দীনের ওপর অবিচল থাকার উপায়

এ পুস্তিকাটিতে দীনের ওপর অটল ও অবিচল থাকার উপায় ও মাধ্যমগুলো আলোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে যুলুম-নির্যাতনের সময় একজনের করণীয়গুলো কী তা কুরআন ও হাদীসের আলোকে আলোচনা করা হয়েছে।


দীনের ওপর অবিচল থাকার উপায়
وسائل الثبات على الدين

< بنغالي- Bengal - বাঙালি>
        
শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ

 





অনুবাদক: জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

 

وسائل الثبات على الدين

        

 الشيخ محمد صالح المنجد




ترجمة: ذاكرالله أبوالخير
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

সূচিপত্র

ক্রম    বিষয়    পৃষ্ঠা
1.        ভূমিকা    
2.        অটল ও অবিচল থাকার উপায়-উপকরণ    
3.        -    কুরআনমূখী হওয়া    
4.        -    আল্লাহর দেওয়া শরী‘আতের অনুসরণ ও নেক আমল    
5.        -    নবীগণের জীবনী অনুযায়ী আমল ও তাদের অনুকরণ করার উদ্দেশ্যে তাদের জীবনী অধ্যয়ন করা    
6.        -    দো‘আ করা    
7.        -    আল্লাহর যিকির করা    
8.        -    একজন মুসলিম সহীহ পথে চলার প্রতি আগ্রহী হওয়া    
9.        -    সঠিক তারবিয়াত লাভ করা    
10.        -    সঠিক পথের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকা    
11.        -    আল্লাহর দীনের প্রতি দাওয়াত দেওয়ার সাথে সম্পৃক্ত থাকা    
12.        -    বাস্তব ও প্রমাণিত উপাদানগুলোর সাথে সম্পৃক্ত থাকা    
13.        -    আল্লাহর সাহায্যের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখা এবং জেনে রাখা যে ভবিষ্যত ইসলাম ও মুসলিমের    
14.        -    বাতিলের হাকীকত সম্পর্কে জানা ও তাতে ধোকায় না পড়া    
15.        -    অটল ও অবিচল থাকতে সহযোগী -এমন আখলাক ও চারিত্রিক গুণাবলীকে নিজের জীবনে একত্র করা    
16.        -    নেকবান্দাদের উপদেশ    
17.        -    জান্নাতের নি‘আমতসমূহ, জাহান্নামের শাস্তি ও মৃত্যুর স্মরণ করা    
18.        অবিচল থাকার স্থানসমূহ    
19.        -    ফিতনার স্থানে অটল ও অবিচল থাকা    
20.        ফিতনার প্রকারসমূহ: যেমন, সম্পদ, সম্মান, সন্তান, স্ত্রী, যুলুম, অত্যাচার, অনাচার, দাজ্জাল প্রভৃতি।    
21.        -    জিহাদের ময়দানে অটল ও অবিচল থাকা    
22.        -    আদর্শের উপর অটল থাকা, কখনও আদর্শচ্যুত না হওয়া    
23.        -    মৃত্যুর সময় দৃঢ় ও অটল থাকা    

 

 

 

 


ভূমিকা
নিশ্চয় সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর। আমরা তাঁরই প্রশংসা করি, তাঁর নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করি এবং তাঁরই নিকট ক্ষমা চাই। আর আমরা আমাদের আত্মার অনিষ্টতা থেকে এবং আমাদের আমলসমূহের মন্দ পরিণতি থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাকে হিদায়াত দেন, তাকে গোমরাহ করার কেউ নেই এবং যাকে গোমরাহ করেন তাকে হিদায়াত দেওয়ারও কেউ নেই। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো ইলাহ নেই, তার কোনো শরীক নেই। আর আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ তার বান্দা ও রাসূল।
অতঃপর......
একজন সত্যিকার মুসলিম যে সঠিক পথের ওপর চলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তার প্রধান লক্ষ্যই হল, দীনের ওপর অটল ও অবিচল থাকা।
আলোচ্য বিষয়টির গুরুত্ব নিম্নবর্ণিত কয়েকটি বিষয় দ্বারা অনুধাবন করা যাবে। তা হলো:
-বর্তমান যে সমাজে মুসলিমগণ বসবাস করে, সে সমাজের বাস্তবচিত্র। আর বিভিন্ন ধরনের ফিতনা-ফ্যাসাদ ও অসংখ্য অনিষ্টতার লেলিহান অগ্নিশিখা; যার আগুনে তারা জ্বলছে, যা বর্তমান সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর নানা ধরনের বেহায়াপনা, নগ্নতা ও অপপ্রচারের ফলে দীন ও দীনের ধারক-বাহকগণ হয়ে পড়েছেন অপরিচিত ও কোণঠাসা। ফলে যারা দীনের ধারক-বাহক ও দা‘ঈ তারা যেন একটি দৃষ্টান্তের শিকার হয়েছেন, যাতে বলা হয়েছে,
القابض على دينه كالقابض على الجمر
“দীনকে আঁকড়ে ধরে থাকা এমন কষ্টকর যেমন জ্বলন্ত কয়লাকে হাতের মুঠোতে আঁকড়ে ধরে রাখা কষ্টকর”।
নিঃসন্দেহে জ্ঞানী লোক মাত্রই তার নিকট এ কথা স্পষ্ট যে, বর্তমান সময়ে একজন মুসলিমের জন্য দীনের ওপর অটল ও অবিচল থাকার মাধ্যমগুলো জানা ও তা অবলম্বন করা পূর্বসূরিদের যুগের তার ভাইদের তুলনায় অধিক প্রয়োজন। কারণ, সময়ের বিবর্তন ঘটেছে, প্রকৃত মুসলিম ভাইদের সংখ্যা দুর্লভ হয়ে গেছে, সহযোগিতাকারীর মধ্যে এসেছে দুর্বলতা আর সাহায্যকারীর সংখ্যায় এসেছে স্বল্পতা।
-দীন থেকে মুরতাদ হওয়া, দীনের প্রতি গুরুত্বহীনতা ও দীন থেকে পশ্চাদপসরতার ঘটনা অহরহ ঘটছে এবং বেড়ে চলছে। এমনকি যারা ইসলামের জন্য কাজ করেন তাদের মধ্যেও তার বিস্তার ঘটে চলেছে, যা একজন মুসলিমকে এ ধরনের ভয়াবহ পরিণতির ব্যাপারে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলে। সে এ ধরনের ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে দীনের ওপর অবিচল থাকার জন্য বিবিধ মাধ্যম খুজে বেড়াচ্ছে।
-বিষয়টি অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া, যে অন্তর বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لَقَلْبُ ابْنِ آدَمَ أَشَدُّ انْقِلَابًا مِنَ الْقِدْرِ إِذَا اجْتَمَعَتْ غَلْيًا»
“আদম সন্তানের অন্তর পাতিলে থাকা ফুটন্ত ও টগবগ করা পানি থেকেও অধিক পবিবর্তন হয়, যখন তাতে উত্তাপ দেওয়া হয়”।  
অপর একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে বলেন,
«إِنَّمَا سُمِّيَ الْقَلْبُ مِنْ تَقَلُّبِهِ، إِنَّمَا مَثَلُ الْقَلْبِ كَمَثَلِ رِيشَةٍ مُعَلَّقَةٍ فِي أَصْلِ شَجَرَةٍ تُقَلِّبُهَا الرِّيحُ ظَهْرًا لِبَطْنٍ»
“কলবকে কলব করে নাম রাখার কারণ, তা অনবরত পরিবর্তন হয়। আর ক্বলবের দৃষ্টান্ত হলো ঐ পাখির পালকের মতো, যা একটি গাছের মূলের সাথে ঝুলছে। প্রবল বাতাস তাকে এদিক সেদিক উলট-পালট করছে”।  
কোনো এক কবি বলেছেন,     
وما سمي الإنسان إلا لنسيانه   ولا القلب إلا أنه يتقلب
“ইনসানকে ইনসান (যা নিসয়ান থেকে নির্গত। অর্থ ভুলে যাওয়া) বলা হয় তার ভুলে যাওয়ার কারণে। আর কলবকে কলব (অর্থ পরিবর্তন হওয়া) বলে নাম রাখা হয় তা পরিবর্তন হওয়ার কারণে”।
সন্দেহ, সংশয় ও প্রবৃত্তির প্রবল বাতাসের ধাক্কাকে উপেক্ষা করে এ টলমল ও পরিবর্তনশীল অন্তরের অটল ও অবিচল থাকা অবশ্যই একটি সমস্যাসঙ্কুল বিষয়। ফলে এ প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করার জন্য এমন কতক শক্তিশালী উপকরণ ও মজবুত মাধ্যম প্রয়োজন যা এ কঠিন ধাক্কা ও মহা প্রলয়কে প্রতিহত করতে এবং সামাল দিতে সক্ষম হবে।
অটল ও অবিচল থাকার উপায়-উপকরণ:
আমাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অপার অনুগ্রহ যে তিনি আমাদের জন্য তার অবতীর্ণ কিতাব আল-কুরআনুল কারীম এবং প্রেরিত নবীর জবান ও জীবন চরিত্রে অটল ও অবিচল থাকার অসংখ্য উপায় ও উপকরণ বর্ণনা করে দিয়েছেন। সম্মানিত পাঠক ভাইগণ, নিম্নে আমি তা থেকে কয়েকটি উপায় ও উপকরণ আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।
প্রথমত: কুরআনমূখী হওয়া
মহা গ্রন্থ আল-কুরআনই হলো, দীনের ওপর অটল ও অবিচল থাকার প্রথম উপায় ও মাধ্যম। কুরআন আল্লাহ তা‘আলা মজবুত রশি এবং সু-স্পষ্ট আলোকবর্তিকা। যে ব্যক্তি কুরআনকে মজবুত করে আঁকড়ে ধরবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে অবশ্যই রক্ষা করবেন। আর যে কুরআনের অনুসরণ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে নাজাত ও মুক্তি দিবেন এবং যে কুরআনের প্রতি মানুষকে আহ্বান করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে সঠিক ও সত্য পথ -সীরাতে মুস্তাকীমের সন্ধান দিবেন।
আল্লাহ তা‘আলা যে উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে এ কিতাবকে ভিন্ন ভিন্নভাবে বিস্তারিত বর্ণনাসহ নাযিল করেন তা তিনি স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। আর তা হলো অন্তরকে অটল ও অবিচল রাখা। আল্লাহ তা‘আলা কাফিরদের সন্দেহ ও সংশয়ের উত্তর দিতে গিয়ে বলেন,
﴿وَقَالَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ لَوۡلَا نُزِّلَ عَلَيۡهِ ٱلۡقُرۡءَانُ جُمۡلَةٗ وَٰحِدَةٗۚ كَذَٰلِكَ لِنُثَبِّتَ بِهِۦ فُؤَادَكَۖ وَرَتَّلۡنَٰهُ تَرۡتِيلٗا ٣٢ وَلَا يَأۡتُونَكَ بِمَثَلٍ إِلَّا جِئۡنَٰكَ بِٱلۡحَقِّ وَأَحۡسَنَ تَفۡسِيرًا ٣٣﴾ [الفرقان: ٣٢،  ٣٣]   
“আর কাফিররা বলে, ‘তার ওপর পুরো কুরআন একসাথে কেন নাযিল করা হলো না? এটা এজন্য যে, আমরা এর মাধ্যমে আপনার হৃদয়কে সুদৃঢ় করব। আর আমরা তা আবৃত্তি করেছি ধীরে ধীরে। আর তারা আপনার কাছে যে কোনো বিষয়ই নিয়ে আসুক না কেন, আমরা এর সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা আপনার কাছে নিয়ে এসেছি” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৩২, ৩৩]
কুরআন সুদৃঢ়, অটল ও অবিচলতার প্রাণকেন্দ্র হওয়ার কারণ কী?
-কারণ, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে কুরআন মানুষের অন্তরে ঈমানের বীজ বপন করে এবং মানব আত্মাকে পবিত্র করে।
-কারণ, একজন মু’মিনের অন্তরের ওপর কুরআনের আয়াতসমূহ প্রশান্তি ও নিরাপত্তা নাযিল করে। ফলে ফিতনার বাতাস যতই ভারী ও শক্তিশালী হোক না কেন তা আত্মাকে কলুষিত করতে পারে না এবং ধ্বংসের গহ্বরের নিক্ষেপ করতে পারে না। আর তার অন্তর আল্লাহ তা‘আলা যিকির দ্বারা প্রশান্তি ও তৃপ্তি লাভ করে।
-কারণ, কুরআনে কারীম একজন মুসলিমকে সু-চিন্তা করা ও সঠিক মূল্যায়ন করার যোগ্যতা প্রদান করে; যার দ্বারা সে তার আশপাশের পরিবেশ ও পরিস্থিতি যথাযথভাবে সামাল দিতে সক্ষম হয়। অনুরূপভাবে তাকে এমন মানদণ্ড ও মাপকাঠির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়, যদ্বারা যাবতীয় বিষয়গুলোর ফায়সালা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা হয়। ফলে তার সিদ্ধান্তের নড়চড় হয় না ব্যক্তি ও প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলেও তার কথা ও কর্মের মধ্যে পরিবর্তন এবং বিরোধ বা বৈপরীত্য দেখা যায় না।
ইসলামের শত্রু কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকরা ইসলামের ওপর যেসব সন্দেহ, সংশয় ও আপত্তি আরোপ করে থাকে, তার বিপক্ষে জীবন্ত দৃষ্টান্ত উপস্থাপন ও দলীল প্রমাণের মাধ্যমে তা এমনভাবে প্রতিহত করে, যেমনটি প্রথম যুগের লোকেরা প্রতিহত করতেন। নিম্নে এর কিছু দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা হলো:
১- যখন মুশরিকরা বললো, (ودع محمد ...) মুহাম্মাদকে (তার রব্ব) ছেড়ে দিয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার কথা-
﴿مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَمَا قَلَىٰ ٣﴾ [الضحى: ٣]   
“আপনার রব আপনাকে পরিত্যাগ করেন নি এবং ঘৃণাও করেন নি” – এর প্রভাব কী পরিমাণ ছিল?  
২- অনুরূপ যখন মুশরিকরা বলল, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে কুরআন তো একজন মানুষ শেখান। মক্কায় অবস্থানকারী একজন কাঠ মিস্ত্রি থেকে সে কুরআন সংগ্রহ করে থাকে। কাঠমিস্ত্রিই তাকে কুরআন শেখায়।  তখন আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
﴿وَلَقَدۡ نَعۡلَمُ أَنَّهُمۡ يَقُولُونَ إِنَّمَا يُعَلِّمُهُۥ بَشَرٞۗ لِّسَانُ ٱلَّذِي يُلۡحِدُونَ إِلَيۡهِ أَعۡجَمِيّٞ وَهَٰذَا لِسَانٌ عَرَبِيّٞ مُّبِينٌ ١٠٣﴾ [النحل: ١٠٣]  
“আর আমরা অবশ্যই জানি যে, তারা বলে, তাকে তো শিক্ষা দেয় একজন মানুষ, যার দিকে তারা ঈঙ্গিত করছে, তার ভাষা হচ্ছে অনারবী। অথচ এটা হচ্ছে সুস্পষ্ট আরবী ভাষা” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১০৩] -এর প্রভাব কেমন ছিল?
৩- অনুরূপভাবে যখন মুনাফিকরা বলল, “আমাকে অনুমতি দাও ফিতনায় ফেলো না।” তখন মুমিনদের অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার বাণী, ألا في الفتنة سقطوا   “শুনে রাখ, তারা ফিতনাতেই পড়ে আছে” – এর প্রভাব কতইনা সুদূরপ্রসারী ছিল?
একি অবিচলতার ওপর অবিচলতা নয়? এবং মুমিনদের অন্তরের ওপর স্রষ্টপ্রদত্ত দৃঢ়তা নয়? বিভিন্ন আপত্তি ও সন্দেহের ওপর দাঁতভাঙ্গা জওয়াব এবং বাতিলপন্থীদের নিরুত্তর করা নয়...? হ্যাঁ অবশ্যই, আল্লাহর কসম তা অবশ্যই সে রকম।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, আল্লাহ তা‘আলা হুদাইবিয়ার যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় মুমিনদেরকে অনেক গণীমত লাভের ওয়াদা দেন। (বস্তুত তা ছিল খাইয়বারের গনীমতের মাল) আরও ওয়াদা করেন যে, তিনি তা তাদের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা করবেন এবং তারা সেদিকে অগ্রসর হবে বলে জানিয়েও দেওয়া হয়, অন্য কেউ নয়, আরও জানিয়ে দেওয়া হয় যে, মুনাফিকরা বার বার তাদের সাথী হওয়ার আব্দার করতে থাকবে, আল্লাহর বাণীকে তারা পরিবর্তন করতে চাইবে এবং তারা মু’মিনদের বলবে বরং তোমরা আমাদের হিংসা করছ। আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথার উত্তর দিয়ে বলেন,
﴿بَلۡ كَانُواْ لَا يَفۡقَهُونَ إِلَّا قَلِيلٗا ١٥﴾ [الفتح: ١٥]   
“বরং তারা খুব কমই বুঝে”। অতঃপর মু’মিনদের সামনে এ সব ঘটনা একের পর এক, অক্ষরে অক্ষরে ও পদে পদে সংঘটিত হতে থাকে। (তখন তাদের মনের অবস্থা কি হয়েছিত তা একবার ভেবে দেখুন?)
-এ দ্বারা পার্থক্য ও ব্যবধান জানা যায়, যারা তাদের নিজের জীবনকে কুরআনের সাথে সম্পৃক্ত করে, কুরআনকে মুখস্থ করে, কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষনে মগ্ন থাকে এবং কুরআন নিয়ে গবেষণা করে, কুরআনের পথে চলে এবং কুরআনের দিকেই ফিরে আসে তাদের মধ্যে আর যারা মানব রচিত কথাকে নিজেদের জীবনের মহা লক্ষ্য বানায় এবং তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
-যারা ইলম অন্বেষণ করে তারা যদি কুরআন ও তার তাফসীরের জন্য বড় একটি অংশ ব্যয় করত, তা তাদের আত্মার জন্য কতই না উপকারী ও ভালো হতো।
দ্বিতীয়ত: আল্লাহর দেওয়া শরী‘আত যথাযথ মেনে চলা ও নেক আমল করা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يُثَبِّتُ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱلۡقَوۡلِ ٱلثَّابِتِ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَفِي ٱلۡأٓخِرَةِۖ وَيُضِلُّ ٱللَّهُ ٱلظَّٰلِمِينَۚ وَيَفۡعَلُ ٱللَّهُ مَا يَشَآءُ ٢٧ ﴾ [ابراهيم: ٢٧]   
“আল্লাহ অবিচল রাখেন ঈমানদারদেরকে সুদৃঢ় বাণী দ্বারা দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে। আর আল্লাহ যালিমদের পথভ্রষ্ট করেন এবং আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন” [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ২৮]
-কাতাদাহ রহ. বলেন, আল্লাহ তাদের দুনিয়ার জীনবে ভালো ও কল্যাণের ওপর অটল, সুদৃঢ় ও অবিচল রাখবেন। আর আখিরাত অর্থাৎ কবরের মধ্যে তাদের কামিয়াবী দেবেন। একই কথা পূর্বসূরীদের একাধিক ব্যক্তি থেকেও বর্ণিত হয়েছে।  
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿وَلَوۡ أَنَّهُمۡ فَعَلُواْ مَا يُوعَظُونَ بِهِۦ لَكَانَ خَيۡرٗا لَّهُمۡ وَأَشَدَّ تَثۡبِيتٗا ٦٦﴾ [النساء : ٦٦]   
“আর যে উপদেশ তাদেরকে দেওয়া হয় যদি তারা তা বাস্তবায়ন করত, তাহলে সেটি হত তাদের জন্য উত্তম এবং স্থিরতায় সুদৃঢ়” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬৬] অর্থাৎ হকের ওপর সুদৃঢ়। এ কথা খুবই স্পষ্ট, অন্যথায় আমরা কি এ আশা করতে পারি যে, যারা অলস, নেক আমল করা থেকে বিরত থাকে তারা অবিচল থাকবে, যখন ফিতনা তাদের মাথায় আক্রমণ করবে। তবে যারা ঈমান এনেছে এবং আমলে সালেহ অবলম্বন করেন, তাদের রব তাদেরকে তাদের ঈমানের কারণে সঠিক পথ দেখাবেন, ঈমানের ওপর অটল ও অবিচল রাখবেন। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নেক আমলের ওপর অটল ও অবিচল থাকতে উৎসাহ প্রদান করতেন। আর তার নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল হলো, কোন আমল সব সময় করা, যদিও তা কম হয়। আর তার সাহাবীগণ যখন কোনো আমল করতেন, তখন তারা সে আমলটি ছাড়তেন না, অব্যাহত রাখতেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার অভ্যাস ছিল, যখন কোনো আমল একবার করতেন তখন তিনি তা পাবন্দির সাথে করতেন, ছাড়তেন না।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন,
 مَنْ ثَابَرَ عَلَى ثِنْتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً مِنَ السُّنَّةِ بَنَى اللَّهُ لَهُ بَيْتًا فِي الجَنَّةِ: ...  
“যে ব্যক্তি বারো রাকা‘আত সালাত সব সময় আদায় করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর বানাবেন...   
অনুরূপ হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَا يَزَالُ  عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ
“বান্দা সব সময় নফল ইবাদাতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকে, ফলে এক পর্যায়ে আমি তাকে মহব্বত করে ফেলি”।   
তৃতীয়: নবীদের জীবনী অনুযায়ী আমল ও তাদের অনুসরণ-অনুকরণ করার উদ্দেশ্যে তাদের জীবনী অধ্যয়ন ও গবেষণা করা
এর ওপর দলীল আল্লাহ তা‘আলার বাণী, তিনি বলেন,
﴿وَكُلّٗا نَّقُصُّ عَلَيۡكَ مِنۡ أَنۢبَآءِ ٱلرُّسُلِ مَا نُثَبِّتُ بِهِۦ فُؤَادَكَۚ وَجَآءَكَ فِي هَٰذِهِ ٱلۡحَقُّ وَمَوۡعِظَةٞ وَذِكۡرَىٰ لِلۡمُؤۡمِنِينَ ١٢٠﴾ [هود: ١٢٠]   
“আর রাসূলদের এ সকল সংবাদ আমরা আপনার কাছে বর্ণনা করছি যার দ্বারা আমরা আপনার মনকে স্থির করি আর এতে আপনার কাছে এসেছে সত্য এবং মুমিনদের জন্য উপদেশ ও স্মরণ”। [সূরা হূদ, আয়াত: ১২০]
উল্লিখিত আয়াতগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে খেলা-ধুলা করা ও মজা নেওয়ার জন্য নাযিল হয় নি। এগুলো একটি মহান উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছে। আর তা হলো, আল্লাহর রাসূলের অন্তর ও মুমিনদের অন্তরসমূহকে সুদৃঢ়, অটল ও অবিচল রাখা।
-হে আমার ভাইয়েরা যদি তুমি আল্লাহর বাণী,
 ﴿قَالُواْ حَرِّقُوهُ وَٱنصُرُوٓاْ ءَالِهَتَكُمۡ إِن كُنتُمۡ فَٰعِلِينَ ٦٨ قُلۡنَا يَٰنَارُ كُونِي بَرۡدٗا وَسَلَٰمًا عَلَىٰٓ إِبۡرَٰهِيمَ ٦٩ وَأَرَادُواْ بِهِۦ كَيۡدٗا فَجَعَلۡنَٰهُمُ ٱلۡأَخۡسَرِينَ ٧٠ ﴾ [الانبياء: ٦٨،  ٧٠]
“তারা বলল, ‘তাকে আগুনে পুড়িয়ে দাও এবং তোমাদের দেবদেবীদেরকে সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও’। আমি বললাম, ‘হে আগুন, তুমি শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও ইবরাহীমের জন্য’। আর তারা তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছিল; কিন্তু আমি তাদেরকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৬৮-৭০] এ বাণীর বিষয়ে চিন্তা-ফিকির কর, তবে তুমি অবশ্যই দৃঢ়তা ও অবিচলতার স্বাদ অনুভব করতে পারবে। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয় তখন তার শেষ কথা ছিল।حسبي الله و نعم الوكيل  “আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট তিনি আমার জন্য কতইনা উত্তম অভিভাবক”।
যালেম, হঠকারী ও অত্যাচারীর সামনে এবং শাস্তির সম্মুখে অবস্থান করার সময় তুমি আয়াতটির মধ্যে চিন্তা করতে থাকলে, তুমি কি তখন অটল ও অবিচল থাকার বিভিন্ন অর্থ থেকে একটি অর্থ অনুভব করতে পারবে না?
অনুরূপ মূসা আলাইহিস সালামের জীবনী সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
﴿فَلَمَّا تَرَٰٓءَا ٱلۡجَمۡعَانِ قَالَ أَصۡحَٰبُ مُوسَىٰٓ إِنَّا لَمُدۡرَكُونَ ٦١ قَالَ كَلَّآۖ إِنَّ مَعِيَ رَبِّي سَيَهۡدِينِ ٦٢﴾ [الشعراء : ٦١،  ٦٢]   
“অতঃপর যখন উভয় দল পরস্পরকে দেখল, তখন মূসার সাথীরা বলল, অবশ্যই ‘আমরা ধরা পড়ে গেলাম!’ মূসা বলল, ‘কখনো নয়; আমার সাথে আমার রব রয়েছেন। নিশ্চয় অচিরেই তিনি আমাকে পথনির্দেশ দেবেন’’ [সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ৬১,৬২]- এ বাণীতে চিন্তা করলে, তুমি কি তোমার সন্ধানকারীদের হাতে ধরা পড়ার সময় অটল ও অবিচল থাকার আরেকটি অর্থ অনুভব করতে পারবে না?। বিপদ মুহুর্তে যখন সবাই হতাশ হয়ে (বাচাও বাচাও বলে) চিৎকার করতে থাকে, আর ঠিক সে কঠিন মূহুর্তে মূসা আলাইহিস সালামের অটল ও অবিচলতা যা এ ঘটনার মধ্যে ফুটে উঠছে। এ ব্যাপারটি নিয়ে তুমি কীভাবে চিন্তা ফিকির করছ?
তদ্রূপ তুমি যখন ফির‘আউনের জাদুকরদের ঘটনাকে তোমার সামনে নিয়ে আসবে যে ঘটনাটির দৃষ্টান্ত খুবই আশ্চর্যপূর্ণ। যে ঘটনার মধ্যে দেখা যাচ্ছে যে, হক ও সত্য স্পষ্ট হওয়ার পর জাদুকরগণ সত্য গ্রহণ করল এবং তার ওপর অটল ও অবিচল থাকল।
তুমি কি দেখ না? একজন অত্যাচারী জালেমের হুমকির সামনে তাদের অন্তরে অটল ও অবিচলতার একটি মহা অধ্যায় প্রগাঢ় হয়ে গেঁথে আছে। আল্লাহ তা‘আলা তার বর্ণনায় বলেন,
﴿قَالَ ءَامَنتُمۡ لَهُۥ قَبۡلَ أَنۡ ءَاذَنَ لَكُمۡۖ إِنَّهُۥ لَكَبِيرُكُمُ ٱلَّذِي عَلَّمَكُمُ ٱلسِّحۡرَۖ فَلَأُقَطِّعَنَّ أَيۡدِيَكُمۡ وَأَرۡجُلَكُم مِّنۡ خِلَٰفٖ وَلَأُصَلِّبَنَّكُمۡ فِي جُذُوعِ ٱلنَّخۡلِ وَلَتَعۡلَمُنَّ أَيُّنَآ أَشَدُّ عَذَابٗا وَأَبۡقَىٰ ٧١﴾ [طه: ٧١]
“ফির‘আউন বলল, ‘কী, আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেওয়ার আগেই তোমরা তার প্রতি ঈমান আনলে? নিশ্চয় সে-ই তোমাদের প্রধান, যে তোমাদেরকে জাদু শিখিয়েছে। সুতরাং আমি অবশ্যই তোমাদের হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব এবং আমি তোমাদেরকে খেজুর গাছের কাণ্ডে শূলবিদ্ধ করবই। আর তোমরা অবশ্যই জানতে পারবে, আমাদের মধ্যে কার আযাব বেশী কঠোর এবং বেশী স্থায়ী”। গুটি কয়েক মুমিনের ঈমানের ওপর অটল ও অবিচল থাকার একটি বিরল দৃষ্টান্ত। শত হুমকি-ধমকি তাদেরকে বিন্দু পরিমাণও বিচ্যুত করতে পারেনি এবং তাদের ফিরিয়ে আনতে পারে নি। তারা হুমকি-ধমকির মুখে বলতে থাকে (কুরআনে তাদের কথা তুলে ধরে) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  
﴿قَالُواْ لَن نُّؤۡثِرَكَ عَلَىٰ مَا جَآءَنَا مِنَ ٱلۡبَيِّنَٰتِ وَٱلَّذِي فَطَرَنَاۖ فَٱقۡضِ مَآ أَنتَ قَاضٍۖ إِنَّمَا تَقۡضِي هَٰذِهِ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَآ ٧٢﴾ [طه: ٧٢]   
“তারা বলল, ‘আমাদের নিকট যে সকল স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে এবং যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তার উপর আমরা তোমাকে কিছুতেই প্রাধান্য দেব না। সুতরাং তুমি যা ফয়সালা করতে চাও, তাই করো। তুমিতো কেবল এ দুনিয়ার জীবনের উপর কর্তৃত্ব করতে পার’’ [সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ৭২]
অনুরূপভাবে সূরা ইয়াসীনে অপর একজন মুমিনের ঘটনা, ফির‘আউনের পরিবারের মুমিন ব্যক্তির ঘটনা, আসহাবে উখদূদের ঘটনা ইত্যাদি। এ সব ঘটনা অধ্যয়ন করলে বুঝা যায় অটল অবিচল থাকার মহত্ব এবং শিক্ষণীয় বিষয়গুলো কতটা অকাট্য এবং আত্মার জন্য তৃপ্তিদায়ক।
চতুর্থ: দো‘আ করা
আল্লাহর মুমিন বান্দাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, আল্লাহ তা‘আলা যেন তাদের অটল ও অবিচল রাখেন সে জন্য তারা দো‘আর মাধ্যমে আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়েন। তারা তাদের দো‘আয় বলতেন,
﴿رَبَّنَا لَا تُزِغۡ قُلُوبَنَا بَعۡدَ إِذۡ هَدَيۡتَنَا وَهَبۡ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحۡمَةًۚ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡوَهَّابُ ٨﴾ [ال عمران: ٨]   
“হে আমাদের রব, আপনি হিদায়াত দেওয়ার পর আমাদের অন্তরসমূহ বক্র করবেন না এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহাদাতা।” [সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ৮]
আরো বলতেন,
﴿رَبَّنَآ أَفۡرِغۡ عَلَيۡنَا صَبۡرٗا وَثَبِّتۡ أَقۡدَامَنَا وَٱنصُرۡنَا عَلَى ٱلۡقَوۡمِ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٢٥٠﴾ [البقرة: ٢٥٠]   
‘‘হে আমাদের রব, আমাদের ওপর ধৈর্য ঢেলে দিন, আমাদের পা স্থির রাখুন এবং আমাদেরকে কাফের জাতির বিরুদ্ধে সাহায্য করুন’ [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৫০] যেহেতু অন্তর আল্লাহর হাতে; যেমনটি হাদীসে বর্ণিত, রাসূলু্ল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
 «إِنَّ قُلُوبَ بَنِي آدَمَ كُلَّهَا بَيْنَ إِصْبَعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ الرَّحْمَنِ، كَقَلْبٍ وَاحِدٍ، يُصَرِّفُهُ حَيْثُ يَشَاءُ»
“আদম সন্তানের অন্তরসমূহ সবই রহমানের আঙ্গুলসমূহের দুটি আঙ্গুলের মাঝখানে একটি অন্তরের মতো। তিনি যে দিকে চান পরিবর্তন করে দেন”। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি বেশি এ দো‘আ করতেন:
«يَا مُقَلِّبَ القُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ»  
“হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী, আপনি আমার অন্তরকে আপনার দীনের ওপর অবিচল রাখুন”।
পঞ্চম: আল্লাহর যিকির
এটি অটল ও অবিচল থাকার গুরুত্বপূর্ণ ও বড় মাধ্যম
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারীমে দুটি বিষয় অর্থাৎ ‘আল্লাহর যিকির এবং অবিচল থাকা’ এ দু’টি বিষয়কে একত্রে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এ বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা, ফিকির ও গবেষণা কর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
 ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا لَقِيتُمۡ فِئَةٗ فَٱثۡبُتُواْ وَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ كَثِيرٗا لَّعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٤٥﴾ [الانفال: ٤٥]  
“হে মুমিনগণ, যখন তোমরা কোনো দলের মুখোমুখি হও, তখন অবিচল থাক, আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হও” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪৫] এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তার যিকির করাকে জিহাদের মাঠে অটল ও অবিচল থাকার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম সাব্যস্ত করেছেন।
আর “তুমি ফারস্য ও রোমবাসীদের দেহের বিষয়ে চিন্তা কর, কীভাবে তাদের দেহ তাদের সাথে খিয়ানত করল (ঐ সময় যখন তারা নিজেদের দেহের প্রতি সবচেয়ে বেশি মুখাপেক্ষী)” । অথচ যারা বেশি বেশি আল্লাহর যিকিরকারী তাদের সংখ্যা নগণ্য এবং তাদের যুদ্ধের সরঞ্জাম অপ্রতুল। (তা সত্বেও তারা বিজয়ী হয় )
-একজন রুপবতী, ক্ষমতাধর ও যুবতী নারী যখন ইউসূফ আলাইহিস সালামকে তার সাথে অপকর্মের প্রতি আহ্বান করে এমন একটি কঠিন পরীক্ষা ও ফিতনার মূহুর্তে তিনি অবিচল থাকার জন্য কিসের দ্বারা সাহায্য চেয়েছিলেন? (তা একটু ভেবে দেখ)। তিনি কি ‘আল্লাহর আশ্রয় কামনা’ এর দূর্গে প্রবেশ করেন নি? অবশ্যই প্রবেশ করেছেন। ফলে তার দূর্গের দেয়ালে অবস্থানকারী প্রবৃত্তির সমস্ত সৈন্যের বাঁধ ও প্রাচীর ভেঙ্গে যায় এবং তা চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে পড়ে যায়।
আর মুমিনদের অবিচল ও সুদৃঢ় রাখার ক্ষেত্রে যিকিরের প্রভাব ও ক্রিয়া এমনই হয়ে থাকে।
ষষ্ট: একজন মুসলিম সহীহ পথে চলার প্রতি আগ্রহী হওয়া
একমাত্র বিশুদ্ধ ও সঠিক পথ যার ওপর একজন মুসলিমের চলা ওয়াজিব, তা হলো, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পথ, সাহায্য প্রাপ্ত দলের পথ এবং নাজাতপ্রাপ্ত দলের পথ। তারাই পরিস্কার ও নীরেট আকীদার অধিকারী, নির্ভুল মানহাজের ধারক-বাহক, সুন্নাহ ও দলীলের অনুসারী, আল্লাহর শত্রুদের থেকে পৃথক এবং আহলে বাতিলদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
অটল ও অবিচল থাকার ক্ষেত্রে এর মূল্য কত তা যদি জানতে চাও, তুমি চিন্তা কর, তুমি তোমাকে জিজ্ঞাসা কর, পূর্বসূরি ও তাদের পরবর্তীদের অধিকাংশ লোক কেন গোমরাহ হলো? তারা কেন দিশেহারা হয়েছিল? এবং তারা কেন সঠিক পথ -সীরাতে মুস্তাকীমের ওপর অটল ও অবিচল থাকতে পারলো না এবং সঠিক পথের ওপর মারা যেতে পারলো না? অথবা জীবনের বড় একটি অংশ অতিবাহিত করার পর অথবা তাদের জীবন থেকে মহা মূল্যবান সময় নষ্ট করার পর তারা কেন সঠিক পথের সন্ধান পেল এবং তার ওপর চলা আরম্ভ করল?
তুমি দেখতে পাবে তাদের কেউ কেউ বিদ‘আত ও ভ্রষ্টতার বিবিধ সোপান যেমন দর্শনশাস্ত্র থেকে শুরু করে কালামশাস্ত্র, মু‘তাযিলা মতবাদ পেরিয়ে বিকৃতকারী, অপব্যাখ্যাকারী, অর্থহীন গণ্যকারী, মুরজিয়া মতবাদে বিশ্বাসীতে পরিণত হয়েছে। আবার তাদের কেউ কেউ সূফীবাদীদের এক তরীকা থেকে আরেক তরীকায় উপনীত হয়েছে।
অনুরূপভাবে বিদ‘আতপন্থীরাও আজ বিভ্রান্ত ও দিশেহারা। দেখ, কালামপন্থীরা কীভাবে মৃত্যুর সময় অবিচল থাকা থেকে বঞ্চিত হয়। পূর্বসূরি সালাফগণ বলেন, মৃত্যুর সময় সবচেয়ে বেশি সন্দেহে থাকেন কালামশাস্ত্রবিদরা। অপর দিকে তুমি দেখ এবং গভীরভাবে চিন্তা কর, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পথকে বুঝা, জানা ও তার ওপর চলার পর কেউ অসন্তুষ্ট হয়ে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কিনা? প্রবৃত্তি পূজা, জ্ঞানের দুর্বলতা ও কু-প্রবৃত্তির প্রভাবে কেউ হয়ত তা ছাড়তে পারে অন্যথায় এ কারণে কেউ এ পথ ছাড়ে না যে, সে এ থেকে অধিক সহীহ বিশুদ্ধ ও সঠিক পথ পেয়েছে বা তার নিকট এ পথ বাতিল হওয়া স্পষ্ট হয়েছে।
আর এ কথা যে সঠিক তার প্রমাণ পাবে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসারীদের বিষয়ে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের জিজ্ঞেস করার পর আবু সুফিয়ানের উত্তর থেকে। হিরাক্লিয়াস আবূ সুফিয়ানকে বলল,
 سَأَلْتُكَ هَلْ يَزِيدُونَ أَمْ يَنْقُصُونَ؟ فَزَعَمْتَ أَنَّهُمْ يَزِيدُونَ، وَكَذَلِكَ الإِيمَانُ حَتَّى يَتِمَّ، وَسَأَلْتُكَ هَلْ يَرْتَدُّ أَحَدٌ سَخْطَةً لِدِينِهِ بَعْدَ أَنْ يَدْخُلَ فِيهِ؟ فَزَعَمْتَ أَنْ لاَ، وَكَذَلِكَ الإِيمَانُ، حِينَ تُخَالِطُ بَشَاشَتُهُ القُلُوبَ لاَ يَسْخَطُهُ أَحَدٌ "
“আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তাদের সংখ্যা কি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে নাকি কমছে? তুমি বললে, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঈমান পূর্ণতা লাভ করা পর্যন্ত এমনই হয়ে থাকে। আর আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তাদের কেউ দীনের মধ্যে প্রবেশ করার পর দীনের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে আসে কিনা? উত্তরে আবূ সুফিয়ান বলল, না। তারপর হিরাক্লিয়াস বলল, ঈমান এমনই হয়ে থাকে, যখন ঈমানের সৌন্দর্য অন্তরসমূহকে স্পর্শ করে কেউ তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয় না”।  
আমরা বড় বড় অনেকের সম্পর্কে শুনেছি তারা বিদ‘আতের শাখা-প্রশাখা ও বিভিন্ন অবস্থানে ঘুরে বেড়িয়েছে তারপর তাদের কতককে আল্লাহ তা‘আলা সঠিক পথ দেখান, ফলে তাদের পূর্বের মাযহাবের প্রতি বিরক্ত হয়ে বাতিল ও গোমরাহী ছেড়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাবের অনুসারী হয়ে যায়; কিন্তু তার উল্টোটি কি তোমরা কখনো শুনেছ?
সুতরাং যদি তুমি হকের ওপর অটল ও অবিচল থাকতে চাও, তবে তোমাকে অবশ্যই মুমিনদের পথ আঁকড়ে ধরতে হবে।
সপ্তম: তারবিয়ত বা সঠিক লালন-পালন
ঈমানী, ইলমী, সদাজাগ্রত ও ধারাবাহিক তারবিয়ত দীনের ওপর অটল ও অবিচল থাকার কার্যকর মাধ্যমসমূহ থেকে মৌলিক একটি কার্যকর বিষয়।
ঈমানী তারবিয়ত: এ দ্বারা আত্মা ও অন্তর ভয়, আশা ও মহব্বত দ্বারা জীবন্ত থাকে। এটি কুরআন ও সূন্নাহ থেকে দূরে থাকা এবং মানুষের কথা-বার্তার সামনে অবস্থানের ফলে অন্তরে যে শুস্কতা ও কাঠিন্যতা তৈরি হয় তা দূর করে।
ইলমী তারবিয়ত: এটি সহীহ ও বিশুদ্ধ দলীলের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যা অন্ধ অনুকরণ ও নিন্দিত অর্বাচিনতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
সদাজাগ্রত তারবিয়ত: যার দ্বারা অপরাধীদের পথ তুমি জানতে পারবে, ইসলামের শত্রুদের পরিকল্পনা ও টার্গেটগুলো নির্ণয় করতে পারবে এবং বাস্তবতাকে উপলব্ধি করবে এবং ঘটনাবলীকে বুঝতে এবং মূল্যায়ন করতে পারবে। এটি চিন্তাগত বদ্ধতা ও নিজেকে ছোট পরিবেশের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকা থেকে মুক্ত রাখবে।
ধারাবাহিক তারবিয়ত: যাতে একজন মুসলিম ধীরে ধীরে চলা আরম্ভ করে। মূল্যবান পরিকল্পনা ও টার্গেট নির্ধারণের মাধ্যমে একজন মুসলিম পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ সোপানগুলো অতিক্রম করতে পারে।
আর আল্লাহর দীনের ওপর অটল ও অবিচল থাকার মাধ্যমসমূহ হতে এ মাধ্যমটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হলে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাতের দিকে ফিরে দেখবো এবং আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করবো:
-কঠিন ও দু্র্যোগপূর্ণ মুহুর্তে মক্কায় রাসূলের সাহাবীদের অটল ও অবিচল থাকার উৎস কি ছিল?
সাহাবীগণের অটল ও অবিচল থাকা নবুওয়াতের প্রশিক্ষণশালা থেকে গভীর ও নিবিড় প্রশিক্ষণ ছাড়া কি সম্ভব হয়েছে? যার ফলে তাদের ব্যক্তিত্ব কলুষমুক্ত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে গেছে।
দৃষ্টান্ত হিসেবে একজন সাহাবীর কথাই এখানে উল্লেখ করব। তিনি হলেন, খাব্বাব ইবনুল আরাত রাদিয়াল্লাহু আনহু। তার মহিলা মুনীব লোহার টুকরোগুলো গরম করত যখন সেগুলো লাল হয়ে যেতো তখন তাকে এ উত্তপ্ত লোহার লাল আগুনে খালি গায়ে নিক্ষেপ করত, ঐ উত্তপ্ত আগুন খাব্বাবের দেহের রক্ত, পুঁজ ও প্রবাহিত চর্বি দ্বারাই নিবতো। কোন বস্তু তাকে এমন বানালো যে, তিনি এতসব কষ্ট ও নির্যাতনের ওপর ধৈর্য ধারণ করলেন?
আর বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু মরুভূমির বালুর মধ্যে পাথরের নিচে ধৈর্যধারণ করেছে? আর সুমাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু শিকল ও কড়া পরিহিত অবস্থায় বন্দী ছিল?। কীসে তাদেরকে ধৈর্যধারণ করার প্রতি প্রতিজ্ঞ করে তুলল?
মাদানী জীবনের আরেকটি নমূনা পেশ করা যেতে পারে, হুনাইনের যুদ্ধে কিসের কারণে কোনো কোনো সাহাবী রাসূলের সাথে অটল ও অবিচল ছিলেন? তারা কি ছিল মক্কা বিজয়ের পরে ইসলাম গ্রহণ করা নও মুসলিমরা? যারা তারবিয়াত গ্রহণের যথার্থ সময় পায় নি। যাদের অনেকেই গনীমতের আশায় সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। কখনও নয়, অধিকাংশ সে বাছাইকৃত মুমিন লোকেরাই রাসূলের সাথে অবিচল ও অটল ছিল যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে তারবিয়াত নিয়েছিলেন।
যদি সে তারবিয়াত তারা না পেতো তবে কি তারা সে কঠিন মুহূর্তে অটল থাকতে পারতো?     
অষ্টম: সঠিক পথের প্রতি আত্মবিশ্বাস
একজন মুসলিম যে পথে চলে সে পথের প্রতি তার আত্মবিশ্বাস যত বেশি হবে, তার অবিচলতা ও দৃঢ়তাও ততবেশি বৃদ্ধি পাবে। এর জন্য একাধিক মাধ্যম ও উপকরণ রয়েছে:
এ অনুভূতি জাগ্রত করা যে, সীরাতে মুস্তাকীম, যার অনুসরণ তুমি করছ -হে ভাই -তা নতুন কিছু নয়, তোমার যুগ বা সময়ের কোনো নতুন আবিষ্কার বা অপরিচিত কোনো পথ বা পদ্ধতি নয় বরং এটি একটি সনাতন ও চিরন্তন পথ যে পথের ওপর তোমার পূর্বের অসংখ্য নবী, রাসূল, সিদ্দীক, আলেম, শহীদ, ও নেক বান্দাগণ প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। যখন তোমার মধ্যে এ অনুভুতি ও বিশ্বাস থাকবে, তখন তোমার আতঙ্ক কেটে যাবে, তোমার নিঃসঙ্গতা ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হবে এবং তোমার দুঃখ আনন্দ ও খুশিতে পরিবর্তন হবে। কারণ, তুমি এ কথা জান যে, তারা সবাই তোমার ভাই, তোমরা সবাই একই পথের যাত্রী ও পথিক, তোমাদের গন্তব্য এক ও অভিন্ন
-তুমি যে পথ চলছো তা একটি মনোনীত ও পরীক্ষিত পথ এ কথার অনুভুতিও তোমার মধ্যে থাকা চাই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
 ﴿الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى﴾ [النمل: ٥٩]  
“বল, ‘সকল প্রশংসাই আল্লাহর নিমিত্তে। আর শান্তি তাঁর বান্দাদের প্রতি যাদের তিনি মনোনীত করেছেন” [সূরা আন-নামাল, আয়াত: ৫৯]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
 ﴿ثُمَّ أَوۡرَثۡنَا ٱلۡكِتَٰبَ ٱلَّذِينَ ٱصۡطَفَيۡنَا مِنۡ عِبَادِنَاۖ ٣٢﴾ [فاطر: ٣٢]  
“অতঃপর আমরা এ কিতাবটির উত্তরাধিকারী করেছি আমাদের বান্দাদের মধ্যে তাদেরকে, যাদেরকে আমরা মনোনীত করেছি” [সূরা ফাতির, আয়াত: ৩২]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
 ﴿وَكَذَٰلِكَ يَجۡتَبِيكَ رَبُّكَ وَيُعَلِّمُكَ مِن تَأۡوِيلِ ٱلۡأَحَادِيثِ ٦﴾ [يوسف: ٦]  
“আর এভাবে তোমার রব তোমাকে মনোনীত করবেন এবং তোমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দেবেন” [সূরা ইউসূফ, আয়াত: ৬]
যেমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা নবীদের নির্বাচিত ও মনোনীত করেছেন অনুরূপভাবে নেকবান্দাদের জন্য ঐ মনোনয়ন ও নির্বাচন থেকে কিছু অংশ রেখে দিয়েছেন। আর তা হলো, নবীদের ইলমের ধারাবাহিকতা যা তারা তাদের উত্তরসূরীদের জন্য রেখে গিয়েছেন।
-যদি আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে জড় পদার্থ অথবা চতুষ্পদ জন্তু অথবা কাফির বা নাস্তিক বানাতেন অথবা বিদ‘আতের দিক আহ্বানকারী বা ফাসিক বা এমন মুসলিম বানাতেন যে ইসলামের প্রতি আহ্বানকারী নয় অথবা এমন পথের প্রতি আহ্বানকারী বানাতেন যে পথ ভুলে ভরা— বাতিল পন্থীদের পথ, তাহলে তোমার কাছে কেমন লাগত? তখন তোমার অনুভূতি কি হতো?
-আল্লাহ তা‘আলা যে তোমাকে এ পথের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি যে তোমাকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের একজন দা‘ঈ বানিয়েছেন এ কথার অনুভূতিই তোমার জন্য যথেষ্ট। এ অনুভূতি তোমাকে তোমার আদর্শ ও পথের ওপর অটল, অবিচল ও দৃঢ় থাকার যে অন্যতম মাধ্যম তা কি তুমি জান না?  
নবম: আল্লাহর দীনের প্রতি দাওয়াত দেওয়ার সাথে সম্পৃক্ত থাকা
মনে রাখবে আত্মা যখন কর্মব্যস্ত না থাকে তখন তাতে পঁচন ধরে যায়। আর যখন তা চলাচল না করে এবং কর্মব্যস্ত না থাকে তখন তা অলস হয়ে যায় আর আত্মাকে সচল রাখার ক্ষেত্রসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হল, আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়া। এটি নবীদের মিশন এবং মানবাত্মার আযাব ও শাস্তি থেকে নাজাত লাভের উপায়। দাওয়াতের দ্বারা ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং বড় বড় কর্মগুলো বাস্তবায়িত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَلِذَٰلِكَ فَٱدۡعُۖ وَٱسۡتَقِمۡ كَمَآ أُمِرۡتَۖ ١٥﴾ [الشورى: ١٥]   
“সুতরাং এজন্যই আপনি দাওয়াত দিন এবং আপনাকে যেমনটি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেভাবে দৃঢ়পদ থাকুন”। কোনো বস্তু সম্পর্কে এ কথা বলা কখনোই শুদ্ধ নয় যে, অমুক উন্নতিও লাভ করে না আবার অবনতিও না। কারণ, আত্মা যখন ইবাদতে ব্যস্ত না হবে, তখন অবশ্যই সে গুনাহে লিপ্ত হবে। আর ঈমান অবশ্যই বাড়ে আবার কমে।
বিশুদ্ধ মানহাজের প্রতি দাওয়াত, সময় ব্যয় করার মাধ্যমে, চিন্তা-ফিকির করার মাধ্যমে, দৈহিক পরিশ্রম করার মাধ্যমে এবং মুখ চালু রাখার মাধ্যমে দেওয়া শয়তানের গোমরাহ করা ও ফিতনায় ফেলার যাবতীয় পথকে রুদ্ধ করে দেয়। সুতরাং এমনভাবে দাওয়াত দেওয়া যাতে প্রমাণিত হয় যে, দাওয়াত দেওয়াই একজন মুসলিমে প্রধান লক্ষ্য ও একমাত্র ব্যস্ততা।
আরো বাড়িয়ে বলা যায়, যে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা দ্বারা যে কোনো প্রকারের বাধা বিপত্তি মুকাবেলা করা, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা ও বাতিলপন্থীদের যে কোন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মত শক্তি লাভের অনুভূতি ও বিশ্বাস একজন দা‘ঈর অন্তরে সৃষ্টি হয়। এর ফলে সে তার দাওয়াতী ময়দানে নির্ভীকভাবে চলতে পারে। ফলে তা ঈমানী শক্তিতে উন্নতি হয় এবং এ দ্বারা ঈমানের রুকনসমূহ শক্তিশালী হয়।
তখন আল্লাহর দিকে আহ্বান করা মহা সাওয়াবের লাভের কারণ হওয়ার সাথে সাথে তা সুদৃঢ়, অটল ও অবিচল থাকার মাধ্যমসমূহের একটি অন্যতম মাধ্যম এবং সিদ্ধান্তহীন ও পশ্চাতপদতা থেকে রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ বলে বিবেচিত হয়। কারণ, যিনি দাওয়াতের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার আত্মরক্ষার প্রয়োজন হয় না। আল্লাহ তা‘আলা দা‘ঈদের সাথেই রয়েছেন। তিনি তাদের অবিচলতা ও দৃঢ়তা প্রদান করেন এবং তাদের ভুলগুলোকে সংশোধন করে দেন। একজন দা‘ঈ সে একজন ডাক্তারের মতো। সে তার অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ও জ্ঞান দ্বারা রোগের সাথে সংগ্রাম করে। অন্যদের বিষয়ে সংগ্রাম করার কারণে সে নিজে তাতে লিপ্ত হওয়া বা আক্রান্ত হওয়া থেকে অনেক দূরে থাকে এবং অনেকটাই নিরাপদে অবস্থান করে।
দশম: বাস্তব ও প্রমাণিত উপাদানগুলোর সাথে সম্পৃক্ত থাকা
ঐ সব উপাদান যার বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ সম্পর্কে আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন, তিনি বলেন,
«إِنَّ مِنَ النَّاسِ مَفَاتِيحَ لِلْخَيْرِ، مَغَالِيقَ لِلشَّرِّ، وَإِنَّ مِنَ النَّاسِ مَفَاتِيحَ لِلشَّرِّ مَغَالِيقَ لِلْخَيْرِ، فَطُوبَى لِمَنْ جَعَلَ اللَّهُ مَفَاتِيحَ الْخَيْرِ عَلَى يَدَيْهِ، وَوَيْلٌ لِمَنْ جَعَلَ اللَّهُ مَفَاتِيحَ الشَّرِّ عَلَى يَدَيْهِ» “মানুষের মধ্যে এমন মানুষ রয়েছে যে কল্যাণের চাবিকাঠি ও অকল্যাণের পথের বাধা বলে বিবেচিত, আবার এমন কিছু রয়েছে যে অকল্যাণের চাবি ও কল্যাণের তালা হিসেবে বিবেচিত। সু-সংবাদ সে সব লোকের জন্য যারা কল্যাণের চাবিস হয়, আর ধ্বংস তাদের জন্য যারা অকল্যাণের জন্য চাবি হয়”  
আলেম, নেককার ও ইসলামী দা‘ঈদের অনুসন্ধান করে বের করা ও তাদের সংস্পর্শ লাভ ও তাদের পাশে থাকা, ঈমান ও দীনের ওপর অটল ও অবিচল থাকার জন্য বড় সহযোগী হিসেবে প্রমাণিত সত্য। ইসলামের ইতিহাস তালাশ করলে দেখা যাবে বিভিন্ন সময়ে যখন বিভিন্ন ধরনের ফিতনা দেখা দিয়েছে তখন মুসলিমদেরকে আল্লাহ কতক ব্যক্তির মাধ্যমে অবিচল ও অটল থাকার তাওফীক দিয়েছেন।
এ ধরনের ঘটনার একটি ঘটনা হল, আলী ইবন আল মাদীনী রহ. তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা দীনকে মুরতাদের ফিতনার সময় সিদ্দীকের দ্বারা বিজয়ী করেছেন। আর নির্যাতনের সময় আহমাদ বিন হাম্বল দ্বারা রক্ষা করেছেন।
অটল ও অবিচল থাকার ক্ষেত্রে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. তার উস্তাদ শাইখুল ইসলামের ভূমিকা সম্পর্কে কি বলেছেন তা একটু ভেবে দেখুন। তিনি বলেন, যখন আমরা কঠিন ভয় পেতাম এবং আমাদের নিজেদের প্রতি খারাপ ধারণা হতো এবং যমীন আমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে পড়ত, তখন আমরা তার নিকট আসতাম। যখন আমরা শুধু তাকে দেখতাম আর তার কথা শুনতাম তখনই আমাদের সব ভয়ভীতি ও আতঙ্ক দূর হয়ে যেতো। আমাদের অন্তর প্রশস্ত হয়ে যেতো, আমাদের পেরেশানী ও দুশ্চিন্তা শক্তি, বিশ্বাস ও প্রশান্তিতে রূপান্তরিত হতো। আল্লাহ তা‘আলা কতই না মহান ও পবিত্র যিনি তার বান্দাদেরকে তার সাথে সাক্ষাতের পূর্বে কর্মক্ষেত্রে জান্নাত দেখিয়ে দিয়েছেন এবং তার দরজাসমূহ খুলে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে জান্নাতের রূহ, শীতল বাতাস ও সুঘ্রাণ দেখিয়ে দিয়েছেন। যার ফলে তারা তাদের সব শক্তি ও প্রেরণা তা লাভের উদ্দেশ্যে ব্যয় করেন এবং তার দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার নিমিত্তে শেষ করেন।  
অটল ও অবিচল থাকার মৌলিক উৎস ও উপাদান ‘ইসলামী ভ্রাতৃত্ব বোধ’ এখানে প্রকাশ পায়। তোমার নেককার ভাইয়েরা, আদর্শ পুরুষগণ এবং তোমার অভিভাবকগণ এ পথে তোমার সত্যিকারের সহযোগী, সহযোদ্ধা ও তোমার মজবুত খুঁটি; যাতে তুমি হেলান দেবে আর শক্তিশালী দুর্গ যেখানে তুমি আশ্রয় নেবে। আল্লাহর যে সব নিদর্শন ও প্রজ্ঞা বা হিকমত রয়েছে তা দ্বারা তারা তোমাকে অটল ও অবিচল থাকতে সহযোগিতা করবে। তুমি তাদের সাথেই থাক, তাদের আঁচলের নীচে বসবাস কর। কখনোই একা বা বিচ্ছিন্ন হয়ো না। কারণ, বাঘ ছাগলের পাল থেকে বিচ্ছিন্ন ছাগলটিকেই আক্রমণ করে।
এগারো: আল্লাহর সাহায্যের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখা এবং জেনে রাখা যে ভবিষ্যত ইসলাম ও মুসলিমের
আল্লাহর সাহায্য আসতে দেরি হলে, তখন আমরা অটল ও অবিচল থাকার খুব মুখাপেক্ষি হয়ে থাকি; যাতে অবিচল থাকার পর পা ছিটকে না পড়ি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَكَأَيِّن مِّن نَّبِيّٖ قَٰتَلَ مَعَهُۥ رِبِّيُّونَ كَثِيرٞ فَمَا وَهَنُواْ لِمَآ أَصَابَهُمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَمَا ضَعُفُواْ وَمَا ٱسۡتَكَانُواْۗ وَٱللَّهُ يُحِبُّ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٤٦ وَمَا كَانَ قَوۡلَهُمۡ إِلَّآ أَن قَالُواْ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوبَنَا وَإِسۡرَافَنَا فِيٓ أَمۡرِنَا وَثَبِّتۡ أَقۡدَامَنَا وَٱنصُرۡنَا عَلَى ٱلۡقَوۡمِ ٱلۡكَٰفِرِينَ ١٤٧ فَ‍َٔاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ ثَوَابَ ٱلدُّنۡيَا وَحُسۡنَ ثَوَابِ ٱلۡأٓخِرَةِۗ وَٱللَّهُ يُحِبُّ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ١٤٨﴾ [ال عمران: ١٤٦،  ١٤٨]   
“আর কত নবী ছিল, যার সাথে থেকে অনেক লোক লড়াই করেছে। তবে আল্লাহর পথে তাদের ওপর যা আপতিত হয়েছে তার জন্য তারা হতোদ্যম হয়নি। আর তারা দুর্বল হয়নি এবং তারা নত হয় নি। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে ভালোবাসেন। আর তাদের কথা শুধু এই ছিল যে, তারা বলল, ‘হে আমাদের রব, আমাদের পাপ ও আমাদের কর্মে আমাদের সীমালঙ্ঘন ক্ষমা করুন এবং অবিচল রাখুন আমাদের পাসমূহকে, আর কাফির কওমের ওপর আমাদেরকে সাহায্য করুন’। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে দিলেন দুনিয়ার প্রতিদান এবং আখিরাতের উত্তম সাওয়াব। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালোবাসেন”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৪৬-১৪৮]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তার নির্যাতিত ও অত্যাচারিত সাহাবীদের শাস্তি ও পরীক্ষার সময় অটল ও অবিচল রাখতে চেষ্টা করেন তখন তিনি তাদের জানিয়ে দেন যে ভবিষ্যৎ ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য। তখন তিনি কী বলেছিলেন?  
ইমাম বুখারীর নিকট মারফু‘ সনদে খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস পৌঁছেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَاللَّهِ لَيُتِمَّنَّ هَذَا الأَمْرَ، حَتَّى يَسِيرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ، لاَ يَخَافُ إِلَّا اللَّهَ، أَوِ الذِّئْبَ عَلَى غَنَمِهِ، وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُونَ»
“আল্লাহ তা‘আলার শপথ, অবশ্যই তিনি এ দীনকে পরিপূর্ণ করবেন। এমনকি একজন আরোহী সান‘আ থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত নিরাপদে ভ্রমন করবে সে আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না এবং ছাগলের ওপর বাঘের আক্রমণ ছাড়া আর কোন কিছুর ভয় থাকবে না”  ।
সুতরাং যে সব হাদীসে সু-সংবাদ রয়েছে যে, ভবিষ্যৎ ইসলামের জন্য নবীনদের সামনে তা তুলে ধর। অবিচল ও দৃঢ় থাকার তা‘লীম ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে এ সব হাদীস খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বারো: বাতিলের হাকীকত সম্পর্কে জানা ও তাতে ধোকায় না পড়া
আল্লাহ তা‘আলা কথা,
  ﴿لَا يَغُرَّنَّكَ تَقَلُّبُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فِي ٱلۡبِلَٰدِ ١٩٦﴾ [ال عمران: ١٩٦]  
“নগরসমূহে সেসব লোকের চলা-ফেরা তোমাকে যেন ধোঁকায় না ফেলে যারা কুফরী করেছে”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯৬] -এর মধ্যে মুমিনদের জন্য রয়েছে সান্ত্বনা এবং তাদের জন্য রয়েছে দৃঢ়তা ও অবিচলতার বিশেষ খোরাক।
আর আল্লাহ তা‘আলা বাণী-
﴿فَأَمَّا ٱلزَّبَدُ فَيَذۡهَبُ جُفَآءٗۖ ١٧﴾ [الرعد: ١٧]   
“অতঃপর ফেনাগুলো নিঃশেষ হয়ে যায়”। [সূরা আর-রা‘আদ, আয়াত: ১৭] -এখানেও জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে বিশেষ উপদেশ; যাতে তারা বাতিলকে ভয় না করে এবং বাতিলের কাছে বশ্যতা স্বীকার না করে।
কুরআনের পদ্ধতি হলো, বাতিলপন্থীদের অপমান অপদস্থ করা এবং তাদের উদ্দেশ্য ও মাধ্যমকে গুরুত্বহীন করে তুলে ধরা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَكَذَٰلِكَ نُفَصِّلُ ٱلۡأٓيَٰتِ وَلِتَسۡتَبِينَ سَبِيلُ ٱلۡمُجۡرِمِينَ ٥٥﴾ [الانعام: ٥٥]   
“আর এভাবেই আমরা আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করি। আর যাতে অপরাধীদের পথ স্পষ্ট হয়ে যায়”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৫৫] যাতে মুসলিমদের অসতর্ক অবস্থায় তাদের বিপদে ফেলতে না পারে এবং যাতে করে মুসলিমরা বুঝতে পারে ইসলামের উপর বিপদ কোথা থেকে আসে।
তাই তো এমন বহু আন্দোলন বা সংগঠন দেখেছি ও শুনেছি যা নিঃশেষ হয়ে গেছে, এমন বহু দা‘ঈ দেখেছি ও শুনেছি তাদের যাদের পদস্খলন হয়েছে, শত্রুদের সম্পর্কে তাদের সম্মক ধারণা ও জ্ঞাণ না থাকার কারণে; যখন তাদের সামনে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি এসেছে যা তারা ধারণা করতে পারে নি তখন তারা অটল ও অবিচল থাকতে পারে নি।  
তেরো: অটল ও অবিচল থাকতে সহযোগী এমন আখলাক ও চারিত্রিক গুণাবলীকে নিজের জীবনে একত্র করা
এ সব গুণের প্রধান গুণ হল, ধৈর্য। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« وَمَا أُعْطِيَ أَحَدٌ عَطَاءً خَيْرًا وَأَوْسَعَ مِنَ الصَّبْرِ»
“আল্লাহ তা‘আলা ধৈর্যের চেয়ে এতো উত্তম ও প্রশস্ত জিনিস আর কাউকে দান করেন নি”   
আর সবচেয়ে কঠিন ধৈর্য হলো প্রথম আঘাতের সময় ধৈর্য ধরা। যখন কোনো মানুষ এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো বিপদে আক্রান্ত হয়, যার আশা সে করে নি, তখন তার মধ্যে হতাশা দেখা দেয় এবং তার মধ্যে ধৈর্য থাকে না তখন সে অধৈর্য হয়ে অটল ও অবিচল থাকার সাহসিকতা হারিয়ে ফেলে।
আল্লামা ইবনুল জাওযী রহ. কী বলেছেন তা ভেবে দেখুন, আমি একজন বৃদ্ধ লোককে দেখেছি, যার বয়স প্রায় আশি, তিনি সবসময় জামা‘আতে সালাত আদায় করতেন। একবার তার একজন নাতি মারা গিয়েছে তখন সে বলে, কারো জন্য দো‘আ করা উচিৎ নয়  কারণ, দো‘আ কবুল হয় না। তারপর তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা আমার সাথে শত্রুতা করেন তিনি আমার কোনো সন্তান আমার জন্য রাখেন নি।  (এভাবে সে বিপদে অটল থাকতে পারলো না, কারণ প্রথম আঘাতে সে ধৈর্য ধারণ করতে পারে নি।) আল্লাহ তা‘আলা তার কথা থেকে অনেক উর্ধ্বে।
-মুসলিমগণ যখন ওহুদের যুদ্ধে এমন এক অনাকাঙ্খিত মুসীবতে আক্রান্ত হলো যা তাদের প্রত্যাশা ছিল না, কারণ আল্লাহ তা‘আলা তাদের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন- তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের রক্ত ঝরিয়ে এবং কতককে শাহাদাত দিয়ে একটি কঠিন শিক্ষা দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَوَلَمَّآ أَصَٰبَتۡكُم مُّصِيبَةٞ قَدۡ أَصَبۡتُم مِّثۡلَيۡهَا قُلۡتُمۡ أَنَّىٰ هَٰذَاۖ قُلۡ هُوَ مِنۡ عِندِ أَنفُسِكُمۡۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ١٦٥﴾ [ال عمران: ١٦٥]  
“আর যখন তোমাদের ওপর বিপদ আসলো, (অথচ) তোমরা তো এর দ্বিগুণ বিপদে আক্রান্ত হলে (বদর যুদ্ধে)। তোমরা বলেছিলে এটা কোত্থেকে? বল, ‘তা তোমাদের নিজদের থেকে’। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৫]
তাদের থেকে কী প্রকাশ পেয়েছিল তা আল্লাহ বলে দিয়েছেন যে, তোমাদের পা পিছলে গেল, আল্লাহর রাসূলের নির্দেশের ব্যাপারে তোমরা বিবাদ করলে এবং তার আদেশ অমান্য করলে যখন তোমরা দেখতে পেলে গনীমতের মাল, যা তোমরা পছন্দ করতে। তোমাদের কেউ কেউ দুনিয়া চায়।
চৌদ্দ: নেকবান্দাদের উপদেশ
যখন কোনো মুসলিম ফিতনা বা বিপদের সম্মুখীন হয় এবং আল্লাহ তা‘আলা তাকে পবিত্র করার উদ্দেশ্যে পরীক্ষা করে, তখন অবিচল থাকার মাধ্যম এমন একজন নেককার লোক হয় যাকে আল্লাহ তা‘আলা তার পিছনে লাগিয়ে দেন, সে তাকে ভালো উপদেশ দেয়, সৎ বুদ্ধি দেয় এবং সৎসাহস দেয়; যাতে সে অবিচল থাকে। তখন এমন এমন কথা তার থেকে প্রকাশ পায় যা তার উপকারে আসে ও কাজে লাগে এবং তার ভুলত্রুটি সংশোধন করে দেয়। এ কথাগুলো আল্লাহর যিকির-স্মরণ ও তার সাক্ষাত এবং তার জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনায় ভরপুর থাকে।
হে আমার মুসলিম ভাই! এ ধরণের দৃষ্টান্ত ইমাম আহমাদের জীবনীতে অসংখ্য। যিনি পরীক্ষাগারে প্রবেশ করেছেন যাতে খাঁটি স্বর্ণ হয়ে বের হতে পারেন।
যখন তাকে কড়া ও কড়া পরিয়ে মামুনের নিকট নিয়ে যাওয়া হল, তার নিকট পৌঁছার আগে তাকে খুব ভয় দেখানো হল এমনকি ইমাম আহমদের একজন খাদেম তাকে বলল, হে আবু আব্দুল্লাহ আমার ভয় হচ্ছে মামুন একটি তলোয়ার কোষমুক্ত করছে ইতঃপূর্বে কখনো সে তা করে নি এবং সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আত্মীয়তার শপথ করছে, যদি আপনি কুরআনকে মাখলুক হওয়ার দাবিতে সাড়া না দেন, তবে সে অবশ্যই এই তলোয়ার দ্বারা আপনাকে হত্যা করবে   
বিচক্ষণতার অধিকারী জ্ঞানীরা ইমামকে অটল ও অবিচল থাকার কথা বলার জন্য তার সাথে সাক্ষাত করতে সুযোগ বের করতে উঠে পড়ে লাগে। ইমাম আয-যাহাবীর সীরাত গ্রন্থে  আবু জা‘ফর আল-আনবারী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইমাম আহমদ রহ.-কে যখন মামুনের নিকট আনা হলো, খবর পেয়ে আমি ফুরাত নদী অতিক্রম করে তার নিকট ছুটে যাই। আমি দেখতে পেলাম সে আঙ্গিনায় বসে আছে। আমি তাকে সালাম দিলাম। তখন সে বলল, হে আবু জা‘ফর তুমি অনেক কষ্ট করলে। আমি বললাম, হে ইমাম! তুমি বর্তমান সময়ের একজন মাথা, মানুষ তোমার কথার অনুকরণ করে। আল্লাহর কসম যদি তুমি কুরআন মাখলুক হওয়ার কথায় সাড়া দাও তাতে অনেক মানুষ সাড়া দেবে। আর যদি তুমি সাড়া না দাও তাতে অনেক মানুষ বিরত থাকবে। সাথে সাথে তুমি এ কথা মনে রাখবে, যদি এ লোক তোমাকে হত্যা না করে তাহলেও তুমি মরবে, তোমাকে অবশ্যই মরতে হবে। তুমি আল্লাহকে ভয় কর, তুমি সাড়া দেবে না। তার কথা শোনে আহমাদ রহ. কাঁদতে লাগলেন এবং বললেন, মাশাআল্লাহ। তারপর তিনি বললেন, হে আবু জা‘ফর তুমি আবার বল.. আমি আবার বললাম, সে বলল, মাশাআল্লাহ...
ইমাম আহমাদ রহ. মামুনের নিকট যাওয়ার পথের বর্ণনা প্রসংগে বলেন, “আমরা মধ্য রাতে একটি খালি ময়দানে গিয়ে পৌঁছলাম। তখন একজন লোক সামনে এসে বলল, তোমাদের মধ্যে ইমাম আহমাদ কে?
তাকে দেখিয়ে দেওয়া হলো, তখন সে বলল, তোমরা চলতে থাকো, তারপর বলল, হে আহমদ, তোমাকে যদি ওখানে হত্যা করা হয় আর তুমি জান্নাতে প্রবেশ কর তাহলে তোমার কোনোই ক্ষতি হবে না। তারপর সে বলল, আমি তোমাকে আল্লাহ তা‘আলার নিকট আমানত হিসেবে রেখে গেলাম এ কথা বলে সে চলে গেল।
আমি তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, তখন বলা হল, লোকটি আরবের রবী‘আ গোত্রের একজন লোক যিনি গ্রামে পশমের কাজ করে। তার নাম জাবের ইবন আমের। তার অনেক সু-খ্যাতি রয়েছে।
আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়ায় একটি ঘটনা বর্ণিত, একজন গ্রাম্যলোক ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ.-কে বলল, হে ইমাম! তুমি মানুষের দলনেতা তুমি তাদের ওপর বোঝা হয়ো না। তুমি এখন তাদের নেতা সুতরাং তোমাকে যেদিকে বাধ্য করা হচ্ছে তাতে সাড়া দেওয়া থেকে সতর্ক থাক। তুমি সাড়া দেওয়ার ফলে তারাও সাড়া দেবে। ফলে কিয়ামতের দিন তুমি তাদের গুণাহের বোঝা বহন করতে বাধ্য হবে। যদি তুমি আল্লাহকে মহব্বত কর, তুমি ধৈর্য ধারণ কর। তোমার মাঝে ও জান্নাতে প্রবেশের মাঝে একমাত্র বাধা হলো তোমাকে হত্যা করা। ইমাম আহমদ বলেন, আমি যে অবস্থানে ছিলাম তার ওপর অটল ও অবিচল থাকা এবং আমাকে যে কথার দিকে ডাকছে তা থেকে বিরত থাকার বিষয়ে লোকটি কথা আমার দৃঢ়তা ও সাহস আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিল।
অপর একটি বর্ণনায় বর্ণিত, ইমাম আহমদ রহ. বলেন, এ বিষয়ে একজন আ‘রাবীর কথার চেয়ে শক্তিশালী কথা শুনি নি। তিনি আমাকে ফুরাত নদীর তীরে বাগদাদ ও রিক্কাতের মাঝে তুক নামক একটি শহরের খালি যায়গায় এ কথাটি বলেন, তিনি বলেন, হে আহমাদ যদি তোমাকে তারা হত্যা করে তাহলে তুমি শহীদ হয়ে মরবে। আর যদি হত্যা না করে এবং তুমি বেঁচে থাক, তাহলে তুমি সু-খ্যাতি নিয়ে বেঁচে থাকবে। তার কথা শুনে আমার অন্তরের সাহস ও শক্তি আরও বৃদ্ধি পেল।  
ইমাম আহমদ তার যুবক সাথী মুহাম্মদ ইবন নূহ যিনি তার সাথে ফিতনা বা পরীক্ষার মুখোমুখি হন, তার সম্পর্কে বলেন, কম বয়স ও স্বল্প জ্ঞান হওয়া সত্বেও আল্লাহর নির্দেশের প্রতি অটল, অবিচল ও দৃঢ় ব্যক্তি তার চেয়ে বেশি আর আর কাউকে দেখি নি। আমার বিশ্বাস তার শেষ পরিণতি ভালোই হবে। একদিন সে আমাকে বলল, হে আবু আব্দুল্লাহ! আল্লাহর শপথ, আল্লাহর শপথ! তুমি আমার মত নও, তুমি একজন অনুকরণীয় ব্যক্তি, তোমার অনুকরণ করা হয়। তোমার থেকে কী প্রকাশ পায় তার প্রতীক্ষায় মানুষ তোমার দিকে তাদের গর্দান বাড়িয়ে দিয়েছে, সুতরাং তুমি আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহর আদেশের ওপর অটল, অবিচল ও দৃঢ় থাক। তারপর লোকটি মারা গেলে আমি তার ওপর জানাযা পড়ি এবং তাকে দাফন করি   
জেলখানায় হাতে-পায়ে জিঞ্জির লাগা অবস্থায় বন্দি ইমাম আহমদ রহ. যাদের সালাতের ইমামতি করতেন, তারাও তার ঈমানের ওপর অটল ও অবিচলতার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে করে। একবার ইমাম আহমদ বন্দিশালায় থাকাবস্থায় বললেন, আমি বন্দি থাকাকে গুরুত্ব দেই না। জেলখানা আর আমার ঘর উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই এবং তলোয়ার দ্বারা হত্যাকে আমি ভয় করি না। তবে আমি শুধু লাঠির ফিতনাকে ভয় পাই।
জেলখানায় অবস্থানকারী কেউ কেউ তার কথা শোনে বলল, হে আবু আব্দুল্লাহ কোনো অসুবিধা নাই। তাতো কেবল দুটি লাঠি। তারপর তুমি জানবেই না বাকীগুলো কোথায় পড়বে। এ কথা শোনার কারণে ইমাম আহমদের কাছে যেন মনে হলো, বিপদ কেটে গেছে।
হে আমার সম্মানিত ভাই! নেককারদের থেকে উপদেশ ও পরার্মশ গ্রহণ করার প্রতি যত্নবান হও। যখন তোমাকে উপদেশ দেয় তখন তুমি তা বুঝতে চেষ্টা কর।
-সফরের পূর্বে তুমি তাকে খুঁজে বের কর যদি তুমি আশঙ্কা কর যে, তাতে তুমি কোন বিপদে পড়বে।
-পরীক্ষার মাঝে তাকে তুমি তালাশ কর অথবা পরীক্ষায় পতিত হওয়ার পূর্বে তুমি তাকে তালাশ কর।
-তুমি তাকে উপদেশ গ্রহণ করার জন্য তালাশ কর, যখন তোমাকে বড় কোনো পদ গ্রহণ করার প্রস্তাব করা হয় অথবা ধন-সম্পদের মালিক বা উত্তরসূরী করা হয়।
তুমি তোমার আত্মাকে দৃঢ় রাখ এবং অপরকে দৃঢ়, অটল ও অবিচল থাকতে সাহায্য কর। আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই মুমিনদের অভিভাবক।
পনেরো: জান্নাতের নি‘আমতসমূহ, জাহান্নামের শাস্তি ও মৃত্যুর স্মরণ করা
জান্নাত হলো, আনন্দের শহর, শান্তির প্রাণকেন্দ্র ও মুমিনদের অবস্থানস্থল। সাধারণত মানুষ আরাম প্রিয় হয়ে থাকে। মানুষকে আরাম প্রিয় হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা কোন ত্যাগ স্বীকার, কষ্ট করা ও ধৈর্য ধারণ করতে চায় না। কিন্তু যদি তার বিনিময়ে মহা মূল্যবান কিছু পাওয়া যায়, যা তার কষ্টকে সহজ করে দেয়, তখন সে তা লাভ করার জন্য কষ্ট ও পরিশ্রম করে, রাস্তার সব ধরনের বাধা অতিক্রম করে এবং তা লাভের জন্য কষ্ট স্বীকার করে।
যে কর্মের বিনিময় ও লাভ জানে, তার জন্য সে কর্ম করা খুব সহজ হয়। তখন সে সামনে চলতে থাকে এবং জানে যে, যদি সে কষ্ট না করে এবং দৃঢ় না থাকে তার থেকে এমন জান্নাত হাত ছাড়া হয়ে যাবে, যার পরিধি আসমান ও যমীনের পরিধির সমান। তারপর মানবাত্মা এমন বস্তুর প্রতি মুখাপেক্ষি থাকে যা তাকে যমীনের মাটি থেকে উন্নতি দিয়ে উর্ধ্ব জগতের দিকে টেনে নিয়ে যাবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবীগণের অটল ও অবিচল রাখতে জান্নাতের আলোচনা তুলে ধরতেন। হাসান সহীহ হাদীসে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আম্মার, উম্মে আম্মার ও ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু আনহুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার কারণে তখন তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বললেন,
«صَبْرًا يَا آلَ يَاسِرٍ، فَإِنَّ مَوْعِدَكُمُ الْجَنَّةُ»
“হে ইয়াসারের পরিবার, তোমরা ধৈর্য ধারণ কর, হে ইয়াসারের পরিবার তোমরা ধৈর্য ধারণ কর, তোমাদের জন্য জান্নাতের প্রতিশ্রুতি রয়েছে”।  অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের বলতেন,
 «إِنَّكُمْ سَتَلْقَوْنَ بَعْدِي أَثَرَةً، فَاصْبِرُوا حَتَّى تَلْقَوْنِي وَمَوْعِدُكُمُ الحَوْضُ»
“তোমরা অবশ্যই আমার পর প্রাচুর্য ও ধন-সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে তোমাদের ওপর অন্যদের প্রাধান্য দেখতে পাবে। আমার সাথে হাউজে কাউসারে দেখা করা পর্যন্ত তোমরা ধৈর্য ধারণ কর।”   অনুরূপভাবে কবর, হাশর, হিসাব, মিযান, ফুলসীরাতসহ আখিরাতের প্রতিটি ঘাটিতে উভয় দলের অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করার মাধ্যমেও এ দৃঢ়তা ও অবিচলতা আসতে পারে।
যেমনিভাবে মৃত্যুর স্মরণ করা একজন মুসলিমকে অধঃপতন থেকে রক্ষা করে, এবং তা তাকে আল্লাহর নির্দেশাবলীর কাছে দাঁড়িয়ে যেতে সহায়তা করে, ফলে সে সীমা লঙ্ঘন করে না। কারণ, সে যখন জানে যে, মৃত্যু তার জুতার পিতার চেয়েও অতি নিকটে, কিছুক্ষণ পরেই তার সময় এসে যাবে, তখন তার জন্য পদস্খলন এবং গোমরাহীর মধ্যে সময় নষ্ট করা কিভাবে সম্ভব হবে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
 «أَكْثَرُوا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ الْمَوْتِ»
“তোমরা আরাম-আয়েশকে নিঃশেষকারী মৃত্যুর স্মরণ বেশি বেশি কর” ।

অবিচল থাকার স্থানসমূহ
অবিচল থাকার স্থানসমূহ অনেক; যার আলোচনা অনেক দীর্ঘ ও বিস্তৃত। আমরা এখানে সংক্ষিপ্তাকারে কয়েকটির মধ্যে আমাদের আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখবো:
প্রথম: ফিতনার স্থানে অটল ও অবিচল থাকা
যে সব কারণে অন্তরসমূহ আক্রান্ত হয় তার অন্যতম কারণ হল ফিতনা। যখন মানবাত্মা বিপদ-আপদ বা সুখ-দুঃখের পরীক্ষার সম্মুখীন হয় তখন তার ওপর কেবল যারা বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ, যাদের অন্তর ঈমান দ্বারা আবৃত, তারাই অটল ও অবিচল থাকতে পারে।
ফিতনার প্রকারসমূহ
-সম্পদের ফিতনা
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمِنۡهُم مَّنۡ عَٰهَدَ ٱللَّهَ لَئِنۡ ءَاتَىٰنَا مِن فَضۡلِهِۦ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلصَّٰلِحِينَ ٧٥ فَلَمَّآ ءَاتَىٰهُم مِّن فَضۡلِهِۦ بَخِلُواْ بِهِۦ وَتَوَلَّواْ وَّهُم مُّعۡرِضُونَ ٧٦ ﴾ [التوبة: ٧٥،  ٧٦]
“আর তাদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করে যে, যদি আল্লাহ তার স্বীয় অনুগ্রহে আমাদের দান করেন, আমরা অবশ্যই দান-খয়রাত করব এবং অবশ্যই আমরা নেককারদের অন্তর্ভুক্ত হব। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ দান করলেন, তারা তাতে কার্পণ্য করল এবং বিমুখ হয়ে ফিরে গেল”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৭৫-৭৬]
-ইজ্জতের ফিতনা
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱصۡبِرۡ نَفۡسَكَ مَعَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ رَبَّهُم بِٱلۡغَدَوٰةِ وَٱلۡعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجۡهَهُۥۖ وَلَا تَعۡدُ عَيۡنَاكَ عَنۡهُمۡ تُرِيدُ زِينَةَ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَلَا تُطِعۡ مَنۡ أَغۡفَلۡنَا قَلۡبَهُۥ عَن ذِكۡرِنَا وَٱتَّبَعَ هَوَىٰهُ وَكَانَ أَمۡرُهُۥ فُرُطٗا ٢٨﴾ [الكهف: ٢٨]   
“আর তুমি নিজকে ধৈর্যশীল রাখ তাদের সাথে, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের রবকে ডাকে, তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশে এবং দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তোমার দু’চোখ যেন তাদের থেকে ঘুরে না যায়। আর ঐ ব্যক্তির আনুগত্য করো না, যার অন্তরকে আমি আমার যিকির থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে এবং যার কর্ম বিনষ্ট হয়েছে”। [সূরা আল-কাহাফ, আয়াত: ২৮]
উল্লিখিত ফিতনা দুটির ক্ষতি ও ভয়াবহতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
 «مَا ذِئْبَانِ جَائِعَانِ أُرْسِلَا فِي غَنَمٍ أَفْسَدَ لَهَا مِنْ حِرْصِ الْمَرْءِ عَلَى الْمَالِ، وَالشَّرَفِ لِدِينِهِ»
“ক্ষুধার্ত দু’টি বাঘ ছাগলের পালে ছেড়ে দিলে তা ছাগলের জন্য যতটুকু ক্ষতিকর ও ভয়াবহ, একজন মানুষের দীনের জন্য ধন-সম্পদ ও পদের লোভ তার চেয়েও অধিক ক্ষতিকর ও ভয়াবহ।”
- স্ত্রীর ফিতনা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّ مِنۡ أَزۡوَٰجِكُمۡ وَأَوۡلَٰدِكُمۡ عَدُوّٗا لَّكُمۡ فَٱحۡذَرُوهُمۡۚ ١٤﴾ [التغابن : ١٤]   
“হে মুমিনগণ, তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের কেউ কেউ তোমাদের শত্রু”।  অতএব, তোমরা তাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর”। [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৪]
- সন্তানের ফিতনা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الولد مجبنة مبخلة محزنة»
“সন্তান ভীরু হওয়া, কৃপণ হওয়া ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়”   
- যুলুম, অত্যাচার ও নির্যাতনের পরীক্ষা: এর সবচেয়ে উত্তম ও উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হলো আসহাবে উখদূদ সম্পর্কে আল্লাহর বাণী— আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  
﴿قُتِلَ أَصۡحَٰبُ ٱلۡأُخۡدُودِ ٤ ٱلنَّارِ ذَاتِ ٱلۡوَقُودِ ٥ إِذۡ هُمۡ عَلَيۡهَا قُعُودٞ ٦ وَهُمۡ عَلَىٰ مَا يَفۡعَلُونَ بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ شُهُودٞ ٧ وَمَا نَقَمُواْ مِنۡهُمۡ إِلَّآ أَن يُؤۡمِنُواْ بِٱللَّهِ ٱلۡعَزِيزِ ٱلۡحَمِيدِ ٨ ٱلَّذِي لَهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۚ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ شَهِيدٌ ٩﴾ [البروج: ٤،  ٩]   
“ধ্বংস হয়েছে গর্তের অধিপতিরা, (যাতে ছিল) ইন্ধনপূর্ণ আগুন। যখন তারা তার কিনারায় উপবিষ্ট ছিল। আর তারা মুমিনদের সাথে যা করছিল তার প্রত্যক্ষদর্শী। আর তারা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধুমাত্র এ কারণে যে, তারা মহা পরাক্রমশালী প্রশংসিত আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল। আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব যার। আর আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ের প্রত্যক্ষদর্শী”। [সূরা আল-বুরূজ, আয়াত: ৪-৯]
ইমাম বুখারী রহ. সহীহ বুখারীতে খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,
«شَكَوْنَا إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَهُوَ مُتَوَسِّدٌ بُرْدَةً لَهُ فِي ظِلِّ الكَعْبَةِ، قُلْنَا لَهُ: أَلاَ تَسْتَنْصِرُ لَنَا، أَلاَ تَدْعُو اللَّهَ لَنَا؟ قَالَ: «كَانَ الرَّجُلُ فِيمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُ لَهُ فِي الأَرْضِ، فَيُجْعَلُ فِيهِ، فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ فَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الحَدِيدِ مَا دُونَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَاللَّهِ لَيُتِمَّنَّ هَذَا الأَمْرَ، حَتَّى يَسِيرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ، لاَ يَخَافُ إِلَّا اللَّهَ، أَوِ الذِّئْبَ عَلَى غَنَمِهِ، وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُونَ»
“একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘বা শরীফের ছায়ায় স্বীয় চাদরকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে আছেন। আমরা তার নিকট অভিযোগ নিয়ে গিয়ে তাকে বললাম, আমাদের জন্য কি সাহায্য চাইবেন না, আমাদের জন্য কি আল্লাহর কাছে দো‘আ করবেন না। তিনি বললেন, তোমাদের পূর্বের লোকদের অবস্থা এমন ছিল যে, একজন লোককে ধরে নিয়ে আসা হতো এবং তার জন্য যমীনে গর্ত করে তাকে তাতে নিক্ষেপ করা হত। তারপর একটি করাত এনে তাকে তা দ্বারা দুই টুকরা করা হত। এত নির্যাতনের পরও লোকটিকে দীন থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুত করা যেত না। লোহার চিরুনি দিয়ে তাদের হাড় ও রগ থেকে গোশতকে আলাদা করা হতো। তারপরও তাদেরকে দীন থেকে বিচ্যুত করা যেতো না। আল্লাহ তা‘আলার শপথ, অবশ্যই তিনি এ দীনকে পরিপূর্ণ করবেন। এমনকি একজন আরোহী সান‘আ থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত নিরাপদে ভ্রমণ করবে সে আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না এবং ছাগলের ওপর বাঘের আক্রমণ ছাড়া আর কোনো কিছুর ভয় থাকবে না। তবে তোমরা তাড়াহুড়া কর”  
- দাজ্জালের ফিতনা:
এটি দুনিয়ার জীবনে সবচেয়ে বড় ফিতনা,
«إِنَّهُ لَمْ تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ، مُنْذُ ذَرَأَ اللَّهُ ذُرِّيَّةَ آدَمَ، أَعْظَمَ مِنْ فِتْنَةِ الدَّجَّالِ، ... يَا عِبَادَ اللَّهِ فَاثْبُتُوا، فَإِنِّي سَأَصِفُهُ لَكُمْ صِفَةً لَمْ يَصِفْهَا إِيَّاهُ نَبِيٌّ قَبْلِي... »
“আদম সন্তানদের সৃষ্টির পর থেকে এ পর্যন্ত দাজ্জালের ফিতনার চেয়ে আর কোন বড় ফিতনা ভূ-পৃষ্ঠে দেখা দেবে না...। হে আল্লাহর বান্দাগণ তোমরা দাজ্জালের ফিতনার সময় অটল ও অবিচল থাক। আমি তোমাদের নিকট দাজ্জালের পরিচয় এমনভাবে বর্ণনা করব এর পূর্বে কোনো নবী এমন পরিষ্কারভাবে দাজ্জালের পরিচিতি বর্ণনা করেন নি” ।
ফিতনার সামনে অন্তর অটল ও অবিচল থাকা ও বক্র হয়ে যাওয়া বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«تُعْرَضُ الْفِتَنُ عَلَى الْقُلُوبِ كَالْحَصِيرِ عُودًا عُودًا، فَأَيُّ قَلْبٍ أُشْرِبَهَا، نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ، وَأَيُّ قَلْبٍ أَنْكَرَهَا، نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ بَيْضَاءُ، حَتَّى تَصِيرَ عَلَى قَلْبَيْنِ، عَلَى أَبْيَضَ مِثْلِ الصَّفَا فَلَا تَضُرُّهُ فِتْنَةٌ مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ، وَالْآخَرُ أَسْوَدُ مُرْبَادًّا كَالْكُوزِ، مُجَخِّيًا لَا يَعْرِفُ مَعْرُوفًا، وَلَا يُنْكِرُ مُنْكَرًا، إِلَّا مَا أُشْرِبَ مِنْ هَوَاهُ»
“ফিতনা মানুষের অন্তরের সাথে এমনভাবে লেগে থাকবে যেমনিভাবে চাটাই একটির পর একটি করে লেগে থাকে। ফলে যে অন্তর এ ফিতনার মধ্যে প্রবেশ করবে, তার অন্তরে একটি কালো দাগ সৃষ্টি হবে। আর যে অন্তর তা প্রত্যাখ্যান করবে, তার অন্তরে একটি সাদা দাগ সৃষ্টি হবে। ফলে অন্তর দু’টি ভাগে বিভক্ত হবে।
এক- সাদা অন্তর; যা হবে মর্মর পাথরের মত। যতক্ষণ পর্যন্ত আসমান ও যমীন স্থির থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো ফিতনা তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
দুই- কালোর সাথে সাদা মিশ্রিত অন্তর। তার দৃষ্টান্ত হলো, উল্টো করে রাখা পান পাত্রের মত (যাতে কোনো কিছুই প্রবেশ করতে পারে না) ফলে সে অন্তর কোনো ভালো চিনতে পারে না এবং কোনো কু-কর্মকে বাধা দেয় না, কেবল  সেটাই সে করে যা তার প্রবৃত্তিতে সে গ্রহণ করেছে”  
এখানে عرض الحصير এর অর্থ, মানুষের অন্তরে ফিতনাসমূহ এমনভাবে দাগ কাটবে যেমনিভাবে বিছানায় ঘুমন্ত ব্যক্তির পিঠে বিছানা বা চাটাইর দাগ পড়ে। আর مربدا এর অর্থ ধবধবে সাদা যার সাথ কালোর মিশ্রণ রয়েছে। আর مجخياً এর অর্থ ভাঙ্গ পাত্র।
দ্বিতীয়: জিহাদের ময়দানে অটল ও অবিচল থাকা
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا لَقِيتُمۡ فِئَةٗ فَٱثۡبُتُواْ وَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ كَثِيرٗا لَّعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٤٥﴾ [الانفال: ٤٥]  
“হে মুমিনগণ, যখন তোমরা কোনো দলের মুখোমুখি হও, তখন অবিচল থাক, আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হও”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪৫]
আমাদের দীনে বড় গুনাহের একটি হলো, যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খন্দকের যুদ্ধে পরীখা খনন করার সময় যখন স্বীয় পৃষ্ঠে মাটি বহন করেছিলেন তখন তিনি মুমিনদের এ কথা বার বার উচ্চারণ করছিল- و ثبت الأقدام إن لاقينا “আর যখন আমরা শত্রুর মুখোমুখী হই তখন আমাদেরকে অটল ও অবিচল রাখুন”।
তৃতীয়: আদর্শচ্যুত না হওয়া
এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مِّنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ رِجَالٞ صَدَقُواْ مَا عَٰهَدُواْ ٱللَّهَ عَلَيۡهِۖ فَمِنۡهُم مَّن قَضَىٰ نَحۡبَهُۥ وَمِنۡهُم مَّن يَنتَظِرُۖ وَمَا بَدَّلُواْ تَبۡدِيلٗا ٢٣﴾ [الاحزاب : ٢٣]
“মুমিনদের মধ্যে কিছু লোক রয়েছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত তাদের প্রতিশ্রুতি সত্যে বাস্তবায়ন করেছে। তাদের কেউ কেউ (যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করে) তার দায়িত্ব পূর্ণ করেছে, আবার কেউ কেউ (শাহাদাত বরণের) প্রতীক্ষায় রয়েছে। তারা (প্রতিশ্রুতিতে) কোনো পরিবর্তনই করে নি”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২৩]
চতুর্থ: মৃত্যুর সময় অবিচল থাকা
যারা কাফির ও ফাজির (বদকার-পাপিষ্ঠ) তারা কঠিন বিপদের মুহুর্তে অটল ও অবিচল থাকা থেকে বঞ্চিত হয়, ফলে তারা মৃত্যুর সময় কালিমায়ে শাহাদাত উচ্চারণ করতে সক্ষম হয় না। আর এ হল, খারাপ পরিণতির আলামত। যেমন এক ব্যক্তিকে মৃত্যুর সময় কালিমাلا إله إلله  “আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো ইলাহ নেই” পড়তে বলা হলে সে তা বলতে পারে নি। সে তার মাথাকে ডানে ও বামে নাড়াতে থাকে এবং কালিমা উচ্চারণ করাকে প্রত্যাখ্যান করে।
একজন মৃত্যুর সময় বলে, “এটি একটি ভালো অংশ, এটির মূল্য সস্তা” অপরজনকে দেখা গেল, সে মৃত্যুর সময় দাবার গুটির নাম উচ্চারণ করছে। চতুর্থ এক লোককে দেখা গেল, সে গানের সুরে গুণগুণ করছে অথবা গান গাচ্ছে বা তার প্রেমিকার নাম আলোচনা করছে।
এর কারণ হলো, এ বিষয়গুলো ব্যস্ততা দুনিয়ার জীবনে তাকে আল্লাহর যিকির হতে বিরত রাখছে। অনেক সময় তুমি এ ধরনের লোকদের মৃত্যুর সময় দেখতে পারে তাদের চেহারা কালো হয়ে গিয়েছে, মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে অথবা রুহ বের হওয়া সময় তাদের মুখ কিবলা থেকে ফিরে গেছে। কিন্তু যারা দীনদার ও আল্লাহর নেক বান্দা এবং রাসূলের সুন্নাতের অনুসারী আল্লাহ তা‘আলা তাদের মৃত্যুর সময় অটল ও অবিচল থাকার তাওফীক দেন। ফলে তারা মৃত্যুর সময় কালিমায়ে শাহাদাত উচ্চারণ করে থাকে। এ ধরনের লোকদের মৃত্যুর সময় দেখা যায় তাদের চেহারা উজ্জ্বল, আশপাশ সু-ঘ্রাণযুক্ত ও তাদের রূহ বের হওয়ার সময় তারা এক প্রকার সু-সংবাদ প্রাপ্ত হয়।
আল্লাহ তা‘আলা যাদেরকে মৃত্যুর যন্ত্রণার সময় অটল ও অবিচল থাকার তাওফীক দিয়েছেন তাদের একজনের দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা হলো। আর তিনি হলেন, হাদীসবিদগণের ইমামদের থেকে একজন ইমাম আবু যুর‘আ আর-রাযী। তার ঘটনা নিম্নরূপ:
আবু জা‘ফর মুহাম্মাদ ইবন আলী, যাকে ওয়াররাকে আবু যুর‘আ বলা হয়, তিনি বলেন, আমরা রাই এলাকার একটি গ্রামে আবু যুর‘আর নিকট যাই। তার মৃত্যু উপস্থিত হওয়ায় তাকে আমরা দেখলাম তিনি মৃত্যু পথের যাত্রী। তখন তার পাশে উপস্থিত ছিল আবু হাতিম, ইবন ওয়ারাহ, মুনযির ইবন শাযান প্রমুখ বড় বড় হাদীসের ইমামগণ। তারা সবাই তালকীনের হাদীস لقنوا موتاكم لا إله إلا الله “তোমরা তোমাদের মুমূর্ষু ব্যক্তিকে কালিমার তালকীন দাও” এটি স্মরণ করছিল। কিন্তু তারা আবু যুর‘আকে কালিমার তালকীন করতে লজ্জাবোধ করছিল। তখন তারা বলল, চলো আমরা হাদীসটি নিয়ে আলোচনা শুরু করি। তখন ইবন ওয়ারাহ বলল, আমাকে হাদীস বর্ণনা করেছেন আবু আসেম, তিনি বললেন, আমাকে হাদীস বর্ণনা করেছেন আব্দুল হামীদ ইবন জা‘ফর, তিনি সালেহ থেকে। যখন তিনি ইবন আবি বলতে আরম্ভ করলেন, তা এখনো অতিক্রম করেন নি তখন আবু হাতিম বলল, আমাকে হাদীস বর্ণনা করেছেন বুন্দার, তিনি বললেন, আমাকে হাদীস বর্ণনা করেছেন আবু আছেম আর তিনি আব্দুল হামীদ ইবন জা‘ফর থেকে এবং তিনি সালেহ থেকে.... এতটুকু বলার পর আর সামনে বলেন নি। অন্যান্য যারা ছিলেন তারা সবাই চুপ ছিলেন। তখন আবু যুর‘আ মুমূর্ষু অবস্থায় দুই চোখ খুলল এবং বলল, আমাকে হাদীস বর্ণনা করছেন বুন্দার, তিনি বললেন আমাকে হাদীস বর্ণনা করেছেন আবু আসেম, তিনি বললেন, আমাকে হাদীস বর্ণনা করেছেন আব্দুল হামীদ, তিনি সালেহ ইবন আবি গারীব থেকে, তিনি কাসীর ইবন মুররাহ থেকে, তিনি মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, من كان آخر كلامه لا إله إلا الله دخل الجنة “যার শেষ কথা হবে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্যিকার উপাস্য নেই, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে” এ বলার পর তার রূহ বের হয়ে গেল।  
এ ধরনের লোকদের বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ قَالُواْ رَبُّنَا ٱللَّهُ ثُمَّ ٱسۡتَقَٰمُواْ تَتَنَزَّلُ عَلَيۡهِمُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ أَلَّا تَخَافُواْ وَلَا تَحۡزَنُواْ وَأَبۡشِرُواْ بِٱلۡجَنَّةِ ٱلَّتِي كُنتُمۡ تُوعَدُونَ ٣٠﴾ [فصلت: ٣٠]  
“নিশ্চয় যারা বলে, ‘আল্লাহই আমাদের রব’ অতঃপর অবিচল থাকে, ফিরিশতারা তাদের কাছে নাযিল হয় (এবং বলে) ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, দুশ্চিন্তা করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর তোমাদেরকে যার ওয়াদা দেওয়া হয়েছিল’’। [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৩০]
হে আল্লাহ! তুমি আমাদের তাদের অন্তর্ভুক্ত কর,  হে আল্লাহ আমরা তোমার নিকট যাবতীয় কর্মে অটল ও অবিচলতা কামনা করছি আর ভালো কর্মের ওপর দৃঢ়তা কামনা করছি। আমাদের শেষ দাওয়াত হচ্ছে সকল প্রশংসা মহান রাব্বুল আলামীনের জন্য।
সমাপ্ত