সূরা আন-নাবা-এর তাফসীর

তাফসীরে কুরতুবী থেকে পবিত্র কুরআনের মক্কায় অবতীর্ণ গুরুত্বপূর্ণ সূরা আন-নাবা-এর তাফসীর এখানে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ এ সূরাটিতে কিয়ামতের আলোচনা ও জান্নাতের নি‘আমত এবং জাহান্নামের শাস্তি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। মানুষের প্রতি আল্লাহর যে অসীম দয়া রয়েছে তাও তিনি তুলে ধরেছেন। তাফসীরে যদি কোথাও অগ্রহণযোগ্য বর্ণনা দৃষ্টিগোচর হয়েছে তখনি তা বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে কোথাও কোথাও লেখকের নিয়মানুসারে কিছু তাফসীর বর্ণনা করা হয়েছে। বুদ্ধিমান পাঠক সঠিক মতটি নিতে কার্পন্য করবে না বলেই বিশ্বাস।

اسم الكتاب: تفسير سورة النبأ


تأليف: محمد بن أحمد القرطبي


الناشر: المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة


نبذة مختصرة: كتاب مترجمة إلى اللغة البنغالية لتفسير سورة النبأ من الجامع لأحكام القرآن لأبي عبدالله القرطبي رحمه الله.


সূরা আন-নাবা-এর তাফসীর
تفسير سورة النبأ

< بنغالي >
        
আবু আবদুল্লাহ কুরতুবী রহ.





অনুবাদক: জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
 

تفسير سورة النبأ

 

 

 

 

 

أبو عبد الله القرطبي رحمه الله
 


 

ترجمة: ذاكرالله أبوالخير
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
সূচিপত্র

ক্রম    বিষয়    পৃষ্ঠা
1.        ভূমিকা    
2.        সূরাটি নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট    
3.        মহা সংবাদ কি তার ব্যাখ্যা    
4.        কিয়ামত দিবসের বর্ণনা    
5.        জাহান্নামের শাস্তির বর্ণনা    
6.        জাহান্নামীদের সবোর্চ্চ শাস্তির বর্ণনা    
7.        জান্নাতীদের জন্য জান্নাতের নিয়‘আমতসমূহের বর্ণনা    
8.        রূহ-এর তাফসীর বা ব্যাখ্যা    
9.        কিয়ামতের দিন কাফিরদের অসহায়ত্ব    

ভূমিকা

সূরা আন-নাবা মক্কায় অবতীর্ণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা। একে সূরা আম্মা হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এর আয়াত সংখ্যা চল্লিশ অথবা একচল্লিশটি। কিয়ামত দিবস সম্পর্কে মক্কার মুশরিকদের বিভিন্ন অলিক কথা-বার্তার জবাব আল্লাহ তা‘আলা এ সূরাটিতে তুলে ধরেন। আল্লাহ তা‘আলা পুনরুত্থানকে অস্বীকারকারী কাফির ও মুশরিদের জানিয়ে দেন যে, কিয়ামত তথা বিচার ফায়সালার দিন অবশ্যই সংঘটিত হবে। আর তার বাস্তবায়ন আল্লাহর জন্য খুবই সহজ কাজ। কারণ, যিনি আসমান-জমিন, পাহাড়-পর্বত, গাছ-পালা, নদ-নদী ইত্যাদিকে প্রথমে সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি এসব মাখলুককে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে পারবেন না? প্রথমবার সৃষ্টি করা যতটা কঠিন দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা ততটা কঠিন নয়; বরং তা আরো সহজ। সুতরাং আল্লাহর জন্য পুনরুত্থান কোনো কঠিন বিষয় নয়। এ ছাড়াও যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করবে, আখিরাত দিবসের ওপর বিশ্বাস করবে এবং আল্লাহর কিতাবের প্রতি বিশ্বাস করবে, তাদের জন্য জান্নাতে কি কি নিয়‘আমত, পুরস্কার, সাওয়াব ও বিনিময় রয়েছে তার একটি চিত্র এ সূরায় তুলে ধরা হয়েছে। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর নি‘আমতকে অস্বীকার করে, আল্লাহর কিতাবকে অস্বীকার করে, আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনে না এবং নবী ও রাসূলদের বিশ্বাস করে না তাদের পরিণতি যে কত ভয়াবহ এবং তাদের শাস্তি ও ‘আযাব যে কত করুণ ও বেদনাদায়ক হবে তাও এ সূরাতে তুলে ধরা হয়ে। আখিরাত বিষয়ে মক্কায় অবতীর্ণ এ সূরাটি মুমিনের হৃদয়কে বিগলিত করবে। মনের মধ্যে নাড়া দেওয়ার মতো যথেষ্ট বর্ণনা এ সূরার মধ্যে বিদ্যমান। অনেক ইমাম সাহেবকে সালাতে এ সূরাটি পড়তে শোনা যায়। কিন্তু খুব কম সংখ্যক লোকই রয়েছেন যারা এ সূরার অর্থ ও বর্ণনা সম্পর্কে অবগত। তাই সূরাটির তাফসীর তুলে ধরাটা বাংলাভাষা-ভাষীদের জন্য প্রয়োজন মনে করি। ফলে মুহাম্মাদ ইবন ইবন জারীর আবু জাফর আত-তাবারীর তাফসীর ‘তাফসীরে তাবারী’ থেকে এ সূরাটির তাফসীর তুলে ধরার চেষ্টা করি। এ মূল তাফসীরকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সনদ ও বিভিন্ন কবিদের কাব্যগুলো উহ্য রাখা হয়েছে, যাতে পাঠকের জন্য লম্বা এবং বিরক্তির কারণ না হয়। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের কুরআন বুঝা ও অনুধাবন করা তাওফীক দিন। আমীন।
জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের

 

 

 


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
পরম দয়াময় অত্যন্ত দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি,
 ﴿عَمَّ يَتَسَآءَلُونَ ١ عَنِ ٱلنَّبَإِ ٱلۡعَظِيمِ ٢ ٱلَّذِي هُمۡ فِيهِ مُخۡتَلِفُونَ ٣ كَلَّا سَيَعۡلَمُونَ ٤ ثُمَّ كَلَّا سَيَعۡلَمُونَ ٥ ﴾ [النبا: ١،  ٥]   
অর্থানুবাদ:
১. লোকেরা কোন বিষয়ে একে অন্যের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করছে? ২. (কিয়ামত  সংঘটিত হওয়ার) সেই মহা সংবাদের বিষয়ে, ৩. যে বিষয়ে তাদের মাঝে মতপার্থক্য আছে। ৪. কক্ষনো না, তারা শীঘ্রই জানতে পারবে। ৫. আবার বলছি, কক্ষনো না (তাদের ধারণা একেবারে অলীক ও অবাস্তব), তারা শীঘ্রই জানতে পারবে।  [সূরা আন-নাবা, আয়াত: ১-৫]
তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলর বাণী:  عَمَّ يَتَسَآءَلُونَ “লোকেরা কোন কোন বিষয়ে একে অন্যের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করছে”? عَمَّ  অর্থ (কোন বিষয়ে) এটি একটি জিজ্ঞাসাবাচক শব্দ, এ শব্দ থেকে الف পড়ে গেছে, আসলে ছিল عما যাতে করে استفهام  (প্রশ্ন) থেকে  خبر(বিধেয়)-এর স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত করা যায় অনুরূপভাবে فيم  এবং مم  যখন এ দু’টোর দ্বারা কোনো কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়  অর্থাৎ কী সম্পর্কে তারা পরস্পর পরস্পরকে জিজ্ঞেস করছে  
যাজ্জাজ বলেন,  عَمَّমূলত ছিল عن ما,  نونকে ميم এর মধ্যে ইদগাম করা হয়েছে  কেননা তা গুন্নায় তার (ميم) -এর সাথে শরীক হয়েছে  يَتَسَآءَلُونَ -এর সর্বনাম (বা এখানে কর্তা) হচ্ছে কুরাইশরা  (অর্থাৎ কুরাইশরা পরস্পর পরস্পরকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে)
সূরাটি নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট:
আবু সালিহ রহ. বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন,  কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় কুরাইশরা বসে নিজেদের মাঝে কথা-বার্তা বলত, তাদের কেউ একে সত্যায়ন করত আবার কেউ কেউ একে মিথ্যা বলত, ফলে এ সূরা অবতীর্ণ হয়, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, عَمَّ يَتَسَآءَلُونَ؟ “লোকেরা কোন বিষয়ে একে অন্যের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করছে”?  
কেউ কেউ বলেন,  عمএর অর্থ হচ্ছে কী সম্পর্কে মুশরিকরা বাড়াবাড়ি করছে এবং বিবাদে লিপ্ত রয়েছে ? আল্লাহ তা‘আলার বাণী:عَنِ ٱلنَّبَإِ ٱلۡعَظِيمِ  (কিয়ামত  সংঘটিত হওয়ার) “সেই মহা সংবাদের বিষয়ে”  অর্থাৎ তারা ‘মহা সংবাদের বিষয়ে’ জিজ্ঞাসাবাদ করছে عن  শব্দটি তিলাওয়াতে থাকা يَتَسَآءَلُونَ -এর সাথে সম্পর্ক রাখে না  কেননা, তাহলে  استفهامএর আলামত প্রবেশ করা আবশ্যক ছিল  ফলে হতعَنِ ٱلنَّبَإِ ٱلۡعَظِيمِ  (কিয়ামত  সংঘটিত হওয়ার) “সেই মহা সংবাদের বিষয়ে”?) যেমন তুমি বল: কতজন মালিক, ত্রিশজন নাকি চল্লিশ জন? ফলে তিলাওয়াতের يَتَسَآءَلُونَ -এর সাথে সম্পৃক্ত নয় মর্মে আমাদের উল্লিখিত বিষয়টি আবশ্যক হত, বরং তা উহ্য আরেকটি يَتَسَآءَلُونَ -এর সাথে সম্পৃক্ত  মাহদাওয়ী বলেন, কতিপয় পণ্ডিত ব্যক্তি উল্লেখ করেছেন যে, استفهام (জিজ্ঞাসা) عن এর মাঝে দ্বিতীয়বার সংঘটিত হয়েছে তবে তা উহ্যরূপে  যেমন তিনি বলেন, কী সম্পর্কে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করছে, সেই মহা সংবাদের বিষয়ে কী? আর এ অবস্থায় তা প্রথম আয়াতের সাথে সম্পৃক্ত  ٱلنَّبَإِ ٱلۡعَظِيمِ  হচ্ছে, মহা সংবাদ, বড় খবর।
ٱلَّذِي هُمۡ فِيهِ مُخۡتَلِفُونَ  “যে বিষয়ে তাদের মাঝে মতপার্থক্য আছে” অর্থাৎ এ বিষয়ে তারা পরস্পর মতপার্থক্য করছে, একদল সত্যায়ন করছে আর অপর দল করছে তাতে মিথ্যারোপ।  
মহাসংবাদ কী তার ব্যাখ্যা:
আবু সালিহ বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহুআনহুমা বলেন, মহা সংবাদ হচ্ছে কুরআন, তার প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ﴿قُلۡ هُوَ نَبَؤٌاْ عَظِيمٌ ٦٧ أَنتُمۡ عَنۡهُ مُعۡرِضُونَ ٦٨ ﴾ [ص : ٦٧،  ٦٨]   “বলুন, এটা এক ভয়ানক সংবাদ। যা থেকে তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ”  [সূরা স-দ, আয়াত: ৬৭-৬৮] কুরআন হচ্ছে খবর, সংবাদ এবং ঘটনাবলী, কুরআন হচ্ছে এমন সংবাদ যার ব্যাপার অতি বিরাট ও মহান।  
সা‘ঈদ বর্ণনা করেন, কাতাদা বলেন, তা হচ্ছে মুত্যুর পরে পুনরুত্থান, লোকেরা এ ব্যাপারে দুই দলে বিভক্ত, কেউ একে সত্য বলছে, কেউ একে বলছে মিথ্যা  
কেউ কেউ বলেন, (এটা হচ্ছে) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ  
দাহহাক বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, ইয়াহূদীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অনেক বিষয়ে জিজ্ঞেস করে, এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে তাদের মতবিরোধের ব্যাপারে অবহিত করেন, এরপর তিনি তাদেরকে ধমক দিয়ে বলেন,  كَلَّا سَيَعۡلَمُون“কখনো না, (তারা যা ধারণা করে তা একেবারে অলীক ও অবাস্তব), তারা শীঘ্রই জানতে পারবে” অর্থাৎ তারা অচিরেই  কুরআনে বর্ণিত  পরিণাম সম্পর্কে বুঝতে পারবে অর্থাৎ তারা অচিরেই পুনরুত্থান সম্পর্কে জানতে পারবে, সেটা কি সত্য নাকি মিথ্যা।
 كلا  তাদের পুনরুত্থান সম্পর্কে অস্বীকৃতি এবং কুরআনকে মিথ্যা সাব্যস্ত করার জবাবে বলা হয়েছে  ফলে এখানে থামতে হবে এ অর্থ করাও বৈধ ‘যথাযথভাবে’ অথবা ‘জেনে রেখো’  তবে সবচেয়ে স্পষ্ট অর্থ হচ্ছে, তাদের জিজ্ঞাসা ছিল পুনরুত্থান সম্পর্কে। আমাদের কতিপয় আলেম বলেন,
﴿إِنَّ يَوۡمَ ٱلۡفَصۡلِ كَانَ مِيقَٰتٗا ١٧﴾ [النبا: ١٧]  
“নিশ্চয় নির্ধারিত আছে মীমাংসার দিন” [সূরা আন-নাবা, আয়াত: ১৭] এ আয়াত যা প্রমাণ  করে তাতে প্রমাণিত হয় যে, তারা পরস্পর পুনরুত্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।
ثُمَّ كَلَّا سَيَعۡلَمُونَ “আবার বলছি, কখনো নয়, তারা শীঘ্রই জানতে পারবে” মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন এবং মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান সম্পর্কে তাদেরকে যা বলেছেন, তার সত্যতা ও বাস্তবতা সম্পর্কে সত্যসত্যই তারা অবশ্যই জানতে পারবে
দাহহাক বলেন:كَلَّا سَيَعۡلَمُونَ  “তারা অচিরেই জানতে পারবে” অর্থাৎ কাফিররা তাদের মিথ্যা সাব্যস্ত করার পরিণতি সম্পর্কে অচিরেই জানতে পারবে   মুমিনগণ তাদের সত্য বলে মেনে নেওয়ার পরিণতি সম্পর্কে অবশ্যই জানতে পারবে।
কেউ কেউ বলেন, এর বিপরীত অর্থও বলেছেন।
হাসান রহ. বলেন, এখানে ভীতিপ্রদর্শনের পর ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে  
অধিকাংশ আলেম يا দ্বারা পাঠ করেছেন  আর তা খবর, তা এ কারণে যে, আয়াতে বলা হয়েছে  ﴿يَتَسَآءَلُونَ﴾ জিজ্ঞাসাবাদ করছে? এবং আল্লাহর বাণী: ٱلَّذِي هُمۡ فِيهِ مُخۡتَلِفُونَ “যে বিষয়ে তাদের মাঝে মতপার্থক্য আছে” (নাম পুরুষ ব্যবহার করা হয়েছে), হাসান, আবুল আলীয়্যাহ এবং মালিক ইবন দীনার উভয়ের মাঝে تا দ্বারা পড়েছেন। (অর্থাৎ,  تعلمون)
﴿أَلَمۡ نَجۡعَلِ ٱلۡأَرۡضَ مِهَٰدٗا ٦ وَٱلۡجِبَالَ أَوۡتَادٗا ٧ وَخَلَقۡنَٰكُمۡ أَزۡوَٰجٗا ٨ وَجَعَلۡنَا نَوۡمَكُمۡ سُبَاتٗا ٩ وَجَعَلۡنَا ٱلَّيۡلَ لِبَاسٗا ١٠ وَجَعَلۡنَا ٱلنَّهَارَ مَعَاشٗا ١١ وَبَنَيۡنَا فَوۡقَكُمۡ سَبۡعٗا شِدَادٗا ١٢ وَجَعَلۡنَا سِرَاجٗا وَهَّاجٗا ١٣ وَأَنزَلۡنَا مِنَ ٱلۡمُعۡصِرَٰتِ مَآءٗ ثَجَّاجٗا ١٤ لِّنُخۡرِجَ بِهِۦ حَبّٗا وَنَبَاتٗا ١٥ وَجَنَّٰتٍ أَلۡفَافًا ١٦ ﴾ [النبا: ٦،  ١٦]  
অর্থানুবাদ:
৬. আমরা যে সব কিছুকে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে সক্ষম তা তোমরা অস্বীকার করছ কীভাবে) আমরা কি জমিনকে (তোমাদের জন্য) বিছানা বানাই নি? ৭. আর পর্বতগুলোকে কীলক (বানাই নি)? ৮. আর আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়। ৯. আর তোমাদের নিদ্রাকে করেছি বিশ্রামদায়ী। ১০. আর রাতকে করেছি আবরণ, ১১. আর দিনকে করেছি জীবিকা সংগ্রহের মাধ্যম। ১২. আর তোমাদের উর্ধ্বদেশে বানিয়েছি সাতটি সুদৃঢ় আকাশ। ১৩. এবং সৃষ্টি করেছি উজ্জ্বল প্রদীপ। ১৪. আর আমরা বর্ষণ করি বৃষ্টিবাহী মেঘমালা থেকে প্রচুর পানি, ১৫. যাতে আমি তা দিয়ে উৎপন্ন করি শস্য ও উদ্ভিদ ১৬. আর ঘন উদ্যান। [সূরা আন-নাবা, আয়াত: ৬-১৫]
তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَلَمۡ نَجۡعَلِ ٱلۡأَرۡضَ مِهَٰدٗا “আমরা কি জমিনকে (তোমাদের জন্য) বিছানা বানাই নি”? এখানে তাদেরকে অবহিত করেছেন যে, তিনি পুনরুত্থান ঘটাতে সক্ষম  অর্থাৎ এ সব কিছুর অস্তিত্ব দানে আমার ক্ষমতা (এ গুলোকে) পুনরায় সৃষ্টি করার ক্ষমতার চেয়ে বড়  مهاد হচ্ছে নিম্নভূমি ও বিছানা  আল্লাহ তা‘আলা অপর একটি আয়াতে বলেন: ﴿ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ فِرَٰشٗا ٢٢﴾ [البقرة: ٢٢]   “যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিছানা বানিয়েছেন”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২]
আয়াতেمهداً  ও পড়া হয়েছে, অর্থাৎ এটা যেন তাদের জন্য বাচ্চার দোলনার মতো, এটা তার জন্য বিছিয়ে দেওয়া হয় ফলে সে তার উপরে শয়ন করে  
 وَٱلۡجِبَالَ أَوۡتَادٗا ً“আর পর্বতগুলোকে কীলক (বানাই নি)?”) যেন তা স্থির থাকে, কেঁপে না উঠে এবং এর অধিবাসীদের নিয়ে হেলে না পড়ে  وَخَلَقۡنَٰكُمۡ أَزۡوَٰجٗا “আর আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়” কয়েক প্রকারে, পুরুষ এবং নারী।
কেউ কেউ বলেন, বিভিন্ন রঙে।
কেউ কেউ বলেন, এখানে সুশ্রী-কদাকার, লম্বা-খাটো সবই শামিল, যাতে করে অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়, যাতে মর্যাদাবানরা শুকরিয়া আদায় করে আর অধম ধৈর্য ধারণ করে।
 وَجَعَلۡنَا نَوۡمَكُمۡ سُبَاتٗا“আর তোমাদের নিদ্রাকে করেছি বিশ্রামদায়ী” এখানে  جعلنا অর্থ হচ্ছে আমরা বানিয়েছি এ কারণে এটি দু’টি  مفعول-এর দিকে মুতা‘আদ্দী (সকর্মক ক্রিয়া) হয়েছে  سُبَاتٗا (বিশ্রামদায়ী) এটা হচ্ছে দ্বিতীয়  مفعول অর্থাৎ তোমাদের শরীরের আরামের জন্য, যেমন বলা হয় يوم السبت অর্থাৎ আরামের দিন, অর্থাৎ বাণী ইসরাঈলকে বলা হয়েছিল তোমরা এ দিনে আরাম কর, এদিন কিছুই করো না। অবশ্য ইবনুল আনবারী এ মত অস্বীকার করেছেন, তিনি বলেন, আরামকে سبات বলা হয় না   
কেউকেউ  বলেন, এর মূল হচ্ছে সম্প্রসারিত ও বিস্তৃত করা  বলা হয়:   سبتت المرأة شعرها নারীর চুল খুলার সময় বলা হয় সে তার চুলকে ছড়িয়ে দিয়েছে  سبات হচ্ছে ছড়িয়ে দেওয়ার  মতো। আরও বলা হয়ে থাকে   ورجل مسبوت الخلق লোকটি প্রশস্ত চরিত্রের অধিকারী, যখন কেউ আরাম করার ইচ্ছা করে তখন সে প্রসারিত হয় বা ছড়িয়ে দেয় এ কারণে আরাম করাকে  سبتবলা হয়েছে।
কেউ বলেন, এর মূল হচ্ছে বিচ্ছিন্ন করা, যেমন বলা হয় سبت شعره سبتا (সে তার চুলকে বিচ্ছিন্ন করেছে) যখন সে তা মুণ্ডন করে, যেন যখন সে ঘুমায় তখন সে লোকেদের এবং কর্মব্যস্ততা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়,
বস্তুত  سباتশব্দটি মৃত্যুর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, তবে রূহ তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না  বলা হয়: سير سبت  নিদ্রিত অবস্থায় বেড়ানো (ঘুমের মাঝে স্বপ্নচারণ করা) অর্থাৎ: সহজ, কোমল।
وَجَعَلۡنَا ٱلَّيۡلَ لِبَاسٗا  “রাতকে করেছি আবরণ” অর্থাৎ এর অন্ধকার তোমাদেরকে আচ্ছাদিত করে আর ঢেকে ফেলে  তাবারী বর্ণনা করেন, ইবন জুবাইর এবং সুদ্দী বলেন, তোমাদের জন্য শান্তিদায়ক করেছি।  
وَجَعَلۡنَا ٱلنَّهَارَ مَعَاشٗا “আর দিনকে করেছি জীবিকা সংগ্রহের মাধ্যম” এখানে ‘সময়’ কথাটি উহ্য রয়েছে অর্থাৎ জীবিকার সময়, অর্থাৎ জীবিকা অন্বেষণের জন্য কাজ-কর্ম, অর্থাৎ খাদ্য-পানীয় এবং অন্যান্য কিছুর মাধ্যমে জীবিকার সময়, এর ভিত্তিতে معاشا হচ্ছে সময়ের নাম, আবার معاشاً শব্দটি জীবন-যাপন অর্থে মাসদারও হতে পারে। এ অবস্থায় مضاف উহ্য থাকবে, (অর্থাৎ  وقت عيش) জীবিকার সময়।  
 وَبَنَيۡنَا فَوۡقَكُمۡ سَبۡعٗا شِدَادٗا “আর তোমাদের উর্ধ্বদেশে বানিয়েছি সাতটি সুদৃঢ় আকাশ” অর্থাৎ সপ্ত আসমান, যা অত্যন্ত মজবুতভাবে নির্মিত।
وَجَعَلۡنَا سِرَاجٗا وَهَّاجٗا  “এবং সৃষ্টি করেছি উজ্জ্বল প্রদীপ” অর্থাৎ দীপ্তিমান, তা হচ্ছে সূর্য, এখানে جعل অর্থ হচ্ছে সৃষ্টি করেছেন  কেননা এ শব্দটি (جعل) একটি مفعول এর দিকে متعدي  হয়, وهاج যা জ্বলজ্বল করে, যেমন মণিমুক্তা যখন জ্বলজ্বল করে, তখন বলা হয় تَوَهَّجَ। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, জ্বলজ্বল, দীপ্তিমান, চকচক করা।
  وَأَنزَلۡنَا مِنَ ٱلۡمُعۡصِرَٰتِ مَآءٗ ثَجَّاجٗا “আর আমরা বর্ষণ করি বৃষ্টিবাহী মেঘমালা থেকে প্রচুর পানি” মুজাহিদ ও কাতাদা বলেন, المعصرات  হচ্ছে বাতাস, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাও এ মত পোষণ করেছেন; যেন তা মেঘমালাকে নিংড়ায় (নিংড়ে বৃষ্টি বের করে)।
 আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে: এটা হচ্ছে মেঘমালা, সুফিয়ান, রাবী‘, ‘আবুল ‘আলিয়া এবং দাহ্হাক বলেন, অর্থাৎ মেঘমালা যা পানির দ্বারা নিষ্পেষিত হয় কিন্তু তারপরও তা বৃষ্টি বর্ষণ করে না। যেমন বলা হয়  المرأة المعصر অর্থাৎ ঐ নারী যার হায়েযের সময় নিকটবর্তী হয়েছে কিন্তু রক্তস্রাব হয় নি।
বাতাসকেও বলা হয় معصرات। বলা হয়: বাতাস নিংড়িয়েছে যখন সে ধূলিকে উসকে দেয়, অর্থাৎ ধূলিঝড়ের সৃষ্টি করে, মেঘকেও معصرات বলা হয়, কেননা তা বৃষ্টি বর্ষণ করে।  
কাতাদা আরও বলেন, معصراتহচ্ছে আকাশ।  
নাহ্হাস রহ. বলেন, এ সবগুলো উক্তিই সঠিক, বাতাস মেঘকে পরাগায়িত করে, এরপর বৃষ্টি হয়, এর ভিত্তিতে বাতাস থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়।
আবার উপরোক্ত সকল উক্তিকে এক উক্তি হিসেবে বলা যেতে পারে, আমরা বৃষ্টিবাহী বায়ু থেকে প্রচুর পানি বর্ষণ করি।  
তবে এ সকল উক্তির মাঝে সবচেয়ে বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে معصرات হচ্ছে মেঘমালা  এটিই প্রসিদ্ধ যে, মেঘ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়  বিশুদ্ধ বর্ণনায় রয়েছে, معصرات  হচ্ছে মেঘমালা, (যা) বৃষ্টি বর্ষণ করে।   
কেউ কেউ পাঠ করেছেন:  ﴿وَفِيهِ يَعۡصِرُونَ ٤٩﴾ [يوسف: ٤٨]   “প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে” [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৪৮]  معصرবলা হয় ঐ মেয়েকে যে সম্প্রতি সাবালিকা হয়েছে এবং তার রক্তস্রাব হয়েছে  বলা হয়: اعصرت  ‘যখন সে যৌবনে পদার্পণ করেছে এবং সাবালিকা হয়েছে’   معصر এর বহুবচন হচ্ছে  معاصرবলা হয়: সে হচ্ছে ঐ মেয়ে যে হায়েযের নিকটবর্তী হয়েছে, অর্থাৎ পরিণত বয়সে উপনিত হয়েছে। আমি এ ব্যাপারটি আবুল গাউস আল আ‘রাবীর নিকট শুনেছি, অন্যান্যরা বলেন, معصر  হচ্ছে ঐ মেঘ যা বৃষ্টি বর্ষণ করার নিকটবর্তী হয়েছে  যেমন বলা হয়:  اجن الزرع فهو مجن অর্থাৎ ফসল তুলে আনার উপযোগী হয়েছে, অনুরূপভাবে মেঘমালা যখন বৃষ্টি বর্ষণের নিকটবর্তী হয়, তখন বলা হয়  أعصر المطر(বৃষ্টি বর্ষণের উপযুক্ত হয়েছে)  
মুবাররাদ বলেন, বলা হয়  سحاب معصرঅর্থাৎ পানি ধারণকারী (মেঘ), আর তা থেকে একের পর এক জিনিস বর্ষিত হয়। এ থেকে বলা হয় العصر  অর্থাৎ আশ্রয়স্থল, عُصرة—এর অর্থও আশ্রয়স্থল, সূরা ইউসূফে এ অর্থ ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে  সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার।
পরিণত বয়সে উপনিত হওয়া মেয়েকে বলা হয় معصر কেননা সে তার গৃহে অবস্থান করে আর গৃহ তার জন্য আশ্রয়কেন্দ্র  আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা ও ইকরিমার কিরাআতে রয়েছে وأنزلنا بالمعصرات আর মুসহাফে (কুরআনে) রয়েছে من المعصرات উবাই ইবন কা‘আব, হাসান, ইবন জুবাইর, যায়েদ ইবন আসলাম এবং মুকাতিল ইবন হাইয়্যান বলেন, من المعصرات  অর্থাৎ আসমানসমূহ থেকে,ماءً  ثجّاجا  ধারাবাহিক বর্ষণ  আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা, মুজাহিদ এবং অন্যান্যরা বলেন, قد ثج الدم  রক্ত প্রবাহিত হয়েছে, হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মাকবুল হজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,  العج والثج অতঃপর عج হচ্ছে উচ্চস্বরে তালবিয়াহ পড়া, আর ثج হচ্ছে রক্ত প্রবাহিত করা এবং হাদী (হাজীর ওপর ওমরা করার কারণেওয়াজিব পশু) যবেহ করা  ইবন যায়েদ বলেন, ثجاجا  অর্থাৎ প্রচুর। উপরোক্ত সবগুলোর অর্থ একই।
لِّنُخۡرِجَ بِهِۦ, “যাতে আমরা তা দিয়ে উৎপন্ন করি” অর্থাৎ সেই পানি দ্বারা, حَبّٗا  (শস্য) যেমন, গম, যব এবং এ জাতিয় অন্যান্য কিছু وَنَبَاتٗا (ও উদ্ভিদ) গবাদির তৃণাদি খাদ্য,جَنَّٰتٍ  “আর উদ্যান” অর্থাৎ বাগবাগিচা,أَلۡفَافًا  “ঘন” যা পরস্পর জড়ানো, যা বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত, এ শব্দটির একবচন নেই, যেমন أوزاع এবং أخياف  
কেউ কেউ বলেন,  الألفافএর একবচন হচ্ছে لِف (যের দ্বারা) এবং لُف (পেশ দ্বারা), কাসাঈ তা বর্ণনা করেছেন, তার থেকে এবং আবু আবু  উবাইদাহ থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, الألفاف এর একবচন হচ্ছে  لفيف । যেমন, شريف এবংأشراف  কেউ কেউ বলেন, এটা হচ্ছে বহুবচনের বহুবচন। কাসাঈ তা বর্ণনা করেছেন, বলা হয়  نبت لف আচ্ছাদিত তৃণ-উদ্ভিদ, এর বহুবচন لُف যেমন حُمُر এরপর   لُف এর আবার বহুবচন করা হয়েছে   الفافদ্বারা।
কেউ কেউ বলেন, এখানে উহ্য রয়েছে ونخرج به جنات ألفافاً অর্থাৎ আমরা তা দ্বারা উৎপন্ন করি ঘন বাগান। এখানে (نخرج به  -বের করি) এ কথাকে হযফ করে দেওয়া হয়েছে  কেননা বর্ণনাভঙ্গিতে তাই বুঝা যাচ্ছে  আর এ আচ্ছাদনের এবং পরস্পর মিলানোর অর্থ হচ্ছে বাগানে গাছ-গাছালি পরস্পর পরস্পরের নিকটবর্তী থাকে এবং শক্তির কারণে প্রতিটি বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা থাকে নিকটবর্তী।
 ﴿إِنَّ يَوۡمَ ٱلۡفَصۡلِ كَانَ مِيقَٰتٗا ١٧ يَوۡمَ يُنفَخُ فِي ٱلصُّورِ فَتَأۡتُونَ أَفۡوَاجٗا ١٨ وَفُتِحَتِ ٱلسَّمَآءُ فَكَانَتۡ أَبۡوَٰبٗا ١٩ وَسُيِّرَتِ ٱلۡجِبَالُ فَكَانَتۡ سَرَابًا ٢٠﴾ [النبا: ١٧،  ٢٠]  
অর্থানুবাদ:
১৭. নিশ্চয় নির্ধারিত আছে মীমাংসার দিন, ১৮. সেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, আর তোমরা দলে দলে আসবে, ১৯. আকাশ খুলে দেওয়া হবে আর তাতে হবে অনেক দরজা। ২০. আর পর্বতগুলোকে করা হবে চলমান, ফলে তা নিছক মরীচিকায় পরিণত হবে। [সূরা আন-নাবা, আয়াত: ১৫-২০]
তাফসীর:
কিয়ামত দিবসের বর্ণনা:
আল্লাহর বাণী: إِنَّ يَوۡمَ ٱلۡفَصۡلِ كَانَ مِيقَٰتٗا “নিশ্চয় নির্ধারিত আছে মীমাংসার দিন” অর্থাৎ আগের পরের সকলের জন্য রয়েছে সময়, সম্মেলন ও অঙ্গীকার, বিনিময় ও সাওয়াব দেওয়ার যে অঙ্গীকার আল্লাহ তা‘আলা করেছেন, এ দিবসকে বলা হয় يوم الفصل কেননা, আল্লাহ তা‘আলা এতে তাঁর বান্দাদের বিচার-ফায়সালা করবেন।
 يَوۡمَ يُنفَخُ فِي ٱلصُّورِ َ  “সেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে” অর্থাৎ পুনরুত্থানের জন্য, فَتَأۡتُون  “আর তোমরা আসবে” অর্থাৎ উপস্থিত হওয়ার স্থানে (যেখানে তারা আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হবে) أَفۡوَاجٗا  “দলে দলে” নিজ নিজ জাতির সাথে, প্রত্যেক জাতি আসবে তাদের নেতার সাথে  কেউ কেউ বলেন, দলে দলে, أَفۡوَاجٗا এর একবচন হচ্ছে فوج প্রথম اليوم থেকে (আরবী ব্যাকরণে) বদল হওয়ার কারণে যবরযুক্ত হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَفُتِحَتِ ٱلسَّمَآءُ فَكَانَتۡ أَبۡوَٰبٗا “আকাশ খুলে দেওয়া হবে আর তাতে হবে অনেক দরজা” অর্থাৎ ফিরিশতাদের অবতীর্ণ হওয়ার জন্য  যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَيَوۡمَ تَشَقَّقُ ٱلسَّمَآءُ بِٱلۡغَمَٰمِ وَنُزِّلَ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ تَنزِيلًا ٢٥﴾ [الفرقان: ٢٥]   “সেদিন মেঘমালাসহ আকাশ বিদীর্ণ হবে আর ফিরিশতাদেরকে ধীরে ধীরে নীচে নামিয়ে দেওয়া হবে” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ২৫] অর্থাৎ টুকরা টুকরা করা হবে, একেকটি টুকরা হবে দরজার মতো, এর ভিত্তিতে  ك-কে বিলুপ্ত করে দেওয়ার মাধ্যমে أبواب কে نصب দেওয়া হয়েছে  কেউ কেউ বলেন, এখানে উহ্য হচ্ছে, তা হবে অনেক দরজা বিশিষ্ট, কেননা সবগুলো দরজা হবে  কেউ কেউ বলেন, এর দরজাসমুহ হচ্ছে এর পথসমূহ, তা বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়বে অবশেষে এগুলোতে দরজা সৃষ্টি হবে  কেউ কেউ বলেন, প্রত্যেকের জন্য আসমানে দু’টি করে দরজা রয়েছে, একটি হচ্ছে তার কর্মের অপরটি হচ্ছে তার জীবিকার, যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে দরজসমূহ খুলে যাবে  মি‘রাজের হাদীসে এসেছে: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, «ثم عرج بنا إلى السماء فاستفتح جبريل، فقيل: من أنت قال: جبريل. قيل: ومن معك؟ قال: محمد. قيل: وقد بعث إليه؟ قال: قد بعث إليه. ففتح لنا»
“এরপর আমাদেরকে আসমানে উত্তোলন করা হয়, জিবরীল দরজা খুলতে বলেন, তাকে বলা হয়: আপনি কে? তিনি বলেন, জিবরীল, তাকে বলা হয়: আপনার সাথে কে? তিনি বলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  তাঁকে কি ডাকা হয়েছে? তিনি বলেন, তাঁকে ডাকা হয়েছে, এরপর আমাদের জন্য দরজা খোলা হয়”
 وَسُيِّرَتِ ٱلۡجِبَالُ فَكَانَتۡ سَرَابًا“আর পর্বতগুলোকে করা হবে চলমান, ফলে তা নিছক মরীচিকায় পরিণত হবে”  অর্থাৎ কোনো কিছু থাকবে না, যেমন মরীচিকা, কোনো দর্শক তাকে মনে করে পানি, অথচ তা পানি নয়।
কেউ কেউ বলেন, سيرت  অর্থ হচ্ছে তাকে তার মূল থেকে ভেঙ্গে ফেলা হবে।  
কেউ বলেন, তাকে তার স্থান থেকে উৎপাটন করা হবে।
﴿إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتۡ مِرۡصَادٗا ٢١ لِّلطَّٰغِينَ مَ‍َٔابٗا ٢٢ لَّٰبِثِينَ فِيهَآ أَحۡقَابٗا ٢٣ لَّا يَذُوقُونَ فِيهَا بَرۡدٗا وَلَا شَرَابًا ٢٤ إِلَّا حَمِيمٗا وَغَسَّاقٗا ٢٥ جَزَآءٗ وِفَاقًا ٢٦ إِنَّهُمۡ كَانُواْ لَا يَرۡجُونَ حِسَابٗا ٢٧ وَكَذَّبُواْ بِ‍َٔايَٰتِنَا كِذَّابٗا ٢٨ وَكُلَّ شَيۡءٍ أَحۡصَيۡنَٰهُ كِتَٰبٗا ٢٩ فَذُوقُواْ فَلَن نَّزِيدَكُمۡ إِلَّا عَذَابًا ٣٠﴾ [النبا: ٢١،  ٣٠]  
অর্থনুবাদ:
২১. জাহান্নাম তো ওৎ পেতে আছে, ২২. (আর তা হলো) সীমালঙ্ঘনকারীদের আশ্রয়স্থল। ২৩. সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে থাকবে, ২৪. সেখানে তারা কোনো শীতল ও পানীয় আস্বাদন করবে না ২৫. ফুটন্ত পানি ও পুঁজ ছাড়া; ২৬. উপযুক্ত প্রতিফল। ২৭. তারা (তাদের কৃতকর্মের) কোনো হিসাব-নিকাশ আশা করতো না, ২৮. তারা আমার নিদর্শনসমহে মিথ্যারোপ করেছিল- পুরোপুরি মিথ্যারোপ। ২৯. সবকিছুই আমরা সংরক্ষণ করে রেখেছি লিখিতভাবে। ৩০. অতএব, এখন স্বাদ গ্রহণ কর, আমরা তোমাদের জন্য কেবল শাস্তিই বৃদ্ধি করব (অন্য আর কিছু নয়)। [সূরা আন-নাবা, আয়াত: ২১-৩০]
তাফসীর:
জাহান্নামের শাস্তির বর্ণনা:
إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتۡ مِرۡصَادٗا “জাহান্নাম তো ওৎ পেতে আছে”  مرصادশব্দটি رصد মূত ধাতু থেকে مفعال এর ওজনে হয়েছে  প্রত্যেক বস্তু যা তোমার সম্মুখে রয়েছে  হাসান বলেন, জাহান্নামে একজন প্রহরী রয়েছে, তাকে অতিক্রম না করা পর্যন্ত কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না  যে ব্যক্তি অনুমতি নিয়ে আসবে সে অতিক্রম করবে আর যে অনুমতি নিয়ে আসবে না সে আঁটকে যাবে  
সুফিয়ান রহ. বলেন, সেখানে তিনটি সাঁকো থাকবে
কেউ বলেন, مرصاد  হচ্ছে পর্যবেক্ষক, যে তার সামনে দিয়ে অতিক্রম করবে তাকে পর্যবেক্ষণ করবে  
মুকাতিল বলেন, বন্দিখানা, কেউ কেউ বলেন, পথ। কাজেই জাহান্নাম অতিক্রম করা ছাড়া জান্নাতে যাওয়ার কোনো পথ নেই।
বিশুদ্ধ বর্ণনায় এসেছে: المرصاد হচ্ছে পথ,। কুশাইরী বলেন, مرصاد হচ্ছে ঐ স্থান যেখানে কেউ তার শত্রুকে পর্যবেক্ষণ করে  যেমন,  مضمارসেটা ঐ স্থান যেখানে (দৌড়ের) ঘোড়াকে শক্তিশালী করার জন্য প্রস্তুত করা হয়  مرصادঅর্থ হচ্ছে স্থান, ফিরিশতাগণ কাফিরদের পর্যবেক্ষন করবে অবশেষে তাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হবে  মাওয়ারদী রহ. বর্ণনা করেন,  আবু  সিনান রহ. বলেন, এর অর্থ হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক, তাদেরকে তাদের কর্ম অনুসারে বদলা দেওয়া হবে  বিশুদ্ধ বর্ণনায় রয়েছে কোনো বিষয়ের  الراصد-এর অর্থ হচ্ছে তার তত্ত্বাবধায়ক, ترصد শব্দের অর্থ হচ্ছে তত্ত্বাবধান, مرصد হচ্ছে তত্ত্বাবধানস্থল  আসমা‘ঈ রহ. বলেন, أرصدته মানে হচ্ছে আমি তার জন্য প্রস্তুত করেছি  কাসাঈও অনুরূপ বলেছেন  আমি বলি: জাহান্নাম। مترصدة (একে) প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে, الرصد মাসদার থেকে متفعل তত্ত্বাবধান করা হয়েছে, مرصاد হচ্ছে  مفعال এর ওজনে মুবালাগা (অতিশয়) অর্থে ব্যবহৃত  যেমন, معطار এবং  مغيارযেন জাহান্নাম কাফিরদের জন্য খুব বেশি বেশি প্রতীক্ষা করছে।
 لِّلطَّٰغِينَ مَ‍َٔابٗا (আর তা হলো) “সীমালঙ্ঘনকারীদের আশ্রয়স্থল”  مرصاداً থেকে (আরবী ব্যাকরণে) বদল (ব্যাখ্যা বিশেষ্য) সংঘটিত হয়েছে, والمآب অর্থ হচ্ছে প্রত্যাবর্তনস্থল অর্থাৎ যেখানে তারা প্রত্যবর্তন করবে, যেমন বলা হয়, آب يؤوب أوبة  কাতাদা রহ. বলেন, আশ্রয়স্থল, গৃহ। الطاغين হচ্ছে যে ব্যক্তি কুফরীর মাধ্যমে দীনের ক্ষেত্রে সীমলঙ্ঘন করে অর্থাৎ দুনিয়াতে সে যুলুম-অত্যাচারের মাধ্যমে (সীমালঙ্ঘন করে)।
لَّٰبِثِينَ فِيهَآ أَحۡقَابٗا “সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে থাকবে” অর্থাৎ জাহান্নামে বসবাস করবে অনন্তকাল অর্থাৎ শেষ হবে না। যখনই কোনো এক যুগ শেষ হবে এরপর আসবে আরেক যুগ,  حُقُبদুই পেশ সহকারে, অর্থ হচ্ছে যুগ, কাল। এর বহুবচন হচ্ছে الأحقاب আর الحِقْبَة যের সহকারে অর্থ হচ্ছে: বৎসর, এর বহুবচন হচ্ছে  حِقَب
 الحُقْب— حا এর উপর পেশ এবং با এর উপরে সাকিন সহকারে অর্থ হচ্ছে আশি বৎসর। কেউ কেউ বলেন, এর চেয়ে বেশি  অথবা কম, আগমনের ভিত্তিতে, এর বহুবচন হচ্ছে أحقاب আয়াতে অর্থাৎ  لَّٰبِثِينَ فِيهَآ أَحۡقَابٗاএ আয়াতের অর্থ হচ্ছে পরকালের অনন্তকাল, যার কোনো শেষ নেই  الآخرة কথাটিকে হযফ করে দেওয়া হয়েছে। কেননা এখানে এর কথাই বলা হয়েছে, এছাড়াও বাক্যে পরকালের উল্লেখ রয়েছে, যেমন বলা হয় পরলৌকিক দিনসমূহে অর্থাৎ দিনের পর দিন যার কোনো শেষ নেই, যদি বলা হয় خمسة أحقاب অথবা عشرة أحقاب তাহলে নির্দিষ্ট সময় বুঝাবে। এখানে الأحقاب বলা হয়েছে, কেননা حقب শব্দের অর্থ সবচেয়ে দূরবর্তী সময় আর এ শব্দের উল্লেখ করা হয়েছে যাতে করে তাদের মন-মস্তিষ্ক সেদিকে নিবদ্ধ হয়, যেন তারা তা বুঝতে পারে। এখানে অনন্তকালের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে অর্থাৎ তাতে তারা চিরকাল বসবাস করবে।
কেউ কেউ বলেন,أحقاب  বলা হয়েছেايام  বলা হয় নি, কেননা  أحقاب এ শব্দের প্রয়োগে অন্তরে আতঙ্কের সৃষ্টি হয় আর চিরস্থায়ী অধিকরূপে বুঝায়, অর্থ কাছাকাছি, এ চিরস্থায়ী (জাহান্নামে বসবাস) কাফিরদের জন্য, এ আয়াতে ঐ সমস্ত পাপিষ্টরাও শামিল হতে পারে যারা যুগ যুগ পরে জাহান্নাম থেকে বের হবে  কেউ কেউ বলেন,أحقاب  হচ্ছে তাদের ফুটন্ত পানি ও দুর্গন্ধময় পানি পানের সময়, যখন তারা তা পান শেষ করবে তখন তাদের জন্য অন্য ধরণের শাস্তি রয়েছে, এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَّٰبِثِينَ فِيهَآ أَحۡقَابٗا ٢٣ لَّا يَذُوقُونَ فِيهَا بَرۡدٗا وَلَا شَرَابًا ٢٤ إِلَّا حَمِيمٗا وَغَسَّاقٗا   “সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে থাকবে, ২৪. সেখানে তারা কোনো শীতল ও পানীয় আস্বাদন করবে না ২৫. ফুটন্ত পানি ও পুঁজ ছাড়া”
لابثين  হচ্ছেلبث  মাসদার থেকে اسم فاعل -এর সীগাহ, আর তাকে শক্তিশালী করে (لابثين)—এর মাসদার হচ্ছে  اللبث,  با—এর উপরে সাকিন। যেমন الشرب  হামযাহ এবং কাসাঈ পড়েছেন: لبثين অর্থাৎ الف ছাড়া, আবু আবু  হাতিম, আবু আবু  উবাইদ একে পছন্দ করেছেন, এর দুইটি (পড়ার) রীতি রয়েছে। বলা হয়: لابث  এবং لبث যেমন, طامع  এবং طمع  বলা হয়: সে অমুক স্থানে বসবাস করে অর্থাৎ বসবাস করা তার কাজ, যা মানুষের স্বভাব-প্রকৃতির সাদৃশ্যপূর্ণ  কেননা  فَعِلএর বাব অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা মানুষের স্বভাব-চরিত্র-এরূপ অর্থে ব্যবহৃত হয় لابث অর্থাৎ  اسم فاعل এ অর্থ প্রদান করে না।
الحقب  হচ্ছে আশি বৎসর, এ মত পোষণ করেছেন আব্দুল্লাহ ইবন উমার, ইবন মুহাইসিন,  আবু  হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুম। বৎসর হবে তিনশত ষাট দিনে, আর একদিন হবে দুনিয়ার হিসেবে এক হাজার বৎসরের সমান, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা এ মত পোষণ করেছেন, আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-থেকে মারফু‘ সূত্রে বর্ণনা করেছেন  আবু আবু  হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, বৎসর হবে তিনশত ষাট দিনে, প্রত্যেক দিন হবে দুনিয়ার হিসেবের মতো। আব্দুল্লাহ ইবন উমার থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে: الحقب হচ্ছে চল্লিশ বৎসর, সুদ্দী বলেন, সত্তর বৎসর, কেউ কেউ বলেন, তা হচ্ছে এক হাজার মাস, আবু আবু  উমামা তা মারফু‘ সূত্রে বর্ণনা করেছেন  বাশীর ইবন কা‘আব বলেন, তিনশত বৎসর। হাসান বলেন, الأحقاب  সম্পর্কে কেউ জানে না সেটা কী? তবে উল্লেখ করা হয়েছে তা হবে একশত حقب, আর এক حقب  সত্তর হাজার বৎসর, এর একদিন হবে তোমাদের গণনায় এক হাজার বৎসরের সমান  আবু আবু  উমামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “এক حقب  ত্রিশ হাজার বৎসর”  মাহদাওয়ী এটা বর্ণনা করেছেন, প্রথম উক্তিটি করেছেন মাওয়ারদী, কুতরুব বলেন, তা হচ্ছে দীর্ঘ সময় যার সীমা নেই।
‘উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
 “আল্লাহর শপথ, জাহান্নামে যে প্রবেশ করবে সে বের হবে না, যতক্ষণ না সে তাতে কয়েক حقب অবস্থান করে।الحقب  হচ্ছে আশির কিছু বেশি বৎসর  বৎসর হবে তিনশত ষাট দিন, প্রতিদিন হবে তোমাদের গণনায়, সুতরাং তোমাদের কেউ যেন এ ভরসা না করে যে সে জাহান্নাম থেকে বের হবে।” সা‘লাবী। আর কুরাযী বলেন, الأحقاب হবে তেতাল্লিশটি, প্রতিটি  حقب এর দুরত্ব হবে সত্তর খারিফ, প্রত্যেক খারিফ হবে সাতশত বৎসর, প্রত্যেক বৎসর হবে তিনশত ষাট দিন, প্রতি দিন হবে হাজার বৎসরের সমান।
আমি বলি: উপরোক্ত উক্তিগুলো পরস্পর বিরোধী, আর এগুলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়, বস্তুত حقب এর অর্থ হচ্ছে -আল্লাহ ভালো ভালো জানেন। পূর্বে আমরা যা উল্লেখ করেছি অর্থাৎ তারা তাতে যুগের পর যুগ, কালের পর কাল বসবাস করবে, যখনই একটি কাল অতিক্রম করবে পরে পরেই আরেক কাল এসে হাযির হবে, যুগের পর যুগ আসবে, এভাবে ধারাবাহিকভাবে অনন্তকাল বসবাস করবে।
ইবনু কাইসান বলেন:  لَّٰبِثِينَ فِيهَآ أَحۡقَابٗا“সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে থাকবে” এর অর্থ হচ্ছে: যার কোনো শেষ নেই, যেন তিনি বলেন, অনন্তকাল  ইবন যায়েদ এবং মুকাতিল বলেন,  এ আয়াতটি পরবর্তী আয়াত-
 فَذُوقُواْ فَلَن نَّزِيدَكُمۡ إِلَّا عَذَابًا “অতএব এখন স্বাদ গ্রহণ কর, আমরা তোমাদের জন্য কেবল শাস্তিই বৃদ্ধি করব” (অন্য আর কিছু নয়)- এর মাধ্যমে রহিত হয়ে গেছে, নির্দিষ্ট সংখ্যা শেষ হয়ে গেছে, অনন্তকাল সাব্যস্ত হয়েছে  আমি বলি: এ সম্ভাবনা অনেক দুরে, কেননা তা হচ্ছে খবর বা সংবাদ (আর সংবাদে রহিত হওয়ার বিষয়টি প্রবেশ করবে না)। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ﴿وَلَا يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ حَتَّىٰ يَلِجَ ٱلۡجَمَلُ فِي سَمِّ ٱلۡخِيَاطِۚ ٤٠﴾ [الاعراف: ٤٠]   “আর তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না সূঁচের ছিদ্রে উট প্রবেশ করে”  [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৪০]
যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, এটা কাফিরদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, আর আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদে বিশ্বাসী পাপিষ্টদের ক্ষেত্রে রহিত হওয়ার বিষয়টি সঠিক হতে পারে; আর তখন রহিত হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হবে  তাখসীস বা বিশেষায়িত করণ। আল্লাহ ভালো ভালো জানেন  
কারও কারও মতে এখানে যে বলা হয়েছে:لَّٰبِثِينَ فِيهَآ أَحۡقَابٗا  “সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে থাকবে” এর দ্বারা উদ্দেশ্য তারা যমীনে এ সময়টুকু থাকবে। যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
لَّا يَذُوقُونَ فِيهَا بَرۡدٗا وَلَا شَرَابًا “সেখানে তারা কোনো শীতল ও পানীয় আস্বাদন করবে না”  এ আয়াতে ها সর্বনামটির উদ্দেশ্য হচ্ছে جهنم কেউ বলেন,  الأحقاب এর একবচন حقب এবং حقبة
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: لَّا يَذُوقُونَ فِيهَا “সেখানে আস্বাদন করবে না” অর্থাৎ যে যুগ যুগ ধরে তারা থাকবে তাতে  بَرۡدٗا وَلَا شَرَابًا “শীতল ও পানীয় আস্বাদন করবে না।” البرد হচ্ছে নিদ্রা, এ মত পোষণ করেছেন আবু আবু  উবাইদ এবং অন্যান্যরা  আরবরা বলে: منع البرد البرد অর্থাৎ শীত ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আমি বলি: হাদীসে  এসেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জান্নাতে নিদ্রা আছে কিনা -এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, «لا؛ النوم أخو الموت، والجنة لا موت فيها" فكذلك النار؛ وقد قال تعالى: لَا يُقۡضَىٰ عَلَيۡهِمۡ فَيَمُوتُواْ»“না, নিদ্রা হচ্ছে মৃত্যুর ভাই, জান্নাতে মৃত্যু নেই, অনুরূপভাবে জাহান্নামে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿لَا يُقۡضَىٰ عَلَيۡهِمۡ فَيَمُوتُواْ ٣٦﴾ [فاطر: ٣٦]   “তাদের জন্য কোনো সময় নির্ধারণ করা হবে না যে, তারা (নির্ধারিত সময় আসলে) মরে যাবে”  [সূরা ফাতির, আয়াত: ৩৬]
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, البرد হচ্ছে ঠাণ্ডা পানীয়। তাঁর থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে: البرد হচ্ছে নিদ্রা, আর الشراب হচ্ছে পানি।  
যাজ্জাজ রহ. বলেন, তারা সেখানে না পাবে ঠাণ্ডা বাতাস, ছায়া, আর না নিদ্রা, ঠাণ্ডা জিনিস সবকিছুকে ঠাণ্ডা করে দেয় যাতে আরাম বোধ হয়  আর এ ঠাণ্ডা মানুষের উপকারে আসে, কিন্তু ‘যামহারীর’ এমন ঠাণ্ডা যাতে জাহান্নামীরা কষ্ট ভোগ করবে, এতে তাদের কোনো উপকার হবে না, এর দ্বারা তারা শাস্তি ভোগ করবে। সে সম্পর্কে কেবল আল্লাহ তা‘আলা ভালো জানেন।  
হাসান, ‘আতা’, ইবন যায়েদ বলেন, برداً  -এর অর্থ হচ্ছে: আরাম-বিশ্রাম।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: لَّا يَذُوقُونَ فِيهَا بَرۡدٗا وَلَا شَرَابًا “সেখানে তারা কোনো শীতল ও পানীয় আস্বাদন করবে না”  এ বাক্যটি  الطاغين (সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য) থেকে حال বা অবস্থাবোধক বাক্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে  অথবা  احقاب-এর সিফাত বা বিশেষণ হিসেবে গণ্য, احقاب (ব্যাকরণে) ظرف زمان অর্থাৎ (ক্রিয়া সংঘটিত হবার কাল) হয়েছে, এর চালক শব্দ (عامل) হচ্ছে لابثين অথবা لبثين থেকে।  
إِلَّا حَمِيمٗا وَغَسَّاقٗا “ফুটন্ত পানি ও পুঁজ ছাড়া”  ব্যাকরণে ( (مستثنى منقطع সংঘটিত হয়েছে, যারা البرد শব্দ দ্বারা নিদ্রা উদ্দেশ্য করেছেন তাদের মতে। আর যারা البرد দ্বারা শীতল উদ্দেশ্য নিয়েছেন তাদের মতে  حميما وغساقا বদল (ব্যাখ্যা বিশেষ্য) সংঘটিত হয়েছে। حميم হচ্ছে গরম পানি  আবু আবু  উবাইদাহ এ মত ব্যক্ত করেছেন  ইবন যায়েদ বলেন, حميم হচ্ছে তাদের চোখের অশ্রু, হায়েযের সাথে একত্রিত করে তাদেরকে পান করানো হবে  নাহ্হস বলেন,حميم  এর অর্থ হচ্ছে গরম পানি, এ থেকে নির্গত হয়েছে حمام গোসলখানা এবং حمى জ্বর এবং ﴿وَظِلّٖ مِّن يَحۡمُومٖ ٤٣﴾ [الواقعة: ٤٣] “আর কালো ধোঁয়ার ছায়ায়”  [সূরা আল-ওয়াকি‘আহ, আয়াত: ৪৩] এখানে প্রচণ্ড গরম উদ্দেশ্য।  غساق হচ্ছে জাহান্নামীদের পুঁজ  কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ হচ্ছে যামহারীরা। হামযাহ এবং কাসাঈ سএ তাশদীদ সহ পাঠ করেছেন, সূরা স-দ এ সংক্রান্ত আলোচনা অতিবাহিত হয়েছে।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন,جَزَآءٗ وِفَاقًا  “উপযুক্ত প্রতিফল”  অর্থাৎ তাদের কৃতকর্ম অনুযায়ী  আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা, মুজাহিদ এবং অন্যান্যদের থেকে বর্ণিত হয়েছে, وفاق অর্থ হচ্ছে  موافقة অনুসারে, যেমন قتال থেকেمقاتلة , جزاءً  এটি মাসদার, (এবং) এর উপরেযবর হয়েছে অর্থাৎ তাদের কর্ম অনুযায়ী আমরা তাদেরকে প্রতিদান দিয়েছি  ফাররা এবং আখফাস রহ. উভয় ইমাম এ মত পোষণ করেছেন ফাররা রহ. আরও বলেন, এটা হচ্ছে وفق  -এর বহুবচন  মুকাতিল রহ. বলেন, পাপ অনুযায়ী শাস্তি হয়েছে, শির্কের চেয়ে বড় গোনাহ নাই, জাহান্নামের চেয়ে বড় শাস্তি নাই  হাসান ও ইকরিমা রহ. বলেন, তাদের কর্ম ছিল মন্দ, ফলে আল্লাহ তা‘আলাও তাদের প্রতি এমন কিছু আপতিত করেন যা তাদেরকে কষ্ট দেয়।
 إِنَّهُمۡ كَانُواْ لَا يَرۡجُونَ حِسَابٗا “তারা (তাদের কৃতকর্মের) কোনো হিসেব আশা করত না”  অর্থাৎ ভয় করত না,حِسَابٗا   “হিসাব-নিকাশের” অর্থাৎ তাদের কর্মের হিসাব-নিকাশ নেওয়া হবে এর কোনো ভয় তারা করতো না। কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ হচ্ছে তারা হিসাব-নিকাশের পুরষ্কারের আশা করত না  যাজ্জাজ রহ. বলেন, তারা পুনরুত্থান দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করত না, ফলে হিসাব-নিকাশের আশা করত না
 وَكَذَّبُواْ بِ‍َٔايَٰتِنَا كِذَّابٗا“তারা আমার নিদর্শনগুলোতে সম্পূর্ণরূপে মিথ্যারোপ করেছিল”  অর্থাৎ নবীগণ যা কিছু নিয়ে এসেছিলেন তা তারা পুরোপুরি অস্বীকার করেছিল। কেউ কেউ বলেন, আমরা যে সমস্ত কিতাব অবতীর্ণ করেছিলাম তা তারা অস্বীকার করেছিল। সকলে পড়েছেন كذّابا যাল  (ذال)-এর ওপর তাশদীদ এবং  كاف-এর নিচে যের সহকারে  অর্থাৎ كذب  মাসদার থেকে অর্থাৎ, তারা বড় ধরণের মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল  ফাররা রহ. বলেন, এটা হচ্ছে ইয়েমেনের বিশুদ্ধ ভাষা, তারা বলে: كذبت به كِذابا  অর্থাৎ তুমি এ সম্পর্কে বড় মিথ্যা বলেছ; যেমন خرقت القميص خراقا অর্থাৎ তুমি কাপড়টি টুকরা টুকরা করে ফেলেছ। প্রতি  فعل (ক্রিয়া) যা  فِعل-এর ওজনে হয় তাদের নিকট এর মাসদার আসে  فعَّال-এর ওজনে, অর্থাৎ  ع-এ তাশদীদ সহকারে।
আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু كذابا অর্থাৎ  ذال-এর উপরে তাশদীদ ছাড়া, এটাও আরেকটি মাসদার,  আবু  আলী রহ. বলেন,  ذالএর উপরে তাশদীদ হোক বা না হোক সর্বাবস্থায় মাসদারمكاذبة  যামাখশারী রহ. বলেন,  كذابا (ذال) -এর উপরে তাশদীদ ছাড়া হলে মাসদার হচ্ছে كذب এটা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার ঐ আয়াতের মতো, যাতে ﴿وَٱللَّهُ أَنۢبَتَكُم مِّنَ ٱلۡأَرۡضِ نَبَاتٗا ١٧ ﴾ [نوح: ١٧]   “আল্লাহ তোমাদেরকে মাটি থেকে যথাযথভাবে উদ্গত করেন”। [সূরা নূহ, আয়াত: ১৭] অর্থাৎ তারা আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করেছিল, তারা পুরোপুরি অস্বীকার করেছিল كذّابا -তে যবর প্রদান করেছে كذّبوا ক্রিয়াটি  কেননা তা ‘তারা মিথ্যা বলেছিল’-এর অর্থের সাথে সম্পৃক্ত, কেননা যে ব্যক্তিই সত্যকে অস্বীকার করে সেই মিথ্যাবাদী  কেননা তারা মুসলিমগণের নিকট মিথ্যাবাদী আর তাদের নিকট মুসলিমবৃন্দ মিথ্যাবাদী, তারা পরস্পরকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে  আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা পাঠ করেছেন كُذَّابا  অর্থাৎ  كاف-এর উপরে পেশ এবং  ذال-এর উপরে তাশদীদ সহকারে  এর একবচন হচ্ছে كاذب  আবু  হাতিম এ মত ব্যক্ত করেছেন  (আরবী ব্যাকরণে) حال হওয়ার কারণে এতেযবর হয়েছে, এ মত ব্যক্ত করেছেন যামাখশারী রহ.। কখন সে অতিশয় মিথ্যাবাদী হয় অর্থাৎ খুব বেশি মিথ্যা কথা বলে  বলা হয়: رجل كذّاب লোকটি ডাহা মিথ্যাবাদী, যেমন বলা হয় حسّان এবং بخّال এরপর  كذابا-কে  كذّبوا-এর মাসদারের সিফাত করা হয়েছে; অর্থাৎ  تكذيباً كذابا অর্থাৎ মিথ্যায় সীমা ছাড়িয়ে গেছে  বিশুদ্ধ বর্ণনায় রয়েছে: আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَكَذَّبُواْ بِ‍َٔايَٰتِنَا كِذَّابٗا  “তারা আমার নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করেছিল- পুরোপুরি অস্বীকার”  এর তাশদীদযুক্ত মাসদারসমূহের মধ্য থেকে অন্যতম একটি মাসদার, কেননা এর মাসদার কখনও আসে  تفعيل-এর ওজনে, যেমন تكليم, কখনও আসে  فعّال-এর ওজনে, যেমন كذّاب আবার কখনও আসে  تفعلة-এর ওজনে, যেমন  توصية কখনও আসে  مفعَّل-এর ওজনে, যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ﴿وَمَزَّقۡنَٰهُمۡ كُلَّ مُمَزَّقٍۚ ٖ ١٩﴾ [سبا: ١٩]  “আর তাদেরকে পুরোপুরি ছিন্ন ভিন্ন করে দিলাম” [সূরা সাবা, আয়াত: ১৯]
وَكُلَّ شَيۡءٍ أَحۡصَيۡنَٰهُ كِتَٰبٗا “সবকিছুই আমরা সংরক্ষণ করে রেখেছি লিখিতভাবে”  كلَّ-কে যবর প্রদান করেছে উহ্য একটি فعل যা বাহ্যত বুঝা যায় (যে তা লুকিয়ে আছে) (তা হচ্ছে) أحصيناه অর্থাৎ أحصيناه كل شيء أحصيناه অর্থাৎ আমরা সংরক্ষণ করে রেখেছি সবকিছু, সংরক্ষণ করে রেখেছি লিখিতভাবে  আবুস সাম্মাল  وكل شيء  -এ كُلُّ লামের উপরে পেশ সহকারে পড়েছেন।  কেননা তা মুবতাদা, (উদেশ্য) আরكتاباً -এর উপরে যবর হয়েছে মাসদার হওয়ার কারণে  কেননা  أحصينا এর অর্থ হচ্ছেكتبنا  “আমরা লিপিবদ্ধ করে রেখেছি”  অর্থাৎ আমরা তা যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছি  এরপর বলা হয়েছে: এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞান  কেননা যা লিখা হয় তা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম  কেউ কেউ বলেন, অর্থাৎ আমরা তা লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ করেছি যাতে করে ফিরিশতারা তা জানতে পারে  কেউ কেউ বলেন, এতে বান্দাদের যে সমস্ত আমল লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, বান্দাদের আমলের এ সমস্ত রেকর্ড আল্লাহর নির্দেশে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিরিশতাগণই সম্পাদন করেছেন, প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ﴿وَإِنَّ عَلَيۡكُمۡ لَحَٰفِظِينَ ١٠ كِرَامٗا كَٰتِبِينَ ١١﴾ [الانفطار: ١٠،  ١١]“অবশ্যই তোমাদের ওপর নিযুক্ত আছে তত্ত্বাবধায়কগণ, সম্মানিত লেখকগণ (যারা লিপিবদ্ধ করছে তোমাদের কার্যকলাপ” [সূরা আল-ইনফিতার, আয়াত: ১০-১১]
জাহান্নামীদের সর্বোচ্চ শাস্তির বর্ণনা:
فَذُوقُواْ فَلَن نَّزِيدَكُمۡ إِلَّا عَذَابًا  “অতএব এখন স্বাদ গ্রহণ কর, আমরা তোমাদের জন্য কেবল শাস্তিই বৃদ্ধি করব (অন্য আর কিছু নয়) ” আবু বারযাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম কুরআন মাজীদের সবচেয়ে কঠিন আয়াত কোনটি? তিনি বলেন, فَذُوقُواْ فَلَن نَّزِيدَكُمۡ إِلَّا عَذَابًا “অতএব এখন স্বাদ গ্রহণ কর, আমরা তোমাদের জন্য কেবল শাস্তিই বৃদ্ধি করব (অন্য আর কিছু নয়) ” অর্থাৎ এ বাণীটি আল্লাহর অপর বাণীর অনুরূপ যাতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿كُلَّمَا نَضِجَتۡ جُلُودُهُم بَدَّلۡنَٰهُمۡ جُلُودًا غَيۡرَهَا ٥٦ ﴾ [النساء : ٥٦]   “যখন তাদের গায়ের চামড়া দগ্ধ হবে, আমরা সেই চামড়াকে নতুন চামড়া দ্বারা বদলে দেব”। [সূরা আন-নিসা: [ , আয়াত: ৫৬] আল্লাহ তা‘আলা অপর আয়াতে বলেন, ﴿كُلَّمَا خَبَتۡ زِدۡنَٰهُمۡ سَعِيرٗا ٩٧﴾ [الاسراء: ٩٧]   “যখনই তার আগুন নিস্তেজ হয়ে আসবে, আমরা তাদের জন্য অগ্নির দহন শক্তি বৃদ্ধি করে দেব।” [সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ৯৭]
﴿إِنَّ لِلۡمُتَّقِينَ مَفَازًا ٣١ حَدَآئِقَ وَأَعۡنَٰبٗا ٣٢ وَكَوَاعِبَ أَتۡرَابٗا ٣٣ وَكَأۡسٗا دِهَاقٗا ٣٤ لَّا يَسۡمَعُونَ فِيهَا لَغۡوٗا وَلَا كِذَّٰبٗا ٣٥ جَزَآءٗ مِّن رَّبِّكَ عَطَآءً حِسَابٗا ٣٦﴾ [النبا: ٣١،  ٣٦]   
অর্থনুবাদ:
৩১. (অন্য দিকে) মুত্তাকীদের জন্য আছে সাফল্য। ৩২. বাগান, আঙ্গুর, ৩৩. আর সমবয়স্কা নব্য যুবতী ৩৪. এবং পরিপূর্ণ পানপাত্র। ৩৫. সেখানে তারা শুনবে না অসার অর্থহীন আর মিথ্যে কথা, ৩৬. এটা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রতিফল, যথোচিত দান। [সূরা নাবা, আয়াত নং ৩১-৩৬]
তাফসীর:
জান্নাতীদের জন্য জান্নাতের নিয়‘আমতসমূহের বর্ণনা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:إِنَّ لِلۡمُتَّقِينَ مَفَازًا  “(অন্য দিকে) মুত্তাকীদের জন্য আছে সাফল্য” যারা আল্লাহ তা‘আলার বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে বেঁচে থাকে তাদের পরিণতি উল্লেখ করা হয়েছে সফলতা, সাফল্যের স্থান, আর জাহান্নামীরা যে দুঃখ-কষ্টে রয়েছে তা থেকে মুক্তি  এ কারণে পানি শুকিয়ে গেলে মরুভূমিকে বলা হয়  مفازةএ আশায় যে শুষ্কতা দুর হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  حَدَآئِقَ وَأَعۡنَٰبٗا“বাগান, আঙ্গুর” এখানে পূর্বে উল্লিখিত সফলতার ব্যাখ্যা প্রদান করা হচ্ছে: বলা হয়েছে إِنَّ لِلۡمُتَّقِينَ مَفَازًا  (অন্য দিকে) “মুত্তাকীদের জন্য আছে সাফল্য”  মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে বাগ-বাগিচা,  حدائق-এ একবচন হচ্ছে حديقة প্রাচীর বেষ্টির বাগান  বলা হয় أحدق به  অর্থাৎ তাকে বেষ্টন করে রেখেছে,  الأعناب-এর একবচন হচ্ছে عنب অর্থাৎ আঙ্গুর।
 وَكَوَاعِبَ أَتۡرَابٗا“আর সমবয়স্কা নব্য যুবতী” كواعب -এর একবচন হচ্ছে كاعب, এর অর্থ হচ্ছে স্ফীত স্তন বিশিষ্ট রমনী  দাহ্হাক রহ. বলেন, পূর্ণবক্ষা কুমারীর মতো,  الأترابহচ্ছে সমবয়স্কা, সূরা আল-ওয়াকি‘আতে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে  এর একবচন হচ্ছে ترب।
 وَكَأۡسٗا دِهَاقٗا “এবং পরিপূর্ণ পানপাত্র”  হাসান, কাতাদা, ইবন যায়েদ, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন,  دهاقا -এর অর্থ হচ্ছে পরিপূর্ণ  বলা হয়:  أدهقت الكأسঅর্থাৎ আমি গ্লাস পরিপূর্ণ করেছি,  كأس دهاق-এর অর্থ হচ্ছে ভরা গ্লাস (কাঁচের পাত্র), সা‘ঈদ ইবন জুবাইর, ইকরিমা, মুজাহিদ, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা আরও বলেন, ধারাবাহিকভাবে, একের পর এক আসতে থাকবে  যেমন, বলা হয়)  أدهقت الحجارة ادهاقا আমি প্রস্তর বর্ষণ করেছি, তীব্রতা ও পরস্পর (বোঝানো হয়েছে), একের মাঝে অপর প্রবিষ্ট হওয়া  متتابع অর্থাৎ ধারাবাহিক হচ্ছে অনুপ্রবিষ্টের ন্যায়  ইকরিমার অপর এক বর্ণনা এবং যায়েদ ইবন আসলাম থেকে বর্ণিত হয়েছে (এর অর্থ হচ্ছে) বিশুদ্ধ। যার একবচন হচ্ছেدهق  কাঁচের পাত্র দ্বারা উদ্দেশ্য সুরার পাত্র, বাক্যে উহ্য রয়েছে: গ্লাস ভর্তি সুরা, অর্থাৎ নিংড়িয়েছি এবং বিশুদ্ধ করেছি  কুশাইরী এ মত পোষণ করেছেন বিশুদ্ধ বর্ণনায় রয়েছে: أدهقت الماء  অর্থাৎ আমি পানি সম্পূর্ণরূপে শেষ করে দিয়েছি  আবু আমর বলেন,  الدّهَق যবর সহকারে: এক প্রকার শাস্তি, المدهوق হচ্ছে এমন শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তি যে সকল প্রকার শাস্তির সম্মুখীন হয়েছে যাতে কোনো বিরতি নেই, ইবনুল ‘আরাবী বলেন, دهقت الشيء  আমি তা ভেঙ্গে ফেলেছি, আমি তা কেটে ফেলেছি, অনুরূপ অর্থ دهقته –এর  আসমা‘ঈ বলেন,  الدهمقة নরম খাবার ও উৎকৃষ্ট, অনুরূপভাবে প্রতিটি নরম জিনিষ, যেমন উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসে এসেছে: আমি যদি আমার জন্য নরম করতে চাইতাম তবে তা পারতাম, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা ঐ সম্প্রদায়কে দোষি সাব্যস্ত করেন এবং বলেন,  ﴿أَذۡهَبۡتُمۡ طَيِّبَٰتِكُمۡ فِي حَيَاتِكُمُ ٱلدُّنۡيَا وَٱسۡتَمۡتَعۡتُم بِهَا ٢٠﴾ [الاحقاف: ٢٠] “তোমরা তোমাদের পার্থিব জীবনেই তোমাদের অংশের নি‘আমাতগুলো নিঃশেষ করেছ আর তা ভোগ করেছ”  [সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ২০]
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:  لَّا يَسۡمَعُونَ فِيهَا لَغۡوٗا وَلَا كِذَّٰبٗا  “সেখানে তারা শুনবে না অসার অর্থহীন আর মিথ্যে কথা”  অর্থাৎ জান্নাতে তারা শুনবে না অসার অর্থহীন আর মিথ্যে কথা।
جَزَآءٗ مِّن رَّبِّكَ عَطَآءً حِسَابٗا “এটা তোমার রবের পক্ষ থেকে প্রতিফল, যথোচিত দান ” اللغو হচ্ছে আজগুবি কথাবার্তা, তা হচ্ছে কথাবার্তায় চিন্তা-ভাবনা না করে ভুলত্রুটি করা। হাদীসে এসেছে: “জুম‘আর দিন ইমামের খুৎবারত অবস্থায় তুমি যখন তোমার সাথীকে বল ‘চুপ কর’ তখন তুমি অনর্থক কাজ করলে”  কেননা জান্নাতবাসীগণ যখন তা পান করবে তাদের মস্তিষ্ক বিগড়ে যাবে না, তারা অনর্থক কথা-বার্তাও বলবে না, কিন্তু দুনিয়াবাসীদের কথা ভিন্ন  وَلَا كِذَّٰبٗا পূর্বে (এর তাফসীর) অতিবাহিত হয়েছে  অর্থাৎ কেউ কারও সাথে মিথ্যা বলবে না, তারা মিথ্যা শুনবে না  কাসাঈ كِذَّٰبٗا অর্থাৎ ذال -এর উপরে তাশদীদ ছাড়া পাঠ করেছেন, অর্থাৎ জান্নাতে পরস্পর পরস্পরের সাথে মিথ্যা বলাবলি করবে না  কেউ কেউ বলেন, এ দু’টো হচ্ছে تكذيب (অবিশ্বাসের) মাসদার  وَكَذَّبُواْ بِ‍َٔايَٰتِنَا كِذَّابٗا  “তারা আমার নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করেছিল- পুরোপুরি অস্বীকার ”
جَزَآءٗ مِّن رَّبِّكَ “এটা তোমার রবের পক্ষ থেকে”  মাসদার হিসেবে নসব হয়েছে, এর অর্থ হচ্ছে তিনি তাদেরকে প্রতিদান দিবেন যার বর্ণনা পূর্বে দেওয়া হয়েছে, তাদের পুরস্কার, অনুরূপভাবেعَطَآءً  (প্রতিফল) (নসব হয়েছে) কেননা, এর অর্থ হচ্ছে তিনি তাদেরকে প্রদান করবেন, আর جزاهم একই অর্থ অর্থাৎ তিনি তাদেরকে পুরস্কার প্রদান করবেন
 حِسَابٗا “যথোচিত দান” অর্থাৎ প্রচুর, কাতাদা এ মত পোষণ করেছেন  বলা হয়: أحسبت فلان অর্থাৎ আমি তাকে প্রচুর পরিমাণে প্রদান করেছি এমনকি সে বলে: যথেষ্ট হয়েছে  ক্বুতাবী বলেন, এর অর্থ হচ্ছে তিনি তাকে এতটা প্রদান করবেন যে পরিশেষে সে বলবে: যথেষ্ট হয়েছে  যাজ্জাজ রহ. বলেন, حسابا  অর্থাৎ যা তাদের জন্য যথেষ্ট হবে  আখফাশও তাই বলেন, বলা হয়: أحسبني كذا  অর্থাৎ আমার জন্য যথেষ্ট  কালবী বলেন, حاسبهم  তিনি তাদেরকে তাদের নেক আমলের বিনিময়ে দশগুণ প্রদান করবেন মুজাহিদ বলেন, তারা যা করেছে তার যথাযথ হিসেব দিবেন, তখন حساب  অর্থ বিবেচনা অর্থাৎ রবের ওয়াদা অনুযায়ী যা আবশ্যক সে পরিমাণ অনুসারে, তিনি পূণ্যের দশগুণ পুরস্কার দিবেন বলে ওয়াদা করেছেন, কারও জন্য সাতশত গুণ, কারও জন্য ওয়াদা করেছেন এমন পুরস্কার দেওয়ার যার কোনো সীমা নেই  যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿إِنَّمَا يُوَفَّى ٱلصَّٰبِرُونَ أَجۡرَهُم بِغَيۡرِ حِسَابٖ ١٠﴾ [الزمر: ١٠]  “আমি ধৈর্যশীলদেরকে তাদের পুরস্কার অপরিমিতভাবে দিয়ে থাকি ” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১০]
আবু আবু  হাশিম পাঠ করেছেন:  عطاءً حَسَّاباًঅর্থাৎ  حا-এ যবর এবং سين -এ তাশদীদ সহকারে,  فعّال-এর ওজনে, অর্থাৎ যথেষ্ট (পরিমাণ)  আসমা‘ঈ রহ. বলেন, আরবগণ যখন কোনো লোককে সম্মান করে তখন বলে: حسَّبْت الرجل (অর্থাৎ লোকটিকে আমরা সম্মান করেছি), আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা এভাবে পাঠ করেছে حساناً অর্থাৎ  (با-এর স্থলে  نون)
﴿ رَّبِّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَمَا بَيۡنَهُمَا ٱلرَّحۡمَٰنِۖ لَا يَمۡلِكُونَ مِنۡهُ خِطَابٗا ٣٧ يَوۡمَ يَقُومُ ٱلرُّوحُ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ صَفّٗاۖ لَّا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَقَالَ صَوَابٗا ٣٨ ذَٰلِكَ ٱلۡيَوۡمُ ٱلۡحَقُّۖ فَمَن شَآءَ ٱتَّخَذَ إِلَىٰ رَبِّهِۦ مَ‍َٔابًا ٣٩ إِنَّآ أَنذَرۡنَٰكُمۡ عَذَابٗا قَرِيبٗا يَوۡمَ يَنظُرُ ٱلۡمَرۡءُ مَا قَدَّمَتۡ يَدَاهُ وَيَقُولُ ٱلۡكَافِرُ يَٰلَيۡتَنِي كُنتُ تُرَٰبَۢا ٤٠ ﴾ [النبا: ٣٧،  ٤٠]  
অর্থানুবাদ:
৩৭. যিনি আকাশ, পৃথিবী আর এগুলোর মাঝে যা কিছু আছে সব কিছুর রব্ব, তিনি অতি দয়াময়, তাঁর সম্মুখে কথা বলার সাহস কারো হবে না। ৩৮. সেদিন রূহ (জিবরাঈল) আর ফিরিশতারা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে, কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না, সে ব্যতীত যাকে পরম করুণাময় অনুমতি দিবেন, আর সে যথার্থ কথাই বলবে। ৩৯. এ দিনটি সত্য, সুনিশ্চিত। অতএব, যার ইচ্ছে সে তার রবের দিকে আশ্রয় গ্রহণ করুক। ৪০. আমি তোমাদেরকে নিকটবর্তী শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করছি, যেদিন মানুষ দেখতে পাবে তার হাতগুলো আগেই কী (‘আমাল) পাঠিয়েছে আর কাফির বলবে- ‘হায়! আমি যদি মাটি হতাম (তাহলে আমাকে আজকের এ ‘আযাবের সম্মুখীন হতে হত না। [সূরা আন-নাবা, আয়াত: ৩৭-৪০]
তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, رَّبِّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَمَا بَيۡنَهُمَا ٱلرَّحۡمَٰنِۖ   “যিনি আকাশ, পৃথিবী আর এগুলোর মাঝে যা কিছু আছে সব কিছুর প্রতিপালক, তিনি অতি দয়াময়”  আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, নাফে‘, আবু ‘আমর, ইবন কাসীর, যায়েদ ইয়া‘কূব থেকে, মুফায্যাল আসেম থেকে, ربُّ অর্থাৎ با -এ পেশ সহকারে, কেননা এখান থেকে বাক্য শুরু হয়েছে, الرحمن হচ্ছে তার خبر বা বিধেয় অথবা هو رب السموات (অর্থাৎ তিনি আসমানসমূহের রব) الرحمن  দ্বিতীয় مبتدا অর্থাৎ নতুন করে শুরু করা বাক্যের প্রথম অংশ। পক্ষান্তরে ইবন আমের, ইয়াকূব, ইবন মুহাইসিন উভয়ে পাঠ করেছেন যের সহকারে, এ হিসেবে رب হচ্ছে সিফাত  جَزَآءٗ مِّن رَّبِّكَ“তোমার রবের পক্ষ থেকে (দান)” যিনি আসমানসমূহের রব্ব, (যিনি) দয়াবান। আর আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা, আসিম, হামযাহ, কাসাঈ পাঠ করেছেন: رب السموات  –এ  رب-কে যের দ্বারা পড়েছেন সিফাত হিসেবে আর الرحمن -কে পড়েছেন পেশ সহকারে مبتدا  হিসেবে  আবু আবু  উবাইদ এ পন্থা পছন্দ করেছেন। তিনি বলেন, এটা সবচেয়ে সঠিক,  رب-কে যের দ্বারা (পড়া হবে) কেননা তা পূর্বের   من ربك এর সিফাত (গুণ) হয়েছে  আর  الرحمن-কে (পড়া হবে) পেশ সহকারে, কেননা তা من ربك থেকে দূরে আর এখান থেকে নতুন করে বাক্য শুরু হয়েছে  আর তারخبر  (বিধেয়) হচ্ছেلَا يَمۡلِكُونَ مِنۡهُ خِطَابٗا  “তাঁর সম্মুখে কথা বলার সাহস কারো হবে না”  তারা তাঁর নিকট কোনো প্রশ্ন করার ক্ষমতা রাখবে না; তবে যে বিষয়ে তাদেরকে অনুমতি দিবেন (তার কথা ভিন্ন)  কাসাঈ বলেন, (তাঁর সম্মুখে কথা বলার সাহস কারো হবে না) অর্থাৎ সুপারিশের, তবে যাকে তিনি অনুমতি দিবেন (তার কথা ভিন্ন)  কেউ কেউ বলেন, الخطاب মানে কথা অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ছাড়া তাঁর সাথে কথা বলার ক্ষমতা কারও থাকবে না  তার প্রমাণ হচ্ছে: ﴿لَا تَكَلَّمُ نَفۡسٌ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ ١٠٥﴾ [هود: ١٠٥]  “তখন তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ মুখ খুলতে পারবে না।” [সূরাহূদ, আয়াত: ১০৫] কেউ কেউ বলেন, এখানে তিনি কাফিরদের উদ্দেশ্য করেছেন তারা তাঁর সম্মুখে কথা বলার সাহস করবে না”  কিন্তু মুমিনগণ সুপারিশ করবেন। আমি বলি: তাদেরকে অনুমতি দানের পরে, কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ ٢٥٥﴾ [البقرة: ٢٥٥]    “কে সেই ব্যক্তি যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে? ” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৫] আর আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী: ﴿يَوۡمَئِذٖ لَّا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَرَضِيَ لَهُۥ قَوۡلٗا ١٠٩﴾ [طه: ١٠٩]    “সেদিন কারো সুপারিশ কোনো কাজে আসবে না, দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন আর যার কথায় সন্তুষ্ট হবেন তার (সুপারিশ) ব্যতীত ” [সূরা ত্বাহা, আয়াত: ১০৯]
রূহ-এর তাফসীর বা ব্যাখ্যা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:  يَوۡمَ يَقُومُ ٱلرُّوحُ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ صَفّٗاۖ “সেদিন রূহ (জিবরাঈল) আর ফিরিশতাগণ সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে”  يوم শব্দটিতে যবর হয়েছে কেননা তা ظرف  (অর্থাৎ ক্রিয়া সংঘটিত হবার কাল) অর্থাৎ সেদিন তার সম্মুখে কারও কথা বলার সাহস হবে না যেদিন রূহ দাঁড়াবেন  এ আয়াতে روح (রূহ) দ্বারা কে বা কী উদ্দেশ্য এ ব্যাপারে আট প্রকার মত রয়েছে:
প্রথম মত হচ্ছে: রূহ হচ্ছে ফিরিশতাদের মধ্য থেকে অন্যতম একজন ফিরিশতা।  আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, আল্লাহ তা‘আলা ‘আরশের পরে তার চেয়ে বড় আর কোনো সৃষ্টি তৈরি করেন নি  যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে তখন সে এক কাতারে দাঁড়াবে আর সমস্ত ফিরিশতা এক কাতারে দাঁড়াবে, তার অবয়ব হবে ফিরিশতাদের কাতারের মতো। এ ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকেও অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে। তিনি বলেন, রূহ এমন একজন ফিরিশতা যিনি সপ্ত আসমান, সপ্ত জমিন এবং পাহাড়সমূহ থেকেও বড়, চতুর্থ আসমানের বিপরীতে তার অবস্থান, সে প্রত্যহ বারো হাজার বার আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক তাসবীহ থেকে একজন করে ফিরিশতা সৃষ্টি করেন, সে কিয়ামত দিবসে একাই এক কাতারে দাঁড়াবে আর সমস্ত ফিরিশতা দাঁড়াবে এক কাতারে।
দ্বিতীয় মত হচ্ছে: রূহ হচ্ছে জিবরীল আলাইহিস সালাম, এ মত পোষণ করেছেন শা‘বী, দাহ্হাক, সা‘ঈদ ইবন জুবাইর। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাবর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলার ‘আরশের ডান পার্শ্বে নূরের একটি দরিয়া আছে, যা সপ্ত আসমান, সপ্ত জমিন এবং সাত সমুদ্রের মতো। জিবরীল আলাইহিস সালাম প্রতিদিন সকালে এতে ডুব দিয়ে গোসল করেন। ফলে তার নূর, তার সৌন্দর্য এবং তার সম্মান আরও বেড়ে যায়, এরপর তিনি কেঁপে উঠেন এরপর তার পালক থেকে নির্গত হওয়া প্রতিটি ফোঁটা থেকে আল্লাহ তা‘আলা সত্তর হাজার ফিরিশতা সৃষ্টি করেন, তাদের থেকে প্রত্যেক দিন সত্তর হাজার ফিরিশতা বাইতুল মা‘মূর এবং সত্তর হাজার ফিরিশতা কা‘বায় প্রবেশ করে; কিন্তু কিয়ামত দিবস পর্যন্ত এদের কারও দ্বিতীয়বার সেখানে ফিরে আসার সুযোগ হবে না  ওয়াহাব বলেন, জিরবীল আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে দাঁড়ান, তাতে ভয়ে তিনি কম্পবান থাকেন, প্রত্যেক কম্পনে আল্লাহ তা‘আলা এক লক্ষ ফিরিশতা সৃষ্টি করেন, ফিরিশতাগণ আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে অবনত মস্তকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, এরপর আল্লাহ তা‘আলা যখন তাদেরকে কথা বলার অনুমতি দান করেন তখন তারা বলে   لا إله إلا انت আপনি ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই  আর এটাই হচ্ছে وَقَالَ صَوَابٗا এর অর্থ। এ কথাই আল্লাহ তা‘আলার বাণী,  يَوۡمَ يَقُومُ ٱلرُّوحُ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ صَفّٗاۖ لَّا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحۡمَٰنُ  “সেদিন রূহ (জিবরাঈল) আর ফিরিশতাগণ সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে, কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না, সে ব্যতীত যাকে পরম করুণাময় অনুমতি দিবেন” কথা বলার  وَقَالَ صَوَابٗا “আর সে যথার্থ কথাই বলবে” অর্থাৎ তার কথা:  لا إله إلا انت (আপনি ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই)  
তৃতীয় মত হচ্ছে: আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,  এ আয়াতে রূহ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার সৈন্যসামন্তের মধ্য থেকে এক সৈন্য, তারা ফিরিশতা নয়, তাদের মাথা, হাত-পা আছে, তারা আহার করে, এরপর তিনি পাঠ করেন: يَوۡمَ يَقُومُ ٱلرُّوحُ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ صَفّٗا “সেদিন রূহ (জিবরীল) আর ফিরিশতাগণ সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে ” ওরাও সৈন্য, এরাও সৈন্য, এ মত পোষণ করেছেন  আবু  সালিহ, মুজাহিদ, এর ভিত্তিতে মানুষের মতোই তাদের আকৃতি, তবে তারা মানুষ নয়  
চতুর্থ মত হচ্ছে: তারা হচ্ছে ফিরিশতাদের মাঝে সবচেয়ে সম্মানিত, মুকাতিল ইবন হাইইয়ান এ মত ব্যক্ত করেছেন  
পঞ্চম মত হচ্ছে: তারা হচ্ছে ফিরিশতাগণের তত্ত্বাবধায়ক, ইবন  আবু  নাজীহ এ মত পোষণ করেছেন।
ষষ্ঠ মত হচ্ছে: তারা হচ্ছে আদম সন্তান (অর্থাৎ মানব), হাসান এবং কাতাদা এ মত ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ যাদের রূহ (আত্মা) রয়েছে। আওফী এবং কুরাযী বলেন, এ মতটি আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু গোপন রাখতেন। তিনি বলেন, তারা হচ্ছে মানুষের আকৃতির মত এক সৃষ্টি, আসমান থেকে যে ফিরিশতাই অবতীর্ণ হয় তার সাথে রূহ থাকে।  
সপ্তম মত হচ্ছে: আদম সন্তানদের রূহসমূহ এক কাতারে দাঁড়াবে আর ফিরিশতাগণ এক কাতারে দাঁড়াবে, আর সেটা সিঙ্গার দুই ফুৎকারের মধ্যবর্তী সময়ে তাদের রূহগুলোকে তাদের দেহসমূহে ফিরিয়ে দেওয়ার পূর্বে। আতিয়্যাহ এ মত ব্যক্ত করেছেন।
অষ্টম মত হচ্ছে: তা হচ্ছে কুরআন, যায়েদ ইবন আসলাম এ মত পোষণ করেছেন  আর তিনি দলীল হিসেবে এ আয়াত পাঠ করেন: ﴿وَكَذَٰلِكَ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ رُوحٗا مِّنۡ أَمۡرِنَاۚ ٥٢﴾ [الشورى: ٥٢]  “এভাবে (উপরোক্ত ৩টি উপায়েই) আমার নির্দেশের মূল শিক্ষাকে তোমার কাছে আমরা অহী যোগে প্রেরণ করেছি” [সূরা আশ- -শূরা, আয়াত: ৫২] আর صفا  এটি মাসদার অর্থাৎ তারা দাঁড়াবে সারিবদ্ধভাবে, মাসদার একবচন ও বহুবচন উভয়ের জন্যই ব্যবহৃত হয়, যেমন عدل (ন্যায়বিচার) صوم (সিয়াম)। আর এখান থেকেই ঈদের দিনকে বলা হয় يوم الصف সারিবদ্ধ (হয়ে দাঁড়ানো)-এর দিন  আল্লাহ তা‘আলা  কুরআনের অপর এক স্থানে বলেন,﴿وَجَآءَ رَبُّكَ وَٱلۡمَلَكُ صَفّٗا صَفّٗا ٢٢﴾ [الفجر: ٢٢]  “আর যখন তোমার রব আসবেন আর ফিরিশতাগণ আসবে সারিবদ্ধ হয়ে” [সূরা আল-ফাজর, আয়াত: ২২] এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, সারির সংখ্যা একাধিক হবে।  আর তা সংঘটিত হবে উপস্থাপন ও হিসাব-নিকাশের দিনে। ক্বুতাবী এবং অন্যান্যরা এ অর্থ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বলেন, রূহ দাঁড়াবে এক কাতারে আর ফিরিশতাগণ দাঁড়াবে আরেক কাতারে, তাঁরা দু’টি কাতারে দাঁড়াবে  কেউ বলেন, তারা সকলে একই কাতারে দাঁড়াবে।
 لَّا يَتَكَلَّمُونَ “কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না”  অর্থাৎ সুপারিশ করতে পারবে না, إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحۡمَٰنُ  “সে ব্যতীত যাকে পরম করুণাময় অনুমতি দিবেন” সুপারিশের।
وَقَالَ صَوَابٗا  “আর সে যথার্থ কথাই বলবে” অর্থাৎ সঠিক তথা হক্ব কথা  দাহ্হাক এবং মুজাহিদ এ মত পোষণ করেছেন  আবু  সালিহ বলেন, অর্থাৎ  لا إله إلا الله অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই  দাহ্হাক বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, যে ব্যক্তি لا إله إلا الله বলেছে তার জন্য সুপারিশ করবে। তবে ‘সঠিক কথা’ তো তা-ই যা হবে কথা ও কাজে সঠিক। ...
কেউ কেউ বলেন, (কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না) অর্থাৎ ফিরিশতাগণ এবং রূহ যারা কাতারে দণ্ডায়মান হবে, তারা কথা বলতে পারবে না আল্লাহ তা‘আলার হাইবাত অর্থাৎ ভীতিজড়িত শ্রদ্ধা এবং তাঁর সম্মান-মর্যাদার কারণে, তবে দয়াময় যাকে অনুমতি প্রদান করবেন শাফা‘আত করার, তারা হচ্ছে ওরাই যারা সঠিক কথা বলেছে, তারা আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদ ঘোষণা করেছে এবং তাঁর তাসবীহ পাঠ করেছে
হাসান বলেন, রূহ কিয়ামত দিবসে বলবে: কেউ আল্লাহ তা‘আলার রহমাত ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, আর কেউ জাহান্নামেও নয়; তবে আমলের কারণে, আর তাই হচ্ছে وَقَالَ صَوَابٗا “আর সে যথার্থ কথাই বলবে”  এ কথার অর্থ।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:  ذَٰلِكَ ٱلۡيَوۡمُ ٱلۡحَقُّۖ “এ দিনটি সত্য, সুনিশ্চিত” অর্থাৎ অবশ্যই ঘটবেفَمَن شَآءَ ٱتَّخَذَ إِلَىٰ رَبِّهِۦ مَ‍َٔابًا  “অতএব যার ইচ্ছে সে তার রবের দিকে আশ্রয় গ্রহণ করুক”  অর্থাৎ সৎকর্মের মাধ্যমে তার প্রত্যাবর্তনস্থল, অর্থাৎ যখন সে ভালো কাজ করে তখন তা আল্লাহ তা‘আলার দিকে ফিরায় (তার দয়ায় হয়েছে বলে), আর যখন সে মন্দ কাজ করে তখন সেটা তার নিজের (কারণে হয়েছে) বলে গণ্য করে। আর এ অর্থই বুঝা যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নোক্ত হাদীস থেকে, তিনি বলেন, الخير كله بيديك والشر ليس إليك  অর্থাৎ “ভালো সব কিছুই আপনার হাতে আর মন্দ আপনার প্রতি সম্বন্ধযুক্ত নয়”।  কাতাদা বলেন,  مأباএর অর্থ হচ্ছে পথ।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:  إِنَّآ أَنذَرۡنَٰكُمۡ عَذَابٗا قَرِيبٗا“আমরা তোমাদেরকে নিকটবর্তী শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করছি”  এখানে কুরাইশ কাফির এবং আরবের মুশরিকদের সম্বোধন করে বলা হচ্ছে। কেননা তারা বলে: আমরা পুনরুত্থিত হবো না  (এখানে) ‘আযাব দ্বারা উদ্দেশ্য পরকালের শাস্তি, যা কিছুই আসন্ন তাই নিকটবর্তী, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿كَأَنَّهُمۡ يَوۡمَ يَرَوۡنَهَا لَمۡ يَلۡبَثُوٓاْ إِلَّا عَشِيَّةً أَوۡ ضُحَىٰهَا ٤٦﴾ [النازعات: ٤٥]  “যেদিন তারা তা দেখবে সেদিন তাদের মনে হবে, যেন তারা (পৃথিবীতে) এক সন্ধ্যা বা এক সকালের বেশি অবস্থান করে নি”। [সূরা আন- নাযি‘আত, আয়াত: ৪৫] কালবী এবং অন্যান্যর এরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন  কাতাদা বলেন, দুনিয়ার শাস্তি, কেননা তা উভয় শাস্তির মাঝে অধিক নিকটবর্তী  মুকাতিল বলেন, তা হচ্ছে বদরের ময়দানে কাফিরদের নিহত হওয়া, তবে সবচেয়ে স্পষ্ট হচ্ছে: তা হচ্ছে পরকালের শাস্তি, তা হচ্ছে মৃত্যু এবং কিয়ামত  কেননা যে মারা যায় তার কিয়ামত শুরু হয়ে যায়, কাজেই যদি সে জান্নাতবাসী হয় তবে সে তার বাসস্থান জান্নাতে দেখতে পায়  আর যদি সে হয় জাহান্নামী তবে অপমান-অপদস্থ প্রত্যক্ষ করে এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,   يَوۡمَ يَنظُرُ ٱلۡمَرۡءُ مَا قَدَّمَتۡ يَدَاهُ “যেদিন মানুষ দেখতে পাবে তার হাতগুলো আগেই কী (‘আমাল) পাঠিয়েছে”  সেই শাস্তির সময়ের মাঝে, অর্থাৎ আমরা তোমাদেরকে সেদিনের নিকটবর্তী শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেছি, তা হচ্ছে যেদিন মানুষ দেখতে পাবে যে, তার হাতগুলো আগেই কী (আমল) পাঠিয়েছে; অর্থাৎ প্রত্যক্ষ করবে।  
কেউ কেউ বলেন, তার দিকে দেখবে যা আগেই পাঠিয়েছে, এখানে إلى শব্দটি উহ্য আছে, المرء দ্বারা হাসানের মতে এখানে উদ্দেশ্য মুমিন, সে নিজের আমল পেয়ে যাবে, আর কাফির নিজের কোনো আমল পাবে না, সে আকাঙ্খা করবে মাটি হয়ে যেতে
কিয়ামতের দিন কাফিরদের অসহায়ত্ব:
আল্লাহ তা‘আলা যখন বললেন, وَيَقُولُ ٱلۡكَافِرُ  “আর কাফির বলবে” তখন বুঝা যায় যে, তিনি المرء দ্বারা মুমিনগণের উদ্দেশ্য গ্রহণ করেছেন।  কেউ কেউ বলেন, المرء  দ্বারা এখানে উদ্দেশ্য উবাই ইবন খালফ, উকবাহ ইবন আবু আবু  মু‘ঈত  আর وَيَقُولُ ٱلۡكَافِرُ  দ্বারা উদ্দেশ্য আবু  জাহাল  
কেউ বলেন, এর দ্বারা সাধারণভাবে সকলেই উদ্দেশ্য, মানুষ সেদিন তার কর্মফল প্রত্যক্ষ করবে।  
মুকাতিল বলেন,  يَوۡمَ يَنظُرُ ٱلۡمَرۡءُ مَا قَدَّمَتۡ يَدَاهُ “যেদিন মানুষ দেখতে পাবে তার হাতগুলো আগেই কী (‘আমাল) পাঠিয়েছে”  এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে আবু আবু  সালামাহ ইবন আব্দুল আসাদ আল মাখযূমীর ব্যাপারে।  
وَيَقُولُ ٱلۡكَافِرُ يَٰلَيۡتَنِي كُنتُ تُرَٰبَۢا “আর কাফির বলবে  ‘হায়! আমি যদি মাটি হতাম” (তাহলে আমাকে আজকের এ ‘আযাবের সম্মুখীন হতে হত না)  এ আয়াতটি তার (সালামার) ভাই আসওয়াদ ইবন আব্দুল আসাদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে।  
সা‘লাবী বলেন, আমি আবুল কাসিম ইবন হাবীবকে বলতে শুনেছি: এখানে কাফির দ্বারা উদ্দেশ্য ইবলিস, সে আদম আলাইহিস সালামের দোষ ধরেছিল যে, তিনি মাটির তৈরী, আর সে অহঙ্কার করে যে, সে আগুনের তৈরি, এরপর কিয়ামত দিবসে যখন সে স্বচক্ষে আদম আলাইহিস সালাম এবং তার সন্তানাদি কী ধরণের পুরস্কার, আরাম-আয়েশ ও রহমতের মাঝে, আর সে কী ধরণের কষ্ট ও শাস্তির মাঝে রয়েছে প্রত্যক্ষ করবে  তখন সে আকাঙ্খা করবে সে যদি আদম আলাইহিস সালামের স্থানে থাকত, সে বলবে, يَٰلَيۡتَنِي كُنتُ تُرَٰبَۢا “হায়! আমি যদি মাটি হতাম” (তাহলে আমাকে আজকের এ ‘আযাবের সম্মুখীন হতে হত না) তিনি বলেন, আমি কুশাইরী আবু  নাসরের কোনো তাফসীরে দেখেছি। যাতে বলা হয়েছে: অর্থাৎ ইবলিস বলবে: হায় আফসোস, আমি যদি মাটির তৈরি হতাম, আর যদি না বলতাম ‘আমি আদমের চেয়ে উত্তম’।
 আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, কিয়ামত দিবসে জমিনকে উপরিভাবে সম্প্রসারিত (প্রশস্ত) করা হবে, এরপর ভারবাহি জন্তু, জানোয়ার ও বন্য প্রাণীদের একত্রিত করা হবে, এর জীব-জন্তুর মাঝে কিসাস (বদলা) সংঘটিত হবে, গুতা মারার কারণে শিংওয়ালা বকরী থেকে শিংবিহীন জন্তুর কিসাস নেওয়া হবে, তাদের কিসাসের কার্যাদি সমাপ্ত হওয়ার পরে তাদেকে বলা হবে: মাটি হয়ে যাও,  সে সময় কাফির বলবে: হায় আফসোস, যদি মাটি হতাম। অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে আবু  হুরাইরাহ, আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম থেকেও  আমরা এ বিষয়টি ‘আত-তাযকিরাহ’ গ্রন্থে সুন্দররূপে উল্লেখ করেছি মৃত্যুর অবস্থাসমূহ ও পরকালের বিষয়াদি সহকারে  সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য
আবু আবু জা‘ফার আন-নাহ্হাস বর্ণনা করেন: হাদীস বর্ণনা করেছেন আমাদের নিকট আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন নাফে‘ (তিনি বলেন) হাদীস বর্ণনা করেছেন আমাদের নিকট সালামাহ ইবন শাবীব ইয়াযীদ ইবনুল আসাম্ম (তিনি) আবু  হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে, তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা চতুষ্পদ জন্তু, পাখি, মানুষ সকলকে একত্রিত করবেন, এরপর চতুষ্পদ জন্তু এবং পাখিদের বলবেন: মাটি হয়ে যাও, সে সময় কাফির বলবে: يَٰلَيۡتَنِي كُنتُ تُرَٰبَۢا  “হায়! আমি যদি মাটি হতাম”।  
কেউ কেউ বলেন, يَٰلَيۡتَنِي كُنتُ تُرَٰبَۢا  “হায়! আমি যদি মাটি হতাম” অর্থাৎ যদি পুনরুত্থিত না হতাম, যেমন তারা বলবে: ﴿فَيَقُولُ يَٰلَيۡتَنِي لَمۡ أُوتَ كِتَٰبِيَهۡ ٢٥﴾ [الحاقة: ٢٥]   “হায়! আমাকে যদি আমার ‘আমালনামা না দেওয়া হত”  [সূরা আল-হা-ক্কাহ, আয়াত: ২৫]
আবু আবুয যিনাদ বলেন, মানুষের মাঝে যখন ফায়সালা করে দেওয়া হবে, জান্নাতবাসীদেরকে জান্নাতে যেতে নির্দেশ দেওয়া হবে, আর জাহান্নামীদের নির্দেশ দেওয়া হবে জাহান্নামে যেতে, তখন (মানুষ ব্যতীত) অন্য সকল প্রজাতি এবং মুমিন জিন্নদের বলা হবে: মাটিতে ফিরেও যাও, (অর্থাৎ মাটি হয়ে যাও) তারা মাটি হয়ে যাবে  কাফিররা যখন তাদেরকে দেখবে তখন তারা বলবে: يَٰلَيۡتَنِي كُنتُ تُرَٰبَۢا “হায়! আমি যদি মাটি হতাম”।
লাইস ইবন আবু আবু সুলাইম বলেন, মুমিন জিন্নেরা মাটি হয়ে যাবে, উমার ইবন আব্দুল আযীয, ইমাম যুহরী, কালবী এবং মুজাহিদ রহ. বলেন, মুমিন জিন্নেরা জান্নাতের চারপাশে বিশ্রাম ও প্রশস্ততার মাঝে থাকবে, তারা এর ভেতরে থাকবে না  আর এটাই অধিক বিশুদ্ধ মত। এ সম্পর্কে সূরা আর-রহমানে আলোচনা করা হয়েছে, তারা মুকাল্লাফ বা শরী‘আতের বিধি-বিধান পালনে বাধ্য, তাদেরকে (তাদের ভালো-মন্দ কর্মের ভিত্তিতে) সাওয়াব-শাস্তি দেওয়া হবে, তারা মানুষের মতো। আল্লাহ তা‘আলা সঠিক বিষয় সম্পর্কে অধিক অবগত। আল্লাহই ভালো জানেন।

 

সূরা আন-নাবা-এর তাফসীর

বই সম্পর্কে

লেখক :

Muhammad ibn Ahmad Al-Qurtubi

প্রকাশক :

www.islamhouse.com

বিভাগ :

About Quran & Hadith