকাশ করতে চান না এমনকি তার আনুগত্য প্রকাশেও খুশি হন না, তবে মানুষ তার সাথে মিলিত হলে তিনি চান যে, তারা প্রথমে সালাম করুক বা মানুষ তার সাথে হাসি খুশি ও সম্মানের সাথে সাক্ষাৎ করুক, তার প্রশংসা করুক বা তারা তার প্রয়োজন দূর করুক অর্থাৎ তার অবস্থা এমন যে, তিনি সুপ্তভাবে তাদের আনুগত্যে ও সম্মান কামনা করেন। অথচ সে এরূপ না করলেও মানুষ তাকে যথাযথ সম্মান করত।
দ্বিতীয়ত: ইখলাসকে দুনিয়াবী উদ্দেশ্য যথা প্রজ্ঞা, সম্মান, পার্থিব ধন সম্পদ ইত্যাদি হাসিলের মাধ্যম বানানো। 
তৃতীয়ত: ইবন রজব রহ. বলেছেন, মানুষের মাঝে কেউ নিজেকে দোষারোপ করে; যাতে মানুষ তার বিনয় নম্রতা দেখে তাকে আরো সম্মান ও প্রশংসা করে। এটা খুব সূক্ষ্ম রিয়া। আমাদের সৎপূর্বসূরীরা এ ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন। মুতাররিফ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন শিখখির রহ. বলেছেন, “মানুষের নিজের প্রশংসার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে লোকের সামনে নিজের দোষারোপ করবে যেন সে এ নিন্দার দ্বারা নিজের সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি করল, আর এটা আল্লাহর কাছে খুবই বোকামী কাজ”।  বস্তুত আল্লাহর আনুগত্যের উপর ধৈর্যধারণ করা তিন প্রকারের। আনুগত্য করার পূর্বে, আনুগত্য করার সময় ও আনুগত্য করার পরে ধৈর্যধারণ করা।
চতুর্থত: কখনও কেউ নিজে রিয়া করাকে অপছন্দ করে তবে অন্য কেউ তার আমলের কথা উল্লেখ করে প্রশংসা করে তখন তার অপছন্দতা লক্ষ্য করা যায় না বরং আনন্দ অনুভব করে এবং এতে ইবাদতের কিছু কষ্ট লাঘব হয় বলে তার মনে হয়। এটাও সুক্ষ্ন রিয়া
 
ইখলাস অর্জনের উপায়সমূহ:
১- বান্দাহ মনে প্রাণে ইয়াকিনের সাথে বিশ্বাস করবে যে সে শুধু আল্লাহর দাস, আর দাস খিদমতের বিনিময়ে মনিবের কাছে কিছু প্রত্যাশা করতে পারে না। যেহেতু সে দাসত্বের কারণে মনিবের খিদমত করবে। অতএব মনিবের কাছে যে প্রতিদান ও সাওয়াব পায় তা শুধু তার অনুগ্রহ, দয়া ও ইহসান। কোন কিছুর বিনিময় বা প্রতিদান নয়।
২- বান্দাহর উপর আল্লাহর অনুগ্রহ, দয়া ও তাওফিক সর্বদা লক্ষ্য করা, একথা ভাবা যে এ সব কিছু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে, তার নিজের থেকে কিছুই হয় নি। আল্লাহর ইচ্ছায়ই তার আমল করতে হবে, নিজের ইচ্ছায় নয়। সব কল্যাণ একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ায়।
৩- ব্যক্তি নিজের দোষত্রুটি, কমতি, নফসের ও শয়তানের অংশিদারিত্ব সর্বদা স্মরণ করা। কেননা অনেক আমলেই কম বেশি নফসের ও শয়তানের অংশ থাকে।
عَنْ مَسْرُوقٍ، عَنْ عَائِشَةَ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الْتِفَاتِ الرَّجُلِ فِي الصَّلَاةِ؟ فَقَالَ: «إِنَّمَا هُوَ اخْتِلَاسٌ يَخْتَلِسُهُ الشَّيْطَانُ مِنْ صَلَاةِ الْعَبْدِ»
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাতের মধ্যে (ঘাড় ফিরিয়ে) এদিক ওদিক তাকানোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি। জবাবে তিনি বলেন, “এটা শয়তানের ছোঁ মারা, সে মানুষের সালাত হতে কিছু অংশ ছো মেরে নিয়ে যায়”।
সামান্য এদিক ওদিক তাকালে যদি এমন সতর্ক করা হয় তাহলে আল্লাহ ছাড়া অন্য দিকে অন্তর ফিরালে কি অবস্থা হবে?  
৩- অন্তরের সংশোধন ও ইখলাসের জন্য আল্লাহ যেসব আদেশ দিয়েছেন সেগুলো স্মরণ করা। লোক দেখানো ব্যক্তিরা আল্লাহর তাওফিক থেকে বঞ্চিত হয়।
৪- আল্লাহর ক্রোধ ও আযাবের ভয় যখন বান্দাহর অন্তরে থাকবে তখন সে রিয়া থেকে বিরত থাকবে।
৫- গোপনে বেশি বেশি আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করা, যেমন: তাহাজ্জুদের সালাত, গোপনে দান সদকা করা ও আল্লাহর ভয়ে নির্জনে কাঁদা।
৬- আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ব মনে বাস্তবায়ন করা। আসমাউল হুসনা (আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ) ও আল্লাহর সিফাত যেমন: ‘আলীউল ‘আযীম, ‘আলীম, রাযযাক, খালিক ইত্যাদি নামসমূহের দ্বারা আল্লাহর তাওহীদ ও ‘উবুদিয়াত বাস্তবায়ন করা।  
৭- সর্বদা একথা মনে রাখা যে, সে মহান আল্লাহর একমাত্র গোলাম।
৮- আল্লাহর সুন্দর জাতী ও গুণবাচক নামসমূহ জানা ও আল্লাহকে যথাযথ সম্মান করা।
৯- মৃত্যু ও এর ভয়াবহতা স্মরণ করা।
১০- রিয়ামুক্ত ভাল মানুষের অনুসরণের মাধ্যমে রিয়াকে ত্যাগ করা।  
১১- রিয়ার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে জানা।
১২- দু‘আর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি কাকুতি মিনতি পেশ করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দু‘আ ও কাকুতি মিনতি পেশ করতেন।
১৩- গভীর চিন্তা ও গবেষণাসহ কুরআন পড়া।
১৪- নফসের ধোঁকা থেকে মুক্ত থাকা। কেননা ইখলাস ও মানুষের প্রশংসা, লোভ লালসা ইত্যাদি অন্তরে একত্রিত হতে পারে না, যেমনিভাবে পানি ও আগুন একত্রিত হতে পারে না। তাই ইখলাস চাইলে লোভ লালসাকে দমন কর, মানুষের প্রশংসা ও সুনাম সুখ্যাতির কামনা বাসনা ত্যাগ কর এবং দুনিয়ার মায়া মমতা ত্যাগ করে আখিরাতের ভালবাসা মনে লালন কর, তাহলে ইখলাস অর্জন সহজ হবে। আর লোভ লালসা ধ্বংসের জন্য এটা জানাই যথেষ্ট যে, দুনিয়াতে লোভনীয় যা কিছুই আছে তা আল্লাহর হাতেই রয়েছে, তিনি যাকে ইচ্ছা তাকেই দান করেন।
১৫- অধ্যবসায়ী ও আত্মসংযমী হওয়া। আল্লাহ বলেছেন,
﴿ وَٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ فِينَا لَنَهۡدِيَنَّهُمۡ سُبُلَنَاۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَمَعَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٦٩ ﴾ [العنكبوت: ٦٩] 
“আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন”। [সূরা  আল্-আনকাবূত: ৬৯]
অতএব রিয়ার ভয়াবহতা ত্যাগ করতে হলে আপনাকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ধাপে ধাপে রিয়া ত্যাগ করে যখন নিম্নোক্ত স্তরে পৌঁছবে তখন আল্লাহর আনুগত্য করতে নফস প্রশান্তি পাবে।
﴿ إِنَّ عِبَادِي لَيۡسَ لَكَ عَلَيۡهِمۡ سُلۡطَٰنٌ إِلَّا مَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡغَاوِينَ ٤٢ ﴾ [الحجر: ٤٢] 
“নিশ্চয় আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই, তবে পথভ্রষ্টরা ছাড়া যারা তোমাকে অনুসরণ করেছে”। [সূরা আল-হিজর: ৪২]
১৬- ইবাদত প্রকাশ না করা।
১৭- মানুষ কে কি বলে সে ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব না দেওয়া।
১৮- সব ধরণের শির্ক থেকে বেঁচে থাকা ও সতর্ক থাকা।
১৯- রিয়ার কাফফারা থেকে বেঁচে থাকার জন্য দু‘আ করা। হাদীসে এসেছে,
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا هَذَا الشِّرْكَ؛ فَإِنَّهُ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ ". فَقَالَ لَهُ: مَنْ شَاءَ اللهُ أَنْ يَقُولَ وَكَيْفَ نَتَّقِيهِ، وَهُوَ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: قُولُوا: " اللهُمَّ إِنَّا نَعُوذُ بِكَ مِنْ أَنْ نُشْرِكَ بِكَ شَيْئًا نَعْلَمُهُ، وَنَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا نَعْلَمُ"
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “হে লোকসকল, তোমরা এ খফি শির্ক (রিয়া) থেকে বেঁচে থাকো, কেননা এটা পিপীলিকা চলার চেয়েও সূক্ষ্ম। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা এর থেকে কিভাবে বেঁচে থাকব? তিনি বললেন, তোমরা বল, হে আল্লাহ আমরা জানা শির্ক থেকে পানাহ চাই এবং অজানা শির্ক থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি”।
২০- ওয়াজ নসিহত, জিকিরের মসলিস ও মুখলিস ব্যক্তিদের সাথে উঠা বসা ও চলা ফেরা করা।
২১- ব্যক্তির উপর আল্লাহর অপরিসীম নি‘আমতের কথা স্মরণ করা ও সেগুলোর শুকরিয়া আদায় করা। প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সবসময়ই তা স্বীকার করা।
২২- ধারাবাহিকভাবে নিয়মিত ইবাদত বন্দেগী করা এবং একে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করা। 
 

সূচীপত্র

অন্তরের কাজের গুরুত্ব:    
ইখলাসের পরিচিত:    
ইসলামে ইখলাসের স্থান:    
স্বল্প আমল সত্বেও ইখলাসের কারণে তার সাওয়াব অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়:    
ইখলাসের স্তরসমূহ:    
ইখলাসের ফায়েদা:    
সালাফে সালেহীন ও তাদের ইখলাস:    
ইখলাস সম্পর্কে কিছু সতর্কতা:    
কিছু কাজ লোক দেখানো বা শির্ক বলে মনে হয়, মূলত তা নয়:    
কিছু সূক্ষ্ম বিষয়:    
রিয়ার কিছু সূক্ষ্ম ও অপ্রকাশ্য দিক:    
রিয়ার তিনটি সূক্ষ্ম দিক:   
ইখলাস কিভাবে অর্জিত হয়?   

ইখলাস

বই সম্পর্কে

লেখক :

عبد الله المأمون

প্রকাশক :

www.islamhouse.com

বিভাগ :

Morals & Ethics