রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা গ্রহণ কর

সুন্নাতে নববী হলো ইসলামী শরী‘আতের দ্বিতীয় উৎস, যা আল-কুরআনে বর্ণিত বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে এবং হালালকে হালাল করার ব্যাপারে এবং হারামকে হারাম করণের ব্যাপারে বক্তব্য প্রদান করে, যে ব্যাপারে মূলতঃ আল-কুরআনের কোনো ‘নস’ বা বক্তব্য বর্ণিত হয় নি।
এ আধুনিক যুগে এসে বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ সুন্নাহকে বিলকুল অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করে এবং আল-কুরআনকেই যথেষ্ট বলে মনে কর, আরেক দল নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের ব্যাপারে তার প্রবৃত্তি ও চিন্তা-ভাবনাকে বিচারক বা সালিস মানে। অতঃপর সে তা (সুন্নাত) থেকে তার ইচ্ছা মত তাই গ্রহণ করে, যা তার বিবেক-বুদ্ধির কাছে সুবিধাজনক হয়। আরেক দল সুন্নাতকে খুব অবজ্ঞা ও অবহেলা করে। ফলে যখনই তাকে সুন্নাত সংশ্লিষ্ট কোনো কিছুর দিকে আহ্বান করা হয়, তখন সে বলে: এটা তো সুন্নাত, ফরয নয়।
এ ছোট্ট পুস্তিকাটিতে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তা আঁকড়ে ধরার গুরুত্ব আলোচনা করা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সা. তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা গ্রহণ কর
[بنغالي –  Bengali – বাংলা ]

 


        

ড. আদেল আশ-শিদ্দী
ড. আহমাদ আল-মাযইয়াদ




অনুবাদ: ড. মো: আমিনুল ইসলাম
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

 

وما آتاكم الرسول فخذوه

    
عادل بن علي الشدي
أحمد بن عثمان المزيد



ترجمة: د/ محمد أمين الإسلام
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
সূচীপত্র

ক্র    শিরোনাম    পৃষ্ঠা
১    ভূমিকা    
২    আল-কুরআনের ভাষায় সুন্নাহর অবস্থান    
৩    সুন্নাহর ভাষায় বা সুন্নাহর মধ্যে সুন্নাহর অবস্থান    
৪    নবী তোমার কাছে তোমার নিজের জীবনের চেয়ে অধিক ঘনিষ্টতর!!    
৫    সুন্নাতের অনুসরণ করার প্রশ্নে পূর্ববর্তী ভালো মানুষজনের অবস্থান    
৬    প্রথমত: সাহাবীগণ    
৭    দ্বিতীয়ত: তাবে‘ঈগণ ও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম    
৮    সুন্নাহ সম্পর্কে জাহেল বা অজ্ঞ ব্যক্তির সাথে কথপোকথন    
৯    সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের কারণসমূহ    


ভূমিকা
بسم الله الرحمن الرحيم
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য নিবেদিত, যিনি সকল ভাষায় প্রশংসিত, আর সালাত ও সালাম আদনান বংশীয় নবী আমাদের নবী মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি, যত দিন পাখি গান গায় এবং আযান উচ্চতায় ছড়িয়ে পড়ে। অনুরূপ তাঁর পরিবার-পরিজন ও সঙ্গী-সাথীদের প্রতিও।
অতঃপর.......
সুন্নাতে নববী হলো ইসলামী শরী‘আতের উৎসসমূহের মধ্যে দ্বিতীয় উৎস, আল-কুরআনুল কারীমের পরে যার অবস্থান, আর তা ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত, আদব-কায়দা ও বিধিবিধানগুলো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দেয়। আর তা আল-কুরআনে বর্ণিত বিষয়গুলোকে সুসাব্যস্ত করে ও তাকীদ দেওয়ার মাধ্যমে সুদৃঢ় করে অথবা তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে; যেমনিভাবে তা স্বতন্ত্রভাবে শরী‘আতের বিধিবিধান বর্ণনা করে। আর তা হালালকে হালাল করার ব্যাপারে এবং হারামকে হারাম করণের ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করে, যে ব্যাপারে আল-কুরআনের কোনো ‘নস’ বা বক্তব্য বর্ণিত হয় নি ।
এই কথাগুলোর প্রেক্ষাপট হচ্ছে, এ আধুনিক বা শেষ যুগে এসে বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ সুন্নাহকে বিলকুল অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করে বসেছে এবং আল-কুরআনকেই যথেষ্ট বলে মনে করছে, এ দলটি মূলত কুরআন ও সুন্নাহ উভয়কেই অস্বীকার করেছে। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ﴾ [الحشر:٧]
“রাসূল তোমাদেরকে যা দেয়, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে, তা থেকে বিরত থাক।” [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ৭]
আরেক দল নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের ব্যাপারে তার প্রবৃত্তি ও চিন্তাভাবনাকেই বিচারক বা সালিস বানিয়ে নিয়েছে। ফলে তারা সুন্নাত থেকে তাদের ইচ্ছা তাই গ্রহণ করে, যা তাদের বিবেক-বুদ্ধির কাছে সুবিধাজনক হয়, পক্ষান্তরে যা তাদের বিবেক-বুদ্ধির কাছে সুবিধাজনক না হয় তারা তা তাদের ইচ্ছামত প্রত্যাখ্যান করে। এভাবে তারা মুসলিমগণের মধ্যে ফিতনার সৃষ্টি করছে ফলে সাধারণ জনগণ সুন্নাতকে বর্জন ও তার নিন্দা বা সমালোচনা করার সাহস পায়।
আর অপর আরেক শ্রেণি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসসমূহের ওপর অদ্ভুত ব্যাখ্যাসমূহ ও পাশ্চাত্যের অপব্যাখ্যাসমূহ আরোপ করে নিয়েছে, এর দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য হলো ইসলাম এবং আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে কাছাকাছি নিয়ে আসা, অথচ ঐসব লোক ভুলে গেছে আল্লাহ তা‘আলার সে বাণী, যেখানে তিনি বলেছেন:
﴿وَلَن تَرۡضَىٰ عَنكَ ٱلۡيَهُودُ وَلَا ٱلنَّصَٰرَىٰ حَتَّىٰ تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمۡۗ قُلۡ إِنَّ هُدَى ٱللَّهِ هُوَ ٱلۡهُدَىٰۗ وَلَئِنِ ٱتَّبَعۡتَ أَهۡوَآءَهُم بَعۡدَ ٱلَّذِي جَآءَكَ مِنَ ٱلۡعِلۡمِ مَا لَكَ مِنَ ٱللَّهِ مِن وَلِيّٖ وَلَا نَصِيرٍ ١٢٠﴾ [البقرة: ١٢٠]  
“আর ইয়াহূদী ও নাসারারা আপনার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না আপনি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ করেন। বলুন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর হিদায়াতই প্রকৃত হিদায়াত’। আর যদি আপনি তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করেন আপনার কাছে জ্ঞান আসার পরও, তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার কোনো অভিভাবক থাকবে না এবং থাকবে না কোনো সাহায্যকারীও।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১২০]
আর চতুর্থ দল সুন্নাতকে খুব অবজ্ঞা ও অবহেলা করে। ফলে যখনই তাকে সুন্নাত সংশ্লিষ্ট কোনো কিছুর দিকে আহ্বান করা হয়, তখন তারা বলে: এটা তো সুন্নাত, ফরয নয়। সুতরাং তুমি আমাকে তা পালনে বাধ্য করার চেষ্টা করো না!! আবার ঐসব লোকের অনেকে নিজেদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে এবং মুমিনগণের পথ থেকে দূরে সরে গিয়ে বহু ওয়াজিব বিষয়কে সুন্নাত মনে করে এবং অনেক হারাম জিনিসকে মাকরূহ মনে করে। ফলে তাদের কাছে জামা‘আতে সালাত আদায় করার বিষয়টি সুন্নাত, ওয়াজিব নয়, আর তাদের মতে সালামের জবাব দেওয়ার বিষয়টি সুন্নাত, ওয়াজিব নয়। আর তাদের মতে দাড়ি মুণ্ডন করাটা মাকরূহ, হারাম নয়। আর অনুরূপভাবে টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান করা, ধুমপান করা ইত্যাদি বিষয়েও এ ধরনের মতামত পেশ করে থাকে।
আমরা যদি ধরেও নিই যে, এসব বিষয় সুন্নাতের সীমা ছাড়িয়ে যায় না এবং মাকরূহের সীমাও অতিক্রম করে না, তাহলেও আমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের প্রতি আমল করব না কেন? আর কেনইবা আমরা মাকরূহের অন্ধকার সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ব? সাহাবায়ে কিরামগণ যখন কোনো বিষয়ের বিধান জানতে পারতেন, তখন তা সুন্নাত হলে কি তা বর্জন করতেন? আর মাকরূহ হলে তা আমল করতেন? কেন আমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের সাথে যথাযথ আদব রক্ষা করে অবস্থান করব না? আর কেন আমরা সুন্নাতকে সম্মান করব না, গ্রহণ করব না এবং আমাদের প্রত্যেকটি বিষয় ও কাজের সাথে তার সমন্বয় সাধন করব না? কেন আমরা অধিকাংশ সুন্নাতকে তুচ্ছ ও অবহেলা করব? কেন আমরা মনে করব যে, আমাদের কাছে সুন্নাত মানতে চাওয়া হয়নি?
* * *
আল-কুরআনের ভাষায় সুন্নাহর অবস্থান
* আল্লাহ তা‘আলা কি তাঁর নবীর আনুগত্য এবং তাঁর নবীর সুন্নাতের অনুসরণ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন নি? কারণ, আল্লাহ তা‘আলা তো বলেছেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَا تَوَلَّوۡاْ عَنۡهُ وَأَنتُمۡ تَسۡمَعُونَ ٢٠﴾ [الانفال: ٢٠]
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমরা যখন তাঁর কথা শোন, তখন তা হতে মুখ ফিরিয়ে নিও না।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ২০]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱسۡتَجِيبُواْ لِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمۡ لِمَا يُحۡيِيكُمۡۖ﴾ [الانفال: ٢٤]
“হে ঈমানদারগণ! রাসূল যখন তোমাদেরকে এমন কিছুর দিকে ডাকে যা তোমাদেরকে প্রাণবন্ত করে, তখন তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দিবে।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ২৪]
* আল্লাহ তা‘আলা কি হিদায়াতের বিষয়টিকে তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য এবং তাঁর সুন্নাতের অনুসরণ করার সাথে সম্পর্কযুক্ত করে দেন নি? কারণ, আল্লাহ তা‘আলা তো বলেছেন:
﴿وَٱتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُونَ ١٥٨﴾ [الاعراف: ١٥٨]
“আর তোমরা তার অনুসরণ কর, যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হও।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৮]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন:
﴿وَإِن تُطِيعُوهُ تَهۡتَدُواْۚ﴾ [النور: ٥٤]
“আর তোমরা তার আনুগত্য করলে সৎপথ পাবে।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫৪]
* আল্লাহ তা‘আলা কি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারীদের জন্য তাঁর রহমতের বিষয়টিকে নিশ্চিত করে লিপিবদ্ধ করে দেন নি এবং তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা ও মুক্তির গ্যারান্টি দেন নি? আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَرَحۡمَتِي وَسِعَتۡ كُلَّ شَيۡءٖۚ فَسَأَكۡتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱلَّذِينَ هُم بِ‍َٔايَٰتِنَا يُؤۡمِنُونَ ١٥٦ ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِيَّ ٱلۡأُمِّيَّ ٱلَّذِي يَجِدُونَهُۥ مَكۡتُوبًا عِندَهُمۡ فِي ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَٱلۡإِنجِيلِ يَأۡمُرُهُم بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَىٰهُمۡ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيۡهِمُ ٱلۡخَبَٰٓئِثَ وَيَضَعُ عَنۡهُمۡ إِصۡرَهُمۡ وَٱلۡأَغۡلَٰلَ ٱلَّتِي كَانَتۡ عَلَيۡهِمۡۚ فَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِهِۦ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَٱتَّبَعُواْ ٱلنُّورَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ مَعَهُۥٓ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٥٧﴾ [الاعراف: ١٥٦،  ١٥٧]  
“আর আমার দয়া- তা তো প্রত্যেক বস্তুকে ঘিরে রয়েছে। কাজেই আমি তা লিখে দেব তাদের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় ও আমাদের আয়াতসমূহে ঈমান আনে, যারা অনুসরণ করে রাসূলের, উম্মী (নিরক্ষর) নবীর, যার উল্লেখ তারা তাদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিপিবদ্ধ পায়, যিনি তাদেরকে সৎকাজের আদেশ দেন, অসৎকাজ থেকে নিষেধ করেন, তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করেন এবং অপবিত্র বস্তু হারাম করেন। আর তাদেরকে তাদের গুরুভার ও শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেন যা তাদের ওপর ছিল। কাজেই যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তার সাথে নাযিল হয়েছে সেটার অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৬-১৫৭]
* আল্লাহ তা‘আলা কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিচারক নিযুক্তকরণ এবং তাঁর রায় ও সিদ্ধান্তকে মেনে নেওয়ার সাথে ঈমানের বিষয়টিকে সম্পর্কযুক্ত করে দেন নি? কারণ, আল্লাহ তা‘আলা তো বলেছেন:
﴿فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥﴾ [النساء: ٦٥]  
“কিন্তু না, আপনার রবের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারের ভার আপনার উপর অর্পণ না করে। অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬৫]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿وَمَا كَانَ لِمُؤۡمِنٖ وَلَا مُؤۡمِنَةٍ إِذَا قَضَى ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمۡرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ ٱلۡخِيَرَةُ مِنۡ أَمۡرِهِمۡۗ ﴾ [الاحزاب: ٣٦]
“আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ের ফয়সালা দিলে কোনো মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর জন্য সে বিষয়ে তাদের কোনো (ভিন্ন সিদ্ধান্তের) ইখতিয়ার সংগত নয়।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৬]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন:
﴿فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ﴾ [النساء: ٥٩]
“অতঃপর কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাক।” সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৯]
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ﴿فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ﴾ (তোমরা তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট)-প্রসঙ্গে ইমাম শাফে‘ঈ রহ. বলেন: তোমরা তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন তার সামনে অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর সামনে তা উপস্থাপন কর।
* আল্লাহ তা‘আলা কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে সতর্ক করে দেননি এবং এরই কারণে বা ধারাবাহিকতায় ধ্বংস ও ফিতনার কথা বর্ণনা করে দেননি? আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿فَلۡيَحۡذَرِ ٱلَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنۡ أَمۡرِهِۦٓ أَن تُصِيبَهُمۡ فِتۡنَةٌ أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٦٣﴾ [النور: ٦٣]
“কাজেই যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের ওপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের ওপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৬৩]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿وَيَوۡمَ يَعَضُّ ٱلظَّالِمُ عَلَىٰ يَدَيۡهِ يَقُولُ يَٰلَيۡتَنِي ٱتَّخَذۡتُ مَعَ ٱلرَّسُولِ سَبِيلٗا ٢٧ يَٰوَيۡلَتَىٰ لَيۡتَنِي لَمۡ أَتَّخِذۡ فُلَانًا خَلِيلٗا ٢٨﴾ [الفرقان: ٢٦،  ٢٧]  
“যালিম ব্যক্তি সেদিন নিজের দু‘হাত দংশন করতে করতে বলবে, ‘হায়, আমি যদি রাসূলের সাথে কোন পথ অবলম্বন করতাম! ‘হায়, দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম!” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ২৭-২৮]
* আল্লাহ তা‘আলা কি তাঁর ভালোবাসা পাওয়ার বিষয়টিকে তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ করার সাথে শর্তযুক্ত করে দেন নি? আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۚ﴾ [ال عمران: ٣١]
“বলুন, ‘তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১]
* আল্লাহ তা‘আলা কি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতকে নির্ভেজাল ওহীর অন্তর্ভুক্ত করে দেননি? আল্লাহ তা‘আলা তো বলেছেন:
﴿وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلۡهَوَىٰٓ ٣ إِنۡ هُوَ إِلَّا وَحۡيٞ يُوحَىٰ ٤﴾ [النجم: ٣،  ٤]
“আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না। তাতো কেবল অহী, যা তার প্রতি অহীরূপে প্রেরিত হয়।” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ৩-৪]
অতএব, হে গুণীজন! আল্লাহর এ কিতাবটি তো সত্য কথাই বলে এবং আমাদেরকে প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার জন্য আহ্বান করে; সুতরাং এসব আয়াতে কারীমার ব্যাপারে আমাদের কারও কারও দৃষ্টি দুর্বল বা অন্ধ হয়ে গেল কেন? আর কেনইবা আমাদের কেউ কেউ এসব আয়াতের ব্যাপারে শিয়ালের ধূর্তামী বা ছল-চাতুরীর মতো করে ছল-চাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করি?
* * *
 
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর ভাষায় সুন্নাহর মর্যাদা
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ভরপুর হয়ে আছে, সুন্নাতকে অনুসরণ করার নির্দেশ প্রদান, বিদ‘আত থেকে নিষেধ করা এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কথা অথবা কাজ অথবা মৌনসম্মতি- যাই এসেছে তা আঁকড়ে ধরার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদানে। এ ব্যাপারে যা বর্ণিত হয়েছে তন্মধ্যে নিম্নোক্তগুলো অন্যতম:
১. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«كُلُّ أُمَّتِي يَدخُلُونَ الجَنَّةَ إلاَّ مَنْ أبَى. قَالُوا: وَمَنْ يَأبَى يَا رَسُول الله؟ قَالَ: مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الجَنَّةَ ، وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أبَى».
“আমার সকল উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে, কিন্তু যে অস্বীকার করে, সে ব্যতীত। সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করলেন: হে আল্লাহ রাসূল! কে অস্বীকার করবে? জবাবে তিনি বললেন: যে আমার অনুসরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে, সেই মূলত অস্বীকারকারী।”
২. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«دَعُونِي مَا تَرَكْتُكُمْ، إِنَّمَا أهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَثْرَةُ سُؤالِهِمْ واخْتِلافُهُمْ عَلَى أنْبيَائِهِمْ، فَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْء فَاجْتَنِبُوهُ، وَإِذَا أمَرْتُكُمْ بأمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ».
“আমি যেসব বিষয়ে বর্ণনা না করে তোমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছি, সেসব ব্যাপারে তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও (অর্থাৎ সেসব বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করো না)। কারণ, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের অধিক প্রশ্ন ও তাদের নবীদের ব্যাপারে তাদের মতভেদের কারণে ধ্বংস হয়েছে। কাজেই আমি যখন তোমাদেরকে কোনো কিছু থেকে নিষেধ করি, তখন তোমরা সেটা থেকে বিরত থাক। আর যখন আমি তোমোদেরকে কোনো বিষয়ে নির্দেশ প্রদান করি, তখন তোমরা তা তোমাদের সাধ্যানুসারে পালন কর।”
৩. আর ‘ইরবাদ ইবন সারিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«وَعَظَنَا رسولُ اللهِ  صلى الله عليه وسلم مَوعظةً بَليغَةً وَجِلَتْ مِنْهَا القُلُوبُ ، وَذَرَفَتْ مِنْهَا العُيُونُ ، فَقُلْنَا : يَا رسولَ اللهِ ! كَأَنَّهَا مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَأوْصِنَا ، قَالَ: «أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللهِ، وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإنْ تَأمَّر عَلَيْكُمْ عَبْدٌ حَبَشِيٌّ ، وَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ فَسَيَرَى اختِلافاً كَثيراً ، فَعَليْكُمْ بسُنَّتِي وسُنَّةِ الخُلَفاءِ الرَّاشِدِينَ المَهْدِيِيِّنَ عَضُّوا عَلَيْهَا بالنَّواجِذِ ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ؛ فإنَّ كلَّ بدعة ضلالة».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জ্বালাময়ী ভাষায় আমাদেরকে উপদেশ দিলেন। এতে আমাদের মন গলে গেল এবং চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগল, তখন আমরা বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! এটা তো বিদায়ী ভাষণের মতো। কাজেই আপনি আমাদেরকে আরও উপদেশ দিন। তখন তিনি বলেন: ‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বনের জন্য উপদেশ দিচ্ছি, আর তোমাদের ওপর হাবশী গোলামকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করে দিলেও তার কথা শুনার এবং তার অনুগত্য করার উপদেশ দিচ্ছি, আর তোমাদের কেউ জীবিত থাকলে সে অবশ্যই বহু রকমের মতভেদ দেখতে পাবে, তখন তোমাদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য হলো আমার সুন্নাত ও হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে অনুসরণ করা, এ সুন্নাতকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরে থাক এবং সকল প্রকার বিদ‘আত থেকে বিরত থাক। কারণ, প্রত্যেকটি বিদ‘আত-ই পথভ্রষ্টতা।”
নবী তোমার কাছে তোমার নিজের জীবনের চেয়ে অধিক ঘনিষ্টতর!!
প্রিয় ভাই আমার! তুমি কি জান না যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমার কাছে তোমার জীবনের চেয়েও অধিক প্রিয় হওয়া উচিৎ? আল্লাহর কসম! প্রিয় ভাই আমার! অবশ্যই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমার কাছে তোমার জীবনের চেয়েও অধিক প্রিয় হতে হবে। আর এটা সম্ভব হবে তাঁকে অনুসরণ ও অনুকরণ করার দ্বারা এবং তাঁর বশ্যতা স্বীকার করার মাধ্যমে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ٱلنَّبِيُّ أَوۡلَىٰ بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ مِنۡ أَنفُسِهِمۡۖ﴾ [الاحزاب: ٦]
“নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও ঘনিষ্টতর।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৬]
ইবনুল কায়্যেম রহ. বলেন: “আর এ আয়াতটি এ কথার ওপর দলীল যে, যার কাছে তার নিজের চেয়েও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘনিষ্টতর না হবেন, সে মুমিনগণের অন্তর্ভুক্ত নয়, আর এ ঘনিষ্টতা ও শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি কতগুলো বিষয়কে শামিল করে:
তন্মধ্যে একটি হলো: বান্দার কাছে তার নিজের জীবনের চেয়েও তিনি অধিক প্রিয় হবেন। কারণ, ঘনিষ্টতার মূল কথা হলো মহব্বত করা, আর বান্দার জীবনটি তার কাছে অন্যের চেয়ে অনেক বেশি প্রিয়, এটা সত্ত্বেও ওয়াজিব হলো তার কাছে তার জীবনের চেয়েও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘনিষ্টতর ও অধিক প্রিয় হওয়া। কারণ, এর মাধ্যমেই তার পক্ষে ঈমান নামক বস্তুটি অর্জন করা সম্ভব হবে।
* আর এ ঘনিষ্টতা ও মহব্বতের কারণে আবশ্যক হয়ে পড়ে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করা, আনুগত্য করা, তাঁকে মেনে নেওয়া এবং তাঁর সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা; আর তাঁর নির্দেশের প্রতি নিজেকে সঁপে দেওয়া এবং সকল কিছুর উপর তাঁকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
তন্মধ্যে আরেকটি হলো: মৌলিকভাবে বান্দার জন্য তার নিজের উপর সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার থাকবে না; বরং তার নিজের ওপর হুকুম চলবে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের, তিনি তার ওপর হুকুম বা সিদ্ধান্ত দিবেন এমন জোরালোভাবে, যা মনিব কর্তৃক গোলামের ওপর দেওয়া সিদ্ধান্ত এবং পিতা কর্তৃক সন্তানের ওপর দেওয়া সিদ্ধান্তের চেয়ে অনেক বেশি শ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ হবে। সুতরাং তার জন্য কোনো বিষয়ে কখনও তার নিজের মধ্যে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই, যে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হস্তক্ষেপ করেছেন, যিনি তার (বান্দার) কাছে তার নিজের চেয়েও ঘনিষ্টতর।
সুতরাং আশ্চর্যের বিষয়! বান্দার জন্য কিভাবে এ ঘনিষ্টতা অর্জিত হবে, অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিচারকের পদমর্যাদা ও অবস্থান প্রসঙ্গে যা নিয়ে এসেছেন, সে তা থেকে দূরে সরে যায় এবং অন্যের বিচার-ফয়সালায় সে সন্তুষ্ট হয়। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রশান্তি পাওয়ার চেয়ে সে তার (অন্য বিচারকের) কাছে অনেক বেশি প্রশান্তি অনুভব করে, আর সে ধারণা করে যে, তাঁর (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের) আলোর মশাল থেকে সঠিক পথ পাওয়া যাবে না, বরং তা পাওয়া যাবে যুক্তি-বুদ্ধির নির্দেশনা থেকে। আর তিনি যা নিয়ে এসেছেন, তা নিশ্চিত জ্ঞানের ফায়দা দেয় না ...ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কথা, যা তাঁর প্রতি এবং তিনি যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলাই বুঝায়, আর এটাই হচ্ছে বড় পথভ্রষ্টতা। বান্দার কাছে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘনিষ্টতর হওয়ার এ বিষয়টি প্রমাণের ক্ষেত্রে তিনি ভিন্ন বাকি সব বর্জন করা এবং সকল বিষয়ে তাঁকে গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। আর তার বিপরীতে বলা প্রত্যেকের কথাকে তার কথার কাছে পেশ করা, ফলে যদি তাঁর কথা সেটার বিশুদ্ধতার পক্ষে সাক্ষ্য দেয়, তাহলে সেটা গ্রহণ করবে। আর যদি তাঁর কথা সেটা বাতিল বা অচল বলে সাক্ষ্য দেয়, তাহলে তা প্রত্যাখ্যান করবে। আর যদি নবীর কথার মাধ্যমে সেটার বিশুদ্ধতা কিংবা বাতিল হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট না হয় তখন অন্যের এসব কথাকে কিতাবধারী (ইয়াহূদী-নাসারা)দের কথার মত মনে করতে হবে; যতক্ষণ না তার কাছে কোনো কিছু স্পষ্ট হবে ততক্ষণ সে ব্যাপারে আমল করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
সুতরাং যে ব্যক্তি এ পদ্ধতি অনুসরণ করবে, সে ব্যক্তির জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে হিজরতের যাত্রাপথটি সঠিক বলে বিবেচিত হবে এবং তার ইলম (জ্ঞান) ও আমল সঠিক হবে, আর চতুর্দিক থেকে সঠিক বিষয়গুলো তার দিকে ছুটে আসবে ।
* * *

সুন্নাতের অনুসরণ করার প্রশ্নে পূর্ববর্তী ভালো মানুষজনের অবস্থান
এ উম্মতের ভালো মানুষগণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতকে ভালোবেসেছেন, তা আমল করেছেন, তার দিকে জনগণকে দা‘ওয়াত দিয়েছেন এবং তাকে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ করেছেন, আর তা প্রচার ও প্রসারের পথে অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন এবং তার শত্রুদের সাথে রীতিমত যুদ্ধ করেছেন, অবশেষে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের কালেমা বিজয় লাভ করেছে; আর প্রবৃত্তির পূজারী ও বিদ‘আতের অনুসারী ব্যক্তি-গোষ্ঠীর মতবাদ ও চিন্তধারার পতন হয়েছে।
প্রথমত: সাহাবীগণ:
১. এই তো আবূ বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, তিনি বলেন:
«لَسْتُ تَارِكًا شَيْئًا كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَعْمَلُ بِهِ إِلا عَمِلْتُ بِهِ ، إِنِّي أَخْشَى إِنْ تَرَكْتُ شَيْئًا مِنْ أَمْرِهِ أَنْ أَزِيغَ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা আমল করতেন, আমি তার কোনো কিছুই ছেড়ে দিতে পারি না, বরং আমি তাই আমল করব। কারণ, আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করি, যদি আমি তাঁর কোনো কথা বা নির্দেশনা ছেড়ে দিই।”
২. আর এই তো উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, তিনি বলেন:
«إِنِّي لَأَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لَا تَضُرُّ ولَا تَنْفَعُ، وَلَوْلَا أَنِّي رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ!».
“আমি ভালো করেই জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র, না তুমি কোনো ক্ষতি করতে পার, আর না পার কোনো উপকার করতে। আমি যদি তোমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলো আমি কখনও তোমাকে চুমু দিতাম না।”
৩. সা‘ঈদ ইবন মানসূর রহ. সাহাবী ‘ইমরান ইবন হোসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
«أنهم كانوا يتذاكرون الحديث، فقال رجل: دعونا من هذا، وجيئونا بكتاب الله، فقال عمران: إنك أحمق؛ أتجد في كتاب الله الصلاة مفسرة؟ أتجد في كتاب الله الصوم مفسراً؟ إن هذا القرآن أحكم ذلك، والسنة تفسِّره».
“তারা হাদীস নিয়ে আলোচনা করছিলেন, তখন এক ব্যক্তি বলল: আমাদের নিকট এ বিষয়ে আলোচনা করা থেকে বিরত থাক এবং আমাদের নিকট আল্লাহর কিতাব তথা কুরআন নিয়ে আস। জবাবে ‘ইমরান বললেন: তুমি একটা আহাম্মক। তুমি কি আল্লাহর কিতাব আল-কুরআনের মধ্যে সালাতে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে পাবে? তুমি কি আল্লাহর কিতাবের মধ্যে সাওমের বিষয়টিকে বিস্তারিতভাবে পাবে? আল-কুরআনুল কারীম এ বিষয়ে বিধান বা সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে; আর সুন্নাহ তাকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছে।”
৪. আর এই তো আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, তিনি বলেন:
«مَا كُنْتُ لِأَدَعَ سُنّةَ رَسُولِ اللّهِ صَلّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ لِقَوْلِ أَحَدٍ مِنَ النَّاسِ».
“আমি কোনো মানুষের কথায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতকে ছেড়ে দিতে পারি না।”
৫. আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আরও বলেন:
«لَو كانَ الدِّينُ بالرأْي، لَكانَ باطنُ الخُفين أَحَقَّ بالمَسْحِ منْ ظاهِرهِما وَلَكِنْ رأَيتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَمْسَحُ عَلَى ظاهِرهِما».
“যদি দীনের বিষয়টি যুক্তি-তর্কের দ্বারা পরিচালিত হত, তাহলে মোজাদ্বয়ের বাইরের অংশের চেয়ে ভিতরের অংশ মাসেহ করার বিষয়টি অগ্রধিকার পাওয়ার মত ছিল; কিন্তু আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মোজার বাইরের অংশে মাসেহ করতে দেখেছি।”
৬. আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
«الاِقْتِصَادُ فِى السُّنَّةِ خيرٌ مِنَ الاِجْتِهَادِ فِى الْبِدْعَةِ».
“বিদ‘আত নিয়ে কষ্টকর আমল করার চেয়ে সুন্নাতের (অনুসরণ করার) ব্যাপারে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা অনেক উত্তম।”
৭. উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
«عَلَيْكُمْ بِالسَّبِيلِ وَالسُّنَّةِ ، فَإِنَّهُ لَيْسَ مِنْ عَبْدٍ عَلَى سَبِيلٍ وَسُنَّةٍ، ذَكَرَ الرحْمنَ فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ ، فَمَسَّتْه النَّارُ أَبَدًا، وَإِنْ اقْتِصَادًا فِي سَبِيلٍ وَسُنَّةٍ خَيْرٌ مِنْ اجْتِهَادٍ فِي خِلَافِ سَبِيلٍ وَسُنَّةٍ».
“তোমাদের জন্য অপরিহার্য হলো আল্লাহর পথ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করা। কারণ, যে ব্যক্তিই আল্লাহর পথ ও সুন্নাতের উপর অবিচল থেকে দয়মায় আল্লাহকে স্মরণ করে, তারপর আল্লাহর ভয়ে তার দু’চোখ অশ্রু বিসর্জন করে, সে ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুন কখনও স্পর্শ করবে না, আর আল্লাহর পথ ও সুন্নাতের বিপরীত বিষয়ে কষ্টকর আমল করার চেয়ে আল্লাহর পথ ও সুন্নাতের (অনুসরণ করার) ব্যাপারে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা অনেক উত্তম।”
৮. আর এই তো আদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার কথা বলছি: হুবহু নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করার কারণে কেউ যখন তাঁকে দেখত, তখন সে মনে করত যে, তাকে কোনো কিছু পেয়ে বসেছে! তার আযাদকৃত গোলাম নাফে‘ বলেন:  
«لو نظرت إلى ابن عمر رضي الله عنهما إذ اتبع سنّةَ النبي صلى الله عليه وسلم لقلت : هذا مجنون!!».
“যদি তুমি আদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার দিকে তাকাতে যখন তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করেন, তখন তুমি বলতে: এ তো পাগল!!”
৯. আর আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন:
«أما تخافون أن تعذبوا ويخسف بكم؟ أن تقولوا : قال رسول الله وقال فلان!».
“তোমাদের কি ভয় হয় না যে, তোমাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং তোমাদেরকে নিয়ে যমীন ধ্বসে যাবে? কারণ, তোমরা বল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন এবং অমুক ব্যক্তি বলেছেন।” (অর্থাৎ তোমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা এবং সাধারণ ব্যক্তির কথাকে এক পাল্লায় ওজন কর এবং একই রকম মনে কর। সাবধান! বিষয়টি কখনও এক রকম হতে পারে না)
১০. আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা আরও বলেন:
«أيها النَّاس! تُوشكُ أَنْ تَنزلَ عَليكُم حِجارة من السماءِ؛ أَقولُ لَكُم: قالَ رسولُ الله صلى الله عليه وعلى آله وسلمَّ وتقُولونَ: قالَ أَبو بكر وعُمر!!».
“হে জনগণ! অচিরেই তোমাদের উপর আকাশ থেকে পাথরের বৃষ্টি বর্ষিত হবে! আমি তোমাদেরকে বলছি: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; আর তোমরা বলছ: আবূ বকর ও উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেছেন!!” (অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা এবং আবূ বকর ও উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার কথার মান কখনও এক নয়। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথার বিপরীতে আবূ বকর ও উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার মতো প্রভাবশালী ব্যক্তির কথাও গ্রহণযোগ্য হবে না)।
দ্বিতীয়ত: তাবে‘ঈগণ ও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম:
১. আবূল ‘আলিয়া রহ. বলেন:
«عليكم بالأمر الأول الذي كانوا عليه قبل أن يفترقوا».
“তোমাদের ওপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হলো প্রথম বিষয় ও নির্দেশনাটিকে আঁকড়িয়ে ধরা, যার উপর তাঁরা মতানৈক্য সৃষ্টির পূর্বেই প্রতিষ্ঠিত ছিল।”
২. আওযা‘ঈ রহ. বলেন:
«اصبر نفسك على السنة , وقف حيث وقف القوم , وقل بما قالوا , وكفَّ عما كفوا عنه , واسلك سبيل سلفك الصالح , فإنه يسعك ما وسعهم».
“তুমি নিজেকে সুন্নাহর ওপর ধৈর্যের সাথে প্রতিষ্ঠিত রাখ, আর তুমি থেমে যাও, যেখানে জাতি থেমে গেছে; আর তুমি বল, তাঁরা যা বলেছে, আর তুমি তা থেকে বিরত থাক, যা থেকে তারা বিরত থেকেছে, আর তুমি তোমার পূর্ববর্তী সজ্জনদের পথে চল। কারণ, তা তোমাকে শক্তি যোগাবে, যা তাদেরকে শক্তি যুগিয়েছে।”
৩. ইউসূফ ইবন আসবাত রহ. বলেন:
«إِذا بَلغكَ عن رجُلٍ بالمشرق؛ أَنه صَاحبُ سُنة، فابعثْ إِليه بالسلام؛ فقد قل أَهل السنَّة».
“প্রাচ্যের কোনো লোকের কাছ থেকে যখন তোমার কাছে কোনো খবর পৌঁছে যে, সে সুন্নাহর অনুসারী, তখন তুমি তাঁর কাছে সালাম পৌঁছাও। কারণ, সুন্নাহর অনুসারীর সংখ্যা কমে গেছে।”
৪. আর আইয়ূব রহ. বলেন:
«إِنِّي لأخْبَرُ بموتِ الرجُلِ من أَهلِ السنة؛ فكأنِّي أَفقدُ بعضَ أَعضائي».
“আমাকে সুন্নাহর অনুসারী কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর সংবাদ দেওয়া হলে, মনে হয় যেন আমি আমার কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে ফেলি।”
৫. আইয়ূব রহ. আরও বলেন:
«إن من سعادة الحَدَث والأعجميّ أن يوفقهما الله لعالمٍ مِنْ أهل السنة».
“যুবক ও অনারব ব্যক্তির জন্য সৌভাগ্যের কারণ হলো, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাওফীক দিবেন সুন্নাহর অনুসারী একজন আলেমের অনুসরণ করার।”
৬. আবূ বকর ইবন ‘আইয়াশ রহ. বলেন:
«السنة في الإسلام أعز من الإسلام في سائر الأديان».
“সকল ধর্মের মধ্যে ইসলামের মর্যাদাগত অবস্থানের চেয়ে ইসলামের মধ্যে সুন্নাহর অবস্থানের বিষয়টি অধিক শক্তিশালী।”
৭. সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেন:
«استوصوا بأهل السنة خيراً ، فإنهم غرباء».
“তোমরা সুন্নাহর অনুসারীগণের কল্যাণ কামনা কর। কারণ, তারা অপরিচিত হয়ে গেছে (হারিয়ে যাচ্ছে)।”
৮. জুনায়েদ রহ. বলেন:
«الطرق كلها مسدودة إلا على المقتفين آثار رسول الله صلى الله عليه وسلم، والمتبعين سنته وطريقته، فإن طرق الخيرات كلها مفتوحة عليه كما قال الله تعالى: ﴿لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ﴾ [الاحزاب: ٢١] » .
“(মানুষের জন্য) সকল পথ বন্ধ, তবে তাদের জন্য নয়, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদাঙ্ক অনুসরণকারী এবং তাঁর সুন্নাত ও কর্মপন্থার অনুকরণকারী। কারণ, কল্যাণের সকল পথ তার জন্য খোলা রয়েছে, যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১]
* * *

সুন্নাহ সম্পর্কে জাহেল বা অজ্ঞ ব্যক্তির সাথে কথপোকথন
ইমাম আল-আজুররী তাঁর ‘আশ-শরী‘আহ’ (الشريعة) নামক গ্রন্থে বলেন: জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিবর্গের জন্য উচিৎ হলো, যখন তারা কোনো ব্যক্তিকে বলতে শুনবে: কোনো বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যা আলেমগণের নিকট প্রমাণিত, তারপর জাহেল বা মূর্খ ব্যক্তি তার বিরোধিতা করে বলল: আমি আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের মধ্যে যা আছে, তা ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করব না, তখন-
আলেমের ওপর কর্তব্য হবে এটা বলা যে, তুমি একজন মন্দ লোক, আর তুমি এমন এক ব্যক্তি, যার ব্যাপারে আমাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করেছেন এবং আলেমগণও তোমার ব্যাপারে সতর্ক করেছে।
আর তাকে বলতে হবে: হে জাহেল‍! আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ফরযসমূহ সার্বিকভাবে অবতীর্ণ করেছেন এবং তাঁর নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তিনি জনগণকে তাদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তা সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلذِّكۡرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيۡهِمۡ وَلَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ ٤٤﴾ [النحل: ٤٤]
“আর আমরা তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে পার- যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল, যাতে তারা চিন্তাভাবনা করে।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৪৪]
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর বিরোধী এ ব্যক্তিকে বলতে হবে: হে মূর্খ! আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ﴾ [البقرة: ٤٣]
“আর তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা কর ও যাকাত দাও।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৪৩]
তুমি আল্লাহ তা‘আলার কিতাব আল-কুরআনের মধ্যে কোথায় পাবে যে, ফযরের সালাত দুই রাকাত? যোহরের সালাত চার রাকাত? আসরের সালাত চার রাকাত? মাগরিবের সালাত তিন রাকাত? আর এশার সালাত চার রাকাত?
আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের মধ্যে ছাড়া আর কোথায় তুমি পাবে সালাতের বিধিবিধান ও সময়সূচী? আর কোথায় পাবে কিসে সালাতকে পরিশুদ্ধ করে এবং কিসে সালাতকে বাতিল বা নষ্ট করে দেয়?!
আর অনুরূপভাবে যাকাতের বিষয়টিও; আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের মধ্যে তুমি কোথায় পাবে দুইশত দিরহাম থেকে পাঁচ দিরহাম যাকাত দিতে হবে? আর বিশ দিনার থেকে দিতে হবে অর্ধ-দিনার? চল্লিশটি ছাগল থেকে যাকাত দিতে হবে একটি ছাগল? আর পাঁচটি উটের যাকাত দিতে হবে একটি ছাগল দিয়ে? আর যাকাতের সকল বিধিবিধান আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের মধ্যে কোথায় তুমি পাবে?
অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলার সকল ফরয তিনি তাঁর কিতাবের মধ্যে ফরয করে দিয়েছেন, কিন্তু সেগুলোর বিস্তারিত বিধিবিধান সম্পর্কে জানা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ব্যতীত সম্ভব নয়।
এটা হলো মুসলিম সম্প্রদায়ের আলেমগণের কথা; যে ব্যক্তি এর বিপরীত কিছু বলবে, সে মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ (বের) হয়ে যাবে এবং নাস্তিকদের দলে শামিল হবে। আমরা হিদায়াত পাওয়ার পর পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে আল্লাহ তা‘আলার নিকট আশ্রয় চাই।
* * *
সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের কারণসমূহ
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَأُوْلِي ٱلۡأَمۡرِ مِنكُمۡۖ فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ ذَٰلِكَ خَيۡرٞ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلًا ٥٩﴾ [النساء: ٥٩]  
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আরও আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যকার ক্ষমতাশীলদের, অতঃপর কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাক। এ পন্থাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৯]
ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা তাঁর ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন... আর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের কারও আনুগত্য করাটা তখনই কেবল অপরিহার্য (ওয়াজিব) হবে, যখন তার আনুগত্য করার বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যের অন্তর্ভুক্ত হবে, নিঃশর্তভাবে তার (প্রশাসনিক ব্যক্তির) আনুগত্য করা যাবে না। ...অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ﴾ “অতঃপর কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট), আর এটা হলো অকাট্য দলীল এ ব্যাপারে যে, যখনই গোটা দীনের কোনো বিষয়ে মানুষের মাঝে মতভেদ ঘটবে, তখন আবশ্যক হলো সে মতভেদপূর্ণ বিষয়টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট উপস্থাপন করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ব্যতীত অন্য কারও নিকট উপস্থাপন না করা। কারণ, যে ব্যক্তি মতবিরোধপূর্ণ বিষয়টিকে সমাধান করার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ব্যতীত ভিন্ন কারও নিকট পেশ করল, সে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশের বিরোধিতা করল, আর যে ব্যক্তি ঝগড়া বা বিরোধের সময় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ব্যতীত অন্য কারও ফয়সালা বা মীমাংসার দিকে আহ্বান করে, সে ব্যক্তি মূলত জাহেলিয়্যাতের দিকেই আহ্বান করে। অতএব, বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানের গণ্ডীতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না সে বিরোধকারীদের বিরোধপূর্ণ প্রত্যেকটি বিষয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট উপস্থাপন করবে। আর এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: ﴿إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ﴾ “যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাক” অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿ذَٰلِكَ خَيۡرٞ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلًا﴾ “এ পন্থাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর” অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে আমার আনুগত্য করার এবং আমার রাসূল ও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের আনুগত্য করার যে নির্দেশ দিয়েছি সে বিষয়টি মেনে চলা এবং সমাধানের জন্য তোমাদের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ প্রত্যেকটি বিষয় আমার ও আমার রাসূলের নিকট পেশ করার কাজটি তোমাদের জন্য কল্যাণকর হবে তোমাদের ইহকালে ও পরকালে এবং তা উভয় জগতে তোমাদের সৌভাগ্যের কারণ হবে; আর তোমাদের শেষ পরিণাম হবে অতি উত্তম ও প্রকৃষ্টতর।  
সুতরাং এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে বিচারক বা সালিস মানার বিষয়টি হলো দুনিয়া ও আখিরাতে সৌভাগ্যবান হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ বা উপলক্ষ। আর যে ব্যক্তি বিশ্ব ব্যবস্থা ও তার মধ্যকার সংঘটিত ক্ষতি ও দুর্যোগ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করবে, সে ব্যক্তি জানতে পারবে যে, দুনিয়ার প্রতিটি মন্দ ও অকল্যাণের কারণ হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধাচরণ করা এবং তাঁর আনুগত্যের গণ্ডী থেকে বের হয়ে যাওয়া। আর দুনিয়ার মধ্যকার প্রতিটি কল্যাণ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার কারণেই অর্জিত হয়। অনুরূপভাবে আখেরাতের খারাপি, যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ও আযাবের বিষয়টিও অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে। সুতরাং দুনিয়া ও আখিরাতের অকল্যাণ ও বিপদ-মুসীবত আপতিত হওয়ার বিষয়টি প্রত্যাবর্তন ও নির্ভর করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধাচরণ করার দিকে।
অতএব, মানুষ যদি যথাযথভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করে, তাহলে পৃথিবীতে কখনও কোনা মন্দ ও অকল্যাণ হবে না, আর এ তো হলো পৃথিবীতে সংঘটিত সাধারণ দুর্যোগ ও বিপদ-মুসীবতের কথা, আর বান্দা নিজে যে মন্দ, যন্ত্রণা ও দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হয়, সে বিষয়টির বেলায়ও একই কথা। কারণ, তা শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধাচরণ করার কারণেই হয়ে থাকে। কেননা, তাঁর আনুগত্য করার বিষয়টি হলো এমন দুর্গ, যে কেউ তাতে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ হয়ে যাবে; আর তা হলো এমন এক গুহা, যে কেউ তাতে আশ্রয় নিবে সে মুক্তি পেয়ে যাবে। সুতরাং বুঝা গেল যে, দুনিয়া ও আখিরাতের অকল্যাণ ও বিপর্যয়ের একমাত্র কারণ হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, সে সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং তাঁর আনুগত্যের গণ্ডী ও পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে যাওয়া।
وصلى الله على نبينا محمد و على آله و صحبه و سلّم.
“আল্লাহ রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীগণের প্রতি”।
সমাপ্ত
আধুনিক যুগে বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ সুন্নাহকে বিলকুল অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করে এবং আল-কুরআনকেই যথেষ্ট বলে মনে কর, আরেক দল নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের ব্যাপারে তার প্রবৃত্তি ও চিন্তা-ভাবনাকে বিচারক বা সালিস মানে। অতঃপর সে সুন্নাত থেকে তার ইচ্ছেমত তাই গ্রহণ করে, যা তার বিবেক-বুদ্ধির কাছে সুবিধাজনক হয়।
এ ছোট্ট পুস্তিকাটিতে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তা আঁকড়ে ধরার এবং বিবেক-বুদ্ধির কাছে সুবিধাজনক বিষয়গুলোকে পরিহার করার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।

 

 

 

 

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা গ্রহণ কর

বই সম্পর্কে

লেখক :

أحمد بن عثمان المزيد Adel ibn Ali Al-Shiddy

প্রকাশক :

www.islamhouse.com

বিভাগ :

For New Muslim