Ile
Nipa
E pade
Awon ipin
Ise afihan Isilamu
Anabi Muhammad-ki Ike ati ola Olohun ma ba.
Obinrin ninu Isilamu
Ifesi si awon asigboye
Iyanu ohun ijinle
Jesu-ki Ike ati ola Olohun ma ba- ninu Isilamu
Sise ifijora awon esin
Bibe Olohun to ola Re ga julo
Why I became a Muslim!
Fun eniti o se se di Musulumi
Pataki ile-aye
Nipa Alukuranu ati Hadisi
Fatiwa, idahun si ibere eko esin
Awon iwa rere ati eko
Adiokan ati awon ijo
Orun
Bayogirafi ati awon Onimimo
Idunadura ati ijosin
Awon ese nla ati awon iwa ebo sise
Eko imo agboye-esin
Fun awon omode
Ede larubawa ati eko ijinle re
Awon ede
English
- English
Arabic
- اللغة العربية
Chinese
- 中文
Russian
- Русский
Deutsch
- Deutsch
French
- Français
Spanish
- Español
Portuguese
- Português
Greek
- Ελληνικά
Italian
- Italiano
Romanian
- Română
Japanese
- 日本語
Turkish
- Türkçe
Hindi
- हिन्दी
Thai
- ไทย
Ukrainian
- Украïнська
Urdu
- اردو
Filipino
- Tagalog
Nepali
- नेपाली
Dutch
- Nederlands
Polish
- Polski
Swedish
- Svenska
Sinhalese
- සිංහල
Bosnian
- Bosanski
Swahili
- Kiswahili
Persian
- فارسى
Albanian
- Shqip
Czech
- Čeština
Korean
- 한국어
Hebrew
- עברית
Bengali
- বাংলা ভাষা
Vietnamese
- tiếng Việt
Malay
- Bahasa Melayu
Danish
- Dansk
Finnish
- suomi
Norwegian
- norsk
Armenian
- Հայերեն
Estonian
- Eesti
Tamil
- தமிழ் மொழி
Telugu
- తెలుగు
Slovak
- Slovenčina
Macedonian
- македонски
Uzbek
- Ўзбек
Bulgarian
- български
hungarian
- magyar
Indonesian
- Indonesian
Icelandic
- íslenska
Georgian
- ქართული
Mongolian
- Mongɣol
Hausa
- Hausa
Latvian
- latviešu
Lithuanian
- lietuvių
Yoruba
- Yoruba
Malayalam - Malabar
- മലയാളം
Burmese
- myanma
Amharic
- አማርኛ
Azerbaijani
- Azərbaycanca
Kurdish
- کوردی
Somali
- Af-Soomaali
Uyghur
- ئۇيغۇر تىلى
Sindhi
- سنڌي
Pashto
- پښتو
Comorian
- Comorian
Tajik
- Тоҷикӣ
Fula
- Fulani - Peul
Flata
- Falatia
Malagasy
- Malagasy
Chechen
- Chechen
N'ko Bambara
- Bamanankan
Brahui
- Brahui
Catalan
- català
Lingala
- Lingala
Kannada
- ಕನ್ನಡ
Maranao Iranon
- Mëranaw
Luganda
- Luganda
Afaan Oromoo
- Oromoo
Tigrinya
- ትግርኛ
Kirghiz - Kyrgyz
- Кыргызча
Turkmani
- Türkmen dili
Khmer Campodian
- ភាសាខ្មែរ
Circassian
- Circassian
Chewa
- Chichewa - Nyanja
Slovenian
- Slovenščina
Avar - Awari
- МагIарул мацI
Kazakh
- Қазақ тілі
Soninke
- Soninke
Tatar
- Татарча
Maldivian
- Maldivi - divehi
Serbian
- Српски
Wolof
- Wolof
Tamazight
- Tamazight
Romani Gipsy
- Romani ćhib
Zulu
- isiZulu
Rohingya
- Ruáingga
Belarusian
- беларуская
Visayan
- Bisayan - Bisaya
Kalagan
- Kalagan
Yakan
- Yakan
Tausug
- Bahasa Sūg
Maguindanao
- Maguindanao
Cham
- Cham
Sepedi
- Sepedi - Sesotho
Samal
- Samal
Papiamento
- Papiamento
Kashmiri
- कॉशुर كأشُر kạ̄šur
Tibetan
- Tibetan
Bashkir
- Башҡорт теле
Kinyarwanda
- Kinyarwanda
Croatian
- hrvatski
Mandar
- Mandar
Afrikanns
- Afrikanns
Afar
- Qafár af
Jola
- Jóola - Diola
Kurmanji
- Kurmancî
Ossetian
- Иронау
Mauritian
- Kreol Morisien
Esperanto
- Esperanto
Igbo
- Asụsụ Igbo
Xhosa
- isiXhosa
Karachay-Balkar
- Къарачай-Малкъ
Kanuri
- Kanuri
Bassa
- Bissa - Mbene
Marathi
- Marāţhī
Gujarati
- Gujarātī
Assamese
- অসমীয়া
Nuer
- Nuer - Naadh
Dinka/Bor
- Dinka/Bor
Shilluk/Chollo
- Shilluk/Dhøg Cøllø
Akan
- Akan/Twi/Fante
Ingush
- ГІалгІай мотт
Shona
- chiShona
Maltese
- Malti
Mossi
- Mõõré
Bambara
- Bamanan
Balochi
- بلوچی
Mandinka
- Mandi'nka kango
Sotho
- Sesotho
Nzema
- Nzima
Fante dialect of Akan
- Fanti
Mouskoun
- Mouskoun
Dagbani
- Dagbanli
Lusoga
- Soga
Luhya
- Luhiya
Gonja
- Gonja
Ile
Awon iwe
ঈমানের মূলনীতিসমূহের ব্যাখ্যা
Awon iwe
Awon telifisan
Awon redio
Akole
Fatiwa
Kurani
Awon fidio
Odio
Awon onkowe
Awon Iwelo
Webusaiti
ঈমানের মূলনীতিসমূহের ব্যাখ্যা
লেখক এই পুস্তিকাটিতে ইসলামী আক্বীদার মূল ভিত্তিসমূহ সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ও সঠিক ব্যাখ্য প্রদান করেছেন। নির্ভেজাল ইসলামী আক্বীদার জ্ঞানার্জনের জন্য বইটির গুরুত্ব অপরিসীম।
ঈমানের মূলনীতিসমূহের ব্যাখ্যা
شرح أصول الإيمان
< بنغالي >
মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল-উছাইমীন
অনুবাদক: আবু মাহমুদ মুহাম্মাদ আলীমুল্লাহ
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
شرح أصول الإيمان
محمد بن صالح العثيمين
ترجمة: أبو محمود محمد عليم الله
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
সূচিপত্র
ক্রম বিষয় পৃষ্ঠা
1. অনুবাদকের কথা
2. ভূমিকা
3. দীন ইসলাম
4. ইসলামের ভিত্তিসমূহ
5. ঈমানের প্রথম ভিত্তি হলো আল্লাহ তা‘আলার ওপর ঈমান
6. ঈমানের দ্বিতীয় ভিত্তি: ফিরিশতাগণের ওপর ঈমান
7. ঈমানের তৃতীয় ভিত্তি: আসমানী কিতাবসমূহের ওপর ঈমান
8. ঈমানের চতুর্থ ভিত্তি: রাসূলগণের ওপর ঈমান
9. ঈমানের পঞ্চম ভিত্তি: আখেরাতের ওপর ঈমান
10. ঈমানের ষষ্ঠ ভিত্তিঃ ঈমান বিল ক্বদার অর্থাৎ ভাগ্যের প্রতি ঈমান
11. ইসলামী আক্বীদার লক্ষ্যসমূহ
অনুবাদকের কথা
আল্লাহ তা‘আলার অসংখ্য প্রশংসা যিনি নিখিল বিশ্বের একমাত্র রব। তিনি আমাদের সকলের সত্য মা‘বুদ। আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় সত্ত্বায় যেমন এক ও অদ্বিতীয় তেমনি তাঁর গুণাবলীতেও তিনি অনন্য ও অতুলনীয়। সালাত ও সালাম সেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি, যাঁকে আল্লাহ তা‘আলা সত্য-সঠিক দীন ইসলাম সহকারে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমাতরূপে প্রেরণ করেছেন এবং তাঁর বংশধর ও সাহাবায়ে কেরামের প্রতি এবং কিয়ামত পর্যন্ত ঐ সকল লোকদের প্রতি, যারা নিষ্ঠার সাথে কুরআন ও সুন্নাহর আনুগত্য ও অনুসরণ করে চলেন।
জেনে রাখুন, দীন ইসলামের মূল ভিত্তি হল ঈমানের ওপর। অথচ আজ আমাদের মুসলিম সমাজের এক বিরাট অংশ কুরআন ও সুন্নাহর আলোকবর্তিকা এবং ঈমান ও আক্বীদার জ্ঞান থেকে বহুদূরে অবস্থান করার ফলে কুফর, শির্ক এবং বিভিন্ন বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا يُؤۡمِنُ أَكۡثَرُهُم بِٱللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشۡرِكُونَ ١٠٦﴾ [يوسف: ١٠٦]
“তাদের অধিকাংশ আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে, কিন্তু তারা মুশরিক।’’ [সূরা ইউসূফ, আয়াত: ১০৬]
লেখক এ পুস্তিকাটিতে ইসলামী আক্বীদার মূল ভিত্তিসমূহ সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন। নির্ভেজাল ইসলামী আক্বীদার জ্ঞানার্জনের জন্য বইটির অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলা ভাষায় এর অনুবাদ করার প্রয়াসী হই। অনুবাদে কোনো ভুলত্রুটি দৃষ্টিগোচর হলে আমাকে অবহিত করার জন্য পাঠকের নিকট বিনীত অনুরোধ রইল। অসীম দয়ালু আল্লাহর নিকট আকুল আবেদন, তিনি যেন খালেসভাবে তাঁরই জন্য আমার এ পরিশ্রম কবূল করেন এবং এ কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য দুনিয়ার কল্যাণ ও আখেরাতে নাজাতের ওসীলা করে দেন। আমীন।
আবু মাহমুদ মুহাম্মাদ আলীমুল্লাহ
পোঃ দারোগার হাট
৩৯১২ ছাগলনাইয়া
ফেনী।
ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আমরা তাঁরই প্রশংসা করি এবং তাঁরই নিকট সাহায্য চাই। তাঁরই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তাঁরই নিকট তাওবা করি। সমস্ত বিপর্যয় ও কুকীর্তি হতে রক্ষার জন্য আমরা তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করি। আল্লাহ যাকে হিদায়াত দান করেন, তার কোনো পথভ্রষ্টকারী নেই আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তার কোনো পথ প্রদর্শনকারী নেই। অতঃপর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত সত্যিকার কোনো মা‘বুদ নেই, তিনি এক এবং অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরীক নেই। আরো সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর প্রিয় রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর, তাঁর বংশধর ও সাহাবায়ে কেরামের ওপর এবং যারা তাঁদের প্রদর্শিত পথের সঠিক অনুসারী হবে তাদের ওপর।
জেনে রাখুন, ইলমে তাওহীদ, তথা আল্লাহর তা‘আলার একত্ব সংক্রান্ত জ্ঞান সর্বাপেক্ষা মহৎ ও পবিত্র। কেননা, ইলমে তাওহীদ হলো আল্লাহ তা‘আলার নাম ও গুণাবলী সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করা এবং বান্দার ওপর তাঁর অধিকারসমূহ সম্পর্কে অবহিত হওয়া। আর এটাই আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের একমাত্র পথ এবং ইসলামী শরী‘আতের মূল ভিত্তি। এজন্যই নবী-রাসূলগণের দাওয়াত ও আহ্বান ছিল এরই প্রতি কেন্দ্রীভূত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ إِلَيۡهِ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ ٢٥﴾ [الانبياء: ٢٥]
‘‘আপনার পূর্বে আমরা যে রাসূলই প্রেরণ করেছি তার প্রতি এ প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি যে, আমি ব্যতীত সত্যিকার কোনো মা‘বুদ বা উপাস্য নেই। সুতরাং তোমরা একমাত্র আমারই ইবাদাত কর।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৫]
এটা সেই তাওহীদ যার সাক্ষ্য আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং নিজের জন্য দিয়েছেন এবং সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁর ফিরিশতাগণ ও বিদ্বান ব্যক্তিগণ আর এটাই আসমানী কিতাবসমূহের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কিত সর্ববৃহৎ সাক্ষ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿شَهِدَ ٱللَّهُ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَأُوْلُواْ ٱلۡعِلۡمِ قَآئِمَۢا بِٱلۡقِسۡطِۚ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٨﴾ [ال عمران: ١٨]
‘‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন, তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য মা‘বুদ নেই এবং ফিরিশতাগণ ও ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগন ও সাক্ষ্য দিয়েছেন, তিনি ছাড়া আর কোনো সত্যিকার ইলাহ (উপাস্য) নেই। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮]
তাওহীদের তাৎপর্য ও মর্যাদা যেহেতু অপরিসীম, তাই প্রত্যেক মুসলিমের অপরিহার্য দায়িত্ব হলো, আল্লাহর তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বের জ্ঞান শিক্ষা করা, অন্যকে তা শিক্ষা প্রদান করা এবং তাওহীদ নিয়ে গবেষণা ও চিন্তা-ভাবনা করা। যাতে করে, সে প্রশান্ত মন নিয়ে স্বীয় দীনকে এমন দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করে, যার সফলতা ও পরিণাম নিয়ে সে সুখী হতে পারে।
দীন ইসলাম:
ইসলাম সেই মহান দীন বা সত্য ও সঠিক জীবন বিধান, যা সহকারে আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাহমাতুল লিল ‘আলামীনরূপে প্রেরণ করেন এবং আল্লাহ তা‘আলা তাদ্বারা সমস্ত ধর্ম রহিত করে দেন, তাঁর বান্দাদের জন্য তা পূর্ণ করে দেন এবং এরই মাধ্যমে বান্দাদের ওপর আল্লাহর নি‘আমতের চুড়ান্ত পরিপূর্ণতার ঘোষণা প্রদান করেন ও বিশ্বমানবতার জন্য ইসলামকে একমাত্র দীন হিসেবে মনোনিত করেন। তিনি কারো থেকে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন কবুল করবেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٖ مِّن رِّجَالِكُمۡ وَلَٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّۧنَۗ﴾ [الاحزاب: ٤٠]
“মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন; (১) বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী’’। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪০]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ﴾ [المائدة: ٣]
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সুসম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যএকমাত্র দীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৩]
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
﴿إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ﴾ [ال عمران: ١٩]
‘‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দীন হলো একমাত্র ইসলাম।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত, ১৯]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٨٥﴾ [ال عمران: ٨٥]
“যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন অনুসন্ধান করে, কস্মিণকালেও তার নিকট হতে তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে হবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮৫]
আল্লাহ তা‘আলা মানবকূলের ওপর তাঁর মনোনীত এই দীন গ্রহণ করা ফরয করে দিয়েছন। তিনি স্বীয় নবীকে সম্বোধন করে বলেন,
﴿قُلۡ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنِّي رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَيۡكُمۡ جَمِيعًا ٱلَّذِي لَهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ يُحۡيِۦ وَيُمِيتُۖ فََٔامِنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِ ٱلنَّبِيِّ ٱلۡأُمِّيِّ ٱلَّذِي يُؤۡمِنُ بِٱللَّهِ وَكَلِمَٰتِهِۦ وَٱتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُونَ ١٥٨﴾ [الاعراف: ١٥٨]
“(হে নবী) বলে দিন, হে মানবমণ্ডলী, আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল, যিনি সমগ্র আসমান ও যমিনের সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তিনি ছাড়া আর কোনো সত্যিকার উপাস্য নেই। তিনি জীবন ও মৃত্যু দান করেন। সুতরাং তোমরা ঈমান আন আল্লাহর ওপর, তাঁর প্রেরিত উম্মী নবীর ওপর, যিনি ঈমান রাখেন আল্লাহ ও তাঁর সমস্ত কালামের ওপর। তাঁর অনুসরণ কর, যাতে তোমরা সঠিক সরল পথপ্রাপ্ত হতে পার।’’ [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৮]
সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘সেই মহান আল্লাহর কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, এই উম্মতের মধ্যকার লোক হোক সে ইয়াহূদী কিংবা খ্রিস্টান; যে লোক আমার আবির্ভাব সম্পর্কে অবহিত হবে, অতঃপর সে ইসলাম গ্রহণ ব্যতিরেকে মারা যাবে সে জাহান্নামে যাবে।”
রাসূলের প্রতি ঈমানের অর্থ:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে হিদায়াত এবং শিক্ষা নিয়ে এসেছেন সে সব বিষয়কে বিশ্বাস সহকারে গ্রহণ করা ও তার প্রতি অনুগত হওয়া। শুধু বিশ্বাস করাই যথেষ্ট নয়। এজন্যই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা আবু তালেব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনয়নকারী বলে বিবেচিত হন নি অথচ তিনি রাসূল যা নিয়ে এসেছিলেন তা সত্য বলে বিশ্বাস করতেন এবং সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনিত ইসলাম সর্বাপেক্ষা উত্তম ধর্ম।
ইসলামের মৌলিক বৈশিষ্ট্যাবলী:
এক: পূর্ববর্তী সব ধর্মের কল্যাণসমূহ ইসলামে নিহিত আছে। অন্যান্য ধর্মের ওপর ইসলামের প্রাধান্যের অন্যতম কারণ এটাও যে, ইসলাম স্থান-কাল, জাতি নির্বিশেষে সবার জন্য উপযোগী। আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলেন,
﴿وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ بِٱلۡحَقِّ مُصَدِّقٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهِ مِنَ ٱلۡكِتَٰبِ وَمُهَيۡمِنًا عَلَيۡهِۖ﴾ [المائدة: ٤٨]
“আর আমরা আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি সত্যগ্রন্থ যা পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর ওপর বিচারকারী (তাতে যে হক রয়েছে এবং যে বাতিল প্রবিষ্ট হয়েছে তা নির্ধারণকারী) হিসেবে’’। [সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৪৮]
‘ইসলাম নামক দীনটি স্থান-কাল, জাতি নির্বিশেষে সবার জন্য উপযুক্ত’ এর অর্থ এই যে, ইসলামের প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন কোনো যুগে বা কোনো দেশে জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী নয়; বরং তা সকল জাতির জন্য কল্যাণকর ও উপযোগী। আবার এর অর্থ এই নয় যে, ইসলাম প্রত্যেক স্থান-কাল ও জাতির প্রবৃত্তির অনুগত হয়ে থাকবে; যেমন কোনো কোনো লোক উদ্দেশ্য নিয়ে থাকে।
দুই: ইসলাম সে মহা সত্য দীন, যদি কেউ তা সঠিকভাবে ধারণ করে তা হলে তার প্রতি আল্লাহর ওয়াদা রয়েছে যে, আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন এবং অন্য সবকিছুর ওপর তাকে জয়যুক্ত করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿هُوَ ٱلَّذِيٓ أَرۡسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلۡهُدَىٰ وَدِينِ ٱلۡحَقِّ لِيُظۡهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡمُشۡرِكُونَ ٣٣﴾ [التوبة: ٣٣]
‘‘তিনিই সে সত্ত্বা যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন। যাতে একে অন্য সমস্ত দীনের ওপর জয়যুক্ত করেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩৩]
তিনি আরো বলেন,
﴿وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنكُمۡ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ لَيَسۡتَخۡلِفَنَّهُمۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ كَمَا ٱسۡتَخۡلَفَ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمۡ دِينَهُمُ ٱلَّذِي ٱرۡتَضَىٰ لَهُمۡ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّنۢ بَعۡدِ خَوۡفِهِمۡ أَمۡنٗاۚ يَعۡبُدُونَنِي لَا يُشۡرِكُونَ بِي شَيۡٔٗاۚ وَمَن كَفَرَ بَعۡدَ ذَٰلِكَ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡفَٰسِقُونَ ٥٥﴾ [النور: ٥٥]
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসন কর্তৃত্ব দান করবেন। যেমন, তিনি শাসনকর্তৃত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সূদৃঢ় করবেন তাদের দীনকে। যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদেরকে ভয় ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে শান্তি দান করবেন। তারা আমার ইবাদাত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হয়, তারা হলো ফাসেক।’’ [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫৫]
তিন: ইসলাম আক্বীদা ও শরী‘আত উভয়ের সমন্বয়ে গঠিত বিষয়ের নাম। ইসলাম তার আক্বীদা ও শরী‘আতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যেমন,
১। ইসলাম আল্লাহর একত্বের আদেশ দেয় এবং শির্ক থেকে নিষেধ করে।
২। ইসলাম সত্যের আদেশ দেয় এবং মিথ্যা থেকে নিষেধ করে।
৩। ইসলাম ন্যায় ও ইনসাফের নির্দেশ দেয় এবং যুলুম অত্যাচার থেকে নিষেধ করে।
৪। ইসলাম আমানত আদায়ের নির্দেশ দেয় এবং আমানতের খিয়ানত করতে নিষেধ করে।
৫। ইসলাম প্রতিশ্রুতি রক্ষার নির্দেশ দেয় এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ থেকে নিষেধ করে।
৬। ইসলাম মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার ও আনুগত্যের হুকুম দেয় এবং তাদের প্রতি অবাধ্য আচরণ করা থেকে নিষেধ করে।
৭। ইসলাম আত্মীয় স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার হুকুম দেয় এবং সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা থেকে নিষেধ করে।
৮। ইসলাম প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দেয় এবং অসদ্ব্যবহারে বাধা দেয়।
সারকথা, ইসলাম সর্বপ্রকার উত্তম চরিত্রের আদেশ দেয় এবং যাবতীয় কু-চরিত্র থেকে নিষেধ করে। প্রতিটি সৎকর্মের হুকুম দেয় ও প্রতিটি অপকর্ম থেকে নিষেধ করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُ بِٱلۡعَدۡلِ وَٱلۡإِحۡسَٰنِ وَإِيتَآيِٕ ذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَيَنۡهَىٰ عَنِ ٱلۡفَحۡشَآءِ وَٱلۡمُنكَرِ وَٱلۡبَغۡيِۚ يَعِظُكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَذَكَّرُونَ ٩٠﴾ [النحل: ٩٠]
“আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয় স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ ও সীমালংঘন নিষেধ করেন; তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর। [সূরা আন-নাহল আয়াত: ৯০]
ইসলামের ভিত্তিসমূহ
ইসলামের ভিত্তি হলো পাঁচটি। এগুলো আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা কর্তৃক বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীসে উল্লিখিত আছে। তিনি বলেছেন, ‘‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের ওপর। যথা, (১) এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য মা‘বুদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর প্রেরিত রাসূল। (২) সালাত কায়েম করা, (৩) যাকাত প্রদান করা, (৪) রমযানের সাওম পালন করা এবং (৫) কাবাঘরের হজ পালন করা।’’ এক ব্যক্তি হাদীসে বর্ণিত রুকনসমূহের ধারাবাহিক বর্ণনায় হজ্জ্বকে রমযানের সাওমের আগে উল্লেখ করলে আব্দুল্লাহ্ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা তা অস্বীকার করে বললেন, ‘রমযানের সাওম ও হজ’ এভাবেই আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি। (বুখারী ও মুসলিম, শব্দ মুসলিমের)
প্রথম ভিত্তি: কালিমাতুশ শাহাদাহ:
شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلاَ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
এর অর্থ হলো, ‘‘এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত ইবাদতের যোগ্য সত্যিকার কোনো মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। এ কথা মনে প্রাণে দৃঢ় বিশ্বাস করা এবং মুখে উচ্চারণ করা। এমনভাবে সেটা মনে দৃঢ় হবে যেন তা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। এই বাক্যে একাধিক বিষয় থাকা সত্বেও তাকে ইসলামের একটি ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে; এর কয়েকটি কারণ হতে পারে:
সম্ভবত তা এ জন্য যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে তার দীনের প্রচারক হেতু তাঁর উবুদিয়্যাত ও রিসালাত তথা আল্লাহর বান্দা ও রাসূল হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান -লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু -এর সাক্ষ্য প্রদানের সম্পূরক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
অথবা এ দুটি সাক্ষ্যই সমস্ত ইবাদাত ও সৎকর্ম সহীহ-শুদ্ধ হওয়া এবং আল্লাহ তা‘আলার নিকট তা গ্রহণযোগ্য হওয়ার পূর্বশর্ত। কারণ কোনো ইবাদাত শুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হয় না যতক্ষণ না তার মধ্যে দুটি শর্ত পাওয়া যায়; (ক) ইখলাছ অর্থাৎ শির্ক থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে ইবাদাত করা, (খ) মুতাবা‘আত অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা ও পদ্ধতি অনুযায়ী ইবাদাতগুলো সম্পাদন করা। সুতরাং ইখলাছের দ্বারা ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’-এর সাক্ষ্য বাস্তবায়িত হয় আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিপূর্ণ আনুগত্যের দ্বারা ‘‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’’ এর সাক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়।
কালিমায়ে শাহাদাত -এর সাক্ষ্য প্রদানের অন্যতম প্রধান ফল হলো:
অন্তর ও আত্মাকে সৃষ্টির গোলামী থেকে বের করা এবং নবী রাসূলগণ ছাড়া অন্যের আনুগত্য থেকে মুক্ত করা।
দ্বিতীয় ভিত্তি: সালাত কায়েম করা:
এর অর্থ হলো: সঠিক পদ্ধতি ও পরিপূর্ণভাবে, নির্দিষ্ট সময় ও সুষ্ঠুপন্থায় সালাত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদাত সম্পাদন করা।
সালাতের অন্যতম ফলাফল হলো, এর মাধ্যমে মনের প্রশান্তি, চোখের শীতলতা লাভ এবং অশ্লীল ও ঘৃণ্য কর্ম-কাণ্ড হতে বিরত থাকা যায়।
তৃতীয় ভিত্তি: যাকাত প্রদান করা:
আর তা হলো যাকাতের উপযুক্ত ধন-সম্পদে নির্ধারিত পরিমাণ মাল ব্যয়ের মধ্যমে আল্লাহর ইবাদাত করা।
যাকাত প্রদানের অন্যতম উপকারিতা হলো, যাকাত প্রদানের মধ্যমে কৃপণতার মতো হীন চরিত্র হতে আত্মাকে পবিত্র করা এবং ইসলাম ও মুসলমানদের অভাব পূরণ করা যায়।
চতুর্থ ভিত্তি: রমযান মাসের সাওম:
সাওম হচ্ছে রমযান মাসে দিনের বেলায় সাওম ভঙ্গকারী বিষয়াদি যেমন, পানাহার, যৌনাচার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদাত পালন করা।
সাওমের অন্যতম উপকারিতা: আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশায় স্বীয় কামনা-বাসনার বস্তুসমূহ বিসর্জনের মাধ্যমে আত্মার উৎকর্ষ সাধন করা।
পঞ্চম ভিত্তি: হজ্জ পালন করা:
এর অর্থ হলো: হজের কাজসমূহ পালনের জন্য বায়তুল্লাহর উদ্দেশ্যে গমন করে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদাত করা।
হজের অন্যতম উপকারিতা:
আল্লাহর আনুগত্যে নিজের শারিরীক ও অর্থনৈতিক সম্পদ ব্যয় করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির অনুশীলন করা। এই কারনে হজ পালন আল্লাহর পথে এক প্রকার জিহাদ হিসেবে পরিগণিত।
আমরা ইসলামের স্তম্ভসমূহ সম্পর্কে উপরে যে সব উপকারিতার কথা উল্লেখ করেছি এবং যা উল্লেখ করি নি, সবকিছুই জাতিকে এমন পবিত্র মুসলিম জাতিতে পরিণত করবে, যারা আল্লাহর জন্যই এ সত্য দীন পালন করবে, সৃষ্টিজগতের সাথে ন্যায়পরায়ণতা ও সততার আচরণ করবে। কেননা ইসলামী শরী‘আতের এ ভিত্তিসমূহ সংশোধন হলে শরী‘আতের অন্যান্য বিধানগুলোও সংশোধিত হয়ে যাবে আর মুসলিম উম্মতের সার্বিক অবস্থা সংশোধিত হয়ে যাবে তার দীনী উন্নতি যথাযথভাবে সম্পন্ন হলেই। পক্ষান্তরে তাদের দ্বীনী কর্মকাণ্ডে যতটুকু ভাটা পড়বে ততটুকুই তাদের অবস্থার অবনতি ঘটবে।
যে আমার উপরোক্ত বক্তব্যের যথার্থতা যাচাই করতে চায় সে যেন কুরআনে কারীমের নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করে:
﴿وَلَوۡ أَنَّ أَهۡلَ ٱلۡقُرَىٰٓ ءَامَنُواْ وَٱتَّقَوۡاْ لَفَتَحۡنَا عَلَيۡهِم بَرَكَٰتٖ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ وَلَٰكِن كَذَّبُواْ فَأَخَذۡنَٰهُم بِمَا كَانُواْ يَكۡسِبُونَ ٩٦ أَفَأَمِنَ أَهۡلُ ٱلۡقُرَىٰٓ أَن يَأۡتِيَهُم بَأۡسُنَا بَيَٰتٗا وَهُمۡ نَآئِمُونَ ٩٧ أَوَ أَمِنَ أَهۡلُ ٱلۡقُرَىٰٓ أَن يَأۡتِيَهُم بَأۡسُنَا ضُحٗى وَهُمۡ يَلۡعَبُونَ ٩٨ أَفَأَمِنُواْ مَكۡرَ ٱللَّهِۚ فَلَا يَأۡمَنُ مَكۡرَ ٱللَّهِ إِلَّا ٱلۡقَوۡمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ٩٩ ﴾ [الاعراف: ٩٦، ٩٩]
“জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনত এবং তাক্ওয়া অবলম্বন করত, তাহলে আমরা তাদের জন্য আসমান ও জমিনের সমস্ত বরকতের দ্বার উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা যখন মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেছে, তখন আমরা তাদেরকে তাদেরই কৃতকর্মের দরুন পাকড়াও করেছি। জনপদের অধিবাসীরা এব্যাপারে কি নিশ্চিন্ত যে, আমাদের আযাব তাদের ওপর রাতের বেলায় এসে পড়বে না ! যখন তারা থাকবে ঘুমে অচেতন? জনপদের অধিবাসীরা কি নিশ্চিন্ত হয়ে পড়েছে যে, তাদের ওপর আমাদের আযাব দিনের বেলায় এসে পড়বে না! যখন তারা থাকবে খেলা-ধুলায় মত্ত? তারা কি আল্লাহর পাকড়াও-এর ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে? বস্তুত আল্লাহর পাকড়াও থেকে তারাই নিশ্চিন্ত হতে পারে যাদের ধ্বংস ঘনিয়ে আসে’’। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৯৬-৯৯]
সাথে সাথে অতীত লোকদের ইতিহাসের প্রতিও প্রত্যেকের লক্ষ্য করা উচিত। কেননা, ইতিহাসে রয়েছে বুদ্ধিমান এবং যাদের অন্তরে আবরণ পড়ে নি এমন লোকদের জন্য প্রচুর জ্ঞান ও শিক্ষনীয় বিষয়বস্তু। আর আল্লাহই আমাদের সহায়।
ইসলামী আক্বীদার ভিত্তিসমূহ
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসলাম হচ্ছে আক্বীদা ও শরী‘আতের সামষ্টিক নাম। ইতোপূর্বে ইসলামী শরী‘আতের ভিত্তিসমূহের বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে।
ইসলামী আক্বীদার ভিত্তিসমূহ যা পবিত্র কুরআনে কারীম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, তা হলো:
আল্লাহর ওপর, তাঁর ফিরিশতাগণের ওপর, তাঁর কিতাবসমূহের ওপর, তাঁর রাসূলগণের ওপর, শেষ দিবসের ওপর ও ভাল মন্দসহ তক্বদীরের প্রতি ঈমান স্থাপন করা।
উক্ত ভিত্তিসমূহের প্রমাণ কুরআনে কারীম ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহীহ সুন্নাহতে এসেছে।
যেমন, আল্লাহ তা‘আলা কুরআন কারীমে বলেন,
﴿لَّيۡسَ ٱلۡبِرَّ أَن تُوَلُّواْ وُجُوهَكُمۡ قِبَلَ ٱلۡمَشۡرِقِ وَٱلۡمَغۡرِبِ وَلَٰكِنَّ ٱلۡبِرَّ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ وَٱلۡكِتَٰبِ وَٱلنَّبِيِّۧنَ﴾ [البقرة: ١٧٧]
“সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ ফিরাবে; বরং সৎকাজ হলো, ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর, কিয়ামতদিবসের ওপর, ফিরিশতাদের ওপর, আসমানী কিতাবসমূহের ওপর এবং সমস্ত নবী-রাসূলগণের ওপর।’’ [সূরা আল-বাক্বারা, আয়াত: ১৭৭]
আর তাক্বদীর সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّا كُلَّ شَيۡءٍ خَلَقۡنَٰهُ بِقَدَرٖ ٤٩ وَمَآ أَمۡرُنَآ إِلَّا وَٰحِدَةٞ كَلَمۡحِۢ بِٱلۡبَصَرِ ٥٠﴾ [القمر: ٤٩، ٥٠]
“নিশ্চয় আমরা প্রত্যেকটি বস্তু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাণে (তাকদীর অনুযায়ী)। আমার কাজ তো সম্পন্ন হয় এক মুহুর্তে, চোখের পলকের মতো।’’ [সূরা আল-ক্বামার, আয়াত: ৪৯-৫০]
অনুরূপভাবে প্রসিদ্ধ হাদীসে জিবরীলে বর্ণিত আছে যে, জিবরীল (আলাইহিস সালাম) উপস্থিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামকে ঈমান সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, ‘‘ঈমান হলো, তুমি আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফিরিশতাগণের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর রাসূলগণের প্রতি, শেষ দিবসের প্রতি ও ভালো-মন্দসহ তাঁর তাক্বদীরের প্রতি ঈমান স্থাপন করবে।” [সহীহ মুসলিম]
ঈমানের প্রথম ভিত্তি হলো আল্লাহ তা‘আলার ওপর ঈমান
আল্লাহর ওপর ঈমানের মধ্যে চারটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
এক: আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বের ওপর ঈমান: ফিত্বরাত, (স্বাভাবিক প্রকৃতি) যুক্তি ও শরী‘আত এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দলীল সবই আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বের প্রমাণ করে,
(১) ফিত্বরাতের আলোকে আল্লাহর অস্তিত্ব:
আল্লাহর অস্তিত্বের ওপর ফিত্বরাত তথা স্বাভাবিক প্রকৃতিগত প্রমাণ হলো, আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিগতভাবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে চিন্তা ও শিক্ষা ছাড়াই স্রষ্টার ওপর ঈমান গ্রহণের যোগ্যতা নিহিত রেখেছেন। ফিত্বরাতের এ দাবী থেকে কেউ বিমুখ হয় না, যদি না সেখানে তা থেকে নিরোধকারী কোনো বিষয়ের প্রতিক্রিয়া পড়ে। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا مِنْ مَوْلُودٍ إِلاَ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ»
“প্রতিটি শিশুই ইসলামী ফিত্বরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে; কিন্তু তার পিতা-মাতা তাকে ইয়াহূদী, খ্রিস্টান অথবা অগ্নিউপাসকে পরিণত করে।’’ [সহীহ বুখারী]
(২) বিবেক-বুদ্ধি ও যুক্তির আলোকে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ:
পূর্বাপর সৃষ্টি-জগতের সকল কিছু প্রমাণ করে যে, এসবকিছুর এমন একজন স্রষ্টা আছেন যিনি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন। কেননা জগতের কোনো বস্তু নিজেই নিজকে অস্তিত্ব দান করেনি অথবা এসব কিছু হঠাৎ করেই আপনা-আপনি অস্তিত্ব লাভ করে নি। আর কোনো কিছুর নিজেই নিজেকে অস্তিত্ব দান করা কখনো সম্ভব নয়। কারণ, বস্তু কখনো নিজেই নিজকে সৃষ্টি করতে পারে না। কেননা, তা অস্তিত্ব লাভের পূর্বে ছিল অস্তিত্বহীন এবং যা ছিল অস্তিত্বহীন তা কীভাবে নিজের স্রষ্টা হতে পারে? আবার হঠাৎ করেই আপনা-আপনি অস্তিত্ব লাভ করাও সম্ভব নয়; কেননা প্রতিটি ঘটনার কোনো না কোনো ঘটক থাকে। আর সমগ্র বিশ্ব-জগৎ এবং এর মধ্যকার সকল ঘটনা- প্রবাহ এমন এক অভূতপূর্ব নিয়মে এবং একে অপরের সাথে সুন্দর ও সুচারুরূপে পরিচালিত হচ্ছে যে, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ বিশ্বজগতের হঠাৎ করে আপনা-আপনি অভ্যুদয় ঘটে নি। হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনো কিছু নিয়ম বহির্ভূতভাবে হয়ে থাকে, এর মূল কোনো নিয়ম থাকে না, তা হলে এ সৃষ্টি এত সুশৃঙ্খলভাবে দীর্ঘ পরিক্রমায় কীভাবে টিকে আছে? তাহলে সৃষ্টিজগত যখন নিজকে নিজে অস্তিত্ব দান করতে পারে নি এবং হঠাৎ করেও তা সৃষ্টি হয় নি, তাই এ থেকে প্রমাণিত হলো যে এর একজন স্রষ্টা আছেন, যিনি হলেন সমস্ত জগতের রব আল্লাহ।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমের সূরা আত্ব-তুরে এই যুক্তিসঙ্গত দলীল উল্লেখ করে বলেন,
﴿أَمۡ خُلِقُواْ مِنۡ غَيۡرِ شَيۡءٍ أَمۡ هُمُ ٱلۡخَٰلِقُونَ ٣٥ أَمۡ خَلَقُواْ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَۚ بَل لَّا يُوقِنُونَ ٣٦ أَمۡ عِندَهُمۡ خَزَآئِنُ رَبِّكَ أَمۡ هُمُ ٱلۡمُصَۜيۡطِرُونَ ٣٧﴾ [الطور: ٣٥، ٣٧]
‘‘তারা কি নিজেরাই আপনা-আপনি সৃষ্ট হয়ে গেছে, না তারা নিজেরাই নিজেদের স্রষ্টা? না তারা নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছে? বরং তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে না। তাদের কাছে কি আপনার পালনকর্তার ভাণ্ডার রয়েছে, নাকি তারাই সবকিছুর তত্ত্বাবধায়ক? [সূরা আত্ব-তূর, আয়াত: ৩৫-৩৭]
তাই জুবাইর ইবনুল মুত‘য়িম রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘‘ইসলাম গ্রহণের পূর্বে আমি একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাগরিবের সালাতে সূরা আত্ব-তূর পড়তে শুনি। তিনি যখন উল্লিখিত আয়াতে পৌঁছলেন তখন জুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মনে হলো যেন আমার অন্তর উড়ে যাচ্ছে। তাঁর কুরআন শ্রবণের এটাই ছিল আমার প্রথম ঘটনা।” তিনি বলেন, “সে দিনই আমার অন্তরে ঈমান স্থান করে নিয়েছিল।’’ (বুখারী ভিন্ন ভিন্ন স্থানে তা বর্ণনা করেন)
আরেকটি উদাহরণ দিয়ে এ যুক্তিটাকে আরো স্পষ্ট ভাবে অনুধাবন করা যায়। যেমন, কোনো লোক যদি আপনাকে এমন একটি বিরাট প্রাসাদের কথা বলে যার চর্তুপাশ্বে বাগান, ফাঁকে-ফাঁকে রয়েছে প্রবাহমান নদ-নদী ও ঝর্ণাধারা, প্রাসাদে রয়েছে এর পূর্ণতা দানকারী সব সরঞ্জামাদি। অতঃপর যদি সে বলে যে, এ প্রাসাদ ও এর মধ্যে যে পরিপূর্ণতা রয়েছে সব কিছু নিজেই নিজকে সৃষ্টি করেছে বা আপনা-আপনি আকস্মিকভাবে অস্তিত্ব লাভ করেছে। তখন আপনি বিনা দ্বিধায় তা অস্বীকার করবেন, তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করবেন বরং তার কথাকে বড় ধরনের বোকামী বলে আখ্যায়িত করবেন। তাহলে এ বিশাল আসমান, জমিন ও এতদুভয়ের মাঝে লক্ষ-লক্ষ অনুপম সৃষ্টি কি নিজেই নিজের স্রষ্টা বা স্রষ্টা ছাড়াই কি তা আপনা-আপনিই অস্তিত্ব লাভ করেছে?
(৩) শরী‘আতের আলোকে আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বের প্রমাণ:
সকল আসমানীগ্রন্থে আল্লাহর অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং ঐ সব গ্রন্থে বিদ্যমান সৃষ্টিজগতের কল্যাণ সংবলিত হুকুম আহকাম প্রমাণ করে যে, এ সব কিছু এমন প্রজ্ঞাময় প্রতিপালকের পক্ষ হতে এসেছে যিনি অবহিত আছেন সৃষ্টি জগতের সার্বিক কল্যাণ সম্পর্কে। আর সেসব গ্রন্থে সৃষ্টিজগত সম্পর্কে যে সব সংবাদ এসেছে আর বাস্তব যা সত্য বলে সাক্ষ্য দিচ্ছে তা প্রমাণ করছে যে, এ সৃষ্টিজগত এমন মহান রবের পক্ষ থেকে এসেছে যিনি তাঁর দেওয়া সংবাদ অনুযায়ী অস্তিত্বদানে সক্ষম।
(৪) ইন্দ্রিয় অনুভুতির আলোকে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ:
এ ধরণের প্রমাণ আমরা দু’দিক থেকে পেশ করতে পারি:
প্রথমত: আমরা শুনি ও দেখি যে, প্রার্থনাকারীদের অনেক প্রার্থনা কবুল হচ্ছে, অসহায় ব্যক্তিগণ বিপদ থেকে উদ্ধার পাচ্ছেন। এর দ্বারা আল্লাহর অস্তিত্ব অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَنُوحًا إِذۡ نَادَىٰ مِن قَبۡلُ فَٱسۡتَجَبۡنَا لَهُۥ فَنَجَّيۡنَٰهُ وَأَهۡلَهُۥ مِنَ ٱلۡكَرۡبِ ٱلۡعَظِيمِ ٧٦﴾ [الانبياء: ٧٦]
“স্মরণ করো নূহকে, সে যখন আহ্বান করেছিল তখন আমরা তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম।’’[সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৭৬]
অপর একটি আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
{إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ }
“স্মরণ করো, তোমরা যখন তোমাদের রবের কাছে উদ্ধার প্রার্থনা করছিলে তখন তিনি তোমাদের প্রার্থনা কবুল করেছিলেন।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৯]
সহীহ বুখারীতে আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুৎবা প্রদানের সময় এক বেদুঈন মসজিদে প্রবেশ করে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! ধন-সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর পরিবার-পরিজন ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছে। আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য দো‘আ করুন। আল্লাহর নবী দু’হাত তুলে দো‘আ করলেন। ফলে আকাশে পর্বত সদৃশ মেঘ জমলো এবং আল্লাহর নবী মিম্বার হতে অবতরণ করার পূর্বেই বৃষ্টিপাত শুরু হলো। এমনকি বৃষ্টির কারণে রাসূলের দাড়ী হতে পানির ফোটা পড়তে লাগলো।
দ্বিতীয় জুমু‘আয় সে বেদুঈন বা অন্য কেউ এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে এবং ধন-সম্পদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের জন্য দো‘আ করুন।
অতঃপর তিনি দু’হাত তুলে বললেন, হে আল্লাহ! আমাদের চতুর্পার্শ্বে, (বৃষ্টি বর্ষণ করুন) আমাদের ওপর নয়। এমনকি তিনি যেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন সে দিক থেকেই মেঘ কেটে গিয়েছিল।’ [বুখারী ও মুসলিম]
দো‘আ কবুল হওয়ার শর্ত পূরণ করে সত্যিকারার্থে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে দো‘আ করলে এখনও যে দো‘আ কবুল হয় তা এখনো দৃশ্যমান প্রমাণিত বিষয়।
দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূলগণের হাতে তাঁদের রিসালাত ও নবুওয়াত প্রমাণ করার জন্য যেসব নিদর্শন, যাকে মু‘জিযা বলা হয়, (সাধারণের সাধ্যাতীত অলৌকিক ঘটনাসমূহ) যা মানুষ প্রত্যক্ষ করে থাকে অথবা শুনে থাকে, সেগুলো ঐ মু’জিযা প্রকাশক নবী-রাসূলদের প্রেরণকারী আল্লাহর অস্তিত্বের ওপর অকাট্য প্রমাণ। কারণ এগুলো মানুষের ক্ষমতার বাইরের বিষয়, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য সংঘটিত করেন। তার কয়েকটি উদাহরণ নিম্নরূপ:
প্রথম উদাহরণ: মুসা আলাইহিস সালামের নিদর্শন, যখন আল্লাহ তা‘আলা মুসা আলাইহিস সালামকে নির্দেশ দিলেন যে, স্বীয় লাঠি দ্বারা সমুদ্রের মধ্যে আঘাত কর। মুসা আলাইহিস সালাম আঘাত করলেন। ফলে, সমুদ্রের মধ্যে বারটি শুষ্ক রাস্তা হয়ে যায় এবং দু-পার্শ্বের পানি বিশাল পবর্তসদৃশ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَأَوۡحَيۡنَآ إِلَىٰ مُوسَىٰٓ أَنِ ٱضۡرِب بِّعَصَاكَ ٱلۡبَحۡرَۖ فَٱنفَلَقَ فَكَانَ كُلُّ فِرۡقٖ كَٱلطَّوۡدِ ٱلۡعَظِيمِ ٦٣﴾ [الشعراء: ٦٣]
“অতঃপর আমরা মুসাকে আদেশ করলাম, তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত কর, ফলে তা বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতসদৃশ হয়ে গেল।’’ [সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ৬৩]
দ্বিতীয় উদাহরণ: ঈসা আলাইহিস সালামের নিদর্শন: তিনি আল্লাহর ইচ্ছায় মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতেন এবং তাদেরকে কবর থেকে বের করে আনতেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
﴿وَأُحۡيِ ٱلۡمَوۡتَىٰ بِإِذۡنِ ٱللَّهِۖ﴾ [ال عمران: ٤٩]
‘‘আর আমি জীবিত করে দেই মৃতকে আল্লাহর হুকুমে।’’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৪৯]
﴿وَإِذۡ تُخۡرِجُ ٱلۡمَوۡتَىٰ بِإِذۡنِيۖ﴾ [المائدة: ١١٠]
“এবং যখন তুমি আমার আদেশে মৃতদেরকে বের করে দিতে।’’ [সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ১১০]
তৃতীয় উদাহরণ: নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিদর্শন: কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে তাঁর রিসালাতের স্বপক্ষে কোনো নিদর্শন চাইলে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাঁদের দিকে ইশারা করেন অতঃপর চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় এবং উপস্থিত সবাই এ ঘটনা অবলোকন করেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱقۡتَرَبَتِ ٱلسَّاعَةُ وَٱنشَقَّ ٱلۡقَمَرُ ١ وَإِن يَرَوۡاْ ءَايَةٗ يُعۡرِضُواْ وَيَقُولُواْ سِحۡرٞ مُّسۡتَمِرّٞ ٢﴾ [القمر: ١، ٢]
“কিয়ামত আসন্ন এবং চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। তারা যদি কোনো নিদর্শন দেখে তবে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, এটা তো চিরাচরিত এক প্রকার যাদু।’’ [সূরা আল-ক্বামার, আয়াত: ১-২]
ইন্দ্রিয় শক্তি দ্বারা অনুধাবন যোগ্য উক্ত নিদর্শন ও অলৌকিক ঘটনাসমূহ যেগুলো আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য ঘটিয়েছিলেন, সেসব আল্লাহর অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ।
দুই: আল্লাহ তা‘আলার রবুবিয়্যাতের ওপর ঈমান:
এর অর্থ হলো, তিনিই একমাত্র রব, তাঁর কোনো শরীক নেই, নেই কোনো সাহায্যকারী।
আর রব তো তিনিই যিনি সৃষ্টিকর্তা, মালিক এবং সার্বিক (শরী‘আতগত ও পরিচালনাগত) নির্দেশ প্রদানকারী। সুতরাং আল্লাহ ব্যতীত কোনো স্রষ্টা নেই, তিনি ব্যতীত কোনো মালিকও নেই আর তিনি ব্যতীত অন্য কারও নির্দেশও সর্বত্র চলে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَا لَهُ ٱلۡخَلۡقُ وَٱلۡأَمۡرُۗ﴾ [الاعراف: ٥٤]
“জেনে রেখো, সৃষ্টি আর হুকুম প্রদানের কাজ একমাত্র তাঁরই।” [সূরা আল আ‘রাফ, আয়াত: ৫৪]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمۡ لَهُ ٱلۡمُلۡكُۚ وَٱلَّذِينَ تَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ مَا يَمۡلِكُونَ مِن قِطۡمِيرٍ﴾ [فاطر: ١٣]
“তিনি আল্লাহ, তোমাদের রব, সাম্রাজ্য একমাত্র তাঁরই। তাঁর পরিবর্তে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা তুচ্ছ খর্জুর আঁটির আবরণেরও অধিকারী নয়। [সূরা ফাতির, আয়াত: ১৩]
কতিপয় অহংকারী, মিথ্যা বাগড়ম্বরকারী, অন্তরের বিশ্বাস থেকে নয় শুধু মুখে দাবীকারী ব্যক্তি ব্যতীত সৃষ্টি জগতের কেউই আল্লাহর রবুবিয়্যাতকে অস্বীকার করে নি। যেমন, ফির‘আউনের বেলায় তা ঘটেছিল। সে তার জাতিকে বললো,
﴿فَقَالَ أَنَا۠ رَبُّكُمُ ٱلۡأَعۡلَىٰ ٢٤﴾ [النازعات: ٢٤]
“সে (ফির‘আউন) বলল, আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ রব।” [সূরা আন-নাযি‘আত, আয়াত: ২৪-২৫]
ফির‘আউন আরো বলল,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلۡمَلَأُ مَا عَلِمۡتُ لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرِي﴾ [القصص: ٣٨]
“হে পরিষদবর্গ, আমি জানি না যে, আমি ব্যতীত তোমাদের আর কোনো উপাস্য আছে।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৩৮]
ফির‘আউন একথা অহংকার করে বলেছিল; কিন্তু তার অন্তরের বিশ্বাস এমনটি ছিল না। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَجَحَدُواْ بِهَا وَٱسۡتَيۡقَنَتۡهَآ أَنفُسُهُمۡ ظُلۡمٗا وَعُلُوّٗاۚ ﴾ [النمل: ١٤]
“তারা অন্যায় ও অহংকার করে নিদর্শনাবলীকে প্রত্যাখ্যান করল। অথচ তাদের অন্তর এগুলো সত্য বলে বিশ্বাস করেছিল।” [সূরা আন-নামল, আয়াত, ১৪]
অনুরূপভাবে মুসা আলাইহিস সালাম ফির‘আউনকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,
﴿لَقَدۡ عَلِمۡتَ مَآ أَنزَلَ هَٰٓؤُلَآءِ إِلَّا رَبُّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ بَصَآئِرَ وَإِنِّي لَأَظُنُّكَ يَٰفِرۡعَوۡنُ مَثۡبُورٗا ﴾ [الاسراء: ١٠٢]
“তুমি জান যে আসমান ও জমিনের পালনকর্তাই এসব নিদর্শনাবলী প্রত্যক্ষ প্রমাণস্বরূপ নাযিল করেছেন। হে ফির‘আউন, আমার ধারণায় তুমি ধ্বংস হতে চলেছ।” [সূরা বনী-ইসরাঈল, আয়াত: ১০২]
আর তাই দেখা যায় আরবের মুশরিকরা ও আল্লাহর উলূহিয়্যাত বা ইবাদাতে শির্ক করা সত্বেও তাঁর রবুবিয়্যাতকে স্বীকার করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُل لِّمَنِ ٱلۡأَرۡضُ وَمَن فِيهَآ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٨٤ سَيَقُولُونَ لِلَّهِۚ قُلۡ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ٨٥ قُلۡ مَن رَّبُّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ ٱلسَّبۡعِ وَرَبُّ ٱلۡعَرۡشِ ٱلۡعَظِيمِ ٨٦ سَيَقُولُونَ لِلَّهِۚ قُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ ٨٧ قُلۡ مَنۢ بِيَدِهِۦ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيۡءٖ وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيۡهِ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٨٨ سَيَقُولُونَ لِلَّهِۚ قُلۡ فَأَنَّىٰ تُسۡحَرُونَ ٨٩﴾ [المؤمنون: ٨٤، ٨٩]
“বল, পৃথিবী এবং পৃথিবীতে যারা আছে তারা কার? যদি তোমরা জান, তবে বল। তখন তারা বলবে, সবই আল্লাহর। বল, তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?। বল, সপ্তাকাশ ও মহা-‘আরশের মালিকানা কার? অচিরেই তারা বলবে, আল্লাহর। বল, তবুও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না? বলুন, তোমাদের জানা থাকলে বল, কার হাতে সব বস্তুর কর্তৃত্ব, যিনি রক্ষা করেন এবং যার কবল থেকে কেউ রক্ষা করতে পারে না? তখন তারা বলবে, আল্লাহর। বল, তাহলে কেমন করে তোমাদেরকে যাদু করা হচ্ছে? [সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত: ৮৪-৮৯]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَئِن سَأَلۡتَهُم مَّنۡ خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡعَلِيمُ ٩﴾ [الزخرف: ٩]
‘‘(হে রাসূল) আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, কে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তবে অবশ্যই তারা বলবে, সৃষ্টি করেছেন পরাক্রান্ত সর্বজ্ঞ আল্লাহ।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৯]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَئِن سَأَلۡتَهُم مَّنۡ خَلَقَهُمۡ لَيَقُولُنَّ ٱللَّهُۖ فَأَنَّىٰ يُؤۡفَكُونَ ٨٧﴾ [الزخرف: ٨٧]
“আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, কে তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তবে অবশ্যই তারা বলবে, আল্লাহ। সুতরাং তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে?” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৮৭]
আর ‘আল্লাহর আদেশ’ কথাটি তাঁর সৃষ্টিগত ও শরী‘আত সংশ্লিষ্ট উভয় প্রকার বিষয়াদি শামিল করে। তিনি যেমন তাঁর হিকমতানুসারে সৃষ্টিজগতে যা ইচ্ছা তার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও ব্যবস্থাপক, তেমনি তিনি তাঁর হিকমতানুযায়ী যাবতীয় আইন, বিধি-বিধান ও ইবাদাত ও পারষ্পারিক লেনদেনের হুকুম রচনার একচ্ছত্র অধিকারী। অতএব, যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ইবাদতের বিধান প্রদানকারী অথবা লেন-দেনের হুকুমদাতা হিসাবে গ্রহণ করে তা হলে সে আল্লাহর সাথে শরীক করলো এবং ঈমান বাস্তবায়ণ করলো না।
তিন: আল্লাহর উলূহিয়্যাতের ওপর ঈমান:
এর অর্থ হলো, এই কথা স্বীকার করা যে, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই সত্যিকার মা‘বুদ বা উপাস্য, এতে অন্য কেউ তাঁর শরীক নেই।
আর ‘‘ইলাহ’’ শব্দটি মালূহ শব্দের অর্থে। যার অর্থ মা‘বুদ। অর্থাৎ সে উপাস্য যাকে পূর্ণ ভালোবাসা ও পূর্ণ সম্মানের সাথে ইবাদাত বা দাসত্ব করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞۖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلرَّحۡمَٰنُ ٱلرَّحِيمُ ١٦٣﴾ [البقرة: ١٦٣]
“আর তোমাদের উপাস্য একমাত্র একই উপাস্য। তিনি ব্যতীত আর কোনো সত্য মা‘বুদ নেই, তিনি মহা করুণাময় দয়ালু।” [সূরা আল-বাক্বারা, আয়াত: ১৬৩] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿شَهِدَ ٱللَّهُ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَأُوْلُواْ ٱلۡعِلۡمِ قَآئِمَۢا بِٱلۡقِسۡطِۚ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٨﴾ [ال عمران: ١٨]
“আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন, তিনি ছাড়া সত্যিকার কোনো মা‘বুদ নেই এবং ফিরিশতাগণ, ন্যায়নিষ্ট জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য মা‘বুদ নেই। তিনি পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮]
তাই আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে তার ইবাদাত করা হলে তার সে উপাস্যরূপে গ্রহণ বাতিল বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেন,
﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ هُوَ ٱلۡبَٰطِلُ وَأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡكَبِيرُ ٦٢﴾ [الحج: ٦٢]
“তা এই জন্য যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তিনিই সত্য এবং তাঁর পরিবর্তে তারা যাদের ডাকে তারা অসত্য এবং আল্লাহ, তিনিই হলেন সুমহান সর্বশ্রেষ্ঠ।” [সূরা আল-হজ, আয়াত: ৬২]
(আল্লাহ ব্যতীত যাদের উপাসনা করা হয়) সেগুলোকে মা‘বুদ বলে নাম রাখলেই তা সত্যিকার উপাস্যের মর্যাদায় আসীন হয় না; বরং শুধু নাম সর্বস্বই থেকে যায়। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে লাত, মানাত, ওযযা ইত্যাদি সম্পর্কে বলেন,
﴿إِنۡ هِيَ إِلَّآ أَسۡمَآءٞ سَمَّيۡتُمُوهَآ أَنتُمۡ وَءَابَآؤُكُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلۡطَٰنٍۚ﴾ [النجم: ٢٣]
“এগুলো কতেক নাম বৈ কিছু নয়, যে সমস্ত নাম তোমরা এবং তোমাদের পূর্ব-পুরুষরা রেখেছ। এর সমর্থনে আল্লাহ কোনো দলীল নাযিল করেন নি।” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ২৩]
অনুরূপভাবে ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) তাঁর কারাগারের সঙ্গীদেরকে বলেন,
﴿يَٰصَٰحِبَيِ ٱلسِّجۡنِ ءَأَرۡبَابٞ مُّتَفَرِّقُونَ خَيۡرٌ أَمِ ٱللَّهُ ٱلۡوَٰحِدُ ٱلۡقَهَّارُ ٣٩ مَا تَعۡبُدُونَ مِن دُونِهِۦٓ إِلَّآ أَسۡمَآءٗ سَمَّيۡتُمُوهَآ أَنتُمۡ وَءَابَآؤُكُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلۡطَٰنٍۚ﴾ [يوسف: ٣٩، ٤٠]
“হে কারাগারের সাথীদ্বয়! পৃথক পৃথক অনেক উপাস্য ভালো, নাকি পরাক্রমশালী এক আল্লাহ ভালো? তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের ইবাদাত কর, সেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারাই সাব্যস্ত করে নিয়েছ। আল্লাহ এদের পক্ষে কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেন নি।” [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৩৯-৪০]
তাই সকল নবী রাসূলগণ তাঁদের স্ব স্ব জাতিকে বলতেন,
﴿ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُ﴾ [الاعراف: ٥٩]
“তোমরা আল্লাহরই ইবাদাত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য সত্যিকার কোনো মা‘বুদ বা উপাস্য নেই। [সূরা আল-আ‘রাফ: ৫৯]
কিন্তু যুগে যুগে মুশরিকগণ এই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বিভিন্ন ধরণের বাতিল উপাস্যকে আল্লাহর সাথে শরীক করে ওদের উপাসনা করেছে। তাদের নিকট সাহায্য কামনা করেছে এবং তাদের কাছে ফরিয়াদ করেছে।
আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের এ প্রকার উপাস্য গ্রহণের বিষয়কে দু’টি যুক্তি দ্বারা খণ্ডন করেছেন:
প্রথম: যাদেরকে তারা মা‘বুদ সাব্যস্ত করে নিয়েছে ওদের মধ্যে উপাস্যগত কোনো গুণ নেই। তারা সামান্যতম শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী নয়। যেমন, তারা কোনো একটি বস্তুও সৃষ্টি করে নি; বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট। আর ঐ সব মা‘বুদ তাদের পুজারীদের না কোনো উপকার সাধন করতে পারে, না তাদের কোনো মুসিবত দূর করতে পারে এবং তাদের জীবন, মরণ ও পুনরুজ্জীবনেরও তারা মালিক নয়। আসমান, জমিনেরও কোনো কিছুর মালিক নয় এবং এতে তাদের অংশও নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ ءَالِهَةٗ لَّا يَخۡلُقُونَ شَيۡٔٗا وَهُمۡ يُخۡلَقُونَ وَلَا يَمۡلِكُونَ لِأَنفُسِهِمۡ ضَرّٗا وَلَا نَفۡعٗا وَلَا يَمۡلِكُونَ مَوۡتٗا وَلَا حَيَوٰةٗ وَلَا نُشُورٗا ٣﴾ [الفرقان: ٣]
‘‘তারা আল্লাহর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে যারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট এবং তারা নিজেদের ভালোও করতে পারে না, মন্দও করতে পারে না এবং জীবন, মরণ ও পুনরুজ্জীবনেরও তারা মালিক নয়।’’ [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৩]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ لَا يَمۡلِكُونَ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَلَا فِي ٱلۡأَرۡضِ وَمَا لَهُمۡ فِيهِمَا مِن شِرۡكٖ وَمَا لَهُۥ مِنۡهُم مِّن ظَهِيرٖ ٢٢ وَلَا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ عِندَهُۥٓ إِلَّا لِمَنۡ أَذِنَ لَهُ﴾ [سبا: ٢٢، ٢٣]
“বল, তোমরা আহ্বান কর, যাদেরকে তোমরা উপাস্য মনে করতে আল্লাহ ব্যতীত। তারা তো নভোমণ্ডল ও ভু-মণ্ডলের অণু পরিমাণ কোনো কিছুর মালিক নয়। এতে তাদের কোনো অংশও নেই এবং তাদের কেউ আল্লাহর সহায়কও নয়। আল্লাহর নিকট কারো জন্য সুপরিশ ফলপ্রসু হবে না; কিন্তু যার জন্য অনুমতি দেওয়া হয় সে ব্যতীত।’’ [সূরা সাবা, আয়াত: ২২-২৩]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَيُشۡرِكُونَ مَا لَا يَخۡلُقُ شَيۡٔٗا وَهُمۡ يُخۡلَقُونَ ١٩١ وَلَا يَسۡتَطِيعُونَ لَهُمۡ نَصۡرٗا وَلَآ أَنفُسَهُمۡ يَنصُرُونَ ١٩٢﴾ [الاعراف: ١٩١، ١٩٢]
“তারা কি এমন কাউকে শরীক সাব্যস্ত করে, যে একটি বস্তুও সৃষ্টি করতে পারে না? বরং তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর তারা না তাদের সাহায্য করতে পারে, না নিজেদের সাহায্য করতে পারে।’’ [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৯১-১৯২]
আর যখন এই বাতেল উপাস্যদের এরূপ অসহায় অবস্থা, তখন তাদেরকে উপাস্য নির্ধারণ করা চরম বোকামী ও বাতিল কর্ম বৈ কিছু নয়।
দ্বিতীয়: যখন মুশরিকরা স্বীকার করে যে এ নিখিল বিশ্বের রব ও স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, যাঁর হাতে সবকিছুর ক্ষমতা, যিনি আশ্রয় দান করেন, তাঁর ওপর কোনো আশ্রয়দানকারী নেই; তখন তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে উঠে এ বিষয় স্বীকার করা যে, একমাত্র মহান আল্লাহ তা‘আলাই সর্বপ্রকার ইবাদাত বা উপাসনা পাওয়ার অধিকারী, যেমনিভাবে তারা স্বীকার করে যে, আল্লাহ তা‘আলা রবুবিয়্যাতে একক ও অদ্বিতীয়, এতে তাঁর কোনো শরীক নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٢١ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ فِرَٰشٗا وَٱلسَّمَآءَ بِنَآءٗ وَأَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ فَأَخۡرَجَ بِهِۦ مِنَ ٱلثَّمَرَٰتِ رِزۡقٗا لَّكُمۡۖ فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٢﴾ [البقرة: ٢١، ٢٢]
“হে লোকসকল! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদাত কর, যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হতে পার। যে মহান আল্লাহ তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদস্বরূপ স্থাপন করেছেন। আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসেবে। অতএব, আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে সমকক্ষ করো না। বস্তুত তোমরা এসব অবগত আছ।” [সূরা আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ২১-২২]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿وَلَئِن سَأَلۡتَهُم مَّنۡ خَلَقَهُمۡ لَيَقُولُنَّ ٱللَّهُۖ فَأَنَّىٰ يُؤۡفَكُونَ ٨٧﴾ [الزخرف: ٨٧]
“যদি আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, কে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তবে অবশ্যই তারা বলবে, আল্লাহ। অতঃপর তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে?” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৮৭]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿قُلۡ مَن يَرۡزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ أَمَّن يَمۡلِكُ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡأَبۡصَٰرَ وَمَن يُخۡرِجُ ٱلۡحَيَّ مِنَ ٱلۡمَيِّتِ وَيُخۡرِجُ ٱلۡمَيِّتَ مِنَ ٱلۡحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَۚ فَسَيَقُولُونَ ٱللَّهُۚ فَقُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ ٣١ فَذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمُ ٱلۡحَقُّۖ فَمَاذَا بَعۡدَ ٱلۡحَقِّ إِلَّا ٱلضَّلَٰلُۖ فَأَنَّىٰ تُصۡرَفُونَ ٣٢ ﴾ [يونس: ٣١، ٣٢]
“বলুন, কে রুযী দান করেন তোমাদেরকে আসমান ও জমিন থেকে? কিংবা কে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কে-ই-বা মৃত্যুকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন এই বিশ্বের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ। তখন আপনি বলুন, তারপরেও কেন তোমরা তাঁকে ভয় করো না? অতএব, এ আল্লাহই তোমাদের সত্যিকার রব। আর সত্য ত্যাগ করার পর বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কী থাকে? সুতরাং তোমরা কোথায় পরিচালিত হচ্ছ?” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩১-৩২]
চার: আল্লাহর নাম ও তাঁর গুণাবলীর ওপর ঈমান:
আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমানের চতুর্থ দিক হলো, তিনি তাঁর জন্য তাঁর কিতাবে যে সব নাম উল্লেখ করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত সহীহ হাদীস দ্বারা তাঁর সর্ব সুন্দর নামসমূহ ও তাঁর মহৎ গুণরাজি যে ভাবে সাব্যস্ত করা হয়েছে ঠিক সে ভাবে কোনো প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন অস্বীকৃতি ও উপমা-সাদৃশ্য আরোপ ব্যতীত এবং কোনো ধরণ-গঠন নির্ণয় না করে যে ভাবে আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য সে ভাবে তা সাব্যস্ত করা। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ وَذَرُواْ ٱلَّذِينَ يُلۡحِدُونَ فِيٓ أَسۡمَٰٓئِهِۦۚ سَيُجۡزَوۡنَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٨٠﴾ [الاعراف: ١٨٠]
“আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সর্বোত্তম নামসমূহ। কাজেই তোমরা সে নাম ধরেই তাঁকে ডাক। আর ওদেরকে বর্জন কর, যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বিকৃতি সাধন করে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই পাবে।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৮০]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَهُ ٱلۡمَثَلُ ٱلۡأَعۡلَىٰ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۚ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ﴾ [الروم: ٢٧]
“আকাশ ও পৃথিবীতে সবের্বাচ্চ মর্যাদা তাঁরই এবং তিনিই পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’’ [সূরা আর-রূম: ২৭]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ﴾ [الشورا: ١١]
“তাঁর অনুরূপ কোনো কিছুই নেই, তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’’ [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ১১]
আল্লাহ তা‘আলা নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে দু’টি দল পথভ্রষ্ট হয়েছে:
প্রথম দল: আল-মু‘আত্তিলাহ: যারা আল্লাহ তা‘আলার সমস্ত নাম বা কোনো কোনো নাম ও গুণাবলীকে অস্বীকার করে, তাদের ধারণা যে আল্লাহর জন্য গুণাবলী প্রতিষ্ঠা করলে আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য বা সমতুল্য করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। বস্তুত তাদের এ ধারণা কয়েক কারণে বাতিল:
১। যদি আল্লাহর নাম ও গুণাবলী নেই বলা হয় তাহলে একারণে কয়েকটি বাতিল কথা মানা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যেমন মহান আল্লাহর কথার মধ্যে স্ববিরোধিতা এসে যাওয়া। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তাঁর নাম ও গুণাবলী আছে বলে আমাদের জানিয়েছেন এবং তাতে তাঁর কোনো সদৃশ বা সমতুল্য নেই বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। এখন যদি আল্লাহর জন্য গুণাবলী প্রতিষ্ঠা করলে আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য বা সমতুল্য করা হয়ে যাবে মনে করা হয় তবে তো আল্লাহর কথাকেই সাংঘর্ষিক বলতে হয়; আর তাঁর বাণীর একাংশ অপর অংশে মিথ্যারোপ করে বলতে হবে।
২। দুটি বস্তু নাম বা গুণে অভিন্ন হলেও উভয় বস্তু সার্বিক দিক দিয়ে সদৃশ হওয়া আবশ্যক নয়। আপনি দেখতে পান, দু’ব্যক্তি মানুষ হওয়া, শ্রবণ, দৃষ্টি ও বাকশক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মানবিক গুণ, শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও বাকশক্তির দিক থেকে তারা সমান নয়।
অনুরূপভাবে আপনি দেখবেন, সব জন্তুদের হাত, পা ও চক্ষু রয়েছে, কিন্তু নাম এক হওয়ার কারণে তাদের হাত, পা ও চক্ষু এক রকম নয়।
সুতরাং যদি সৃষ্টির মধ্যে নাম ও গুণাবলীর অভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও এভাবে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, তাহলে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে অধিকতর স্পষ্ট ও বড় পার্থক্য ও ভিন্নতা থাকাই অধিকতর স্বাভাবিক।
দ্বিতীয় দল: আল মুশাব্বিহা: এ দলটি আল্লাহর নাম ও তাঁর গুণাবলী আছে বলে বিশ্বাস করে, তবে সাথে সাথে তারা আল্লাহর গুণাবলীকে সৃষ্টির গুণাবলীর অনুরূপ মনে করে। তাদের যুক্তি হলো যে, কুরআন ও সুন্নাহর উদ্ধৃতি থেকে এটাই বুঝা যায়। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর গুণাবলীর বিষয়ে তাদের বোধগম্য ভাষাতেই সম্বোধন করেছেন। বস্তুত তাদের এ ধরনের বিশ্বাস ভিত্তিহীন এবং কয়েক কারণে বাতিল:
১। যুক্তি ও শরী‘আতের আলোকে যাচাই করলে উপলব্দি করা যায় যে, মহান রাব্বুল আলামীন কখনও সৃষ্টির সদৃশ হতে পারেন না। আর কুরআন ও সুন্নাহর দাবী কোনো বাতিল বিষয় হওয়াও সম্ভব নয়।
২। আল্লাহ তা‘আলা যদিও এমন ভাষা ও শব্দ দিয়ে তাঁর বান্দাদেরকে সম্বোধন করেছেন, যেগুলো মৌলিক অর্থগত দিক দিয়ে তাদের বোধগম্য’ কিন্তু তাঁর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে সেগুলোর প্রকৃত অবস্থা ও আসল তত্ত্বের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কাউকে অবহিত করেন নি; বরং আল্লাহ তা‘আলা নিজ সত্ত্বা ও গুণাবলী সম্পর্কিত বিষয়ের প্রকৃত জ্ঞানকে নিজের জন্যে নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজেকে ‘‘আস-সামী‘’’ বা ‘সর্বশ্রোতা’ নামে বিশেষিত করেছেন। শ্রবণের অর্থটা আমাদের বোধগম্য (শব্দ পাওয়া) কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার শ্রবণ গুণের মূল তত্ত্ব আমাদের জানা নেই। কেননা, শ্রবণশক্তির দিক থেকে সৃষ্টিকুলও সমান নয়, তাই স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে এই ক্ষেত্রে অধিকতর তফাৎ থাকাই স্বাভাবিক।
অনুরূপভাবে যখন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, তিনি ‘আরশের উপর উঠেছেন, তখন ‘উপরে উঠা’র বিষয়টি অর্থের দিক থেকে আমাদের বোধগম্য; কিন্তু মহান রাব্বুল ‘আলামীনের ‘উপরে উঠা’র প্রকৃত রূপ, ধরণ আমাদের জানা নেই। কারণ, সৃষ্টির মধ্যেও ‘উপরে উঠা’র ক্ষেত্রে ভিন্নতা আমাদের চোখে ধরা পড়ে। কেননা একটি স্থিতিশীল চেয়ারের উপরে উঠা আর একটি চঞ্চল পলায়নপর উটের পিঠের উপর উঠা সমান নয়। আর যখন সৃষ্টিকুলের ‘উপরে উঠা’র মধ্যে এতটুকু ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়, তখন ‘উপরে উঠা’র ক্ষেত্রে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে ঢের ব্যবধান থাকা অধিকতর স্পষ্ট ও নিশ্চিত।
উপরোক্ত বর্ণনানুযায়ী আল্লাহ তা‘আলার ওপর ঈমান আনলে মু’মিনদের জন্য যেসব ফলাফল সাধিত হয় তন্মধ্যে অন্যতম হলো:
প্রথমত: আল্লাহর তাওহীদ বা একত্ববাদ যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়; ফলে বান্দার মধ্যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো প্রতি কোনো প্রকার ভয়-ভীতি বা আশা-ভরসার লেশমাত্র থাকে না এবং তিনি ছাড়া আর কারো ইবাদাত সে করে না।
দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ ভালোবাসা ও সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন সম্ভব হয়; আর তা হবে আল্লাহর সর্বসুন্দর নামসমূহ ও তার সুউচ্চ গুণাবলীর দাবী অনুযায়ী।
তৃতীয়ত: আল্লাহর ইবাদাত যথাযথরূপে বাস্তবায়ণ; আর তা সম্ভব আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী ইবাদাত পালন এবং তাঁর নিষেধাবলী বর্জন করার মাধ্যমে।
ঈমানের দ্বিতীয় ভিত্তি: ফিরিশতাগণের ওপর ঈমান
ফিরিশতাগণ আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্ট এক অদৃশ্য জগত। তাঁরা সর্বদা আল্লাহর ইবাদাতে মাশগুল থাকেন; তাঁদের মধ্যে উলুহিয়্যাত বা রুবুবিয়্যাতের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।
আল্লাহ তাঁদেরকে নূরের দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তাঁদেরকে তাঁর পূর্ণ আনুগত্যের গুণ প্রদান করেছেন এবং তাঁর আদেশ বাস্তবায়ন করার তাঁদেরকে ক্ষমতা দান করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা তাদের বর্ণনা দিয়ে বলেন,
﴿وَمَنۡ عِندَهُۥ لَا يَسۡتَكۡبِرُونَ عَنۡ عِبَادَتِهِۦ وَلَا يَسۡتَحۡسِرُونَ ١٩ يُسَبِّحُونَ ٱلَّيۡلَ وَٱلنَّهَارَ لَا يَفۡتُرُونَ ٢٠ ﴾ [الانبياء: ١٩، ٢٠]
“আর যারা তাঁর সান্নিধ্যে আছে, তাঁরা অহংকারবশে তাঁর ইবাদাত করা হতে বিমুখ হয় না এবং ক্লান্তিও বোধ করে না। তাঁরা দিবা-রাত্রি তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করে এবং কোনো সময় শৈথিল্য করে না।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১৯-২০]
তাঁদের সংখ্যা এতবেশী যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ তা গণনা করে শেষ করতে পারবে না। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে মি‘রাজের ঘটনায় বর্ণিত আছে যে, ‘নবী সাল্লাল্লাহ্ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসমানে অবস্থিত ‘বায়তুল মা‘মুর’ দেখেন। এই বায়তুল মা‘মুরে দৈনিক সত্তর হাজার ফিরিশতা প্রবেশ করে। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের পুনরায় প্রবেশ করার পালা আর আসবে না।’
ফিরিশতাদের প্রতি ঈমানের মধ্যে চারটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
১। ফিরিশতাদের অস্তিত্বের ওপর ঈমান আনা।
২। কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা যাদের নাম আমাদের জেনেছি যেমন, জিবরীল আলাইহিস সালাম, তাঁদের ওপর নির্দিষ্ট করে ঈমান আনা। আর যাদের নাম আমাদের জানা নেই তাঁদের প্রতি সার্বিকভাবে ঈমান আনা।
৩। কুরআনুল করীম ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত তাঁদের গুণাবলীর প্রতি ঈমান আনা। যেমন, জিবরীলের ব্যাপারে রাসূলূল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়েছেন যে, তিনি তাঁকে তাঁর আসল আকৃতিতে দেখেছেন। তাঁর ছয়শত ডানা আছে যা গোটা দিগন্তকে ঘিরে রেখেছে।
আর ফিরিশতারা আল্লাহর আদেশে মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা যখন জিবরীল আলাইহিস সালামকে ঈসা আলাইহিস সালাম-এর জননী মারইয়ামের নিকট প্রেরণ করেন। তখন তিনি তাঁর নিকট পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করলেন।
অনুরূপভাবে জিবরীল আলাইহিস সালাম একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এক অজ্ঞাত ব্যক্তির আকৃতিতে উপস্থিত হন তখন তিনি সাহাবায়ে কেরামের মাঝে বসা ছিলেন, তাঁর (জিবরীলের) পরিহিত পোষাক ছিল সাদা ধবধবে, মাথার চুল ছিল ঘনকালো। ভ্রমণের কোনো লক্ষণ তাঁর ওপর দেখা যাচ্ছিল না। সাহাবীগণের কেউ তাঁকে চিনতেও পারে নি। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মুখে তাঁর হাটুর সাথে আপন হাঁটু মিলিয়ে বসলেন এবং আপন হস্তদ্বয় তাঁর উরুর উপর রাখলেন এবং তাঁকে ইসলাম, ঈমান, ইহসান এবং কিয়ামত ও তার লক্ষণাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগুলোর জবাব দেন। এরপর তিনি চলে যান। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের বললেন,
«فَإِنَّهُ جِبْرِيلُ أَتَاكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِينَكُم»
“ইনি জিবরীল, তোমাদেরকে তোমাদের দীন শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন।” (সহীহ মুসলিম)
এভাবে আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম ও লুত আলাইহিমাস সালাম-এর নিকট যে সব ফিরিশতাকে প্রেরণ করেছিলেন তারাও পুরুষলোকের অকৃতিতে উপস্থিত হয়েছিলেন।
৪। ফিরিশতাগণের ‘আমল বা কর্মসমূহের ওপর ঈমান আনা, যা তাঁরা আল্লাহর নির্দেশে পালন করে থাকে। যেমন, ফিরিশতাদের দিন-রাত তাসবীহ পাঠ ও আল্লাহর ইবাদাত করা বিনা ক্লান্তি ও বিনা অলসতায়।
তাদের মধ্যে কোনো কোনো ফিরিশতা বিশেষ বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। যেমন, জিবরীল আলাইহিস সালাম, তিনি নবী রাসূলগণের প্রতি আল্লাহর কালাম ও ওহী বহন করেন।
আরও যেমন, মিকায়ীল আলাইহিস সালাম, তিনি আল্লাহর অদেশক্রমে বৃষ্টি বর্ষণ করেন।
আরও যেমন, ইসরাফীল আলাইহিস সালাম, তিনি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময়ে এবং সৃষ্টিকুলের পুনরুত্থানের সময়ে শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেওয়ার দায়িত্বে রয়েছেন।
আরও যেমন, মালাকুল মউত আলাইহিস সালাম, সমস্ত প্রাণী জগতের মৃত্যুর সময় তার রূহ অধিগ্রহণের দায়িত্বে ন্যস্ত।
আরও যেমন, মালিক (আলাইহিস্ সালাম) তিনি দায়িত্বে নিয়োজিত। তিনি জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক।
আরও যেমন, একদল ফিরিশতা, যারা মায়ের গর্ভে সন্তানদের ভ্রূণের দায়িত্বে নিয়োজিত। মাতৃগর্ভে যখন সন্তানের চার মাস পূর্ণ হয়, তখন সেই সন্তানের কাছে আল্লাহ তা‘আলা একজন ফিরিশতা প্রেরণ করেন এবং তাকে সেই মানবসন্তানের রিজিক্ব, মৃত্যুক্ষণ, ‘আমল এবং সে সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যবান তা লিখার নির্দেশ প্রদান করেন।
আরও অনুরূপ আরেক দল ফিরিশতা, যারা প্রত্যেক মানুষের আমলনামা সংরক্ষণ ও লেখার দায়িত্বে নিয়োজিত। বস্তুত তারা দু’জন। একজন ডানদিকে অপরজন বামদিকে।
আরও যেমন, একদল ফিরিশতা মৃত ব্যক্তিকে দাফনের পর কবরে তাকে প্রশ্ন করার দায়িত্বে নিয়োজিত। মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখার পর দু’জন ফিরিশতা এসে তাকে তিনটি বিষয়ে প্রশ্ন করেন,
এক: তার রব বা প্রভু সম্পর্কে।
দুই: তার দীন সম্পর্কে।
তিন: তার নবী সম্পর্কে।
ফিরিশতাদের প্রতি ঈমানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপকার রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো:
প্রথমত: মহান আল্লাহর মাহত্ম্য, অসীম শক্তি ও তাঁর কর্তৃত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ। কেননা, সৃষ্টির মাহত্ম্য স্রষ্টার মাহত্ম্য থেকেই প্রাপ্ত।
দ্বিতীয়ত: আদমসন্তানের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহের জন্য তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন; যেহেতু তিনি ফিরিশতাদেরকে মানুষের হিফাযত, তাদের ‘আমলনামা সংরক্ষণসহ তাদের বহুবিধ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিত রেখেছেন।
তৃতীয়ত: ফিরিশতাদের প্রতি মহব্বত সৃষ্টি; যেহেতু তাঁরা যথাযথভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদাত সম্পাদন করে চলছেন।
একদল বিভ্রান্ত লোক ফিরিশতাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। তারা বলে, ফিরিশতারা হলো সৃষ্টিকুলের মধ্যে নিহিত কল্যাণশক্তি বিশেষ। তাদের এই বক্তব্য আল্লাহর কিতাব, তাঁর রাসূলের হাদীস ও মুসলিম ঐক্যমতে মিথ্যারোপ করার নামান্তর।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ فَاطِرِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ جَاعِلِ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ رُسُلًا أُوْلِيٓ أَجۡنِحَةٖ مَّثۡنَىٰ وَثُلَٰثَ وَرُبَٰعَۚ يَزِيدُ فِي ٱلۡخَلۡقِ مَا يَشَآءُۚ﴾ [فاطر: ١]
“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। যিনি আকাশমণ্ডল ও জমিনের স্রষ্টা এবং ফিরিশতাগণকে করেছেন বার্তাবাহক। তারা দুই-দুই, তিন-তিন, চার-চার ডানা বিশিষ্ট। তিনি সৃষ্টির মধ্যে যা ইচ্ছা বৃদ্ধি করে দেন।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ১]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَوۡ تَرَىٰٓ إِذۡ يَتَوَفَّى ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ يَضۡرِبُونَ وُجُوهَهُمۡ وَأَدۡبَٰرَهُمۡ وَذُوقُواْ عَذَابَ ٱلۡحَرِيقِ ٥٠﴾ [الانفال: ٥٠]
“আর যদি তুমি দেখ! যখন ফিরিশতারা কাফেরদের প্রাণ হরণ করে এবং প্রহার করে তাদের মুখে ও তাদের পশ্চাদদেশে; আর বলে, তোমরা দহনযন্ত্রনা ভোগ কর।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৫০]
মহান আল্লাহ আরো বলেন,
﴿وَلَوۡ تَرَىٰٓ إِذِ ٱلظَّٰلِمُونَ فِي غَمَرَٰتِ ٱلۡمَوۡتِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ بَاسِطُوٓاْ أَيۡدِيهِمۡ أَخۡرِجُوٓاْ أَنفُسَكُمُۖ﴾ [الانعام: ٩٣]
“আর যদি তুমি দেখ, যখন যালিমরা মৃত্যু-যন্ত্রণায় থাকে এবং ফিরিশতারা স্বীয় হস্ত প্রসারিত করে বলে, বের কর স্বীয় আত্মা!” [সূরা আল আন‘আম, আয়াত: ৯৩]
আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে আরো বলেন,
﴿حَتَّىٰٓ إِذَا فُزِّعَ عَن قُلُوبِهِمۡ قَالُواْ مَاذَا قَالَ رَبُّكُمۡۖ قَالُواْ ٱلۡحَقَّۖ وَهُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡكَبِيرُ ﴾ [سبا: ٢٣]
“অবশেষে যখন তাদের মন থেকে ভয়-ভীতি দূর হয়ে যায়। তখন তারা পরস্পর বলে, তোমাদের পালনকর্তা কি বললেন? তারা বলে, তিনি সত্যই বলেছেন এবং তিনিই সবার ওপরে মহান।’’ [সূরা সাবা, আয়াত: ২৩]
জান্নাতবাসীদের সম্পর্কে অল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿جَنَّٰتُ عَدۡنٖ يَدۡخُلُونَهَا وَمَن صَلَحَ مِنۡ ءَابَآئِهِمۡ وَأَزۡوَٰجِهِمۡ وَذُرِّيَّٰتِهِمۡۖ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ يَدۡخُلُونَ عَلَيۡهِم مِّن كُلِّ بَابٖ ٢٣ سَلَٰمٌ عَلَيۡكُم بِمَا صَبَرۡتُمۡۚ فَنِعۡمَ عُقۡبَى ٱلدَّارِ ٢٤﴾ [الرعد: ٢٣، ٢٤]
“তা হচ্ছে বসবাসের বাগান। তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের সৎকর্মশীল বাপ-দাদা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানেরাও। ফিরিশতা তাদের কাছে আসবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে। বলবে, তোমাদের ধৈর্যের কারণে, তোমাদের ওপর শাস্তি বর্ষিত হোক। আর তোমাদের এই শেষ গন্তব্যস্থল কতই না চমৎকার।’’ [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ২৩-২৪]
সহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন তখন তিনি জিবরীলকে ডেকে বলেন, আল্লাহ তা‘আলা অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন, তুমিও তাকে ভালোবাস। তখন জিবরীল তাকে ভালোবাসেন। অতঃপর জিবরীল আকাশবাসীদের মধ্যে ঘোষণা করে দেন, আল্লাহ তা‘আলা অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন সুতরাং তোমরাও তাকে ভালোবাস। তখন আকাশবাসীগণ সেই বান্দাকে ভালোবাসেন। এর ফলশ্রুতিতে পৃথিবীতেও সেই বান্দার গ্রহণযোগ্যতা অর্জিত হয়ে যায়।”
সহীহ বুখারীতে আরেকটি হাদীস প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহ আনহু) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
‘‘যখন জুমু‘আর দিন হয় তখন মসজিদের প্রত্যেক দরজায় ফিরিশতাগণ অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁরা সালাতে আগমনকারীদের নাম যথাক্রমে লিখতে থাকে। তারপর ইমাম যখন খুৎবার জন্য মিম্বরে বসে পড়েন তখন তারা তাদের ফাইল গুটিয়ে নেয় এবং খুৎবা শুনার জন্য তারা হাজির হয়ে যায়।’’
এসব আয়াত ও হাদীস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, ফিরিশতাদের অস্তিত্ব রয়েছে, তাঁরা অশরীরী কোনো অর্থে নন; যেমনটি বিভ্রান্ত লোকেরা বলে থাকে। উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলোর মর্মার্থ অনুযায়ী এই ব্যাপারে সমগ্র মুসলিমের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ঈমানের তৃতীয় ভিত্তি: আসমানী কিতাবসমূহের ওপর ঈমান
কিতাব শব্দটি একবচন, অর্থ লেখা। শব্দটির বহুবচন ‘কুতুবুন’; যা দ্বারা ‘মাকতূব’ বা লিখিত গ্রন্থ বুঝায়।
আর এখানে ‘কিতাব’ দ্বারা উদ্দেশ্য হবে সেসব কিতাবসমূহ যা আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি জগতের জন্য হেদায়াত ও রহমতস্বরূপ স্বীয় নবী রাসূলগণের ওপর অবতীর্ণ করেছেন। যাতে তারা তাদের দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর প্রদর্শিত সৌভাগ্যের পথে চলা দ্বারা যাবতীয় কল্যাণ ও সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে।
কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনার মধ্যে চারটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
১। সর্বপ্রথম এ ঈমান আনয়ন করতে হবে যে, এসব গ্রন্থাবলী মহান আল্লাহর নিকট থেকেই যথাযথভাবে অবতীর্ণ হয়েছে। (তা মানব রচিত গ্রন্থ নয় অনুরূপভাবে তা কোনো শব্দ বা অর্থের অনুবাদ নয়।)
২। নির্দিষ্ট নামে ঐ সব কিতাবের প্রতি ঈমান স্থাপন করা, যেগুলোর নাম আল্লাহ তা‘আলা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন, আল-ক্বুরআন-মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে, তওরাত অবতীর্ণ হয়েছে মূসা আলাইহিস সালামের ওপর, যাবুর অবতীর্ণ হয়েছে দাউদ আলাইহিস সালামের ওপর এবং ইঞ্জীল ঈসা আলাইহিস সালামের ওপর।
আর যে সব আসমানী কিতাবের নাম আমাদের জানা নেই, তার প্রতি সার্বিক ভাবে ঈমান রাখা।
৩। আসমানী গ্রন্থসমূহে পূর্ববর্তী নবী রাসূলগণ ও তাঁদের উম্মত, শরী‘আত এবং তাঁদের ইতিহাস সম্পর্কে যে সব বিশুদ্ধ বর্ণনা রয়েছে, সেগুলোর প্রতি ঈমান স্থাপন করা। যেমন, কুরআনে বর্ণিত সংবাদসমূহ এবং পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের অপরিবর্তিত অথবা অবিকৃত সংবাদসমূহের ওপর ঈমান রাখা।
৪। আসমানী গ্রন্থসমূহে বর্ণিত এমন আদেশসমূহের ওপর আমল করা যা রহিত হয় নি এবং ঐ সব হুকুমের হিকমত আমাদের জানা থাকুক বা না-ই থাকুক সর্বাবস্থায় মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা অনুভব করা ছাড়া হৃদয়ের সন্তুষ্টি ও আনুগত্যের সাথে তা মেনে নেওয়া। আর কুরআনুল করীমের দ্বারা পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহ মানসূখ বা রহিত করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলেন,
﴿وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ بِٱلۡحَقِّ مُصَدِّقٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهِ مِنَ ٱلۡكِتَٰبِ وَمُهَيۡمِنًا عَلَيۡهِۖ﴾ [المائدة: ٤٨]
“আর আমরা আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি সত্য গ্রন্থ, যা পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারকারী।” (অর্থাৎ যথাযথ সত্য-মিথ্যা নির্ধারণকারী)। [সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৪৮]
একারণে, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের কোনো হুকুমের ওপর আমল করা জায়েয হবে না, একমাত্র ঐসব হুকুম ব্যতীত যা বিশুদ্ধ ভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং কুরআনের দ্বারা তা প্রতিপাদিত ও বলবৎ রাখা হয়েছে।
আসমানী কিতাবসমূহের ওপর ঈমানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো:
প্রথম: বান্দাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অশেষ রহমত ও অনুগ্রহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ, কেননা তিনি প্রত্যেক জাতির প্রতি তাদের হিদায়াতের উদ্দেশ্যে কিতাব পাঠিয়েছেন।
দ্বিতীয়: শরী‘আত প্রবর্তনে আল্লাহ তা‘আলার হিকমত সম্পর্কে জ্ঞান লাভ, যেহেতু তিনি প্রতিটি জাতির প্রতি তাদের অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল শরী‘আত প্রবর্তন করে পাঠিয়েছেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿لِكُلّٖ جَعَلۡنَا مِنكُمۡ شِرۡعَةٗ وَمِنۡهَاجٗاۚ﴾ [المائدة: ٤٨]
“আমরা তোমাদের -প্রতিটি সম্প্রদায়ের- জন্য শরী‘আত ও জীবন পদ্ধতি প্রবর্তন করেছি।” [সূরা আল-মায়িদাহ-৪৮]
তৃতীয়: উপরোক্ত নি‘আমতসমূহের জন্য আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া জ্ঞাপন।
ঈমানের চতুর্থ ভিত্তি: রাসূলগণের ওপর ঈমান
‘রাসূল’ শব্দটি একবচন, আরবীতে এর বহুবচন হচ্ছে ‘রুসুল’। যার অর্থ কোনো বিষয় পৌঁছানোর জন্য প্রেরিত দূত বা প্রতিনিধি। ইসলামী পরিভাষায় রাসূল সেই মহান ব্যক্তি, যার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে শরী‘আত অবতীর্ণ হয়েছে এবং তা প্রচার করার জন্য তাঁকে হুকুম দেওয়া হয়েছে।
সর্বপ্রথম রাসূল হলেন নূহ আলাইহিস সালাম আর সর্বশেষ রাসূল হলেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّآ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ كَمَآ أَوۡحَيۡنَآ إِلَىٰ نُوحٖ وَٱلنَّبِيِّۧنَ مِنۢ بَعۡدِهِ﴾ [النساء: ١٦٣]
“আমরা আপনার প্রতি ওহী পাঠিয়েছি। যেমন করে ওহী পাঠিয়েছিলাম নূহের ওপর এবং সে সমস্ত নবী-রাসূলগণের ওপর যাঁরা তাঁর পরে প্রেরিত হয়েছেন।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৬৩]
সহীহ বুখারীতে আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে শাফা‘আতের হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন হাশরবাসীগণ আল্লাহ তা‘আলার কাছে সুপারিশের আশায় প্রথমে আদম আলাইহিস সালামের নিকট আসবে। তখন আদম আলাইহিস সালাম নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে বলবেন, “তোমরা নূহ আলাইহিস সালামের নিকট যাও। তিনি প্রথম রাসূল, যাকে আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির প্রতি প্রেরণ করেছেন।”
আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সম্পর্কে বলেন,
﴿مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٖ مِّن رِّجَالِكُمۡ وَلَٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّۧنَۗ وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٗا ٤٠﴾ [الاحزاب: ٤٠]
‘‘মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যকার কোনো পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী। আর আল্লাহ সবকিছুর ব্যাপারে সম্পূর্ণ জ্ঞাত।’’ [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪০]
আল্লাহ তা‘আলা যুগে-যুগে প্রত্যেক জাতির প্রতি স্বতন্ত্র শরী‘আতসহ রাসূল অথবা পূর্ববর্তী শরী‘আত নবায়নের জন্য ওহীসহ নবী প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ﴾ [النحل: ٣٦]
‘‘আমরা প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাগুতকে পরিহার কর।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَإِن مِّنۡ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٞ﴾ [فاطر: ٢٤]
‘‘এমন কোনো সম্প্রদায় নেই যাদের কাছে আমার পক্ষ থেকে সতর্ককারী আসে নি।’’ [সূরা ফাতির, আয়াত: ২৪]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿ إِنَّآ أَنزَلۡنَا ٱلتَّوۡرَىٰةَ فِيهَا هُدٗى وَنُورٞۚ يَحۡكُمُ بِهَا ٱلنَّبِيُّونَ ٱلَّذِينَ أَسۡلَمُواْ لِلَّذِينَ هَادُواْ وَٱلرَّبَّٰنِيُّونَ وَٱلۡأَحۡبَارُ بِمَا ٱسۡتُحۡفِظُواْ مِن كِتَٰبِ ٱللَّهِ وَكَانُواْ عَلَيۡهِ شُهَدَآءَۚ﴾ [المائدة: ٤٤]
‘‘আমরা তাওরাত অবতীর্ণ করেছি, এতে রয়েছে হিদায়াত ও আলো। নবীগণ যাঁরা আল্লাহর অনুগত ছিলেন তারা ইয়াহূদীদেরকে তদনুসারে বিধান দিতেন, আরো বিধান দিতেন রাব্বানীগণ এবং বিদ্বানগণ। কেননা তাদেরকে এ কিতাবুল্লার দেখাশোনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং তাঁরা এর ওপর সাক্ষ্য ছিল।” [সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৪৪]
নবী-রাসূলগণ আল্লাহর প্রিয় সৃষ্টি, তাঁরা মানুষ। তাঁদের মধ্যে রুবুবিয়্যাত বা উলুহিয়্যাতের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।
আল্লাহ তা‘আলা নবীকুল শিরোমনি ও নবীদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বড় মর্যাদার অধিকারী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন,
﴿قُل لَّآ أَمۡلِكُ لِنَفۡسِي نَفۡعٗا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَآءَ ٱللَّهُۚ وَلَوۡ كُنتُ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ لَٱسۡتَكۡثَرۡتُ مِنَ ٱلۡخَيۡرِ وَمَا مَسَّنِيَ ٱلسُّوٓءُۚ إِنۡ أَنَا۠ إِلَّا نَذِيرٞ وَبَشِيرٞ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ ١٨٨﴾ [الاعراف: ١٨٨]
“আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধন এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই কিন্তু যা আল্লাহ চান। আর আমি যদি অদৃশ্যের কথা জানতাম, তাহলে বহু কল্যাণ অর্জন করে নিতে পারতাম। ফলে আমাকে কোনো অমঙ্গল স্পর্শ করতে পারত না। আমি তো একজন ভীতি প্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা ঈমানদারদের জন্য।” [সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ১৮৮]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿قُلۡ إِنِّي لَآ أَمۡلِكُ لَكُمۡ ضَرّٗا وَلَا رَشَدٗا ٢١ قُلۡ إِنِّي لَن يُجِيرَنِي مِنَ ٱللَّهِ أَحَدٞ وَلَنۡ أَجِدَ مِن دُونِهِۦ مُلۡتَحَدًا ٢٢﴾ [الجن: ٢١، ٢٢]
“বলুন, আমি তোমাদের ক্ষতি সাধন করার ও সুপথে আনয়ন করার মালিক নই। বলুন, আল্লাহ তা‘আলার কবল থেকে আমাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না এবং তিনি ব্যতীত আমি কখনও কোনো আশ্রয়স্থল পাব না।” [সূরা আল-জিন, আয়াত: ২১-২২]
নবী-রাসূলগণও সাধারণ মানুষের ন্যায় মানবিক বৈশিষ্ট্যে বিশেষিত। তাঁরাও পানাহার করতেন, অসুস্থ হতেন এবং তাঁরা মারা যেতেন। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর জাতির সামনে স্বীয় রবের পরিচয় দিয়ে বলেন,
﴿وَٱلَّذِي هُوَ يُطۡعِمُنِي وَيَسۡقِينِ ٧٩ وَإِذَا مَرِضۡتُ فَهُوَ يَشۡفِينِ ٨٠ وَٱلَّذِي يُمِيتُنِي ثُمَّ يُحۡيِينِ ٨١﴾ [الشعراء: ٧٩، ٨١]
“আর যিনি আমাকে আহার এবং পানীয় দান করেন। যখন আমি রোগাক্রান্ত হই তখন তিনিই আমাকে আরোগ্য দান করেন। যিনি আমার মৃত্যু ঘটাবেন, অতঃপর তিনিই আমার পুনঃর্জীবন দান করবেন।’’ [সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ৭৯-৮১]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ। আমি ভুলে যাই, যেমন তোমরা ভুলে যাও। আর যদি আমি ভুলে যাই তা হলে তোমরা আমাকে স্বরণ করিয়ে দিও। (বুখারী ও মুসলিম)
তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূলগণকে দাসত্বগুণে বিশেষিত করেছেন তাঁদের সর্বোচ্চ মর্যাদার স্থলে এবং তাঁদের প্রশংসা করার বেলায়ও তাঁদেরকে বান্দা বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা নূহ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন,
﴿إِنَّهُۥ كَانَ عَبۡدٗا شَكُورٗا ﴾ [الاسراء: ٣]
“নিশ্চয়ই সে ছিল আমার কৃতজ্ঞ বান্দা।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৩]
নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿تَبَارَكَ ٱلَّذِي نَزَّلَ ٱلۡفُرۡقَانَ عَلَىٰ عَبۡدِهِۦ لِيَكُونَ لِلۡعَٰلَمِينَ نَذِيرًا ١﴾ [الفرقان: ١]
“পরম কল্যাণময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফয়সালার গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন, যাতে সে সৃষ্টিকুলের জন্য সতর্ককারী হয়।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ১]
আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুব আলাইহিমুস সালাম সম্পর্কে বলেন,
﴿وَٱذۡكُرۡ عِبَٰدَنَآ إِبۡرَٰهِيمَ وَإِسۡحَٰقَ وَيَعۡقُوبَ أُوْلِي ٱلۡأَيۡدِي وَٱلۡأَبۡصَٰرِ ٤٥ إِنَّآ أَخۡلَصۡنَٰهُم بِخَالِصَةٖ ذِكۡرَى ٱلدَّارِ ٤٦ وَإِنَّهُمۡ عِندَنَا لَمِنَ ٱلۡمُصۡطَفَيۡنَ ٱلۡأَخۡيَارِ ٤٧﴾ [ص: ٤٥، ٤٧]
“স্মরণ কর, আমার বান্দা ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের কথা, তাঁরা ছিল শক্তিশালী ও সুক্ষ্মদর্শী। আমি তাঁদের এক বিশেষ গুণ, পরকালের স্মরণ দ্বারা স্বাতন্ত্র্য দান করেছিলাম। আর তাঁরা আমার কাছে মনোনীত ও সৎলোকদের অন্তর্ভুক্ত।” [সূরা সাদ, আয়াত: ৪৫-৪৭]
অনুরূপভাবে ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنۡ هُوَ إِلَّا عَبۡدٌ أَنۡعَمۡنَا عَلَيۡهِ وَجَعَلۡنَٰهُ مَثَلٗا لِّبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ٥٩﴾ [الزخرف: ٥٩]
“সে তো আমার এক বান্দাই বটে, আমি তার প্রতি অনুগ্রহ করেছি এবং তাকে করেছি বনী ইসরাঈলের জন্য এক আদর্শ।’’ [সূরা আয-যুখরুফ, আযাত: ৫৯]
রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনার মধ্যে চারটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
প্রথম: ঈমান আনয়ন করা যে, সমস্ত নবী-রাসূলের রিসালাত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই যথাযথভাবে এসেছে। তাঁদের কোনো একজনের প্রতি কুফুরী বা কোনো একজনকে অস্বীকার করা সবার প্রতি কুফুরী করার নামান্তর। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা নূহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় সম্পর্কে বলেন,
﴿كَذَّبَتۡ قَوۡمُ نُوحٍ ٱلۡمُرۡسَلِينَ ١٠٥﴾ [الشعراء: ١٠٥]
‘‘নূহের সম্প্রদায় রাসূলগণকে মিথ্যারোপ করেছে।” [সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ১০৫]
আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সকল নবী-রাসূলগণের ওপর মিথ্যারোপকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অথচ সে সময় নূহ আলাইহিস সালাম ব্যতীত অন্য কোনো রাসূল ছিলেন না। তাই খ্রিস্টানদের মধ্যে যারা নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর মিথ্যারোপ করে এবং তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ করে না, তারা বস্তুত ঈসা-মসীহ আলাইহিস সালামকে অস্বীকার করলো, তাঁর অনুকরণ ও আনুগত্য থেকে মুখ ফেরালো। কেননা, মরিয়ম তনয় ঈসা আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈলকে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে সুসংবাদ দিয়েছিলেন আর সে সুসংবাদ প্রদানের অর্থই হচ্ছে এটা প্রমাণিত হওয়া যে, তিনি তাদের কাছে প্রেরিত রাসূল। যিনি তাদেরকে গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করে সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করবেন।(১)
দ্বিতীয়: নবী-রাসূলগণের মধ্যে যাঁদের নাম জানা আছে তাঁদের প্রতি নির্দিষ্ট করে ঈমান আনা। যেমন, মুহাম্মদ, ইবরাহীম, মুসা, ঈসা, নূহ (আলাইহিমুস সালাম)। উল্লিখিত পাঁচজন হলেন নবী-রাসূলগণের মধ্যে বিশিষ্ট ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে কুরআনের দু’স্থানে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি সূরা আল-আহযাবে বলেছেন,
﴿وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِنَ ٱلنَّبِيِّۧنَ مِيثَٰقَهُمۡ وَمِنكَ وَمِن نُّوحٖ وَإِبۡرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَى ٱبۡنِ مَرۡيَمَۖ﴾ [الاحزاب: ٧]
“আর স্মরণ করুন সে সময়ের কথা, যখন আমরা নবীগণের কাছ থেকে ও তোমার কাছ থেকে এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মরিয়ম তনয় ঈসার কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৭]
আর সূরা আশ-শূরায় বলা হয়েছে,
﴿شَرَعَ لَكُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِۦ نُوحٗا وَٱلَّذِيٓ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ وَمَا وَصَّيۡنَا بِهِۦٓ إِبۡرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰٓۖ أَنۡ أَقِيمُواْ ٱلدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُواْ فِيهِۚ ﴾ [الشورا: ١٣]
“তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দীন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমরা প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এ মর্মে যে, তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ১৩]
আর নবী-রাসূলগণের মধ্যে যাদের নাম আমাদের জানা নেই, তাঁদের প্রতি সাধারণ ও সার্বিকভাবে ঈমান স্থাপন করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا رُسُلٗا مِّن قَبۡلِكَ مِنۡهُم مَّن قَصَصۡنَا عَلَيۡكَ وَمِنۡهُم مَّن لَّمۡ نَقۡصُصۡ عَلَيۡكَۗ﴾ [غافر: ٧٨]
“আমরা আপনার পূর্বে অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি। তাঁদের কারো কারো ঘটনা আপনার কাছে বিবৃত করেছি এবং কারো কারো ঘটনা আপনার কাছে বিবৃত করি নি।” [সূরা গাফির, আয়াত: ৭৮]
তৃতীয়: কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত তাঁদের ঘটনাসমূহের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা।
চতুর্থ: নবী-রাসূলগণের মধ্যে যাঁকে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের প্রতি রাসূল করে প্রেরণ করেছেন, তাঁর আনিত শরী‘আতের ওপর আমল করা। আর তিনি হলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যাকে আল্লাহ তা‘আলা সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥﴾ [النساء: ٦٥]
“অতএব, না আপনার রবের শপথ, ঐ পর্যন্ত তারা ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারভার আপনার ওপর অর্পণ না করে। অতঃপর আপনার মীমাংসার ব্যাপারে তাদের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা না থাকে এবং সন্তুষ্টচিত্তে তা কবুল করে।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬৫]
নবী-রাসূলগণের প্রতি ঈমানের ফলে যে সব গুরুত্বপূর্ণ উপকার সাধিত হয় তন্মধ্যে রয়েছে:
১। আল্লাহ তা‘আলার রহমত ও বান্দাদের প্রতি তাঁর পূর্ণ তত্ত্বাবধান সম্পর্কে জানা। যেহেতু তিনি তাদের প্রতি আপন রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন, যাতে তাঁরা মানবজাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন এবং কোন পদ্ধতিতে আল্লাহর ইবাদাত করতে হয় তা লোকদের স্পষ্ট করে বলে দেন। কেননা, মানুষের নিজস্ব জ্ঞান-বুদ্ধির মাধ্যমে তা জানা অসম্ভব।
২। এই মহা নি‘আমতের ওপর আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করা।
৩। নবী রাসূলগণের প্রতি মহব্বত ও সম্মান প্রদর্শন করা ও তাঁদের শান ও মর্যাদা উপযোগী প্রশংসা করা। কেননা, তাঁরা আল্লাহর রাসূল এবং তাঁরা প্রকৃত অর্থেই আল্লাহর ইবাদাত আদায় করেছেন। তাঁরা রিসালাতের পবিত্র দায়িত্ব যথাযথ ভাবে আদায় করেছেন এবং তাঁর বান্দাদের নসিহত করেছেন।
শুধূমাত্র একগুঁয়ে কাফেররা তাদের প্রতি প্রেরিত রাসূলগণকে অবিশ্বাস করেছে এই বলে যে, আল্লাহর রাসূলগণ মানুষ থেকে হতে পারেন না। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারীমে তাদের এ ভ্রান্ত ধারণার উল্লেখ করে তা বাতিল করে বলেন,
﴿وَمَا مَنَعَ ٱلنَّاسَ أَن يُؤۡمِنُوٓاْ إِذۡ جَآءَهُمُ ٱلۡهُدَىٰٓ إِلَّآ أَن قَالُوٓاْ أَبَعَثَ ٱللَّهُ بَشَرٗا رَّسُولٗا ٩٤ قُل لَّوۡ كَانَ فِي ٱلۡأَرۡضِ مَلَٰٓئِكَةٞ يَمۡشُونَ مُطۡمَئِنِّينَ لَنَزَّلۡنَا عَلَيۡهِم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ مَلَكٗا رَّسُولٗا ٩٥﴾ [الاسراء: ٩٤، ٩٥]
‘‘আল্লাহ কি মানুষকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন?! যখন তাদের নিকট পথ-নির্দেশ আসে তখন তাদের এ উক্তিই লোকদেরকে ঈমান আনা থেকে বিরত রাখে। বল, যদি পৃথিবীতে ফিরিশতারা স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করত, তা হলে আমি আকাশ থেকে কোনো ফিরিশতাকেই তাদের নিকট রাসূল করে প্রেরণ করতাম।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৯৪-৯৫]
আল্লাহ তা‘আলা তাদের এই ধারণা খণ্ডন করে দেন এই অর্থে যে, আল্লাহর রাসূলগণ মানুষ হওয়া অপরিহার্য। কেননা তাঁরা পৃথিবীবাসীর প্রতি প্রেরিত, যেহেতু এরা হলো মানুষ। আর যদি পৃথিবীবাসীরা ফিরিশতা হতো তাহলে তাদের প্রতি নিশ্চয়ই কোনো ফিরিশতাকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করার প্রয়োজন দেখা দিতো, যাতে সেই রাসূল তাদেরই মত একজন হয়ে দায়িত্ব পালন করতেন।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা রাসূলগণকে অবিশ্বাসকারীদের বক্তব্য বর্ণনা করে বলেন,
﴿قَالُوٓاْ إِنۡ أَنتُمۡ إِلَّا بَشَرٞ مِّثۡلُنَا تُرِيدُونَ أَن تَصُدُّونَا عَمَّا كَانَ يَعۡبُدُ ءَابَآؤُنَا فَأۡتُونَا بِسُلۡطَٰنٖ مُّبِينٖ ١٠ قَالَتۡ لَهُمۡ رُسُلُهُمۡ إِن نَّحۡنُ إِلَّا بَشَرٞ مِّثۡلُكُمۡ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يَمُنُّ عَلَىٰ مَن يَشَآءُ مِنۡ عِبَادِهِۦۖ وَمَا كَانَ لَنَآ أَن نَّأۡتِيَكُم بِسُلۡطَٰنٍ إِلَّا بِإِذۡنِ ٱللَّهِۚ﴾ [ابراهيم: ١٠، ١١]
‘‘তারা বললো, তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ! তোমরা আমাদেরকে ঐ উপাস্য থেকে বিরত রাখতে চাও, যার ইবাদাত আমাদের পিতৃপুরুষগণ করত। অতএব তোমরা কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ আনয়ন কর। তাদের রাসূলগণ তাদেরকে বললেন, আমরাও তোমাদের মতো মানুষ; কিন্তু আল্লাহ বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা, অনুগ্রহ করেন। আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত তোমাদের কাছে প্রমাণ নিয়ে আসা আমাদের কাজ নয়। ঈমানদারগণ কেবল আল্লাহরই ওপর ভরসা করা উচিৎ।” [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ১০-১১]
ঈমানের পঞ্চম ভিত্তি: আখেরাতের ওপর ঈমান
শেষ দিবস বলতে কিয়ামতের দিনকে বুঝানো হয়েছে। যেদিন প্রতিফল প্রদান ও হিসাব-নিকাশের জন্য সব মৃত মানুষদের পুনরুত্থান করা হবে।
ঐ দিনকে ইয়াওমুল আখের বা শেষ দিন এ জন্যই বলা হয় যে, এরপর আর অন্য কোনো দিবস থাকবে না। হিসাব-নিকাশের পর জান্নাতীগণ তাঁদের চিরস্থায়ী আবাসস্থলে অবস্থান করবে এবং জাহান্নামীগণও তাদের ঠিকানায় অবস্থান করবে।
আখেরাতের ওপর ঈমান তিনটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে:
প্রথম: পুনরুত্থান দিবসের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা। আর তা হলো যেদিন শিঙ্গায় দ্বিতীয় বার ফুঁৎকার দেওয়া হবে, তখন সব মৃতরা জীবিত হয়ে নগ্ন দেহ, নগ্ন পা ও খত্নাবিহীন অবস্থায় রাব্বুল ‘আলামীনের সামনে উপস্থিত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿كَمَا بَدَأۡنَآ أَوَّلَ خَلۡقٖ نُّعِيدُهُۥۚ وَعۡدًا عَلَيۡنَآۚ إِنَّا كُنَّا فَٰعِلِينَ﴾ [الانبياء: ١٠٤]
“যেভাবে আমরা প্রথমবার সৃষ্টি শুরু করেছিলাম সেভাবে পুনরায় তাকে সৃষ্টি করব। আমার ওয়াদা নিশ্চিত। অবশ্যই আমরা তা পূর্ণ করব।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০৪]
পুনরুত্থান:
মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সত্য, যা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত এবং এর ওপর মুসলিমদের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ثُمَّ إِنَّكُم بَعۡدَ ذَٰلِكَ لَمَيِّتُونَ ١٥ ثُمَّ إِنَّكُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ تُبۡعَثُونَ ١٦﴾ [المؤمنون: ١٥، ١٦]
“অতঃপর নিশ্চয় তোমরা মারা যাবে। তারপর কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে পুনঃর্জীবিত করা হবে।” [সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত: ১৫-১৬]
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘কিয়ামতের দিন সব মানুষকে নগ্ন পা ও খত্নাবিহীন অবস্থায় সমবেত করা হবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
আর পুনরুত্থান সাব্যস্ত হওয়ার ওপর মুসলিমদের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তাছাড়া আল্লাহর হিকমতের দাবী হলো এই পৃথিবীবাসীর জন্য পরবর্তীতে একটি সময় নির্ধারণ করা অনিবার্য, যাতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলদের মাধ্যমে বান্দার ওপর যেসব কাজ-কর্মের দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি তার প্রতিফল প্রদান করেন। আল্লাহ বলেন,
﴿أَفَحَسِبۡتُمۡ أَنَّمَا خَلَقۡنَٰكُمۡ عَبَثٗا وَأَنَّكُمۡ إِلَيۡنَا لَا تُرۡجَعُونَ ١١٥﴾ [المؤمنون: ١١٥]
“তোমরা কি ধারণা করেছ যে, আমরা তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং আমাদের কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে না?” [সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত: ১১৫]
আল্লাহ স্বীয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলেন,
﴿إِنَّ ٱلَّذِي فَرَضَ عَلَيۡكَ ٱلۡقُرۡءَانَ لَرَآدُّكَ إِلَىٰ مَعَادٖۚ﴾ [القصص: ٨٥]
‘‘যিনি আপনার জন্য কুরআনকে করেছেন বিধান তিনি অবশ্যই আপনাকে তাঁর অঙ্গিকারকৃত প্রত্যাবর্তনস্থলে ফিরিয়ে নিবেন।” [সূরা আল-ক্বাসাস, আয়াত: ৮৫]
দ্বিতীয়: হিসাব-নিকাশ ও প্রতিফল প্রদানের ওপর ঈমান আনা।
আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন বান্দার কৃতকর্মের হিসাব-নিকাশ নিবেন এবং প্রত্যেকের যাবতীয় কাজ-কর্মের প্রতিফল প্রদান করবেন। এর প্রমাণ কুরআন, সুন্নাহ্ ও মুসলিম উম্মার ইজমা‘। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ إِلَيۡنَآ إِيَابَهُمۡ ٢٥ ثُمَّ إِنَّ عَلَيۡنَا حِسَابَهُم ٢٦﴾ [الغاشية: ٢٥، ٢٦]
‘‘নিশ্চয়ই তাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে হবে। অতঃপর তাদের হিসাব-নিকাশ থাকবে আমারই দায়িত্বে।” [সূরা আল-গাশিয়াহ, আয়াত: ২৫-২৬]
তিনি আরো বলেন,
﴿مَن جَآءَ بِٱلۡحَسَنَةِ فَلَهُۥ عَشۡرُ أَمۡثَالِهَاۖ وَمَن جَآءَ بِٱلسَّيِّئَةِ فَلَا يُجۡزَىٰٓ إِلَّا مِثۡلَهَا وَهُمۡ لَا يُظۡلَمُونَ ١٦٠﴾ [الانعام: ١٦٠]
‘‘যে একটি সৎকর্ম করবে তার জন্য রয়েছে এর দশগুণ সাওয়াব এবং যে একটি মন্দ কাজ করবে সে তারই সমান শাস্তি পাবে। বস্তুতঃ তাদের প্রতি কোনো যুলুম করা হবে না।” [সূরা আল-আন’আম, আয়াত: ১৬০]
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
﴿وَنَضَعُ ٱلۡمَوَٰزِينَ ٱلۡقِسۡطَ لِيَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ فَلَا تُظۡلَمُ نَفۡسٞ شَيۡٔٗاۖ وَإِن كَانَ مِثۡقَالَ حَبَّةٖ مِّنۡ خَرۡدَلٍ أَتَيۡنَا بِهَاۗ وَكَفَىٰ بِنَا حَٰسِبِينَ ٤٧﴾ [الانبياء: ٤٧]
“আর আমরা কিয়ামতের দিন ন্যায় বিচারের পাল্লা স্থাপন করব। সুতরাং কারো প্রতি যুলুম করা হবে না। যদি কোনো ‘আমল সরিষার দানা পরিমাণও ক্ষুদ্র হয়, আমরা তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্য আমরাই যথেষ্ট।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৪৭]
আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
«إن الله يدني الْمُؤْمِنَ حَتَّى يَضَعَ عَلَيْهِ كَنَفَهُ فَيُقَرِّرُهُ بِذُنُوبِهِ تَعْرِفُ ذَنْبَ كَذَا يَقُولُ أَعْرِفُ يَقُولُ رَبِّ أَعْرِفُ مَرَّتَيْنِ فَيَقُولُ سَتَرْتُهَا فِي الدُّنْيَا وَأَغْفِرُهَا لَكَ الْيَوْمَ ثُمَّ تُطْوَى صَحِيفَةُ حَسَنَاتِهِ وَأَمَّا الْآخَرُونَ أَوْ الْكُفَّارُ فَيُنَادَى عَلَى رُءُوسِ الْأَشْهَادِ هَؤُلاءِ الَّذِينَ كَذَبُوا عَلَى رَبِّهِمْ أَلا لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ»
‘‘আল্লাহ ঈমানদার ব্যক্তিকে শেষ বিচারের দিন নিকটবর্তী করে তার ওপর পর্দা ঢেলে দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি কি তোমার অমুক অমুক পাপ সম্পর্কে অবগত আছ? সে উত্তরে বলবে, হ্যাঁ, হে আমার রব! এভাবে যখন সে তার পাপসমূহ স্বীকার করে নিবে এবং দেখবে যে, সে ধ্বংসের মুখোমুখী হয়ে গেছে, তখন আল্লাহ বলবেন, আমি দুনিয়াতে তোমার পাপসমূহ গোপন করে রেখেছিলাম এবং আজ তোমার সে সব পাপ ক্ষমা করে দিলাম। এরপর তাকে তার নেকীর ‘আমলনামা দেওয়া হবে। আর কাফের ও মুনাফিকদেরকে সকল সৃষ্টির সামনে সমবেত করে বলা হবে, এরা সেই সব লোক যারা তাদের রবের প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল। শুনে রাখ, অত্যাচারীদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাৎ রয়েছে।” (বুখারী ও মুসলিম)
অন্য এক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি কোনো একটি সৎকাজের ইচ্ছা করে এবং তা সম্পন্ন করে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য দশ থেকে সাতশত গুণ সাওয়াব লিখে রাখেন; বরং আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কৃপায় আরো বেশি দিতে পারেন। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি একটি গুনাহের ইচ্ছা করে আর সে তা বাস্তবায়িত করে, আল্লাহ তার নামে শুধু একটি গুনাহই লিপিবদ্ধ করেন।”
আর আখেরাতে হিসাব-নিকাশ শাস্তি ও পুরষ্কার প্রদান করার ওপর মুসলিম উম্মাতের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তাছাড়া এটাই হিকমতের দাবী। কেননা আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে গ্রন্থরাজি পাঠিয়েছেন, রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন এবং তাঁদের আনিত দীন গ্রহণ করা ও তার ওপর আমল করা বান্দাদের ওপর ফরয করে দিয়েছেন। তাদের বিরোধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ওয়াজিব করেছেন, তাদের রক্ত, ছেলে-সন্তান, মাল-সম্পদ ও নারীদেরকে মুসলিমদের জন্য হালাল করেছেন। অতএব, যদি প্রতিটি কৃতকর্মের হিসাব-নিকাশ ও শাস্তি-পুরষ্কার প্রদান করা না হয় তাহলে এ সবই হয় অনর্থক, যা থেকে আমাদের সর্ববিজ্ঞ রব আল্লাহ তা‘আলা পাক-পবিত্র। এর প্রতিই আল্লাহ তা‘আলা ইঙ্গিত করে বলেন,
{فَلَنَسْأَلَنَّ الَّذِينَ أُرْسِلَ إِلَيْهِمْ وَلَنَسْأَلَنَّ الْمُرْسَلِينَ فَلَنَقُصَّنَّ عَلَيْهِم بِعِلْمٍ وَمَا كُنَّا غَآئِبِينَ}
‘‘অতএব আমরা অবশ্যই তাদেরকে জিজ্ঞেস করব, যাদের কাছে রাসূল প্রেরিত হয়েছিল এবং আমরা অবশ্যই জিজ্ঞেস করব রাসূলগণকে। অতঃপর আমি স্বজ্ঞানে তাদের কাছে অবস্থা বর্ণনা করব। বস্তুত আমি সেখানে অনুপস্থিত ছিলাম না।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৬]
তৃতীয়: জান্নাত ও জাহান্নামের ওপর বিশ্বাস স্থাপন এবং বিশ্বাস স্থাপন করা যে, এই দু’টি স্থান মু’মিন ও কাফিরদের চিরকালের শেষ আবাসস্থল।
জান্নাত, তা তো অফুরন্ত নি‘আমতের স্থান, আল্লাহ তা সেসব মু’মিন-মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন, যারা ঐ সব বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছে যে সব বিষয়ের প্রতি ঈমান আনা আল্লাহ তাদের ওপর অপরিহার্য করেছেন এবং নিষ্ঠার সাথে তারা আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য ও তাঁর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করেছে। সেথায় এমন অফুরন্ত নিয়ামতের ভাণ্ডার মওজুদ রয়েছে যা কখনও কোনো চক্ষু দেখে নি, কোনো কর্ণ শ্রবণ করে নি এবং কোনো মানুষ তা মনে মনে কল্পনাও করতে পারে নি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أُوْلَٰٓئِكَ هُمۡ خَيۡرُ ٱلۡبَرِيَّةِ ٧ جَزَآؤُهُمۡ عِندَ رَبِّهِمۡ جَنَّٰتُ عَدۡنٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۖ رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُۚ ذَٰلِكَ لِمَنۡ خَشِيَ رَبَّهُۥ ٨﴾ [البينة: ٧، ٨]
“যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তারাই হলো সৃষ্টির সেরা। তাদের রবের কাছে রয়েছে তাদের প্রতিদান, চিরকাল বসবাসের জান্নাত, যার তলদেশে নির্ঝরিনীসমূহ প্রবাহিত। তারা সেখানে থাকবে অনন্তকাল। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য যে তার রবকে ভয় করে।” [সূরা আল-বাইয়্যিনাত, আয়াত: ৭-৮]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَلَا تَعۡلَمُ نَفۡسٞ مَّآ أُخۡفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعۡيُنٖ جَزَآءَۢ بِمَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٧﴾ [السجدة: ١٧]
“কেউ জানে না, তাদের জন্য নয়ণ প্রীতিকর কী লুক্কায়িত রাখা আছে তাদের কৃতকর্মের পুরস্কারস্বরূপ” [সূরা আস-সিজদা, আয়াত: ১৭]
আর জাহান্নাম, জাহান্নাম তো শাস্তির স্থান, যা আল্লাহ তা‘আলা কাফির যালিমদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন। যারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফুরী ও তাঁর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাফরমানী করে। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার ‘আযাব ও হৃদয়বিদারক শাস্তি, যা কারো কল্পনায়ও আসতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱتَّقُواْ ٱلنَّارَ ٱلَّتِيٓ أُعِدَّتۡ لِلۡكَٰفِرِينَ ١٣١﴾ [ال عمران: ١٣١]
“সেই আগুন থেকে তাকওয়া অবলম্বন কর, যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে কাফিরদের জন্য।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩১]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿ إِنَّآ أَعۡتَدۡنَا لِلظَّٰلِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمۡ سُرَادِقُهَاۚ وَإِن يَسۡتَغِيثُواْ يُغَاثُواْ بِمَآءٖ كَٱلۡمُهۡلِ يَشۡوِي ٱلۡوُجُوهَۚ بِئۡسَ ٱلشَّرَابُ وَسَآءَتۡ مُرۡتَفَقًا﴾ [الكهف: ٢٩]
“আমরা যালিমদের জন্য জাহান্নাম প্রস্তুত করে রেখেছি, যার বেষ্টনী তাদেরকে পরিবেষ্টিত করে রাখবে। যদি তারা পানীয় প্রার্থনা করে তাহলে তাদেরকে পূঁজের ন্যায় পানীয় দেওয়া হবে, যা তাদের মুখমণ্ডল বিদগ্ধ করবে। কতই না নিকৃষ্ট পানীয় তা এবং কতই না মন্দ সেই আশ্রয়স্থল।” [সূরা আল কাহাফ, আয়াত: ২৯]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿إِنَّ ٱللَّهَ لَعَنَ ٱلۡكَٰفِرِينَ وَأَعَدَّ لَهُمۡ سَعِيرًا ٦٤ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۖ لَّا يَجِدُونَ وَلِيّٗا وَلَا نَصِيرٗا ٦٥ يَوۡمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمۡ فِي ٱلنَّارِ يَقُولُونَ يَٰلَيۡتَنَآ أَطَعۡنَا ٱللَّهَ وَأَطَعۡنَا ٱلرَّسُولَا۠ ٦٦﴾ [الاحزاب: ٦٤، ٦٦]
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফিরদের ওপর অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্য জ্বলন্ত অগ্নি প্রস্তুত করে রেখেছেন। তথায় তারা অনন্তকাল থাকবে এবং তথায় কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। যে দিন অগ্নিতে তাদের মুখমণ্ডল ওলট-পালট করা হবে, সে দিন তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহ ও আমাদের রাসূলের আনুগত্য করতাম।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৬৪-৬৬]
শেষ দিবসের ওপর ঈমান আনার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির মধ্যে আরও রয়েছে, মৃত্যুর পর সংগঠিত বিভিন্ন বিষয়। যেমন,
(ক) কবরের পরীক্ষা:
মৃত ব্যক্তির দাফনের পর ফিরিশতা কর্তৃক তাকে তার রব, তার দীন ও তার নবী সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা ঈমানদারগণকে সুদৃঢ় বাণী দ্বারা সংহত করবেন এবং ঈমানদার ব্যক্তি বলবে, আল্লাহ আমার রব, ইসলাম আমার দীন এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নবী। আর আল্লাহ জালেমদের বিভ্রান্ত করবেন। তাই কাফের বলবে, হায়! হায়! আমি তো কিছুই জানি না। আর মুনাফিক বা সন্দেহকারী বলবে, আমি কিছুই জানি না, তবে লোকদেরকে কিছু বলতে শুনেছি, অতঃপর আমিও তাই বলেছিলাম।
(খ) কবরের ‘আযাব ও তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য:
কবরের ‘আযাব যালিম, কাফির ও মুনাফিকদের জন্য হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَوۡ تَرَىٰٓ إِذِ ٱلظَّٰلِمُونَ فِي غَمَرَٰتِ ٱلۡمَوۡتِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ بَاسِطُوٓاْ أَيۡدِيهِمۡ أَخۡرِجُوٓاْ أَنفُسَكُمُۖ ٱلۡيَوۡمَ تُجۡزَوۡنَ عَذَابَ ٱلۡهُونِ بِمَا كُنتُمۡ تَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ غَيۡرَ ٱلۡحَقِّ وَكُنتُمۡ عَنۡ ءَايَٰتِهِۦ تَسۡتَكۡبِرُونَ﴾ [الانعام: ٩٣]
“যদি আপনি দেখেন, যখন যালিমরা মৃত্যু-যন্ত্রণায় থাকে এবং ফিরিশতারা স্বীয়-হস্ত প্রসারিত করে বলবে, বের কর স্বীয় আত্মা! অদ্য তোমাদেরকে অপমানকর শাস্তি প্রদান করা হবে। কারণ, তোমরা আল্লাহর ওপর অসত্য বলতে এবং তাঁর আয়াতসমূহ থেকে অহংকার করতে। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৯৩]
মহান আল্লাহ তা‘আলা ফির‘আউনের গোত্র সম্পর্কে বলেন,
﴿ٱلنَّارُ يُعۡرَضُونَ عَلَيۡهَا غُدُوّٗا وَعَشِيّٗاۚ وَيَوۡمَ تَقُومُ ٱلسَّاعَةُ أَدۡخِلُوٓاْ ءَالَ فِرۡعَوۡنَ أَشَدَّ ٱلۡعَذَابِ ٤٦﴾ [غافر: ٤٦]
“সকাল ও সন্ধ্যায় তাদেরকে আগুনের সামনে পেশ করা হয় এবং যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন আদেশ করা হবে, ফির‘আউন গোত্রকে কঠিনতর ‘আযাবে প্রবেশ করাও।” [সূরা গাফির, আয়াত: ৪৫]
সহীহ মুসলিম শরীফে যায়েদ ইবন সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যদি তোমরা মৃতদেরকে দাফন করবে না -এ আশঙ্কা আমার না হতো তাহলে আমি আল্লাহর নিকট দো‘আ করতাম, তোমাদেরকে কবরের ঐ ‘আযাব শুনিয়ে দেওয়ার জন্য যা আমি শুনে থাকি। তারপর সাহাবীগণের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা জাহান্নামের ‘আযাব থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর। তাঁরা বললেন, আমরা জাহান্নামের ‘আযাব থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি। অতঃপর তিনি বললেন, তোমরা কবরের ‘আযাব হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাও। তাঁরা বললেন, আমরা কবরের ‘আযাব থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ফিতনাসমূহ থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় কামনা কর। তাঁরা বললেন, আমরা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ফিতনাসমূহ থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি। তিনি বললেন, তোমরা দাজ্জালের ফিতনা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর। তাঁরা বললেন, আমরা দাজ্জালের ফিতনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি।”
আর কবরের নি‘আমত ও স্বাচ্ছন্দ্য, তা তো সত্যবাদী ঈমানদার লোকদের জন্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ قَالُواْ رَبُّنَا ٱللَّهُ ثُمَّ ٱسۡتَقَٰمُواْ تَتَنَزَّلُ عَلَيۡهِمُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ أَلَّا تَخَافُواْ وَلَا تَحۡزَنُواْ وَأَبۡشِرُواْ بِٱلۡجَنَّةِ ٱلَّتِي كُنتُمۡ تُوعَدُونَ ٣٠﴾ [فصلت: ٣٠]
“নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের রব আল্লাহ, অতঃপর এর ওপর তারা অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফিরিশতারা অবতীর্ণ হয়ে বলে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না এবং তোমাদের প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর” [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৩০]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَلَوۡلَآ إِذَا بَلَغَتِ ٱلۡحُلۡقُومَ ٨٣ وَأَنتُمۡ حِينَئِذٖ تَنظُرُونَ ٨٤ وَنَحۡنُ أَقۡرَبُ إِلَيۡهِ مِنكُمۡ وَلَٰكِن لَّا تُبۡصِرُونَ ٨٥ فَلَوۡلَآ إِن كُنتُمۡ غَيۡرَ مَدِينِينَ ٨٦ تَرۡجِعُونَهَآ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٨٧ فَأَمَّآ إِن كَانَ مِنَ ٱلۡمُقَرَّبِينَ ٨٨ فَرَوۡحٞ وَرَيۡحَانٞ وَجَنَّتُ نَعِيمٖ ٨٩﴾ [الواقعة: ٨٣، ٨٩]
‘‘উপরন্তু কেন নয় যখন কারো প্রাণ কন্ঠাগত হয় এবং তোমরা তাকিয়ে থাক, তখন আমরা তোমাদের অপেক্ষা তার অধিক নিকটে থাকি; কিন্তু তোমরা দেখ না। যদি তোমাদের হিসাব-কিতাব না হওয়াই ঠিক হয়, তবে তোমরা এই আত্মাকে ফিরাও না কেন? যদি তোমরা সত্যবাদী হও। অতঃপর যদি সে নৈকট্যপ্রাপ্তদের একজন হয়, তবে তাঁর জন্য আছে সুখ-সাচ্ছন্দ্য, উত্তম জীবনোপকরণ ও নি‘আমত ভরা উদ্যান।” [সূরা ওয়াকিয়াহ, আয়াত: ৮৩-৮৯]
অনুরূপভাবে বারা ইবনে ‘আযিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ঈমানদার ব্যক্তি কর্তৃক কবরে ফিরিশতাদ্বয়ের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর এক আহ্বানকারী আসমান থেকে আহ্বান করে বলবে, আমার বান্দা সত্য বলেছে। তোমরা তার জন্য জান্নাতে বিছানা করে দাও, তাকে জান্নাতের পোষাক পরিধান করিয়ে দাও এবং তার জন্য জান্নাতের একটা দরজা খুলে দাও। অতঃপর তাঁর কবরে জান্নাতের সুগন্ধি আসতে থাকবে এবং তার জন্য কবর চক্ষুদৃষ্টির সীমা পর্যন্ত প্রশস্ত করা হবে। (ইমাম আহমদ ও আবু দাউদ কর্তৃক বর্ণিত, এটি দীর্ঘ একটি হাদীসের অংশ বিশেষ)
শেষ দিবসের ওপর ঈমানে অনেক উপকারিতা রয়েছে, তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ:
১। আখেরাতের সে দিনের সুখ-শান্তি ও প্রতিফলের আশায় ঈমান অনুযায়ী আল্লাহর আনুগত্যে ‘আমল করার প্রেরণা ও স্পৃহা সৃষ্টি হয়।
২। আখেরাতের সে দিনের ‘আযাব ও শাস্তির ভয়ে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাফরমানী করা থেকে ও পাপ কাজের ওপর সন্তুষ্ট হওয়া থেকে বিরত থাকা।
৩। আখেরাতে সংরক্ষিত নি‘আমত ও সাওয়াবের আশায় পার্থিব বঞ্চনায় মু’মিনের আন্তরিক প্রশান্তি লাভ হয়।
আখেরাতের ব্যাপারে সন্দেহ ও তার অপনোদন:
কাফেরগণ মৃত্যুর পর পূনরুজ্জীবন অস্বীকার করে। তাদের ধারণায় এ পুনরুজ্জীবন অসম্ভব:
কাফেরদের এই ধারণা বাতিল। কারণ, মৃত্যুর পর পুণরুত্থানের ওপর শরী‘আত, ইন্দ্রিয় শক্তি ও যুক্তিগত প্রমাণ রয়েছে:
(ক) শরী‘আতের প্রমাণ: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿زَعَمَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ أَن لَّن يُبۡعَثُواْۚ قُلۡ بَلَىٰ وَرَبِّي لَتُبۡعَثُنَّ ثُمَّ لَتُنَبَّؤُنَّ بِمَا عَمِلۡتُمۡۚ وَذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٞ ٧﴾ [التغابن: ٧]
“কাফেররা ধারণা করে যে, তারা কখনও পুণরুত্থিত হবে না। বলুন, অবশ্যই তা হবে, আমার পালনকর্তার কসম, নিশ্চয়ই তোমরা পুণরুত্থিত হবে। অতঃপর তোমাদেরকে অবহিত করানো হবে যা তোমরা করতে। এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ৭]
উপরন্তু সব আসমানী গ্রন্থ মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সংগঠিত হওয়ার ব্যাপারে একমত।
(খ) ইন্দ্রিয় শক্তির আলোকে প্রমাণ:
আল্লাহ তা‘আলা এ পৃথিবীতে মৃত ব্যক্তিদেরকে জীবিত করে তার বান্দাদের সম্মুখে প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেশ করেছেন। সূরা আল-বাক্বারাতে এর পাঁচটি দৃষ্টান্ত বর্ণিত হয়েছে।
প্রথম উদাহরণ: মূসা আলাইহিস সালামের ঘটনা। যখন মুসা আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈলের সত্তর জন লোককে মনোনীত করে তাঁর সঙ্গে তূর পর্বতে নিয়ে গেলেন। সেখানে পৌঁছে তারা আল্লাহর বাণী স্বয়ং শ্রবণ করেও ঈমান আনলো না বরং বলল, যতক্ষণ না আমরা আল্লাহকে প্রকাশ্য দেখবো ততক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাস করব না। এ ধৃষ্টতার জন্য তাদের ওপর বজ্রপাত হলো এবং সবাই ধ্বংস হয়ে গেল। অতঃপর মুসা আলাইহিস সালামের দো‘আয় আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে তাদেরকে পূণর্জীবিত করে ছিলেন। আল্লাহ বনী ইসরাঈলদেরকে সম্বোধন করে বলেন,
﴿وَإِذۡ قُلۡتُمۡ يَٰمُوسَىٰ لَن نُّؤۡمِنَ لَكَ حَتَّىٰ نَرَى ٱللَّهَ جَهۡرَةٗ فَأَخَذَتۡكُمُ ٱلصَّٰعِقَةُ وَأَنتُمۡ تَنظُرُونَ ٥٥ ثُمَّ بَعَثۡنَٰكُم مِّنۢ بَعۡدِ مَوۡتِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ٥٦﴾ [البقرة: ٥٥، ٥٦]
‘‘আর যখন তোমরা বললে, হে মুসা, কস্মিনকালেও আমরা তোমাকে বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না আমরা আল্লাহকে প্রকাশ্য দেখতে পাব। বস্তুতঃ তোমদেরকে পাকড়াও করল বজ্রপাত এবং তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে। তারপর মরে যাবার পর তোমাদিগকে পূনরায় জীবন দান করেছি, যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নাও।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৫৫-৫৬]
দ্বিতীয় উদাহরণ: একজন নিহত ব্যক্তির ঘটনা। বনী ইসরাঈলের মধ্যে একটি হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হয় এবং মুল হত্যাকারী কে? তা জানা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন আল্লাহ তাদেরকে একটি গরু জবাই করে তার একটি অংশ দ্বারা মৃত ব্যক্তিকে আঘাত করার আদেশ দিলেন। অতঃপর তারা সেভাবে আঘাত করলে ঐ ব্যক্তি জীবিত হয়ে উঠে এবং হত্যাকারীর নাম বলে দেয়। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِذۡ قَتَلۡتُمۡ نَفۡسٗا فَٱدَّٰرَٰٔتُمۡ فِيهَاۖ وَٱللَّهُ مُخۡرِجٞ مَّا كُنتُمۡ تَكۡتُمُونَ ٧٢ فَقُلۡنَا ٱضۡرِبُوهُ بِبَعۡضِهَاۚ كَذَٰلِكَ يُحۡيِ ٱللَّهُ ٱلۡمَوۡتَىٰ وَيُرِيكُمۡ ءَايَٰتِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ٧٣﴾ [البقرة: ٧٢، ٧٣]
“স্মরণ কর, যখন তোমরা এক ব্যক্তিকে হত্যা করলে, অতঃপর সে সম্পর্কে একে অপরকে অভিযুক্ত করেছিলে। তোমরা গোপন করতে চেয়েছ, তা প্রকাশ করে দেওয়া ছিল আল্লাহর অভিপ্রায়। অতঃপর আমি বললাম, গরুর একটি খণ্ড দ্বারা মৃতকে আঘাত কর। এভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং তোমাদেরকে তাঁর নির্দশনসমূহ প্রদর্শন করেন, যাতে তোমরা চিন্তা কর।” [সূরা আল-বাক্বারা, আয়াত: ৭২-৭৩]
তৃতীয় উদাহরণ: এ ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই যে, বনী ইসরাঈলের কিছু লোক কোনো এক শহরে বাস করতো, সেখানে কোনো মহামারী বা মারাত্মক রোগ-ব্যধির প্রাদুর্ভাব হয়। তখন তারা মৃত্যুর ভয়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে দু’টি পাহাড়ের মধ্যবর্তী এক প্রশস্ত ময়দানে গিয়ে বসবাস করতে লাগলো। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে এবং দুনিয়ার অন্যান্য, জাতিকে একথা অবগত করার জন্য যে, মৃত্যুর ভয়ে পালিয়ে গিয়ে কেউ রক্ষা পেতে পারে না, তাদের সবাইকে ঐ জায়গায় একসাথে মৃত্যু দিয়ে দিলেন এবং পরে তাদেরকে আবার জীবিত করেন।
এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَمۡ تَرَ إِلَى ٱلَّذِينَ خَرَجُواْ مِن دِيَٰرِهِمۡ وَهُمۡ أُلُوفٌ حَذَرَ ٱلۡمَوۡتِ فَقَالَ لَهُمُ ٱللَّهُ مُوتُواْ ثُمَّ أَحۡيَٰهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَذُو فَضۡلٍ عَلَى ٱلنَّاسِ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَشۡكُرُونَ ٢٤٣﴾ [البقرة: ٢٤٣]
“তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা মৃত্যুর ভয়ে নিজেদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল? আর তারা ছিল সংখ্যায় হাজার হাজার। তারপর আল্লাহ তাদেরকে বললেন, মরে যাও। তারপর আবার তাদেরকে জীবিত করে দিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের ওপর পরম অনুগ্রহশীল। কিন্তু অধিকাংশ লোক শুকরিয়া জ্ঞাপন করে না।” [সূরা আল-বাক্বারা, আয়াত: ২৪৩]
চতুর্থ উদাহরণ: সেই ব্যক্তির ঘটনা যে এক মৃত শহর দিয়ে যাচ্ছিল। অবস্থা দেখে সে ধারণা করল যে, আল্লাহ এই শহরকে আর জীবিত করতে পারবেন না। আল্লাহ তা‘আলা তাকে একশত বছর মৃত রাখেন। তারপর তাকে জীবিত করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন,
﴿أَوۡ كَٱلَّذِي مَرَّ عَلَىٰ قَرۡيَةٖ وَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَىٰ عُرُوشِهَا قَالَ أَنَّىٰ يُحۡيِۦ هَٰذِهِ ٱللَّهُ بَعۡدَ مَوۡتِهَاۖ فَأَمَاتَهُ ٱللَّهُ مِاْئَةَ عَامٖ ثُمَّ بَعَثَهُۥۖ قَالَ كَمۡ لَبِثۡتَۖ قَالَ لَبِثۡتُ يَوۡمًا أَوۡ بَعۡضَ يَوۡمٖۖ قَالَ بَل لَّبِثۡتَ مِاْئَةَ عَامٖ فَٱنظُرۡ إِلَىٰ طَعَامِكَ وَشَرَابِكَ لَمۡ يَتَسَنَّهۡۖ وَٱنظُرۡ إِلَىٰ حِمَارِكَ وَلِنَجۡعَلَكَ ءَايَةٗ لِّلنَّاسِۖ وَٱنظُرۡ إِلَى ٱلۡعِظَامِ كَيۡفَ نُنشِزُهَا ثُمَّ نَكۡسُوهَا لَحۡمٗاۚ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُۥ قَالَ أَعۡلَمُ أَنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ٢٥٩﴾ [البقرة: ٢٥٩]
‘‘তুমি কি সে লোককে দেখনি, যে এমন এক জনপদ দিয়ে যাচ্ছিল, যার ঘর-বাড়িগুলো ধ্বংস-স্তুপে পরিণত হয়েছিল। বলল, কেমন করে আল্লাহ মরণের পর একে জীবিত করবেন? অতঃপর আল্লাহ তাকে মৃত অবস্থায় রাখলেন একশত বছর। তারপর তাকে পুনঃর্জীবিত করে বললেন, কতকাল মৃত ছিলে? বলল, আমি মৃত ছিলাম একদিন কিংবা একদিনের কিছু কম সময়। আল্লাহ বললেন, তা নয়! বরং তুমি তো একশত বছর মৃত ছিলে। এবার চেয়ে দেখ নিজের খাবার ও পানীয় দ্রব্যের দিকে, সেগুলো পঁচে যায় নি এবং দেখ, নিজের গাধাটির দিকে। আর আমি তোমাকে মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বানাতে চেয়েছি। আর হাড়গুলোর দিকে চেয়ে দেখ, আমি এগুলোকে কেমন করে জুড়ে দেই এবং সেগুলোর ওপর মাংসের আবরণ কীভাবে পরিয়ে দেই। অতঃপর যখন তার ওপর এ অবস্থা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হল, তখন বলে উঠল, আমি জানি, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সব কিছুর ওপর সর্ব শক্তিমান।” [সূরা আল-বাক্বারা, আয়াত: ২৫৯]
পঞ্চম উদাহরণ: ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ঘটনা, যখন তিনি আল্লাহ তা‘আলার কাছে আরয করলেন, তিনি কীভাবে মৃতকে পূনঃর্জীবিত করেন, তখন আল্লাহ তাকে তা প্রত্যক্ষ করান।
আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন চারটি পাখী জবাই করে সেগুলোর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পার্শ্ববর্তী পাহাড়গুলোর ওপর ছড়িয়ে-ছিঠিয়ে দেন। এরপর তাদের ডাক দিলে দেখা যাবে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো একত্রিত হয়ে পূর্ণ আকারে ইবরাহীমের দিকে ধাবিত হয়ে আসছে।
আল্লাহ তা‘আলা ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন,
﴿وَإِذۡ قَالَ إِبۡرَٰهِۧمُ رَبِّ أَرِنِي كَيۡفَ تُحۡيِ ٱلۡمَوۡتَىٰۖ قَالَ أَوَ لَمۡ تُؤۡمِنۖ قَالَ بَلَىٰ وَلَٰكِن لِّيَطۡمَئِنَّ قَلۡبِيۖ قَالَ فَخُذۡ أَرۡبَعَةٗ مِّنَ ٱلطَّيۡرِ فَصُرۡهُنَّ إِلَيۡكَ ثُمَّ ٱجۡعَلۡ عَلَىٰ كُلِّ جَبَلٖ مِّنۡهُنَّ جُزۡءٗا ثُمَّ ٱدۡعُهُنَّ يَأۡتِينَكَ سَعۡيٗاۚ وَٱعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٞ ٢٦٠﴾ [البقرة: ٢٦٠]
‘‘এবং স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম বলল, হে আমার রব! আমাকে দেখাও, কেমন করে তুমি মৃতকে জীবিত কর। বললেন, তুমি কি তা ঈমান আনয়ন কর নি? বলল, অবশ্যই বিশ্বাস করি, কিন্তু এজন্য দেখতে চাই যাতে অন্তরে প্রশান্তি লাভ করতে পারি। বললেন, তাহলে চারটি পাখী ধরে নাও। পরে সেগুলোকে কেটে টুকরো টুকরো করে নাও। অতঃপর সেগুলোর দেহের একেকটি অংশ বিভিন্ন পাহাড়ের উপর রেখে দাও। তারপর সেগুলোকে ডাক। দেখবে, সেগুলো (জীবিত হয়ে) তোমার নিকট দৌড়ে আসবে। আর জেনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, অতি জ্ঞানসম্পন্ন।” [সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২৬০]
এ সকল বাস্তব ইন্দ্রিয়গত উদাহরণ যা মৃতদের পুনরায় জীবিত করা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে। ইতোপূর্বে মৃতকে জীবিত করা এবং কবর থেকে পুণরুত্থিত করা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম নিদর্শন ঈসা ইবন মারিয়াম আলাইহিমাস সালামের মু‘জিযার প্রতি ঈঙ্গিত করা হয়েছে।
(গ) যুক্তির আলোকে পুণরুত্থানের প্রমাণসমূহ এবং সেগুলো দু’ভাবে উপস্থাপন করা যায়:
এক: নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা নভোমণ্ডল ও ভুমণ্ডল এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছুর স্রষ্টা। আর যিনি প্রথমবার এগুলো সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে কোনো ক্লান্তিবোধ করেন নি, তিনি কি পুনরুত্থানে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে অক্ষম? না তিনি অক্ষম নন; বরং তা তো আরো সহজ। আর তিনি সর্বশক্তিমান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَهُوَ ٱلَّذِي يَبۡدَؤُاْ ٱلۡخَلۡقَ ثُمَّ يُعِيدُهُۥ وَهُوَ أَهۡوَنُ عَلَيۡهِۚ وَلَهُ ٱلۡمَثَلُ ٱلۡأَعۡلَىٰ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۚ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ٢٧﴾ [الروم: ٢٧]
‘‘তিনিই প্রথমবার সৃষ্টিকে অস্তিত্বে আনয়ন করেন, অতঃপর পুনর্বার তিনিই সৃষ্টি করবেন। এটা তাঁর জন্য অধিকতর সহজ। আকাশ ও পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মর্যাদা তাঁরই এবং তিনিই পরাক্রমাশালী প্রজ্ঞাময়।” [সূরা রূম, আয়াত: ২৭]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿كَمَا بَدَأۡنَآ أَوَّلَ خَلۡقٖ نُّعِيدُهُۥۚ وَعۡدًا عَلَيۡنَآۚ إِنَّا كُنَّا فَٰعِلِينَ﴾ [الانبياء: ١٠٤]
‘‘যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম সেভাবে আমি পুনরায় সৃষ্টি করব। আমার ওয়াদা নিশ্চিত, আমি অবশ্যই তা পূর্ণ করব।” [সূরা আল-আম্বিয়া আয়াত: ১০৪]
যে ব্যক্তি পঁচে-গলে যাওয়া হাড্ডি পুনর্জীবিত হওয়াকে অস্বীকার করে, আল্লাহ তা‘আলা তার উত্তর প্রদানের জন্য তাঁর নবীকে নির্দেশ দিয়ে বলেন,
﴿وَضَرَبَ لَنَا مَثَلٗا وَنَسِيَ خَلۡقَهُۥۖ قَالَ مَن يُحۡيِ ٱلۡعِظَٰمَ وَهِيَ رَمِيمٞ ٧٨ قُلۡ يُحۡيِيهَا ٱلَّذِيٓ أَنشَأَهَآ أَوَّلَ مَرَّةٖۖ وَهُوَ بِكُلِّ خَلۡقٍ عَلِيمٌ ٧٩ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُم مِّنَ ٱلشَّجَرِ ٱلۡأَخۡضَرِ نَارٗا فَإِذَآ أَنتُم مِّنۡهُ تُوقِدُونَ ٨٠ أَوَ لَيۡسَ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ بِقَٰدِرٍ عَلَىٰٓ أَن يَخۡلُقَ مِثۡلَهُمۚ بَلَىٰ وَهُوَ ٱلۡخَلَّٰقُ ٱلۡعَلِيمُ ٨١﴾ [يس: ٧٨، ٨١]
‘‘সে আমার সম্পর্কে এক অদ্ভুত কথা বর্ণনা করে অথচ সে নিজের সৃষ্টি ভুলে যায়। সে বলে, কে জীবিত করবে অস্থিসমূহকে যখন সেগুলো পঁচে গলে যাবে? বলুন, যিনি প্রথমবার এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন তিনিই পুনরায় সেগুলোকে জীবিত করবেন। তিনি সর্বপ্রকার সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক অবগত।” [সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ৭৮-৭৯]
দুই: জমীন কখনও কখনও সবুজ বৃক্ষ, তৃন-লতাহীন পতিত হয়ে পড়ে। আল্লাহ তা‘আলা তখন বৃষ্টি বর্ষণ করে পুনরায় তাকে জীবিত ও সবুজ-শ্যামল করে তুলেন। যিনি এই জমিনকে মরে যাওয়ার পর জীবিত করতে সক্ষম তিনি নিশ্চয়ই মৃত প্রাণীদেরকে পুনরায় জীবন্ত করতে সম্পূর্ণ সক্ষম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦٓ أَنَّكَ تَرَى ٱلۡأَرۡضَ خَٰشِعَةٗ فَإِذَآ أَنزَلۡنَا عَلَيۡهَا ٱلۡمَآءَ ٱهۡتَزَّتۡ وَرَبَتۡۚ إِنَّ ٱلَّذِيٓ أَحۡيَاهَا لَمُحۡيِ ٱلۡمَوۡتَىٰٓۚ إِنَّهُۥ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٌ ٣٩﴾ [فصلت: ٣٩]
“তাঁর এক নিদর্শন এই যে, তুমি ভূমিকে দেখবে অনুর্বর পড়ে আছে। অতঃপর আমি যখন তার উপর বৃষ্টি বর্ষণ করি তখন তা সবুজ-শ্যামল ও স্ফীত হয়ে উঠে। নিশ্চয়ই যিনি একে জীবিত করেন তিনি জীবিত করবেন মৃতুদেরকেও। নিশ্চয়ই তিনি সব কিছু করতে সক্ষম।” [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৩৯]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَنَزَّلۡنَا مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ مُّبَٰرَكٗا فَأَنۢبَتۡنَا بِهِۦ جَنَّٰتٖ وَحَبَّ ٱلۡحَصِيدِ ٩ وَٱلنَّخۡلَ بَاسِقَٰتٖ لَّهَا طَلۡعٞ نَّضِيدٞ ١٠ رِّزۡقٗا لِّلۡعِبَادِۖ وَأَحۡيَيۡنَا بِهِۦ بَلۡدَةٗ مَّيۡتٗاۚ كَذَٰلِكَ ٱلۡخُرُوجُ ١١﴾ [ق: ٩، ١١]
“এবং আমি আকাশ থেকে বরকতময় বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং তদ্বারা বাগান ও পরিপক্ষ শষ্যরাজি উদ্গত করি। আর সৃষ্টি করি সমুন্নত খর্জুর বৃক্ষ, যাতে থাকে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর আমার বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ; বৃষ্টির দ্বারা আমি সঞ্জীবিত করি মৃত ভূমিকে। এভাবে পুনরুত্থান ঘটবে।” [সূরা ক্বাফ, আয়াত: ৯-১১]
আরও একটি সন্দেহ ও তাঁর অপনোদন:
পথভ্রষ্ট একটি সম্প্রদায় কবরের আযাব ও তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে অস্বীকার করে। তাদের ধারণা এটা অসম্ভব ও বাস্তবতা বিরোধী। তারা বলে, কোনো সময় কবর উন্মুক্ত করা হলে দেখা যায়, মৃত ব্যক্তি যেমন ছিল তেমনই আছে। কবরের পরিসর বৃদ্ধি পায় নি বা তা সংকুচিতও হয় নি।
বস্তুত এ ধরনের সন্দেহ শরী‘আত, ইন্দ্রিয়শক্তি ও যুক্তির বিচারে তাদের এ ধারণা বাতিল:
শরী‘আতের প্রমাণ: কবরের শাস্তি ও এর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রমাণ হিসাবে ইতোপূর্বে কুরআন ও হাদীসের উদ্ধৃতিসমূহ ‘শেষ দিবসের উপর ঈমান’ পরিচ্ছদে (খ) প্যারায় উল্লেখ করা হয়েছে।
সহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বাগানের পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি দু’জন লোকের আওয়াজ শুনতে পেলেন, যাদেরকে তাদের কবরে শাস্তি দেওয়া হচ্ছিল...। এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ্ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আযাবের কারণ উল্লেখ করে বললেন, এদের একজন প্রস্রাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতো না এবং অপরজন চোগলখুরী করতো।
ইন্দ্রিয়শক্তির আলোকে এর প্রমাণ:
যেমন, ঘুমন্ত ব্যক্তি স্বপ্নে হয়ত একটা প্রশস্ত বাগান বা ময়দান দেখতে পায় এবং সেখানে শান্তি উপভোগ করতে থাকে। আবার কখনও সে দেখে যে, কোনো বিপদে পতিত হয়ে ভীষণ কষ্টে অস্থির হয়ে উঠে এবং অনেক সময় ভয়ে জাগ্রত হয়ে যায় অথচ সে নিজ বিছানার উপর পূর্বাবস্থায় বহাল রয়েছে।
বলা হয়, ‘‘নিদ্রা মৃত্যুর সমতুল্য।” এজন্য আল্লাহ তা‘আলা নিদ্রাকে মৃত্যু বলেছেন। আল্লাহ বলেন,
﴿ٱللَّهُ يَتَوَفَّى ٱلۡأَنفُسَ حِينَ مَوۡتِهَا وَٱلَّتِي لَمۡ تَمُتۡ فِي مَنَامِهَاۖ فَيُمۡسِكُ ٱلَّتِي قَضَىٰ عَلَيۡهَا ٱلۡمَوۡتَ وَيُرۡسِلُ ٱلۡأُخۡرَىٰٓ إِلَىٰٓ أَجَلٖ مُّسَمًّىۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ ٤٢﴾ [الزمر: ٤٢]
“আল্লাহ মানুষের প্রাণ হরণ করেন তার মৃত্যুর সময়। আর যে মরে না তার নিদ্রাকালে। অতঃপর যার মৃত্যু অবধারিত করেন,তার প্রাণ ছাড়েন না এবং অন্যান্যদের ছেড়ে দেন এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৪২]
যুক্তি বা বুদ্ধির আলোকে কবরের শাস্তি ও শান্তির প্রমাণ:
ঘুমন্ত ব্যক্তি কখনো এমন সত্য স্বপ্ন দেখে থাকে যা বাস্তবের সাথে মিলে যায় এবং হয়ত বা সে কখনো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর প্রকৃত আকৃতিতে স্বপ্নে দেখল। আর যে রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর প্রকৃত আকৃতিতে স্বপ্নে দেখে, সে অবশ্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই দেখেছে। অথচ তখন সে নিজ কক্ষে আপন বিছানায় শায়িত। দুনিয়ার ব্যাপারে এসব সম্ভব হলে আখেরাতের ব্যাপারে কেন সম্ভব হবে না?
আর যে ধারণার ওপর নির্ভর করে তারা বলে যে, অনেক সময় কবর উন্মুক্ত করা হলে দেখা যায় যে, মৃত ব্যক্তি যেমন ছিল তেমনই আছে। কবরের পরিসর বৃদ্ধি পায় নি বা তা সংকুচিতও হয় নি। তাদের এ ভ্রান্ত ধারণার জবাব কয়েক ভাবে দেওয়া যায়। যেমন,
১। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো কাজের আদেশ করলে বা কোনো ব্যাপারে সংবাদ দিলে তা মান্য ও বিশ্বাস করা ছাড়া ঈমানদার নর-নারীর ভিন্ন কোনো ক্ষমতা থাকে না। বিশেষ করে এজাতীয় অমূলক ক্ষেত্রে। যদি অস্বীকার কারী ব্যক্তি শরী‘আত কর্তৃক বর্ণিত বিষয়সমূহে যথাযথ চিন্তা-ভাবনা করে তা হলে সে এসব সন্দেহ-সংশয়ের অসারতা অনুধাবন করতে পারবে। আরবীতে বলা হয়,
وكم من عائب قولا صحيحا وآفته من الفهم السقيم
‘‘অনেকেই বিশুদ্ধ বক্তব্যের মধ্যে দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ায় অথচ প্রকৃত দোষ বা বিপদ তার রুগ্ন বুদ্ধিমত্তাতেই নিহিত রয়েছে।”
২। কবরের অবস্থাসমূহ গায়েব বা অদৃশ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। ইন্দ্রিয়শক্তির মাধ্যমে তা উপলব্দি করা অসম্ভব। যদি ইন্দ্রিয় বা অনুভূতির মাধ্যমে উপলব্ধি করা যেতো তা হলে ঈমান বিল গায়বের আর প্রয়োজন হতো না এবং এ কারণে গায়েবে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী একই পর্যায়ভুক্ত হয়ে যাবে।
৩। কবরের শান্তি ও শাস্তি এবং প্রশস্ততা ও সংকীর্ণতা কেবল কবরবাসী মৃত ব্যক্তিই অনুভব করে, অন্যেরা নয়। যেমন ঘুমন্ত ব্যক্তি স্বপ্নে কোনো বিপদে পতিত হয়ে ভীষণ কষ্টে অস্থির হতে থাকে; কিন্তু নিকটে উপবিষ্ট ব্যক্তি মোটেই তা টের পায় না। অনুরূপ সমবেত সাহাবায়ে কেরামের মাঝে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি যখন ওহী অবতীর্ণ হতো তখন তিনি তা শুনতেন ও কন্ঠস্থ করতেন; কিন্তু সাহাবীগণ কিছুই শুনতেন না। অনেক সময় জিবরীল আলাইহিস সালাম ওহী নিয়ে আগমন করতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাঠ করে শুনাতেন। তিনি শুনতেন, ও দেখতেন; কিন্তু সাহাবীগণ টেরও পেতেন না।
৪। মানুষের জ্ঞান অতি সামান্য ও সীমিত। সৃষ্টির অনেক বস্তু মানুষের ইন্দ্রিয় ও চেতনা এবং জ্ঞানের ঊর্ধে।
এভাবে সপ্তাকাশ, জমিন ও এতদুভয়ের সব বস্তু সত্যিকারার্থে আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করে কিন্তু তা আমাদের বোধশক্তি ও অনুভূতির উর্ধ্বে, সাধারণ মানুষের তা শ্রুতিগোচর হয় না। যেমন; আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿تُسَبِّحُ لَهُ ٱلسَّمَٰوَٰتُ ٱلسَّبۡعُ وَٱلۡأَرۡضُ وَمَن فِيهِنَّۚ وَإِن مِّن شَيۡءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمۡدِهِۦ وَلَٰكِن لَّا تَفۡقَهُونَ تَسۡبِيحَهُمۡۚ إِنَّهُۥ كَانَ حَلِيمًا غَفُورٗا ٤٤﴾ [الاسراء: ٤٤]
‘‘সপ্তাকাশ ও পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে সমস্ত কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর প্রশংসা, পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না। কিন্তু তাদের পবিত্রতা, মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না। নিশ্চয় তিনি অতি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ। [সূরা আশ-শু‘আরা আয়াত: ৪৪]
আর এভাবেই শয়তান ও জ্বিনদের পৃথিবীতে গমনাগমন। জিন্নদের একদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত হয়ে নীরবে কুরআন শ্রবণ করার পর ইসলাম গ্রহণ করে এবং আপন সম্প্রদায়ের প্রতি ভীতিপ্রদর্শনকারী হিসেবে প্রত্যাবর্তন করে। এতদসত্বেও তারা আমাদের দৃষ্টির অগোচরে। এই সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰبَنِيٓ ءَادَمَ لَا يَفۡتِنَنَّكُمُ ٱلشَّيۡطَٰنُ كَمَآ أَخۡرَجَ أَبَوَيۡكُم مِّنَ ٱلۡجَنَّةِ يَنزِعُ عَنۡهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوۡءَٰتِهِمَآۚ إِنَّهُۥ يَرَىٰكُمۡ هُوَ وَقَبِيلُهُۥ مِنۡ حَيۡثُ لَا تَرَوۡنَهُمۡۗ إِنَّا جَعَلۡنَا ٱلشَّيَٰطِينَ أَوۡلِيَآءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ ٢٧﴾ [الاعراف: ٢٧]
“হে আদম সন্তান! শয়তান যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত না করে, যেমন সে তোমাদের পিতা-মাতাকে (বিভ্রান্ত করে) জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছিল, এমতাবস্থায় যে, তাদের পোষাক তাদের থেকে খুলিয়ে দিয়েছিল যাতে তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখিয়ে দেয়। সে এবং তার দলবল তোমাদেরকে দেখে যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখ না। আমি শয়তানদেরকে তাদের বন্ধু করে দিয়েছি, যারা ঈমান আনে না।” [সূরা আল আ‘রাফ, আয়াত: ২৭]
আর যখন সৃষ্টিলোক পৃথিবীতে বিরাজমান সবকিছু উপলব্ধি করতে পারে না, তখন তাদের পক্ষে তাদের উপলব্ধির বাইরে বিরাজমান যে সব গায়েবী বিষয়াদি রয়েছে সেগুলো অস্বীকার করা কোনোভাবেই বৈধ হবে না।
ঈমাননের ষষ্ঠ ভিত্তি
ঈমান বিল ক্বাদার অর্থাৎ তাকদীরের উপর ঈমান
শরী‘আতের পরিভাষায় ‘ক্বাদর (قدر) শব্দের অর্থ: আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক স্বীয় হিকমত ও জ্ঞান অনুসারে সৃষ্টিকুলের জন্য সবকিছু নির্ধারণ।
তাকদীরের উপর ঈমানের মধ্যে নিম্নোক্ত চারটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে,
প্রথম: ঈমান আনা যে, অনাদিকাল হতে অনন্তকাল পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের ও তাঁর বান্দাদের কার্যাবলী সংশ্লিষ্ট সব কিছু সম্পর্কে সামগ্রিক ও বিশেষভাবে অবগত আছেন।
দ্বিতীয়: এ ঈমান আনা যে আল্লাহ তা‘আলা যা কিছু নির্ধারণ ও সম্পাদন করেছেন সব কিছুই তিনি তাঁর লাওহে মাহফুযে (সংরক্ষিত ফলকে) লিখে রেখেছেন।
এ দু’টো বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ مَا فِي ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِۚ إِنَّ ذَٰلِكَ فِي كِتَٰبٍۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٞ ٧٠﴾ [الحج: ٧٠]
“তোমার কি জানা নেই, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে আল্লাহ তা অবগত আছেন। নিশ্চয়ই তা একটি কিতাবে সংরক্ষিত আছে। তা আল্লাহর নিকট অতি সহজ।” [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৭০]
‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবনুল ‘আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তা‘আলা আসমান ও জমিন সৃষ্টি করার পঞ্চাশ হাজার বছর আগে সমগ্র সৃষ্টি জগতের তাকদীর লিপিবদ্ধ করেছেন। (সহীহ মুসলিম)
তৃতীয়: এই ঈমান স্থাপন করা যে, বিশ্বজগতের কোনো কিছুই আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ব্যতীত সংঘটিত হয় না। সেটি তাঁর নিজের কার্যসম্পর্কিত হোক অথবা তাঁর সৃষ্টির কার্যসম্পর্কিত হোক।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কার্যাদি সম্পর্কে বলেন,
﴿وَرَبُّكَ يَخۡلُقُ مَا يَشَآءُ وَيَخۡتَارُۗ﴾ [القصص: ٦٨]
“আপনার রব যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৬৮]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿وَيَفۡعَلُ ٱللَّهُ مَا يَشَآءُ ﴾ [ابراهيم: ٢٧]
“আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।” [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ২৭]
তিনি আরো বলেন,
﴿هُوَ ٱلَّذِي يُصَوِّرُكُمۡ فِي ٱلۡأَرۡحَامِ كَيۡفَ يَشَآءُۚ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ٦﴾ [ال عمران: ٦]
“তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি তোমাদের আকৃতি গঠন করেন মায়ের গর্ভে যেমন তিনি ইচ্ছা করেন। তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য উপাস্য নেই। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬]
মাখলুকাতের কর্ম-কাণ্ড সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ لَسَلَّطَهُمۡ عَلَيۡكُمۡ فَلَقَٰتَلُوكُمۡۚ﴾ [النساء: ٩٠]
“যদি আল্লাহ ইচ্ছে করতেন তবে তোমাদের ওপর তাদেরকে প্রবল করে দিতেন। ফলে তারা অবশ্যই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করত।” [সূরা নিসা, আয়াত: ৯০]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ مَا فَعَلُوهُۖ فَذَرۡهُمۡ وَمَا يَفۡتَرُونَ﴾ [الانعام: ١٣٧]
“যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তারা একাজ করত না। অতএব, আপনি তাদেরকে এবং তাদের বানোয়াট বুলিকে পরিত্যাগ করুন।” [সূরা আল- আন‘আম, আয়াত: ১৩৭]
চতুর্থ: ঈমান স্থাপন করা যে, সমগ্র সৃষ্টিজগৎ, তাদের সত্তা, গুণ এবং কর্ম তৎপরতাসহ সবই আল্লাহর সৃষ্ট।
আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে বলেন,
﴿ٱللَّهُ خَٰلِقُ كُلِّ شَيۡءٖۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ وَكِيلٞ ٦٢﴾ [الزمر: ٦٢]
“আল্লাহ প্রতিটি বস্তুর সৃষ্টিকর্তা এবং তিনিই সব কিছুর তত্ত্বাবধায়ক।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৬২]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿وَخَلَقَ كُلَّ شَيۡءٖ فَقَدَّرَهُۥ تَقۡدِيرٗا﴾ [الفرقان: ٢]
“তিনি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করেছেন, তারপর তা নির্ধারণ করেছেন পরিমিতভাবে।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ২]
আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন যে, তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছেন,
﴿وَٱللَّهُ خَلَقَكُمۡ وَمَا تَعۡمَلُونَ ٩٦﴾ [الصافات: ٩٦]
‘‘আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা যে সব কর্ম সম্পাদন করছো সবই তিনি সৃষ্টি করেছেন।” [সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ৯৬]
পূর্বেই আমরা বর্ণনা করেছি যে ‘‘ঈমান বিল ক্বদার’’ বা তাক্বদীরের প্রতি ঈমান স্থাপন করার কারণে মানুষের কর্মসমূহের ওপর তার ইচ্ছা ও ক্ষমতার বিষয়টি সাংঘর্ষিক নয়। কেননা, শরী‘আত ও বাস্তব অবস্থা বান্দার নিজস্ব যে ইচ্ছাশক্তি রয়েছে তা সাব্যস্ত করে।
১। শরীয়াতের প্রমাণ:
আল্লাহ তা‘আলা বান্দার ইচ্ছা প্রসঙ্গে বলেন,
﴿ذَٰلِكَ ٱلۡيَوۡمُ ٱلۡحَقُّۖ فَمَن شَآءَ ٱتَّخَذَ إِلَىٰ رَبِّهِۦ مََٔابًا ٣٩﴾ [النبا: ٣٩]
“এই দিবস সত্য। সুতরাং যার ইচ্ছা সে তার রবের নিকট তার ঠিকানা তৈরী করুক।” [সূরা আন-নাবা: ৩৯]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَأۡتُواْ حَرۡثَكُمۡ أَنَّىٰ شِئۡتُمۡۖ﴾ [البقرة: ٢٢٣]
“অতএব তোমরা তোমাদের শষ্য-ক্ষেত্রে (স্ত্রীদের কাছে) যেভাবে ইচ্ছা গমন কর।” [সূরা আল-বাক্বারা, আয়াত: ২২৩]
আল্লাহ তা‘আলা বান্দার সামর্থ্য সম্পর্কে আরো বলেন,
﴿فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُمۡ﴾ [التغابن: ١٦]
‘‘অতএব, তোমরা আল্লাহর যথাসাধ্য তাকওয়া অবলম্বন কর।” [সূরা আত-তাগাবূন, আয়াত: ১৬]
আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
﴿لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفۡسًا إِلَّا وُسۡعَهَاۚ﴾ [البقرة: ٢٨٦]
“আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের দায়িত্ব দেন না, সে তাই পায় যা সে উপার্জন করে এবং তাই তার ওপর বর্তায় যা সে করে।’’ [সূরা আল-বাক্বারা, আয়াত: ২৮৬]
২। বাস্তবতার আলোকে এর প্রমাণ:
প্রত্যেক মানুষ জানে যে, তার নিজেস্ব ইচ্ছাশক্তি ও সামর্থ্য রয়েছে এবং এরই মাধ্যমে সে কোনো কাজ করে বা তা থেকে বিরত থাকে। যে সব কাজ তার ইচ্ছায় সংঘঠিত হয় যেমন, চলাফেরা করা এবং যা তার অনিচ্ছায় হয়ে থাকে যেমন, হঠাৎ করে শরীর প্রকম্পিত হওয়া। এ উভয় অবস্থার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা সে পার্থক্যও করতে পারে।
তবে বান্দার ইচ্ছা ও সামর্থ্য আল্লাহর ইচ্ছা ও সামর্থ্যের অধীন ও অনুগত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لِمَن شَآءَ مِنكُمۡ أَن يَسۡتَقِيمَ ٢٨ وَمَا تَشَآءُونَ إِلَّآ أَن يَشَآءَ ٱللَّهُ رَبُّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٢٩﴾ [التكوير: ٢٨، ٢٩]
‘‘যে সরল পথে চলার ইচ্ছা করে (এ ঘোষণা) তার জন্য, আর আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের ইচ্ছার বাইরে তোমাদের কোনো ইচ্ছা কার্যকর হতে পারে না।” [সূরা তাকওয়ীর: ২৮-২৯]
যেহেতু সমগ্র বিশ্বজগৎ আল্লাহ তা‘আলার রাজত্ব, তাই তাঁর রাজত্বে তাঁর অজানা কিছু ঘটতে পারে না।
আমাদের উল্লিখিত বর্ণনানুযায়ী তাক্বদীরের ওপর বিশ্বাস বান্দাকে তার ওপর অর্পিত ওয়াজিব আদায় না করার অথবা তাক্বদীরের কথা বলে পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কোনো সুযোগ প্রদান করে না। সুতরাং তাক্বদীরের ওপর বিশ্বাস করে এই ধরণের যুক্তি উপস্থাপন করা কয়েকটি কারণে বাতিল বলে বিবেচিত হবে। তন্মধ্যে কয়েকটি প্রমাণ নিম্নে বর্ণনা করা হলো:
প্রথম: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿سَيَقُولُ ٱلَّذِينَ أَشۡرَكُواْ لَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ مَآ أَشۡرَكۡنَا وَلَآ ءَابَآؤُنَا وَلَا حَرَّمۡنَا مِن شَيۡءٖۚ كَذَٰلِكَ كَذَّبَ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡ حَتَّىٰ ذَاقُواْ بَأۡسَنَاۗ قُلۡ هَلۡ عِندَكُم مِّنۡ عِلۡمٖ فَتُخۡرِجُوهُ لَنَآۖ إِن تَتَّبِعُونَ إِلَّا ٱلظَّنَّ وَإِنۡ أَنتُمۡ إِلَّا تَخۡرُصُونَ ١٤٨﴾ [الانعام: ١٤٨]
“যারা শির্ক করছে তারা অচিরেই বলবে, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তবে আমরা এবং আমাদের পূর্বপুরুষগণ শির্ক করতাম না এবং না আমরা কোনো বস্তুকে হারাম করতাম। এমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তীরা মিথ্যারোপ করেছে, শেষ পর্যন্ত তারা আমার শাস্তি আস্বাদন করেছে। আপনি বলুন, তোমাদের কাছে কি কোনো প্রমাণ আছে, যা আমাদেরকে দেখাতে পার? তোমরা শুধুমাত্র আন্দাজের অনুসরণ কর এবং তোমরা শুধু অনুমান করে কথা বল।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৪৮]
এতে বুঝা গেল যে, পাপ কাজ করার জন্য তাক্বদীরকে প্রমাণ হিসাবে পেশ করা যদি বৈধ হত তবে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাদের অবাধ্যতার কারণে শাস্তি দিতেন না।
দ্বিতীয়: আল্লাহ বলেন,
﴿رُّسُلٗا مُّبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى ٱللَّهِ حُجَّةُۢ بَعۡدَ ٱلرُّسُلِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمٗا ١٦٥﴾ [النساء: ١٦٥]
‘‘রাসূলগণকে সুসংবাদ দাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূলগণের পরে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করার মতো কোনো অবকাশ মানুষের জন্য না থাকে। আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৬৫]
যদি তাক্বদীর পথভ্রষ্ট লোকদের জন্য পাপ কাজ করার প্রমাণ হতো তা হলে নবী-রসূলগণ প্রেরিত হওয়ার পর এ প্রমাণকে উঠিয়ে নেওয়া হতো না। কেননা, নবী এবং রাসূলগণের আগমনের পরেও অবাধ্যতা ত্বাকদীরের কারণে সংঘটিত হচ্ছে।
তৃতীয়: সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আলী ইবন আবু তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের মধ্যে এমন কোনো লোক নেই, যার ঠিকানা জান্নাতে বা জাহান্নামে লেখা হয় নি। উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে একলোক বলল, হে আল্লাহর রাসূল! তাহলে আমরা কি ভাগ্যের ওপর তাওয়াক্কুল তথা ভরসা করে থাকব না? রাসূলুল্লাহ তদুত্তোরে বললেন, না, আমল করতে থাক, যাকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে, সে তা সহজ পাবে। তারপর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করলেন:
﴿فَأَمَّا مَنۡ أَعۡطَىٰ وَٱتَّقَىٰ ٥ وَصَدَّقَ بِٱلۡحُسۡنَىٰ ٦ فَسَنُيَسِّرُهُۥ لِلۡيُسۡرَىٰ ٧﴾ [الليل: ٥، ٧]
“আর যে দান করে, আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যা উত্তম তা সত্য বলে মেনে চলে, আমরা তার জন্য সুগম করে দেব সহজ পথ।” [সূরা আল-লাইল আয়াত: ৫-৭]
সহীহ মুসলিমের হাদীসে এভাবে এসেছে যে,
«كُلٌّ مُيَسَّرٌ لِمَا خُلِقَ لَهُ»
“যে যার জন্য সৃষ্ট তা তার জন্য সহজ।”
তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলকে কাজ করে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাক্কদীরের ওপর ভর করে থাকতে নিষেধ করেছেন।
চতুর্থ: আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে কতিপয় বিষয়ের আদেশ এবং কতিপয় বিষয় থেকে নিষেধ করেছেন। তাকে তার ক্ষমতা ও সাধ্যের বাইরে কিছুই করতে বলেন নি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُمۡ﴾ [التغابن: ١٦]
“অতএব, তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর।” [সূরা আত-তাগাবুন: ১৬]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفۡسًا إِلَّا وُسۡعَهَاۚ﴾ [البقرة: ٢٨٦]
“আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের দায়িত্ব দেন না” [সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২৮৬]
যদি বান্দা কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে বাধ্যই থাকত, তাহলে তাকে তার সাধ্য ও ক্ষমতার বহির্ভূত এমন কাজের নির্দেশ দেওয়া হতো যা থেকে তার রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় থাকতো না। আর সেটা বাতেল। তাই বান্দা ভুল, অজ্ঞতাবশতঃ অথবা জোরপূর্বক অনিচ্ছাকৃত কোনো অপরাধ করলে তাতে তার পাপ হয় না।
পঞ্চম: আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত তাক্বদীর সম্পর্কে বান্দার কোনো জ্ঞান নেই। তা গায়েবী জগতের এক গোপন রহস্য। তক্বদীরের বিষয় সংঘটিত হওয়ার পরই কেবল বান্দা তা জানতে পারে। বান্দার ইচ্ছা তার কাজের পূর্বে হয়ে থাকে; তাই তার ইচ্ছা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত তাক্বদীর জানার ওপর ভিত্তি করে হয় না। এমতাবস্থায় তাক্বদীরের দোহাই দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না। আর যে বিষয় বান্দার জানা নেই সে বিষয়ে তার জন্য প্রমাণ হতে পারে না।
ষষ্ঠ: আমরা লক্ষ্য করি, মানুষ পার্থিব বিষয়ে সদাসর্বদা যথোপযুক্ত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আগ্রহী হয়ে থাকে। কখনও ক্ষতিকর ও অলাভজনক কাজে পা বাড়ায় না এবং তখন তাকদীরের দোহাইও দেয় না। তা হলে ধর্মীয় কাজে উপকারী দিক ছেড়ে দিয়ে ক্ষতিকর ও নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়ে তাক্বদীরের দোহাই দেওয়া হয় কেন? ব্যাপারটা কি উভয় ক্ষেত্রে এক নয়?
প্রিয় পাঠক, আপনার সম্মুখে দুটি উদাহরণ পেশ করছি যা বিষয়টি স্পষ্ট করে দিবে:
প্রথম উদাহরণ: যদি কারো সামনে দুটি পথ থাকে। এক পথ তাকে এমন এক দেশে নিয়ে পৌঁছাবে যেখানে শুধু নৈরাজ্য, খুন-খারাবী, লুটপাট, ভয়-ভীতি ও দূর্ভিক্ষ বিরাজমান। দ্বিতীয় পথ তাকে এমন স্বপ্নের শহরে নিয়ে যাবে যেখানে শৃঙ্খলা নিরাপত্তা, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও জান-মালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিদ্যমান। এমতাবস্থায় সে কোনো পথে চলবে? নিশ্চিতভাবে বলা যাবে যে, সে দ্বিতীয় পথে চলবে, যে পথে শান্তি ও আইন-শৃঙ্খলা বলবৎ রয়েছে। কোনো বুদ্ধিমান লোক প্রথম পথে পা দিয়ে ভাগ্যের দোহাই দিবে না। তাহলে মানুষ আখিরাতের ব্যাপারে জান্নাতের পথ ছেড়ে জাহান্নামের পথে চলে ক্বদরের দোহাই দিবে কেন?
দ্বিতীয় উদাহরণ: রোগীকে ঔষধ সেবন করতে বললে তা তিক্ত হলেও সে সেবন করে। বিশেষ ধরনের কোনো খাবার খেতে নিষেধ করা হলে তা সে খায় না, যদিও তার মন তা খেতে চায়। এ সব শুধু নিরাময় ও রোগমুক্তির আশায় এবং সে ত্বাকদীরের দোহাই দিয়ে ঔষধ সেবন থেকে বিরত থাকে না বা নিষিদ্ধ খাদ্য ভক্ষণ করে না।
তাহলে মানুষ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশাবলী বর্জন এবং নিষেধাবলী অমান্য করে তাকদীরের দোহাই দেবে কেন?
সপ্তম: যে ব্যক্তি তার ওপর অর্পিত ওয়াজিব কাজসমূহ ত্যাগ করে অথবা পাপকাজ করে তাকদীরের দোহাই দিয়ে থাকে অথচ তার ধন-সম্পদ বা মান সম্মানে কেউ যদি আঘাত হেনে বলে, এটাই তোমার তাক্বদীরে লেখা ছিল, আমাকে দোষারূপ করো না, তখন সে তার যুক্তি গ্রহণ করবে না। তাহলে কেমন করে সে তার ওপর অন্যের আক্রমনের সময় তাক্বদীরের দোহাই স্বীকার করে না। তা হলে কেন সে আল্লাহর অধিকারে আঘাত হেনে তক্বদীরের দোহাই দেবে?
উল্লেখ্য, একদা উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর দরবারে এক চোরকে হাজির করা হয়। তার হাত কর্তনের নির্দেশ দেওয়া হলে সে বলে! হে আমিরুল মু’মিনীন! থামুন, আল্লাহ তাক্বদীরে লিখে রেখেছেন বলে আমি চুরি করেছি। উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমরাও আল্লাহ তাক্বদীরে লিখে রেখেছেন বলে হাত কর্তনের নির্দেশ দিয়েছি।
তাক্বদীরের ওপর ঈমানের বহুবিধ ফল রয়েছে তন্মধ্যে বিশেষ কয়েকটি হলো:
১। ঈমান বিল ক্বাদর দ্বারা উপায়-উপকরণ গ্রহণকালে ব্যক্তির অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার ওপর তাওয়াক্কুল ও ভরসার সৃষ্টি হয় এবং সে তখন শুধুমাত্র উপায়-উপকরণের ওপর নির্ভরশীল হয় না। কেননা, প্রতিটি বস্তুই আল্লাহ তা‘আলার তাক্বদীরের আওতাধীন।
২। ব্যক্তির কোনো উদ্দেশ্য সাধিত হলে সে তখন নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করে না। কারণ, যা অর্জিত হয়েছে তা সবই আল্লাহর নে‘আমত। যা তিনি কল্যাণ ও সাফল্যের উপকরণ দ্বারা নির্ধারণ করে রেখেছেন। আর ব্যক্তি নিজ কর্মের জন্য আত্মম্ভরি হলে এই নি‘আমতের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে ভুলে যায়।
৩। ঈমান বিল ক্বাদর দ্বারা বান্দার ওপর আল্লাহর তক্বদীর অনুযায়ী যা কার্যকরী হয় তাতে তার অন্তরে প্রশান্তি ও নিশ্চিন্ততা অর্জিত হয়। ফলে সে কোনো প্রিয় বস্তু হারালে বা কোনো প্রকার কষ্ট ও বিপদাপদে পতিত হলে বিচলিত হয় না। কারণ; সে জানে যে, সবকিছুই সেই আল্লাহর তক্বদীর অনুযায়ী ঘটছে যিনি আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর মালিক। যা ঘটবার তা ঘটবেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَآ أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٖ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَا فِيٓ أَنفُسِكُمۡ إِلَّا فِي كِتَٰبٖ مِّن قَبۡلِ أَن نَّبۡرَأَهَآۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٞ ٢٢ لِّكَيۡلَا تَأۡسَوۡاْ عَلَىٰ مَا فَاتَكُمۡ وَلَا تَفۡرَحُواْ بِمَآ ءَاتَىٰكُمۡۗ وَٱللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخۡتَالٖ فَخُورٍ ٢٣ ﴾ [الحديد: ٢٢، ٢٣]
“পৃথিবীতে এবং তোমাদের নিজেদের ওপর যে সব বিপদাপদ আসে জগৎ সৃষ্টির পূর্বেই তা একটি কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর পক্ষে অতি সহজ। এটা এজন্য, যাতে তোমরা যা হারিয়ে ফেলো তজ্জন্য দুঃখিত না হও এবং তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তজ্জন্য উল্লসিত না হয়ে উঠ। আল্লাহ কোনো উদ্ধত্ত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” [সূরা আল-হাদীদ, আয়াত: ২২-২৩]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘মু’মিনের ব্যাপারে আশ্চর্য্য হতে হয়, তার সব ব্যাপারেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে। একমাত্র মু’মিনের ব্যাপারেই তা হয়ে থাকে। আনন্দের কিছু হলে সে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে, তখন তা তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। আর যখন তার ওপর কোনো ক্ষতিকর বিষয় আপতিত হয় তখন সে ধৈর্য ধারণ করে, তখন তার জন্য তাও কল্যাণকর হয়ে উঠে।” (সহীহ মুসলিম)
তাক্বদীর সম্পর্কে দু’টি সম্প্রদায় পথভ্রষ্ট হয়েছে:
তন্মধ্যে একটি হলো জাবরিয়্যাহ সম্প্রদায়, এরা বলে, বান্দা তাক্বদীরের কারণে স্বীয় ক্রিয়া-কর্মে বাধ্য, এতে তার নিজস্ব কোনো ইচ্ছা শক্তি বা সামর্থ্য নেই।
আর দ্বিতীয়টি হলো ক্বাদারিয়্যাহ সম্প্রদায়, এদের বক্তব্য হলো বান্দা তার যাবতীয় কর্ম-কাণ্ডে স্বীয় ইচ্ছা ও শক্তির ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পন্ন, তার কাজে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা বা কুদরতের কোনো প্রভাব নেই।
শরী‘আত ও বাস্তবতার আলোকে প্রথম দল (জাবরিয়্যাহ সম্প্রদায়)-এর বক্তব্যের জবাব:
১. শরী‘আতের আলোকে এর জবাব: নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার জন্য ইরাদা ও ইচ্ছাশক্তি সাব্যস্ত করেছেন এবং বান্দার প্রতি তার কার্যক্রমের সম্বন্ধও আরোপ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مِنكُم مَّن يُرِيدُ ٱلدُّنۡيَا وَمِنكُم مَّن يُرِيدُ ٱلۡأٓخِرَةَۚ﴾ [ال عمران: ١٥٢]
“তোমাদের কারো কাম্য হয় দুনিয়া আবার কারো কাম্য হয় আখেরাত।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫২]
আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
﴿وَقُلِ ٱلۡحَقُّ مِن رَّبِّكُمۡۖ فَمَن شَآءَ فَلۡيُؤۡمِن وَمَن شَآءَ فَلۡيَكۡفُرۡۚ إِنَّآ أَعۡتَدۡنَا لِلظَّٰلِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمۡ سُرَادِقُهَاۚ﴾ [الكهف: ٢٩]
“বল, সত্য তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত। অতএব, যার ইচ্ছা বিশ্বাস স্থাপন করুক এবং যার ইচ্ছা কুফুরী করুক। আমি যালিমদের জন্য অগ্নি প্রস্তুত করে রেখেছি। যার বেষ্টনী তাদেরকে পরিবেষ্টিত করে রাখবে।” [সূরা আল-ক্বাহাফ, আয়াত: ২৯]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿مَّنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا فَلِنَفۡسِهِۦۖ وَمَنۡ أَسَآءَ فَعَلَيۡهَاۗ وَمَا رَبُّكَ بِظَلَّٰمٖ لِّلۡعَبِيدِ ٤٦﴾ [فصلت: ٤٦]
“যে সৎকর্ম করে সে নিজের জন্যই করে আর যে অসৎকর্ম করে, তা তারই ওপর বর্তাবে। আপনার পালনকর্তা বান্দাদের প্রতি মোটেই যুলুম করেন না। [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৪৬]
২. বাস্তবতার আলোকে এর জবাব: সকল মানুষেরই জানা আছে যে, তার কিছু কর্ম স্বীয় ইচ্ছাধীন, যা তার আপন ইচ্ছায় সম্পাদিত করে, যেমন, খাওয়া-দাওয়া, পান করা এবং ক্রয়-বিক্রয় করা। আর কিছু কাজ তার অনিচ্ছাধীন, যেমন, অসুস্থ্যতার কারণে শরীর কম্পন করা ও উঁচু স্থান থেকে নীচের দিকে পড়ে যাওয়া। প্রথম ধরণের কাজে মানুষ নিজেই কর্তা, নিজ ইচ্ছায় সে তা গ্রহণ করেছে এতে কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। আর দ্বিতীয় প্রকার কাজ-কর্মে তার কোনো নিজস্ব পছন্দ ছিল না এবং তার ওপর যা পতিত হয়েছে তার কোনো ইচ্ছাও তার ছিল না।
শরী‘আত ও যুক্তির আলোকে দ্বিতীয় দল ক্বাদারিয়্যাহদের বক্তব্যের জবাব:
শরী‘আত: আল্লাহ তা‘আলা সকল বস্তুর স্রষ্টা, জগতের সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছায় অস্তিত্ব লাভ করে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পবিত্র গ্রন্থে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, বান্দাদের সব কর্ম-কাণ্ডও আল্লাহর ইচ্ছায় বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ مَا ٱقۡتَتَلَ ٱلَّذِينَ مِنۢ بَعۡدِهِم مِّنۢ بَعۡدِ مَا جَآءَتۡهُمُ ٱلۡبَيِّنَٰتُ وَلَٰكِنِ ٱخۡتَلَفُواْ فَمِنۡهُم مَّنۡ ءَامَنَ وَمِنۡهُم مَّن كَفَرَۚ وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ مَا ٱقۡتَتَلُواْ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يَفۡعَلُ مَا يُرِيدُ﴾ [البقرة: ٢٥٣]
“আর আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি এসে যাবার পর তাঁদের পয়গম্বরদের পরবর্তীরা পরষ্পর লড়াই-বিগ্রহে লিপ্ত হতো না। কিন্তু তাদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়ে গেলো। অতঃপর তাদের কেউ তো ঈমান এনেছে, আর কেউ হয়েছে কাফের। আর আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন তাহলে তারা পরস্পর লড়াই করতো না। কিন্তু আল্লাহ তাই করেন, যা তিনি ইচ্ছা করেন।” [সূরা আল-বাকারা: আয়াত: ২৫৩]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿وَلَوۡ شِئۡنَا لَأٓتَيۡنَا كُلَّ نَفۡسٍ هُدَىٰهَا وَلَٰكِنۡ حَقَّ ٱلۡقَوۡلُ مِنِّي لَأَمۡلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ ٱلۡجِنَّةِ وَٱلنَّاسِ أَجۡمَعِينَ ١٣﴾ [السجدة: ١٣]
“আমি ইচ্ছা করলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৎপথে পরিচালিত করতাম। কিন্তু আমার এ উক্তি অবধারিত সত্য, আমি জিন্ন ও মানব উভয় দ্বারা অবশ্যই জাহান্নাম পূর্ণ করব।” [সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত: ১৩]
যুক্তির মাধ্যমে এর জবাব: একথা নিশ্চিত যে, সমগ্র বিশ্বজগৎ আল্লাহর মালিকানাধীন এবং মানুষ এই বিশ্বজগতেরই একটি অংশ, তাই সেও আল্লাহর মালিকানাধীন। আর মালিকানাধীন কোনো সত্তার পক্ষে মালিকের অনুমতি ও ইচ্ছা ব্যতিরেকে তার রাজত্বে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়।
ইসলামী আক্বীদার লক্ষ্যসমূহ
অর্থাৎ তার মহৎ উদ্দেশ্যাবলী যা এ আক্বীদাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ ও পালন করার ফলে অর্জিত হয়ে থাকে, সেগুলো অনেক ও বহুবিধ যেমন,
১। সর্বপ্রকার নিয়ত ও ইবাদত শুধু আল্লাহ তা‘লার জন্য একনিষ্ঠভাবে সম্পাদন করা। কেননা, তিনিই আমাদের একমাত্র স্রষ্টা, এতে তাঁর কোনো অংশীদার নেই। তাই ইবাদত একমাত্র তাঁরই জন্য হতে হবে।
২। আক্বীদার শূণ্যতার ফলে উদ্ভব নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা থেকে চিন্তাধারা ও বুদ্ধিমত্তাকে মুক্ত করা। কারণ, এই আক্বীদাবিহীন ব্যক্তি আক্বীদাশূন্য ও বস্তুপূজারী হয় অথবা কুসংস্কার ও নানাবিধ আক্বীদাগত ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত থাকে।
৩। মানুষিক ও চিন্তাগত প্রশান্তি অর্জন। এর ফলে ব্যক্তির মনে না কোনো প্রকারের উদ্বেগ ও বিষন্নতা থাকে, না চিন্তাধারায় থাকে কোনো অস্থিরতা। কারণ, এই আক্বীদা আল্লাহর সাথে মুমিনের সম্পর্ককে জোরদার ও সুদৃঢ় করে দেয়। ফলে, সে তার স্রষ্টা ও রবের তাক্বদীর বা সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকে। তার আত্মা লাভ করে প্রশান্তি। ইসলামের জন্য তার অন্তর হয় উন্মোচিত এবং জীবনধর্ম হিসেবে সে ইসলাম ছাড়া বিকল্প কোনো কিছুর দিকে তাকায় না।
৪। আল্লাহর ইবাদত বা মানুষের সাথে লেন-দেন ও আচার আচরণের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যে ও কর্মে পথবিচ্যুতি হতে নিরাপত্তা অর্জন। কেননা, এ আক্বীদার ভিত্তি হচ্ছে রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস ও তাঁদের অনুসরণের ওপর, যা উদ্দেশ্য ও কর্মগত দিক দিয়ে নিরাপদ ও বিশুদ্ধ।
৫। সব বিষয়ে সুচিন্তিত ও দৃঢ়তার সাথে পদক্ষেপ নিতে সাহায্য লাভ হয়। যাতে বান্দা সওয়াবের আশায় সৎ ও পুণ্য কাজের কোনো সুযোগ হাতছাড়া করে না এবং আখেরাতের কঠোর ও ভয়াবহ শাস্তির ভয়ে সব ধরণের পাপের স্থান থেকে নিজেকে দূরে রাখে। কারণ, ইসলামী আক্বীদার অন্যতম মৌলিক বিশ্বাস হচ্ছে পুনরুত্থান ও কাজের প্রতিফল লাভের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلِكُلّٖ دَرَجَٰتٞ مِّمَّا عَمِلُواْۚ وَمَا رَبُّكَ بِغَٰفِلٍ عَمَّا يَعۡمَلُونَ ١٣٢﴾ [الانعام: ١٣٢]
“প্রত্যেকের জন্য রয়েছে তাদের কর্মের আনুপাতিক মর্যাদা এবং আপনার রব তাদের কর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন।’’ [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৩২]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই লক্ষ্য সাধনের জন্য উৎসাহিত করে বলেন,
«الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلا تَعْجَزْ وَإِنْ أَصَابَكَ شَيْءٌ فَلا تَقُلْ لَوْ أَنِّي فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَان»
“শক্তিশালী মু’মিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মু’মিনের চেয়ে উত্তম ও অধিক প্রিয়। প্রত্যেকের মধ্যেই কল্যাণ নিহিত আছে। তোমার জন্য যা কল্যাণকর ও উপকারী তা করতে সচেষ্ট হও এবং আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর। অপারগ ও অক্ষম হয়ো না। বিপদগ্রস্ত হলে এ কথা বলবে না যে, আমি যদি এটা করতাম, ওটা করতাম, তাহলে এমনটা হতো। বরং বল, আল্লাহ তাক্বদীরে যা রেখেছেন তা হয়েছে, আল্লাহ যা চান, তাই করেন। কারণ, ‘‘যদি’’ শব্দটি শয়তানী কাজের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।” (সহীহ মুসলিম)
৬। এমন এক শক্তিশালী জাতি গঠন করা যে জাতি আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠিত করার, তার ভিত্তিসমূহ মজবুত ও তার পতাকা সমুন্নত করার লক্ষ্যে দুনিয়ার সব প্রতিকূল পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে জান ও মাল ব্যয় করবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمۡ يَرۡتَابُواْ وَجَٰهَدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّٰدِقُونَ ١٥﴾ [الحجرات: ١٥]
“তারাই মু’মিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে জীবন ও ধন-সম্পদ দ্বারা জেহাদ করে। তারাই সত্যবাদী।” [সূরা আল-হুজরাত, আয়াত: ১৫]
৭। ব্যক্তি ও দল সংশোধন করে ইহ ও পরকালের শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন করা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সওয়াব ও সম্মান লাভ করা। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَنُحۡيِيَنَّهُۥ حَيَوٰةٗ طَيِّبَةٗۖ وَلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٩٧﴾ [النحل: ٩٧]
“যে সৎ কর্ম করে সে ঈমানদার পুরুষ হোক কিংবা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরুষ্কার দেব, যা তারা করত।” [সূরা আন-নাহল আয়াত: ৯৭]
উপরোক্ত বিষয়গুলো হচ্ছে, ইসলামী আক্বীদার কতিপয় উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে এবং সকল মুসলমানকে এগুলো অর্জনের তাওফীক দান করেন।
আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাত ও সালাম আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবায়ে কেরামদের ওপর। আমীন।
সমাপ্ত
Danlodu
PDF
Oro
Nipa iwe na
Onkowe
:
Muhammad ibn Saleh al-Othaimeen
Olute
:
www.islamhouse.com
Ipin
:
Adiokan ati awon ijo
O wa ni
English
አማርኛ
فارسى
Français
हिन्दी
Indonesian
മലയാളം
Русский
සිංහල
தமிழ் மொழி
Тоҷикӣ
ไทย
Tagalog
ئۇيغۇر تىلى
اردو
Ўзбек
tiếng Việt
Кыргызча
اللغة العربية
فارسى
کوردی
اللغة العربية
English
Română
magyar
中文
Türkçe
中文
অসমীয়া
Nederlands
বাংলা ভাষা
தமிழ் மொழி
සිංහල
Српски
Bosanski
Ўзбек
Қазақ тілі
Hausa
Shqip
suomi
پښتو
mute
Update Required
To play the media you will need to either update your browser to a recent version or update your
Flash plugin
.
© Copyright
Islam land أرض الإسلام
. All Rights Reserved 2017