হাফেয ইবন কাসীরের তাফসীর থেকে সংক্ষেপিত সূরা আল-আনফালের তাফসীর

এটি ইমাম ইবন কাসীরের তাফসীর থেকে সংক্ষেপিত সূরা আনফালের তাফসীর। সূরা আনফাল পবিত্র কুরআনের মক্কায় অবতীর্ণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা। এ সূরাটিতে বদরের যুদ্ধের ঘটনা, গনীমতের মালের বিধান, বদরের যুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য লাভ, বন্দিদের বিধান, যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করার শাস্তি, রাসূলকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রকে বানচাল করা ইত্যাদি বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে।

اسم الكتاب: مختصر تفسير سورة الأنفال للحافظ ابن كثير


تأليف: أحمد محمد شاكر


الناشر: المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة


نبذة مختصرة: كتاب مترجم إلى اللغة البنغالية، يحتوي على تفسير سورة الأنفال مختصراً من تفسير ابن كثير، أن هذه السورة من السور المكية المهمة التي نزلت حول واقعة غزوة بدر، بين الله سبحانه وتعالى في هذه السورة حكم الغنائم، ونصرة الله لأوليائه المسلمين، وفشل مؤامرة الكفار لقتل النبي - صلى الله عليه وسلم -، وحكم الفرار يوم الزحف وغيرها من الأحكام التي يحتاج إليها كل مسلم.


হাফেয ইবন কাসীরের তাফসীর থেকে সংক্ষেপিত  
সূরা আল-আনফালের তাফসীর

مختصر تفسير سورة الأنفال للحافظ ابن كثير
        < بنغالي- Bengal - বাঙালি>                  

 

শাইখ আহমদ মুহাম্মাদ শাকের





অনুবাদক: জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

 

مختصر تفسير سورة الأنفال للحافظ ابن كثير
        
 للشيخ أحمد محمد شاكر



ترجمة: ذاكرالله أبوالخير
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

 
সূচিপত্র

ক্রম    বিষয়    পৃষ্ঠা
1.        ভূমিকা    
2.        আয়াতের শানে নুযূল    
3.        আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার আরো কারণ    
4.        সত্যবাদী মুমিনগণের গুণাবলী    
5.        কুরআন তিলাওয়াতের সময় ঈমান বৃদ্ধি পাওয়া    
6.        আয়াতের শানে নুযূল    
7.        আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার আরো কারণ    
8.        সত্যবাদী মুমিনগণের গুণাবলী    
9.        কুরআনের আয়াত তিলাওয়াতের সময় ঈমান বৃদ্ধি পাওয়া    
10.        আল্লাহর ওপর ভরসার বর্ণনা    
11.        মুমিনগণের আমলসমূহের বর্ণনা    
12.        প্রকৃত ঈমানের বর্ণনা    
13.        পরিপূর্ণ ঈমানের ফলাফল    
14.        রাসূলের আনুগত্য করা মুমিনগণের জন্য উত্তম    
15.        মুসলিমবৃন্দের সাহায্য প্রার্থনা এবং ফিরিশতা পাঠিয়ে তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার সাড়া প্রদান    
16.        মুসলিমদের ওপর তন্দ্রা প্রবল হওয়া    
17.        বদরের রাতে বৃষ্টি বর্ষণ    
18.        ফিরিশতাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ    
19.        যুদ্ধের ময়দান থেকে পালানোর নিষেধাজ্ঞা এবং তার শাস্তি    
20.        কাফেরদের হত্যা এবং তাদের প্রতি ধুলা নিক্ষেপ    
21.        মুশরিকদের মীমাংসার আবেদনে সাড়া প্রদান    
22.        আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করার নির্দেশ    
23.        আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দেওয়ার নির্দেশ    
24.        মুসলিমদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে তারা ইতোপূর্বে হীন ও দুর্বল ছিল তারপর তারা শক্তিশালী ও বিজয়ী হয়    
25.        খিয়ানাত থেকে নিষেধাজ্ঞা    
26.        নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা অথবা বন্দী অথবা বিতাড়নের জন্য মক্কাবাসীদের পরিকল্পনা    
27.        তারা কুরআনের মত (গ্রন্থ) নিয়ে আসতে পারবে বলে কুরাইশদের ধারণা    
28.        কাফেরদের মীমংসা চাওয়া এবং প্রার্থনা    
29.        পাপের কারণে মুশরিকদের শাস্তি পাওয়া    
30.        আল্লাহর পথে বাধা দেওয়ার জন্য কাফেরদের সম্পদ ব্যয় এবং পরিতাপ     
31.        তাওবার প্রতি উৎসাহ প্রদান আর কুফুরীর ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন    
32.        কুফর ও শির্ক খতম করার জন্য যুদ্ধের নির্দেশ    
33.        গনীমত এবং ফাই মালের বিধান    
34.        বদর যুদ্ধের কিছু ব্যাখ্যা    
35.        উভয় বাহিনীকে কম করে দেখান    
36.        যুদ্ধের শিষ্টাচার শিক্ষা    
37.        শত্রুদের মুকাবিলা করার সময় দৃঢ় থাকার নির্দেশ    
38.        মুহাজির এবং আনসারগন পরস্পর পরস্পরের বন্ধু    
39.        যারা ঈমানের পর হিজরত করে নি তাদের জন্য কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই     
40.        কাফেররা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু, মুসলিমদের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই    
41.        মুমিনগণ সত্যের ভেতরে রয়েছে    
42.        উত্তরাধিকার নিকটাত্মীয়দের জন্য    

ভূমিকা

সূরা আল-আনফাল মক্কায় অবতীর্ণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা। এ সূরায় আল্লাহ তা‘আলা ইসলামী শরী‘আতের বিভিন্ন বিধান তুলে ধরেছেন। গনীমতের মালের বিধান, প্রকৃত মুমিনদের গুণাবলী, ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধের পেক্ষাপট, সূচনা, বদরের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী ও কাফের বাহিনীর অবস্থা এবং এ যুদ্ধের বিস্তারিত ঘটনা এ সূরায় আলোচনা করা হয়েছে। মক্কার কাফেররা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার ষড়যন্ত্র করলে তাদের ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে কীভাবে রক্ষা করলেন তা এ সূরায় খুব সুন্দরভাবে চিত্রায়িত করা হয়। ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বদরের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আল্লাহ তা‘আলা আসমান থেকে ফিরিশতা অবতরণ করে মুসলিম সৈন্য ও মুজাহিদদের সাহায্য করেছিলেন।  আসমানী সাহায্য লাভের কথাও এ সূরায় তুলে ধরা হয়।
মুসলিম বাহিনী ও মুজাহিদদের বিজয় কখনো অস্ত্র ও জনবলের আধিক্য বা কম হওয়ার ওপর নির্ভর করে না, জাগতিক শক্তির ওপর নির্ভর করে না, তা নির্ভর করে কেবল আল্লাহর সাহায্য ও মদদের ওপর। এ অকাট্য সত্যটি এ সূরার মূল পতিপাদ্য বিষয়ের অন্যতম। কারণ, ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল নিরস্র স্বল্প সংখ্যক মুসলিম বাহিনীর সাথে রণ সজ্জায় সজ্জিত সশস্ত্র, অশ্বারোহী এক বিশাল সৈন্য বাহিনীর সাথে; কিন্তু এত বড় সশস্ত্র বাহিনীর সাথে নিরস্ত্র এ বাহিনীর বিজয় আসমানী সাহায্য দ্বারাই যে সম্ভব হয়েছে তা এ সূরায় গুরুত্ব সহকারে বিভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়।
সাহাবীগণের আত্মত্যাগ, রাসূলের প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা, ইসলামের জন্য তাদের কুরবানী, আমীরের প্রতি তাদের নজিরবিহীন আনুগত্য, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুলের যে দৃষ্টান্ত তারা দুনিয়াবাসীর জন্য রেখেছেন, তা এ সূরায় বিভিন্নভাবে ফুটে উঠেছে। এ ছাড়াও কাফেরদের প্রতি তাদের ঘৃণা আর ইসলামের প্রতি তাদের ভালোবাসা যে কত গভীর এ সূরা অধ্যয়নে তা অনুভব করা যাবে।
যুদ্ধ বন্দিদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যবহার ও তাদের সাথে কেমন আচরণ হওয়া উচিৎ সে আলোচনাও এ সূরায় স্থান পেয়েছে। যুদ্ধের শিষ্টাচার, যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করার শাস্তি, আমীরের আনুগত্য করার গুরুত্ব, খিয়ানত করার নিষেধাজ্ঞা ও তার শাস্তি, মুহাজির ও আনছারদের পারস্পরিক সু-সম্পর্ক, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের গুরুত্ব এবং ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ ও শক্তি সঞ্চয় করা, যে কোনো বিষয়ে পরামর্শ করা, মারা যাওয়ার পর উত্তরাধিকারী কারা হবে ইত্যাদি বিষয়ে এ সূরায় আলোচনা করা হয়েছে।
বর্তমান সময়ের বাস্তবতা ও দাবি অনুযায়ী বিষয়গুলো জানা থাকা খুবই জরুরি। ফলে বাংলা ভাষাভাষী ভাইদের জন্য সূরাটির তাফসীর তুলে ধরা হলো। সূরাটির সংক্ষিপ্ত তাফসীর তাফসীরে ইবন কাসীরের অবলম্বনে রচিত উমদাতুত তাফসীর নামক গ্রন্থ থেকে অনুবাদ করে তুলে ধরা হল। মূলত উমদাতুত তাফসীর নামক কিতাবটি হাফেয ইবন কাসীরের রচিত বিশ্ব বিখ্যাত তাফসীর ‘তাফসীরে ইবন কাসীর’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। শাইখ আল্লামা আহমদ শাকের রহ. কিতাবটি সংকলন করেন। তিনি তার এ কিতাবে যে কথাগুলো মূল কিতাবে বার বার এসেছে সেগুলো বাদ দিয়ে পাঠকের জন্য কুরআনের মর্মকে বুঝতে সহজ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আর প্রতিটি হাদীসের সূত্র হাদীন নম্বরসহ তিনি এখানে তুলে ধরেছেন। অনুবাদ করতে গিয়ে তার হুবহু অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। তবে কিছু যায়গায় কোনো প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ হাদীস বা তাফসীরের বর্ণনা জানা প্রয়োজন মনে করলে, তা মূল কিতাব তাফসীরে ইবন কাসীর থেকে নিয়ে টিকা আকারে তুলে ধরা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে অনুবাদকের সংযোজন বিধায় তা অনুবাদক লিখে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আশা করি এ তাফসীর দ্বারা পাঠক ভাইয়েরা উপকৃত হবেন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের কুরআন বুঝা ও তা অনুধাবন করা তাওফীক দিন। আমীন।
জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের

 

 

 

 

 

সূরা আল-আনফাল-এর তাফসীর
সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ, এর আয়াত সংখ্যা পঁচাত্তার, শব্দ সংখ্যা এক হাজার ছয়শত একত্রিশ, হরফ সংখ্যা পাঁচ হাজার দুই শত চুরানব্বই। আল্লাহ ভালো জানেন।
بسم الله الرحمن الرحيم
পরম করুণাময় অসীম দয়াময় আল্লাহর নামে।
﴿يَسۡ‍َٔلُونَكَ عَنِ ٱلۡأَنفَالِۖ قُلِ ٱلۡأَنفَالُ لِلَّهِ وَٱلرَّسُولِۖ فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَأَصۡلِحُواْ ذَاتَ بَيۡنِكُمۡۖ وَأَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ١﴾ [الانفال: ١]   
অর্থানুবাদ:
“তারা তোমাকে যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। বল, ‘যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের; কাজেই তোমরা আল্লাহকে ভয় কর আর নিজেদের সম্পর্ককে সুষ্ঠু সুন্দর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত কর। তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাক তবে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১]
তাফসীর:
ইমাম বুখারী রহ. বলেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, আনফাল হচ্ছে গনীমত। সা‘ঈদ ইবন জুবাইর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে সূরা আল-আনফাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এটি বদর যুদ্ধ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়। ইমাম বুখারী আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে মু‘আল্লাকরূপে যা বর্ণনা করেছেন অনুরূপ বর্ণনা করেছেন আলী ইবন আবু তালহা আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে, তিনি বলেন, আনফাল হচ্ছে গনীমত। এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য খাস ছিল, এ থেকে আর কারও কোনো অংশ ছিল না। অনুরূপ মত পোষণ করেছেন মুজাহিদ, ইকরিমা, ‘আতা’, দাহ্হাক, কাতাদা, ‘আতা’ আল খোরাসানী, মুকাতিল ইবন হাইয়ান, আব্দুর রহমান ইবন যাইদ ইবন আসলাম এবং অন্যান্যরা।
ইবন জারির রহ. কাসেম ইবন মুহাম্মাদ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে এক লোক আনফাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে আমি শুনেছি, তখন তিনি বললেন, নফল হচ্ছে ‘অতিরিক্ত’ ঘোড়া বা সালাব- সৈন্যের বক্তিগত অর্জন। লোকটি আবারো জিজ্ঞাসা করলে, ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একই কথা বললেন। তারপর লোকটি বলল, আল্লাহর কিতাবে যে আনফালের কথা বলা হয়েছে তার ব্যাখ্যা কী? কাসেম বলেন, লোকটি এভাবে জিজ্ঞাসা করতেই ছিল, মনে হচ্ছিল, লোকটি তাকে সংকটে ফেলবে। তখন ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বললেন, তোমরা জান এর দৃষ্টান্ত কী? এর দৃষ্টান্ত সবীগ-এর মতো যাকে উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু প্রহার করেছিল।  আব্দুর রাযযাক রহ. কাসেম ইবন মুহাম্মদ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে যখন কোনো বিষয় জিজ্ঞাসা করা হত, তখন তিনি বলতেন, আমি তোমাদের আদেশও করি না নিষেধও করি না। তারপর ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, আল্লাহর কসম আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে আদেশ ও নিষেধকারী এবং হালাল ও হারামের বর্ণনাদানকারী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। কাসেম বলেন, ইবন আব্বাসের ওপর এক লোক চড়াও হলো, সে তাকে আনফাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বললেন, একজন মানুষের ঘোড়া ও অস্ত্র ‘নফল’ অতিরিক্ত হিসেবে প্রদান করা হত। লোকটি আবারো জিজ্ঞেস করলে তিনি একই উত্তর দিলেন। তারপর লোকটি আবারো জিজ্ঞেস করলো এবং তাকে ক্ষুব্ধ করে তুলল। তখন ইবন আব্বাস বললেন, এ লোকের দৃষ্টান্ত তোমরা জান? এর দৃষ্টান্ত সবীগ-এর মতো যাকে উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু প্রহার করার ফলে তার ঘাড় ও পা রক্তাক্ত হয়। তখন লোকটি বলল, হে সবীগ, আল্লাহ তোমার থেকে উমারের জন্য বদলা নিয়েছেন। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত, তিনি আনফাল-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, আনফাল হচ্ছে অতিরিক্ত মাল যা ইমাম কতিপয় ব্যক্তিকে মূল গনীমত বন্টন করার পর প্রদান করেন। চাই তা সালাব (সৈন্যের বক্তিগত অর্জন) হোক বা এ জাতীয় কিছু। অধিকাংশ ফকীহর নফল শব্দের ব্যাখ্যা থেকেও এ ধরনের ব্যাখ্যাই প্রতিফলিত হয়। কেউ কেউ বলেন, আনফাল হচ্ছে অতিরিক্ত মাল যা ইমাম কতিপয় ব্যক্তিকে মূল গনীমত বন্টন করে দেওয়ার পর প্রদান করেন। চাই তা সালাব (সৈন্যের বক্তিগত অর্জন) হোক বা এ জাতীয় কিছু। মুজাহিদ রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক-পঞ্চমাংশ যা পাঁচ ভাগের চার ভাগ বন্টন করার পরে দেওয়া হয় সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে, আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত يَسْأَلُونَكَ عَنِ الأنْفَال “তারা তোমাকে যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে” নাযিল করেন।  আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও মাসরুক উভয়ে বলেন, যুদ্ধের দিন কোনো নফল নেই। নফল হলো, শত্রুদের মুকাবেলার আগে যে সম্পদ অর্জিত হয়। বর্ণনায় ইবন আবী হাতিম।
আব্দুল্লাহ ইবন মুবারক ‘আতা ইবন আবু রিবাহ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি يَسْأَلُونَكَ عَنِ الأنْفَال “তারা তোমাকে যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে” এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, তারা আপনার নিকট মুশরিকদের থেকে কোনো প্রকার যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়া মুসলিমদের যা কিছু অর্জন হয়েছে যেমন, জন্তু অথবা দাস-দাসী অথবা সম্পদ সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। উত্তরে বললেন, এ সম্পদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য নফল, এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। এ কথা দ্বারা বুঝা যায়, তিনি আনফালের ব্যাখ্যা ফাই দ্বারা করেছেন, আর তা হলো, কাফেরদের থেকে বিনা যুদ্ধে অর্জিত সম্পদ।
ইবন জারীর বর্ণনা করেন, অন্যান্যরা বলেন, (তা হচ্ছে) সৈন্যদের একটি ছোট্ট বাহিনীর অর্জিত সম্পদ। আমার নিকট এ আয়াত يَسْأَلُونَكَ عَنِ الأنْفَالِ “তারা তোমাকে যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে” বিষয়ে পৌঁছেছে যে, (তা হচ্ছে) সৈন্যদের একটি ছোট্ট বাহিনী, এখানে অর্থ হচ্ছে নেতা কতিপয় সৈন্যকে সেনাবাহিনীর অন্যান্যদের সাথে তাদের বন্টনের পরও তাদেরকে অতিরিক্ত কিছু দান করেন। আল্লামা শা‘বী এ অর্থই স্পষ্ট করেন। আর ইবন জারির রহ. এ মত পছন্দ করেন যে, তা হলো, বন্টনের পর অতিরিক্ত সম্পদ। তিনি প্রমাণ হিসেবে শানে নুযূলের বিষয়টি তুলে ধরেন। ইমাম আহমদ সা‘দ ইবন আবু ওয়াক্কাস থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, বদর যুদ্ধে আমার ভাই উমাইর নিহত হয়। আমি সা‘ঈদ ইবন আ‘সকে হত্যা করি এবং তার তরবারী ছিনিয়ে নেই। তরবারীটি যাল-কুতাইফা নামে পরিচিত ছিল। তারপর সেটি নিয়ে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসি, তিনি বললেন, “যাও তুমি তা গনীমতের মালে রেখে দাও” তিনি বলেন, ভাইকে হত্যা করা ও তার তরবারী ছিনিয়ে নেওয়ার পর তা রেখে আসা ইত্যাদি কারণে আমার অন্তর এত বেশি ভারাক্রান্ত ও ব্যথিত তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। আমি ব্যথিত হৃদয়ে ফিরে আসি। আমার অন্তরের অবস্থা এমন ছিল তা আমি কাউকে বুঝাতে পারছি না। তারপর আমি হাঁটতে হাঁটতে সামান্য পথ অতিক্রম করতে না করতেই সূরা আল-আনফাল নাযিল হয়। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডেকে বললেন, اذهب فخذ سيفك “যাও তুমি তোমার তরবারী গ্রহণ কর”।
আয়াতের শানে নুযূল
ইমাম আহমাদ রহ. সা‘দ ইবন মালিক থেকে বর্ণনা করেন, সা‘দ ইবন মালিক রহ. বলেন, আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের থেকে আমাদেরকে আজ আরাম ও নিরাপত্তা দিয়েছেন, কাজেই আমাকে এ তরবারীটি প্রদান করুন। ফলে তিনি বলেন, إِنَّ هَذَا السَّيْفَ لَا لَكَ وَلَا لِي، ضَعْهُ “এ তরবারীটি না তোমার, না আমার, রেখে দাও”। তিনি বলেন, ফলে আমি তা রেখে দেই, কিন্তু মনে মনে বলি: তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হয়ত সেটা এমন কাউকে দিয়ে দিবেন যে আমার মতো এমন বিপদে আক্রান্ত হয় নি এবং এত প্রচণ্ডরূপে যুদ্ধ করে নি। তিনি বলেন, হঠাৎ দেখি জনৈক ব্যক্তি পেছন থেকে আমাকে ডাকছে, তিনি বলেন, আমি বলি, আমার ব্যাপারে কি কোনো আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, كُنْتَ سَأَلْتَنِي السَّيْفَ، وَلَيْسَ هُوَ لِي وَإِنَّهُ قَدْ وُهِبَ لِي، فَهُوَ لَكَ “তুমি আমার কাছে তরবারী চেয়েছিলে, সেটা আমার নয় (যে ব্যাপারে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি) এখন আমার জন্য এটি মঞ্জুর করা হয়েছে (আল্লাহ তা‘আলা পক্ষ থেকে), আমি তোমাকে এটি আমার পক্ষ থেকে প্রদান করছি”। তিনি বলেন, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন: يَسْأَلُونَكَ عَنِ الأنْفَالِ قُلِ الأنْفَالُ لِلَّهِ وَالرَّسُولِ “তারা তোমাকে যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। বল, ‘যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের”।  হাদীসটি বর্ণনা করেন, আবূ দাউদ, তিরমিযী এবং ইমাম নাসাঈ। ইমাম তিরমিযী বলেন, হাসান সহীহ। অনুরূপভাবে হাদীসটি বর্ণনা করেন, আবু দাউদ আত-তায়ালিসী সা‘দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে তিনি বলেন, আমার সম্পর্কে চারটি আয়াত নাযিল হয়, বদরের দিন আমি একটি তলোয়ার লাভ করি, তারপর তা নিয়ে রাসূলুল্লাহর সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলি, এটি আমাকে নফল হিসেবে দিন। তখন তিনি বললেন, “যেখান থেকে নিয়েছ সেখানে রেখে দাও”। কথাটি দুইবার বললেন। তারপর আমি আবারও তার কাছে চাইলাম, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একই কথা বললেন, “যেখান থেকে নিয়েছ সেখানে রেখে দাও”। তারপর এ আয়াত يَسْأَلُونَكَ عَنِ الأنْفَالِ “তারা তোমাকে যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে” নাযিল হয়। আরো যে তিনটি আয়াত তার সম্পর্কে নাযিল হয়, সূরা আনকাবুতের আট নং আয়াত, মদ, জুয়া বিষয়ে সূরা আল-মায়েদার ৯নং আয়াত এবং অসিয়ত সম্পর্কিয় আয়াত। বর্ণনায় মুসলিম।

আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার অন্য কারণ:
ইমাম আহমাদ রহ. বর্ণনা করেন, আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি উবাদা রা. এর নিকট ‘আনফাল’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমরা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়, যখন আমাদের মাঝে নফল (গনীমতের অতিরিক্ত মাল) নিয়ে বিবাদ হয়েছিল এ ব্যাপারে আমাদের আচরণ আপত্তিজনক ও মন্দ হয়েছিল, ফলে আল্লাহ তা‘আলা সেটাকে আমাদের থেকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধীনে করে দেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদের মাঝে তা সমানভাগে ভাগ করে দেন।  
ইমাম আহমাদ রহ. আরও বর্ণনা করেন, আবু উমামা ‘উবাদা ইবন সামিত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করে বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বের হই এবং আমি তাঁর সাথে বদরে অংশগ্রহণ করি, ফলে উভয় বাহিনী পরস্পর মুখোমুখি হয়, আল্লাহ তা‘আলা শত্রুদের পরাজিত করেন,  একটি দল তাদেরকে (সম্পূর্ণরূপে) পরাজিত করা এবং হত্যা করার জন্য পশ্চাদ্ধাবন করেন, আরেকটি দল লড়াইয়ের ময়দানে এসে গনীমতের মাল সংগ্রহ করতে থাকে। আর এক দল সৈন্যদের পাহারায় নিয়োজিত থাকে। আর আরেকটি দল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শত্রুদের হঠাৎ আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য তাঁর চারিদিক বেষ্টন করে থাকে, রাতের বেলায় (উপরোক্ত) সব ধরণের লোক তাদের শিবিরে ফিরে আসে, যারা গনীমতের মাল জমা করেছিল তারা বলে, আমরা এগুলো সংগ্রহ করেছি এতে আর কারও অংশ নেই, আর যারা শত্রুদের অনুসন্ধানে বের হয়েছিল তারা বলে, তোমরা আমাদের চেয়ে এ ব্যাপারে বেশি অধিকার রাখ না, আমরা তো এ থেকে শত্রুদেরকে হটিয়ে দিয়েছি এবং তাদেরকে পরাজিত করেছি, আর যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বেষ্টন করে রেখে ছিল তারা বলে: আমরা আশঙ্কা করেছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শত্রুরা হঠাৎ আক্রমণ করবে ফলে আমরা তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আমরাই বেশি হকদার। তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয় يَسۡ‍َٔلُونَكَ عَنِ ٱلۡأَنفَالِۖ قُلِ ٱلۡأَنفَالُ لِلَّهِ وَٱلرَّسُولِۖ فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَأَصۡلِحُواْ ذَاتَ بَيۡنِكُمۡۖ “তারা তোমাকে যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। বল, ‘যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের; কাজেই তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আর নিজেদের সম্পর্ককে সুষ্ঠু সুন্দর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত কর”। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদের মাঝে তা বন্টন করে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন শত্রু ভূখণ্ডে হঠাৎ আক্রমণ চালাতেন তখন তিনি এক চতুর্থাংশ নফল প্রদান করতেন। এরপর যখন শত্রুদের মুখোমুখি হতেন (সংঘর্ষ হত) আর সকলে ফিরে আসত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নফল প্রদান অপছন্দ করতেন, আর শক্তিশালী যোদ্ধাদের উৎসাহ দিতেন যাতে তারা দুর্বল যোদ্ধাদেরকে তাদের কিছু অংশ প্রদান করে। আহমাদ, তিরমিযী, ইবন মাজাহ, অনুরূপ বর্ণনা করেছেন, আর ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, হাদীসটি হাসান। ইবন হিব্বান স্বীয় সহীহতে হাদীসটি বর্ণনা করেন এবং হাকিম স্বীয় মুস্তাদরাকে এবং হাকিম বলেন, বিশুদ্ধ সনদ ইমাম মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী তবে হাদীসটি ইমাম মুসলিম ও বুখারী উল্লেখ করেন নি।
ইমাম আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবন জারির, ইবন মারদাবিয়্যাহ, ইবন হিব্বান এবং হাকিম ইকরামা থেকে তিনি ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, বদর যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, «مَنْ صَنَعَ كَذَا وَكَذَا فَلَهُ كَذَا وَكَذَا» “যে ব্যক্তি এমন এমন বাহাদুরী করবে, তার জন্য এমন এমন পুরস্কার থাকবে”। এ কথা শুনে যুবকরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর বৃদ্ধরা পতাকা তলে থেকে যায়। তারপর যখন গনীমতের মাল অর্জিত হল, যাদের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল তারা তাদের দাবি নিয়ে উপস্থিত হল, তখন বৃদ্ধরা বলল, তাদের তোমরা আমাদের ওপর প্রাধান্য দেবে না। কারণ, আমরা তোমাদের জন্য রক্ষক ছিলাম। আমরা প্রতিহত করেছি। যদি তোমরা পরাজিত হতে আমাদের কাছেই ফিরতে। তারা পরস্পর বিবাদে জড়িয়ে পড়ল। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন يَسْأَلُونَكَ عَنِ الأنْفَالِ “তারা তোমাকে যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে” থেকে وَأَطِيعُوااللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ “তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাক তবে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর” পর্যন্ত।
ইমাম আবু উবাইদ কাসেম ইবন সাল্লাম স্বীয় কিতাবে (আল-আমওয়ালুশ শর‘ঈয়্যাহ ওয়া বায়ানু জিহাতিহা)-তে লিখেন, আনফাল হলো, গনীমতের মাল এবং যে মাল মুসলিমগণ তাদের শত্রুদের থেকে অর্জন করে। প্রথম যুগে এ মাল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য খাস ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَسۡ‍َٔلُونَكَ عَنِ ٱلۡأَنفَالِۖ قُلِ ٱلۡأَنفَالُ لِلَّهِ وَٱلرَّسُولِۖ “তারা তোমাকে যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। বল, ‘যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের”। তারপর বদরের যুদ্ধে আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী পাঁচ ভাগ করা ছাড়াই তা মুজাহিদদের মধ্যে বন্টন করে দেন। তারপর পাঁচ ভাগ করার আয়াত নাযিল হলে পূর্বের নিয়ম রহিত হয়ে যায়। একই মতামত আলী ইবন আবু তালহা রহ. ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকেও হুবহু বর্ণনা করেন। একই মত পোষণ করেন, মুজাহিদ, ইকরামাহ ও সুদ্দী। আর ইবন যায়েদ বলেন, আয়াতটি রহিত নয়, বরং অকাট্য। আবু উবাইদ রহ. বলেন, এ বিষয়ে বিভিন্ন আছার (সাহাবী ও তাবে‘ঈদের থেকে প্রাপ্ত মতামত) রয়েছে। আনফাল হল, গনীমতেরই সারাংশ। তবে এক-পঞ্চমাংশ খাস তাদের জন্য যারা এর হকদার। যাদের বিষয়ে কুরআন নাযিল হয়েছে এবং সুন্নাতের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। আরবী ভাষায় আনফালের অর্থ, বাড়তি দয়া, যা একজন ব্যক্তি কারো ওপর করে থাকে যা করা তার ওপর ওয়াজিব নয়। এ কারণেই পূর্বের উম্মতদের ওপর গনীমত হারাম থাকার পর আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের জন্য তাদের শত্রুদের সম্পদ থেকে নফলকে (অর্জিত সম্পদকে) হালাল করেছেন, তা হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের ওপর বিশেষ ফযীলত। এটিই হলো নফল বা গনীমতের বাস্তবতা। আমি বলি, এর প্রমাণ সহীহ বুখারী ও মুসলিমে জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস, তাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, أُعْطِيتُ خَمْسًا لَمْ يُعْطَهُنَّ أَحَدٌ قَبْلِي “আমাকে পাঁচটি বিষয় দেওয়া হয়েছে যা আমার পূর্বে আর কাউকে দেওয়া হয় নি” তারপর তিনি বলেন, «وَأُحِلَّتْ لِيَ الْغَنَائِمُ وَلَمْ تَحِلَّ لِأَحَدٍ قَبْلِي» ‘আমার জন্য গনীমতের মাল হালাল করা হয়েছে আমার পূর্বে আর কারো জন্য তা হালাল করা হয় নি’’। তারপর পূর্ণ হাদীস উল্লেখ করেন। আবু উবাইদ রহ. বলেন, এ কারণেই ইমাম কোনো যোদ্ধাকে তার সাহসিকতা বা বাহাদুরীর কারণে তার প্রাপ্য অংশের অতিরিক্ত পুরস্কার হিসেবে যা প্রদান করে থাকেন, তাকে নফল বলা হয়।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ “কাজেই তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর আর নিজেদের সম্পর্ককে সুষ্ঠু সুন্দর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত কর” অর্থাৎ তোমাদের যাবতীয় বিষয়ে আল্লাহ সচেতনতা অবলম্বন কর, আর তোমাদের পারস্পরিক বিষয় সংশোধন কর, পরস্পর যুলুম করো না, ঝগড়া-বিবাদ করো না, তোমরা যে কারণে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়েছ তার চেয়ে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে যে হিদায়াত ও জ্ঞান দিয়েছেন সেটা অধিক উত্তম।
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ “তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর” অর্থাৎ তোমাদের মাঝে তাঁর বন্টন যেভাবে আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করেছেন। কেননা, তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তো সেভাবেই বন্টন করেন যেভাবে আল্লাহ তা‘আলা আদল ও ইনসাফের সাথে তাঁকে বন্টন করতে বলেছেন। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, এটি হচ্ছে মুমিনগণের প্রতি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশ যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং নিজেদের সম্পর্ককে সুষ্ঠু সুন্দর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত কর। মুজাহিদও অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন।
সুদ্দী রহ. বলেন, فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ “কাজেই তোমরা আল্লাহকে ভয় কর আর নিজেদের সম্পর্ককে সুষ্ঠু সুন্দর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত কর”। হাফেয আবু ইয়া‘লা আল মূসিলী স্বীয় মুসনাদে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে একটি হাদীস উল্লেখ করেন, তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিয়ে বসে ছিলেন, তখন আমরা দেখলাম তিনি হঠাৎ এমনভাবে হাসলেন এমনকি তার দাঁত দেখা গেল। তারপর উমার রাদিয়াল্লাহু রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনার ওপর আমার মাতা-পিতা কুরবান হোক, কোনো জিনিসটি আপনাকে হাসালো? তিনি বললেন, আমার উম্মতের দুই ব্যক্তি আল্লাহ রাব্বুল ইয্যতের সম্মুখে ঝগড়া করছে, তাদের একজন বলে, হে আমার রব! আমার ভাই থেকে আমার যুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ করুন। তখন আল্লাহ তা‘আলা লোকটিকে বললেন, তোমার ভাইয়ে পাওনা পরিশোধ কর, তখন সে বলল, হে আমার রব! আমার নেক আমলের আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। বলল, তাহলে সে আমার গুনাহগুলো বহন করুক। তারপর কাঁদতে কাঁদতে রাসূলের চক্ষুদ্বয় অশ্রুশিক্ত হয়ে পড়ল। আর বলল, এ দিন বড়ই মহান দিন, এ দিন মানুষ এমন লোককে তালাশ করবে যে, তার গুণাহগুলো বহন করবে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা লোকটিকে বলল, তুমি তোমার চোখ উপরের দিক উঠাও এবং জান্নাতসমূহের দিকে তাকাও। তারপর সে মাথা উঠাবে এবং বলবে, হে আমার রব! আমি চাদির শহুরগুলো দেখছি এবং বড় বড় প্রাসাদ দেখছি যা স্বর্ণ-মুতি দ্বারা নির্মিত। এগুলো কোন নবীর জন্য? কোন সিদ্দীকের জন্য? কোন শহীদের জন্য? বলল, যে তার মূল্য পরিশোধ করতে পারবে তার জন্য। বলল, হে রব, কে আছে যে তার মূল্য দিতে পারবে? বলল, তুমিও পারবে। বলল, কীভাবে হে আমার রব! বলল, তুমি তোমার ভাইকে ক্ষমা করে দাও। সে বলল, হে আমার রব! আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। বলল, তুমি তোমার ভাইয়ের হাত ধর আর তাকে জান্নাতে নিয়ে যাও। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,«فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُواْ ذَاتَ بِيْنِكُمْ، فَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يُصْلِحُ بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ القيامة» “তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, নিজেদের মাঝে ইনসাফের সাথে মীমাংসা কর। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন মুমিনদের মাঝে আপোস-মীমাংসা করে দিবেন”।  
﴿إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ ٱللَّهُ وَجِلَتۡ قُلُوبُهُمۡ وَإِذَا تُلِيَتۡ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتُهُۥ زَادَتۡهُمۡ إِيمَٰنٗا وَعَلَىٰ رَبِّهِمۡ يَتَوَكَّلُونَ ٢ ٱلَّذِينَ يُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَمِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ يُنفِقُونَ ٣ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ حَقّٗاۚ لَّهُمۡ دَرَجَٰتٌ عِندَ رَبِّهِمۡ وَمَغۡفِرَةٞ وَرِزۡقٞ كَرِيمٞ ٤﴾ [الانفال: ٢،  ٤]
অর্থানুবাদ
“মুমিন তো তারাই আল্লাহর কথা আলোচিত হলেই যাদের অন্তর কেঁপে উঠে, আর তাদের কাছে যখন তাঁর আয়াত পঠিত হয়, তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে আর তারা তাদের রবের ওপর নির্ভর করে। তারা সালাত ক্বায়িম করে, আর আমি তাদেরকে যে জীবিকা দিয়েছি তাত্থেকে ব্যয় করে। এসব লোকেরাই প্রকৃত মুমিন। এদের জন্য এদের রবের নিকট আছে নানা মর্যাদা, ক্ষমা আর সম্মানজনক জীবিকা”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ২-৩]
তাফসীর:
সত্যবাদী মুমিনগণের গুণাবলী:
আলী ইবন আবু তলহা বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা এ আয়াত- إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُم “মুমিন তো তারাই আল্লাহর কথা আলোচিত হলেই যাদের অন্তর কেঁপে উঠে” সম্পর্কে বলেন, মুনাফিকদের অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার যিকির ইত্যাদি কোনো কিছুই প্রবেশ করে না যখন তারা তাঁর ফরয বিষয় পালন করে। তারা আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের কোনো কিছুই বিশ্বাস করে না, তারা তাঁর ওপর ভরসা রাখে না, যখন তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে তখন সালাত আদায় করে না, তারা তাদের সম্পদের যাকাত প্রদান করে না, আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে অবহিত করছেন যে, তারা মুমিন নয়। এরপর আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণের গুণাবলীর কথা উল্লেখ করে বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ “মুমিন তো তারাই আল্লাহর কথা আলোচিত হলেই যাদের অন্তর কেঁপে উঠে”। তারা তাঁর ফরয বিষয় পালন করে। وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا “আর তাদের কাছে যখন তাঁর আয়াত পঠিত হয়, তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে”। তিনি বলেন, তাদের দৃঢ় বিশ্বাস বেড়ে যায়। وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ “আর তারা তাদের রবের ওপর নির্ভর করে” অর্থাৎ তারা তাঁকে ছাড়া আর কারও আশা রাখে না। মুজাহিদ রহ. বলেন, وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ “যাদের অন্তর কেঁপে উঠে”فرقت অর্থাৎ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। অনুরূপ মত ব্যক্ত করেন সুদ্দী এবং অন্যান্যরা।
এটি হচ্ছে সাচ্চা ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য যার সম্মুখে আল্লাহর যিকির বা স্মরণ করা হলে তার আত্মা কেঁপে উঠে। তাঁকে ভয় করে, ফলে সে তাঁর নির্দেশাবলী পালন করে আর তাঁর নিষেধকৃত বিষয় বর্জন করে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَٱلَّذِينَ إِذَا فَعَلُواْ فَٰحِشَةً أَوۡ ظَلَمُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ ذَكَرُواْ ٱللَّهَ فَٱسۡتَغۡفَرُواْ لِذُنُوبِهِمۡ وَمَن يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ إِلَّا ٱللَّهُ وَلَمۡ يُصِرُّواْ عَلَىٰ مَا فَعَلُواْ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ١٣٥﴾ [ال عمران: ١٣٥]   “যারা কোনো পাপ কাজ করে ফেললে কিংবা নিজেদের প্রতি যুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং আল্লাহ ব্যতীত গুনাহসমূহের ক্ষমাকারী কেই বা আছে এবং তারা জেনে শুনে নিজেদের (পাপ) কাজের পুনরাবৃত্তি করে না”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৫] আরও বলেন,  ﴿وَأَمَّا مَنۡ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِۦ وَنَهَى ٱلنَّفۡسَ عَنِ ٱلۡهَوَىٰ ٤٠ فَإِنَّ ٱلۡجَنَّةَ هِيَ ٱلۡمَأۡوَىٰ ٤١ يَسۡ‍َٔلُونَكَ عَنِ ٱلسَّاعَةِ أَيَّانَ مُرۡسَىٰهَا ٤٢﴾ [النازعات: ٣٩،  ٤١]   “আর যে লোক তার রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করেছিল এবং নিজেকে অন্যায় কামনা বাসনা থেকে নিবৃত্ত রেখেছিল, জান্নাতই হবে তার বাসস্থান”। [সূরা আন-নাযি‘আত, আয়াত: ৪০-৪১] এ কারণে সুফিয়ান আস সাউরী রহ. বলেন, আমি সুদ্দী রহ.-কে إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُم “মুমিন তো তারাই আল্লাহর কথা আলোচিত হলেই যাদের অন্তর কেঁপে উঠে” এ আয়াত সম্পর্কে বলতে শুনেছি: এ হচ্ছে সেই ব্যক্তি সে যুলুম করার ইচ্ছা করে অথবা তিনি বলেন, পাপ কাজ করার চিন্তা করে, এ সময় তাকে বলা হয়: আল্লাহকে ভয় কর, তখন তাঁর অন্তর কেঁপে উঠে। উম্মে দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে এ আয়াত, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُم “মুমিন তো তারাই আল্লাহর কথা আলোচিত হলেই যাদের অন্তর কেঁপে উঠে” বিষয়ে বর্ণিত, তিনি বলেন, الْوَجَلُ বলা হয় অন্তরের জলনকে। যেমন, খেজুর গাছের ডাল পুড়ে যায়। তখন কি তোমরা কম্পন দেখতে পাও না। বলল, হ্যাঁ, তিনি বলেন, যখন তুমি এ ধরনের অবস্থা অনুভব কর, তখন তুমি আল্লাহর নিকট দো‘আ করবে। কারণ, দো‘আ তা দূর করে দেবে।  
কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করার সময় ঈমান বৃদ্ধি পাওয়া:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا “আর তাদের কাছে যখন তাঁর আয়াত পঠিত হয়” তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে”। যেমন, তিনি বলেন,وَإِذَا مَا أُنزلَتْ سُورَةٌ فَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ أَيُّكُمْ زَادَتْهُ هَذِهِ إِيمَانًا فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا فَزَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ [التوبة: ١٢٤] “যখনই কোনো সূরা নাযিল হয় তখন তাদের কতক লোক (বিদ্রূপ করে) বলে- “এতে তোমাদের কার ঈমান বৃদ্ধি হলো?” (কাফেররা জেনে রাখুক) যারাই ঈমান এনেছে তাদের ঈমান বৃদ্ধি হয় আর তারা এতে আনন্দিত হয়”। [সূরা আত-তাওবাহ:১২৪]
ইমাম বুখারী এবং অন্যান্য ইমামগণ এ আয়াত এবং এ জাতীয় আয়াত দ্বারা প্রমাণ করেন যে, ঈমান বাড়ে এবং অন্তরসমূহে ঈমান বিভিন্ন রকম হয়। এটি জামহুরে উম্মাতের মাযহাব। অধিকাংশ আলেম এ মত পোষণ করেন বরং একাধিক আলেম থেকে এ ব্যাপারে ইজমা বর্ণিত হয়েছে। যেমন, শাফে‘ঈ, আহমাদ ইবন হাম্বাল, আবু উবাইদ। আমরা এ বিষয় সম্পর্কে বুখারীর শারহের গোড়ার দিকে গবেষনামূলক আলোচনা করেছি। আল্লাহ তা‘আলার জন্য সকল প্রশংসা এবং তাঁরই অনুগ্রহ।
আল্লাহর ওপর ভরসা করার বর্ণনা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ “আর তারা তাদের রবের ওপর নির্ভর করে” অর্থাৎ তাঁকে বাদ দিয়ে আর কারও আকাঙ্খা করে না। তারা কেবল তাঁকেই চায়, তারা কেবল তাঁরই আশ্রয় কামনা করে, তারা তাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে তাঁর সাহায্য চায় এবং তাঁরই নিকট প্রার্থনা করে। তারা জানে যে, তিনি যা চান তাই হয় আর যা চান না তা হয় না, তিনি তাঁর সাম্রাজে কর্তৃত্ব করেন, তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই, তাঁর ফায়সালার পশ্চাদ্ধাবনকারী কেউ নেই, তিনি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। এ কারণে সা‘ঈদ ইবন জুবাইর রহ. বলেন, আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করা হচ্ছে ঈমানের সারাংশ ও সারমর্ম।
মুমিনগণের আমলসমূহের বর্ণনা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ “তারা সালাত কায়েম করে, আর আমি তাদেরকে যে জীবিকা দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে” ইতোপূর্বে মুমিনদের ঈমান ও আক্বীদার কথা বর্ণনার পর আল্লাহ তা‘আলা তাদের আমলসমূহ সম্পর্কে অবহিত করছেন। এ সব আমল সর্বপ্রকার কল্যাণকে শামিল করে। অর্থাৎ সালাত প্রতিষ্ঠা করা যা আল্লাহ তা‘আলারই হক। কাতাদা রহ. বলেন, সালাত প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, সালাত সঠিক সময়ে আদায় করা, এর জন্য ভালোভাবে অযু করা, রুকু-সাজদাহ সঠিকভাবে আদায় করা। মুকাতিল ইবন হাইইয়ান রহ. বলেন, সালাত প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, সঠিক সময়ে তা আদায় করা, সুচারুরূপে এর জন্য পবিত্রতা অর্জন করা, পূর্ণরূপে রুকু-সাজদাহ করা, এতে কুরআন তিলাওয়াত করা, তাশাহহুদ এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দুরূদ পাঠ করা, এ হচ্ছে সালাত প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে যে রিযিক দান করেছেন তা থেকে ব্যয় করার মাঝে যাকাত প্রদান করা এবং বান্দার সকল হক আদায় করা চাই তা ওয়াজিব হোক অথবা মুস্তাহাব, আল্লাহ তা‘আলার সকল সৃষ্টি তাঁর পোষ্য বা পরিবার, আল্লাহ তা‘আলার নিকট সবচেয়ে বেশি প্রিয় সৃষ্টি সেই যে তাঁর সৃষ্টির প্রতি সবচেয়ে বেশি উপকার করে। কাতাদাহ রহ. আল্লাহ তা‘আলার বাণী:وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ “আর তাদের যা রিযিক দেওয়া হয়েছে তা থেকে তারা ব্যয় করে” সম্পর্কে বলেন, হে আদম সন্তান আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের যে রিযিক দিয়েছে তা থেকে তোমরা ব্যয় কর। কারণ, এ সম্পদ তোমাদের নিকট আমানত অচিরেই তোমরা তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
প্রকৃত ঈমানের বর্ণনা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: أُولَئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا “এসব লোকেরাই প্রকৃত মুমিন” অর্থাৎ এ সমস্ত গুণাবলীর অধিকারীরাই হলো প্রকৃত ঈমানদার। হারেস ইবন মালেক আল আনসারী থেকে বর্ণিত তিনি রাসূলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে হারেস! তুমি কেমন সকাল উদযাপন করলে? তখন বললেন, ‘সত্যিকার মুমিন অবস্থায় সকাল উদযাপন করছি’ তিনি বললেন, তুমি কি বলছ তা ভেবে দেখ! কারণ, প্রতিটি বস্তুর বাস্তবতা আছে তোমাদের বাস্তবতা কী? আমার আত্মা দুনিয়া থেকে বিমুখ হয়ে গেছে, রাত জেগে থাকি দিনে না খেয়ে থাকি। আমি যেন আমার রবের ‘আরশ সরাসরি দেখছি। আর জান্নাতীদের দেখছি তারা তাতে ঘুরাফেরা করছে আর জাহান্নামীদের দেখছি তারা তাতে চিৎকার করছে। তারপর তিনি বললেন, হে হারেস! তুমি সত্যিই বুঝতে পারছ। এর ওপর অবিচল থাক। এ কথাটি তিনবার বললেন।
পূর্ণ ঈমানের ফলাফল:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: لَهُمْ دَرَجَاتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ “এদের জন্য এদের রবের নিকট আছে নানা মর্যাদা, ক্ষমা আর সম্মানজনক জীবিকা” অর্থাৎ জান্নাতে পদমর্যাদা,  শ্রেণি এবং স্তর। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿هُمۡ دَرَجَٰتٌ عِندَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ بَصِيرُۢ بِمَا يَعۡمَلُونَ ١٦٣﴾ [ال عمران: ١٦٣] “আল্লাহর নিকট তাদের বিভিন্ন মর্যাদা রয়েছে, বস্তুতঃ তারা যা কিছুই করছে, আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা”। [সূরা আলে-ইমরান,   আয়াত: ১৬৩] ومغفرة “ক্ষমা” অর্থাৎ তিনি তাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন আর তাদের ভালো আমলগুলোর সাওয়াব প্রদান করবেন। দাহ্হাক বলেন, জান্নাতীরা কতক কতকের উপরে অবস্থান করবেন। ফলে যারা উপরে থাকবেন তারা তাদের নীচে যারা আছেন তাদের ওপর তাদের কি ফযীলত ও মর্যাদা তা দেখতে পাবেন। আর যারা নীচে থাকবেন তারা তাদের ওপরে যারা আছেন তাদের কি ফযীলত ও মর্যাদা তা দেখতে পাবেন না। এ কারণেই সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «إِنَّ أَهْلَ عِلِّيِّينَ لَيَرَاهُمْ مَنْ أسفل منهم كما ترون الكوكب الغائر فِي أُفُقٍ مِنْ آفَاقِ السَّمَاءِ» قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ تِلْكَ مَنَازِلُ الْأَنْبِيَاءِ لَا يَنَالُهَا غَيْرُهُمْ؟ فَقَالَ: «بَلَى، وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ رِجَالٌ آمَنُوا بِاللَّهِ وصدَّقوا الْمُرْسَلِينَ»  “ইল্লিয়্যীনবাসীগণকে তাদের নিচের স্তরের লোকেরা প্রত্যক্ষ করবে যেভাবে তোমরা সুদূর দিগন্তে দুরবর্তী তারকা প্রত্যক্ষ কর”। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন: হে আল্লাহর রাসূল, সেগুলো হচ্ছে নবীগণের বাসস্থান, অন্য কেউ সেগুলো অর্জন করবে না, তখন তিনি বলেন, “অবশ্যই, যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, সেগুলো হচ্ছে ঐ সকল লোকেরা যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে আর নবীগণকে বিশ্বাস করেছে”।
অপর হাদীসে এসেছে যা ইমাম আহমাদ রহ. এবং সুনান চতুষ্ঠয় মারফূ‘ সনদে বর্ণনা করেছেন আতিয়্যাহ আবু সাঈদ থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِنَّ أَهْلَ الْجَنَّةِ لَيَتَرَاءَوْنَ أَهْلَ الدَّرَجَاتِ الْعُلَى كما تراءون الكوكب الغائر فِي أُفُقِ السَّمَاءِ، وَإِنَّ أَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ منهم وأنعما»
“জান্নাতবাসিগণ ঊর্দ্ধজগতের বাসিন্দাদের প্রত্যক্ষ করবে যেভাবে তোমরা সুদূর দিগন্তে দুরবর্তী তারকা প্রত্যক্ষ কর। আবু বকর এবং উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা তাদের অন্যতম আর কতইনা চমৎকার তারা”।  

﴿كَمَآ أَخۡرَجَكَ رَبُّكَ مِنۢ بَيۡتِكَ بِٱلۡحَقِّ وَإِنَّ فَرِيقٗا مِّنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ لَكَٰرِهُونَ ٥ يُجَٰدِلُونَكَ فِي ٱلۡحَقِّ بَعۡدَ مَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُونَ إِلَى ٱلۡمَوۡتِ وَهُمۡ يَنظُرُونَ ٦ وَإِذۡ يَعِدُكُمُ ٱللَّهُ إِحۡدَى ٱلطَّآئِفَتَيۡنِ أَنَّهَا لَكُمۡ وَتَوَدُّونَ أَنَّ غَيۡرَ ذَاتِ ٱلشَّوۡكَةِ تَكُونُ لَكُمۡ وَيُرِيدُ ٱللَّهُ أَن يُحِقَّ ٱلۡحَقَّ بِكَلِمَٰتِهِۦ وَيَقۡطَعَ دَابِرَ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٧﴾ [الانفال: ٥، ٧]
অর্থানুবাদ:
(তারা যেমন প্রকৃত মুমিন) “ঠিক তেমনি প্রকৃতভাবেই তোমার রব তোমাকে তোমার ঘর থেকে বের করে এনেছিলেন যদিও মুমিনদের একদল তা পছন্দ করে নি। সত্য স্পষ্ট করে দেওয়ার পরও তারা তোমার সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত হয়েছিল, (তাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল) তারা যেন চেয়ে চেয়ে দেখছিল যে, তাদেরকে মৃত্যুর দিকে তাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, দু’টি দলের মধ্যে একটি তোমরা পাবে, আর তোমরা চেয়েছিলে যেন নিরস্ত্র দলটি তোমরা লাভ কর আর আল্লাহ চেয়েছিলেন তাঁর বাণী দ্বারা সত্যকে সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে আর কাফেরদের জড় কেটে দিতে। যাতে তিনি সত্যকে সত্য হিসেবে প্রতিপন্ন করেন আর মিথ্যেকে মিথ্যে প্রমাণিত করেন, যদিও তা পাপীদের কাছে পছন্দনীয় নয়”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৫-৭]
তাফসীর:
রাসূলের আনুগত্য করা মুমিনগণের জন্য উত্তম:
ইমাম আবু জা‘ফর আত তাবারী রহ. বলেন, আল্লাহ তা‘আলার বাণী: كَمَا أَخْرَجَكَ رَبُّكَ “ঠিক তেমনি প্রকৃতভাবেই তোমার রব তোমাকে বের করে এনেছিলেন”-এর কাফ অক্ষরটির ব্যাখ্যায় মুফাসসিরদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, মুমিনগণের ইসলাহের ক্ষেত্রে তার উপমা দেওয়া হয়েছে। তাদের রবের প্রতি তাদের ভীতি এবং তাদের নিজেদের সম্পর্ককে সুষ্ঠু সুন্দর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি তাদের আনুগত্য। অতঃপর ইকরিমা থেকে এমনই বর্ণনা করা হয়েছে।
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যেভাবে তোমরা গনীমত নিয়ে পরস্পর বিবাদ করেছ আর এ ব্যাপারে কৃপণতা করেছ, যার ফলে তোমাদের থেকে আল্লাহ তা‘আলা তা ছিনিয়ে নিয়েছেন এবং তা স্বয়ং আল্লাহ ও  তাঁর রাসূলের বন্টনে দিয়েছেন, এরপর তিনি (রাসূল) সেটা ন্যায় ও ইনসাফের সাথে বন্টন করেছেন। এটি তোমাদের জন্য সম্পূর্ণরূপে ভালো হয়েছিল। অনুরূপভাবে যখন তোমরা অস্ত্রে সজ্জিত শত্রুদের বিরুদ্ধে বের হতে অপছন্দ করেছিলে, তারা ঐ দল যারা তাদের (বাতিল) ধর্মের সাহাযার্থে এবং তাদের বাণিজ্যিক কাফেলাকে বাঁচানোর জন্য বের হয়েছিল। তোমরা যুদ্ধ অপছন্দ করেছিলে, ফলে আল্লাহ তা‘আলা যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার ফায়সালা দেন আর দিনক্ষণ নির্ধারণ ছাড়াই তোমাদেরকে এবং তোমাদের শত্রুদেরকে মুখোমুখি করেন। এতে তাঁর উদ্দেশ্য হচ্ছে তোমাদেরকে হিদায়াত করা, সাহায্য করা এবং বিজয় দান করা। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلۡقِتَالُ وَهُوَ كُرۡهٞ لَّكُمۡۖ وَعَسَىٰٓ أَن تَكۡرَهُواْ شَيۡ‍ٔٗا وَهُوَ خَيۡرٞ لَّكُمۡۖ وَعَسَىٰٓ أَن تُحِبُّواْ شَيۡ‍ٔٗا وَهُوَ شَرّٞ لَّكُمۡۚ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ وَأَنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ ٢١٦﴾ [البقرة: ٢١٦] “তোমাদের প্রতি যুদ্ধের বিধান দেওয়া হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপ্রিয়, কিন্তু তোমরা কোনো কিছু অপছন্দ কর সম্ভবতঃ তোমাদের জন্য তা কল্যাণকর এবং সম্ভবতঃ কোনো কিছু তোমাদের কাছে প্রিয় অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১৬]
ইবন জারির রহ. বলেন, অন্যান্যরা বলেন, كَمَآ أَخْرَجَكَ رَبُّكَ مِن بَيْتِكَ بِالْحَقِّ “ঠিক তেমনি প্রকৃতভাবেই তোমার রব তোমাকে বের করে এনেছিলেন”-এর অর্থ মুমিনদের একটি অংশের অপছন্দ সত্বেও তোমাদের বের করা হয়, অনুরূপভাবে তারা যুদ্ধ করতেও অপছন্দ করে। তারপর মুজাহিদ থেকেও একই কথা বর্ণিত, তিনি বলেন, كَمَآ أَخْرَجَكَ رَبُّكَ “ঠিক তেমনি প্রকৃতভাবেই তোমার রব তোমাকে বের করে এনেছিলেন” তারা অনুরূপভাবে হকের বিষয়ে তোমার সাথে বিবাদ করবে। সুদ্দি রহ. বলেন, আল্লাহ তা‘আলা আয়াতটি বদরের যুদ্ধে বের হওয়া এবং তার সাথে সাথে বিবাদ করা বিষয়ে নাযিল করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَإِنَّ فَرِيقًا مِنَ الْمُؤْمِنِينَ لَكَارِهُونَ “যদিও মুমিনদের একদল তা পছন্দ করে নি” মুশরিকদেরকে অনুসন্ধান করার জন্য। আল্লাহ বলেন, يُجَادِلُونَكَ فِي الْحَقِّ بَعْدَمَا تَبَيَّنَ “সত্য স্পষ্ট করে দেওয়ার পরও তারা তোমার সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত হয়েছিল”।
কেউ কেউ বলেন, তারা তোমার নিকট আনফাল (যুদ্ধলব্ধ অতিরিক্ত সম্পদ) চায়। আর এ ব্যাপারে তর্ক করে, যেভাবে বদরের দিন তোমার সাথে তর্কে লিপ্ত হয়েছিল, তখন তারা বলেছিল: আপনি বাণিজ্য কাফেলাকে ধরার জন্য আমাদেরকে বের করে এনেছেন, আমাদেরকে যুদ্ধের ব্যাপারে অবহিত করেন নি, যাতে আমরা প্রস্তুতি নিতে পারি।
আমি বলি: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ানের বাণিজ্যিক কাফেলার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে বের হন। যে কাফেলাটি সিরিয়া থেকে ফিরছিল। তাতে ছিল কুরাইশদের বিশাল ধন ভাণ্ডার। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদের এ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বললে লোকেরা তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়, কেউ কেউ বিষয়টিকে হালকা মনে করে। অবশেষে তিনশত তের জন লোক নিয়ে আল্লাহর রাসূল নদীর দিকে বদরের পথে বের হন। আবু সুফিয়ান যখন হিজাযের নিকটবর্তী হয় তখন সে সতর্কতার সাথে অগ্রসর হয় এবং গোপন সূত্রে সংবাদ সংগ্রহ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বের হওয়ার কথা জানতে পারে। সে সময় সে ভীত হয়ে দমদম ইবন আমর আল গিফারীকে ভাড়া করে মক্কায় প্রেরণ করে যাতে করে সে বাণিজ্য কাফেলাকে রক্ষার জন্য কুরাইশদের সমবেত করে আর তাদেরকে যেন অবহিত করে যে, মুহাম্মাদ বাণিজ্য কাফেলাকে ধরার জন্য তার সহচরবৃন্দকে সমবেত করেছে। দমদম ইবন আমর দ্রুত মক্কায় গমন করে। ফলে তারা প্রায় এক হাজার যোদ্ধা নিয়ে বের হয়ে পড়েন। এ দিকে আবু সুফিয়ান বিকল্প পথ দিয়ে মক্কায় গমন করে এবং বেঁচে যায়। মক্কার কাফেররা বদরের প্রান্তরে এসে সমবেত হয়। আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম ও কাফেরদের মাঝে অনির্ধারিতভাবে একত্র করেন। যাতে মুসলিমদের বাক্যকে সমুন্নত করেন, তাদের দুশমনদের ওপর তাদের বিজয়ী করেন এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করেন। যার বর্ণনা অচিরেই আসছে।
মোটকথা, রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যখন বাণিজ্যিক কাফেলা বের হওয়ার সংবাদ পৌঁছল, আল্লাহ তা‘আলা যে কোনো একটি দল (হয় বাণিজ্যিক কাফেলা বা কুরাইশ) যে কোনো একটি ওপর বিজয়ী করার ঘোষণা দিয়ে তার নিকট অহী প্রেরণ করেন। অধিকাংশ মুসলিম বাণিজ্যিক কাফেলার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন। কারণ, তাতে যুদ্ধ ছাড়াই অর্জন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَتَوَدُّونَ أَنَّ غَيۡرَ ذَاتِ ٱلشَّوۡكَةِ تَكُونُ لَكُمۡ وَيُرِيدُ ٱللَّهُ أَن يُحِقَّ ٱلۡحَقَّ بِكَلِمَٰتِهِۦ وَيَقۡطَعَ دَابِرَ ٱلۡكَٰفِرِينَ “আর তোমরা চেয়েছিলে যেন নিরস্ত্র দলটি তোমরা লাভ কর আর আল্লাহ চেয়েছিলেন তাঁর বাণী দ্বারা সত্যকে সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে আর কাফেরদের জড় কেটে দিতে। যাতে তিনি সত্যকে সত্য হিসেবে প্রতিপন্ন করেন আর মিথ্যেকে মিথ্যে প্রমাণিত করেন, যদিও তা পাপীদের কাছে পছন্দনীয় নয়”। হাফেয আবু বকর ইবন মারদুবিয়্যাহ আবু আইউব আল-আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমাকে আবূ সুফিয়ানের বাণিজ্যিক কাফেলা সম্পকে সংবাদ দেওয়া হয়েছে যে, তা সিরিয়া থেকে অগ্রসর হচ্ছে। এ দলটির ওপর আক্রমণ করার ব্যাপারে তোমাদের আগ্রহ আছে কি? হতে পারে আল্লাহ এর মাধ্যমে আমাদের লাভবান করবেন।  আমরা বললাম, হ্যাঁ। তারপর তিনি ও আমরা বের হলাম। আমরা এক বা দুই দিন চলার পর তিনি আমাদের বললেন, তারা আমাদের বের হওয়ার সংবাদ জেনে ফেলেছে সুতরাং কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ করাকে তোমরা কি মনে করছ? তখন আমরা বললাম, আল্লাহর শপথ শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করার কোনো শক্তি আমাদের নেই। আমরা বাণিজ্যিক কাফেলার উদ্দেশ্যেই বের হয়েছি। তারপর তিনি আবার বললেন, কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ করাকে তোমরা কী মনে করছ? আমরা একই উত্তর দিলে মিকদাদ ইবন ‘আমর বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনাকে এমন কথা বলব না যে কথা মূসা আলাইহিস সালামের কাওমের লোকেরা তাকে বলেছিল। ﴿فَٱذۡهَبۡ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَٰتِلَآ إِنَّا هَٰهُنَا قَٰعِدُونَ ٢٤﴾ [المائ‍دة: ٢٤]   “তুমি এবং তোমার রব যাও যুদ্ধ কর আমরা এখানে অবস্থা করলাম”। সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ২৪] এ কথা শোনে আমরা আনসারী সাহাবীরা এ আকাঙ্খা পোষণ করলাম যে, আমরা যদি এমন কথা বলতাম যেমনটি মিকদাদ রাদিয়াল্লাহু ‘আন বলেছে তা আমাদের জন্য অনেক সম্পদের লাভের তুলনায় অধিক প্রিয় ছিল। তারপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত كَمَآ أَخۡرَجَكَ رَبُّكَ مِنۢ بَيۡتِكَ بِٱلۡحَقِّ وَإِنَّ فَرِيقٗا مِّنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ لَكَٰرِهُونَ “ঠিক তেমনি প্রকৃতভাবেই তোমার রব তোমাকে তোমার ঘর থেকে বের করে এনেছিলেন যদিও মুমিনদের একদল তা পছন্দ করে নি”। তারপর পুরো হাদীস উল্লেখ করেন। ইবন আবী হাতিম রহ. অনুরূপ বর্ণনা করেন। ইবন মারদাবিয়্যাহ আলকামা ইবন ওয়াক্কাস আল-লাইসী থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন, বদরের দিন রাসূল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হলেন, রাওহা নামক স্থানে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, তোমরা কি মনে কর? আবু বকর রা. বলল, আমাদের নিকট সংবাদ আছে যে, তারা অমুক অমুক স্থানে। তারপর আবারও ভাষণ দিলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি মতামত দাও? উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর মতো একই উত্তর দিলেন। তারপর আবারও ভাষণ দিলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কী মতামত দাও? তখন সা‘দ ইবন মু‘আয রা. বললেন, আপনি কি আমাদের থেকে উত্তর চাচ্ছেন হে আল্লাহর রাসূল। যে আল্লাহ আপনাকে সম্মানিত করেছেন এবং আপনার ওপর কিতাব নাযিল করেছেন, তার শপথ করে বলছি, আমি কখনোই এ পথে চলিনি, আর তা আমার জানাও নেই। কিন্তু আপনি যদি ইয়ামানের ‘বারকুল গামাদ’ও ভ্রমণ করেন আমরা আপনার সাথেই চলতে থাকব। আমরা তাদের মতো হব না যারা মূসা আ. কে বলেছিল, ﴿فَٱذۡهَبۡ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَٰتِلَآ إِنَّا هَٰهُنَا قَٰعِدُونَ ٢٤﴾ [المائ‍دة: ٢٤]  “তুমি এবং তোমার রব যাও যুদ্ধ কর আমরা এখানে অবস্থা করলাম”। সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ২৪] বরং আমরা বলব, আপনি এবং আপনার রব যান যুদ্ধ করুন আমরা আপনাদের দু’জনের অনুসারী। নিশ্চয় আপনি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কর্মে বের হচ্ছেন, আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে ব্যতিক্রম কিছু জানিয়েছেন, আল্লাহর জন্য তা বাস্তবায়ন করুন, যার সম্পর্ক ছিন্ন করতে চান করুন, যার সাথে সম্পর্ক করতে চান করুন, যার সাথে শত্রুতা করতে চান করুন এবং যার সাথে বন্ধুত্ব করতে চান করুন। আমাদের সম্পদ থেকে যা নিতে চান তা নিন। সা‘দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কথার ওপর আল্লাহ তা‘আলা আয়াত নাযিল করেন। كَمَآ أَخۡرَجَكَ رَبُّكَ مِنۢ بَيۡتِكَ بِٱلۡحَقِّ وَإِنَّ فَرِيقٗا مِّنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ لَكَٰرِهُونَ “ঠিক তেমনি প্রকৃতভাবেই তোমার রব তোমাকে তোমার ঘর থেকে বের করে এনেছিলেন যদিও মুমিনদের একদল তা পছন্দ করে নি”।
আওফী রহ. ইবন আব্বাস থেকে বর্ণনা করে বলেন, বদরের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করা বিষয়ে পরামর্শ চাইলে সা‘দ ইবন ‘উবাদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যা বলার বলেন, তিনি লোকদের যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন এবং তাদেরকে কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেন। বিষয়টি মুমিনদের অপছন্দ হলে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত كَمَآ أَخۡرَجَكَ رَبُّكَ مِنۢ بَيۡتِكَ بِٱلۡحَقِّ وَإِنَّ فَرِيقٗا مِّنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ لَكَٰرِهُونَ ٥ يُجَٰدِلُونَكَ فِي ٱلۡحَقِّ بَعۡدَ مَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُونَ إِلَى ٱلۡمَوۡتِ وَهُمۡ يَنظُرُونَ “ঠিক তেমনি প্রকৃতভাবেই তোমার রব তোমাকে তোমার ঘর থেকে বের করে এনেছিলেন যদিও মুমিনদের একদল তা পছন্দ করে নি। সত্য স্পষ্ট করে দেওয়ার পরও তারা তোমার সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত হয়েছিল, (তাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল) তারা যেন চেয়ে চেয়ে দেখছিল যে, তাদেরকে মৃত্যুর দিকে তাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে”।
মুজাহিদ রহ. বলেন, হক বিষয়ে যুদ্ধ করতে তারা তোমার সাথে বিবাদ করে।
ইবন জারির বলেন, অন্যান্যরা বলেছেন, এ দ্বারা উদ্দেশ্য মুশরিকরা। তারপর ইবন যায়েদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এ সব মুশরিক হকের বিষয়ে রাসূলের সাথে বিবাদে লিপ্ত হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বাণী,  وَتَوَدُّونَ أَنَّ غَيۡرَ ذَاتِ ٱلشَّوۡكَةِ تَكُونُ لَكُمۡএর অর্থ তারা পছন্দ করে যে দলটির কোনো শক্তি নেই এবং যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই সে দলটি যেন তাদের মুখোমুখি হয়। অর্থাৎ বাণিজ্যিক কাফেলা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَيُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُحِقَّ الْحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ “আর আল্লাহ্ চেয়েছিলেন তাঁর বাণী দ্বারা সত্যকে সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে” অর্থাৎ তিনি তোমাদেরকে এবং অস্ত্র-শস্ত্রে বলিয়ান দলকে একত্রিত করার ইচ্ছা করেন যাতে করে তিনি তাদের ওপর তোমাদেরকে বিজয় দান করেন তাদের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে সাহায্য করেন, তাঁর দীনকে বিজয়ী করেন, ইসলামের বাণীকে উর্ধ্বে তুলে ধরেন এবং সকল দীনের ওপরে তাঁর দীনকে বিজয়ী করেন। তিনি সকল বিষয়ের পরিণতি সম্পর্কে অবগত আছেন, তিনি তোমাদেরকে সুন্দররূপে পরিচালিত করেন, যদিও বান্দারা এর বিপরীত বিষয়কে পছন্দ করে, যা তাদের নিকট বাহ্যত প্রতিভাত হয়। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلۡقِتَالُ وَهُوَ كُرۡهٞ لَّكُمۡۖ وَعَسَىٰٓ أَن تَكۡرَهُواْ شَيۡ‍ٔٗا وَهُوَ خَيۡرٞ لَّكُمۡۖ وَعَسَىٰٓ أَن تُحِبُّواْ شَيۡ‍ٔٗا وَهُوَ شَرّٞ لَّكُمۡۚ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ وَأَنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ ٢١٦﴾ [البقرة: ٢١٦]  “তোমাদের প্রতি যুদ্ধের বিধান দেওয়া হয়েছে অথচ তা তোমাদের কাছে অপ্রিয়, কিন্তু তোমরা কোনো কিছু অপছন্দ কর সম্ভবত তোমাদের জন্য তা কল্যাণকর এবং সম্ভবত কোনো কিছু তোমাদের কাছে প্রিয় অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১৬]
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক রহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন জানতে পারেন যে, আবু সুফিয়ান মক্কার উদ্দেশ্যে সিরিয়া ত্যাগ করেছে তখন তিনি মুসলিমগণকে উৎসাহিত করেন মাঝপথে তাদের পাকড়াও করতে। তিনি বলেন, এ হচ্ছে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা এতে তাদের মালামাল রয়েছে, তাদেরকে ধরার জন্য বের হও, হতে পারে আল্লাহ তা‘আলা এ থেকে তোমাদেরকে গনীমত প্রদান করবেন। লোকেরা তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়, কেউ কেউ বিষয়টিকে হালকা মনে করে আবার কারও কারও কাছে তা ভারি মনে হয়, কেননা তারা ভাবেন নি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যুদ্ধ করতে হবে। আবু সুফিয়ান যখন হিজাযের নিকটবর্তী হয় তখন সে সতর্কতার সাথে অগ্রসর হয় আর এবং গোপনসূত্রে সংবাদ সংগ্রহ করে। সে তার বাণিজ্য কাফেলার ক্ষতির ভয়ে পথিমধ্যে যার সাথে সাক্ষাত হয় তাকেই জিজ্ঞেস করে, অবশেষে কতিপয় কাফেলার নিকট সংবাদ পায় মুহাম্মাদ তোমাকে এবং তোমার বাণিজ্য কাফেলাকে ধরার জন্য তাঁর সহচরবৃন্দকে সমবেত করেছে। সে সময় সে ভীত হয়ে দমদম ইবন আমর আল-গিফারীকে ভাড়া করে মক্কায় প্রেরণ করে যাতে করে সে বাণিজ্য কাফেলাকে রক্ষার জন্য কুরাইশদের সমবেত করে আর তাদেরকে যেন অবহিত করে যে, মুহাম্মাদ বাণিজ্য কাফেলাকে ধরার জন্য তার সহচরবৃন্দকে সমবেত করেছে। দমদম ইবন আমর দ্রুত মক্কায় গমন করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে নিয়ে বের হন, এমনকি তারা যারফান নামক উপত্যকায় এসে পৌঁছেন, এরপর তিনি সেখান থেকে বের হয়ে যান তবে এর কিছু অবশিষ্ট থাকতে তিনি সেখানে নেমে পড়েন (শিবির স্থাপন করেন) এ সময় তাঁর নিকট সংবাদ আসে যে, কুরাইশরা তাদের বাণিজ্য কাফেলাকে রক্ষা করার জন্য বের হয়ে পড়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণের নিকট পরামর্শ চান আর তাদেরকে কুরাইশাদের সম্পর্কে অবহিত করেন, তখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু দাঁড়িয়ে ভালো কিছু পরামর্শ দেন, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুও অনুরূপ বলেন, এরপর মিকদাদ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু উঠে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তার জন্য অগ্রসর হোন, আমরা আপনার সাথে আছি, আল্লাহর শপথ, আমরা আপনাকে এমন কথা বলব না যা বনী ইসরাঈল মূসা আলাইহিস সালামকে বলেছিল: ‘তুমি আর তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর, আমরা এখানে বসে রইলাম’ বরং (বলব) আপনি আর আপনার রব গিয়ে যুদ্ধ করুন আমারও আপনাদের সাথে থেকে যুদ্ধ করব। যিনি আপনাকে সত্য নবী করে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদেরকে নিয়ে বিরকুল গিমাদ অর্থাৎ হাবাশার (ইথিওপিয়ার) উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন তবুও আমরা আপনার সাথে থেকে যুদ্ধ করব যে পর্যন্ত আমরা সেখানে গিয়ে পৌঁছি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ভালো কিছু বলেন আর তার জন্য মঙ্গলের দো‘আ করেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘হে লোক সকল! তোমাদের মতামত ব্যক্ত কর’ এ থেকে তিনি আনসারদের প্রতি ইঙ্গিত করেন, কেননা সে সময় অধিকাংশ লোক ছিল তাদের থেকে, কেননা তারা যখন আক্বাবায় তাঁকে অঙ্গিকার দিয়েছিল, তারা বলেছিল: হে আল্লাহর রাসূল, আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে নিরাপত্তা দিব না যতক্ষণ না আপনি আমাদের অঞ্চলে আসেন, যখন আপনি আমাদের অঞ্চলে আসবেন তখন কেবল আমরা আপনাকে নিরাপত্তা দিব, আপনাকে আমরা সে সব বিষয় থেকে নিরাপত্তা দিব যেসব বিষয়ে আমরা আমাদের বাপ-দাদা এবং সন্তানাদিকে নিরাপত্তা দিয়ে থাকি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশঙ্কা করেন যে, আনসারগণ হয়ত ভাবতে পারে যে, মদীনায় যারা তাঁকে আক্রমণ করে তাদেরকে প্রতিহত করা ছাড়া তাদের জন্য তাঁকে সমর্থন করা আবশ্যক নয়। অন্য এলাকায় শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য তারা তাঁর সাথে যাবে না; কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন একথা বলেন তখন সা‘দ ইবন মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁকে বলেন, আল্লাহর শপথ, আপনি যাদেরকে ইঙ্গিত করেছেন তারা আমরা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হাঁ, তখন তিনি (সা‘দ) বলেন, আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি, আপনাকে বিশ্বাস করেছি, আর এ সাক্ষ্যও দিয়েছি যে, আপনি যা নিয়ে এসেছেন তা সত্য, আর এ ব্যাপারে আমরা আপনাকে আমাদের অঙ্গিকার প্রদান করেছি যে, আর আপনার সাথে ওয়াদা করেছি যে, আপনার কথা শুনব এবং আপনার আনুগত্য করব, হে আল্লাহর রাসূল আপনাকে আল্লাহ তা‘আলা যে নির্দেশ দিয়েছেন তা পালনে চলুন, তাঁর শপথ যিনি আপনাকে সত্য নবী করে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি এ সমুদ্র (লোহিত সাগর) পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তবে এ ক্ষেত্রে আমরা আপনার অনুসরণ করব, আমাদের কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না, আর আগামীকাল আমরা আমাদের শত্রুদের মুখোমুখি হতেও ভয় করি না, যুদ্ধের ময়দানে আমরা ধৈর্যশীল, লড়াই আমরা দুর্ধর্ষ, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের থেকে আপনাকে এমন কিছু দেখাবেন যাতে আপনার চক্ষু জুড়িয়ে যায়। আল্লাহর বরকতের সাথে আমাদেরকে নিয়ে চলুন, সা‘দের কথায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশি হন আর সেটা তাঁর উদ্যম সৃষ্টি করে। এরপর তিনি বলেন, আল্লাহর বরকতের সাথে তোমরা অগ্রসর হও, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এ দু’টি দলের একটির সুসংবাদ দিয়েছেন, আল্লাহর শপথ, যেন আমি কাওমের (কুরাইশের) ধ্বংস প্রত্যক্ষ করছি।
আউফী আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। অনুরূপ বলেছেন সুদ্দী, কাতাদা, আব্দুর রহমান ইবন যায়েদ ইবন আসলাম রহ. সহ আগের পরের অনেক আলেম। আমরা মুহাম্মাদ ইবন ইসহাকের বর্ণনার দ্বারা তাদের কথাগুলো সংক্ষিপ্ত করা যথেষ্ট মনে করলাম।
﴿إِذۡ تَسۡتَغِيثُونَ رَبَّكُمۡ فَٱسۡتَجَابَ لَكُمۡ أَنِّي مُمِدُّكُم بِأَلۡفٖ مِّنَ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ مُرۡدِفِينَ ٩ وَمَا جَعَلَهُ ٱللَّهُ إِلَّا بُشۡرَىٰ وَلِتَطۡمَئِنَّ بِهِۦ قُلُوبُكُمۡۚ وَمَا ٱلنَّصۡرُ إِلَّا مِنۡ عِندِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ١٠﴾ [الانفال: ٩، ١٠]
অর্থানুবাদ:
“স্মরণ কর, যখন তোমরা তোমাদের রবের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছিলে তখন তিনি তোমাদেরকে জবাব দিলেন, ‘আমি তোমাদেরকে এক হাজার ফিরিশতা দিয়ে সাহায্য করব যারা পর পর আসবে।’ আর আল্লাহ যে এটি করেছিলেন তার উদ্দেশ্য তোমাদেরকে সুসংবাদ দান ছাড়া অন্য কিছু নয় আর যাতে এর মাধ্যমে তোমাদের চিত্ত প্রশান্তি ঘটে। কেননা সাহায্য তো একমাত্র আল্লাহর নিকট থেকেই আসে। আল্লাহ তো মহাপরাক্রমশালী, মহাবিজ্ঞানী”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৯-১০]
তাফসীর:
ইমাম আহমদ রহ. উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, বদরের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথীদের দিকে তাকিয়ে দেখেন তাদের সংখ্যা মাত্র তিনশত ও সামান্য; পক্ষান্তরে কাফেরদের দিকে দেখেন তাদের সংখ্যা তাদের এক হাজারের বেশি। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চাদর ও পরিধেয় পরিহিত অবস্থায় কিবলামুখী হন এবং বলেন: হে আল্লাহ তুমি যা ওয়াদা করেছ তা কোথায়? তারপর তিনি বলেন,«اللَّهُمَّ أَنْجِزْ لِي مَا وَعَدْتَنِي، اللَّهُمَّ إِنْ تُهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةَ مِنْ أَهْلِ الْإِسْلَامِ فَلَا تُعْبَدْ فِي الْأَرْضِ أَبَدًا» “হে আল্লাহ! তুমি আমাকে যে ওয়াদা দিয়েছিলে তা বাস্তবায়ন কর। হে আল্লাহ! যদি তুমি আহলে ইসলামের এ ছোট জামা‘আত ধ্বংস করে দাও, তবে জমিনে কখনোই তোমার গোলামী করার মতো কেউ থাকবে না”। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন, তাকে ডাকছিলেন। ফলে তাঁর তার চাদর তাঁর শরীর থেকে নিচে পড়ে গেল। এ মুহুর্তে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এসে তাঁর চাদরকে তাঁর শরীরে ফিরিয়ে দিলেন এবং পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আপনার রবের নিকট যেভাবে চেয়েছেন তাই আপনার জন্য যথেষ্ট। তিনি আপনাকে যে ওয়াদা দিয়েছেন তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করবেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত إِذۡ تَسۡتَغِيثُونَ رَبَّكُمۡ فَٱسۡتَجَابَ لَكُمۡ أَنِّي مُمِدُّكُم بِأَلۡفٖ مِّنَ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ مُرۡدِفِينَ “স্মরণ কর, যখন তোমরা তোমাদের রবের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছিলে তখন তিনি তোমাদেরকে জবাব দিলেন” নাযিল করেন। তারপর যখন যুদ্ধ সংঘটিত হলো, আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের পরাজিত করেন, তাদের সত্তর জন নিহত হয় এবং সত্তরজন বন্দী হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বন্দীদের বিষয়ে আবু বকর, উমার ও আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমদের নিকট পরামর্শ চান। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, এরা সবাই চাচাতো ভাই, স্বগোত্রীয় ভাই। আমার মতামত হলো, তাদের থেকে ফিদইয়া নেওয়া হোক। আমরা তাদের থেকে যা নিলাম তা আমাদের জন্য কাফেরদের বিপক্ষে শক্তিতে পরিণত হবে। আর হতে পারে আল্লাহ তাদের হিদায়াত দেবেন, তাতে তারা আমাদের শক্তি হবে। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে ইবনুল খাত্তাব তোমার মতামত কী? তিনি বললেন, আমি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মতামতের সাথে একমত নই। আমার মতামত হলো, আমাকে আমার অমুক আত্মীয় বিষয়ে অনুমতি দেবেন আমি নিজ হাতে তাকে হত্যা করব। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আকীলকে হত্যা করবে এবং হামযা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার ভাইকে হত্যা করবে। যাতে আল্লাহ তা‘আলা জানেন যে, আমাদের অন্তরে মুশরিকদের প্রতি কোনো দুর্বলতা নেই। এরা সবাই মুশরিকদের সর্দার, তাদের ইমাম ও তাদের নেতা। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর মতামতের দিকে ঝুঁকেন এবং আমার মতামতকে গ্রহণ করেন নি। তাই তাদের থেকে তিনি ফিদইয়া গ্রহণ করেন। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, পরবর্তী দিন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর নিকট গমন করলে তাদের দেখতে পাই, তারা দুইজন কাঁদছে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল কোনো জিনিসটি আপনাকে এবং আপনার সাথীকে কাঁদতে বাধ্য করল? যদি কাঁদার বিষয় হয়, তবে আমিও কাঁদবো আর যদি তা কাঁদার বিষয় না হয় তবে আমি কাঁদার ভান করব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, «لِلَّذِي عرض عليَّ أصحابك من أخذهم الفداء، لقد عُرِضَ عليَّ عَذَابُكُمْ أَدْنَى مِنْ هَذِهِ الشَّجَرَةِ» “তোমার সাথীরা আমাকে তাদের ফিদিয়া গ্রহণের প্রস্তাব পেশ করার কারণে তোমাদের শাস্তি আমার নিকট পেশ করা হয়েছে যা এ গাছেরও নিকটে এসে গেছে”। গাছটি রাসূলুল্লার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুব কাছেই ছিল। আর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত ﴿مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَن يَكُونَ لَهُۥٓ أَسۡرَىٰ حَتَّىٰ يُثۡخِنَ فِي ٱلۡأَرۡضِۚ ٦٧﴾ [الانفال: ٦٧] “কোনো নবীর জন্য সঙ্গত নয় যে, তার নিকট যুদ্ধবন্দী থাকবে (এবং পণের বিনিময়ে তিনি তাদেরকে মুক্ত করবেন) যতক্ষণ না তিনি জমিনে (তাদের) রক্ত প্রবাহিত করেন”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৬৭] থেকে নিয়ে ﴿فَكُلُواْ مِمَّا غَنِمۡتُمۡ حَلَٰلٗا طَيِّبٗاۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٦٩﴾ [الانفال: ٦٩] “অতএব, তোমরা যে গনীমত পেয়েছ, তা থেকে হালাল পবিত্র হিসেবে খাও, আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৬৯] পর্যন্ত নাযিল করেন।  আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য গনীমতকে হালাল করেন। পরবর্তী বছর ওহুদের যুদ্ধে এ কর্ম অর্থাৎ ফিদইয়া গ্রহন করার ফলাফল হিসেবে মুসলিমরা শাস্তি ভোগ করেন। তাদের সত্তরজন শহীদ হয়, সাহাবীগণ রাসূলকে ছেড়ে পলায়ন করে, তাঁর দাঁত ভেঙ্গে যায়, তাঁর মাথায় বল্লমের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়, তাঁর চেহারা থেকে রক্ত প্রবাহিত হয়। তারপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত﴿أَوَلَمَّآ أَصَٰبَتۡكُم مُّصِيبَةٞ قَدۡ أَصَبۡتُم مِّثۡلَيۡهَا قُلۡتُمۡ أَنَّىٰ هَٰذَاۖ قُلۡ هُوَ مِنۡ عِندِ أَنفُسِكُمۡۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ١٦٥﴾ [ال عمران: ١٦٥] “আর যখন তোমাদের ওপর বিপদ এল, (অথচ) তোমরা তো এর দ্বিগুণ বিপদে আক্রান্ত হলে (বদর যুদ্ধে)। তোমরা বলেছিলে এটি কোত্থেকে? বল, ‘তা তোমাদের নিজদের থেকে’। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান”। [সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১৬৫] নাযিল করেন। তোমাদের ফিদইয়া গ্রহণ করার কারণে”।
মুসলিমবৃন্দের সাহায্য প্রার্থনা এবং ফিরিশতা পাঠিয়ে তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার সাড়া প্রদান:
ইমাম বুখারী রহ. আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের দিন বলেন, «اللَّهُمَّ أَنْشُدُكَ عَهْدَكَ وَوَعْدَكَ، اللَّهُمَّ إِنْ شِئْتَ لَمْ تُعْبَدْ» “হে আল্লাহ, আমি আপনার কৃত অঙ্গিকারের জন্য আপনার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছি, হে আল্লাহ আপনি যদি চান যে আপনার ইবাদাত করা হবে না”। (এমন সময়) আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাত ধরে বলেন, আপনার জন্য যথেষ্ট হয়েছে, এমন সময় তিনি বলতে বলতে বের হন: «سَيُهْزَمُ الجمع وَيُوَلُّونَ الدبر» “জামা‘আত (মুশরিকরা) পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করবে”।
আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী: بِأَلْفٍ مِنَ الْمَلائِكَةِ مُرْدِفِينَ “এক হাজার ফিরিশতা দিয়ে সাহায্য করব -যারা পর পর আসবে” অর্থাৎ একের পর এক আসবে, যেমন হারুন ইবন হুবাইরাহ আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন, مُرْدِفِينَ অর্থাৎ যারা পর পর আসবে। এ অর্থ হওয়ারও সম্ভাবনা আছে مُرْدِفِينَ অর্থাৎ তোমাদের সাহায্যার্থে। যেমনটি আউফী ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন। মুজাহিদ, ইবন কাসীর ও ইবন যায়েদ আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করে বলেন, তিনি বলেন, مُرْدِفِينَ অর্থাৎ সাহায্য, যেমন তুমি লোককে বল, তুমি তাকে এমন এমন বাড়িয়ে দাও। ইবন জারির রহ. বলেন, রাসূলের ডানে যাতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ছিলেন, জিবরীল আলাহিস সালাম এক হাজার ফিরিশতা নিয়ে অবতরণ করেন। আর রাসূলের বামে মিকাইল ফিরিশতা এক হাজার ফিরিশতার মধ্যে অবতরণ করেন। যদি সনদটি শুদ্ধ হয়, তার অর্থ এক হাজারের পিছনে আরো এক হাজার অবতরণ করেন। এ কারণেই অনেকে مُرْدِفِينَ কে দাল-এর উপর যবরের সাথে পড়েছেন। প্রসিদ্ধ হলো যা আলী ইবন আবু তালহা বর্ণনা করেন: আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুমিনগণকে এক হাজার ফিরিশতা পাঠিয়ে সাহায্য করেন, একদিকে তিনি জিবরীল আলাইহিস সালামের নেতৃত্বে পাঁচশত ফিরিশতা পাঠান, অপর দিকে মিকাঈল আলাইহিস সালামের নেতৃত্বে পাঠান পাঁচশত ফিরিশতা। ইমাম আবু জাফর ইবন জারীর এবং ইমাম মুসলিম রহ. আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা এবং উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাতে রয়েছে: জনৈক মুসলিম তার সম্মুখে এক মুশরিকের পশ্চাদ্ধাবন করেন হঠাৎ তিনি উপরে বেত্রাঘাত এবং অশ্বারোহীর শব্দ শুনতে পান সে বলছে: এস, হে হাইযূম। তিনি হঠাৎ মুশরিকটির দিকে তাকিয়ে দেখেন সে জমিনে পড়ে আছে, তিনি তার দিকে তাকিয়ে দেখেন তার নাক কেটে গেছে আর তার চেহার বিদীর্ণ হয়েছে, যেন সে এতে ছড়ির আঘাত পেয়েছে আর তার চেহারা সম্পূর্ণরূপে সবুজ হয়ে গেছে, আনসারী ব্যক্তিটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে এ কথা জানালে তিনি বলেন, তুমি সত্য বলেছ, সেটা ছিল তৃতীয় আসমানের সাহায্য। সেদিন সত্তরজন নিহত হয় আর বন্দী হয় সত্তরজন। ইমাম বুখারী রহ. বলেন, “পরিচ্ছেদ: বদরে ফিরিশতাদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে”। এরপর রিফা‘আহ ইবন রাফি‘ আয-যুরাক্বী রহ. বর্ণনা করেন, তিনি ছিলেন বদরী সাহাবী, তিনি বলেন, জিবরীল আলাইহিস সালাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলেন, যারা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে তাদের সম্মান কিরূপ, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «مِنْ أَفْضَلِ الْمُسْلِمِينَ» ‘তারা হচ্ছে সর্বোত্তম মুসলিম’ অথবা এ জাতীয় কোনো কথা বলেন। তিনি বলেন, অনুরূপ সম্মান সে সমস্ত ফিরিশতাদের যারা বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। ইমাম বুখারী এককভাবে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ত্বাবরানী মু‘জামুল কাবীরে রাফি‘ ইবন খাদীজ থেকে যে হাদীস বর্ণনা করেছেন তা ভুল, বিশুদ্ধ হচ্ছে বুখারীর বর্ণনা। আল্লাহ ভালো জানেন। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমারকে বলেন যখন তিনি হাতিব ইবন আবু বালতা‘আকে হত্যা করার পরামর্শ দেন: «إِنَّهُ قَدْ شَهِدَ بَدْرًا وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّ اللَّهَ قَدِ اطَّلَعَ عَلَى أَهْلِ بَدْرٍ فَقَالَ اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ فَقَدْ غفرت لكم؟» “সে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে, আর তুমি কি জান না, আল্লাহ তা‘আলা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি তাকিয়ে বলেন, তোমাদের যা খুশি কর, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি”।  
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَمَا جَعَلَهُ اللَّهُ إِلَّا بُشْرَى “আর আল্লাহ যে এটি করেছিলেন তার উদ্দেশ্য তোমাদেরকে সুসংবাদ দান ছাড়া অন্য কিছু নয়” অর্থাৎ ফিরিশতামণ্ডলীকে প্রেরণ এবং এ বিষয়টি সম্পর্কে তোমাদেরকে অবহিতকরণকে করেছেন তোমাদের জন্য সু-সংবাদস্বরূপ।
وَلِتَطْمَئِنَّ بِهِ قُلُوبُكُم “আর যাতে এর মাধ্যমে তোমাদের চিত্ত প্রশান্তি ঘটে” নয়ত আল্লাহ তা‘আলা এটি ছাড়াই তোমাদের শত্রুদের ওপরে তোমাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَا النَّصْرُ إِلا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ “সাহায্য তো একমাত্র আল্লাহর নিকট থেকেই আসে” যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿فَإِذَا لَقِيتُمُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَضَرۡبَ ٱلرِّقَابِ حَتَّىٰٓ إِذَآ أَثۡخَنتُمُوهُمۡ فَشُدُّواْ ٱلۡوَثَاقَ فَإِمَّا مَنَّۢا بَعۡدُ وَإِمَّا فِدَآءً حَتَّىٰ تَضَعَ ٱلۡحَرۡبُ أَوۡزَارَهَاۚ ذَٰلِكَۖ وَلَوۡ يَشَآءُ ٱللَّهُ لَٱنتَصَرَ مِنۡهُمۡ وَلَٰكِن لِّيَبۡلُوَاْ بَعۡضَكُم بِبَعۡضٖۗ وَٱلَّذِينَ قُتِلُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَلَن يُضِلَّ أَعۡمَٰلَهُمۡ ٤ سَيَهۡدِيهِمۡ وَيُصۡلِحُ بَالَهُمۡ ٥ وَيُدۡخِلُهُمُ ٱلۡجَنَّةَ عَرَّفَهَا لَهُمۡ ٦﴾ [محمد : ٤، ٦]  “অতঃপর যখন তোমরা কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের ঘাড়ে আঘাত হানো, অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাস্ত কর, তখন তাদেরকে শক্তভাবে বেঁধে ফেল। অতঃপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, না হয় তাদের থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ কর। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, যে পর্যন্ত না শত্রুপক্ষ অস্ত্র সমর্পণ করে। এ নির্দেশই তোমাদেরকে দেওয়া হলো। আল্লাহ্ ইচ্ছে করলে (নিজেই) তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের একজনকে অন্যের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান (এজন্য তোমাদেরকে যুদ্ধ করার সুযোগ দেন)। যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয় তিনি তাদের কর্মফল কক্ষনো বিনষ্ট করবেন না। তিনি তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন আর তাদের অবস্থা ভালো করে দেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন যা তাদেরকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন”। [সূরা মুহাম্মদ, আয়াত: ৪-৬] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿وَتِلۡكَ ٱلۡأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيۡنَ ٱلنَّاسِ وَلِيَعۡلَمَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَيَتَّخِذَ مِنكُمۡ شُهَدَآءَۗ وَٱللَّهُ لَا يُحِبُّ ٱلظَّٰلِمِينَ ١٤٠ وَلِيُمَحِّصَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَيَمۡحَقَ ٱلۡكَٰفِرِينَ ١٤١﴾ [ال عمران: ١٤٠، ١٤١] (জয়-পরাজয়ের) “এ দিনগুলোকে আমরা মানুষের মধ্যে আবর্তিত করে থাকি যাতে আল্লাহ মুমিনদেরকে চিনে নিতে পারেন এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে কাউকে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন, বস্তুত আল্লাহ যালিমদেরকে ভালোবাসেন না এবং (এ জন্যেও) যেন আল্লাহ মুমিনদেরকে সংশোধন করেন ও কাফেরদের নিশ্চিহ্ন করেন”। [সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১৪০-১৪১] এ হচ্ছে প্রজ্ঞা যার জন্য আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণের হাতের মাধ্যমে কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদের আইন প্রদান করেছেন। অন্যথায় আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের জাতিসমূহকে তাদের নবীগণকে অস্বীকার করার কারণে বিভিন্ন ধরণের বিপর্যয় দিয়ে শাস্তি দিয়েছিলেন যা সেই মিথ্যা সাব্যস্তকারী জাতিসমূহকে ঘিরে ধরেছিল। যেমন, তিনি নূহ আলাইহিস সালামের জাতিকে তুফান দ্বারা ধ্বংস করেছিলেন, আদকে বায়ু দ্বারা, সামূদকে প্রচণ্ড আওয়াজ দ্বারা, লূত আলাইহিস সালামের জাতিকে ভুমিধস, উল্টে দেওয়া ও সিজ্জীলের পাথর দ্বারা, শু‘আইব আলাইহিস সালামের কাওমকে ছায়ার দিবসের দ্বারা। এরপর যখন আল্লাহ তা‘আলা মূসা আলাইহিস সালামকে প্রেরণ করেন, তখন তিনি তার শত্রু ফির‘আউন এবং তার জাতিকে সাগরে ডুবিয়ে ধ্বংস করেন এরপর তিনি মূসা আলাইহিস সালামের ওপরে তাওরাত অবতীর্ণ করেন, সেখানে তিনি কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার বিধান আরোপ করেন। এ বিধান তার পরে পরবর্তী শরী‘আতসমূহে টিকে থাকে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿وَلَقَدۡ ءَاتَيۡنَا مُوسَى ٱلۡكِتَٰبَ مِنۢ بَعۡدِ مَآ أَهۡلَكۡنَا ٱلۡقُرُونَ ٱلۡأُولَىٰ بَصَآئِرَ لِلنَّاسِ ٤٣﴾ [القصص: ٤٣] “আমি পূর্ববর্তী অনেক মানব গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার পর মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৪৩] মুমিনগণের কাফেরদেকে হত্যা করা, কাফেরদের জন্য চরম অপমানজনক। এতে মুমিনগণের আত্মা ঠাণ্ডা হয়। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা নিন্মোক্ত আয়াতে মুমিনগণের জন্য বলেন, قَاتِلُوهُمْ يُعَذِّبْهُمُ اللهُ بِأَيْدِيكُمْ وَيُخْزِهِمْ وَيَنْصُرُكُمْ عَلَيْهِمْ وَيَشْفِ صُدُورَ قَوْمٍ مُؤْمِنِينَ [التوبة: ١٤] “তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর, তোমাদের হাত দিয়েই আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন, তাদেরকে অপমানিত করবেন, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে সাহায্য করবেন আর মুমিনদের অন্তর ঠাণ্ডা করবেন”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১৪] এ কারণে কুরাইশ কাফেরদের তুচ্ছজ্ঞান করা শত্রুদের হাতে নিহত হওয়া ছিল তাদের জন্য বেশি অপমানজনক আর বিশ্বাসী দলের অন্তরের জন্য ছিল শীতলকারী। যেমন, আবু জাহল যুদ্ধের ময়দানে নিহত হয় আর এটি ছিল তার জন্য তার বিছানায় মৃত্যুর চেয়ে অধিক অপমানজনক। আলো, বাতাস অথবা এ জাতীয় কষ্টক্লেশ থেকে। যেমন, আবু লাহাব (তার ওপর আল্লাহ তা‘আলার অভিশাপ) গুটিবসন্তে মারা যায়, তার নিকট আত্মীয়দের কেউ আসে নি, দুরে থেকে পানি নিক্ষেপ করে তারা তাকে গোসল দিয়েছিল, আর পাথর নিক্ষেপ করে তারা তাকে দাফন করেছিল। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ “আল্লাহ তো মহাপরাক্রমশালী” অর্থাৎ সম্মান আল্লাহ তা‘আলার, তাঁর রাসূলের এবং মুমিনগণের দুনিয়া এবং আখিরাত উভয় জগতে। যেমন, তিনি বলেন, ﴿إِنَّا لَنَنصُرُ رُسُلَنَا وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَيَوۡمَ يَقُومُ ٱلۡأَشۡهَٰدُ ٥١﴾ [غافر: ٥١] “আমি আমার রসূলদেরকে আর মুমিনদেরকে অবশ্যই সাহায্য করব দুনিয়ার জীবনে আর (কিয়ামতে) যে দিন সাক্ষীরা দাঁড়াবে”। [সূরা আল-গাফির, আয়াত: ৫১] حَكِيم “মহাবিজ্ঞানী” কাফেরদের হত্যার যে বিধান তিনি দিয়েছেন তাতে, অথচ তিনি আপন শক্তি ও ক্ষমতায় তাদেরকে ধ্বংস করে দিতে পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী।
﴿إِذۡ يُغَشِّيكُمُ ٱلنُّعَاسَ أَمَنَةٗ مِّنۡهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيۡكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ لِّيُطَهِّرَكُم بِهِۦ وَيُذۡهِبَ عَنكُمۡ رِجۡزَ ٱلشَّيۡطَٰنِ وَلِيَرۡبِطَ عَلَىٰ قُلُوبِكُمۡ وَيُثَبِّتَ بِهِ ٱلۡأَقۡدَامَ ١١ إِذۡ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ أَنِّي مَعَكُمۡ فَثَبِّتُواْ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْۚ سَأُلۡقِي فِي قُلُوبِ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ ٱلرُّعۡبَ فَٱضۡرِبُواْ فَوۡقَ ٱلۡأَعۡنَاقِ وَٱضۡرِبُواْ مِنۡهُمۡ كُلَّ بَنَانٖ ١٢ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ شَآقُّواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥۚ وَمَن يُشَاقِقِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَإِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ١٣ ذَٰلِكُمۡ فَذُوقُوهُ وَأَنَّ لِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابَ ٱلنَّارِ ١٤﴾ [الانفال: ١١، ١٤]
অর্থানুবাদ:
“স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তাঁর নিকট হতে প্রশান্তি ধারা হিসেবে তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেছিলেন, আকাশ থেকে তোমাদের উপর বৃষ্টিধারা বর্ষণ করেছিলেন তোমাদেরকে তা দিয়ে পবিত্র করার জন্য। তোমাদের থেকে শায়ত্বানী পংকিলতা দূর করার জন্য, তোমাদের দিলকে মজবুত করার জন্য আর তা দিয়ে তোমাদের পায়ের ভিত শক্ত করার জন্য। স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফিরিশতাদের প্রতি অহী পাঠিয়েছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গেই আছি; অতএব, মুমিনদেরকে তোমরা দৃঢ়পদ রেখ’। অচিরেই আমি কাফেরদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করব, কাজেই তাদের স্কন্ধে আঘাত হান, আঘাত হান প্রত্যেকটি আঙ্গুলের গিঁটে গিঁটে। এর কারণ, তারা আল্লাহ ও রাসূলের বিরোধিতা করে আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করবে (তাদের জেনে রাখা দরকার) আল্লাহ শাস্তিদানে বড়ই কঠোর। এটিই তোমাদের শাস্তি, অতএব তার স্বাদ গ্রহণ কর, কাফেরদের জন্য আছে আগুনের (জাহান্নামের) শাস্তি।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১১-১৪]
তাফসীর:
মুসলিমগণের ওপরে তন্দ্রা প্রবল হয়:
আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমগণকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি তাদের প্রতি তন্দ্রা প্রেরণ করেন তাদেরকে ভয়ভীতি থেকে নিরাপত্তা দিতে যা তাদেরকে পেয়ে বসেছিল। কেননা বদর যুদ্ধে তাদের শত্রুদের সংখ্যা ছিল বেশি আর তাদের সংখ্যা ছিল অল্প। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা উহুদ যুদ্ধে ঈমানদারদের সাথে করেছিলেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿ثُمَّ أَنزَلَ عَلَيۡكُم مِّنۢ بَعۡدِ ٱلۡغَمِّ أَمَنَةٗ نُّعَاسٗا يَغۡشَىٰ طَآئِفَةٗ مِّنكُمۡۖ وَطَآئِفَةٞ قَدۡ أَهَمَّتۡهُمۡ أَنفُسُهُمۡ يَظُنُّونَ بِٱللَّهِ غَيۡرَ ٱلۡحَقِّ ظَنَّ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِۖ ١٥٤﴾ [ال عمران: ١٥٤] “অতঃপর কষ্টের পর আল্লাহ তোমাদের প্রতি শান্তি-তন্দ্রা প্রেরণ করলেন, যা তোমাদের একদলকে আচ্ছন্ন করল এবং অন্যদল মূর্খের মতো আল্লাহর প্রতি কুধারণা পোষণ করত”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৪] আবু তালহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, উহুদের ময়দানে যাদেরকে তন্দ্রা পেয়েছিল আমিও তাদের অন্যতম ছিলাম। আমার হাত থেকে বহুবার তরবারী পড়ে গিয়েছিল, একবার পড়ে যাচ্ছিল আবার কুড়িয়ে নিচ্ছিলাম। আমি আমার সাথীদের দিকে তাকিয়ে দেখি তাদের মাথাগুলো ঝুঁকে পড়েছে, যেন তারা পেছনের প্রহরায় রয়েছে।
হাফিয আবু ইয়া‘লা বর্ণনা করেন আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, বদরের যুদ্ধে মিকদাদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ছাড়া আমাদের মাঝে আর কোনো অশ্বারোহী ছিল না, আমরা আমাদের নিজেদের মাঝে দেখেছি শুধু ঘুমন্তকে, তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া, তিনি বৃক্ষের তলদেশে সকাল পর্যন্ত সালাত আদায় করছিলেন আর কাঁদছিলেন।
আমি বলি: উহুদের ময়দানে মুসলিমগণকে তন্দ্রা পেয়ে বসেছিল আর এ বিষয়টি খুব প্রসিদ্ধ। আর এ আয়াতটি (অত্র সূরার ৮নং আয়াত) বদরের যুদ্ধের সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, বদর যুদ্ধেও মুসলিমগণকে তন্দ্রা পেয়েছিল। এ বিষয়টি মুসলিমের মাঝে সংঘটিত হয় যখন তাদের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়েছিল। যাতে করে আল্লাহর সাহায্যে তাদের অন্তরগুলো প্রশান্ত হয়। আর এটি তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ ও দয়া এবং তাদের ওপরে তাঁর নি‘আমত। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿فَإِنَّ مَعَ ٱلۡعُسۡرِ يُسۡرًا ٥ إِنَّ مَعَ ٱلۡعُسۡرِ يُسۡرٗا ٦﴾ [الشرح: ٥، ٦] “কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে, নিঃসন্দেহে কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে”। [সূরা আল-ইনশিরাহ, আয়াত: ৫-৬] এ কারণে বিশুদ্ধ হাদীসে এসেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর যুদ্ধে যখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাথে তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন, তারা উভয়ে দো‘আ করছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তন্দ্রা স্পর্শ করে এরপর তিনি হাস্যোজ্জল অবস্থায় ঘুম থেকে জেগে বলেন, «أَبْشِرْ يَا أَبَا بَكْرٍ هَذَا جِبْرِيلُ عَلَى ثَنَايَاهُ النَّقْعُ» “খুশি হও, হে আবু বকর, এ যে জিবরীল তার কাঁধের উপর ধুলা লেগে আছে”। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁবুর দরজা দিয়ে বের হন আর বলেন, ﴿سَيُهۡزَمُ ٱلۡجَمۡعُ وَيُوَلُّونَ ٱلدُّبُرَ ٤٥﴾ [القمر: ٤٥] “এ সংঘবদ্ধ দল শীঘ্রই পরাজিত হবে আর পিছন ফিরে পালাবে”। [সূরা আল-কামার, আয়াত: ৪৫]
বদরের রাতে বৃষ্টি বর্ষণ:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَيُنزلُ عَلَيْكُمْ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً “আকাশ থেকে তোমাদের ওপর বৃষ্টিধারা বর্ষণ করেছিলেন” আলী ইবন আবু তলহা বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বদরের ময়দানে আসেন, তিনি সেখানে শিবির স্থাপন করেন। মুশরিকদের মাঝে ও তাদের মাঝে ছিল বালু। মুশরিকরা পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেললে মুসলিমদের কষ্ট হতে থাকে। শয়তান মুসলিমদের অন্তরে ক্রোধ সৃষ্টি করে, তাদের মাঝে কুমন্ত্রণা দেয়। তোমরা মনে কর তোমরা আল্লাহর বন্ধু, তোমাদের মাঝে তাঁর রাসূল রয়েছেন, মুশরিকরা তোমাদের ওপর পানির দখল গ্রহণ করেছে। যখন তোমরা প্রবিত্রতার দো‘আ করছিলে। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করেন, মুসলিমগণ পানি পান করেন, পবিত্রত অর্জন করেন, আল্লাহ তা‘আলা তাদের থেকে শয়তানের অপবিত্রতা দূর করে দেন, বৃষ্টি হওয়ার ফলে বালু স্থির হয়, মুসলিমগণ এবং তাদের বাহনগুলো তার উপর দিয়ে হেঁটে যায় এরপর তারা তাদের শত্রুদের নিকট গিয়ে পৌঁছে। আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে এবং মুমিনদেরকে এক হাজার ফিরিশতা দিয়ে সাহায্য করেন। জিবরীল আলাইহিস সালাম পাঁচশত ফিরিশতা নিয়ে ডানে ছিলেন এবং মিকাঈল আলাইহিস সালাম অপর পাঁচশ নিয়ে বামে ছিলেন।
অনুরূপ আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, মুশরিকরা তাদের কাফেলাকে সাহায্য করতে এসে এবং তাদের পক্ষে যুদ্ধ করতে এসে এমন স্থানে অবস্থান নেয় যেখানে পানি ছিল। তারা মুমিনদের ওপর প্রাধান্য নিয়ে নিল। ফলে মুমিনদের কষ্ট হতে লাগল, তাদের পিপাসা পেল, তারা অপবিত্র অবস্থায় সালাত আদায় করা আরম্ভ করল। এ বিষয়টি মুসলিমগণের অন্তরে বিভিন্ন দুশ্চিন্তার উদ্রেক করছিল। মুসলিমগণ দুর্বলতা অনুভব করে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, যার ফলে পানিতে মাঠ ভরে যায়। তখন মুমিনরা পানি পান করল, তাদের বাহনদের পানি পান করালো, পবিত্রতার গোসল করল, তাদের পাত্রগুলো ভরে নিল— আল্লাহ তা‘আলা তাদের পবিত্রতার ব্যবস্থা করল। তাদের পদসমূহ দৃঢ় করল এবং তাদের মনোবল বাড়িয়ে দিল। অনুরূপ বর্ণনা কাদাদাহ, দাহ্হাক ও সূদ্দী রহ. থেকেও বর্ণিত
প্রসিদ্ধ কথা হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বদরে তিনি এমন স্থানে অবস্থান নিলেন যেখানে সামান্য পানি ছিল। অর্থাৎ প্রাথমিক পানি। তখন হুবাব ইবনুল মুনযির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু অগ্রসর হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! যে জায়গায় আপনি অবস্থান করেছেন তা কি আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন তাহলে এ স্থান অকিক্রম করব না, নাকি যুদ্ধ করার জন্য এ স্থান গ্রহণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, «بَلْ مَنْزِلٌ نَزَلْتُهُ لِلْحَرْبِ وَالْمَكِيدَةِ» “বরং যুদ্ধ করা ও ষড়যন্ত্রের জবাব দেওয়ার জন্য এখানে উপস্থিত হয়েছি”। তখন সে বলল, আল্লাহর রাসূল এটি ভালো কোনো জায়গা নয়। আপনি আমাদের নিয়ে পানির নিকট নিয়ে যান যা সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে মিলিত। আমরা তার পিছনে কুপ খনন করব, ফলে আমাদের পানি থাকবে, তাদের পানি থাকবে না। তার কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চললেন এবং তাই করলেন।
এ সম্পর্কে সবচেয়ে সুন্দর বর্ণনা দিয়ে হাদীস বর্ণনা করেছেন মাগাযীর গ্রন্থকার ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক ইবন ইয়াসার রহ.। তিনি বলেন, আমার নিকট বর্ণনা করেছেন ইয়াযীদ ইবন রুমান (তিনি) উরওয়া ইবন যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে, তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বালুময় উপত্যকায় আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, বৃষ্টি যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণ শিবির স্থাপন করেছিলেন সে স্থানটিকে মজবুত করে যাতে করে তাদের চলাফিরায় বিঘ্ন না ঘটে, আর কুরাইশদের স্থানটিকে এমন করে দেয় যাতে তাদের চলাফিরায় বিঘ্ন ঘটে।
মুজাহিদ রহ. বলেন, তন্দ্রার পুর্বেই আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন, বৃষ্টির ফলে বালু উড়া বন্ধ হয়, জমিন মজবুত হয়, তাদের অন্তর পরিতৃপ্ত হয় এবং তাদের পাগুলো দৃঢ় হয়।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: لِيُطَهِّرَكُمْ بِهِ “তোমাদেরকে তা দিয়ে পবিত্র করার জন্য” অর্থাৎ ছোট-বড় অপবিত্রতা থেকে আর তা বাহ্যিক দিককে পবিত্র করে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:وَيُذْهِبَ عَنْكُمْ رِجْزَ الشَّيْطَانِ “তোমাদের থেকে শয়তানী পংকিলতা দূর করার জন্য” অর্থাৎ কুমন্ত্রণা ও খারাপ চিন্তা থেকে আর তা হচ্ছে আভ্যন্তরীণ বিষয়ের পবিত্রতা। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতবাসীদের সম্পর্কে বলেন, ﴿عَٰلِيَهُمۡ ثِيَابُ سُندُسٍ خُضۡرٞ وَإِسۡتَبۡرَقٞۖ وَحُلُّوٓاْ أَسَاوِرَ مِن فِضَّةٖ ٢١﴾ [الانسان: ٢١] “তাদের আবরণ হবে চিকন সবুজ রেশম ও মোটা রেশম, আর তাদেরকে অলংকারে সজ্জিত করা হবে রুপার কঙ্কণ দ্বারা”। [সূরা আল-ইনসান, আয়াত: ২১] এটি হচ্ছে বাহ্যিক সৌন্দর্য, ﴿وَسَقَىٰهُمۡ رَبُّهُمۡ شَرَابٗا طَهُورًا ٢١﴾ [الانسان: ٢١] “আর তাদের রব্ব তাদেরকে পান করাবেন পবিত্র পরিচ্ছন্ন পানীয়” অর্থাৎ যা তাদের মধ্যে ক্রোধ, হিংসা ও ঘৃণা রয়েছে তা পবিত্র করে। আর তা হচ্ছে আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ও এর পবিত্রতা। [সূরা আল-ইনসান, আয়াত: ২১] وَلِيَرْبِطَ عَلَى قُلُوبِكُمْ “তোমাদের দিলকে মজবুত করার জন্য” ধৈর্যের সাথে আর তোমাদেরকে তোমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উৎসাহিত করে আর তা হচ্ছে আভ্যন্তরীণ সাহসিকতা। وَيُثَبِّتَ بِهِ الأقْدَامَ “আর তা দিয়ে তোমাদের পায়ের ভিত শক্ত করার জন্য” আর তা হচ্ছে বাহ্যিক সাহসিকতা। আল্লাহ ভালো জানেন।
ফিরিশতাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ:
ফিরিশতাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ তারা যেন, মুমিনগণের অন্তরগুলোকে দৃঢ় করে এবং তাদের সাথে থেকে যুদ্ধ করে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী: إِذْ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى الْمَلائِكَةِ أَنِّي مَعَكُمْ فَثَبِّتُوا الَّذِينَ آمَنُوا “স্মরণ কর যখন তোমার রব ফিরিশতাদের প্রতি অহী পাঠিয়েছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গেই আছি। অতএব, মুমিনদেরকে তোমরা দৃঢ়পদ রেখ”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১২] এটি হচ্ছে গোপন নি‘আমত যা আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য প্রকাশ করেছেন; যাতে করে তারা এ জন্য তাঁর শুকরিয়া আদায় করে- আল্লাহ মহান, পবিত্র, বরকতময় এবং মর্যাদাবান- তিনি তাঁর প্রেরিত ফিরিশতামণ্ডলীর প্রতি প্রত্যাদেশ করেন তাঁর নবী, তাঁর দীন এবং তাঁর বাহিনী মুসলিমগণকে সাহায্য করতে। ইবন জারির রহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘তিনি তাদের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন যা তাঁর এবং তাদের মাঝে রয়েছে সে ব্যাপারে তারা যেন মুমিনগণকে দৃঢ়পদ রাখে, তাদেরকে শত্রুদের বিরুদ্ধে শক্তির জোগান দেয়। আর আমি অবশ্যই যারা আমার দীন ও রাসূলকে অস্বীকার করে তাদের অন্তরে ভীতি সৃষ্টি করে দেব, তাদের অপমান ও লাঞ্চিত করব’।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী, سَأُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ “অচিরেই আমি কাফেরদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করব” অর্থাৎ তোমরা (হে ফিরিশতাগণ) মুমিনগণকে দৃঢ়পদে রাখ, আর তাদেরকে তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী কর আর এভাবে তোমাদের প্রতি আমার নির্দেশ কার্যে পরিণত কর, এর দ্বারা অচিরেই আমি আমার নির্দেশ অমান্যকারী এবং আমার রাসূলগণকে অস্বীকারকারীর ওপর আতঙ্ক, অপমান-অপদস্থতা চাপিয়ে দিব। فَاضْرِبُوا فَوْقَ الأعْنَاقِ وَاضْرِبُوا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ “কাজেই তাদের স্কন্ধে আঘাত হান, আঘাত হান প্রত্যেকটি আঙ্গুলের গিঁটে গিঁটে” অর্থাৎ তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে তাদের কপালে আঘাত কর, আর তাদেরকে কেটে ফেলতে তাদের গর্দানে মার, তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেল, তা হলো, হাত-পা।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: فَوْقَ الأعْنَاقِ “স্কন্ধে” এর ব্যাখ্যা একাধিক। মুফাসসিরগণ فَوْقَ الأعْنَاقِ এর অর্থ সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ কেউ এর ব্যাখ্যায় বলেন, তাদের মাথায় মার, এ মত দিয়েছেন ইকরামা।  কেউ কেউ বলেন, فَوْقَ الأعْنَاقِ এর অর্থ হচ্ছে তাদের গর্দানে মার অর্থাৎ তাদের কাঁধে আঘাত কর। দাহ্হাক এবং আতিইইয়াহ আল-আউফী রহ. এ মত ব্যক্ত করেছেন। এ অর্থের সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণকে যেটার দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন সে আয়াত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿فَإِذَا لَقِيتُمُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَضَرۡبَ ٱلرِّقَابِ حَتَّىٰٓ إِذَآ أَثۡخَنتُمُوهُمۡ فَشُدُّواْ ٱلۡوَثَاقَ ٤﴾ [محمد : ٤] “অতঃপর যখন তোমরা কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের ঘাড়ে আঘাত হানো, অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাস্ত কর, তখন তাদেরকে শক্তভাবে বেঁধে ফেল”। [সূরা মুহাম্মদ, আয়াত: ৪] ইবন জারির পছন্দ করেন যে, এ আয়াত স্কন্দে আঘাত হানাকে প্রমাণ করে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَاضْرِبُوا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ “আঘাত হান প্রত্যেকটি আঙ্গুলের গিঁটে গিঁটে”। ইবন জারীর রহ. বলেন, এর অর্থ হচ্ছে: হে মুমিনগণ তোমরা তোমাদের শত্রুদের সব জায়গায় এবং হাত-পার গ্রন্থিতে গ্রন্থিকে আঘাত কর بنان শব্দটি بنانة এর বহুবচন (অর্থাৎ আঙ্গুল)।
আউফী আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন: তিনি বদরের ঘটনা উল্লেখ করেন এমনকি তিনি বলেন, [তাদেরকে একেবারে হত্যা করো না; বরং তাদেরকে পাকড়াও কর যাতে করে তারা তোমাদের দীনের প্রতি আঘাত এনে আর লাত-ওজ্জা থেকে বিরাগ হয়ে কী করেছিল এ ব্যাপারটি তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে পার।] ফলে আল্লাহ তা‘আলা ফিরিশতাদের প্রতি এ বলে অহী প্রেরণ করেন: أَنِّي مَعَكُمْ فَثَبِّتُوا الَّذِينَ آمَنُوا سَأُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ فَاضْرِبُوا فَوْقَ الأعْنَاقِ وَاضْرِبُوا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ “আমি তোমাদের সঙ্গেই আছি। অতএব, মুমিনদেরকে তোমরা দৃঢ়পদ রেখ’। অচিরেই আমি কাফেরদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করব, কাজেই তাদের স্কন্ধে আঘাত হান, আঘাত হান প্রত্যেকটি আঙ্গুলের গিঁটে গিঁটে”। এরপর আবু জাহল (তার ওপর আল্লাহ তা‘আলার লা‘নাত) সত্তর জনের মধ্যে (সেও) নিহত হয়, উক্ববা ইবন আবু মুঈত্ব বন্দী হয় আর এ অবস্থায় সে নিহত হয় আর এভাবে সত্তরজন পূর্ণ হয় অর্থাৎ নিহতের সংখ্যা ছিল সত্তরজন। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ شَاقُّوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ “এর কারণ হলো, তারা আল্লাহ ও রাসূলের বিরোধিতা করে” অর্থাৎ তারা তাদের বিরোধিতা করেছিল ফলে বিরুদ্ধাচরণের প্রতি তারা ধাবিত হয়েছিল এবং তারা শরী‘আত মান্য করা, তার প্রতি ঈমান আনয়ন এবং আনুগত্য পরিত্যাগ করেছিল।  আর (يشاقق) শব্দটি এমন হতে পারে যে شق العصا থেকে নেওয়া হয়েছে অর্থাৎ, তাকে দ্বিখণ্ডিত করা। وَمَنْ يُشَاقِقِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ “আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করবে (তাদের জেনে রাখা দরকার) আল্লাহ শাস্তিদানে বড়ই কঠোর” অর্থাৎ যে তাঁর অবাধ্য হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে, তিনি তার অনুসন্ধানী ও পরাজিতকারী। না কোনো কিছু তাঁর থেকে পালাতে পারে আর না কোনো কিছুকে তাঁর ক্রোধের সম্মুখে তারা দাঁড় করাতে পারে। তিনি বরকতমণ্ডিত সুউচ্চ, তিনি ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই, তিনি ছাড়া নেই কোনো প্রতিপালক। ذَلِكُمْ فَذُوقُوهُ وَأَنَّ لِلْكَافِرِينَ عَذَابَ النَّارِ “এটাই তোমাদের শাস্তি। অতএব, তার স্বাদ গ্রহণ কর, কাফেরদের জন্য আছে আগুনের (জাহান্নামের) শাস্তি)”। এখানে কাফেরদের প্রতি সম্বোধন করা হয়েছে অর্থাৎ তোমরা দুনিয়াতে এ আযাব-গজব আস্বাদন কর এবং আরও জেনে রাখ যে, পরকালে কাফেরদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا لَقِيتُمُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ زَحۡفٗا فَلَا تُوَلُّوهُمُ ٱلۡأَدۡبَارَ ١٥ وَمَن يُوَلِّهِمۡ يَوۡمَئِذٖ دُبُرَهُۥٓ إِلَّا مُتَحَرِّفٗا لِّقِتَالٍ أَوۡ مُتَحَيِّزًا إِلَىٰ فِئَةٖ فَقَدۡ بَآءَ بِغَضَبٖ مِّنَ ٱللَّهِ وَمَأۡوَىٰهُ جَهَنَّمُۖ وَبِئۡسَ ٱلۡمَصِيرُ ١٦﴾ [الانفال: ١٥، ١٦]
অর্থানুবাদ:
“হে মুমিনগণ! তোমরা যখন যোদ্ধা-বাহিনীরূপে কাফেরদের সম্মুখীন হও, তখন তাদেরকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে না। এমন দিনে যুদ্ধে কৌশল অবলম্বন বা নিজ দলের সঙ্গে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ তাদেরকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলে সে তো আল্লাহর গজবে পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ল, জাহান্নামই তার ঠিকানা আর তা কতই না নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১৫-১৬]
তাফসীর:
যুদ্ধের ময়দান পলায়ন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং তার শাস্তি:
যারা যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করে তাদের জন্য আগুনের শাস্তি রয়েছে মর্মে আল্লাহ তা‘আলা হুঁশিয়ার করেন, আল্লাহ বলেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا زَحْفًا “হে মুমিনগণ! তোমরা যখন যোদ্ধা-বাহিনীরূপে কাফেরদের সম্মুখীন হও” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১৫] অর্থাৎ, তাদের নিকটবর্তী ও মুখোমুখী হও فَلا تُوَلُّوهُمُ الأدْبَارَ “তখন তাদেরকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে না” অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন হও না, তোমাদের সাথীদের ছেড়ে পালিয়ে যেও না وَمَنْ يُوَلِّهِمْ يَوْمَئِذٍ دُبُرَهُ إِلا مُتَحَرِّفًا لِقِتَالٍ “এমন দিনে যুদ্ধে কৌশল অবলম্বন উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ তাদেরকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলে” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১৬] অর্থাৎ সে এমন ভাব দেখিয়ে তার (শত্রু) থেকে পলায়ন করে যেন সে তাকে ভয় পেয়েছে ফলে সে তাকে অনুসরণ করে এরপর সে সুযোগ গ্রহণ করে আর ফিরে এসে তাকে হত্যা করে। এ ক্ষেত্রে তার (মুসলিমের) কোনো গোনাহ নেই। সা‘ঈদ ইবন জুবাইর এবং সুদ্দী এ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। দাহ্হাক রহ. বলেন, যে ব্যক্তি শত্রুদের শক্তি সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য তার সাথীদের থেকে সামনে এগিয়ে যায় এবং তা কাজে লাগায়। أَوْ مُتَحَيِّزًا إِلَى فِئَةٍ “বা নিজ দলের সঙ্গে মিলিত হওয়ার” অথবা এখান থেকে পালিয়ে মুসলিমের অন্য দলের সাথে মিলিত হয় (ফলে) সে তাদেরকে সহযোগিতা করে অথবা তারা তাকে সাহায্য করে, এটি তার জন্য বৈধ। এমনকি সে যদি ক্ষুদ্র কোনো দলে থাকে এরপর পালিয়ে তার নেতার নিকট যায় অথবা বড় কোনো নেতার নিকট যায় তবুও সে এ অনুমতির আওতায় পড়বে। আব্দুল্লাহ ইবন উমার থেকে ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন, রাসূলের প্রেরিত একটি সৈন্য দলে যুদ্ধরত ছিলাম। এ যুদ্ধে লোকেরা পালিয়ে যায়। আমি পালিয়ে যাওয়াদের মধ্যে একজন। পরে আমরা বললাম, আমরাতো যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করেছি এখন আমরা কি করব? তারপর আমরা বললাম, আমরা মদীনায় প্রবেশ করে তাতে রাত কাঁটাই। তারপর বললাম আমরা আমাদের বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট তুলে ধরি। যদি কোনো তাওবা থাকে তবে ভালো আর না হয় আমাদের ধ্বংস। আমরা সকালের সালাতের পূর্বে দরবারে আসি। তিনি বের হয়ে বললেন, তারা কারা? তখন আমরা বললাম, আমরা যুদ্ধে ময়দান থেকে পলায়নকারী। তখন তিনি বললেন, না বরং তোমরা অবস্থানকারী, আমি তোমাদের দল এবং মুসলিমদের দলভুক্ত। তারপর আমরা সামনে অগ্রসর হয়ে তার হাতে চুমু দিলাম। অনুরূপ বর্ণনা করেছেন আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবন মাযাহ, ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীসটি হাসান।
অনুরূপ বলেছেন উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবু উবাইদাহর সম্পর্কে বলেন যখন তিনি পারস্যে একটি সেতুর ওপর যুদ্ধ করছিলেন আর এ সময় পারস্য সৈন্যরা ছিল সংখ্যায় অনেক: সে যদি আমার নিকট ফিরে আসত তবে আমি তার জন্য এক দল হয়ে যেতাম। মুহাম্মাদ ইবন সীরীন উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে একই বর্ণনা দেন। অপর এক বর্ণনায় এসেছে, যা আবু উসমান আন-নাহদী উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন তিনি বলেন, আবু ‘উবাইদ যখন লড়াই করছিলেন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, হে লোক সকল, আমি প্রতিটি মুসলিমের সেনাদল। মুজাহিদ রহ. বলেন, উমার রা. বলেন, আমি প্রত্যেক মুসলিমের দল।
আর দাহ্হাক রহ. أَوْ مُتَحَيِّزًا إِلَى فِئَةٍ “বা নিজ দলের সঙ্গে মিলিত হওয়ার” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন, المتحيز হচ্ছে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণের নিকট ফিরে যায়; কিন্তু পলায়ন যদি এ সমস্ত কারণের কোনো একটির জন্য না হয় তবে তা হারাম, কবীরা গোনাহ। কেননা এ সম্পর্কে বুখারী ও মুসলিম তাদের ‘সহীহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: «اجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوبِقَاتِ» قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا هُنَّ؟ قَالَ: «الشِّرْكُ بِاللَّهِ، وَالسِّحْرُ، وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ، وَأَكْلُ الرِّبَا، وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيمِ، وَالتَّوَلِّي يَوْمَ الزَّحْفِ، وقذف المحصنات الغافلات المؤمنات» ‘‘তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী গোনাহ থেকে বেঁচে থাক: বলা হয়: হে আল্লাহর রাসূল সেগুলো কী কী? তিনি বলেন, আল্লাহর সাথে শির্ক করা, যাদু, এমন আত্মাকে হত্যা করা যা আল্লাহ তা‘আলা হারাম করেছেন তবে ন্যায়ভাবে (হলে ভিন্ন কথা), সুদ খাওয়া, ইয়াতীমের সম্পদ ভোগ করা, যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা এবং মুমিনা, সাধাসিধে পবিত্রা নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়া”।  এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَقَدْ بَاءَ “সে তো পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ল” অর্থাৎ ফিরে গেল بِغَضَبٍ مِنَ اللَّهِ وَمَأْوَاهُ “আল্লাহর গজবে, আর তার ঠিকানা” তার গন্তব্য, এবং প্রত্যাবর্তণ দিবসে তার বাসস্থান جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ “জাহান্নামই আর তা কতই না নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল”।  কেউ কেউ বলেন, পলায়ন করা হারাম শুধু সাহাবীগণের জন্য। কারণ, তাদের জন্য জিহাদ করা ছিল ফরযে ‘আইন। কেউ কেউ বলেন, আনসারদের ওপর হারাম। কারণ, তারা সর্বাবস্থায় শোনা ও মানার ওপর বাই‘আত করেছেন।
কেউ কেউ বলেন, এ আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য বদরী সাহাবীগণ। (এ মত বর্ণিত, আমর, ইবন আব্বাস, আবু হুরায়রা, আবু সা‘ঈদ না‘ফে, হাসান বাসরী সা‘ঈদ ইবন জুবাইর, ইকরিমাহ, কাতাদা ও দাহ্হাক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম প্রমূখ থেকে) এ মতের পক্ষে তাদের প্রমাণ, এ দিন এমন কোনো ক্ষুদ্র জামা‘আত ছিল না যাদের কোনো দল আছে, যাদের দিকে তারা ফিরে যাবে, একমাত্র এ দল ছাড়া। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «اللَّهُمَّ إِنَّ تُهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةَ لَا تُعْبَدُ في الأرض» “হে আল্লাহ তুমি যদি এ ক্ষুদ্র জামা‘আতকে ধ্বংস কর, তবে জমিনে ইবাদাত করার আর কেউ থাকবে না”। এ কারণে হাসান রহ. আল্লাহর বাণী: وَمَن يُوَلِّهِمْ يَوْمَئِذٍ دُبُرَه “এমন দিনে যে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করল” সম্পর্কে বলেন, এটি ছিল বদরের দিন। তবে বর্তমানে যদি কেউ তার শহর বা দলের দিক ফিরে আসে তাতে কোনো অসুবিধা নেই।
ইবনুল মুবারক রহ. ইয়াযিদ ইবন হাবীব রহ. থেকে বর্ণনা করে বলেন, বদরের দিন যে পলায়ন করে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَن يُوَلِّهِمۡ يَوۡمَئِذٖ دُبُرَهُۥٓ إِلَّا مُتَحَرِّفٗا لِّقِتَالٍ أَوۡ مُتَحَيِّزًا إِلَىٰ فِئَةٖ فَقَدۡ بَآءَ بِغَضَبٖ مِّنَ ٱللَّهِ وَمَأۡوَىٰهُ جَهَنَّمُۖ وَبِئۡسَ ٱلۡمَصِيرُ “এমন দিনে যুদ্ধে কৌশল অবলম্বন বা নিজ দলের সঙ্গে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ তাদেরকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলে সে তো আল্লাহর গজবে পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ল, জাহান্নামই তার ঠিকানা আর তা কতই না নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল।” তারপর যখন ওহুদের দিন আসে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ تَوَلَّوۡاْ مِنكُمۡ يَوۡمَ ٱلۡتَقَى ٱلۡجَمۡعَانِ إِنَّمَا ٱسۡتَزَلَّهُمُ ٱلشَّيۡطَٰنُ بِبَعۡضِ مَا كَسَبُواْۖ وَلَقَدۡ عَفَا ٱللَّهُ عَنۡهُمۡۗ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌ حَلِيمٞ ١٥٥﴾ [ال عمران: ١٥٥] “নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে যারা পিছু হটে গিয়েছিল সেদিন, যেদিন দু’দল মুখোমুখি হয়েছিল, শয়তানই তাদের কিছু কৃতকর্মের ফলে তাদেরকে পদস্খলিত করেছিল। আর অবশ্যই আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করেছেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, সহনশীল”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৫] তারপর যখন সাত বছর পর হুনাইনের যুদ্ধের দিন আসে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ثُمَّ وليِتُم مُّدْبِرِينَ “অতঃপর তোমরা পৃষ্ট প্রদর্শন করলে” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ২৫] ثُمَّ يَتُوبُ اللَّهُ مِن بَعْدِ ذَلِكَ عَلَى من يشآء “তারপর আল্লাহ যাকে চান তার তাওবা কবুল করেন”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ২৭] আবু সা‘ঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি এ আয়াত وَمَن يُوَلِّهِمۡ يَوۡمَئِذٖ دُبُرَهُ “এমন দিনে যে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করল” সম্পর্কে বলেন, এ আয়াতটি বদরী সাহাবীগণের বিষয়ে নাযিল হয়।
তবে আয়াতটি বদরী সাহাবীগণের সম্পর্কে নাযিল হলেও উল্লিখিত মতামত বদরী সাহাবী ছাড়া অন্যদের জন্য যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা হারাম হওয়ার পরিপন্থী নয়। যেমন, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত উল্লিখিত হাদীস থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, যুদ্ধ থেকে পলায়ন করা ধ্বংসাত্মক বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ ভালো জানেন।
﴿فَلَمۡ تَقۡتُلُوهُمۡ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ قَتَلَهُمۡۚ وَمَا رَمَيۡتَ إِذۡ رَمَيۡتَ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ رَمَىٰ وَلِيُبۡلِيَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ مِنۡهُ بَلَآءً حَسَنًاۚ إِنَّ ٱللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٞ ١٧ ذَٰلِكُمۡ وَأَنَّ ٱللَّهَ مُوهِنُ كَيۡدِ ٱلۡكَٰفِرِينَ ١٨﴾ [الانفال: ١٧، ١٨]
অর্থানুবাদ:
(আসল ব্যাপার হলো) “তোমরা তাদেরকে হত্যা করো নি, বরং আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছেন, তুমি যখন নিক্ষেপ করছিলে তাতো তুমি নিক্ষেপ করো নি; বরং আল্লাহই নিক্ষেপ করেছিলেন যাতে তিনি মুমিনদেরকে এক সুন্দরতম পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ করতে পারেন। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। আমার এ ব্যবস্থা তোমাদের জন্য, (আর কাফেরদের সম্পর্কে কথা এ যে) আল্লাহ কাফেরদের ষড়যন্ত্রকে অকেজো করে দেন”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১৭-১৮]
তাফসীর:
কাফেরদের হত্যা এবং তাদের প্রতি ধুলি নিক্ষেপ:
আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেন যে, তিনি মানুষের কর্মসমূহ সৃষ্টি করেছেন আর তাদের থেকে যত ভালো কার্য সংঘটিত হয় সেগুলোর জন্য তিনিই প্রশংসার যোগ্য। কেননা, তিনিই তাদেরকে এ সব কাজ করার তাওফীক দিয়েছেন এবং তাদেরকে সহযোগিতা করেছেন। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَلَمْ تَقْتُلُوهُمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ قَتَلَهُمْ “(আসল ব্যাপার হলো) তোমরা তাদেরকে হত্যা করো নি; বরং আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছেন” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১৭] অর্থাৎ তোমরা তোমাদের শক্তি ও ক্ষমতায় তোমাদের শত্রুদের হত্যা করো নি যখন তাদের সংখ্যা ছিল বেশি আর তোমাদের সংখ্যা ছিল কম। অর্থাৎ বরং তিনিই তোমাদেরকে তাদের ওপর বিজয় দান করেছেন। যেমন, তিনি বলেন, ﴿وَلَقَدۡ نَصَرَكُمُ ٱللَّهُ بِبَدۡرٖ وَأَنتُمۡ أَذِلَّةٞۖ ١٢٣﴾ [ال عمران: ١٢٣] “এবং আল্লাহ তোমাদের হীন অবস্থায় বদর যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাদের সাহায্য করেছেন”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১২৩] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللَّهُ فِي مَوَاطِنَ كَثِيرَةٍ وَيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئًا وَضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الأرْضُ بِمَا رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُمْ مُدْبِرِينَ٢٥﴾ [التوبة: ٢٥ ] “বস্তুতঃ আল্লাহ তোমাদেরকে বহু যুদ্ধ ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন আর হুনায়নের যুদ্ধের দিন, তোমাদের সংখ্যার আধিক্য তোমাদেরকে গর্বে মাতোয়ারা করে দিয়েছিল, কিন্তু তা তোমাদের কোনো কাজে আসে নি, জমিন তার বিশালতা নিয়ে তোমাদের কাছে সংকীর্ণই হয়ে গিয়েছিল, আর তোমরা পিছন ফিরে পালিয়ে গিয়েছিলে”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ২৫] আল্লাহ তা‘আলা অবহিত করেন যে, বিজয় কখনও সংখ্যাধিক্য অথবা বেশি অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহ করার ওপর নির্ভর করে না; বরং বিজয় আসে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿كَم مِّن فِئَةٖ قَلِيلَةٍ غَلَبَتۡ فِئَةٗ كَثِيرَةَۢ بِإِذۡنِ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ ٢٤٩﴾ [البقرة: ٢٤٩] “আল্লাহর হুকুমে বহু ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র দল বৃহৎ দলের ওপর জয়যুক্ত হয়েছে, আর আল্লাহ তা‘আলা ধৈর্য্যশীলদের সাথে আছেন” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৪৯]
এরপর আল্লাহ তা‘আলা এক মুষ্টি বালুর কথা উল্লেখ করেন যা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের ময়দানে কাফেরদের প্রতি নিক্ষেপ করেন, যখন তিনি তাঁবু থেকে বের হয়ে আসেন যার পূর্বে তিনি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দো‘আ করেন, অনুনয়-বিনয় করেন, তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন, এরপর তিনি সেই মুষ্টি বালু তাদের প্রতি নিক্ষেপ করেন আর বলেন, شاهت الوجوه ‘তাদের চেহারাগুলো অপমানিত হোক’ এরপর তিনি তাঁর সাহাবীগণকে সাবধানতার সাথে যুদ্ধ শুরু করার নির্দেশ দেন, ফলে তারা তাই করে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর এক মুষ্টি বালু কাফেরদের চোখে প্রবেশ করান, তাদের প্রত্যেকে এর দ্বারা আক্রান্ত হয় যাতে যা তাদেরকে এতে ব্যস্ত করে তুলে। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ رَمَى “তুমি যখন নিক্ষেপ করছিলে তাতো তুমি নিক্ষেপ করনি, বরং আল্লাহই নিক্ষেপ করেছিলেন” অর্থাৎ তিনিই তাদের নিকট তা পৌঁছে দিয়েছিলেন, আর তাদেরকে এতে ব্যস্ত করেছিলেন। তুমি নও।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, বদরের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার নিকট দো‘আ করেন, অনুনয়-বিনয় করেন এবং বলেন, «يَا رَبِّ إِنْ تُهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةَ فَلَنْ تُعْبَدَ فِي الْأَرْضِ أَبَدًا» “হে আল্লাহ যদি এ ক্ষদ্র জামা‘আতটি ধ্বংস করা হয় তবে জমিনে তোমার গোলামী করার কেউ রইল না”। তখন জিবরীল আলাইহিস সালাম তাকে বললেন, এক মুষ্টি মাটি তাদের চেহারার দিক নিক্ষেপ করুন। তারপর তিনি এক মুষ্টি মাঠি নিয়ে তাদের চেহারার দিকে নিক্ষেপ করলেন। তখন একজন মুশরিকও বাকী থাকলো না যাদের চেহারা ও মুখে বালু পৌঁছে নি। তারপর তারা পিছু হটল।
মুহাম্মাদ ইবন কাইস ও মুহাম্মদ ইবন কা‘ব আল-কুরাযী বলেন, যখন উভয় দল একে অপরের মুখোমুখী হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মুষ্টি মাটি হাতে নিলেন, তারপর তিনি তা প্রতিপক্ষের দিকে নিক্ষেপ করলেন এবং বললেন, شاهت الوجوه ‘তাদের চেহারাগুলো অপমানিত হোক’ ফলে বালি প্রত্যেক মুশরিকের চোখে গিয়ে প্রবেশ করে। আর এ সুযোগে রাসূলে সাহাবীগণ সামনে অগ্রসর হয়ে তাদের হত্যা ও বন্দী করতে শুরু করেন। কাফেরদের পরাজয় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বালি নিক্ষেপের কারণেই ছিল। তারপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ رَمَى “তুমি যখন নিক্ষেপ করছিলে তাতো তুমি নিক্ষেপ কর নি; বরং আল্লাহই নিক্ষেপ করেছিলেন” নাযিল করেন। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন: আমার নিকট মুহাম্মাদ ইবন জা‘ফার ইবনুয যুবাইর হাদীস বর্ণনা করেছেন উরওয়া ইবন যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি এ আয়াত: وَلِيُبْلِيَ الْمُؤْمِنِينَ مِنْهُ بَلاءً حَسَنًا “যাতে তিনি মুমিনদেরকে এক সুন্দরতম পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ করতে পারেন” সম্পর্কে বলেন, অর্থাৎ যাতে করে মুমিনগণ তাদের ওপরে আল্লাহর নি‘আমতকে বুঝতে পারে যে, তিনি তাদেরকে তাদের শত্রুদের ওপর বিজয় দান করেছেন অথচ শত্রুদের সংখ্যা ছিল বেশি আর তাদের সংখ্যা ছিল কম; যাতে করে এর মাধ্যমে তারা তাঁর অধিকার চিনতে পারে আর এর মাধ্যমে তাঁর নি‘আমতের শুকরিয়া আদায় করে। ইবন জারীর রহ.ও এ ধরণের ব্যাখ্যা করেছেন। হাদীসে এসেছে: (আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে) সব ধরণের পরীক্ষা আমাদের জন্য নি‘আমতস্বরূপ)।
إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ “আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ” অর্থাৎ তিনি সকল দো‘আ শ্রবণ করেন, আর কারা তাঁর সাহায্য ও বিজয়ের উপযুক্ত তাদের সম্পর্কেও অবগত আছেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ذَلِكُمْ وَأَنَّ اللَّهَ مُوهِنُ كَيْدِ الْكَافِرِينَ “আমার এ ব্যবস্থা তোমাদের জন্য, (আর কাফেরদের সম্পর্কে কথা এটাই যে) আল্লাহ কাফেরদের ষড়যন্ত্রকে অকেজো করে দেন” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১৮] এটি মুসলিমদের অর্জিত বিজয়ের পাশাপাশি আরেকটি সুসংবাদ, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে অবহিত করেন যে, ভবিষ্যতে তিনি কাফেরদের চক্রান্ত নস্যাত করে দিবেন, তাদেরকে অপদস্থ করবেন, আর তাদের সকল বিষয়কে ধ্বংস করে দিবেন। আল্লাহ তা‘আলার জন্য সকল প্রশংসা এবং তাঁরই অনুগ্রহ।
﴿إِن تَسۡتَفۡتِحُواْ فَقَدۡ جَآءَكُمُ ٱلۡفَتۡحُۖ وَإِن تَنتَهُواْ فَهُوَ خَيۡرٞ لَّكُمۡۖ وَإِن تَعُودُواْ نَعُدۡ وَلَن تُغۡنِيَ عَنكُمۡ فِئَتُكُمۡ شَيۡ‍ٔٗا وَلَوۡ كَثُرَتۡ وَأَنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ١٩﴾ [الانفال: ١٩]
অর্থানুবাদ:
(ওহে কাফেরগণ!) “তোমরা মীমাংসা চাচ্ছিলে, মীমাংসা তো তোমাদের কাছে এসে গেছে; আর যদি তোমরা (অন্যায় থেকে) বিরত হও, তবে তা তোমাদের জন্যই কল্যাণকর, তোমরা যদি আবার (অন্যায়) কর, আমিও আবার শাস্তি দিব, তোমাদের দল-বাহিনী সংখ্যায় অধিক হলেও তোমাদের কোনো উপকারে আসবে না এবং আল্লাহ তো মুমিনদের সঙ্গে আছেন”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১৯]
তাফসীর:
মুশরিকদের মীমাংসার আবেদনে সাড়া প্রদান:
আল্লাহ তা‘আলা কাফেরদের বলেন, إِنْ تَسْتَفْتِحُوا فَقَدْ جَاءَكُمُ الْفَتْحُ “(ওহে কাফেরগণ!) তোমরা মীমাংসা চাচ্ছিলে, মীমাংসা তো তোমাদের কাছে এসে গেছে”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১৯] অর্থাৎ তোমরা আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহায্য চাও বিজয়ের এবং তোমাদের শত্রু মুমিনগণের মাঝে বিচার-ফায়সালা করে দেওয়ার জন্য, তবে তোমরা যা চেয়েছ সেটাতো এসে গেছে। যেমন, মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক এবং অন্যান্যরা বর্ণনা করেন যুহরী থেকে (তিনি) আব্দুল্লাহ ইবন সা‘লাবা ইবন সাঈর থেকে: আবু জাহাল বদরের দিন বলে: হে আল্লাহ, আমাদের দু’দলের মধ্যে কে রক্তের সম্পর্ক অধিক ছিন্নকারী আর আমাদেরকে তাতে নিয়ে এসেছে যা আমাদের কাছে পরিচিত নয়, আপনি তাকে এ দিনে ধ্বংস করে দিন। এ ছিল তার পক্ষ থেকে বিজয় মীমাংসা চাওয়ার ধরণ। তখন অবতীর্ণ হয় এ আয়াত: إِنْ تَسْتَفْتِحُوا فَقَدْ جَاءَكُمُ الْفَتْحُ “(ওহে কাফেরগণ!) তোমরা মীমাংসা চাচ্ছিলে, মীমাংসা তো তোমাদের কাছে এসে গেছে”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১৯]
ইমাম আহমাদ রহ. আব্দুল্লাহ্ ইবন সা‘লাবা থেকে বর্ণনা করেন: আবু জাহাল যখন মুসলিমবৃন্দের মুখোমুখি হয় তখন সে বলে: হে আল্লাহ, আমাদের মাঝে অধিক রক্তের সম্পর্ক ছিন্নকারী, আর আমাদেরকে যাতে নিয়ে এসেছে যা আমাদের নিকট পরিচিত নয়, তাকে ধ্বংস করে দিন, সে মীমংসা করে দিতে বলে।
অনুরূপভাবে হাকিম তাঁর মুস্তাদরাকে এর উল্লেখ করেছেন আর তিনি বলেন, এ বর্ণনা বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী বিশুদ্ধ, তবে তারা তাদের গ্রন্থদ্বয়ে এর উল্লেখ করেন নি।  সুদ্দী রহ. বলেন, মুশরিকরা যখন মক্কা থেকে বদরের উদ্দেশ্যে বের হয় তখন তারা কা‘বার পর্দা ধরে আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহায্য চায় আর বলে: হে আল্লাহ, আমাদের দু’টি দলের মধ্যে যে অধিক মর্যাদাবান ও সম্মানিত এবং উভয় গোত্রের মধ্যে যে ভালো তাকে সাহায্য কর। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنْ تَسْتَفْتِحُوا فَقَدْ جَاءَكُمُ الْفَتْحُ “(ওহে কাফেরগণ!) তোমরা মীমাংসা চাচ্ছিলে, মীমাংসা তো তোমাদের কাছে এসে গেছে”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১৯] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি তোমাদের দো‘আ কবূল করেছি। আর তিনি হলেন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যিনি জয়লাভ করেছেন। আব্দুর রহমান ইবন যাইদ ইবন আসলাম বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এখানে তাদের সম্পর্কে বলেন যারা বলেছিল, ﴿وَإِذۡ قَالُواْ ٱللَّهُمَّ إِن كَانَ هَٰذَا هُوَ ٱلۡحَقَّ مِنۡ عِندِكَ فَأَمۡطِرۡ عَلَيۡنَا حِجَارَةٗ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ أَوِ ٱئۡتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيمٖ ٣٢﴾ [الانفال: ٣٢] “স্মরণ কর, যখন তারা বলেছিল, ‘হে আল্লাহ! এটি যদি তোমার নিকট থেকে (প্রেরিত) সত্য (দীন) হয়) তবে আমাদের ওপর আকাশ থেকে পাথার কিংবা আমাদের ওপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আপতিত করুন।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৩২]
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَإِنْ تَنْتَهُوا “আর যদি তোমরা (অন্যায় থেকে) বিরত হও” অর্থাৎ তোমরা যে আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফুরী এবং তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করার মধ্যে ডুবে আছ (তা থেকে বিরত হও) فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ “তবে তা তোমাদের জন্যই কল্যাণকর” অর্থাৎ দুনিয়া ও আখিরাতে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَإِنْ تَعُودُوا نَعُدْ “তোমরা যদি আবার (অন্যায়) কর, আমিও আবার শাস্তি দিব)” যেমন, তিনি অপর আয়াতে বলেন, ﴿وَإِنۡ عُدتُّمۡ عُدۡنَاۚ ٨﴾ [الاسراء: ٨] “(কিন্তু যদি তোমরা (তোমাদের পূর্বকৃত পাপের) পুনরাবৃত্তি কর, তবে আমিও (পূর্বে দেওয়া শাস্তির) পুনরাবৃত্তি করব” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৮] অর্থাৎ তোমরা যে কুফুরী ও গোমরাহীর মধ্যে পড়ে ছিলে তার যদি পুনরাবৃত্তি কর তবে আমরাও তোমাদের সাথে এ ধরণের ঘটনা ঘটাব।
আল্লাহ তা‌‘আলার বাণী: وَلَنْ تُغْنِيَ عَنْكُمْ فِئَتُكُمْ شَيْئًا وَلَوْ كَثُرَتْ “তোমাদের দল-বাহিনী সংখ্যায় অধিক হলেও তোমাদের কোনো উপকারে আসবে না” যে বাহিনী তোমাদের সামর্থ্যে কুলায় তা যদি জড় কর তবুও আল্লাহ তা‘আলা যার সাথে আছেন সেই বিজয়ী হবে। وَأَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ “আল্লাহ তো মুমিনদের সঙ্গে আছেন ”। তারা হচ্ছে নবীর দল, নির্বাচিত নবীর পক্ষ।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَا تَوَلَّوۡاْ عَنۡهُ وَأَنتُمۡ تَسۡمَعُونَ ٢٠ وَلَا تَكُونُواْ كَٱلَّذِينَ قَالُواْ سَمِعۡنَا وَهُمۡ لَا يَسۡمَعُونَ ٢١ إِنَّ شَرَّ ٱلدَّوَآبِّ عِندَ ٱللَّهِ ٱلصُّمُّ ٱلۡبُكۡمُ ٱلَّذِينَ لَا يَعۡقِلُونَ ٢٢ وَلَوۡ عَلِمَ ٱللَّهُ فِيهِمۡ خَيۡرٗا لَّأَسۡمَعَهُمۡۖ وَلَوۡ أَسۡمَعَهُمۡ لَتَوَلَّواْ وَّهُم مُّعۡرِضُونَ ٢٣﴾ [الانفال: ٢٠، ٢٣]
অর্থনুবাদ:
“ওহে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং আদেশ শোনার পর তা অমান্য কর না। তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা বলেছিল, ‘আমরা শুনলাম’; প্রকৃতপক্ষে তারা শোনে নি। আল্লাহর নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব হচ্ছে যারা (হক কথা শুনার ব্যাপারে) বধির এবং (হক কথা বলার ব্যাপারে) বোবা, যারা কিছুই বোঝে না। আল্লাহ যদি জানতেন যে, তাদের মধ্যে কোনো ভালো গুণ নিহিত আছে তবে তিনি তাদেরকে শুনবার তাওফীক দিতেন। আর (গুণ না থাকা অবস্থায়) তিনি যদি তাদেরকে শুনতে দিতেন তাহলে তারা উপেক্ষা করে মুখ ফিরিয়ে নিত”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ২০-২৩]
তাফসীর:
আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করার নির্দেশ:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মুমিন বান্দাগণকে নির্দেশ দিচ্ছেন তাঁর এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে আর তাদেরকে নিষেধ করছেন তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে এবং তাঁকে যারা অস্বীকার করে তাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করতে যারা একগুঁয়েমীতে লিপ্ত রয়েছে। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلا تَوَلَّوْا عَنْهُ “তা অমান্য কর না” অর্থাৎ (তা এভাবে যে) তাঁর আনুগত্য করা থেকে বিরত থাক, তাঁর নির্দেশ পালন করা এবং তাঁর নিষেধকৃত বিষয় বর্জন ছেড়ে দেওয়া। وَأَنْتُمْ تَسْمَعُونَ “আদেশ শোনার পর” অর্থাৎ তোমাদেরকে যেদিকে আহ্বান জানানো হচ্ছে তা জানার পরও। وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ قَالُوا سَمِعْنَا وَهُمْ لا يَسْمَعُونَ “তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা বলেছিল, ‘আমরা শুনলাম’, প্রকৃতপক্ষে তারা শোনে নি” কেউ কেউ বলেন, এরা হলো, মুশরিকরা। ইবন জারির রহ. এ মতকে গ্রহণ করেন। ইবন ইসহাক রহ. বলেন, ওরা হচ্ছে মুনাফিক, তারা বাহ্যিকভাবে দেখায় যে, তারা শুনেছে এবং সাড়া দিয়েছে; কিন্তু বাস্তবতা তার উল্টো।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন যে, আদম সন্তানদের মধ্যে এ শ্রেণিটি সবচেয়ে নিকৃষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّ شَرَّ الدَّوَابِّ عِنْدَ اللَّهِ الصُّمُّ “আল্লাহর নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব হচ্ছে যারা (হক কথা শুনার ব্যাপারে) বধির” অর্থাৎ সত্য শোনা থেকে বধির البكم “এবং (হক কথা বলার ব্যাপারে) বোবা” তা বোঝা থেকে। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, الَّذِينَ لا يَعْقِلُونَ “যারা কিছুই বোঝে না” এরা হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব। কেননা এরা ছাড়া আর সকল জীব আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করে যার জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর ইবাদাতের জন্য; কিন্তু তারা অস্বীকার করেছে, এ কারণে তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তুর সাথে উপমা দেওয়া হয়েছে নিম্নের এ আয়াতে: ﴿وَمَثَلُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ كَمَثَلِ ٱلَّذِي يَنۡعِقُ بِمَا لَا يَسۡمَعُ إِلَّا دُعَآءٗ وَنِدَآءٗۚ صُمُّۢ بُكۡمٌ عُمۡيٞ فَهُمۡ لَا يَعۡقِلُونَ ١٧١﴾ [البقرة: ١٧١] “এ কাফেরদের তুলনা সেই ব্যক্তির মতো যে এমন কিছুকে ডাকে যা হাঁক-ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনে না”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭১] অপর আয়াতে তিনি বলেন, ﴿أُوْلَٰٓئِكَ كَٱلۡأَنۡعَٰمِ بَلۡ هُمۡ أَضَلُّۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡغَٰفِلُونَ ١٧٩﴾ [الاعراف: ١٧٨] “তারা জন্তু-জানোয়ারের মতো; বরং তার চেয়েও পথভ্রষ্ট, তারা একেবারে বে-খবর”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৭৮] আয়াতে উল্লিখিত এসব লোকদের দ্বারা উদ্দেশ্য কুরাইশের আব্দুদ দার গোত্র। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা, মুজাহিদ থেকে এটি বর্ণিত হয়েছে, ইবন জারীর তা পছন্দ করেছেন। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক রহ. বলেন, তারা হচ্ছে মুনাফিক। আমি বলি: মুনাফিক হোক আর মুশরিক হোক এ ব্যাপারে তা সাংঘর্ষিক নয়, কেননা উভয় দলই সঠিক বোঝ শক্তিহীন। সৎ আমল করার ইচ্ছা তাদের নেই।
এরপর আল্লাহ তা‘আল অবহিত করেন যে, তাদের সঠিক বোধ নেই, নেই তাদের বিশুদ্ধ ইচ্ছা। যদি ধরে নেওয়া হয় যে, তাদের বোধ রয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَوْ عَلِمَ اللَّهُ فِيهِمْ خَيْرًا لأسْمَعَهُمْ “আল্লাহ যদি জানতেন যে, তাদের মধ্যে কোনো ভালো গুণ নিহিত আছে তবে তিনি তাদেরকে শুনবার তাওফীক দিতেন”। অর্থাৎ তাদেরকে বোঝাতেন, এখানে উহ্য কথা হচ্ছে তাদের মাঝে কোনো কল্যাণ নেই, ফলে তাদেরকে বোঝান নি, কেননা তিনি জানেন যে, وَلَوْ أَسْمَعَهُمْ “যদি তিনি তাদেরকে শুনবার তাওফীক দিতেন” অর্থাৎ বোঝাতেন لَتَوَلَّوْا “তাহলে তারা মুখ ফিরিয়ে নিত” এ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে এবং একগুঁয়েমীবশত অথচ তারা ততক্ষণে সেটা বুঝে গেছে। وَهُمْ مُعْرِضُونَ “আর তারা উপেক্ষা করে” তা থেকে।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱسۡتَجِيبُواْ لِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمۡ لِمَا يُحۡيِيكُمۡۖ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ يَحُولُ بَيۡنَ ٱلۡمَرۡءِ وَقَلۡبِهِۦ وَأَنَّهُۥٓ إِلَيۡهِ تُحۡشَرُونَ ٢٤﴾ [الانفال: ٢٤]
অর্থানুবাদ:
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দাও যখন তোমাদেরকে ডাকা হয় (এমন বিষয়ের দিকে) যা তোমাদের মাঝে জীবন সঞ্চার কর, আর জেনে রেখ যে আল্লাহ মানুষ ও তার অন্তরের মধ্যবর্তী হয়ে থাকেন আর তোমাদেরকে তাঁর কাছেই একত্রিত করা হবে”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ২৪]
তাফসীর:
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দেওয়ার নির্দেশ:
ইমাম বুখারী রহ. বলেন, اسْتَجِيبُوا “ডাকে সাড়া দাও” لِمَا يُحْيِيكُمْ “যা তোমাদের মাঝে জীবন সঞ্চার করে” যা তোমাদেরকে সংশোধন করে। আবু সা‘ঈদ ইবনুল মু‘আল্লা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি সালাতে রত ছিলাম এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে ডাক দেন; কিন্তু আমি সালাত আদায় করার পরে তাঁর নিকট আসি, তখন তিনি বলেন, «مَا مَنَعَكَ أَنْ تَأْتِيَنِي؟»أَلَمْ يَقُلِ اللَّهُ: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَجِيبُوا لِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ “কিসে তোমাকে আমার নিকট আসতে বাধা দিয়ে রেখেছিল? আল্লাহ কি বলেন নি? يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَجِيبُوا لِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দাও যখন তোমাদেরকে ডাকা হয় (এমন বিষয়ের দিকে) যা তোমাদের মাঝে জীবন সঞ্চার করে” এরপর তিনি বলেন, আমি বের হয়ে যাওয়ার পূর্বে তোমাকে কুরআনের সবচেয়ে সম্মানিত সূরাটি শিক্ষা দিব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হয়ে যেতে উদ্যত হন, আমি তাঁকে (বিষয়টি) স্মরণ করিয়ে দেই। মু‘আয রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হাফ্স ইবন ‘আসিম আবু সা‘ঈদ (যিনি) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের অন্যতম তাঁকে এ সম্পর্কে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেন, তা হলো, الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ “সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সমগ্র সৃষ্টির রব” তা হচ্ছে সাতটি বারংবার পঠিতব্য আয়াত।  
মুজাহিদ রহ. বলেন, لِمَا يُحْيِيكُمْ অর্থাৎ হকের জন্য। কাতাদাহ বলেন, لما يحييكم আর তা হলো, কুরআন; যাতে রয়েছে নাজাত, বাকী থাকা ও জীবন।
সুদ্দি রহ. বলেন, ইসলামের মধ্যে রয়েছে তাদের পূণরায় জীবন; কুফুরীর কারণে তা মৃত হয়ে যাওয়ার পর। যুদ্ধের জন্য; যার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা অপমানিত হওয়ার পরে তোমাদেরকে সম্মানিত করেন, দুর্বলতার পরে তোমাদেরকে শক্তিশালী করেন আর তোমাদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর পরে শত্রুদেরকে তোমাদের থেকে বাধা দেন।
আল্লাহ মানুষ ও তার অন্তরের মধ্যবর্তী হয়ে থাকেন:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَحُولُ بَيْنَ الْمَرْءِ وَقَلْبِهِ “আর জেনে রেখ যে আল্লাহ মানুষ ও তার অন্তরের মধ্যবর্তী হয়ে থাকেন” আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, মুমিন এবং কুফুরীর মধ্যবর্তী হয়ে থাকেন এবং কাফের ও ঈমানের মধ্যবর্তী হয়। হাকিম তাঁর মুস্তাদরাকে মাওকূফরূপে এর উল্লেখ করেছেন আর তিনি বলেন, বর্ণনাটি বিশুদ্ধ কিন্তু ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাদের গ্রন্থদ্বয়ে এটি উল্লেখ করেন নি। অনুরূপ মত পোষণ করেছেন মুজাহিদ, সা‘ঈদ, ইকরিমা, দাহ্হাক, আবু সালিহ, আতিয়্যাহ, মুকাতিল ইবন হাইইয়ান এবং সুদ্দী রহ.। মুজাহিদ রহ. এর এক বর্ণনায় রয়েছে, তিনি يَحُولُ بَيْنَ الْمَرْءِ وَقَلْبِهِ “আল্লাহ মানুষ ও তার অন্তরের মধ্যবর্তী হয়ে থাকেন” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন, তারা বোঝে না এরূপ অবস্থায় তাদের রেখে দেন। সুদ্দী রহ. বলেন, মানুষ এবং তার অন্তরের মধ্যবর্তী হন ফলে সে তার অনুমতি ছাড়া ঈমান আনতে পারে না, কুফুরী করতে পারে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বহু হাদীস এ বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে যা এ আয়াতের সাথে সম্পর্ক রাখে। কাতাদাহ রহ. বলেন, এটি আল্লাহর বাণী ﴿وَنَحۡنُ أَقۡرَبُ إِلَيۡهِ مِنۡ حَبۡلِ ٱلۡوَرِيدِ ١٦﴾ [ق: ١٦]   ‍এর মতো।
ইমাম আহমাদ রহ. বর্ণনা করেন, আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি বেশি এ দো‘আ করতেন: يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلى دِيْنِكَ ‘হে অন্তরের পরিবর্তনকারী, আপনি আমার অন্তর আপনার দীনের ওপর অটল রাখুন’। তিনি বলেন, আমরা বলি: হে আল্লাহর রাসূল, আমরা আপনার ওপর এবং আপনি যা নিয়ে এসেছেন তার ওপর ঈমান এনেছি, আপনি কি আমাদের ব্যাপারে আশঙ্কা করেন? তিনি বলেন,  نَعَمْ إِنَّ الْقُلُوبَ بَيْنَ أصبعين من أصابع الله تعالى يقلبها ‘হাঁ, নিশ্চয় অন্তরসমূহ আল্লাহ তা‘আলার আঙ্গুলসমূহের মধ্য হতে দু’আঙ্গুলের মাঝে থাকে তিনি সেগুলো উলট-পালট করেন। এভাবে ইমাম তিরমিযী (হাদীস নং ২১৪০) তার ‘জামে‘ গ্রন্থের কাদর অধ্যায়ে এর উল্লেখ করেছেন আর তিনি বলেন, (হাদীসটি) হাসান।  
ইমাম আহমাদ রহ. বলেন, উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে হাদীস বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ يُكْثِرُ فِي دُعَائِهِ يقول:«اللَّهُمَّ مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ» قَالَتْ، فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ الله أن القَلْبَ لَتُقَلَّبُ؟ قَالَ: «نَعَمْ مَا خَلَقَ اللَّهُ مِنْ بَشَرٍ مِنْ بَنِي آدَمَ إِلَّا أَنَّ قَلْبَهُ بَيْنَ أُصْبُعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ اللَّهِ عزَّ وجلَّ، فَإِنْ شَاءَ أَقَامَهُ، وَإِنْ شَاءَ أَزَاغَهُ. فَنَسْأَلُ الله ربنا أن لا يزيع قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَانَا، وَنَسْأَلُهُ أَنْ يَهَبَ لَنَا مِنْ لَدُنْهُ رَحْمَةً إِنَّهُ هُوَ الْوَهَّابُ» قالت، فقلت: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلَا تُعَلِّمُنِي دَعْوَةً أَدْعُو بِهَا لِنَفْسِي؟ قَالَ: «بَلَى، قُولِي اللَّهُمَّ رَبَّ النَّبِيِّ مُحَمَّدٍ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي، وَأَذْهِبْ غَيْظَ قَلْبِي، وَأَجِرْنِي مِنْ مُضِلَّاتِ الْفِتَنِ مَا أَحْيَيْتَنِي».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো‘আতে এ কথা অধিকহারে বলতেন, «اللَّهُمَّ مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ» আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল! অন্তর পরিবর্তন হয়? বলল, হ্যাঁ আল্লাহ তা‘আলা এমন কোনো আদম সন্তান সৃষ্টি করেন নি, তবে প্রত্যেকের অন্তর সমগ্র বিশ্বের রব দয়াময়ের আঙ্গুলসমূহের দুই আঙ্গুলের মাঝে থাকে, তিনি যখন সেটাকে প্রতিষ্ঠিত রাখার ইচ্ছা করেন তখন প্রতিষ্ঠিত রাখেন আর যখন তাতে বক্রতা আনয়নের ইচ্ছা করেন সেটাকে বাঁকিয়ে দেন। আমরা আল্লাহর কাছে কামনা করি, তিনি যেন আমাদের অন্তরকে হিদায়াতের পর বক্র করে না দেন। আর আমরা তার কাছে চাই তিনি যেন আমাদের তার নিজের পক্ষ থেকে রহমত দান করেন। তিনি বলেন, আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল আপনি আমাকে এমন একটি দো‘আ শিখিয়ে দিন যদ্বারা আমি আমার অন্তরের জন্য দো‘আ করব। তিনি বললেন, তুমি এ দো‘আ পড়- اللَّهُمَّ رَبَّ النَّبِيِّ مُحَمَّدٍ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي، وَأَذْهِبْ غَيْظَ قَلْبِي، وَأَجِرْنِي مِنْ مُضِلَّاتِ الْفِتَنِ مَا أَحْيَيْتَنِي “হে আল্লাহ তুমি নবী মুহাম্মাদের রব, আমার গুনাহ ক্ষমা কর, আমার অন্তরের ক্ষোভ দূর কর, যতদিন তুমি আমাকে বাঁচিয়ে রাখ, আমাকে ফিতনার গোমরাহী থেকে পরিত্রাণ দাও”।
ইমাম আহমদ রহ. আব্দুল্লাহ ইবন আমর থেকে হাদীস বর্ণনা করেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে বলতে শুনেছেন... “বান্দাগণের অন্তরসমূহ সমগ্র বিশ্বের রব দয়াময়ের আঙ্গুলসমূহের দুই আঙ্গুলের মাঝে থাকে, এক অন্তরের মতো। তিনি যেভাবে চান পরিবর্তন করেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে অন্তরসমূহ পরিবর্তনকারী দয়াময় আল্লাহ, তুমি আমাদের অন্তরসমূহকে তোমার আদেশের অনুসরণ করার দিক ফিরিয়ে দাও। এ হাদীস কেবল ইমাম মুসলিম (২৬৫৪) বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী বর্ণনা করেন নি”।  
﴿وَٱتَّقُواْ فِتۡنَةٗ لَّا تُصِيبَنَّ ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ مِنكُمۡ خَآصَّةٗۖ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ٢٥﴾ [الانفال: ٢٥]
অর্থানুবাদ:
“সতর্ক থাক সেই ফিতনা থেকে যা বিশেষভাবে তোমাদের যালিম লোকেদের মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে না আর জেনে রেখ, যে আল্লাহ শাস্তিদানে খুবই কঠোর”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ২৪]
তাফসীর:
চারিদিক থেকে বেষ্টনকারী ফিৎনা থেকে সতর্কীকরণ:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে ফিতনা এবং পরীক্ষার সতর্ক করছেন যা দুর্বল এবং তাদের পাশে যারা রয়েছে তাদেরকে বেষ্টন করে ফেলবে। এতে শুধুমাত্র গোনাহগার এবং মন্দ লোকেরাই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং সকলের নিকট তা পৌঁছে যাবে যদি গোনাহ বন্ধ না হয়। যেমন, ইমাম আহমাদ রহ. বর্ণনা করেন, মুতাররিফ রহ. বলেন, আমরা যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে জিজ্ঞেস করি: হে আবু আব্দুল্লাহ, তোমরা কী নিয়ে এসেছ? (উটের যুদ্ধের জন্য) তোমরা খলীফাকে পরিত্যাগ করেছ যিনি নিহত হয়েছেন। এরপর তোমরা তাঁর রক্তপণের দাবি নিয়ে এসেছ? ফলে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বকর, উমার এবং উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম-এর যুগে পাঠ করতাম وَٱتَّقُواْ فِتۡنَةٗ لَّا تُصِيبَنَّ ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ مِنكُمۡ خَآصَّةٗۖ “সতর্ক থাক সেই ফিতনা থেকে যা বিশেষভাবে তোমাদের যালিম লোকেদের মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে না” তবে আমরা ভাবিনি যে, এতে আমরাও পতিত হব; কিন্তু এখন আমাদের থেকে যা ঘটার ঘটে গেছে।  হাসান রহ. বলেন, এ আয়াত আলী, আম্মার, তালহা ও যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম সম্পর্কে নাযিল হয়। আর সুদ্দি রহ. বলেন, আয়াতটি বিশেষ করে বদরী সাহাবীগণের শানে নাযিল হয়, জামালের দিন তারা ফিতনায় আক্রান্ত হয় এবং পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে তাঁর অপর এক বর্ণনায় এ আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে এসেছে: আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণকে নির্দেশ দেন তারা যেন তাদের মাঝে মন্দ কাজে স্বীকৃতি না দেয় নইলে আল্লাহ তা‘আলার আযাব তাদেরকেও শামিল করে নিবে। এ ধরণের তাফসীর খুবই সুন্দর। এ কারণে মুজাহিদ রহ. وَٱتَّقُواْ فِتۡنَةٗ لَّا تُصِيبَنَّ ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ مِنكُمۡ خَآصَّةٗۖ “সতর্ক থাক সেই ফিতনা থেকে যা বিশেষভাবে তোমাদের যালিম লোকেদের মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে না” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন, এটি তোমাদের জন্যও। অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন দাহ্হাক, ইয়াযীদ ইবন আবু হাবীব সহ অন্যান্যারা।  আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, তোমাদের প্রত্যেকেই ফিতনার মধ্যে শামিল রয়েছ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿إِنَّمَآ أَمۡوَٰلُكُمۡ وَأَوۡلَٰدُكُمۡ فِتۡنَةٞۚ ١٥﴾ [التغابن : ١٥] “তোমাদের ধন-সম্পদ আর সন্তানাদি পরীক্ষা (এর বস্তু) মাত্র”। [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৫] তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আশ্রয় চায় সে যেন ফিতনার গোমরাহী থেকে আল্লাহ তা‘আলার নিকট আশ্রয় চায়।
এখানে কথা হচ্ছে এ সতর্কতার মধ্যে সাহাবী এবং অন্যান্যরাও শামিল। যদিও তাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে, তাই সঠিক। ফিতনা থেকে সতর্কীকরণ সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসসমূহ এ ব্যাপারে প্রমাণ করে।  অপর হাদীস ইমাম আহমদ রহ. হুযাইফাহ ইবনুল ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: «وَالَّذِي نَفْسِي بيده لتأمرن بالمعروف ولتنهن عَنِ الْمُنْكَرِ أَوْ لَيُوشِكَنَّ اللَّهُ أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عِقَابًا مِنْ عِنْدِهِ، ثُمَّ لَتَدْعُنَّهُ فَلَا يستجيب لكم» “যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে নয়ত আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের ওপর শাস্তি প্রেরণ করবেন এরপর তোমরা দো‘আ করবে; কিন্তু তিনি তোমাদের দো‘আ কবুল করবেন না”।
ইমাম আহমাদ রহ. আরও একটি হাদীস বর্ণনা করেন, নু‘মান ইবন বাশীর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুৎবা দেন এ সময় তিনি তাঁর দুই আঙ্গুল দ্বারা তাঁর দু’কানে ইঙ্গিত করে বলেন, مَثَلُ الْقَائِمِ عَلَى حُدُودِ اللَّهِ وَالْوَاقِعِ فِيهَا والمدهن فِيهَا كَمَثَلِ قَوْمٍ رَكِبُوا سَفِينَةً فَأَصَابَ بَعْضُهُمْ أَسْفَلَهَا وَأَوْعَرَهَا وَشَرَّهَا، وَأَصَابَ بَعْضُهُمْ أَعْلَاهَا، فَكَانَ الَّذِينَ فِي أَسْفَلِهَا إِذَا اسْتَقَوُا الْمَاءَ مَرُّوا عَلَى مَنْ فَوْقَهُمْ فَآذُوهُمْ، فَقَالُوا: لَوْ خَرَقْنَا فِي نَصِيبِنَا خَرْقًا فَاسْتَقَيْنَا مِنْهُ وَلَمْ نُؤْذِ مَنْ فَوْقَنَا! فَإِنْ تَرَكُوهُمْ وَأَمْرَهُمْ هَلَكُوا جَمِيعًا، وإن أخذوا على أيديهم نجوا جميعاً. “আল্লাহ তা‘আলার সীমারেখার (নির্দেশের) ওপর প্রতিষ্ঠিত আর তাতে বিদ্যমান ব্যক্তি এবং যে আল্লাহ তা‘আলার সীমারেখা লঙ্ঘন করে তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে একদল লোকের মত যারা নৌকায় আরোহণ করে, এদের কেউ নৌকার নিচের তলায় আরোহণ করে যা নৌকাটির নিকৃষ্ট অংশ ও কষ্টদায়ক অংশ, আর কেউ উপরের তলায় আরোহণ করে, নিচের তলার লোকেরা পানি সংগ্রহের জন্য উপরের তলায় গেলে তারা অস্বস্তি বোধ করে, ফলে তারা (নিচের তলার লোকেরা) বলে: আমরা যদি আমাদের অংশটিতে ফুটো করে নেই তাহলে আমরা এ থেকে পানি সংগ্রহ করতে পারব আর আমাদের দ্বারা উপরের তলার লোকেরা কষ্ট পাবে না। এখন যদি উপরের তলার লোকেরা তাদেরকে তাদের কাজে ছেড়ে দেয় তবে সকলে ধ্বংস হয়ে যাবে; কিন্তু যদি তারা তাদেরকে এ কাজে বাধা দেয় তবে তারা সকলে পরিত্রাণ পাবে”।
অন্য হাদীস: ইমাম আহমাদ রহ. বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী উম্মু সালামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন,«إِذَا ظَهَرَتِ الْمَعَاصِي فِي أُمَّتِي عَمَّهُمُ اللَّهُ بِعَذَابٍ مِّنْ عِنْدِهِ» فَقُلْتُ؟ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَمَا فِيهِمْ أُنَاسٌ صَالِحُونَ؟ قَالَ: «بَلَى» قَالَتْ: فَكَيْفَ يَصْنَعُ أُولَئِكَ؟ قَالَ: «يُصِيبُهُمْ مَا أَصَابَ النَّاسُ ثُمَّ يَصِيرُونَ إلى مَغْفِرَةٍ مِّن الله ورضوان» “আমার উম্মাতের মাঝে যদি পাপাচারিতা প্রকাশ পায় তবে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পক্ষ থেকে সকলকে শাস্তি প্রদান করবেন”। আমি বলি: হে আল্লাহর রাসূল, তাদের মাঝে কি সৎকর্মশীল বান্দা নেই? তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “অবশ্যই”, তিনি বলেন, তবে তাদের কী হবে? “তারাও লোকেদের মতো আক্রান্ত হবে তবে তাদের পরিসমাপ্তি ঘটবে আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা ও সন্তুষ্টি নিয়ে”।
﴿وَٱذۡكُرُوٓاْ إِذۡ أَنتُمۡ قَلِيلٞ مُّسۡتَضۡعَفُونَ فِي ٱلۡأَرۡضِ تَخَافُونَ أَن يَتَخَطَّفَكُمُ ٱلنَّاسُ فَ‍َٔاوَىٰكُمۡ وَأَيَّدَكُم بِنَصۡرِهِۦ وَرَزَقَكُم مِّنَ ٱلطَّيِّبَٰتِ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ٢٦﴾ [الانفال: ٢٦]
অর্থানুবাদ:
“স্মরণ কর সে সময়ের কথা যখন তোমরা ছিলে সংখ্যায় অল্প, দুনিয়াতে তোমাদেরকে দুর্বল হিসেবে গণ্য করা হত। তোমরা আশঙ্কা করতে যে, মানুষেরা তোমাদের কখন না হঠাৎ ধরে নিয়ে যায়। এমন অবস্থায় তিনি তোমাদেরকে আশ্রয় দিলেন, তাঁর সাহায্য দিয়ে তোমাদেরকে শক্তিশালী করলেন, তোমাদের উত্তম জীবিকা দান করলেন যাতে তোমরা (তাঁর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ২৬]
তাফসীর:
মুসলিমবৃন্দকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে তারা ইতোপূর্বে হীন ও দুর্বল ছিল এবং এরপর তারা শক্তিশালী ও বিজয়ী হয়:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মুমিন বান্দাগণকে তাঁর নি‘আমত ও দয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, তারা স্বল্প সংখ্যক ছিল এরপর তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেন, তারা ছিল দুর্বল, ভীতসন্ত্রস্ত এরপর তিনি তাদেরকে শক্তিশালী ও বিজয়ী করেন। তারা ছিল দরিদ্র এরপর তিনি তাদেরকে জীবন-জিবীকা দান করেন, তিনি তাদেরকে আদেশ দেন তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে। এরপরে তারা তাঁর আনুগত্য করে, তাঁর সকল নির্দেশ মেনে নেয়, এ ছিল মুমিনগণের অবস্থা। মুমিনগণ যখন মক্কায় ছিল তারা সংখ্যায় ছিল অল্প, তারা কাফেরদের অত্যাচার ও ভয়ে গোপনে দীন চর্চা করত। তারা ভয় করত যে আল্লাহ তা‘আলার সমগ্র জমিন থেকে মুশরিক, অগ্নি উপাসক এবং রোমানরা তাদেরকে অপহরণ করে নিয়ে যাবে, এরা সকলে ছিল তাদের শত্রু। বিশেষ করে তারা যখন ছিল স্বল্পসংখ্যক এবং তাদের শক্তি ছিল না। তাদের এ অবস্থা যখন চলতে থাকে তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে নির্দেশ দেন মদীনায় হিজরত করতে এরপর তিনি তাঁদেরকে সেখানে আশ্রয় দেন, তাদের জন্য এখানকার লোকেরদেরকে নিয়োজিত করেন, তারা তাদেরকে আশ্রয় দেন আর বদর ও অন্যান্য যুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করেন। তারা হিজরতকারীদেরকে সম্পদ দিয়ে সহযোগিতা করেন আর তাদেরকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য তাদের জীবন প্রদান করেন।
কাতাদা ইবন দি‘আমা আস-সাদূসী রহ. وَٱذۡكُرُوٓاْ إِذۡ أَنتُمۡ قَلِيلٞ مُّسۡتَضۡعَفُونَ فِي ٱلۡأَرۡضِ “স্মরণ কর সে সময়ের কথা যখন তোমরা ছিলে সংখ্যায় অল্প, দুনিয়াতে তোমাদেরকে দুর্বল হিসেবে গণ্য করা হত” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন, আরবরা ছিল দুর্বলদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল জাতি, তাদের জীবন-যাপন ছিল কষ্টকর, তারা ছিল ক্ষুধার্ত, নাঙ্গা পা আর ছিল স্পষ্টত বিভ্রান্ত। তাদের মাঝে যে বসবাস করত সে বসবাস করত দুর্ভাগ্য নিয়ে, তাদের মাঝে যে মারা যেত সে যেত নরকে, তারা ছিল অন্যের খোরাক; কিন্তু অন্যদের তারা ভক্ষন করতে ছিল অক্ষম। আল্লাহর শপথ, জমিনের ওপর সে সময়ে এমন কোনো লোকেদের কথা আমাদের জানা নেই যে, তাদের জীবন ছিল তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট। এমন সময় আল্লাহ তা‘আলা ইসলাম নিয়ে আসেন, তিনি জমিনের উপর এর প্রভাব বিস্তার করেন। এরপর তিনি তাদেরকে জীবন-জীবিকা এবং লোকেদের ঘাড়ের উপর নেতৃত্ব প্রদান করেন। আল্লাহ তা‘আলা ইসলামের মাধ্যমে তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা তোমরা দেখতে পাচ্ছ, কাজেই তোমরা আল্লাহ তা‘আলার নি‘আমতের জন্য তাঁর শুকরিয়া আদায় কর। আল্লাহ তা‘আলা নি‘আমত দান করেন আর কৃতজ্ঞতা পছন্দ করেন। আর আল্লাহ তা‘আলা শুকরিয়া আদায়কারীদেরকে আরও বেশি বাড়িয়ে দেন।  
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَخُونُواْ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَ وَتَخُونُوٓاْ أَمَٰنَٰتِكُمۡ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٧ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّمَآ أَمۡوَٰلُكُمۡ وَأَوۡلَٰدُكُمۡ فِتۡنَةٞ وَأَنَّ ٱللَّهَ عِندَهُۥٓ أَجۡرٌ عَظِيمٞ ٢٨﴾ [الانفال: ٢٧، ٢٨]
অর্থানুবাদ:
“হে মুমিনগণ! তোমরা জেনে বুঝে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করো না, আর যে বিষয়ে তোমরা আমানাত প্রাপ্ত হয়েছ তাতেও বিশ্বাস ভঙ্গ করো না। জেনে রেখ, তোমাদের ধন-সম্পদ আর সন্তান-সন্ততি হচ্ছে পরীক্ষার সামগ্রী মাত্র। (এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হবে তাদের জন্য) আল্লাহর নিকট রয়েছে মহাপুরস্কার”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ২৭-২৮]
তাফসীর:
আয়াতের শানে নুযূল এবং খিয়ানাত থেকে নিষেধাজ্ঞা
আব্দুল্লাহ ইবন আবু কাতাদা এবং যুহরী রহ. বলেন, আয়াতটি আবু লুবাবাহ ইবন আব্দুল মুনযির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বনু কুরাইযার নিকট পাঠান; যাতে তিনি তাদের রাসূলুল্লাহর ফয়সালা মেনে নেওয়ার প্রতি আহ্বান করেন। তারা তার নিকট পরামর্শ চাইলে তিনি তাদের তার গলার দিকে ইশারা করেন এবং তিনি বুঝিয়ে দেন যে, তাদের পরিণতি জবেহ -হত্যা। অতঃপর আবু লুবাবাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বুঝতে পারেন যে, তিনি আল্লাহ ও তার রাসূলের খিয়ানত করেছেন। তারপর তিনি শপথ করলেন, তিনি কোনো কিছুই খাবেন না এবং পান করবেন না যতক্ষণ না তিনি মারা যান বা আল্লাহ তা‘আলা তার তাওবা কবুল করেন। তিনি মদীনার মসজিদে গমন করেন এবং মসজিদের একটি খুঁটিতে তিনি নিজেকে বেঁধে রাখেন। এভাবে তিনি নয় দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। ফলে তার অবস্থা এমন হত, মাঝে মাঝে তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে যেতেন। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তার তাওবা কবুল করেন। লোকেরা তার নিকট তার তাওবা কবুল হওয়ার সু-সংবাদ নিয়ে আসেন এবং খুঁটি থেকে তাকে ছাড়ানোর ইচ্ছা করেন। তখন তিনি শপথ করলেন যতক্ষণ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে তার বাঁধন খুলবেন না, ততক্ষণ তিনি মুক্ত হবেন না। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বাঁধন খুললে তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল আমি আমার সমস্ত সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার মান্নত করেছি। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এক তৃতীয়াংশ সদকা করাই তোমার জন্য যথেষ্ট।  
ইবন জারির রহ. বলেন, এ আয়াতটি উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হত্যা করা বিষয়ে নাযিল হয়। সহীহ বুখারী এবং মুসলিমে হাতিব ইবন আবু বালতা‘আহ-এর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, মক্কা বিজয়ের বৎসর তিনি কুরাইশ কাফেরদেরকে পত্র লিখে জানান যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রতি যাত্রার ইচ্ছা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে এ বিষয়টি জানিয়ে দেন। পত্রের খোঁজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোক পাঠান, পত্রটি ফিরিয়ে আনেন আর হাতিবকে উপস্থিত করেন, তিনি তাঁর কর্ম স্বীকার করেন। এ সময় উমার ইবনল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু দাঁড়িয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে ছাড়ুন, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দিই, কেননা সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «دَعْهُ فَإِنَّهُ قَدْ شهد بدراً وما يُدْرِيكَ لَعَلَّ اللَّهَ اطَّلَعَ عَلَى أَهْلِ بَدْرٍ» فَقَالَ: «اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ» রাখ, সে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, (অর্থাৎ বদরী সাহাবী), কিসে তোমাকে জানাবে যে, সম্ভবত আল্লাহ তা‘আলা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি তাকিয়ে বলেন, তোমাদের যা খুশি কর, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
আমি বলি: বিশুদ্ধ কথা হলো, আয়াতটি ব্যাপক। যদিও এ কথা সত্য যে, আয়াতটি নির্দিষ্ট কারণে অবতীর্ণ হয়েছে, অধিকাংশ আলেমের মত হলো,  সার্বিক শব্দ গ্রহণ করা, কোনো কারণের সাথে নির্দিষ্ট না করা।
খিয়ানত ছোট-বড়, ব্যক্তিগত ও সামাজিক সব ধরণের গোনাহকে শামিল করে। আলী ইবন আবু তালহা রহ. বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, আমানত হলো, এমন কিছু কর্ম যার ওপর আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের বিশ্বাস করেন অর্থাৎ ফরয। তিনি বলেন, لاتَخُونُوا “বিশ্বাসঘাতকতা করো না” তোমরা ফরয বিষয়গুলো ভঙ্গ করো না। সুদ্দী বলেন, যখন তারা আল্লাহ ও রাসূলের খিয়ানত করে, তখন তারা প্রকৃতপক্ষে তাদের নিজেদের আমানতেরই খিয়ানত করে। তিনি আরো বলেন, তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো কথা শোনতো তারপর তা এমনভাবে প্রচার করত তা মুশরিকদের নিকট পৌঁছে যেত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّمَآ أَمۡوَٰلُكُمۡ وَأَوۡلَٰدُكُمۡ فِتۡنَةٞ “জেনে রেখ, তোমাদের ধন-সম্পদ আর সন্তান- সন্ততি হচ্ছে পরীক্ষার সামগ্রী মাত্র” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ২৮] অর্থাৎ তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ, তিনি তোমাদেরকে এগুলো দিয়েছেন এটি জানার জন্য যে, তোমরা কি এ জন্য শুকরিয়া আদায় কর, আর এদের ক্ষেত্রে তাঁর আনুগত্য কর নাকি তাঁকে ভুলে গিয়ে এদেরকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়, তাঁকে বাদ দিয়ে এদের প্রতি নিবেদিত হও। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿إِنَّمَآ أَمۡوَٰلُكُمۡ وَأَوۡلَٰدُكُمۡ فِتۡنَةٞۚ وَٱللَّهُ عِندَهُۥٓ أَجۡرٌ عَظِيمٞ ١٥﴾ [التغابن : ١٥] “তোমাদের ধন-সম্পদ আর সন্তানাদি পরীক্ষার বস্তু মাত্র আর আল্লাহ এমন যাঁর কাছে আছে মহা পুরস্কার”। [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৫] তিনি বলেন, ﴿وَنَبۡلُوكُم بِٱلشَّرِّ وَٱلۡخَيۡرِ فِتۡنَةٗۖ ٣٥﴾ [الانبياء: ٣٥] “আমি তোমাদেরকে ভালো ও মন্দ দ্বারা পরীক্ষা করি”। [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১৫] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُلۡهِكُمۡ أَمۡوَٰلُكُمۡ وَلَآ أَوۡلَٰدُكُمۡ عَن ذِكۡرِ ٱللَّهِۚ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ٩﴾ [المنافقون: ٩] “হে মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ আর তোমাদের সন্তানাদি তোমাদেরকে যেন আল্লাহর স্মরণ হতে গাফিল করে না দেয়। যারা এমন করবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত”। [সূরা আল-মুনাফিকুন, আয়াত: ৯] তিনি আরো বলেন,﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّ مِنۡ أَزۡوَٰجِكُمۡ وَأَوۡلَٰدِكُمۡ عَدُوّٗا لَّكُمۡ فَٱحۡذَرُوهُمۡۚ ١٤﴾ [التغابن : ١٤] “হে মুমিনগণ! তোমাদের স্ত্রী আর সন্তানদের মধ্যে কতক তোমাদের শত্রু। কাজেই তোমরা তাদের হতে সতর্ক হও” [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৪]
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَأَنَّ ٱللَّهَ عِندَهُۥٓ أَجۡرٌ عَظِيمٞ “আল্লাহর নিকট রয়েছে মহাপুরস্কার” অর্থাৎ ধন-সম্পদ এবং সন্তান-সন্তুতির চেয়ে তাঁর সাওয়াব, তাঁর দান এবং তাঁর জান্নাত উত্তম। কেননা কখনও তাদের মধ্য থেকে তোমাদের শত্রু পাওয়া যায়, তাদের অধিকাংশই তোমাদের কোনো উপকারে আসে না। আর আল্লাহ তা‘আলা হচ্ছেন দুনিয়া ও আখিরাতে কর্তৃত্বশীল, অধিপতি। কিয়ামত দিবসে তাঁর নিকট রয়েছে অঢেল সাওয়াব। বিশুদ্ধ বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «ثَلَاثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وجد حَلَاوَةَ الْإِيمَانِ: مَنْ كَانَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَمَنْ كَانَ يُحِبُّ الْمَرْءَ لَا يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ، وَمَنْ كَانَ أَنْ يُلْقَى فِي النَّارِ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ أَنْ يَرْجِعَ إِلَى الْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنْقَذَهُ اللَّهُ منه» “যার মাঝে তিনটি বিষয় রয়েছে এর দ্বারা সে ঈমানের স্বাদ পায়, যার নিকট আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল অন্যের চেয়ে অধিক প্রিয় হয়, যে ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসে, সে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালোবাসে, যার নিকট কুফুরীতে ফিরে যাওয়ার চেয়ে আগুনে ঝাঁপ দেওয়া অধিক প্রিয় হয় যখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে কুফুরী থেকে বাঁচিয়েছেন”।  বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা সন্তান-সন্তুতি এবং নিজের নফসের চেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া বাঞ্ছনীয়। যেমন, সহীহ হাদীসে প্রমাণিত হয়, তিনি বলেন, «وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ نَفْسِهِ وَأَهْلِهِ وَمَالِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ». “যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না যে পর্যন্ত না আমি তার নিকট তার নিজের চেয়ে, তার পরিবার-পরিজনের চেয়ে, তার সম্পদের চেয়ে এবং সকল মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হই”।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن تَتَّقُواْ ٱللَّهَ يَجۡعَل لَّكُمۡ فُرۡقَانٗا وَيُكَفِّرۡ عَنكُمۡ سَيِّ‍َٔاتِكُمۡ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡۗ وَٱللَّهُ ذُو ٱلۡفَضۡلِ ٱلۡعَظِيمِ ٢٩﴾ [الانفال: ٢٩]
অর্থনুবাদ:
“ওহে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর তাহলে তিনি তোমাদেরকে ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার শক্তি প্রদান করবেন, তোমাদের দোষ-ত্রুটি ক্ষতিপূরণ করে দিবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন, আর আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহশীল”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ২৯]
তাফসীর:
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা, সুদ্দী, মুজাহিদ, ইকরিমা, দাহ্হাক, কাতাদা এবং মুকাতিল ইবন হাইইয়ান রহ. সহ অন্যান্যরা বলেন, فُرۡقَانٗا “ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার শক্তি” বের হওয়ার পথ। মুজাহিদ রহ. অতিরিক্ত সংযোজন করে বলেন, দুনিয়া ও আখিরাতে। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার অপর এক বর্ণনায় রয়েছে فُرۡقَانٗا “ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার শক্তি” হচ্ছে, নাজাত। অপর বর্ণনায়, সাহায্য। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক রহ. বলেন, فُرۡقَانٗا (শব্দের অর্থ হচ্ছে) ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করা। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাকের এ তাফসীর পূর্বে বর্ণিত তাফসীর থেকে ব্যাপক আর তা সে সবগুলোকে আবশ্যক করে। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশিত বিষয়গুলো পালন করে এবং তার নিষেধকৃত বিষয়গুলো বর্জন করার মাধ্যমে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তাকে মিথ্যা থেকে সত্য চেনার তাওফীক দান করেন। আর তাই হচ্ছে তার বিজয় ও পরিত্রাণের কারণ, দুনিয়াবী বিষয় থেকে বের হওয়ার পথ এবং কিয়ামত দিবসে সৌভাগ্যবান হওয়ার উপায়। তার গোনাহগুলো মোচন হবে, সেগুলোর ক্ষমা, লোকদের থেকে সেগুলো আড়াল হবে। যা আল্লাহ তা‘আলার অঢেল সাওয়ার অর্জিত হওয়ার কারণ। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَءَامِنُواْ بِرَسُولِهِۦ يُؤۡتِكُمۡ كِفۡلَيۡنِ مِن رَّحۡمَتِهِۦ وَيَجۡعَل لَّكُمۡ نُورٗا تَمۡشُونَ بِهِۦ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٢٨﴾ [الحديد: ٢٨] “ওহে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর আর তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন, তিনি তাঁর অনুগ্রহে তোমাদেরকে দ্বিগুণ পুরস্কার দিবেন আর তিনি তোমাদের জন্য আলোর ব্যবস্থা করবেন যা দিয়ে তোমরা পথ চলবে, আর তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু”। [সূরা আল-হাদীদ, আয়াত: ২৮]
﴿وَإِذۡ يَمۡكُرُ بِكَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ لِيُثۡبِتُوكَ أَوۡ يَقۡتُلُوكَ أَوۡ يُخۡرِجُوكَۚ وَيَمۡكُرُونَ وَيَمۡكُرُ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَيۡرُ ٱلۡمَٰكِرِينَ ٣٠﴾ [الانفال: ٣٠]
অর্থানুবাদ:
“স্মরণ কর, সেই সময়ের কথা যখন কাফেরগণ তোমাকে বন্দী করার কিংবা হত্যা করার কিংবা দেশ থেকে বের করে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করে। তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহও কৌশল করেন। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৩০]
তাফসীর:
মক্কাবাসীদের দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা অথবা বন্দী অথবা বিতাড়নের পরিকল্পনা:
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা, মুজাহিদ এবং কাতাদা রহ. বলেন, لِيُثْبِتُوكَ “তোমাকে বন্দী করার, তোমাকে কয়েদ করার। আতা ও ইবন যায়িদ বলেন, এর অর্থ, যাতে তোমাকে বন্দী করে। সুদ্দী রহ. বলেন, الإثبات শব্দের অর্থ হচ্ছে, বন্দী করা, বাঁধা। এ কথা সব কথাকে শামিল করে। এটিই সব মতামতের সারাংশ। যখন কোনো ব্যক্তি কারো ক্ষতি চায় তখন এ ধরনের অর্থের শব্দই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।  
ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন, মাগাযীর গ্রন্থকার ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক ইবন ইয়াসার রহ. আব্দুল্লাহ ইবন আবু নাজীহ রহ. থেকে বর্ণনা করেন, (তিনি) মুজাহিদ রহ. থেকে, (তিনি) আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে। অনুরূপ মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন, হাদীস বর্ণনা করেন আমার নিকট কালবী, (তিনি) ইম্মু হানীর আযাদকৃত গোলাম বাযান থেকে, (তিনি) আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে: কুরাইশের প্রত্যেক সম্ভ্রান্ত গোত্রের একদল লোক দারুন নাদওয়ায় (তাদের সম্মেলন কেন্দ্রে) প্রবেশের জন্য একত্রিত হয়, এ সময় শয়তান এক বিশিষ্ট ব্যক্তির বেশ ধরে এসে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে, তারা যখন তাকে দেখে তখন বলে: তুমি কে? সে বলে নজদের এক প্রবীণ ব্যক্তি, শুনেছি তোমরা একত্রিত হয়েছে, ফলে আমি তোমাদের সম্মেলনে উপস্থিত হবার ইচ্ছা করেছি, তোমরা আমার মতামত ও উপদেশ দ্বারা উপকৃত হবে। তারা বলে: বেশ তো, প্রবেশ কর। তখন সে তাদের সাথে প্রবেশ করে। সে বলে: এ লোকের (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) ব্যাপারে তোমাদের চিন্তা-ভাবনা করতে হবে, আল্লাহর শপথ, সে শীঘ্রই তার দীনের মাধ্যমে তোমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে। তাদের মধ্যে জনৈক ব্যক্তি বলে: তাকে কারারুদ্ধ করে রাখ আর তার মৃত্যু পর্যন্ত তাকে জিঞ্জিরে বেঁধে রাখ যেভাবে তার পূর্বে বিভিন্ন কবি মারা গেছে (যেমন) যুহাইর, নাবিগাহ, সে তো তাদেরই একজন। তখন আল্লাহর শত্রু নজদী শাইখ (শয়তান) চিৎকার করে বলে: আল্লাহর শপথ, এটি কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নয়, আল্লাহর শপথ, অবশ্যই তার প্রতিপালক তাকে বন্দীদশা থেকে বের করে তার সাথীদের কাছে নিয়ে যাবে। তারা তোমাদের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করবে। তারা তোমাদের থেকে তাকে রক্ষা করবে, আর আমি তোমাদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত নই যে, তারা তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বের করে দিবে না। তারা বলে: এ প্রবীণ ঠিকই বলেছে: তোমরা অন্য কোনো চিন্তা কর। তাদের মধ্যে জনৈক বলে: তোমরা তাকে তোমাদের মাঝে থেকে বের করে দাও আর এভাবে তার থেকে নিষ্কৃতি লাভ কর, কেননা সে যখন বের হয়ে যাবে তখন তোমরা তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, যাই সে করুক না কেন, আর যেখানেই সে যাক না কেন, যখন তোমাদের থেকে তার জ্বালাতন দূর হবে তখন তোমরা আরাম পাবে আর অন্য লোকেরা তার খপ্পরে পড়বে। তখন নজদের শাইখ (শয়তান) বলে: আল্লাহর শপথ, তোমাদের জন্য এ সিদ্ধান্ত উপযুক্ত নয়, তোমরা কি তার সুমিষ্ট ভাষা ও অনর্গল কথা-বার্তার ব্যাপারে অবগত নও, তোমরা তার যে কথা শোন তাতে কি হৃদয় কাড়ে না? আল্লাহর শপথ, এভাবে সে আরবদের থেকে আরও বেশি অনুসারী সংগ্রহ করবে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হবে এরপর তোমাদের নিকট এসে তোমাদেরকে তোমাদের এলাকা থেকে বের করে দিবে আর তোমাদের সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা করবে। তারা বলে: আল্লাহর শপথ, সে সত্য বলেছে, তোমরা অন্য কোনো পন্থা অনুসন্ধান কর, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, তখন আবু জাহল (তার ওপর আল্লাহ তা‘আলার লা‘নত) বলল: আল্লাহর শপথ, আমি তোমাদেরকে এমন এক পরামর্শ দিব যা এখন পর্যন্ত তোমাদের কেউ দিতে পারে নি। আর আমি এর চেয়ে ভালো কোনো মতামত আছে বলে মনে করি না, তারা বলে: কী সেটা? সে বলল: তোমরা প্রত্যেক গোত্র থেকে শক্তিশালী এবং সমাজে প্রভাব রয়েছে এমন একজন করে যুবক নাও, এরপর এদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে ধারালো তরবারী দিয়ে দাও এরপর তারা সকলে মিলে তাকে এক ব্যক্তি আঘাতের মতো আঘাত করবে। এরপর যখন তারা তাকে হত্যা করবে তখন তার রক্তের বদলা সকল গোত্রের ওপর পড়বে। আমি মনে করি না যে, বনী হাশিমের এ গোত্রটি সকল কুরাইশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে, যখন তারা সেটা বুঝতে পারবে তখন রক্তপণ গ্রহণ করবে। আর এভাবে আমরা আরাম পাব আর আমাদের থেকে তার জ্বালাতন বন্ধ হবে। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, নজদের শাইখ (শয়তান) বলল: আল্লাহর শপথ, এ লোক সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে। এছাড়া আমি আর কোনো মতামত সমর্থন করি না। এরপর তারা দ্রুত তাদের সম্মেলন শেষ করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে। এদিকে জিবরীল আলাইহিস সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে তাঁকে নির্দেশ দেন যেন তিনি সে রাতে তাঁর বিছানায় না ঘুমান আর তাঁকে লোকদের চক্রান্তের কথা জানিয়ে দেন। সে রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গৃহে ঘুমান নি। সে সময় আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে (মক্কা থেকে) বের হয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন। আর তাঁর মদীনায় আগমনের পরে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ওপর সূরা আল-আনফাল অবতীর্ণ করেন আর তাতে তিনি তাঁকে প্রদত্ত তাঁর নি‘আমতের কথা স্মরণ করিয়ে দেন আরও যে বিপদে তিনি ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَإِذۡ يَمۡكُرُ بِكَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ لِيُثۡبِتُوكَ أَوۡ يَقۡتُلُوكَ أَوۡ يُخۡرِجُوكَۚ وَيَمۡكُرُونَ وَيَمۡكُرُ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَيۡرُ ٱلۡمَٰكِرِينَ “স্মরণ কর, সেই সময়ের কথা যখন কাফেরগণ তোমাকে বন্দী করার কিংবা হত্যা করার কিংবা দেশ থেকে বের করে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করে। তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহও কৌশল করেন। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী”। আর তাদের উক্তি تربصوا به ريب المنون ‘তোমরা তার বের হওয়ার প্রতীক্ষা কর’ (যাতে সে ধ্বংস হয়, যেমনিভাবে পূর্বের কবিরা ধ্বংস হয়।) সম্পর্কে অবতীর্ণ করেন: ﴿أَمۡ يَقُولُونَ شَاعِرٞ نَّتَرَبَّصُ بِهِۦ رَيۡبَ ٱلۡمَنُونِ ٣٠﴾ [الطور: ٢٩] “তারা কি বলছে, ‘সে (মুহাম্মাদ) একজন কবি? আমরা তার মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছি।’ তারা তার কালচক্রের (বিপদাপদের) অপেক্ষা করেছে যাতে করে সে সেভাবেই ধ্বংস হয়ে যায় যেভাবে তার পূর্ববর্তী কবিগণ ধ্বংস হয়েছিল। যেদিন তারা এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল সে দিনটিকে يوم الزحمة একত্রিত হওয়ার (ভিড় করার) দিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ, তারা এ দিন বিভিন্ন মতামত দিয়ে থাকেন।
আল্লাহ তা‘আলা তাকে তারা বের করে দেওয়ার ইচ্ছা করলে তাদের বিষয়ে এ বাণী ﴿وَإِن كَادُواْ لَيَسۡتَفِزُّونَكَ مِنَ ٱلۡأَرۡضِ لِيُخۡرِجُوكَ مِنۡهَاۖ وَإِذٗا لَّا يَلۡبَثُونَ خِلَٰفَكَ إِلَّا قَلِيلٗا ٧٦﴾ [الاسراء: ٧٦]   “আর তাদের অবস্থা এমন ছিল যে, তারা তোমাকে যমীন থেকে উৎখাত করে দেবে, যাতে তোমাকে সেখান থেকে বের করে দিতে পারে এবং তখন তারা তোমার পরে স্বল্প সময়ই টিকে থাকতে পারত” নাযিল করেন। ইবন ইসহাক রহ. বলেন, তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা করতে থাকেন, তারপর যখন মক্কার কুরাইশরা একত্র হলো এবং তার বিপক্ষে ষড়যন্ত্র করল এবং তারা তাদের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করার প্রত্যয় গ্রহণ করল, ঠিক তখন তার নিকট জিবরীল আ. এসে তাকে নির্দেশ দেন যে, তিনি যেন তার স্বীয় বিছানায় না ঘুমায়। তিনি আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ডেকে নির্দেশ দেন তিনি যেন তার বিছানায় ঘুমায় এবং সবুজ চাদর যেন গায়ের উপর দিয়ে থাকে। তিনি তাই করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মাঝখান দিয়ে বের হয়ে পড়লেন যখন তারা তার দরজায় অবস্থান করছিল। তিনি হাতে করে এক মুষ্টি বালি নিলেন আর সেগুলোকে তাদের মাথার উপর ছিটিয়ে দিলেন আর আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় নবীর পক্ষ থেকে তা তাদের চোখের মধ্যে ঢেলে দিলেন। আর তিনি পড়েছেন ﴿يسٓ ١ وَٱلۡقُرۡءَانِ ٱلۡحَكِيمِ ٢﴾ [يس: ١، ٢] থেকে ﴿فَأَغۡشَيۡنَٰهُمۡ فَهُمۡ لَا يُبۡصِرُونَ ٩﴾ [يس: ٩] পর্যন্ত।  হাফেয আবূ বকর আল-বাইহাকী বলেন, ইকরিমা থেকে এমন বর্ণনা পাওয়া যায় যা এর সমর্থন করে।
ইবন হিব্বান রহ. স্বীয় সহীহতে এবং হাকিম রহ. স্বীয় মুস্তাদরাকে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন, ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা কন্দনরত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট প্রবেশ করেন। তিনি বললেন, হে আমার কন্যা তুমি কেন কাঁদছ? ফাতেমা বললেন, হে পিতা আমি কেন কাঁদব না, কুরাইশরা কা‘বার হিজরে লাত, উয্যা ও মানাত-এর শপথ করেছে, তারা যখন আপনাকে দেখতে পাবে, তারা আপনার ওপর আক্রমণ করবে এবং আপনাকে হত্যা করে ফেলবে। তাদের প্রত্যেকেই আপনার খুন করার অংশটুকু সম্পর্কে জানে। তারপর তিনি বললেন, হে আমার কন্যা তুমি আমার জন্য অযুর পানি নিয়ে আস, তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অযু করলেন, তারপর তিনি মসজিদে গমন করলেন। যখন তারা তাকে দেখতে পেল, তারা বলল, এইতো সেই ব্যক্তি, তাদের গর্দান তাদের হাতের সামনে পড়ে গেল। তারা আর তাদের চোখ উঠাতে পারল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মুষ্টি মাটি হাতে নিলেন আর তা তাদের প্রতি নিক্ষেপ করলেন এবং বললেন, «شَاهَتِ الْوُجُوهُ» তাদের যার দেহে এ বালি কণা থেকে কোনো একটি আঘাত হেনেছে সে বদরের যুদ্ধে কাফের অবস্থায় মারা গিয়েছে। হাকিম বলেন, মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদীস বিশুদ্ধ, ইমাম বুখারী ও মুসলিম হাদীসটি উল্লেখ না করার কারণ আমার জানা নেই।
উরওয়াহ ইবনুয যুবাইর وَيَمۡكُرُونَ وَيَمۡكُرُ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَيۡرُ ٱلۡمَٰكِرِينَ“তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহও কৌশল করেন। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন, আমি তাদের বিরুদ্ধে বড়ই মজবুত কৌশল করি এমনকি আমি তোমাকে তাদের থেকে মুক্ত করি।
﴿وَإِذَا تُتۡلَىٰ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتُنَا قَالُواْ قَدۡ سَمِعۡنَا لَوۡ نَشَآءُ لَقُلۡنَا مِثۡلَ هَٰذَآ إِنۡ هَٰذَآ إِلَّآ أَسَٰطِيرُ ٱلۡأَوَّلِينَ ٣١ وَإِذۡ قَالُواْ ٱللَّهُمَّ إِن كَانَ هَٰذَا هُوَ ٱلۡحَقَّ مِنۡ عِندِكَ فَأَمۡطِرۡ عَلَيۡنَا حِجَارَةٗ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ أَوِ ٱئۡتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيمٖ ٣٢ وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمۡ وَأَنتَ فِيهِمۡۚ وَمَا كَانَ ٱللَّهُ مُعَذِّبَهُمۡ وَهُمۡ يَسۡتَغۡفِرُونَ ٣٣﴾ [الانفال: ٣١، ٣٣]
অর্থানুবাদ:
“তাদের কাছে যখন আমাদের আয়াত পাঠ করা হয় তখন তারা বলে, ‘শুনলাম তো, ইচ্ছে করলে এ রকম কথা আমরাও বলতে পারি, এগুলো তো আগে কালের কেচ্ছা কাহিনী ছাড়া আর কিছুই না।’ স্মরণ কর, যখন তারা বলেছিল, ‘হে আল্লাহ! এটি যদি তোমার নিকট থেকে (প্রেরিত) সত্য (দীন) হয় তাহলে আমাদের উপর আসমান থেকে পাথর বর্ষণ কর কিংবা আমাদের ওপর কোনো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি নিয়ে এসো।’ আপনি তাদের মাঝে থাকাবস্থায় আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না এবং যখন তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে এরূপ অবস্থায়ও আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৩০-৩১]
তাফসীর:
কুরাইশদের ধারণা কুরআনের মতো (গ্রন্থ) তারা বানাতে পারবে:
আল্লাহ তা‘আলা কুরাইশদের কুফুরী, বিদ্রোহ, একগুঁয়েমী এবং কুরআনের আয়াত যখন তাদের সম্মুখে তিলাওয়াত করা হয় তখন তা শ্রবণের সময় তাদের বাতিল দাবি সম্পর্কে তুলে ধরে অবহিত করছেন যে, তারা বলে: قَدۡ سَمِعۡنَا لَوۡ نَشَآءُ لَقُلۡنَا مِثۡلَ هَٰذَآ ‘‘শুনলাম তো, ইচ্ছে করলে এ রকম কথা আমরাও বলতে পারি” এটি শুধু তাদের মুখের কথা কাজের নয়, তাদেরকে তো বহুবার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে কুরআনের একটি সূরার মতো সূরা নিয়ে আসতে; কিন্তু এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার তাদের কোনো উপায় ছিল না। তারা এ কথা বলে নিজেদেরকে এবং তাদের বাতিলের ওপর যারা অনুসরণ করে তাদেরকে বিভ্রান্ত করে। কেউ কেউ বলেন, এ কথা বলেছিল আন-নাদ্বর ইবনুল হারিস (তার ওপর আল্লাহ তা‘আলার অভিশাপ)। সা‘ঈদ ইবন জুবাইর, সুদ্দী, ইবন জুরাইয রহ.-সহ অন্যান্যদের থেকে এটি বর্ণিত হয়েছে, সে (তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ) পারস্যে গমন করে এবং সেখানকার রাজা-বাদশাহদের কিসসা-কাহিনী শিখে যেমন, রুস্তম, আসফানদিয়ার, সে ফিরে এসে দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তা‘আলা নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন, তিনি লোকেদের সম্মুখে কুরআন তিলাওয়াত করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাঁর মজলিশ সমাপ্ত করে উঠতেন নদ্বর তখন সেই মজলিসে বসে ঐ সমস্ত লোকেদের কিসসা-কাহিনী বর্ণনা করত। এরপর বলত: আল্লাহর শপথ, (বল দেখি) কে বেশি সুন্দর কিসসা বলে, আমি নাকি মুহাম্মাদ? এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বদরের যুদ্ধে যখন তার ওপর ক্ষমতা প্রদান করেন, সে বন্দী হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। ফলে তাঁর সম্মুখে তাকে হত্যা করা হয়। (আল্লাহ তা‘আলা জন্য সকল প্রশংসা) যিনি তাকে বন্দী করেন তিনি হলেন, মিকদাদ ইবন আসওয়াদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু। যেমনটি বললেন ইবন জারীর রহ.। সা‘ঈদ ইবন জুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, নবী সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের দিন উকবা ইবন আবু মু‘আইত ও তু‘আইমাহ ইবন আদী এবং নদ্বর ইবনুল হারেসকে হত্যা করেন। মিকদাদ রা. নদ্বরকে বন্দী করেছিলেন। যখন তাকে হত্যা করার নির্দেশ দিলেন তখন মিকদাদ বললেন, হে আল্লাহ রাসূল আমার বন্দী। তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে খারাপ কথা বলত, তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। তখন মিকদাদ বললেন, হে আল্লাহ রাসূল আমার বন্দী। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আল্লাহ তুমি তোমার রহমত দ্বারা মিকদাদকে যথেষ্ট করে দাও, তখন মিকদাদ বললেন, আমি এ জিনিষটি চেয়েছিলাম। তিনি বলেন, তার সম্পর্কে এ আয়াত وَإِذَا تُتۡلَىٰ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتُنَا قَالُواْ قَدۡ سَمِعۡنَا لَوۡ نَشَآءُ لَقُلۡنَا مِثۡلَ هَٰذَآ إِنۡ هَٰذَآ إِلَّآ أَسَٰطِيرُ ٱلۡأَوَّلِينَ তাদের কাছে যখন আমাদের আয়াত পাঠ করা হয় তখন তারা বলে, ‘শুনলাম তো, ইচ্ছে করলে এ রকম কথা আমরাও বলতে পারি, এগুলো তো আগে কালের কেচ্ছা কাহিনী ছাড়া আর কিছুই না।’ নাযিল হয়।
আল্লাহ তা‘আলার  أَسَاطِيرُ الأوَّلِينَ “আগে কালের কেচ্ছা কাহিনী” এর অর্থ হচ্ছে أساطير শব্দের একবচন হচ্ছে أسطورة অর্থাৎ তাদের বইপুস্তক যা সে শিখেছে, অর্থাৎ সে সেখান থেকে শিখে লোকেদের নিকট তিলাওয়াত করে, এটি হচ্ছে চরম মিথ্যা। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে অপর এক আয়াতে বলেন, ﴿وَقَالُوٓاْ أَسَٰطِيرُ ٱلۡأَوَّلِينَ ٱكۡتَتَبَهَا فَهِيَ تُمۡلَىٰ عَلَيۡهِ بُكۡرَةٗ وَأَصِيلٗا ٥ قُلۡ أَنزَلَهُ ٱلَّذِي يَعۡلَمُ ٱلسِّرَّ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۚ إِنَّهُۥ كَانَ غَفُورٗا رَّحِيمٗا ٦﴾ [الفرقان: ٥، ٦] “তারা বলে- ‘এগুলো পূর্ব যুগের কাহিনী যা সে (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লিখিয়ে নিয়েছে আর এগুলোই তার কাছে সকাল-সন্ধ্যা শোনানো হয়।’ বল: ‘তা তিনিই নাযিল করেছেন যিনি আসমান-যমীনের যাবতীয় গোপন বিষয় অবগত আছেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু”। [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৫-৬] অর্থাৎ যে তাঁর নিকট তাওবা করে এবং তাঁর নিকট ফিরে যায়, তিনি তার তাওবা গ্রহণ করেন আর তাকে ক্ষমা করে দেন।
কাফেরদের মীমংসা চাওয়া এবং তাদের আযাব প্রার্থনা:
মুশরিকরা বলে-وَإِذۡ قَالُواْ ٱللَّهُمَّ إِن كَانَ هَٰذَا هُوَ ٱلۡحَقَّ مِنۡ عِندِكَ فَأَمۡطِرۡ عَلَيۡنَا حِجَارَةٗ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ أَوِ ٱئۡتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيمٖ “স্মরণ কর, যখন তারা বলেছিল, ‘হে আল্লাহ! এটি যদি তোমার নিকট থেকে (প্রেরিত) সত্য (দীন) হয় তাহলে আমাদের উপর আসমান থেকে পাথর বর্ষণ কর কিংবা আমাদের ওপর কোনো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি নিয়ে এসো” তারা অতিশয় মুর্খতা, অস্বীকৃতি, একগুঁয়েমী এবং ঔদ্ধত্য প্রদর্শনহেতু এ কথা বলে, এতে তাদের দোষ প্রকাশ পায়, তাদের এরূপ বলা উচিত ছিল: হে আল্লাহ, এটি যদি আপনার পক্ষ থেকে সত্য হয়ে থাকে তবে এর হিদায়াত আমাদের দান করুন আর আমাদেরকে এর অনুসরণ করার তাওফীক দিন; কিন্তু তারা নিজেদের ব্যাপারে মীমাংসা চায় এবং আযাবের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿وَيَسۡتَعۡجِلُونَكَ بِٱلۡعَذَابِ وَلَوۡلَآ أَجَلٞ مُّسَمّٗى لَّجَآءَهُمُ ٱلۡعَذَابُۚ وَلَيَأۡتِيَنَّهُم بَغۡتَةٗ وَهُمۡ لَا يَشۡعُرُونَ ٥٣﴾ [العنكبوت: ٥٣] “তারা তোমাকে তাড়াতাড়ি শাস্তি আনতে বলে। (‘আযাবের) সময়কাল যদি না নির্ধারিত থাকত তবে তাদের ওপর শাস্তি অবশ্যই এসে পড়ত। তা তাদের ওপর অবশ্য অবশ্যই আসবে আকস্মিকভাবে, তারা (আগেভাগে) টেরও পাবে না”। [সূরা আল-‘আনকাবুত, আয়াত: ৫৩] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿وَقَالُواْ رَبَّنَا عَجِّل لَّنَا قِطَّنَا قَبۡلَ يَوۡمِ ٱلۡحِسَابِ ١٦﴾ [ص : ١٦] “এরা বলে, হে আমাদের রব! হিসাবের দিনের আগেই আমাদের প্রাপ্য (শাস্তি) আমাদেরকে তাড়াতাড়ি দিয়ে দিন”। [সূরা সাদ, আয়াত: ১৬] আল্লাহ তা‘আলার বাণী:﴿سَأَلَ سَآئِلُۢ بِعَذَابٖ وَاقِعٖ ١ لِّلۡكَٰفِرِينَ لَيۡسَ لَهُۥ دَافِعٞ ٢ مِّنَ ٱللَّهِ ذِي ٱلۡمَعَارِجِ ٣﴾ [المعارج: ١، ٣] “এক ব্যক্তি চাইল সে ‘আযাব যা অবশ্যই সংঘটিত হবে। কাফেরদের জন্য তা প্রতিরোধ করার কেউ নেই (যে শাস্তি আসবে) আল্লাহর নিকট থেকে যিনি আসমানে উঠার সিঁড়িগুলোর মালিক”। [সূরা আল-মা‘আরেজ, আয়াত: ১-৩] অনুরূপভাবে আগের যুগের মুর্খ লোকেরা বলেছিল, যেমন শু‘আইব আলাইহিস সালামের কাওম তাঁকে বলে: ﴿فَأَسۡقِطۡ عَلَيۡنَا كِسَفٗا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّٰدِقِينَ ١٨٧﴾ [الشعراء : ١٨٧] “তুমি সত্যবাদী হলে আকাশের এক টুকরো আমাদের উপর ফেলে দাও”। [সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ১৮৭] শু‘বা রহ. যিয়াদীর সাথী আব্দুল হামীদ থেকে বর্ণনা করেন, আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আবু জাহল ইবন হিশাম বলে: ٱللَّهُمَّ إِن كَانَ هَٰذَا هُوَ ٱلۡحَقَّ مِنۡ عِندِكَ فَأَمۡطِرۡ عَلَيۡنَا حِجَارَةٗ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ أَوِ ٱئۡتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيمٖ “হে আল্লাহ! এটি যদি তোমার নিকট থেকে (প্রেরিত) সত্য (দীন) হয় তাহলে আমাদের ওপর আসমান থেকে পাথর বর্ষণ কর, কিংবা আমাদের ওপর কোনো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি নিয়ে এসো”। তখন আল্লাহ তা‘আলার বাণী এ আয়াত: وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيهِمْ وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ “তুমি তাদের মাঝে থাকা অবস্থায় আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না এবং যখন তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে এরূপ অবস্থায়ও আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না” নাযিল হয়। ইমাম বুখারী এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইবন আবু হাতিম বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, মুশরিকরা বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করত আর বলত: আমি হাযির হে আল্লাহ আমি হাযির, আমি হাযির আপনার কোনো শরীক নেই, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন: বাস এ পর্যন্তই, কিন্তু তারা এরপরে বলত: আমি হাযির, হে আল্লাহ আমি হাযির, আমি হাযির, আপনার কোনো শরীক নেই, তবে সে ছাড়া যে আপনার শরীক, আপনি তার মালিক কিন্তু সে মালিক নয়। আর তারা বলত: আপনার ক্ষমা, আপনার ক্ষমা। তখন আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করেন: وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيهِمْ “তুমি তাদের মাঝে থাকা অবস্থায় আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না” আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, তাদের মাঝে দু’টি নিরাপত্তা ছিল: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ক্ষমা প্রার্থনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলে যান, বাকি থাকে ক্ষমা প্রার্থনা। (ইবন আবী হাতিম)
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنتَ فِيهِمْ “তুমি তাদের মাঝে থাকা অবস্থায় আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না” এর অর্থ সম্পর্কে বলেন, আল্লাহ তা‘আলা কোনো সম্প্রদায়কে এ অবস্থায় আযাব দেন না, যখন তাদের নবীরা তাদের মাঝে অবস্থান করেন। যতক্ষণ তিনি নবীদের তাদের থেকে বের করে নিয়ে আসেন। তারপর তিনি বলেন, وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ “এবং যখন তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে এরূপ অবস্থায়ও আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না”। তিনি বলেন, তাদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে যার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ঈমান গ্রহণ করা ইতোপূর্বে লিখিত হয়েছে, আর ‘ক্ষমা প্রার্থনা করা’ সেটাই বুঝানো হয়েছে। يَسْتَغْفِرُونَ অর্থাৎ সালাত আদায় করেন, সুতরাং এর দ্বারা উদ্দেশ্য মক্কাবাসী।
দাহ্হাক রহ. বলেন, وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ “এবং যখন তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে এরূপ অবস্থায়ও আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না” অর্থাৎ, ঐসব মুমিন যারা মক্কায় ছিল। ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেন, আবু মূসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: "أَنْزَلَ اللَّهُ عَلَيَّ أَمَانَيْنِ لِأُمَّتِي: وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنتَ فِيهِمْ، وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ فَإِذَا مَضَيْتُ تَرَكْتُ فِيهِمُ الاستغفار إلى يوم القيامة" “আল্লাহ তা‘আলা আমার উম্মাতের জন্য আমার ওপর দু’টি নিরাপত্তা প্রদান করেছেন: এক- وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيهِمْ “আপনি তাদের মাঝে থাকা অবস্থায় আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না এবং দুই- وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ“যখন তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে এরূপ অবস্থায়ও আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না” আমার চলে যাওয়ার পরে কিয়ামত পর্যন্ত তোমাদের জন্য ছেড়ে যাচ্ছি ‘ক্ষমা প্রার্থনা’। এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয় যা ইমাম আহমাদ রহ. তার মুসনাদে এবং হাকিম তার মুস্তাদরাকে বর্ণনা করেছেন, আবু সা‘ঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: "إِنَّ الشَّيْطَانَ قَالَ: وَعَزَّتِكَ يَا رَبِّ لَا أَبْرَحُ أُغْوِي عِبَادَكَ مَا دَامَتْ أَرْوَاحُهُمْ فِي أَجْسَادِهِمْ، فَقَالَ الرَّبُّ وَعِزَّتِي وَجَلَالِي، لَا أَزَالُ أَغْفِرُ لَهُمْ مَا استغفروني" শয়তান বলে: আপনার ইজ্জতের কসম, আমি আপনার বান্দাদের দেহে রূহ থাকা পর্যন্ত তাদেরকে গোমরাহ করেই যাব, তখন রব বলেন, আমার ইজ্জত ও বড়ত্বের শপথ, তারা যতক্ষণ পর্যন্ত আমার কাছে ক্ষমা চাইতে থাকবে আমি ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে ক্ষমা করেই যাব। এরপর হাকিম রহ. বলেন, এ হাদীসের সনদ বিশুদ্ধ; কিন্তু ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাদের গ্রন্থদ্বয়ে তা উল্লেখ করেন নি।
﴿وَمَا لَهُمۡ أَلَّا يُعَذِّبَهُمُ ٱللَّهُ وَهُمۡ يَصُدُّونَ عَنِ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ وَمَا كَانُوٓاْ أَوۡلِيَآءَهُۥٓۚ إِنۡ أَوۡلِيَآؤُهُۥٓ إِلَّا ٱلۡمُتَّقُونَ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ ٣٤ وَمَا كَانَ صَلَاتُهُمۡ عِندَ ٱلۡبَيۡتِ إِلَّا مُكَآءٗ وَتَصۡدِيَةٗۚ فَذُوقُواْ ٱلۡعَذَابَ بِمَا كُنتُمۡ تَكۡفُرُونَ ٣٥﴾ [الانفال: ٣٤، ٣٥]
অর্থানুবাদ:
“আল্লাহ যে তাদেরকে শাস্তি দিবেন না এ ব্যাপারে ওজর পেশ করার জন্য তাদের কাছে কী আছে যখন তারা (মানুষদেরকে) মসজিদুল হারাম-এর পথে বাধা দিচ্ছে? তারা তো ওর (প্রকৃত) মুতাওয়াল্লী নয়, মুত্তাকীরা ছাড়া কেউ তার মুতাওয়াল্লী থেকে পারে না, কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোক এ সম্পর্কে অবগত নয়। আল্লাহর ঘরের নিকট তাদের সালাত হাত তালি মারা আর শিষ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই না, (এসব অপরাধে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে বলা হবে) আযাব ভোগ কর; যেহেতু তোমরা কুফুরীতে লিপ্ত ছিলে”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৩৫-৩৬]
তাফসীর:
মুশরিকরা পাপের শাস্তি পায়:    
আল্লাহ তা‘আলা অবহিত করেন যে, তারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য; কিন্তু তাদের মাঝে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপস্থিতির বরকতে তাদের ওপর শাস্তি আসে নি। এ কারণে যখন তিনি তাদের মাঝ থেকে বের হয়ে যান আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর বদরের শাস্তি আপতিত করেন, তাদের নেতৃবৃন্দ নিহত হয় অথবা বন্দী হয়। এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তারা যে শির্ক ও ফাসাদের মধ্যে পরিতৃপ্ত ছিল সে গোনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনার প্রতি দিক-নির্দেশনা দেন। তাদের মাঝে (মক্কায়) যদি ক্ষমা প্রার্থনাকারী, দুর্বল মুমিনগণ না থাকত, তবে তাদের ওপর শাস্তি নেমে আসত যা তারা ফিরাতে পারত না; কিন্তু তাদের কারণে তা প্রতিহত হয়েছে।
কাতাদাহ এবং সুদ্দী রহ. বলেন, এ জাতিটি ক্ষমা চাচ্ছিল না। অন্যথায় তাদের শাস্তি দেওয়া হত না। ইবন জারির রহ. এ মতকে গ্রহণ করেন। অর্থাৎ যদি তাদের মধ্যে দুর্বল ক্ষমা প্রার্থনাকারী মু’মিন না থাকত, তাহলে তাদের ওপর শাস্তি আসত যা তারা ঠেকাতে পারত না। কিন্তু মক্কায় অবস্থানরত দুর্বল মুমিন ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের কারণে কাফেরদের থেকে শাস্তি প্রতিহত করা হল। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা হুদাইবিয়ার দিন সম্পর্কে বলেন, ﴿هُمُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ وَصَدُّوكُمۡ عَنِ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ وَٱلۡهَدۡيَ مَعۡكُوفًا أَن يَبۡلُغَ مَحِلَّهُۥۚ وَلَوۡلَا رِجَالٞ مُّؤۡمِنُونَ وَنِسَآءٞ مُّؤۡمِنَٰتٞ لَّمۡ تَعۡلَمُوهُمۡ أَن تَطَ‍ُٔوهُمۡ فَتُصِيبَكُم مِّنۡهُم مَّعَرَّةُۢ بِغَيۡرِ عِلۡمٖۖ لِّيُدۡخِلَ ٱللَّهُ فِي رَحۡمَتِهِۦ مَن يَشَآءُۚ لَوۡ تَزَيَّلُواْ لَعَذَّبۡنَا ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنۡهُمۡ عَذَابًا أَلِيمًا ٢٥﴾ [الفتح: ٢٥] “তারাই তো কুফুরী করেছিল এবং তোমাদেরকে মসজিদুল হারাম থেকে বাধা দিয়েছিল, আরও বাধা দিয়েছিল কুরবানীর পশুগুলোকে কুরবানীর স্থানে পৌঁছতে। মুমিন পুরুষ আর মুমিন নারীরা যদি (মাক্কায় কাফেরদের মাঝে) না থাকত যাদের সম্পর্কে তোমরা জান না আর অজ্ঞতাবশতই তোমরা তাদেরকে পর্যুদস্ত করে দিবে; যার ফলে তোমাদের ওপর কলঙ্ক লেপন হবে -এমন সম্ভাবনা না থাকত, তাহলে তোমাদেরকে যুদ্ধের আদেশ দেওয়া হত। যুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয় নি যাতে আল্লাহ যাকে ইচ্ছে তাঁর রহমাতের মধ্যে শামিল করে নিতে পারেন। (মাক্কায় অনেক মুমিন আর কাফেররা একত্রিত না থেকে) যদি তারা পৃথক হয়ে থাকত, তাহলে আমি তাদের মধ্যে কাফেরদেরকে ভয়াবহ শাস্তি দিতাম”। [সূরা আল-ফাতহ, আয়াত: ২৫]
ইবন জারির রহ. ইবন আবযা রহ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় ছিলেন, তখন আল্লাহ তা‘আলা সূরা আল-আনফালের আয়াত وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيهِمْ “তুমি তাদের মাঝে থাকা অবস্থায় আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না”। তারপর তিনি যখন মদীনায় তখন وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ “এবং যখন তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে এরূপ অবস্থায়ও আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৩৩] এ আয়াত নাযিল করেন।
কেউ কেউ বলেন, আয়াতটি وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيهِمْ পরবর্তী আয়াত وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ রহিত করে দেয়। এ শর্তে যে তাদের থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা তাদের নিজেদের থেকে পাওয়া যেতে হবে। ইকরিমা ও হাসান বাসরী রহ. বলেন, আল্লাহ তা‘আলা সূরা আনফালে বলেন, وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيهِمْ وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ এর পরবর্তী আয়াতটি এ আয়াতের বিধানকে রহিত করে দেন। অর্থাৎ  وَمَا لَهُمْ أَلاَّ يُعَذِّبَهُمُ اللَّهُ “কে আল্লাহ তাদের শাস্তি দেবেন না” থেকে নিয়ে فَذُوقُواْ الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ “তোমরা শাস্তি ভোগ কর, কারণ, তোমারা কুফুরী করতে” এ পর্যন্ত। অতঃপর তারা মক্কায় যুদ্ধ করে। যার ফলে তাদের ক্ষতি হয় এবং তারা দূর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়।
ইবন আবু হাতিম ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন, وَمَا كَانَ ٱللَّهُ مُعَذِّبَهُمۡ وَهُمۡ يَسۡتَغۡفِرُونَ “এবং যখন তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে এরূপ অবস্থায়ও আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না” তারপর  মুশরিকদের বাদ দেওয়া হয় এবং তিনি বলেন, وَمَا لَهُمۡ أَلَّا يُعَذِّبَهُمُ ٱللَّهُ وَهُمۡ يَصُدُّونَ عَنِ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ “আল্লাহ যে তাদেরকে শাস্তি দিবেন না এ ব্যাপারে ওজর পেশ করার জন্য তাদের কাছে কী আছে যখন তারা (মানুষদেরকে) মসজিদুল হারাম-এর পথে বাধা দিচ্ছে”?
আর আল্লাহর বাণী:وَمَا لَهُمۡ أَلَّا يُعَذِّبَهُمُ ٱللَّهُ وَهُمۡ يَصُدُّونَ عَنِ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ وَمَا كَانُوٓاْ أَوۡلِيَآءَهُۥٓۚ إِنۡ أَوۡلِيَآؤُهُۥٓ إِلَّا ٱلۡمُتَّقُونَ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ “আল্লাহ যে তাদেরকে শাস্তি দিবেন না -এ ব্যাপারে ওজর পেশ করার জন্য তাদের কাছে কী আছে যখন তারা (মানুষদেরকে) মসজিদুল হারামের পথে বাধা দিচ্ছে? তারা তো ওর (প্রকৃত) মুতাওয়াল্লী নয়, মুত্তাকীরা ছাড়া কেউ তার মুতাওয়াল্লী হতে পারে না; কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোক এ সম্পর্কে অবগত নয়”। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা কেন তাদেরকে শাস্তি দিবেন না অথচ তারা মাসজিদুল হারাম থেতে তাদেরকে বাধা দেয় অর্থাৎ যা মক্কায়, তারা মুমিনগণকে বাধা দেয়, যারা সেখানে সালাত আদায় করার এবং এতে তাওয়াফ করার অধিকারী। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَا كَانُوٓاْ أَوۡلِيَآءَهُۥٓۚ إِنۡ أَوۡلِيَآؤُهُۥٓ إِلَّا ٱلۡمُتَّقُونَ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ “তারা তো ওর (প্রকৃত) মুতাওয়াল্লী নয়, মুত্তাকীরা ছাড়া কেউ তার মুতাওয়াল্লী হতে পারে না; কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোক এ সম্পর্কে অবগত নয়” অর্থাৎ তারা মাসজিদুল হারামের হকদার নয়; বরং এর হকদার হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণ। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿مَا كَانَ لِلْمُشْرِكِينَ أَنْ يَعْمُرُوا مَسَاجِدَ اللَّهِ شَاهِدِينَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ بِالْكُفْرِ أُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ وَفِي النَّارِ هُمْ خَالِدُونَ إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلا اللَّهَ فَعَسَى أُولَئِكَ أَنْ يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ﴾ [التوبة: ١٧،١٨] “মুশরিকদের এটি কাজ নয় যে, তারা আল্লাহর মাসজিদের রক্ষণাবেক্ষণকারী সেবক হবে যখন তারা নিজেরাই নিজেদের কুফুরীর সাক্ষ্য দেয়, তাদের সমস্ত কাজ বরবাদ হয়ে গেছে, জাহান্নামেই তারা হবে চিরস্থায়ী। আল্লাহর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ তো তারাই করবে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান আনে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায়, তারাই হবে সঠিক পথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১৭-১৮] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿وَصَدٌّ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ وَكُفۡرُۢ بِهِۦ وَٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ وَإِخۡرَاجُ أَهۡلِهِۦ مِنۡهُ أَكۡبَرُ عِندَ ٱللَّهِۚ ٢١٧﴾ [البقرة: ٢١٧] “পক্ষান্তরে আল্লাহর পথ থেকে বাধা দান, আল্লাহর সঙ্গে কুফুরী, কা‘বা গৃহে যেতে বাধা দেওয়া এবং তাত্থেকে তার বাসিন্দাদেরকে বের করে দেওয়া আল্লাহর নিকট তার চেয়ে অধিক অন্যায়”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১৭] হাকিম ইসমাঈল ইবন উবাইদ ইবন রিফা‘আ তিনি তার পিতা এবং তিনি তার দাদা থেকে তার মুস্তাদরাকে উল্লেখ করেন, তিনি (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদেরকে একত্রিত করে বলেন, «هل فيكم من غيركم؟» “তোমাদের মাঝে কি তোমাদের ভিন্ন অন্য কেউ রয়েছে”? তারা বলল: আমাদের মাঝে রয়েছে আমাদের ভাগনে, রয়েছে যাদের সাথে আমাদের মৈত্রী সম্পর্ক আছে, রয়েছে আমাদের বন্ধুবর্গ। এরপর তিনি বলেন, «حَلِيفُنَا مِنَّا وَابْنُ أُخْتِنَا مِنَّا وَمَوْلَانَا منا إن أوليائي منكم المتقون». “আমাদের সাথে বন্ধু যারা তারাও আমাদের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের যারা ভাগনে রয়েছে তারাও আমাদের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু প্রকৃত বন্ধুবর্গ তো হচ্ছে তোমাদের মধ্যকার মুত্তাক্বীগণ”।  
উরওয়া, সুদ্দী এবং মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক রহ. إِنْ أَوْلِيَاؤُهُ إِلا الْمُتَّقُونَ “মুত্তাকীরা ছাড়া কেউ তার মুতাওয়াল্লী হতে পারে না” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন, তারা হচ্ছেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম। মুজাহিদ রহ. বলেন, তারা হচ্ছেন মুজাহিদগণ, তারা যারাই হোকনা এবং যেখানেই হোকনা কেন।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেন মুশরিকরা মাসজিদুল হারামের কাছে কী ধরনের কর্মকাণ্ড চর্চা করত আর এর ব্যাপারে তাদের কেমন কাজ-কারবার ছিল। তিনি বলেন, وَمَا كَانَ صَلَاتُهُمۡ عِندَ ٱلۡبَيۡتِ إِلَّا مُكَآءٗ وَتَصۡدِيَةٗۚ “আল্লাহর ঘরের নিকট তাদের সালাত হাত তালি মারা আর শিষ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই না”। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা, মুজাহিদ, ইকরিমা ও অন্যান্যরা  বলেন, তা হচ্ছে শিষ। মুজাহিদ রহ. আরও সংযোজন করে বলেন, তারা তাদের মুখে আঙ্গুল প্রবেশ করাত। সুদ্দী রহ. বলেন, مُكَاء  সাদা পাখির মতো শিষ দেওয়া। তাকে বলা হয় مُكَاءً তা হিজাযের জমিনে পাওয়া যায়। সা‘ঈদ ইবন জুবাইর বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা وَمَا كَانَ صَلَاتُهُمۡ عِندَ ٱلۡبَيۡتِ إِلَّا مُكَآءٗ وَتَصۡدِيَةٗۚ “আল্লাহর ঘরের নিকট তাদের সালাত হাত তালি মারা আর শিষ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই না” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন, কুরাইশরা বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করত এ সময় তারা থাকত উলঙ্গ, শিষ দিত, তালি বাজাত। المكاء শব্দের অর্থ হচ্ছে শিষ দেওয়া, التصدية শব্দের অর্থ হচ্ছে তালি বাজানো। অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা, মুজাহিদ, মুহাম্মাদ ইবন কা‘ব, আবু সালামাহ ইবন আব্দুর রহমান, দাহ্হাক, কাতাদা, আতিয়্যাহ আল আউফী, হুজর ইবন আম্বাসা এবং ইবন আবযা থেকে। আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে وَمَا كَانَ صَلَاتُهُمۡ عِندَ ٱلۡبَيۡتِ إِلَّا مُكَآءٗ وَتَصۡدِيَةٗۚ “আল্লাহর ঘরের নিকট তাদের সালাত হাত তালি মারা আর শিষ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই না” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন, المكاء হচ্ছে শিষ দেওয়া আর التصدية হচ্ছে তালি বাজানো। ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে আরও বর্ণিত, তিনি বলেন, তারা তাদের চেহারাকে জমিনে রাখত তারপর তারা তালি বাজাতো এবং শিষ দিতো। মুজাহিদ বলেন, তারা এ কাজটি এ জন্য করত, যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সালাতে উল্টাপাল্টা করে ফেলে। যুহরী রহ. বলেন, তারা মুমিনদের সাথে বিদ্রুপ করত।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: فَذُوقُواْ ٱلۡعَذَابَ بِمَا كُنتُمۡ تَكۡفُرُونَ “আযাব ভোগ কর যেহেতু তোমরা কুফুরীতে লিপ্ত ছিলে”। দাহ্হাক, ইবন জুরাইয এবং মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক রহ. বলেন, বদর যুদ্ধে তারা যে নিহত ও বন্দী হয়েছে এটাই এখানে বুঝানো হয়েছে। এ মতকে ইবন জারির রহ. গ্রহণ করেন। তিনি ছাড়া আর কেউ তা বর্ণনা করেন নি।
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ يُنفِقُونَ أَمۡوَٰلَهُمۡ لِيَصُدُّواْ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِۚ فَسَيُنفِقُونَهَا ثُمَّ تَكُونُ عَلَيۡهِمۡ حَسۡرَةٗ ثُمَّ يُغۡلَبُونَۗ وَٱلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ إِلَىٰ جَهَنَّمَ يُحۡشَرُونَ ٣٦ لِيَمِيزَ ٱللَّهُ ٱلۡخَبِيثَ مِنَ ٱلطَّيِّبِ وَيَجۡعَلَ ٱلۡخَبِيثَ بَعۡضَهُۥ عَلَىٰ بَعۡضٖ فَيَرۡكُمَهُۥ جَمِيعٗا فَيَجۡعَلَهُۥ فِي جَهَنَّمَۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ٣٧﴾ [الانفال: ٣٦، ٣٧]
অর্থানুবাদ:
“যে সব লোক সত্যকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে তারা আল্লাহর পথ থেকে (লোকেদেরকে) বাধা দেওয়ার জন্য তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে থাকে, তারা তা ব্যয় করতেই থাকবে, অতঃপর এটিই তাদের দুঃখ ও অনুশোচনার কারণ হবে। পরে তারা পরাজিতও হবে। যারা কুফুরী করে তাদেরকে (অবশেষে) জাহান্নামের পানে একত্রিত করা হবে। যাতে আল্লাহ পবিত্র থেকে অপবিত্রকে আলাদা করে দেন, অতঃপর অপবিত্রদের এককে অন্যের ওপর রাখবেন, সকলকে স্তুপীকৃত করবেন, অতঃপর এ সমষ্টিকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। এরাই হলো সর্বস্বান্ত”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৩৬-৩৭]
তাফসীর:
কাফরদের ব্যয় তাদের পরিতাপের কারণ:
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক রহ. বলেন, হাদীস বর্ণনা করেছেন আমার নিকট যুহরী, মুহাম্মাদ ইবন ইয়াহইয়া ইবন হিব্বান, ‘আসিম ইবন উমার ইবন কাতাদা এবং হুসাইন ইবন আব্দুর রহমান ইবন আমর্‌ ইবন সা‘দ ইবন মু‘আয, তারা বলেন, বদরের যুদ্ধে কুরাইশরা যখন পর্যুদস্ত হয় তাদের বাহিনী মক্কায় ফিরে আসে, আবু সুফিয়ানও বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে ফিরে আসে, আব্দুল্লাহ ইবন আবু রাবী‘আহ, ইকরিমা ইবন আবু জাহাল, সাফওয়ান ইবন উমাইইয়া কতিপয় কুরাইশদের কাছে গমন করতে থাকে, এদের বাপ-চাচা, পুত্র এবং তাদের ভাই-বেরাদর বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছে তারা আবু সুফিয়ান ইবন হারব এবং বাণিজ্য কাফেলায় যাদের সম্পদ ছিল তাদের সাথে কথা বলে, তারা বলল: হে কুরাইশবৃন্দ, মুহাম্মাদ তোমাদেরকে দুঃখ-দুর্দশায় ফেলেছে, তোমাদের নেতৃবৃন্দকে হত্যা করেছে, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তোমরা এ সম্পদের দ্বারা আমাদেরকে সহযোগিতা কর। হতে পারে এর মাধ্যমে আমরা তাদের থেকে প্রতিশোধ নিতে পারব। ফলে তারা তা-ই করে। বর্ণনাকারী বলেন, তাদের ব্যাপারে (যা আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে) আল্লাহ তা‘আলা إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ “যে সব লোক সত্যকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে তারা তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে থাকে” থেকে  أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ “এরাই হলো সর্বস্বান্ত” এ পর্যন্ত অবতীর্ণ করেন। অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে মুজাহিদ, সা‘ঈদ ইবন জুবাইর, হাকাম ইবন উইয়াইনা, কাতাদা, সুদ্দী এবং ইবন আবযা রহ. থেকে। তারা বলেন যে, এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে আবু সুফিয়ান এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে উহুদের যুদ্ধের জন্য তার সম্পদ খরচের ব্যাপারে। দাহ্হাক রহ. বলেন, এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে।
যে কোনো অর্থেই হোক আয়াতটি ব্যাপক ও সার্বিকভাবে বর্ণিত হয়েছে, ফলে আয়াতটি ব্যাপক, যদিও নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়াতে তার নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট খাস। আল্লাহ তা‘আলা অবহিত করেন যে, কাফেররা তাদের সম্পদ ব্যয় করে সত্য পথের অনুসরণ হতে লোকেদেরকে বাধা দেওয়ার জন্য, তারা এরূপ করার ফলে তদের সম্পদ চলে যাবে পরে এটিই তাদের জন্য অনুশোচনার অর্থাৎ পরিতাপের কারণ হবে। ثُمَّ تَكُونُ عَلَيۡهِمۡ حَسۡرَةٗ  “অতঃপর এটিই তাদের দুঃখ ও অনুশোচনার কারণ হবে”। অর্থাৎ তারা (এর বিনিময়ে) কিছুই পাবে না। কেননা, তারা আল্লাহ তা‘আলার আলোকে নিভিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা করেছে আর সত্যের কালেমার ওপর তাদের কালেমাকে বিজয়ী করতে চেয়েছে; কিন্তু কাফেররা অপছন্দ করা সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আলোকে পূর্ণ করবেন, তাঁর দীনকে সাহায্য করবেন, তাঁর কালেমার ঘোষণা দিবেন এবং সকল ধর্মের ওপর তাঁর দীনকে বিজয়ী করবেন। এ হচ্ছে দুনিয়ায় তাদের অপমান আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি। তাদের মাঝে যারা জীবিত থাকবে তারা স্বচক্ষে দেখবে এবং নিজ কর্ণে শুনবে যা তাদেরকে কষ্ট দিবে। আর যারা নিহত হয়েছে অথবা মারা গেছে তারা চিরস্থায়ী লাঞ্ছনা এবং চিরন্তর শাস্তির দিকে ফিরে যাবে। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَسَيُنفِقُونَهَا ثُمَّ تَكُونُ عَلَيۡهِمۡ حَسۡرَةٗ ثُمَّ يُغۡلَبُونَۗ وَٱلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ إِلَىٰ جَهَنَّمَ يُحۡشَرُونَ “তারা তা ব্যয় করতেই থাকবে, অতঃপর এটিই তাদের দুঃখ ও অনুশোচনার কারণ হবে। পরে তারা পরাজিতও হবে। যারা কুফুরী করে তাদেরকে (অবশেষে) জাহান্নামের পানে একত্রিত করা হবে”।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: لِيَمِيزَ ٱللَّهُ ٱلۡخَبِيثَ مِنَ ٱلطَّيِّبِ “যাতে আল্লাহ পবিত্র থেকে অপবিত্রকে আলাদা করে দেন” আলী ইবন আবু তালহা বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা لِيَمِيزَ ٱللَّهُ ٱلۡخَبِيثَ مِنَ ٱلطَّيِّبِ “যাতে আল্লাহ পবিত্র থেকে অপবিত্রকে আলাদা করে দেন” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন, যাতে করে সৌভাগ্যবানদেরকে হতভাগাদের থেকে পৃথক করে নিতে পারেন। সুদ্দী রহ. বলেন, মুমিনদের কাফের থেকে পৃথক করবেন। হতে পারে এ পৃথক করা আখিরাতে হবে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَيَوۡمَ نَحۡشُرُهُمۡ جَمِيعٗا ثُمَّ نَقُولُ لِلَّذِينَ أَشۡرَكُواْ مَكَانَكُمۡ أَنتُمۡ وَشُرَكَآؤُكُمۡۚ فَزَيَّلۡنَا بَيۡنَهُمۡۖ وَقَالَ شُرَكَآؤُهُم مَّا كُنتُمۡ إِيَّانَا تَعۡبُدُونَ ٢٨﴾ [يونس : ٢٨] “আর যেদিন আমি তাদের সকলকে একত্র করব, অতঃপর যারা শির্ক করেছে, তাদেরকে বলব, ‘থাম, তোমরা ও তোমাদের শরীকরা’। অতঃপর আমি তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাব। আর তাদের শরীকরা’ বলবে, ‘তোমরা তো আমাদের ইবাদাত করতে না’’। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ২৮] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَيَوۡمَ تَقُومُ ٱلسَّاعَةُ يَوۡمَئِذٖ يَتَفَرَّقُونَ ١٤﴾ [الروم: ١٤] “আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন তারা বিভক্ত হয়ে পড়বে”। [সূরা আর-রূম, আয়াত: ১৪] এবং অপর আয়াতে বলেন,﴿يَوۡمَئِذٖ يَصَّدَّعُونَ ٤٣﴾ [الروم: ٤٣] “সেদিন তারা বিভক্ত হয়ে পড়বে”। [সূরা আর-রূম, আয়াত: ১৪] এবং আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَٱمۡتَٰزُواْ ٱلۡيَوۡمَ أَيُّهَا ٱلۡمُجۡرِمُونَ ٥٩﴾ [يس: ٥٩] “আর (বলা হবে) ‘হে অপরাধীরা, আজ তোমরা পৃথক হয়ে যাও’’। [সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ৫৯] এ পৃথক করা দুনিয়াতেও হতে পারে। মুমিনদের যে আমল প্রকাশ পায় তা দ্বারা। অর্থাৎ আমি তাদের এর ক্ষমতা দিয়েছি, যাতে করে তিনি আলাদা করেন কে তাঁর কাফের শত্রুদেরকে হত্যা করার মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য করে আর কে এ থেকে বিরত থেকে তাঁর নাফরমানী করে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَمَآ أَصَٰبَكُمۡ يَوۡمَ ٱلۡتَقَى ٱلۡجَمۡعَانِ فَبِإِذۡنِ ٱللَّهِ وَلِيَعۡلَمَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ١٦٦ وَلِيَعۡلَمَ ٱلَّذِينَ نَافَقُواْۚ وَقِيلَ لَهُمۡ تَعَالَوۡاْ قَٰتِلُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ أَوِ ٱدۡفَعُواْۖ قَالُواْ لَوۡ نَعۡلَمُ قِتَالٗا لَّٱتَّبَعۡنَٰكُمۡۗ ١٦٧﴾ [ال عمران: ١٦٦، ١٦٧] “আর তোমাদের ওপর যে বিপদ এসেছিল দুই দল মুখোমুখি হওয়ার দিন তা আল্লাহর অনুমতিক্রমে এবং যাতে তিনি মুমিনদেরকে জেনে নেন। আর যাতে তিনি জেনে নেন মুনাফিকদেরকে। আর তাদেরকে বলা হয়েছিল, ‘এসো, আল্লাহর পথে লড়াই কর অথবা প্রতিরোধ কর’। তারা বলেছিল, ‘যদি আমরা লড়াই হবে জানতাম  তবে অবশ্যই তোমাদেরকে অনুসরণ করতাম’। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৬-১৬৭] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿مَّا كَانَ ٱللَّهُ لِيَذَرَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ عَلَىٰ مَآ أَنتُمۡ عَلَيۡهِ حَتَّىٰ يَمِيزَ ٱلۡخَبِيثَ مِنَ ٱلطَّيِّبِۗ وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُطۡلِعَكُمۡ عَلَى ٱلۡغَيۡبِ ١٧٩﴾ [ال عمران: ١٧٩] “আল্লাহ মুমিনদেরকে সে অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না এবং আল্লাহ তোমাদেরকে গায়িবের বিধান জ্ঞাত করেন না”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৭৯] সুতরাং আয়াতের অর্থ হলো, আমি তোমাদের কাফেরদের দ্বারা পরীক্ষা করলাম তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করবে এবং তাদের শক্তি দিলাম মাল খরচ করার এবং এ ব্যাপারে তা ব্যয় করার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿أَمۡ حَسِبۡتُمۡ أَن تَدۡخُلُواْ ٱلۡجَنَّةَ وَلَمَّا يَعۡلَمِ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ مِنكُمۡ وَيَعۡلَمَ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٤٢﴾ [ال عمران: ١٤٢] “তোমরা কি ভেবেছ যে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ আল্লাহ এখনও পর্যন্ত পরখ করেন নি তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করেছে আর কারা ধৈর্যশীল”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৪২] সুতরাং, আয়াতের অর্থ হচ্ছে আমরা তোমাদেরকে পরীক্ষা করেছি কাফেরদের দ্বারা যারা তোমাদের সাথে লড়াই করে আর আমি তাদেরকে এ ক্ষেত্রে সম্পদ ব্যয় করার সামর্থ্য দিয়েছি لِيَمِيزَ ٱللَّهُ ٱلۡخَبِيثَ مِنَ ٱلطَّيِّبِ وَيَجۡعَلَ ٱلۡخَبِيثَ بَعۡضَهُۥ عَلَىٰ بَعۡضٖ فَيَرۡكُمَهُۥ جَمِيعٗا “যাতে আল্লাহ পবিত্র থেকে অপবিত্রকে আলাদা করে দেন, অতঃপর অপবিত্রদের এককে অন্যের ওপর রাখবেন, সকলকে স্তুপীকৃত করবেন”। অর্থাৎ তিনি এ সবকিছু একত্রিত করবেন তা এভাবে যে, একের ওপর আরেক একত্রিত করা। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা মেঘমালা সম্পর্কে বলেন, ﴿ثُمَّ يَجۡعَلُهُۥ رُكَامٗا ٤٣﴾ [النور : ٤٣] “তারপর তিনি সেগুলোকে একত্রে জুড়ে দেন, তারপর সেগুলো স্তুপীকৃত করেন”। [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৪৩] একে অপরের উপর আরোহণকারী। فَيَجۡعَلَهُۥ فِي جَهَنَّمَۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ “অতঃপর এ সমষ্টিকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। এরাই হলো সর্বস্বান্ত” অর্থাৎ দুনিয়া ও আখিরাতে এরা ক্ষতিগ্রস্ত।
﴿قُل لِّلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ إِن يَنتَهُواْ يُغۡفَرۡ لَهُم مَّا قَدۡ سَلَفَ وَإِن يَعُودُواْ فَقَدۡ مَضَتۡ سُنَّتُ ٱلۡأَوَّلِينَ ٣٨ وَقَٰتِلُوهُمۡ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتۡنَةٞ وَيَكُونَ ٱلدِّينُ كُلُّهُۥ لِلَّهِۚ فَإِنِ ٱنتَهَوۡاْ فَإِنَّ ٱللَّهَ بِمَا يَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ٣٩ وَإِن تَوَلَّوۡاْ فَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ مَوۡلَىٰكُمۡۚ نِعۡمَ ٱلۡمَوۡلَىٰ وَنِعۡمَ ٱلنَّصِيرُ ٤٠﴾ [الانفال: ٣٨، ٤٠]
অর্থনুবাদ:
“যারা কুফুরী করে তাদেরকে বল, ‘তারা যদি নিবৃত্ত হয় তাহলে তারা পূর্বে যা করেছে তা ক্ষমা করা হবে, আর যদি (কুফরীর) পুনরাবৃত্তি করে, তাহলে আগের লোকেদের (প্রতি অনুসৃত) নীতির দৃষ্টান্ত তো অতীতের পাতাতেই আছে।’ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাও যে পর্যন্ত না ফিতনা খতম হয়ে যায় আর দীন পুরোপুরিভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। অতঃপর তারা যদি বিরত হয় তাহলে তারা (ন্যায় বা অন্যায়) যা করে আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। আর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে জেনে রেখ যে, আল্লাহ্ই তোমাদের অভিভাবক, কতই না উত্তম অভিভাবক! কতই না উত্তম সাহায্যকারী”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৩৮-৪০]
তাফসীর:
কাফেরদেরকে তাওবার প্রতি উৎসাহ প্রদান আর কুফুরীর ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, قُل لِّلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ إِن يَنتَهُواْ “যারা কুফুরী করে তাদেরকে বল, ‘তারা যদি নিবৃত্ত হয়” অর্থাৎ তারা যে কুফুরী, বিরুদ্ধাচরণ এবং একগুঁয়েমীতে ডুবে আছে তা থেকে বিরত থাকে, আর ইসলাম, আনুগত্য এবং তাওবা গ্রহণ করে يُغۡفَرۡ لَهُم مَّا قَدۡ سَلَفَ “তাহলে তারা পূর্বে যা করেছে তা ক্ষমা করা হবে” অর্থাৎ তাদের কুফুরী, গোনাহ এবং দোষত্রুটি থেকে তাদের ক্ষমা করা হবে। যেমন, সহীহ হাদীসে এসেছে: যা আবু ওয়াইল আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: «مَنْ أَحْسَنَ فِي الْإِسْلَامِ لَمْ يُؤَاخَذْ بِمَا عَمِلَ فِي الْجَاهِلِيَّةِ، وَمَنْ أَسَاءَ فِي الْإِسْلَامِ أُخِذَ بِالْأَوَّلِ وَالْآخِرِ» “যে ব্যক্তি ইসলামে সৎ হয়, সে জাহেলী যুগে (ইসলামের পূর্বে) কি করেছে তার হিসাব নেওয়া হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে মন্দ হয় তবে তার আগের পরের সকল হিসাব গ্রহণ করা হবে”।  বিশুদ্ধ হাদীসে আরও বর্ণিত হয়েছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «الْإِسْلَامُ يُجبُّ مَا قَبْلَهُ وَالتَّوْبَةُ تجبُّ مَا كَانَ قَبْلَهَا» “ইসলাম পূর্বে কৃত গোনাহকে মিটিয়ে দেয়, তাওবাহ তার পূর্বের কৃত গোনাহকে মোচন করে”।  
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:وَإِن يَعُودُواْ  “আর যদি (কুফুরীর) পুনরাবৃত্তি করে” অর্থাৎ তারা যাতে রয়েছে তাতে নিরবচ্ছিন্ন থাকে। فَقَدۡ مَضَتۡ سُنَّتُ ٱلۡأَوَّلِينَ “তাহলে আগের লোকেদের (প্রতি অনুসৃত) নীতির দৃষ্টান্ত তো অতীতের পাতাতেই আছে” অর্থাৎ আগেকার লোকেদের ব্যাপারে আমাদের নীতির দৃষ্টান্ত অতীতের পাতাতেই আছে। তারা যখন অস্বীকার করে এবং তাদের একগুঁয়েমীর ওপর নিরবচ্ছিন্ন থাকে, তবে আমরাও তাদেরকে দ্রুত শাস্তি দিয়ে দিব।
মুজাহিদ রহ. আল্লাহর বাণী: فَقَدۡ مَضَتۡ سُنَّتُ ٱلۡأَوَّلِينَ সম্পর্কে বলেন, বদরের দিন কুরাইশদের অবস্থা এবং অন্যান্য উম্মতের অবস্থা।
সূদ্দী ও ইবন ইসহাক রহ. বলেন, অর্থাৎ বদরের দিন।
কুফর ও শির্ক খতম করার জন্য যুদ্ধের নির্দেশ:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَقَٰتِلُوهُمۡ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتۡنَةٞ وَيَكُونَ ٱلدِّينُ كُلُّهُۥ لِلَّهِۚ “তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাও যে পর্যন্ত না ফিতনা খতম হয়ে যায় আর দীন পুরোপুরিভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়” ইমাম বুখারী আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি এসে বলে: হে আবু আব্দুর রহমান, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে যা বলেছেন সেটা কি করবেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَإِن طَآئِفَتَانِ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٱقۡتَتَلُواْ ٩﴾ [الحجرات: ٩] “মুমিনদের দু’দল লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়লে” [সূরা আল-হুজরাত, আয়াত: ৯] কিসে আপনাকে যুদ্ধ করতে বাধা দেয় যেমন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন? ফলে তিনি বলেন, হে ভাতিজা, এ আয়াত স্মরণ করব কিন্তু লড়াই করব না এ বিষয়টি আমার নিকট অধিক প্রিয় এ আয়াতটি স্মরণ করার চেয়ে যাতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَمَن يَقۡتُلۡ مُؤۡمِنٗا مُّتَعَمِّدٗا ٩٣﴾ [النساء : ٩٣] “যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করে” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৯৩] আয়াতের শেষ পর্যন্ত। তিনি বলেন, অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَقَٰتِلُوهُمۡ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتۡنَةٞ “তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাও যে পর্যন্ত না ফিতনা খতম হয়ে যায়” আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে এরূপ করেছি যখন ইসলাম ছিল দুর্বল, যখন কোনো ব্যক্তি তার দীনের ব্যাপারে পরীক্ষিত হত যে, হয় তারা তাকে হত্যা করবে আর নয়ত বন্দী করবে। অবশেষে যখন ইসলাম শক্তিশালী হয় ও বিস্তার লাভ করে তখন ফিতনার বেশি আশঙ্কা নেই। এরপর যখন তিনি দেখেন যে, তিনি তাঁর ইচ্ছার সাথে একমত নন তখন বলেন, আলী এবং উসমান (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) সম্পর্কে আপনাদের মতামত কী? আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, আলী এবং উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা সম্পর্কে আমার মতামত হচ্ছে: উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করেছেন; কিন্তু তোমরা এটি অপছন্দ করেছ যে, তাঁকে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করুন। আর আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হচ্ছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচাত ভাই এবং তাঁর জামাতা, তিনি তাঁর হাত দ্বারা ইঙ্গিত করে বলেন, আর এ হল তাঁর মেয়ে যেমন তোমরা দেখছ।  
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, وَقَٰتِلُوهُمۡ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتۡنَةٞ وَيَكُونَ ٱلدِّينُ كُلُّهُۥ لِلَّهِۚ “তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাও যে পর্যন্ত না ফিতনা খতম হয়ে যায় আর দীন পুরোপুরিভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়” অর্থাৎ যে পর্যন্ত না শির্ক খতম হয়। অনুরূপ বর্ণনা করেন আবুল ‘আলিয়া, মুজাহিদ, হাসান, কাতাদা, আর-রাবী‘ ইবন আনাস, সুদ্দী, মুকাতিল ইবন হাইইয়ান এবং যাইদ ইবন আসলাম।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক রহ. বলেন, আমি যুহরী কর্তৃক উরওয়া ইবন যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এবং অন্যান্য আলেমদের থেকে জেনেছি তারা বলেন, حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتۡنَةٞ “যে পর্যন্ত না ফিতনা খতম হয়ে যায়” যে পর্যন্ত কোনো মুসলিম তাঁর দীনের কারণে নির্যাতিত না হয়। (যার কারণে তাকে তাঁর দীন পরিত্যাগ করতে হয়)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَيَكُونَ ٱلدِّينُ كُلُّهُۥ لِلَّهِۚ “আর দীন পুরোপুরিভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়” দাহ্হাক রহ. বলেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম এ আয়াত সম্পর্কে বলেন, একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার জন্য একত্ববাদের ঘোষণা দেয়।
হাসান, কাতাদা এবং ইবন জুরাইয রহ. বলেন, وَيَكُونَ ٱلدِّينُ كُلُّهُۥ لِلَّهِۚ “আর দীন পুরোপুরিভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়” যে বলে: لَا إِلَهَ إلا الله “আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই”। একনিষ্ঠ তাওহীদ কেবল আল্লাহর জন্য। যাতে কোনো শির্ক থাকবে না। আল্লাহর ছাড়া অন্যান্য শরীক থেকে মুক্ত হওয়া। মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক রহ. বলেন, তাওহীদ একনিষ্টভাবে আল্লাহর জন্য হয়। তাতে শির্ক না থাকে। তাঁকে বাদ দিয়ে আর সকল উপাস্যকে বর্জন করে।
আব্দুর রহমান ইবন যাইদ ইবন আসলাম রহ. বলেন, وَيَكُونَ ٱلدِّينُ كُلُّهُۥ لِلَّهِۚ “আর দীন পুরোপুরিভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়” তোমাদের দীনের সাথে কুফুরী না থাকে। আর তিনি এ কথার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন এ হাদীস দ্বারা যা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا لَا إِلَهَ إلا الله، فإذا قالوها فقد عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقِّهَا وَحِسَابُهُمْ على الله عزَّ وجلَّ». “আমি লোকেদের সাথে লড়াই করতে আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ না তারা বলে: لَا إِلَهَ إلا الله আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই। যখন তারা সেটা বলে তখন তাদের জন্য আমার পক্ষ থেকে রয়েছে তাদের জান-মালের নিরাপত্তা, তবে ন্যায়সঙ্গতভাবে (কারও জানমাল গেলে ভিন্ন কথা), আর তাদের হিসাব-নিকাশ আল্লাহর নিকট”।  সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আরও বর্ণিত, আবু মূসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, سُئِل رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الرَّجُلِ يُقَاتِلُ شُجَاعَةً وَيُقَاتِلُ حَمِيَّة، وَيُقَاتِلُ رِيَاءً، أيُّ ذَلِكَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، عَزَّ وَجَلَّ؟ فَقَالَ: من قاتل لتكون كَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا، فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، عَزَّ وَجَلَّ “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, যে লড়াই করে বীরত্ব দেখানোর জন্য, লড়াই করে আপন গোত্রের মর্যাদা রক্ষার জন্য এবং লড়াই করে লোক দেখানোর জন্য, এগুলোর কোনটি আল্লাহর পথে লড়াই বলে গণ্য? তখন তিনি বলেন, যে ব্যক্তি লড়াই করে আল্লাহ তা‘আলার বাণীকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য, সেই আল্লাহর পথে লড়াই করে।  
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: فَإِنِ ٱنتَهَوۡاْ “অতঃপর তারা যদি বিরত হয়” অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের লড়াইয়ের কারণে যে কুফুরীতে তারা লিপ্ত রয়েছে তা থেকে, তাহলে তোমরাও বিরত হও, যদিও তোমরা তাদের ভেতরের কথা না জান। فَإِنَّ ٱللَّهَ بِمَا يَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ “তাহলে তারা (ন্যায় বা অন্যায়) যা করে আল্লাহ্ তার সম্যক দ্রষ্টা” যেমন তিনি বলেন, فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ [التوبة: ١١] “কিন্তু তারা যদি তাওবাহ করে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে, তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১১] অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ [التوبة: ١١] “তাহলে তারা তোমাদের দীনী ভাই”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১১]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,﴿وَقَٰتِلُوهُمۡ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتۡنَةٞ وَيَكُونَ ٱلدِّينُ لِلَّهِۖ فَإِنِ ٱنتَهَوۡاْ فَلَا عُدۡوَٰنَ إِلَّا عَلَى ٱلظَّٰلِمِينَ ١٩٣﴾ [البقرة: ١٩٣] “ফিতনা দূরীভূত না হওয়া পর্যন্ত এবং দীন আল্লাহর জন্য নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, অতঃপর যদি তারা বিরত হয় তবে যালিমদের ওপর ছাড়া কোনোও প্রকারের কঠোরতা অবলম্বন জায়েয হবে না” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৩] বিশুদ্ধ হাদীসে এসেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামা ইবন যাইদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলেন, যখন তিনি তরবারী দিয়ে জনৈক ব্যক্তিকে পরাভূত করেন আর এমন সময় সে বলে: لَا إِلَهَ إلا الله আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই, এরপর তিনি তাকে আঘাত করে হত্যা করেন। এ সংবাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানানো হলে তিনি উসামাকে বলেন,«أقتلته بعدما قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ؟ وَكَيْفَ تَصْنَعُ بلا إله إلا الله يوم القيامة» ؟ فقال: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّمَا قَالَهَا تَعَوُّذًا، قَالَ: «هَلَّا شَقَقْتَ عَنْ قَلْبِهِ» ، وَجَعَلَ يَقُولُ وَيُكَرِّرُ عَلَيْهِ: «مَنْ لَكَ بِلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ» ؟ قَالَ أُسَامَةُ: حَتَّى تَمَنَّيْتُ أَنِّي لم أكن أسلمت إلا يومئذ، “সে لَا إِلَهَ إلا الله (আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই) বলার পরও তুমি তাকে হত্যা করেছ? কিয়ামত দিবসে لَا إِلَهَ إلا الله (আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই)-এর সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে তুমি কী করবে? তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, সে তো জান বাঁচাতে এটি বলেছে? তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তুমি কি তার অন্তর ফেড়ে দেখেছ? তিনি বারবার এ কথা বলতে থাকেন, কিয়ামত দিবসে لَا إِلَهَ إلا الله (আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই)-এর সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে কে তোমার সাথে থাকবে। উসামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, অবশেষে আমার আকাঙ্খা হয় যে, আমি যদি সেই দিনই ইসলাম গ্রহণ করতাম।  
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَإِن تَوَلَّوۡاْ فَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ مَوۡلَىٰكُمۡۚ نِعۡمَ ٱلۡمَوۡلَىٰ وَنِعۡمَ ٱلنَّصِيرُ “আর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে জেনে রেখ যে, আল্লাহই তোমাদের অভিভাবক, কতই না উত্তম অভিভাবক! কতই না উত্তম সাহায্যকারী!” অর্থাৎ তারা যদি তোমাদের বিরুদ্ধাচরনে এবং তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিরবচ্ছিন্ন থাকে فَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ مَوۡلَىٰكُمۡۚ “তবে জেনে রাখ আল্লাহ তা‘আলাই তোমাদের শত্রুদের ওপর তোমাদের অভিভাবক”। তোমাদের মালিক এবং তোমাদের দুশমণদের বিপক্ষে সাহায্যকারী, তিনি কতই না উত্তম অভিভাবক এবং শ্রেষ্ট সাহায্যকারী।
﴿وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّمَا غَنِمۡتُم مِّن شَيۡءٖ فَأَنَّ لِلَّهِ خُمُسَهُۥ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِ إِن كُنتُمۡ ءَامَنتُم بِٱللَّهِ وَمَآ أَنزَلۡنَا عَلَىٰ عَبۡدِنَا يَوۡمَ ٱلۡفُرۡقَانِ يَوۡمَ ٱلۡتَقَى ٱلۡجَمۡعَانِۗ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٌ ٤١﴾ [الانفال: ٤١]
অর্থানুবাদ:
“তোমরা জেনে রেখ যে, যুদ্ধে যা তোমরা লাভ কর তার এক-পঞ্চমাংশ হচ্ছে আল্লাহ, তাঁর রসূল, রাসূলের আত্মীয়স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য, যদি তোমরা আল্লাহর ওপর আর চূড়ান্ত ফায়সালা-ফুরকানের দিন, দু’পক্ষের মিলিত হওয়ার দিন, আমি যা আমার বান্দার ওপর অবতীর্ণ করেছিলাম তার ওপর ঈমান এনে থাক। আর আল্লাহ সকল বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪১]
তাফসীর:
গনীমত এবং ফাইয়ের মালের বিধান:
আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের সমস্ত জাতির মধ্য থেকে এ সম্মানিত জাতির জন্য গনীমত হালাল সম্পর্কিত যে শরী‘আত নির্ধারণ করেছেন তার ব্যাখ্যা প্রদান করছেন। গনীমত হচ্ছে, কাফেরদের কাছ থেকে গৃহিত সম্পদ, যার জন্য তাদেরকে সৈন্য সামন্তের ব্যবহার এবং ঘোড়া দৌড়াতে হয়েছে, আর ফাই হচ্ছে যে সম্পদ অর্জনের জন্য তাদেরকে এ সব কোনো কিছুই করতে হয় নি। যেমন এমন সম্পদ যা প্রদানের শর্তে সন্ধি হয়েছে, অথবা যে সম্পদ ছেড়ে মারা গেছে আর তাদের কোনো উত্তরাধিকারী নেই। জিযইয়া (প্রশাসন কর্তৃক আরোপকৃত জান রক্ষা কর), খারাজ (সম্পদের খাজনা) ইত্যাদি। এটি ইমাম শাফে‘ঈর মাযহাব। কতক আলেম গনীমতকে ফাঈ বলেন এবং ফাঈকে গনীমত বলে আখ্যায়িত করেন। আবার এর উল্টোও বলেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّمَا غَنِمۡتُم مِّن شَيۡءٖ فَأَنَّ لِلَّهِ خُمُسَهُۥ “তোমরা জেনে রেখ যে, যুদ্ধে যা তোমরা লাভ কর তার এক-পঞ্চমাংশ হচ্ছে আল্লাহর” এ বিষয়টির প্রতি জোর প্রদান করা হচ্ছে যে, কম-বেশি সকল সম্পদ থেকে এক-পঞ্চমাংশ বের করতে হচ্ছে এমনকি সুঁচ-সুতা থেকেও। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿وَمَن يَغۡلُلۡ يَأۡتِ بِمَا غَلَّ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِۚ ثُمَّ تُوَفَّىٰ كُلُّ نَفۡسٖ مَّا كَسَبَتۡ وَهُمۡ لَا يُظۡلَمُونَ ١٦١﴾ [ال عمران: ١٦١] “আর যে খিয়ানত করবে, কিয়ামতের দিনে উপস্থিত হবে তা নিয়ে যা সে খিয়ানত করেছে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে পুরোপুরি দেওয়া হবে যা সে উপার্জন করেছে এবং তাদেরকে যুলম করা হবে না”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬১]
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: فَأَنَّ لِلَّهِ خُمُسَهُۥ وَلِلرَّسُولِ “এক-পঞ্চমাংশ হচ্ছে আল্লাহ, তাঁর রসূলের, এখানে “রাসূলের” শব্দের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বিভিন্ন মতামত পোষণ করেছেন, কতক বলেন, এক-পঞ্চমাংশ হতে আল্লাহর জন্য এক অংশ রয়েছে যা কা‘বা ঘরে রাখা হবে। আর কতক বলেন, আল্লাহর নাম উল্লেখ করা এখানে কেবল বরকতের জন্য। আর অংশ হলো, তা রাসূলের জন্য।
দাহ্হাক রহ. বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো অভিযান প্রেরণ করতেন তখন তাদের সংগৃহিত যুদ্ধলব্ধ সম্পদকে পাঁচ ভাগে ভাগ করতেন, এরপর এর একভাগ নিয়ে একে আবার পাঁচভাগে ভাগ করতেন। এরপর তিনি পাঠ করেন: وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّمَا غَنِمۡتُم مِّن شَيۡءٖ فَأَنَّ لِلَّهِ خُمُسَهُ وَلِلرَّسُولِ “তোমরা জেনে রেখ যে, যুদ্ধে যা তোমরা লাভ কর তার এক-পঞ্চমাংশ হচ্ছে আল্লাহ, তাঁর রাসূলের” তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলার বাণী: فَأَنَّ لِلَّهِ خُمُسَهُۥ “এক-পঞ্চমাংশ হচ্ছে আল্লাহ” কথার শুরু لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ “আসমান এবং জমিনসমূহে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর”। আয়াতে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের অংশকে একই অংশ ধরা হয়েছে।  সুতরাং আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের অংশ একই। এ বিষয়টিকে শক্তিশালী করে (এ হাদীস যা) ইমাম হাফেয আবু বকর আল-বায়হাক্বী বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেছেন, আব্দুল্লাহ ইবন শাক্বীক্ব বলেন যে, বিলক্বীন গোত্রের এক ব্যক্তি বলেছেন: আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসি এমতাবস্থায় যে তিনি ওয়াদী আল-ক্বুরায় ছিলেন, তিনি ঘোড়া পরীক্ষা করছিলেন, আমি তাঁকে বলি, ইয়া রাসূলাল্লাহ, গনীমত সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? তিনি বলেন, «لله خمسها وأربعة أخماسها لِلْجَيْشِ» “এক-পঞ্চমাংশ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার এবং পাঁচ ভাগের চার ভাগ হচ্ছে সৈন্যদের”। আমি বলি এতে কি কেউ কারও চেয়ে বেশি হকদার নয়? তিনি বলেন, «لَا وَلَا السَّهْمُ تَسْتَخْرِجُهُ مِنْ جيبك لَيْسَ أَنْتَ أَحَقَّ بِهِ مِنْ أَخِيكَ الْمُسْلِمِ» “না, এমনকি তুমি যেই তীরটি তোমার পার্শ্ব থেকে বের কর সেটার ক্ষেত্রেও তুমি তোমার মুসলিম ভাইয়ের চেয়ে বেশি হকদার নও”।  ইবন জারির রহ. হাসান রহ. থেকে বর্ণনা করেন, আবূ বকর রা. তার মালের এক-পঞ্চমাংশ বিষয়ে ওসিয়ত করেন এবং বলেন, আমি কি রাজি হব না আমার সম্পদ থেকে যে বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের জন্য রাজি। আতা বলেন, আল্লাহ ও রাসূলের এক-পঞ্চমাংশ এক। তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রহণ করবেন এবং তাতে তিনি যা ইচ্ছা করবেন। এ কথা ব্যাপক ও সব মতামতকে সামিল করে। আর তা হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক-পঞ্চমাংশ যা আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য নির্ধারণ করেছেন, তিনি তাতে যা ইচ্ছা করতে পারবেন। তিনি তার উম্মাতের মধ্যে যেভাবে চান বন্টন করবেন। এর সাক্ষ্য ঐ হাদীস, যেটি ইমাম আহমাদ রহ. বর্ণনা করেন মিকদাম ইবন মা‘দীকারিব আল কিনদী থেকে, তিনি বলেন, তিনি উবাদাহ ইবনুস সামিত, আবুদ দারদা’, আল-হারিস ইবন মু‘আবিয়া আল-কিনদী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈন সাথে বসা ছিলেন: তারা পরস্পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস নিয়ে আলোচনা করছিলেন, আবূ দারদা’ উবাদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে বলেন, হে উবাদহা, উমুক উমুক যুদ্ধে গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভিমত কী? উবাদাহ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি যুদ্ধে গনীমতের উটকে সুতরা বানিয়ে তাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করেন, এরপর যখন তিনি সালাম ফিরান তখন উঠে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দুই আঙ্গুল দ্বারা এর পশম নিয়ে বলেন, «إِنَّ هَذِهِ مِنْ غَنَائِمِكُمْ، وَإِنَّهُ لَيْسَ لِي فِيهَا إلا نصيبي معكم الْخُمُسُ، وَالْخُمُسُ مَرْدُودٌ عَلَيْكُمْ، فَأَدُّوا الْخَيْطَ وَالْمَخِيطَ، وَأَكْبَرَ مِنْ ذَلِكَ وَأَصْغَرَ، وَلَا تَغُلُّوا، فَإِنَّ الغلول عار ونار عَلَى أَصْحَابِهِ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ، وَجَاهِدُوا النَّاسَ فِي اللَّهِ الْقَرِيبَ وَالْبَعِيدَ، وَلَا تُبَالُوا فِي اللَّهِ لَوْمَةَ لَائِمٍ، وَأَقِيمُوا حُدُودَ اللَّهِ فِي السفر والحضر، وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ، فَإِنَّ الْجِهَادَ بَابٌ مِنْ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ عظيم ينجي الله به من الهم والغم» “এগুলো হচ্ছে তোমাদের গনীমতের সম্পদ, এতে তোমাদের সাথে আমার নির্ধারিত এক-পঞ্চমাংশ অংশ ছাড়া আর কোনো অধিকার নেই, আর এক-পঞ্চমাংশও তোমাদের দেওয়া হবে, কাজেই তোমরা সুঁচ-সুতা, এর চেয়ে বড় বা এর চেয়ে ছোট (যা কিছু আছে) প্রদান কর, আর প্রতারণা করো না, কেননা প্রতারণা দুনিয়া ও আখিরাতে এর কর্তার জন্য আগুন (শাস্তি) এবং লজ্জাস্বরূপ হবে, আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে লোকেদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর। চাই তারা নিকটে হোক বা দুরে, আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির পথে কোনো নিন্দুকের নিন্দাকে তোয়াক্কা করোনা, গৃহে আবস্থানকালে হোক বা সফরে আল্লাহ তা‘আলার বিধান প্রতিষ্ঠা কর, আল্লাহ তা‘আলার পথে জিহাদ কর, কেননা জিহাদ হচ্ছে জান্নাতের দরজাসমূহের মধ্য হতে বড় একটি দরজা, এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা বিষণ্ণতা এবং দুঃখ-কষ্ট থেকে হিফাযত করেন”।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য গনীমতের কিছু অংশ ছিল যা তিনি নিজের জন্য বেছে রাখতেন, দাস বা দাসি, অথবা ঘোড়া বা তরবারী অথবা এ জাতীয় অন্যান্য কিছু। মুহাম্মাদ ইবন সীরীন রহ. এবং ‘আমির আশ-শা‘বীর এ ব্যাপারে ভাষ্য রয়েছে এবং অধিকাংশ আলেম তাদের অনুসরণ করেছেন। ইমাম আহমাদ এবং তিরমিযী রহ. বর্ণনা করেন, আর তিরমিযী রহ. একে হাসান বলেছেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, বদরের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুলফিক্বার নামক তরবারী পছন্দ করেন, উহুদ যুদ্ধে একে তিনি স্বপ্নে দেখেন।  আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাফিয়্যাহ ছিল যুদ্ধবন্দিনী, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিজের জন্য নির্বাচন করে বিবাহ করেন। এ হাদীস আবু দাউদ তার সুনানে বর্ণনা করেছেন।  
ইয়াযিদ ইবন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা মিরবাদে ছিলাম, এক ব্যক্তি আমাদের নিকট প্রবেশ করল, তার সাথে চামড়ার একটি টুকরা ছিল তা পড়ে দেখলাম তাতে লিখা ছিল,«مِنْ مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللَّهِ إِلَى بَنِي زُهَيْرِ بْنِ أُقَيْشٍ، إِنَّكُمْ إِنْ شَهِدْتُمْ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَأَقَمْتُمُ الصَّلَاةَ، وَآتَيْتُمُ الزَّكَاةَ، وَأَدَّيْتُمُ الخمس من المغنم، وسهم النبي صلى الله عليه وسلم، وَسَهْمَ الصَّفِيِّ، أَنْتُمْ آمِنُونَ بِأَمَانِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ» “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বনী যুহাইর ইবন উকাইস-এর নিকট, যদি তোমরা এ কথার সাক্ষ্য দাও, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর, গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ আদায় কর, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অংশ ও বিশেষভাবে নির্বাচিত অংশ আদায় কর, তাহলে তোমরা আল্লাহর ও তার রাসূলের নিরাপত্তায় নিরাপদ। আমরা তাকে বললাম এ কে লিখেছে? সে বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।  হাদীসগুলো গ্রহণযোগ্য। এর প্রমাণিত হওয়া ও স্বীকৃত হওয়া এ বিষয়ে প্রমাণস্বরূপ। এ কারণে অধিকাংশরা একে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৈশিষ্ট্য বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আবার কেউ কেউ বলেন, এক-পঞ্চমাংশকে শাসক মুসলিমদের কল্যাণে তার ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যয় করবে, যেমনটি ফাঈ-এর সম্পদকে বন্টন করা হয়ে থাকে। আমার শাইখ ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ বলেন, এটি ইমাম মালেক ও অধিকাংশ সালাফের মত এবং এটিই সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত।
এ কথা প্রমাণ হওয়া ও জানার পর এ বিষয়েও মত পার্থক্য রয়েছে যে, এক-পঞ্চমাংশ থেকে প্রাপ্ত সম্পদ লাভ করার পর তা কি করবে। কেউ কেউ বলেন, তারপর যে ক্ষমতাশীল হবে, তা তার জন্য হবে। কেউ কেউ বলেন, মুসলিমদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। আবার কেউ কেউ বলেন, তা বাকী যেসব খাত রয়েছে যেমন আত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফির তাদের জন্য ব্যয় করা হবে। ইবন জারির রহ. এ মতকে গ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ বলেন, বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অংশ ও আত্মীয়ের অংশ ইয়াতীম, মিসকীন ও মুসাফিরের খ্যাতে ব্যয় করা হবে। ইবন জারির রহ. বলেন, এটি কতক ইরাকীদের মত।
কেউ বলেন, এক-পঞ্চমাংশ পুরোটাই আত্মীয়ের জন্য। রাসূলের মৃত্যুর পর এক-পঞ্চমাংশ বিষয়ে কি করা হবে তা নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, রাসূলের অংশ তার মৃত্যুর পর যিনি খলীফা হবেন তার জন্য। কেউ কেউ বলেন, রাসূলের আত্মীয়দের জন্য। কেউ কেউ বলেন, রাসূলের আত্মীয়ের অংশ খলীফার আত্মীয়ের জন্য। তবে তারা সবাই এ দু’টি অংশকে যুদ্ধের বাহন -ঘোড়া ও যুদ্ধের প্রস্তুতির কাজে ব্যয় করা বিষয়ে একমত। আবু বকর ও উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার আমলে এ প্রদ্ধতিই চলছিল।
আবু বকর ও উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা রাসূলের অংশকে অস্ত্র ও যুদ্ধের সামগ্রী ক্রয়ে ব্যয় করতেন। এরপর আত্মীয়স্বজনের অংশ তিনি একে বনী হাশিম এবং বনী মুত্তালিবে বন্টন করতেন। কেননা, বানু মুত্তালিব জাহেলী যুগে এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে বানু হাশিমকে সহযোগিতা করে, তারাও তাদের সাথে শি‘আবে আবু তালিবে প্রবেশ করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বার্থে রাগান্বিত হয়ে এবং তাঁর নিরাপত্তার জন্য, (বানু আব্দুল মুত্তালিবের) যারা মুসলিম ছিল তারা এ সব কিছু করেছিল আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য রক্ষার্থে, আর যারা কাফের ছিল তারা আত্মীয়-স্বজনের সমর্থন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা আবু তালিবের অনুসরণে এমনটি করে। আর বনু আব্‌দ শামছ্‌ ও বনু নাওফল যদিও তারা তাদের চাচাদের গোত্র ছিল, তারা তাদের সাথে সহযোগিতা করে নি; বরং তারা তাদের সাথে যুদ্ধ করে, তাদের প্রত্যাখ্যান করে এবং রাসূলের বিরুদ্ধে কুরাইশদের শক্তির যোগান দেয়।
জুবাইর ইবন মুত‘য়িম বলেন, আমি ও উসমান ইবন আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! খাইবারের গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ থেকে বনী আব্দুল মুত্তালিবকে অংশ দিলেন আর আমাদের দিলেন না? তারা এবং আমরা উভয় সম্প্রদায় আপনার আত্মীয় হিসেবে একই স্তরের। তিনি বললেন, «إِنَّمَا بَنُو هَاشِمٍ وبنو المطلب شيء واحد» “বনু হাসিম ও বনু মুত্তালিব এক”।  অপর বর্ণনায় বর্ণিত তিনি বলেন, «إِنَّهُمْ لَمْ يُفَارِقُونَا فِي جَاهِلِيَّةٍ وَلَا إِسْلَامٍ» “তারা ইসলাম ও ইসলামের পূর্বে আমাদের সহযোগিতা করা ছাড়েন নি”।  অধিকাংশ আলেমের মত হলো, তারা হলেন বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব। ইবন জারির রহ. বলেন, কেউ কেউ বলেন, তারা বনু হাশিম। তারপর মুজাহিদ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা জানতেন যে, বনী হাশিমদের মধ্যে দরিদ্র রয়েছে তাই তাদের জন্য তিনি সদকার পরিবর্তে এক-পঞ্চমাংশ নির্ধারণ করে দেন। তার থেকে অপর একটি বর্ণনায় বর্ণিত, তিনি বলেন, তারা হলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঐ সব আত্মীয় যাদের জন্য সাদকা খাওয়া হালাল নয়।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَالْيَتَامَى (ইয়াতীম) অর্থাৎ মুসলিমবৃন্দের ইয়াতীমরা, আলেমদের মধ্যে এ বিষয়ে দু’টি মত রয়েছে যে এখানে ইয়াতীম দ্বারা গরীবের সন্তান নাকি গরীব ধনী উভয়ের সন্তান। الْمَسَاكِينِ (মিসকীন) সকল প্রকার অভাবী; যারা তাদের ক্ষুধা নিবারণ ও বাসস্থানের চাহিদা পূরণের কোনো কিছু পায় না। وَابْنِ السَّبِيلِ (ও মুসাফিরদের জন্য) সে হচ্ছে মুসাফির অথবা এতটা পথ অতিক্রমের ইচ্ছা পোষণকারী ব্যক্তি যাতে তাকে সালাত কসর করা শরী‘আতসম্মত। আর সেই সফরের ব্যয়ভার বহন করার তার সামর্থ নেই। সূরা বারা‘আতে সদাকা সংক্রান্ত আয়াতে এ সংক্রান্ত তাফসীর শীঘ্রই আসছে ইনশাআল্লাহ। তাঁর ওপর আমাদের আস্থা ও ভরসা।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: إِنْ كُنْتُمْ آمَنْتُمْ بِاللَّهِ وَمَا أَنزلْنَا عَلَى عَبْدِنَا “যদি তোমরা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করে থাক আর আমি যা আমার বান্দা ওপর অবতীর্ণ করেছিলাম তার ওপর” অর্থাৎ এক-পঞ্চমাংশ গনীমতের যে বিধান আমরা তোমাদের জন্য দিয়েছি তোমরা সেটা পালন কর, যদি তোমরা আল্লাহ, পরকাল এবং তাঁর রাসূলের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে ঈমান আন। এ কারণে সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে: আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা আব্দুল কাইসের কাফেলার হাদীসে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বলেছেন, «وَآمُرُكُمْ بِأَرْبَعٍ وَأَنْهَاكُمْ عَنْ أَرْبَعٍ: آمُرُكُمْ بِالْإِيمَانِ بِاللَّهِ، ثُمَّ قَالَ: هَلْ تَدْرُونَ مَا الْإِيمَانُ بِاللَّهِ؟ شَهَادَةُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَإِقَامُ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءُ الزَّكَاةِ، وَأَنْ تؤدوا الخمس من المغنم» “আমি তোমাদেরকে চারটি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি আর চারটি বিষয় থেকে নিষেধ করছি, আমি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে, এরপর তিনি বলেন, তোমরা কি জান আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনয়ন কী? এ সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই, আর মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, সালাত প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত প্রদান করা, এবং এক-পঞ্চমাংশ গনীমাত আদায় করা”।  এ হাদীসটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ বিশেষ, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এক-পঞ্চমাংশ গনীমত আদায় করাকে সার্বিক ঈমানের মধ্যে গণ্য করেছেন।  
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:  وَمَآ أَنزَلۡنَا عَلَىٰ عَبۡدِنَا يَوۡمَ ٱلۡفُرۡقَانِ يَوۡمَ ٱلۡتَقَى ٱلۡجَمۡعَانِۗ “অর্থাৎ দু’পক্ষের মিলিত হওয়ার দিন আর আল্লাহ সকল বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান” আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের প্রতি তাঁর নি‘আমত ও দয়ার কথা অবহিত করছেন। কেননা তিনি বদরের দিন সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করে দিয়েছেন আর এর নামকরণ করেছেন فرقان অর্থাৎ সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্যের দিন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এতে মিথ্যার বাণীর ওপর সত্যের বাণীকে সুউচ্চ করে তুলে ধরেছেন, তাঁর দীনকে প্রকাশ করেছেন তাঁর নবীকে এবং তাঁর দলকে সাহায্য করেছেন।  
উরওয়া ইবন যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, يوم الفرقان ঐ যেদিন আল্লাহ তা‘আলা হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য নির্ধারণ করেন। আর তা হলো, বদরের যুদ্ধের দিন। এটি সর্বপ্রথম যুদ্ধ, যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে স্বশরীরে অংশগ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে মুশরিকদের নেতা ছিল উতবা ইবন রাবী‘আহ। উভয় বাহিনী রমযানের তের বা সতের তারিখে একে অপরের মুখোমুখী হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথী ছিল সেদিন মাত্র তিনশত তের জন আর মুশরিকদের সংখ্যা ছিল নয় শত থেকে এক হাজার। আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের পরাজিত করেন। তাদের সত্তরের অধিক নিহত হয় এবং একই পরিমাণ লোক বন্দী হয়।
আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, পার্থক্যের রাত ছিল উভয় জামা‘আত মুখোমুখি হওয়ার দিন। রমযান মাসের সতের তারিখ জুমু‘আর দিন সকাল বেলা। মাগাযী ও সীরাতবিদদের নিকট এটিই বিশুদ্ধ মতামত।
﴿إِذۡ أَنتُم بِٱلۡعُدۡوَةِ ٱلدُّنۡيَا وَهُم بِٱلۡعُدۡوَةِ ٱلۡقُصۡوَىٰ وَٱلرَّكۡبُ أَسۡفَلَ مِنكُمۡۚ وَلَوۡ تَوَاعَدتُّمۡ لَٱخۡتَلَفۡتُمۡ فِي ٱلۡمِيعَٰدِ وَلَٰكِن لِّيَقۡضِيَ ٱللَّهُ أَمۡرٗا كَانَ مَفۡعُولٗا لِّيَهۡلِكَ مَنۡ هَلَكَ عَنۢ بَيِّنَةٖ وَيَحۡيَىٰ مَنۡ حَيَّ عَنۢ بَيِّنَةٖۗ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَسَمِيعٌ عَلِيمٌ ٤٢﴾ [الانفال: ٤٢]
অর্থানুবাদ:
“স্মরণ কর, যখন তোমরা উপত্যকার নিকট প্রান্তে ছিলে আর তারা ছিল দূরের প্রান্তে আর উটের আরোহী কাফেলা (আবু সুফইয়ানের নেতৃত্বে কুরাইশের সম্পদসহ কাফেলা) ছিল তোমাদের অপেক্ষা নিম্নভূমিতে। যদি তোমরা যুদ্ধ করার ব্যাপারে পরস্পরের মধ্যে পূর্বেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে, তবুও যুদ্ধ করার এ সিদ্ধান্ত তোমরা অবশ্যই রক্ষা করতে পারতে না (তোমাদের দুর্বল অবস্থার কারণে), যাতে আল্লাহ সে কাজ সম্পন্ন করতে পারেন যা ছিল পূর্বেই স্থিরীকৃত, যেন যাকে ধ্বংস হতে হবে সে যেন সুস্পষ্ট দলীলের ভিত্তিতে ধ্বংস হয় আর যাকে জীবিত থাকতে হবে সেও যেন সুস্পষ্ট দলীলের ভিত্তিতে জীবিত থাকে। আল্লাহ নিশ্চয় সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪২]
তাফসীর:
বদর যুদ্ধের বিভিন্ন দিক:
আল্লাহ তা‘আলা ফুরক্বানের দিন সম্পর্কে অবহিত করে বলেন, إِذۡ أَنتُم بِٱلۡعُدۡوَةِ ٱلدُّنۡيَا “স্মরণ কর, যখন তোমরা উপত্যকার নিকট প্রান্তে” মদীনার নিকটবর্তী উপত্যকার প্রান্তে তাঁবু ফেলেছিলে وَهُمْ (আর তারা) অর্থাৎ মুশরিকরা তাঁবু গেড়েছিল بِٱلۡعُدۡوَةِ ٱلۡقُصۡوَىٰ “ছিল দূরের প্রান্তে” অর্থাৎ মদীনা থেকে দুরে মক্কার প্রান্তে والرَّكْبُ “আরোহী কাফেলা” আর কাফেলা যাতে ছিল আবু সুফিয়ান তার ব্যবসাসামগ্রী সহকারে। أَسْفَلَ مِنْكُمْ “তোমাদের অপেক্ষা নিম্নভূমিতে” অর্থাৎ সমুদ্রের নিকটে وَلَوْ تَوَاعَدْتُمْ “যদি তোমরা যুদ্ধ করার ব্যাপারে পরস্পরের মধ্যে পূর্বেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে” অর্থাৎ তোমরা এবং মুশরিকরা নির্দিষ্ট একটি স্থানের لاخْتَلَفْتُمْ فِي الْمِيعَادِ “তবুও যুদ্ধ করার এ সিদ্ধান্ত তোমরা অবশ্যই রক্ষা করতে পারতে না” মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক এ আয়াত সম্পর্কে বলেন, ইয়াহইয়া ইবন আব্বাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবনুয যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, (তিনি) তার পিতা থেকে বর্ণনা করে বলেন, এ ব্যাপারে যদি তোমাদের এবং তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ থাকত, আর যদি তোমারা জানতে পারতে যে, তাদের সংখ্যা বেশি আর তোমাদের সংখ্যা কম, তবে তাদের সাথে তোমাদের সাক্ষাত হোক সেটা চাইতে না। وَلَٰكِن لِّيَقۡضِيَ ٱللَّهُ أَمۡرٗا كَانَ مَفۡعُولٗا “যাতে আল্লাহ সে কাজ সম্পন্ন করতে পারেন যা ছিল পূর্বেই স্থিরীকৃত”। অর্থাৎ যাতে আল্লাহ তা‘আলা তার স্বীয় কুদরাত দ্বারা ইসলাম এবং তার অনুসারীদেরকে শক্তিশালী ও সম্মানিত করবেন আর শির্ক এবং এর অনুসারীদেরকে অপদস্থ করবেন। অথচ এটি যে ঘটবে এ ব্যাপারে তোমাদের কোনো জ্ঞান ছিল না। ফলে আল্লাহ তা‘আলা নিজ অনুগ্রহে এ ব্যাপারে যা ইচ্ছা সম্পন্ন করেন। কা‘ব ইবন মালিকের হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুসলিমবৃন্দ কুরাইশ কাফেলাকে ধরার জন্য বের হয়ে আসেন, অবশেষে নির্দিষ্ট দিন স্থির ছাড়াই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে এবং শত্রুদেরকে একত্রিত করে দেন।  ইবন জারির রহ. বলেন, উমাইর ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন, আবু সুফিয়ান সিরিয়া থেকে বাণিজ্যিক কাফেলা নিয়ে আসছিল। আবু জাহাল বের হয়ে আসে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাথীদের থেকে তাদের রক্ষা করা জন্য। ঘটনাক্রমে তারা বদর প্রান্তরে একত্র হয়। অবস্থা এমন ছিল কেউ কারো সম্পর্কে জানে না, তারাও জানে না এরাও জানে না। শেষ পর্যন্ত উভয় দল মিলিত হল এবং লোকেরা একে অপরের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন, আবু সুফিয়ান যখন দেখতে পেল তার কাফেলা নিরাপদ, তখন সে কুরাইশদের নিকট সংবাদ পাঠান যে, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের কাফেলা ও লোকদের নাজাত দিয়েছে তোমরা মক্কায় ফিরে আস। তখন আবু জাহল বলল, আল্লাহর কসম আমরা ফিরে যাবো না। আমরা বদর প্রান্তরে পৌঁছবো, তথায় আমরা তিন দিন অবস্থান করব, সেখানে আমরা খাওয়ার আয়োজন করব, উট জবাই করব, মদপান করব, আমাদের গায়িকারা সেখানে গান গাইবে, আরবরা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারবে। তারপর থেকে তারা আমাদের ভয় করবে।
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন, এ হাদীসটি আমার নিকট বর্ণনা করেছেন ইয়াযীদ ইবন রূমান, (তিনি) উরওয়া ইবন যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে (তিনি বলেন): রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বদরের নিকটবর্তী হন তখন তিনি আলী ইবন আবু তালিব, সা‘দ ইবন আবু ওয়াক্কাস, যুবাইর ইবন আউওয়ামসহ একদল সাহাবীকে (কুরাইশ কাফেরদের) সংবাদ নিয়ে আসার জন্য প্রেরণ করেন। তারা কুরাইশদেরকে পানি পান করায় এমন দু’জন গোলামকে আটক করেন যাদের একজন ছিল সা‘ঈদ ইবন ‘আস গোত্রের এবং অপরজন ছিল হাজ্জাজ গোত্রের। তারা তাদের দু’জনকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে দেখেন যে, তিনি সালাত আদায় করছেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন: তোমরা কারা? তারা বলে, আমরা কুরাইশদেরকে পানি পান করাই, তারা আমাদেরকে পানি আনার জন্য পাঠিয়েছিল; কিন্তু সাহাবীগণের উত্তর মনঃপূত হয় না, তারা ভেবেছিল তারা আবু সুফিয়ানের লোক, ফলে তারা তাদেরকে মারধর শুরু করেন, এরপর যখন তারা তাদেরকে দুর্বল করে ফেলেন তখন তারা বলে আমরা আবু সুফিয়ানের লোক, তখন সাহাবীগণ তাদেরকে ছেড়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকু‘ করেন এবং দুই সাজদাহ করার পরে সালাম ফিরান, এরপর বলেন,«إِذَا صدَقاكم ضَرَبْتُمُوهُمَا، وَإِذَا كَذَبَاكُمْ تَرَكْتُمُوهُمَا. صَدَقَا، وَاللَّهِ إِنَّهُمَا لِقُرَيْشٍ، أَخْبِرَانِي عَنْ قُرَيْشٍ» “যখন তারা তোমাদেরকে সত্য বলেছিল তখন তোমরা তাদেরকে প্রহার করেছিলে, আর যখন তারা তোমাদেরকে মিথ্যা বলে তখন তোমরা তাকে ছেড়ে দিয়েছ, তারা সত্য বলেছে, আল্লাহর শপথ, তারা হচ্ছে কুরাইশের লোক, তোমরা আমাকে কুরাইশদের সম্পর্কে অবহিত কর”। তারা বলে, তারা এ পাহাড়ের পেছনে রয়েছে যা আপনি উপত্যকা থেকে দূরের প্রান্তে দেখতে পাচ্ছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বলেন, كَمِ الْقَوْمُ؟ তারা কতজন? তারা বলে, অনেক, তিনি বলেন, مَا عدَّتهم؟ সংখ্যা কত? তারা বলে, জানি না, তিনি বলেন, كَمْ ينحَرُون كُلَّ يَوْمٍ؟ তারা প্রতিদিন কয়টি করে উট জবেহ করে? তারা বলে, একদিন নয়টি আরেক দিন দশটি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, الْقَوْمُ مَا بَيْنَ التِّسْعِمِائَةِ إِلَى الْأَلْفِ. “তারা নয়শত থেকে এক হাজার”। এরপর তিনি তাদেরকে বলেন, فَمَنْ فِيهِمْ مِنْ أَشْرَافِ قُرَيْشٍ؟ কুরাইশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কারা কারা রয়েছে? তারা বলে, উতবা ইবন রাবী‘আহ, শাইবাহ ইবন রাবী‘আহ, আবুল বাখতারী ইবন হিশাম, হাকীম ইবন হিযাম, নাউফাল ইবন খুওয়াইলিদ, আল-হারিস ইবন ‘আমির ইবন নাউফাল, তুওয়াইমাহ ইবন ‘আদী ইবন নাউফাল, নাদ্বর ইবনুল হারিস, যাম‘আহ ইবনুল আসওয়াদ, আবু জাহল ইবন হিশাম, উমাইইয়া ইবন খালফ, ইবনুল হাজ্জাজের দুই পুত্র নাবীহ এবং মুনাব্বিহ, সুহাইল ইবন আমর, আমর ইবন আব্দে ওয়াদ্দ। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণের মুখোমুখি হয়ে বলেন, «هَذِهِ مَكَّةُ قَدْ أَلْقَتْ إِلَيْكُمْ أَفْلَاذَ كَبِدِهَا» “এ হচ্ছে মক্কা, সে তার মুল্যবান (নেতৃবৃন্দ) কলিজার টুকরা সন্তানদেরকে তোমাদের কাছে নিয়ে এসেছে”।
মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন, যখন লোকেরা বদরের দিন একত্র হয়, তখন সা‘আদ ইবন মু‘আয রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, আপনার জন্য কি একটি তাঁবু বানাবো নাকি যেখানে আপনি অবস্থান করবেন? আমরা আমাদের বাহনগুলোকে আপনার কাছে এনে বসাবো এবং আমরা আমাদের শত্রুদের মুখোমুখি হব। যদি আল্লাহ তা‘আলা আমাদের বিজয় দেন এবং আমাদের সম্মান দেন যা আমাদের চাওয়া আর যদি আমাদের পরাজিত করেন, তাহলে আপনি আপনার বাহনে অবস্থান করবেন আমাদের সম্প্রদায়ের যারা অবশিষ্ট থাকবে তাদের সাথে গিয়ে মিশবেন। আল্লাহর শপথ কিছু লোক পিছনে রয়ে গেছে আমরা আপনাকে তাদের চেয়ে বেশি মহব্বত করি না। যদি তারা জানতে পারত আপনি শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করবেন, তাহলে তারা পিছনে থাকত না। তারা আপনাকে সাহায্য করত, আপনার সঙ্গে থাকত। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রশংসা করলেন, তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন, তারপর তার জন্য একটি তাঁবু বানানে হলো তাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকর অবস্থান করলেন। তাদের সাথে আর কেউ ছিল না।
ইবন ইসহাক বলেন, কুরাইশরা সকালেই রওয়ানা করল। যখন তারা সামনে আসল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দেখতে পেল, তিনি বললেন,«اللهم هذه قريش قد أقلبت بخيلائها وفخرها تُحَادُّكَ وَتُكَذِّبُ رَسُولَكَ، اللَّهُمَّ أَحِنْهُمُ الْغَدَاةَ» “হে আল্লাহ এ হলো কুরাইশ সম্প্রদায় তারা অহংকার ও দম্ভ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। তারা তোমার বিরোধিতা করছে এবং রাসূলকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে। হে আল্লাহ! তুমি আগামী দিন তাদের ধ্বংস কর”।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: لِّيَهۡلِكَ مَنۡ هَلَكَ عَنۢ بَيِّنَةٖ وَيَحۡيَىٰ مَنۡ حَيَّ عَنۢ بَيِّنَةٖۗ “যেন যাকে ধ্বংস হতে হবে সে যেন সুস্পষ্ট দলীলের ভিত্তিতে ধ্বংস হয় আর যাকে জীবিত থাকতে হবে সেও যেন সুস্পষ্ট দলীলের ভিত্তিতে জীবিত থাকে” মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বলেন, নিদর্শণ এবং দৃষ্টান্ত এ সব দলীল-প্রমাণাদি প্রত্যক্ষ করার পরারও যে কুফুরী করার সে কুফুরী করে, আর যে এ অবস্থায় ঈমান আনার সে ঈমান আনে। এ তাফসীর সুন্দর, এখানে সরল কথা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ِيَهۡلِكَ مَنۡ هَلَكَ “যেন যাকে ধ্বংস হতে হবে সে যেন ধ্বংস হয়” নির্ধারিত দিন ছাড়াই একই স্থানে তোমাদেরকে তোমাদের শত্রুদের সাথে একত্রিত করার কারণ হচ্ছে তোমাদেরকে যেন তিনি তাদের ওপর সাহায্য করেন, সত্যের বাণীকে মিথ্যার বাণীর ওপর তুলে ধরেন, যাতে করে বিষয়টি স্পষ্ট হয়, দলীল অকাট্য হয় এবং প্রমাণ পরিষ্কার হয়। যাতে করে কারও পক্ষে দলীল এবং সন্দেহ-সংশয় অবশিষ্ট না থাকে। يَهۡلِكَ مَنۡ هَلَكَ “যেন যাকে ধ্বংস হতে হবে সে যেন ধ্বংস হয়”। অর্থাৎ বিবেক-বুদ্ধিমত্তা থাকার পরও যে কুফুরীর ওপর অবিচল থাকে, সে যেন তার পরিণতি কি তা জেনে থাকে। আর এ ব্যাপারেও সচেতন থাকে যে, সে একজন বিভ্রান্ত। কারণ তার বিরুদ্ধে দলীল-প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। وَيَحۡيَىٰ مَنۡ حَيَّ “আর যাকে জীবিত থাকতে হবে সেও যেন জীবিত থাকে” অর্থাৎ যে ঈমান আনার ঈমান আনে, عَنۢ بَيِّنَةٖۗ “সুস্পষ্ট দলীলের ভিত্তিতে” অর্থাৎ দলীল-প্রমাণ, অন্তর্দৃষ্টি ভিত্তিতে। ঈমান হচ্ছে অন্তরসমূহের প্রাণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿أَوَ مَن كَانَ مَيۡتٗا فَأَحۡيَيۡنَٰهُ وَجَعَلۡنَا لَهُۥ نُورٗا يَمۡشِي بِهِۦ فِي ٱلنَّاسِ ١٢٢﴾ [الانعام: ١٢٢] “যে ব্যক্তি মৃত ছিল, তাকে আমরা জীবিত করলাম, তার জন্য আলোর ব্যবস্থা করলাম যার সাহায্যে সে মানুষের মাঝে চলাফেরা করে”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত ১২২] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা অপবাদের ঘটনায় বলেন, আমার ব্যাপারে যে ধ্বংস হওয়ার ধ্বংস হয়েছে, অর্থাৎ তাঁর ব্যাপারে যে অপবাদ আরোপ করার সে তা করেছে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَإِنَّ ٱللَّهَ لَسَمِيعٌ عَلِيمٌ “আল্লাহ নিশ্চয় সর্বশ্রোতা” অর্থাৎ তোমাদের দো‘আর, অনুনয়-বিনয়ের আর তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনার বিষয়টি তিনি শুনেছেন। عَلِيمٌ“সর্বজ্ঞ” অর্থাৎ তোমাদের ব্যাপারে, তোমরা তোমাদের একগুঁয়ে কাফের শত্রুদের ওপর বিজয় অর্জন করার উপযুক্ত এটা তিনি ভালো করেই জানেন।
﴿إِذۡ يُرِيكَهُمُ ٱللَّهُ فِي مَنَامِكَ قَلِيلٗاۖ وَلَوۡ أَرَىٰكَهُمۡ كَثِيرٗا لَّفَشِلۡتُمۡ وَلَتَنَٰزَعۡتُمۡ فِي ٱلۡأَمۡرِ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ سَلَّمَۚ إِنَّهُۥ عَلِيمُۢ بِذَاتِ ٱلصُّدُورِ ٤٣ وَإِذۡ يُرِيكُمُوهُمۡ إِذِ ٱلۡتَقَيۡتُمۡ فِيٓ أَعۡيُنِكُمۡ قَلِيلٗا وَيُقَلِّلُكُمۡ فِيٓ أَعۡيُنِهِمۡ لِيَقۡضِيَ ٱللَّهُ أَمۡرٗا كَانَ مَفۡعُولٗاۗ وَإِلَى ٱللَّهِ تُرۡجَعُ ٱلۡأُمُورُ ٤٤﴾ [الانفال: ٤٣، ٤٤]
অর্থানুবাদ:
“স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নের মাধ্যমে তাদের সংখ্যাকে অল্প করে দেখিয়েছিলেন, যদি তিনি তাদের সংখ্যাকে তোমার নিকট বেশি করে দেখাতেন তাহলে তোমরা অবশ্যই সাহস হারিয়ে ফেলতে আর যুদ্ধের বিষয় নিয়ে অবশ্যই ঝগড়া শুরু করে দিতে। কিন্তু আল্লাহই তোমাদেরকে রক্ষা করেছিলেন, অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে তিনি খুবই ভালোভাবে অবহিত। স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিলে তখন তিনি তোমাদের চোখে তাদেরকে স্বল্প সংখ্যক দেখিয়েছিলেন এবং তাদের চোখে তোমাদেরকে স্বল্প সংখ্যক দেখিয়েছিলেন সেই ব্যাপারটি সম্পন্ন করার জন্য যা ছিল পূর্ব স্থিরীকৃত। যাবতীয় বিষয়াবলী (অবশেষে) আল্লাহর ই নিকট ফিরে আসে”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪৩-৪৪]
তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা উভয় বাহিনীকে একের চোখে অপরকে কম করে দেখান:
মুজাহিদ রহ. বলেন, আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখান যে, তাদের সংখ্যা কম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে এ ব্যাপারে অবহিত করেন, এ ব্যাপারটি ছিল তাদেরকে দৃঢ় করার জন্য, এরূপ মত ব্যক্ত করেন ইবন ইসহাক এবং অন্যান্যরা।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَلَوۡ أَرَىٰكَهُمۡ كَثِيرٗا لَّفَشِلۡتُمۡ “যদি তিনি তাদের সংখ্যাকে তোমার নিকট বেশি করে দেখাতেন তাহলে তোমরা অবশ্যই সাহস হারিয়ে ফেলতে” তবে তোমরা তাদের ব্যাপারে ভীরু হয়ে পড়তে, আর তোমাদের মাঝে মতভেদ দেখা দিত, وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ سَلَّمَۚ “কিন্তু আল্লাহই তোমাদেরকে রক্ষা করেছিলেন” অর্থাৎ তা থেকে, তিনি তোমাদের নিকট তাদেরকে কম করে দেখিয়েছেন, إِنَّهُۥ عَلِيمُۢ بِذَاتِ ٱلصُّدُورِ “অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে তিনি খুবই ভালোভাবে অবহিত” অন্তর এবং অভ্যন্তর যা কিছু গোপন করে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা সম্যক অবগত আছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿يَعۡلَمُ خَآئِنَةَ ٱلۡأَعۡيُنِ وَمَا تُخۡفِي ٱلصُّدُورُ ١٩﴾ [غافر: ١٩]
আল্লাহ তা‘আলা বাণী: وَإِذۡ يُرِيكُمُوهُمۡ إِذِ ٱلۡتَقَيۡتُمۡ فِيٓ أَعۡيُنِكُمۡ قَلِيلٗا “স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিলে তখন তিনি তোমাদের চোখে তাদেরকে স্বল্প সংখ্যক দেখিয়েছিলেন” এটিও তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম দয়া যে, তিনি মুসলিমবৃন্দের চর্মচক্ষেও কাফেরদেরকে কম করে দেখিয়েছেন, তিনি তাদের ওপর তাদেরকে সাহস যুগিয়েছেন, আর তাদের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَيُقَلِّلُكُمۡ فِيٓ أَعۡيُنِهِمۡ “এবং তাদের চোখে তোমাদেরকে স্বল্প সংখ্যক দেখিয়েছিলেন” ইবন আবু হাতিম বর্ণনা করেন, ইকরিমা বলেন, وَإِذۡ يُرِيكُمُوهُمۡ إِذِ ٱلۡتَقَيۡتُمۡ “স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিলে” তিনি দু’টি দলের উভয়কে একে অপরের বিরুদ্ধে উৎসাহিত করেন, এ বর্ণনাটির বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিকতা বিশুদ্ধ।
আল্লাহ তা‘আলা বাণী: لِيَقۡضِيَ ٱللَّهُ أَمۡرٗا كَانَ مَفۡعُولٗاۗ “যাতে আল্লাহ সে কাজ সম্পন্ন করতে পারেন যা ছিল পূর্বেই স্থিরীকৃত” তাদের উভয়ের মাঝে যুদ্ধ শুরুর জন্য, যাতে করে তিনি তার থেকে প্রতিশোধ নিতে পারেন যে প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা করেছিলেন আর তার বন্ধুদের মধ্যেকার যার ওপর তিনি অনুগ্রহ করে নি‘আমত পরিপূর্ণ করতে চান তা করেন। এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা উভয় দলকে একে অপরের বিরুদ্ধে আগ্রহী করে তুলেন আর উভয়কে উভয়ের চোখে কম করে দেখান যেন তারা উভয়ে সাক্ষাতের ব্যাপারে আগ্রহী হয়, আর এটি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে সংঘটিত হয়; কিন্তু যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় আর আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বাসীদেরকে এক হাজার ফিরিশতা দ্বারা সাহায্য করেন যারা ক্রমান্বয়ে আসতে থাকে। (সে সময়) কাফেররা বিশ্বাসীদেরকে তাদরে দ্বিগুণ প্রত্যক্ষ করে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿قَدۡ كَانَ لَكُمۡ ءَايَةٞ فِي فِئَتَيۡنِ ٱلۡتَقَتَاۖ فِئَةٞ تُقَٰتِلُ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَأُخۡرَىٰ كَافِرَةٞ يَرَوۡنَهُم مِّثۡلَيۡهِمۡ رَأۡيَ ٱلۡعَيۡنِۚ وَٱللَّهُ يُؤَيِّدُ بِنَصۡرِهِۦ مَن يَشَآءُۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَعِبۡرَةٗ لِّأُوْلِي ٱلۡأَبۡصَٰرِ ١٣﴾ [ال عمران: ١٣] “তোমাদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন আছে সেই দু’দল সৈন্যের মধ্যে, যারা পরস্পর প্রতিদ্বন্দীরূপে দাঁড়িয়েছিল (বদর প্রান্তরে)। একদল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছিল এবং অপরদল ছিল কাফের, তারা মুসলিমগণকে প্রকাশ্য চোখে দ্বিগুণ দেখছিল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে স্বীয় সাহায্যের দ্বারা শক্তিশালী করে থাকেন, নিশ্চয় এতে দৃষ্টিমানদের জন্য শিক্ষা রয়েছে”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩] এভাবে আমরা দু’টো আয়াতকে একত্রিত করতে পারি, আর এদের প্রতিটি ন্যায় ও সত্য। আল্লাহ তা‘আলার জন্য সকল প্রশংসা এবং তাঁরই অনুগ্রহ।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا لَقِيتُمۡ فِئَةٗ فَٱثۡبُتُواْ وَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ كَثِيرٗا لَّعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٤٥ وَأَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَا تَنَٰزَعُواْ فَتَفۡشَلُواْ وَتَذۡهَبَ رِيحُكُمۡۖ وَٱصۡبِرُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ ٤٦﴾ [الانفال: ٤٥، ٤٦]
অর্থানুবাদ:
“হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা কোনো বাহিনীর সম্মুখীন হবে তখন অবিচল থাকবে আর আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সাফল্য লাভ করতে পার। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, পরস্পরে ঝগড়া বিবাদ করো না, তা করলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে, তোমাদের শক্তি-ক্ষমতা বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য ধারণ করবে, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪৫-৪৬]
তাফসীর:
যুদ্ধের শিষ্টাচার শিক্ষা:
এখানে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মুমিন বান্দাগণকে শিক্ষা দিচ্ছেন যে, যখন তারা শত্রুদের মুখোমুখী হবে তখন সাক্ষাতের আদব এবং সাহসিকতার পদ্ধতি কিরূপ হবে তা শিক্ষা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا لَقِيتُمۡ فِئَةٗ فَٱثۡبُتُواْ “হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা কোনো বাহিনীর সম্মুখীন হবে তখন অবিচল থাকবে”। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবন আবু আউফা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শত্রুদের সাথে সাক্ষাতের দিনগুলোর কোনো এক দিনের প্রতীক্ষা করেন, অবশেষে যখন সূর্য ঢলে পড়ে তখন তিনি দাঁড়িয়ে সাহাবীগণের উদ্দেশ্যে বলেন,«يَا أَيُّهَا النَّاسُ لَا تَتَمَنَّوْا لِقَاءَ الْعَدُوِّ وَاسْأَلُوا اللَّهَ الْعَافِيَةَ، فَإِذَا لَقِيتُمُوهُمْ فَاصْبِرُوا، وَاعْلَمُوا أَنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ ظِلَالِ السُّيُوفِ» ‘হে লোক সকল, তোমরা শত্রুদের সাথে সাক্ষাতের আকাঙ্খা করো না, আল্লাহ তা‘আলার নিকট এ থেকে আশ্রয় চাও, কিন্তু যদি সাক্ষাত হয়েই যায় তবে ধৈর্য ধারণ কর। জেনে রাখ, জান্নাত হচ্ছে তরবারীর ছায়ার নিচে’। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে বলেন,«اللَّهُمَّ مُنْزِلَ الْكِتَابِ، وَمُجْرِيَ السَّحَابِ، وَهَازِمَ الْأَحْزَابِ، اهْزِمْهُمْ وانصرنا عليهم» “হে আল্লাহ, কিতাব অবতীর্ণকারী, মেঘকে প্রবাহিতকারী, যৌথবাহিনীকে পরাজিতকারী, তাদেরকে পরাজিত করুন আর তাদের ওপর আমাদেরকে সাহায্য করুন’’।  
কাতাদাহ রহ. বলেন, সর্বাধিক ব্যস্ততা তরবারীর আঘাতের সময়ও আল্লাহ তা‘আলার যিকির করাকে ফরয করে দিয়েছেন।  
শত্রুদের মুকবিলা করার সময় দৃঢ় থাকার নির্দেশ:
আল্লাহ তা‘আলা শত্রুদের সাথে যুদ্ধের সময় দৃঢ় থাকার এবং তাদের সাথে লড়াই করার মুহূর্তে ধৈর্য ধারণ করার নির্দেশ প্রদান করেন, কাজেই তারা  পালিয়ে যাবে না, ভয় পেয়ে সরে পড়বে না, ভীরুতা দেখাবে না। সে অবস্থায় তারা আল্লাহকে স্মরণ করবে, তাঁকে ভুলে যাবে না; বরং তাঁর কাছে সাহায্য চাইবে এবং তাঁর ওপর ভরসা করবে, শত্রুদের বিরুদ্ধে তাঁর কাছে সাহায্য চাইবে। আর সে অবস্থায় আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে যে নির্দেশ দেন সেগুলো তারা পালন করবে আর যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাকবে, তারা নিজেরা আপসে বিবাদে লিপ্ত হবে না, ফলে তাদের মাঝে মতভেদের সৃষ্টি হবে আর সেটা তাদের দুর্বলতা এবং ব্যর্থতার কারণ হবে। وَتَذۡهَبَ رِيحُكُمۡۖ “তোমাদের শক্তি-ক্ষমতা বিলুপ্ত হবে” অর্থাৎ তোমাদের শক্তি, তোমাদের ঐক্য এবং তোমাদের যে মনোযোগ রয়েছে (তা চলে যাবে)। وَٱصۡبِرُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ “আর ধৈর্য ধারণ করবে, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন” সাহাবীগণের ছিল এমন সাহসিকতা এবং তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের প্রতি ছিলেন এতটা আনুগত্যশীল আর তারা তাদেরকে যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন তা এতটা পালনকারী, যা তাদের পূর্বে কোনো জাতির মাঝে এবং তাদের পূর্বের শতাব্দিগুলোতে দেখা যায় নি, আর তাদের পরে যারা এসেছে তাদের মাঝেও দেখা যায় নি। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যের কল্যাণে এবং তিনি তাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তার প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে তাদের আল্লাহ তাদের অন্তরগুলোকে উন্মোচন করে দেন।  আর অল্প সময়ের মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিমে বিভিন্ন অঞ্চল তারা জয় করেছিল। অথচ ঐ সমস্ত অঞ্চলগুলোর সৈন্যসামন্তদের সংখ্যার তুলনায় তাদের সংখ্যা ছিল নিতান্ত অল্প। যেমন, রোম, পারস্য, তুরস্ক, পূর্ব ইউরোপ, বার্বার, ইথিওপিয়া, সুদানের কিছু অঞ্চল, মিসরীয় এলাকা এবং আদম সন্তানদের আরও অনেক। তারা তাদের সকলের ওপর বিজয়ী হয়েছিল অবশেষে আল্লাহর বাণী উর্ধ্বে উন্নীত হয়। আর সমস্ত দীনের ওপর তাঁর দীন বিজয় লাভ করে, ত্রিশ বৎসরের কম সময়ে ইসলামী সাম্রাজ্য দুনিয়ার পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে সম্প্রসারিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর সন্তুষ্ট হোন আর তাদের সকলকে তিনি সন্তুষ্ট করুন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাদের দলভুক্ত করুন, নিশ্চয় তিনি উদার এবং দানশীল।
﴿وَلَا تَكُونُواْ كَٱلَّذِينَ خَرَجُواْ مِن دِيَٰرِهِم بَطَرٗا وَرِئَآءَ ٱلنَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِۚ وَٱللَّهُ بِمَا يَعۡمَلُونَ مُحِيطٞ ٤٧ وَإِذۡ زَيَّنَ لَهُمُ ٱلشَّيۡطَٰنُ أَعۡمَٰلَهُمۡ وَقَالَ لَا غَالِبَ لَكُمُ ٱلۡيَوۡمَ مِنَ ٱلنَّاسِ وَإِنِّي جَارٞ لَّكُمۡۖ فَلَمَّا تَرَآءَتِ ٱلۡفِئَتَانِ نَكَصَ عَلَىٰ عَقِبَيۡهِ وَقَالَ إِنِّي بَرِيٓءٞ مِّنكُمۡ إِنِّيٓ أَرَىٰ مَا لَا تَرَوۡنَ إِنِّيٓ أَخَافُ ٱللَّهَۚ وَٱللَّهُ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ٤٨ إِذۡ يَقُولُ ٱلۡمُنَٰفِقُونَ وَٱلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ غَرَّ هَٰٓؤُلَآءِ دِينُهُمۡۗ وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ فَإِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٞ ٤٩﴾ [الانفال: ٤٧، ٤٩]
অর্থানুবাদ:
“তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা গর্ব অহঙ্কারসহ লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহর পথে বাধা দেওয়ার জন্য নিজেদের ঘর থেকে বের হয়েছিল। তারা যা কিছুই করুক না কেন, আল্লাহ তাদেরকে ঘিরে রেখেছেন। স্মরণ কর, যখন শয়তান তাদের কার্যকলাপকে তাদের দৃষ্টিতে খুবই চাকচিক্যময় করে দেখিয়েছিল আর তাদেরকে বলেছিল, ‘আজ তোমাদেরকে পরাজিত করতে পারে মানুষের মাঝে এমন কেউই নেই, আমি তোমাদের পাশেই আছি।’ অতঃপর দল দু’টি যখন পরস্পরের দৃষ্টির হলো তখন সে পিছনে সরে পড়ল আর বলল, ‘তোমাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্কই নেই, আমি তো দেখি (কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আল্লাহর নাযিলকৃত ফিরিশতা) যা তোমরা দেখতে পাও না, আমি অবশ্যই আল্লাহকে ভয় করি। কেননা আল্লাহ শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠোর। যখন মুনাফিকরা আর যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা বলে, ‘এ লোকগুলোকে তাদের দীন ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে’। (কিন্তু আসল ব্যাপার হলো) কেউ যদি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তাহলে আল্লাহ তো প্রবল পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞানী”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪৭-৪৯]
তাফসীর:
বদরের দিন মুশরিকরা যেভাবে বের হয়:
আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণকে নির্দেশ প্রদান করেন তারা যেন তাঁর পথে আন্তরিকভাবে যুদ্ধ করে, বেশি বেশি তাঁর যিকির করে, আর তাদেরকে মুশরিকদের মতো নিজেদের গৃহ থেকে বের হয়ে আসতে নিষেধ করেন, بَطَرٗا “দম্ভভরে” সত্যকে প্রতিহত করে, وَرِئَآءَ ٱلنَّاسِ “লোক দেখানোর জন্য” অর্থাৎ তাদের ওপর গর্ব অহঙ্কার প্রকাশ করা। যেমন, আবু জাহলকে যখন বলা হয়: বাণিজ্য কাফেলা বেঁচে গেছে কাজেই ফিরে চল, তখন সে বলল: না, আল্লাহর শপথ, আমরা ফিরে যাব না যতক্ষণ না বদরের কূপে এসে উপনিত হই, উট কুরবাণী করি, মদ পান করি, আর গায়িকারা আমাদেরকে গান গেয়ে শুনায়, আর আরবরা সর্বদাই আমাদের অবস্থান আর আমরা যা করেছি এ সম্পর্কে আলোচনা করবে; কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণরূপে তার বিপরীতে চলে যায়। কেননা তারা যখন বদরের কূপে এসে উপনীত হয় তখন তারা নিজেদেরকে মৃত্যুর নিকট নিয়ে আসে, (বদরে তাদের শেষ পরিণতি ছিল) তাদেরকে বদরের কূপে অপমান-অপদস্থ করে নিক্ষেপ করা হয়, তারা চিরকালের শাস্তির মধ্যে দুর্বিসহ জীবন-যাপন করে। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَٱللَّهُ بِمَا يَعۡمَلُونَ مُحِيطٞ “তারা যা কিছুই করুক না কেন, আল্লাহ তাদেরকে ঘিরে রেখেছেন” অর্থাৎ তিনি জানেন তারা কীভাবে এবং কী নিয়ে এসেছে? এ কারণে তিনি তাদেরকে নিকৃষ্ট শাস্তি প্রদান করবেন। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা, মুজাহিদ, কাতাদা, দাহ্হাক, সুদ্দী রহ.وَلَا تَكُونُواْ كَٱلَّذِينَ خَرَجُواْ مِن دِيَٰرِهِم بَطَرٗا وَرِئَآءَ ٱلنَّاسِ “তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা গর্ব অহঙ্কারসহ লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহর পথে বাধা দেওয়ার জন্য নিজেদের ঘর থেকে বের হয়েছিল” তারা বলেন, এরা হচ্ছে ঐ সমস্ত মুশরিক যারা বদরের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। মুহাম্মাদ ইবন কা‘আব বলেন, কুরাইশরা যখন মক্কা থেকে বদরের উদ্দেশ্যে বের হয় তখন তারা গায়িকা এবং বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বের হয়েছিল, ফলে তাদের বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা আয়াত অবতরণ করে বলেন-وَلَا تَكُونُواْ كَٱلَّذِينَ خَرَجُواْ مِن دِيَٰرِهِم بَطَرٗا وَرِئَآءَ ٱلنَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِۚ وَٱللَّهُ بِمَا يَعۡمَلُونَ مُحِيطٞ “তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা গর্ব অহঙ্কারসহ লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহর পথে বাধা দেওয়ার জন্য নিজেদের ঘর থেকে বের হয়েছিল, তারা যা কিছুই করুক না কেন, আল্লাহ তাদেরকে ঘিরে রেখেছেন”।
শয়তান কর্তৃক (মন্দকে) সুশোভিত করে দেখানো আর মুশরিকদেরকে তার বিভ্রান্ত করা:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَإِذۡ زَيَّنَ لَهُمُ ٱلشَّيۡطَٰنُ أَعۡمَٰلَهُمۡ وَقَالَ لَا غَالِبَ لَكُمُ ٱلۡيَوۡمَ مِنَ ٱلنَّاسِ وَإِنِّي جَارٞ لَّكُمۡۖ “স্মরণ কর, যখন শয়তান তাদের কার্যকলাপকে তাদের দৃষ্টিতে খুবই চাকচিক্যময় করে দেখিয়েছিল আর তাদেরকে বলেছিল, ‘আজ তোমাদেরকে পরাজিত করতে পারে মানুষের মাঝে এমন কেউই নেই, আমি তোমাদের পাশেই আছি” শয়তান (তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ) মুশরিকদের পরিকল্পনা তাদের দৃষ্টিতে চাকচিক্যময় করে তোলে, আর তাদেরকে প্রলুব্ধ করে যে, এ দিনে কোনো লোকই তাদেরকে পরাজিত করতে পারবে না। আর তাদের দেশে তাদের শত্রু বনু বাকর আক্রমণ করতে আসবে এ থেকে তাদের ভয় দুর করে দেয়। আর বলে: আমি তোমাদের পড়শি, সে বানু মুদলিজের সর্দার সুরাকাহ ইবন মালিক ইবন জু‘শুমের রূপ ধরে তাদের কাছে আসে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা তার বর্ণনা দিয়ে বলেন,﴿يَعِدُهُمۡ وَيُمَنِّيهِمۡۖ وَمَا يَعِدُهُمُ ٱلشَّيۡطَٰنُ إِلَّا غُرُورًا ١٢٠﴾ [النساء : ١٢٠] “সে তাদেরকে আশ্বাস দেয়, মিথ্যা প্রলোভন দেয়, বস্তুতঃ শয়তান তাদেরকে যে আশ্বাস দেয় তা ছলনা ছাড়া আর কিছুই নয়” আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা এ আয়াত সম্পর্কে বলেন, বদর যুদ্ধের দিন ইবলিস তার পতাকা এবং তার দলবল সহ মুশরিকদের সাথে যাত্রা করে, আর মুশরিকদের অন্তরে ঢুকিয়ে দেয় এবং বলে যে لَا غَالِبَ لَكُمُ ٱلۡيَوۡمَ مِنَ ٱلنَّاسِ وَإِنِّي جَارٞ لَّكُمۡۖ কেউ তাদেরকে পরাজিত করতে পারবে না আর আমি তোমাদের পড়শি হিসেবে আছি; কিন্তু যখন মুসলিমবৃন্দের সাথে তাদের সাক্ষাত হয় রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মুষ্টি মাটি নিয়ে মুশরিকদের দিক নিক্ষেপ করেন, শয়তান ফিরিশতাদের সাহায্য প্রত্যক্ষ করে, তখন শয়তান পলায়ন কনের  نَكَصَ عَلَىٰ عَقِبَيۡهِ “তখন সে পিছনে সরে পড়ল” তিনি বলেন, পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে ফিরে যায়, আর বলে: إِنِّيٓ أَرَىٰ مَا لَا تَرَوۡنَ “আমি তো দেখি যা তোমরা দেখতে পাও না”।
আলী ইবন আবু তালহা বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, বদরের যুদ্ধে ইবলিস মুদলিজ গোত্রের সুরাকাহ ইবন মালিক ইবন জু‘শুমের আকৃতি ধরে শয়তান বাহিনীর সাথে আসে এ সময় তার সাথে ছিল পতাকা, তখন শয়তান মুশরিকদের বলে: আজ কেউ তোমাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবে না আর আমি তোমাদের পড়শি, যখন উভয় বাহিনী মুখোমুখী হয় তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মুষ্টি বালি নিয়ে মুশরিকদের মুখে ছুঁড়ে মারেন, ফলে তারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পলায়ন করে, জিবরীল আলাইহিস সালাম ইবলিসের মুখোমুখী হন, এরপর সে যখন জিবরীল আলাইহিস সালামকে দেখে এ সময় তার হাত ছিল এক মুশরিকের হাতে, সে তখন টান মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার বাহিনীর সাথে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পলায়ন করে তখন সেই মুশরিক বলে, ওহে সুরাকাহ, তুমি কি মনে কর না যে, তুমি আমাদের পড়শি? সে বলে: আমি যা দেখি তোমরা তা দেখ না, আমি আল্লাহকে ভয় করি, আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা, এ কথা সে তখন বলে যখন ফিরিশতাকে প্রত্যক্ষ করে। আল্লাহর শত্রু মিথ্যা কথা বলে, আল্লাহর শপথ সে কখনোই আল্লাহকে ভয় করে না। কিন্তু সে বুঝতে পারছে যে, তার কিছু করার কোনো শক্তি নেই। যারা আল্লাহর আনুগত্য করে ও তার অনুসরণ করে তাদের ক্ষেত্রে আল্লাহর দুশমনের অভ্যাস এমনই হয়ে থাকে। এমনকি দেখা যাবে, যখন হক ও বাতিলের মাঝে যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তখন সে সময়মত তাদের ছেড়ে দেয় এবং তাদের থেকে দায় মুক্তির ঘোষণা দেয়।
আমি বলি,  আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿كَمَثَلِ ٱلشَّيۡطَٰنِ إِذۡ قَالَ لِلۡإِنسَٰنِ ٱكۡفُرۡ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّي بَرِيٓءٞ مِّنكَ إِنِّيٓ أَخَافُ ٱللَّهَ رَبَّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٦﴾ [الحشر: ١٦] “(এরা) শয়তানের ন্যায়, সে মানুষকে বলেছিল, ‘কুফুরী কর’, অতঃপর যখন সে কুফুরী করল তখন সে বলল, আমি তোমার থেকে মুক্ত; নিশ্চয় আমি সকল সৃষ্টির রব আল্লাহকে ভয় করি”। [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ১৬] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَقَالَ ٱلشَّيۡطَٰنُ لَمَّا قُضِيَ ٱلۡأَمۡرُ إِنَّ ٱللَّهَ وَعَدَكُمۡ وَعۡدَ ٱلۡحَقِّ وَوَعَدتُّكُمۡ فَأَخۡلَفۡتُكُمۡۖ وَمَا كَانَ لِيَ عَلَيۡكُم مِّن سُلۡطَٰنٍ إِلَّآ أَن دَعَوۡتُكُمۡ فَٱسۡتَجَبۡتُمۡ لِيۖ فَلَا تَلُومُونِي وَلُومُوٓاْ أَنفُسَكُمۖ مَّآ أَنَا۠ بِمُصۡرِخِكُمۡ وَمَآ أَنتُم بِمُصۡرِخِيَّ إِنِّي كَفَرۡتُ بِمَآ أَشۡرَكۡتُمُونِ مِن قَبۡلُۗ إِنَّ ٱلظَّٰلِمِينَ لَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٞ ٢٢﴾ [ابراهيم: ٢٢] “আর যখন যাবতীয় বিষয়ের ফয়সালা হয়ে যাবে, তখন শয়তান বলবে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে ওয়াদা দিয়েছিলেন সত্য ওয়াদা, তোমাদের ওপর আমার কোনো আধিপত্য ছিল না, তবে আমিও তোমাদেরকে ওয়াদা দিয়েছিলাম, এখন আমি তা ভঙ্গ করলাম। তোমাদেরকে দাওয়াত দিয়েছি, আর তোমরা আমার দাওয়াতে সাড়া দিয়েছ। সুতরাং তোমরা আমাকে ভর্ৎসনা করো না; বরং নিজদেরকেই ভর্ৎসনা কর। আমি তোমাদের উদ্ধারকারী নই, আর তোমরাও আমার উদ্ধারকারী নও। ইতোপূর্বে তোমরা আমাকে যার সাথে শরীক করেছ, নিশ্চয় আমি তা অস্বীকার করছি। নিশ্চয় যালিমদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব’’। [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ২২]
বদর যুদ্ধে মুনাফিকদের অবস্থান:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: إِذۡ يَقُولُ ٱلۡمُنَٰفِقُونَ وَٱلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ غَرَّ هَٰٓؤُلَآءِ دِينُهُمۡۗ “যখন, মুনাফিক্বরা আর যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা বলে, ‘এ লোকগুলোকে তাদের দীন ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে” আলী ইবন আবু তালহা বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা এ আয়াত সম্পর্কে বলেন, যখন উভয় পক্ষ পরস্পর মুখোমুখী হয় আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের চোখে মুসলিমবৃন্দের সংখ্যা কম করে দেখান, আর মুসলিমবৃন্দের চোখে মুশরিকদের সংখ্যা কম করে দেখান, তখন মুশরিকরা বলে: غَرَّ هَٰٓؤُلَآءِ دِينُهُمۡۗ তাদের দীন তাদেরকে ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে, এ কথা তারা এ জন্য বলে কেননা তাদের চোখে মুসলিমবৃন্দের সংখ্যা কম ধরা পড়ে, তারা মনে করে যে, তারা অচিরেই পরাজিত হবে, এতে তারা বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ করে না, এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ فَإِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ “কেউ যদি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তাহলে আল্লাহ তো প্রবল পরাক্রান্ত”।
কাতাদা রহ. বলেন, তারা একদল মুমিনকে দেখে যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার বিধানের ব্যাপারে বড়ই কঠোর, আমাদেরকে বলা হয়েছে: আল্লাহর শত্রু আবু জাহল যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণকে প্রত্যক্ষ করে তখন সে বলে: আল্লাহর শপথ, আজকের দিনের পর তারা আর কখনই আল্লাহর ইবাদাত করবে না, সে একথা বলে ধৃষ্টতা এবং একগুঁয়েমী বশতঃ।
মুজাহিদ রহ. বলেন, তারা হলো কুরাইশ। মক্কা থেকে কুরাইশদের সাথে বের হয়। অতঃপর সংশয় তাদের বিরত রাখে। তারা যখন রাসূলের সাহাবীগণকে দেখতে পায়, তারা বলে তাদেরকে তাদের দীন ধোঁকায় ফেলেছে, ফলে তারা তাদের নিজেদের সংখ্যা কম আর শত্রুদের সংখ্যা বেশি হওয়া সত্বেও এখানে এসেছে। একই কথা মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ইবন ইয়াসার বলেছেন।
এ আয়াত সম্পর্কে ইবন জারির রহ. হাসান রহ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, তারা হলো, যারা বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে নি, ফলে তাদের মুনাফিক নাম রাখা হয়। আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ “কেউ যদি আল্লাহর ওপর ভরসা করে” অর্থাৎ তাঁর সম্মানের ওপর ভরসা করে, فَإِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ “তাহলে আল্লাহ তো প্রবল পরাক্রান্ত” যে ব্যক্তি তাঁর নিকট আশ্রয় নেয়, حَكِيمٞ “মহাবিজ্ঞানী” তাঁর কর্মসমূহে, তিনি সবকিছুকে তার সঠিক স্থানে রাখেন। ফলে তিনি তাকে সাহায্য করেন যে সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত আর তাকে অপদস্থ করেন যে তার যোগ্য।
﴿وَلَوۡ تَرَىٰٓ إِذۡ يَتَوَفَّى ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ يَضۡرِبُونَ وُجُوهَهُمۡ وَأَدۡبَٰرَهُمۡ وَذُوقُواْ عَذَابَ ٱلۡحَرِيقِ ٥٠ ذَٰلِكَ بِمَا قَدَّمَتۡ أَيۡدِيكُمۡ وَأَنَّ ٱللَّهَ لَيۡسَ بِظَلَّٰمٖ لِّلۡعَبِيدِ ٥١﴾ [الانفال: ٥٠، ٥١]
অর্থানুবাদ:
“তুমি যদি দেখতে যখন ফিরিশতারা কাফেরদের প্রাণবায়ু নির্গত করে তখন তাদের মুখে আর পিঠে প্রহার করে আর বলে অগ্নিতে দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা ভোগ কর। এটি হলো তা-ই যা তোমাদের হস্তগুলো (অর্জন করে) আগে পাঠিয়েছে কেননা আল্লাহ তো তাঁর বান্দার প্রতি অত্যাচারী নন”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৫০-৫১]
তাফসীর:
ফিরিশতামণ্ডলি যখন কাফেরদের রূহগুলো কবজ করছিল তখন তাদেরকে প্রহার করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি তুমি স্বচক্ষে দেখতে, হে মুহাম্মাদ, যখন ফিরিশতারা কাফেরদের রূহগুলোকে কবজ করছিল তবে তুমি এক ভয়ানক মন্দ বিষয় দেখতে পেতে, যখন يَضۡرِبُونَ وُجُوهَهُمۡ وَأَدۡبَٰرَهُمۡ “তাদের মুখে আর পিঠে প্রহার করে” তারা তাদেরকে বলে: وَذُوقُواْ عَذَابَ ٱلۡحَرِيقِ “আর বলে অগ্নিতে দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা ভোগ কর” ইবন জুরাইয বর্ণনা করেন: মুজাহিদ রহ. বলেন, وَأَدۡبَٰرَهُمۡ (পিঠে) তাদের পেছনের দিকে, তিনি বলেন, বদরের দিন। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, মুশরিকরা যখন বদর যুদ্ধে মুসলিমদের মুখোমুখী হয় তখন তারা তরবারী দ্বারা মুশরিকদের মুখে আঘাত করে, এরপর যখন তারা পলায়ন করে তখন ফিরিশতারা তাদেরকে ধরে তাদের পশ্চাৎদেশে আঘাত করে। সা‘ঈদ ইবন জুবাইর বলেন, يَضۡرِبُونَ وُجُوهَهُمۡ وَأَدۡبَٰرَهُمۡ অর্থাৎ নিতম্ব।
এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ফিরিশতারা তাদেরকে বলবে: وَذُوقُواْ عَذَابَ ٱلۡحَرِيقِ “অগ্নিতে দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা ভোগ কর”।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ذَٰلِكَ بِمَا قَدَّمَتۡ أَيۡدِيكُمۡ “এটি হলো তাই যা তোমাদের হস্তগুলো (অর্জন করে) আগে পাঠিয়েছে” অর্থাৎ তোমরা তোমাদের দুনিয়াবী জীবনে যে মন্দ আমল করেছ, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে এর বদলে এ শাস্তি প্রদান করবেন, وَأَنَّ ٱللَّهَ لَيۡسَ بِظَلَّٰمٖ لِّلۡعَبِيدِ “আল্লাহ তো তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যাচারী নন” তিনি তাঁর বান্দাদের কারও প্রতি যুলুম করেন না; বরং তিনি ন্যায়বিচারক যিনি অত্যাচার করেন না, তিনি বরকতময়, সুউচ্চ, পাক-পবিত্র, অভাবমুক্ত প্রশংসিত। এ কারণে সহীহ হাদীসে এসেছে, ইমাম মুসলিম রহ. আবু যার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: «يَا عِبَادِي إِنِّي حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلَا تَظَالَمُوا، يَا عِبَادِي إِنَّمَا هِيَ أَعْمَالُكُمْ أُحْصِيهَا لَكُمْ، فَمَنْ وَجَدَ خَيْرًا فَلْيَحْمَدِ اللَّهَ، وَمِنْ وَجَدَ غير ذلك فلا يلومن إلا نفسه» “হে আমার বান্দাগণ, আমি আমার ওপর যুলুমকে হারাম করে নিয়েছি আর তা তোমাদের মাঝেও হারাম করে দিয়েছি, কাজেই তোমরা পরস্পর যুলুম-অত্যাচার করোনা, হে আমার বান্দা, এগুলো হচ্ছে তোমাদের আমল যা আমি তোমাদের জন্য গণনা করে রাখছি, কাজেই যে ব্যক্তি ভালো কিছু পায় সে যেন আল্লাহর সুখ্যাতি করে, আর যে ব্যক্তি এটি ছাড়া অন্য কিছু পায় সে যেন শুধুমাত্র নিজেকেই তিরস্কার করে”।  এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿كَدَأۡبِ ءَالِ فِرۡعَوۡنَ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡۚ كَفَرُواْ بِ‍َٔايَٰتِ ٱللَّهِ فَأَخَذَهُمُ ٱللَّهُ بِذُنُوبِهِمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ قَوِيّٞ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ٥٢﴾ [الانفال: ٥٢]
অর্থানুবাদ:
“ফির‘আউনের লোকজন ও তাদের আগের লোকেদের মতোই, এরা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে প্রত্যাখ্যান করেছে, কাজেই তাদের পাপের কারণে আল্লাহ তাদেরকে পাকড়াও করেছেন। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠোর”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৫২]
তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমাকে যা দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে সে ব্যাপারে অস্বীকারকারী ঐ সমস্ত মুশরিকরা তাই করেছে হে মুহাম্মাদ, যা তাদের পূর্ববর্তী অস্বীকারকারী জাতিসমূহ করেছে। ফলে আমরা তাদের সাথে তাই করেছি যা আমাদের অভ্যাস এবং রীতিনীতি তাদের মতো অস্বীকারকারীদের ব্যাপারে। যেমন, ফির‘আউনের সম্প্রদায় এবং তাদের পূর্বে আরও যে সমস্ত জাতি রাসূলগণকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল এবং আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনাদিকে অস্বীকার করেছিল। فَأَخَذَهُمُ ٱللَّهُ بِذُنُوبِهِمۡۚ “কাজেই তাদের পাপের কারণে আল্লাহ তাদেরকে পাকড়াও করেছেন” অর্থাৎ তাদের গোনাহের কারণে তাদেরকে তিনি ধ্বংস করে দেন আর তাদেরকে পাকড়াও করেছিলেন মহাপরাক্রমশালী ও ক্ষমতাবানের পাকড়াওয়ে। إِنَّ ٱللَّهَ قَوِيّٞ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ “নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠোর” কোনো বিজয়ী তাকে পরাজিত করতে পারে না আর কোনো পলায়নকারী তাঁর থেকে পালাতে পারে না।
﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّ ٱللَّهَ لَمۡ يَكُ مُغَيِّرٗا نِّعۡمَةً أَنۡعَمَهَا عَلَىٰ قَوۡمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنفُسِهِمۡ وَأَنَّ ٱللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٞ ٥٣ كَدَأۡبِ ءَالِ فِرۡعَوۡنَ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡۚ كَذَّبُواْ بِ‍َٔايَٰتِ رَبِّهِمۡ فَأَهۡلَكۡنَٰهُم بِذُنُوبِهِمۡ وَأَغۡرَقۡنَآ ءَالَ فِرۡعَوۡنَۚ وَكُلّٞ كَانُواْ ظَٰلِمِينَ ٥٤﴾ [الانفال: ٥٣،  ٥٤]  
অর্থানুবাদ:
“এটি এজন্য যে, আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের নিকট দেওয়া তাঁর অবদানকে পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই (তাদের কর্মনীতির মাধ্যমে) তা পরিবর্তন করে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। ফির‘আউনের লোকজন ও তাদের আগের লোকেদের মতই তারা তাদের রবের নিদর্শনগুলোকে মিথ্যা জেনেছিল। কাজেই তাদের পাপের কারণে আমরা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছিলাম আর ফির‘আউনের লোকজনকে ডুবিয়ে মেরেছিলাম। এরা সবাই ছিল যালিম। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৫৩-৫৪]
তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মীমাংসায় তাঁর পূর্ণ ইনসাফ এবং ন্যায়বিচার সম্পর্কে বলেন যে, নিশ্চয় তিনি কারও ওপর অনুগ্রহ করলে তার নি‘আমতকে পরিবর্তন করে ফেলেন না, তবে তার দ্বারা সংঘটিত পাপের কারণে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوۡمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنفُسِهِمۡۗ وَإِذَآ أَرَادَ ٱللَّهُ بِقَوۡمٖ سُوٓءٗا فَلَا مَرَدَّ لَهُۥۚ وَمَا لَهُم مِّن دُونِهِۦ مِن وَالٍ ١١﴾ [الرعد: ١١] “আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। আল্লাহ তা’আলা কোনো সম্প্রদায়ের অকল্যাণ করতে চাইলে তা রদ করার কেউ নেই, আর তিনি ছাড়া তাদের কোনো অভিভাবক নেই”। [সূরা আর-রা‘আদ, আয়াত: ১১]
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: كَدَأۡبِ ءَالِ فِرۡعَوۡنَ “ফির‘আওনের লোকজন” যেভাবে তিনি ফির‘আউনের সম্প্রদায় এবং তাদের মত অন্যান্যদের সাথে করেছিলেন, যখন তারা তাঁর নিদর্শণসমূহকে অস্বীকার করেছিল, আল্লাহ তা‘আলা তাদের গোনাহের কারণে তাদেরকে ধ্বংস করে দেন, আর সে সমস্ত নি‘আমতকে ছিনিয়ে নেন যা তিনি তাদের জন্য বরাদ্দ করেছিলেন, যেমন উদ্যান, ঝর্ণা, শস্য, ভাণ্ডার এবং মনোরম বাসস্থান। সব ধরণের নি‘আমতরাজি যা তারা ভোগ করেছিল। আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে তাদের প্রতি যুলুম করেন নি; বরং তারাই ছিল অত্যাচারী।
 ﴿إِنَّ شَرَّ ٱلدَّوَآبِّ عِندَ ٱللَّهِ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَهُمۡ لَا يُؤۡمِنُونَ ٥٥ ٱلَّذِينَ عَٰهَدتَّ مِنۡهُمۡ ثُمَّ يَنقُضُونَ عَهۡدَهُمۡ فِي كُلِّ مَرَّةٖ وَهُمۡ لَا يَتَّقُونَ ٥٦ فَإِمَّا تَثۡقَفَنَّهُمۡ فِي ٱلۡحَرۡبِ فَشَرِّدۡ بِهِم مَّنۡ خَلۡفَهُمۡ لَعَلَّهُمۡ يَذَّكَّرُونَ ٥٧﴾ [الانفال: ٥٥، ٥٧]
অর্থানুবাদ:
“যারা কুফুরী করে আল্লাহর নিকট তারাই নিকৃষ্টতম জীব, অতঃপর আর তারা ঈমান আনবে না। তাদের মধ্যে (বিশেষভাবে নিকৃষ্ট তারা) তুমি যাদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হও, অতঃপর তারা সে চুক্তি প্রত্যেকবার ভঙ্গ করে আর তারা (আল্লাহকে) ভয় করে না। যুদ্ধে তোমরা যদি তাদেরকে বাগে পেয়ে যাও তাহলে ওদের পেছনে যারা ওদের সাথী-সঙ্গী আছে তাদের থেকে ওদেরকে এমনভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে যাতে মনে রাখার মত তারা একটা শিক্ষা পেয়ে যায়”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৫৫-৫৭]
তাফসীর:
যারা কুফুরী করে এবং অঙ্গিকার ভঙ্গ করে তাদেরকে কঠিন মার দেওয়ার নির্দেশ:
আল্লাহ তা‘আলা অবহিত করেন: জমিনে বিচরণকারী সবচেয়ে নিকৃষ্ট সৃষ্টি হচ্ছে তারাই যারা কাফের, যারা ঈমান আনয়ন করে না, যারা যখনই অঙ্গিকার করে তখনই ভঙ্গ করে এবং যখনই তারা সেটা রক্ষা করার জন্য শপথ করে তারা সেটা ভঙ্গ করে। وَهُمۡ لَا يَتَّقُونَ “আর তারা (আল্লাহকে) ভয় করে না” অর্থাৎ তারা যে সমস্ত গোনাহ কামিয়েছে তার কোনো কিছুর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করেনা, َإِمَّا تَثۡقَفَنَّهُمۡ فِي ٱلۡحَرۡبِ “যুদ্ধে তোমরা যদি তাদেরকে বাগে পেয়ে যাও” অর্থাৎ যদি তুমি তাদেরকে পরাজিত কর, আর যুদ্ধে তাদের ওপর বিজয় অর্জন কর فَشَرِّدۡ بِهِم مَّنۡ خَلۡفَهُمۡ “তাহলে ওদের পেছনে যারা ওদের সাথী-সঙ্গী আছে তাদের থেকে ওদেরকে এমনভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে” অর্থাৎ গ্রেফতারকৃতদেরকে কঠিন শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা, হাসান আল-বাসরী, দাহ্হাক, সুদ্দী, ‘আতা’ আল খুরাসানী এবং ইবন ‘উয়াইনাহ এ মত ব্যক্ত করেছেন, অর্থাৎ তাদেরকে কঠিন শাস্তি দাও এবং হত্যা কর, যাতে করে আরবের এবং অন্যান্য যে সব শত্রুরা রয়েছে তারা ভয় পায় আর তাদের জন্য একটা শিক্ষা হয়ে যায়। لَعَلَّهُمۡ يَذَّكَّرُونَ “যাতে মনে রাখার মত তারা একটা শিক্ষা পেয়ে যায়”।
সুদ্দী বলেন, এর অর্থ, আল্লাহ বলেন, যাতে করে তারা অঙ্গিকার ভঙ্গ করা থেকে বিরত থাকে। অন্যথায় তাদের সাথেও অনুরূপ করা হবে।
﴿وَإِمَّا تَخَافَنَّ مِن قَوۡمٍ خِيَانَةٗ فَٱنۢبِذۡ إِلَيۡهِمۡ عَلَىٰ سَوَآءٍۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلۡخَآئِنِينَ ٥٨﴾ [الانفال: ٥٨]
অর্থানুবাদ:
“যদি তুমি কোনো সম্প্রদায়ের চুক্তি ভঙ্গের আশঙ্কা কর তাহলে (তাদের চুক্তিকে) তাদের প্রতি নিক্ষেপ কর যাতে সমান সমান অবস্থা বিরাজিত হয়। আল্লাহ নিশ্চয় (ওয়াদা-চুক্তি-প্রতিশ্র“তি) ভঙ্গকারীদের পছন্দ করেন না”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৫৮]
তাফসীর:
সমান সমান অবস্থা বিরাজিত হওয়ার ওপর অঙ্গিকার ভঙ্গের নির্দেশ:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, َإِمَّا تَخَافَنَّ مِن قَوۡمٍ “যদি তুমি কোনো সম্প্রদায়ের আশঙ্কা কর” যাদের সাথে অঙ্গিকার করেছ- خِيَانَةٗ“চুক্তি ভঙ্গের” অর্থাৎ তোমার এবং তাদের মাঝে সংঘটিত কোনো চুক্তি ভঙ্গের فَٱنۢبِذۡ إِلَيۡهِمۡ “তাদের প্রতি নিক্ষেপ কর” অর্থাৎ তাদের চুক্তিকে عَلَىٰ سَوَآءٍۚ “যাতে সমান সমান অবস্থা বিরাজিত হয়” তাদেরকে অবহিত কর যে, তুমি তাদের চুক্তি ভঙ্গ করেছ, যাতে করে তুমি এবং তারা অবগত থাক যে, তোমাদের মাঝে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করবে, এবং সমান সমানভাবে তোমার এবং তাদের মাঝে কোনো প্রকার চুক্তি নেই। অর্থাৎ তুমি এবং তারা এ ব্যাপারে সমান সমান। আল্লাহর বাণী: إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلۡخَآئِنِينَ “আল্লাহ নিশ্চয় (ওয়াদা-চুক্তি-প্রতিশ্রুতি) ভঙ্গকারীদের পছন্দ করেন না” অর্থাৎ যদিও তা কাফেরদের অধিকারের ব্যাপারে হোক না কেন, এটিও আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন না।
ইমাম আহমাদ ও আবূ দাউদ রহ. বর্ণনা করেন, সুলাইম ইবন ‘আমির বলেন, মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রোম দেশের প্রতি যাত্রা করেন, সে সময় তাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি চলছিল, তিনি তাদের নিকটবর্তী হয়ে থাকার ইচ্ছা করেন, এরপর যখন চুক্তি শেষ হবে তখন তিনি তাদের ওপর হামলা করবেন, কিন্তু তাঁর বাহনে আরোহণকারী এক বৃদ্ধ ব্যক্তি বলেন, الله أكبر (আল্লাহ মহান) الله أكبر (আল্লাহ মহান) সততা রক্ষা করুন, চুক্তি ভঙ্গ করবেন না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: «وَمَنْ كَانَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ قَوْمٍ عَهْدٌ فَلَا يَحِلَّنَّ عُقْدَةً وَلَا يَشُدَّهَا، حَتَّى يَنْقَضِيَ أَمَدُهَا، أَوْ يَنْبِذَ إِلَيْهِمْ عَلَى سَوَآءٍ» ‘‘যে ব্যক্তি এবং কোনো সম্প্রদায়ের মাঝে চুক্তি রয়েছে তার উচিৎ নয় এর কোনো অংশ খুলে ফেলা অথবা একে আরও শক্ত করে বাঁধা, যে পর্যন্ত না চুক্তি তার মেয়াদ পর্যন্ত পৌঁছে যায়, অর্থাৎ তার কর্তৃক চুক্তি বাতিল বা বলবৎ রয়েছে মর্মে ঘোষণা দেওয়া অথবা সমান সমান অবস্থা বিরাজের উদ্দেশ্যে তাদের প্রতি তা নিক্ষেপ করা’’। ফলে এ কথা যখন মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর নিকট পৌঁছে তখন তিনি ফিরে আসেন। সেই বৃদ্ধ ব্যক্তিটি ছিলেন ‘আমর ইবন আনবাসাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু।  
﴿وَلَا يَحۡسَبَنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ سَبَقُوٓاْۚ إِنَّهُمۡ لَا يُعۡجِزُونَ ٥٩ وَأَعِدُّواْ لَهُم مَّا ٱسۡتَطَعۡتُم مِّن قُوَّةٖ وَمِن رِّبَاطِ ٱلۡخَيۡلِ تُرۡهِبُونَ بِهِۦ عَدُوَّ ٱللَّهِ وَعَدُوَّكُمۡ وَءَاخَرِينَ مِن دُونِهِمۡ لَا تَعۡلَمُونَهُمُ ٱللَّهُ يَعۡلَمُهُمۡۚ وَمَا تُنفِقُواْ مِن شَيۡءٖ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ يُوَفَّ إِلَيۡكُمۡ وَأَنتُمۡ لَا تُظۡلَمُونَ ٦٠﴾ [الانفال: ٥٩، ٦٠]
অর্থানুবাদ:
“যারা কুফুরী করে তারা যেন এটি ধারণা না করে যে তারা প্রাধান্য লাভ করে নিয়েছে, তারা মুমিনদেরকে কক্ষনো পরাজিত করতে পারবে না। আর তাদেরকে মুকাবালা করার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী সদা প্রস্তুত রাখবে যদ্দ্বারা তোমরা ভয় দেখাতে থাকবে আল্লাহর শত্রু আর তোমাদের শত্রুকে, আর তাদের ছাড়াও অন্যান্যদেরকেও যাদেরকে তোমরা জান না, কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে জানেন। তোমরা আল্লাহর পথে যা খরচ কর তার পুরোপুরি প্রতিদান তোমাদেরকে দেওয়া হবে, আর তোমাদের সাথে কক্ষনো যুলুম করা হবে না”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৫৯-৬০]
তাফসীর:
আল্লাহর শত্রুকে ভয় দেখাতে সামর্থ্য অনুযায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করার নির্দেশ:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে বলেন, وَلَا تَحْسَبَنّ তুমি মনে করো না, হে মুহাম্মাদ, ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ سَبَقُوٓاْۚ “যারা কুফুরী করে তারা প্রাধান্য লাভ করে নিয়েছে” অর্থাৎ আমাদের থেকে তারা পালিয়ে গেছে ফলে আমরা তাদের ওপর কোনো ক্ষমতা রাখি না; বরং তারা আমাদের সামর্থ্যের ও ক্ষমতার অধিনে রয়েছে, আমাদের ইচ্ছার আয়ত্তে রয়েছে, তারা আমাদেরকে অপারগ করতে পারবে না। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿أَمۡ حَسِبَ ٱلَّذِينَ يَعۡمَلُونَ ٱلسَّيِّ‍َٔاتِ أَن يَسۡبِقُونَاۚ سَآءَ مَا يَحۡكُمُونَ ٤﴾ [العنكبوت: ٤] “যারা মন্দ কাজ করে তারা কি ভেবে নিয়েছে যে, তারা আমার আগে বেড়ে যাবে? তাদের ফায়সালা বড়ই খারাপ” অর্থাৎ যা তারা ধারণা করে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:﴿لَا تَحۡسَبَنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مُعۡجِزِينَ فِي ٱلۡأَرۡضِۚ وَمَأۡوَىٰهُمُ ٱلنَّارُۖ وَلَبِئۡسَ ٱلۡمَصِيرُ ٥٧﴾ [النور : ٥٧] “তুমি কাফেরদেরকে এমন মনে কর না যে, তারা পৃথিবীতে আল্লাহর ইচ্ছেকে পরাভূত করার ক্ষমতা রাখে, তাদের বাসস্থান আগুন; কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়স্থল!”। অনুরূপ আল্লাহ তা‘আলার বাণী:﴿لَا يَغُرَّنَّكَ تَقَلُّبُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فِي ٱلۡبِلَٰدِ ١٩٦ مَتَٰعٞ قَلِيلٞ ثُمَّ مَأۡوَىٰهُمۡ جَهَنَّمُۖ وَبِئۡسَ ٱلۡمِهَادُ ١٩٧﴾ [ال عمران: ١٩٦، ١٩٧] “দেশে দেশে কাফেরদের সদম্ভ পদচারণা তোমাকে যেন বিভ্রান্ত না করে। সামান্য ভোগ, তারপর জাহান্নাম তাদের আবাস, আর তা কতই না নিকৃষ্ট বিশ্রামস্থল”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯৬-১৯৭]
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সামর্থ্য ও ক্ষমতা অনুযায়ী যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করার নির্দেশ প্রদান করে বলেন- وَأَعِدُّواْ لَهُم مَّا ٱسۡتَطَعۡتُم “আর সদা প্রস্তুত রাখবে তাদেরকে মুকাবেলা করার জন্য যথাসাধ্য”। অর্থাৎ তোমাদের যেরূপ সমার্থ্য রয়েছে, مِّن قُوَّةٖ وَمِن رِّبَاطِ ٱلۡخَيۡلِ “শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী” ইমাম আহমাদ রহ. বর্ণনা করেন, উক্ববাহ ইবন ‘আমির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিম্বারে দাঁড়িয়ে ভাষণে বলতে শুনেছি: وَأَعِدُّواْ لَهُم مَّا ٱسۡتَطَعۡتُم مِّن قُوَّةٖ “আর তাদেরকে মুকাবেলা করার জন্য যথাসাধ্য শক্তি সদা প্রস্তুত রাখবে” « أَلَا إِنَّ الْقُوَّةَ الرمي، إلا إن القوة الرمي» “জেনে রাখ, শক্তি হচ্ছে নিক্ষেপ করা, জেনে রাখ, শক্তি হচ্ছে নিক্ষেপ করা”।  ইমাম মালিক বর্ণনা করেন, আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«الْخَيْلُ لِثَلَاثَةٍ: لِرَجُلٍ أَجْرٌ، وَلِرَجُلٍ سِتْرٌ، وَعَلَى رَجُلٍ وِزْرٌ. فَأَمَّا الَّذِي لَهُ أَجْرٌ فَرَجُلٌ رَبَطَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَأَطَالَ لَهَا فِي مَرْجٍ أَوْ رَوْضَةٍ، فَمَا أَصَابَتْ فِي طِيَلِهَا ذَلِكَ مِنَ الْمَرْجِ أَوْ الرَّوْضَةِ كَانَتْ لَهُ حَسَنَاتٌ،وَلَوْ أَنَّهَا قَطَعَتْ طِيَلَهَا فَاسْتَنَّتْ شَرَفًا أو شرفين كانت آثارها وأورائها حَسَنَاتٍ لَهُ، وَلَوْ أَنَّهَا مَرَّتْ بِنَهَرٍ فَشَرِبَتْ مِنْهُ وَلَمْ يُرِدْ أَنْ يَسْقِيَ بِهِ كَانَ ذَلِكَ حَسَنَاتٍ لَهُ، فَهِيَ لِذَلِكَ الرَّجُلِ أَجْرٌ، وَرَجُلٌ رَبَطَهَا تَغَنِّيًا وَتَعَفُّفًا وَلَمْ يَنْسَ حَقَّ اللَّهِ فِي رِقَابِهَا وَلَا في ظُهُورِهَا فَهِيَ لَهُ سِتْرٌ، وَرَجُلٌ رَبَطَهَا فَخْرًا وَرِيَاءً وَنِوَاءً فَهِيَ عَلَى ذَلِكَ وِزْر وَسُئِلَ رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الْحُمُرِ؟ فَقَالَ» : مَا أَنْزَلَ اللَّهُ عَلَيَّ فِيهَا شَيْئًا إِلَّا هَذِهِ الْآيَةَ الْجَامِعَةَ الْفَاذَّةَ: ﴿فَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٍ خَيۡرٗا يَرَهُۥ ٧ وَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ شَرّٗا يَرَهُۥ ٨ ﴾ [الزلزلة: ٧،  ٨]  
“ঘোড়া হচ্ছে তিন ব্যক্তির জন্য, এক ব্যক্তির জন্য তা পুরস্কারস্বরূপ, আরেক ব্যক্তির জন্য ঢালস্বরূপ এবং আরেক ব্যক্তির ওপর তা বোঝাস্বরূপ, যার জন্য সেটা পুরস্কারস্বরূপ সে ঐ ব্যক্তি যে তাকে আল্লাহর পথে (ব্যবহারের জন্য) বেঁধে রেখেছে, এভাবে তার পুরো জীবনটাকে ব্যয় করে চারণভুমি অথবা বাগানেতে পশু পালনের মাধ্যমে, (জিহাদের জন্য প্রস্তুতিতে অপেক্ষা করে) কাজেই চারণভুমি অথবা বাগানে সে এ দীর্ঘ সময়ে যে ক্লেশ অনুভব করে তার জন্য তাঁর সাওয়াব হতে থাকে, তাদের এ দীর্ঘ সময় যদি শেষ হয়ে যায়, এরপর সেগুলো একটি অথবা দু’টি মহান যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর ক্ষুরের ছাপ, মল সব সাওয়াব হিসেবে গন্য হয়। যদি এ অশ্ব কোনো নদীর পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তার পানি পান করে আর এ ব্যক্তি যদিও তাকে পানি পান করানোর ইচ্ছা না থাকে এ সবের কারণে ঐ ব্যক্তির জন্য সাওয়াব রয়েছে। আর যে ব্যক্তি সম্পদশালী হওয়ার জন্য এবং অন্যের কাছে যাতে চাইতে না হয়-এ জন্য ঘোড়া পালে, আর এগুলোর ঘাড়ের এবং পিঠের উপর আল্লাহ তা‘আলার অধিকারের কথা ভুলে যায় না, (অর্থাৎ যাকাত ও বাহন হাওলাত প্রদান করে) তবে সেগুলো হবে তার জন্য ঢালস্বরূপ (জাহান্নাম থেকে বাঁচার) আর যে ব্যক্তি গর্ব-অহঙ্কার, লোক দেখানোর জন্য তবে সেগুলো হবে তার জন্য বোঝাস্বরূপ (কিয়ামত দিবসে)। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গাধা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এদের সম্পর্কে কোনো কিছু অবতীর্ণ করেন নি, তবে এ একক সমন্বিত আয়াতটি ﴿فَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٍ خَيۡرٗا يَرَهُۥ ٧ وَمَن يَعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ شَرّٗا يَرَهُۥ ٨﴾ [الزلزلة: ٧، ٨] “অতএব, কেউ অণু পরিমাণও সৎ কাজ করলে সে তা দেখবে, আর কেউ অণু পরিমাণও অসৎ কাজ করলে সে তা দেখবে”। ইমাম বুখারী এ হাদীস বর্ণনা করেছেন, এগুলো তারই শব্দ, মুসলিমও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
অধিকাংশ আলেম এ মত পোষণ করেন যে, তীর নিক্ষেপ উত্তম ঘোড়ায় আরোহণ করা হতে। ইমাম মালেক বলেন, আরোহণ করা উত্তম তীর নিক্ষেপ করা হতে। হাদীসের আলোকে জামহুরের মত অধিক শক্তিশালী। আল্লাহই ভালো জানেন। আল্লাহর রাস্তায় ঘোড়া প্রস্তুত করার ফযীলত বিষয়ক হাদীস আরো অনেক রয়েছে।  সহীহ বুখারীতে বর্ণিত আছে উরওয়া ইবন আবুল জা‘আদ আল-বারিক্বী বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: «الْخَيْلُ مَعْقُودٌ فِي نَوَاصِيهَا الْخَيْرُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ الْأَجْرُ وَالْمَغْنَمُ» “কিয়ামত দিবস পর্যন্ত ঘোড়ার কপালে কল্যাণ টিকে থাকবে, (তা হচ্ছে) পুরস্কার এবং গনীমত”।  
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: تُرْهِبُونَ “তোমরা ভয় দেখাতে থাকবে” অর্থাৎ ভীতি ছড়াবে بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ “এর দ্বারা আল্লাহর শত্রু আর তোমাদের শত্রুকে” অর্থাৎ কাফেরদেরকে وَآخَرِينَ مِنْ دُونِهِمْ “আর তাদের ছাড়াও অন্যান্যদেরকেও”। মুজাহিদ রহ. বলেন, অর্থাৎ বানু কুরাইযা। সুদ্দী রহ. বলেন, পারস্য। সুফীয়ান সাওরী বলেন, তারা হলো শয়তান। মুকাতিল ইবন হাইইয়ান, আব্দুর রহমান ইবন যাইদ ইবন আসলাম বলেন, তারা হচ্ছে মুনাফিকরা, এ মত সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। আর এ মতের সাক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الأعْرَابِ مُنَافِقُونَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ مَرَدُوا عَلَى النِّفَاقِ لا تَعْلَمُهُمْ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ “তোমাদের চতুষ্পার্শ্বে কতক বেদুঈন হলো মুনাফিক, আর মাদীনাবাসীদের কেউ কেউ মুনাফিকীতে অনঢ়, তুমি তাদেরকে চেন না, আমি তাদেরকে চিনি”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১০১]
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَمَا تُنفِقُواْ مِن شَيۡءٖ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ يُوَفَّ إِلَيۡكُمۡ وَأَنتُمۡ لَا تُظۡلَمُونَ “তোমরা আল্লাহর পথে যা খরচ কর তার পুরোপুরি প্রতিদান তোমাদেরকে দেওয়া হবে, আর তোমাদের সাথে কখনো যুলুম করা হবে না” তোমরা জিহাদে যা কিছুই খরচ করবে তা তোমাদেরকে পুরোপুরি দিয়ে দেওয়া হবে।
﴿وَإِن جَنَحُواْ لِلسَّلۡمِ فَٱجۡنَحۡ لَهَا وَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ٦١ وَإِن يُرِيدُوٓاْ أَن يَخۡدَعُوكَ فَإِنَّ حَسۡبَكَ ٱللَّهُۚ هُوَ ٱلَّذِيٓ أَيَّدَكَ بِنَصۡرِهِۦ وَبِٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٦٢ وَأَلَّفَ بَيۡنَ قُلُوبِهِمۡۚ لَوۡ أَنفَقۡتَ مَا فِي ٱلۡأَرۡضِ جَمِيعٗا مَّآ أَلَّفۡتَ بَيۡنَ قُلُوبِهِمۡ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ أَلَّفَ بَيۡنَهُمۡۚ إِنَّهُۥ عَزِيزٌ حَكِيمٞ ٦٣﴾ [الانفال: ٦١، ٦٣]
অর্থনুবাদ:
“তারা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে, তুমিও তার দিকে ঝুঁকে পড়, আর আল্লাহর ওপর নির্ভর কর, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। তারা যদি তোমাকে ধোঁকা দেওয়ার নিয়্যাত করে, সেক্ষেত্রে আল্লাহই তোমার জন্য যথেষ্ট। তিনি তো তাঁর সাহায্য ও মুমিনদের দ্বারা তোমাকে শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাদের হৃদয়গুলোকে প্রীতির বন্ধনে জুড়ে দিয়েছেন। দুনিয়ায় যা কিছু আছে তার সবটুকু খরচ করলেও তুমি তাদের অন্তরগুলোকে প্রীতির ডোরে বাঁধতে পারতে না; কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি করে দিয়েছেন, তিনি তো প্রবল পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞানী”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৬১-৬৩]
তাফসীর:
শত্রুরা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ার নির্দেশ:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি তোমরা লোকেদের থেকে বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা কর, তবে তাদের চুক্তি তাদের দিকে ছুঁড়ে মার যাতে করে সমান সমান হয়, তারা যদি তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ও বিরোধিতায় নিরবচ্ছিন্ন থাকে তবে তুমিও তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর। وَإِن جَنَحُواْ “তারা যদি ঝুঁকে পড়ে” অর্থাৎ নুয়ে পড়ে لِلسَّلْمِ “সন্ধির দিকে” অর্থাৎ মীমাংসা, আপোস-নামা এবং মিত্রতার দিকে فَاجْنَحْ لَهَا “তুমিও তার দিকে ঝুঁকে পড়” তবে তুমিও নুয়ে পড় আর তাদের থেকে সেটা গ্রহণ কর। এ কারণে হুদায়বিয়ার বৎসর মুশরিকরা যখন সন্ধির প্রস্তাব করে এবং তাদের এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে নয় বৎসর কোনো যুদ্ধ হবে না মর্মে আহ্বান জানায়, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতে সাড়া দেন যদিও তারা অন্যান্য কিছু শর্তারোপ করেছিল।  
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِۚ “আর আল্লাহর ওপর নির্ভর কর” অর্থাৎ তাদের সাথে সন্ধি কর এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তোমার জন্য যথেষ্ট, তিনি তোমার সাহায্যকারী, যদিও তারা ধোকা দেওয়ার জন্য সন্ধি করতে চায়, যাতে করে তারা একত্রিত হতে পারে এবং তাদের শক্তি পুনর্গঠিত করতে পারে। فَإِنَّ حَسۡبَكَ ٱللَّهُۚ “সেক্ষেত্রে আল্লাহই তোমার জন্য যথেষ্ট” তিনি একাই তোমার জন্য যথেষ্ট।
মুমিনদের হৃদয়গুলোকে প্রীতির বন্ধনে জুড়ে দেওয়া সংক্রান্ত নি‘আমত স্মরণ করিয়ে দেওয়া:
এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ওপর তাঁর নি‘আমতকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তন্মধ্যে তিনি তাকে মুমিন মুহাজির ও আনসারগণের দ্বারা শক্তিশালী করেছেন তিনি বলেন, هُوَ ٱلَّذِيٓ أَيَّدَكَ بِنَصۡرِهِۦ وَبِٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٦٢ وَأَلَّفَ بَيۡنَ قُلُوبِهِمۡۚ “তিনি তো তাঁর সাহায্য ও মুমিনদের দ্বারা তোমাকে শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাদের হৃদয়গুলোকে প্রীতির বন্ধনে জুড়ে দিয়েছেন”। আল্লাহ তা‘আলা তোমার প্রতি বিশ্বাস, তোমার আনুগত্য, তোমাকে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য মুমিনদের অন্তরকে একত্রিত করে দিয়েছেন, لَوۡ أَنفَقۡتَ مَا فِي ٱلۡأَرۡضِ جَمِيعٗا مَّآ أَلَّفۡتَ بَيۡنَ قُلُوبِهِمۡ “দুনিয়ায় যা কিছু আছে তার সবটুকু খরচ করলেও তুমি তাদের অন্তরগুলোকে প্রীতির ডোরে বাঁধতে পারতে না” কেননা জাহেলী যুগে আনসারগণের আওস ও খাজরায গোত্রের মাঝে বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল আরও অন্যান্য মন্দ ধারাবাহিকভাবে চলে আসছিল, অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা ঈমানের আলো দ্বারা এ সব মন্দ দূর করে দেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتَ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡ إِذۡ كُنتُمۡ أَعۡدَآءٗ فَأَلَّفَ بَيۡنَ قُلُوبِكُمۡ فَأَصۡبَحۡتُم بِنِعۡمَتِهِۦٓ إِخۡوَٰنٗا وَكُنتُمۡ عَلَىٰ شَفَا حُفۡرَةٖ مِّنَ ٱلنَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنۡهَاۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمۡ ءَايَٰتِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُونَ ١٠٣﴾ [ال عمران: ١٠٣] “আল্লাহর রজ্জুকে সমবেতভাবে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর নি‘আমত স্মরণ কর, যখন তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু, তিনি তোমাদের অন্তরে প্রীতির সঞ্চার করলেন, ফলে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নি-গহ্বরের প্রান্তে ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করলেন। এভাবে আল্লাহ নিজের নিদর্শনাবলী তোমাদের কাছে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন যাতে তোমরা সঠিক পথ প্রাপ্ত হও”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আনসারবৃন্দের মাঝে হুনাইনের গনীমতের ব্যাপারে সম্বোধন করে ভাষণ দেন, তিনি তাদেরকে বলেন, «يَا مَعْشَرَ الْأَنْصَارِ أَلَمْ أَجِدْكُمْ ضُلَّالًا فَهَدَاكُمُ اللَّهُ بِي، وَعَالَةً فَأَغْنَاكُمُ اللَّهُ بِي، وَكُنْتُمْ مُتَفَرِّقِينَ فَأَلَّفَكُمُ اللَّهُ بِي» ‘হে আনসারগণ, আমি কি তোমাদেরকে বিভ্রান্ত পাই নি, এরপর আল্লাহ তা‘আলা আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে পথ দেখিয়েছেন, (তোমাদেরকে কি পাই নি) অভাবি, এরপর আল্লাহ তা‘আলা আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে সম্পদশালী করেছেন, তোমরা ছিলে দলে দলে বিভক্ত, এরপর আল্লাহ তা‘আলা আমার মাধ্যমে তোমাদের মাঝে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছেন। যখনই তিনি তাদেরকে কিছু বলেন, তারা বলে: সত্যই, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে দয়া।
এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ أَلَّفَ بَيۡنَهُمۡۚ إِنَّهُۥ عَزِيزٌ حَكِيمٞ “কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি করে দিয়েছেন, তিনি তো প্রবল পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞানী” তিনি সম্মানিত সর্বশক্তিমান, যে ব্যক্তি তাঁর ওপর ভরসা রাখে সে আশাহত হয় না, তিনি প্রজ্ঞাবান তাঁর কাজেকর্মে ও বিধিবিধানে। হাকিম রহ. এবং ইমাম নাসাঈ রহ. আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন, لَوۡ أَنفَقۡتَ مَا فِي ٱلۡأَرۡضِ جَمِيعٗا مَّآ أَلَّفۡتَ بَيۡنَ قُلُوبِهِمۡ “দুনিয়ায় যা কিছু আছে তার সবটুকু খরচ করলেও তুমি তাদের অন্তরগুলোকে প্রীতির ডোরে বাঁধতে পারতে না”। তারা হলেন যারা একে অপরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসেন। অপর বর্ণনায় এসেছে, যে দুই ব্যক্তি একে অপরকে আল্লাহর জন্য মহব্বত করেন তাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। হাকেম হাদীসটি সহীহ আখ্যায়িত করেন।  মুজাহিদ রহ. বলেন, যখন দুই বন্ধু একে অপরের সাথে সাক্ষাত হয় এবং একজন অপর জনের হাত ধরে মুছকি হাসি দেয়, তাদের উভয়ের গুনাহ এমনভাবে ঝরে পড়ে যেমনটি ঝরে পড়ে গাছের পাতাগুলো। আবদাহ বলেন, আমি বললাম, নিশ্চয় এটি খুবই কম। তিনি বললেন, তুমি এ কথা কথা বলো না। কারণ, আল্লাহ তা’আলা বলেন, তারপর তিনি এ আয়াত- لَوۡ أَنفَقۡتَ مَا فِي ٱلۡأَرۡضِ جَمِيعٗا مَّآ أَلَّفۡتَ بَيۡنَ قُلُوبِهِمۡ “দুনিয়ায় যা কিছু আছে তার সবটুকু খরচ করলেও তুমি তাদের অন্তরগুলোকে প্রীতির ডোরে বাঁধতে পারতে না”  তিলাওয়াত করেন। আবদাহ রহ. বলেন, এতে আমি বুঝতে পারলাম তিনি আমার চেয়েও অধিক জ্ঞানী। তাবরানী সালমান আল-ফারসী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে হাদীস বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا لَقِيَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ فَأَخَذَ بِيَدِهِ تَحَاتَّتْ عَنْهُمَا ذنوبهما كما تحات الْوَرَقُ عَنِ الشَّجَرَةِ الْيَابِسَةِ فِي يَوْمِ رِيحٍ عاصف، وإلا غفر لهما ذنوبهما ولو كانت مِثْلَ زَبَدِ الْبِحَارِ» . “যখন কোনো মুসলিম অপর মুসলিমের সাথে সাক্ষাৎ করে একে অপরের সাথে হাত মেলায়, তাদের উভয়ের গুনাহগুলো এমনভাবে ঝরে পড়ে যেমনভাবে প্রবল বাতাসের সময় গাছের শুকনো পাতাগুলো ঝরে পড়ে। অন্যথায় তাদের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়ে থাকে”।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ حَسۡبُكَ ٱللَّهُ وَمَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٦٤ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ حَرِّضِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ عَلَى ٱلۡقِتَالِۚ إِن يَكُن مِّنكُمۡ عِشۡرُونَ صَٰبِرُونَ يَغۡلِبُواْ مِاْئَتَيۡنِۚ وَإِن يَكُن مِّنكُم مِّاْئَةٞ يَغۡلِبُوٓاْ أَلۡفٗا مِّنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بِأَنَّهُمۡ قَوۡمٞ لَّا يَفۡقَهُونَ ٦٥ ٱلۡـَٰٔنَ خَفَّفَ ٱللَّهُ عَنكُمۡ وَعَلِمَ أَنَّ فِيكُمۡ ضَعۡفٗاۚ فَإِن يَكُن مِّنكُم مِّاْئَةٞ صَابِرَةٞ يَغۡلِبُواْ مِاْئَتَيۡنِۚ وَإِن يَكُن مِّنكُمۡ أَلۡفٞ يَغۡلِبُوٓاْ أَلۡفَيۡنِ بِإِذۡنِ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ ٦٦﴾ [الانفال: ٦٤، ٦٦]
অর্থানুবাদ:
“হে নবী! আল্লাহই তোমার আর তোমার অনুসারী ঈমানদারদের জন্য যথেষ্ট। হে নাবী! যুদ্ধের ব্যাপারে মুমিনদেরকে উদ্বুদ্ধ কর। তোমাদের মধ্যে বিশজন ধৈর্যশীল থাকলে তারা দু’শ জনের ওপর জয়ী হবে এবং তোমাদের মধ্যে (ঐরূপ) একশ’ জন থাকলে তারা একহাজার কাফিরের ওপর বিজয়ী হবে। কেননা তারা হচ্ছে এমন লোক যারা (ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে) কোনো বোধ রাখে না। (তবে) এখন আল্লাহ তোমাদের দায়িত্বভার কমিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তো জানেন যে তোমাদের ভিতর দুর্বলতা রয়ে গেছে, কাজেই তোমাদের মাঝে যদি একশ’ জন ধৈর্যশীল হয় তবে তারা দু’শ জনের ওপর বিজয়ী হবে। আর যদি তোমাদের মাঝে এক হাজার (ঐ রকম) লোক পাওয়া যায় তাহলে তারা আল্লাহর হুকুমে দু’হাজার লোকের ওপর জয়ী হবে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে (আছেন)।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৬৪-৬৬]
তাফসীর:
যুদ্ধের জন্য উৎসাহ প্রদান এবং এ ব্যাপারে সুসংবাদ প্রদান যে, অল্পসংখ্যক মুসলিম বহুসংখ্যক কাফেরের ওপর জয়লাভ করবে:
তা‘আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুমিনগণকে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে উৎসাহিত করছেন, এবং তাদের দলবলের বিপক্ষে সংগ্রাম করার নির্দেশ দেন, তিনি তাদেরকে অবহিত করেন যে, তিনি তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদের জন্য যথেষ্ট, তিনি তাদেরকে সাহায্য করবেন, তাদেরকে শক্তিশালী করবেন, যদিও শত্রুদের সংখ্যা বেশি হয় আর একের পর এক তাদের জন্য সাহায্য আসে, আর মুমিনদের সংখ্যা অল্প হয়। ইবন আবী হাতিম শা‘আবী থেকে আল্লাহর বাণী يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ حَسۡبُكَ ٱللَّهُ وَمَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ হে নাবী! আল্লাহই তোমার আর তোমার অনুসারী ঈমানদারদের জন্য যথেষ্ট”  বিষয়ে বলেন, আল্লাহ আপনার জন্য এবং আপনার সাথে যারা আপনার অনুসারী রয়েছে তাদের জন্য যথেষ্ট। আতা আল-খুরাসানী এবং আব্দুর রহমান ইবন যায়েদ থেকেও অনুরূপ বর্ণনা বর্ণিত।
এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ حَرِّضِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ عَلَى ٱلۡقِتَالِۚ “হে নবী! যুদ্ধের ব্যাপারে মুমিনদেরকে উদ্বুদ্ধ কর” অর্থাৎ তাদেরকে উৎসাহিত কর, তাদেরকে নির্দেশ দাও। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের জন্য তাদেরকে উৎসাহিত করতেন, যখন তারা শত্রুদের মুখোমুখি হতেন, বদর যুদ্ধের দিন কাফেররা যখন তাদের দলবল ও যোগান নিয়ে হাযির হয়, তখন তিনি তাঁর সাহাবীগণকে বলেন, «قُومُوا إلى جنة عرضها السموات والأرض» ‘তোমরা জান্নাতের প্রতি উঠে দাঁড়াও যা আসমানসমূহ ও জমিনের সমান প্রশস্ত’। তখন উমাইর ইবনল হুমাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, এটি কি আসমানসমূহ ও জমিনের মতো প্রশস্ত? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হাঁ, তখন তিনি বলেন, بخ بخ (কতইনা চমৎকার, কতইনা চমৎকার) এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «مَا يَحْمِلُكَ عَلَى قَوْلِكَ بَخٍ بَخٍ» কিসে তোমাকে بخ بخ কথাটি বলতে উদ্বুদ্ধ করেছে? তিনি বলেন, এ আশায় যেন আমি এর অধিবাসী হতে পারি, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, « فَإِنَّكَ مِنَ أَهْلِهَا » “তুমি এর অধিবাসী, লোকটি তখন সম্মুখে অগ্রসর হয়, তিনি তার তরবারীর কোষ ভেঙ্গে ফেলেন, এরপর খেজুর বের করে খেতে থাকেন, এরপর তিনি বাকি খেজুরগুলো তার হাত থেকে ফেলে দিয়ে বলেন, আমি যদি এগুলো খাওয়ার জন্য বেঁচে থাকি তবে তো সেটা বড় দীর্ঘ জীবন, এরপর তিনি সম্মুখে এগিয়ে গিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হন অবশেষে শহীদ হন।  
এরপর আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণকে সু-সংবাদ প্রদান করে এবং নির্দেশ দিয়ে বলেন, إِن يَكُن مِّنكُمۡ عِشۡرُونَ صَٰبِرُونَ يَغۡلِبُواْ مِاْئَتَيۡنِۚ وَإِن يَكُن مِّنكُم مِّاْئَةٞ يَغۡلِبُوٓاْ أَلۡفٗا مِّنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ “তোমাদের মধ্যে বিশজন ধৈর্যশীল থাকলে তারা দু’শ জনের ওপর জয়ী হবে এবং তোমাদের মধ্যে (ঐরূপ) একশ’ জন থাকলে তারা একহাজার কাফিরের ওপর বিজয়ী হবে” প্রতি একজন দশজনের মোকাবিলায় ধৈর্য্য করতে পারবে, এরপর আল্লাহ তা‘আলা এ বিষয়টি রোহিত করে দেন আর সুসংবাদ বাকি রেখে দেন। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন, হাদীসটি আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন জারীর ইবন হাযিম, (তিনি বলেন) হাদীসটি আমার নিকট বর্ণনা করেছেন আয-যুবাইর ইবন র্খিরীত (তিনি) ইকরিমা থেকে (তিনি) আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে, তিনি বলেন, যখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। إِن يَكُن مِّنكُمۡ عِشۡرُونَ صَٰبِرُونَ يَغۡلِبُواْ مِاْئَتَيۡنِۚ “তোমাদের মধ্যে বিশজন ধৈর্যশীল থাকলে তারা দু’শ জনের ওপর জয়ী হবে” তখন বিষয়টি মুসলিমবৃন্দের নিকট কঠিন মনে হয় অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর ফরয করেন যে, একজন যেন দশজন মুশরিকের মোকাবিলায় ধৈর্য্য ধারণ করে, এরপর হালকা করে আয়াত অবতীর্ণ হয়, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ٱلۡـَٰٔنَ خَفَّفَ ٱللَّهُ عَنكُمۡ “(তবে) এখন আল্লাহ তোমাদের দায়িত্বভার কমিয়ে দিয়েছেন” এখান থেকে يَغۡلِبُواْ مِاْئَتَيۡنِ (দু’শ জনের ওপর জয়ী হবে” এ পর্যন্ত। তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তাদের থেকে বৈরিতা কমিয়ে দেন, আর কমিয়ে দেওয়ার অনুপাতে ধৈর্য্যরে নির্দেশও হাল্কা করেন।
﴿مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَن يَكُونَ لَهُۥٓ أَسۡرَىٰ حَتَّىٰ يُثۡخِنَ فِي ٱلۡأَرۡضِۚ تُرِيدُونَ عَرَضَ ٱلدُّنۡيَا وَٱللَّهُ يُرِيدُ ٱلۡأٓخِرَةَۗ وَٱللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٞ ٦٧ لَّوۡلَا كِتَٰبٞ مِّنَ ٱللَّهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمۡ فِيمَآ أَخَذۡتُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ٦٨ فَكُلُواْ مِمَّا غَنِمۡتُمۡ حَلَٰلٗا طَيِّبٗاۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٦٩﴾ [الانفال: ٦٧، ٦٩]
অর্থানুবাদ:
“কোনো নবীর জন্য এটি সঠিক কাজ নয় যে, দেশে (আল্লাহর শত্রুদেরকে) পুরোমাত্রায় পরাভূত না করা পর্যন্ত তার (হাতে) যুদ্ধ-বন্দী থাকবে। তোমরা দুনিয়ার স্বার্থ চাও আর আল্লাহ চান আখিরাত (এর সাফল্য), আল্লাহ প্রবল পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞানী। আল্লাহর লেখন যদি পূর্বেই লেখা না হত তাহলে তোমরা যা (মুক্তিপণ হিসেবে) গ্রহণ করেছ তজ্জন্য তোমাদের ওপর মহাশাস্তি পতিত হত। এক্ষণে, যুদ্ধে গনীমত হিসেবে যা তোমরা লাভ করেছ তা ভোগ কর, তা বৈধ ও পবিত্র। আল্লাহকে ভয় করে চলো, নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৬৭-৬৯]
তাফসীর:
ইমাম আহমাদ রহ. বর্ণনা করেন, আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর যুদ্ধের বন্দীদের ব্যাপারে (সাহাবীগণের নিকট) পরামর্শ চান, তারপর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তারা আপনার স্বজাতী ও আত্মীয় আপনি তাদের বাচিয়ে রাখেন এবং তাদের তাওবা করতে বলেন। হতে পারে আল্লাহ তা‘আলা তাদের তওবা কবুল করবেন। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, হে আল্লাহর রাসূল তারা আপনাকে অস্বীকার করছে, আপনাকে বের করে দিয়েছে, আপনি অগ্রসর হয়ে তাদের গর্দান উড়িয়ে দিন। আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এমন একটি এলাকায় রয়েছেন যাতে প্রচুর জালানি রয়েছে, আপনি মাঠে আগুন জালান তারপর তাদের আগুনে নিক্ষেপ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপচাপ থাকলেন তাদের কথার কোনো উত্তর তিনি দিলেন না। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভিতরে প্রবেশ করলেন। তখন তারা বলাবলি করতে লাগল, কেউ বলে, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর মতামত গ্রহণ করবেন। আর কতক মানুষ বলে, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর মতামত গ্রহণ করবেন আর কেউ কেউ বলেন, আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর মতামত গ্রহণ করবেন। তারপর তিনি বের হলেন, আল্লাহ তা‘আলা কতক মানুষের অন্তরকে নরম করে দেন ফলে তা দুধের চেয়ে নরম হয়। আবার কতক মানুষের অন্তরকে কঠিন করেন ফলে তা পাথরের চেয়ে কঠিন হয়। হে আবু বকর তোমার দৃষ্টান্ত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মত। তিনি বলেন, ﴿فَمَن تَبِعَنِي فَإِنَّهُۥ مِنِّيۖ وَمَنۡ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٣٦﴾ [ابراهيم: ٣٦] “সুতরাং যে আমার অনুসরণ করেছে, নিশ্চয় সে আমার দলভুক্ত, আর যে আমার অবাধ্য হয়েছে, তবে নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’’। [সূরা ইবরাহী, আয়াত: ৩৬] হে আবু বকর! তোমার দৃষ্টান্ত ঈসা আলাইহিস সালামের মতো। তিনি বলেন, ﴿إِن تُعَذِّبۡهُمۡ فَإِنَّهُمۡ عِبَادُكَۖ وَإِن تَغۡفِرۡ لَهُمۡ فَإِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١١٨﴾ [المائ‍دة: ١١٨] যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করেন তবে তারা আপনারই বান্দা, আর তাদেরকে যদি ক্ষমা করেন, তবে নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ১১৮] হে উমার! তোমার দৃষ্টান্ত মূসা আলাইহিস সালামের মতো, তিনি বলেন, ﴿رَبَّنَا ٱطۡمِسۡ عَلَىٰٓ أَمۡوَٰلِهِمۡ وَٱشۡدُدۡ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ فَلَا يُؤۡمِنُواْ حَتَّىٰ يَرَوُاْ ٱلۡعَذَابَ ٱلۡأَلِيمَ ٨٨﴾ [يونس : ٨٨] “হে আমাদের রব, তাদের ধন-সম্পদ নিশ্চি‎হ্ন করে দিন, তাদের অন্তরসমূহকে কঠোর করে দিন। ফলে তারা ঈমান আনবে না, যতক্ষণ না যন্ত্রণাদায়ক আযাব দেখে’। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৮৮] হে আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহা তোমার দৃষ্টান্ত নূহ আলাইহিস সালামের মতো, তিনি বলেন,﴿وَقَالَ نُوحٞ رَّبِّ لَا تَذَرۡ عَلَى ٱلۡأَرۡضِ مِنَ ٱلۡكَٰفِرِينَ دَيَّارًا ٢٦﴾ [نوح: ٢٦] “আর নূহ বলল, ‘হে আমার রব! জমিনের উপর কোনো কাফেরকে অবশিষ্ট রাখবেন না’। [সূরা নূহ, আয়াত: ২৬] ইবন মাসউদ বলেন, আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল! «إِلَّا سُهَيْلُ بْنُ بيضاء» ‘তবে সুহাইল ইবন বাইদা’ কারণ সে ইসলামের কথা আলোচনা করে। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ থাকেন। আমি আমার ওপর আসমান থেকে পাথর বর্ষিত হওয়ার প্রকট আশঙ্কার ভয়ে ভীত হওয়াটা ঐ দিনের চেয়ে অধিক আর কখনো দেখিনি। এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে, «إِلَّا سُهَيْلُ بْنُ بيضاء» তারপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত- مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَن يَكُونَ لَهُۥٓ أَسۡرَىٰ শেষ পর্যন্ত নাযিল করেন।
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, বদর যুদ্ধে যখন বন্দীদের বন্দী করা হয়, তাদের মধ্যে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ছিলেন, তাকে একজন আনসারী বন্দী করেন। সে বলে আমি আনসারীদের ওয়া‘দা দিয়েছি তারা তাকে হত্যা করবে। এ সংবাদটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছলে তিনি বলেন, "إِنِّي لَمْ أَنَمِ اللَّيْلَةَ مِنْ أَجْلِ عَمِّي الْعَبَّاسِ، وَقَدْ زَعَمَتِ الْأَنْصَارُ أَنَّهُمْ قَاتِلُوهُ" “আমি আমার চাচা আব্বাসের চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি নি। আমার মনে হচ্ছিল আনসাররা তাকে হত্যা করে ফেলবে” তখন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমি কি তাদের নিকট যাব? বললেন, হাঁ, তারপর উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আনসারদের নিকট আসলেন এবং বললেন, তোমরা আব্বাসকে ছেড়ে দাও। তারা বলল, আল্লাহর শপথ আমরা তাকে ছাড়বো না, তখন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাদের বললেন, যদি আল্লাহর রাসূল তাতে রাযি হয়? তারা বলল, যদি আল্লাহর রাসূল তাতে রাজি হয়, তবে তুমি তাকে নিয়ে যাও। তারপর উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে ছাড়ালেন। তারপর যখন সে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাতে ছিলেন, তখন তিনি তাকে বলল, হে আব্বাস তুমি ইসলাম গ্রহণ কর, আল্লাহর শপথ তোমার ইসলাম গ্রহণ করা আমার নিকট খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ করা হতে প্রিয়। কারণ, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি তাকে তোমার ইসলাম কবুল করা খুশি করবে। তিনি তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরামর্শ চাইলেন, তখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, এরাতো আপনার গোত্রের লোক তাদের ছেড়ে দিন। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট পরামর্শ চান তখন তিনি বলেন, আপনি তাদের হত্যা করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থেকে ফিদইয়া গ্রহণ করলেন, তখন আল্লাহ তা‘আলা مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَن يَكُونَ لَهُۥٓ أَسۡرَىٰ حَتَّىٰ يُثۡخِنَ فِي ٱلۡأَرۡضِۚ “কোনো নবীর জন্য এটি সঠিক কাজ নয় যে, দেশে (আল্লাহর শত্রুদেরকে) পুরোমাত্রায় পরাভূত না করা পর্যন্ত তার (হাতে) যুদ্ধ-বন্দী থাকবে। এ আয়াত নাযিল করেন।  
ইমাম আহমাদ রহ. বর্ণনা করেন, আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর যুদ্ধের বন্দীদের ব্যাপারে (সাহাবীগণের নিকট) পরামর্শ চান, তিনি বলেন, إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَمْكَنَكُمْ مِنْهُمْ আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর তোমাদেরকে বিজয়ী করেছেন’ তখন উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি তাদের গর্দান উড়িয়ে দিন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, এরপর আবারও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَمْكَنَكُمْ مِنْهُمْ “হে লোক সকল, আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর তোমাদেরকে বিজয় দান করেছেন, আর এরা গতকাল (পূর্বে) ছিল তোমাদেরই ভাই। তখন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি তাদের গর্দান উড়িয়ে দিন, কিন্তু এবারও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, এরপর আবারও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকেদের নিকট আগের কথাই বলেন, তখন আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু দাঁড়িয়ে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা মনে করি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন, আর তাদের থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করুন। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারায় চিন্তার যে ছাপ ছিল তার দূর হয়, তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন আর তাদের থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন, لَّوۡلَا كِتَٰبٞ مِّنَ ٱللَّهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمۡ فِيمَآ أَخَذۡتُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ “আল্লাহর লেখন যদি পূর্বেই লেখা না হত তাহলে তোমরা যা (মুক্তিপণ হিসেবে) গ্রহণ করেছ তজ্জন্য তোমাদের ওপর মহাশাস্তি পতিত হত” আলী ইবন আবু তালহা বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা لَّوۡلَا كِتَٰبٞ مِّنَ ٱللَّهِ سَبَقَ “আল্লাহর লেখন যদি পূর্বেই লেখা না হত” এ আয়াত সম্পর্কে বলেন, অর্থাৎ সংরক্ষিত গ্রন্থে যে, গনীমত এবং বন্দী তোমাদের জন্য হালাল, لَمَسَّكُمۡ فِيمَآ أَخَذۡتُمۡ (মুক্তিপণ হিসেবে) “গ্রহণ করেছ তজ্জন্য তোমাদের ওপর পতিত হত” অর্থাৎ বন্দীদের থেকে, عَذَابٌ عَظِيمٞ “মহাশাস্তি” আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَكُلُواْ مِمَّا غَنِمۡتُمۡ حَلَٰلٗا طَيِّبٗاۚ “এক্ষণে, যুদ্ধে গনীমত হিসেবে যা তোমরা লাভ করেছ তা ভোগ কর, তা বৈধ ও পবিত্র”। আউফী রহ. আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন, অনুরূপ বর্ণনা করেছেন আবু হুরায়রাহ, আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ, সা‘ঈদ ইবন জুবাইর, ‘আতা’, হাসান আল-বাসরী, কাতাদা এবং আ‘মাশ থেকেও। لَّوۡلَا كِتَٰبٞ مِّنَ ٱللَّهِ سَبَقَ “আল্লাহর লেখন যদি পূর্বেই লেখা না হত” এ আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে এ জাতির জন্য গনীমত হালাল। এ মতের সাক্ষ্য প্রদান করে (এ হাদীসটি যা) ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম তাদের ‘সহীহ’ গ্রন্থদ্বয়ে বর্ণনা করেছেন, জাবির ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, "أُعْطِيتُ خَمْسًا لَمْ يُعْطَهُنَّ أَحَدٌ مِنَ الْأَنْبِيَاءِ قَبْلِي: نصرتُ بِالرُّعْبِ مَسِيرَةَ شَهْرٍ، وَجُعِلَتْ لِي الْأَرْضُ مَسْجِدًا وَطَهُورًا، وَأُحِلَّتْ لِيَ الْغَنَائِمُ وَلَمْ تُحَلَّ لِأَحَدٍ قَبْلِي، وَأُعْطِيتُ الشَّفَاعَةَ، وَكَانَ النَّبِيُّ يُبْعَثُ إِلَى قَوْمِهِ وَبُعِثْتُ إِلَى النَّاسِ عَامَّةً". “আমাকে পাঁচটি জিনিস দেওয়া হয়েছে যা আমার পূর্বে আর কোনো নবীকে দেওয়া হয় নি, আমাকে এক মাসের দুরত্বে থেকে ভয় দেখানোর মাধ্যমে কাফেরেদের ওপর জয় দেওয়া হয়েছে, সমস্ত পৃথিবীকে আমার জন্য মসজিদ (সালাত আদায়ের স্থান) এবং পবিত্র করা হয়েছে, আমার জন্য গনীমতকে হালাল করা হয়েছে, আমার পূর্বে আর কারও জন্য হালাল করা হয় নি। আমাকে শাফা‘আত দেওয়া হয়েছে, কোনো নবীকে শুধুমাত্র তার জাতির প্রতি প্রেরণ করা হত, আর আমাকে সকল মানুষের প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে”।
আ‘মাশ বলেন, আবু সালিহ আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘গনীমতকে আমাদের ছাড়া মানবজাতির আর কারও জন্য কখনই বৈধ করা হয় নি। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, َكُلُواْ مِمَّا غَنِمۡتُمۡ حَلَٰلٗا طَيِّبٗاۚ “এক্ষণে, যুদ্ধে গনীমত হিসেবে যা তোমরা লাভ করেছ তা ভোগ কর” সে সময় তারা বন্দীদের থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করেন। ইমাম আবু দাঊদ তাঁর ‘সুনানে’ উল্লেখ করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের দিন জাহেলী যুগের লোকেদের মুক্তিপণ ধার্য করেন চারশত। জমহুর উলামার নিকট বন্দীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হচ্ছে বিষয়টি ইসলামী নেতার ইখতিয়ারে, ইচ্ছা হলে তিনি তাদেরকে হত্যা করবেন। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বানু কুরাইযার বন্দীদের ক্ষেত্রে করেছিলেন, আবার ইচ্ছা হলে মুক্তিপণ নিতে পারেন। যেমন, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের বন্দীদের ব্যাপারে করেছিলেন। অথবা মুসলিম বন্দীদের বিনিময়ে মুক্ত করবেন। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈকা দাসী ও তার কন্যার ব্যাপারে করেছিলেন। এরা সালামাহ ইবনুল আকওয়ার নিকট বন্দী হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদেরকে ফিরিয়ে দিয়ে তাদের পরিবর্তে মুসলিম বন্দীদের গ্রহণ করেছিলেন। অথবা তিনি ইচ্ছা করলে বন্দীদেরকে কয়েদী করে রাখতে পারেন। এটি ইমাম শাফে‘ঈ এবং একদল আলেমের মতামত। এ মাসআলা বিষয়ে ইমামদের আরো মতামত রয়েছে যা ফিকাহের কিতাবসমূহে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ قُل لِّمَن فِيٓ أَيۡدِيكُم مِّنَ ٱلۡأَسۡرَىٰٓ إِن يَعۡلَمِ ٱللَّهُ فِي قُلُوبِكُمۡ خَيۡرٗا يُؤۡتِكُمۡ خَيۡرٗا مِّمَّآ أُخِذَ مِنكُمۡ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٧٠ وَإِن يُرِيدُواْ خِيَانَتَكَ فَقَدۡ خَانُواْ ٱللَّهَ مِن قَبۡلُ فَأَمۡكَنَ مِنۡهُمۡۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ ٧١﴾ [الانفال: ٧٠، ٧١]
অর্থানুবাদ:
“হে নবী! তোমাদের হাতে যে সব যুদ্ধ-বন্দী আছে তাদেরকে বল, ‘আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তরে ভালো কিছু দেখেন তাহলে তোমাদের কাছ থেকে (মুক্তিপণ) যা নেওয়া হয়েছে তাত্থেকে উত্তম কিছু তোমাদেরকে তিনি দান করবেন আর তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।’ যদি তারা তোমার সাথে খিয়ানাত করার ইচ্ছে করে (তবে সেটা অসম্ভব কিছু নয়, কারণ এর থেকেও গুরুতর যে) তারা পূর্বে আল্লাহর সাথে খিয়ানাত করেছে, কাজেই আল্লাহ তাদেরকে তোমার অধীন করে দিয়েছেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে বিশেষভাবে অবগত, সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞাবান”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৭০-৭১]
তাফসীর:
বন্দীদেরকে উত্তম বিনিময় প্রদানের অঙ্গিকার:
মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের দিন বলেন,«إني قد عرفت أَنَّ أُنَاسًا مِنْ بَنِي هَاشِمٍ وَغَيْرِهِمْ قَدْ أُخْرِجُوا كُرْهًا لَا حَاجَةَ لَهُمْ بِقِتَالِنَا، فَمَنْ لَقِيَ مِنْكُمْ أَحَدًا مِنْهُمْ - أَيْ مِنْ بَنِي هاشم - فلا يقتله، ومن لقي الْبَخْتَرِيِّ بْنَ هِشَامٍ فَلَا يَقْتُلُهُ، وَمَنْ لَقِيَ الْعَبَّاسَ بْنَ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَلَا يَقْتُلُهُ، فَإِنَّهُ إنما خرج مُسْتَكْرَهًا» “আমি জানি যে, বানু হাশিম এবং অন্যান্য গোত্রের কতিপয় ব্যক্তিকে বদর যুদ্ধে জোরপূর্বক বের করে আনা হয়েছে, আমাদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ করার বাসনা ছিল না, তাদের কারও সাথে যদি তোমাদের কারও সাক্ষাত হয় অর্থাৎ বাণী হাশিমের- তবে তাকে হত্যা করো না, যে ব্যক্তির আবুল বাখতারী ইবন হিশামের সাথে সাক্ষাত হয় তাকে হত্যা করো না, যার সাথে আব্বাস ইবন আব্দুল মুত্তালিবের দেখা হয় তাকে হত্যা করো না। কেননা তাকে জোরপূর্বক বের করে আনা হয়েছে”। তখন আবু হুযাইফা ইবন উৎবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমরা আমাদের পিতা, আমাদের সন্তানাদি, আমাদের ভাতৃমণ্ডলি এবং আমাদের আত্মীস্বজনদের হত্যা করব আর আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে ছেড়ে দিব, আল্লাহর শপথ, আমার সাথে যদি তার সাক্ষাত হয় তবে তরবারী দ্বারা তাকে হত্যা করব। এ কথা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছে তখন তিনি উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলেন, হে আবু হাফস (উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, এ ছিল প্রথম দিন যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার উপনাম ধরে ডাকেন) আল্লাহর রাসূলের চাচার মুখে কি তরাবারি দ্বারা আঘাত করা হবে? তখন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে অনুমতি দিন আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেই, সে মুনাফিক হয়ে গেছে, আবু হুযাইফাহ এরপরে বলতেন: আল্লাহর শপথ, আমি আমার এ কথার জন্য নিজেকে নিরাপদ মনে করি না আর সর্বদা আমি এর ভয়ে ভীত, তবে আমার শাহাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা এর ক্ষতিপূরণ করে দিবেন, এরপর তিনি ইয়ামামার যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।  
ইউনুস ইবন বুকাইর বর্ণনা করেন মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক থেকে (তিনি) ইয়াযীদ ইবন রূমান থেকে (তিনি) উরওয়া থেকে (তিনি) যুহরী থেকে (তিনি) একদল (বর্ণনাকারী থেকে) তিনি তাদের নাম বলেন, তারা বলেন, কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তাদের বন্দীদের মুক্তিপণ প্রেরণ করে, প্রতিটি কাওম তাদের বন্দীদের জন্য এমন পরিমাণ মুক্তিপণ পাঠায় যাতে তিনি খুশি হয়ে যান, আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি তো মুসলিম ছিলাম, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «اللَّهُ أَعْلَمُ بِإِسْلَامِكَ، فَإِنْ يَكُنْ كَمَا تَقُولُ فَإِنَّ اللَّهَ يَجْزِيكَ، وَأَمَّا ظَاهِرُكَ فَقَدْ كَانَ عَلَيْنَا، فَافْتَدِ نَفْسَكَ وابني أخيك نوفل وعقيل، وحليفك عتبة بن عمرو» “আল্লাহ তা‘আলা আপনার ইসলাম সম্পর্কে ভালো অবগত আছেন, প্রকৃত বিষয় যদি তাই হয় যা আপনি বলছেন তবে আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে বদলা দিবেন, তবে আপনার বাহ্যিক বিষয়টি আমাদের বিরুদ্ধে, কাজেই আপনার মুক্তিপণ দিন, আরও দিন আপনার দুই চাচাত ভাই নাউফাল ইবনুল হারিস ইবন আব্দুল মুত্তালিব এবং আক্বীল ইবন আবু তালিব ইবন আব্দুল মুত্তালিবের আর আপনার মিত্র বানু হারিস ইবন ফিহর ভাই উৎবা ইবন আমরের। তখন তিনি (আব্বাস) বলেন, আমার নিকট মুক্তিপণ নেই ইয়া রাসূলাল্লাহ। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «فَأَيْنَ الْمَالُ الَّذِي دَفَنْتَهُ أَنْتَ وَأُمُّ الْفَضْلِ؟ فَقُلْتَ لَهَا إِنْ أُصِبْتُ فِي سَفَرِي هَذَا، فَهَذَا الْمَالُ الَّذِي دَفَنْتُهُ لِبَنِيَّ الْفَضْلِ وَعَبْدِ اللَّهِ وَقُثَمَ» “সেই সম্পদ কোথায় যা আপনি এবং উম্মুল ফায্ল পুঁতে রেখেছেন আর আপনি তাকে বলেছিলেন: আমি যদি সফরে নিহত হই তবে আমার এ পুঁতে রাখা সম্পদ আমার সন্তান ফযল, আব্দুল্লাহ এবং কুসামের জন্য? তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ, ইয়া রাসূলাল্লাহ, নিঃসন্দেহে আমি অবগত আছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, এটি এমন একটি বিষয় যা আমি আর ফযলের মা ছাড়া আর কেউ জানে না, তাহলে আপনারা আমার কাছে থাকা যে বিশ উকিয়া নিয়ে নিয়েছেন সেটাকেই আমার মুক্তিপণ হিসেবে গ্রহণ করুন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «لَا، ذَاكَ شَيْءٌ أَعْطَانَا اللَّهُ تَعَالَى مِنْكَ» না, সেটা তো আল্লাহ তা‘আলা নিজ অনুগ্রহে আপনার থেকে আমাদেরকে দিয়েছেন। সুতরাং আব্বাস নিজের, তাঁর দুই ভাতুষ্পুত্র এবং তাঁর হালীফের (মিত্রের) পক্ষ থেকে মুক্তিপণ আদায় করেন। সে সময় আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করেন-  يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ قُل لِّمَن فِيٓ أَيۡدِيكُم مِّنَ ٱلۡأَسۡرَىٰٓ إِن يَعۡلَمِ ٱللَّهُ فِي قُلُوبِكُمۡ خَيۡرٗا يُؤۡتِكُمۡ خَيۡرٗا مِّمَّآ أُخِذَ مِنكُمۡ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ “হে নবী! তোমাদের হাতে যে সব যুদ্ধবন্দী আছে তাদেরকে বল, ‘আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তরে ভালো কিছু দেখেন তাহলে তোমাদের কাছ থেকে (মুক্তিপণ) যা নেওয়া হয়েছে তাত্থেকে উত্তম কিছু তোমাদেরকে তিনি দান করবেন আর তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন, আর আল্লাহ তা‘আলা পরম ক্ষমাশীল অত্যন্ত দয়ালু”।
আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল, আপনি যা নিয়ে এসেছি আর আমরা সাক্ষ্য দিই যে, আপনি আল্লাহর রাসূল। আমরা অবশ্যই আমাদের কাওমের ওপর আপনা কল্যাণকে প্রাধান্য দেব। তারপর আল্লাহ নাযিল করেন, إِن يَعۡلَمِ ٱللَّهُ فِي قُلُوبِكُمۡ خَيۡرٗا يُؤۡتِكُمۡ خَيۡرٗا مِّمَّآ أُخِذَ مِنكُمۡ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের থেকে যা নেওয়া হয়েছে তার বিনিময়ে তোমাদের উত্তম বদলা দেবেন। وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡۚ তোমাদের শির্ক যার ওপর তোমরা ছিলে। এ আয়াত নাযিলের পর আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমার সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল না হয়ে সমগ্র দুনিয়া আমাকে দেওয়া হোক তা আমি পছন্দ করি না। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, يُؤۡتِكُمۡ خَيۡرٗا مِّمَّآ أُخِذَ مِنكُمۡ আমার থেকে যা নেওয়া হয়েছে তার একশত গুণ বেশি উত্তম আমাকে দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡۚ আশা করি তিনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَإِن يُرِيدُواْ خِيَانَتَكَ “যদি তারা তোমার সাথে খিয়ানাত করার ইচ্ছে” (তবে সেটা অসম্ভব কিছু নয়, কারণ এর থেকেও গুরুতর যে) অর্থাৎ তারা যে সমস্ত কথাবার্তা প্রকাশ করে তাতে فَقَدۡ خَانُواْ ٱللَّهَ مِن قَبۡلُ “তারা পূর্বে আল্লাহর সাথে খিয়ানাত করেছে” অর্থাৎ বদর যুদ্ধের পূর্বে তাঁকে অস্বীকার করে। فَأَمۡكَنَ مِنۡهُمۡۗ “কাজেই আল্লাহ তাদেরকে তোমার অধীন করে দিয়েছেন” তাদেরকে বদরে বন্দী করার মাধ্যমে। وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ “আল্লাহ সর্ব বিষয়ে বিশেষভাবে অবগত, সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞাবান” তিনি তাঁর কর্ম সম্পর্কে পূর্ণ অবগত আর সে ব্যাপারে প্রজ্ঞাবান।
কাতাদাহ বলেন, আব্দুল্লাহ ইবন আবী সারাহ যখন সে মুরতাদ হয়ে মুশরিকদের সাথে মিলিত হয় তার সম্পর্কে আয়াত নাযিল হয়।
আতা আল-খুরাসানী বলেন, ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেছেন, আব্বাস ও তার সাথীদের বিষয়ে নাযিল হয়েছে যখন তারা বলে আমরা আমাদের সম্প্রদায়ের ওপর আপনার কল্যাণকে প্রাধান্য দেব। সূদ্দী রহ. বলেন, আয়াতটি ব্যাপক। তার কথাই স্পষ্ট ও ব্যাপক। আল্লাহ ভালো জানেন।
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَهَاجَرُواْ وَجَٰهَدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱلَّذِينَ ءَاوَواْ وَّنَصَرُوٓاْ أُوْلَٰٓئِكَ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَلَمۡ يُهَاجِرُواْ مَا لَكُم مِّن وَلَٰيَتِهِم مِّن شَيۡءٍ حَتَّىٰ يُهَاجِرُواْۚ وَإِنِ ٱسۡتَنصَرُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ فَعَلَيۡكُمُ ٱلنَّصۡرُ إِلَّا عَلَىٰ قَوۡمِۢ بَيۡنَكُمۡ وَبَيۡنَهُم مِّيثَٰقٞۗ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ٧٢﴾ [الانفال: ٧٢]
অর্থনুবাদ:
“যারা ঈমান এনেছে, হিজরাত করেছে, নিজেদের মাল দিয়ে জান দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে আর যারা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, সাহায্য করেছে, এরা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর যারা ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরাত করে নি তারা হিজরাত না করা পর্যন্ত তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার কোনো দায়-দায়িত্ব তোমার ওপর নেই, তবে তারা যদি দীনের ব্যাপারে তোমাদের সাহায্য চায় তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য, তবে তাদের বিরুদ্ধে নয় যাদের সঙ্গে তোমাদের মৈত্রী চুক্তি রয়েছে। তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখেন”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৭২]
তাফসীর:
মুহাজির এবং আনসারগণ পরস্পর পরস্পরের বন্ধু:
আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের একাধিক প্রকার বর্ণনা করেছেন, আর তাদেরকে বিভক্ত করেছেন মুহাজিরে যারা তাদের ঘরবাড়ী ও ধনসম্পদ ছেড়ে বের হয়ে এসেছে তারা এসেছে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে সাহায্য করার জন্য, দীন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে, আর এ জন্য তারা তাদের ধনসম্পদ এবং আত্মা ব্যয় করেছেন। (আর) আনসারে বিন্যাস করেছেন, তারা হচ্ছে মদীনাবাসী মুসলিমবৃন্দ যারা তাদের মুহাজির ভাইদেরকে তাদের বাড়ীঘরে আশ্রয় দিয়েছিলেন, আর তাদের ধনসম্পদ দিয়ে তাদের আরামের ব্যবস্থা করেছিলেন, আর আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে সাহায্য করেছিলেন তাদের সাথে থেকে যুদ্ধ করার মাধ্যমে। بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ “এরা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু” তাদের প্রত্যেকের রয়েছে অপরের জন্য অধিক অধিকার অন্যদের চেয়ে। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজির এবং আনসারবৃন্দের প্রত্যেক দু’জনের মাঝে ভাতৃত্ব সৃষ্টি করে দেন, এ কারণে তারা পরস্পরে উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন যা আত্মীয়স্বজনের ওপর অগ্রগণ্য ছিল। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা মীরাসের আয়াতের মাধ্যমে এ বিষয়টিকে রহিত করে দেন। সহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে এ বিষয়টি প্রমাণিত রয়েছে।  মুজাহিদ, ইকরামাহ, হাসান, হাসান রহ. ও অন্যান্যরা একই কথা বলেছেন।  আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের একাধিক স্থানে মুহাজির ও আনসারগণের প্রশংসা করেছেন, তিনি বলেছেন: وَالسَّابِقُونَ الأوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالأنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الأنْهَارُ [التوبة: “মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম সারির অগ্রণী আর যারা তাদেরকে যাবতীয় সৎকর্মে অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট আর তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তাদের জন্য তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত যার তলদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১০০] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَقَدْ تَابَ اللَّهُ عَلَى النَّبِيِّ وَالْمُهَاجِرِينَ وَالأنْصَارِ الَّذِينَ اتَّبَعُوهُ فِي سَاعَةِ الْعُسْرَةِ [التوبة: “আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন নাবীর প্রতি এবং মুহাজির ও আনসারদের প্রতি যারা সংকটকালে তাকে অনুসরণ করেছিল”। [সূরা আদ-তাওবাহ আয়াত: ১১৭] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿لِلۡفُقَرَآءِ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ ٱلَّذِينَ أُخۡرِجُواْ مِن دِيَٰرِهِمۡ وَأَمۡوَٰلِهِمۡ يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗا وَيَنصُرُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّٰدِقُونَ ٨ وَٱلَّذِينَ تَبَوَّءُو ٱلدَّارَ وَٱلۡإِيمَٰنَ مِن قَبۡلِهِمۡ يُحِبُّونَ مَنۡ هَاجَرَ إِلَيۡهِمۡ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمۡ حَاجَةٗ مِّمَّآ أُوتُواْ وَيُؤۡثِرُونَ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ وَلَوۡ كَانَ بِهِمۡ خَصَاصَةٞۚ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفۡسِهِۦ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٩﴾ [الحشر: ٨، ٩] “(আর এ সম্পদ) সে সব দরিদ্র মুহাজিরদের জন্য যাদেরকে তাদের বাড়ীঘর ও সম্পত্তি-সম্পদ থেকে উৎখাত করা হয়েছে। যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে, আর তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। এরাই (কথায় ও কাজে) সত্যবাদী। (আর এ সম্পদ তাদের জন্যও) যারা মুহাজিরদের আসার আগে থেকেই (মাদীনাহ) নগরীর বাসিন্দা ছিল আর ঈমান গ্রহণ করেছে। তারা তাদেরকে ভালোবাসে যারা তাদের কাছে হিজরাত করে এসেছে। মুহাজিরদেরকে যা দেওয়া হয়েছে তা পাওয়ার জন্য তারা নিজেদের অন্তরে কোনো কামনা রাখে না, আর তাদেরকে (অর্থাৎ মুহাজিরদেরকে) নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয় নিজেরা যতই অভাবগ্রস্ত হোক না কেন। যাদেরকে হৃদয়ের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই সফলকাম”। তিনি কতই না চমৎকারভাবে এ আয়াতে বলেছেন: وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمۡ حَاجَةٗ مِّمَّآ أُوتُوا “মুহাজিরদেরকে যা দেওয়া হয়েছে তা পাওয়ার জন্য তারা নিজেদের অন্তরে কোনো কামনা রাখে না” অর্থাৎ হিজরতের কারণে আল্লাহ তা‘আলা মুহাজিরবৃন্দকে যে মর্যাদা দিয়েছেন তার জন্য তাদের প্রতি তারা পরশ্রীকাতর নয়। আয়াতে বাহ্যত বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা আনসারদের ওপর মুহাজিরদেরকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আর এ বিষয়ের ওপর আলেমগণের মাঝে ঐক্যমত সৃষ্টি হয়েছে কেউ এ ব্যাপারে মতনৈক্য করে নি। এ কারণেই ইমাম বাযযার সা‘ঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব থেকে তিনি হুযাইফাহ থেকে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে হিজরত ও সাহায্য দু’টির মধ্যে যে কোনো একটি গ্রহণ করতে বললে আমি হিজরতকে গ্রহণ করি।
যারা ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরত করে নি তাদের জন্য কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَلَمۡ يُهَاجِرُواْ مَا لَكُم مِّن وَلَٰيَتِهِم مِّن شَيۡءٍ “আর যারা ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরাত করে নি তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার কোনো দায়-দায়িত্ব তোমার ওপর নেই” হামযাহ وَلَٰيَتِهِم অর্থাৎ واو এ যের দ্বারা পাঠ করেছেন, বাকিরা পড়েছেন যাবার দিয়ে। উভয়ের অর্থ একই, যেমন دِلَالَة এবং دَلَالَة আল্লাহ তা‘আলার বাণী: حَتَّى يُهَاجِرُوا “হিজরাত না করা পর্যন্ত” এ হচ্ছে মুমিনগণের তৃতীয় প্রকার, তারা ওরাই যারা ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরত করে নি; বরং তাদের এলাকাতেই অবস্থান করেছে, গনীমতে তাদের কোনো অংশ নেই, নেই এক পঞ্চমাংশেও তবে যদি তারা এ ব্যাপারে জিহাদে উপস্থিত থাকে তবে ভিন্ন কথা। যেমন, ইমাম আহমাদ রহ. বর্ণনা করেন, বুরাইদাহ ইবনুল হুসাইব আল-আসলামী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কাউকে কোনো সারিয়্যাহ (অভিযান) এবং সৈন্যবাহিনীর কমাণ্ডার করে পাঠাতেন তখন তাকে আল্লাহভীতি এবং তার নেতৃত্বের অধীনে থাকা মুসলিমদের প্রতি দয়াপরবশ হওয়ার উপদেশ দিতেন। তিনি বলতেন, «اغْزُوا بِاسْمِ اللَّهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، قَاتِلُوا مَنْ كَفَرَ بِالْلَّهِ، إِذَا لَقِيتَ عَدُوَّكَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ فَادْعُهُمْ إِلَى إِحْدَى ثَلَاثِ خِصَالٍ - أَوْ خِلَالٍ - فَأَيَّتُهُنَّ مَا أَجَابُوكَ إِلَيْهَا فَاقْبَلْ مِنْهُمْ، وَكُفَّ عَنْهُمْ، ادْعُهُمْ إِلَى الْإِسْلَامِ فَإِنْ أَجَابُوكَ فَاقْبَلْ مِنْهُمْ وَكُفَّ عَنْهُمْ، ثُمَّ ادْعُهُمْ إِلَى التَّحَوُّلِ مِنْ دَارِهِمْ إِلَى دَارِ الْمُهَاجِرِينَ وَأَعْلِمْهُمْ إِنْ فَعَلُوا ذَلِكَ أَنَّ لَهُمْ مَا لِلْمُهَاجِرِينَ وَأَنَّ عَلَيْهِمْ مَا عَلَى الْمُهَاجِرِينَ، فَإِنْ أَبَوْا وَاخْتَارُوا دَارَهُمْ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّهُمْ يَكُونُونَ كَأَعْرَابِ الْمُسْلِمِينَ يَجْرِي عَلَيْهِمْ حُكْمُ اللَّهِ الَّذِي يَجْرِي عَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَلَا يَكُونُ لَهُمْ فِي الْفَيْءِ وَالْغَنِيمَةِ نَصِيبٌ إِلَّا أن يجاهدوا مع المسلمين، فإن أَبَوْا فَادْعُهُمْ إِلَى إِعْطَاءِ الْجِزْيَةِ، فَإِنْ أَجَابُوا فَاقْبَلْ مِنْهُمْ وَكُفَّ عَنْهُمْ، فَإِنْ أَبَوْا فَاسْتَعِنْ بالله وقاتلهم» “আল্লাহ তা‘আলার নাম নিয়ে আল্লাহর পথে লড়াই কর, আল্লাহর প্রতি অস্বীকারকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যখন তুমি তোমার কোনো মুশরিক শত্রুর সাক্ষাত পাও তখন তাদেরকে তিনটি ইখতিয়ার প্রদান কর- এর যে কোনো একটির প্রতি তারা সাড়া দেয় তাই তাদের থেকে গ্রহণ কর আর তাদের থেকে হাত গুটিয়ে নাও, তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানাও, যদি তারা তোমার আহ্বানে সাড়া দেয় তবে তাই তাদের থেকে গ্রহণ করা আর তাদের থেকে ফিরে যাও, এরপর তাদেরকে তাদের এলাকা থেকে মুহাজিরদের এলাকার দিকে হিজরতের আহ্বান জানাও, আর তাদেরকে জানিয়ে দিবে যে, যদি তারা সেটা করে তবে তাদের জন্য তাই রয়েছে যা মুহাজিরবৃন্দের জন্য রয়েছে। আর তাদের ওপর তাই বর্তাবে যা মুহাজিরদের ওপর বর্তাবে; কিন্তু যদি তারা অস্বীকার করে আর তাদের এলাকাতেই থেকে যেতে পছন্দ করে তবে তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, তারা হবে মুসলিম দেহাতিদের মতো তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার সেই বিধান চলবে যা মুমিনদের ওপর চলে। আর মালে ফাই এবং গনীমতে তাদের কোনো অংশ নেই, তবে যদি তারা মুসলিমদের সাথে থেকে জিহাদ করে তবে ভিন্ন কথা। কিন্তু যদি তারা অস্বীকার করে তবে তাদেরকে জিযিয়া (কর) দিতে আহ্বান জানাও, যদি তারা তা দিতে চায় তবে তাদের থেকে তা গ্রহণ কর আর তাদের থেকে ফিরে যাও; কিন্তু তাতেও যদি তারা অস্বীকৃতি জানায়, তবে আল্লাহর নিকট সাহায্য কামনা কর, এরপর তাদের সাথে যুদ্ধ কর”।  
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَإِنِ ٱسۡتَنصَرُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ فَعَلَيۡكُمُ ٱلنَّصۡرُ “তবে তারা যদি দীনের ব্যাপারে তোমাদের সাহায্য চায় তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য” আল্লাহ তা‘আলা বলেন, এ সমস্ত দেহাতি যারা হিজরত করে নি তারা যদি তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে দীনের জিহাদে তোমাদের নিকট সাহায্য চায় তবে তোমরা তাদেরকে সাহায্য কর, কেননা তাদেরকে সাহায্য করা তোমাদের ওপর ওয়াজিব, কেননা তারা তোমাদের দীনী ভাই, তবে যদি তারা এমন সব কাফেরদের বিরুদ্ধে সাহায্য চায় بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ مِيثَاقٌ “যাদের সঙ্গে তোমাদের মৈত্রী চুক্তি রয়েছে” অর্থাৎ নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত শান্তি চুক্তি রয়েছে, তবে তাদের চুক্তি ভঙ্গ করো না অথবা তোমাদের অঙ্গিকার ভঙ্গ করো না যাদের সাথে তোমরা তা করেছ। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে এরূপ বর্ণিত হয়েছে।
﴿وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٍۚ إِلَّا تَفۡعَلُوهُ تَكُن فِتۡنَةٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَفَسَادٞ كَبِيرٞ ٧٣﴾ [الانفال: ٧٣]
অর্থানুবাদ:
“আর যারা কুফুরী করে তারা একে অপরের বন্ধু। যদি তোমরা তা না কর (অর্থাৎ তোমরা পরস্পর পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে না আস) তাহলে দুনিয়াতে ফিতনা ও মহাবিপর্যয় দেখা দিবে”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৭৩]
তাফসীর:
কাফেররা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু, মুসলিমবৃন্দের সাথে তাদের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই:
ইতোপূর্বে আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেন যে, মুমিনগণ পরস্পর পরস্পরের বন্ধু, এরপর তিনি তাদের এবং কাফেরদের মাঝের সকল প্রকার বন্ধুত্ব ও সমর্থন কেটে দেন, যেমন হাকিম তাঁর মুস্তাদরাকে বর্ণনা করেন, উসামা বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: "لَا يَتَوَارَثُ أَهْلُ مِلَّتَيْنِ وَلَا يَرِثُ مُسْلِمٌ كَافِرًا وَلَا كَافِرٌ مُسْلِمًا، ثُمَّ قَرَأَ: و وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٍۚ إِلَّا تَفۡعَلُوهُ تَكُن فِتۡنَةٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَفَسَادٞ كَبِيرٞ" “ভিন্ন ভিন্ন দুই জাতি পরস্পর পরস্পরের উত্তরাধিকারী হবে না, মুসলিম কাফিরের উত্তরাধিকারী হবে না, কাফের মুসলিমের উত্তরাধিকারী হবে না, এরপর তিনি পাঠ করেন-وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٍۚ إِلَّا تَفۡعَلُوهُ تَكُن فِتۡنَةٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَفَسَادٞ كَبِيرٞ “আর যারা কুফুরী করে তারা একে অপরের বন্ধু। যদি তোমরা তা না কর (অর্থাৎ তোমরা পরস্পর পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে না আস) তাহলে দুনিয়াতে ফিতনা ও মহাবিপর্যয় দেখা দিবে”। (মুস্তাদরাক: ২/২৪০) এরপর হাকিম বলেন, হাদীসটির সনদ বিশুদ্ধ; কিন্তু ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাদের কিতাবে উল্লেখ করেন নি। আমি বলি, হাদীসটি সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে উসামা ইবন যায়েদ বর্ণনা করে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: «لَا يَرِثُ الْمُسْلِمُ الْكَافِرَ وَلَا الْكَافِرُ الْمُسْلِمَ» “মুসলিম কাফিরের উত্তরাধিকারী হবে না আর কাফের মুসলিমের উত্তরাধিকারী হবে না”।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: إِلَّا تَفۡعَلُوهُ تَكُن فِتۡنَةٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَفَسَادٞ كَبِيرٞ “যদি তোমরা তা না কর (অর্থাৎ তোমরা পরস্পর পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে না আস) তাহলে দুনিয়াতে ফিতনা ও মহাবিপর্যয় দেখা দিবে” এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে তোমরা যদি কাফেরদেরকে পরিহার না কর, আর বিশ্বাসীদের প্রতি বন্ধুত্ব স্থাপন না কর, তা হচ্ছে বিষয় মিশ্রিত করা, কাফেরদের সাথে মুমিনগণের মেলামেশা করা। ফলে মানুষের মাঝে বিক্ষিপ্ত, বিস্তৃত ও দীর্ঘ ফিৎনার সৃষ্টি হবে।
﴿وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَهَاجَرُواْ وَجَٰهَدُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱلَّذِينَ ءَاوَواْ وَّنَصَرُوٓاْ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ حَقّٗاۚ لَّهُم مَّغۡفِرَةٞ وَرِزۡقٞ كَرِيمٞ ٧٤ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنۢ بَعۡدُ وَهَاجَرُواْ وَجَٰهَدُواْ مَعَكُمۡ فَأُوْلَٰٓئِكَ مِنكُمۡۚ وَأُوْلُواْ ٱلۡأَرۡحَامِ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلَىٰ بِبَعۡضٖ فِي كِتَٰبِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمُۢ ٧٥﴾ [الانفال: ٧٤، ٧٥]
অর্থানুবাদ:
“যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে আর যারা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, সাহায্য-সহযোগিতা করেছে- তারাই প্রকৃত ঈমানদার। তাদের জন্য আছে ক্ষমা আর সম্মানজনক জীবিকা। যারা পরে ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে আর তোমাদের সাথে মিলিত হয়ে জিহাদ করেছে, এসব লোক তোমাদেরই মধ্যে গণ্য। কিন্তু আল্লাহর বিধানে রক্ত সম্পর্কীয়গণ পরস্পর পরস্পরের নিকট অগ্রগণ্য। আল্লাহ সকল বিষয়ে সবচেয়ে বেশি অবগত”। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৭৪-৭৫]
তাফসীর:
মুমিনগণ সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে:
ইতোপূর্বে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে মুমিনগণের বিধান সম্পর্কে উল্লেখ করেন, এরপর পরকালে তাদের জন্য কী রয়েছে এর বর্ণনা তার সাথে সংযুক্ত করেন, আল্লাহ তা‘আলা তাদের দৃঢ় ঈমানের বিষয়টি সত্যায়ন করেন, যেমন সূরার গোড়ার দিকে তা বর্ণনা করা হয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমার মাধ্যমে পুরস্কৃত করবেন আর গোনাহগুলোকে উপেক্ষা করবেন যদি তা থেকে থাকে। তিনি তাদেরকে সম্মানিত রিযিক প্রদান করবেন যা সুন্দর, প্রচুর, পবিত্র, সম্মানিত, চিরস্থায়ী, যা কখনও বন্ধ হবে না, শেষ হবে না, সেগুলোতে একঘেয়েমি জনিত বিরক্তি অনুভুত হবে না, সেগুলো হবে আনন্দদায়ক এবং বহু বৈচিত্রময়তা সেগুলোর মধ্যে পরিলক্ষিত হবে। এরপর আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেন যে, দুনিয়ায় তাদের অনুসারীরা যারা তাদের ঈমানের অনুসরণ করেছিল এবং সৎ কর্ম করেছিল আখিরাতেও তারা তাদের সাথে থাকবে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَالسَّابِقُونَ الأوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالأنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الأنْهَارُ “মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম সারির অগ্রণী আর যারা তাদেরকে যাবতীয় সৎকর্মে অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট আর তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তাদের জন্য তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত যার তলদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১০০] তিনি বলেন, ﴿وَٱلَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعۡدِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠ ﴾ [الحشر: ١٠] “যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে: ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোনো বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু”। [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ১০] মুত্তাফাকুন আলাইহি-এর হাদীস বরং বিভিন্ন বিশুদ্ধ সূত্র থেকে তা মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌঁছেছে (এরূপ হাদীস), রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «الْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ» ‘ব্যক্তি তার সাথে থাকবে যাকে সে ভালোবাসে’।  
উত্তরাধিকার নিকটাত্মীয়দের জন্য:
আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَأُوْلُواْ ٱلۡأَرۡحَامِ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلَىٰ بِبَعۡضٖ فِي كِتَٰبِ ٱللَّهِۚ “কিন্তু আল্লাহর বিধানে রক্ত সম্পর্কীয়গণ পরস্পর পরস্পরের নিকট অগ্রগণ্য” অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার বিধানে وَأُوْلُواْ ٱلۡأَرۡحَامِ “রক্ত সম্পর্কীয়গণ”।  এ কথার দ্বারা শুধুমাত্র তারা উদ্দেশ্য নয় ইলমুল ফারায়েজের আলেমগণ যাদেরকে আত্মীয় হিসেবে গণ্য করেছেন কিন্তু কুরআনে তাদের নির্ধারিত কোনো অংশের কথা বলে দেওয়া হয় নি আর তারা আসাবাও নয়; বরং তারা ওয়ারিসের সাথে ঝুলন্ত, যেমন খালা, মামা, ফুফু, কন্যার সন্তানেরা, বোনের সন্তানেরা এবং তাদের মত অন্যান্যরা। কিন্তু অনেকে ভাবেন এ কথার দ্বারা তাদেরকেই বুঝানো হয়েছে, আর এ আয়াত এর দলীল হিসেবে পেশ করেন আর মাসআলায় সুস্পষ্টভাবে এটিই বিশ্বাস করেন বরং প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে আয়াতটি عام সব আত্মীয়স্বজন এ আয়াতে শামিল। যেমন, এ ব্যাপারে বলেছেন আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা, মুজাহিদ, ইকরিমা, হাসান, কাতাদা এবং আরও অন্যান্যরা। তারা বলেন যে, এ আয়াতটি তাদের উত্তরাধিকারকে রহিত করে দেয় যারা চুক্তিগত অথবা ভ্রাতৃত্বের কারণে ইসলামের প্রাথমিক যুগে উত্তরাধিকারী হত। এর ভিত্তিতে বিশেষ নামের সাথে যাবিল আরহামও এতে শামিল, আর যারা তাদেরকে ওয়ারিসই মনে করেন না তারা কয়েকটি দলীল প্রদান করেন, তন্মধ্যে: হাদীস: «إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَعْطَى كُلَّ ذِي حَقٍّ حَقَّهُ، فَلَا وصِيَّة لِوَارِثٍ» “আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক হকদারকে তার হক প্রদান করেছেন। কাজেই ওয়ারিসের জন্য কোনো ওয়াসিয়ত নেই’’।  তারা বলেন যে, সে যদি হকদার হত তবে তার হক আল্লাহ তা‘আলা কিতাবে নাম ধরে অবধারিত থাকত, যখন তা পাওয়া যাচ্ছে না তখন সে ওয়ারিস নয়। আল্লাহ ভালো জানেন।
সূরা আনফালের তাফসীর সমাপ্ত। আল্লাহ তা‘আলার জন্য সকল প্রশংসা এবং তাঁরই অনুগ্রহ, তাঁর ওপর আমরা ভরসা রাখি, তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট আর তিনি উত্তম কর্মবিধায়ক।

 

 

হাফেয ইবন কাসীরের তাফসীর থেকে সংক্ষেপিত সূরা আল-আনফালের তাফসীর

বই সম্পর্কে

লেখক :

أحمد محمد شاكر

প্রকাশক :

www.islamhouse.com

বিভাগ :

About Quran & Hadith